বাঘের শখ – দীপান্বিতা রায়
এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ। গায়ে তার ডোরা ডোরা দাগ। সোঁদরবনের বাঘ সে। ডোরা দাগ তা থাকবেই। তা সে বাঘ একদিন জঙ্গল থেকে বেরিয়ে হেলতে-দুলতে ঢুকে পড়েছে এক হাটের মধ্যে। সেদিন অবিশ্যি হাটবার নয়। হাট তাই শুনশান। বাঘ তো শুঁকে শুঁকে দেখছে পচা কপি পাতা, পোকায় খাওয়া বেগুন, ছিটিয়ে থাকা মাছের আঁশ আর ক্রমশই ভারি রিক্ত হয়ে উঠছে। হাঁস, মুরগি, ছাগলের গনূ আছে দিব্যি কিন্তু ঘুরে-টুরে বেড়াচ্ছে না একটিও। বেজার মুখে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাঘের চোখে পড়ল একটা বাঁশের মাচা। বেঘো বুদ্ধি তো। বাঘ অমনি লাফ দিয়ে উঠতে গেছে মাচায়। তক্ষুনি লেগেছে দারুণ এক চমক।
আসলে মাচাটা হল এক নাপিতের। প্রতি হাটবারে সে লোকের চুল-দাড়ি কাটে। তার খদ্দেররা বসে ওই মাচায়। চুল-টুল কাটা হয়ে গেলে, তারা যাতে নিজেদের মুখটি টুক করে দেখে নিতে পারে, তাই মাচার সামনের বাঁশে একটা আয়না ঝুলিয়ে রেখেছে নাপিত। দিনের শেষে ক্ষুর, কাঁচি, সাবান, ফটকিরি সব বাক্সে ঢুকিয়ে বাড়ি নিয়ে গেলেও আয়নাটা সে আর নিয়ে যায় না। মরচে-ধরা টিনে-বাঁধানো আয়নাটা একা-একাই সারাদিন ঝোলে বাঁশের গায়ে। লাফ দিয়ে মাচায় উঠতে গিয়ে তাতেই নিজের মুখ দেখে আঁতকে উঠেছে বাঘ। আরে, এই হোঁতকামতো, সারা মুখে বিশ্রী কালো কালো দাগ-কাটা জন্তুটা আবার কে?
প্রথমেই তো দাঁত খিঁচিয়ে, গোঁফ ফুলিয়ে অজানা জন্তুটাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করল বাঘ। কিন্তু জন্তুটা ভয়ও পেল না, পালিয়ে গেল না। বরং উলটে বাঘ দেখলে, সে ভেংচি কাটলেও ও ভেংচি কাটছে, কান নাচালে, কান নাচাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? বাঁশের খুঁটির চারপাশটা গোল গোল করে কয়েকবার ঘুরে, শেষপর্যন্ত বাঘ বুঝতে পারলে ওটা আসলে সে নিজেই। আর অমনি ভারি মন খারাপ হয়ে গেল তার। সে হল গিয়ে বনের রাজা আর তাকে কি না অমন বিচ্ছিরি দেখতে! তাদের জঙ্গলে তো হরিণ আছে, শুয়োর আছে, কই কারুর মুখে তো এমন কালো ডোরা নেই। জঙ্গলের আশপাশে এত মানুষ থাকে, কাউকে তো কখনো ডোরাকাটা দেখেনি সে। না:, ডোরা মুছে ফেলার নিশ্চয়ই কোনো উপায় আছে। সবাই সেটা জানে। এবার তাকেও জেনে নিতে হবে। কিন্তু কার কাছ থেকে জানা যায়? হরিণকে তো জিজ্ঞাসা করার কোনো উপায় নেই। তাকে দেখলেই হাওয়ার বেগে পালিয়ে যাবে। শুয়োরও কেমন যেন গোঁয়ারগোবিন্দ গোছের। তার থেকে মানুষই ভালো। বুদ্ধিশুদ্ধি পরিষ্কার। ব্যাপারটা গুছিয়ে বলতে পারবে। হাট থেকে না-নদীর ধার বরাবর রাস্তা দিয়ে কিছুদূর গেলে গ্রাম। বাঘ রওনা দিল সেদিকে।
শীতকাল। ধান উঠছে। সারাদিন ধরে ধান ঝাড়াঝাড়ি বাছাবাছির কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল পুঁটু। অন্য মুনিশরা কাজ সেরে বাড়ি চলে গেছে। পুঁটু মনিব-বাড়িতেই থাকে। তার মা রান্নার কাজ করেন। আর পুঁটু নিজে করে না এমন কাজ নেই। তা সারাদিন খাটাখাটনির পর খড়ের গাদার পাশে বসে পুঁটু একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। চোখ দুটোও লেগে এসেছে। এমন সময় কানের পাশে ঘেঁয়াক শব্দ শুনে আঁতকে উঠে দেখে, ঠিক নাকের ডগায় বসে আছে মস্ত এক বাঘ। পুঁটুর তো চুল খাড়া, হাত-পা ঢুকে গেছে পেটের মধ্যে, প্রাণ আইঢাই করছে। ভয়ে মূর্ছা যাবার জোগাড়।
বাঘটা কিন্তু মোটেই তার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল না। বরং আর একবার ঘেঁয়াক করে দাঁত খিঁচিয়ে গুমগুমে গলায় জিজ্ঞাসা করলে, ‘মুখের দাগগুলো গেল কী করে শুনি?’
পুঁটুর তখন ভয়ের চোটে দাঁতে-দাঁত লাগছে ঠকঠক করে। তবু কোনোওরকমে বললে, ‘কীসের দাগ?’
‘তোর মুখের কালো দাগগুলো গেল কী করে শুনি?’
একটু আগেই ধান সেদ্ধ-করা কড়াই তুলতে গিয়ে পুঁটুর মুখে ভুসো-কালির দাগ লেগেছিল। সে ভাবলে বাঘ নিশ্চয়ই সে-কথাই বলছে। তাই তাড়াতাড়ি বললে, ‘সাবান দিয়ে মুখ ধুতেই উঠে গেছে।’
‘তাহলে চল আমার মুখটাও সাবান দিয়ে ধুয়ে দিবি।’
শুনে তো পুঁটু অবাক, ‘সে কী, তুমি আবার সাবান দিয়ে মুখ ধোবে কী গো!’
‘কেন, আমার মুখে এই কালো কালো দাগগুলো কী খুব ভালো দেখাচ্ছে?’
‘ও তো তোমার ডুরে দাগ, ও তো সাবানে উঠবে না।’
‘আমার কথা না-শুনলে কিন্তু আমি ঘাড় মটকে দেব।’
পুঁটু আর কথা না বাড়িয়ে বাঘকে নিয়ে গেল পুকুরঘাটে। তারপর একটু করে সাবানজলে ভিজিয়ে সেই বাঘের মুখে ঘষতে শুরু করেছে, অমনি বাঘ চেঁচিয়ে উঠল, ‘উহুঁ, উহুঁ।’
‘আরে আরে, চোখ বুজে থাকো, চোখ বুজে থাকো। মুখে সাবান দিলে চোখ বুজে থাকতে হয়, তাও জানো না।’
বলে উঠল। চন্দন সাবানের গন্ধটা ভারি বিচ্ছিরি লাগলেও লক্ষ্মী ছেলের মতো চোখ বুজে বসে রইল বাঘ। পুঁটু পুকুর থেকে জল এনে তার মুখটা ভালো করে ধুয়ে দিল। মুখটুক ধুয়ে প্রথমটায় বেশ খুশি হয়েছিল বাঘ। কিন্তু পুকুরের টলটলে জলে, নিজের ছায়া দেখে আবার তার মেজাজ গরম হয়ে গেল। ‘দাগ তো ওঠেনি?’ ভয়ে ভয়ে দু-পাশে মাথা নাড়াল পুঁটু। ‘আজ রাতটা ভাবার সময় দিলাম। ভেবেচিন্তে আমার দাগ তোলার একটা উপায় বার কর। কাল সকালে আমি তোর জন্য হাটের ধারে অপেক্ষা করব। চালাকি করার চেষ্টা করিস না যেন।’ পুঁটুকে হুমকি দিয়ে শীতের মরে-আসা বেলায় হেলে-দুলে জঙ্গলেতে দিকে মিলিয়ে গেল বাঘ।
সারারাত ঘুম এল না পুঁটুর। বাঘের ডোরা কী মুছে ফেলা যায় নাকি? সে তো অসম্ভব কাজ। রাতভর এপাশ-ওপাশ করে, যখন সবে সকালের আলো ফুটিফুটি করছে, তখন তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সূর্য উঠে, কুয়াশার চাদর একটু পাতলা হতেই চা-মুড়ি খেয়ে পুঁটু গেল কুমোরদাদুর বাড়ি। গ্রামের অন্য প্রান্তে কুমোরদাদুর বাড়ি। সারাবছর গ্রামের মানুষের জন্য সরা, হাঁড়ি, খুরি গড়ে। তবে পুজো আসলেই শুরু হয়ে যায় ঠাকুর গড়া। বুড়ো, মাথার চুল সব সাদা, তবে এখনও বেশ শক্তপোক্ত।
পুঁটু গিয়ে সব কথা খুলে বললে। শুনে তো কুমারদাদুর মাথায় হাত। ‘সে আবার কীরে! বাঘের ডোরা, তা কী আর মোছা যায়?’
ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলে পুঁটু বললে, ‘তুমিই একমাত্র আমাকে বাঁচাতে পারো দাদু।’
‘কী করে, কী করে হবে?’ ব্যস্ত হয়ে বললেন কুমোরদাদু। পুঁটুকে তিনি ভারি ভালোবাসেন।
‘তোমার হলুদ রঙের বাটি আর তুলিটা নিয়ে চলো। বাঘের মুখের কালো ডোরাগুলোর ওপরে হলুদ রং লাগিয়ে দেবে। তাহলেই আর দেখা যাবে না।’
‘বারে পুঁটু, তোর তো খুব বুদ্ধি।’ খুশি হয়ে বললে কুমোরদাদু।
ঝোলাতে হলুদ রং, রং গোলার বাটি তুলি সব গুছিয়ে নিয়ে কুমোরদাদু আর পুঁটু চলল হাটের দিকে। সেদিন হাটবার নয়। শুনশান হাটের একপাশে গোঁফ দুলিয়ে বাঘ বসেছিল। বুক দুরদুর করলেও কুমোরদাদু খুব যত্ন করে বাঘের মুখের কালো ডোরাগুলো হলুদ রং দিয়ে ঢেকে দিল। নাপিতের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে ঘেঁয়াত করে গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে জঙ্গলের দিকে রওনা দিল বাঘ। পুঁটু আর কুমোরদাদুও নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরল।
কিন্তু বাঘের দাগ ঢাকতে কুমোরদাদু তো লাগিয়েছে গোলা রং। জল লাগলেই তো সে রং উঠে যাবে। কিন্তু বাঘের তো আর সে কথা জানা নেই। সে দিব্যি নদীতে মুখ ডুবিয়ে জল খাচ্ছে, সাঁতার কাটছে। তাই মুখের রং তো ধুয়ে গেছে পরদিনই। কিন্তু বাঘের তো সে কথা জানা নেই। সে দিব্যি ফুর্তিতেই আছে। তবে কয়েকদিন পর তার আবার ইচ্ছে হল নিজের সুন্দর চেহারাটা দেখার। তাই ভোর না-হতেই হাজির হল নাপিতের আয়নার সামনে। কিন্তু আয়নায় নিজের চেহারা দেখে বাঘের তো চক্ষু চড়কগাছ। গোটা মুখ জুড়ে ঠিক আগের মতোই কালো কালো ডোরা।
পরদিন দুপুরবেলা পুঁটু যখন পুকুরে চান করতে গেছে, তখন তাকে খপ করে ধরে ফেলল বাঘ। তারপর এই মারে তো সেই মারে। তাকে ঠকানো। এত বড়ো সাহস? পুঁটু বেচারি অনেক কষ্টে হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে তো তখনকার মতো নিস্তার পেল। কিন্তু বাঘ সেদিন আর নড়ল না। বললে, এখুনি বসে পুঁটুকে বুদ্ধি বাতলাতে হবে কী করে ডোরা মোছা যায়, কী করে বাঘকে আরও সুন্দর করা যায়!
বেচারা পুঁটু গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসল। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই করছে, শীতকাল। ফটফট করছে, নাকের ডগায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে উত্তুরে হাওয়া, কিন্তু রেহাই নেই। অনেক ভেবে পুঁটু বললে, ‘উপায় একটা আছে। কিন্তু তাতে মেলা খরচ।’
‘কী রকম?’ জানতে চাইল বাঘ।
‘নদি পেরিয়ে ওপারে গেলে যে গঞ্জ আছে, সেখানে একটা দোকান আছে। সেখানে গেলেই নাকি সবাই সুন্দর হয়ে যায়। কালো-বোঁচা মেয়েদেরও নাকি ফরসা, হুরি-পরিদের মতো দেখতে হয়ে যায়।’
‘তাই নাকি!’ বাঘ তো রীতিমতো উৎসাহিত।
‘না, মানে,’ একটু ঢোঁক গিলে পুঁটু বলে, ‘আমার মুনিব, বাড়িতে তো অনেক মেয়েরা কাজ করে থাকে। তারা না-খেয়ে-খেয়ে টিফিনের টাকা জমিয়ে চোখের নীচের, গালের পাশের কালো দাগ তুলতে যায়। দাগ ওঠে কিনা তা অবশ্য আমি তেমন ঠাহর করে দেখনি কোনোদিন। তবে তুমি যেতে পারো। টাকা লাগবে কিন্তু।’
সেদিন রাতে গ্রাম জুড়ে হৈচৈ। সুদখোর মহাজন বিষ্টু বুড়োর বাড়িতে বাঘ পড়েছে। বুড়ো তখন বসে বসে টাকা গুনছিল। বাঘের ডাক শুনে ছুটে গিয়ে গোয়ালের মধ্যে লুকোয়। বাঘ অবশ্য সেখানে তাকে খুঁজতে যায়নি। তবে টাকা-পয়সা আর বন্ধকী গয়নাগাঁটি, ভর্তি বাক্সটি নিয়ে বসে গেছে। বাঘের এমন বেঘোমি নিয়ে সবাই যখন আলোচনায় ব্যস্ত, সেই সুযোগে পুঁটু চুপিচুপি ক্যাশব্যাক্সটা লুকিয়ে রাখল পুকুরধারে একটা ঝোপের ভিতর।
কিন্তু তাতেই কী আর সমস্যা মেটে। গঞ্জে যেতে হলে নদী পেরিয়ে, ভ্যান-রিকশাতে চেপে যেতে হবে বেশ খানিকটা পথ। এতখানি রাস্তা বাঘ যাবে কী করে, শেষপর্যন্ত ভেবে-চিন্তে একটা চটের বস্তায় বাঘকে ঢোকাল পুঁটু। বস্তার মুখটা ভালো করে নিজের গামছা দিয়ে বাঁধল। তারপর অতিকষ্টে সেটাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে উঠল নৌকোয়। বস্তার গায়ে ছোটো ছোটো কয়েকটা ফুটো ছিল। তাই বাঘের নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়নি। তবে সে ছিলও খুব লক্ষ্মী ছেলে হয়ে। এবড়ো -খেবড়ো রাস্তায় ভ্যান-রিকশার দারুণ ঝাঁকুনি, তবু মুখ দিয়ে এতটুকু ঘেঁয়াও আওয়াজ বার করেনি।
গঞ্জের সাজগোছের দোকানটায় পুটু যখন পৌঁছোল তখন বেলা দুপুর। দোকান ফাঁকা, মালকিন নখে নেলপালিশ লাগাতে লাগাতে মন দিয়ে রেডিয়ো শুনছিল। পুঁটুকে বস্তা নিয়ে ঢুকতে দেখে ভারি বিরক্ত হয়ে কড়া গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার, কী চাই?’ বস্তা নামিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে পুঁটু বললে, ‘না, মানে, কালো দাগ তুলতে হবে তাই…।’
‘কালো দাগ তুলতে হবে? কার? তোমার?’
‘না না…এর।’ হলেই পুঁটু বস্তার মুখটা দিল খুলে। আর বস্তা থেকে ঘেঁয়াক করে বাঘকে বেরিয়ে আসতে দেখে তক্ষুনি মুচ্ছো গেল দোকানের মালকিন।
জলটল ঢেলে তার জ্ঞান ফেরাতে বেশ কিছুটা সময় গেল। তারপরেও অবশ্য হাত-পায়ের কাঁপুনি থামছিল না। কিন্তু পুঁটু তাকে বুঝিয়ে বললে যে বাঘ এমনিতে ভারি ভালোমানুষ। সে শুধু মুখের দাগ গুলো উঠিয়ে সুন্দর হতে চায়। তার জন্য অনেক টাকাও দেবে।
টাকার কথা শুনে মনে জোর পেল মালকিন। উঠে বসে বাঘকে মন দিয়ে দেখে বললে, ‘উহুঁ। খুব কঠিন ব্যাপার।’
‘দাগ তোলা যাবে না?’ উদবিগ্ন হয়ে জানতে চাইল পুঁটু।
‘যাবে। কিন্তু তারপরেও কিন্তু সুন্দর দেখতে হবে না।’
‘কেন, কেন?’ জানতে চাইল বাঘ।
‘তোমার তো রীতিমতো হোঁৎকা চেহারা। সুন্দর দেখতে হতে হলে রোগা হতে হবে। কাঠি কাঠি রোগা। না-হলে কেউ সুন্দর বলবে না।’
‘কী করে রোগা হব?’
‘খাবে না। উপোস করবে। মাঝে মাঝে এই ফল-টল মানে শশা-টসা খাবে।’
‘শশা!’ বাঘের মুখ দেখে মনে হল তার নাকের ওপর বুঝি মৌমাছি হুল ফুটিয়েছে। মালকিন কিন্তু আবার বলল, ‘হ্যাঁ, শসা। খিদে পেল আর অমনি একটা নধর শুয়োর খেয়ে নিলে…ওসব চলবে না। একমাস সময় দিলাম। রোগা হয়ে এসো। তারপর তোমার দাগ-টাগ তুলে এমন চেহারা বানিয়ে দেব যে জঙ্গলসুদ্ধ জন্তু-জানোয়ার ধন্য ধন্য করবে। আর মানুষরা তো তোমাকে দেখলেই টিভি সিরিয়ালের জন্য ডেকে নেবে।’
খুশিমনে জঙ্গলে ফিরে এল বাঘ। তারপর একমাস ধরে চলল কৃচ্ছসাধন । নাকের ডগায় হরিণ-শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবু সে ফিরে তাকায় না। কিন্তু গাছে চড়ে ফলটল পাড়া তো আর অভ্যাস নেই। তাই বাঁদরদের সঙ্গে ভাব করতে হয়েছে। পুঁটু নিজেও মাঝে মাঝে জামরুল-সবেদা-পেঁপে এসব দিয়ে আসে। এইভাবে একমাস পেরোলে বেশ হাড়-জিরজিরে রোগা হয়ে ফের পুঁটুর সঙ্গে সাজগোজের দোকানে হাজির হল বাঘ। এবার অবশ্য তাকে বইতে পুঁটুর আর তত কষ্ট হয়নি।
বাঘকে দেখে রীতিমতো খুশি হয়ে দোকানের মালিকিন বললেন, ‘বা:, এই তো দিব্যি হয়েছে। এবার বসে পড়ো চেয়ারে।’ বাঘ অমনি লাফ দিয়ে চেয়ারে চড়ে বসল। তার দু-চোখের ওপর দু-টুকরো টম্যাটো চাপা দিয়ে শুরু হল কেরামতি। সেসব চলল বেশ কয়েক ঘণ্টা। তারপর চোখ থেকে টম্যাটো সরিয়ে মালকিন তার সামনে আয়না ধরল। আঁতকে উঠল বাঘ। এটা আবার কে? কালো দাগ নেই বটে, কিন্তু গোটা মুখটাই কেমন যেন পাটকিলে রঙের। গোঁফগুলো ছোটো করে ছাঁটা। চোখের ওপর আবার কীসব চকচক করছে। থাবাগুলোতে একটুও কাদা-ময়লা লেগে নেই। এমনকী নখগুলো পর্যন্ত গোল গোল, ভোঁতা ভোঁতা। একটুও পছন্দ হল না বাঘের। কিন্তু কিছু করার নেই। সবাই এমন ‘আহা-আহা’ করছে যে বাঘও শেষপর্যন্ত বেজার মুখে কাষ্ঠ হাসি হেসে থলিতে গিয়ে ঢুকল। টাকাপয়সা মিটিয়ে দিল পুঁটু মালকিন বললেন, ‘প্রত্যেক মাসে একবার করে আসতে হবে। তাহলেই বাঘকে সবসময় এরকম সুন্দর দেখাবে।’
এক সপ্তাহ হয়ে গেল সাজগোজ সেরে জঙ্গলে ফিরে এসেছে বাঘ। কিন্তু তার মেজাজ একেবারে তিরিক্ষি হয়ে আছে। জঙ্গলের কেউ তাকে দেখে সুন্দর বলেনি! হরিণরা আঁতকে উঠেছে, শুয়োররা মুখ বাঁকিয়েছে আর বাঁদররা তো রীতিমতো ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হেসেছে। এদিকে খাওয়া-দাওয়ারও খুব অসুবিধা। বড়ো জন্তু ধরার মতো শক্তি নেই শরীরে। নখগুলি সব ভোঁতা। তাই ছোটো জন্তুও পালাচ্ছে থাবা ফসকে। কলা-পেঁপে খেতে খেতে বাঘের এবার কান্না পাচ্ছে।
এমনি করেই কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। দুপুরবেলা। রোদ এখন বেশ চড়া। গাছতলায় বসে বসে ঝিমোচ্ছিল বাঘ। হঠাৎ চোখ মেলে দেখে, একেবারে তার নাকের ডগায় বসে একমনে কাঠবাদাম খাচ্ছে একটা মোটাসোটা খরগোশ। খানিকটা অভ্যাসেই থাবা চালিয়ে দিলে বাঘ। ওমা, মরে গেল খরগোশটা। চমকে উঠে বাঘ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে নিজের থাবা। দশ দিনে নখ আবার অনেকটা বড়ো আর ছুঁচলো হয়ে গেছে। অনেকদিন পর খরগোশের মাংস খেয়ে সেদিন নিশ্চিন্তে ঘুমোল বাঘ।
ঠিক ছিল একমাস পরে পুঁটুর সঙ্গে বাঘ আবার যাবে গঞ্জের দোকানে। সেই মতো মাস ফুরোলে পুঁটু এসে অপেক্ষা করছে হাটের ধারে। একটু পরেই জঙ্গল থেকে হেলেদুলে বেরিয়ে এল বাঘ। তাকে দেখেই আঁতকে উঠলে পুঁটু, ‘এ কী! তুমি তো আবার সেই হোঁৎকা হয়ে গেছ।’
‘হ্যাঁ হয়েছি তো। বেশ হয়েছি। ঠিক হয়েছি। মোটেই আমি আর সুন্দর হতে চাই না। সুন্দর হতে গিয়ে মরি আর কী!’ রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললে বাঘ। পুঁটু তো ভয়ে-ময়ে চুপ। ‘তা ছাড়া ওরকম হাড়-পাঁজরা বের করা চেহারায় আমাকে একটুও সুন্দর দেখাচ্ছিল না। আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। এখন মুখের এই পাটকিলে রংটা কোনোরকমে উঠলে বাঁচি।’ বাঘের মনের কথাটি এতক্ষণে ঠিকঠাক বুঝল পুঁটু। ভারি আনন্দ হল তার। পিঠে হাত বুলিয়ে বললে, ‘ঠিক বলেছ। তোমার তাগড়াই চেহারায় হলুদের ওপর কালো ডোরা কী সুন্দর দেখায়! চিন্তা কোরো না। নোনা জলে মুখ ধুলে ওই পাটকিলে রংও ক-দিন বাদেই উঠে যাবে। তবে তুমি কিন্তু ভারি বুদ্ধিমান। একবার গিয়েই সার কথাটি বুঝেছ। মানুষরা তো দেখি বারে বারে যায় আর রাশি রাশি টাকা দিয়ে বোকা বনে।’ পুঁটু মুখে নিজের প্রশংসা শুনে ঘেঁয়াও করে হাসলে বাঘ। তারপর গলা নামিয়ে বললে, ‘ক্যাশবাক্সের বাকি টাকাগুলো তুমিই নিয়ে নিও। ভালোমতো খেয়েদেয়ে চেহারাটা তাগড়াই বানাও। খবরদার গঞ্জের দিকে যেন পা বাড়িও না। খরখরে জিভ দিয়ে পুঁটুর হাতটা একটু চেটে দিয়ে দুলকি চালে জঙ্গলের দিকে এগোতে এগোতে বাঘ ভাবলে, ‘না:, জব্বর খিদে পেয়েছে। আজ একটা নধর শুয়োর না-মারলেই নয়।’