বাঘের বাড়ি – রতনতনু ঘাটী
অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর-পরই তপোসুন্দরদাদু মেদিনীপুর থেকে আমাদের বাড়ি আসতেন। হিসেব করে আসতেন, না-এমনি, জানি না। তবে আমাদের অ্যানুয়াল পরীক্ষার ছুটির সঙ্গে তপোসুন্দরদাদুর আমাদের বাড়িতে আসাটা মিলে যেত। বড়োদের কাছ থেকে তখন পড়াশোনার তাড়া নেই। শুধু ছুটি আর ছুটি। সকালে ক্যারাম, বিকেলে ফুটবল, সন্ধেবেলা সাপলুডো। উনি এলে ওই সব খেলারও ছুটি হয়ে যেত। তখন শুরু হত সকাল-বিকেল আমাদের গল্প শোনার আসর।
ওঁর ছিল সব রাজারাজড়াদের নিয়ে গল্প। মহিষাদলের রাজার গল্প, তমলুকের রাজার গল্প, ময়নার রাজার গল্প। সেবার এসে বললেন, ‘এবার তোদের বলব বিক্রমগড়ের রাজার গল্প।’
বিক্রমগড় নামটা একদম শোনা-শোনা লাগল না। অর্ক বলল, ‘বিক্রমগড় কি মেদিনীপুরে?’
তপোসুন্দরদাদু ভুরু দুটো নাচিয়ে বললেন, ‘বিক্রমগড় কোথায়, সে জেনে অত কাজ কী? রাজার গল্প হলেই তো হল?’
কথাটা খুব ঠিক। আমরা তো রাজার গল্পের পোকা। আমি বললাম, ‘দেশটা কোথায় তোর জেনে কাজ কী? তুই কি সেখানে যাবি?’
অর্ক ঘাড় নেড়ে বলল, সে যাবে না। তপোসুন্দরদাদু আবার ভুরু দুটো একবার নাচিয়ে নিলেন। উনি যখন গল্প শুরু করেন ভুরুজোড়াটা নাচিয়ে নেন।
তপোসুন্দরদাদু বললেন, ‘বিক্রমগড় কিন্তু ধারে-কাছে না, বেশ দূর। অর্ক যেতে চাইলে পারবে না। মেদিনীপুর থেকে যদি ও বিক্রমগড় যেতে চায়, প্রথমে পড়বে একটা নদী, নাম ‘আকুলপারা’। সেই নদী পেরোলে পড়বে একটা ছোটো পাহাড়। তোরা অবশ্য তাকে পাহাড় নাও বলতে পারিস। তোরা তো টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে কথায় কথায় এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, কেটু পাহাড় দেখিস। তোদের ওটাকে টিলা মনে হতেই পারে। পাহাড়টার নাম ‘অতিক্রমী’।’
পাহাড়ের নামটা পছন্দ হল না টোটার। ও আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি চোখের ইশারায় চুপ করে থাকতে বললাম।
তপোসুন্দরদাদু বলে চললেন, ‘পাহাড়ের গায়ে একটা ঝরনা পড়বে। সেটা পেরোলে একটা খুব বড়ো বন। মহাভারতে ‘খান্ডব বন’-এর কথা শুনেছিস তো? সেরকম একটা বড়ো বন, নাম ‘গড়কান্তার’।’
খান্ডব বনের কথা শুনে মিমি চট করে ঘাড় নেড়ে দিল, সে জানে। অন্য সময় হলে তপোসুন্দরদাদু যাচাই করে নিতেন মিমি জানে কি না। আজ আর সে পথে গেলেন না। ক্লাস টুয়ে-পড়া মিমির অজ্ঞতাও আর চাউর হয়ে গেল না বটে, তবে আমরা নিশ্চিত, মিমি খান্ডব বন কী, জানে না।
তপোসুন্দরদাদুর গল্প শুনছি, ‘তা সেই গড়কান্তার পেরোলেই বিক্রমগড়। সেখানকার রাজারা ছিলেন তিন ভাই, বড়ো মৃগয়াকুমার, মেজো মল্লকুমার, আর ছোটো ভাই সন্তরণকুমার। নাম শুনে বুঝতে পারছিস, বড়ো রাজা শিকার করতেন, মেজো রাজা কুস্তি লড়তেন আর ছোটো রাজা ছিলেন সাঁতারু। বেশ কয়েক বছর হল ভারত স্বাধীন হয়েছে। ভারতবাসীর মনে তখন আনন্দ ধরে না। রাজা মৃগয়াকুমার ঠিক করলেন, ব্রিটিশরা পালিয়েছে, সেও তো কতদিন হল। এবার একবার জমিয়ে বাঘ শিকারে যাবেন। বাঘ শিকার নিয়ে রাজা মৃগয়াকুমারের খুবই কৌতূহল। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে তিনি দু-বার নৈনিতালে গিয়ে দেখা করেও এসেছেন জিম করবেট সাহেবের সঙ্গে। অবশ্য এখনকার মতো তখন তো বাঘ শিকার বন্ধ করার জন্যে আইন হয়নি।
‘দলবল, খাবারদাবার, মশাল জ্বালাবার সরঞ্জাম আর গুলি-বন্দুক নিয়ে রাজা মৃগয়াকুমার চললেন শিকারে। এই একটা নদী পেরোন তো এই একটা ছোটো টিলা পেরোন। এই একটা টিলা পেরোন তো এই একটা বন পেরোন। শেষে একটা ঘন বনের ভিতরে বড়ো দুটো গাছের মাথায় মাচা বাঁধা হল। একটা মাচায় বসলেন রাজা মৃগয়াকুমার এবং তাঁর শিকারের প্রধান সহকারী দিগম্বর গায়েন। অন্য মাচাটিতে রইল রাজার শিকারের দলের লোকেরা। একদিন গেল, দু-দিন গেল। বাঘের আর দেখা নেই। তখন বনের আরও গভীরে ফের মাচা বাঁধার আদেশ দিলেন রাজামশাই। লোকলশকর চলল গভীর বনে। একটা বড়োগাছ বাছা হল। তার উপর একটা মাচা বেঁধে দিল রাজার লোকজন। প্রথমে রাজা মৃগয়াকুমার উঠলেন মাচায়। তিনি ওঠার পর তাঁর পিছন-পিছন দুটো বন্দুক নিয়ে হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে মাচায় উঠল দিগম্বর।
‘তারপর রাজা আদেশ দিলেন আর সবাইকে, তারা যেন চলে যায় তাদের পুরোনো মাচায়। সবাই ফিরে গেল রাজার আদেশমতো। রাজামশাই বলে দিলেন, শূন্যে গুলি ছোড়ার শব্দ শুনলেই তারা যেন রাজামশাইয়ের মাচার কাছে চলে আসে। দেখতে-দেখতে সন্ধে নামল বনের মাথায়। প্রায় পূর্ণিমার মতো একটা গোল চাঁদও উঠল জ্যোৎস্না ছড়িয়ে।
‘রাজা মৃগয়াকুমার দিগম্বরকে বললেন, ‘চোখ খোলা রাখো দিগম্বর। তুমি চোখ রাখো পিছনের দিকে, আমি চোখ রাখি সামনের দিকে।’
‘পলকহীন চোখে দুজন সারারাত জাগলেন। দূরের মাচায় রাজার লোকজন বন্দুকের আওয়াজ শোনার জন্য কান খাড়া করে সারারাত জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালবেলার আলোয় আড়মোড়া ভেঙে রাজা বললেন, ‘দিগম্বর, এ যাত্রায় বাঘের তো দেখাই মিলল না। এবার মনে হয় খালি হাতেই ফিরতে হবে।’
‘দিগম্বর গলা সরিয়ে বলল, ‘না মহারাজ, আর একটা-দুটো দিন তো দেখি। বাঘ ঠিক আসবেই।’
‘দিগম্বরের কথামতো তৃতীয় রাতে রাজা মৃগয়াকুমারকে দূরে ঘন ঝোপের পাশে চাঁদের আলোয় একটা বাঘকে দেখতে পেলেন। বাঘটা থাবা মেলে বসে আছে ঝোপের দিকে মুখ করে। মাঝে-মাঝে মুখ নীচু করে কিছু চাটছে যেন। রাজা আঙুল তুলে দেখালেন দিগম্বরকে। দিগম্বরও দেখল, হ্যাঁ, রাজামশাইয়ের কথাই ঠিক। রাজা বন্দুকটা তাক করতে-করতে ফিসফিস করে বললেন, ‘দিগম্বর, আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
‘বলার সঙ্গে-সঙ্গে গর্জে উঠল রাজা মৃগয়াকুমারের বন্দুক। চাঁদের আলোয় তাঁরা দুজন মাচার উপর থেকে স্পষ্ট দেখলেন, বাঘটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তখন রাজা মৃগয়াকুমার গলা উঁচু করে বললেন, ‘দিগম্বর, শূন্যে গুলি ছুড়ে ওদের আসতে বলো।’
‘দিগম্বর শূন্যে গুলি ছুড়ল। প্রথম গুলির শব্দটা দূর থেকে ওরা আগেই শুনেছিল। এবার শূন্যে ছোড়া গুলির শব্দ শুনে মশাল জ্বালিয়ে রাজা মৃগয়াকুমারের দলবল মাচার নীচে এসে হাজির হল। মৃগয়াকুমার বললেন, ‘দিগম্বর, আগে তুমি নামো মাচা থেকে। তারপর আমি নামব।’
‘দিগম্বর সরসর করে নীচে নেমে এল। তারপর ধীরে-ধীরে রাজামশাই মাচা থেকে নীচে নামলেন। সবাই দেখল, মশালের আলোয় রাজামশাইয়ের মুখটা বীরত্বে চকচক করছে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে মশালধারীদের পিছনে চললেন রাজা। তাঁর পিছনে দিগম্বর। তার পিছনে আর সব লোকজন।
‘বাঘটার কাছে গিয়ে দিগম্বর হেসে বলল, ‘রাজামশাইয়ের নিশানা কখনো ভুল হয়?’ আর সকলে চোখ বড়ো-বড়ো করে নিহত বাঘটাকে দেখতে লাগল। এ আর ক-জনের ভাগ্যে জোটে? সারাজীবন কত নাতিপুতি আর মানুষজনকে যে এই গল্প শোনাতে পারবে তারা!
‘তখনও রাজার মুখ থেকে একটাও কথা সরছে না। সকলেই অবাক। এমন সময় খুব ধীরে রাজা মৃগয়াকুমার কান্না-ভেজা গলায় বললেন, ‘এ আমি কী করলাম?’
‘কেউ রাজামশাইয়ের এ কথার মানে বুঝতে পারল না। এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। দিগম্বর বলল, ‘কেন হুজুর, এ কথা বলছেন কেন?’
‘রাজা মৃগয়াকুমার ঝোপের পাশে আঙুল তুলে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই দেখো। ওকে আমি মা-হারা করে দিলাম!’
‘সকলে তাকিয়ে দেখল, বাঘটার একটা ছোট্ট বাচ্চা থরথর করে কাঁপছে ভয়ে। মশালের আলোয় জ্বলছে তারও চোখ দুটো। রাজা মৃগয়াকুমার এগিয়ে গেলেন বাঘের বাচ্চাটার কাছে। কোলে তুলে নিলেন। সকলে দেখল, রাজামশাইয়ের চোখে টলমল করছে জল।’
অর্ক বলল, ‘রাজা মৃগয়াকুমার বাঘের বাচ্চাটাকে নিয়ে কী করলেন?’
তপোসুন্দরদাদু ভুরু জোড়া নাচিয়ে বললেন, ‘বাঘের বাচ্চাটাকে নিয়ে মৃগয়াকুমার ফিরতে লাগলেন বিক্রমগড়ে। শিকার করা বাঘটা রইল পড়ে। দিগম্বর একবার বাঘটার দিকে আঙুল তুলে জানতে চাইছিল। রাজামশাই নীরবে শুধু ঘাড় নেড়ে না বলে দিলেন। ফেরার পথে একটা নদীর জলে রাজামশাই বন্দুক দুটো ফেলে দিয়ে দিগম্বরকে বললেন, ‘এই আমার শিকার করা শেষ!’ কেউ তাঁর কথায় কোনো প্রশ্ন করার সাহস পেল না। এমনকী, দিগম্বরও না। বিক্রমগড়ের রাজপ্রাসাদে বড়ো হতে লাগল বাঘের বাচ্চাটা।’
মিমি তপোসুন্দরদাদুর কথার মাঝখানে প্রশ্ন করে বসল, ‘এখনও বাঘের বাচ্চাটা রাজবাড়িতে আছে?’
তপোসুন্দরদাদু বললেন, ‘গল্প এখানেই শেষ নয় গো মিমিদিদি। বাঘের বাচ্চাটা তো চিরদিন ছোট্টটি থাকল না। ধীরে-ধীরে সে বড়ো হতে লাগল। ইতিমধ্যে ভারত সরকারের কাছে রাজা মৃগয়াকুমার একদিন চিঠি লিখলেন, এমন আইন চালু করা হোক, যাতে ভারতে কেউ যেন বাঘ না শিকার করতে পারে। ভারত সরকারও এ নিয়ে ভাবছিলেন। বাঘ শিকার করা বন্ধের জন্যে চালু হয়ে গেল আইন।
এদিকে রাজামশাইয়ের পোষা বাঘটা ঘুরে বেড়ায় গোটা রাজপ্রাসাদময়। রাজদরবারে যেতেও তার বাধা নেই, রাজঅন্তঃপুরেও যেতে তার বাধা নেই। মেজো রাজামশাই মল্লকুমার সুযোগ পেলেই বাঘটার মুখোমুখি হয়ে কুস্তির নকল প্যাঁচ দেখান। মুখোমুখি হলেই ছোটো রাজা সন্তরণকুমার বাঘটার সামনে নকল ফ্রি-স্টাইল, আর ব্যাকস্ট্রোক দেখিয়ে কেটে পড়েন।
‘কিন্তু ঝামেলা হল ছোটো রানিমা আর দাসদাসীদের নিয়ে। বাঘের বাচ্চাটা যত বড়ো হয়, ততই তাদের ভয়ও বাড়তে থাকে। এই দেখে রাজা মৃগয়াকুমার একদিন মন খারাপ করে বসেছিলেন রাজপ্রাসাদে। এই বাঘের বাচ্চাটা তো মা-হারা হয়েছিল তাঁরই বন্দুকের গুলিতে। তাকে তিনি রাজপ্রাসাদে এনে বড়ো করলেন। এখন যদি রাজবাড়ির লোকজন বাঘটাকে ভয় পায়, তাহলে কী করা যাবে? শেষে তিনি মনস্থির করলেন, বাঘটাকে বনেই ছেড়ে দিয়ে আসবেন।’
‘ফের জড়ো করা হল লোকলশকর। মোতায়েন করা হল বড়ো গাড়ি। বাঘটাকে পেট ভরে খাইয়েদাইয়ে গাড়ির সঙ্গে রাজা মৃগয়াকুমারও চললেন বনে। বড়ো রানিমা ঠাকুরের ফুল বাঘটার মাথায় ছুঁইয়ে মঙ্গল কামনা করলেন। মেজো রানিমা রাজদেবতার কাছে গিয়ে প্রার্থনা করে এলেন, বাঘটা বনে যেন ভালো থাকে। যে ছোটো রানিমা বাঘটাকে অত ভয় পেতেন, তাঁরও চোখ দুটো ছলছল করে উঠল বাঘটাকে নিয়ে যাওয়ার সময়।
‘কিন্তু বনে গিয়ে হল এক বিপত্তি। বাঘটা গাড়ি থকে কিছুতেই বনে যেতে চাইল না। সে শুধু রাজা মৃগয়াকুমারের পায়ের কাছে মুখ ঘষতে লাগল। রাজামশাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যাও বাবা, বনই তো তোমার বাড়ি। এখানেই তুমি ভালো থাকবে।’
‘বাঘটা কিছুতেই বনে গেল না। সে শুধু রাজামশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। শেষে রাজা মৃগয়াকুমার বাঘটাকে নিয়ে ফিরে এলেন বিক্রমগড়ের রাজপ্রাসাদে। এসেই তিনি তাঁর রাজপ্রসাদের পাশে বেশ কয়েক বিঘে গাছপালা ঘেরা জায়গা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেললেন। তার মধ্যে জলাশয়ও তৈরি করালেন। বনের মধ্যে তৈরি করালেন গুহার মতো দেখতে একটা ছোটো ঘর। তারপর একদিন বাঘটাকে নিয়ে বেড়াতে গেলেন সেই বনে। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরার পর রাজামশাই তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্যে এই বনটা আমি বানিয়েছি। এটা তোমার নিজের বাড়ি। এখানে তুমি থাকবে। কেউ তোমাকে মারতে পারবে না এখানে! আমি রোজ এসে তোমাকে দেখে যাব।’ বাঘটা কী বুঝল কে জানে, আর রাজপ্রাসাদে আসার জন্যে বায়না করল না। থেকে গেল সেখানে। রাজা মৃগয়াকুমার প্রাসাদে ফিরে এসে সাইনবোর্ড লেখার লোককে ডেকে পাঠালেন।’
আমি বললাম, ‘বুঝতে পেরেছি। ওই বনটার একটা নাম দিয়ে বোর্ডে লিখে টাঙিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন তো রাজামশাই?’
তপোসুন্দরবাবু হেসে বললেন, ‘ঠিক ধরেছিস। রাজামশাই বনটার নাম দিলেন ‘বাঘের বাড়ি’। রাজা মৃগয়াকুমারের এই কনসেপ্ট থেকেই তো গোটা পৃথিবী জুড়ে এত ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি বা অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে।’