বাঘের নখ, সাপের চোখ

বাঘের নখ, সাপের চোখ

২২ এপ্রিল, ২০০৪। স্থান উত্তর কোরিয়ার রিয়ঙ্গচন জেলা। একটি মালগাড়ি এগোচ্ছিল নিজের গন্তব্য পোর্ট অব নাম্পোর দিকে। আর তখনই ঘটল এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে আশেপাশের এলাকার মাটি কেঁপে উঠল। রিখটার স্কেলে সেই কাঁপন ধরা দিল ৩.৬ মাত্রায়। নিহত হল ৫৪ জন মানুষ। একটা ছোট শহর ধ্বংস হয়ে গেল। আহত হল ২,০০০ জন নাগরিক।

উত্তর কোরিয়ার সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রেস রিলিজ করে জানানো হল যে, ওই মালগাড়িতে লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম ছিল। বিদ্যুৎ পরিবাহী একটি তারের সংস্পর্শে আসার ফলেই ঘটে গেছে এই ভয়ানক বিস্ফোরণ।

শুধু তা-ই নয়। সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ঘিরে ফেলা হল এলাকা। সাইটের আশেপাশে কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার লোককে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছিল না। এক সপ্তাহের মধ্যে সারা দেশে আগামী পাঁচ বছরের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হল মোবাইল পরিষেবা। দেশে কী ঘটেছে, তা যাতে বহির্বিশ্বে না ছড়ায় তাঁর জন্যই নেওয়া হল এহেন পদক্ষেপ।

সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। স্বাভাবিক নিয়মেই সকলে ভুলতে বসেছিল এই ঘটনাকে। কিন্তু ভোলেনি একটি দেশ। নর্থ কোরিয়ার পক্ষ থেকে দেওয়া সাফাই কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সেই দেশটি। দেশটির নাম ইসরায়েল। তারা বুঝে গিয়েছিল কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। আর তাই এত ঢাক ঢাক গুড় গুড়।

বিদেশের মাটি থেকে খবর আনা প্রতিটা দেশের কাছে দুঃসাধ্য ব্যাপার। বিশেষত এত রাখঢাকে রক্ষিত বিষয়কে। কিন্তু ইসরায়েলের কাছে আছে মোসাদ। আর মোসাদের কাছে দুঃসাধ্য বা অসাধ্য বলে কিছুই নেই।

তখন মোসাদের চিফ ছিলেন মির ডাগান। রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পিছপা হওয়ার বান্দা ছিলেন না উনি। উত্তর কোরিয়ার গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক। মির খোঁজ লাগাতে আরম্ভ করে দিলেন। খবর এল। একটি সিরিয়ান মিলিটারি প্লেন উত্তর কোরিয়ার মাটি স্পর্শ করেছে।

তা হঠাৎ সিরিয়ান মিলিটারি প্লেনের ল্যান্ডিংয়ের কারণ কী?

প্রাথমিক ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট আসার আগে মনে করা হয়েছিল যে, প্লেনটি বিস্ফোরণের পর মেডিক্যাল হেল্প নিয়ে গেছে।

কিন্তু না। বিষয় অন্য ছিল। ওই বিমানের মাধ্যমে বিস্ফোরণে নিহত ব্যক্তিদের দেহ সরিয়ে ফেলার কাজ চলছিল। সবথেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, সিরিয়ানরা মরদেহগুলোকে প্লেনে তোলার আগে সীসে দিয়ে মোড়া কফিনে ভরছিল। যারা মৃতদেহ বহনের কাজ করছিল, তাদের পরনে ছিল কেমিক্যাল উইপন স্যুট। গড়বড়টা ভয়ানক মনে হচ্ছিল।

আরও বেশি চাঞ্চল্যকর তথ্য পেলেন ডাগান। মৃতদেহগুলোর সব ক’টাই উত্তর কোরিয়ার কোনো অধিবাসীর ছিল না। মৃতদের মধ্যে ছিলেন বেশ কয়েক জন সিরিয়ান বৈজ্ঞানিক। গোপন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা গেল যে, ১২ জন সিরিয়ান বিজ্ঞানী সিরিয়ান সায়েন্টিফিক রিসার্চ সেন্টার থেকে একটি গোপন মিলিটারি গবেষণার জন্য উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন।

ট্রেনের যে বগিতে বিস্ফোরণ ঘটে, তার মধ্যে বেশ ক’জন সিরিয়ান প্রযুক্তিবিদের থাকার সংবাদও মিলল। তাঁরা উত্তর কোরিয়াতে গিয়েই ছিলেন পারমাণবিক বিভাজন সংক্রান্ত কিছু বস্তু সংগ্রহ করতে।

তাহলে ঠিক কী ঘটছিল উত্তর কোরিয়ার মাটিতে? উত্তর কোরিয়া থেকে ৫,০০০ মাইল দূরে বসে থাকা মির ডাগানের পক্ষে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানা সম্ভব হচ্ছিল না। ছটফট করছিলেন ডাগান। সন্দেহের মেঘ ঘনাচ্ছিল তাঁর মনে। ওদিকে উত্তর কোরিয়ার প্রশাসন অ্যান্টি কন্টামিনেশন স্যুট পরিহিত সৈন্যদের দিয়ে এলাকা ঘিরে ফেলে কিছু সংগ্রহ করছিল বিস্ফোরণস্থল থেকে। ডাগান আন্দাজ করলেন যে, হতে পারে ওটা প্লুটোনিয়ামের অবশেষ।

উত্তর কোরিয়া কি তাহলে সিরিয়াকে পরমাণু বোমা বানাতে সাহায্য করছিল? উত্তর পাওয়া সহজ ছিল না। কিন্তু তাই বলে উত্তরের সন্ধান করা থামায়নি ইসরায়েল তথা মোসাদ।

.

২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাস। লন্ডনের একটি হোটেলের বারে একাকী বসে মদ্যপান করছিলেন এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। আচমকাই তাঁর নজর গিয়ে পড়ল পাশের স্টুলে বসা এক সুন্দরীর ওপর। চোখে চোখে ইশারা হল। তারপর হালকা ফ্লার্টিং।

‘আপনার মতো একজন মারকাটারি সুন্দরী এভাবে একা…?’

‘একা কই? আপনি তো আছেন।’

‘হ্যাঁ, আমিই তো আছি।’

ক্রমশ কথার মায়াজালে ফাঁসছিলেন পুরুষ। এখানে বলে রাখি, ওই সুন্দরী ছিলেন একজন মোসাদ এজেন্ট। আর পুরুষটিও সাধারণ কেউ নন। তিনি ছিলেন সিরিয়ার নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ের কাজে গিয়ে ওই আধিকারিক নাম ভাঁড়িয়ে লন্ডনের হোটেলে উঠেছিলেন। সবাইকে ধোঁকা দিতে পারলেও নজর এড়ানো যায়নি মোসাদের। আর খবর পাওয়া মাত্রই মোসাদ পাঠিয়ে দিয়েছিল নিজের ১০ জন বাঘা বাঘা এজেন্টকে।

১০ জনের টিম ভাগ হয়ে গিয়েছিল তিনটি ভাগে। প্রথম দলটির কাজ ছিল সিরিয়ান আধিকারিক লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামা মাত্রই তাঁকে চিহ্নিত করে ফেলা। হোটেল বুক করা বা আধিকারিকের জন্য নির্দিষ্ট হোটেলকে খুঁজে বের করার দায়িত্বে ছিল দ্বিতীয় দলটি। আর অন্তিম দলের কাজ ছিল ওই সিরিয়ান আধিকারিকের প্রতিটি পদক্ষেপ, মিটিংকে নখদর্পণে রাখা তথা তাঁর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ডেটা হরণ করা।

এই কাজের জন্য সেরার সেরাদের বেছে নিয়েছিল মোসাদ। বিদেশের মাটিতে কাজ করা মানে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে তাকে বের করে আনার চেষ্টা। কিডন ডিভিশন থেকে গুপ্তহত্যায় বিশেষজ্ঞ আনা হয়েছিল। হোটেলের ঘরে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ইলেকট্রনিক ডেটা ট্রান্সফারের জন্য স্পেশালিস্ট হিসেবে আনা হয়েছিল নেভিয়ট ডিভিশনের লোক।

ওদিকে হোটেলের বার লাউঞ্জে বসে সুরা এবং সুন্দরীতে মজে ছিলেন সিরিয়ান আধিকারিক। আর এদিকে হোটেলের সিকিউরিটি সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে আধিকারিকের কক্ষে প্রবেশ করে গিয়েছিল নেভিয়ট টিম। মেথডিক্যাল সার্চ আরম্ভ হল। টেবিলে রাখা ছিল ল্যাপটপ কম্পিউটার। মুহূর্তের মধ্যে ল্যাপটপের ডেটা ট্রান্সফার হয়ে গেল তেল আভিভের মোসাদ হেডকোয়ার্টার্সে। পুরো প্রক্রিয়াটা কোনো হলিউড স্পাই মুভির মতোই বা বলা ভালো যে, হলিউড স্পাইগুলো সম্ভবত এমনই হয়।

হোটেল রুমের ডেটা ট্রান্সফারের কাজ শেষ হলে সিরিয়ান আধিকারিকের ল্যাপটপে ইনস্টল করে দেওয়া হল একটি ‘বাগ’। এর মাধ্যমে পরবর্তীকালে ল্যাপটপের যাবতীয় গতিবিধি দেখা যাবে তেল আভিভে বসেই। সিগন্যাল দিয়ে দেওয়া হল হোটেল লাউঞ্জের মোসাদের সুন্দরী এজেন্টকে, ‘বাগান পরিষ্কার হয়ে গেছে।’ বেচারা সিরিয়ান কর্তার আম আর ছালা দুইই গেল সেবারের মতো।

ডাগানের সামনে বিশ্লেষকরা তুলে ধরলেন যাবতীয় তথ্য। একের পর এক ছবি ফুটে উঠছিল কম্পিউটার স্ক্রিনে। আর সেগুলো দেখতে দেখতে চিন্তার ভাঁজ জন্মাচ্ছিল ডাগানের কপালে। উত্তর কোরিয়ার নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম অফিসিয়াল চৌ চিবুর সঙ্গে দেখা গেল সিরিয়ার অ্যাটমিক এনার্জির নির্দেশক ইব্রাহিম ওঠমানকে।

মরুভূমির মধ্যে একটা সুবিশাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফেসিলিটির কয়েকশ ছবি পাওয়া গেল। আন্দাজ করা হল জায়গাটার পরিমাপ— ১৩০ ফুট × ১৩০ ফুট ৭০ ফুট। বিল্ডিংটার ভেতরকার যন্ত্রপাতির ছবি দেখেই ডাগান ধরে ফেললেন ঠিক কী ঘটে চলেছে। তাঁর মাথায় ভেসে উঠল পুরোনো একটা ছবি। উত্তর কোরিয়ার য়ংবিয়ন নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারের রিয়্যাক্টরের হুবহু একটা রেপ্লিকা বানানো হয়েছিল সিরিয়ার বুকে কোথাও। আর তাতে মদত দিয়ে চলেছিল উত্তর কোরিয়া।

ডাগান সঙ্গে সঙ্গে কথা বললেন লন্ডনে মোসাদ টিমের সঙ্গে। নির্দেশ দিলেন যে, প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুসারে ডেটা পেয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ান আধিকারিককে গুপ্ত ভাবে হত্যা করা হবে ঠিক করা হলেও তা যেন না করা হয়। কারণ পরবর্তী খবরাখবর পাওয়ার জন্য ওই আধিকারিক সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের মতোই দামি।

নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের পিছনে সিরিয়া বা উত্তর কোরিয়া যেই থাক না কেন, আগামী দিনে যে সেটা ইসরায়েলের কাছে বিপদ হয়ে দাঁড়াবে তা বোঝা মাত্রই মাথা ঘুরে গিয়েছিল মির ডাগানের। আর তাঁর কাছে রাষ্ট্র সবার ওপরে। রাষ্ট্রের বিপদ এড়াতে তিনি সব করতে পারতেন। সমগ্র সিরিয়ার স্যাটেলাইট ইমেজ চাইলেন ডাগান। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পিন পয়েন্ট করে ফেলা হল নিউক্লিয়ার ফেসিলিটির নিখুঁত লোকেশন আল-কাবার। দেখা গেল এই এলাকা থেকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে অগুনতি বার। স্যাট ইমেজ এবং ল্যাপটপ ইমেজের বিল্ডিং মিলেও গেল।

খবর দেওয়া হল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী য়হুদ অলমার্টকে। অবস্থা দেখেই ব্যবস্থার কথা বললেন তিনি। সম্ভাব্য এয়ার স্ট্রাইকের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার কথাও শুনিয়ে রাখলেন। তিন সদস্যের একটি প্যানেল তৈরি হল। ছ’ মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিল সেই প্যানেল। জেনারেল ইয়াকভ আমিড্রোর প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন, ‘শুধু উত্তর কোরিয়াই নয়, ইরানও এই প্রোজেক্টে সিরিয়ার পাশে আছে। ১ বিলিয়ন ডলার ফান্ডিং হয়েছে ইরানের পক্ষ থেকে। নিজেদের মাটিতে ইউরেনিয়াম এনরিচমেন্ট প্রকল্পে অসফল হলে ইরান সিরিয়ার ফেসেলিটি ব্যবহার করতে চায়।’ মানে বাঘের নখ আর সাপের চোখ একই সঙ্গে ইসরায়েলকে শিকারে পরিণত করা পথ খুঁজছিল।

জুলাই, ২০০৭ সাল। উত্তর সিরিয়ার মুসলমিয়া অঞ্চলে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে প্রাণ হারাল ১৫ জন সিরিয়ান মিলিটারি পারসোনেল এবং আহত হল ৫০ জন ব্যক্তি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে খবর এসে গেল ডাগানের টেবিলে— একটি স্কুড-সি মিসাইলে মাস্টার্ড গ্যাস ভরতে গিয়েই এই বিপত্তি ঘটে যায়। অবশ্য এ ঘটনার আগেই নিজেদের চর সিরিয়ায় নিয়োগ করে ফেলেছিল মোসাদ।

মোসাদ তত দিনে নিঃসন্দেহ হয়ে গেছে সিরিয়ার উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে। এবার শুধু করণীয়কে রূপ দেওয়ার পালা। য়হুদ অলমার্ট ডাগানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিরিয়ার এই নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর কতখানি অপারেশনাল হয়েছে বা আদৌ চালু হয়েছে কি? কারণ যদি তা পুরোপুরি ভাবে সক্রিয় হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তার ওপরে এয়ার স্ট্রাইক করে বোমাবর্ষণ করলে ফল হবে প্রলয়ঙ্কর। ঘটে যেতে পারে পলিউশন পয়জনিং ক্যাটাস্ট্রফ।’

উত্তর দিতে পারলেন না মোসাদ চিফ ডাগান। আল-কাবারের এই রিয়্যাক্টর আদৌ চালু হয়েছে কিনা কিংবা হয়ে থাকলে তা কোন মাত্রায় রয়েছে তা নিয়ে কিছুই জানা ছিল না ডাগানের, কারণ তাঁদের কাছে থাকা ছবিগুলো ছিল প্রায় দেড় বছর পুরোনো।

আরম্ভ হল বাঘের নখ আর সাপের চোখ উপড়ে আনার পালা। ডাগানকে করা প্রশ্নর উত্তর খোঁজার জন্য ডাক পড়ল ইসরায়েলের সবথেকে এলিট ব্ল্যাক অপস্ ইউনিট সায়েরাত মটকলের। ইসরায়েলের সবথেকে দুর্ধর্ষ এই কম্যান্ডো ইউনিটের তুলনা টানা যায় বিশ্ববিখ্যাত এসএএস (ব্রিটিশ), সিল টিম (ইউএস) বা ডেল্টা ফোর্সের সঙ্গে। নিজের দেশের সীমানা পেরিয়ে বিভিন্ন অপারেশন সেরে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে ফেরার বিষয়ে সায়েরাত মটকলের জুড়ি মেলা ভার। নিজেদের কার্যকলাপের সমস্ত চিহ্ন চুকিয়ে এরা অপারেশন সেরে এসেছে জর্ডন বা লেবাননের মতো শত্রুভূমিতেও।

আগস্ট, ২০০৭ সাল। রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ১২জন মটকলিস্ট কম্যান্ডো উড়ে চলল একজোড়া সিএইচ ৫৩সি স্ট্যালিয়ন হেলিকপ্টারে। রাডারের চোখ-কান এড়াতে চপারগুলো উড়ছিল মাটি থেকে খুব অল্প উচ্চতায়। কম্যান্ডোদের পরনে ছিল সিরিয়ান সোলজারদের ইউনিফর্ম। চিরাচরিত এম ১৬ রাইফেলের বদলে কম্যান্ডোদের হাতে ছিল একে ৪৭। এটাও ছিল ওদের ছদ্মবেশের অন্যতম অঙ্গ। ক্যামোফ্ল্যাজের জন্য সিরিয়ান মডেলের পুরোনো মিলিটারি জিপ বয়ে নিয়ে যাওয়া হল চপারে। মাটিতে নামার পর পরিবহনের ব্যাপারটা মাথায় রাখতে ভোলেনি মটকলিস্টরা।

ব্যাক আপ টিম সঙ্গ দিল সমানে। ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার দুটি ছাড়াও ছিল একাধিক অ্যাটাক হেলিকপ্টার এবং একটি রেসকিউ চপার। ইসরায়েলের সুরক্ষিত মাটি থেকে সুদূর সিরিয়ার মরুভূমিতে দেশের মানুষকে বিপন্ন অবস্থায় কি ফেলে আসতে পারে ইসরায়েল? একটি কম্যান্ডো প্লেন তাই সমানে রাডার পরিধি ও সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেমের সীমার ওপরে চক্কর দিতে লাগল সিরিয়ার আকাশে। তার কাজ ছিল সিরিয়ান মিলিটারি কমিউনিকেশনকে ডিকোড করতে থাকা এবং বিপদের আঁচ পেলেই আগাম সতর্কতা দেওয়া।

কম্যান্ডোদের ব্যক্তিগত কিটের মধ্যে কত ওজনের অস্ত্র বা সরঞ্জাম দেওয়া হবে এই নিয়ে দ্বিধা ছিল প্রথম থেকেই। বিপদসংকুল এই মিশনে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল। তাই পলায়নপথে বাধা যতটা সম্ভব কম রাখাই ছিল উদ্দেশ্য। নিউক্লিয়ার ফেসিলিটি থেকে প্রায় এক মাইল দূরত্বে নামিয়ে দেওয়া হয় কম্যান্ডোদের। শুধুমাত্র একটি কম্পাসের সাহায্য নিয়ে বা অনেক সময় তারও অনুপস্থিতিতে ভিনদেশের মাটিতে নিজের লক্ষ্যকে খুঁজে বের করতে ওস্তাদ সায়েরাত মটকল টিম।

টিমের পরিকল্পনা নিখুঁত। একটি দল স্কাউট গাইডের কাজ করে জানান দেবে রাস্তা সাফ আছে কিনা। কোর টিমের তুলনায় ১০০ মিটার এগিয়ে থাকবে স্কাউটরা। টু ওয়ে কমিউনিকেশন বজায় থাকবে সবসময়। পথের বিপদ নেই জানলে তবেই এগোবে কোর টিম। প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর কম্যান্ডারের নির্দেশ মেনে টিমের সদস্যরা থামবে। নিজেদের কিট থেকে দরকারি এনার্জি বার ও ড্রিঙ্ক খেয়ে নেবে। খাওয়ার পর যে কোনো প্যাকেট বা বোতল বাইরে না ফেলে রাখতে হবে নিজের কিটব্যাগের মধ্যেই।

কোর টিমের প্রত্যেক অপারেটর সদস্যকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছিল ভূবিজ্ঞানী, পদার্থবিদদের অধীনে। কী দেখতে হবে, কোন জিনিসটা খোঁজা দরকার, কীভাবে চিহ্নিত করতে হবে দরকারি বিষয়কে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল নিপুণ ভাবে। রিয়্যাক্টরের কাছাকাছি পৌঁছানো মাত্রই টিম লিডারের নির্দেশে দলের সদস্যরা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরতে শুরু করে দিল আবর্জনা, মাটি, ঘাসপাতা এবং জলের নমুনা। মাটির নমুনা সংগ্রহ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত মাটিও খুঁড়তে হচ্ছিল।

মূল কাজ অর্থাৎ নমুনা সংগ্রহ করতে লেগেছিল মাত্র কয়েক মিনিট। আসল কাজটা শুরু হচ্ছিল তারপরে। স্যাম্পেল কালেক্টরদের পিছনে একজন করে সদস্য একটা অত্যাধুনিক যন্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছিল। সেটাকে ঝাড়ুর ই-ভার্সন বলা চলে। খোঁড়া গর্তকে বুজিয়ে ফেলা বা সায়েরাত মটকল টিমের উপস্থিতিজনিত যে কোনো চিহ্নকে বিলোপ করার কাজটা সারছিল তারাই। অর্থাৎ, সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখা চলবে না। সাক্ষী রইল শুধু নীরব ইউফ্রেটিস।

ফোর্স কম্যান্ডার সিগন্যাল দেওয়া মাত্রই আরম্ভ হল প্যাক আপ মিশন। নিরাপদেই ইসরায়েলে ফিরল পুরো সায়েরাত মটকল টিম। সংবাদ দেওয়া হল দেশের প্রধানমন্ত্রী য়হুদ অলমার্টকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। কারণ টিমের একটি সামান্য ভুলও দুই দেশের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল।

ল্যাব রেজাল্ট জানা গেল কয়েক দিনের মধ্যেই। সেখানে দেখা গেল, মাটির নমুনা পজিটিভ। সিরিয়ার আল-কাবারে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের উপস্থিতি নিয়ে আর কোনো দ্বিধা রইল না।

ডাগানের সঙ্গে মিটিংয়ে বসলেন য়হুদ অলমার্ট।

ডাগান বললেন, ‘নমুনা পরীক্ষণ পরিণাম বলছে যে, রিয়্যাক্টর পুরোপুরি চালু হয়নি। এবার?’

‘দ্য রিয়্যাক্টর ইজ অন ইটস ওয়ে টু বিকাম হট। আর দেরি করলে চলবে না। এখুনি আঘাত হানতে হবে!’ বললেন প্রধানমন্ত্রী অলমার্ট।

.

একটি স্বাধীন দেশের বুকে অপর একটি রাষ্ট্রের বোমাবর্ষণ কিন্তু সহজ কাজ নয়। আর এই কথাটা খুব ভালো ভাবেই জানতেন প্রধানমন্ত্রী অলমার্ট। উনি তৎকালীন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশের সম্মতি চাইলেন এক্ষেত্রে। বিভিন্ন সূত্র দাবি করে যে, উক্ত নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের কথা শোনা মাত্রই সেটাকে ধ্বংস করার অনুমতি দেন রাষ্ট্রপতি বুশ। যদিও জুনিয়র বুশের আত্মজীবনী ‘ডিসিশন পয়েন্টস্’-এ দাবি করা হয়েছে যে, অলমার্টকে পারমাণবিক রিয়্যাক্টর ধ্বংস করার ব্যাপারে কোনো সম্মতি উনি দেননি। বুশের বক্তব্য অনুসারে নিম্নরূপ ছিল সেই কথোপকথনঃ

বুশ: একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে এভাবে আপনি বোমা ফেলতে পারেন না। নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।

অলমার্ট: বিষয়টাকে দীর্ঘ এবং বিরক্তিকর করে তুলছেন আপনি। ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য যা করা দরকার, তা আমি করবই।

এরপর একটি জরুরি বৈঠক ডাকেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। উপস্থিত ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী এবং দেশের সামরিক বিভাগের প্রধানরা। সিরিয়ার পারমাণবিক রিয়্যাক্টর ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্তকে সাদরে আহ্বান করেন তৎকালীন বিরোধী দলনেতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। কর্মসূচির একাত্মতা নিয়ে উনি কোনো প্রশ্নই তোলেননি।

প্রশ্ন উঠল অন্য বিষয় নিয়ে। আক্রমণ হানা হবে কোন পথে? স্থলপথে নাকি বায়ু মাধ্যমে? পক্ষে এবং বিপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন কারণ দেখানো হল। স্থলপথে আক্রমণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভোট পড়ল বেশি। যেমন যদি কোনো অপারেটর ধরা পড়ে যায় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রনীতি সমস্যায় পড়বে; অত সুবিশাল একটি ফেসিলিটিকে বিধ্বস্ত করার মতো দরকারি বিস্ফোরক প্লান্ট করা না গেলে ব্যাপারটা পর্বতের মূষিক প্রসবে পরিণত হবে। অতএব, বিমান হানাই শ্রেয়।

প্রধানমন্ত্রীর লিখিত নির্দেশ বেরোল— প্রিপেয়ার ফর অ্যান এয়ার অ্যাটাক অন দ্য সিরিয়ান রিয়্যাক্টর অ্যান্ড দ্য মিটিং কোডনেমড দ্য অপারেশন ‘অপারেশন অৰ্চার্ড’।

ডাকা হল ইসরায়েলের একটি স্পেশ্যাল ফোর্সেস ইউনিট, স্কোয়াড্রন ৬৯- কে। এর ২৫ বছর আগে একটি ইরাকি নিউক্লিয়ার ফেসিলিটিকে বিধ্বস্ত করার কাজে অভিজ্ঞ স্কোয়াড্রন ৬৯-কেই বেছে নেওয়াতে কোনো দ্বিমত হল না। এফ ১৬ এবং এফ ১৫ ফাইটার জেট সমৃদ্ধ এই বাহিনীর কাছে আকাশপথে হামলা চালানো এমন কিছু কঠিন কাজ ছিল না। তবে সিরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল টেকনোলজি কিনে নেওয়ায় সেদিকটা একটু ভেবে দেখার মতো তো ছিলই। যদিও অমন বহু এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে বোকা বানাতে পারার অভিজ্ঞতায় ঝুলি ভর্তি ছিল স্কোয়াড্রন সিক্সটি নাইনের। এই ফাইটার জেটগুলো থেকে ইসিএম ফ্লেয়ার ব্যবহার করে সিস্টেম গাইডেড মিসাইলকে পথভ্রষ্ট করার ব্যবস্থাও ছিল।

পুরো মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হল ইসরায়েলি এয়ারফোর্সের জেনারেল এলিজার কেডি-কে। নিজের কাজের ক্ষেত্রে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন এই ব্যক্তি ইসরায়েলের এয়ার ডিফেন্স, অ্যাটাক মেকানিজম এবং অস্ত্রভাণ্ডারকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে সেই কথাগুলো আজকের দিনে বসে শুনলেও মনে হয় কল্পবিজ্ঞানের গল্প। একজন দুদে ফাইটার পাইলট হিসেবে উনি শত্রুপক্ষের ডিফেন্সে ভয়ানক আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি আমজনতার ন্যূনতম ক্ষতির তত্ত্ব তুলে এনেছিলেন। একটি বিশাল বিল্ডিংয়ের একটি নির্দিষ্ট তলার একটা নির্দিষ্ট কক্ষে হামলা চালানোর মতো নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্রের উদ্ভাবনে ওঁর যোগদান অনস্বীকার্য। জ্যামে ভরা রাস্তায় একটি মাত্র মোটরবাইকে হামলা চালিয়ে তার আরোহীকে নিকেশ করাতে চাইলে সেটা করার মতো দক্ষতাও ইসরায়েলি এয়ারফোর্স স্পর্শ করেছিল ওঁর আমলেই।

অপারেশন অর্চার্ডের জন্য নিজে পাইলট বাছাই করলেন জেনারেল কেডি। এয়ার রেইডের আগে চলল বেশ কয়েক দিনের প্রশিক্ষণ পর্ব। প্রশিক্ষণের সময়ে রাতের বেলায় ছোট আকারের টার্গেটে নিশানা লাগিয়ে লক্ষ্যভেদ করতে হত পাইলটদের। আঘাত হানতে হত ৩৫ ডিগ্রি কোণ করে। যে ডামি বোমাগুলো ব্যবহার করা হত, সেগুলো ফাটা মাত্রই ফসফরাসের সাদা ধোঁয়া ছেয়ে যেত বিমানের নীচে। তার মধ্যেই করতে হত লক্ষ্যভেদ।

এসবের মাঝে ৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দফতরে খবর এল যে, সিরিয়ার উপকূলে হাজির হয়েছে একটি ১,৭০০ টনের জাহাজ। জলযানটি উত্তর কোরিয়ার। কাগজপত্র অনুসারে সেই জাহাজ সিমেন্ট বহন করে নিয়ে এলেও বাস্তবে তার মধ্যে লুকিয়ে আনা হয়েছে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরকে পুরোপুরি ভাবে চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। অতএব, আঘাত হানার জন্য ইসরায়েলের হাতে আর বেশি সময় রইল না।

.

৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। রাত ১১: ৫৯। স্কোয়াড্রন সিক্সটি নাইনের ১০ জন পাইলট উড়ানের প্রস্তুতি আরম্ভ করে দিলেন। টেক অফ করার আগে তাদের বলা হল কোন মিশনে যাচ্ছেন। কেউ জানতেন না লক্ষ্যবস্তুই বা কী? কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলের রামাত ডেভিড এয়ারবেসের রানওয়ে থেকে প্রতি ২০ সেকেন্ডের তফাতে আকাশে পাড়ি জমাল একটার পর একটা এফ ১৬ আর এফ ১৫। প্রতিটি বিমানকে সাজনো হয়েছিল ৫০০ পাউন্ড ওজনের লেজার গাইডেড এজিএম ৬৫ বোমা দিয়ে।

সাগরপানে উড়ে গেল জেটগুলো। গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৬০০ মাইল। সিরিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে এড়ানোর জন্য প্লেনগুলো বেছে নিল একটি বিকল্প পথ। সিওরায়েল থেকে পশ্চিমে গিয়ে ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে উত্তরে ঢুকল। তারপর বাঁক নিল পূর্বে। তুরস্ক হয়ে প্রবেশ করবে সিরিয়ায়, এ-ই ছিল উদ্দেশ্য।

ওদিকে তখন তেল আভিভের ইসরায়েলি এয়ারফোর্সের আন্ডারগ্রাউন্ড কম্যান্ড সেন্টারে উপস্থিত হয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী সহ দেশের বরিষ্ঠ সামরিক আধিকারিকেরা। সেখান থেকে জেটগুলো পেল পরবর্তী নির্দেশ— তিনটি এফ ১৫ বিমানকে বেসে ফেরার অর্ডার দেওয়া হল। বাকি সাতটি বিমান সিরিয়ান রাডারকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য মাটি থেকে ২০০ ফুটেরও কম উচ্চতায় উড়তে উড়তে এগোতে থাকল সিরিয়ার দিকে।

ঠিক ওই সময়েই জেনারেল কেডি পাইলটদের বলে দিলেন যে তাঁদের লক্ষ্যবস্তু কী হতে চলেছে। জেনারেল জানালেন, ‘আপনারা এখন সিরিয়ান এয়ারস্পেসে প্রবেশ করেছেন। ওদের এয়ার ডিফেন্স খুব উন্নত হলেও চিন্তার কোনো কারণ নেই। সেই সিস্টেম আমরা আগেই জ্যাম করে দিয়েছি। লক্ষ্যবস্তুর কথা তো বলেই দিয়েছি। আর হ্যাঁ, কোনো সিভিলিয়ান এরিয়ায় বোমা ফেলবেন না। আই রিপিট… সিভিলিয়ান এরিয়ায় বোমা ফেলবেন না!’

সিরিয়ান এয়ারস্পেসে প্রবেশ করার পরপরই টাল্ল আল-আবয়াদ-এ একটি রাডার সাইটকে ধ্বংস করে দেয় বিমানগুলি। একাধিক রাডারকে জ্যাম করে দেওয়া হয়েছিল আগেই। সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছিল কোড। রাশিয়ানদের থেকে কেনা রাডারগুলোকে শায়েস্তা করার জন্য রাশিয়ানদেরই কিনে নিয়েছিল মোসাদ। পেয়ে গিয়েছিল রাডারকে বোকা বানাবার জ্যামিং কোড। জ্যামিং প্রসেস আরম্ভ করে দিতেই রাডারে দেখাচ্ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে প্লেন ঢুকছে, আবার সবকিছু শূন্য হয়ে যাচ্ছিল পর মুহূর্তেই। স্বাভাবিক ভাবে সিরিয়ানরা মনে করছিল প্রযুক্তিগত কোনো সমস্যার মুখে পড়েছে তারা। সিরিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমটাই চলে গিয়েছিল মোসাদের কবজায়।

ইসরায়েলি পাইলটদের প্লেনে থাকা অন বোর্ড কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেওয়া হল আল-কাবার নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের নিখুঁত অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশের বিবরণ। নিজেদের অবস্থান থেকে দক্ষিণে বেঁকে গেল ফাইটার জেটগুলো। বোমা যে ফেলতে হবে সেদিকেই।

অপারেশন অর্ডার্ডের সবথেকে বিপজ্জনক অংশ আরম্ভ হল এখান থেকেই। বোমা চার্জ করার সময়ে ফাইটার প্লেন সবথেকে বেশি অরক্ষিত অবস্থায় থাকে। নিজেদের সুরক্ষার দিকটা তখন পাইলটের পক্ষে খেয়াল রাখা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আরম্ভ হল বোমাবর্ষণ। একটি করে আঘাত হানার পর প্রতিক্রিয়ায় থরথর কেঁপে উঠছিল বিমানগুলোও। গুঁড়িয়ে দেওয়া হল রিয়্যাক্টরের ছাদ, দেওয়াল। প্রতিটা দৃশ্য ধরে রাখা হল ক্যামেরায়। সিরিয়ার যে ক্ষতি হল, তা ছিল অপূরণীয়।

সবচেয়ে উদ্বিগ্ন অবস্থায় সময় কাটছিল ইসরায়েলের এয়ারবেসের সেনানায়কদের তথা প্রধানমন্ত্রীর। কী ঘটছে, না ঘটছে তার একমাত্র আন্দাজ করা সম্ভব হচ্ছিল পাইলটদের সঙ্গে কথা বলেই। নচেৎ শত্রুপক্ষ জানতে পেরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কিনা বা নিলেও তার ফলে কোনো ক্ষতি হয়ে গেল কিনা বোঝার রাস্তা ছিল না ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগে অবধি। প্রতিটা সেকেন্ডকে মনে হচ্ছিল শতাব্দীর মতো দীর্ঘ। আর এমন সময়ে রেডিও ট্রান্সমিশনে ভেসে এল একটা শব্দ— ‘অ্যারিজোনা’। উল্লাস করে উঠল ইসরায়েলি এয়ারবেসে উপস্থিত সকলে। কারণ অপারেশন অচার্ড আরম্ভ হওয়ার আগে পাইলটদের বলে দেওয়া হয়েছিল যে, লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে তা ধ্বংস করতে পারার পরেই যেন বলা হয় এই শব্দটিকে। সংবাদ এল, কোনো ইসরায়েলি বিমানের ক্ষতি হয়নি এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরটি। দ্য মিশন ইজ ওভার।

এরপর বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় না করে ইসরায়েলের পাইলটরা বেরিয়ে আসে সিরিয়ার এয়ারস্পেস থেকে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী অলমার্ট আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বুশকে ফোনে করে বলেন, ‘নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সিরিয়া, ইরান আর উত্তর কোরিয়ার সাজানো বাগান।’ কিন্তু বাস্তবে বিরোধী পক্ষের বাগান থেকে তার প্রিয় ফুলটাকে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল মাত্র, কাঁটা সাফ হয়নি তখনও। আর সেই কাঁটার নাম ছিল সুলেইমান। জেনারেল সুলেইমান।

অপারেশন অর্চার্ড তাই এখানেই শেষ হয়েও শেষ হল না। সিরিয়া প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া রূপে জানাল যে, ইসরায়েলের কয়েকটি যুদ্ধবিমান তাদের দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ঢুকে পড়ায় তারাও প্রতি-আক্রমণ করে বের করে দেন বিমানগুলিকে। ওদিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এই হামলা নিয়ে কোনো কথা তোলা হয় না।

কিন্তু মির ডাগান ছিলেন পারফেকশনিস্ট। একটা খুঁতখুঁতানি কিছুতেই যাচ্ছিল না ওঁর মন থেকে। সাতটা দীর্ঘ বছর ধরে একটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর তৈরির কাজ চালিয়ে গেল সিরিয়ানরা, আর সেটার খবর মোসাদ পেল না? কীভাবে সম্ভব হল এত গোপনীয়তা?

আর ডাগান হলেন ডাগান! বলা হয় যে, পাতালে ঢুকে লুকোলে ঈশ্বরের প্রকোপ থেকে মুক্তি মিললেও মিলতে পারে, কিন্তু ডাগানের হাত থেকে পার পাওয়া অসাধ্য ব্যাপার। মোসাদের তদন্তকারীরা খুঁজে বের করলেন একটা নতুন তত্ত্ব। সিরিয়া নিজেদের রিয়্যাক্টর তৈরি করার জন্য খবরাখবর আদানপ্রদানের সময়ে কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ব্যবহারই করেনি। পুরোনো দিনের মতোই কাগজে-কলমে নথিপত্র নেওয়াদেওয়া করা হয়েছিল এক্ষেত্রে। হতে পারে সেই পদ্ধতি অনেক ধীরগতির, কিন্তু নিরাপত্তার বিষয় ছিল প্রথম। আর সত্যিই তা ফলদায়ী হয়েছিল। তাই বিপক্ষের দ্বারা হ্যাক হওয়া বা ডেটা কপি করে ফেলতে পারার মতো বিপদ ঘটেনি।

প্রতি বারেই সিরিয়া বা উত্তর কোরিয়া কোনো তথ্য পাঠানোর সময়ে তার প্রিন্ট বের করে নিয়ে সেটাকে একটা খামে ভরে খামটার মুখ বন্ধ করে দিত গালা বা মোম দিয়ে সিল করে। ওপরে লেখা হত ‘টপ সিক্রেট’। তারপর সেটাই ডাকে বা ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে গিয়ে পড়ত উলটো দিকের হাতে। এভাবেই সাত বছর ধরে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল এত বড় একটা প্রকল্পকে।

এসব কিছুর মাস্টারমাইন্ড ছিল জেনারেল মুহম্মদ সুলেইমান। সে ছিল সিরিয়ান প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ছায়াসঙ্গী তথা অন্যতম পরামর্শদাতা। মোসাদের টনক নড়ল আরও নতুন কিছু তথ্যে। নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর ধ্বংস হওয়ার পরেও আবার নতুন রি-অ্যাক্টর বানাবার সর্বপ্রকার সম্ভাব্য প্রয়াস করে চলেছে সিরিয়া, যার নেপথ্য-নায়ক ছিল এই সুলেইমান। এবারে নতুন করে প্রকল্প করা অনেক সহজ ছিল সিরিয়ার কাছে। অর্থের জোগান ছিল, প্রযুক্তির বেশিরভাগটাই চলে এসেছিল আয়ত্তে, আর ছিল অদম্য মনোবল। এমতাবস্থায় একটি শক্তিশালী পারমাণবিক অস্ত্র থেকে সিরিয়ার দূরত্ব ছিল হয়তো মাত্র পাঁচটি বছর।

ডাগান তথা মোসাদ একটা কথা খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল যে, যত দিন সুলেইমান টিকে থাকবে, ততদিন পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ হাতে নিয়ে ভয় দেখানোর ক্ষমতা রাখবে সিরিয়া।

শুরু হল সুলেইমানকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার যোজনা। বাস্তবে দেখা গেল সুলেইমানকে হত্যা করার থেকে সহজ ছিল নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরে বম্বিং করা। একটা স্থাবর সম্পত্তিকে বোমা মেরে বিধ্বস্ত করা, আর একজন বুদ্ধিমান মানুষকে মারা এক কাজ নয়। সুলেইমানকে সবসময়ে ঘিরে থাকত কয়েক জন দুর্ধর্ষ অঙ্গরক্ষক। সশস্ত্র সেই বাহিনীকে টেক্কা দিয়ে সুলেইমানকে নিহত করা অসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়াল মোসাদের কাছে।

কিন্তু এ ছিল ডাগানের মোসাদ। ছল, বল বা কৌশল কোনোটার ব্যবহার করতেই ডাগান পিছপা হতেন না। প্রাথমিক ভাবে সুলেইমানের ওপরে আঘাত হানতে না পারলেও তিনি নজরে রাখলেন সুলেইমানকে। তক্কে তক্কে থাকল মোসাদ। ২০০৮ সালের গ্রীষ্মকাল। মোসাদের কাছে ইন্টেল রিপোর্ট গেল যে, নিজের দামাস্কাসের বাড়ি ছেড়ে তারতাসের একটি ভিলায় ছুটি কাটাতে যাবেন জেনারেল সুলেইমান। তারতাস একটি সৈকত নগরী। অনুপম সৌন্দর্যে ভরা এই শহরে কাটানো ছুটিই যেন সুলেইমানের শেষ ছুটি হয় তার জন্য তৎপর হয়ে উঠল মোসাদ।

এ ধরনের কাজে প্রয়োজন ছিল গুপ্তহত্যার। আর তাই ডাকা হল ইসরায়েলের ব্ল্যাক অপস্ টিম ‘দ্য কিডন’-কে। সতর্ক শিকারীর মতোই আগুপিছু বিবেচনা করে এগোয় কিডন টিম। তারা ছকে ফেলল সুলেইমানের ভিলার নকশা। প্রাসাদোপম বাড়িটা দুর্গের মতোই অভেদ্য। তার একদিকে নীল সমুদ্র। সাগরের দিকের খোলা বারান্দাতেই নিজের অতিথিদের জন্য পার্টির আয়োজন করে সুলেইমান।

২ আগস্ট, ২০০৮। সন্ধ্যাবেলা। সুলেইমানের ভিলায় তখন হইহই করছে অভ্যাগতরা। বারান্দায় পাতা টেবিলে বসে একে অপরের শুভকামনা করে গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে অতিথিরা গলায় ঢালছেন সোনালি পানীয়। নেশা চড়ছে ক্রমশ। ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে আসা একটি ইয়ট এসে থেমে গেল সুলেইমানের ভিলা থেকে প্রায় এক মাইলেরও বেশি দূরত্বে। জলযান থেকে ডুবুরির কালো পোশাক পরে জলে নেমে গেল দুজন মানুষ। সঙ্গে জলেও ব্যবহার উপযোগী থাকবে এমন অস্ত্র। ভাসতে ভাসতে সেই লোক দুটোই এসে পৌঁছাল ভিলা থেকে ১৫০-২০০ গজের দূরত্বে। অগাধ জলরাশিতে মানুষ দুজনকে দুটি নিশ্চল বিন্দু বললেও বেশি বলা হয়। তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া ছিল কার্যত অসম্ভব।

স্নাইপারের মাধ্যমে তারা নজর রেখেছিল সুলেইমানের ওপরে। বন্ধু, আত্মীয়, অভ্যাগতদের নিয়ে জেনারেল টেবিলে খেতে বসলেন। দুজন স্নাইপারই নিশানার জন্য ক্রসহেড স্থির করল সুলেইমানের ওপর। ট্রিগার টিপতে যাবে নিশানাবাজরা এমন সময়ে এক অভ্যাগত এসে দাঁড়াল সুলেইমানের সামনে। থামতে বাধ্য হল স্নাইপাররা। নিজেদের অবস্থান বদলে আবার নিশানা স্থির করল তারা।

দুজন স্নাইপারের নিশানার মধ্যে তালমিল বজায় রাখার জন্য ব্যবস্থা করা ছিল ইলেট্রনিক কাউন্টডাউনের। যাতে একইসঙ্গে ফায়ার করা সম্ভব হয়। টাইমার সেট করে কাউন্টডাউনের তালে দুজনেই গুলি চালায় এবার। নির্ভুল নিশানা। একটি গুলি গিয়ে লাগল সুলেইমানের গলায়, আরেকটি বিদ্ধ করল ওর মাথাকে। বন্দুকে সাইলেন্সার লাগানো ছিল এ কথা বলাই বাহুল্য। তাই প্রাথমিক ভাবে পার্টিতে উপস্থিত লোকজনে বুঝতেই পারেনি যে ঠিক কী ঘটেছে। গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গেই নিহত হয় সুলেইমান। মাথাটা হেলে যায় পিছন দিকে। মাথা আর গলা থেকে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে ভিজে ওঠে তার পোশাক। হুলস্থুল পড়ে যায় আসরে।

সিরিয়ার রিয়্যাক্টরে এয়ার স্ট্রাইকের পর যেমন বলা হয়েছিল ‘অ্যারিজোনা’, তেমন ভাবেই এই গুপ্তহত্যার পর দুই ঘাতকের একজন নিজের হেডকোয়ার্টারে খবর দেওয়ার সময়ে জানায়, ‘ভেরি হ্যাপি ইনসিডেন্ট!’

সুলেইমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো রকমের তথ্য ফাঁস করেনি মোসাদ। তাই এই হত্যা নিয়ে অনেক কন্সপিরেসি থিওরি কাজ করে। কেউ বলে, ইসরায়েলের ফ্লোটিলা টিমের সদস্যরা এই কাজটা করেছিল। অনেকে আবার এই হত্যাকাণ্ডের পরেই একজন মোসাদ স্পাইয়ের গ্রেফতার হওয়ার কথা বলে থাকে। উইকি লিক্‌-এর তথ্য ফাঁসের সময়ে উঠে এসেছিল আরেকটি তথ্য। সেখানে জানানো হয়েছিল যে, প্রেসিডেন্টের ভাই মাহের আল-আসাদ রাজনৈতিক স্বার্থে গুপ্তহত্যা করিয়েছিলেন সুলেইমানের। আবার ফ্রান্সের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সুলেইমানের ভিলায় আদৌ সুলেইমানকে হত্যাই করা হয়নি। ওর গাড়িতেই ওকে গুলি মেরে হত্যা করা হয়। বাকি সবটাই সাজানো ঘটনা।

তবে জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে হাসান নাসারাল্লাহ্ বলেছিল, ‘২০০৬ সালের জুলাই মাসে আমাদের সাহায্য করেছিল জেনারেল সুলেইমান। তারই খেসারত চোকাতে হল ওকে। ইসরায়েল বদলা নিল।’

মধ্যপ্রাচ্যে হিজবুল্লাহ্ সাপের মতোই খতরনাক। আর বাঘের মতো শক্তিশালী সুলেইমান তাদের সাহায্য করায় ভয়ানক জোড়া ফলার মতো এগোচ্ছিল তারা। তাই বাঘের নখ আর সাপের চোখকে নষ্ট করে দিতে কোনো কসুর বাকি রাখেনি মোসাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *