বাঘের ঘরে – শেখর বসু
রঙিন টিভির পর্দায় জঙ্গলের ছবি। গভীর জঙ্গল। লম্বা-লম্বা ঘাস, ঝোপ, ঝাঁকড়া গাছপালা, লতা-ঝুরির মধ্যে দিনের আলো কেমন যেন চোরের মত ঢুকছে। ঝিঁঝি ডাকছে তারস্বরে, সরু নদীতে ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে শব্দ করে। জঙ্গলের নানা কোণ থেকে আরও কিছু চাপা আওয়াজ : ভেসে আসছে। কিসের আওয়াজ বোঝা কঠিন, তবু ওগুলোই বোধহয় গোটা পরিবেশকে থমথমে করে তুলেছিল। টিভির সামনে যারা বসে ছিল তাদের কারুরই বোধহয় বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না যে, শান্ত ওই জঙ্গলের মধ্যে এক্ষুণি ভয়ঙ্কর একটা কাণ্ড ঘটতে চলেছে।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। ওই তো সেই ডোরাকাটা বিশাল বাঘটা। ঝাপসা আলোয় ভয়ঙ্কর বাঘের চোখ জ্বলছিল আগুনের দুটো টুকরোর মতো। গুঁড়ি মেরে মেরে বাঘ এগুচ্ছে। শিকারের ওপর আচমকা লাফিয়ে পড়ার আগে বাঘ বোধহয় সবসময়ই এইভাবে এগিয়ে থাকে। কিন্তু শিকারটা কী?
টিভির দর্শকদের বুকে আর একটা বুঝি ধাক্কা লাগল। যা আশঙ্কা করা হয়েছে, ঠিক তাই। শিকার মিষ্টি চেহারার ছোট্ট ওই ছেলেটা। আপন মনে পা ছড়িয়ে খেলে যাচ্ছে। ওর পেছনে সাক্ষাৎ মৃত্যু।
এবার! বাঘ আর একটুখানি গুঁড়ি মারার পরে শরীরটাকে চাকার মত পাকিয়ে ফেলল। মস্ত একটা লাফ মেরে শিকারের ওপর লাফিয়ে পড়ার আগের মুহূর্ত এটা। আর ঠিক তক্ষুণি কে যেন হিসহিস করে বলে উঠল : মোগ্লি সাবধান! পেছনে শের খান।
গভীর ওই জঙ্গলে ছোট্ট ওই ছেলেটা কিন্তু একা নয়। ওর সঙ্গে খুব ভাব আছে প্রকাণ্ড সাপ, পেল্লায় ভাল্লুক, কুচকুচে কালো প্যান্থার আর দাঁতালো হাতিদের। বন্ধুরাই ওকে আগলে রাখে সারাক্ষণ। বিপদের গন্ধ পেলে সাবধান করে দেয়। এখন যেমন!
মোগ্ফলি তিড়িং করে একটা লাফ মেরে ঝুলে পড়ল সামনের গাছের লম্বা ঝুরিটা ধরে। তারপর শরীরের দ্রুত মোচড়ে দুবার ঝুল খেয়ে উঠে গেল সরু নদীর ওপরে ঝুলে থাকা গাছের ডালে। নদীতে পোড়া কাঠের মত বিশাল এক কুমির। কী হাঁ! মস্ত ওই হাঁয়ের মধ্যে বাঘের অত বড় মাথাটা বোধহয় একবারে ঢুকে যাবে। সেই ভয়েই বুঝি শের খানের লাফ মারা আর হল না। চাকার মত পাকানো শরীর আবার লম্বা হল। প্রকাণ্ড ওই জঙ্গল কাঁপিয়ে বিকট একটা ডাক ছাড়ল বাঘ। রাগের চোখে মাটিতে লেজ আছড়াল কয়েকবার, তারপর আস্তে আস্তে পাশের ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল।
টিভির দর্শকরা বোধহয় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। না, কোনও অঘটন ঘটেনি। তবে সুস্থির হয়ে বসারও কোনও উপায় ছিল না। গা ছমছমে ঘটনা তো শুধু ওই একটা নয়, একটার পর একটা। সব ঘটনাই বাঁক নিচ্ছিল দ্রুত।
গল্পের শেষটা অবশ্য বেশ আরামের। পাজি বাঘ শের খান ঢিট হল ছোট্ট ছেলে মোগ্লির হাতে। জঙ্গলে শান্তি ফিরল আবার। স্ক্রিনে ‘দি এন্ড’ ফুটতেই নব ঘুরিয়ে টিভি বন্ধ করলেন সুবিমল বাগচী। সুবিমলবাবুর বয়েস বছর পঞ্চান্ন। ঘরের মধ্যে বাকি যে চারটি ছেলে বসে আছে তারা পঁচিশের আশপাশে। চারজনেই কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়াশুনো একসঙ্গে শেষ করার পরে চাকরিবাকরি খুঁজতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু খোঁজাই সার, চাকরি আর জোটেনি। চাকরির বাজার এখন অসম্ভব খারাপ, চেনাশোনা না থাকলে জোটানো কঠিন। বিরক্ত হয়ে চার বন্ধুই তাই ঠিক করেছিল, চাকরি নয়—ব্যবসা করে ভাগ্য ফেরাতে হবে। কিন্তু কিসের ব্যবসা? সঠিক ব্যবসার হদিস করতে গিয়েই সুবিমলবাবুর সঙ্গে ওদের আলাপ। কিংবা বলা যায়, ভদ্রলোকই যেচে পরিচয় করেছিলেন ওদের সঙ্গে। ওঁর প্রায় প্রতিটি কথাতেই চমকে উঠেছিল ওরা। কত কী জানেন ভদ্রলোক! ব্যবসার কাজে চষে বেড়ান গোটা পৃথিবী। ওদের দু-চার কথা শোনার পরেই বলেছিলেন : ব্যস, আর কিছু বলতে হবে না। ব্যবসা করে বড় হতে চান, এই তো? শুনুন, ব্যবসা করে যে কেউ বড় হতে পারে। দরকার শুধু জেদ, পরিশ্রম আর টিপ্কিপলিংয়েরসের। টিপস আমি আপনাদের দিয়ে দেব। কী করতে হবে! আপনাদের শুধু মন শক্ত রেখে টানা পরিশ্রম করে যেতে হবে, রাজী?
এ কথায় কে না রাজী হবে? চার বন্ধু একসঙ্গে লম্বা করে ঘাড় কাত করার পরে সুবিমলবাবু বলেছিলেন : ঠিক আছে, সামনের রোববার সকালে আপনারা আমার বাড়িতে চলে আসুন। ব্যবসার কথা একেবারে পাকা হয়ে যাবে।
সেই হিসেবেই আজ সুবিমলবাবুর বাড়িতে এসেছে চার বন্ধু। ভদ্রলোকও বেশ উৎসাহের সঙ্গে নানান কথা বলতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু কথা বেশিক্ষণ গড়ায়নি। উনি হঠাৎ থেমে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ওহ্! আজ টিভিতে দারুণ একটা বই আছে—কিপ্ষলিংয়ের জাঙ্গল বুক। দেখে নিন। ওটা আপনাদের ব্যবসার ব্যাপারেও কাজে লাগবে।’
ছবি দেখার সঙ্গে ব্যবসার কী সম্পর্ক? প্রশ্নটা চার বন্ধুর মাথাতেই খেলে গিয়েছিল, কিন্তু কেউ আর ও নিয়ে কোনও কথা তোলেনি। খানিকটা যেন কর্তব্যের খাতিরেই ছবি দেখতে বসে গিয়েছিল। কিন্তু তখন কে জানত যে অসাধারণ এই ছবিটা ওদের এভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলবে!
জঙ্গল নিয়ে রূপকথাগোছের একটা গল্প। কিন্তু এমন গল্প কী করে এত সত্যি হয়! মানবশিশু মোগ্লি নেকড়ের বাচ্চাদের সঙ্গে বড় হয়ে উঠল। সবাই মোগ্লির বন্ধু। শত্রু শুধু শের খান নামের বাঘটা। মোগ্লিকে খেয়ে ফেলার জন্যে ওর চেষ্টার অন্ত ছিল না। পারেনি ওর বন্ধুদের জন্যে। বন্ধুদের মধ্যে ছিল ভয়ঙ্কর চেহারার ব্ল্যাক প্যান্থার বাঘিরা, ছিল নেকড়েরা, ছিল স্লিপি ব্রাউন বিয়ার বালু। শেষে এই মোগ্লির হাতেই শেষ হল কেঁদো বাঘ শের খান।
ছবি শেষ হওয়ার পরে বেশ খুশির মেজাজে হাতের লম্বা সিগারেটে লম্বা দুটো টান মেরে সুবিমলবাবু বললেন, ‘কিপ্লিং আমার খুব প্রিয় লেখক, জাঙ্গল বুক আমার দারুণ প্রিয় বই। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারের ভেতর দিয়ে কিপ্লিং আমাদের সমাজের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছেন। তবে, এ সব তত্ত্বের মধ্যে আমি এখন যেতে চাইছি না। যা বলতে চাইছি—তা হল, কিপ্লিং আমাদের জঙ্গলটাকে খুব ভাল করে চিনেছিলেন। আমাদের জঙ্গল মানে আমাদের জঙ্গল। জানেন তো কিপ্লিং বোম্বেতে জন্মেছিলেন—
‘তাই?’
প্রশ্নের মধ্যে বিস্ময় মিশে থাকলে বক্তার কথা বলার আগ্রহ বেশ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ঝলমলে গলায় সুবিমলবাবু বললেন, ‘শুধু যে এখানে জন্মেছেন তা নয়, ওঁর ছেলেবেলার একটা অংশ এদেশেই কেটেছে। পড়াশুনো করতে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন, শেষে আবার ভারত। এখানে চাকরি করেছিলেন সাত বছর। ওঁর বইপত্তর আমার ভীষণ ভাল লাগে। কিন্তু পরে যখন জানলাম, উনি নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখক, তখন বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’
‘অবাক! কেন?’
উত্তরে সুবিমলবাবু খোলা-গলায় একটু হেসে নিলেন, তারপর বললেন, ‘আমি বইটই পড়তে একটু ভালবাসি, কিন্তু সিরিয়াস বই একেবারেই নয়। আমার ধারণা সব নোবেল পুরস্কার পাওয়া লেখকই সিরিয়াস লেখক। সুতরাং ওঁদের বই কখনও হাতে এসে পড়লে আমি মাথায় ঠেকিয়ে সরিয়ে রাখি। আলাদা বোধ হয় শুধু কিপ্লিং। মোগ্মোগলির গল্পটলির গল্পটা সত্যিই অসাধারণ। সব বয়েসের মানুষেরই ভাল লাগে। এই গল্পটা নিয়ে ফিল্ম হয়েছে দু-তিনটে—একটা তো কার্টুন। মোগ্লির ছবি দেখার পর একটা ছোট্ট মেয়ে বেশ একটা মজার কথা বলেছিল আমাকে। বলেছিল, ‘কাকু, তোমার গোঁফটা ঠিক শের খানের গোঁফের মত।’
শেষ কথাটা কোনও মতে শেষ করে আর একবার গলা ছেড়ে হাসলেন সুবিমল বাগ্চী।
দেখাদেখি ঘরের চারটি ছেলেও হাসল, তবে নিছক সায় দেওয়ার হাসি। ওদের মধ্যে আগের সেই উত্তেজনাটা ফিরে এসেছে। কোন ব্যবসার হদিস দেওয়ার জন্যে ভদ্রলোক এত ঘটা করে ডেকে এনেছেন ওদের?
এখানে আসার পরেই টিভির ছবি, তারপর তাই নিয়ে গল্প। আসল কথাটা হবে কখন!
সুবিমলবাবু সামনের চার শ্রোতার আসল প্রশ্ন আন্দাজ করার কোনও রকম চেষ্টার মধ্যেই গেলেন না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন ভদ্রলোক। ঘোরের মধ্যে থেকেই আগের কথার জের টেনে বললেন, ‘আমার মনে হয়, ভারতবর্ষের জঙ্গল আর জন্তুজানোয়ারই কিপ্লিংকে আসল পথটা চিনিয়ে দিয়েছে। শুধু কিপ্লিং কেন, আমাদের বনজঙ্গল, পশুপাখি সব সময়ই দারুণ সব গল্প বানাতে সাহায্য করেছে। এই যে পঞ্চতন্ত্র, আমাদের একেবারে নিজস্ব জিনিস ভাবা যায়! আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে লেখা। রাজা অমরশক্তির তিনটে আকাট ছেলেকে নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যে পঞ্চতন্ত্র লিখলেন বিষ্ণু শর্মা। বাঘ, সিংহ, খরগোস, গাধা, শেয়াল, বেড়াল, মাছ, ব্যাঙ ইত্যাদির গল্প। চমৎকার সব গল্প। সেই আমলেই গল্পগুলো গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রুতে অনূদিত হয়ে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বাস করুন, এইসব ঘটনার দিকে যত তাকাই, আমার একটা থিয়োরি তত পাকা হয়ে ওঠে।’
‘কী থিয়োরি?’
‘ভারতের জন্তুজানোয়ার, ভারতের বনজঙ্গল ফেল করেনি কখনও।’
‘ফেল করেনি! মানে?’
‘মানেটা খুব পরিষ্কার। ভারতবর্ষের বনজঙ্গল, জন্তুজানোয়ার বরাবরই মস্ত একটা বাজার পেয়েছে।’
এতক্ষণের এত কথাবার্তার মধ্যে এই প্রথম একটুখানি ব্যবসার গন্ধ পেল চার বন্ধু। কিন্তু এ কেমন ব্যবসা!
চৌকোগোছের মুখগুলো চট করে বোধ হয় কঠিন হতে পারে। সুবিমলবাবুর মুখ চৌকো। কঠিন মুখে কঠিন গলায় বললেন, ‘এই ব্যবসাটাই আপনাদের ধরতে হবে। আমার বিশ্বাস, এই ব্যবসায় মার নেই।’
চার বন্ধু নিজেদের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। ওদের মুখচোখ দেখলে যে-কেউ বুঝতে পারবে, বিষয়টা ওদের কাছে এখনও পর্যন্ত ধাঁধাই রয়ে গেছে।
সুবিমলবাবুর চোখদুটো আশ্চর্য রকমের জ্বলজ্বলে। ওই চোখ দিয়ে উনি বোধহয় যে-কারও মনের কথা পড়ে ফেলতে পারেন। চার বন্ধুর মুখের ওপর একবার দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘বুঝতে পারছি, কিছুই বুঝতে পারেননি। আচ্ছা, কৌশিকের তো বেশ লেখার হাত আছে। কাগজে কয়েকটা গল্পও বেরিয়েছে। তা, লেখককে এবার অন্য একটা ব্যাপারে কলম ধরতে হবে। আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে ছবি তোলার শখ নেই কারও?’
উত্তরে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বজয় বলল, ‘তাপস, তাপসের ছবি তোলার হাত খুব ভাল।’
সুবিমলবাবু নিশ্চিন্ত ভঙ্গি করে বললেন, ‘ভেরি গুড তাহলে কৌশিক আর তাপস একটা সেট। বাকি সেটে থাকছে বিশ্বজয় আর সুমন।’
কিসের সেট! একটু আগের ওই ধাঁধাটা চার বন্ধুর কাছে এখন বোধহয় আরও জটিল হয়ে গিয়েছিল।
সুবিমলবাবু ওদের মনের অবস্থাটা আন্দাজ করে নিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন, তারপর বললেন, ‘লেখক আর ক্যামেরাম্যানকে যেতে হবে জঙ্গালে। জঙ্গল আর জন্তুজানোয়ার নিয়ে ছবি তুলতে হবে। সঙ্গে থাকবে টেক্সট। জঙ্গলজীবন নিয়ে দুর্দান্ত একটা বই বার করব আমরা। বাকি দুজনের কাজ হল শহরের মধ্যিখানে ভাল একটা ঘর খুঁজে নিয়ে ট্রাভেল এজেন্সি খোলা। দেশ বিদেশ, বিশেষ করে দেশবিদেশের জঙ্গল আর জানোয়ার দেখাতে হবে পর্যটককে। কী, কেমন ব্যবসা?’
চার বন্ধুর মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। এটা আবার কী ধরণের ব্যবসা! জন্তুজানোয়ারের ছবির বই আর ট্রাভেল এজেন্সি—এসব নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
সুবিমলবাবু আবার যেন আগের সেই ঘোরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। নিজের মনে কথা বলার ভঙ্গিতে বললেন, ‘খুব ভাল স্ট্যান্ডার্ডের ছবির বই বার করা বেশ কঠিন কাজ। তবে সেটা আমরা করবই। এখন তো আমাদের দেশে ছাপার কাজে বেশ উন্নতি হয়েছে। একটা জিনিস অবশ্য তেমন ভাল নয়। ভাল নয় তেমন নজর দেওয়া হয়নি বলেই। সেটা হল বাইন্ডিং। আমরা কিন্তু এই বাঁধাইয়ের দিকে বেশ নজর দেব।’
উৎসাহে কেমন যেন টগবগ করছিলেন সুবিমলবাবু, কিন্তু শ্রোতাদের মুখ কালো হয়েই ছিল। ভদ্রলোক থামতেই থমথমে গলায় সুমন বলল ‘কিন্তু এসব ব্যবসার কিছুই তো আমরা জানি না।’
‘আগে থেকে কেউই কিছু জানতে পারে না। পরে অস্তে আস্তে শিখে নেয়। আমি আপনাদের সঙ্গে এক্সপার্টদের দিয়ে দেব। কিছু অসুবিধে হবে না। আপনাদের সঙ্গে জঙ্গলে যাবে প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান। লেখা ঘষামাজা করার কাজও করবে পাকা লোক। ট্রাভেল এজেন্সি চালাবার কাজেও গোড়ার দিকে সাহায্য করবে অভিজ্ঞ লোকজন। পাসপোর্ট, ভিসা বার করা, ফরেন এক্সচেঞ্জ জোগাড় করা, ট্যুর প্রোগ্রাম বানানো, কম ঝঞ্ঝাটের নাকি! আপনাদের শুধু খাটতে হবে, যাকে বলে ভালবাসার খাটুনি। কী, রাজী তো?’
‘কিন্তু—কিন্তু এসব ব্যবসায় তো বিরাট টাকাপয়সার দরকার।’
বিশ্বজয়ের কথার উত্তরে রহস্যময় একটা হাসি ফুটে উঠল সুবিমলবাবুর মুখে। তারপর উনি মুখ খুললেন, ‘কত টাকা ইনভেস্ট করা দরকার? আন্দাজ করুন তো।’
‘তা, মনে হয়, লাখদুয়েক তো লাগবেই।’
সুবিমলবাবুর মুখের খুব সরু-সরু রেখাগুলো কেমন যেন জট পাকিয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘আমি যে স্কেলে ভাবছি, তাতে মনে হয়—লাখবিশেক না হলে ঠিক সুবিধে করা যাবে না।’
‘বিশ লাখ!’
চার বন্ধুই একসঙ্গে চমকে উঠেছিল। তারপর চারজনেরই মনে হয়েছিল, ভদ্রলোক নিষ্ঠুর একটা রসিকতা করার জন্যে ওদের আজ এখানে ডেকে এনেছেন।
সুবিমলবাবু ওদের মুখ দেখে নির্ঘাত মনের কথাটা পড়ে ফেলেছিলেন। রহস্যময় ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি কিন্তু পরোপকার করার জন্যে আপনাদের বাড়িতে ডেকে আনিনি। এ দুটো ব্যবসা খোলার পেছনে আপনাদের চাইতে আমার স্বার্থ ঢের বেশি। বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক, কেননা পুরো টাকাটা উপস্থিত আমিই ইনভেস্ট করব।’
‘পুরো টাকা! আপনি!’
সদয় হাসি ফুটে উঠল সুবিমলবাবুর মুখে। ‘তাছাড়া উপায় কী? আপনাদের কাছে তো অত টাকা এখন হবে না। তবে একটা কথা—।’ একটা কথা শোনার জন্যে চারটে ঝলমলে মুখ তাকিয়েছিল সুবিমলবাবুর দিকে। উনি বললেন, ‘ব্যবসার কাগজপত্র, মানে আপনাদের সঙ্গে আমার, তৈরি হবে বছরখানেক বাদে। তদ্দিনে মনে হয়, ব্যবসা দুটো দাঁড়িয়ে যাবে। এই এক বছর আপনাদের আমি একটা অ্যালাউন্স দেব। মাথাপিছু হাজার চারেক টাকা দিলে হবে?’
চার হাজার! এখন থেকেই প্রতি মাসে!
খুশিতে ঝকঝক করে উঠেছিল চারজনের মুখ। একজনের মনে হল, গোপনে ওরা নির্ঘাত আলাদীনের প্রদীপ ঘষে দিয়েছে। এখন ইচ্ছাপূরণ করতে দৈত্য এসেছে সামনের এই ভদ্রলোকটির চেহারা ধরে।
সুবিমলবাবু শূন্যে বুড়ো আঙুল ভাসিয়ে বললেন, ‘ডান’। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে ব্যাঙ্কের চেকবই বার করলেন।
সত্যিই বোধহয় প্রদীপের দৈত্যের কাণ্ডকারখানা। কাজকর্ম এগোতে লাগল অবিশ্বাস্য গতিতে।
তিন মাসের মধ্যে বেরিয়ে গেল ‘নিউ জাঙ্গল বুক অব ইন্ডিয়া।’ অসাধারণ বই, পাতায় পাতায় দুর্দান্ত সব ছবি। বেশ মোটা বোর্ডের কভার। দাম পাঁচ পাউন্ড। ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম ‘দি সেভেন সিজ।’ উড স্ট্রিটে বিশাল বাহারি অফিস। দেশ-বিদেশের নানা পত্র-পত্রিকায় বই আর এজেন্সির বিস্তর বিজ্ঞাপন পড়েছে। সেইজন্যেই বোধহয় ব্যবসা দুটো জমে উঠেছিল চট করে। সুবিমলবাবুর পরামর্শ নিয়ে ব্যবসা চালায় চার বন্ধু।
॥ দুই ॥
একটু বড় মাপের ঘটনা হলেই অদিতি দিন তারিখের কথা ঠিক-ঠিক বলে দিতে পারে। যেমন গত দুটো রোববারের আগের রোববার এই সময় আমরা তিন্নির বিয়েতে হই-হই করছি। কিংবা, আজ এক তারিখ তো—আগের মাসের এক তারিখে আমরা ছিলাম শিবপুরে, ছোড়দির বাড়িতে। এইভাবে অক্লেশে কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া অদিতির কাছে কোনও ব্যাপারই নয়। এগিয়েও যেতে পারে ও। যেমন, সামনের বুধবার এইসময় আমরা পুরীর ট্রেনে না? কিংবা আগামী বেস্পতিবার এইসময় তো আমরা শম্পাদের সঙ্গে অকাদেমিতে থিয়েটার দেখছি, তাই তো?
কিন্তু এই অদিতি এখন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও পরশুদিনের আগাম ছবিটা কিছুতেই দেখতে পেল না। ছবিটার কথা ভাবতে গেলে কেমন যেন রোমাঞ্চ জাগে, তারপরেই সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়। পরশুদিন ও শান্তনুর সঙ্গে জেনিভা যাচ্ছে। জেনিভা থেকে জুরিখ। তারপর লন্ডন, প্যারিস হয়ে ফেরা। সাতদিনের ট্রিপ। তার মধ্যে দু’দিন শান্তনুর সেমিনার, বাকি পাঁচদিন মনের সুখে বেড়ানো। বইতে, সিনেমায় ইউরোপের অনেক ছবি ও দেখেছে ; কিন্তু কোনও ছবিটাই এখন ওর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠছিল না। শুধু উত্তেজনা, বিদেশে বেড়াবার কথা ভাবলেই সারা শরীরে মৃদু একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছিল। অন্যান্য দিন বিছানায় শোওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়, কিন্তু আজ ঘুম যেন ত্রিসীমানার মধ্যে ছিল না।
চিৎ হয়ে শুয়েছে অদিতি। বুকের ওপর আধখোলা বই, তবে বইয়ের হরফগুলো চোখের সামনে দিয়ে পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মাথায় রাজ্যের এলোমেলো চিন্তা।
রাত এগারোটা। গোটা পাড়া শান্ত হয়ে গেছে। শান্তনুর আজ শুতে একটু রাত হবে। হাতে অফিসের কয়েকটা জরুরী কাজ, বাইরে যাওয়ার আগে সেরে যেতে হবে।
একটা কাজ শেষ করে আর একটা কাজ ধরার মুখে শান্তনুর চোখ গেল বিছানার দিকে। হাতে বই নিয়ে শুতে যাওয়া অদিতির বরাবরের অভ্যাস। কিন্তু নামেই বই পড়া। একটুখানি পড়তে না পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। হাতের বই ছিটকে পড়ে বিছানায় কিংবা মেঝেতে। আজ ওর হাতে ওই দুটো নতুন বইয়ের একটা।
অদিতি কি ঘুমিয়ে পড়েছে? নির্ঘাত ঘুমিয়েছে। বই হাতে ওর পক্ষে এতক্ষণ জেগে থাকা অসম্ভব। এইরকম কিছু একটা ভেবে নিয়ে অদিতির হাতে-ধরা বইটা সরিয়ে রাখতে এসেছিল শান্তনু। কিন্তু অবাক কাণ্ড, অদিতি আজ ঘুমোয়নি এখনও!
শান্তনু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তাজ্জব ব্যাপার! তুমি ঘুমোওনি! নাকি একঘুম দিয়ে উঠলে?’
অদিতি একটু হেসে বলল, ‘বইটা খুব ইন্টারেস্টিং।’
‘আমি তো বইটাই সরিয়ে রাখতে এসেছিলাম।’
‘তুমি কি ঘুমোবে এখন?’
‘উঁহুঁ। আমাকে আরও ঘণ্টাদেড়েক জাগতে হবে।’
‘তাহলে আমি আর একটু পড়ি।’
বাধ্য ছেলের মত শান্তনু ফিরে গেল ওর কাজের টেবিলে। বইয়ের পাতায় আবার চোখ ঘুরতে লাগল অদিতির। নিস্তব্ধ রাত ফের গড়াতে লাগল নিজের নিয়মে। কিন্তু বেশিক্ষণ গড়াতে পারল না এভাবে। হঠাৎ বিকট একটা শব্দে চমকে উঠল শান্তনু।
শক্ত মলাটের মোটা বইটা অদিতির হাত থেকে আছড়ে পড়েছে মেঝের ওপর। নিঝুম রাতে এই শব্দটাই অনেকখানি। ওই শব্দে অদিতিরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।
মেঝে থেকে বইটা তুলতে এসে আর একবার চমকাল শান্তনু। এ কী! বইয়ের মলাট ফেটে গেছে, আর মলাটের ভেতর থেকে গুঁড়ো-গুঁড়ো কী বেরিয়ে আসছে এগুলো!
অদিতির বোধহয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে, আর তা বুঝি অত্যন্ত প্রখর। ও ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, ‘কী জানি বাবা, ব্যাপারটা আমার কিন্তু একেবারেই ভাল ঠেকছে না। তুমি চিন্ময়কে কাল একটা ফোন করো তো।’
চিন্ময় এই পরিবারের গোয়েন্দা-বন্ধু। গোয়েন্দা বন্ধুর কথা অদিতি মনে করিয়ে দিতেই শান্তনুর মাথায় অন্য একটা তরঙ্গ খেলে গেল। সত্যিই তো, ব্যাপারটাকে খুব একটা নির্দোষ ভাবার কোনও কারণ নেই। ও বলল, ‘চিন্ময় তো রাত দুটো পর্যন্ত পড়াশুনো, কাজকর্ম করে। ওকে এখন ধরাই সহজ। দাঁড়াও।’
ডায়াল ঘোরাতেই পাওয়া গেল চিন্ময়কে। সব শুনে চিন্ময় বলল, ‘আমি এক্ষুণি আসছি। অসুবিধে হবে না তো?’
‘না না, কী আশ্চর্য, অসুবিধে হবে কেন!’
মিনিট কুড়ির মধ্যে চিন্ময় ওর লাল মারুতি চেপে হাজির হল শান্তনুদের ফ্ল্যাটে। তারপর কয়েক মুহূর্ত পাউডারের মত ওই গুঁড়োর ওপর ম্যাগনিফাইং গ্লাস ঘুরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই ।’
‘কী ?’
গোয়েন্দা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পকেট থেকে খুব ছোট্ট পাতের ধারাল একটা ছুরি বার করে খুব আস্তে দুটো বইয়ের মলাটের ধারের কাগজ একটুখানি ছাড়িয়ে নিল। তারপর মেঝের ওপর কাগজ বিছিয়ে বইদুটো ঠুকতেই পাউডার বেরিয়ে এল অনেকটা।
গোয়েন্দার কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ। চাপা গলায় নিজের মনে কথা বলার ভঙ্গিতে বলল, ‘সাঙ্ঘাতিক!’
ওই শব্দটা কানে যেতেই অদিতি বলে বসল, ‘আমার কিন্তু ভীষণ ভয় করছে।’
সাদা গুঁড়ো খুব যত্ন করে একটা কাগজে মুড়ে নিয়ে চিন্ময় বলল, ‘এবার বল বইদুটো তোমাদের হাতে ঠিক কীভাবে এল?’
গোয়েন্দার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু শান্তনু কিন্তু পাকচক্রে এমন গোলমেলে ব্যাপারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ফলে ওর অস্বস্তি শুরু হয়ে গিয়েছিল।
‘আশ্চর্য! এর মধ্যে যে এত বড় একটা···আমি তো···।’
ছোট একটা নোটবুক আর ডটপেন বার করে বন্ধুকে এবার সরাসরি প্রশ্নোত্তরের মধ্যে নিয়ে এল গোয়েন্দা। ‘বইদুটো কোত্থেকে পেয়েছ?’
ট্রাভেল এজেন্সি থেকে। ওখান থেকেই তো আমরা আমাদের টিকিট কেটেছি।’
‘কী নাম এজেন্সির?’
‘দি সেভেন সিজ।’
‘কোথায় এটা?’
‘উড স্ট্রিটে।’
‘ওখানেই বইদুটো দিয়ে দিয়েছিল?’
‘না-না, ফ্ল্যাটে এসে দিয়ে গেছে। কাল।’
‘কে ?’
‘এজেন্টের অফিসে একদম সামনের কাউন্টারে খুব ফার্সামত যে ছেলেটা বসে—।’
‘নাম মনে আছে?’
‘বিশ্বজিৎ না বিশ্বজয়···ঠিক মনে পড়ছে না···অল্পবয়সী—।’
‘কী বলল এসে?’
‘খুব সহজ কথাবার্তা। তখন কী করে বুঝব যে এর মধ্যে এত ঘোরপ্যাঁচ!’
গোয়েন্দা কথা শুনতে শুনতে নোটবুকে কয়েকটা কথা দ্রুত লিখে নিয়েছিল। ডটপেনের পিছন দিকটা এবার গালে চেপে ধরে বলল, ‘ছেলেটা এসে কী বলেছিল তোমাকে?’
‘ওই তো এসে বলল—লন্ডনে কোথায় উঠবেন আপনারা? কিছু ঠিক হয়েছে? বললাম, হ্যাঁ ; গোল্ডেন স্ক্রিনে, নর্থ লন্ডনে। কেন? তখন বলল, দয়া করে যদি একটা উপকার করেন! কী উপকার? বলল—আমার মামাতো ভাইবোনের জন্যে দুটো বই পাঠাব আপনার হাতে। আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। আমার ছোটমামা কিংবা অন্য কেউ টেলিফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলে আপনার অ্যাপার্টমেন্টে এসে বইদুটো নিয়ে যাবে। বললাম, এতে অত কিন্তু কিন্তু করার কী আছে, নিয়ে যাব বই। ছেলেটা তখন বই দিয়ে আমার লন্ডনের ঠিকানা নিয়ে চলে গেল মামাকে টেলিফোন করে জানাবে বলে।’
গোয়েন্দা হঠাৎ নোটবই আর ডটপেন এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার লন্ডনের পুরো ঠিকানাটা এখানে লিখে দাও তো।’
লিখে দিল শান্তনু।
‘লন্ডনে কবে পৌঁছচ্ছ?’
‘পাঁচ তারিখ।’
‘থাকবে কদিন?’
‘দু-দিন,পাঁচ আর ছয়।’
লন্ডনের ঠিকানার পাশে তারিখ দুটোও নোট করে নিল গোয়েন্দা। তারপর নোটবুক আর ডটপেন পকেটে ঢুকিয়ে বলল, ‘ব্যস, ঠিক আছে। উপস্থিত এতেই চলে যাবে।’
কিন্তু সামান্য এই ক’টা কথা বলে একেবারেই স্বস্তিবোধ করছিল না শান্তনু। ছটফটে গলায় বলল, ‘কী করব এবার?’
‘কী আবার! যাও গিন্নিকে নিয়ে সাহেবদের দেশ থেকে ঘুরে এস। ফিরে এলে একদিন আড্ডা মারতে হবে জমিয়ে।’
কঠিন পরিস্থিতিতে হালকা গলায় কথা বলা চিন্ময়ের বরাবরের অভ্যাস। কিন্তু অন্যের বিপদ আর নিজের বিপদের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক থাকে। কেমন যেন ডুবে যাওয়া মানুষের গলায় শান্তনু বলল, ‘কিন্তু এই বইদুটো নিয়ে কী করব এখন?’
হেসে উঠল গোয়েন্দা। ‘এখন কিছু করার নেই। যথাসময়ে লন্ডনের ঠিকানায় যে লোকটা আসবে তার হাতে তুলে দিলেই হবে।’
হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে শান্তনু বলল, ‘এর পরেও বইদুটো তুমি উটকো একটা লোকের হাতে তুলে দিতে বলছ।’
‘উটকো হতে যাবে কোন্ দুঃখে। তোমার ট্র্যাভেল এজেন্টের রেফারেন্স নিয়েই তো আসবে।’
‘কোনও দরকার নেই। ওই বইও আমি আর ছুঁচ্ছি না। টেলিফোন করলে ভাগিয়ে দেব সঙ্গে সঙ্গে।’
গোয়েন্দার চোয়াল কঠিন আর দৃষ্টি ধারাল হয়ে উঠল এবার। ‘পাগলামো করো না শান্তনু। আমি যা বলছি সেটা তোমার করা দরকার—ইনভেস্টিগেশনের প্রয়োজনেই বলছি। বইদুটো এখন আমি নিয়ে যাচ্ছি। মলাট মেরামত করে কাল সকালে পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে।’
গোয়েন্দার গলার স্বরে বেশ একটা আদেশের ভাব ছিল। আর শান্তনুর চোখমুখ দেখে যে-কেউ এখন বুঝতে পারবে যে, ওই আদেশ পালনে ওর কোনও আপত্তি নেই।
অদিতি এতক্ষণ চুপচাপ দুই বন্ধুর কথা শুনে যাচ্ছিল, ওরা থামতেই চিন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটু কফি করি।’
হেসে উঠে জবাব দিল চিন্ময়, ‘এখন থাক, পরে বিলেতটিলেতের গল্প শুনতে শুনতে খাওয়া যাবে। অনেক রাত হয়ে গেছে, এখন তোমরা ঘুমোও। আমি কাটছি।’
সাদা গুঁড়োর মোড়কটা জ্যাকেটের পকেটে ঢোকাল গোয়েন্দা। তারপর বইদুটো হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘ভারি সুন্দর বই কিন্তু। যেমন কাগজ তেমনি ছাপা। ছবিগুলোও চমৎকার। বাঁধাইও দারুণ। এত মোটা বোর্ডের মলাট আর কোনও বইয়ের দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বইয়ের নামটাও বেশ—নিউ জাঙ্গল বুক অব ইন্ডিয়া।
বগলে দুটো বই নিয়ে মাঝরাত্তিরে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লাল মারুতির দিকে এগিয়ে গেল গোয়েন্দা।
॥ তিন ॥
‘দি সেভেন সিজ’ অফিসের একেবারে সামনের কাউন্টারে খুব ফর্সামত যে ছেলেটি বসে তার নাম বিশ্বজয়, বিশ্বজয় ভৌমিক। কাস্টমাররা নানা ধরণের খোঁজখবর নিতে ট্রাভেল এজেন্সিতে আসে, বিশ্বজয়ের কাজ হল সেইসব প্রশ্নের প্রাথমিক জবাবগুলো দেওয়া। দফতরের গুণে ওর চোখকান দুটোই এখন বেশ ধারাল হয়ে উঠেছে। শান্তনু আর অদিতিকে হঠাৎ ও ওখানে আসতে দেখে একটু যেন অবাক হয়ে বলল, ‘আরে, আপনারা?’
অদিতি সুন্দর করে হেসে বলল, ‘ঘুরে এলাম।’
‘সে কি, এর মধ্যে।’
‘ট্রিপ তো মোটে সাতদিনের। যাতায়াতের টিকিট তো আপনারাই দিয়েছেন। মনে নেই?’
সামান্য একটু বিব্রত হল বিশ্বজয়। ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, কেন মনে থাকবে না! আসলে ট্রিপ তো খুব ছোট। সাতটা দিন দেখতে না দেখতেই কেটে যায়। তা, কেমন বেড়ালেন বলুন?’
‘খুব ভাল।’
‘যাতায়াতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?’
‘ন্না, একেবারেই নয়।’
‘ফিরেছেন কবে? গতকাল বোধহয়?’
‘হ্যাঁ, কালকেই।’
টেবিল থেকে ছোট একটা পেপারওয়েট হাতে তুলে নিয়ে বিশ্বজয় জিজ্ঞেস করল, ‘তা, এদিকে কোনও কাজে—নাকি···?’
এবার উত্তর দিল শান্তনু, ‘হ্যাঁ কাজেই, খুব জরুরী কাজ বলতে পারেন।’
‘কী রকম?’
‘আপনিই আমাকে বিপদে ফেলেছেন।’
‘বিপদে।’
‘ওই যে নিউ জাঙ্গল বুক অব ইন্ডিয়া দিয়েছিলেন—।’
বিশ্বজয় একটু যেন চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন, আপনার লন্ডনের ঠিকানায় বই নিতে কোনও লোক আসেনি?’
‘এসেছিল, নিয়েও গেছে। কিন্তু ওখানে আমার এক বন্ধুর ছোট মেয়ে ওই বইটা দেখে নেওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি শুরু করে দিয়েছিল। আমি মেয়েটিকে কথা দিয়েছি, ফিরে গিয়েই তোমার জন্যে একটা বই পাঠিয়ে দেব। এসে শুনি আমাদের সিস্টার কনসার্ন থেকে একটা টিম লন্ডনে যাচ্ছে, তা আমি ওদের একজনের হাতে আপনাদের এক কপি বই ওই মেয়েটির জন্যে পাঠাতে চাই। বইটা তো আপনাদেরই পাবলিকেশন, তাই না?’
বিশ্বজয় মাথা চুলকে বলল, ‘হ্যাঁ, আমাদেরই। তবে ও বই তো এখান থেকে বিক্রি হয় না।’
‘দু-তিনটে দোকানে খোঁজ করেছিলাম, পাইনি। আজ আবার শনিবার বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। প্লিজ, একটা কপি আপনাকে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে দিতে হবে। আমি তো আপনার কথা রেখেছি।’
এই ধরণের কথার উত্তরে কারও পক্ষেই বোধহয় সরাসরি ‘না’ বলা সম্ভব নয়। বিশ্বজয় আর একবার মাথা চুলকে বলল, ‘দাঁড়ান, দেখছি।’
কোণের দিকে কাচের দেওয়াল-ঘেরা ছোট্ট একটা জায়গা আছে, তার মধ্যে লাল রঙের একটা টেলিফোন। কাচের আড়াল থেকে একটা টেলিফোন সেরে এসে বিশ্বজয় বলল, ‘আপনাদের একটা টিম লন্ডনে যাচ্ছে, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘ক’ জনের টিম?’
‘পাঁচজনের।’
বিশ্বজয় আর একবার মাথা চুলকে বলল, ‘আপনার বইটা আমরা দিয়ে দিতে পারব। পে করতে হবে না, আমাদের এজেন্সির তরফ থেকে গিফট হিসেবে দেব। তবে, কাইন্ডলি যদি ছোট একটা উপকার করেন।’
‘বলুন।’
‘লন্ডনের একটা বেঙ্গলি ক্লাবকে আমাদের পাঁচটা বই ডোনেট করার কথা, আপনি যদি আপনার টিমের হাত দিয়ে—।কোথাও গিয়ে দিয়ে আসতে হবে না। ওঁদের লন্ডনের ঠিকানাটা দিয়ে দিন, ক্লাবের লোক গিয়ে নিয়ে আসবে। আমরা ফোন করে দেব।’
শান্তনু গলায় অনেকটা জোর এনে বলল, ‘এভাবে বলছেন কেন! ওদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভাল— আর এ তো অত্যন্ত সামান্য ব্যাপার, বই নিয়ে যেতে কেউ আপত্তি করবে না। দিন ওগুলো।’
‘এখানে তো নেই, আমি কাল সকালে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেব।’
‘কাল! কাল নিয়ে তো কোনও লাভ হবে না। ওরা আজ রাতেই বোম্বে যাচ্ছে। ওখান থেকে কাল সকালের এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ধরে লন্ডনে যাবে। বইগুলো এখনই পাওয়া দরকার।’
‘এখন! দাঁড়ান দেখছি। আর একবার ফোন করে—।’
নিজের মনে বিড়বিড় করার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল বিশ্বজয়। কিন্তু শান্তনু ওর যাবতীয় সংশয় উড়িয়ে দেওয়ার গলায় বলল, “প্লিজ এখন আর ফোনটোনের মধ্যে যাবেন না। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, চলুন। জায়গাটা কদ্দূর এখান থেকে? আমি আপনাকে আবার ছেড়ে দিয়ে যাব এখানে।’
শান্তনুর কথার মধ্যে এমনই একটা ধাক্কা ছিল যে বিশ্বজয় ‘ঠিক আছে, চলুন’ বলে বেরিয়ে এল।
উল্টোদিকের রাস্তার ধারে লাল মারুতি দাঁড়িয়ে ছিল। তিনজনে গাড়িতে ওঠার পরে শান্তনু বলল, ‘চিন্ময়, তোমাকে আর একটু খাটাব, এক জায়গা থেকে কয়েকটা বই এনে—ওহ্! তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই—এ হচ্ছে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিন্ময়, আর এ হল সেভেন সিজের বিশ্ব-বিশ্ব—।’
বিশ্বজয় হাতদুটো একটুখানি ওপরে তুলে বলল, ‘আমার নাম বিশ্বজয় ভৌমিক।’
ড্রাইভারের সিটে গোয়েন্দা। ও নিচু গলায় বলল, ‘কোনদিকে যাব?’
উত্তরে বিশ্বজয় জানাল, ‘সোজা গিয়ে ডানদিকে।’
এইভাবে কিছুক্ষণ সোজা আর ডানদিক বাঁদিক করার পরে গাড়ি এসে দাঁড়াল ছোট একটা দোতলা বাড়ির সামনে। বাড়ির সামনে চমৎকার একটা বাগান। বাগানের গেটে পেতলের হরফে সুবিমল বাগচীর নাম লেখা।
বিশ্বজয় ‘আপনারা একটু বসুন’ বলে বাগান পেরিয়ে বাড়ির দেওয়ালের কলিংবেলের বোতামে আঙুল রাখল।
দরজা খুলে গেল একটু বাদে, আর ঠিক তক্ষুণি বিশ্বজয় অবাক হয়ে দেখল গাড়ির তিনজন ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
অচেনা লোকদের হঠাৎ একেবারে বাড়িতে নিয়ে হাজির হওয়ার জন্যে সুবিমলবাবু বিরক্ত চোখে বিশ্বজয়ের দিকে তাকালেন। কিন্তু যাঁরা খুব দ্রুত মনোভাব পাল্টাতে পারেন ভদ্রলোক তাঁদের একজন। অসন্তুষ্ট হওয়ার পরেই ওঁর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল। একটু আপ্যায়নের ভঙ্গিতে অচেনা অতিথিদের বললেন, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’
বসার ঘরে টিভি চলছিল। টিভিতে রঙিন ছবি। সুবিমলবাবু অতিথিদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার খুব প্রিয় ছবি—কিপ্লিংয়ের জাঙ্গল বুক। ক্যাসেট করে রেখে দিয়েছি, মাঝেমধ্যে দেখে থাকি। এটা লাস্ট সিন, খুব এক্সাইটিং।’
সুবিমলবাবু টিভি বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, চিন্ময় ওঁকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না না চলুক, শেষটা সত্যিই দারুণ!’
জঙ্গলের ছোট্ট ছেলে মোগ্লির সঙ্গে পাজি বাঘ শের খানের ভয়ঙ্কর এক লড়াই শুরু হয়ে গেছে। একদিকে প্রকাণ্ড বাঘ, অন্যদিকে ছুরি হাতে অল্পবয়সী একটা ছেলে। শেষ জানা থাকলেও এই ধরণের লড়াইয়ে অল্পবিস্তর ছমছমে ভাব থেকেই যায়। সেই ছমছমে ভাবের মধ্যেই একসময় শেষ হল লড়াই। পাজি বাঘ মরল মোগ্লির হাতে। জঙ্গলে আবার শান্তি ফিরল, তারপর স্ক্রিনে ফুটে উঠল ‘দি এন্ড’।
টিভি বন্ধ করতে করতে সুবিমলবাবু বললেন, ‘ক্যাসেট করে রেখেছি। যতবার দেখি ততবারই কিন্তু ভাল লাগে। দুর্দান্ত বই।’
ওঁর কথায় সায় দিল সবাই।
সুবিমলবাবু শান্তনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনাদের বই আনতে লোক পাঠিয়ে দিয়েছি গোডাউনে, এক্ষুণি এসে যাবে।’
বলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গাট্টাগোট্টা চেহারার একটা লোক বইয়ের দটো প্যাকেট নিয়ে হাজির হল। একটা বই সুন্দর গিফ্ট প্যাকেটে মোড়া, অন্য পাঁচটা বই ব্রাউন পেপারে জড়ানো।
সুবিমলবাবু গিফ্ট প্যাকেটটা শান্তনুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা এজেন্সির তরফ থেকে আপনার উপহার। আর এই পাঁচটা বই আপনাদের ওই টিমের হাতে দিয়ে লন্ডনে পাঠাবার জন্যে। এটাকে কিন্তু বাড়তি একটা বোঝা বানাবার দরকার নেই। টিমে তো পাঁচজন মেম্বার। প্রত্যেকের হাতে একটা করে দিয়ে দেবেন। যে যার ব্যাগে ঢুকিয়ে নেবেন। পরে লন্ডনের ঠিকানা থেকে বেঙ্গলি ক্লাবের লোক এসে নিয়ে যাবে। কোনও অসুবিধে হবে না তো?’
‘না-না, একেবারেই নয়।’
আচ্ছা, এবার ওঁদের লন্ডনের ঠিকানাটা বলুন। কোথায় উঠছেন ওঁরা।
‘আমরা যেখানে উঠেছিলাম সেখানেই। ঠিকানাটা তো বিশ্বজয়বাবুর কাছে আছে। আছে না?’
বিশ্বজয় একপাশে মাথা কাত করে জানাল, ‘আছে।’
চিন্ময় হঠাৎ ওই পাঁচটা বই হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘বইগুলোর কিন্তু বড্ড দাম!’
ডান হাতটা দু-দিকে নাড়িয়ে প্রতিবাদ জানালেন সুবিমলবাবু, ‘না-না, বরং বলা যেতে পারে প্রোডাকশনের তুলনায় দাম বেশ সস্তা। পাঁচ পাউন্ড, তার মানে আমাদের টাকায় এখন শ দেড়েক টাকা। এই ধরণের একটা বিলিতি বই কিন্তু কিছুতেই তিনশো টাকার কমে পাবেন না।’
বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠল গোয়েন্দা চিন্ময়ের মুখে। ‘আমি কিন্তু ওই দামের কথা বলছি না।’
কয়েকটা ভাঁজ পড়ল সুবিমলবাবুর কপালে। ‘তবে কোন্ দামের কথা বলছেন?’
গোয়েন্দার হাসি হঠাৎই বেশ জটিল হয়ে উঠেছিল। ‘আসল দামের কথা বলছি।’
‘আসল দাম মানে!’
‘ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে আপনার এক-একটা বইয়ের দাম লাখ পঞ্চাশেক হবে, না?’
কথা শুনে ঘরের সবাই চমকে উঠেছিল। চমকালেন না শুধু সুবিমল বাগচী। কিন্তু ওঁর কপালের ভাঁজের সংখ্যা দ্বিগুণ আর চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক রকমের ধারাল হয়ে উঠেছিল। রাগী গলায় উনি কেটে কেটে বললেন, ‘কী যা তা বলছেন আপনি?’
‘যা তা হবে কেন, এ তো নারকোটিক্স সেন্ট্রাল ব্যুরোর এক্সপার্টের হিসেব। আপনার প্রতিটি জাঙ্গল বুকের দুই মলাটের ভেতরে প্রায় সাতশো গ্রাম ব্রাউন সুগার ধরে।’
সুবিমল বাগচীর দু-চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে পড়ছিল। চোয়ালের দুটো হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কে?’
‘আজ্ঞে আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি গোয়েন্দা।’
ব্যঙ্গের একটা হাসি ফুটে উঠল সুবিমল বাগচীর ঠোঁটে। ‘শখের?’
মৃদু প্রতিবাদ করার ভঙ্গিতে চিন্ময় বলল, ‘শখের গোয়েন্দা কথাটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। আমি নিজেকে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর বলতেই ভালবাসি।’
হা-হা করে হেসে উঠলেন নিউ জাঙ্গল বুকের মালিক। ‘আমিও শখের টিকটিকি। আর আমি খুব ভালভাবে জানি, টিকটিকি অত্যন্ত নিরীহ প্রাণী। অনেকের ধারণা টিকিটিকির বিষ আছে। খাবারদাবারে পড়লে সে সব বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি জানি, টিকটিকি নির্বিষ—ঠিক শখের টিকটিকির মতই।’
সুবিমল বাগচীর কথায় চিন্ময়ের বোধহয় একটু চটে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওর কোনও ভাবান্তর হল না। ঝলমলে মুখচোখ দেখে মনে হবে, কথাটা ওর কানেই যায়নি। সুতরাং উল্টো ফল ফলল। সুবিমল বাগচী ওঁর ঝাঁটার কাঠির মত গোঁফে একবার আঙুল বুলিয়ে নিয়ে ধারাল গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইয়ের মলাটের মধ্যে ড্রাগ পাচার করার গল্পটা আপনার মাথায় এল কী ভাবে?’
‘গল্প তো নয়, সত্যি ঘটনা। তবে আমার দেখাটা হয়েছে ঘটনাচক্রে প্রথম দেখে অদিতি, তারপর শান্তনু, তারপরে আমি। তারপরেরটা আমার পেশাগত কাজ। শান্তনুর লন্ডনের ঠিকানায় আপনাদের কনট্যাক্টম্যান শশী প্যাটেল বই নিতে এসে ধরা পড়েছে ইন্টারপোলের হাতে। ইন্টারপোলকে আমিই খবর দিয়েছিলাম। সাহেব পুলিশের খোঁচা খেয়ে প্যাটেল সব কিছুই বলতে বাধ্য হয়। আজ ভোর রাতেই আপনাদের গুজরাটের হেড অফিসে রেড হয়েছে। তবে আপনাদের বাহাদুরি আছে। ইল্লিসিট ড্রাগ ট্রাফিকিংয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আপনাদের সিন্ডিকেট মস্ত বড় ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। আমাদের হিসেবে আপনি গত তিন মাসে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ছ’খানা করে বই এইভাবে বিদেশে পাঠিয়েছেন। প্রতি বইয়ে ছিল পঞ্চাশ লাখ টাকার ড্রাগ। তার মানে ছ’টা বইয়ে তিন কোটি টাকার ব্যবসা। মাসে বারো কোটি, তিন মাসে ছত্রিশ কোটি। ফ্যান্টাসটিক পারফরমাস!’
সুবিমল বাগচীর হাত আস্তে আস্তে টেবিলের ড্রয়ারের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ শাঁ করে জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা পিস্তল বার করে গোয়েন্দা বলল, ‘একসঙ্গে ঘরের মধ্যে দুটো পিস্তল বার করার কী দরকার সুবিমলবাবু! আমি তো আমারটা বার করেই ফেলেছি।’
সুবিমল বাগচীর দু-চোখ থেকে দুটো আগুনের শিখা যেন লাফিয়ে পড়ল। গলার স্বরেও আগুনের তাপ। ‘আমি না হয় বার করলাম না, কিন্তু তুমি কি জানো ঘরের তিনটে লুকানো জায়গা থেকে তিনটে পিস্তল তাক করা আছে তোমাদের দিকে?’
গোয়েন্দা পিস্তলের গায়ে আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘জানি। কিন্তু আপনি জানেন না যে আপনার এই বাড়িটা ঘিরে রেখেছে ডিসি ডিডি আর তাঁর ফোর্স। সঙ্গে আছে নারকোটিকস ব্যুরো, কাস্টমস আর ইন্টারপোলের লোকজন। আসলে এটাও তো মস্ত বড় রেড। আপনার বাড়িতে এখন কম করে বিশ কোটি টাকার ড্রাগ আছে।’
সুবিমল বাগচীর গোটা মুখ লালচে হয়ে উঠেছিল। ‘আমার বাড়িতে! কোথায়?’
‘আপনার একতলার কোণের ঘরে। নিউ জাঙ্গল বুকের স্পেশাল বাঁধাই ওখানেই হয়ে থাকে। তদন্ত চালাবার কাজে কাল মাঝরাতে ওই ঘরে আমাকে একবার আসতে হয়েছিল।’
গোয়েন্দার কথায় সুবিমল বাগচীর লালচে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল হঠাৎ, তারপরেই লোকটা একটানে টেবিলের ড্রয়ার খুলে পিস্তল বার করে নিল। কিন্তু গোয়েন্দা তৈরি ছিল, বিদ্যুৎগতিতে লাফিয়ে পড়ে পিস্তলসমেত ওই হাতটাকে তুলে ধরল শূন্যে। তারপরেই তীক্ষ্ণ শব্দে একটা বাঁশি বেজে উঠল। বাঁশির শব্দে যেন মাটি ফুঁড়ে চারদিক থেকে কয়েকজন জবরদস্ত পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকল। সবার হাতেই বাগানো ছিল রিভলবার।
॥ চার ॥
নিষিদ্ধ ড্রাগ চোরাচালানের দায়ে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে সুমিবল বাগচীর। ওদিকে কানের পাশ দিয়ে বুলেট বেরিয়ে গেছে বিশ্বজয় আর তার তিন বন্ধুর। চিন্ময় ওদের বলেছে, ‘আর দুটো মাস ওই ট্রাভেল এজেন্সিতে থাকলে ভয়ঙ্কর ওই চক্রের সঙ্গে তোমরাও ঠিক জড়িয়ে পড়তে!’
সত্যিই তাই। সাঙ্ঘাতিক ওই কাণ্ডকারখানার কথা ভাবতে গেলে চার বন্ধুর প্রত্যেকেরই আবার নতুন করে গা-ছমছম করে ওঠে। কিন্তু এই ছমছমে ভাবের মধ্যে একটা বোধহয় নেশা আছে। চারজন একসঙ্গে হলে ড্রাগের চোরাচালানের প্রসঙ্গ একবার উঠবেই। শনিবারের আড্ডায় বিশ্বজয় বলল, ‘সুবিমল বাগচীর মুখের সঙ্গে কিন্তু শের খানের মুখের সত্যিই বেশ মিল আছে। দুটো গোঁফই একরকম, দুটো চোখই সমান ধূর্ত।’
এই কথাটা আগেও কয়েকবার উঠেছে, কিন্তু সেদিন হঠাৎ ওই কথার উত্তরে কৌশিক বলে বসল, মোগ্লির সঙ্গেও একজনের চেহারার খুব মিল আছে। লক্ষ্য করে দেখেছিস?’
‘কার?’
‘চিন্ময়দার।’
মনে মনে গোয়েন্দার চেহারার সঙ্গে মোগলির চেহারা মেলাবার পরে তিন বন্ধুই হৈ-হৈ করে উঠে সামান্য আগে-পরে বলল, ‘সত্যি, দারুণ বলেছিস! শুধু এদের চেহারার মধ্যেই নয়, দুটো গল্পের মধ্যেও আশ্চর্য মিল। পুরনো জঙ্গলের গল্পে মোগ্লি পাজি বাঘ শের খানকে মেরেছে, আর নতুন জঙ্গলের গল্পে গোয়েন্দা চিন্ময় পাজি লোকটাকে জেলে পুরেছে—এইটুকুই যা তফাত।’