বাঘিনীর নিঃশব্দ গর্জন
আজও গ্রামই দেখবেন লোকনাথবাবু ভাবেননি।
তেত্রিশ বছর আগে বরং এই বর্ধিষ্ণু গ্রামে শহরের কিছু ছাঁদছিরি এসেছিল। এখানকার কাঠের ব্যবসা ফলাও হয়ে উঠেছিল। দূরের মানুষদের আনাগোনা বেড়েই চলেছিল। ফলে তখনই এর থেকে ঢের বেশি চেকনাই দেখা গেছল। তেত্রিশ বছর বাদে এখানে পা দিয়ে লোকনাথবাবুর কেবলই মনে হতে লাগল–সমস্ত গ্রামটা যেন ভয়ানক বুড়িয়ে গেছে আর আফিমখোরের মতো ঝিমুচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখানে দিনকতক কাটালে এখানকার জরা বুঝি তাকেও ঘেঁকে ধরবে।
অথচ দিনকয়েক এখানে থাকার বাসনা নিয়েই এসেছেন লোকনাথবাবু। জীবনের প্রথম বিশটা বছর এই জায়গার সঙ্গে নিবিড় যোগ তার। যদিও বছরের বেশির ভাগ সময়েই দূরের শহরে কাটাতে হত তাকে। এই দশা হলেও এখানে নাকি হাই স্কুল আছে একটা। তখন প্রাইমারী স্কুল ছিল। সেখান থেকে বৃত্তি পাওয়ার ফলে কাকা উদার হয়ে কাকীমার অমতে শহরের হাই স্কুলে পড়তে পাঠিয়েছিলেন তাকে। কাকীমার। ইচ্ছে ছিল, নিজের ছেলেকেই শুধু শহরের স্কুলে পড়তে পাঠান, একসঙ্গে দুজনকে বোর্ডিং-এ রেখে পড়ানোর সংগতি কোথায়? ভাসুরপো বরং বাবুদের কাঠের গুদামে বা জঙ্গলের কাজে লেগে যাক।
কাকা অনেক কারণে চক্ষুলজ্জায় পড়েছিলেন। প্রথম কারণ, মরার আগে লোকনাথবাবুর বাবা কাকার হাতে কিছু টাকাকড়ি তুলে দিয়ে গেছলেন। আর মাতৃহীন ছেলেটাকে মানুষ করার আকৃতি জানিয়ে গেছলেন। দ্বিতীয় কারণ, কাকার আগে লোকনাথবাবুর বাবাই কর্তাদের বিশেষ প্রিয়পাত্র ছিলেন। বাবা অকালে মারা যেতে তার জায়গায় কাকা জাঁকিয়ে বসেছেন। এই কাকাকে বুড়ো কর্তামশাই খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। কিন্তু অতিবৃদ্ধ তিনি তখন, আর তার তিন ছেলের মধ্যে মেজ আর ছোটই সর্বব্যাপারে মাতব্বর তখন। বড় ছেলেই বাপের এত বড় কাঠের ব্যবসা আর জঙ্গল তত্ত্বাবধানের প্রধান সহায় ছিলেন। সেই ছেলে শিকারে বেরিয়ে বাঘের থাবার ঘা নিয়ে ফিরলেন। তারপর একটু একটু করে দেহ বিষিয়ে চোখ বুজলেন। সেই শোক তার বৃদ্ধ বাপ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভুলতে পারেন নি। লোকনাথবাবুর কাকা ওই ছোট দুই ছেলের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, একসময়। তাদের অনেক রকমের হুকুম তামিলের মানুষ ছিলেন। তাই লোকনাথবাবুর বাবা চোখ বুজতে কাকাকেই তার বাবার জায়গায় বসিয়ে দিলেন। সেই জায়গার গালভরা নাম হল ম্যানেজার। কিন্তু আসলে গোমস্তা। লোকনাথবাবুর বাবা বুড়ো কর্তার স্নেহের ভাগীদার ছিলেন, কিন্তু কাকা শুধুই গোমস্তা। মাইনে পঞ্চাশ টাকা। তেত্রিশ বছর আগে সেটা একেবারে কম কিছু নয়। কিন্তু বুঝে-শুনে চলতে পারলে আরো অনেক দিকে আয়ের পথ খোলা ছিল। সে-রকম বুঝেশুনে চলার বুদ্ধিও কাকার ছিল। তবু ভাইপোর বাবার জায়গায় তিনি বসেছেন, এটা বোধহয় ভুলতে পারেন নি।
তৃতীয় কারণ, চক্ষুলজ্জা। নিজের ছেলেটা কোনরকমে প্রাইমারী পাশ করেছে, তাকে শহরের স্কুলে পড়তে পাঠাবেন আর জলপানি পাওয়া ভাইপো এখানে বসে থাকবে, শুনলে কর্তাবাবুরাই বা বলবেন কি? বাইরের পাঁচজনের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল।
আর ভাইপোকে শহরের স্কুলে পড়তে পাঠানোর শেষ কারণ সম্ভবত ভবিষ্যতের আশা। নিজের ছেলেকে দিয়ে সেরকম আশা করেননি। ভাইপো যদি লেখাপড়া শিখে একটা পাশ দিয়ে বিদ্বান হয়ে আসতে পারে, তাহলে কর্তাবাবুদের এতবড় বিষয় আশয়ের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব ঢের বাড়বে। ওঁর ভাইপো কোনদিন তার অবাধ্য হতে পারে সেটা কল্পনার বাইরে। অতএব ভাইপোকে বিদ্বান করে সুখে কাল কাটানোর একটা স্বপ্নও তিনি দেখেছিলেন হয়তো।
বয়সে বছর পাঁচেকের বড় এক দিদি আছেন লোকনাথবাবুর। বাবা সেই দিদির ভালো বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। লোকনাথবাবু আর কাকার ছেলে মন্মথ সমবয়েসী। দুই এক মাসের তফাত। দুজনেই ভঁরা শহরের স্কুলে পড়তে চলে গেছলেন। পূজো আর গ্রীষ্মের বড় ছুটিতে তো বটেই–একসঙ্গে পাঁচটা দিনের ছুটি পেলেও মন্মথকে পট্টি পরিয়ে দেশের বাড়িতে চলে আসার জন্য ছটফট করতেন। লোকনাথবাব। গাঁটের পয়সা ভেঙে একা আসাটা কাকা-কাকীমা বরদাস্ত করবেন না, তাই মন্মথকে চাই। মন্মথর কিন্তু শহর ছেড়ে আসার ঝোঁক পরের দিকে তেমন ছিল। না। লোকনাথ বরাবরই ছুটে চলে আসার জন্য পাগল। এখানকার আকাশ বাতাস। নদী জঙ্গল পাহাড় সব ভালো লাগত তার। এরা যেন হাতছানি দিয়ে সর্বদা ডাকত তাকে।
…আজ তেত্রিশ বছর বাদে সেইখানেই এসেছেন। এসে যেন পায়ে পায়ে ঠোক্কর খাচ্ছেন।
কাকা তো অনেককাল বিগত। মন্মথও নেই। তার ছেলেরা এখানে ছোটখাট কাঠের কল দিয়ে বসেছে একটা। শহরের সঙ্গে যোগাযোগও এত বছরে আগের থেকে ঢের সহজ হয়েছে। লরি আর বাস চলার পাকা সড়ক হয়েছে। উঠতি মানুষেরা শহরের দিকেই ছুটেছে। সেখান থেকে আরো দূরে দূরে গেছে। ফলে যা স্বাভাবিক তাই হয়েছে। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বেড়েছে অথচ শহর গ্রামের দিকে এগিয়ে আসেনি, গ্রামের। প্রাণ শহরের দিকে ধাওয়া করেছে।
লোকনাথবাবুর বাস এখন কলকাতায়। কম করে সাড়ে তিনশ মাইল দূর। এখান থেকে। কর্মজীবনে ভারত সরকারের চাকরি নিয়ে বহু জায়গায় ঘুরেছেন। এখন কলকাতায় বহাল আছেন। বয়েস এখন তিপ্পান্ন তার। চাকরির মেয়াদ আরো পাঁচ বছর। পদস্থ ব্যক্তি তিনি। কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি। মন্মথর বড় দুই ছেলে কলকাতায় বেড়াতে এসেছিল। বিশ বছর বয়সে দেশছাড়া লোকনাথবাবু আর ও-মুখো হননি, মন্মথ বিয়ে করেছে কি করেনি এ খবরও তার জানা ছিল না। ছেলেদের চেনার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
কোথা থেকে কেমন করে তার আপিসের ঠিকানা সংগ্রহ করে তারা এক দুপুরে সেখানে এসে হাজির। ওদের পরিচয় পেয়ে লোকনাথবাবু আদর করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। একটা সস্তার হোটেলে উঠেছিল, সেখান থেকে ওদের তুলে এনে নিজের কাছে রেখেছিলেন কটা দিন। এত বড় মানী জ্যাঠার (মন্মথর থেকে লোকনাথবাবুই মাস দেড় দুইয়ের বড় ছিলেন) আন্তরিক আদরযত্নে ছেলে দুটো মুগ্ধ। ওদের মুখেই লোকনাথবাবু খবর পেলেন মন্মথ আর নেই। মা আছেন। বাবার কাঠের কল এখন ছেলেরা চালাচ্ছে। মন্মথর তিন ছেলে। ছেলেরা নাকি তাদের বাবার মুখে এই জ্যাঠার গল্প অনেক শুনেছে। লোকনাথবাবুর বড় চাকুরে হবার কথা মন্মথর জানা অস্বাভাবিক নয়। দেড় বছর আগেও লোকনাথবাবুর দিদির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।
যাবার আগে ওই দুই ছেলে বার বার তাকে অনুরোধ করেছিলো একবারটি তিনি যেন দেশে আসেন। লোকনাথবাবু কথা দিয়েছিলেন যাবেন।…এখানকার এই আকাশ বাতাস নদী পাহাড় জঙ্গল প্রায় তিন যুগ বাদে আবার তাকে ডেকেছে, হাতছানি দিয়েছে। এর কারণ ওই ছেলেদের জানার কথা নয়। প্রথম সুযোগে তিনি চলে এসেছেন।
মম্মথর বউ আর ছেলেরা তাকে পেয়ে মহা ব্যস্তসমস্ত। তার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সক্কলের বিশেষ নজর। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে তিন ছেলের একজন না একজন ছায়ার মতো তার সঙ্গে লেগে আছে। শেষে নিরুপায় হয়ে লোকনাথবাবু বলেছেন, এ জায়গার সবকিছু আমার বড় চেনা, আমি নিজের মনে দু-চারদিন বেশ বেড়াব–আমার জন্যে তোমরা নিজেদের কাজের ক্ষতি কোরো না।
মানী জ্যাঠার মন বুঝে ছেলেরা কিছুটা অব্যাহতি দিয়েছে তাকে।
…তেত্রিশ বছর আগে তারা যেখানে থাকতেন মন্মথর ছেলেরা এখন আর সেখানে থাকে না। ওদের বাবাই নাকি এখানে এই কাঠের বাড়ি করে রেখে গেছে।
এখানে এসে এক ঘণ্টার মধ্যে লোকনাথবাবু তাঁদের আদি বাসস্থান দেখতে গেছলেন মন্মথর বড় ছেলেকে নিয়ে। দেখে হতভম্ব তিনি।… তাদের সেই কাঠের দালান প্রায় নিশ্চিহ্ন। চারদিক জঙ্গলে ছেয়ে আছে। অদূরে কর্তাদের সেই চকমিলাননা দালানেরও প্রায় সেই অবস্থা। সমস্ত গাঁয়ের মধ্যে ওটাই ছিল একমাত্র তিন-মহলা দালান। ভাঙা জীর্ণ একটা কংকাল শুধু দাঁড়িয়ে আছে। সেটার নানা দিক খসে ধসে পড়ছে। সর্বাঙ্গে পুরু শ্যাওলা জমে আছে। বাড়িটার পিছনের দিকে ছিল মস্ত একটা দীঘি। দীঘিটাও কর্তাদেরই ছিল, কিন্তু ওই বাড়ির আঙিনার বাইরে ছিল ওই দীঘি। বাড়ির মুখোমুখি ঘাটটা বাবুদের নিজস্ব–অন্য দিকের ঘাট দুটো কর্তাদের পোয্য এবং অনুগ্রহভাজনেরা ব্যবহার করতে পারত। ঘাটের তিনদিকেই বেশ সাজানো গাছের সারি ছিল। বাবুদের ঘাট–তাই বাবুঘাট ছিল ওটার নাম।
পায়ে পায়ে ঘাটের দিকে এলেন লোকনাথবাবু। চোখে কাটা বিঁধল যেন। চারদিক জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জল ছিল, এখন সেই জল একেবারে তলায় এসে ঠেকেছে-তার ওপর যেন সবুজ সর পড়ে আছে একটা। দেখলেই বোঝা যায় কেউ আর এখন এই জল ছোঁয় না। বাঁধানো সিঁড়িগুলোও ভেঙে ফেটে চৌচির হয়ে আছে।
লোকনাথবাবু সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, কি ব্যাপার, দেবরায়দের কোনো বংশধরও আর এখানে থাকে না?
মন্মথর বড় ছেলের নাম সুবল। সে বলল, না, মাত্র বছর পাঁচেক আগে বাড়ি-ঘর, বিষয়আশয় সব বেচে দিয়ে তারা এখান থেকে চলে গেছেন। এই বাড়ি আর জায়গা-জমি কি সব কাজে লাগানো হবে বলে সরকার কিনে নিয়েছিল, কিন্তু কিছুই হয় নি, তেমনি পড়ে আছে।
–মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে এই দশা?
সুবল বলল, খারাপ দশা অনেক আগেই শুরু হয়েছিল–ভাগের মা গঙ্গা পায় না, বাড়ি-ঘরদোর কে দেখে! কর্তাদের দুভাইয়ের মিল ছিল খুব, দুজনে একসঙ্গেই নেশা-টেশা করত, কিন্তু তাদের ছেলেদের মধ্যে বনিবনা ছিল না একটুও-বউদের মধ্যেও না। তবু কর্তারা বেঁচে ছিলেন বলে তখনো খাওয়া-খাওয়ি শুরু হয়নি, আর ব্যবসাপত্রও চালু ছিল। ছেলেপুলেসুদ্ধ সেই ডাকাতের হাতে পড়ার পর রাতারাতি অতবড় ব্যবসা অর্ধেক হয়ে গেল, তারপর কিছুদিনের মধ্যে
লোকনাথবাবু অবাক।–ছেলেদেরসুদ্ধ কর্তারা ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন নাকি? কোথায়?
সুবল সোৎসাহে বলল, ও, আপনি তো কিছুই জানেন না–সে এক তাজ্জব কাণ্ড! সেও বছর ছয় আগের কথা, মাসে তখন বুড়ো কর্তারা একবার করে জঙ্গলে যেতেন আদায়পত্র দেখাশুনা করতে। নেশার কল্যাণে তখন ইজারার একটা জঙ্গলই হাতে ছিল, কাদের সঙ্গে তাদের ছেলেরা থাকতেন।
একবার ওমনি জঙ্গলে গিয়ে তিন দিন বাদে ছেলেদের কোথায় রেখে শুধু কর্তা, দুই ভাই ফিরে এলেন। তাদের সে মুখের দিকে তাকানো যায় না, যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে মাথার ওপর দিয়ে। দুজনের দুই-দুই চার ছেলেকে কোথায় রেখে এলেন কেউ জানে না। ফিরে এসেই অত বড় ব্যবসার অর্ধেকই বেচে দিলেন তারা–আর কাউকে সঙ্গে না নিয়েই আবার জঙ্গলে ছুটলেন। তার পরদিনই অবশ্য কর্তাদের সঙ্গে তাদের চার ছেলেও ফিরলেন–কিন্তু ছ মাসের মধ্যে কি ব্যাপার কেউ একটি কথাও জানল না।
ছ মাস বাদে সরকারের কাছে এই সব কেচে এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে ব্যাপারটা জানাজানি হল। যাবার আগে পুলিসের কাছে একটা রিপোর্টও করে গেলেন না তারা এটাই আশ্চর্য। জঙ্গল থেকে ফেরার সময় ওই চার ছেলেসহ দুই কর্তা ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। জঙ্গলের ধারেকাছে ডাকাত আছে এমন খবর কেউ কখনো শোনেনি। সেই ডাকাতের দল নাকি তাদের ধরে বহু দূরে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে তুলেছিল–যাবার সময় মোষের গাড়িতে সক্কলের চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে। তারপর বহু হাজার টাকা ছেলেদের মাথার বিনিময়ে মুক্তিপণ হেঁকে চোখ বেঁধে শুধু বুড়ো কর্তা দুজনকে জঙ্গলের বাইরে এনে ছেড়ে দিয়ে গেছে। টাকা। দেবার জন্য পাঁচটি দিন সময় দেওয়া হয়েছিল তাদের–তার মধ্যে জঙ্গলে টাকা না নিয়ে এলে বা কোনরকম চালাকি খেলতে গেলে চার ছেলেরই মৃতদেহ সোনালীর জলে ভাসবে বলে শাসিয়ে দিয়েছে। টাকা নিয়ে ঠিক দিনে তারা জঙ্গলে গেলেই বাদবাকি ব্যবস্থা তারা করবে।
টানা প্রায় ছমাস কর্তাদের ছেলেরা ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল। তাছাড়া বাপেরাই হয়তো ছেলেদের কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করে থাকবেন। কিন্তু সব ছেড়েছুঁড়ে চলে যাবার আগে তাদের ভয় ভেঙে গেছল। ছেলেরাও মদের নেশায় পোক্ত হয়ে উঠেছিল, সেই মদের ঝেকেই তারা সব ফাস করে দেয়। তারা নাকি খুব ভালো করেই জানে, ওই ডাকাত দলের সর্দারণী একজন মেয়েছেলে। তারা তাকে দেখেনি, কিন্তু টের পেয়েছে।
ঘটনাটা শুনে বেশ অদ্ভুতই লাগল লোকনাথবাবুর। পাহাড়ে জঙ্গলে ডাকাতের উৎপাত হতে পারে, যদিও আগে এ-রকম ঘটনার কথা কখনো শোনা যায়নি। আর আগে থাকতে খবর নিয়ে আঁটঘাট বেঁধে যদি ডাকাতেরা কাজে নেমে থাকে–তাহলে মুক্তিপণ হাঁকাটাও অসম্ভব কথা কিছু নয়। কিন্তু ভয়ের চোটে ঘটনার ছমাস বাদেও এঁরা কাউকে কিছুই বলেননি সেটাই আশ্চর্য। হয়তো বা ডাকাতরা শাসিয়ে রেখেছিল, পরেও কাউকে কিছু বললে আর এ নিয়ে পুলিশের তত্ত্ব-তল্লাসী চললেও তাদের গর্দান যাবে।
লোকালয় ছাড়িয়ে মাইল দুই হাঁটলে সোনালী নদী। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ পায়ে পায়ে সেই দিকে চললেন লোকনাথবাবু। এই এলাকাটাই একসময় সব থেকে প্রিয় ছিল তার। স্কুল-কলেজের বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত এখানে এলে এদিকটাই সব থেকে বেশি চষে বেড়িয়েছেন তিনি।
শীতের অপরাহ্নের মিঠে রোদ, হাঁটতে ভালো লাগছে। এদিকে পা বাড়ানোর পর আরো ভালো লাগছে। তৃষ্ণার্ত দুই চোখ মেলে সোনালীর দিকে এগিয়ে চলেছেন। নদীর দুদিকে সোনার মতো ঝকঝকে বালুর চর–এই জন্যেই নদীর নাম সোনালী বোধ হয়।
দূর থেকে লোকনাথবাবু হতাশ হলেন একটু। সবকিছুর মতো সোনালীও বুড়িয়ে গেছে মনে হল। নদীর দুদিকে চরের পরিধি দ্বিগুণ বেড়ে গেছে মনে হল। কাছে এসে দেখলেন সোনালী অর্ধেক সরু হয়ে তিরতির করে বইছে এখনো, সেই জলে পায়ের পাতা ডোবে কিনা সন্দেহ।
শীতের সময় আগেও অবশ্য হাঁটুজলের বেশি গভীর ছিল না সোনালী। তবে চওড়া এর তিনগুণ ছিল। আর বর্ষায় তো এই সোনালীরই দুকূল ছাপানো সংহার মূর্তি। সুবল ওদের মুখে শুনেছেন, দূরের কোথায় বাঁধ হবার ফলে এখন নাকি বর্ষায়ও সোনালী আর তেমন ভরে ওঠ না।
এখানে এসে বয়েস ভুলে গেলেন লোকনাথবাবু। সামনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিতে দুই চোখে সেই আগের দিনের তৃষ্ণা উপচে উঠল। তিতিরে জলের ওধারে প্রায় দেড় মাইল পর্যন্ত ধু-ধু বালুর চর। তার ওধারে ঘন জঙ্গলের রেখা। তারও ওধারে। সারি সারি বিচ্ছিন্ন পাহাড়।
…আগে হামেশাই লোকনাথবাবু শুকনো চর পার হয়ে ওই জঙ্গলে গিয়ে ঢুকতেন। দুপাশের জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে আগে পায়ে-হাঁটা-রাস্তা ছিল। এখন কি হয়েছে জানেন না। জঙ্গলের ধারে ধারে আদিবাসী গরীবদের বসতি ছিল। সেগুলো গাছের আড়ালেই ছিল বলে আগেও এত দূর থেকে দেখা যেত না। কর্তাদের ইজারার জঙ্গল এদিকে নয়–সেটা পশ্চিমে! দেবরায়দের সেই চকমিলানো বাড়ির এক-আধ মাইলের মধ্যেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। তাদের জঙ্গলও সেইদিকেই ছিল, তবে বহু দূরে। দেবরায়দের ওই বাড়ির ছাদে উঠে লোকনাথবাবু একমনে দাঁড়িয়ে সেদিকের জঙ্গলও দেখতেন। কিন্তু তার সব থেকে ভালো লাগত এ-দিকটা–এই সোনালীর দিকটা।
জুতোজোড়া হাতে নিয়ে লোকনাথবাবু সাগ্রহে সোনালী পেরিয়ে ওদিকের চরে গিয়ে উঠলেন। তারপর ওই জঙ্গল আর পাহাড়ের দিকে চোখ রেখে চলতে লাগলেন। তেত্রিশ বছর বাদে আবার সেই ছেলেবেলায় ফিরে এসেছেন যেন তিনি। মনের আনন্দে এগিয়ে চললেন।
চর শেষ হল। এদিকটায় জলের রেখাও নেই আর। লোকনাথবাবু ওপারের ডাঙায় গিয়ে উঠলেন। দূর থেকে বনের লাইন যেমন নিচ্ছিদ্র মনে হয় তা নয়। তেত্রিশ বছর আগে যেমন দেখেছিলেন, এ-দিকটায় তার থেকে অন্তত ঢের উন্নতি হয়েছে। বনের মাঝখান দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। গাছ-গাছড়ার আড়ালে বেশ সুন্দর কাঠের বাড়িও দেখা গেল গোটাকতক।
ঘন বন একপাশে রেখে আপনমনেই হাঁটতে লাগলেন। জঙ্গলে হিংস্র জন্তু জানোয়ার আছে, লোকালয়ের দিকটায় তাদের পদার্পণ ঘটার কথা নয়।
একটা জীপ পাশ কাটিয়ে গেল। ড্রাইভারের পাশে একজন বয়স্কা রমণী বসে। পরনে ছাপাশাড়ি, মাথায় ঘোমটা। এক নজর তাকিয়ে বাঙালী মনে হল না। লোকনাথবাবুর। কারণ নাকে বড়সড় একটা সোনার নথ। কিন্তু অবাক কাণ্ড, জীপের। গতি শিথিল হল, আর সেই রমণী তার আসন থেকে ঝুঁকে পিছনের দিকে তাকিয়ে তাকে দেখতে লাগল।
তিনি খানিকটা এগিয়ে আসতে প্রায়-থামা জীপটা হঠাৎ স্পীড বাড়িয়ে চলে গেল। নথ-পরা রমণীর ফর্সা গোলগাল মুখ, কিন্তু মুখের আদল লক্ষ্য করার সুযোগ হয়নি লোকনাথবাবুর। ভাবলেন, হয়তো কোনো চেনা লোক ভেবেছিল রমণী, চেনা নয় দেখে চলে গেল।
নিজের মনে আরো অনেকখানি এগিয়ে গেলেন লোকনাথবাবু। পাশের বন ক্রমে গম্ভীর হয়ে উঠছে, অন্যদিকে লোক-বসতির আভাস আর চোখে পড়ছে না। আদিবাসীদের কুঁড়েঘরের বসতি দেখেছেন। এখন আর তাও চোখে পড়ছে না।
এত পথ এভাবে হেঁটে এসে ভালো করেন নি, লোকনাথবাবু ফিরলেন। একটু তাড়াতাড়িই পা চালালেন। যতটা এসেছেন, সোনালীর চরে পৌঁছুতে কম করে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে।
কাছাকাছি এসে গেছেন, আর শতখানেক গজ পথ শেষ হলেই সোনালীর চরের সামনে পৌঁছবেন। চকিত হয়ে পিছন ফিরে তাকালেন। একটা জীপ তীরের মতো এদিকেই ছুটে আসছে- তারই শব্দ। সেই জীপটাই কিনা বুঝলেন না। বাঁধানো হলেও সরু রাস্তা। অত স্পীডে আসতে দেখে লোকনাথবাবু বিরক্ত হয়েই পাশ দেবার জন্য একধারে সরে দাঁড়ালেন।
কিন্তু আশ্চর্য, একটু বাদে জীপটা তার পাশেই ঘ্যাঁচ করে দাঁড়িয়ে গেল। হ্যাঁ, আগের সেই জীপই। কিন্তু এতে ড্রাইভারের পাশে রমণীর বদলে অন্য একটি অল্প বয়সী লোক। আর জীপের পিছনে আরো দুটি ছেলে।
চারজনই জীপ থেকে নেমে এলো। তাদের পরনে পরিষ্কার ট্রাউজার আর গায়ে টেরিকটের হাফ-শার্ট। চারজনেরই মুখের আদল একরকম। দেখলেই মনে হবে চার ভাই। কালোর ওপর বেশ মিষ্টি চেহারা। টানা চোখ। সব থেকে আগে চোখে পড়ে স্বাস্থ্যসম্পদ। ওই দুটো করে বাহু যেন দুনিয়ার অনেক শক্তি কেড়ে নিতে পারে।
চারজনই এগিয়ে এসে হাত কপালে ঠেকিয়ে সবিনয়ে নমস্কার করল তাকে। লোকনাথবাবুও বিমূঢ় মুখে প্রতি-নমস্কার জানালেন। এদের মধ্যে সকলের বড়টির বছর বত্রিশ বয়েস হবে, আর সকলের ছোটর বছর পঁচিশ। ওই বড়জনই জীপ চালাচ্ছিল। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম লোকনাথ মিত্র?
বিমূঢ় মুখে লোকনাথবাবু মাথা নাড়লেন– নামটা তারই বটে।
-আপনাকে একবারটি আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।
লোকনাথবাবু আকাশ থেকে পড়লেন।–কোথায়?
–জীপে গেলে খুব বেশি দূর নয়, আপনি কিছু ভাববেন না, আপনাকে আবার আমরা পৌঁছে দেব।
লোকনাথবাবু ভেবাচাকা খেয়ে গেলেন। আমি তো আপনাদের চিনি না, কোথায় যেতে হবে? কেন যেতে হবে?
–আমাদের মা একবারটি আপনাকে নিয়ে যেতে বলেছেন।
–আপনাদের মা! আপনাদের মা কে?
ছেলেটা হাসল। হাসিটা মিষ্টি। জবাব দিল, মা মা-ই, আসুন!
লোকনাথবাবু ফাঁপরে পড়লেন। বললেন, আমি তো এখানে কাউকেই চিনি না বহুকাল বাদে এদিকে এসেছি, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়েছে, আমাকে কেউ এখানে ডাকতে পারেন না।
ছেলেটা গম্ভীর হঠাৎ। অন্য সকলেও।
বলল, মায়ের ভুল হয় না।–ঘণ্টাখানেক আগে এই জীপে করে যাবার সময় মা আপনাকে দেখেছেন, তাছাড়া আপনার নাম করেই তো আপনাকে নিয়ে যেতে হুকুম করেছেন?
তাও তো বটে।-নথ-পরা সেই রমণীই এদের মা তাহলে! আপনি ছেড়ে এবারে তুমি করে বললেন লোকনাথবাবু।–তোমাদের মায়ের নাম কি?
এই জেরার মধ্যে পড়ে ছেলেগুলো বিরক্ত যেন। ওই বড় ছেলেই জবাব দিল, মা-কে আমরা মা বলেই জানি, নাম-টাম জানি না।
অবাক ব্যাপার। এত বড় বড় ছেলেরা মায়ের নাম জানে না, এও কি বিশ্বাস্য!
তুমি ছেড়ে আবার আপনি করে বললেন লোকনাথবাবু। ব্যাপার-গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না তার।–আপনাদের বাবার নাম কি?
এবারে বড় ছেলেটা স্পষ্টই বিরক্ত।-দেখুন, কোনো কথা না বলে মা আপনাকে শুধু নিয়ে যেতে বলেছেন- আপনি নির্ভয়ে গাড়িতে এসে উঠুন, আবার আপনাকে আমরা পৌঁছে দিয়ে যাব।
মনের ভাব চেপে জিজ্ঞাসা করলেন, গিয়ে আবার ফিরতে কতক্ষণ লাগবে?
–যেতে-আসতে বড়জোর সোয়া-ঘণ্টা, তারপর মা যতক্ষণ আটকে রাখেন আপনাকে।
তার মানে কম করে দু ঘণ্টা। এখনই পাঁচটা বাজে, শীতের আলোয় টান ধরেছে। মাথা নেড়ে বললেন, আমি এখন যেতে পারছি না, এখানে নতুন মানুষ আমি, আপনার মা-কে বলবেন–
–দেখুন, আপনিই মিছিমিছি দেরি করছেন। মায়ের হুকুমে আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। তিনি নিয়ে যেতে বলেছেন, আমরা নিয়ে যাব। আপনি দয়া করে গাড়িতে উঠুন।
বিনীত কথাগুলোর মধ্যে এমনই একটা দৃঢ়তার সুর যে ভিতরে ভিতরে বিষম অস্বস্তিবোধ করলেন লোকনাথবাবু। এই নির্জনে জোর করে জীপে টেনে তুললেই বা কি করতে পারেন তিনি! সকলের মুখের দিকেই তাকালেন একবার। এই অযথা বিলম্ব ওরা কেউ পছন্দ করছে না।
দুর্গা নাম নিয়ে জীপের দিকে এগোলেন। তা ছাড়া তার ক্ষতিই বা কি হতে– পারে? তেত্রিশ বছর বাদে এখানে এসেছেন, ক্ষতি করতে খামোখা কেউ চেষ্টাই বা করবে কেন? নথ-পরা একজন রমণী যে ঝুঁকে দেখছিল তাকে, আর এরা এসে নামটাও তো ঠিকই বলেছে।
ওই বড় ছেলে এবারে নির্বাক অথচ সাদর আপ্যায়নে তাঁকে এনে ড্রাইভারের পাশে বসালো। নিজে চালকের আসনে বসল। পরের তিন ছেলে পিছনে।
জীপ ছুটল।
যে গতিতে ছুটল তাতেই ভয় ধরে গেল লোকনাথবাবুর। মাইলের কাটা পঞ্চাশের দাগ ছুঁয়েছে। এই স্পীডে যেতে-আসতে সোয়া-ঘণ্টা লাগলে কম করে পঁচিশ-তিরিশ মাইল যেতে হবে এখন।
আবার ভয়ানক অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন তিনি।
আধ ঘণ্টা বাদে একটা পাহাড়ের কাছাকাছি ফাঁকা জায়গায় সুন্দর একটা কাঠের বাংলোর সামনে জীপ এসে দাঁড়াল। পাশেই কাঠের স্তূপ আর একটা কাঠ-কাটা-কলের শেড চোখে পড়ল। বাংলোর বারান্দার রেলিং-এ দুটি অল্পবয়সের বউ দাঁড়িয়ে, আর দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করছে।
এইখানেই জীপ দাঁড়াল যখন, অনেকখানি নিশ্চিন্ত বোধ করলেন লোকনাথবাবু। যাক, কোনো একটা সংসারের মধ্যেই এসে পড়েছেন তাহলে তিনি!
ছেলেরা তাকে আপ্যায়ন করে বাংলোয় এনে তুলল। সেখানেই বসার সুন্দর চেয়ার-টেবিল পাতা। দুদিকে চমৎকার বাগান। অনেক রকমের ফুল ফুটে আছে। এই গৃহস্বামী-গৃহস্বামিনীদের রুচি আছে।
বড় ছেলে হাঁক দিল, মা কোথায়? উনি এসেছেন–
অল্পবয়সী বউ দুটি ভিতরে ঢুকে গেছে। ফুটফুটে বাচ্চা ছেলে আর মেয়েটা অবাকবিস্ময়ে আগন্তুককে দেখছে।
ভিতরের দরজার কাছ থেকেই বড় ছেলের হাসি আর কথা শোনা গেল।–আরে না–আমরা কোনরকম জোর-জবরদস্তি করিনি–বাইরের দিকে মুখ বাড়ালো সে–আচ্ছা মশাই, আমরা আপনার সঙ্গে কোনরকম অভদ্র আচরণ করেছি?
ঘুরে তাকিয়ে লোকনাথবাবু মাথা নাড়লেন। ছাপাশাড়ির আভাস পেলেন, কিন্তু মুখ দেখতে পেলেন না। ছেলেটি তাকেই বলছে কথাগুলো।
রমণীটি এগিয়ে এলো। মাথায় ঘোমটা, নাকে বড় নথ, বয়সের দরুন সামান্য মোটার দিক ঘেঁষা, মুখের দিকে ভালো করে তাকান নি কিন্তু অবয়ব দেখেই বোঝা গেল খুব ফর্সা রং।
একেবারে চেয়ারের কাছেই এগিয়ে এলো সে, মাথার ঘোমটা অনেকখানি সরে গেছে তখন। তার একপাশে ওই অল্পবয়সী বউদের একটি। ছেলেরা চারজনই সামনে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু রমণীর মুখে একটিও কথা না শুনে সংকোচ কাটিয়ে মুখ তুলে তাকালেন লোকনাথবাবু। আর তারপরেই মাথাটা ঘুরে গেল কেমন। এই বাংলোটাই যেন প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠল। বিস্ফারিত নেত্রে চেয়ে আছেন–স্বপ্ন দেখছেন কি সত্যি, ভেবে পাচ্ছেন না!
তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছে একটি রমণী। সেই হাসি তার সমস্ত মুখে, এমন কি কানের ডগা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। হাসলে গালের এক দিকে বড় একটা টোল পড়ে, তাই পড়েছে। সেই টোলের ভিতর দিয়েও যেন হাসি ঠিকরোচ্ছে। নিঃশ. এরকম হাসি একজনই হাসতে পারত, একজনেরই ওরকম হাসি সমস্ত মুখের রেখায় রেখায় ছড়াতো, কানের ডগা পর্যন্ত লাল হয়ে যেত, মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠত।
নিজের অগোচরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন লোকনাথবাবু। অস্ফুট বিস্ময়ে বলে উঠলেন, হাসিরানী।
নিঃশব্দ হাসিটা যত বাড়ছে ততো যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠছে মুখ। গালের টোলে ততো বেশি খাঁজ পড়ছে। সেই হাসির একটু ছোঁয়া যেন ছেলেদের মুখেও লেগেছে। তারা অল্প অল্প হাসছে আর দুজনকেই নিরীক্ষণ করছে। বউটিও তাই।
-হাসিরানী তুমি! তুমি এখানে!
চোখের দিকেই চেয়ে আছে, তেমনি হাসছে। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল– সে-ই বটে। পদ্মহাতের মতো একখানা হাত তুলে তাকে বসতে বলল।
নিজেও সামনাসামনি চেয়ারের একটাতে বসল। তখনো মুখ লাল। হাসি মিলায়নি। হাসি চুয়ে পড়ছে।
বউটি তার চেয়ারের হাতলের কাছে দাঁড়াল। একটা চেয়ার টেনে বড় ছেলে একেবারে মায়ের গা ঘেঁষে বসল। রমণী তার দিকে ফিরে একটুও শব্দ না করে ঠোঁট নাড়ল। হাসছে তখনো।
বক্তব্য বুঝে নিয়ে ছেলে লোকনাথবাবুকে বলল, মা বলছেন– আপনাকে হঠাৎ এভাবে ধরে নিয়ে খুব কষ্ট দেওয়া হল!
লোকনাথবাবু সম্বিত ফিরে পেলেন যেন এতক্ষণে। বললেন, না, কষ্ট কিছু না। তোমার মা-কে আজ তেত্রিশ বছর বাদে দেখলাম… কোনদিন দেখব ভাবিনি, তাই অবাক হয়েছি।
ছেলে হাসিমুখে বলল, আপনি তো আসতেই চাননি, ভাবলেন ডাকাতের পাল্লায় পড়েছেন! মায়ের দিকে চোখ পড়তেই সে আবার তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না মা, সত্যিই একটুও খারাপ ব্যবহার করিনি–তুমি জিজ্ঞাসা করে দেখো না
সমর্থনের আশাতেই যেন হাসিরানী লোকনাথবাবুর দিকে তাকালো। অদ্ভুত লাগছে। লোকনাথবাবুর। এখনো যেন সবকিছু বাস্তব ভাবতে পারছেন না তিনি। হাসিরানীর বয়েস বড়জোর বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ মনে হচ্ছে। কিন্তু লোকনাথবাবু জানেন, হাসিরানীর বয়েস এখন একান্ন–ঠিক দু বছরের ছোট তার থেকে।
বললেন, না, ওরা খারাপ ব্যবহার করেনি, তোমাকে দেখব কল্পনা করিনি তো, তাই আসতে ইতস্তত করছিলাম।
হাসিরানীর মুখে আবার সেই হাসি। ছেলের দিকে ফিরে একবার ঠোঁট নাড়লেন শুধু। সে তক্ষুনি উঠে লোকনাথবাবুর পায়ে হাত রেখে প্রণাম করল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি তিন ছেলেও।
হাসিরানী তাদের দিকে চেয়ে আবার ঠোঁট নাড়তে পরের ছেলে জানান দিল, মা বলছেন আমরা মায়ের এই চার ছেলে।
লোকনাথবাবু বলে উঠলেন, বেঁচে থাকো বাবারা, সুখে থাকো।
হাসিরানী বরাবরই রূপসী, কিন্তু এই হাসিমুখ অদ্ভুত কমনীয় দেখালো। আবার তার ইশারা পেয়ে বড় ছেলে হাঁক দিল, আর বউরা সব কোথায়, এদিকে এসো, মা ডাকছেন–
ইত্যবসরে যে বউটি সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেও প্রণাম সেরে উঠল। সেই বোধহয় বড় বউ। সুশ্রী। আরো তিনটি সুশ্রী বউ ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে প্রণাম করল।
বড় ছেলে হাসছে। মা বলছেন, এই তার চার বউ।
আশ্চর্য, মায়ের ঠোঁট নড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে তার কথা এমন পরিষ্কার বুঝে নেয় কি করে লোকনাথবাবু ভেবে পেলেন না। হাসিমুখে হাসিরানী আদুরের বাচ্চা ছেলেমেয়ে দুটোকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটে এলো। বড় ছেলে বলল, প্রণাম করো, দাদু
লোকনাথবাব তাদের ধরে ফেললেন।
বড় ছেলে বলল, এই মায়ের দুই নাতি-নাতনী–এটি আমার ছেলে, এটি ভাইয়ের মেয়ে
সুন্দর ঝলমলে সংসার। কি মনে হতে লোকনাথবাবু হাসিরানীর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কেউ নেই?
ফর্সা মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগল। ম্লান স্নিগ্ধ দুটো চোখ তার মুখের ওপর স্থির হল একটু। তারপর সামান্য মাথা নাড়ল– নেই।
বড় ছেলে বলল, দশ বছর আগে বাবা ব্ল্যাক ফিভারে মারা গেছেন।…এদিকটায় তখন ওই রোগ খুব হত। তারপর হেসেই বলল, মাকে কিন্তু আমরাই কক্ষনো সাদা শাড়ি পরতে দিই না।
লোকনাথবাবু মাথা নেড়ে সায় দিলেন শুধু। প্রতিমার আর যাই হোক থান মানায় না। উন্মুখ হয়ে এবার ওই ছেলেকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন তিনি। কথাটা ঠোঁটের ডগায় এসে গেছল, এবারে তোমার বাবার নাম বলো, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না।…দরকারও নেই, সবই বুঝতে পারছেন।
হাসিরানী বউদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে কি ইশারা করতে তারা চলে গেল। এই ইশারাটা লোকনাথবাবুও বুঝলেন। চা-জলখাবারের ব্যবস্থা করতে বলা হল।
বাধা দিতে চেষ্টা করলেন, আমি এখন কিছু খাব না–
হাসিমুখে একটু দুলিয়ে দুলিয়ে মাথা নাড়ল হাসিরানী। আঠেরো বছর বয়সেও মাথা নাড়তে হলে ঠিক যেমনটি করত। অর্থাৎ বলতে চাইল, তা হয় না।
…কর্তাদের চকমিলানো দালান থেকে আঠারো বছরের বোবা মেয়ে হাসিনী হারিয়ে গেছল একদিন। হারিয়ে যায়নি, সকলেই ধরে নিয়েছিল প্রকারান্তরে সে। আত্মঘাতিনীই হয়েছিল। নিখোঁজ হবার আগের দিনও বিপদের স্পষ্ট হুশিয়ারী এসেছিল। আর সেটা উপেক্ষা করেই সে মরণ বরণ করেছিল।
..আর বিশ বছরের বি-এ পরীক্ষা দেওয়া এক ছেলে ভেবেছিল, দুঃখে অপমানে তার জন্যই মেয়েটা প্রাণ খোয়ালে। তার আত্মহত্যার সামিল কাজ করার জন্য সে-ই দায়ী। তেত্রিশ বছর আগে সেই ছেলেটা অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছল।
সেই ছেলে লোকনাথ মিত্র।
সে-সময়ে বুড়োকর্তার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলের একমাত্র মেয়ে হাসিরানী। বাঘের থাবায় পচন ধরে- যে ছেলে প্রাণ খুইয়েছিলেন তাঁর।
মেয়েটার হাসি দেখেই বুড়োকর্তা তার নাম হাসিরানী রেখেছিলেন বোধহয়। লোকনাথ, খুড়তুতো ভাই মন্মথ, আর বুড়োকর্তার নাতিরা আর এই নাতনী একসঙ্গে পাশাপাশি বড় হয়েছে। দু বছর বয়সে হাসিরানীর টাইফয়েড না কি মরণাপন্ন ব্যাধি হয়েছিল। তখন ও রোগের চিকিৎসা নেই। বাঁচার কোনো আশাই ছিল না। কিন্তু বাচল শেষ পর্যন্ত। কথা বলার মধ্যে সেই দু বছর বয়সেই কেমন একটু জড়তা ছিল। মেয়েটার। সেই কথা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। কথা বলতে চেষ্টা করলে মুখ দিয়ে কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ বেরুতে শুধু।
ওর পাঁচ বছর বয়সে তার বাবা সেই বাঘের ক্ষত নিয়ে ফিরে এলেন। সঙ্গে ছিল বিশ্বাসী আর দুরন্ত সাহসী চাকর কিষণচাঁদ। চাকর বলা ঠিক হবে না, আসলে সে ছিল বড়বাবু অর্থাৎ বড় ছেলের শিকারের অন্তরঙ্গ সঙ্গী। কিষণচাঁদ হুবহু বাঘের ডাক ডেকে বাঘকে ভুলিয়ে কাছে নিয়ে আসতে পারত। আরো অনেক রকম ডাক ডেকে জন্তু-জানোয়ারকে ঘাবড়েও দিতে পারত। বড়বাবুর প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে সেই কিষণচাঁদ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছিল। তার একটা মাত্র ছেলে, বছর চৌদ্দ বয়েস, বাপের মতোই ষণ্ডামার্কা হবে বড় হলে বোঝা যেত। তার নাম মগন, সে বাবুদের বাড়ীর ফাই-ফরমাস খাটত। কিষণ মরে যেতে মগনকেও বুড়োকর্তা সস্নেহে কাছে। টেনে নিয়েছিলেন। একই অঘটনে বড়বাবুও চোখ বুঝতে বুড়োকর্তার হুকুমে মগনের কাজ হল তার বোবা মেয়েটার দেখাশুনা করা, তাকে খেলা দেওয়া।
হাসিনীর বয়স তখন পাঁচ, লোকনাথ আর মন্মথের সাত, আর ওই মগনের চৌদ্দ। লোকনাথ বা মন্মথ মগনকে তেমন পছন্দ করত না, কুচকুচে কালো ছোঁড়াটা হাড়পাজী–আর গায়ে জোরও তেমনই, যখন-তখন ধরে রামঝকানি-টাকানি দিত। মেয়েটাকেও এক-একসময় দু হাতে একেবারে মাথার উপর তুলে ফেলত। কিন্তু হাসিরানী একটুও ভয় পেত না, নীরব হাসিতে ওর সমস্ত মুখ রক্তবর্ণ হয়ে যেত।
পাঁচ বছরে হাসিরানীর বাবা মারা গেছলেন, সাত বছর না হতে তার মা-ও চোখ বুজলেন। স্বামী অঘটনে মারা যাবার পর থেকেই মহিলা জীবন্থত হয়ে ছিলেন। সকলেই বলাবলি করতে লাগল মেয়েটা অভাগা, বিশেষ করে হাসিরানীর কাকা কাকীমারা, আর লোকনাথের কাকীমাও।
মগনের তখন ওকে আগলাবার দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। সে-ই যেন গার্জেন ওর। কর্তাবাবুদের চোখের আড়ালে মেয়েটার ওপর মগন দস্তুরমতো হম্বিতম্বি করত, একটু-আধটু শাসনও করত। কিন্তু লোকনাথ বা মন্মথ এমন কি হাসিরানীর খুড়তুতো ভাইরাও ওর সঙ্গে লাগতে এলে মগন মারমুখী একেবারে। সে-বেলায় কারোও ক্ষমা নেই।
বুড়োকর্তা সময়ে চোখ বুজলেন। হাসিরানীর বয়স তখন নয়। মগনের আঠেরো। পেল্লায় জোয়ান হয়ে উঠেছে। পাথুরে কালো গায়ের রং-এ যেন জেল্লা ছোটে। ওই ফুটফুটে মেয়েটার হাত ধরে পুকুরের পশ্চিম দিকের ঝোঁপঝাড় বনে-জঙ্গলে যখন ঘুরে বেড়াতো–তখন অদ্ভুত দেখতে লাগত। তপ্তকাঞ্চন আর নিকষ কালোর দুই সচল মূর্তি। পশ্চিমের ওই জঙ্গলই বড় জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। মেয়েটাকে ওদিকে নিয়ে যেত বলে গিন্নিদের কাছে বকাঝকা খেত মগন। কিন্তু ও তাদের কথা কানেই তুলত না। ফলে তারাও মগনের ওপর ক্রুদ্ধ। হাড়
এই সময়ে মগনের চাকরিটা গেল। বাবুদের চোখ দিয়ে দেখতে গেলে অপরাধ গুরুতরই বটে। প্রথম অপরাধ, নিষেধ সত্ত্বেও, পুকুরের পশ্চিম দিকে নিয়ে গেছে। মেয়েটাকে। তার সঙ্গে মেজকর্তার এক ছেলেও ছিল। কি কারণে রেগে গিয়ে মগন হাসিরানীর এত জোরে হাতটা ধরেছে যে বোবা মেয়েটা বীভৎস আর্তনাদ করে উঠেছে একটা। গালে রক্তের চাপ ধরে গেছে। মেজকর্তার ছেলে কি বলে উঠতে তার গালেও একটা প্রচণ্ড থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।
গিন্নিরা কর্তাদের কাছে নালিশ করেছেন। মেয়েটার গালের দাগ দেখিয়েছেন। ছেলের গায়ে হাত তোলার কথাও বলেছেন শুনে মেজকর্তা পায়ের চটি খুলে মগনকে বেশ করে প্রহার করে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছেন। এ-বাড়ীর ত্রিসীমানায় আর তাকে দেখা গেলে গায়ের ছাল থাকবে না, তাও বলে দিয়েছেন।
মগনের চাকরি যেতে সকলেই খুশি, এমন কি লোকনাথও কেবল ওই মেয়েটা ছাড়া। মগন ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী।
মগনকে কিন্তু প্রায়ই পশ্চিমের পুকুরঘাটের জঙ্গলের দিকে ঘুরঘুর করতে দেখা যেত। বিশেষ করে দুপুরে, কর্তারা যখন বাড়ি থাকেন না– আর গিন্নিরা যখন দিবানিদ্রায় মগ্ন। হাসিরানীকে চুপি চুপি ওর কাছে যেতে দেখা গেছে। আবার অন্য ভাইদের নালিশের ফলে ধরাও পড়ত হাসিরানী। রেগে গিয়ে কাকীমারা তখন ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতেন। মেয়েটা কিন্তু কাদত না বড়-একটা।
মেয়েটা অপয়া, মেয়েটা বোবা। কাকীমাদের অত্যাচার বাড়তেই থাকল ওর ওপর। আর মেয়েটাও একগুঁয়ে তেমনি। মারুক ধরুক, জঙ্গলের দিকে যাবেই–ফাঁক পেলে বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবেই। কাকীরা ছেড়ে কাকারাও কতদিন মারধর করেছেন ঠিক নেই।
হাসিরানীর চোখে জল গড়ায়, কিন্তু গলা দিয়ে কান্নার শব্দ বেরোয় না। কিন্তু এই মেয়ের হাসি যেন এক অদ্ভুত জিনিস। হাসিটা যেন ছোঁয়াচে রোগের মত ওর। কারণে-অকারণে হাসতে হাসতে রক্তবর্ণ হয়ে যায় একেবারে। তখনো গলা দিয়ে শব্দ বার করে না বিশেষ। হাসলে গালে টোল খায় আর হাসিটা যেন তার মধ্যেও লুটোপুটি খায়।
ওকে হাসাতে বড় ভাল লাগত লোকনাথের। একটু চেষ্টা করলেই হাসাতে পারত। ও মেয়ে সর্বদাই যেন হাসার জন্য তৈরি হয়ে আছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে যখন, তখনো মনে হয় হাসি-হাসি মুখ।
চৌদ্দ ছেড়ে পনেরয় পা দিয়ে এই মেয়েই বাড়ির অশান্তির কারণ হয়ে উঠল। এত রূপ সচরাচর চোখে পড়ে না। তেমনি স্বাস্থ্য। কিন্তু বুদ্ধি যেন হয়ইনি। এখনো সেই হাসি মুখে লেগে আছে–আর পশ্চিমের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আছে। কাকীমাদের। চোখের বিষ ও এখন। এখনো গুম-গুম কিল বসিয়ে দেন তারা, চুলের ঝুঁটি ধরে মাটিতে শুইয়ে ফেলেন। বাড়ির আঙিনার বাইরে সেদিন ওকে মগনের সঙ্গে ঠোঁট নাড়তে দেখে আর হাসতে দেখে তো কাকীমারা রেগে এমন আগুন যে, কাকারা পর্যন্ত সেই নালিশ শুনে রীতিমতো মেরেছেন ওকে। আর দুদিন দরজায় শিকল তুলে দিয়ে ঘরের মধ্যে আটকে রেখেছিলেন।
সেই সময় মন্মথ প্রায়ই বলত, হাসিরানীকে দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন করে। লোকনাথ ঠিক বুঝতে পারেননি তখনো, কেমন করে ওর বুকের ভেতরটা। মেয়েটাকে দেখলে লোকনাথের আগের থেকে ঢের বেশি ভালো লাগে এই পর্যন্ত কিন্তু বুকের ভিতর কেমন করে-টরে না।
বছর দুই বাদে বুঝতে পারল, মন্মথর বুকের ভিতরটা কেমন করে। হাসিরানীর তখন সতের, ওদের উনিশ। নীল ডুরে শাড়ি পরে যখন ঘুরে বেড়ায়, চোখ ফেরানো যায় না। মন্মথ ততদিনে আরো সেয়ানা হয়েছে। একদিন চুপি চুপি বলল, হাসিকে দেখলাম পশ্চিমের ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রায়ই যায় ওদিকে, মেয়েটা তো কথা বলতে পারে না–একদিন ধরব চেপেচুপে!
মন্মথর সঙ্গে লোকনাথের সেদিন দস্তুরমতো রাগারাগিই হয়ে গেছল।
পরের বছর। হাসিরানীর আঠেরো আর ওদের কুড়ি।
মন্মথ ম্যাট্রিকের বেড়া ডিঙোতে না পেরে এখানেই থাকে, তার বাপের সঙ্গে বাবুদের কাজকর্ম দেখে। কিন্তু আসলে কিছুই করে না। লোকনাথ ততদিনে খুব ভালোভাবে আই-এ পাস করে সেবারে বি-এ পরীক্ষা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে কমাসের জন্য ঘরে ফিরেছে।
বাড়িতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে কাকা-কাকীমার খুব হাসিমুখ দেখল। এতটা সচরাচর দেখে না।
মন্মথ ফাঁক পেয়েই তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেল। তারপর তাজ্জব কথা শোনালো। তিন মাস আগে হাসিরানীর কাকারা এক বউ-মরা আধবয়সী লোকের সঙ্গে হাসিরানীর বিয়ের ঠিক করেছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা গেল সেই লোকটার মাথা কে দুর্ফাক করে দিয়েছে-প্রাণে বেঁচে সে আর বিয়ের নামও করছে না।
হাসিরানীর কাকারা তখন মন্মথর বাবাকে ধরেছে। লোকনাথের সঙ্গে হাসিরানীর বিয়ে দিতে হবে। তার জন্যে কাকারা অনেক টাকাও খরচ করবেন। ওর বাবা নাকি তাতে রাজি হয়েছেন। লোকনাথ এসেছে, এবারই বিয়েটা হয়ে যাবে।
লোকনাথের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার তখন ভবিষ্যৎ-চিন্তা অন্যরকম। কমপিটিটিভ পরীক্ষা দেবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তার মধ্যে কিনা বিয়ে! আর যত রূপসীই হোক, একটা বোবা মেয়েকে বিয়ে করবে ও! কক্ষনো না, কক্ষনো না।
এরপর কাকা-কাকীমা ওঁকে খবরটা জানালেন। লোকনাথ মাকে বলল, সে এখন বিয়ে করবে না।
কাকা ততোধিক গম্ভীর। ধমকে বললেন, এটা ফাজলামোর ব্যাপার নয়, কর্তারা নিজের মুখে এ প্রস্তাব দিয়েছেন তার ভাগ্য ভালো। তাদের কথা দেওয়া হয়ে গেছে, এর আর নড়চড় হবে না।
লোকনাথ ঠিক করে ফেলল, বিয়ের আগেই সে পালাবে। জীবনে সে আর এ-মুখো হবে না। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে বড় কষ্ট হল তার। রূপ যেন ফেটে পড়ছে। ওর সঙ্গে দেখা হতেই ফিক করে হাসল, গালে টোল পড়ল সেই হাসি সমস্ত মুখে ছড়ালো। চটপট সরে পড়ল সে।
লোকনাথ বুঝল মেয়েটাও শুনেছে সব। দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু বিয়ে সে এখানে করতে পারবে না– পালাবেই।
পরদিন দুপুরে মেঘলা দিন দেখে পশ্চিমের জঙ্গলের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছিল লোকনাথ। জঙ্গলের পরিবেশ তার ভালো লাগে।
হঠাৎ বিষম চমকে উঠল। সামনে হাসিরানী। ওকে দেখে সেও ভয়ানক চমকে উঠেছে। ঘাটের থেকে বেশি দূরে নয় অবশ্য জায়গাটা। লোকনাথ জিজ্ঞাসা করল, হাসিরানী, তুমি এখানে একলা কি করছ?
হাসিরানীর মুখে লালের ছোপ লাগল। কিন্তু মুখ শুকনো। লোকনাথ ভাবল, পাছে। বাড়িতে বলে দেয়, সেই ভয়।
লোকনাথ বলল, আমি কাউকে কিছু বলব না। শোনো..বাড়ির সব কি কাণ্ড করতে যাচ্ছে শুনেছ?
হাসিরানী মাথা নাড়ল– শুনেছে।
–ইয়ে…তুমি কি বলো?
মুখের দিকে সোজা তাকালো। ঠোঁটের ফাঁকে হাসি। বিপরীত মাথা নেড়ে আপত্তি জানালো কিছু।
–বিয়ে করতে চাও না?
আবার মাথা নাড়ল– চায় না।
–আমি কি করব? আপত্তি করব?
মাথা নেড়ে সায় দিল।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল লোকনাথের। বলল, আমি ভাবছি এখান থেকে পালিয়ে যাব!
এবারে একগাল হেসেই সায় দিল। অর্থাৎ সেই ভালো।
লোকনাথ চলে এলো। কিন্তু মেয়েটার কথা ভেবে অবাকই লাগছে তার। শেষে। ভাবল, বিয়ে কাকে বলে ও বোধহয় তাই-ই জানে না।
এমন দিনে সমস্ত এলাকায় যেন হঠাৎ নাড়াচাড়া পড়ে গেল একটা। ভয়ে সক্কলের মুখ শুকালো। পশ্চিমের জঙ্গলে সেদিন সন্ধ্যায় বাঘের ডাক শোনা গেল। দূরে অবশ্য, কিন্তু বাঘের কাছে কত আর দূরে? বারোশিঙা হরিণেরও বিদঘুঁটে ডাক শোনা যেতে লাগল! বাঘের পদার্পণ ঘটলে তারা অমনি ডেকে নিজেরা হুঁশিয়ার হয়, আর অন্য জীব-জন্তুকেও হুশিয়ার করে।
পর পর দু-তিন দিন দূরে দূরে বাঘের ডাক শোনা যেতে লাগল। তার পরের দিন দিনের বেলায়ও শোনা গেল। কর্তাদের বন্দুক আছে দুদুটো। কিন্তু সে বন্দুক হাতে নেবার মতো আর মানুষ নেই। পাহারাদার আছে একটা। তার কাঁধে একটা বন্দুক উঠল। কিন্তু ভয়ে তারও মুখ আমসি। কর্তারা শহরে খবর পাঠালেন। কিন্তু সেখান থেকেও কোনো সাড়া আসছে না।
…দূরে পশ্চিমের জঙ্গলে আগে বাঘের উপদ্রব খুবই ছিল। কিন্তু দশ বছরের মধ্যে সে ভয় নির্মূল হয়ে গেছে। কত বাঘ যে মারা পড়েছে ঠিক নেই। অন্য কোনো জঙ্গল থেকে ছিটকে-ছটকে এসে গেছে একটা। অত দূর থেকেও এমন গুরুগম্ভীর ডাক শোনা যায় যখন, বড় বাঘ সন্দেহ নেই। যতো দূরেই হোক, বাবুঘাটের ত্রিসীমানায় লোক মাড়ায় না। ঝোঁপঝাড় গাছপালার পরেই তো ঘন জঙ্গল শুরু। বড়-জোর এক-দেড় মাইল। ঘাটের দিকের কর্তাদের বাড়ির জানলা-দরজা পর্যন্ত অষ্টপ্রহর বন্ধ। ত্রাসে দিশেহারা সকলেই। লাঠিসোটা টিন কানেস্তারা নিয়ে লোকজন সন্ধ্যার পর থেকে সমস্ত রাত কর্তাদের বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।
সেদিন সকালের দিকেই বাড়ির সকলের রক্ত জল। পুকুরের ওপারে ঝোঁপ-ঝাড়ের কাছাকাছি বাঘের গরগর গলার শব্দ পাওয়া গেছে–আর দিনমানেই বারো-শিঙারা ডাকাডাকি ছোটাছুটি করেছে। লোকনাথরাও কর্তাদের বাড়ির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে পুকুরের ওপারের দিকে চেয়ে ছিল– আবার দরকারমতো ছোটার জন্যও প্রস্তুত ছিল সকলে।
কিন্তু বাঘের আওয়াজ আর শোনা গেল না। কেউ কেউ মন্তব্য করল, বাঘ ওদিকের ধারেকাছেই খেয়েদেয়ে ঘুম লাগিয়েছে।
…সেই দুপুরেই অঘটন ঘটে গেল। সকলে তখন ঘুমে। বাড়ির একটা ঝিয়ের হঠাৎ চোখ গেল পুকুরের ওপারে ঝোঁপের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে বড় কর্তার মেয়ে হাসিরানী। বাড়ি কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠল ঝিটা। তারপর পড়ি-মরি করে ছুটল তাকে ধরে আনতে। এত থেকে চিৎকার চেঁচামিচি শুনতে পাওয়ার কথা নয়, শোনা গেলও না। হাসিরানী তখন আপনমনে ঝোঁপ-ঝাড়ের আড়ালে অনেকটা। চলে গেছে, আর তাকেও দেখা যাচ্ছে না। ঝিটা একাই তারস্বরে চিৎকার করতে করতে পুকুরের ধার ধরে ছুটল। আর কেউ এগোতে সাহস করছে না–হাসিরানীর কাকীমারা দোতলায় দাঁড়িয়েই কাঁপছেন ঠকঠক করে।
ঝিটা চিৎকার করতে করতে সবে পুকুরের ওপারে পৌঁছেছে-হঠাৎ একেবারে কাছেই বাঘের প্রলয়ংকর গর্জন–চতুর্দিক কাঁপিয়ে দিয়ে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে-রকম গর্জন করে ওঠে তেমনি। গর্জন আর থামে না। ঝোঁপঝাড়ের ওধারেই ওটা যেন লণ্ডভণ্ড কাণ্ড করছে একটা। ঝি-টা আবার আর্তনাদ করতে করতে তীরের মতো এপারে ছুটে এসে মাটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। কর্তাদের বাড়ির সামনে তখন অনেক লোক কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। লোকনাথ আর মন্মথও ছিল।
খানিক বাদে বাঘের গর্জন থেমেছে।
সকলে যা বোঝবার বুঝে নিয়েছে। বড়কর্তার রূপসী বোবা মেয়েটাকে বাঘে টেনে নিয়ে গেল। সকলেই বলাবলি করল, মেয়েটা যেন আত্মঘাতিনী হল। ইচ্ছে কবেই বাঘের মুখে গিয়ে পড়ল।
লোকনাথেরও সেটাই স্থিরবিশ্বাস। আত্মাহুতি দিয়ে সে তাকে এবং অন্য সকলকে অব্যাহতি দিয়ে গেল। তারপর আর কোনদিন বাঘের ডাক শোনা যায় নি। দুদিন বাদে জঙ্গল তল্লাস করা হয়েছিল অনেক লোকজন নিয়ে, কিন্তু মূষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে এর মধ্যে বাঘের বা রক্তের কোনো চিহ্নও মেলেনি।
.
সমস্ত মুখ দিয়ে হাসি চুয়ে চুয়ে পড়ছে হাসিরানীর। পাশ থেকে বড় ছেলের সহাস্য উক্তি, কাকা, আমরাও বাবা আর দাদুর মতো ভয়ংকর বাঘের ডাক ডাকতে পারি–আপনাকে শোনাতে বলছেন!
লোকনাথবাবু হাসিরানীর দিকেই চেয়ে আছেন আর হাসছেনও। চা-জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছে–অন্য ছেলেরা আর বউরাও হাসিমুখে দাঁড়িয়ে।
লোকনাথবাবু বড় ছেলেকে বললেন, তার থেকে তোমার বাবার একখানা ফটো থাকে তো আমার বড় দেখার ইচ্ছে।
মায়ের ইশারায় বড় ছেলে তাকে নিয়ে সামনের ঘরে ঢুকল। সামনের টেবিলেই টাটকা মালা পরানো মস্ত একখানা ফটো। ফটোর মধ্যে দাঁড়িয়ে মগন যেন হাসছে তার দিকে চেয়ে। হাঁটুর ওপর কাপড় তোলা। পাথরে খোদাই করা দেহ।
ফিরে এসে লোকনাথবাবু বসলেন আবার। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। কিন্তু লোকনাথবাবুর উঠতে ইচ্ছে করছে না। মায়ের ঠোঁট-নাড়ার দিকে খানিক মনোযোগ দিয়ে চেয়ে থেকে বড় ছেলে তার দিকে ফিরল।-মা আপনাকে যে জন্য ডেকে এনেছেন, এতক্ষণ সেটাই আপনাকে বলা হয়নি। শুনে আপনিও মতামত দেবেন।
এবারে যে কথাগুলো বলে গেল সে, শুনে লোকনাথবাবু স্তব্ধ খানিকক্ষণ।
–চার ছেলেকে মা তার মনের মতো করে মানুষ করেছে, মায়ের হুকুমে তাদের লাঠি চালানো, ছোরা খেলা আর বন্দুক ছোঁড়া শিখতে হয়েছে। শিকারে পটু হতে হয়েছে। মা সর্বদাই বলতেন তার একটা কাজ ছেলেদের করে দিতে হবে–আর সেই কাজের জন্য বড় হয়ে তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। এই প্রস্তুত হবার ব্যাপারে বাবাই ওদের সাহায্য করেছেন। মারা যাবার আগেও তিনি বলে গেছেন, মা যা বলে তাই করবি, তাতে জান যায় যাক!
সেই কাজের সময় এসেছিল ছ বছর আগে। মায়ের হুকুমে আচমকা ঘেঁকে। ধরে ঠিক ডাকাতের মতোই মায়ের বাপের বাড়ির কর্তাদের দু ভাইকে আর তাদের চার ছেলেকে আটক করে আনা হয়েছিল। তাদের গায়ে কেউ হাত তোলেনি, কিন্তু ভয়ে তারা তখন আধমরা। তার তিন ভাই বন্দুক হাতে ওই চার ছেলেকে পাহারা। দিয়েছে–আর বড় ভাই আলাদা ঘরে মায়ের দুই কাকাকে। মা শুধু তার কাকাদের ঘরে এসেছেন, প্রণাম করেছেন, তারপর তার মারফৎ কাকাদের জানিয়েছেন-পৈতৃক সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ মায়ের পাওনা–তার বিনিময়ে নগদ মূল্য না পেলে ছেলেদের হাত থেকে ওঁদের ছেলেদের রক্ষা করা যাবে না। মায়ের কাকারা অনেক মিনতি করেছেন ছেড়ে দেওয়ার জন্য, ছেড়ে দিলে যথাসাধ্য ব্যবস্থা করবেন।
মা অবিচল কঠিন। তার হুকুম, কাকার ছেলেরা তার জিম্মায় থাকবে, কাকারা টাকা আনার জন্য যেতে পারেন–পাঁচ দিন সময়, তার মধ্যে তাদের ছেলেদের কেউ কেশ স্পর্শ করবে না–কিন্তু পাঁচদিনের মধ্যে টাকা না নিয়ে এলে আর তাদের রক্ষা করার কোনো দায়িত্ব তার থাকবে না।
…কাকারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন। মাকে, মা রাজি হননি। শেষে সত্তর হাজার টাকায় রফা হয়েছে।
পাঁচদিনের মধ্যে সেই টাকা তারা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে ছেলেদের মুক্ত করে নিয়ে গেছেন।
হাসিরানী চেয়ে আছে লোকনাথবাবুর দিকে। একাগ্রভাবে যেন সে জানতে চায় কিছু। লালচে মুখ গম্ভীর এখন।
বড় ছেলে বলল, এখন মায়ের জিজ্ঞাস্য, এ-ভাবে দাবি আদায় করে মা পাপ করেছেন কিনা, অন্যায় করেছেন কিনা।
লোকনাথবাবু মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে ছিলেন তার দিকে। এরকম রমণী তিনি এ জীবনে আর দেখেন নি। বললেন, কোনো পাপ করোনি, কোনো অন্যায় করোনি তুমি যা করেছ তোমার ছেলেরা তা সোনার অক্ষরে লিখে রাখে যেন, বংশ বংশ ধরে সকলে যেন জানতে পারে।
আবার ওই মুখে হাসি ভরাট হতে লাগল, গালে টোল পড়ল, ঠোঁট দিয়ে গাল দিয়ে নাক-চোখ-কান দিয়ে হাসি ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়তে লাগল যেন।
আত্মবিস্মৃতের মতো চেয়েই আছেন লোকনাথবাবু।
তার মনে হতে লাগল, তেত্রিশ বছর আগে বাবুদীঘির নিরাপদ ব্যবধানে দাঁড়িয়ে বাঘের ডাক শুনেছে সকলে কদিন ধরে। বাঘিনীর নিঃশব্দ গর্জন কেউ শোনেনি।