বাঘিনি
১
বিশেষ খবর
নিজস্ব সংবাদদাতা :
‘‘শহরে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বাঘনখের আবির্ভাব হল! দু-মাস আগে বাঘনখের আক্রমণে প্রথম মারা গিয়েছিলেন প্রবীণ গ্রহরত্নবিক্রেতা ও স্বর্ণব্যবসায়ী শ্রীশ ঘোষ! বর্তমানে আবার বাঘনখের শিকার হলেন এক যুবতী৷ যুবতীর নাম কল্পনা বসু৷ জানা গিয়েছে, তিনি পেশায় ফটোগ্রাফার ছিলেন৷ দেড় বছর আগেই এক বিখ্যাত পশু সংরক্ষণশালায় বাঘিনি ‘তেজস্বিনী’র আক্রমণে ‘সুবীর মুর্মু’’ নামক কিশোরের মর্মান্তিক মৃত্যুর লাইভ ও সম্পূর্ণ ফুটেজটি তিনিই তুলেছিলেন৷ পরবর্তীকালে প্রায় কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে এই ফুটেজটি বেসরকারি চ্যানেলকে বিক্রিও করেছিলেন কল্পনা৷ অথচ তারই মর্মান্তিক মৃত্যু হল বাঘনখের হামলায়! আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, এই হত্যাকাণ্ডেরও একটি লাইভ ফুটেজ তোলা হয়েছে স্বয়ং কল্পনারই মোবাইলে! কোনও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি মোবাইলটি একটি বিখ্যাত বেসরকারি চ্যানেলকে পাঠিয়েছেন! ফুটেজে অবশ্য শুধু কল্পনাকেই দেখা গিয়েছে, হামলাকারীকে দেখা যায়নি৷ পুলিশ আপাতত মোবাইলটির প্রেরককে খুঁজছে৷
এ সম্পর্কে তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন যে প্রথমে প্রত্যেকটি ছিন্নভিন্ন মৃতদেহকে দেখে হিংস্র পশুর আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে বলেই মনে করেছিলেন তাঁরা৷ কিন্তু ফরেনসিক রিপোর্ট সবাইকেই স্তম্ভিত করে দেয়৷ ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী কোনও হিংস্র পশুর নখে নয়, বরং উপরোক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু হয়েছে মজবুত টাইটানিয়াম অ্যালয়ের তৈরি ধারালো ও তীক্ষ্ণ কোনও অস্ত্রে, যার আকার অবিকল বাঘের নখের মতো৷ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ এও জানান যে টাইটানিয়াম অ্যালয়ের কৃত্রিম বাঘনখ আসল বাঘের নখের থেকেও অনেকগুণ বেশি ধারালো ও মজবুত৷ কল্পনা-হত্যার ভিডিও ফুটেজ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মতমতকেই সঠিক প্রমাণ করেছে! ভিডিও ফুটেজে হত্যাকারীকে দেখা না গেলেও বাঘনখটিকে স্পষ্ট দেখা গেছে৷ তদন্তকারী অফিসার অবশ্য বাঘনখ রহস্যের অন্ধকারে বিশেষ কোনও আলোকপাত করতে পারেননি৷ তাঁর মতে এগুলো কোনও বিকৃত মস্তিষ্ক সিরিয়াল কিলারের কাজ৷’’
২
আজ এখানে, এই পশু সংরক্ষণশালার মুক্তাঞ্চলে একটা লড়াই হবে৷ ভারী মজার লড়াই৷
প্রথম যোদ্ধার নাম শুইমুই মুর্মু৷ শুইমুই নাম শুনলেই বোঝা যায় যে, সে জন্মসূত্রে বাঙালি নয়৷ প্রণয় ও পরিণয়সূত্রে বাঙালি হয়েছে৷ নাগাল্যান্ডের কোনও এক গ্রামে তার বাবার জন্ম হয়েছিল৷ আর তার জন্ম হয়েছিল এক সার্কাস পার্টির তাঁবুতে৷ নাগাদের সহজাত ও স্বভাবগত প্রবৃত্তিতে সে বেপরোয়া হিংস্র যোদ্ধা ও প্রতিহিংসাপ্রবণ! বয়েস চল্লিশ৷ দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি৷ ওজন ১০৭ পাউন্ড৷ প্রজাতি মানবী৷ তার আরেকটি পরিচয়, সে দেড় বছর আগে বাঘিনির আক্রমণে মৃত হতভাগ্য কিশোর ‘সুবীর মুর্মু’র মা!
শুইমুই-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হল ‘তেজস্বিনী’৷ কোনও এক কালে তার কোনও পূর্বপুরুষ হয়তো সুন্দরবনের অরণ্যে ছিল, তবে তার মা-বাপ, ঠাকুর্দা-ঠাকুমা; মায় কয়েক পুরুষ এই পশু সংরক্ষণশালায় জন্মেছে৷ তার জন্মও এখানেই৷ তবে সহজাত ও স্বভাবগত প্রবৃত্তিতে সে ভয়াবহ হিংস্র৷ তার সম্বন্ধে দুটি ইংরেজি শব্দ অমোঘভাবেই বলা যায়৷ ‘অটোম্যাটিক কিলিং মেশিন’ ও ‘ন্যাচারাল প্রিডেটর’৷ বয়েস, পাঁচ বছর৷ দৈর্ঘ্য মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯ ফুট৷ ওজন সাড়ে তিনশো পাউন্ড৷ প্রজাতি বিশুদ্ধ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগ্রেস, বাঘিনি৷ তার আরেকটি পরিচয়, সে শুইমুই-এর একমাত্র সন্তান ‘সুবীর মুর্মু’র খুনি!
দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পরিচয় দিয়ে দিয়েছি৷ এবার যুদ্ধ শুরু হবে৷ ভারী মজার যুদ্ধ৷ যে কোনও রিয়েলিটি শো’র টি আর পি-কে চ্যালেঞ্জ করতে পারত এই লড়াই৷ কিন্তু সে উপায় নেই৷ এ যুদ্ধ চোখে দেখা যাবে না৷ তাই সেই যুদ্ধের গল্পই আজ বলব তোমাদের৷ ধরে নাও, এটা এক অদ্ভুত সংগ্রামের ধারাবিবরণী!
৩
শুইমুই প্রাণীটার গন্ধ পাচ্ছিল৷ একটু আগেই পশু সংরক্ষণশালার দুই প্রহরীকে চিরঘুমের দেশে পাঠিয়ে দিয়ে তেজস্বিনীর খাঁচা নিজের হাতে খুলে দিয়েছে সে৷ ওই দুই অপদার্থ সিকিউরিটি গার্ডের মৃত্যুই ছিল উপযুক্ত শাস্তি! ওরা সুবীরকে বাঁচায়নি৷ ওদের মরাই উচিত!
সে খাঁচা খুলে দিয়েই মুক্তাঞ্চলে ঢুকে গেছে৷ অবশ্য তেজস্বিনী তখনও ব্যাপারটা কী হচ্ছে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি৷ সে তার তিন সন্তানকে নিয়ে খাঁচায় ঘুমিয়ে ছিল৷ কিন্তু খাঁচা খোলার শব্দ পেয়েই কান খাড়া হয়ে গিয়েছিল তার৷ এই মুহূর্তে সে তিন তিনটি ব্যাঘ্রশিশুর জননী৷ তাই সবসময় স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে!
তাই আজও অসময়ে গেট খোলার আওয়াজ শুনে সে তখনই মুক্তাঞ্চলে যায়নি৷ বরং আশপাশটা ভালোভাবে জরিপ করে নিল! ব্যাপারটা ঠিক কী হচ্ছে হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে৷ ততক্ষণে অবশ্য বাচ্চাদের ঘুম ভেঙে গেছে৷ মহানন্দে আহ্লাদি গরগর আওয়াজ করে তারা ছুটেছে মুক্তাঞ্চলের দিকে৷ ঘুরে বেড়াবার বাগানটা তাদের ভারী পছন্দ৷ একবার বেরোলে আর খাঁচায় ঢুকতেই চায় না! তেজস্বিনী গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে৷ বাচ্চারা মুক্ত উদ্যানের দিকে যাচ্ছে৷ ওদের একা যেতে দেওয়া উচিত নয়৷ অগত্যা সে-ও পেছন পেছন গেল৷
ততক্ষণে অবশ্য মুক্তাঞ্চলের বিরাট একটা গাছের মগডালে উঠে গিয়েছে শুইমুই৷ এবার পচা মাংসের বিকট বুনো গন্ধটা পেয়ে বুঝল শত্রু খুব কাছাকাছিই আছে৷ ছোটবেলা থেকেই সে প্রায় বাঘের সঙ্গে ঘর করে এসেছে৷ তার বাবা ছিল সার্কাসের নামজাদা রিংমাস্টার৷ সারাজীবনে অজস্র বাঘকে চাবকে সোজা করেছিল বাবা৷ শুইমুই যখন ছোট ছিল তখন থেকেই বাবার ট্রেনিং দেওয়া দেখত৷ জীবনে প্রচুর বাঘ দেখেছে ও৷ বাবার মুখে শুনেছে ওদের দুর্বলতার কথা৷ বাঘের গায়ের গন্ধ, বাঘের আক্রমণ কৌশল, বাঘ কী ভয় পায়, তার দুর্বলতা কোথায়; এ সব কিছুই শৈশব থেকে শুইমুইয়ের নখদর্পণে!
দেহটাকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে অদ্ভুত কৌশলে পা দিয়ে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ল ও৷ তার মাথাটা নীচের দিকে৷ এখন শরীরটা পেন্ডুলামের মতো দুলছে৷ দুলতে দুলতেই সে বাঘটার উপস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে৷ অন্য কেউ হলে নির্ঘাৎ নীচে পড়ে যেত৷ কিন্তু সার্কাসে মানুষ হওয়া শুইমুই অল্পবয়েসে সার্কাসে ট্র্যাপিজের খেলা দেখাত৷ দেহের ব্যালান্স, ক্ষিপ্রতা, রিফ্লেক্সের চরম সীমায় নিজেকে নিয়ে গিয়েছিল সে৷ তার জন্মদাত্রীও ট্র্যাপিজশিল্পীই ছিলেন৷ এই বিদ্যা তার জন্মলব্ধ ও কুড়ি বছরের সাধনায় শানিত!
তেজস্বিনী তখন ঠিক সেই গাছটার নীচেই দাঁড়িয়েছিল৷ তার তিন সন্তান এখন মায়ের লেজ নিয়ে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ তেজস্বিনী আলতো সতর্ক দৃষ্টিতে একবার ওদের দেখে নিল৷ পরক্ষণেই উৎকর্ণ হয়ে উঠে কী যেন শোনার চেষ্টা করে৷ একটা অস্ফুট শব্দ তার কানে এল৷ শব্দটা মাথার ঠিক ওপরে! গাছের মগডালে অদ্ভুত একটা চাঞ্চল্য তার তীক্ষ্ণ অনুভূতিতে ধরা পড়েছে৷ তার সঙ্গে একটা অপরিচিত গন্ধ৷ সে কৌতূহলী হয়ে মুখ তুলে গাছের দিকে তাকাতেই যাচ্ছিল, তার আগেই গাছ থেকে ঝুপ করে কেউ একটা লাফিয়ে পড়ল একদম সামনে!
তেজস্বিনী প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েই পিছনে হটে যায়৷ অদ্ভুত দৃষ্টিতে জরিপ করছে সামনের প্রাণীটিকে! একটা মানুষ! আস্ত একটা মানুষ! কিন্তু এ কী ভয়ংকর মানুষ! সারা গায়ে তার অজস্র কাঁটা! দু-হাতে ধারালো লম্বা লম্বা নখ! অতবড় নখ তেজস্বিনীর নিজেরও নেই!
তেজস্বিনী কী করে জানবে যে শুধু এই কাঁটাওয়ালা আঁটোসাঁটো জামাটা তৈরি করাতেই মানুষটা তার সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছে! শুইমুইয়ের বাঙালি স্বামী তাদের সার্কাসেই ছুরির খেলা দেখাত৷ সুবীর যখন শুইমুইয়ের পেটে এল, তখন দুজনে মিলে ঠিক করল, আর সার্কাসে চাকরি করবে না৷ সুবীরের বাবা চাকু, ছুরি ভালো বুঝত৷ সে প্রথমে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছুরি, বঁটিতে শান দেওয়ার কাজ করত৷ তারপর একটু মূলধন জমা করে নিজেই একটা ছোট্ট দোকান দিয়ে বসল৷ চাকু, ছুরি, বঁটি, দা বানাত সে৷ ধারও দিত৷ তার সঙ্গে থেকে থেকে শুইমুইও ধাতু গড়া-পেটা-শান দেওয়ার কাজটা শিখে গিয়েছিল৷ তাই স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর সে নিজেই দোকান চালাত!
সেই দোকানটাও এক বছর আগে বিক্রি করে দিয়েছে শুইমুই৷ বেচে দিয়েছে অনেক কষ্টে তৈরি করা নিজস্ব বসতবাড়িটাও৷ টাইটানিয়ামের দামি বাঘনখ, কাঁটাওয়ালা আঁটোসাঁটো ট্র্যাপিজ স্যুট বানানোর জন্য সে সমস্ত সঞ্চয় মায় জীবনধারণের একমাত্র রাস্তা এমনকি মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে৷
তেজস্বিনী অপলকে দেখছিল৷ সেও চুপ করে দেখছিল তাকে৷ বাঘের জ্বলজ্বলে চোখের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল৷ একবারও পলক ফেলছে না! রাগে তার চোয়াল শক্ত! এই তো! এই তার ছেলের খুনি! এই শয়তানির চোয়ালে দশ মিনিট ধরে ঝুলেছিল তার একমাত্র সন্তান৷ এর তীক্ষ্ণ দাঁতের কামড়ে অসময়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল তার জীবনের ধন সুবীর! দৃশ্যটা মনে পড়তেই চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে তার৷ আর কিছু হারানোর নেই! কোনও পিছুটান নেই! এই দিনটার প্রতীক্ষাতেই এতদিন ছিল সে৷ অধীর আগ্রহে দেড় বছর ধরে অপেক্ষা করছিল, কবে বাঘিনিটা যুবতী হবে! কবে সে মা হবে! ওই তো! তিনটে বাচ্চা মায়ের কাছেই খেলা করে বেড়াচ্ছে! এইবার দ্যাখ শয়তানি, সন্তানের মৃত্যু নিজের চোখের সামনে দেখতে কেমন লাগে! এই বাঘনখ দিয়েই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করব তোর বাচ্চাদের গলার নলি! দ্যাখ রক্তপিপাসু রাক্ষসী!
তেজস্বিনী কিছু বোঝার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল একটা মশাল৷ এতক্ষণ মশালটাকে পিঠে বেঁধে রেখেছিল শুইমুই৷ এবার জ্বালিয়ে দিয়েছে! চোখের সামনে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতে দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল তেজস্বিনী৷ কী করছে মানুষটা! প্রচণ্ড বিপন্নতায় সে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে! বিদ্যুৎগতিতে শিশু বাঘগুলোকে আলতো করে কামড়ে ধরে বাঘিনি প্রাণপণ দৌড় লাগাল একটু নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে৷ এইমুহূর্তে তার নিজের প্রাণের ভয় নেই! কিন্তু বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতেই হবে…বাঁচাতেই হবে…!
…ঠিক এমনই একটা দৃশ্য দেড় বছর আগে অভিনীত হয়েছিল এখানে! এক কিশোর পাঁচিলের ওপরে উঠে বাঘিনিকে ভালো করে দেখতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে পড়ে গিয়েছিল ভিতরে! তখন এই বাঘিনিই এসে দাঁড়িয়েছিল তার মুখোমুখি! সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখে বারবার করজোড়ে প্রাণভিক্ষা করে চলেছিল সুবীর৷ বাঘিনি তখনও স্থিরচিত্রের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ বোধহয় তখনও সে বুঝতে পারেনি, সামনের ক্রন্দনরত, ভয়ে সাদা হয়ে যাওয়া প্রাণীটাকে নিয়ে ঠিক কী করা উচিত!
আর বাইরে সেই হতভাগ্যের মা তখন উন্মাদিনীর মতো কাঁদছে! কাঁদতে কাঁদতেই উপস্থিত জনতার হাতে-পায়ে পড়ছে৷ পাগলের মতো বলছে, ‘আমার ছেলেকে বাঁচাও! যে করেই হোক বাঁচাও! ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই! ওর কিছু হলে আমি আর বাঁচব না৷’
‘আ-বে হট!’ এক মোটাসোটা দর্শক লাথি মেরে সরিয়ে দিল তাকে৷ উত্তেজিত জনতার রাশ তখন ভেঙে পড়েছে খাঁচার বাইরে৷ মানুষ আর বাঘের ডুয়েল! এমন বীভৎস ও দুর্লভ মজার দৃশ্য কেউ হাতছাড়া করে! মোটা লোকটা ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল সেদিকেই৷ হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘ওই দ্যাখ! কী করছে বোকাটা! বাঘের সামনে হাতজোড় করছে! বাঘের সামনে হাতজোড় করে কিছু হয়?’
হতভাগী মায়ের চোখে বসে গিয়েছিল সেই দর্শকের চেহারাটা! লোকটা গ্রহরত্ন ও সোনার ব্যবসায়ী ছিল! নাম শ্রীশ ঘোষ! দেড় বছর পরে যখন তার বুকে বাঘনখ বসাতে যাচ্ছিল শুইমুই, তখনও লোকটা অবিকল সুবীরের মতোই বারবার হাতজোড় করে জীবনভিক্ষা করছিল৷ তার পায়ে পড়েছিল৷ শুইমুই মুচকি হেসে বলেছে; ‘ধুর বোকা! বাঘিনির সামনে হাতজোড় করছিস! বাঘিনির সামনে হাতজোড় করে কিছু হয়?’
কথাগুলো মনে পড়তেই হাল্কা মাথা ঝাঁকাল সে৷ নাঃ, সেসব এখন অতীত৷ বর্তমান এখন অন্তিম প্রতিশোধ! বাঘিনি তেজস্বিনী! যে এখন আগুন দেখে নিজের সন্তানদের বাঁচানোর জন্য পালাচ্ছে! শুইমুই জ্বলন্ত মশাল হাতে নিয়েই দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সেদিকেই৷
পালা, যতদূর পালাবি পালা! তুই আমার ছেলেটাকে তিন মিনিট সময় দিয়েছিলি৷ তোকে তিন ঘণ্টা সময় দিলাম৷ পারলে আরেক বাঘিনির হাত থেকে বাঁচা নিজের বাচ্চাকে৷
৪
তেজস্বিনী বুঝতে পারছিল না কী করবে! মানুষটার সঙ্গে লড়াই করতেই পারে৷ কিন্তু শিশুগুলোকে কীভাবে বাঁচাবে! সে জাতে বাঘিনি৷ কিন্তু সঙ্গে কোলের শিশু থাকলে মানুষ হোক, কী বাঘ, সব মায়েরাই অসহায়৷ সে আঁতিপাতি করে শুধু এমন একটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থান খুঁজছিল যেখানে ওই কালান্তক বাঘনখ পৌঁছবে না! কিন্তু সে জায়গা কোথায়? ওদিকে মশালটা ক্রমাগতই এগিয়ে আসছে! অথচ এখানে লুকোনোর জন্য একটা গুহাও নেই! খাঁচায় ফেরার উপায়ও নেই৷ মানুষটা পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে৷ বাচ্চাগুলোকে ওখানে রেখে আসতে পারলে মানুষটাকে দেখে নিত সে!
তেজস্বিনী প্রাচীরের চতুর্দিকে ছোটাছুটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল৷ চতুর্দিকে শুধু উঁচু উঁচু পাথরের দেওয়াল৷ একদিকে একটা লোহার গরাদ৷ ওই লোহার গরাদের সামনেই রোজ দর্শকের ভিড় জমে৷ ওদিকে গিয়ে লাভ নেই! সামনে শুধু একটা বড় পাথর৷ ওই পাথরের পেছনে বাচ্চাদের রেখে এবার সেও ঘুরে দাঁড়ায়৷
শুইমুই ততক্ষণে বাঘিনির পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ তার হাতের মশালে লকলকিয়ে উঠছে আগুন৷ বাঘ আগুনকে ভয় পায়৷ তেজস্বিনী তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছে৷ পরক্ষণেই হিংস্র দাঁত বের করে গর্জন করে উঠল! শুইমুই জানে, ও যতই বিক্রম দেখাক, ওর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে৷ সে বাঘিনির চোখে চোখ রাখে! দেওয়ালের দিকে এক পা এক পা করে পিছোচ্ছে সে৷ অর্থাৎ এবার নির্ঘাৎ লাফিয়ে পড়বে শুইমুইয়ের ঘাড়ে৷ বাঘের প্রত্যেকটা মুভমেন্ট, প্রতিটি ভঙ্গি ছেলেবেলা থেকেই তার মুখস্থ৷ ও এবার তরবারির মতো মশালটাকে তার মুখের কাছে খোঁচা মারার ভঙ্গিতে এগিয়ে দিল, ‘এই নে!’
তেজস্বিনী ক্রুদ্ধ গর্জন করে লাফিয়ে পিছিয়ে গেছে! সে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করছিল৷ কিন্তু মানুষটা তরোয়ালের মতো মশালটাকে তার নাকের সামনে ক্রমাগত নাড়িয়ে চলেছে৷ সে বিহ্বল! শরীরটাকে কুঁকড়ে তিন পা পিছিয়ে গেছে৷ প্রচণ্ড আক্রোশে অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করেই লাফিয়ে পড়ল মানুষটার ওপর৷
শুইমুই প্রস্তুত ছিল৷ অদ্ভুত ভঙ্গিতে একটা ভল্ট খেয়ে পিছিয়ে গেল৷ বাবা বলতেন, বাঘকে জব্দ করতে হলে অসম্ভব ক্ষিপ্রতা, রিফ্লেক্স প্রয়োজন৷ বাঘ ধারালো জিনিসকেও ভয় পায়৷ তাই সচরাচর বাইসন, ইন্ডিয়ান বাইসনের ধারে-কাছে ঘেঁষে না৷ এমনকি নিতান্ত নিরুপায় না হলে শজারুকেও ধরে না! কারণ শজারু যদি একবার সারা গায়ের কাঁটা পেটে ফুটিয়ে দিতে পারে, তবে বাঘেরও নিস্তার নেই৷ আর বাঘের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা দু-চোখের মাঝখানের অংশ আর পেট! পিঠ বা কাঁধে মজবুত মাসল থাকলেও ওদের পেটটা তুলনামূলক ভাবে অরক্ষিত৷
শুইমুই পিছিয়ে গেলেও বাঘের নখ ছুঁয়ে গেছে তার মুখ৷ কপাল থেকে গাল পর্যন্ত অংশ চিরে ফালাফালা হয়ে গেছে৷ যন্ত্রণায়, অসম্ভব আক্রোশে সেও তার বাঘনখ চালিয়ে দিয়েছে শূন্যে লাফিয়ে ওঠা বাঘিনির পেট লক্ষ্য করে৷ একটা প্রচণ্ড গর্জন! পরক্ষণেই ধপাস করে মাটির ওপরে পড়ে গেল তেজস্বিনী৷ তার পেট কেটে গেলেও খুব মারাত্মক জখম হয়নি৷ রক্তাক্ত, আহত, মরিয়া বাঘিনি প্রচণ্ড প্রতিশোধস্পৃহায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশে দ্বিতীয় লাফটা দিল৷ যেন ঝলসে উঠল একটা সোনালি ডোরাকাটা বিদ্যুৎ! শুইমুই দ্বিতীয় আক্রমণটা এত তাড়াতাড়ি আসবে বুঝতে পারেনি৷ এবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি তেজস্বিনী৷ মানুষটার টুঁটি তার হিংস্র শ্বদন্তে চেপে ধরেছে!
বাঘের চোয়ালে আটকে গেছে ঘাড়! একটু চাপ দিলেই মানুষটা শেষ! কিন্তু তেজস্বিনী পারল না! যন্ত্রণায় কাতরে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিয়েছে শুইমুই-এর গলা! শুইমুই জানত, বাঘের সহজাত প্রবৃত্তি শিকারের টুঁটি কামড়ে ধরা৷ সে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল৷ তার গলা, ঘাড় বেষ্টন করে আছে টাইটানিয়ামের কাঁটা শোভিত মজবুত কলার! তার খোঁচায় বাঘিনির জিভ, গাল কেটে গেছে! তেজস্বিনী আবার প্রচণ্ড গর্জন করে ওঠে! মশালের আলোয় স্পষ্ট দেখা যায় তার জিভ রক্তে ভেসে যাচ্ছে! গর্জনের তেজ অনেকটাই কম৷ বরং এবার সে অসম্ভব ভয় পাচ্ছে! তার চোখে মৃত্যুভয় স্পষ্ট!
‘আয়…!’ শুইমুই মশাল হাতে আবার এগোল তার দিকে৷ সে-ও অক্ষত নেই৷ তেজস্বিনীর নখ আরেকটু হলেই তার চোখটা খুবলে নিত৷ একটুর জন্য বেঁচে গেছে৷ দরদর করে রক্তের ধারা নেমে আসছে চোখে৷ সে ঝাপসা দেখছে৷ তবু ফের মশালটাকে উঁচিয়ে ধরে হাতের ইশারায় বাঘিনিকে ডাকে, ‘আয়…আয়…!’
আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল তেজস্বিনী৷ আক্রমণ না করে উপায়ও নেই৷ তার নির্বোধ সন্তানেরা এই পরিস্থিতিতেও মহানন্দে নিজেদের মধ্যে মারপিট করে খেলা করছে৷ ওরা এখনও আগুনকে ভয় পেতে শেখেনি! বিপদের গন্ধ কী ওরা বোঝে না!…
সুবীরও জানত না মৃত্যু কাকে বলে! মৃত্যুভয় কী! তাই নির্বোধের মতো পাঁচিলের ওপর উঠে বাঘ দেখতে গিয়েছিল৷ একবারও মনে হয়নি, পড়ে গেলে কী হবে! যখন বুঝতে পারল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে! নাকের সামনে স্বয়ং মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে!
…তখন প্রায় দু-মিনিট অতিক্রম করে গেছে! খাঁচার ভেতরে সুবীর তখনও জীবিত এবং আশ্চর্যভাবে সম্পূর্ণ অক্ষত! বাইরে লোকের পায়ে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে শুইমুই৷ সে জানে, এখনও বাঁচার আশা আছে! তার কান্নায় ঝাপসা অথচ অভিজ্ঞ চোখ বলছে, এই বাঘিনিটা কস্মিনকালেও শিকার করেনি! রেডিমেড মাংস খেয়ে অভ্যস্ত তেজস্বিনী জানেই না, ওর সামনে দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ শিকার বসে আছে৷ বরং সুবীরকে দেখে সে অবাক হয়ে গেছে! আদুরে গরগর আওয়াজ করে তাকে শুঁকছে৷ থাবা দিয়ে তাকে স্পর্শ করছে, অর্থাৎ খেলতে চাইছে৷ সুবীর অসহায়ের মতো কাঁদছে, তাকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে, হাতজোড় করছে! বাঘ যদি তাকে কিছু নাও করে, শুধু ভয়েই হয়তো মরে যাবে সে৷
এক যুবতী তখন ভিড় ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেছে মোবাইল হাতে নিয়ে৷ খুব মন দিয়ে ছবি তুলছে! তার পা জড়িয়ে ধরল শুইমুই, ‘কাউকে ডাকুন৷ আমার ছেলেকে বাঁচান! ও মরে যাবে!’
‘আঃ! ডোন্ট ডিস্টার্ব!’ যুবতী তখন সেলফোনের ক্যামেরায় ভিডিও তুলতেই ব্যস্ত! বিরক্ত হয়ে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল৷
‘দিদি, বাঁচান ওকে…!’ কান্নায় বুঁজে এসেছিল তার কণ্ঠস্বর৷ শিকার করুক বা না করুক, ভেতরের প্রাণীটা বাঘ! তার ওপর মূর্খ জনতা চেঁচামেচি করে তাকে ক্রমাগতই তিতিবিরক্ত করে তুলছে! সিকিউরিটি গার্ডরাই বা কোথায়? এতগুলো লোকের মধ্যে একজনও সিকিউরিটিকে ডাকবার কথা ভাবছে না! উলটে দৃশ্যটা দেখার জন্য হুড়োহুড়ি, হইচই করে সর্বনাশ করছে! মোবাইলে ছবি তুলছে…
সেই যুবতীর নামই কল্পনা বসু! ফুটেজটা বিক্রি করে সে প্রচুর টাকা কামিয়েছিল৷ তার মৃত্যুর ফুটেজও তাই তুলে সংবাদমাধ্যমকে পাঠিয়ে দিয়েছে শুইমুই৷ শোধবোধ!
এখন শেষ প্রতিশোধটাই বাকি৷ কিন্তু বিগত একঘণ্টা ধরে কিছুতেই সুবিধে করতে পারছে না সে৷ তেজস্বিনী তাকে কিছুতেই বাচ্চাদের কাছে যেতে দিচ্ছে না৷ বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে তার ওপর! দুজনেই ক্ষতবিক্ষত৷ দুজনেই ক্লান্ত৷ কিন্তু কেউ কাউকে একতিল জমিও ছাড়ছে না৷ টাইটানিয়ামের কাঁটায় রক্তাক্ত হয়ে গেছে বাঘিনি৷ বারবার নানা কৌশলে প্রতিপক্ষের টুঁটি ছিঁড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না! মুখ রক্তে লাল হয়ে গেছে, তবু হাল ছাড়ছে না! কাঁটার খোঁচাও তাকে নিরস্ত করতে পারে না! অন্যদিকে বাঘের থাবায় শুইমুইয়ের তলপেট, উরু, কোমর জখম হয়েছে৷ তবু সেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছে! দুজনেই হাঁফিয়ে গিয়েছে, তবু তেজ কমছে না! একজন সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর, আরেকজন সন্তানকে রক্ষা করতে মরিয়া! দুজনেই চক্কর কাটছে, একে অপরকে মেপে নিচ্ছে, এগোচ্ছে-পিছোচ্ছে৷ পরক্ষণেই লাফিয়ে পড়ে, জড়াজড়ি করে শুম্ভ-নিশুম্ভের লড়াই লড়ছে৷ আক্রোশে পরস্পরকে আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে, কিন্তু আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে! তেজস্বিনীর চওড়া পিঠের পেছনে তিন সন্তান এখনও সুরক্ষিত!
কতক্ষণ ধরে এই অদ্ভুত যুদ্ধ চলত কে জানে! আচমকা একটা সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল! এতক্ষণের লড়াইয়ে ক্লান্ত তেজস্বিনী লাফ মারতে গিয়ে হঠাৎই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়৷ তাকে কোনওমতে কাটিয়েই শুইমুই দেখল তার সামনে লাফাতে লাফাতে চলে এসেছে একটা বাচ্চা! এতক্ষণ ধরে এখানে যে লঙ্কাকাণ্ড চলছে, সে বিষয়ে তার কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই! সে মহানন্দে তিড়িংবিড়িং নাচছে! শুইমুই আর চিন্তা করল না! তিনটেকে না পারে, অন্তত একটাকে নিকেশ করবেই! বিদ্যুৎগতিতে বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় ছোঁ মেরে বাচ্চাটার ঘাড় চেপে ধরে৷ বাঘিনি দৃশ্যটা দেখেই হিংস্র দাঁত বের করে লাফ মারতে যাচ্ছে৷ কিন্তু তাকে লক্ষ্য করে হাতের জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে দিল শুইমুই! তেজস্বিনী ফের পিছিয়ে গিয়েছে৷ সে নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই লাফ মেরে গাছে উঠে গেল মানুষটা৷
বাঘিনি বুঝতে পারে, এবার আর উপায় নেই৷ পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ মানুষটার হাতে লম্বা লম্বা ধারালো নখে সে নিজে ক্ষতবিক্ষত! ক্রমাগত রক্তক্ষরণে দুর্বলও লাগছে, হাঁফ ধরেছে! কিন্তু ওর বাচ্চাটার কী হবে? ওর কোমল গলায় বা বুকে যদি ওই কাঁটা বসে যায়…!
আর ভাবতে পারে না সে৷ না! এত সহজে ছাড়বে না! রক্ত জমল তার চোখে! লাফ মেরে বেশ কয়েকবার হাঁচোড়-পাঁচোড় করে গাছে ওঠার চেষ্টা করল! কিন্তু চিতা আর লেপার্ড ছাড়া অন্য কোনও বাঘ গাছে চড়তে জানে না! ব্যর্থ হয়ে ভয়াল হুংকার ছেড়ে এখন পাগলের মতো, গোঁয়ারের মতো গাছটার গুঁড়িতে ছুটে এসে ধাক্কা মারছে সে! প্রচণ্ড গতির সঙ্গে সাড়ে তিনশো পাউন্ড এসে গায়ে আছড়ে পড়ায় গাছটাও থরথর করে কেঁপে ওঠে!
শুইমুই গাছে উঠে গিয়েছিল! কিন্তু আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে পা ফস্কেছে তার! ওই…পড়ল! পড়ল বুঝি! বাঘিনি আবার হুংকার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল! নাঃ, বাচ্চার নাগাল পায়নি! শুইমুই আবার ডাল আঁকড়ে ধরে সামলে নিয়েছে৷ ব্যালান্সের খেলায় তার সঙ্গে পারা মুশকিল! কিন্তু তার পা ছুঁয়ে গেল বাঘের থাবা!
‘আঃ! শয়তানি!’ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল শুইমুই! কী আশ্চর্য বোকা এই বাঘিনি! ও কি জানে না যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগাররা গাছে উঠতে পারে না! এখনও গাছের গায়ে নখ বিঁধিয়ে প্রাণপণ ওঠার চেষ্টা করে চলেছে! বারবার পিছলে পড়ছে, তবু কী প্রচণ্ড জেদে আবার ছুটে এসে লাফ মারছে৷ গোঁত্তা মারছে! চেষ্টার অন্ত নেই ওর! শুইমুই দাঁতে দাঁত পিষছে৷ বেশ হয়েছে! এবার বুঝেছিস, সন্তানের মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে কেমন লাগে! তবু তোর আরও দুটো বাচ্চা আছে! কিন্তু আমার তো একটাই ছিল! হারামজাদি! রাক্ষসী! আমার চোখের সামনে তার টুঁটি ছিঁড়েছিস তুই! আমার ছেলেটাকে শেষ করে তুই তিনটে বাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্তে খেলে বেড়াবি! হবে না! হতে দেব না! শোধ নেব! নিয়েই ছাড়ব!
সে আর দাঁড়ায় না! ট্র্যাপিজ প্লেয়ারের দক্ষতায় এ গাছে ও গাছে লাফ মারতে মারতে টপকে গেল পাথুরে প্রাচীর! তেজস্বিনী তাড়া করেছিল তাকে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাচীরের ওপরে দাঁড়িয়ে শেষ হাসিটা হাসল শুইমুই! তার শরীরটা ক্লান্ত হয়ে এসেছে, পেশিগুলোও এতক্ষণের যুদ্ধ, প্রচণ্ড উত্তেজনার পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে! তবু সে লাফ মারে প্রাচীরের ওপর থেকে৷ বাইরে বেরিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু জখম পা-টা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে! মাটিতে ল্যান্ড করার সময় পা মচকে গেল৷
‘উঃ! মা!’
৫
যুদ্ধ শেষ! বাঘিনি হেরে গিয়েছে৷ অবশেষে শুইমুই-এর বাঘনখ এঁটে বসতে চলেছে তার একটা বাচ্চার বুকে৷ বাচ্চাটাকে মেরে সামনের লোহার গরাদ দিয়ে লাশটা তেজস্বিনীর নাকের সামনে ফেলে দেবে ও! যে আগুনে দেড় বছর ধরে জ্বলছে সে, সেই আগুনে এবার বাঘিনিও জ্বলবে৷ ওর নাকের সামনেই বাচ্চাটার গলা কাটবে ও৷
শুইমুই উঠে দাঁড়াতে যায়৷ কিন্তু পারল না৷ গোড়ালিটা বেশ ভালোই মচকেছে! যন্ত্রণায় এই প্রথম চোখে জল এল তার৷ হাতের মুঠো আলগা হয়ে যায়৷ বাঘশিশুটা হাত ফস্কে পড়ে গেল মাটিতে৷ ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে ও বসে পড়েছে!
একটা চুকচুক শব্দ! মচকে যাওয়া পাটায় একটা ভিজে ভিজে ভাব! সে বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখে, ফুলে যাওয়া জখম গোড়ালি পরম মমতায় চেটে দিচ্ছে ব্যাঘ্রশিশু! না, রক্তের স্বাদ নিচ্ছে না! বাচ্চাটা ওর মায়ের কাছ থেকে শিখেছে যে কেউ ব্যথা পেলে সেই আহত জায়গাটা চেটে দিতে হয়৷ তাই সযত্নে আহত গোড়ালিটা চেটে দিতে দিতে মার্বেলের মতো নিষ্পাপ চোখ দুটো তুলে তাকায় বাচ্চাটা৷ যেন জানতে চাইছে, ‘ব্যথা কমেছে?’
শুইমুই স্তম্ভিত, বিস্ময়াহত হয়ে বসেছিল! কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না৷ কোথায় গেল তার সেই আক্রোশ! কোথায় সেই প্রতিশোধস্পৃহা! কোথায় জ্বালা! বাচ্চাটা কি এতদিনের সেই অনির্বাণ জ্বালার ওপরও মমতা ঢেলে দিয়েছে!
কানের কাছে একটা ‘গোঁ গোঁ’ শব্দ! তার সঙ্গেই অদ্ভুত একটা জোরালো ধাতব আওয়াজ৷ ভেতর থেকে বাঘের গর্জন ভেসে আসে৷ না, ঠিক গর্জন নয়! বাঘের এমন করুণ ডাক সহজে শোনা যায় না! এ বুকফাটা হাহাকার! কান্না! তেজস্বিনী কাঁদছে! বাঘিনি নয়, মানুষও নয়; এক মা নিজের শিশুকে হারিয়ে বুকফাটা কান্না কাঁদছে! আর এই জোরালো ধাতব আওয়াজটাও তার চেনা৷ বাঘিনি ছুটে এসে মাথা ঠুকছে লোহার গেটে৷ এখনও চালিয়ে যাচ্ছে শেষ চেষ্টা৷ ও কি জানে না, এই লোহার মোটা মোটা গরাদে মাথা ঠুকলে ওর মাথা ফাটতে পারে, কিন্তু এ ফাটক ভেঙে বেরোনো যাবে না! নিশ্চয়ই জানে৷ তবু অন্তিম নিঃশ্বাস অবধি সে এই গরাদে মাথা ঠুকে যাবে৷ কিছুতেই ওকে বোঝানো যাবে না যে চেষ্টা করে লাভ নেই…! একটা বাঘ হয়তো বুঝবে! কিন্তু মায়ের প্রাণ বুঝবে না৷
…তখন তিন মিনিট কেটে গেছে৷ খাঁচার বাইরে প্রবল হল্লা৷ ভিতরে তখনও সম্পূর্ণ অক্ষত সুবীর৷ বাঘিনি তার সঙ্গে খেলা করতে ব্যস্ত৷ খেলা করতে করতেই মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে৷ বাইরে তখন মূর্খ জনতা, ‘এই হুশ…হুশ…’ করে বাঘ তাড়াতে চাইছে৷ কেউ কেউ তুলে নিয়েছে পাথরের টুকরো৷ বাঘিনিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিচ্ছে! যেন ও আস্ত বাঘ নয়, স্রেফ ডোরাকাটা বড়সড় একটা বেড়াল৷ পাথর গায়ে পড়লেই পালিয়ে যাবে! একটা-দুটো ছোট ছোট ঢিল গায়ে লাগার ফলে বাঘিনিটা এবার রাগে ফুঁসছে!
সুবীরের হতভাগিনী মা তখন ঠিক এমন করেই লোহার গরাদে পাগলের মতো মাথা ঠুকছিল! উন্মাদিনীর মতো মাথা ঠুকতে ঠুকতে চেঁচাচ্ছে, ‘ওগো, তোমরা চুপ করো! ইট ছুড়ে ওকে ক্ষেপিয়ে দিও না! ক্ষেপে গেলে ও প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে! তোমাদের নাগাল পাবে না! কিন্তু হাতের কাছে যাকে পাবে, তাকে শেষ করে দেবে! আর ওর হাতের কাছে এখন আমার ছেলেটা একা…!’
কেউ তার কথায় পাত্তা দেয়নি৷ ভ্রূক্ষেপও করেনি৷ শুইমুইয়ের চোখের সামনেই একটা অব্যর্থ পাথরের টুকরো প্রচণ্ড বেগে লাগল বাঘিনির কপালের ঠিক মাঝখানে! ‘গাঁক’ করে একটা গর্জন করে উঠে পেশি কুঁচকে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে একটু পিছিয়ে গেল প্রাণীটা! বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল শুইমুই, তার আশঙ্কাকে সত্যি করেই এবার প্রচণ্ড হিংস্রতায় সুবীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে৷ বিদ্যুৎগতিতে তার গলা তীক্ষ্ণ দাঁতে কামড়ে ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল অন্যদিকে…!
প্রচণ্ড ধাতব শব্দে সংবিত ফিরল শুইমুইয়ের৷ আওয়াজটা ক্রমাগতই বাড়ছে! অর্থাৎ জোরে, আরও জোরে, প্রচণ্ড জোরে লোহার গরাদে মাথা ঠুকছে তেজস্বিনী৷ ও কি নিজের প্রাণটাও দিয়ে দেবে! ওর গোঙানির আওয়াজ এখন আরও স্পষ্ট৷ এদিকে শিশু বাঘটার কোনও ভয় নেই৷ সে দিব্যি তিড়িংবিড়িং করে লম্ফঝম্প করে নাচতে শুরু করল৷ আস্তে আস্তে হাতের বাঘনখটা খুলে ফেলে শুইমুই! দু-হাতে তুলে নিল তার চিরশত্রুর সন্তানটিকে৷ বাচ্চা বাঘটা তার ছোট্ট ছোট্ট দুটো থাবা রাখল তার দু-গালে! ভীষণ নিশ্চিন্ততায়, আরামে তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে জব্বর হাই তুলল৷ বেচারির ঘুম পেয়েছে!
দেড় বছর ধরে যে কান্না বুকের ভেতরে জমে ছিল, এবার সহ্যের শেষ সীমাটুকুও অতিক্রম করে বেরিয়ে এল বাইরে৷ ভিতরে এক বাঘিনি বুকফাটা কান্না কাঁদছে৷ সেই আওয়াজেই শুইমুইয়ের প্রাণ মুচড়ে উঠেছিল৷ এবার ব্যাঘ্রশিশুকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে সেও ‘হা হা’ করে বোবাকান্নায় ফেটে পড়ল!
একজন বাঘিনি, অন্যজন মানুষ! কান্নার আওয়াজ কিন্তু দুজনেরই প্রায় একরকম৷
সেদিন সকালে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে পশু সংরক্ষণশালার কর্মীরা চমকে গেল! এক মহিলা গরাদের বাইরে টানটান হয়ে পড়ে আছে৷ মেয়েটি নিজের বুকেই টাইটানিয়ামের বাঘনখ বসিয়ে আত্মহত্যা করেছে৷ তার মৃতদেহের পাশে, গরাদের উল্টোদিকে স্থির হয়ে বসে আছে বাঘিনি ‘তেজস্বিনী’৷ দুজনেই সমান ক্ষতবিক্ষত৷ তেজস্বিনীর চোখ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ছে! তার কোলের কাছে শুয়ে আরাম করে দুধ খাচ্ছে তিন সন্তান! হ্যাঁ, তিন সন্তানই৷ শুইমুই তার প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে৷ তেজস্বিনী বুঝেছে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা কাকে বলে! মায়ের প্রাণের জ্বালা সেও অনুভব করেছে৷ এক প্রতিশোধকামী নারী তার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল তার সন্তানকে৷ আর এক মা ফিরিয়ে দিয়ে গেল তাকে…!
একটু পরেই এই অভিনব দৃশ্য দেখার জন্য ভিড় জমে গেল৷ একের পর এক মিডিয়ার লোক মাইক হাতে নিয়ে নানারকম মুখভঙ্গি করে বক্তৃতা করছে৷ ‘বাঘনখ’ কিলারের পরিচয় ততক্ষণে জানা গেছে৷ সুতরাং তা নিয়ে সম্ভব-অসম্ভব অনেকরকম গল্প বানিয়ে চলেছে তারা! অনেক সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে তাদের কথায়৷ এক অদ্ভুত নারীর অবিশ্বাস্য প্রতিশোধের গল্প এখন মিডিয়ার কাছে ‘হটকেক’৷
শুধু একটা প্রশ্ন করা উচিত ছিল৷ কিন্তু কেউ করল না! খুব স্বাভাবিক এবং মানবিক একটা প্রশ্ন উঠে আসার সম্ভাবনা ছিল; তবু উঠল না!
বাঘিনির চোখ বেয়ে জল পড়ছিল কেন? ও কি কাঁদছিল? কেন?…
—