বাঘকে বিশ্বাস নেই
বাঘ শিকারের কাহিনি অধিকাংশ সময়েই অতিরঞ্জিত হয়ে থাকে। অভিজ্ঞ শিকারি এমন সুকৌশলে শিকারের দলটাকে পরিচালনা করেন যে, বাঘের আত্মরক্ষার চেষ্টা প্রায়ই ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে হাতির সাহায্যে জঙ্গল ভাঙা হলে, সেখানে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। জঙ্গল তাড়িয়ে নির্দিষ্ট স্থানে বাঘকে আনা হয়, তারপর হস্তিপৃষ্ঠে নিরাপদ ব্যবধান থেকে কয়েকজন শিকারি গুলি চালিয়ে বাঘকে বধ করেন। তবু বিপদ যে ঘটে না, তা নয়। তবে সেগুলো হচ্ছে অভাবিত দুঘর্টনা।
কোনো কোনো শিকারি নিহত ব্যাঘ্রের দৈহিক পরিমাপ খুব বাড়িয়ে বলেন। মরার আগে শ্বাপদের বিক্রম প্রকাশের কাল্পনিক কাহিনি প্রচার করে বাঘ শিকারি তার বীরত্বব্যঞ্জক ভাবমূর্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান জনসাধারণের কাছে তাই অধিকাংশ সময়েই নিহত বাঘ শিকারির বিবরণীতে এক রক্তলোভী ভয়ংকর দানবের চেহারা নিয়ে প্রকাশিত হয়।
বাঘ কিন্তু আসলে যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তুত এক গোঁয়ার-গোবিন্দ জানোয়ার নয়। সে অত্যন্ত ধূর্ত, পরিস্থিতি যেখানে তার অনুকূলে নয়, সেখান সে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে জানে– অর্থাৎ সগর্জনে বিক্রম প্রকাশের চেষ্টা না করে সে সরে পড়তে সচেষ্ট হয়।
এ বিষয়ে তার নীতি হচ্ছে–
লড়তে লড়তে যে পালিয়ে যায়
সে পরের দিনটাও বেঁচে থাকে
আবার লড়াই করার জন্য।
ঘন জঙ্গলের মধ্যে দলে দলে হাতি যখন পিঠে শিকারিদের নিয়ে বাঘের আস্তানার দিকে অগ্রসর হয়, বাঘ তখন লড়াই করার জন্য এগিয়ে না এসে নিঃশব্দে দুর্জনের সঙ্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অরণ্যে শিকারির আবির্ভাব ঘটলে দুর্জনের সঙ্গ ত্যাগ করার অলিখিত আইন ব্যাঘ্র সমাজে প্রচলিত। বুদ্ধিমান বাঘ মাত্রেই ওই আইনের রীতিনীতি পালন করে তাকে সতর্কভাবে।
বাঘ অধিকাংশ সময়েই বৃদ্ধ হলে নরমাংসের প্রতি আকৃষ্ট হয় সুস্থ সবল বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য হচ্ছে বন্যপশু। যখন বয়সের ভারে অশক্ত বাঘ বিদ্যুতের মতো বেগমান হরিণকে ধরতে পারে না, দীর্ঘ শ্বদন্ত ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছোটো হয়ে মাড়িতে লেগে যায়, এবং ওই অবস্থায় দুর্দান্ত বন্যবরাহ অথবা অরণ্যচারী ভয়ংকর মহিষযুথের সঙ্গে শক্তি-পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলে যখন প্রাণ বিপন্ন হয়ার সম্ভাবনা থাকে তখনই বাঘ হয় নরখাদক।
কোনো আকস্মিক ঘটনার ফলে অথবা ক্ষুধার তাড়নায় ক্ষিপ্ত হয়ে বৃদ্ধ বাঘ মানুষ মারে, তারপরই সে বুঝতে পারে এই দ্বিপদ জীবটিকে বধ করা যায় খুব সহজেই। এই দু-পেয়ে জন্তুটা হরিণের মতো ছুটতে পারে না, শুয়োরের মতো ধারাল দাঁতের খোঁচা মারে না কিংবা মোষের মতো তেড়ে এসে গুঁতিয়ে দেয় না– অতএব মানুষ ধরো আর খাও। দেখতে দেখতে পশুমাংসে অভ্যস্ত বাঘ হয়ে ওঠে নরমাংসলোলুপ।
প্রায় সব মানুষখেকো বাঘই বৃদ্ধ (ব্যতিক্রম আছে বই কি!)। তারা অধিকাংশ সময়েই চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। মানুষের গতিবিধি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নরখাদক অতিশয় ধূর্ত জানোয়ার। গ্রামের আশেপাশে অরণ্যপ্রান্তে অবস্থিত মাঠে যখন গরু-মহিষ চরাতে নিয়ে যায় রাখাল, সেই সময় অলক্ষ্যে তাকে অনুসরণ করে মানুষ খেকো বাঘ এবং সুযোগ বুঝে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষটাকে হত্যা করে মৃতদেহ নিয়ে যায় গভীর অরণ্যে তার পৈশাচিক ক্ষুধা তৃপ্ত করার জন্য।
যেখানে হাট বসে, সেখানে আসে বিভিন্ন গ্রামের মেয়েরা বনপথ অতিক্রম করে। কেউ শাকসবজি বিক্রি করতে আসে, কেউ বা আসে জিনিস বন্ধক দিতে-হাট ভেঙে গেলে আবার তারা ফিরে চলে নিজস্বগ্রামের দিকে। বাঘের উপদ্রব ঘটলে সকলেই সন্ধ্যার আগে বাড়িফিরতে চায়।কিন্তু কখনো কখনো বেচাকেনা করে বাড়ি ফিরতে দেরিহয়-হঠাৎ একদল মেয়ে শঙ্কিতচিত্তে আবিষ্কারকরে দিনের আলোকে লুপ্ত করে নেমে আসছে সন্ধ্যার ধূসর ছায়া। তাড়াতাড়ি দল বেঁধে তারা ফেরার পথ ধরে।
ওই পথের ধারেই জঙ্গলের আড়ালে আত্মগোপন করে শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় নরখাদক বাঘ। আতঙ্কে দুরুদুরু বুক নিয়ে মেয়ের দল ঘেঁষাঘেঁষি করে পথ চলে, এদিক-ওদিক ছড়ানো ঝোপ আর বাতাসে দোদুল্যমান ঘাসের উপর নিবদ্ধ থাকে মেয়েদের ভয়ার্ত দৃষ্টি। ওই ঝোপ আর ঘাসের পিছনে লুকিয়ে নিঃশব্দে শিকারের পিছনে অনুসরণ করে বাঘ, কিন্তু মেয়েরা তার উপস্থিতি বুঝতে পারে না।
আসলে বাঘ এক অতিকায় বিড়াল ছাড়া আর কিছুই নয়– বিড়াল যেমনভাবে নিজেকে লুকিয়ে নিঃশব্দে ঘাসের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে পারে, সরীসৃপও সেভাবে চলাফেরা করতে পারে না। বিড়ালসুলভ ক্ষিপ্রতায় আত্মগোপন করে এগিয়ে চলে নরমাংস-লোলুপ শার্দুল মেয়েদের পিছনে।
তারপর যে বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটে, মানুষখেকো বাঘের এলাকায় তা নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। সব জায়গায় সব সময় প্রায় একই ভাবে প্রাণ হারায় পথ-চলিত মেয়েরা।
হঠাৎ হয়তো কারো হাতের ঝুড়ি উলটে পড়ে অথবা কাঁটা ফুটে যায় কারো পায়ে। সে নীচু হয়ে পথের উপর পড়ে-থাকা জিনিসগুলো কুড়িয়ে ঝুড়িতে ভরতে থাকে অথবা পায়ের কাটা তুলতে চেষ্টা করে। সঙ্গেসঙ্গে আড়াল থেকে শিকারের উপর লাফিয়ে পড়ে বাঘ এবং তাকে মুখে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে উধাও হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে; মানুষখেকো বাঘ সহজে গর্জন করে নিজের উপস্থিতি জানাতে চায় না– আক্রান্ত হতভাগিনী মেয়েটির মৃত্যু হয় অতর্কিতে নিঃশব্দে। পরের দিন সকালে রাতের বিয়োগান্ত ঘটনার সাক্ষী দেয় কয়েকটা ভাঙা চর্বিত হাড়ের টুকরো। শোকার্ত মানুষের ক্রন্দন শোনা যায় কোনো একটি কুটিরের ভিতর থেকে; উপদ্রুত অঞ্চলের ভয়ার্ত মানুষ হয়ে ওঠে আরও বেশি সন্ত্রস্ত। নরমাংসের উপর বাঘের লোভ বেড়ে যায়। কিন্তু তবু রাখাল মাঠেই যায়, মেয়েরাও হাটের পথ ধরে জীবনধারণের জন্য অবশ্যকরণীয় কাজ তো করতেই হবে। অতএব, মাংসলোলুপ মানুষখেকোর সামনে উপস্থিতি হয় নিত্যনূতন বলি।
যে সব অঞ্চলে নীলের চাষ হয়, সেখানে অবশ্য খুব বেশিদিন সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাতে পারে না বাঘ। নীলকুঠির ম্যানেজার তার এলাকায় মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব সহ্য করে না-মানুষখেকোর আবির্ভাব ঘটেছে শুনলেই বন্দুক নিয়ে বাঘকে শায়েস্তা করতে সচেষ্ট হয় ম্যানেজার। কিছুদিনের মধ্যেই গুলি খেয়ে বাঘ হয় পঞ্চত্ব প্রাপ্ত। এবং স্থানীয় মানুষও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচে।
কিন্তু যেসব গ্রাম দুর দূরান্তে অরণ্যবেষ্টিত হয়ে অবস্থান করে, সেখানে যখন নরখাদক বাঘের হামলা শুরু হয় তখনই পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ভয়াবহ। আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়া বাঘকে জব্দ করা কঠিন। নিত্যনূতন নরমাংসের খাজনা আদায় করে ঘুরে বেড়ায় বাঘ। জেমস ইংলিস নিজের চোখে দেখেছেন উর্বর জমি কৃষির অনুপযুক্ত হয়ে বনভূমিতে পরিণত হয়েছে বাঘের অত্যাচারে।কখনো কখনো অতিষ্ট হয়ে গ্রামবাসী লাঠি বল্লম প্রভৃতি আদিম অস্ত্র নিয়েই বাঘকে তাদের এলাকা থেকে হত্যা করতে বা বিতাড়িত করতে সচেষ্ট হয়। লাঠি সোটার মারে বাঘ আহত হলেও মারা পড়ে না, কিন্তু মার খেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে কয়েকটি মানুষকে হতাহত করে সে পালিয়ে গিয়ে অন্য এলাকায় হামলা চালায়। কয়েকদিন বা কয়েকমাস পরে আবার পলাতক শ্বাপদ ফিরে আসে তার আগেকার আস্তানায় তখন সে আরও বেশি ধূর্ত, আরও বেশি দুঃসাহসী, আরও বেশি মাংসলোলুপ।
এমন ভয়ানক জীবের কবল থেকে বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করা প্রত্যেক শিকারিরই কর্তব্য। অতএব জেমস ইংলিস ও তার বন্ধুবর্গ যখন শুনলেন প্রতাপগঞ্জ গ্রামের পাশে এক মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব ঘটেছে, তখনই তারা ওই জন্তুটাকে বধ করতে কৃতসংকল্প হলেন।
কুশীনদের দক্ষিণতটে প্রতাপগজ্ঞ নামক জনবসতি শিকারিরা হাতি সাজিয়ে সেই দিকে রওনা হলেন। কখনো নৌকাযোগে, কখনো বা হস্তিপৃষ্ঠে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে প্রতাপগঞ্জের কাছে এসে পৌঁছালেন শিকারির দল।
গ্রামের কাছাকাছি এসে কয়েকটি গ্রামবাসীর সঙ্গে সাহেবদের দেখা হল। লোকগুলি অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের হাবভাব আর আচরণে বোঝা গেল এক অবর্ণনীয় আতঙ্ক আর অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে তারা দিনযাপন করছে। সাহেবদের কিছু মিষ্টি আর গুড় দিয়ে গ্রামবাসী অভ্যর্থনা জানাল। গ্রামের কর্তাব্যক্তিরা প্রত্যেকেইহাতের তালুতে একটি টাকা নিয়ে সাহেবদের সামনে এল। সাহেবরা ওই টাকা হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। নজরানা বা সেলামীর উক্ত রীতি তখনকার দিনে ইংরেজ-শাসিত ভারতে প্রতিপালিত হত পরম নিষ্ঠার সঙ্গে। সাহেবরা টাকা নিতেন না, শুধু নিয়মরক্ষার জন্য স্পর্শ করতেন মাত্র। তবে অনেক সময়ে সাহেবদের অগোচরে তাদের অধীন অসাধু কর্মচারীরা ভয় দেখিয়ে দরিদ্র গ্রামবাসীর কাছ থেকে ওই টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করত বটে।
জো সাহেব দলটাকে থামতে বললেন। জো যে হাতিটার পিঠে ছিলেন, সেই জন্তুটাকে ঘিরে অন্যান্য হাতিদের দাঁড় করানো হল এবং সেইখানেই বাঘের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের পরামর্শ সভা। বসালেন শিকারির দল। গাঁয়ের মোড়লকে ডেকে সাহেবরা মানুষ খেকোর খবরা খবর জানতে চাইলেন। কিন্তু লোকটা দারুণ বোকা, তার উলটো পালটা কথা থেকে সাহেবরা বাঘের কোনো সংবাদ সংগ্রহ করতে পারলেন না।
সুখের বিষয় ওই সময়ে সাহেবদের সাহায্য করতে এগিয়ে এল এক গ্রাম্য পুলিশ। পুলিশটি বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, দীর্ঘকায় যুবক। সে জানাল একজন ঘেসেড়াকে কয়েকদিন আগেই বাঘ নিয়ে গেছে এবং বাঘ যেখানে আছে সেখানে সে সাহেবদের নিয়ে যেতে পারবে।
লোকটিকে তৎক্ষণাৎ জো সাহেবের হাতির পিঠে তুলে নেওয়া হল। সাহেবরা চটপট তাদের বন্দুকগুলিকে পরীক্ষা করে নিলেন, জলপান করলেন জলের বোতল খুলে তারপর অগ্রসর হলেন পথপ্রদর্শক পুলিশটির নির্দেশ অনুসারে সেই দিকে, যেখানে লুকিয়ে আছে বহু মানুষের হন্তারক কুখ্যাত নরখাদক শার্দুল।
গ্রামটিকে বৃত্তাকারে প্রদক্ষিণ করে শিকারিদের পিঠে নিয়ে এগিয়ে চলল সারিবদ্ধ হস্তিযুথ। যেতে যেতে শিকারিরা লক্ষ্য করলেন অনেক জায়গাতেই ধানজমিকে গ্রাস করে গিয়ে এসেছে বনভূমির জঙ্গল, গোয়াল ঘরগুলির অবস্থা খুব খারাপ, প্রায় জনশূন্য মুদির দোকানে জিনিসপত্র নেই বললেই চলে, এমনকী শিশুদের চোখে মুখেও আনন্দের পরিবর্তে অনিশ্চিত আশঙ্কার চিহ্ন– সব মিলিয়ে পরিত্যক্ত এক ধ্বংসস্তূপের বিষণ্ণ ও ক্ষয়িত পরিবেশ থমথম করছে জায়গাটাকে ঘিরে।
শিকারিদের ডানদিকে একটা জঙ্গল ছিল, কিন্তু সেইদিকে না তাকিয়ে পথপ্রদর্শক পুলিশ একটা বিস্তৃত মাঠের মতো ঘাসজমির দিকে দলটাকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিল। ওই ঘাসজমির মধ্যে বাঘ তো দূরের কথা, একটা শুয়োরের পক্ষেও লুকিয়ে থাকা কঠিন- অতএব, জো সাহেব পুলিশটিকে জানালেন বাঘের অবস্থান নির্ণয় করতে সম্ভবত তার ভুল হয়েছে।
বাঘ ওইখানেই আছে, মাই লর্ড, পুলিশটি আঙ্গুল তুলে ঘাসজমির মধ্যে একটা ছোটো জঙ্গল দেখিয়ে দিল। ওই জঙ্গলের পাশেই ছিল একটা অগভীর প্রায়-শুষ্ক খাড়ি। খাড়িতে জল ছিল না বললেই চলে।
হঠাৎ দলের একটা হাতি অস্বস্তিকর ভাবভঙ্গি প্রকাশ করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে সারা দলটার মধ্যে সেই অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল, প্রত্যেকটি হাতির আচরণেই উবেগ আর অস্বস্তির চিহ্ন দেখা দিল। হাতির দল গঁড় গুটিয়ে তুলে নিল মাথার উপর। মাহুতের অঙ্কুশের খোঁচা খেয়ে তারা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে চলল বটে, কিন্তু তাদের আচরণে স্পষ্টই বোঝা গেল তারা আর অগ্রসর হতে ইচ্ছুক নয়।
কয়েকটা হাতি সামনের দুই পা একবার এগিয়ে একবার পিছিয়ে দুলতে শুরু করল। বাঘের নিকটবর্তী হলেই হাতি ওই ধরণের আচরণ করে। সুতরাং সাহেবরা বুঝলেন কাছেই কোথাও নরখাদক লুকিয়ে রয়েছে। হাতির ঘ্রাণশক্তি অতি প্রখর, সে নিশ্চয়ই বাঘের গন্ধ পেয়েছে।
জেমস ইংলিসের মাহুত ফিস ফিস করে মনিবকে জানাল, বাঘ এখানেই আছে, স্যার।
হাতির হাবভাবে বাঘের অস্তিত্বের নিদর্শন পেলেও সাহেবরা সেখানে বাঘের উপস্থিতি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে পারছিলেন না। তাদের দোষ নেই- অত পাতলা অগভীর জঙ্গলে বিড়ালের পক্ষেও লুকিয়ে থাকা কঠিন, বাঘ তো দূরের কথা।
শুষ্ক জলধারার পাশে পাতলা ঝোপগুলির খুব কাছাকাছি যখন সাহেবরা এসে পৌঁছালেন, সেই সময় হঠাৎ তীব্র তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল একটি হাতি। সঙ্গেসঙ্গে যেন ভোজবাজির মতো মাটি থেকে লাফিয়ে আত্মপ্রকাশ করল অত্যন্ত কৃশ এক দীর্ঘ দেহী ব্যাঘ্র!
বাঘ কোনোদিকে দৃকপাত করল না, তার গমন ভঙ্গিতেও ব্যস্ততার কোনো লক্ষণ ছিল না, নির্বিকারভাবে মাঠের উপর দিয়ে সে এগিয়ে চলল শিকারিদের সান্নিধ্যে ত্যাগ করে গতি তার মৃদু, অলস-মন্থর।
এমন শান্তভাবে, এমন নিঃশব্দে বাঘের আবির্ভাব ঘটেছিল যে, দৃষ্টিশক্তির উপরেই সাহেবরা সাময়িকভাবে আস্থা হারিয়ে ফেললেন– অন্তত মিনিটখানেক ধরে নিশ্চেষ্ট হয়ে হতভম্বের মত চুপ করে বসেছিলেন তারা।
কিন্তু না–ওই তো বাঘ! প্রকাণ্ড অস্থিসার দেহ, বিরল রোম, কুৎসিত নরখাদক!
ধীরে ধীরে বিমূঢ়ভাব কেটে গেল, উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল শিকারিদের মধ্যে। প্রথমেই অগ্নিবমন করে গর্জে উঠল জো সাহেবের রাইফেল, তারপরই অন্যান্য শিকারিদের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছুটে এল গুলির পর গুলি বাঘের দেহ লক্ষ্য করে।
বাঘ ধরাশায়ী হল। একবার থাবা ছুঁড়ল না, একবার গর্জন করল না, এমনকী একটু ছটফট পর্যন্ত করল না- এ যেন পড়ল আর মরল!
কিন্তু মানুষ খেকো বাঘ ভীষণ ধূর্ত হয়। জন্তুটা মরার ভান করে পড়ে নেই তো?…
নাঃ, সে সম্ভাবনা নেই। বাহু সন্ধির উপর একটা ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসছে লাল রক্তের ধারা। বহু মানুষের হন্তারক কুখ্যাত নরখাদকের ভবলীলা সত্যিই শেষ হয়ে গেছে।
কী বাজে শিকার, প্যাট সাহেবের উক্তি।
এটা বাঘ নয়, নিতান্তই কুত্তা, জো মন্তব্য করলেন। তার গুলি অবশ্য বাঘের দেহ স্পর্শ। করতে পারেনি।
জো আবার মন্তব্য করলেন, চামড়াটা ঘরে রাখার উপযুক্ত নয়তারপরইশিকারিরা সমবেতভাবে মৃত ব্যাঘ্র সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলেন।
হাতির পিঠে চড়ে এগিয়ে এলেন শিকারিরা, গোল হয়ে ঘিরে বাঘের মৃতদেহ নিরীক্ষণ করতে লাগলেন তারা। এখন থেকে হাটের পথে নির্ভয়ে চলাচল করতে পারবে মেয়ের দল, বুড়ি ঠাকুমা আর ঘরে খিল দিয়ে বসে নাতি-নাতনিদের বাঘের ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে পারবেনা মূর্তিমান অভিশাপের মতো নরখাদক আজ নিহত।
হাতির পিঠ থেকে প্রথমেই নামলেন প্যাট সাহেব। যে হাতির পিঠে তিনি আসন গ্রহণ করেছিলেন, সেই জন্তুটার মালিক ছিলেন এক করদ রাজ্যের রাজা। মাত্র কিছুদিন হল রাজামশাই হাতিটাকে কিনেছিলেন। প্যাট সাহেব ওই হাতিকে শিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলেন। বাঘের চেহারা আর গন্ধে তাকে অভ্যস্ত করার জন্য প্যাট সাহেব মৃত শ্বাপদের কাছে মাহুতকে হাতি নিয়ে আসতে আদেশ করলেন।
অন্যান্য শিকারিদের মধ্যে একজন আয়েস করে পাইপে আগুন ধরিয়ে ধুমপানের উদ্যোগ করলেন। প্যাট ধরাশায়ী নরখাদকের মৃতদেহের উপর ঝুঁকে হাতির সঙ্গে কথা কইতে কইতে তাকে এগিয়ে আসতে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু হাতি কাছে আসতে অনিচ্ছুক, সে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে, অতিকায় ডোরাদার বিড়ালের সান্নিধ্যে সে নিরাপদ মনে করছে না।
হঠাৎ ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন ম্যাক—
সবাই সাবধান! এটা যে বেঁচে আছে দেখছি! তারপরই চটপট পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ডিগবাজি খেয়ে উলটে পড়লেন তিনি।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে মরা বাঘ চোখ মেলে চাইল, জ্বল জ্বল করে উঠল হলদে-সবুজ দুই জ্বলন্ত চক্ষু, সে হাঁ করে একবার স্বাসগ্রহণের চেষ্টা করল, ফলে উন্মুক্ত মুখ গহ্বরের ভিতর থেকে প্রকাশিত হল ভয়াল দন্তের সারি! পরক্ষণেই মুখ থেকে ফেনা আর রক্ত ছড়াতে ছড়াতে বাঘ দীর্ঘ নখ বিস্তার করে গড়িয়ে এসে সনখ থাবার আলিঙ্গনে হাতির একটি পা চেপে ধরল, তারপর ভীষণ জোরে কামড় বসাল তৎক্ষণাৎ পায়ের মাংসে ঢুকে গেল শাণিত শ্বদন্ত!
দারুন যাতনায় আহত হাতি চিৎকার করে উঠল। আশে পাশে দণ্ডায়মান অন্যান্য হাতিরা ও তীব্র বৃংহন-শব্দে তাদের উত্তেজনা প্রকাশ করতে লাগল। মাহুতরাও চাঁচাতে লাগল তারস্বরে। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত শিকারের দলটা বিশৃঙ্খল কোলাহলে ফেটে পড়ল। ব্যাঘ্রের দংশনে আহত হস্তীর আর্তনাদ ছিল তার মধ্যে সবচেয়ে তীব্র, সবচেয়ে করুণ। পাছে বাঘ তাকেও ধরে সেই ভয়ে আক্রান্ত হস্তীর মাহুত তার পা দুটো গুটিয়ে বাহনের মাথার উপর তুলে ফেলল এবং বাঘের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করার জন্য ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ আর যাবতীয় দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা জানাতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে।
সমস্ত ঘটনাটা ঘটল পলকের মধ্যে। মরতে মরতেও প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা করে ছিল বাঘ, মরণ-কামড় বসিয়েছিল শেষ শক্তি দিয়ে। কিন্তু কামড়টা হয়েছিল মোক্ষম।
হাতির দংশন-ক্ষত ভালো করে ধুয়ে মুছে ঔষধ লাগিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। তবু ক্ষতস্থান বিষিয়ে গ্যাংগ্রীন দেখা দিল, তিনদিনের মধ্যেই মারা গেল হাতি।
সাহেবরা প্রত্যেককে তিনশো টাকা করে দিয়ে হাতির মালিকের ক্ষতিপূরণ করলেন। তাদের শিকারের শখ চরিতার্থ করতে অন্য লোক ক্ষতিস্বীকার করবে এমন অনুচিত মনোভাব সাহেবদের ছিল না।
হিতোপদেশের গল্পের মতো এই কাহিনিটিরও একটি নীতিবাক্য আছে– মরা বাঘকেও বিশ্বাস নেই! আরও প্রাঞ্জল করে বললে বলতে হয়, বাঘ মরে গেছে বলে মনে হলে চট করে তার সামনে যেতে নেই।
ওই ঘটনা থেকে ইংলিস সাহেব যে শিক্ষা পেয়েছিলেন জীবনে তা ভোলেননি। পরবর্তীকালে আহত ব্যাঘ্রের মৃত্যু সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত না হয়ে জেমস ইংলিস তার সামন কখনো যেতেন না এবং অন্য কোনো মানুষ বা পশুকেও কাছে যেতে দিতেন না।