বাঘ

বাঘ

যাহা শুনিতেছি, তাহার অর্ধেকও যদি সত্য হয় তো শুধু এখন কেন, আজ সমস্ত রাত্রির মধ্যে আমি বাড়ির বাহির হইতে পারিব না; সেজন্য আপনারা আমায় কাপুরুষ, ভেতো বাঙালি—যা খুশি বলুন।

আমাদের বাড়িটা আপনারা দেখেন নাই। বাড়ির খিড়কির দিকটায় কাঠা পাঁচেক জমির উপর একটা মাঝারি-গোছের বাগান আছে। তাহার শেষ দিকটা জাম আর জামরুল গাছের ডালপালায় বেশ একটু অন্ধকার। একটু যা খালি জায়গা ছিল, সেখানটায় আজকাল একটা বিচালির গাদা তৈয়ার করা হইয়াছে। মোটের উপর সব মিলিয়া জায়গাটা বেশ একটু ঘুপচি-গোছের হইয়া গিয়াছে, রাত্রিবেলায় গাঢ় অন্ধকারের আড্ডা। অবশ্য তার পরেই গয়লাপাড়ার ঘন বস্তি, তবু ছেলেবেলায় ওই কোণাটুকুর কথা রাত্রে ভাবিতে গেলে বরাবরই গা ছম-ছম করিত। আর, সত্য কথা বলিতে কি, এখনও না ভাবিলেই ভাল থাকি। সেইখানে খড়ের গাদার পাশে সন্ধ্যার পর হইতে একটা বাঘ আসিয়া বসিয়া আছে। গোবাঘা না, চিতাও নয়, একটা জাত বাঘ; কিছু নয় তো হাত ছয়েক লম্বা, কাঁচা সোনার মত হলদে রঙের ওপর হাত খানেক করিয়া লম্বা এক-একটা কালো ডোরা, ইয়া ঘোরালো মুখ, এক- একটা গোঁফ যেন এক-একটা সজারুর কাঁটা। সামনের দুইটা থাবা ছড়াইয়া ঘাড় উঁচাইয়া বসিয়া আছে, পেটের ঢিলাঢালা মাংস হাত পাঁচ-ছয়ের একটা গোল জায়গার উপর ছড়াইয়া আছে। বেশ বোঝা যায়, আস্ত একটা মহিষ হইলে, ওই পেটের কতকটা ভরিতে পারে।

তবে বাঘ যে নিতান্ত উপোস করিয়া আছে এমন নয়, একটু জলখাবার সারিয়া লইয়াছে। জেওলগাছের বেড়া ডিঙাইয়া আমাদের বাগানে পড়িবার আগে, বুধনী গয়লানীর যে কচি মেয়েটা অষ্টপ্রহর ট্যা-ট্যা করিয়া পাড়া মাথায় করিত, সেটাকে জিবে করিয়া তুলিয়া গিলিয়া ফেলিয়াছে—-বুধনী মেয়েটাকে বাহিরের দাওয়ায় শোয়াইয়া রাখিয়া ঘরের পাট সারিতেছিল। মেয়েটার গায়ে দাঁত বসে নাই, সেই জন্য বোধ হয়, পেটে গিয়াও ট্যা-ট্যা করিতেছিল, বাঘটা জ্বালাতন হইয়া সেইখান হইতে একটা লাফ দিয়া হরুনী মাহাতোর বাড়িতে পড়ে। হরুনীর বুড়ো বাপ বাহিরে বসিয়া ভজন করিতেছিল। শুধু মাস খাইয়া বাঘের একটু হাড় চিবাইবার ইচ্ছা হয়। হরুনীর বাপের ঘাড়টা ধরিয়া দুইটা ঝাঁকানি দিয়া পিঠের উপর ফেলিয়া এক লাফে আমাদের বাগানের মধ্যে আসিয়া পড়ে।

টের পাওয়া যাইত না; ওদিকে গয়লা-পাড়া ভয়ে একেবারে আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে। আর সন্ধ্যার পর আমাদের বাগানের দিকেও বড় একটা যায় না কেহ। ঝপাং করিয়া একটা শব্দ হয় বটে, কিন্তু সেটা যে বাঘ-পড়ারই শব্দ, লোকে কি করিয়া জানিবে? বাঘ তো আর রোজই দুই-দশটা করিয়া লাফ দিয়া পড়িতেছে না। একটা কলাগাছ নুইয়া গিয়াছিল, সবাই ভাবিল, বোধ হয় সেইটিই ভূমিসাৎ হইয়াছে। নিশ্চিন্ত আছে, এমন সময় কড়-কড়-কড়-কড় কড়াৎ! সে এক বিকট আওয়াজ—যেমন বিনা ঝড়ে গাছ পড়া, তেমনই বিনা মেঘে বজ্রাঘাত!

পরে টের পাওয়া গেল, বাজপড়া নয়—বাঘটা হরুনীর বুড়ো বাপকে দুই থাবা দিয়া মুড়িয়া-সুড়িয়া মুখের মধ্যে ফেলিয়া দাঁতের একটা চাপ দিয়াছিল, সমস্ত হাড়গুলা একসঙ্গে চুর হইয়া যাওয়ায় ওই রকম বিকট আওয়াজ হইয়াছে। আশি বছরের বুড়ো হরুনীর বাপ সোজা কথা নয় তো, হাড়ের পরিপক্কতা দেখিতে গেলে একেবারে দধীচি হইয়া উঠিয়াছিল।

কিন্তু শব্দের রহস্য ভেদ করিতে যাইয়াই কাল হইল। বাগানের এদিকটায় আমাদের মালী মহিষটাকে জাবনা দিতেছিল, খড়ের গাদার কাছে হঠাৎ এ কি বিপরীত শব্দ! হাতের জাবনা মুছিতে মুছিতে দেখিতে যাইবে—দেখে, অন্ধকারের মধ্যে ঠিক খড়ের পাছটিতে দাউ দাউ করিয়া আগুনের ভাঁটা জ্বলিতেছে। বেচারা আর ভাবিতেও সময় পায় নাই, ছুটিয়া ফিরিয়া আসিয়া মহিষের জন্যে তোলা বালতিসুদ্ধ সমস্ত লইয়া গিয়া একেবারে বাঘের মাথায়। যখন হুঁশ হইল, আগুন নয়—বাঘের চোখ, তখন মালীর চোখ ঘোলাটে হইয়া গিয়াছে—ব্যাঘ্ররাজের একটি থাবায়। বাঘের গলায় তখন হরুনীর বাপের উরুর হাড়টা ফুটিয়া গিয়াছে। যন্ত্রণায় ছটফট করিতে করিতে সে বেচারী বোধ হয় সারসের সন্ধানে জলার দিকে পা বাড়াইয়াছিল,—চুকিয়া যাইত সব ল্যাঠা, এমন সময় ওই নূতন উপদ্রব! সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের উপর থাবাটি বসাইয়া একটি চাপ।

ব্যাপারটা আপাতত এইখানেই শেষ হইত। বাগানের এক পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে যে এত বড় একটা কাণ্ড হইতেছে, কে কি করিয়া জানিবে? বড়রা নিজেদের গল্পগুজব লইয়া আছে, ছেলেমেয়েরা নিজেদের পড়াশুনা লইয়া আছে, কুঁচোরা নিজেদের হুল্লোড় লইয়া আছে। হদ্য সকালবেলায় ব্যাপারটা সবার জ্ঞানগম্য হইত, কিংবা বাঘ যদি সব নিশ্চিহ্ন করিয়া রাতারাতি সরিয়া পড়িত তো তাহারও সম্ভাবনা ছিল না। জানাজানি করাইয়া দিল মহিষটা। মালীর নিয়ম ছিল, জাবনাটি ঠিক তৈয়ার করিয়া মহিষটাকে এই খোঁটায় আনিয়া বাঁধিয়া দিত। সঙ্গে সঙ্গে বাছুরটাকে খুলিয়া দিত। বাছুরটাকে একটু পিয়াইয়া মালী দুধ দুহিতে আরম্ভ করিত। এদিকে মহিষ জাবনা খাইয়া যাইত।

তৈয়ারি জাবনার সোঁদা-সোঁদা গন্ধ বাহির হইয়াছে, অথচ খাইতে পাইতেছে না। মহিষটা ছট্‌ফট করিতে লাগিল। কিন্তু গুজরাটি মহিষ; এ দেশের দড়িকে মনে করে সূতা, খোঁটাকে মনে করে একটা কুটা, নিতান্ত ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ করিয়া বাঁধা থাকে। যখন নিতান্ত আর সহ্য করিতে পারিল না, দিল মাথায় একটা ঝাঁকানি। একটা ঘাসের শিকড় টানিলে যেমন নিরুপদ্রবে উঠিয়া আসে, খুঁটিটা সেই রকম ভাবে উঠিয়া আসিল। মহিষ হাঁস- হাঁস করিয়া সমস্ত জাবনাটা সাবাড় করিল, তারপর বাছুরটার কাছে গিয়া তাহাকে সমস্ত দুধটা খাওয়াইয়া দিল; এখানকার মহিষ তো নয়,—এক দোহনে পাক্কা সাত সের দুধ দেয়।

বাচ্চাকে খাওয়াইয়া তখন তাহার মালীকে মনে পড়িল। মালীকেও মনে পড়িতে পারে কিংবা জলতৃষ্ণাও পাইতে পারে, মহিষের মনের কথা কে বলিবে? মালীটা জলের বালতি লইয়া যেদিকে গিয়াছিল, জাবনাভরা পেটটা দুলাইতে দুলাইতে, জাবর কাটিতে কাটিতে মন্থর গতিতে সেই দিকে অগ্রসর হইল। যেন ওপাড়ার কালোপিসি নেমন্তন্ন খাইয়া পান চিবাইতে চিবাইতে টহল দিয়া বেড়াইতেছিল। তাহার পর দুই পা গিয়াই ওই দৃশ্য।

গুজরাটি মহিষ, তার নূতন বাচ্চা হইয়াছে, বাঘ দেখিয়া রাগে একেবারে কয়লার আগুনের মত গনগন করিয়া উঠিল। বাঘের চোখের আর কি জ্বলন! মহিষের চোখ জ্বলিতে লাগিল যেন মোটরগাড়ির দুটো হেডলাইট; তিনটা করিয়া পাক দেওয়া সিং একেবারে সোজা হইয়া উঠিল, যেন দুইটি বর্ণা–লক্ষ্য বাঘের জ্বলন্ত চোখ দুইটি। মাথা গুঁজিয়া, ক্ষুর দিয়া এক আঁচড়ে এক এক কোদাল মাটি চাঁছিয়া পিছনে ফেলে আর গোঁ-গোঁ শব্দ। যেন সেদিনকার মত ঈশান কোণে কালবৈশাখী ঝড় উঠিয়াছে।

বাঘের চোখে পলক পড়ে না, ভয়ে যেন আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছে, পেটের মধ্যে বুধনীর মেয়ের চিঁ-চিঁ শব্দটুকু পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গিয়াছে, হরুনীর বাপকে চিবাইতেছিল;—একে এমনই শুকনো হাড়ের গাদা তায় যা একটু-আধটু রস ছিল, ভয়ে গলা শুকাইয়া সব একেবারে ছাতু হইয়া গিয়াছে। গলা দিয়া আওয়াজ বাহির হয় না, তবুও মহিষের পানে চাহিয়া কোন রকমে ভয়ে কাঁপা গলায় বলিল, লম্বা লম্বা শিং তোমার—

***

বড় বাড়াবাড়ি হইয়া যাইতেছে।

শুইয়া শুইয়া পাশের ঘরের পানে চাহিয়া বলিলাম, রাণু, বড্ড ভুল করছ মা, কচি ছেলে, ওকে এখন অত উৎকট ভয়ের গল্প শুনিও না। তোমাকে আমি দেখিয়ে দোব বইয়ে যে, ওতে ওদের মনে কি ভীষণ চাপ পড়ে। বাঘটাকেই যথেষ্ট উগ্র করেছিলে, তার ওপর তুমি আবার মহিষটাকে যেমন দাঁড় করাতে চাইছ, তাতে—

রাণু ক্লান্তি ও বিরক্তিতে বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া পড়িল; আমার দিকে বিস্মিতভাবে চাহিয়া বলিল, ভয় দেখে যাও মেজকাকা, এততেও ও দজ্জালের চোখে একটু ভয় আছে কিনা! আর এর বেশি আমার মাথায় আসেও না বাপু। তুমি বইয়ের কথা বলছ! ওই শোন, আবদার উঠেছে, বাঘ আর মোষের লড়াই দেখতে নিয়ে যেতে হবে। আমি পেরে উঠব না ও ছেলেকে মেজকাকা, সামলাও তোমার নাতি, আমার রাজ্যির পাট পড়ে আছে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *