বাগানের তাজা গোলাপ
আজকাল কোনো অনুষ্ঠানে আমার যেতে ইচ্ছে হয় না। তবু যেতে হয়। এমন সব কাছের মানুষজন আসে অনুরোধ নিয়ে, যাদের শেষ পর্যন্ত কিছুতেই ‘না’ বলতে পারি না। অনেক সময় উপরোধে ঢেঁকিও গিলতে হয়।
এই উপরোধের ঢেঁকি গিলতে আজ যাচ্ছি। নতুন লাইব্রেরি ভবনের উদবোধন। ফিতে কাটতে হবে। আমি এবং আমার এক লেখক-বন্ধু প্রধান অতিথি, বিশেষ
অতিথি। স্টেশন থেকে গাড়ি করে নিয়ে গেল। অনুষ্ঠানে মানুষজনের সমাগম বেশ ভালোই হয়েছে। যদিও এই গল্পের জন্য এগুলো বাড়তি কথা, তবে গল্পের তো শুরু থাকে–শুরুটা এভাবেই করা গেল।
অনুষ্ঠান শেষে অটোগ্রাফের কিছুটা ব্যস্ততা থাকে। একজন বিশ-বাইশ বছরের মেয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। আজকাল পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম বড়ো কেউ করে না। করলেও আমার অস্বস্তি হয়। বললাম, আমি তো তোমার বাবা-কাকা হই না। প্রণাম কেন? যাকে-তাকে প্রণাম করতে নেই।
মেয়েটি একদম ঘাবড়াল না। বলল, তার চেয়েও বেশি।
খুবই দমে গেলাম কথাটাতে।
মেয়েটি দুটো তাজা গোলাপ আমার হাতে দিয়ে বলল, আমার বাগানের।
তুমি বাগান করো?
ওই আর কী! আপনাকে দেবো বলে এনেছি।
তারপরই মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে কোথায় যে হারিয়ে গেল!
কে যে কখন নিজের পৃথিবী আবিষ্কার করে ফেলে, বুঝি না। অনুষ্ঠানের মঞ্চেই রজনীগন্ধার মালা কিংবা ফুলের স্তবক ফেলে রেখে আসি। অথবা যে বালিকা মালা পরায়, তাকে পরিয়ে দিই। কিশোর হলে, তাও পারি না। কোথায় যে সংস্কারে বাধে। অবশ্য এ-সবও গল্পের জন্য লিখছি না গল্পটি এখনো শুরুই হয়নি।
আমার এই হয়। গল্প শুরু করতে সময় লাগে, গল্প শেষ করতে সময় লাগে না।
অনুষ্ঠানের মাতব্বর ব্যক্তিরা এই প্রাচীন লাইব্রেরির বার্ষিক অনুষ্ঠানে যে-সব রথী মহারথীদের নিয়ে এসেছিলেন গত একশো বছর ধরে, তাঁদেরও বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। আমার মতো চুনোপুঁটিকেও কিছু বলতে হল। লাইব্রেরিতে শরৎচন্দ্রও এসেছিলেন—তিনি আসতেই পারেন। জায়গাটা থেকে শরৎচন্দ্রের বাড়ি বেশি দূরও না। একটা জংশন স্টেশন থেকে মাইল দেড়েক হেঁটে গেলেই তাঁর বাড়ি।
এমন সব কথার মধ্যেই আমাকে নতুন ভবনের ছাদে নিয়ে যাওয়া হল। ছাদটি অতি বিশাল, সামনে বর্ষার গঙ্গা কলকল ছলছল।
নদী থেকে ভারি মনোরম ঠাণ্ডা বাতাস উঠে আসছে। সামনে নিরন্তন আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে মেয়েটির মুখ কেন যেন মনে পড়ে গেল। সে তার বাগানের দুটো তাজা গোলাপ দিয়ে গেছে। অবহেলায় গোলাপ দুটো অনুষ্ঠানের মঞ্চে যদি পড়ে থাকে, তবে তাকে খাটোই করা হবে। সে জানবেও না—গোলাপ দুটো ফেলে এসেছি। ভাবলাম, গোলাপ দুটো যত্নকরে নেওয়া দরকার। ব্যাগে রাখলে—গোলাপ দুটো নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে, একজনকে বললাম, ভাই, সামান্য কলাপাতায় গোলাপ দুটো একটু জড়িয়ে দেবে।
এবারে গল্পটা শুরু করা যাক।
হাওড়া স্টেশনে নেমে ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। আচমকা ট্যাক্সি ধর্মঘট। কোথায় যেন ট্যাক্সি ডাইভারের খুনখারাবির খবর পাওয়া গেল।
আমার লেখক-বন্ধুটি থাকে দক্ষিণে। আমি থাকি উত্তরে। রাত প্রায় দশটা বাজে। আমাদের দিকের বাস-টাস কিংবা মিনি রাত দশটার পর বিরল হয়ে আসে। শেষে বিপদে না পড়ি—এই ভেবে, একটা মিনিবাস ধরার আশায় সাবওয়ের দিকে এগোতে থাকি।
বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখলাম আমাদের দিকের একটা বাসও নেই।
আর একটু এগিয়ে দেখা দরকার, মিনি যদি থাকে। ভাগ্য প্রসন্ন, পেয়েও গেলাম। উঠে দেখি, ভেতরের দিকে একটি সিট-ই খালি আছে। তবে বসা মুশকিল। একজন সাত-আট বছরের বালিকা সিটের অধিকাংশ জায়গা দখল করে রেখেছে।
কী যে বলি!
মেয়েটির পাশে একটি সুন্দর প্লাস্টিকের ব্যাগ। কোলে প্ল্যাস্টিকের একটি হরিণ-শিশু। একপাশে তার ছোট্ট খেলনার রেলগাড়িও আছে। সে তার লটবহর নিয়ে বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।
বললাম, আমাকে একটু জায়গা দেবে? বসব।
মেয়েটি আমাকে দেখে মুখ তুলে, তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, না। আমি সরে বসব না।
সুন্দর প্লাস্টিকের ব্যাগটি সে জানালার দিকেই রেখেছে। আর আশ্চর্য, ব্যাগটি সুরক্ষার জন্যই হোক, অথবা অন্য কোনো কারণেও হতে পারে, সে বেশ দু-সিটের অনেকটা জায়গাই দখল করে বসে আছে। ও সরে না-বসলে, আমার বসার জায়গা হয় না।
বললাম ব্যাগটা কোলে নাও, তাহলেই জায়গা হয়ে যাবে।
ছোট্ট মেয়েটি খুবই গম্ভীর হয়ে গেল।
পেছনের সিট থেকে কেউ তখন বলছে, অ্যাই, সরে বস না। ওনাকে বসতে দে। তুই কী রে?
আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন, সারা রাস্তায় জালাচ্ছে। কাউকে বসতে দিচ্ছে না পাশে। কিছুতেই সরে বসবে না।
অবশ্য বাসে অন্য উত্তেজনা প্রবল।
কেউ বলছে, এতদিনে সরকার একটা কাজের কাজ করেছে!
কেউ বলছে, আগেই করা উচিত ছিল। সুরক্ষা বলে কথা!
কিছুদিন ধরেই মানুষজন বড়োই উত্তেজনায় ভুগছে। এখন সুরক্ষা ছাড়া মানুষের মাথায় যেন সব কিছুই ভোঁতা হয়ে গেছে।
পেছনের সিটে বসা ভদ্রলোক মেয়েটির হয়তো কেউ হবে। বাবা হতে পারে। মামা কাকা যে-কেউ হতে পারে।
ওঁর কথায় আমি কেমন বিব্রত বোধ করলাম।
মেয়েটি আমার দিকে আর তাকাচ্ছে না। জানালার চোখ রেখে সেতু পার হবার সময় নদীর জল দেখছে। বাসে যে সুরক্ষা নিয়ে এত উত্তেজনা চলছে—কীসের সুরক্ষা, কেন সুরক্ষা সে কিছুই বুঝছে না। তার নিজের জায়গাটির সুরক্ষা ছাড়া, সে বেশি কিছু যেন বোঝেও না।
বাধ্য হয়ে বললাম ঠিক আছে। না বসলেও চলবে। আমার দাঁড়িয়ে যেতে অসুবিধে হবে না। আপনি ওকে প্লিজ, কিছু বলবেন না।
আসলে মিনি কিংবা বাসে বসতে পাওয়া গেলে, সৌভাগ্যবান হতে হয়। এখন তো আবার সুরক্ষার আবেগে মানুষজন ভাসছে। একজন বলেই ফেলল, আপনি এখানটায় বসুন। আমি দাঁড়িয়ে যেতে পারব। কোনো অসুবিধা হবে না।
না না, আপনি বসুন। আপনি দাঁড়িয়ে যেতে পারলে আমিও পারব।
লোকটির কথায় কিছুটা যে আহত, মেয়েটি আমাকে দেখেই তা টের পেয়েছে। সে কী ভেবে জানালার দিকে সামান্য সরে বসল। তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু খেলনাপাতি গুছিয়ে, প্লাস্টিকের ব্যাগে তুলেও রাখল।
আমি তবু বসছি না দেখে মেয়েটি বলল বোসো না। জায়গা হয়ে যাবে।
আমি হাসলাম।
মেয়েটি এত চঞ্চল আর সুন্দর যে তাকে ভারি আদর করারও ইচ্ছে হল। শিশুরা আছে বলে পৃথিবীটা যে এত সুন্দর তাও টের পেলাম।
মেয়েটি আরও চেপে, আরও একটু সরে বলল, কী হবে না?
আমি না বসলেও স্বস্তি পাচ্ছে না যেন মেয়েটি—তবু সুন্দর প্লাস্টিকের ব্যাগটি কোলের উপর রাখবে না।
কী আছে ওই ব্যাগে? এত সতর্ক ব্যাগটি নিয়ে। ব্যাগের মধ্যে এমন কোনো কোমল বস্তু থাকতেই পারে, কোলে তুলে রাখলে হাতের চাপে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
যাই থাকুক, আমার বসে পড়া ছাড়া আর উপায় নেই।
আর বসতেই মেয়েটি বলল, তোমার নাম কী গো?
এতটুকুন মেয়ে চোখ দুটো ভারি সুন্দর—আবার কখনো সব কিছু তার মনে হয় ভারি রহস্যে ভরা, সে আমার পাশে বসে আছে, পেছনে কেউ আছে তার—কত সহজে সে আমার নাম জানার আগ্রহ প্রকাশ করল।
তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। বললাম, আমার নাম দিয়ে কী হবে?
বলোই না। জানো, বাবা আমাকে আববু বলে ডাকে। জানো, আমার না, বাবার, বাবা আছে। তাঁর বাড়িতে আমরা যাচ্ছি।
মেয়েটির কথাবার্তা এত আন্তরিক যে কেবল আদর করতে ইচ্ছে হয়। কী পাকা পাকা কথা অথচ নিষ্পাপ।
এমন জীবন তো আমরাও পার করে দিয়ে এসেছি।
বললাম, বাবার বাবা তোমার কে হয়?
বা রে, তুমি তাও জানো না! নানাজি হয়।
তাহলে দাদুর বাড়ি যাচ্ছ?
হ্যা। জানো, আমার দাদুর খুব অসুখ। বাঁচবে না। তারপর পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, আমার বাবা। আমার মা। কোলে দ্যাখো আমার ভাই।
পেছনে চেয়ে দেখলাম—ভাইটির বয়স বছরখানেকও নয়।
ওর বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, পাশে তো বসলেন, সারা রাস্তা জ্বালিয়ে মারবে।
আমি কিছু বললাম না। ঘণ্টাখানেকের রাস্তা এবং এরা জানে না, আববুর কথা আমি কত আগ্রহ নিয়ে শুনছি।
আমার ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে গেছে, তারা উড়েও গেছে—আমি আর আমার স্ত্রী এখন বাড়িতে, আমরা বড় নিঃসঙ্গ মানুষ। কাজের লোক ছাড়া আমাদের দেখারও কেউ নেই। অফিস ছাড়া কথা বলারও লোক নেই। কাগজের অফিসে কাজ, বিকালে যাই, রাতে ফিরি। আর এ-সময়ে এমন সবুজ তাজা প্রাণের স্পর্শ, কে না পেতে চায়।
আববু এবার কী বুঝে, খুব যত্নের সঙ্গে সুন্দর প্লাস্টিকের ব্যাগটি কোলে তুলে, জানালার কাছে ঘেসে বসল। তারপর আমাকে দেখল। শেষে কী ভেবে বলল, ঠিক হয়ে বোসো না। এত জড়ভরত হয়ে বসলে হয়!
ঠিক হয়ে বসতে না বসতেই বলল, এতে কী আছে, বলো তো?
এবারে ধাঁধা শুরু।
বললাম, এতে তোমার সব খেলনা, রেলগাড়ি, পুতুল উড়োজাহাজ, প্লাস্টিকের ঘরবাড়ি সব।
কিছু বলতে পারলে না। কী মজা। তুমি খুব বোকা আছো।
আমি বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম।
আববু বলল, এতে আছে আমার ভাইয়ের ফিডিং বোতল। জানো তো, ভাইকে আমি দুধ খাওয়াতে পারি।
কত কাজের মেয়ে পৃথিবীতে এ-কাজটি সে ছাড়া যেন আর কেউ করতে পায়ে না।
আমি ততোধিক বিস্ময়ের গলায় বললাম, বলো কী! এত কাজের মেয়ে তুমি?
জানো, আমার বাবা রোজ অফিসে যায়। মা তো একা, ভাইকে নিয়ে পেরে ওঠে না।
আর কী কাজ করো।
ঘর ঝাঁড় দিতে পারি। জানো, মা আমাকে তখন বকে। ঝাঁটা হাত থেকে কেড়ে নেয়।
তাই নাকি? তোমার মার এটা ভারি অন্যায়।
মার সঙ্গে বাসনকোসন মাজতে বসলেও বকে। কেবল বলবে—যা, পড়তে বোস। আমার পড়তে ভালো লাগে না।
কাজ করতে গেলেই, মা রেগে যায়।
খুব অন্যায়।
আমাদের কাজের দিদি না খুব ফাঁকি দেয়।
তুমি বকে দিতে পারো না?
মুখে তার আশ্চর্য হাসিটুকু লেগেই আছে। কেউ বোধহয় এত গুরুত্ব দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে না।
আমার দিকে তাকিয়ে ফের মুখ তুলে বলল, তুমি অফিস যাও না?
হুঁ। যাই।
তোমার বাড়িতে কে আছে?
আমার কেন যে সহসা গলায় কথা আটকে গেল! কী বলি! সবাই আছে অথচ কেউ নেই।
একসময়, সে যেন কবেকার কথা—মা বাবা ভাই বোন, আত্মীয়স্বজনও কম ছিল না। একে একে আলগা হয়ে যেতে থাকল। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সম্বল করে ফ্ল্যাটবাড়ি। তারপর নিজের বাড়ি। তারপর সব ফাঁকা। পুত্র-কন্যারা সময়ই পায় না! বছরে, দু-বছরে বাড়ি ঘুরে যায় ঠিক, তবে কোথায় যেন সেই আন্তরিকতা আর নেই। এককালে এক বিছানায় সবাই শুয়েছে, বড়ো হয়েছে। তারপর কখন যে সব আলগা হয়ে গেছে।
কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তুমি মার সঙ্গে শোও, না বাবার সঙ্গে?
বা রে, আমরা তো এক বিছানায় শুই। একসঙ্গে না শুলে আমার ঘুমই হবে না।
তুমি কাকে বেশি ভালোবাস? মাকে, না বাবাকে?
আমি সবাইকে ভালোবাসি।
তারপর থুতনিতে আঙুল রেখে কী ভাবল, যে আমার প্রশ্নের সে সঠিক জবাব দিতে পারেনি।
জানো, আসলে আমি ভাইকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।
মা-বাবাকে?
সমান-সমান।
ভাই তোমাকে ভালোবাসে?
মোটটেও না। দ্যাখো না, আমার হাত কামড়ে দিয়েছে সকালে।
খুব অন্যায়। তুমি এত ভালোবাসো, ভাই জানে না?
জানবে না কেন। মা বলেছে—নতুন দাঁত উঠেছে তো, তাই কামড়াবে। ওর তো কোনো দোষ নেই। ছেলেমানুষ, বোঝে না—কামড়ালে লাগে।
মিনিবাসটা মানিকতলার মোড়ে এসে, সামান্য জ্যামে পড়ে গেছে।
চুপচাপ বসে থাকলে যা হয়, গোলাপ দুটোর কথা মনে পড়ে গেল। খুবই যত্নের সঙ্গে কলাপাতায় মুড়ে ব্যাগে রেখেছি। ফুল দুটো কেন যে কিছুটা মায়ায় জড়িয়ে আছে, তাও ঠিক বুঝছি না। মেয়েটির মুখ মনে পড়ে গেলে যা হয়—সে দিয়েছে, সে দিয়েই খুশি তার প্রিয় লেখককে। সে কিছু আর চায়ও না। দু-দণ্ডের জন্য হলেও, আমার ফুলদানিতে ফুল দুটো শোভা পেল, তার যে খুশির অন্ত থাকবে না, তাও বুঝি।
ব্যাগে ঠিকঠাক আছে কি না, চেপ্টে না যায় সেজন্য সতর্কতার শেষ নেই।
হাত দিয়ে দেখলাম-না ঠিকই আছে।
তবে এই ফুলের জন্য বাড়ির কারও কোনো যে আগ্রহ নেই, টেবিলে রেখে দিলে পড়েই থাকতে পারে, আর কাজের লোকের দায়ই বা কতটা। সুমিত্রার অফিসে কাজের চাপ, তার শরীরও বিশেষ সুস্থ না, যেন কোনোরকমে জীবনযাপন।
কেন জানি মনে হল—ফুলদানিতে নিজেই গোলাপ দুটো রেখে দেবো। যে ক দিন তাজা থাকে। মেয়েটি আমাকে প্রণাম করার কেন যে সহসা ক্ষেপে গেছিলাম, তাও বুঝতে পারছি না। বরং এখন মেয়েটির সেই করুণ মুখের কথাও ভেবে আমার খারাপই লাগছিল।
আমার কোনো গল্প কিংবা উপন্যাস পাঠের পর মেয়েটির হয়তো মনে হয়েছিল —যদি কোনো দিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তবে এই গোলাপ দুটি তার ইচ্ছের প্রতীক হয়ে থাকবে।
তখনই আববু বলল, তোমাকে কে বেশি ভালোবাসে?
এ ভারি কঠিন প্রশ্ন।
শিশুদের প্রশ্ন এত কঠিন হয়, জানা ছিল না। মিছে কথাও বলতে পারছি না। সবাই আমাকে ভালোবাসে বলতে পারলে, খুশি হতে পারতাম। কিন্তু মিছে কথা হয়ে যাবে। এই মুহূতে কে আমার নিজের, তাও বুঝতে পারছি না। এমন নিষ্পাপ শিশুর সঙ্গে ছলনাও করা যাবে না।
বললাম, আমি ঠিক জানি না, এ-মুহূর্তে কে আমাকে বেশি ভালোবাসে।
আমার মুখ কেমন হতাশায় ভরে গেছে দেখে আববু বলল, জানো, আমার নানাজির ভারি কঠিন অসুখ। আমি ফুল নিয়ে যাচ্ছি। নানাজি ফুল খুব ভালোবাসে।
দাদুর জন্য ফুল নিয়ে যাচ্ছ? কোথায় থাকেন তিনি?
বা রে, হাতিয়াড়ায় পীরের দরগা আছে না, দরগার পাশে থাকেন।
তোমরা কোথায় থাকো?
তারকেশ্বরে। আমাদের কোয়ার্টারের পাশে সবুজ ধানখেত। যতদূর তাকাবে না….. কেবল ধানের খেত। কোয়ার্টারের পাশে ডোবা আছে। কত জল। কত কচুরিপানা। মা আমাকে যেতে দেয় না। ডোবার পাড়ে জঙ্গল। জানো, জঙ্গলে একটা ভূত থাকে।
ভূতের সঙ্গে কথা হয়।
হবে না! আড়ি দিয়ে রেখেছি। আবার ভাব হলে কথা বলব। ভূতটাই তো এসে বলল—দাদুর বাড়ি যাবি, ফুল নিবি না?
তারপর আববু কী ভেবে বলল, কী ফুল নিই, কোনো ফুলই নেই—যা গরম পড়েছে! তখনই কচুরিপানার ফুল মনে পড়ে গেল। লুকিয়ে জলে নেমে গেছি— কেউ জানে না, দুটো ফুল ডোবা থেকে তুলে এনেছি।
ভূত না বলে বন্ধু বলো।
আববু বলল, বন্ধুই তো। আমি কি বলেছি, বন্ধু নয়?
এ-সব কথাবার্তার মধ্যেই আববু তার ব্যাগ থেকে কচু পাতায় মোড়া ফুল দুটো বড়ো সন্তর্পণে বের করে আনল।
সে তারপর কচুর পাতা খুলে যা বের করল অবাক না হয়ে পারলাম না।
সত্যি, দুটো কচুরিপানার ফুল।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে ফুল দুটো বোধহয় তুলে এনেছে। সামান্য দুটো কচুরিপানার ফুল নীল-সবুজ পাপড়ি মেলে, এক বিশাল ফোয়ারার মতো আববুর দু-আঙুলের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে।
আববু বলল, কী সুন্দর না! বাবা জানে না—ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
আমি বললাম, আমারও কেউ জানে না। ব্যাগে লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
বারে, বড়োরা আবার কিছু লুকিয়ে নিয়ে যায় নাকি?
আমি বলতে চাইলাম, যায়। বড়রাই যায়।
আববু বলল, কী লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছ?
তোমার মতো দুটো ফুল।
দেখি কোথায় ফুল?
ব্যাগ থেকে কলার পাতা খুলে দেখাতেই আববু লাফিয়ে উঠল।
কী সুন্দর ফুল! আমাকে একটা দেবে?
আমার ফুল দুটো কলাপাতায়, ওর দুটো কচুর পাতায়।
তুমি দুটোই নাও। দুটোই বাগানের তাজা গোলাপ।
বাড়িতে তোমাকে বকবে না? সব দিয়ে দিচ্ছ।
হাসলাম। শেষে বললাম তোমার দাদুকে দিও। দাদুকে বলবে—রাস্তার একটা লোক…. জানো, ফুল দুটো তোমাকে দিতে বলল। ……. আর কী বলবে, বলো তো?
বা রে, আর কী বলব, জানব কী করে? আমি কি তোমাদের মতো বড়ো?
বলবে—আমিও তোমার দাদুর বাড়ির দিকে হাঁটছি। আগে থেকেই তাঁকে আমার প্রিয় ফুল দুটো পৌঁছে দিলাম।
তুমি যাবে আমাদের বাড়ি?
যাবো।
কবে যাবে?
বাস থেকে নেমে যাবার সময় হাত তুলে বললাম যাবো। ঠিক একদিন চলে যাবো। যে-কোনও দিন।
আববু বাসের জানালার হাত নাড়ল।
টা টা।
আববুর মুখে দুরন্ত হাসি। যতক্ষণ দেখা যায় বাসের জানালায় দাঁড়িয়ে আববু। আমাকে দেখল। আমি হাত নাড়ছি। হাঁটছি।
বাসটা চলে যেতেই কেমন ঝুপ করে যেন সব অন্ধকার হয়ে গেল। চোখে যেন কিছু আর দেখতে পাচ্ছি না। কে যে কখন কার প্রিয়জন হয়ে যায়, কেউ বোধহয় জানে না।