1 of 2

বাখরাবাদের ভুবন

বাখরাবাদের ভুবন

বউদিরা সকলেই ভুবনকে ভালোবাসতেন। ওর মাথার একটু গোলমাল ছিল বলে এবং ওর স্বভাবটা বড়ো শান্ত ছিল বলে আমাদের বাড়িতে ওর একটা বিশেষ স্থান ছিল।

বাখরাবাদ জায়গাটা কটকের অনেকদিনের পুরোনো মহল্লা। মহানদীর পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে সোজা, সেই রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমাদের বাড়ির পাশে একফালি জমি। আতা এবং অনেক অমৃতভাণ্ডার গাছ। সেই জমিটুকুর মধ্যে একটি ছোটো ঘরে ভুবন থাকত। থাকত মানে, দুপুরে বিশ্রাম করত ও রাতে গিয়ে শুত। নইলে সারাদিন ও আমাদের বাড়ির বাইরের গেটের ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে টুল পেতে বসে থাকত।

শীতের দিনে রোদ এসে ভরে দিত জায়গাটুকু। ভুবন রোদের মধ্যে টুলটাকে টেনে এনে রোদে পিঠ দিয়ে বসত। পরনে সব সময় গেরুয়া ধুতি আর একটা হলুদ রঙে ছোপানো শার্ট। শীতের দিনে একটা কটকি মোটা গামছা গায়ে জড়িয়ে থাকত ও সবসময়।

আমার দোতলার জানলার সামনের টেবিলে বসে কলেজের পড়া করতে করতে মুখ তুললেই ভুবনকে দেখতে পেতাম। ভুবনের মনে এক অদ্ভুত শান্ত নির্লিপ্তি ছিল। এই পৃথিবীতে ওর। আপনজন বলতে কেউই ছিল না। না ছিল আপনার কোনো জন, না ছিল নিজস্ব কোনো সম্পত্তি। তবুও ওর মুখে কোনো অভিযোগ, অনুযোগ বা বিরক্তি ছিল না, কারও বিরুদ্ধেই। সব সময় হাসি হাসি মুখে সকলের আজ্ঞাপালনের জন্যে ও তৈরি হয়ে বসে থাকত।

মাঝে মাঝে ভুবনকে আমার সিগারেট আনতে পাঠাতাম। ফেরত আসা খুচরো পয়সা ওকে কখনো দিতে চাইলে ও নিত না। ও বলত, পয়সা দিয়ে আমি কী করব দাদাবাবু? আমি নিজে ছাড়া আর আমার তো কেউই নেই যার জন্য আমার কিছু করার আছে। আমার ভার তো তোমরাই নিয়েছ।

প্রতি বছর গরমের সময় ভুবনের মাথার গোলমালটা বাড়ত। আমাদের বাড়ির আশ্রয়ে ও শান্তিতে থাকত কিন্তু আমাদের বাড়ি পেরুলেই জায়গাটা ওর জন্যে নিরাপদ ছিল না। পাড়ার ছেলেরা ওর দিকে কুকুর লেলিয়ে দিত, কখনো-বা খালি দইয়ের হাঁড়ি মাথায় পরিয়ে দিত। কোনো। কোনোদিন বা গাধার পিঠে উলটোমুখ করে চড়িয়ে দিয়ে মুখে চোখে রসগোল্লার রস মাখিয়ে পাড়াময় ঘোরাতো। আমরা ওকে বাঁচাবার জন্যে কিছুই করতে পারতাম না। ওকে মানা করতাম বাড়ির বাইরে যেতে–কিন্তু অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ও বেরিয়ে যেত। যখন বেরোনো ওর পক্ষে বিপজ্জনক ছিল, ও ঠিক তখনই বেরিয়ে যেত।

বড়ো বউদির বাপের বাড়ির ঝি পেঁচি থাকত আমাদের বাড়ির হাতার মধ্যেই প্রায় বাড়ির লাগোয়া আউট হাউসের দোতলায়, একতলায় অন্য চাকরবাকরেরা থাকত। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠেই পেঁচির ঘর।

পেঁচির চেহারা যে আহামরি ছিল তা নয় কিন্তু পেঁচির চোখ দুটো ভারি সুন্দর ছিল। ভুবন সেই চোখের মধ্যে কিছু বোধহয় দেখেছিল, যা তার নিখিল ভুবনের আর কোথাওই দেখেনি। যার পৃথিবীতে থাকার মধ্যে কিছুই নেই, কাউকে দেওয়ার মতো কণামাত্র জাগতিক ধন নেই, সে যখন কাউকে সর্বস্ব দিয়ে মনে মনে ভালোবাসে, সে ভালোবাসা বড়ো কষ্টের হয়। হয়তো দারুণ আনন্দেরও হয় কারণ তার ভালোবাসার জনকে বিশেষ দেয় কিছু থাকে না বলেই অদেয়ও বোধহয় কিছুই থাকে না।

বয়সে ভুবন প্রায় আমারই সমবয়সি ছিল। সে কারণে, অন্য কোনো ব্যাপারে আমাদের মিল না থাকলেও মানসিকতার এক বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো অজ্ঞাত কারণে আমাদের খুব মিল ছিল। যে ক্ষেত্রে সে সময় আমার কোনোমাত্র প্রাপ্তিযোগ ঘটেনি–অথচ ভুবন তার সমস্ত সম্বলহীনতার। মধ্যেও আমাকে সেখানে অতিক্রম করে গেছিল, তাই মনে মনে ভুবনের কাছে আমি হেরে গেছিলাম।

রানি অথবা বাঁদিই হোক দুপুরের শেষটাতে ঘরে থাকা সব মেয়েদেরই যে একফালি রোদ্দুর মাখা অবসর থাকে সেই অবসরের পরিসরটুকুতে পেঁচি ভুবনের সঙ্গে রোদে বসে প্রায়ই গল্প করে কাটাত। ভুবন নিজে বিশেষ কথা বলত না। পেঁচিই অনর্গল কথা বলে যেত। কানে আসত। নানারকম কথা। তাদের গ্রামে কবে তালগাছের মাথায় বাজ পড়েছিল, কবে পুকুরে দেড়মণি। কাতলা মাছ ধরা পড়েছিল,ইত্যাদি ইত্যাদি নানা কথা। একে প্রেমালাপ বলা চলত না কোনো মতেই। কিন্তু পেঁচির সামনে বসে পেঁচির মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকা ভুবনের চোখ দেখলে তখন মনে হত, ভুবনের মতো সুখী লোক আর নেই।

মেয়েদের চোখে কিছুই এড়ায় না। তাই বউদিরা ভুবন ও পেঁচির মধ্যে যে একটা মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারতেন। কিন্তু পেঁচি সাবধানি ও চালাকচতুর ছিল যে, তার সম্বন্ধে তাঁদের সহজাত সাধারণ বুদ্ধিতে তাঁরা মোটেই চিন্তিত ছিলেন না। ভুবন সম্বন্ধেও ছিলেন না। কারণ ভুবনের মধ্যে এবং একটি বোকা, সরল, ক্ষমতাহীন জল ঢোঁড়া নির্বিষ সাপের মধ্যে তাঁরা কোনো তফাত দেখতে পেতেন না। বাড়ির দুধেল গাই, মেনিবেড়াল এবং ভুবন-পাগলও যে সমগোত্রীয় কোনো মনুষ্যেতর হৃদয়রহিত জীব এ সম্বন্ধে তাঁদের কারো মনেই কখনো কখনো সন্দেহের উদ্রেক হয়নি।

একবার পাড়ার বকাটে ছেলেরা কলেজ ফিরতি একদল মেয়ের গায়ে ভুবনকে ঠেলে ফেলে দেয়। সেই সব ছেলেদের কিছু না বলে, মেয়েরা ভুবনকে ধরেই পুলিশে দেয়। ভুবনকে আমি যখন থানা থেকে দু-ঘন্টা পরে ছাড়িয়ে আনতে যাই, তার আগেই ন্যায় বিচারের পরাকাষ্ঠা দেখানোর জন্যে তাকে বেদম প্রহার করা হয়। ভুবনের তখন প্রায় হুশ ছিল না। ও কেবলই বলছিল, দিদিমণিদের কোনো দোষ নেই, সব দোষ আমার কপালের। ভুবনের সেই অবস্থাতেও কারো উপর কোনো রাগ বা অভিমান দেখিনি।

সেই সময় ওকে দেখে আমার ওকে আবার মারতে ইচ্ছে করেছিল।

কত পাগল রেগে গিয়ে কত কী করে। ইট ছোড়ে, গালাগালি করে, থুথু ছিটোয়, অথচ ভুবন অন্যায়ভাবে এত মার খাওয়ার পরও একটু রাগ করে না কেন? এত নির্লিপ্ত ও কী করে যে থাকে সবসময়, সবকিছুতে, একথা ভাবতেই আমার অবাক লাগত। খারাপও লাগত।

ভুবনের ঘরে গেছিলাম ভুবনের জ্বর দেখতে। বেশ কদিন হল ও জ্বরে পড়েছিল। দু-বেলা ভুবনকে গিয়ে দেখে আসতাম আমি। পেঁচি পথ্য নিয়ে গিয়ে খাইয়ে আসত। প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে তখন ও। ভাত খাবে।

ছোটো ঘর। মাটির দেওয়াল টিনের চাল। বাঁশের মাচার উপর এক কোণায় রাখা কালোর মধ্যে লাল ফুল তোলা টিনের একটি ছোট্ট তোরঙ্গ। অন্য একটি বাঁশের মাচার উপরে ভুবনের বিছানা।

ওর ঘরে সেদিন গিয়ে পৌঁছোতেই আমাকে দেখে ভুবন তাড়াতাড়ি কী যেন একটা লুকিয়ে ফেলল। বললাম, কী লুকোলি রে ভুবন?

ভুবন লজ্জা পেয়ে গেল। মনে হল, ভয়ও পেয়েছে। কিন্তু আমাকে ও মিথ্যা কথা বলতে পারল না। মিথ্যা কথা বলতে পারতও না ও। অস্ফুটে বলল, ফোটো।

বললাম, কার ফোটো।

ভুবন কথা না বলে তোরঙ্গ থেকে একটা ফোটো বার করল। দেখলাম, মেজদার মেয়ে রাণুর ছবি। পেঁচির কোলে রাণু। মেজোবউদি নিজে বক্স-ক্যামেরা দিয়ে হাত পাকিয়েছিলেন ওদেরই উপর।

ভুবন মুখ নীচু করে ছিল।

কথাটা বলব কি বলব না ভাবলাম একটুখন, তারপর বলেই ফেললাম। পেঁচিকে তোর খুব ভালো লাগে? না রে? পেঁচিকে তুই ভালোবাসিস?

ভুবনের সমস্ত মুখ সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ দাদাবাবু।

ও এমন গলায় কথাটা আমার কাছে কবুল করল যে, মনে হল ও খুনের অপরাধ স্বীকার করছে।

আমার সত্যিই অবাক লাগছিল। ভুবন, আমাদের ভুবনও ভালোবাসে। কিন্তু কেন?

আমি বোকার মতো ছেলেমানুষি সরলতায় ভুবনকে শুধিয়েছিলাম, ভালোবেসে কী পাস রে ভুবন?

সে প্রশ্নের উত্তরে ভুবন যেকথা বলেছিল তা শোনার জন্যে আমি মনে মনে মোটেই তৈরি ছিলাম না। ভুবন বলেছিল, কাউকে ভালোবেসে, যাকে ভালোবাসা যায়, তার কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই।

আমি বলেছিলাম, মানে?

–আমি অত জানি না দাদাবাবু। লেখাপড়া করিনি তো তোমাদের মতো। পেঁচিকে ভালোবেসে আমি আমার নিজের থেকে অনেকই বড়ো হয়ে গেছি।

তারপরই ভুবন বলেছিল, তোমার পায়ে পড়ি, তুমি কাউকে বলবে না যেন। এই ছবিটা ছাড়া আমার আর দামি কিছুই নেই! এইটাই সবচেয়ে দামি।

আমি চুপ করে ছিলাম। ভুবন জানে না যে, বাড়ির সকলেই জানে পেঁচির কথা। আমি শুধিয়েছিলাম, পেঁচি কি তোকে ভালোবাসে ভুবন?

ভুবনের চোখ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, কারো ভালোবাসা পাওয়া যে কী আনন্দের, যতদিন না তোমাকে কেউ সত্যি সত্যি ভালোবাসছে, ততদিন তুমি বুঝবেই না।

তারপর আর এক দিনের ঘটনা মনে আসে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে। মিষ্টি মিষ্টি ঠান্ডা পড়েছে কটকে। একদিন সন্ধ্যের পর দোতলার খোলা বারান্দায় বসে আছি ইজিচেয়ারে চাদর মুড়ি। দিয়ে। চমৎকার নীল আকাশে তারারা ঝিকমিক করছে। সেজদার তখন সবে বিয়ে হয়েছে। সেজো বউদি ঘরে বসে সেতার বাজাচ্ছে। কানে, দূর থেকে ভেসে আসা সুরগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেজো বউদি একটা আনকমন রাগ বাজাচ্ছিল। রাগটা কী, তাই ধরবার চেষ্টা করছি কান পেতে, এমন সময়ে কাছেই কোনো দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ শোনা গেল। মুখ তুলে দেখলাম, আমাদের ভুবন, পেঁচির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে। ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজটা ধীরে ধীরে জোর হতে লাগল। বেশ অনেকক্ষণ পর পেঁচির ঘরের দরজা খুলে গেল। ভিতরে একটা লণ্ঠন জ্বলছিল তার আলোতে দেখা গেল পেঁচিকে। ওর মুখে পাশ থেকে আলো পড়ায় মনে হল ও বিছানায় শুয়ে ছিল, এখুনি উঠে এল। এলোমেলো শাড়ি, উশকোখুশকো চুল।

আগেই বলেছিলাম, আউট-হাউসটা বাড়ির একেবারে লাগোয়া ছিল। আমি বারান্দার অন্ধকারে ইজিচেয়ারে বসে থাকায় আমার ওখান থেকে দেখা যাচ্ছিল না। অথচ পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে ভুবন ও পেঁচিকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। কথা তো শুনতে পাচ্ছিলামই।

পেঁচি ঘর থেকে বেরিয়ে বিরক্তির গলায় শুধোলো, কী ব্যাপার?

ভুবন একটুখন চুপ করে থেকে বলল, তোর ঘরে কে রে? তুই কী করছিলি? পেঁচি বলল, কেউ না তো!

ভুবনের গলায় এমন একটা আঁচ লাগল যে, এমন গলায় ওকে কখনো কারো সঙ্গে কথা বলতে শুনিনি। ভুবন বলল, আমি তোর ঘর দেখব। বলেই, দরজার পাল্লাটা ঠেলে ভিতরে ঢুকে যেতেই পেঁচি ওকে ঠেলে বাইরে বের করে নিজেও ঘরের বাইরে চলে এল।

পেঁচি বলল, আছে একজন, আমার জাজপুরের মামা। আমাকে দেখতে এসেছে।

ভুবন ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে কী দেখছিল, ভুবনই জানে। কিন্তু আমি সেই অন্ধকারেই অনুমান করতে পারলাম যে, ভুবন যেন কীরকম হয়ে গেল।

হঠাৎ ভুবন চাপা গলায় বলল, সত্যি কথা বল পেঁচি। আমাকে মিথ্যে বলিস না। তুইও আমাকে মিথ্যে বললে আমি কিন্তু মরে যাব।

পেঁচি খিলখিল করে হেসে উঠল। ভাড়া-করা সস্তা মেয়েদের মতো ভুবনের গায়ে ঢলে পড়ল।

পেঁচি ভুবনকে বলল, পাগল হলি তুই ভুবন? তোকে আমি মিথ্যে বলতে পারি? এই বলে ভুবনের হাত ধরে পেঁচি ভুবনকে নিয়ে তরতরিয়ে নীচে নেমে এল।

বলল, কাল এই সময়ে আসিস কিন্তু। এই সময়টাই আমার একটু সুবিধে। মামা আমার আজই চলে যাবে। জাজপুর থেকে এসেছে, জাজপুরে চলে যাবে।

ভুবন নীচে দাঁড়িয়ে পেঁচিকে করুণ গলায় আবার বলল, আমাকে মিথ্যে বলিস না পেঁচি। আমি কিন্তু মরে যাব। তুই ছাড়া আমার আর কেউই নেই রে। সত্যিই কেউ নেই।

এইটুকু বলেই, মাথা নীচু করে ওর ঘরের দিকে চলে যেতে লাগল।

পিছনে আর ফিরে তাকাল না একবারও।

আমি ভাবলাম, ভুবন না খেয়েই আজ চলে গেল কেন? মনে হল, ডাকি ভুবনকে। তারপর ভাবলাম, এ ব্যাপারের আমি যে কিছু জানি, একথা বাড়ির কেউ জানলে আমারই সমূহ বিপদ!

ভুবন হন হন করে চলে যাবার পরই পেঁচি আবার দৌড়ে, সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওর ঘরে পৌঁছেছিল। তারপর ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল।

আমি আবার সেজো বউদির সেতারে মনোনিবেশ করলাম। কী রাগ উনি বাজাচ্ছিলেন, তখনও ধরতে পারিনি, এমন সময় পেঁচির ঘরের দরজাটা খুলে গেল। ঘরের আলোয় দেখলাম বড়দার নতুন গাড়ির নতুন ড্রাইভার ডোকরা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, পায়জামা আর নীলরঙা টেরিলিনের ফুল শার্ট পরে।

ছোকরা সিঁড়ি বেয়ে নেমে, চোরের মতো গ্যারেজের দিকে চলে গেল।

আমার গলা ছেড়ে ভুবনকে ডাকতে ইচ্ছে করল। ইচ্ছে করল, ভুবনকে গিয়ে বলি, ভুবন শুনে যা, দেখে যা, তোর কাঙাল ভুবনের একমাত্র ভুবনেশ্বরী তোকে কী মর্মান্তিকভাবে ঠকিয়েছে রে!

সেই রাতেই আমরা ভুবনকে শেষ দেখি, ভুবন সম্বন্ধে শেষ শুনি।

পরদিন থেকে ভুবনকে আর পাওয়া গেল না। পুলিশে খবর দেওয়া হল। কিছুই হল না। এক মাস দাদারা সবরকম চেষ্টা করলেন। বউদিরা অনেকদিন ভুবনের জন্যে খাবার রেখে দিতেন আলাদা করে। বলতেন, বেচারার মাথা খারাপ। কবে আবার নিজেই কোথা থেকে ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হবে দেখিস।

কিন্তু কটকের বাখরাবাদের সে বাড়িতে আমরা আরও তিন বছর ছিলাম। যাভেনশ কলেজ থেকে আমি বি. এ. পাশ করা পর্যন্ত সেই তিন বছরের মধ্যে আমরা ভুবনের কোনো খোঁজ পাইনি।

পাড়ার ছেলেরা যারা ভুবনকে কুকুর বেড়ালের মতো দেখেছে, তারাও নিজেদের অজান্তে ভুবনকে ভালোবেসে ফেলেছিল হয়তো। তারাও কম চেষ্টা করেনি খুঁজে বের করার। অবশেষে কেউ কেউ বলল, কটক স্টেশনের আউটার সিগন্যালের কাছে যে লোকটার বিকৃত মৃতদেহ পাওয়া গেছে লাইনের ওপর, সেই ভুবন। যে লোকটা ট্রেনে কাটা পড়েছে, সেই ভুবন। কেউ বলল, ভুবন মহানদীতে ডুবে মরেছে।

পুলিশের লোকেরা ভুবন নিখোঁজ হওয়ার দিন ভুবনের ঘর যখন তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল, কোনও তথ্যের খোঁজে তখন আমি সামনে ছিলাম। ভুবনের ঘরে যেমনটি যেখানে থাকার সবই তেমনটি ছিল। একমাত্র যা খোয়া গেছিল, তা একটি ফোটো।

ভুবন যেখানেই যাক না কেন যাওয়ার সময় তার জীবনের সবচেয়ে দামি বস্তুটিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে ভোলেনি।

পেঁচির সঙ্গে সেই ছোকরা ড্রাইভারের বিয়ে হয়েছিল। পেঁচির একটি ছেলেও হয়েছিল আমরা বাখরাবাদে থাকতে থাকতেই। বড়ো বউদি ওদে প্রাইভেসির জন্যে বিয়ের পরই ভুবন যেখানে থাকত সেই ঘর, আমবাগানের ছায়া, আতা গাছের শান্তি সবই পেঁচির জন্যে নির্দিষ্ট করেছিলেন।

মাঝে মাঝে পেঁচির চোখের দিকে আমি তাকাতাম। ওর চোখে চেয়ে ওর কোনোরকম দুঃখ বা অনুতাপ আছে বলে আমার কখনো মনে হয়নি। দুঃখবোধ বোধহয় সকলের থাকে না। পেঁচি ভালো খেত, ডুরে শাড়ি পরত, দুপুরে পান মুখে দিয়ে রোদে চুল ছড়িয়ে বসত। দিব্যি ছিল।

গত সপ্তাহে বহু বহু বছর বাদে অফিসের কাজে কটকে গেছিলাম। কাজ সেরে প্রথমেই বাখরাবাদে দৌড়েছিলাম গাড়ি নিয়ে। আমার শৈশব–যৌবনের প্রথম ভাগ যে বাড়িতে কেটেছে সে বাড়ি দেখতে।

কিন্তু সে বাড়ি এত দিন বাদে আর সে বাড়ি নেই। সামনের মাঠে চারতলা নতুন বাড়ি উঠেছে। পুরোনো বাড়ির একেবারে জরাজীর্ণ দশা। সেই সব পরিচিত, প্রিয় গাছগুলোও প্রায় কোনোটাই আর নেই এখন। কিছুই আর চেনা যায় না। দেখে শুনে মনে হচ্ছিল বারবার যে, এখানে এতদিন পর না এলেই পারতাম!

স্মৃতির কোটরে যা ছিল, সবই বদলে গেছে, ক্ষয়ে নুয়ে ভেঙে গেছে, রোদে জলে ধুয়ে গেছে, মুছে গেছে। শুধু আজও যা একটুও মোছেনি মন থেকে তা বাখরাবাদের ভুবনের স্মৃতি।

বয়সে এখন অনেক বড়ো হয়ে গেছি, নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে জীবনে, তবুও যখনই নানা কাজের ফাঁকে একটু সময় পাই স্মৃতিচারণার, তখনই কেবলই মনে হয়–সেই রাতে পেঁচির ঘরে ভুবন কেন জোর করে ঢুকল না, কেন পেঁচির স্বরূপ বুঝতে পেরেও পেঁচির সামনে সকলের সামনে, তার নিজের সামনে, পেঁচির স্বরূপ উদঘাটিত করল না? করল না কেন?

সেই কেনর উত্তর আমার কাছে নেই। কিন্তু ওর কাছে তা নিশ্চয়ই ছিল। যেকথা ভুবন তার আম গাছের ছায়াঘেরা ঘরে বসে একদিন আমাকে বলেছিল।

বলেছিল, পেঁচিকে ভালোবেসে আমি আমার নিজের চেয়ে অনেক বড়ো হয়ে গেছি দাদাবাবু।

ভুবনটা বড়ো বোকা ছিল। পেঁচিকে, পৃথিবীকে ও বড়ো বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছিল। ও বোধহয় কখনো বোঝেনি যে, পেঁচিরা চিরদিনই পেঁচিই থাকবে, আর ভুবনেরা হারিয়ে যাবে, ভুবনের মতো।

চিরদিনই তাই হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *