২০১৫ সালের ২৪ মার্চ। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ক’ ধারাকে বাতিল করেছেন। ওটি ছিল বাক স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি আইন। সর্বোচ্চ আদালত সেদিন বলে দিয়েছেন, আইনটি মত-প্রকাশের অধিকার বিরোধী তো বটেই, ভারতের সংবিধান বিরোধীও। মাননীয় বিচারকমণ্ডলীকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। ওঁদের রায়টি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রায়। আমার জন্য সবচেয়ে সুখের বিষয়, কালো আইনটি বাতিল করার লড়াইয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে ছিলাম আমিও। আমি ভারতের নাগরিক না হয়েও ভারতের একটি অসাংবিধানিক আইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, এবং জিতেছি। ভারতের মত-প্রকাশ-বিরোধী আইন হঠাতে আমার একটি ভূমিকা রয়ে গেল।
এই আইনটির কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। আমারও হয়েছে। গত বছর আগে আমার একটি টুইটের কারণে উত্তর প্রদেশের এক মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে ৬৬ক ধারায় মামলা করেছিল। আমার টুইটটা ছিল এরকম, ‘যে অপরাধীরা নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, নারীর মাথার দাম ঘোষণা করে, তাদের কোনও শাস্তি হয় না ভারতবর্ষে’। টুইটটি করার পেছনের কারণ ছিল, কয়েক বছর আগে মুসলিম ল’ বোর্ডের প্রধান তৌকির রাজা খান আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছিল ৫ লাখ টাকা। এই ফতোয়া জারির জন্য তার কোনও শাস্তি হয়নি। শাস্তি বরং আমার হয়েছে। ভুক্তভোগীকেই আরও ভোগানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়, ধর্মসংক্রান্ত রীতিনীতিগুলো অনেকটা এরকমই। এর আগেও পাটনায় একটি মামলা হয়েছিল আমার এক টুইটের জন্য। ওটা ৬৬ক ধারায় ছিল না। কিন্তু ওটাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। ওই মামলাটি আজও খারিজ হয়নি, প্রায় দু’বছর যুদ্ধ করে উচ্চ আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানাকে স্থগিত করার ব্যবস্থা হয়েছে। ৬৬ক ধারায় উত্তর প্রদেশের মামলাটির জন্য আমি সর্বোচ্চ আদালতের একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলি। টুইটের কথা তাঁকে বলাতে তিনি বললেন, ‘আপনি তো ভুল কিছু লেখেননি। ক্রিমিনালকে ক্রিমিনাল বলেছেন। যে লোক মানুষের মাথার মূল্য ধার্য করে, সে অবশ্যই ক্রিমিনাল। সে জনসমক্ষে মানুষকে হত্যার প্ররোচনা দিচ্ছে’। যে কেউ একটা টুইট লিখবে, ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেবে, বা একটা ব্লগ লিখবে– সে কারণে তাকে গ্রেফতার হতে হবে, তাকে জেলে যেতে হবে, মত প্রকাশের কোনও স্বাধীনতা তবে এদেশে নেই! আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক হলো, আমি শুধু আমার বিরুদ্ধে জারি হওয়া মামলার বিরুদ্ধে লড়বো না, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে এমন একটি বাক স্বাধীনতা বিরোধী আইন থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবো। সেই শুরু। আইনের ছাত্রী শ্রেয়া সিংঘাল প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেই মিছিলে যোগ দিলাম আমিও। আটজন, সম্ভবত আটজনই, প্রশ্ন তোলার পর মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে উঠলো।
মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আজ লড়ছি প্রায় তিন যুগ। শুধু নিজের লেখা বই আর টিভি সিরিয়ালের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আমার চিন্তা-ভাবনা আদর্শ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে শান্ত হয়নি কোনও মৌলবাদী বা কোনও সরকার, আমি মানুষটাকেও নিষিদ্ধ করেছে। আমার আজ বাংলার মাটিতে পা দেওয়ার কোনও অধিকার নেই। অথচ এই বাংলা নিয়ে আমার ভাবনার কুলকিনার নেই, আমার গদ্যপদ্যের ভাষাটিও তো বাংলাই। এতকালের লড়াইয়ের সুফল বাংলায় না হোক, অন্য কোথাও পেলাম আজ। তবে ৬৬-ক ধারাটি বাতিল করার সঙ্গে-সঙ্গেই যে মুক্তচিন্তার জয় হয়ে গেলো তা নয়। তথ্যপ্রযুক্তির ৬৯-ক নামের যে ধারাটি এখনও বহাল আছে, সেটি ব্যবহার করে সরকার এখনও বন্ধ করে দিতে পারে যে কোনও ওয়েবসাইট। তথ্যপ্রযুক্তির আইন আর কত ব্যবহৃত হচ্ছে, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যে আইনটি ব্যবহৃত হয় সেটি ভারতীয় ফৌজদারি আইনের ২৯৫ ক, খ ধারা। এটি শুধু ভারতবর্ষে নয়, পুরো উপমহাদেশেই বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। আইনটি একশ’ পঞ্চাশ বা তারও অধিক বয়সী একটি আইন। ইংরেজরা বানিয়েছিল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মারামারি বন্ধ করার জন্য। পুরোনো এই আইনটি উপমহাদেশে মূলত ব্যবহৃত হয় মুক্তচিন্তকদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে। বাংলাদেশে এবং ভারতে মুক্তচিন্তক আর যুক্তিবাদীদের হেনস্থা করার জন্য, নির্যাতন করার জন্য, এই আইনটি মূলত ব্যবহৃত হয় । পাকিস্তানে আবার ক, খ ছাড়াও গ নামক ধারাটি আছে, যেটি মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ডের জন্য পাকিস্তানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের ঘন-ঘন বেছে নেওয়া হয়।
২৯৫ ক,খ,গ এই তিনটি ধারাকেই উপমহাদেশ থেকে অতি শীঘ্র বিদেয় করা উচিত। এটি থাকলে এটি ব্যবহৃত হবেই মানুষের বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। সুতরাং না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। ৬৬ক বাতিল করাটা প্রথম ছোট্ট পদক্ষেপ। ধীরে-ধীরে পা ফেলতে হবে বৃহত্তর শত্রুর দিকে। পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে বাক স্বাধীনতা বিরোধী এত আইন নেই। থাকলেও মৃত পড়ে আছে, লেখক-শিল্পীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখানকার মতো ওসব আইন অন্য কোথাও এত ব্যবহৃত হয় না। ফোজদারি আইনের ২৯৫ ক,খ-কে বাতিল করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন সব করবো।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ৫৭ ধারাটিও ভারতের ৬৬ক এর মতো, একই ধরনের। বাংলাদেশে কেউ কি নেই ওই ধারাটিকে চ্যালেঞ্জ করার? বাংলাদেশেও ৫৭ ধারার আওতায় হুটহাট ধরে নিয়ে যায় ছেলে-মেয়েদের। অনলাইনে কেউ কোনও লেখার লাইক দিল, বা কোনও প্রতিবাদে নাম লেখালো, ওমনি তাকে বেধে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ আসবে। ৫৭ ধারায় কম ধর-পাকড় হয়নি, কম হেনস্থা হয়নি। আশা করে আছি বাংলাদেশের মানুষ ৫৭ ধারাটি অতি শীঘ্র বাতিল করবে এবং দেশটির পরিবেশ বাসযোগ্য করে তুলবে। একটা গণতন্ত্র শুধু ধর্মবিশ্বাসী মানুষের নিরাপত্তার অঙ্গীকার করে না, ধর্মমুক্ত মানুষদের নিরাপত্তার দেওয়ার অঙ্গীকারও করে। মত এবং ভিন্নমত—দুই অধিকারও নিশ্চিত করে।
নারীবিরোধী ও মানবতাবিরোধী ধর্মান্ধদের তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সে কারণে জগত সজাগ। এখনও কি জগতের সময় হয়নি সবাইকে সমান চোখে দেখার! ধর্মান্ধদের বাড়তি খাতির না করার! যুক্তিবাদীদের মানবাধিকারকে সম্মান করার!