১১ আর ১২ অক্টোবরে আন্তর্জাতিক সেক্যুলারিজম কনফারেন্স হয়ে গেল লন্ডনে। সেক্যুলারিজমের ওপর পশ্চিমের অনেক দেশেরই অনেক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছি আজ কুড়ি বছর। বেশির ভাগ অনুষ্ঠানেই একমাত্র এশিয়ান আমিই। অন্যান্য ধর্ম নিয়ে বলার লোক প্রচুর, কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে বলার বা মুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সবেধন নীলমণি এক আমিই। ইদানীং একটু বদলাচ্ছে অবস্থা। তবু কত আর বদলাচ্ছে! দু’মাস আগে যোগ দিয়েছিলাম অঙ্ফোর্ডের যে ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিস্ট কংগ্রেসে, সেখানেই বা আমি ছাড়া ক’জন ছিলেন মুসলিম সমস্যা নিয়ে বলার! এবারের অনুষ্ঠানটি ভিন্ন। মুসলিম অভিজ্ঞতা বলার জন্য বক্তার অভাব হয়নি এবার। এশিয়া থেকে বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো থেকে অনেক বক্তাই অংশ নিয়েছেন। মুসলিম মেয়েরা এক একটা মুসলিম দেশে শরিয়া আইনের অধীনে বাস করার ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। এবারের সেক্যুলারিজম কনফারেন্সটার অবশ্য যে দুজন আহ্বায়ক, তাদের জন্ম হয়েছিল দুটো মুসলিম দেশে। একজনের ইরানে, আরেকজনের আলজেরিয়ায়। দুজনই সাহসী যোদ্ধা। একজন বিলেতে ‘সবার জন্য এক আইন’ নামে আন্দোলন করছেন। আরেকজন বাস করেন ফরাসি দেশে, তাঁর সংগঠনের নাম ‘মুসলিম আইনের অধীনে মুসলিম নারী’। এবারের কনফারেন্সে যাঁর বক্তব্য শুনবো বলে আমার গভীর আগ্রহ ছিল, তিনি পাকিস্তানের পদার্থবিদ পারভেজ হুডভয়। পারভেজ হুডভয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এই অনুষ্ঠানেই। বহুকাল তাঁর আমি অনুরাগী পাঠক। পরিচয় দিতেই তিনি জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ডিনারে আমি অন্য টেবিলে ছিলাম। তিনি ডেকে নিয়ে পাশে বসালেন। তাঁর পাশে বসেই ডিনার করতে হলো। সমমনাদের সানি্নধ্য খুব বেশি পাওয়া হয় না, তাই খানিকক্ষণ কথা বললাম। পাকিস্তানের গল্প হলো, পাকিস্তানের গল্প মানে একরাশ হতাশার গল্প। আর এদিকে যখন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের হতাশা, তাঁর তখন বাংলাদেশ নিয়ে আশা। তিনি দু’বছর আগে বাংলাদেশে গিয়ে নাকি রীতিমতো মুগ্ধ। বললেন, হিজাব নিকাব ছাড়া মেয়েরা রাস্তায় চলাফেরা করছে, এরকম দৃশ্য পাকিস্তানে দেখা যায় না। মৌলবাদের পুণ্যভূমি পাকিস্তান থেকে এলে বাংলাদেশকে তুলনায় সেক্যুলার দেশ মনে হওয়াই হয়তো স্বাভাবিক। আর আমরা যারা বাংলাদেশকে ষাট-সত্তরের দশকে দেখেছি, তারা বর্তমান বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আশংকা ছাড়া আর কিছু করতে পারি না।
পারভেজ হুডভয় চমৎকার ভাষণ দিয়েছেন অনুষ্ঠানে। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, পাকিস্তান থেকে কিভাবে কমে যাচ্ছে অমুসলিম জনসংখ্যা, ক্রিশ্চান আর হিন্দু সংখ্যা তো কমছেই, কিন্তু কিভাবে সুনি্ন মুসলিমরা আহমদিয়া আর শিয়া মুসলিমদের মারছে। মুসলিমদের জন্য ইসলামিক স্টেটের ধর্মান্ধ খুনিরা যে পূতপবিত্র ইসলামিক রাজ্য বা রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখছে, সেই রাজ্য বা রাষ্ট্র মুসলমানদের জন্য হয়ে উঠবে আস্ত এক নরক, এ বিষয়ে তাঁর সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে আমাদেরও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি বিষয়ে আমার সন্দেহ জন্মেছে পারভেজ হুডভয় বাকস্বাধীনতা সম্পর্কে বিশদ জানেন কিনা এ নিয়ে। অবাক হয়েছি যখন তিনি তাঁর বক্তৃতার শেষদিকে বলেছেন, ‘আপনারা দয়া করে কার্টুন অাঁকবেন না, আপনারা কার্টুন অাঁকলে আমাদের জীবনের নিরাপত্তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। মৌলবাদীরা আমাদের প্রাণে মেরে ফেলে। সুতরাং, কার্টুন অাঁকা বন্ধ করুন’। সাদা ভাষায়, পারভেজ হুডভয় ইসলামের কোনও সমালোচনা না করতে বিশ্ববাসীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ সমালোচনা করলে, ধর্মান্ধরা, সে যে দেশেই থাকুক, সে দেশের প্রগতিশীল মানুষকে খুন করে। ডেনমার্কে এক লোক কার্টুন অাঁকলো, এর প্রতিবাদে সব দেশেই মৌলবাদীরা সন্ত্রাস করলো। ডেনমার্কের ঘটনা ডেনমার্কে থেমে থাকেনি। পাকিস্তানের প্রগতিশীলদের মধ্যে পারভেজ হুডভয় অন্যতম একজন। সুতরাং তিনিও ভয়ংকর কোনও কার্টুন কোথাও অাঁকা হলে খুন হবেন বলে ভয় পাচ্ছেন। তাই সকলকেই তিনি অনুরোধ জানালেন, কার্টুন ইত্যাদি যেন বন্ধ করা হয়। যখন মঞ্চ থেকে নেমে এলেন তিনি ভাষণ শেষ করে, একজন মুক্তচিন্তক তাঁকে জোঁকের মতো ধরলেন এবং বলতে লাগলেন, কতগুলো অসভ্য বর্বর লোক কী করবে, তার দোষ কেন গিয়ে পড়বে কার্টুনিস্টের ওপর। বাকস্বাধীনতায় তাহলে আপনি কি বিশ্বাস করেন না, মিস্টার প্রফেসর? আপনার বক্তব্য পুরোপুরি প্রমাণ করছে যে, বাকস্বাধীনতায় আপনি বিশ্বাস করেন না প্রফেসর। প্রফেসরের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছিল। তিনিও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলেন যে, পাকিস্তানের অবস্থা জানলে কেউ তাঁর সঙ্গে দ্বিমত করতো না। আমার দিকে তাকিয়েও তিনি সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধা করেও আমি তাঁর মতের সঙ্গে একমত হতে পারিনি। পাকিস্তানে বর্বর মৌলবাদীরা হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, সে কারণে আমি কথা বলা বন্ধ করবো কেন। আমি ছবি অাঁকা বন্ধ করবো কেন। পারভেজ আমাকে বললেন, তিনি মৌলবাদীদের ভয় পান। ভয় ওদের কে না পায়। যে কোনও সময় কাউকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে, বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে সামনে যা আছে সব, এমন কী নিজেদেরও, যে কাউকে আল্লাহর নামে জবাই করতে পারে। ওদের ভয় না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ওদের হাতে জীবন খোয়াতে কেউ চায় না। কিন্তু, পারভেজকে বললাম, ওদের দমন করার উপায় মুখ বন্ধ করে থাকা নয়। কার্টুন অাঁকলে ওরা তাণ্ডব করে, না অাঁকলেও ওরা তাণ্ডব করে। তুমি মুখ বন্ধ করে থাকলেও ওরা কিন্তু মুখ বন্ধ করে থাকবে না। তুমি হাত গুটিয়ে রাখলেও ওরা রাখবে না। আমি পারভেজকে বললাম, বরং সবাই মিলে ওদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করো, হাজার হাজার মুক্তচিন্তকের ক’জনকে ওরা টারগেট করবে! একসময় হাল ছেড়ে দেবে। ওরা হাল ছাড়ুক বা না ছাড়ুক, আমরা যেন হাল না ছাড়ি। মূর্খ খুনিদের হাতে সমাজকে ছেড়ে দেওয়ার মানে সমাজকে জেনেশুনে নষ্ট হতে দেওয়া।
পারভেজকে আমি জানাই, একজন কার্টুন এঁকেছিলো বলে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা বিশ্ব জুড়ে তাণ্ডব করেছে। এখন কার্টুন অাঁকার একটি দিবসই বানানো হয়েছে, ওই দিবসে লক্ষ লক্ষ লোক কার্টুন অাঁকে নেটে। করলে এভাবেই প্রতিবাদ করতে হয়। এখন কার্টুন অনেকটা ওদের কাছেও গা-সওয়া হয়ে গেছে। বাকস্বাধীনতা মেনে নিতে ঠিক এটাই করতে হয়। একসময় ক্রিশ্চান ধর্মের সমালোচনা করলে মেরে ফেলা হতো। এখন ওই ধর্মের সমালোচনা করা ইটকাঠপাথরের সমালোচনা করার মতো। সমালোচনা করতে করতেই সমালোচনাটাকে সহনীয় করে তোলা যায়। আমার বইয়ে ইসলাম সম্পর্কে সামান্য প্রশ্ন পেয়েছিল বলে নব্বই দশকের শুরুতে বাংলাদেশ জুড়ে সন্ত্রাস করেছিল মৌলবাদীরা। ওরা সবসময় ছুতো খোঁজে নিজেদের অপশক্তির বাহার দেখাবার। সরকার ওদের বিরুদ্ধে সেদিন কোনও টুঁ শব্দ না করে বরং আমাকে শাস্তি দিয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল, আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছিল। আমাকে শাস্তি দিয়ে সন্ত্রাসীদের সম্মানিত করেছিল সরকার। অপশক্তির তেজ শতগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন যদি মানুষ প্রতিবাদ করতো, তখন যদি আমার পাশে কয়েকশ’ মানুষও দাঁড়াতো, তাহলে কিন্তু আমাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার এবং, দেশটাকে মৌলবাদীদের হাতে তুলে দেওয়ার সাহস সরকারের হতো না। এভাবেই তলিয়ে যায় দেশ। প্রগতিশীলদের স্বার্থপরতা, ভয়, আপোস, এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ না করাই তলিয়ে যাওয়ার কারণ। আজ মৌলবাদীরা আগের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি, দেশের সর্বনাশ আগের চেয়ে বেশি করছে, আগের চেয়ে শতগুণ বেশি তাদের ক্ষমতা। এটি হতো না, যদি প্রগতিশীলরা আমার মতোই মুখ খুলতো, প্রতিবাদ করতো। এটি হতো না, যদি আরিফের মতো আর সবাই কার্টুন অাঁকতো দেশে। আরিফ একা এঁকেছিল বলে ওকে জেল খাটতে হয়েছিল, আমি একা বলেছিলাম বলে আমার মাথার দাম ঘোষণা হয়েছে, নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হচ্ছে দীর্ঘ কুড়ি বছর। অন্যরাও যদি মুখ বুজে না থাকতো, তাহলে মৌলবাদীরা পিছু হটতো। জানতো তারা একের সঙ্গে পারলেও অনেকের সঙ্গে পারবে না। অনেককে জেলে ভরা যায় না, অনেককে কোপানো যায় না, অনেককে নির্বাসন দেওয়া যায় না। যখন অনেকের মুখ খোলার কথা, তখন পারভেজ হুডভয় অনেককে বলছেন মুখ বন্ধ করতে। তিনি বাকস্বাধীনতা মানে কী, এখনও জানেন না। এবারের কনফারেন্সে আমি যার সাহসী বাক্য শুনবো বলে বসেছিলাম, সেই পারভেজ হুডভয় আমাকে খুব হতাশ করেছেন।
সূত্রঃ দৈনিক বাংলাদেশ-প্রতিদিন, ৬ অক্টোবর, ২০১৪