বাউল তত্ত্ব
০১.
মৈথুনতত্ত্ব ও টোটেম-বিশ্বাস অতি প্রাচীন। দুনিয়ার তাবৎ জাতির আদিম বিশ্বাস ও জীবনচর্যার সঙ্গে এ দুটো জড়িত। টোটেম-বিশ্বাসের একটি পরিচায়ক হচ্ছে পশু-পাখির নামানুসারে গোত্র ও ব্যক্তির নাম গ্রহণ। এটি আমরা প্রাচীন ভারতে যেমন দেখি, তেমনি অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যেও পাই। মৈথুনতত্ত্ব ভিত্তি করে শাস্ত্র ও দর্শন গড়ে ওঠে প্রধানত কৃষিজীবী সমাজেই–বিদ্বানদের মত এই। তার কারণ মৈথুন ও প্রজনন প্রাচীনকালের চেতনা অনুসারে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত ছিল।২ এবং ধন উৎপাদন পদ্ধতির অভিন্নতর ধারণা থেকেই মৈথুনতত্ত্ব ধর্মশাস্ত্রের মর্যাদায় উন্নীত হয়। এই জন্যে মৈথুন-ক্রিয়া ও উৎসবের সঙ্গে ফসলের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ। জাভা, নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকো প্রভৃতি আদিবসী অঞ্চলে এবং ভারতের আদিবাসী সাঁওতাল, হো, মুণ্ডা, পাঞ্চা, কোটার প্রভৃতির মধ্যে আজো মৈথুন উৎসব বিদ্যমান। এ হচ্ছে ফসল প্রাপ্তির বাঞ্ছায় সিদ্ধির আবহ সৃষ্টির প্রয়াস। আমাদের দেশে চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আজো অনাবৃষ্টির সময়ে ছেলেমেয়েরা কুলো নিয়ে ঘরে ঘরে পানি মাগে। তখন যেসব ছড়া আওড়ায় তাতে আছে কলাতলে এক গলা পানি, বৌ নাইয়রের নৌকা আনি ইত্যাদি। এতে বোঝা যায়, প্রবল বারিপাত জাত পরিবেশটা এরা কল্পনা করে, এবং তা-ই উচ্চারিত হয় বৃষ্টির আগমনী গানে। শস্য উৎপাদনের সঙ্গে মৈথুনের এমনি প্রতীকী আবহ সৃষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। R. Briffault তাই বলেন :
The assimilation of the fruit-bearing soil to the child-bearing women is universal ….. the fecundity of the earth and the fecundity of women are viewed as being one and the same quality.
James Frazer-ও বলেন :
In the opinion of those who performed them (ceremonies) the marriage of trees and plants could not be fertile without the real union of the human sexes …. ruder races in other parts of the world have consciously employed the intercourse of the sexes as a means to ensure the fruitfulness of the earth; and some rites which are still of were till lately, kept up in Europe can be reasonably explained only as stunted relics of similar practice.
G. Thomson-ও বলেন :
The desired reality is described as though already present.
এ বিশ্বাসের আরো একটি দিক রয়েছে। পৃথিবীর পিছিয়ে পড়া মানুষদের মধ্যে আজো এ বিশ্বাস টিকে আছে যে, নারীদেহ থেকেই আদি শস্যের উদগম হয়েছে। আমাদের দেশেও এ বিশ্বাস চালু ছিল তার প্রমাণ রয়েছে মার্কেন্ডেয় পুরাণে, আর আভাস আছে অনেক ক্ষেত্রে। মার্কেন্ডেয় পুরাণে দেবী বলেছেন :
ততোহহম খিলং লোকমাত্মদেহসমুদ্ভবৈ:।
ভবিষ্যামি সুরা: শাকৈরাবৃষ্টৈ: প্রাণধারকৈ: ॥
শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদাস্যাম্যহং ভূবি।
[অনন্তর আমি নিজদেহ উদ্ভুত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে যত দিন না বৃষ্টি হয়, ততদিন জগৎ পালন করব। এইজন্য আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব ] এই শাকম্ভরীই দুর্গা। দুর্গোৎসব হয় শরৎকালে। এতে সেই শস্যদেবীর পূজা উৎসবের আভাস মেলে। দুর্গাপূজার ভিতরেই দেখিতে পাই ….. একটি কলাগাছের সহিত কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বিন্দু, ডালিম, মানকচু, অশোক এবং ধান্য একত্রে যে শস্যবধূ নির্মাণ করা হয়, …. এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক বলিয়া গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়। শাকম্ভরী বলেই দুর্গা অন্নদা-অন্নপূর্ণা রূপেও পরিচিতা। হরপ্পায় আবিষ্কৃত একটি সীলে দেখা যায় একটি নগ্ন নারীমূর্তির দুটো পা দুপাশে ছড়ানো আর তার যোনি থেকে একটি লতা বেরিয়ে এসেছে। এ নারী যে শস্যদেবী এবং ফসল যে এদেবীর আত্মদেহসমুদ্ভবৈ : তাতে সন্দেহ নেই। এদেশের উমা ও প্রাচীন আনার্যদেবী; কেবল তাই নয়, এর বহির্ভারতিক অস্তিত্বও দেখা যায় :
The babylonian word for mother is Ummu or Umma, the Accadian Ummi and the Dravidian is Umma. These words can be connected with each other and with Uma the mother goddess.
কৃষির শুরু নারীদের হাতেই। প্রসবিনী নারীরা হয়তো নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে ফসলি উৎপাদনী ভূমির প্রজননক্রিয়া কল্পনা করেছে। তা থেকেই মৈথুন-প্রজননে এবং প্রসব উৎপাদনেও অভিন্ন পদ্ধতি কল্পিত হয়েছে। R. Briffault বলেন :
The art of cultivation has developed exclusively in the hands of women.
G. Thomson 76901 :
Food-gathering led to the cultivation of seed in plots adjacent to the settlement and so garden tillage is womens work.
অন্যান্য বিদ্বানেরাও এ মত সমর্থন করেন। পিতৃপ্রাধান্য অর্থে বীজ প্রাধান্য, আর মাতৃপ্রাধান্যসূচক ক্ষেত্র প্রাধান্য–শব্দদুটোর অভিধার মধ্যেও কৃষিপদ্ধতির আভাস রয়েছে। নারী উদ্ভাবিত কৃষিপদ্ধতির সঙ্গে নারীদেবীর যোগ থাকাই স্বাভাবিক। তাই পৃথিবীর সর্বত্র বসুমাতার কল্পনা প্রশ্রয় পেয়েছিল। পশুজীবী আর্যেরা এদেশে এসে কৃষিজীবী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষি সংক্রান্ত ও কৃষিজীবী সমাজের সংস্কারের প্রভাবে পড়েছিল বলে অনুমান করি। তাই বাজসনেয়ী সংহিতা, ব্রাহ্মণ, বৃহদারণ্যক, ছান্দোগ্য প্রভৃতিতে মৈথুন, প্রজনন, জীবন ও সম্পদ প্রভৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্বীকৃত হয়েছে।১৭ ছান্দোগ্যে আছে :
ক. হে গৌতম, স্ত্রীলোকই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি, তার উপস্থই হলো সমিধ। ওই আহ্বানই হলো ধূম। যোনিই হলো অগ্নিশিখা। প্রবেশক্রিয়াই হলো অঙ্গার। রতি সম্ভোগই হলো স্ফুলিঙ্গ।
অগ্নিতে দেবতারা রেতর আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়।
খ. ছান্দোগ্যের বামদেব্য ব্রতকথায় আছে।
যে একইভাবে বামদেব্য সামকে মৈথুনে প্রতিষ্ঠিত জানে; সে মৈথুনে মিলিত হয়। (তার) মিথুন থেকে সন্তান উৎপন্ন হয়। সে পূর্ণজীবী হয়; সন্তান, পশু ও কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না–এই-ই ব্রত।
এসব আদিম ধারণা থেকেই উদ্ভূত আদিম আচার আজো নতুন তাৎপর্যে ধর্মশাস্ত্রের অঙ্গ হয়ে আছে। আজো তাই লতা, স্ত্রীভগ, যন্ত্র প্রভৃতি সাধন-পূজনের অপরিহার্য অঙ্গ। কেবল এখানেই শেষ নয়, দেবতার হাতের ডালিম হচ্ছে রক্ত তথা রজ : ঋতুর প্রতীক। রজ: আবার সিন্দুরেও প্রতীকীরূপ নিয়েছে। আর পদ্ম হচ্ছে নারীযোনির প্রতীক।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে চেয়েছি যে আর্যেরা প্রাকৃতিক শক্তির পূজারী ছিল। পশুজীবী আর্যরা প্রকৃতি-প্রতীক দেবতা বায়ু, বরুণ, অগ্নি, ইন্দ্র প্রভৃতি কল্পনা করেছে। আর অনার্যেরা গুণময় শক্তির পূজারী ছিল। প্রকৃতির প্রসাদ নির্ভর আদিকালের অজ্ঞ অসহায় মানুষ কল্পনাশ্রয়ী না হয়েই পারেনি। অসহায় অসমর্থের অপ্রাপ্তি-অসাফল্যের ভয় থেকেই বিশ্বাস উৎসারিত। আজো দুর্বলচিত্তে তুকতাক ও শুভাশুভ প্রতাঁকের প্রভাব অপরিমেয়। নিজের মনোবাঞ্ছা সিদ্ধির অনুকূল পরিবেশ পেলে যে-কোনো মানুষ তার প্রয়াসে ও বাঞ্ছায় সিদ্ধি সম্বন্ধে আশান্বিত হয়ে ওঠে। বাহ্য নিদর্শন ঘিরে এই যে সিদ্ধির বা অসিদ্ধির কল্পনার প্রশ্রয় তা আজো কম নয়। তুকতাক, দারু-টোনা এবং শুভাশুভ প্রতীক, তিথি, নক্ষত্র ও দিনক্ষণের উপর কর্মের ফলাফল নির্ভরতায় বিশ্বাস আজো অধিকাংশ লোকের মনে দৃঢ়মূল। অক্ষম মানুষকে বাঞ্ছ সিদ্ধির কামনার তীব্রতাই যাদু বিশ্বাসের প্রবর্তনা দেয়। মনের এমনি অবস্থায় সিদ্ধির অনুকূল কাল্পনিক ও আচারিক আবহ সৃষ্টি করাও অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। দুনিয়ার মানুষের আদিম জীবন-জীবিকা সংস্থায়। স্বাভাবিকভাবেই তাই এ মনোবল সঞ্চয়ের সহায় যাদুবিশ্বাস চালু ছিল। প্রয়োজন ও ক্ষেত্র অনুসারে নানা বৈচিত্র্যে বিবর্তিত হয়ে আজকের দিনের সমাজে ও ধর্মে রূপ নিয়েছে।
কৃষিজীবী অনার্যেরা দুনিয়ার আর আর আদিম কৃষিজীবীর মতো মৈথুন তত্ত্বকেই প্রাধান্য দিয়েছিল। নারী-উদ্ভাবিত কৃষি-পদ্ধতিতে ভূমির ফসল উৎপাদন নারীর সন্তানধারণের অনুরূপ বলে কল্পিত হয়েছে। এ বিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা থেকেই জগৎ-সৃষ্টিতেও তারা প্রকৃতি ও পুরুষের–নর ও নারী স্বরূপার মৈথুনতত্ত্বে আস্থা রেখেছে। মনোবল সঞ্চয় ও বাঞ্ছসিদ্ধির সহায়ক আবহ সৃষ্টির প্রয়োজনে তারা মৈথুনকে বীজ বোনার শুভযোগ সৃষ্টির প্রারম্ভানুষ্ঠানরূপে গ্রহণ করে। পরে সমাজ ব্যবস্থার ও উৎপাদন পদ্ধতির বিবর্তন হয়েছে এবং আদিম সংস্কারও নানা তাত্ত্বিক চিন্তাযযাগে কলেবরে পুষ্ট হয়েছে। কালিক ব্যবধানে আদি উদ্দেশ্যের বিস্মৃতি ঘটেছে এবং উন্নততর মননের দ্বারা নতুন ও জটিলতর তত্ত্ব ও উদ্দেশ্য আরোপিত হয়েছে। বসুমতী বা শস্যদেবীরূপে যেই মানস প্রসূতার প্রথম আবির্ভাব, তিনি আদ্যাশক্তি। তার থেকেই পরম-পুরুষের উৎপত্তি। শক্তিস্বরূপা নারীর সঙ্গে অবিনাবদ্ধ হয়ে পুরুষ হয় শক্তিমান। শক্তি ও শক্তিমান তাত্ত্বিক কল্পনায় একসময় অদ্বয়, অভিন্ন বা অদ্বৈত সত্তারূপেও কল্পিত হয়, আবার দ্বৈতরূপেও তার প্রকাশ-সম্ভাবনা অস্বীকৃত হয়নি। ফলে মায়া-ব্রহ্ম, শিব-শিবানী, পুরুষ-প্রকৃতি, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি আদ্যশক্তিরূপে কল্পিত হয়েছে। এখানেও সৃষ্টি-সহ মৈথুনতত্ত্ব স্বীকৃত। মৈথুন মাধ্যমে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা এই নারী-পুরুষ তত্ত্ব-ভাবনায় তথা মিলন-তত্ত্ব কল্পনায় প্রচুর প্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু কালে মৈথুনতত্ত্বের আদি উদ্দেশ্যের বিস্তৃতি ঘটেছে এবং নতুন তাৎপর্য পেয়ে অধ্যাত্ম-মাধুর্যে মহৎ এবং তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতায় অসামান্য হয়ে উঠেছে। এর বিচিত্র প্রকাশ আমরা সাংখ্যে, যোগে, তন্ত্রে ও শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব গাণপত্যে-লিঙ্গায়েতে দেখছি। তবু এর আদিরূপের রেশ রয়েছে জয়পুর, পাঞ্জাব, নিলগিরি, ছোটনাগপুর, এবং উত্তর ও উত্তর-পূর্ব বাঙলার আদিবাসীদের মধ্যে। মৈথুন যেমন আদিতে ফসল উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক অঙ্গরূপে বিবেচিত হয়েছে, তেমনি আবার রতিনিরোধ সাধনায়ও প্রবর্তনা দিয়েছে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে তারও পরিচয় রয়েছে। J. Frazer বলেছেন :
Either he may infer that by yielding to his appetites he will thereby assist in the multiplication of plants and animals; or he may imagine that the vigour that he refuses to extend in reproducing his own kind, will form as it were a store of energy whereby other creatures, whether vegetable or animal, will somehow benefit in propagating their species. Thus from the same crude philosophy, the same primitive notions of nature and life, the savage may derive by different channels a rule either of profligacy or of asceticism.
কাজেই বামাচারী ও কামবর্জিত সাধনার উৎস অভিন্ন হতে বাধা নেই।
.
০২.
সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র যে অনার্য-মানস উদ্ভূত আদিম মত ও আচার-আজকাল এ- কথা আর অস্বীকৃত হয় না। বাঙলা দেশ মূলত-আর্য অধ্যুষিত দেশ নয়, এদেশে আর্য-অনুপ্রবেশ বেশি হয়নি। গুপ্ত ও সেন আমলে ব্রাহ্মণ্যধর্মের কিছুটা প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখা দেয়, আর পাল শাসনে বৌদ্ধধর্ম রাজধর্ম হয়। কাজেই এদেশে অবিমিশ্র আর্য প্রভাব কোনদিন পড়েনি। বেলভেলকার ও রানাডে বলেন, যোগ আদিতে অবৈদিক সাধন পদ্ধতি ছিল। এবং এর সঙ্গে আদি যাদুবিশ্বাসের সম্পর্কও তাঁরা অস্বীকার করেননি। বলেছেন, Sympathetic magic-এর ধারণাও এর মূলে রয়েছে। A.E. Gough ও বলেন–স্থানীয় অনার্য আদিবাসীদের কাছ থেকেই বৈদিক আর্যরা কালক্রমে যোগ সাধন-পদ্ধতিটা গ্রহণ করেছিল। H.H. Zimmer বলেন, সাংখ্যের তত্ত্বগুলি বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের অন্তর্গত নয়। দুইটি ধ্যান-ধারণা স্বতন্ত্র। সাংখ্য ও যোগ জৈনদের যান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। সাংখ্য ও যোগের মূল ধারণাগুলি অত্যন্ত প্রাচীন ও বেদপূর্বযুগের। পাঁচকড়ি বানার্জী বলেন, তন্ত্র অতি প্রাচীন, তন্ত্র ধর্মই বাঙলার আদিম ধর্ম এবং ইহা অবৈদিক ও অনার্য। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, কৌটিল্য তিনটি মাত্র দর্শনের উল্লেখ করেন–সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। সাংখ্যমত সকলের চেয়ে পুরান, উহা মানুষের করা এবং পূর্বদেশের মানুষের করা। উহা বৈদিক আর্যদের মতো নহে; বঙ্গ, বগধ ও চের জাতির কোনো আদি বিদ্বানের মতো। বৌদ্ধমত সাংখ্যমত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, এ কথা অশ্বঘোষ একপ্রকার বলিয়াই গিয়াছেন। বুদ্ধদেবের গুরু আড়ার কলম ও উদ্ৰক–দুজনই সাংখ্য মতাবলম্বী ছিলেন। শশিভূষণ দাশগুপ্তও তন্ত্রকে আদিম অনার্য গুপ্তশাস্ত্র বলেছেন।
এসব মতের ধারকেরা ব্রাহ্মণ্যবাদী, জৈন ও বৌদ্ধদের কাছে লোকায়তিক বলে পরিচিত ছিল; যদিও বেদাদি সব শাস্ত্রগ্রন্থেই আমরা এসব মতের প্রভাব লক্ষ্য করি। তার কারণও আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তার সঙ্গে এও স্মর্তব্য যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্যের আচার-সংস্কারের প্রতি সামাজিক রাজনৈতিক কারণেও উদাসীন বা শ্রদ্ধাহীন থাকা আর্যদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তন্ত্র সম্বন্ধে শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেন :
Tantrism is neither Buddhist nor Hindu in origin, it seems to be a religious under-current, originally independent of any obstruse metaphysical speculation flowing on from an obscure point of time in the religious history of Inida, with these practices and yogic processes, which characterise Tantrism as a whole, different philosophical, or rather theological systems got closely associated in different times …. these esoteric practices (yogic) when associated with the theological speculations of the saivas and saktas, have given rise to Saiva and Sakta Tantrism, when associated with the Buddhistic speculations have given rise to the composite religious system of Buddhist Tantrism, and again, when associated with the speculations of Bengal Vainavism the same esoteric practices have been responsible for the growth of the esoteric Vaisnavite Cult, known as the Vaisnava Sahajia movement.
তিনি আরো বলেন, বৃহত্তর ভারতে এই তান্ত্রিকতার একটি বিশেষ ভূমি ভাগ আছে। উত্তর পশ্চিম কাশ্মীর হইতে আরম্ভ করিয়া নেপাল, তিব্বত, ভূটান, কামরূপ এবং বাঙলাদেশ–হিমালয় পর্বত সংশ্লিষ্ট এই ভূভাগকেই বোধহয় বিশেষভাবে তান্ত্রিক অঞ্চল বলা চলে। হিমালয় সংশ্লিষ্ট এই বিস্তৃত অঞ্চলটিই কী তন্ত্র বর্ণিত চীন দেশ বা মহাচীন? তন্ত্রাচার চীনাচার নামে সুপ্রসিদ্ধ; বশিষ্ট চীন ও মহাচীন হইতে এই তন্ত্রাচার লাভ করিয়াছিলেন, এইরূপ প্রসিদ্ধিও সুপ্রচলিত। এই সকল কিংবদন্তিও আমাদের অনুমানের পরিপোষক বলিয়া মনে হয়। আমরা লক্ষ্য করিতে পারি, প্রাচীন তন্ত্র অনেকগুলিই কাশ্মীরে রচিত। ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানেও কিছু কিছু তন্ত্র রচিত হইলেও বঙ্গকামরূপ মুখ্যভাবে পরবর্তী তন্ত্রের রচনা স্থান–নেপাল-ভুটান-তিব্বত-অঞ্চলে এগুলির বহুল প্রচার এবং অদ্যাবধি সংরক্ষণ।…. তন্ত্রোক্ত দেহস্থ ষটচক্রের …. অধিষ্টাত্রী দেবী হইলেন ডাকিনী, রাকিনী, লাকিনী, শাকিনী এবং হাকিনী।…. এই ডাকিনী দেবী কোনো নিগূঢ় জ্ঞানসম্পন্না তিব্বতী দেবী হইবেন। … ভূটানে লাকিনী ও হাকিনী দেবীর সন্ধান পাওয়া যাইতেছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেন, তিন্ত্র, যোগ, সাংখ্য প্রভৃতির মূলে আছে কৃষিকেন্দ্রিক জাদু বিশ্বাস এবং জাদু অনুষ্ঠান। তাঁর মতে তন্ত্র শব্দটিও সন্তান উৎপাদন সম্পর্কীয়।
সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র মূলত দেহাত্মবাদী ও নাস্তিক মত। যোগে ও তন্ত্রে পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে ঈশ্বর স্বীকৃত হলেও, এসব সাধনায় ঈশ্বরোপাসনার স্থান অপ্রধান। দেহতত্ত্বই মুখ্য। এই দেহাত্মবাদী নাস্তিক মতকে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা গোড়ার দিকে অসুর-মত বলে আখ্যাত করেছেন। গীতায় বলা হয়েছে অসুর মতে অপরস্পর সম্ভুত কিমন্যং কামহৈতুকম অর্থাৎ জগৎ নারী-পুরুষের মিলনজাত এবং কামোদ্ভূত। ১৬৮। একে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা লোকায়ত বলে অবজ্ঞা করেছেন। সাধারণত মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহ, শঙ্করাচার্যের (?) সর্বসিদ্ধান্ত সংগ্রহ, হরিভদ্রসূরীর ষড়দর্শন সমুচ্চয়, কৃষ্ণ মিত্রের প্রবোধচন্দ্রিকা নাটক, ভাগবত, বৃহদারণ্যক, গীতা, বিষ্ণু পুরাণ, মনুসংহিতা, এবং বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদির আলোকে লোকায়ত তত্ত্ব নিরূপণের চেষ্টা হয়। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের এসব গ্রন্থ থেকে মতবাদটির স্বরূপ প্রকাশিত হয় না। আসলে আদিম তান্ত্রিক, যোগী এবং সাংখ্য মতবাদীরাই লোকায়তিক। তাই শীলাঙ্ক রচিত সূত্র-কৃতাঙ্গ সূত্রের ভাষ্যে সাংখ্য ও লোকায়তিকে বিশেষ পার্থক্য স্বীকৃত হয়নি। তিন মতই মূলে এক এবং এমনকি গীতার আমলেও যোগ ও সাংখ্য অভিন্ন ছিল। সাংখ্য হচ্ছে তত্ত্ব আর যোগ হচ্ছে সাধনশাস্ত্র। সাংখ্য এবং তন্ত্রের সম্পর্কও তাই। পরবর্তীকালে যোগ ও তন্ত্র দুটো ভিন্ন ধারায় যেমন চলেছে, তেমনি আবার যোগতান্ত্রিক মিশ্ৰধারাও সৃষ্টি করেছে। এতে শৈব-শাক্ত-বৌদ্ধ-জৈন তান্ত্রিক সম্প্রদায় যেমন পেয়েছি, তেমনি কামাচার বর্জিত বিশুদ্ধ যোগী সম্প্রদায়েরও উদ্ভব দেখি। এসব মত কালে বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদের শাখা ও উপমত রূপে গৃহীত হয়েছে। এবং জৈন ও বৌদ্ধ মতের অন্তর্গত হয়েও এগুলো মর্যাদা পেয়েছে। তারই জের রয়েছে বৈষ্ণব সহজিয়া, সহজিয়া, নাথ প্রভৃতি বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য-ঘেঁষা সম্প্রদায়ে আর অবলুপ্ত রেশ রয়েছে সাওতাল, হো, পাঞ্চা, কোটার প্রভৃতির সমাজে।
.
০৩.
আদিতে হিন্দু সিন্ধুবাসী অর্থে প্রযুক্ত হলেও কালে গোটা উপমহাদেশ হিন্দুস্তান এবং জাতি ও ধর্মসম্প্রদায় হিসেবে দেশের সব অধিবাসী হিন্দু নামে পরিচিত হতে থাকে। এভাবে আর্য-অনার্য বহু উপধর্মে ও মতে আস্থাবান এক বিপুল মনুষ্য-সমাজ হিন্দু–এই সাধারণ নামে অভিহত হয়। অতএব হিন্দু বললে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মমতবাদীকে বুঝায় না। তারা জাতি অর্থে অভিন্ন হলেও ধর্মসম্প্রদায় হিসেবে বহুধা বিভক্ত। অন্যান্য দেশে কোনো ধর্মমতে দীক্ষিত জনসমষ্টি ধর্মের বা ধর্মপ্রবর্তকের নামে পরিচিত হয়; যেমন মুসলিম, খ্রীস্টান, কনফুসিয়ান, জোরাস্টীয়ান প্রভৃতি। বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম কোনো একজনের প্রবর্তিত ধর্ম নয় বলেই হিন্দু নামের এমন ব্যাপক ও দ্ব্যর্থক ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করেই এই ধর্মের উন্মেষ, বিকাশ ও বিচিত্র রূপান্তর ঘটেছে। তাই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও তার প্রশাখাগুলোকে অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক বিকাশও বলা চলে। আধুনিক সমাজতত্ত্বে এই বিবর্তনের গুরুত্ব অনেকখানি। তাই W.W. Hunter বলেছেন :
India thus forms a great Museum of races, in which we can study man from his lowest to his highest stages of culture. The Specimens are not fossils or dry bones, but living communities. :
এখানে সত্যই Fragments of a Pre-historic world কিংবা remnants to our own day of the stone age calcule
হিন্দুর উপমতগুলোর বাহ্যত এক-একজন প্রবর্তক থাকলেও আসলে বিভিন্ন মতের মিশ্রণে গড়ে-উঠা প্রবল আঞ্চলিক মতবাদের তারা প্রচারক মাত্র। কেননা, এগুলো মূলত ইষ্টদেবতার প্রাধান্য এবং লক্ষ্যের বৈশিষ্ট্যজাত উপমতই। এগুলাকে বলা যায়–বৈদিক মতের প্রশাখা। এখানে উল্লেখ যে ঋগ্বেদেও কোনো একক মত প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নেই। বিস্তৃত কালিক পরিসরে বিভিন্ন কবি রচিত সূক্তসমষ্টিই ঋগ্বেদ বা ঋক্-সংহিতা। এ জন্যে কোনো কোনো মতাদর্শের প্রাধান্য থাকলেও ঋগ্বেদে পরবর্তী প্রায় সব মতেরই কিছু কিছু সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন তারাপদ চৌধুরী বলেন :
যে সকল ভক্তিমার্গে পরব্রহ্মেরই প্রকাশরূপে কোনো ইষ্ট দেবতার কল্পনা করা হইয়াছে। এবং ভক্তির কোমলতা এবং ভক্তের কঠোর নৈতিক আচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে, তাহাদের সূচনা বেদে দেখিতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন রীতির তপশ্চর্যা, এমনকি তান্ত্রিক আচারগুলির পূর্বাভাস বেদে বর্তমান। বেদান্তের অদ্বৈতবাদ এবং মায়া সম্বন্ধে ও জ্ঞানের মাধ্যমে মোক্ষ লাভ সম্বন্ধে ইঙ্গিত, মীমাংসা মতানুযায়ী যজ্ঞের সর্বশক্তিমত্তা, সাংখ্য দর্শন সম্মত ত্রিগুণ এবং প্রকৃতির অন্ধ প্রবণতা, যোগদর্শন সম্মত ইন্দ্রিয় সংযম এবং চিত্তের অভিনিবেশ এবং ন্যায়-বৈশেষিক মতানুসারে ব্রহ্মপ্রাপ্তির জন্য যথার্থ বৌদ্ধিক দৃষ্টি ও যথার্থ বাক্যের প্রয়োজনীয়তা–এই সকলেরই পূর্বাভাস বেদে দেখিতে পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত আত্মা, মন, পরব্রহ্ম, বিশ্বের অভিব্যক্তি, কর্ম, পুনর্জন্ম এবং মোক্ষ প্রভৃতি সম্বন্ধে সাধারণ সমস্যাগুলির আলোচনাও আছে। পরবর্তীকালে বেদগুলিকে যে যাবতীয় ধর্ম ও দর্শনের প্রধান উৎস বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছিল, তাহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছু নাই।
তেমনি পরবর্তীকালের মহাভারতে তথা গীতায়ও নানা মতের অসমন্বিত মিশ্রণ ঘটেছে। অতএব সব কয়টি মত ও উপমতের উদ্ভবের ইতিহাস অত্যন্ত জটিল এবং দুর্নিরীক্ষ্য ও দুর্নির্ণেয়। দেশী-বিদেশীর, শাসক-শাসিতের এবং আর্য-অনার্যের নানা ধারণা, সংস্কার, আচার, আদর্শ ও লক্ষ্যের বিচিত্র মিশ্রণে ও সমাবেশে–কখনো সমন্বয়ে, কখনো বা অজ্ঞতাপ্রসূত বিকৃত-প্রভাবে সব শাখা ও উপশাখাগুলো গড়ে উঠেছে। তাই নিশ্চিত বিশ্বাসে কিংবা যুক্তি ও তথ্য প্রয়োগে কোনো নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। শেষ অবধি বিদ্বানে বিদ্বানে মতানৈক্য থেকেই যায়। অবশ্য যতই আলোচনা হচ্ছে, জটিলতাও ততই হ্রাস পেয়ে গবেষণার পথ খুলে দিচ্ছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় বোঝা যাচ্ছে বৈদিক বিধি-বিধান এবং ভাবকল্প একান্তভাবে আর্য নয়। পশুজীবী আর্যেরা মূলত প্রাকৃত শক্তির পূজারী এবং কর্ম ও কর্মফলে আস্থাবান। কিন্তু কৃষিজীবী অনার্য গোষ্ঠীরা তাদের জীবিকার গরজেই ভাববাদী ও প্রতীকপ্রিয় না হয়ে পারেনি।
অনুমান করি, উর্বরা ভারতভূমির অনিঃশেষ চারণক্ষেত্র আর্যদের স্থায়ী বসবাসে প্রলুব্ধ করে, আর অনায়াসলভ্য ফলমূল তাদেরকে জীবিকার ভাবনা-মুক্তির আশ্বাস দিয়ে কৃষিকার্যে প্রবর্তনা দেয়। এভাবে এ নতুন দেশে নতুন জীবিকার মাধ্যমে আর্যরা কৃষি সম্পর্কিত আচার-সংস্কারেও গোড়া থেকেই প্রভাবিত হতে থাকে। এই প্রভাবেরই স্বাক্ষর রয়েছে হয়তো বেদের বিভিন্ন মণ্ডলের নারী, অদ্বৈততত্ত্ব, ভক্তিতত্ত্ব ও ভাব প্রতীকী কল্পনার মধ্যে–যা সাধারণভাবে আর্য মননের লক্ষণ বলে ব্যাখ্যা করা চলে না। বেদে-ব্রাহ্মণে-উপনিষদে যা আছে সবই আর্যমানসজাত, এ ধারণা তাই যৌক্তিক আলোচনা ও সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। সি. কুহ্বান রাজা বলেছেন–সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা এবং দ্রাবিড়ভ্যতার প্রভাবেই–১. সর্বসাধারণের জীবনে অরণ্যের প্রভাব, ২. মন্দিরে উপাসনা ও তার সঙ্গে অধিকতর মূর্ত আকারে দেবতার অনুধ্যান, ৩. বিশ্বজগতের পরিকল্পনা ধারার মধ্যে পশু, পক্ষী, বৃক্ষ প্রভৃতির উচ্চস্থান লাভ, ৪. ঐশী-শক্তির স্ত্রীরূপকে উচ্চতর মর্যাদা দান, ৫. ঈশ্বরের স্রষ্টত্ব এবং ৬. জাতীয় মহাপুরুষ হিসাবে দেবতাদের আবির্ভাব এবং মানুষের দেবত্বে উন্নয়ন। তার মতে সাংখ্য মত অবৈদিক। ভক্তির বিকাশও অবৈদিক প্রভাবজ। বেদান্ত ও ভক্তিবাদের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনজ্জীবনও ঘটে প্রধানত দাক্ষিণাত্যের দ্রাবিড় দিয়ে। কুমারিল ভট্ট অন্ধদেশের লোক, শঙ্করাচার্যের জন্মস্থান কেরলা, রামানুজ তামিল দেশে আর মাধবাচার্য কর্ণাট দেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং বিষ্ণু আর শিবের শক্তিমহিমা ও ক্রিয়ার ধারণাও অবৈদিক। তাই আগম। শাস্ত্রও অবৈদিক।–
তারাপদ চৌধুরীও বলেন, বৈদিক ধর্মবিশ্বাসের পাশাপাশি মন্ত্রতন্ত্র, বশীকরণ এবং ইন্দ্রজালের ক্ষমতা সম্বন্ধে সাধারণের যে ব্যাপক বিশ্বাস ছিল, তাহাও এই প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন। বৈদিক সাহিত্যে সর্বত্রই এ বিষয়গুলির ইতস্তত উল্লেখ আছে বটে, তথাপি বিশেষভাবে এইগুলি অথর্ববেদ এবং তাহার অনুষ্ঠানাঙ্গ কৌশিক-সূত্র উহাদের বিষয়। সেইজন্যই এই গ্রন্থ দুইটিতে পরবর্তী তন্ত্রশাস্ত্রের সূচনা রহিয়াছে। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন :
It is now becoming more and more clear that the Non-Aryan contributed by far the greater portion in the fabric of Indian civilization, and a great deal of Indian religious and cultural traditions, of ancient legend and history, is just non-Aryan translated in terms of the Aryan speech ….. the ideas of Karma and transmigration, the practice of Yoga the religious and philosophical ideas centring round the conception of the divinity as Siva and Devi and as Vishnu, the Hindu ritual of Puja as opposed to the Vedic ritual of Homa–all these and much more in Hindu religion and thought would appear to be non-Aryan in origin, a great deal of Puranic and epic myth, legend and semi-history is Pre-Aryan, much of our material culture and social and other usages, eg. the cultivation of some of our most important plants like rice and some vegetables and fruits like tamarind and the coconut etc., the use of betel leaf in Hindu life and Hindu ritual, most of our popular religion, most of our folk crafts, our nautical crafts, our distinctive Hindu dress (The dhoti and sari), our marriage ritual in some parts of India with the use of Vermilion and turmeric and many other things would appear to be legacy from our Pre-Aryan ancestors.
এবার আমরা গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রগ্রন্থ ও দর্শনগুলো অবলম্বন করে ক্রমবিবর্তনের ধারা অনুসরণ করব।
উপনিষদ
উপনিষদগুলোতে সমাজ-স্বীকৃত বৈদিক মূলতত্ত্ব, দেবতা, যজ্ঞ ও অন্যান্য আচার-বিরোধিতা লক্ষণীয়। এ ব্যাপারে বৃহদারণ্যক ও ছান্দোগ্য-প্রাচীন বলে স্বীকৃত এ দুটো উপনিষদের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
বৃহদারণ্যকে আছে –যে ব্যক্তি আত্মা ব্যতীত অন্য কোনো দেবতার আরাধনা করে, সে দেবগণের গৃহপালিত পশুবিশেষ।
পরবর্তীকালে শঙ্করও যজ্ঞাদি আচার ও দেবপূজায় অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। বস্তুত আরণ্যক রচনাকাল থেকেই ক্রিয়াকাণ্ডে বিশ্বাসী আর্যেরা ভাববাদী হয়ে উঠল। তার ফলেই উপনিষদে যজ্ঞ ও দেবতাদির প্রতি বিরূপতা দেখা দেয়। এমনকি পরবর্তী উপনিষদ শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতিতে যজ্ঞের মহিমা পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থাকলেও তাতে যজ্ঞের উদ্দিষ্ট ঈশ্বর দেবতা নন। এভাবে উপনিষদে একক ব্ৰহ্মবাদ বা ঈশ্বরতত্ত্ব প্রাধান্য পেতে থাকে। তাই কঠোপরিষদ বলেন, পরব্রহ্মের ভয়েই দেবতারা তাঁহাদের নির্দিষ্ট কার্যক্রম পালন করে থাকে। বৃহদারণ্যকে এবং ছান্দোগ্যেও ১৯ তাই চরম কথা ঘোষিত হয়েছে–আত্মাই ব্রহ্ম।
মহাভারত
মহাভারতে বিষ্ণু ও বিষ্ণু অবতারের কথাই আছে। অন্য দেবতার অবতারের কথা নেই।২০ কাজেই বিষ্ণুই প্রাধান্য পেয়েছেন এ কাব্যে। অবশ্য বৈদিক দেব মণ্ডলে মহাভারতোক্ত দেব-দেবীরই, ঠাঁই হল। এতে দেবতারা একই ঈশ্বর হইতে উদ্ভূত বিভিন্ন রূপ বা প্রকাশ এই মত গৃহী। হইল। সাংখ্য, যোগ, পাশুপত ও পঞ্চরাত্র যথাক্রমে কপিল, হিরণ্যগর্ভ শিব ও নারায়ণ কর্তৃক প্রকাশিত হইয়াছিল বলিয়া কথিত হইয়াছে। যোগ ও সাংখ্য মহাভারতে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া আছে। তাত্ত্বিক শিক্ষার দিক দিয়া এই মহাকাব্যে বিভিন্ন মতবাদ সকলের এক অসঙ্গতিপূর্ণ সংমিশ্রণ দেখিতে পাওয়া যায়।….. মহাকাব্যে বর্ণিত তত্ত্ব-বিদ্যায় বিভিন্ন ভাবধারার পারস্পরিক প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়।….. এই সকলই প্রাথমিক সাংখ্যের স্বভাববাদী দ্বৈতমত ও প্রাথমিক যোগদর্শনের সাধারণ অঙ্গস্বরূপ ঈশ্বরবাদের দ্বারা প্রভাবিত। …. অপরদিকে আমরা পাশুপত, বৈষ্ণব, নারায়ণ ও প্রধান প্রধান ভাগবত সম্প্রদায় সকলের একেশ্বরবাদী ভক্তিবাদ দেখিতে পাই। এইগুলি বিভিন্ন উৎস হইতে তাহাদের ভাবধারা সকল সংগ্রহ করিয়াছিল।২২ মহাভারতের ধর্মীয় চিন্তাধারা ঈশ্বরনিষ্ঠ ও স্পষ্টত দ্বৈতবাদী।২৩ সাধারণ আর্যদের নিজস্ব বিশ্বাস ও আচার ব্যবহার অবশ্যই ছিল। কিন্তু এইগুলি উপত্যকার অনার্য সাংস্কৃতিক ভাবধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হইয়াছিল (রুদ্র শিবের ধারণাতেই ইহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।) ….. ইহা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির যে-সংমিশ্রণ সম্ভবত বৈদিক যুগেই আরম্ভ হইয়াছিল তাহা বেদোত্তর যুগেও ধর্ম ও দর্শনের ক্রমবিকাশের সহায়তা করিয়াছিল। (এবং এইরূপে) বেদবিরোধী লোক প্রচলিত ধর্মসম্মত দেব-দেবী ও আচার নূতন ব্যাখ্যা দিয়া বৈদিক ধর্মের মধ্যেই সন্নিবিষ্ট করা হইল।…. (এইভাবে) রুদ্রশিব, বিষ্ণু-নারায়ণ অথবা কৃষ্ণ-বাসুদেবের উপাসনাকে কেন্দ্র করিয়া যে সকল লোকপ্রচলিত মত গড়িয়া উঠিয়াছিল, সেইগুলির আবেগ-প্রধান ভক্তিবাদের দিকে বিশেষ প্রবণতা ছিল, ইহাতে প্রাচীন ক্রিয়াকাণ্ড ও ব্রহ্মমূলক ধর্মগত নিশ্চয়ই অনেকটা শিথিল হইয়া আসিতেছিল।
পুরাণ
Pargitar বলেন, সমষ্টিগতভাবে বিচার করিলে এইগুলি (পুরাণগুলি) প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় হিন্দুধর্মের ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস, ব্যক্তি, সমাজ ও রাজনীতির একটি সর্বসাধারণের উপযোগী বিশ্বকোষ। পুরাণে অদ্বৈত, দ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত, ও বিশিষ্টাদ্বৈত এমনকি সাংখ্য, যোগ, ন্যায় প্রভৃতি বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদেরও সমন্বয় সাধন করিবার চেষ্টা আছে।২৬ পুরাণগুলোর মধ্যে বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবত পুরাণই শ্রেষ্ঠ। সর্বপুরাণেরই সারকথা ও তাৎপর্য বিশেষ করে বিষ্ণুপুরাণে মেলে।২৭ ভাগবতের দর্শনে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, ইহাতে পুরাণসমূহের ঐশ্বরিক লীলাবাদের সহিত বেদান্ত দর্শনের মায়াবাদ, সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ, শৈব সম্প্রদায়ের শক্তিবাদ এবং মীমাংসা ও অন্যন্য সম্প্রদায়ের কর্মবাদের সমন্বয় সাধনের জন্য একটি সাতিশয় কলাকুশল প্রযত্ন করা হইয়াছে।
চার্বাক দর্শন
বৃহস্পতি লৌক্য বা ঋগ্বেদের ব্রাহ্মণস্পতি সর্বপ্রথম বস্তুকে চরম সত্য বলে ঘোষণা করেন। চার্বাকরা ছিলেন বৃহস্পতির মতানুসারী, এ কারণে তাদেরকে বাৰ্হস্পত্য বা লোকায়তিক বলা হয়। এরা বস্তুবাদী-অধ্যাত্মবাদী নন। বেদের আমল থেকে এঁদের ধারা অব্যাহত রয়েছে। তার আগেও যে লোকমনে এর জড় ছিল, তা অনুমান করা যায় বেদে এইমতের উল্লেখ থেকে। রামায়ণের আবালিমুনি, হরিবংশের রাজা বেন, গৌতম বুদ্ধের সমকালীন অজিত কেশকম্বলী, তাঁর শিষ্য পায়াসি, আর ভাগুরি, পুরন্দর প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে নাস্তিক্যবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন। এ ধারার চিন্তার প্রসূন হচ্ছে ইন্দ্রিয়াত্মবাদ, প্রাণাত্মবাদ ও মনশ্চৈতন্যবাদ। দেহের বিনাশে চৈতন্য লুপ্ত হয় এবং দেহের উপাদানগুলো নিজ নিজ ভূতে মিশে যায়; কাজেই কর্মফল ভোগ, আত্মার জন্মান্তর গ্রহণ ইত্যাদি অর্থহীন। জড় পদার্থ থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি–এই মত বৃহদারণ্যক উপনিষদেও মেলে এবং দেহাত্মবাদের অনুকূলে ইঙ্গিত পাওয়া যায় ছান্দোগ্য উপনিষদের ইন্দ্রবিরোচন উপাখ্যানে।
জৈন–বৌদ্ধমত
সর্বজীবের প্রাণের মূল্যবোধ ও জীব নির্বিশেষের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই অহিংসার জন্ম। এটি মানব-সংস্কৃতির ও সংবেদনশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশের পরিচায়ক, মনুষ্যত্বের এমনি বিকাশ কালের দিক দিয়ে বিস্ময়কর। আদি তীর্থঙ্কর পার্শ্ব ঐতিহাসিক ব্যক্তি। মহাবীরের আড়াইশ বছর আগে তিনি জীবিত ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের আগেও বহু বোধিসত্ত্ব আবির্ভূত হয়েছেন বলে বুদ্ধ দাবী করেছেন। কাজেই অহিংস মত আর্য আগমনের পূর্বেকার বলে মনে হয়। বর্ধমান মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব কাল এক আধ্যাত্মিক অস্থিরতার যুগ। (তখন) প্রাচীন ধর্মের বন্ধন হইতে সমাজ দ্রুত সরিয়া যাইতেছিল। হয়তো অনার্য যৌগিক ধ্যান, কৃঞ্জু সাধনা, জন্মান্তরবাদ, শিবপূজা প্রভৃতি অনার্য আচার-সংস্কার প্রবল হয়ে উঠেছিল। তাই বৌদ্ধমতে দেব, দ্বিজ ও বেদের প্রতি বিদ্বেষ বা অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে। অবশ্য চার্বাকরা আগে থেকেই এসবের প্রতি অবিশ্বাস ও বিরূপতা প্রচার করে চলেছিলেন। ব্রহ্মজাল সুত্ত মতে বৈদিক কর্মকাণ্ড বিরোধী সম্প্রদায় ছিল বহু এবং বিবিধ। এ সময়ে বিভিন্ন পন্থী তীর্থকগণ (নাস্তিক-আচার্য)–যথা, পুরাণ, কস্সপ, মকখলি, গোসাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ-কচ্চায়ন, নিগন্থনাট পুত্ত, সঞ্জয়-বেলটুঠপুত্ত এবং আরো অনেক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী ব্রাহ্মণ্য মতবাদ বিরোধী প্রচারণা চালাতেন। বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদীরাই পরবর্তীকালে সাধনপন্থ হিসেবে যোগাচার গ্রহণ করে।
সাংখ্য ও যোগ
বেদ ও কঠ, শ্বেতাশ্বতর ও মৈত্রায়নী উপনিষদে সাংখ্যসম্মত ধারণা লক্ষ্য করা যায়; কাজেই সাংখ্য মত নিশ্চয়ই প্রাচীনতর। ঈশ্বরকৃষ্ণের সাংখ্যকারিকা খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতকের পূর্ববর্তী নয়। তবু সাংখ্য মত যে ভারতের প্রাচীনতম লোকায়ত দর্শন, তা নানা কারণে অস্বীকার করার উপায় নেই। আড়ার কলমের নিকট গৌতম বুদ্ধের সাংখ্য দর্শন শিক্ষা, ন্যায়সূত্রে এবং ব্রহ্মসূত্রে সাংখ্য দর্শনের মৌলিক মতগুলির সমালোচনা প্রভৃতি থেকেও এর প্রাচীনতা অনুমান করা সম্ভব। গীতায় সাংখ্য ও যোগকে অভিন্ন বলা হয়েছে। …. যোগ হচ্ছে সাংখ্যের ব্যবহারিক প্রয়োগ। যোগ ও সাংখ্যের দার্শনিক ভিত্তি একই। পতঞ্জলি তার যোগসূত্রে ঈশ্বর-রূপ যে অপর একটি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন তার জন্যই এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য।৩৫
আমরা ভারতিক অভিজাতশ্রেণীর ধর্মশাস্ত্র ও দর্শনের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তন ধারার কিছুটা পরিচয় পেলাম। এতে আমরা দেখেছি দেশীয় গণমানসপ্রসূত নানা মত উঁচুস্তরের মানুষের ধর্মে ও দর্শনে বার বার হানা দিয়ে নিজেদের ঠাই করে নিয়েছে। এবার সে গণমানস উদ্ভূত ধর্মসংস্কার ও দেবতার পরিচয় নেওয়া যাক।
ভয় থেকেই বিশ্বাসের উৎপত্তি। ভয় কিসের? ভয় অপ্রাপ্তির, ক্ষতির এবং অ-সুখের। আত্মরক্ষা, আত্মপ্রসার ও আত্মস্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে যা আবশ্যক তা পাওয়ার আকাক্ষার নাম বাঞ্ছা। বাঞ্ছামাত্রই চেষ্টা সত্ত্বেও সিদ্ধ হয় না। নিজের অসামর্থ্য আছে, আছে আরো অজানা অকারণ বাধা। এই বাধাস্বরূপ অজ্ঞাত শক্তিই অমূর্ত অরি-শক্তি, আর সিদ্ধির সহায়ক শক্তি হচ্ছে ইষ্ট-শক্তি। এই অরি-শক্তির দমন ও ইষ্ট-শক্তির আবাহন প্রয়াসই জাদু-বিশ্বাসে প্রবর্তনা দিয়েছে। বাঞ্ছ-সিদ্ধির আত্যন্তিক কামনা থেকেই জাদু-বিশ্বাস উৎসারিত। আদি অমূর্ত জাদু বিশ্বাস পরে পরে প্রমূর্ত ইষ্ট ও অরি দেবতার রূপ নিয়েছে।
এদেশের এক দেবতা গণপতি গণেশ। ইনি ছিলেন আদিতে অরি দেবতা-বিঘ্নরাজ। ইনি অনার্য দেবতা।৩৭ ভিলেরা চাষাবাদের প্রারম্ভে শিলাখণ্ডে সিন্দুর মেখে গণেশরূপে পূজা করে। ঋগ্বেদেও গণপতির উল্লেখ রয়েছে। ঋগ্বেদে গণপতি ও বৃহস্পতি অভিন্ন। লোকায়ত মতের প্রবর্তক বলে পরিচিত বৃহস্পতি ও বৈদিক বৃহস্পতি অবশ্য অভিন্ন কী না, বলা যাবে না। ভারতের বিভিন্ন স্থানে নগ্ননারীর সঙ্গে মৈথুনরত গণেশ মূর্তি পাওয়া গেছে। আনন্দগিরির শঙ্কর বিজয় এর সতেরো সংখ্যক প্রকরণে আছে যে গাণপত্য মতে গণেশ বামাচারের সঙ্গে সংযুক্ত। এতেই বোঝা যায়, আদি মৈথুনতত্ত্ব থেকেই গণপতি গণেশ দেবতার পৌরাণিক রূপান্তর ঘটেছে।
.
০৪.
॥ তন্ত্র ॥
ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্যের ধর্ম বা সংস্কার হিসেবে তন্ত্রের ব্যাপকতা দেখেই এক বিদ্বান বলেছেন:
In the popular knowledge and belief they have practically superseded the Vedas over a large part of India. In all writings (Tantric writings) these female principle is personified and made prominent to the almost total exclusion of the male.
তান্ত্রিক সাধনায় নারীর গুরুত্ব যে অত্যধিক তার সাক্ষ্য আচারভেদ তন্ত্রেও আছে :
পঞ্চতত্ত্বং খপুষ্পঞ্চ পূজয়েৎ কুলঘোষিতম্।
বামাচারো ভবত্ত এবামাভূত্বা যজেৎ পরাম ॥
শাক্তদের সাধনাও এরূপ। R. G. Bhandarkar বলেন :
The ambition of every pious follower of the system (sakta) is to become identical with Tripura-Sundari, and one of his religious exercises is to habituate himself to think that he is a woman.
সহজিয়াদের সাধনতত্ত্বও এরূপ। মনীন্দ্রমোহন বসু বলেন :
The sahajias also believe that at a certain stage of spiritual culture the man should transform himself into a woman and remember that he cannot have the experience of true love so long as he cannot realise the nature of woman in him.
এখানে বৈষ্ণবের রাধাভাব ও গোপীভাব স্মর্তব্য।
তন্ত্রমতে পুরুষ ও প্রকৃতির আদি মৈথুন থেকেই বিশ্বের উৎপত্তি।৪ সাংখ্যেও তাই। বাচ্যবস্তুটিকে স্ত্রীরূপেই সাংখ্য কল্পনা করিয়াছে। প্রকৃতি পুরুষকে মোহিত করে, যেমন নারী পুরুষকে বশ করে, প্রকৃতির ক্রিয়া ও নারীর লাস্য ও হাস্য এবং ভাবও ভাবের অনুরূপ কল্পিত হইয়াছে। চীনেও বিশ্বসৃষ্টি সম্বন্ধে এই ধারণাই ছিল। সৃষ্টি হচ্ছে Yang (পুরুষ) ও Yin (নারী) 49 cita avangal 2007 1 He (man) is described as a Microcasm-a world in miniature এ সব দেখে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করতে হয় যে ভারতের অনার্য সমাজে মিথুনতত্ত্ব, জাদু বিশ্বাস এবং মাতৃ বা ক্ষেত্র প্রাধান্য ছিল। ময়েনজোদাড়োর আবিক্রিয়া এবং দ্রাবিড় সমাজের নারীদেবতা প্রভৃতি এ বিশ্বাসের অনুকূল। দেবীপ্রসাদ বলেন, আমাদের যুক্তি অনুসারে, তন্ত্রের মতোই ওই সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়গুলিও আদিম কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস থেকেই জন্মলাভ করেছে। পাঁচকড়ি বানার্জি বলেন–তন্ত্রের যে-কোনো পুথি পাঠ কর না কেন, তাহা পাঠ করিলে বুঝা যাইবে যে, অতি পুরাতন একটা শক্তি ধর্মের বুনিয়াদের উপর বৌদ্ধ মনীষা একটা নতুন ধর্মের প্রসাদ গড়িয়া তুলিয়াছেন। পরে নব্যহিন্দুর ব্রাহ্মণ-প্রতিভা বৌদ্ধের সেই মনীষা-প্রাসাদের উপর ব্রাহ্মণ্যের লেখা গাঢ় করিয়া লিখিয়া রাখিয়াছেন। তন্ত্রতত্ত্ব সম্বন্ধে পাঁচকড়ি বানার্জি বলেন, যাহা আছে ভাণ্ডে, তাহাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে–ব্রহ্মাণ্ডে যে গুণা : সন্তি তে তিষ্ঠন্তি কলেবরে। ইহাই সকল তন্ত্রের সিদ্ধান্ত। ….. তন্ত্র বলিতেছেন যে যখন ব্রহ্মাণ্ড ও দেহভাণ্ড একই পদ্ধতি অনুসারে, একই রকমের উপাদান সাহায্যে নির্মিত, উভয়ের মধ্যে একই পদ্ধতির খেলা হইতেছে, তখন দেহগত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে ব্রহ্মাণ্ডের শক্তি তোমার অনুকূল হইবে। …. এদেশের সিদ্ধগণ বলেন যে মনুষ্যদেহের মতো পুর্ণাবয়ব যন্ত্র আর নাই। …. অতএব এই যন্ত্রস্থ সকল গুপ্ত এবং সুপ্ত শক্তির উন্মেষ ঘটাইতে পারিলে অন্য কোনো স্বতন্ত্র যন্ত্র ব্যতিরেকে তোমার বাসনা পূর্ণ হইতে পারে। এই উক্তির সমর্থন পাই ছান্দোগ্যে, বিরোচন বলেছেন, এই পৃথিবীতে দেহেরই পূজা করিবে, দেহেরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক ও পরলোক–এই উভয়লোকই লাভ করা যায়।
শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, বাঙলাদেশে এবং তৎসলগ্ন পূর্ব-ভারতীয় অঞ্চলসমূহে এই তন্ত্রপ্রভাব খ্রীস্টীয় অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত মহাযান বৌদ্ধধর্মের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া মহাযান বৌদ্ধধর্মকে বজ্রযান, সহজযান প্রভৃতি তান্ত্রিক ধর্মে রূপান্তরিত করিয়া দিয়াছিল। ….. বাঙলাদেশে যত হিন্দুতন্ত্র প্রচলিত আছে, তাহা মোটামুটিভাবে খ্রীস্টীয় দ্বাদশ শতক হইতে খ্রীস্টীয় পঞ্চদশ শতকের মধ্যে রচিত। …. ভারতবর্ষের তন্ত্রসাধন মূলত: একটি সাধনা।…. এই তন্ত্রসাধনার একটি বিশেষ ধারা বৌদ্ধ দোহা কোষ এবং চর্যাগীতিগুলির ভিতর দিয়া যে সহজিয়ারূপ ধারণ করিয়াছে, তাহারই ঐতিহাসিক ক্রমপরিণতি বাংলাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়া সাধনায় এবং বিশেষ বিশেষ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে। এবং সপ্তদশ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ইহা এখানে একটা নবরূপ লাভ করিয়াছে এবং এই নবরূপেই বাঙলার সমাজ-সংস্কৃতিকে তাহা গভীর প্রভাবান্বিত করিয়াছে। এজন্যেই পাঁচকড়ি বানার্জি বলেছেন, সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরী ভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া-সাধনা সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।
এই দেহতেই কৈলাস, এই দেহতেই হিমালয়, এই দেহতেই বৃন্দাবন, এই দেহতেই গোবর্ধন, এই দেহাভ্যন্তরেই হরগৌরী বা কৃষ্ণরাধিকা নানা লীলানাট্য প্রকাশ করিতেছেন। তাই তান্ত্রিক, যোগী, সহজিয়া বাউল সবাই দেহচর্যাকেই মূত্রত করেছে। আবার তান্ত্রিক ও সহজিয়ারা রতিপ্রয়োগে এবং নাথযোগীরা রতিনিরোধে এ সাধনা করে। যৌগিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এ সাধনা চলে, যোগ তাই বামাচারী ও বামাবর্জিত–এই দুই প্রকার। কামনিরোধ যোগাচার সম্বন্ধে শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন:
The most important of the secret practices, is the yogic control of the sex-pleasure so as to transform it into transcendental bliss, which is at the same time conducive to health both of the body and the mind.
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, যোগাচারমতে যেমন কিছুই থাকে না, বিজ্ঞানমাত্র থাকে; সহজমতে তেমনি কিছুই থাকে না, আনন্দ মাত্র থাকে। এই আনন্দকে তাঁহারা সুখ বলেন, কখনো বা মহাসুখ বলেন, সে-সুখ স্ত্রীপুরুষ সংযোগজনিত সুখ। তন্ত্রের মতো এখানে নারীশক্তিই মুখ্য। তাই শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেন :
Another thing that deserves special attention in connection with the yogic practce of the sahajia Buddhists is the conception of the female force. In the charya songs we find frequent reference to this female force variously called as the chandi, Dombi, Savari, Yogini, Nairamani, Sahaja-Sundari etc. and we find frequent mention of the union of the yogin with this personified female deity … This conception of Sakti of the Buddhist-Sahajias is an adoption of the general Tantric conception of the sakti.
আদি মৈথুনতত্ত্ব থেকে এসব বিভিন্ন মতবাদের উদ্ভবের ধারাবাহিক ইতিহাস দেওয়া সম্ভব নয়। তবু পরোক্ষ ও বিচ্ছিন্ন প্রমাণে এটুকু বোঝা যায়, আদি কৃষিজীবীরা মৈথুনতত্ত্বের বিকাশ লোকায়তে এবং তার পরিণতি শিব-শিবানী, মায়া-ব্রহ্ম, রাধা-কৃষ্ণ, প্রজ্ঞা-উপায় প্রভৃতি রস-রতি তত্ত্বে বা বিজ্ঞানবাদে।
মহাভারতের উদ্দালক ও তৎপুত্র শ্বেতকেতুর উপাখ্যান (আদিপর্ব, ১২২ অধ্যায়) থেকে জানা যায় তখনও গাভীগণের মতো স্ত্রীগণ শতসহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তারা অধর্মলিপ্ত হয় না। বরং এরূপ আসক্ত হওয়াই নিত্যধর্ম। কাজেই তখনও নারীর একনিষ্ঠতাজাত সতীত্ব ধারণা গড়ে উঠেনি।
বাৰ্হস্পত্য সূত্ৰমে আছে : সর্বথা লোকয়তিকমেব শাস্ত্রমর্থসাধনকালে কাঁপালিকমের কামসাধনে।
গুণরত্ন বলেছেন–কাঁপালিক ও লোকায়তিকের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। লোকায়তিকেরা গায়ে ভস্ম মাখে, মদ খায়, মাংস খায় এবং তারা মৈথুনাসক্ত ও যোগী। এবং বছরের এক নির্দিষ্ট দিনে তারা সবাই একস্থানে মিলিত হয়ে মৈথুনে রত হয়। মাধ্বাচার্য বলেছেন, লোকায়তিকেরা কামাচারী–অর্থ ও কামসাধনাই তাদের লক্ষ্য।
গুণরত্নকথিত মৈথুন-উৎসব আজো হয়। সাঁওতাল, হো, পাঞ্চা, কোটার প্রভৃতি দেশী সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং চিলি, নিউমেক্সিকো, নিকারাগুয়া, মেক্সিকো প্রভৃতি বিদেশী আদিবাসীর মধ্যে তা চালু আছে। গুণরত্ন বলেছেন, চার্বাকরা (লোকায়তিকরা)
They drank wine and ate meat and were given to unrestricted sex indulgence. Each year they gathered together on a particular day and had unrestricted intercourse with women. They behaved like common people and for this reason they were called Lokayata.
সাঁওতালেরা এমনি উৎসব আজো করে।
Five days are spent in dancing, drinking and debauching. It is significant that at the commencement the village headman gives a talk to the village-people in which he says that they may act as they like sexually, only being careful not to touch certain women, otherwise they may amuse themselves. The village people reply that they are putting twelve balls of cotton in their ears and will not pay any heed to, nor hear or see anything.
এরই বিকশিত তাত্ত্বিকরূপ পাই পরবর্তী ধর্মমতগুলোতে। হরপ্রসাদ সে-মতগুলোর কথা এভাবে বলেছেন :
The influence of the Lokayatas and Kapalikas is still strong in India. There is a sect and numerous ones too, the followers of which believe that Deha, or the material human body is all that should be cared for and their religious practices are concerned with the Union of men and women and their success (siddhi) varies according to the duration of the union. They call themselves Vaisnavas, but they do not believe in Vishnu or Krishna or their incarnations. They believe in Deha. They have another name Sahajia, which is the name of a sect of Buddhists which arose from Mahayana in the last four Centuries of their existence in India.
দোল, হোলী বা মদনোৎসবে আজো সেই মৈথুন উৎসবের রেশ রয়ে গেছে। W. Crooke এই হোলী বা মদনোৎসবের মূলে মানুষ, পশু ও শস্যের উর্বরতা বাড়ানোর কামনা ছিল বলে অনুমান করেছেন।
অতএব, আমাদের বক্তব্য সংক্ষেপে এই : সৃষ্টিসম্ভব মৈথুনতত্ত্ব থেকে সাংখ্যতত্ত্বের উদ্ভব। এই তত্ত্বের প্রকৃতির উপর আত্যন্তিক গুরুত্বদানের ফলে তন্ত্রমত এবং পুরুষের উপর গুরুত্বদানের কারণে লিঙ্গায়েত মত ও যোগ-পদ্ধতির বিকাশ। নিজের মধ্যে অলৌকিক শক্তির উদ্বোধন ও প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে এ সাধনার লক্ষ্য। তাই মূলত এটি শক্তিবাদ। যোগপদ্ধতি, তান্ত্রিক আচার অথবা যোগতান্ত্রিক মিশ্র আচার মাধ্যমে এই শক্তিকে আয়ত্তে আনার প্রয়াস চলেছে। যেখানে শক্তিস্বরূপা প্রকৃতি প্রাধান্য লাভ করেছেন, সেখানে শাক্তধর্ম বা শাক্তশাস্ত্রের উদ্ভব, যেখানে শক্তিমান শিব বা বিষ্ণু গুরুত্ব পেয়েছেন, সেখানে শৈব বা বৈষ্ণব মতবাদের উদ্ভব। যোগ ও তন্ত্র প্রায় সব মতবাদকে প্রভাবিত করেছে। যারা অধ্যাত্ম সাধনাকে জীবনের একমাত্র ব্রত করে নেয়, সে-সব সাধকের সাধনার আবশ্যিক অঙ্গ হয়েছে তন্ত্র অথবা যোগ। বাঙলা দেশে পাল আমলে আদি অনার্য-সংস্কার ব্রাহ্মণ্যমত এবং মহাযান বৌদ্ধ মতের সমন্বয়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, মন্ত্রযান-বজ্রযান-কালচক্রযান ও শেষে সহজযান সম্প্রদায়ের উদ্ভব। মন্ত্র, যন্ত্র, বীজ, মুদ্রা, মণ্ডল, লতা, ভগ, যোগ ও নানা গুহ্যপ্রক্রিয়াই এসব মতের ভিত্তি। এবং সাধারণভাবে আসন, ন্যাস, দেবতার প্রতীক বর্ণরেখাত্মক যন্ত্র, যোগ-ক্রিয়া, দীক্ষাগ্রহণ এমনকি সম্প্রদায় বিশেষে মূর্তিপূজার মাধ্যমেই উপাসনা চলে। বাঙলা। দেশে অষ্টাদশ শৈব আগম নিঃসন্দেহে গুপ্তযুগে রচিত হয় এবং খুব সম্ভব গুপ্তযুগের শেষের দিকে ও পালযুগে তান্ত্রিক শক্তিপূজার প্রচলন হয়। বর্তমান হিন্দু পূজাপদ্ধতিতেও তান্ত্রিক পদ্ধতির প্রভাব . লক্ষণীয়। মনে হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে গীতার কর্মবাদ ও শঙ্করের জ্ঞানবাদ এবং উচ্চশ্রেণীর অনার্যদের মধ্যে ভক্তিবাদ ও নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যে যোগ ও তন্ত্র প্রাধান্য লাভ করেছিল। এর থেকেই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, মন্ত্রযান-বজ্রযান-কালচক্রযান-সহজযান ও নাথপন্থের উদ্ভব। এর জের রয়েছে বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউল মতে। এই তত্ত্বসাধনার একটি ধারা বৌদ্ধ দোহাকোষ ও চর্যাগীতির ভিতর দিয়া যে সহজরূপ লাভ করিয়াছে, তাহারই ঐতিহাসিক ক্রমপরিণতি বাঙালাদেশের বৈষ্ণব সহজিয়াসাধনায় এবং বিশেষ বিশেষ বাউল সম্প্রদায়ের মধ্যে।২২ এবং সহজিয়া ধর্মের সহিত সাদৃশ্য থাকায় সুফীবাদের সামঞ্জস্য বিধান হইয়া বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। ব্রাহ্মণ্য শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়ার সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্ৰমত–যার নাম। নাথপন্থ। বামাচার নয়, কায়াসাধন তথা দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। হঠযোগের মাধ্যমেই এ সাধনা চলে। একসময় এই নাথপন্থ ও সহজিয়ামতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়। চর্যাগীতি ও নাথ সাহিত্য তার প্রমাণ। এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক পরে ইসলামে ও বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলে ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা নিজেদের পুরোনো প্রথায় ধর্মসাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। সুফী মতের ইসলাম সহজেই বাঙ্গালার প্রচলিত যোগমার্গ ও অন্যান্য সাধনমার্গের সঙ্গে একটা আপোষ করিয়া লইতে সমর্থ হইয়াছিল।ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে মুসলমান মাধববিবি ও আউল চাঁদই বাউলমতের প্রবর্তক এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্রই (বা বীরচন্দ্র) বাউলমত জনপ্রিয় করেন। এ মতের সমর্থন মিলেছে বীরভদ্রের শিক্ষামূলক কড়চা নামের এক অজ্ঞাতপ্রায় পুথিতে। নিত্যানন্দ তাঁর পুত্র বীরদ্রকে বলছেন :
শীঘ্র করি যাহ তুমি মদিনা শহরে …
তথা যাই শিক্ষা লহ মাধববিবির সনে
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে।
মাধববিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই।
ডক্টর সুকুমার সেনের মতে, মহাযানের উপাস্য নরদেবতা অবলোকিতেশ্বর বাংলাদেশে লোকনাথ নাম নিয়ে বিষ্ণুর রূপান্তরে পরিণত হয়েছিলেন। …. বৌদ্ধযুগে বাংলাদেশে লোকনাথকে আশ্রয় করে ভক্তিধর্মের অঙ্কুর উদাত হয়েছিল। ….. বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণবধর্মের মধ্যে যেমন পূর্বেকার ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ভক্তিবাদের যুক্তবেণী প্রবাহিত হয়ে এসেছে, তান্ত্রিক বৈষ্ণব অর্থাৎ বাউল সহজিয়া ইত্যাদি মতের মধ্যে তেমনি পূর্বযুগের শৈব ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক মতবাদের পরিণতি দেখা যায়। অষ্টম শতাব্দী কিংবা তারও পর থেকে বাংলাদেশে অনুন্নত শ্রেণীর মধ্যে তান্ত্রিকভাবের দুটি ধর্মমত চলিত ছিল–শৈবনাথমত এবং বৌদ্ধ সহজিয়ামত। এই দুই মতের সাধনায় ও দর্শনে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। নাথ সন্ন্যাসীরা নিজেদের যোগী বা কাঁপালিক বলত, এরা কানে নরাস্থি কুণ্ডল, কণ্ঠে নরাস্থি মালা, পায়ে নূপুর ও হাতে নরকপাল ধারণ করত এবং গায়ে ছাই মাখত। এদের আহার বিহার ছিল কদর্য, তাই গ্রামের বাহিরে ছিল এদের কুঁড়েঘর। যোগীদের নামের শেষে শব্দ হত নাথ। বর্তমান সময়ে যুগী জাতির (তাঁতি) মধ্যে নাথ পদবী ও পূর্বেকার আচার অনুষ্ঠান কিছু কিছু চলিত আছে। বৌদ্ধ সহজ সাধকেরা দেহতত্ত্বের সাধনা করত এবং আবশ্যক হলে যোগিনী বা অবধূতী অর্থাৎ সাধক-সঙ্গিনী গ্রহণ করত। এদের সাধনার সঙ্গে নিহিত আছে চর্যাপদে। ছকে ফেলে দেখলে বাঙলার তান্ত্রিক ধর্মের বিবর্তন এরূপ দাঁড়ায় :
তন্ত্রিক শৈব–শাক্ত ধর্ম
তন্ত্র হচ্ছে ভোগ-মোক্ষবাদ–ভোগের মাধ্যমে মোক্ষলাভই আদর্শ। নারীই জগত্তারণ আদ্যাশক্তি। তিনিই মহামায়া, কালী, তারা, শিবানী। নারীশক্তিতেই পুরুষ হয় শক্তিমান। শিব হচ্ছেন শক্তিমান। শিবশক্তি অদ্বয়ও বটে, ভিন্নও বটে। শক্তি সাধনায় শক্তিমান হওয়া তথা শিবত্ব উপলব্ধি করাই তান্ত্রিক সাধনার লক্ষ্য। এর সঙ্গে বৌদ্ধ বোধিচিত্ত বা মহাসুখ তুলনীয়। এ সাধনায় প্রকৃতিসঙ্গ প্রয়োজন। মৈথুনে বীর্যধারণের দরকার হয় না। রেতক্রিয়া অবিধেয় নয়। এ সাধনা করতে হয় নারীভাবে–বামা ভুত্বা যজেৎ পরাম। লতা, ভগবান-যন্ত্র, পদ্ম তথা নারীর যোনি-প্রতিম পূজার উপাদান। আসন, ন্যাস, মুদ্রা, মূলমন্ত্র, বীজমন্ত্র, বর্ণরেখাত্মক যন্ত্র, যোগক্রিয়া, দীক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি সাধনার অঙ্গ। এরা গুরুবাদী। সাধনাও গুহ্য। পঞ্চ মকারে তথা মাংস, মৎস্য, মদ্য, মুদ্রা ও মৈথুনে এরা বিশেষ আসক্ত। এরাও পরকীয়া বামা মৈথুনই প্রকৃষ্ট পন্থা বলে মানে। এদের গুরু চার প্রকার–গুরু, পরমগুরু, পরমেষ্টি গুরু ও পরাৎপর গুরু। তারা সবাই শিবের অংশ। হিন্দুতন্ত্রে মেরুদণ্ডকে আশ্রয় করে পর পর ছয়টি চক্র (ষটচক্র-মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্র (দ্বিদল চক্র) ও তাদের সন্নিহিত পদ্ম, এবং ইড়া (গঙ্গা) পিঙ্গলা (যমুনা) সুষুম্না (সরস্বতী) প্রভৃতি বহু নাড়ির কল্পনা করা হয়েছে। সর্বনিম্নের চক্রের নাম মূলাধারচক্র। এতেই সৃষ্টিরূপা কুণ্ডলিনী সুষুপ্ত রয়েছে। ষট্চক্রের ঊর্ধ্বে রয়েছে সহস্রার (সহস্রদলপদ্ম), তাতে থাকেন পরম শিব। যৌগিক প্রক্রিয়ার দ্বারা এই কুণ্ডলিনীকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বে নিয়ে পরম শিবের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে ত্রিগুণাতীত শিবত্ব উপলব্ধি হয়। এটি এক পরমানন্দময় অদ্বয়সত্তা–শিবশক্তির অদ্বয়সত্তা–এই মিলনজাত কেবলানন্দই সাধকের চরম আধ্যাত্মিক লক্ষ্য। শিব পুরুষশক্তির প্রতীক–উমা নারীশক্তির প্রতীক–উভয়ের মিলনজনিত যে সামরস্য তাই কেবলানন্দ, বৌদ্ধ তান্ত্রিকের মহাসুখ ও বৈষ্ণব সহজিয়ার মহাভাবরূপ সহজাবস্থা। মূল পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বই হিন্দুর শিবশক্তি, বৌদ্ধের প্রজ্ঞা-উপায় এবং বৈষ্ণব ও বৈষ্ণব সহজিয়ার রাধাকৃষ্ণতত্ত্বে রূপ নিয়েছে।
শাক্তমন্ত্রে বামাচার ও দক্ষিণাগার নামে দুই সাধনপদ্ধতি আছে। বামাচার পঞ্চ ম-কার ভিত্তিক। আর দক্ষিণাগার ম-কার বর্জিত যোগনির্ভর।
ছকে হিন্দুতন্ত্র
চক্র ——- দেহস্থান ——- পদ্মদল অধিষ্ঠাত্র দেবতা
১. মূলাধার—– গুহ্যদেশ ও জননেন্দ্রিয়ের মধ্যস্থ ৪ —- ব্রহ্ম + ডাকিনী
২. স্বাধিষ্ঠান ——– জননেন্দ্রিয়ের মূলে সুষুমম্নর মধ্যস্থ চিত্রিনী নাড়ীস্থ ৬ — মহাবিষ্ণু + রাকিনী
৩. মণিপুর ——– নাভিমূলে ১০ ——– রুদ্র + লাকিনী
৪. অনাহত —— বক্ষ ১২ ——— ঈশ + কাকিনী
৫. বিশুদ্ধ ——- কণ্ঠ ১৬ ———— অর্ধনারীশ্বর (শিবশক্তি) + শাকিনী
৬. আজ্ঞা ——- ভ্রূ-দ্বয়ের মধ্যস্থ ২ —- পরশিব + হাকিনী
এর উপরে রয়েছে সহস্রদলপদ্ম, নাম সহস্রার। এটি পরমশিব ও কুণ্ডলিনীর মিলনস্থল। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না প্রভৃতি নাড়িই বায়ুপ্রবাহ পথ। ইচ্ছামতো বায়ু সঞ্চালনই যোগক্রিয়ার মূলভিত্তি। তাই নাড়ির সঙ্গে যোগের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। অবশ্য খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিভিন্ন তন্ত্রগ্রন্থে কিছু কিছু অনৈক্যও রয়েছে। বিভিন্ন পদ্ধতির তান্ত্রিক সাধনার মধ্যে দিব্যাচার, সমায়াচার, দক্ষিণাচার ও পশ্বাচার প্রভৃতি নামমাত্র তান্ত্রিক আচার। যথার্থ তান্ত্রিক আচার হচ্ছে : বীরাচার, বামাচার, চীনাচার ও কুলাচার। কৃষ্ণানন্দের তন্ত্রসারই স্বীকৃত, নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় গ্রন্থ। বেশ্যা, নটী, রজকী, ব্রাহ্মণী প্রকৃতিই যোগ্য সাধন সঙ্গিনী।
বৌদ্ধতন্ত্র
প্রকৃতি ও পুরুষকে বৌদ্ধতন্ত্রে প্রজ্ঞা ও উপায় নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দুতন্ত্রের ঘটচক্র বা পদ্ম বৌদ্ধতন্ত্রে চারচক্র বা পদ্ম। এবং তা কায়রূপে পরিকল্পিত। প্রথম চক্রটি নাভির নিচে অবস্থিত। এর নাম নির্মাণকায়। দ্বিতীয় চক্ৰ হৃদয়দেশে অবস্থিত। এর নাম ধর্মকায়। তৃতীয় চক্র কণ্ঠদেশে। এর নাম সম্ভোগকায়। চতুর্থটি ব্রহ্মতালুতে অবস্থিত। এর নাম সহজকায়। এই সহজকায় বা উষ্ণীষ কমলকে মহাসুখচক্র বা মহামুখকমলও বলা হয়। হে বতন্ত্র অনুসারে জননেন্দ্রিয়ের স্থান হইতে চেতন-অচেতন সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব হইয়াছে বলিয়া ঐ প্রদেশে নির্মাণকায় স্থাপিত হইয়াছে। ধর্মচক্র সমস্ত ধর্মের তত্ত্বরূপ বলিয়া হৃৎপ্রদেশে স্থাপিত, সম্ভোগ অর্থে ষড়রস সম্ভোগ, সম্ভোগকায় আনন্দ-রস সম্ভোগস্বরূপ, ইহা কণ্ঠদেশে স্থাপিত। মহাসুখচক্র তথা মহাসুখকায় মস্তকে স্থাপিত।
দেহস্থান — চক্র বা — কায় —- পদ্ম — মুদ্রা –– আনন্দ — দেবী — ক্ষণ
নাভি–নির্মাণচক্র–কায়–-নাভিপদ্ম চৌষট্টিদল–-কর্মমুদ্রা–-আনন্দকায়—লোচনা—বিচিত্র
হৃদয়—ধর্মচক্র–কায়–হৃৎপদ্ম বত্রিশ দল–ধর্মমুদ্রা–পরমানন্দ–মানকী–বিপাক
কণ্ঠ–সম্ভোগচক্র–কায়–কণ্ঠ পদ্ম ষোড়শ দল—মহামুদ্রা–বিরমানন্দ—পাত্র–বিমর্দ
মস্তক—সহজচক্র–উষ্ণীষ পদ্ম চতুর্দল—সময়মুদ্রা—সহজানন্দ—তারা– বিলক্ষণ
এদের সঙ্গে রয়েছে চার সাধনাঙ্গ–সেবা, উপসেবা, সাধনা ও মহাসাধনা।
চার আর্য সত্য– দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিবৃত্তি, নিবৃত্তির উপায়।
চার তত্ত্ব —আত্মতত্ত্ব, মন্ত্ৰতত্ত্ব, দেবতাতত্ত্ব ও জ্ঞানতত্ত্ব।
এর সঙ্গে চার নিকায়, ঘোড়শ সংক্রান্তি, চৌষট্টি দণ্ড ও চার প্রহরাদির সম্পর্ক রয়েছে। আবার কোনো কোনো গ্রন্থে (যেমন সেকোদ্দেশ টীকা) কায়-বাক-চিত্ত-জ্ঞান অনুসারে প্রত্যেকের চার প্রকার ভেদ ধরে মোট ষোলো প্রকার আনন্দ নির্দেশ করা হয়েছে। বৌদ্ধতন্ত্রে ইড়া নাড়ির নাম ললনা, আলি, ধমন, চন্দ্র প্রভৃতি। পিঙ্গলার নাম রসনা, কালি, চমন, সূর্য প্রভৃতি। সুষুম্না নাড়ি, অবধূতী, দেবী, প্রজ্ঞা, নৈরাত্মা, যোগিনী, সহজ সুন্দরী প্রভৃতি নামে পরিচিত। বৌদ্ধতন্ত্রে ললনাকে প্রজ্ঞা (চন্দ্র) এবং রসনাকে উপায় (সূর্য) বলা হয়েছে। এ দুটো নাড়ির মিলন হয় অবধূতীতে। এ মিলন প্রজ্ঞা-উপায়ের মিলন। ললনা বিন্দু বহন করে, রসনা রজ: বহন করে, অবধূতী বহন করে প্রজ্ঞা-উপায় মিলনজনিত বোধিচিত্তকে। এই অবধূতীই সহজানন্দ স্বরূপিণী।
বৌদ্ধতন্ত্র সাধনায় হঠযোগের গুরুত্ব অত্যধিক। কেননা বিন্দুধারণ এবং তা ঊর্ধ্বে সঞ্চালনই এর লক্ষ্য। খড়গ, অঞ্জনা, পাদলেপা, অন্তর্ধান, রস রসায়ন, খেচর, ভূচর ও পাতাল বৌদ্ধতন্ত্রের এই অষ্টসিদ্ধি (সাধনমালা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৫০)। নটী, রজকী, ডোমনী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণীই সাধন সঙ্গিনীরূপে বিশেষ উপযোগী। যোগিনী-ডাকিনীরা সিদ্ধিপ্রভাবে অলৌকিক শক্তিধর হয়।
মহাযান বৌদ্ধমত উদ্ভূত উপমত সমূহ
বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রের প্রচলন কবে থেকে হয়, তা সঠিক বলা যায় না। ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের মতে বুদ্ধের সময় থেকেই বৌদ্ধধর্মে তান্ত্রিকতা প্রবেশ করে, বুদ্ধদেবই সাধারণ অশিক্ষিত লোকদের জন্য মুদ্রা, মন্ত্র প্রভৃতি প্রবর্তন করেন। মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাসই তান্ত্রিকতার ভিত্তি। বৌদ্ধগ্রন্থে মন্ত্রকে বলত ধারণী (যাহা দ্বারা কিছু ধারণ করা যায়)। ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত বলেন, খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকেই বৌদ্ধতন্ত্রগুলো রচিত হতে থাকে। এ সময় বৌদ্ধ ক্ষান্তি-পারমিতা দান-পারমিতা প্রভৃতি তত্ত্ব দেবীরূপে কল্পিত হয়ে প্রমূর্তরূপে পূজা পেতে থাকেন। ধারণী বা বীজমন্ত্রও এ সময় থেকে রচিত হয়। অষ্ট সাহসিক প্রজ্ঞা পারমিতা > প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয় সূত্র > প্রজ্ঞা পারমিতা ধারণী > প্রজ্ঞাপারমিতা মন্ত্ররূপ সংক্ষেপকরণ পরম্পরায় অবশেষে প্রং এই বীজমন্ত্রে (তুলনীয় ওঁ) রূপ নিয়েছে। এই মন্ত্রনির্ভর পূজা-ধ্যান পদ্ধতির নাম মন্ত্রযান। সম্ভবত: এই মন্ত্রতত্ত্বের সঙ্গে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধের যোগাচার পদ্ধতির মিশ্রণ ঘটে। আর প্রকৃতি-পুরুষ তত্ত্ব এর দার্শনিক ভিত্তি হয়। তার থেকেই ক্রমে বিভিন্ন মতের উদ্ভব হয়ে পাল আমলে তিনটি বিশিষ্ট উপমত হিসেবে বিকাশ লাভ করে। এ তিনটি হচ্ছে : বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান।
নাগার্জুনের মতে শূন্যতাই হচ্ছে নির্বাণ। এ মত পরে বসুবন্ধুরও সমর্থন পায়। তিনি বলেন, গ্রাহ্য-গ্রাহকের অস্তিত্বহীনতাই শূন্যতা আর এই শূন্যতাই নির্বাণ। অর্থাৎ বাহ্যত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও পারমার্থিক দৃষ্টিতে সব মায়ামাত্ৰভ্ৰমস্বরূপ–এটি অবিদ্যাজাত।
বজ্রযান
বজ্রযানে এই শূন্যতার নাম বজ্র। এটি অচ্ছেদ্য, অভেদ্য, অদাহী, অবিনাশী বজ্র। এই তত্ত্বই বজ্রসত্ত্ব–তার প্রমূর্তরূপ আদিবুদ্ধ। তিনিই পরমদেবতা। এই পরমদেবতা আত্মাও বটে, আবার সর্বজনীন পরমসত্তারূপে পরমাত্মাও বটে। এ বোধ মূলত ঔপনিষদিক এবং আস্তিক্যসূচক। এই বজ্রসত্ত্ব পরমব্রহ্মের মতো নির্গুণ, আবার সগুণও বটে। এই হচ্ছে বোধিচিত্ত বা শূন্যতা ও করুণা জ্ঞানরূপ সচ্চিদানন্দ স্বরূপ অবস্থা।
বৌদ্ধ ধর্মচক্র বা ধর্মকায় বজ্রযানে বজ্রকায়রূপে অভিহিত হয়। এই বজ্রকায় বজ্রসত্ত্বস্বরূপ এবং জ্ঞান ও করুণারূপ বুদ্ধ। এই আদি বুদ্ধের পঞ্চগুণ–রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। এদের নাম পঞ্চস্কন্ধ। এই পঞ্চস্কন্ধের প্রতীক দেবতা হচ্ছেন–বৈবোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, আমোঘসিদ্ধি ও অক্ষোভ্য। উক্ত সব স্কন্ধের ধ্যানের প্রয়োজনে সৃষ্ট বলে দেবতারা ধ্যানী বুদ্ধ বলে অভিহিত হন। এঁদের প্রকৃতি বা শক্তি হচ্ছেন যথাক্রমে তারা (বজ্রধাত্বেশ্বরী) মামকী, পাণ্ডরা, আর্যরা বা তারা ও লোচনা। এঁদের বোধিসত্ত্ব হচ্ছেন চক্রপাণি (সমন্তন্দ্র), রত্নপাণি, পদ্মপাণি (অবলোকিতেশ্বর), বিশ্বপাণি ও বজ্ৰপাণি। এরা ভূতপিশাচদেরও নাকি পূজা করত। যোনি প্রতীক যন্ত্রপূজাও করত।
দেবীদের মধ্যে আর্যরা–শ্যামাতারা, শেততারা, উগ্রতারা প্রভৃতি নানা নামে বিশেষ জনপ্রিয় হন। তাছাড়া হারিতা, মারীচি প্রভৃতি নামের প্রকৃতিও পরিকল্পিত হয়েছে। এই তারা পরে হিন্দু কালিকাতে রূপান্তরিত হয়েছেন। বৌদ্ধতন্ত্রে বজ্রসত্ত্ব হচ্ছে হেরুক বা হে বস্ত্র এবং তাঁর প্রকৃতির নাম হচ্ছে বজসত্ত্বাত্মিকা, বজ্রবরাহী, প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞা পারমিতা প্রভৃতি আর তার আবাহনের বীজমন্ত্র হল হুং। শূন্যতা ও করুণাকে কমল (প্রজ্ঞা), বজ্র (পুরুষ), প্রজ্ঞা (নারী), উপায় (পুরুষ), চন্দ্র (নারী), সূর্য (পুরুষ), এবং পুরুষ ও প্রকৃতিরূপেও কল্পনা করা হয়েছে। এ দুটোর মিলনজনিত এক তুরীয় আনন্দময় অবস্থা বা চেতনার নাম বোধিচিত্ত। এইটিই তান্ত্রিকতত্ত্ব। শৈব-শাক্ত তন্ত্রের সঙ্গে এখানেই বৌদ্ধতন্ত্রের মৌলিক ঐক্য। বোধিচিত্তেই মহাসুখ, কমলকে (প্রজ্ঞা তথা নারী) বৌদ্ধতন্ত্রে (যোনির) এবং বজ্রকে (উপায় তথা পুরুষ) পুংলিঙ্গের প্রতীকরূপে ধরা হয়েছে! তাই বজ্ৰকমল সংযোগ অর্থ মৈথুনক্রিয়া। এই মৈথুনে যে সামরস্য তাই যুগনদ্ধ বা অদ্বয় এবং এই সামরস্যজাত আনন্দাবস্থাই বোধিচিত্ত। [এতদ অদ্বয়ং ইতি উক্তং বোধিচিত্তং ইদম পরম– সাধনমালা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭] অতএব প্রজ্ঞা-উপায় মৈথুনজাত মহাসুখরূপ বোধিচিত্ত লাভ করাই এ সাধনার লক্ষ্য। এ বজ্ৰতন্ত্রে হে বজ্র (বজ্রসত্ত্ব) নারী যোনিতে শুক্ররূপে বাস করেন বলে এবং শুক্র বিনা মহাসুখ লাভ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন। বজ্রযানীরা চর্যাগীতির মতো বগীতিতে তাদের সাধনতত্ত্ব ব্যক্ত করত। উল্লেখ্য যে আদিকাল থেকেই গানের মাধ্যমে সাধন-ভজন রীতি চালু রয়েছে। সব ধর্মেই গান কৃচিৎ নাচ] সাধনা ও উপাসনার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ অঙ্গ।
কালচক্রযান
বজ্রযানের সঙ্গে কালচক্রযানের মৌলিক কোনো তফাৎ নেই। কালচক্রযানে কালচক্রই বজ্রসত্ত্ব। অর্থাৎ এখানে কাল-এর উপরই অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা কাল ঘসতি ভূতানি। কালচক্র হচ্ছে–শূন্যতা ও করুণার তথা প্রজ্ঞা-উপায়ের অদ্বয়সত্তা। কালকে জয় বা অতিক্রম করে চিরন্তন বোধিচিত্ত লাভ তথা জন্ম ও মৃত্যু (উৎপত্তি ও ক্ষয়) নিরোধক শক্তিলাভই এ সাধনার লক্ষ্য। তাই কালচক্র বুদ্ধের জনকস্বরূপ এবং ত্রিকাল ও ত্রিকায়ের ধারক। (বিমলপ্রভা-বাংলার বাউল ও বাউল গান গ্রন্থের পাদটীকায় উদ্ধৃত। পৃষ্ঠা ২৩৪-৩৫)। সাধন সম্বন্ধে কালচক্রযানীরা দিন, তিথি, নক্ষত্র, যোগ প্রভৃতির বিচার করিতেন বলিয়া মনে হয়। অভয়াকর গুপ্ত কালচক্রাবতার গ্রন্থে বার তিথি-নক্ষত্র-যোগ-করণ-রাশি-ক্ষেত্রি-সংক্রান্তি প্রভৃতির বিশদ আলোচনা করেন। এ কথা সঙ্গতভাবেই অনুমান করা যায় যে, কালচক্রপন্থী সাধকেরা গ্রহ-নক্ষত্রের গতি অনুসারে তাহাদের সাধনজীবন নিয়ন্ত্রিত করিতে চেষ্টা করিতেন।৩৪ বৌদ্ধতন্ত্রে–বজ্র ও কালচক্রানে–তুকতাক্ উচাটন-বশীকরণ-মারণ প্রভৃতি ঐন্দ্রজালিক আচারাদি ছিল।
সহজযান
সহজযান দেব-দেবী, পূজা, মন্ত্র, প্রভৃতি সর্বপ্রকার আনুষ্ঠানিক ও আচারিক ধর্মের বিরোধী। কিন্তু বজ্রযানের সাধনপদ্ধতি ও সহজ যানের সাধনপদ্ধতি অভিন্ন। এমনকি বজ্রধর বা বজ্রসত্ত্বকে তারা মানে। সহজযানের প্রসারক্ষেত্র নেপাল ও তিব্বত। এ মার্গের শাস্ত্রগ্রন্থগুলোও তাই তিব্বতী ভাষায় অনূদিত ও রক্ষিত। আমাদের দোহাকোষ ও চর্যাপদগুলো সহজযানী সিদ্ধাদের রচিত। চর্যাপদে বামাচার ও প্রকৃতিবর্জিত সাধনার মিশ্রণ আছে। সহজযান মতেও প্রজ্ঞা-উপায়ের মিলনজনিত সামরস্য থেকেই মহাসুখরূপ সহজের উদ্ভব। এটিই বোধিচিত্ত। বৌদ্ধ চৌরাশী সিদ্ধার সবাই সহজিয়া ছিলেন না। তার প্রমাণ গোরক্ষ-মীননাথ কাহিনী–এঁরা প্রকৃতিবর্জিত পরম যোগী। কেউ কেউ সহজিয়া ছিলেন, তা চর্যাগীতিতে লক্ষণীয়।
সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও আচার প্রতিষ্ঠার জন্যে রাজকীয় প্রয়াস চলে। এ সময়েই কালবিবেক, দায়ভাগ প্রভৃতি স্মৃতিগ্রন্থাল্লেখিত ব্রাহ্মণ্য আচার সমাজে বহুল প্রচলিত হয়। বারো মাসে তেরো পার্বণের শুরু হয় এভাবেই। চর্যাপদ থেকে এমনও অনুমান করা যায় যে, এ সমস্ত সহজযানীদের মধ্যে দ্বিবিধ সাধনপদ্ধতি চালু ছিল; একটি মৈথুনাত্মক তান্ত্রিকপদ্ধতি, অপরটি প্রকৃতিবর্জিত–বিশুদ্ধ যোগ-প্রণালী, হঠযোগের (চন্দ্র+সূর্য) মাধ্যমে দেহ বা কায়াসাধনই ছিল এঁদের লক্ষ্য।
বিন্দুধারণ ও ঊর্ধে সঞ্চালন করে সহস্রার মধ্যে নিয়ে সচ্চিদানন্দ রূপ মহাসুখ ও সহজানন্দ এর অবস্থা সৃষ্টি করাই লক্ষ্য। এটিই নির্বাণানন্দ তথা শূন্যতা।
নাথধর্ম :
বলেছি, সেন আমলে ব্রাহ্মণ্যবাদ রাজধর্মরূপে গৃহীত হয়। ফলে বিভিন্ন ও বিভক্ত বৌদ্ধ সম্প্রদায় ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে পড়ে। বিশেষ করে, স্মৃতির বিধান-অনুগ সমাজ ও শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ায় লোকজীবনে সে-প্রভাব এড়ানো সম্ভব হয়নি। সেনদের রক্ষণশীলতা আর অনুদারতাও বৌদ্ধ বিলুপ্তির জন্যে অংশত দায়ী। এ বিরুদ্ধ পরিবেশে কোনো কোনো বৌদ্ধ সম্প্রদায় কিছু হিন্দু-দেবতা ও আচার গ্রহণ করে হিন্দুয়ানীর আবরণে পৈত্রিক ধর্ম বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াসী হয়। এরূপে এক যোগী তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রজ্ঞা-উপায়ের পরিবর্তে শিব-উমা নাম দিয়ে নিজেদের প্রাচীন বিশ্বাস সংস্কার চালু রাখে। মীননাথ-গোরক্ষনাথ-হাড়িপা-কানুপা প্রভৃতি এই সম্প্রদায়ভুক্ত। মীননাথ গোরক্ষনাথের নাম অনুসারেই এ সম্প্রদায় নাথপন্থীরূপে আমাদের কাছে পরিচিত। বৌদ্ধ সহজিয়ারা ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের কালে দুটো ভিন্ন পথে রূপান্তর লাভ করে : বামাচার বর্জিত যোগীরা শৈবনাথরূপে এবং কামাচারীরা বৈষ্ণব সহজিয়া রূপে হিন্দু সমাজের উপসম্প্রদায়ে পরিণত হয়। দ্রাবিড় দেবতা শিব ও উমাকে৫ অনেক আগেই ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পুরুষ-প্রকৃতির বিগ্রহরূপে গ্রহণ করেছিল, পরে শৈব-শাক্ততন্ত্রের শিব-উমাই (বা গৌরী) অবলম্বন হয়। তেমনি বৌদ্ধরাও পুরুষ প্রকৃতিকে প্রজ্ঞা-উপায় রূপে কল্পনা করে। আবার বৌদ্ধ বিলুপ্তিকালে প্রজ্ঞা-উপায়ের প্রতীকী পরিবর্তনে রাধাকৃষ্ণ তথা বিষ্ণু-লক্ষ্মী আরাধ্য হয়ে উঠেন। এ কারণে এ সম্প্রদায় বৈষ্ণব সহজিয়া নামে এক উপসম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, বিষ্ণু ও তাঁর অবতার কৃষ্ণ মহাভারতীয় যুগ থেকেই উত্তরভারতিক ধর্মে প্রাধান্য পেয়েছেন। নাথপন্থ যে বৌদ্ধ সহজিয়া মতবাদ থেকে উদ্ভূত তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুশীল কুমার দে প্রমুখ স্বীকার করেছেন। অবশ্য শশিভূষণ দাশগুপ্ত ও কল্যাণী মল্লিকের মতে নাথপন্থ একটি প্রাচীন শৈবমত। কিন্তু ডক্টর মল্লিক বৌদ্ধ সহজযানের সঙ্গে এর সাদৃশ্যও স্বীকার করেছেন–নাথমার্গে হিন্দুর তন্ত্র ও বৌদ্ধ সহজিয়াদের রহস্যবাদের অপূর্ব মিশ্রণ আছে। নাথ হঠযোগ ও বৌদ্ধসহজিয়া সাধনার সাধ্য আছে। …. নাথ ধর্মকে হিন্দুতন্ত্র ও বৌদ্ধ যোগ-তত্ত্বের সংমিশ্রণ বলা যাইতে পারে। আসলে প্রজ্ঞা-উপায়ের পরিবর্তে শিবশক্তির প্রতীকীরূপে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েই ডক্টর মল্লিক–হিন্দুতন্ত্র, সহজিয়ামত ও নাথপন্থে নানা সাদৃশ্য লক্ষ্য করেও–নাথমার্গকে শৈবমত বলেছেন। নাথেরা যে ব্রাহ্মণ্য শৈব নয়, তার একটি প্রমাণ নাথেরা শূন্যবাদী ও কায়াসাধুব্রতী। আর ব্রাহ্মণ্য আদিনাথ শিব আদিবুদ্ধেরই প্রতিশব্দের মতো। নাথদের এক পীঠস্থান কামাখ্যা। কদলিনগরও নাকি কামরূপে। নাহযোগী সম্প্রদায় (তাঁতিরা) তাদের সমাজ, আচার, পূজাপদ্ধতি ও সঙ্কারাদি আজো স্বতন্ত্রভাবে রক্ষা ও পালন করে। এরা প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ। অবশ্য বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে এরা হিন্দু-শৈবযোগীদের প্রভাবে পড়েছে। ভৈরব নামে শিবপূজা তার অন্যতম। নাথপন্থী সাধকরাও নানা মতগত সম্প্রদায়ে বিভক্ত। তারা যোগী, গোরক্ষনাথী, দর্শনী, কানফাটা, সিদ্ধ ইত্যাদি নামে পরিচিত। এখন এসব উপসম্প্রদায়ের কেউ শাক্ত, কেউ শৈব, কেউ বা (বৌদ্ধ) যোগী। তাই এদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা, চক্রপূজা, যযানি ও লিঙ্গপূজা, শ্ৰীযন্ত্রপূজা প্রভৃতি চালু রয়েছে। বৌদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে বলেই শক্তিকে এরা মাতৃকা জ্ঞান করে না। বৌদ্ধতন্ত্রের অষ্টসিদ্ধির অন্তর্ধান খেচর প্রভৃতি সিদ্ধি আমরা মীননাথ গোরক্ষনাথ ও হাড়িপা কাহিনীর মধ্যে পাই। মারণবশীকরণ–উচাটন–জ্যোতিষী প্রভৃতি ঐন্দ্রজালিক আচার-সিদ্ধিও নাথপন্থর লক্ষ্য ছিল। নাথমার্গেও শূন্যবাদ আছে। শৈব ব্যোমবাদ আকাশ, পরাকাশ, মহাকাশ, তত্ত্বাকাশ ও সূর্যাকাশ বৌদ্ধ সহজযানীদের শূন্য, অতিশূন্য ও সর্বশূন্যের তুল্য। শূন্য ও বধিচিত্ত এবং নির্গুণ তুরীয় অবস্থা একই। এ-ই নির্বাণ।
বৈষ্ণব সহজিয়া :
বলেছি, বৌদ্ধ-বিলুপ্তির পর বাঙালি বৌদ্ধসম্প্রদায় হিন্দু-সমাজে মিশে গিয়ে হিন্দুয়ানীর আবরণে তাদের মতাবলী প্রচ্ছন্ন রেখেছিল। বৈষ্ণব সহজিয়া, ধর্মপূজারী, নাথযোগী, হিন্দুতান্ত্রিক প্রভৃতির উদ্ভব এভাবেই হয়েছে। বৌদ্ধ সহজিয়ার সঙ্গে বৈষ্ণব সহজিয়ার পার্থক্য বিশেষ কিছুই নেই। কেবল শূন্যতত্ত্ব বা নির্বাণ বা বোধিচিত্তের স্থলে মহাভাব রূপ সহজ তথা পরমানন্দ এবং প্রজ্ঞা উপায়ের পরিবর্তে রাধা-কৃষ্ণ নামই পার্থক্য সূচিত করেছে। এ কারণে পরকীয়া নারী-মৈথুন, বিন্দুধারণ ও ঊর্ধ্বে সঞ্চালন এবং রাগানুগা সাধনা প্রভৃতি প্রক্রিয়ার নামান্তর ঘটেছে। বৌদ্ধদের মতো এরাও বেদ-বিরোধী। বৌদ্ধদের মতো এরাও একান্তভাবে গুরুবাদী। সৎগুরুর কাছে দীক্ষিত
হয়ে কেউ মহাভাব বা সহজ-এর অধিকারী হতে পারে না। এভাবে হিন্দুতান্ত্রিক ধর্মও গড়ে উঠেছে বৌদ্ধতন্ত্রের কোনো কোনো পরিভাষা ও পদ্ধতির রূপান্তরে ও তত্ত্বের কলেবর বৃদ্ধিতে। বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধ ও হিন্দু মূর্তি-শিল্পে তার সাক্ষ্য রয়েছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনাকে বজায় রেখে যারা বৈষ্ণব ধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল, তারাই বৈষ্ণব সহজিয়া। তারাই অন্য লোকের চোখে নেড়ানেড়ী। নেড়ানেড়ী কথাটিও বৌদ্ধ ঐতিহ্যের ইঙ্গিতবাহী মুণ্ডিত মুখ ও মস্তক]। কেবল রাধাকৃষ্ণ রূপকের মধ্যে (তথা পুরুষ-প্রকৃতি তত্ত্বের মধ্যে) যারা সাধন ভজন আবদ্ধ রেখেছে, তারাই বৈষ্ণব সহজিয়া। আর যারা নির্বিচারে নানা রূপক ও প্রভাব গ্রহণ করেছে, তারাই বাউল। দুইয়ের পার্থক্য এ-ই।
বাউল :
বাউলদের জনশ্রুতিজাত ধারণা, স্বয়ং চৈতন্যদেবের একটি গুহ্য সাধনপ্রণালী ছিল। এই সাধনা ছিল পরকীয়া মৈথুনাত্মক। রূপ, সনাতন, নিত্যানন্দ, জীব প্রমুখ বৈষ্ণব সাধকগণের পরকীয়া সঙ্গিনী ছিল। চৈতন্যদেব স্বয়ং মুসলমান আউলচাঁদ রূপে পুনরাবির্ভূত হয়ে এই সাধনপ্রণালী সাধারণের মধ্যে প্রচার করেন। আউলচাঁদের পুত্র রাম শরণ, তাঁর পুত্র দুলাল চাঁদ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বলে লোকশ্রুতি আছে। সম্ভবত আউলচাঁদের শিষ্যা মাধববিবি এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ পুত্র বীরদ্র ও বীরচন্দ্র এই সাধনতত্ত্ব জনপ্রিয় করেন। আউলাদ ফকির ঠাকুর নামে খ্যাত এবং কর্তাভজা মতের আদি গুরু বলে পরিচিত। বাউলেরা প্রায়ই অশিক্ষিত। বাউলদের লিখিত শাস্ত্র, ইতিহাস বা দর্শন নেই। তাই তারা কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারে না। এজন্যেই পরোক্ষ তথ্যের আলোকে অনেকটা অনুমান-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।
না বললেও চলে যে রাধাকৃষ্ণ নামের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে রাধাকৃষ্ণের যুগলাবতার চৈতন্যদেবকে বাউল মতের উদ্ভাবকরূপে প্রচার করে তারা এই সাধনতত্ত্বকে শ্রদ্ধেয় করার এবং আভিজাত্য দানের প্রয়াস পেয়েছিল। আসলে তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাধনাকে বজায় রেখে যারা বৈষ্ণবধর্মের আশ্রয় নিয়েছিল তারাই বৈষ্ণব সহজিয়া বা রসিক বৈষ্ণব। প্রজ্ঞা-উপায়ের পরিবর্তে রাধাকৃষ্ণ প্রতাঁকে সাধনা চৈতন্য-পূর্ব যুগেই হয়তো শুরু হয়েছিল, কিন্তু চৈতন্যোত্তর কালেই এ সম্প্রদায়ের প্রকাশ্য প্রসার ঘটে। তারই একটি শাখার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আউলচাঁদ। আর অপর শাখার প্রবর্তক ছিলেন মাধববিবি। এই শাখার বিস্তৃতি ঘটে সম্ভবত বীরভদ্রের চেষ্টায়। এটিরই লোক-প্রচলিত নাম বাউল সম্প্রদায়। যেসব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিলেন আর যেসব প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ হিন্দুসমাজ ভুক্ত হয়ে নিজেদের পূর্বপুরুষের ধর্মাচরণে রত ছিল, তারাই কালে বাউল সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছে। বৌদ্ধ-ঐতিহ্যের সাধারণ উত্তরাধিকার ছিল বলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বাউল মত গড়ে উঠতে পেরেছে।
হিন্দুপ্রভাবে বাউল গানে রাধাকৃষ্ণ, শিব-শিবানী, মায়া-ব্রহ্ম, বিষ্ণু-লক্ষ্মী প্রভৃতি পুরুষ-প্রকৃতির প্রতীকরূপে ব্যবহৃত হয়েছে। মুসলিম প্রভাবে তেমনি মোকাম, মঞ্জিল, লতিফা, সিরাজম্মুনিরা, আল্লাহ, কাদের, গনি, রসুল, রুই, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহম্মদ-খাদিজা, আলি-ফাতেমা প্রভৃতি প্রতীকী রূপক গৃহীত হয়েছে। আবার বৌদ্ধনাথ এবং নিরঞ্জনও পরিত্যক্ত হয়নি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৌরাণিক উপমা ও কুরআন হাদীসের বাণীর নানা ইঙ্গিত (যেমন বর্জখ]। অবশ্য বাউল রচনায় এসব শব্দ ও পরিভাষা তাদের মতানুগ অর্থান্তর তথা নতুন ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। বৈষ্ণব ও সুফী সাধনার সঙ্গে বাউল মতের মৌলিক পার্থক্য বর্তমান। সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি পরিহার করে যে-মিলন-ময়দান তারা তৈরি করল, তাকে সার্থক ও স্থায়ী করার জন্যে পরমাত্মা বা উপাস্যের নামেরও এক সর্বজনীন পরিভাষা তারা সৃষ্টি করেছে। তাদের ভাষায় পরম তত্ত্ব পরমেশ্বর বা সচ্চিদানন্দ হচ্ছে মানুষ, অটল মানুষ, সহজ মানুষ, অধর মানুষ, রসের মানুষ, ভাবের মানুষ, অলখ সাই (অলক্ষ্য স্বামী), অচিন পাখী, মনুরা (মনোরায়, মনোরাজা) প্রভৃতি পরমাত্মা আত্মারই পূর্ণাঙ্গরূপ। দেহস্থিত আত্মাকে কিংবা আত্মা সম্বলিত নরদেহকে যখন মানুষ বলে অভিহিত করি, তখন পূর্ণাঙ্গ বা অখণ্ড আত্মা বা পরমাত্মাকে মানুষ বলতে বাধা কী?
বাউলেরা বৈধি তথা বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য আচার বিরোধী এবং মৈথুনাত্মক পরকীয়া ও রাগানুগা সাধনার পক্ষপাতী। বাউল মতবাদও ভোগমোক্ষবাদ। শিবশক্তি, রাধাকৃষ্ণ ও পুরুষ-প্রকৃতিতত্ত্ব, সুফীমত ও নানা লৌকিক-তত্ত্বের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বলে বাউল মতে অসঙ্গতিও কম নেই। তবু বাউলদের উপর বৈষ্ণব মতের (চৈতন্য চরিতামৃতের মাধ্যমে) এবং সুফীমতের (কলন্দরিয়া সম্প্রদায়ের মাধ্যমে) প্রভাবই অত্যধিক। ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে সতেরো শতকের মধ্যভাগ থেকেই বাউল মতের উদ্ভব। গুরু, মৈথুন ও যোগ–তিনটিই সমগুরুত্ব পেয়েছে বাউল মতে। তাই গুরু, বিন্দুধারণ ও দম বা শ্বাস-প্রশ্বাসের কথা বাউল গানে অত্যধিক। সগুরুর কাছে। দীক্ষা না নিলে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা অসম্ভব এবং বিন্দুধারণে সামর্থ্যই সিদ্ধির প্রকৃষ্ট নিদর্শন। বাউলমতে আত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন অর্থাৎ আত্মা পরমাত্মার অংশ। আত্মাকে জানলে পরমাত্মাকেই জানা হয়। এই দেহস্থিত আত্মাই মানুষ, মনের মানুষ, রসের মানুষ, ভাবের মানুষ, অলখ সই। বাউলের রসস্বরূপ হচ্ছে সাকার দেহের মধ্যে নিরাকার আনন্দস্বরূপ আত্মাকে স্বরূপে উপলব্ধি করার প্রয়াস। এটিই অটলমানুষ তথা আত্মতত্ত্ব। এ হচ্ছে অরূপের কামনায় রূপসাগরে ডুব দেয়া, স্বভাব থেকে ভাবে উত্তরণ। সহজিয়াদের সহজই সহজ মানুষ। মৈথুন মাধ্যমে বিন্দুধারণ ও উর্ধ্বে সঞ্চালনের সময়ে গঙ্গা (ইড়া) ও যমুনা (পিঙ্গলা) বেয়ে সরস্বতীতে (সুষুম্নায়) ত্রিবেণী (মিলন) ঘটাতে হয়। তারপর সেখান থেকে সহস্রায় (মস্তকস্থিত-সহস্রদল পদ্মে) যখন বিন্দু গিয়ে পড়ে, তখনই সৃষ্টি হয় মহাভাব বা সহজ অবস্থা। মুলাধারের রজঃকে ফুল, শত্রুকে ক্ষীর ও নিঃসৃত রজঃকে নীর বলে। এই রজো-বীজে বা নীর-ক্ষীরেই মিশে রয়েছে সহজ মানুষ। বৌদ্ধ মতে হেবজ্র (বজ্রসত্ত্ব) শুক্ররূপে নারী-যোনিতে বাস করেন। সহজিয়াদের মতেও ধাতুরূপে সর্বদেহে বৈসে কৃষ্ণশক্তি [বিবর্ত বিলাস–অকিঞ্চন দাস]। এজন্যে পুরুষ নারীরজ : এবং নারী পুরুষের শুক্র পান করে। সাধনার দ্বারা সহজ মানুষের বা মহাচৈতন্যের তথা আত্মার অবিমিশ্র সত্তাবোধ জাগাতে হয়। মৈথুন পদ্ধতিই রাগানুগ পদ্ধতি। চারিচন্দ্র হচ্ছে–মল, মূত্র, রজ : ও শুক্র। এসবের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও আছে। রস বলতেও উক্ত চারি পদার্থকে বোঝায়, আবার সাধারণভাবে প্রেম বা শৃঙ্গার রসও নির্দেশ করে। বাণ পুরুষশক্তি এবং গুণ প্রকৃতি-শক্তি।
বাউলদের মনের মানুষ, মনুরা, সহজমানুষ, অধরমানুষ, ভাবের মানুষ বা অলখ সাঁই-এর সঙ্গে আদিবুদ্ধ, আদিনাথ, বোধিচিত্ত ও সচ্চিদানন্দতত্ত্বের মৌলিক ঐক্য রয়েছে। বৈষ্ণব-সহজিয়াদের সঙ্গে হিন্দু-বাউলের অনেক ব্যাপারেই সাদৃশ্য রয়েছে। বিভিন্ন গুরুর মত বা নামানুসারে এরা বিভিন্ন উপসম্প্রদায়ে বা সমাজে বিভক্ত, যথা কর্তাভজা, কিশোরীভজা, বলরামী, শম্ভচাদী প্রভৃতি। মুসলমান বাউলরা নেড়ার ফকির, আউল, সই, সাহেব ধনী, হযরতী, দরবেশ প্রভৃতি নামে পরিচিত ও বিভিন্ন গুরুপন্থী সমাজে বিভক্ত। দেহ নিরপেক্ষ আত্মার স্থিতি সম্ভব নয়, কাজেই দেহাধারেই আত্মাকে খুঁজতে হবে। এই ধারণা দেহতত্ত্বে আগ্রহ জাগিয়েছে। ফলে দেহের চর্যা ও দেহ-সম্বন্ধীয় তথ্য উদঘাটন আবশ্যিক হয়েছে। বৌদ্ধ-তান্ত্রিকদের আমল থেকে দেহ ও সাধনা সম্বন্ধীয় যেসব পরিভাষা ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সেগুলোর একটি তালিকা দিচ্ছি। এতে দেহের বাম ও দক্ষিণের একটি স্কুল পরিচয় মিলবে :
দেহের দক্ষিণাংশে : রসনা, পিঙ্গলা, সূর্য, রবি, অগ্নি, প্রাণ, চমন, কালি, বিন্দু, উপায়, যমুনা, রক্ত, পলিতা, সূক্ষ্ম, রেত :, ধর্ম, স্থির, পর, দ্যৌ, ভেদ, চিত্ত, বিদ্যা, রজ:, ভাব, পুরুষ, শিব, জিনপুর, নির্মাণকায়, গ্রাহ্য ও গগন।
দেহের বামাংশে : ললনা, ইড়া, চন্দ্র, শশী, সোম, আপান, ধমন, আলি, নাদ, প্রজ্ঞা, গঙ্গা, শুক্র, বলি, স্কুল, রজ:, অধম, অস্থির, অপর, পৃথিবী, অভেদ, অচিত্ত, অবিদ্যা, তামস, অভাব, প্রকৃতি, শক্তি, সম্ভোগকায় ও গ্রাহক।
অবশ্য এসব পরিভাষার সবগুলো বাউল সাধনায় ও বাউল রচনায় মিলবে না। কারণ কালে অনেকগুলোর গূঢ়ার্থের স্মৃতি লোকমানস থেকে মুছে গেছে। বিভিন্ন ধর্মতত্ত্বের ও সাধন-প্রণালীর প্রভাবে পড়েছে বলে বাউল সাধনায় কোনো একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। এজন্যে মুসলমান বাউলদের মধ্যে পরকীয়া ও মৈথুনাত্মক সাধনা দুর্লক্ষ্য; তারা যৌগিক প্রক্রিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণকেই প্রাধান্য দেয়।
বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে বাউল মত। হিন্দু-মুসলমানের মিলনে হয়েছে বাউল সম্প্রদায়। তাই পরমতসহিষ্ণুতা, অসাম্প্রদায়িকতা, গ্রহণশীলতা, বোধের বিচিত্রতা, মনের ব্যাপকতা ও উদার সদাশয়তা এদের বৈশিষ্ট্য।
নানা বরণ গাভীরে ভাই
একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম
একই মায়ের পুত।
মানুষ নির্বিশেষকে এমন উদারদৃষ্টিতে দেখা যে-জীবনবোধের দ্বারা সম্ভব, তার উৎস যে ধর্মমত বা মরমিয়াবাদ তা কখনো তুচ্ছ হতে পারে না। মুসলমান বাউলের হিন্দুগুরু, হিন্দু বাউলের মুসলমানগুরু এমন প্রায়ই দেখা যায়।
সাধারণ দৃষ্টিতে মুসলমান বাউলেরা আধা-মুসলমান। এরাই বাঙলা দেশে মুসলমানের সংখ্যা বাড়িয়েছে। সূফী-দরবেশরা তাদের এমনি আধা-মুসলমান করে না রাখলে, সরাসরি শরীয়তী ইসলাম প্রচারে এত লোককে দীক্ষিত করা যেত না হয়তো। আগে নামত মুসলমান সমাজভুক্ত ছিল বলেই উনিশ-বিশ শতকে তাদের অধিকাংশকে সহজেই পুরো মুসলমান করা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে বাঙলাদেশে প্রায় তিন লক্ষের মতো বাউল রয়েছে। ওয়াহাবী-ফরায়েজী ও আহলে হাদীস আন্দোলনের ফলে মুসলমান বাউলের অনেকে উনিশ-বিশ শতকে শরীয়তী ইসলামে ফিরে এসেছে, তেমনি ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে হিন্দু বাউল-সন্তানও ব্রাহ্মণ্য আচার বরণ করেছে। নইলে বাঙলার বিশেষ করে মধ্য, উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের, এককথায় পদ্মার ওপারের নিম্নশ্রেণীর বাঙালির মধ্যে বাউলের সংখ্যা নগণ্য ছিল না।
বাউলধর্মে বৈরাগ্য নেই। বাউলেরা মুখ্যত তাত্ত্বিক, গৌণত প্রেমিক। এই তাত্ত্বিকতা অনেককেই বিষয়ে অনাসক্ত রাখে। তাই বাউল দুই প্রকার : গৃহী (বিষয়ী গৃহী) ও বৈরাগী (অনাসক্ত গৃহী)। বাউল বৈরাগীরা সাধারণত ভিক্ষাজীবী। বাউল মত বাঙলার ধর্ম, বাঙালির ধর্ম, একান্তভাবেই বাঙালির মানস ফসল। দেশী ভাবে ও বিদেশী প্রভাবে এর উদ্ভব। সমাজের উপরতলার লোকের ধর্ম হলে এই মতবাদ যে কেবল বাঙালির জীবন ও ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করত তা নয়, দুনিয়ার মানুষের কাছে উদার মানবিকতার জন্যে বাঙালিকে শ্রদ্ধেয়ও করে তুলত।
বাউল নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদ আছে। নামটি বাউলদের স্বপ্রদত্ত নয়। পনেরো শতকের শেষপাদের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের এবং ষোলো শতকের শেষপাদের চৈতন্যচরিতামৃতে ক্ষেপা ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে বাউল শব্দের আদি প্রয়োগ পাওয়া যায়। চৈতন্যদেবের কাছে প্রেরিত অদ্বৈতাচার্যের একটি হেঁয়ালিতেও বাউল শব্দের প্রয়োগ দেখেছি। রাঢ় অঞ্চলে এখনো বাউলকে ক্ষেপা বলে। কেউ বলেন বাউর (এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল) থেকেই বাউল নামটির উৎপত্তি হয়েছে। অবশ্য উত্তরভারতের বাউরার সঙ্গে আমাদের বাউল-এর যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। তবু আকুল থেকে আউল এবং ব্যাকুল থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তিও অসম্ভব নয়। আবার কেউ কেউ বলেন–এ মতের উদ্ভব যুগে দীন-দুঃখী, উলঝুল একতারা বাজিয়েদেরকে লোকে বাতুল বলে উপহাস করত। এ বাতুল শব্দ থেকে বাউল নামের উদ্ভব। কারুর কারুর মতে বায়ু শব্দের সঙ্গে স্বার্থে ল যুক্ত হয়ে, বায়ুভোজী উন্মাদ কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়ার দ্বারা সাধনাকারী অর্থে বাউল শব্দ তৈরি হয়েছে। ডক্টর ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বাউল শব্দটি আউল শব্দজ বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, আউল আরবি আউলিয়া (ওলির বহুবচন) সস্তৃত। ডক্টর সৈয়দ আবদুল হালিমের মতে আউল শব্দটি আউয়াল শব্দজ। আগমের আরবি পরিভাষা হিসেবে আউয়াল শব্দটি গ্রহণ করে মুসলমান আগমতাত্ত্বিকেরা আউয়াল বা আউল নামে পরিচিত হয়। অবশ্য আগম-এর আরবি পরিভাষা আউয়াল-এর আউল রূপে বহুল প্রয়োগ বাউল গানে দেখা যায়। উপরোক্ত এ কয়টি ব্যাখ্যার কোনটাই উড়িয়ে দেবার মতো নয়। তবে ব্যাকুল বা বাতুল থেকেই বাউল নামের উদ্ভব বলে অনুমান করি। আমাদের এ অনুমানের পক্ষে একটি যুক্তি এই যে, সমাজের উঁচুস্তরে বাউলেরা কোনো কালেই শ্রদ্ধা বা মর্যাদার আসন পায়নি। তাই মনে হয়, ব্যাকুল (ভাবোন্মত্ত) কিংবা বাতুল (অপদার্থ) অর্থে উপহাসস্থলে তাদের এই নামকরণ হয়েছে। আর আউয়াল থেকে আউল শব্দের উদ্ভবের সম্ভাব্যতাও সহজে অস্বীকার করা যায় না। আবার বাউল মতের আদি প্রবর্তক বলে খ্যাত ব্যক্তির নামটিও আউলাদ। হয়তো আউয়ালবাদী (আগম-বাদী) বলেই তার নাম আউল চাঁদ। কিংবা গোড়ার দিকে আউল চাঁদের অনুসারীরাই ছিল আউল নামে পরিচিত।
সম্প্রতি অধ্যাপক এস. এম. লুৎফর রহমান তার বাউল শব্দের উৎপত্তি ও ব্যাখ্য নামের প্রবন্ধে৮ বাউল নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নতুন তথ্য দান করেছেন। তিনি অবহট্ট রচনায় ও চর্যাগীতিতে ব্যবহৃত বাজিল, বাজুল, বাজির, বাজ্জিল শব্দগুলোকে বাউল শব্দের পূর্বরূপ বলে নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে বজ্ৰী > বজ্জির > বাজির>বজ্জিল > বাজিল > বাজুল > বাউল। অবশ্য বজ্রযানী বৌদ্ধ যদি বজ্ৰকুল নামে অভিহিত হত বলে অনুমান করা সম্ভব হয়, তাহলে বজ্ৰকুল থেকে বাউল হওয়া আরো সহজ। যেমন বজ্রকুল > বজ্জউল > বাজুল > বাউল। যা হোক, বাউল যে বজ্রযানী নির্দেশক, সে সম্পর্কে আমাদেরকে নিঃসংশয় করার গৌরব অধ্যাপক লুৎফর রহমানের প্রাপ্য।
বাউল গান তাত্ত্বিক রচনা–তত্ত্বসাহিত্য। স্বল্পশিক্ষিত লোকের রচনা বলে এগুলো লোক সাহিত্যের উপর উঠতে পারেনি। বৈষ্ণবপদাবলী যেমন আঙ্গিক সৌষ্ঠবে, ভাবের সুষম অভিব্যক্তিতে, কাব্যরসে, শিল্পসৌন্দর্যে, ছন্দলালিত্যে ও সুচিত শব্দ-সম্পদে উকৃষ্ট কবিতার লাবণ্য লাভ করেছে, বাউল গান তেমন নয়। আঙ্গিকে, ছন্দে ও অভিব্যক্তির অসঙ্গতিতে ও শিল্পরুচির অভাবে এসব রচনা কবিতার পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেনি। অবশ্য ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। বিশেষ করে লালন, পাঞ্জ, হাউরে, মদন, যাদুবিন্দু প্রভৃতি কয়েকজনের রচনায় কাব্য-মাধুর্য দুর্লভ নয়। সাহিত্য হিসেবে বিচার করলে বাউল গান লালিত্য-বিরল লোকগীতিমাত্র, আর কিছু নয়। সুরের একঘেয়েমিও তত্ত্ব-বিমুখ শ্রোতার পক্ষে পীড়াদায়ক। বাউল গানের কদর আছে ভাবুক ও তত্ত্বপ্রিয় লোকের কাছে এবং তা গান হিসেবে নয়–তত্ত্বকথার আশ্রয় হিসেবে। বাউলেরা গানকে তত্ত্বপ্রচারের, ভজনের ও আত্মবোধনের কাজে লাগায়। গানের প্রথম চরণেই সাধারণত মূল বক্তব্যের আভাস মেলে এবং তার সৌন্দর্যও অবশ্য স্বীকার্য।
সব গুহ্য সাধনাই যোগ-নির্ভর। তাই এখানে যৌগিক সাধন প্রণালীর স্কুল পরিচয় দেয়া হল : দেহের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য নাড়ি। তার মধ্যে তিনটে প্রধান–ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না; বা গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী। এ তিনটিকে মহানদী কল্পনা করলে অন্যসব হবে উপনদী বা স্রোতস্বিনী। এগুলো দিয়ে শুক্র রজ:, নীর-ক্ষীর-রক্ত প্রবহমান। এ প্রবাহ বায়ুচালিত। অতএব, বায়ু নিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করলেই দেহের উপর কর্তৃত্ব জন্মায়।
আবার শুক্র, রজঃ ও রক্ত হচ্ছে মিশ্রিত বিষামৃত–জীবনীশক্তি ও বিনাশ-বীজ, সৃষ্টি ও ধ্বংস, কাম ও প্রেম, রস ও রতি। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা পবনকে নিয়ন্ত্রণ করলে গোটা দেহের উপরই কর্তৃত্ব জন্মায়। প্রশ্বাস হচ্ছে রেচক, শ্বাস হচ্ছে পূরক এবং দম অবরুদ্ধ করে রাখার নাম কুম্ভক। ইড়া নাড়িতে পূরক, পিঙ্গলায় রেচক করতে হয়। দম ধরে রাখার সময়ের দীর্ঘতাই সাধকের শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ। এর নাম প্রাণায়াম।
ললাট-দেশে আছে সহস্রদল পদ্ম। নাম সহস্রার। মূলাধারস্থ কুণ্ডলিনী শক্তির সঙ্গে এখানে পরমশিবের মিলন হয়। কুণ্ডলিনী হচ্ছে সাড়ে তিন চক্র করে থাকা মূলাধারস্থ সর্প। এটি রজ:বিষ বা কামবিষের প্রতীক। বিষকে অমৃতে পরিণত করে স্থায়ী আনন্দলাভ করাই সাধ্য।
এমনি অবস্থায় দেহ হয় ইচ্ছাধীন। এখন যে-শুক্রের স্থলনে নতুন জীবন সৃষ্টি হয়, সেই শুক্রকে নাড়িমাধ্যমে উধ্বে সঞ্চালিত করে তার পতন-স্খলন রোধ করলেই শক্তি সংরক্ষিত হয়। সেই সঞ্চিত শুক্র শরীরে জোয়ারের মতো ইচ্ছানুরূপ প্রবহমান রেখে স্থায়ী রমণ-সুখ অনুভব করাও সম্ভব।
যোগে সিদ্ধিলাভ হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি অর্জন। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগে তখন মানুষ অসামান্য শক্তির অধিকারী হয়ে অসাধ্য সাধন করে। শুক্র থাকে লিঙ্গের কাছে। সেটাকে প্রজনন শক্তির প্রতীক সর্পস্বরূপ মনে করা হয়েছে। কুণ্ডলীকৃত সুপ্ত সর্পের কল্পনাই কুণ্ডলিনী নাম পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কাম বিষ। কাম বিষ-রূপ সৃষ্টিশীল শুক্র স্থলনেই সৃষ্টি সম্ভব। শুক্রই জীবনীশক্তি। কাজেই সৃষ্টির পথ রোধ করা দরকার। ফলে শক্তি ব্যয় হবে না। আর শক্তি থাকলেই জীবনের বিনাশ নেই। মূলাধার থেকে তাই শুক্রকে নাড়ির মাধ্যমে ঊর্ধ্বে উত্তোলন করে ললাট-দেশে সঞ্চিত করে রাখলেই ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ প্রয়োেগ সম্ভব। এটিই সামরস্য, সহজাবস্থা, চিররমণানন্দাবস্থা বা সচ্চিদান্দাবস্থা–শিব-শক্তি, প্রজ্ঞা-উপায় বা রাধাকৃষ্ণের অন্বেয় সংস্থিতি। এটিই সিদ্ধি। আজকে যুক্তিপ্রবণ মনে এর একটি অনুমিত ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে এরূপ অস্বাভাবিক জীবনচর্যার ফলে একপ্রকার মাদকতা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, আর তাতেই তারা হয়তো মনে করে যে তারা অতিমানবিক শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং আত্মিক অমরত্ব লাভ ঘটেছে।
সাধনার তিনটে স্তর :১. প্রবর্ত, ২. সাধক ও ৩. সিদ্ধি।
১. প্রবর্তাবস্থায় যোগী সুষুম্নমুখে সঞ্চিত শুক্ররাশি ইমার্গে মস্তিষ্কে চালিত করার চেষ্টা পায়। এতে সাফল্য ঘটলে যোগী প্রেমের করুণারূপ অমৃতধারায় স্নাত হয়।
২. শৃঙ্গারের রতি স্থির করলে তথা বিন্দুধারণে সমর্থ হলে যোগী সাধক নামে অভিহিত হয়। তখন মস্তিষ্কে সঞ্চিত শুক্ররাশিকে পিঙ্গলা পথে চালিত করে সুষুম্নমুখে আনে। ফলে বিন্দু আজ্ঞাচক্র থেকে মূলাধার অবধি স্নায়ুপথে জোয়ারের জলের মতো উচ্ছ্বসিত প্রবাহ পায়। এতে প্রেমানন্দে দেহ প্লাবিত হয়। এর নাম তারুণ্যামৃত ধারার মান।
৩. এর ফলে সাধক ইচ্ছাশক্তি দ্বারা দেহ-মন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পায় এবং ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না নাড়িপথে শুক্র ইচ্ছামতো চালু রেখে অজরামরবৎ বোধগত সামরস্যজাত পরমানন্দ বা সহজানন্দ উপভোগ করতে থাকে। এরই নাম লাবণ্যমৃত পারাবারে স্নান। এতে স্কুল শৃঙ্গারের আনন্দই স্থায়ীভাব স্বরূপ শৃঙ্গারানন্দ বা সামরস্য লাভ করে। প্রাণায়ামাদি যোগাভ্যাস দ্বারা দেহরূপ দুগ্ধভাণ্ড শৃঙ্গার-রূপ মথনদণ্ড সাহায্যে প্রবহমান নবনীতে পরিণত করা যায়। এর ফলে জরা-গ্লানি দূর হয় এবং সজীবতা ও প্রফুল্লতা সদা বিরাজমান থাকে।