বাউলা কে বানাইলরে
তিনি ছিলেন একজন ছোটখাট রাজা, অসম্ভব ক্ষমতাবান এক সামন্ত প্রভু। সামন্ত প্রভুদের অনেক বিচিত্র স্বভাব থাকে, তারও ছিল। গভীর রাতে তিনি রূপবতী। সঙ্গিনীদের নিয়ে বজরায় উঠতেন। বজরা নিয়ে যাওয়া হত মাঝ হাওড়ে। যেন। আশপাশে কেউ না থাকে। যেন তার বিচিত্র নিশিযাপন কেউ বুঝতে না পারে। শুরু হত গান। এক পর্যায়ে তিনি তার সঙ্গিনীদের বলতেন নাচতে। শুরু হত নাচ। প্রবল। তামসিক জীবন। শুধু ভোগ, শুধুই আনন্দ। এই তামসিক জীবন যিনি যাপন করে গেছেন তার নাম হাসন রাজা। ভয়াবহ তৃষ্ণা নিয়ে জীবনকে তিনি পান করেছেন। তারপরেও তৃষ্ণা মেটে না। ভোগে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেয়েছেন, বাউলা কে বানাইলরে, হাসন রাজারে?
হাসন রাজার প্রপৌত্র কবি মমিনুল মউজদীন আমাকে সুনামগঞ্জে যাবার আমন্ত্রণ। জানালেন। সুনামগঞ্জের মানুষ হাসন রাজাকে নিয়ে উৎসব করছেন। রাতভর তারা। শোনাবেন হাসন রাজার গান। কবি মমিনুল চাচ্ছেন আমি যেন সেই উৎসবে থাকি। একবার ভাবলাম, যাব না। উৎসব মানেই হৈ-চৈ। তাছাড়া আমাকে সেখানে নিশ্চয়ই বক্তৃতাও দিতে হবে। কি বলব আমি? হাসন রাজার গান শুনেছি–এই পর্যন্তই। আর কিছুই জানি না। বক্তৃতা দেয়ার জন্যে বিদগ্ন বক্তারা তো থাকবেনই। তারা মিসটিক কবি সম্পর্কে অনেক কিছু বলবেন। শুরুটা হবে মিসটিক শব্দের ব্যুৎপত্তি থেকে। গ্রীক কোন শব্দ থেকে এসেছে, এর সাধারণ মানে কি, আবার অসাধারণ মানে কি? দার্শনিক হিসেবে হাসন রাজার শ্রেণীভেদ করা হবে। তার সহজ প্রেমের গানগুলি যে। আসলে আধ্যাত্মিক গান, তা কঠিন সব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা হবে। ১৯৩১ সনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে The Religion of Man প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার গান। বিষয়ে কি বলেছিলেন তা বলা হবে। হংসসম এই সব পণ্ডিত বক্তাদের মাঝে আমি তো দলছুট বক। আমি কি করব?
খোলা মাঠে বসে রাতভর গান শুনতে পাব, খাঁটি গান। টিভি-রেডিও আর্টিস্ট। শহুরে বাউলদের গান না, আসল গান। সেই আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা কঠিন। তার উপর আছে হাসন রাজার বাড়ি দেখার লোভনীয় প্রস্তাব। যে বাড়ি নিয়ে তিনি লিখলেন, ঘরবাড়ি ভালা না আমার।
সমস্যা হল শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। সামনে ফেব্রুয়ারির বইমেলা। অনেককে নতুন বই দেব বলে রেখেছি। একটি পাণ্ডুলিপিও শেষ করতে পারিনি। যখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, তখন আমি সাহায্যের জন্যে যাই দৈনিক বাংলার সালেহ ভাইয়ের কাছে। তিনি নিজেও হাসন মেলায় যাচ্ছেন। আমার সমস্যাটা তিনি ভালই জানেন। সালেহ ভাই অনেক ভেবেচিন্তে বললেন, অসম্ভব, তোমার যাওয়াটা ঠিক হবে না। তুমি লেখালেখি করো।
আপনারা মজা করে গান শুনবেন, আর আমি লেখালেখি করব?
হ্যাঁ। প্রায়েরিটি বলে একটা কথা আছে। তোমার প্রথম প্রায়েরিটি হল লেখালেখি। দ্বিতীয় প্রায়েরিটি খোলা মাঠে গান শোনা। বুঝতে পারছ?
পারছি।
যখন তোমার লেখালেখির চাপ থাকবে না তখন তোমাকে হাসন রাজার বাড়ি দেখিয়ে আনব।
সালেহ ভাই আমাকে ফেলে সুনামগঞ্জ চলে গেলেন। আমার মন খারাপ হল। এবং মন খারাপ ভাব দূর করার জন্যে পরের রাতে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে ট্রেনে চেপে বসলাম। একা না, প্রায় জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছি কবি হাসান হাফিজকে। সফরসঙ্গী হিসেবে কবিরা মোটেই সুবিধার হন না। তারা অকারণে ভাব ধরে ফেলেন। তবে হাসান হাফিজ ব্যতিক্রম। কবি হলেও তার হাবভাব গদ্যকারের মত। ট্রেন ছাড়া মাত্র তিনি পকেট থেকে মার্লবোরো সিগারেট বের করে বললেন, মরমী কবি হাসন। রাজার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে আমরা এখন থেকে মার্কিন সিগারেট খাব। এবং ক্রমাগত হাসন রাজার গান গাইতে থাকব।
আমরা কেউই গান জানি না। তরুণ গায়ক সেলিম যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে। তাকে ধরে আনা হল। আমি বললাম, এখন থেকে ননস্টপ হাসন রাজার গান চলবে। শুরু কর। সেলিম সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলো,
নিশা লাগিলরে
বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে।
হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে…
আমি চমকে উঠলাম। কারণ এই গান নিয়ে আমার কিছু সুখ-স্মৃতি আছে।
কয়েক বছর আগে দেওয়ান গোলাম মোর্তজার স্মৃতি-উৎসবে যোগ দেবার জন্যে হবিগঞ্জ গিয়েছিলাম। থাকি সার্কিট হাউসে। রাত জেগে গল্পগুজব হয় বলে বেলা করে ঘুম ভাঙে। সেদিন কি যে হলো, সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমিও জেগে উঠলাম। প্রভাতের সূর্য দেখে আমি অবাক। সূর্যও সম্ভবত আমাকে দেখে অবাক। সকাল এত সুন্দর হয় কে জানতো! আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালার ওপাশে সকাল হওয়া দেখছি। আমার জন্যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখি এই কাক ডাকা ভোরে মায়াবী চোহারার এক তরুণী আমার ঘরের দরজার সামনে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি বললাম, কি ব্যাপার?
তরুণী ক্ষীণ গলায় জানালো, সে আমার জন্যে কিছু খাবার নিয়ে এসেছে। ঘরে বানানো সন্দেশ। আমাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াবে। তারপর একটা গান শোনাবে। সে আমাকে বিরক্ত করবে না। গানটা শুনিয়েই চলে যাবে। বলাই বাহুল্য, আমি অভিভূত হলাম। সকাল বেলায় আমি মিষ্টি খেতে পারি না। তারপরেও তিনটা সন্দেশ খেয়ে। ফেললাম। বললাম, এখন গান শোনাও। সে কিন্নর কণ্ঠে গান ধরলো,
নেশা লাগিলরে
বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিলরে।
হাসন রাজা পিয়ারীর প্রেমে মজিলরে।
গাইতে গাইতে মেয়েটির চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছতে মুছতে বলল, এটা হাসন রাজার একমাত্র প্রেমের গান। আমার খুব প্রিয়। আমি যতবারই গাই, ততবারই কাদি। আপনি যদি আপনার কোন নাটকে গানটা ব্যবহার করেন, আমার খুব ভাল লাগবে।
এর পরপরই আমি অচিন বৃক্ষ নামে একটা টিভি নাটক লিখি। সেখানে হতদরিদ্র প্রাইমারী স্কুলের এক মাস্টার সাহেবের অসুস্থ স্ত্রী এই গানটি করেন। গানটা যখন টিভিতে রেকর্ড করা হচ্ছে, তখন আমি অবাক হয়ে দেখি, আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সেই দিনই মনে মনে ঠিক করি, হাসান রাজার সব গান শুনব। ক্যাসেটের দোকানে দোকানে কদিন খুব ঘুরলাম। অনেকে হাসন রাজার নামও শোনেনি। অল্প কিছু গান পাওয়া যায়–লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ী ভালা না আমার, মাটির। পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়া রে। গাতক কাউকে পেলেই জিজ্ঞেস করি, হাসন রাজার গান জানেন?
বেশির ভাগ সময়ই উত্তর শুনি, না।
একদিন এক বাউল আমাকে চমকে দিয়ে গাইলেন, আঁখি মুঞ্জিয়া দেখ রূপ রে। আমার চমকাবার কারণ হচ্ছে, এই গান আমি আমেরিকায় শুনেছি। বিখ্যাত একটা গান–Close your eyes and try to see.
কবি চোখ বন্ধ করে দেখতে বলছেন। আর হাসন রাজা বলছেন, চোখ বন্ধ করে রূপ দেখতে। কি সুন্দর কথা! কি অপূর্ব বাণী।
গভীর আবেগ ও গভীর ভালবাসায় হাসন রাজার দেশে পা রাখলাম। উৎসব প্রাঙ্গণ। লোকে লোকারণ্য। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এসেছে গান শুনতে। হাসন রাজা তাদের ভালবেসেছিলেন। তারা সেই ভালবাসা ফেরত দিতে চায়।
সভাতে আমাকে বলা হল, হাসন রাজাকে নিয়ে একটা নাটক লিখতে। আমি বললাম, অবশ্যই আমি এই কবির বর্ণাঢ্য জীবন নিয়ে একটা নাটক লিখব।
সভা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছি। স্থানীয় এক ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন, উনাকে নিয়ে আপনি নাটক লিখবেন? আপনি কি জানেন উনি লম্পট ছিলেন?
আমি বললাম, জানি। হাসন রাজা নিজেই তার গানে লিখে রেখে গেছেন। না জেনে উপায় কি?
হাসন রাজা নিজে বলেছেন তিনি লম্পট?
হ্যাঁ, গানটা হল, সর্বলোকে জানে হাসন রাজায় লম্পটিয়া।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আমি বললাম, হাসন রাজার মত আরো কিছু লম্পট থাকলে কত ভাল হত, তাই না ভাই?
রাত দুটোর দিকে বিরাট দলবল নিয়ে আমরা হাসন রাজার কবর দেখতে গেলাম। গান গাইতে গাইতে যাচ্ছি–বাউলা কে বানাইলরে?
কবরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালাম। কবরের গায়ে লেখা–
লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি ভালা না আমার
কি ঘর বানাইব আমি শূন্যের মাঝার।
আমি মনে মনে বললাম, হাসন রাজা, আমার গভীর ভালবাসা তোমাকে জানানোর জন্যে আমি তোমার কাছে এসেছি। তুমি আমার ভালবাসা গ্রহণ কর। তোমাকে যিনি বাউলা বানিয়েছেন, আমাকেও তিনি বাউলা বানিয়েছেন। তুমি তোমার প্রাণপুরুষকে খুঁজে পেয়েছিলে। আমি পাইনি। আমি এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছি।*
———-
* হাসন রাজার গান ‘নিশা লাগিল রে’ আমি আমার ছবি আগুনের পরশমনিতে অতি সম্প্রতি ব্যবহার করেছি।