বাউণ্টি হাণ্টার্স ২.২

নয়

ইংলিশ চ্যানেল।

স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। নিউ ইয়র্ক সময় অনুযায়ী সকাল সাড়ে এগারোটা।

মস্ত শকুনের মতই সুপারট্যাঙ্কারের ডেকের দশফুট উপরে নেমে এল সুখোই ফাইটার বিমান; ভাসতে লাগল ভ্রমরের মত। উজ্জ্বল ফ্লাডলাইটে ওটাকে মনে হলো ভয়ঙ্কর টেরোডাকটিল।

খুলে গেল কালো শকুনের বম বে, রেপেল করে ডেকে নেমে এল তিন মূর্তি: মাসুদ রানা, কুয়াশা ও নিশাত সুলতানা।

প্রত্যেকে সশস্ত্র। হাতে এমপি-৭, গ্লক পিস্তল অথবা দোনলা পার্ডি শটগান। এসবই পাওয়া গেছে পোল্যাণ্ডের হাউন্টি হান্টার পোলিশের বিমানের হোল্ডে। রঘুপতির বাম পা-র উরু খুলে রানা ও নিশাতের জন্য দুটো ভেস্ট বের করে দিয়েছে কুয়াশা। ভেস্টদুটোর পকেট ভরা নানান যন্ত্রপাতি ও অস্ত্র।

এমভি লোটাসের দীর্ঘ ফোরহেড-এ নেমেছে ওরা, সামনেই কন্ট্রোল টাওয়ার। বিকট আওয়াজ তুলে ওদের মাথার উপর থেকে বৃষ্টিভেজা আকাশে হারিয়ে গেল কালো শকুন।

পরের সেকেণ্ডে ওদের চারপাশে ফুলকি তুলল অসংখ্য। বুলেট।

কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করছে দুই স্নাইপার।

.

নিউ ইয়র্ক বে, ইস্ট কোস্ট, আমেরিকা।

আটলান্টিকের আরেকপ্রান্তে একইসময়ে সুপারট্যাঙ্কার এমভি করপোরেশনে ঝটিকা হামলা করেছে খবির এবং মেরিন যোদ্ধারা।

রানাদের মতই, যিপলাইন ব্যবহার করে কপ্টার থেকে নেমে এসেছে সুপারট্যাঙ্কারের ফোরডেকে।

রানার দলের মত করেই ভারী গুলিবর্ষণের মুখে পড়ল ওরা।

কিন্তু রানাদের মত আঁধার ও বৃষ্টির কারণে সুবিধা পাওয়ার উপায় নেই খবিরদের। সকাল সাড়ে এগারোটা। কটকটে রোদে কুঁচকে যাচ্ছে চোখের পাতা।

করপোরেশনের ব্রিজে অপেক্ষা করছিল দুই স্নাইপার, খবিররা দড়ির শেষে নেমে আসবার আগেই গুলি শুরু করেছে তারা।

সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়েছে দুই মেরিন, মৃত। ধুপ করে ডেকে পড়েই পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করল খবির।

.

স্যান ফ্রান্সিসকো, ওয়েস্ট কোস্ট, ইউএসএ।

পশ্চিম উপকূলে সুপারট্যাঙ্কার এমভি রুবল দখল করতে ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ছে কেভিন কনলনের সঙ্গী মেরিনরা।

কন্ট্রোল টাওয়ারের দুই স্নাইপারের তরফ থেকে পাল্টা গুলি আসেনি।

আগেই স্কট মোসলের সৈনিকরা বুঝে গিয়েছিল অ্যাম্বুশ হবে।

সুপার স্ট্যালিয়নের দরজা থেকেই দলের ক্র্যাক শুটার গেঁথে ফেলেছে দুই শত্ৰু স্নাইপারকে।

সুপারট্যাঙ্কারের কন্ট্রোল টাওয়ারের ছাতে ধুপধাপ নেমে এসেছে সবাই। কেভিনকে মাঝে আগলে রেখে ঝটিকা হামলা শুরু করেছে মেরিনরা।

জাহাজের হাই ভিজিবিলিটি ব্রিজ উইণ্ডোর পাশে স্নাইপারদের লাশ পেল ওরা।

দুই স্নাইপার কৃষ্ণ বর্ণের। পরনে আফ্রিকার খাকি মিলিটারি ফ্যাটিগ।

লাশদুটোর কাঁধের ইনসিগনিয়া অবাক করল মোসলেকে। আসলে হচ্ছেটা কী?

দুই স্নাইপারের পোশাকে যে ব্যাজ রয়েছে, তা ইরিত্রিয়ান আর্মির।

.

ইংলিশ চ্যানেল।

ঝলসে উঠেছে বিদ্যুচ্চমক। সুপারট্যাঙ্কারের খোলে এসে পড়ছে প্রকাণ্ড সব ঢেউ। মাঝে মাঝেই সৎ করে নীল-হলুদ বজ্র নেমে আসছে সাগরের বুকে, সেই সঙ্গে বিকট গর্জন। ফোরডেকে লেগে পিছলে নানাদিকে ছুটছে অসংখ্য বুলেট।

এমভি লোটাসের ব্রিজ লক্ষ্য করে গুলি করছে কুয়াশা ও নিশাত, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে গেঁথেও ফেলল দুই স্নাইপারকে।

আগেই বোঝা উচিত ছিল জাহাজে গার্ড রাখবে ডেমিয়েন ডগলাস, অন্য দুজনের পাশে ছুটবার ফাঁকে বলল রানা। ফোরডেক পেরিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ারের দরজা লক্ষ্য করে ছুটছে।

গলা উঁচিয়ে জানতে চাইল নিশাত, এরা কারা? কাদের পাহারা দিতে পাঠিয়েছে?

টাওয়ারের দিকে ছুটতে গিয়ে ওরা পেয়ে গেল একটা অ্যাক্সেস হ্যাচ, ওটা খুলল রানা। চমকে গেল কানফাটা অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজে। হ্যাঁচের পাশেই দীর্ঘ মই, নেমেছে জাহাজের বিশাল মিসাইল হোল্ডে।

মইয়ের শেষে কী ঘটছে দেখে আগ্রহী হয়ে উঠল রানা ও কুয়াশা।

গোলাগুলি চলছে ওখানেই।

অবাক চোখে রানা ও কুয়াশা দেখল, কালো পোশাক পরা একদল কমাণ্ডো লড়ছে। হাতে উযি এবং এম-১৬ রাইফেল। নিখুঁত মুভমেন্ট। গুলি করছে অচেনা একদল শত্রুকে লক্ষ্য করে।

আবারও হ্যাচ আটকে দিল রানা। চাপা স্বরে বলল, আমরা। বোধহয় অন্যের লড়াইয়ে নাক গলাতে যাচ্ছিলাম।

নীচে কী দেখলেন, স্যর? চেঁচিয়ে জানতে চাইল নিশাত।

আমরা এই সুপারট্যাঙ্কারে প্রথম পার্টি নই, বলল রানা।

অ্যাঁ? তা হলে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ছে নীচে ওরা কারা?

চোখে চোখে কুয়াশার সঙ্গে কথা হলো রানার। খুব কম এলিট ইউনিট আজও উযি ব্যবহার করে, বলল কুয়াশা। ওরা ইজরায়েলি ফোর্স।

আমিও একমত, বলল রানা।

আপনারা একটু খুলে বলবেন, আসলে কী হচ্ছে, রেগেই গেল নিশাত। বৃষ্টির ভিতর নকল পা ঠুকল ডেকে।

আমার ধারণা, বলল রানা, আমাদের আগে এমন এক লোক এসে জাহাজে উঠেছে, যার ক্ষমতা আছে টাচলক সিকিউরিটি সিস্টেম ডিসআর্ম করার। সে ইজরায়েলি এয়ার ফোর্সের আব্রাম অ্যামনন। সঙ্গে এসেছে ইজরায়েলের সেরা ট্রপ–সায়ারেত তিযামহিম।

আজকের দিনটাই অদ্ভুত, বিরক্ত হয়ে বলল নিশাত। আজিব, এমন কী ইজায়েলিরাও আজকে আমাদের পক্ষে লড়ছে! এরপর কী যে হবে, স্যর! প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল ওর কণ্ঠ।

চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা। পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। নিউ ইয়র্কে এগারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিট।

আর মাত্র দশ মিনিট পর লঞ্চ করা হবে নিউক্লিয়ার মিসাইল।

নীচে খুনাখুনি করুক ইজরায়েলিরা, অ্যামনন মিসাইল ডিসআর্ম করে হিরো হলে আমার কোনও আপত্তি নেই, মৃদু হাসল রানা। আমাদের কাজ এখন টাওয়ারে যাওয়া। ওই স্নাইপারদের দেখতে চাই। জানতে চাই তারা কারা, কাদের বিরুদ্ধে লড়ছি। দরকার পড়লে গিয়ে সাহায্য করব অ্যামননের দলকে।

কয়েক সেকেণ্ডে টাওয়ারের সামনে পৌঁছে গেল ওরা, মাত্র দরজা খুলেছে রানা, এমনসময় চোখ ধাঁধানো আলো পড়ল ওদের উপর। মাথার উপরে সার্চলাইট জ্বেলেছে হেলিকপ্টার।

ঝট করে ঘুরে চাইল রানা, মুখে এসে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা। যাহ, মুশকিল, বিড়বিড় করে বলল।

এক শ গজ দূরে সুপারট্যাঙ্কারের ফোরডেকে অত্যুজ্বল সাদা আলো নিয়ে নামছে চোরাই মাল, অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার।

এক সেকেণ্ড পর ডেকে নেমে এল ওটা।

লাফ দিয়ে কপ্টার থেকে ডেকে নামল তিনজন লোক, পরনে রাশান ব্যাটল-ড্রেস ইউনিফর্ম, হাতে স্করপিয়ন মেশিন পিস্তল…

স্পেত্ৰ্যায কোবরা ইউনিটের মিখাইল পেদরোনভ, এবং তার দলের অবশিষ্ট দুই সদস্য।

ধ্যাৎ, ভুলে গিয়েছিলাম, নিচু স্বরে বলল কুয়াশা। এখনও পুরস্কার আছে তোমার মাথার ওপর, রানা। ওই যে মিখাইল পেরোনভ।

ঝটপট কন্ট্রোল টাওয়ারে ঢুকে পড়ল ওরা। বেশ কয়েকটা মইয়ের মত ধাপ পেরিয়ে ব্রিজে উঠে এল।

রানা চট করে দেখল ঘডি; পাঁচটা ছত্রিশ মিনিট।

কানে কনলনের কণ্ঠ শুনল: মেজর, স্যান ফ্রান্সিসকোর সুপারট্যাঙ্কার দখল করে নিয়েছি আমরা। চার স্নাইপার ছিল, পরনে ইরিত্রিয়ান আর্মির ইউনিফর্ম। আর…

দুই স্নাইপারের লাশের পাশে পৌঁছে গেছে রানা, কিছুই শুনছে না।

এই দুজন আফ্রিকান সৈনিক। কমাণ্ডো। খাকি ফ্যাটিগ।

কালো হেলমেট।

কাঁধে একটা ক্রেস্ট। কিন্তু ওটা ইরিত্রিয়ার ক্রেস্ট নয়।

এদের ক্রেস্ট নাইজেরিয়ান আর্মির এলিট কমাণ্ডো ইউনিট প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডের।

আফ্রিকার অসংখ্য গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছে নাইজেরিয়ান প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড, তাদের খুনি হওয়ার ট্রেনিং দিয়েছিল সিআইএ। শুধু যে অন্য দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল তাই নয়, নাইজেরিয়ান নাগরিকদের বিরুদ্ধেই নামিয়ে দিয়েছিল। ল্যাগোস ও আবুজা-র মানুষ আজও প্রেসিডেনশিয়াল গার্ডদের চেনে আরেকটি নামে: দ্য ডেথ স্কোয়াড।

এরাই ডেমিয়েন ডগলাসের প্রোটেকশন টিম। ব্রিজে ছিল এই দুজন স্নাইপার। ডেকের নীচে রয়েছে আরও সৈনিক, পাহারা দিচ্ছে মিসাইল সাইলো। হোল্ডে এখন এদের বিরুদ্ধেই লড়ছে ইজরায়েলিরা।

কেভিন, তুমি বলেছিলে ওই লোকগুলো ছিল ইরিত্রিয়ান।

ঠিকই শুনেছেন।

নাইজেরিয়ান নয়?

না। আমার সঙ্গী মেরিনরা তাই বলেছে। ইনসিগনিয়া ইরিত্রিয়ানই ছিল।

ইরিত্রিয়া… ভাবছে রানা।

স্যর, ডাকল নিশাত। খুলে ফেলেছে স্টোররুমের দরজা।

ছোট ঘরের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে চারটে বডি ব্যাগ। ঝটপট একটার যিপার টেনে খুলল নিশাত। কুঁচকে গেল নাক। মরা লাশের গা থেকে পচা গন্ধ আসছে। লোকগুলো গ্লোবাল জিহাদের টেরোরিস্ট।

এবার বুঝলাম, বলল রানা। ওদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে দোষ।

স্যাটালাইট মাইক চালু করল ও।

কেভিন, তোমার সঙ্গের মেরিনদের সতর্ক থাকতে বলো। জাহাজের মেইন হোল্ডে আরও আফ্রিকান সৈনিক থাকবে। তারা সাইলো পাহারা দিচ্ছে। সরি, কেভিন, লড়াই এখনও শেষ হয়নি। ওই সৈনিকদের পেরিয়ে তোমার স্যাটালাইট আপলিঙ্ক নিয়ে যেতে হবে মিসাইলের কন্ট্রোল কন্সেলের ষাট ফুটের ভেতর, নইলে আমি কিছুই ডিসআর্ম করতে পারব না।

বুঝলাম, বলল কেভিন। হারিয়ে গেল সিগনাল।

আমাদের হাতে সামান্য সময়, বলল নিশাত। কুয়াশার পাশে ব্রিজের জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখ খুঁজছে। পেরোনভকে। কুয়াশার কাছে জানতে চাইল, লোকটাকে দেখছেন?

না। ইঁদুরটা গর্তে ঢুকেছে, বলল কুয়াশা। ওর টার্গেট হয়তো অ্যাব্রাম অ্যামনন।

হঠাৎ কানের ভিতর জোরালো স্বরে বলে উঠল রঘুপতি: বস, মিস্টার রানা, নতুন কন্ট্যাক্ট পেয়েছি, দ্রুত আসছে আপনাদের সুপারট্যাঙ্কারের দিকে। কোনও ধরনের বড় কাটার। দেখে মনে হচ্ছে ফ্রেঞ্চ কোস্ট গার্ড।

জানালার সামনে পৌঁছে গেল রানা, দূরে দেখতে পেল বড়সড় সাদা একটা জাহাজ। ওটা আসছে স্টারবোর্ডের দিকে।

ভীষণ শুকিয়ে গেছে গলা, টের পেল রানা।

ইজরায়েলি টুপ, নাইজেরিয়ান ডেথ স্কোয়াড, রাশান বাউন্টি হান্টার–এসব তথ্য হজম করেই ভাবছিল এরপর কী করবে, এখন হাজির হচ্ছে ফ্রেঞ্চ মেরিটাইম পুলিশ!

না, ওটা কোস্ট গার্ডদের জাহাজ নয়, নাইট ভিশন বিনকিউলারে চোখ রেখেছে কুয়াশা।

পরিষ্কার দেখছে বড়সড় কাটার জাহাজটা মস্ত বড় ঢেউ চিরে আসছে- বোটা ছুরির মত চোখা, দীর্ঘ ফোরডেকে কামান, হুইল হাউসটা কাঁচে ঘেরা। হুইলহাউসের জানালার কাঁচে ছলকে লেগেছে রক্ত।

হুইলের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র লোক।

ওই জাহাজ নিয়ে আসছে ডেভিড এন. হেন্ড্রিক, বলল কুয়াশা।

চট করে রানা আরেকবার ঘড়ি দেখল। পাঁচটা আটত্রিশ। সাত মিনিট পর লঞ্চ করা হবে মিসাইল।

আরও বাউন্টি হান্টার, বিড়বিড় করল রানা। পরক্ষণে বলল, রঘুপতি, ওদেরকে ঠেকাতে পারবে?

না, মিস্টার রানা। আমার কোনও মিসাইল অবশিষ্ট নেই।

বুঝলাম, ঝড়ের গতিতে ভাবতে শুরু করেছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ঠিক আছে, রঘুপতি, আগের ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী কাজ করো। আমরা যদি সঠিক সময়ে মিসাইল ডিসআর্ম করতে না পারি, তোমার সাহায্য নিয়ে সরে যেতে হবে।

জী, মিস্টার রানা।

ঘুরে দাঁড়াল রানা। ভাবছে, কিন্তু বুঝে উঠছে না কী করবে।

সব ঘটতে শুরু করেছে বড় দ্রুত। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে পরিস্থিতি। ডিসআর্ম করতে হবে মিসাইল, জাহাজে উঠেছে ইজরায়েলিরা, নাইজেরিয়ান ট্রপস, হাজির হয়েছে রাশান আর ব্রিটিশ বাউন্টি হান্টাররা…

ভাবো, রানা! ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করো! মনে মনে বলল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর মনস্থির করল। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, এসবের ভেতর দিয়ে কী পেতে চাও তুমি? …পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের আগেই মিসাইল ডিসআর্ম করতে চাই। আর সবকিছু জাহান্নামে যাক!

ব্রিজের পিছনে এলিভেটারের উপর চোখ পড়ল ওর।

আমরা হোল্ডে নামছি, সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল। চট করে দেখে নিল ঘড়ি: পাঁচটা উনচল্লিশ।

দশ

নিউ ইয়র্ক বে।

স্থানীয় সময় এগারোটা ঊনচল্লিশ মিনিট।

ঝকমকে রোদেলা সকালে সুপারট্যাঙ্কারের ফোরডেকে ডাইভ দিয়ে কাভার নিল খবির ও তার সঙ্গীরা।

হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়ল খবির ডেক হ্যাঁচের উপর। ওখান থেকে নামল দীর্ঘ মই বেয়ে।

নীচে প্রায় অন্ধকার। খবিরের পিছনে আসছে মেরিন এস্কোর্ট। মেঝেতে নেমে এসেই চট করে চারপাশ দেখে নিল খবির।

প্রকাণ্ড গুহার মত হোল্ড। জায়গাটা দৈর্ঘ্যে হবে কমপক্ষে তিন শ গজ। অন্ধকারে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে চুরুট আকৃতির মিসাইল সাইলোগুলো। যেন মস্ত সব পিলার ধরে রেখেছে ছাত।

একেবারে শেষ সাইলোর সামনে ব্যারিকেড তৈরি করেছে সশস্ত্র একদল কৃষ্ণ বর্ণের আফ্রিকান কমাণ্ডো। ব্যারিকেড মজবুত করবার জন্য ব্যবহার করেছে স্টিলের ক্রেট ও ফোর্ক-লিফট।

.

ইংলিশ চ্যানেল।

পাঁচটা ঊনচল্লিশ।

এলিভেটারের দরজা খুলে যেতেই দেখা গেল সুপারট্যাঙ্কারের মেইন হোন্ড।

অস্ত্র বাগিয়ে বদ্ধ খুপরি থেকে বেরিয়ে এল রানা, কুয়াশা ও নিশাত।

মিসাইল হোল্ড অবিশ্বাস্য রকমের প্রকাণ্ড পর পর তিনটা ফুটবল মাঠ জুড়ে দিলেও জায়গা রয়ে যাবে। জাহাজের ফোরডেকের নীচে সামনের অর্ধেক জায়গা জুড়ে লিযার্ড মিসাইলের সাইলো: হাই রিএনফোর্সড় টাইটেনিয়াম সিলিণ্ডার। ভিতরে রয়েছে মানব সৃষ্ট সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র।

এবং জাহাজের সামনের দিকে চলছে তুমুল লড়াই।

শেষ দুই মিসাইল সাইলোর সামনে বাঙ্কার করেছে নাইজেরিয়ান কমাণ্ডোরা। কাভার করছে মিসাইল কন্ট্রোল কন্সোল–ডেক থেকে দশফুট উপরে স্টিলের স্ট্রাট দিয়ে তৈরি উঁচু প্ল্যাটফর্ম। মিসাইল ডিসআর্ম করতে হলে ওই জায়গার ষাট ফুটের ভিতর পৌঁছুতে হবে রানাকে।

খুবই মজবুত ব্যারিকেড করেছে নাইজেরিয়ানরা। ঝড়ের মত গুলি করছে মেশিনগান ব্যবহার করে, দরকার পড়লে ইজরায়েলি হামলাকারীদের উদ্দেশে গ্রেনেডও ছুঁড়ছে।

বুলেট ও গ্রেনেড লাগছে সাইলোর গায়ে, কিছুই হচ্ছে না পুরু টাইটেনিয়ামের।

ওই রণক্ষেত্র এবং রানার মাঝে রয়েছে অসংখ্য জিনিস: শিপিং কন্টেইনার, মিসাইল স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদি। এমন কী দুটো হলদে মিনি-সাবমেরিনও দেখল রানা। সিলিং ক্যাটওয়াক থেকে নেমে আসা শেকলে ঝুলছে ও-দুটো।

চিনতে পারল রানা।

মডিফায়েড এএসডিএস।

অ্যাডভান্সড় সিল ডেলিভারি সিস্টেম। সঙ্গে কাঁচের গম্বুজের মত হেমিস্ফেয়ারিক ককপিট। অগভীর সাগরে নামে, স্যাবোটাজ করা হয়নি তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিনের খোল পরীক্ষা করে ইউএস নেভি। নোয়ায শিপ-লিয়ার্ড প্রজেক্টে ব্যবহার করবার জন্য ওগুলো তৈরি করা হয়েছে।

চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা।

পাঁচটা চল্লিশ মিনিট।

একবার ইশারা করল রানা। ছুটতে শুরু করেছে। কুয়াশা ও নিশাত ওর পাশেই চলল। কুঁজো হয়ে খরগোশের মত ছুটছে ওরা। নানান সাপ্লাই জিনিসের ভিতর দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। চোখ রেখেছে যুদ্ধের উপর।

একইসময়ে জানের তোয়াক্কা না করে আক্রমণাত্মক হামলা শুরু করল ইজরায়েলিরা।

ডানদিক দিয়ে এগুচ্ছে তাদের কয়েকজন। নাইজেরিয়ানদের গুলি আকর্ষণ করছে। এই সুযোগে বামদিকের লোকগুলো শত্রু ব্যারিকেড লক্ষ্য করে পরপর তিনটে রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেড ছুঁড়ল।

মিসাইল হোল্ডের আকাশে ছুটে গেল গ্রেনেডগুলো… লেজে সাদা ধোঁয়ার মেঘ। একইসঙ্গে গেল তিন বোমা, লাগল নাইজেরিয়ান ব্যারিকেডে।

ফলাফল হলো নদীর পোক্ত বাঁধ ভেঙে পড়বার মতই।

ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আঘাতে পলকা পুতুলের মত বাতাসে ভেসে উঠল নাইজেরিয়ান কমাণ্ডোরা। আর্তচিৎকার করছে কয়েকজন। অন্যরা পুড়ে খাক হয়ে গেছে।

ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ল ইজরায়েলিরা, কোনও দয়া না দেখিয়ে খুন করতে লাগল নাইজেরিয়ান কমাণ্ডোদেরকে। গুলি করা হচ্ছে আহতদের মাথায় মাল ঠেকিয়ে।

ওই একইসময়ে হোল্ডের স্টারবোর্ডের দেয়ালে গুড়গুড় আওয়াজ তুলে খুলে যেতে লাগল প্রকাণ্ড স্টিলের একটা লোডিং ডোর। ওটাকে উপরে তুলছে রানারগুলো।

জোরালো ধুম্ আওয়াজ তুলে পুরো খুলে গেল মস্ত কবাট। আর সাগরের দিক থেকে ঠেলে দেয়া হলো স্টিলের বোর্ডিং প্লাঙ্ক। ষোড়শ শতাব্দীর জলদস্যুরা এভাবেই গ্যালিয়নে উঠে আসত।

চোরাই কোস্ট গার্ড জাহাজ থেকে বুটের ধুপধাপ আওয়াজ তুলে হোল্ডে এসে ঢুকল কন্টিনেন্টাল সোলজার বাউন্টি হান্টার দলের ৬৬ নম্বর ইউনিটের সদস্যরা। হাতের মেটালস্টর্ম রাইফেলগুলো আগুন উগলে দিতে শুরু করেছে।

চেয়ে আছে রানা: ৬৬ নম্বর ইউনিটের বাউন্টি হান্টাররা সংখ্যায় কমপক্ষে বিশজন, তাদের গুলিবর্ষণের সামনে কচুকাটা হতে লাগল ইজরায়েলি সায়ারেত তিযামহিমের সদস্যরা। এইমাত্র মিসাইল কন্ট্রোল কন্সেল দখল করেছিল তারা।

উঁচু কঙ্গেল প্ল্যাটফর্মের সামনে ছোট অর্ধচন্দ্র তৈরি করল লোকগুলো, প্রত্যেকে চেয়ে আছে জাহাজের পিছনদিক লক্ষ্য করে, যন্ত্রের মত গুলি করছে উযি ও এম-১৬ রাইফেল দিয়ে ৬৬ ইউনিটকে লক্ষ্য করে।

দুঃসাহসী লোকগুলোর দেয়া নিরাপত্তা নিয়ে স্টিলের প্ল্যাটফর্ম বেয়ে উঠে গেল এক লোক।

রানা ধারণা করল, এ লোকই আব্রাম অ্যামনন। সোজা কন্সেলের সামনে চলে গেল সে, হাতের ব্রিফকেস থেকে বের করল টাচলক-৯ ডিসআর্ম ইউনিট।

হারামজাদা ইজরায়েলিরা, তিক্ত স্বরে বলল নিশাত। আর সব তো চুরি করেই, এমন কী অন্য দেশের টেকনোলজিও হজম করে ফেলে।

যা করছে করুক, বলল রানা। দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশের হয়ে কাজ করছে এখন। আমরা রক্ষা করতে চাইব সায়ারেত তিযামহিমের সদস্যদেরকে। ওরা নজর রাখবে অ্যামননের ওপর।

আরেকবার হাতঘড়ি দেখল রানা।

পাঁচটা একচল্লিশ মিনিট।

ও একটা মিসাইল সাইলোর আড়াল থেকে উঁকি দিল রানা। ল্যাপটপের মত করেই টাচলক ইউনিট কোলে নিয়েছে অ্যাব্রাম অ্যামনন, স্ক্রিন থেকে বেরুচ্ছে আলো। টাচস্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে লোকটা। ডানহাতের আঙুলগুলো নেড়েচেড়ে নিল। বুঝতে পারছে, যে-কোনও সময়ে শুরু হবে ডিসআম সিকিউয়েন্স।

মিসাইল সিস্টেম ডিসআর্ম করবে অ্যামনন, ভাবল রানা। সামান্যতম হিংসাও এল না, ওর মনে। ভাবছে, সেক্ষেত্রে কোনও ঝামেলা ছাড়াই সরে যাব।

পরক্ষণে চমকে গেল রানা। দেখল, মিসাইল হোল্ডের উপর রাফটারে অ্যামননের কন্সেল প্ল্যাটফর্মের পিছনে হাজির হয়েছে তিন ছায়ামূর্তি।

এদেরকে দেখতে পায়নি সায়ারেত তিমহিমের সদস্যরা। ডেভিড এন. হেন্ড্রিকের দলের দিকে গুলি পাঠাতে ব্যস্ত।

না… ফিসফিস করল রানা। না… না…

• যিপলাইন ব্যবহার করে মাকড়সার মত নেমে এল ওই তিন ছায়ামূর্তি, গতি অবিশ্বাস্য।

পেপেরোনভ এবং তার কোবরা কমাত্তোরা।

জাহাজের ফোরডেকে বো-র কাছের এক হ্যাচ ব্যবহার করে নেমে এসেছে।

কাভার থেকে ছিটকে সরল রানা, গোলাগুলির আওয়াজের ভিতর অনর্থক, তবুও গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, তোমার পিছনে দেখো!

রানার কথাটা শুনতে পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাল অ্যামননকে রক্ষা করা কমাণ্ডোরা।

গুলি এল রানাকে লক্ষ্য করেই।

এমন কী অ্যামননও মুখ তুলে চাইল। আবারও মনোযোগ দিতে গেল ডিসআর্ম সিকিউয়েন্স-এ।

যেভাবে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল রানা, তার তিনগুণ গতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ও সাইলোর পিছনে। পরক্ষণে কাঁকড়ার মত চার হাত-পা ব্যবহার করে আবারও উঁকি দিল ওদিকে।

ওই একইসময়ে উঁচু প্ল্যাটফর্মে ব্যস্ত অ্যামননের কয়েক গজ পিছনে আস্তে করে নেমে এল তিন কোবরা কমাণ্ডো।

চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারল না রানা, হতবাক। ইজরায়েলিরা গুলি পাঠাচ্ছে এদিকে। অস্ত্রের মাযলে দপদপ করছে আগুন। নিঃশব্দে সামনে বাড়ল মিখাইল পেদরোনভ, কোমরের খাপ থেকে নিয়েছে কসাক ফাইটিং সোর্ড, এক সেকেণ্ড পর অ্যামননের ঘাড়ের পিছনে নেমে এল ক্ষুরধার তলোয়ার।

ওই মুহূর্তে বাউন্টি লিস্টের শেষতম জীবিত শিকার উঠল মাসুদ রানা। পৃথিবীর একমাত্র মানুষ, যে ডিসআর্ম করতে পারবে টাচলক-৯ মিসাইল সিকিউরিটি সিস্টেম।

অ্যামননের কাঁধ থেকে খসে পড়ল মাথা, তখনও ডিসআর্ম সিকিউয়েন্স চালুই করতে পারেনি।

ঢোক গিলল রানা, ব্যাঙের ডাকের মত শোনাল ওর কণ্ঠ: এবার?

সায়ারেত তিমহিমের এক সদস্য ঘাড় ফিরিয়ে চাইল, পরক্ষণে মস্ত হাঁ করল সে। এইমাত্র ধুপ করে কন্সেলের সামনের মেঝেতে পড়েছে মুণ্ডুহীন অ্যামননের ধড়। কলকল করে গড়াতে শুরু করেছে তাজা রক্ত। ইজরায়েলি কমাণ্ডো দেখল, এক লোক রাকস্যাকে পুরে ফেলেছে অ্যামননের মাথা। পরক্ষণে রিট্রাক্টবল যিপলাইন ব্যবহার করে সাঁই করে উঠে গেল হ্যাঁচের দিকে।

টাশ টাশ আওয়াজ তুলল দুটো অস্ত্র। অন্য দুই কোবরা কমাণ্ডে গুলি করছে ইজরায়েলি ট্রুপারদের মুখের উপর। ওই একইসময়ে ৬৬ ইউনিটের হেণ্ডিকের লোক উল্টো দিক থেকে উড়িয়ে দিল আরও দুই সায়ারেত তিযামহিম সদস্যকে।

দুদিক থেকে গুলির মুখে পড়ে অসহায় হয়ে গেল ইজরায়েলিরা। তাদের শত্রুরা প্রফেশনাল বাউন্টি হান্টার।

সায়ারেত তিযামহিম সদস্যদের অবশিষ্ট কয়েকজন খেয়াল করেছে অ্যামননের লাশ ফেলে উপরে রওনা হয়েছে কোবরা কমাণ্ডোরা। দ্বিধার ভিতর পড়ে এবং হেণ্ডিকের দলের তুমুল গোলাগুলিতে ফর্মেশন নষ্ট হয়ে গেল ইজরায়েলিদের।

কচুকাটা হলো তারা।

দেখতে না দেখতে তাদের সামনে পৌঁছে গেল ৬৬ ইউনিট। আহতদেরকেও ছাড়া হলো না, কয়েক সেকেণ্ডে শেষ হয়ে গেল ইজরায়েলি ফোর্সের শেষ সৈনিকও।

সাইলোর আড়াল থেকে চেয়ে আছে রানা। চট করে দেখে নিল ঘড়ি।

পাঁচটা বেয়াল্লিশ মিনিট।

ব্যারিকেডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ডেভিড এন. হেন্ড্রিক। তার ভাবচক্কর অন্যরকম হয়ে উঠল। যেন শত্ৰু ব্লকেড জয় করেছে এক জেনারেল। সিলিঙের দিকে আঙুল তাক করল সে। ওদিক দিয়েই রিট্রাক্টেবল যিপলাইন ব্যবহার করে বেরিয়ে গেছে। মিখাইল পেদরোনভ এবং তার দুই সঙ্গী। সঙ্গে নিয়ে গেছে মহামূল্যবান অ্যামননের মাথা।

.

কোবরা কমাণ্ডোরা পৌঁছে গেছে সিলিঙের কাছে, পাশেই চওড়া একটা কার্গো হ্যাচ।

হ্যাচ দিয়ে বেরিয়ে বৃষ্টি ভিতর ফোরডেকে পৌঁছে গেল পেরোনভের দুই সঙ্গী, একজনের হাতে কাটা মাথার ব্যাগ। দুই সেকেণ্ড পর টেনে তুলতে চাইল নেতাকে।

তখনই মেশিনগানের শতখানেক গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হলো। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি খেয়েছে, ছিটকে বেরোতে লাগল রক্তের ঝর্না।

৬৬ ইউনিটের একটি উপদল বৃষ্টির ভিতর অপেক্ষা করছিল। এমন হতে পারে তা আগেই ধারণা করেছিল ডেভিড এন. হেন্ড্রিক, আগে ভাগেই ফোরডেকে রেখেছে দ্বিতীয় টিম।

অ্যামননের মাথার ব্যাগ পড়েছে ডেকে, কাটা পড়া ঘুড়ির পিছনে ছুটন্ত বাচ্চা ছেলেদের মত ছুটে এল ৬৬ ইউনিটের সাব টিম। সামনের লোকটা খপ করে তুলে নিল সাধের ধন।

শত্রুরা সংখ্যায় অনেক বেশি, একাকী পেরোনভ লুকিয়ে পড়ল ফ্লোর লাইনের নীচে। শরীরে দোল দিয়ে পৌঁছে গেল কাছের ক্যাটওয়াকে। অনেক নীচে মিসাইল হোল্ড। কয়েক সেকেণ্ডে ছায়ার ভিতর মিলিয়ে গেল সে।

.

মিসাইল হোল্ডের পরিস্থিতি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে রানার কাছে।

মাত্র তিন মিনিট বাকি, এরপর রওনা হবে নিউক্লিয়ার মিসাইল। আব্রাম অ্যামনন শেষ, কন্ট্রোল কন্সেল দখল করে নিয়েছে হেণ্ডিকের লোক। সংখ্যায় বিশজন। সঙ্গে মেটালস্টর্ম। রাইফেল!

এদের মনোযোগ সরিয়ে দিতে হবে, ভাবছে রানা। কুয়াশার দিকে চাইল। রঘুপতির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। মাত্র ওই একটা উপায়ই আছে।

থ্রোট মাইকে বলল কুয়াশা, রঘুপতি। বি প্ল্যানের কী অবস্থা?

বস, আপনাদের কাছেরটা পেয়েছি। বিশাল আকার। এক শ গজ সামনে আছি। ইঞ্জিন ঠিকভাবেই চলছে। তাক করেছি ঠিক আপনাদের দিকেই।

এগারো

ঝোড়ো হাওয়ার ভিতর এমভি লোটাসের এক শ গজ দূরে পৌঁছে গেছে আরেকটি বিশাল জাহাজ, এখন ওটার হেলমে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুয়াশার রোবট রঘুপতি।

শারবার্গে কার্গো নামাবার জন্য চ্যানেলে অপেক্ষা করছিল এক লাখ দশ হাজার টনি কন্টেইনার শিপ–এমভি হ্যারিয়েটা। অলস গতিতে চলছিল ইঞ্জিন। তখনই ফোরডেকে নেমে এল কালো শকুন নিয়ে রঘুপতি।

এখন জাহাজে রঘুপতি ছাড়া কেউ নেই। সেইলিং ক্রুরা বুদ্ধিমান লোক, অস্ত্র হাতে দেখেছে ভয়ঙ্কর লোকটাকে, এমন এক লোক, যে ইচ্ছা করলে যেদিকে খুশি, চরকির মত মাথা ঘোরাতে পারে! এরপর আর দেরি করেনি ক্রুরা, ঝটপট লাইফবোট সাগরে নামিয়ে পালিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে দুটো এম-১৬ রাইফেল হাতে ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে রঘুপতি।

এবার কী করতে হবে, বস? জানতে চাইল রেডিয়োতে।

পরিস্থিতি বুঝে নিতে চাইছে রানা।

মিসাইল ডিসআর্ম করতে না পারলে রঘুপতিকে ব্যবহার করাই ছিল শেষ উপায়। ডুবিয়ে দিতে হবে সুপারট্যাঙ্কার, তা হলে মিসাইল লঞ্চ করতে পারবে না ম্যাজেস্টিক-১২। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য জাহাজগুলোর মিসাইল ঠেকাতে পারবে না ওরা।

চট করে একবার কন্ট্রোল কন্সেলের দিকে চাইল রানা। পরক্ষণে দেখল ব্যারিকেড। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল শীতল একটা অনুভূতি।

সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে ডেভিড এন. হেন্ড্রিক। ওকে দেখে ফেলেছে লোকটা।

চওড়া হাসি দিল শয়তানটা।

রঘুপতি, বলল রানা, গুঁতো দাও!

ঘড়ি দেখিয়ে চলেছে: ১৭:৪২:০৫…

ব্যারিকেড়ের পিছন থেকে ছিটকে এল হেণ্ডিকের লোক, ছুটতে শুরু করেছে রানাদেরকে লক্ষ্য করে। আড়াল নিচ্ছে মিসাইল সাইলোর মাঝে। দপদপে. আগুন বেরোচ্ছে মেটালস্টর্ম রাইফেলের মাযল থেকে।

রানার ইশারায় রওনা হলো নিশাত ও কুয়াশা। পৌঁছে গেল স্টারবোর্ডের খোলা কার্গো ডোরের পাশে। কাছেই একটা লাইফবোট।

উঠে পড়ন! গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে বলল রানা।

একইসঙ্গে লাফ দিয়ে লাইফবোটে উঠল ওরা। উঠে বসেই গুলি শুরু করল শত্রুদের লক্ষ্য করে।

অনেক কাছে চলে এসেছে ৬৬ ইউনিটের লোক। যন্ত্রের মত গুলি করছে রানা, কুয়াশা ও নিশাত। রঘুপতি আসা পর্যন্ত নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে বাউন্টি হান্টাররা।

রঘুপতি, গম্ভীর সুরে ডাকল কুয়াশা। কোথায়…

আর তখনই অবিশ্বাস্যভাবে হাজির হলো রঘুপতি।

যে বিকট মড়মড় আওয়াজ শুরু হলো, তাতে মনে হলো। ভেঙে পড়ছে গোটা পৃথিবী।

ওই আওয়াজের পর পরই ধাতুর সঙ্গে ধাতুর জোর সংঘর্ষের শব্দ শুরু হলো।

তালা লেগে গেল কানে।

ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়েছে প্রকাণ্ড দুই জাহাজ। লাফিয়ে উঠেছে। ইংলিশ চ্যানেলের এদিকের সাগর। ঝমঝম বৃষ্টির ভিতর দৃশ্যটা অকল্পনীয় মনে হলো রানার।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটো একহাজার ফুট দীর্ঘ জাহাজ ধাক্কা দিয়েছে একে অপরকে। একেকটার ওজন এক লাখ টনেরও বেশি।

সুপারট্যাঙ্কার এমভি ললাটাসের পোর্টে গুতো দিয়েছে রঘুপতির চোরাই জাহাজ এমভি হ্যারিয়েটা। ছুরির মত ইস্পাত কাটছে চোখা বো। যেন মস্ত ব্যাটারিং র‍্যাম।

কুঁচকে ভিতরে ঢুকল লোটাসের প্লেট। মাঝে তৈরি হলো বড় বড় ফাটল। লাফিয়ে জাহাজে ঢুকল সাগর।

ঘুষি খাওয়া বক্সারের মতই থরথর করে কাঁপছে সুপারট্যাঙ্কার এমভি লোটাস। দুলতে শুরু করেছে ভীষণভাবে।

প্রথম প্রচণ্ড ধাক্কায় ভয়ঙ্করভাবে কাত হয়েছে স্টারবোর্ডে, হুড়মুড় করে জাহাজে ঢুকল সাগরের পানি। পরক্ষণে নাটকীয়ভাবে পোর্টে কাত হলো এমভি লোটাস, যেন হুমড়ি খেয়ে পড়বে সাগরের বুকে। ডুবতে শুরু করেছে জাহাজ।

এমভি লোটাসের মিসাইল হোল্ডে যা ঘটছে, দেখলে হাঁ হয়ে যেতেন নুহ নবী।

বজ্রপাতের আওয়াজ চলছে জাহাজের ভিতর।

এমন কী রানাও বোঝেনি কেমন ভয়ানক হবে সংঘর্ষ। এখন চোখের সামনে দেখল, পোর্টের দেয়াল চিরে ছোরার মত পড়পড় করে ঢুকছে হ্যারিয়েটার চোখা বো।

প্রচণ্ড চাপ খেয়ে কাত হয়ে গেছে গোটা স্টারবোর্ড।

ছিটকে পড়েছে সবাই।

আচমকা প্রকাণ্ড সব ফাটল গলে ভিতরে ঢুকল সাগরের বিপুল পানি।

জোয়ারের দশফুটি ঢেউ ঢুকছে জাহাজে। মুহূর্তে তলিয়ে গেল বেশ কজন ৬৬ ইউনিটের বাউন্টি হান্টার। ঢেউয়ের চাপড় খেয়ে ভেসে উঠল আস্ত ফোর্কলিফট, কার্গো কন্টেইনার এবং মিসাইল পার্টস্।

হুড়মুড় করে রানাদের লাইফবোটের তলে পৌঁছল সাগরের ঢেউ। মাউন্ট থেকে বোটকে তুলে নিল অনায়াসেই। একইসময়ে ডেভিট থেকে বোট খুলে দিল রানা, চাল করল ইঞ্জিন।

কয়েক সেকেণ্ডে তলিয়ে গেল হোল্ডের মেঝে, দ্রুত বাড়ছে। পানির গভীরতা।

বিপুল পানি ঢুকেছে বলে পোর্টে গড়িয়ে গেল জাহাজ। ক্রমেই বাড়ছে ইস্পাতের প্লেটের ফাটল। তিরিশ ডিগ্রি কাত হলো এমভি ললাটাস।

পানি কেটে রওনা হয়েছে রানাদের মোটোরাইযড লাইফ বোট। আরও কাত হতে শুরু করেছে চারপাশের হোল্ড।

ঘড়ি অনুযায়ী: ১৭:৪২:২৯।

পোর্টের দিকে চেয়ে অদ্ভুত দৃশ্য দেখল রানা।

এখনও এমভি লোটাসের বুকে গেঁথে আছে এমভি হ্যারিয়েটা–গলগল করে পেটে পুরছে সুপারট্যাঙ্কার প্রচুর পানি। বামে কাত হয়ে ভাসছে। যেন তার স্তনে মুখ গুঁজেছে। হ্যারিয়েটা। এ পেটের ভিতর পানির পরিমাণ আরও বাড়তেই হ্যারিয়েটার বো-টাকে সাগরে চুবিয়ে দিল এমভি লোটাস। কয়েক মুহূর্ত পর নিজেরই বেশিরভাগ অংশ তলিয়ে গেল, জেগে রইল শুধু দীর্ঘ ফোরডেক ও ব্রিজ টাওয়ার। হেলে পড়েছে তিরিশ ডিগ্রি।

ঢেউয়ের নীচে তলিয়ে গেছে হ্যারিয়েটার বো।

কাউকে বলতে হয়নি কী করতে হবে, নিজেই বুঝে গেছে। রঘুপতি। ব্রিজ থেকে বেরিয়ে ফোরডেকে ছিটকে গিয়ে উঠল কালো শকুনের ককপিটে। কয়েক সেকেণ্ড পর বৃষ্টি ঝরা আকাশে উঠল জেট বিমান।

.

পানিভরা লোটাসের হোল্ডে গতি তুলেছে রানাদের লাইফবোট।

১৭:৪৩:৩০…

হেলে পড়া মিসাইল সাইলো এড়িয়ে উচ্ছল ঢেউয়ের ভিতর দিয়ে তীরের মত ছুটছে রানাদের বোট। পিছনদিকে বসেছে কুয়াশা ও নিশাত, গুলি করছে ভাসমান শত্রুদের লক্ষ্য করে।

রানার মনে হলো, বিদ্যুদ্বেগে স্পিডবোট নিয়ে অর্ধ নিমজ্জিত

জঙ্গলে দূরে কোথাও চলেছে।

দুই জাহাজে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষের পর ডেভিড এন. হেন্ড্রিক এবং তার বেশিরভাগ লোক সরে গেছে হোল্ডের স্টারবোর্ডে ওদিকটা উঁচু। এখনও তলিয়ে যায়নি।

সরাসরি মিসাইল হোল্ডের কন্ট্রোল কন্সেলের দিকে ছুটছে। রানাদের লাইফবোট।

১৭:৪৩:৪৭… ১৭:৪৩:৪৮… ১৭:৪৩:৪৯…

অশান্ত পানিতে বাঁক নিল রানার বোট, পিছনে বসে শত্রুদের দিকে গুলির পর গুলি ছুঁড়ছে কুয়াশা ও নিশাত। পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে অস্ত্র তাক করতে পারছে না ৬৬ ইউনিটের কয়েকজন, মারা পড়ছে গুলি খেয়ে।

পিছনে লাশ রেখে এগিয়ে চলেছে রানাদের লাইফবোট।

উঁচু কন্ট্রোল কন্সেলের পাশে পৌঁছে গেল ওরা। হেলে দাঁড়িয়ে আছে ওয়ায়ার ফ্রেমের কন্ট্রোল কন্সেল। পানি-সমতল থেকে মাত্র একফুট উপরে।

আমাকে কাভার দিন! চেঁচিয়ে জানাল রানা। লাইফবোটের ডেক থেকে দেখল কন্সেলের আভাময় ডিসপ্লে স্ক্রিন। লাল সংখ্যা টিকটিক করে নীচে নামছে। প্রতি সেকেণ্ডের জন্য এক শ মিলিসেকেণ্ড দেখিয়ে চলেছে।

মিসাইল লঞ্চিঙের জন্য চলছে কাউন্টডাউন:

০০:০১:০৯.৮৭…

০০:০১:১০.৮৬…

০০:০১:০৯.৮৫…

সময় পেরিয়ে চলেছে বিদ্যুদ্বেগে।

ফ্রেঞ্চ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে মৃত ডিজিএসই এজেন্টের কাছ থেকে পাওয়া টাচলক-৯ ইউনিট পকেট থেকে বের করল রানা—ওটা ছিল ভেস্টে ওয়াটারপ্রুফ পাউচের ভিতর।

আবারও আলোর মুখ দেখল ওই ডিসপ্লে।

বিঁপ আওয়াজ তুলে স্ক্রিনে ভেসে উঠল মেসেজ:

ফার্স্ট প্রটোকল (প্রক্সিমিটি): স্যাটিসফাইড.
ইনিশিয়েট সেকেণ্ড প্রটোকল।

আগের মতই দেখা দিল সাদা বৃত্ত, টিপটিপ করতে শুরু করেছে।

প্রতিটি বৃত্ত স্পর্শ করছে রানা।

০০:০১:০২…

০০:০১:০১…

০০:০১:০০…

হঠাৎ করেই বেদম হোঁচট খেল এমভি লোটাস। পুরো সুপারট্যাঙ্কার ভাসছে এমভি হ্যারিয়েটার বো-র উপর ভর করে। পিছলে নেমে যেতে শুরু করেছে এই জাহাজ!

প্রস্তুত ছিল না বলে একটা সাদা বৃত্ত স্পর্শ করতে পারল না রানা।

বিপ আওয়াজ ছাড়ল ইউনিট:

সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
ফেইল ডিসআর্ম অ্যাটেম্পট।
রেকর্ডেড।

থ্রি ফেইল্ড ডিসআর্ম অ্যাটেম্পট উইল
রেজাল্ট ইন ডিফল্ট ডেটোনেশন।

সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
রি-অ্যাকটিভেটেড।

কাউণ্ট ডাউনের দিকে চেয়ে ঢোক গিলল রানা।

নতুন উদ্যমে কাজে নামল। ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে সুপারট্যাঙ্কার এমভি লোটাস। রানা টের পেল, ওর বুটের পাশে চাপড় দিচ্ছে সাগরের ঢেউ।

.

টাচলক-৯ ইউনিটের স্ক্রিনে আঙুল স্পর্শ করছে রানা, ওদিকে স্টারবোর্ডের উঁচু জায়গায় ৬৬ ইউনিটের লোকদের লক্ষ্য করে গুলি করছে কুয়াশা।

এক পশলা গুলি ওদিকে পাঠাবার পর হঠাৎ দৃশ্যটা দেখল ও, চমকে গিয়ে বলল, এহ-হে!

কী হলো? পাশ থেকে জানতে চাইল নিশাত।

এবার যে-কোনও সময়ে তলিয়ে যাবে স্টারবোর্ডের কার্গো ডোর, বলল কুয়াশা।

ঠিকই বলেছে।

বামদিকে এমভি লোটাস কাত হয়ে পড়ায় স্টারবোর্ডের প্রকাণ্ড কার্গো ডোরওয়ে এতক্ষণ পানি-সমতল থেকে উপরে ছিল।

কিন্তু উচ্চতা বাড়ছে পানির, এবার তলিয়ে যাবে ওই দরজা। তার বড় কারণ, ওদিক থেকেই হুড়মুড় করে হোল্ডে ঢুকবে সাগরের বিপুল পানি। টুপ করে ডুববে জাহাজ।

মিস্টার কুয়াশা! সতর্ক করল নিশাত। ডানদিক দেখুন! বিড়বিড় করে কাকে যেন অভিশাপ দিল কুয়াশা।

ডানদিকে হেন্ড্রিকের ছয়জন বাউন্টি হান্টার পানি ছেড়ে উঠে পড়েছে দুই মোটোরাইযড লাইফবোটে।

সোজা রওনা হয়ে গেল কুয়াশাদের লক্ষ্য করে।

রানা! গলা ছাড়ল কুয়াশা, তোমার কাজ শেষ হলো?

প্রায়… পাল্টা চেঁচাল রানা। চোখ স্ক্রিনে।

০০:০০:৫২…

০০:০০:৫১…

০০:০০:৫০…

স্টারবোর্ডের নিমজ্জিত এলাকায় সরে গেল ৬৬ ইউনিটের দুই লাইফবোট, তুলে নিল ডেভিড এন, হেণ্ডিক এবং অবশিষ্ট লোকদের।

সবমিলে ষোলোজন তারা।

রানা এবং মিসাইল কন্ট্রোল কন্সেল লক্ষ্য করে তেড়ে এল দুই বোট।

নতুন উদ্যমে গুলি ছুঁড়তে লাগল কুয়াশা ও নিশাত।

পানির উপর দিয়ে রাজহংসীর মত তরতর করে আসছে ৬৬ ইউনিটের দুই লাইফবোট। এড়িয়ে যাচ্ছে হেলে যাওয়া মিসাইল সাইলো। গুলি করছে শত্রুদের উদ্দেশে।

.

এদিকে নিজ জগতে ডুবে আছে রানা। ঝড়ের মত স্পর্শ করছে। সাদা ও লাল বৃত্ত।

০০:০০:৪২…

০০:০০:৪১…

০০:০০:৪০…

হঠাৎই শেষ সাদা বৃত্ত স্পর্শ করল রানা, বদলে গেল স্ক্রিনের দৃশ্য:

সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
স্যাটিসফায়েড।
থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি):
অ্যাকটিভ।
প্লিয এণ্টার অথোরাইযড
ডিসআর্ম কোড।

ঠিক আছে, বিড়বিড় করল রানা। ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড চাইছে ওর কাছে। সপ্তম মার্সেন প্রাইম এখনও ওর তালুতে লেখা: ৪,৩১,১২,৬০৯।

সংখ্যাগুলো টাচলক ইউনিটের নিউম্যারিকাল কিপ্যাডে তুলে দিতে লাগল রানা। এমনসময় হঠাৎ করেই ওকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল পায়ের নীচের ডেক!

বিপ!

জোরালোভাবে আপত্তি তুলল স্ক্রিন:

ফার্স্ট প্রটোকল (প্রক্সিমিটি): ফেইলড.
অল প্রোটোকলস রি-অ্যাকটিভেটেড.

আরেহ! ঝট করে ঘুরে কুয়াশার দিকে চাইল রানা। মিসাইল কঙ্গেল থেকে তীরের মত বোট সরিয়ে নিয়েছে বৈজ্ঞানিক। স্টার্নে ৬৬ ইউনিটের দুই বোট লক্ষ্য করে গুলি করতে ব্যস্ত নিশাত।

মিসাইল সাইলোগুলোর মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটছে। রানাদের বোট।

দুঃখিত, রানা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কুয়াশা। উপায় ছিল না। ওখানে থাকলে এতক্ষণে মারা পড়তাম আমরা।

বুঝেছি! রাগ সামলে নিতে চাইল রানা। কিন্তু আবারও ওই কন্সেলের ষাট ফুটের ভেতর যেতে হবে! অথচ হাতে দশ সেকেণ্ড আছে কি না কে জানে! কমপক্ষে পঁচিশ সেকেণ্ড লাগবে রেসপন্স প্যাটার্ন কমপ্লিট করতে!

ওদের দ্রুতগামী বোটের চারপাশের পানি ছলকে ডুব দিচ্ছে। অসংখ্য বুলেট।

০০:০০:৩৬…।

০০:০০:৩৫…

০০:০০:৩৪…

হঠাৎ করেই টোকা খাওয়া, ক্যারামের গুটির মত আরেকদিকে রওনা হলো কুয়াশা, তারই ফাঁকে বলল, কতটা কাছে যেতে হবে তোমাকে?

ষাট ফুট!

ঠিক আছে!

ওদের কানের পাশ দিয়ে শোঁ-শোঁ আওয়াজে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট। মিসাইল সাইলোর গায়ে লেগে ছিটকে যাচ্ছে বিঈং শব্দে।

বোট ঘুরিয়ে নিয়েছে কুয়াশা, তৈরি করছে বড় বৃত্ত। আবারও ফিরছে ইস্পাতের দ্বীপ লক্ষ্য করে। দূরে দেখা গেল কন্ট্রোল কন্সেল। সাইলোর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলেছে বোট।

০০:০০:২৮…

০০:০০:২৭…

০০:০০:২৬…

আবারও বিপ আওয়াজ ছাড়ল রানার স্ক্রিন:

ফার্স্ট প্রটোকল (প্রক্সিমিটি); স্যাটিসফাইড,
ইনিশিয়েট সেকেণ্ড প্রটোকল।

শুরু হয়েছে লাইট-রেসপন্স ডিসপ্লে।

এবার স্ক্রিন স্পর্শ করতে হবে রানাকে। পিছনে লেগে আছে ৬৬ ইউনিটের দুই বোট। বৃষ্টির মত পিছনে গুলি করছে নিশাত।

একহাতে বোট চালাচ্ছে কুয়াশা, অন্যহাতের অস্ত্র থেকে গুলি করছে। মনে রেখেছে, কন্ট্রোল কন্সেলের ষাট ফুটের ভিতর থাকতে হবে।

০০:০০:১৭…

০০:০০:১৬…

০০:০০:১৫…

কিন্তু কুয়াশা বৃত্ত তৈরি করছে দেখেই বুঝে গেছে হেণ্ড্রিকের দুই লাইফবোটের পাইলট। তারা ফাঁদে ফেলতে চাইল শত্রু বোটকে।

বৃত্তের উল্টো দিক লক্ষ্য করে রওনা হয়ে গেছে একটা বোট, অন্যটা সোজা তেড়ে এল রানাদের দিকে।

বর্তমান পরিস্থিতি কী জানেও না রানা, ঝড়ের মত চলছে। ওর আঙুল।

সাদা-লাল-সাদা-সাদা…

টিপটিপ আওয়াজ তুলছে স্ক্রিন।

০০:০০:১২…

০০:০০:১১…

০০:০০:১০…

৬৬ ইউনিটের প্ল্যান বুঝেছে কুয়াশা। এগিয়ে আসা বোটের ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে গুলি শুরু করল ও।

টাশশ! টাশশ! টাশশ!

তিনটা গুলি মোটেও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না।

০০:০০:০৯…

০০:০০:০৮…

০০:০০:০৭…

ঝড়ের মত চলছে রানার আঙুল। বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে স্পর্শ করছে বৃত্ত।

তেড়ে আসা বোটের এক লোককে গেঁথে ফেলেছে নিশাত। কিন্তু তখনই আহত বাঘের মত গর্জন ছাড়ল ও। উত্তপ্ত বুলেট বিঁধেছে ওর কাঁধে।

০০:০০:০৬…

০০:০০:০৫…

০০:০০:০৪…

মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে রানাদের বোটের সঙ্গে দ্বিতীয় শত্ৰুবোটের। এখনও ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে গুলি করছে। কুয়াশা।

টাশ! টাশ! টাশ! টাশ!

মিস… মিস… মিস… লেগেছে!

০০:০০:০৩….

স্টিয়ারিং হুইলের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ড্রাইভার, মৃত। বাঁক নিয়ে আরেকদিকে রওনা হয়েছে ওই বোট। কুয়াশা কন্সেলের ষাট ফুটের ভিতর রাখছে নিজের বোটকে।

০০:০০:০২…

০০:০০:০১…

রানার আঙুলের নড়াচড়া সামান্য বদলে গেল। বৃত্ত স্পর্শ না। করে টাইপ করছে…

০০:০০:০০

কুয়াশা বুঝে গেল, দেরি হয়ে গেছে ওদের।

অবশ্য কন্সেলে থেমে গেছে কাউন্টডাউন:

০০:০০:০৭।

ঠিকই যিরো পর্যন্ত গুণেছে ঘড়ি। কিন্তু আগেই ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড এন্ট্রি করেছে রানা।

স্ক্রিনে এখন লেখা:

থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি): স্যাটিসফাইড,
অথোররাইযড ডিসআর্ম কোড
এন্টার্ড. মিসাইল লঞ্চ অ্যাবোর্টেড,

মস্ত স্বস্তির শ্বাস ফেলল রানা। কোনও মিসাইল রওনা হয়নি। লণ্ডন, প্যারিস ও বার্লিন নিরাপদ।

কিন্তু এদিকে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে স্টারবোর্ডের প্রকাণ্ড দরজা!

জোরালো হুউউসস্! আওয়াজ ছাড়ল দরজা। যেন হাজার হাজার অজগর শ্বাস ফেলল কানের ভিতর।

ফ্লাডগেটের মত কাজ করছে ওই মস্ত দরজা, লাফিয়ে ভিতরে ঢুকল বিপুল পানি, যেন আস্ত সাগর ঢুকে এল ভিতরে।

রানাদের দিকে তেড়ে এল উঁচু জলপ্রাচীর। বানের মত আসছে। এবার গিলে ফেলবে সবাইকে।

ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর।

শরীর মুচড়ে সোজা হলো গোটা সুপারট্যাঙ্কার। স্টারবোর্ডে প্রচুর পানি ঢুকতেই ঝটকা দিয়ে সিধে হয়েছে জাহাজ। পোর্টসাইড ও স্টারবোর্ড–দুপাশ দিয়েই ঢুকছে সাগর।

জাহাজ সিধে হতেই আরেকটা প্রতিক্রিয়া দেখা দিল: হ্যারিয়েটার বো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সুপারট্যাঙ্কার। কিন্তু ওই জাহাজের বো ভাসিয়ে রেখেছিল এমভি লোটাসকে, এবার আর কোনও অবলম্বন রইল না সুপারট্যাঙ্কারের।

ইংলিশ চ্যানেলের গভীরে তলিয়ে যেতে লাগল এমভি লোটাস।

মিসাইল হোল্ডে লাইফবোটে বসে হাজারো আওয়াজ শুনল রানা, কুয়াশা ও নিশাত কানে তালা লেগে গেল। হোল্ডে বজ্রের মত গর্জন ছাড়ছে যেন জলপ্রপাত। বিকট প্রতিধ্বনি শুরু হলো ফাঁকা জাহাজের ভিতর। ঢেউ আছড়ে পড়ছে স্টিলের দেয়ালে। হোল্ডের পানিতে তৈরি হচ্ছে ঘূর্ণি।

অকল্পনীয়ভাবে বাড়ছে পানির উচ্চতা। রানার মনে হলো, ওদের মাথার উপর নেমে আসছে সিলিং।

কয়েক সেকেণ্ডে প্রকাণ্ড মিসাইল সাইলোর মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছে গেল ওদের বোট। বিশফুট উপরে ছাত থেকে ঝুলছে স্টিলের ক্যাটওয়াক।

এদিকে স্টারবোর্ডের দরজা তলিয়ে যেতেই ধাওয়া বাদ দিয়ে কাছের মই লক্ষ্য করে রওনা হয়েছে ডেভিড এন. হেন্ড্রিক এবং তার লোক, উঠবে হোল্ডের ছাতে।

যোগ্য লোক, মন্তব্য করল কুয়াশা, হেন্ড্রিক ফোরডেকে উঠতে চাইছে। কাভার করবে প্রতিটি হ্যাচ। অপেক্ষা করবে। আমরা বেরুলেই… অথচ আমাদেরকে ওই পথে যেতেই হবে।

হয়তো অন্য পথে বেরোতে পারব, বলল রানা। এই মুহূর্তে প্রথম কাজ: জাহাজ থেকে সরে যাওয়া। নিরাপদ কোথাও থেমে ডিসআর্ম করব আমেরিকার শহরের দিকে তাক করা মিসাইল।

পকেট থেকে পাম পাইলট বের করল রানা, দেখে নেবে। কোন নোয়ায শিপ থেকে মিসাইল লঞ্চ করা হবে।

আগে যেসব ডকুমেন্ট দেখেছিল, সেগুলো আবারও বের করল পাম পাইলটের স্ক্রিনে।

বেছে নিতে চাইল সংক্ষিপ্ত লঞ্চ লিস্ট।

কিন্তু বেরোল বিস্তারিত তালিকা।

পরিচিত তিন জাহাজ ও জিপিএস লোকেশন দেখল রানা।

তালিকায় লেখা:

সোর্স শিপ – ডেলিভারি সিস্টেম – ডাব্লিউএইচ – অরিজিন টার্গেট – টাইম।

লোটাস শাহাব-এস টিএনবি ৫৬০১.০১ ০০০০১.৬৪ ৫০০০২.০০ ৫২৩১.০০ ১১.৪৫

সেইম ৩৫৭০১.২০ ০৪২১-০১, ৫০০২.০০ ৪৯০০.২৪ ১১.১৫

সেইম ৩৫৭০১-২০১২৩১৩-১৫ ৫০০০২ ৫৩৫৮.৭৪ ১১.৪৫

কর্পোরেশন সেইম ২৮৭৪৪-০৫ ২৬৭৪৩-১৭ ৪১০৫-৫৪ ৪১০৩.৬৪ ১২.০০

সেইম ২এ৭৪৩-০৪ ২৬২৪১-০৪ ৪১০৫-৫এস ৩৬৩৬-৬০ ১২.০০

রুবল টেপও-ডং-২ এন-৮ এনএফএল ৩২২২২-বি৩ ২৩২২২-৬৯ ৩৭৪৪-৭৬ ৩৭৪৫-৬৫ ১২.১৫

সেইম ২৩২২২-৬৩ ২৪২৩০-৫০ ৩৭৩৪-৭৫ ৩৪৩৩-০২ ১২.১৫

সেইম ২৩১৫৭-০৬ ২৩১৫৬.৫০ ৩৭৪৫-৭৪ ৪১৩১-৫১. ১২.১৫

হোপ স্কাই হর্স-৩ ডাব্লিউ ৮৮ ১১১০০-০১ ১১৬২২১.৬০ ২৩২৭-০১ ৪০০১-০০ ১২.১৫ (টাইওয়ান স্ট্রেইটস) (বেইজিং)

সেইম ১১১০০-০১১১৪৪৫-৭০ ২৩২৮-০০ ২২৪৩-২৮ ১২.৩০
(টাইওয়ান স্ট্রেইটস) (হংকং)

ডলফিন ঘৌরি-১১ ০৭৭২৫-০৫ ২৩২৭-০১ ২৩২৭.০১২৯৫৮.০৬ ১২.৪৫
(অ্যারাবিয়ান সি) (নিউ দিল্পি)

অগ্নি-১১ ০৭০৪০৪৪ ০৭৩৩২-৬১ ২৩২৭-০০ ৩২৩০-৫১ ১২.৪৫
(অ্যারাবিয়ান সি) (ইসলামাবাদ)

পরবর্তী জাহাজ এমভি করপোরেশন। দুপুর বারোটার সময় ২৮৭৪৪-০৫, ৪১০৫-৫৪ জিপিএস কো-অর্ডিনেট থেকে আকাশে উঠবে মিসাইল।

জাহাজটা আছে নিউ ইয়র্কের উপকূলে, মনে পড়ল রানার। কিন্তু কী যেন সমস্যা আছে এ তালিকায়, খেয়াল করে আগে দেখেনি।

না, এটা খবিরের পাঠানো আগের সেই তালিকা নয়।

বদলে গেছে কিছু।

স্কিনে আরেকটা তালিকা আনল রানা।

এই তালিকায় যোগ করা হয়েছে জাহাজের নতুন মিসাইলের নাম। লঞ্চ করা হবে কয়েক ধরনের ব্যালেস্টিক মিসাইল। কোনও কোনওটা কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পর রওনা হবে।

আরেকটা তফাৎ রয়েছে।

তাইওয়ানি এবং ইজরায়েলি মিসাইলে যোগ করা হয়েছে। আমেরিকান নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড ভয়ঙ্কর শক্তিশালী ডাব্লিউ ৮৮…

পাশের পানিতে একপশলা বুলেট নামতেই চমকে গেল রানা মুখ তুলল, সিলিঙে ওঠা এক মইয়ের পাশে বোট এনেছে। কুয়াশা। কিছুক্ষণ আগেও ওই ছাত ছিল আশি ফুট উপরে। এখন বড়জোর সতেরো ফুট উপরে ছাত। দ্রুত বাড়ছে পানির উচ্চতা।

কিন্তু ক্যাটওয়াকের ষাট গজ দূরে দুদিক থেকে তেড়ে আসছে চারজনের ৬৬ ইউনিটের দুটো দল। সিলিঙের হ্যাচ খুলে আবারও নেমে এসেছে তারা, গুলি করতে করতে তেড়ে আসছে। রানাদের বোটের চারপাশের গার্ডারে বিঈং! বিঈং! শব্দে ছিটকে আরেকদিকে ছুটছে বুলেট।

ডেকে উঠব সেজন্য অপেক্ষা করেনি, তোমার মাথা পাওয়ার জন্যে ধাওয়া করছে, বলল কুয়াশা।

মই বেয়ে উঠুন, স্যর, তাড়া দিল নিশাত। হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিল রানাকে। কমপিউটার পরে দেখবেন!

রানা মই বেয়ে উঠতে শুরু করতেই নিজের দেহ দিয়ে কাভার করল নিশাত। গুলি লাগতে দেবে না রানার গায়ে।

রানার পর পর মই বেয়ে উঠতে লাগল নিশাত। পিছনে কুয়াশা। একহাতে উঠছে ওরা, অন্যহাতে গুলি করছে শত্রু লক্ষ্য করে। উঠে পড়ল ওরা ক্যাটওয়াকে। চারপাশে অসংখ্য ফুলকি তৈরি করে ছিটকে যাচ্ছে বুলেট।

ক্যাটওয়াকে কাভারিং পজিশন পেয়ে গেল নিশাত। ওর দিকে পিঠ রেখে শত্রুদের দিকে গুলি ছুঁড়ল কুয়াশা ও রানা।

চারপাশে বিঈং! বিঈং! আওয়াজ।

নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে বুলেট।

স্টার্নের দিক থেকে ছুটে আসা ৬৬ ইউনিটের লোক লক্ষ্য করে গুলি করছে রানা ও কুয়াশা, কিন্তু হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গেল রানার অস্ত্রের ম্যাগাযিন।

আসলেই কোথাও যেতে চাও, রানা? গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে বলল কয়াশা।

হ্যাঁ, চাই, বলল রানা। এমন কোথাও, যেখানে স্থির হয়ে বসে ডিসআর্ম করতে পারি সব মিসাইল।

তা হলে আগে এই পোড়া জাহাজের মরণফাঁদ থেকে বেরুতে হবে। এদিকে দেখো! হঠাৎ করেই ডানদিকে ঘুরেই ছুট লাগাল কুয়াশা। ক্যাটওয়াকের টি-জাংশনে ছোট এক মেইনটেন্যান্স শ্যাক পেরিয়ে গেল। সামনেই দুই হলদে রঙের মিনি-সাবমেরিন। ছাত থেকে শিকলে ঝুলছে ওদুটো।

ক্যাটওয়াকের মতই এখন আর অনেক উপরে নেই সাবমেরিন দুটো। পানি-সমতল থেকে ষোলো ফুট উপরে। দুই সাবমেরিনকে উপর থেকে ঘিরেছে ঢাকনি। ৬৬ ইউনিটের খুনিদের কাছ থেকে অনেকটা কাভার দিচ্ছে রানাদেরকে ওই ঢাকনি।

পিছলে নানাদিকে ছুটছে বুলেট।

রানা দেখল, মিনি-সাবের দিকে এগুতে চাইল নিশাত, কিন্তু পারল না। বাধা হয়ে দাঁড়াল অসংখ্য বুলেট।

মেইনটেন্যান্স শ্যাকের ভিতর ঢুকে আড়াল নিল নিশাত।

ও আর এদিকে আসতে পারবে না, মনটা ভীষণ ছোট হয়ে গেল রানার। আপা! থ্রোট মাইকে ডাকল।

ভাইডি, চলে যাও, রেডিয়োতে বলল নিশাত।

মেটালস্টর্ম বুলেট ঝাঁঝরা করতে শুরু করেছে শ্যাক।

নিশ্চয়ই চোখের আড়ালে সরে যেতে চাইছে নিশাত, ভাবল রানা। নিশ্চয়ই গুলি লেগেছে।

না, আবারও দরজায় দেখা দিল নিশাত। ঝড়ের মত গুলি করছে, পর পর দুই বাউন্টি হান্টারকে নরকে পাঠিয়ে দিল। রানা! আমি চলে যেতে বলেছি! ধমকের সুরে বলল রেডিয়োতে।

না, আপা, আপনাকে ফেলে যাব না! পাল্টা জানাল রানা।

খবরদার! বলছি যাও! আরেক দফা গুলি ছুঁড়ল নিশাত। আগেই লুকিয়ে পড়েছে ৬৬ ইউনিটের লোক।

সম্ভব না, আপা!

যাও, ভাইডি, ভেজা স্বরে বলল নিশাত। আমার মত বুড়ি মেয়েলোকের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লাখ লাখ মানুষকে বাঁচানো। শ্যাকের ভিতর থেকে রানার দিকে চেয়ে আছে নিশাত। তোমাকে বাঁচতে হবে, ভাইডি! আমার কাজ আমাকে করতে দাও! যাও, আর দেরি কোরো না, যাও! যাও! যাও!

রানা কিছু বলবার বা করবার আগেই দেখল, ভয়ানক সাহস নিয়ে আত্মহত্যার পথে পা বাড়াল নিশাত।

জানালার সামনে সিধে হয়ে দাঁড়াল ছয় ফুটি নিশাত, বিকট এক হুঙ্কার ছেড়ে দুহাতের দুই অস্ত্র থেকে গুলি শুরু করল দুদিকের ৬৬ ইউনিট সদস্যদের লক্ষ্য করে।

নিজেদের অবস্থানে থমকে গেল লোকগুলো। এ ধরনের সাহসিকতার সঙ্গে পরিচিত নয়। তাদের সামনের লোকটা ঝাঁঝরা হয়ে গেল বুলেটের আঘাতে। বুক থেকে ছিটকে বেরোল ঝর্নার মত রক্ত। রানা ও কুয়াশাকে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে নিশাত।

রানা, জলদি! ধমকের সুরে বলল কুয়াশা, টিপে দিয়েছে। সাবের উপরের হ্যাচ বাটন। সড়াৎ করে খুলে গেল গোল হ্যাচ। নিশাতের আত্মত্যাগকে কিছুতেই বৃথা হতে দিয়ো না!

পা গলিয়ে হ্যাঁচে ঢুকতে গিয়েও নিশাতের দিকে চাইল রানা, টের পেল ভিজে গেছে চোখের পাতা।

দুদিক থেকে তুমুল গুলির তোড়ে পিছাতে হচ্ছে নিশাতকে।

বিদায়, আপা, বিড়বিড় করল রানা।

মেটালস্টর্ম রাইফেলের অসংখ্য বুলেট বুকে নিয়ে ছিটকে পড়ল নিশাত। বুলেটের আঘাতে কুঁকড়ে যাচ্ছে চেস্ট আর্মার। তবুও ঝট করে উঠে বসল ও, টলছে ভীষণ, আর গুলি করতে পারল না। হাঁ হয়ে গেল মুখ, হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল দৃষ্টি ধুপ করে পড়ল মেঝেতে।

আগ্নেয়াস্ত্রের ধোঁয়া ও উড়ন্ত কাঁচের ভিতর পড়ে রইল বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা।

শ্যাকের জানালা দিয়ে আর ওকে দেখতে পেল না রানা।

৬৬ ইউনিটের দুই দল তোক শেষ করে দিয়েছে মস্ত সাহসী এক নরম মনের মেয়েকে, যে কি না রানার দলের সবার দেখভাল করত দক্ষ নার্সের মত করে।

একইসময়ে মেইনটেন্যান্স শ্যাক লক্ষ্য করে রকেট লঞ্চ করল ৬৬ ইউনিটের দুই দল।

নিশাতের ছোট্ট ঘরে গিয়ে নামল দুই রকেট। বুম্! আওয়াজ তুলল দুই বোমা। চারদিকে ছিটকে গেল চার দেয়াল। বিস্ফোরিত হয়েছে সবই। রইল শুধু মসৃণ মেঝে। চোদ্দ ফুট নীচে কলকল করে বাড়ছে পানি।

সাবমেরিন থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছিল রানা, কিন্তু ঠেলে ওকে ভিতরে পাঠাল কুয়াশা।

না, রানা! আমাদেরকে যেতে হবে! গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে শোনা গেল ওর কড়া স্বর।

আরেক ধাক্কায় রানাকে সাবমেরিনে ঢুকিয়ে দিল কুয়াশা কিন্তু সাবমেরিনের মেঝেতে পা স্পর্শ করবার আগেই রানা। দেখল, সরাসরি ওর মুখ লক্ষ্য করে আসছে তলোয়ারের ক্ষুরধার ফলা।

হতবাক রানার রিফ্লেক্স কাজ করল।

ঝট করে খালি এইচঅ্যাণ্ডএইচ পিস্তল তুলে ঠেকাতে চাইল তলোয়ার। জোরালো ঠং আওয়াজ উঠল ইস্পাতে ইস্পাতে। ওর পিস্তলের ট্রিগার গার্ডে লেগেছে ফলা, গলার এক ইঞ্চি দূরে।

সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাশান মেজর মিখাইল পেদবরানভ! হাতে খাটো ফলার কসাক তলোয়ার। চোখ ভরা ঘৃণা।

ভুল জায়গায় লুকাতে এসেছ, দাঁতে দাঁত চেপে বলল মেজর।

রানা নড়ে উঠবার আগেই দেয়ালের দুটো বাটন টিপে দিল সে।

প্রথমটা ইন্টারনাল হ্যাচ বাটন। হুউশ আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে গেল স্টিলের দরজা দ্বিতীয় সুইচ এএসডিএস রিলিজ বাটন। রানা টের পেল, হঠাৎ খালি হয়ে গেছে ওর তলপেট।

শিকল থেকে খসে পড়েছে মিনি-সাবমেরিন। চোদ্দ ফুট উপর থেকে পড়তেই চারপাশে ছিটকে গেল পানি।

কী ব্যাপার! অবাক সুরে বলল কুয়াশা। কী হচ্ছে?

মাত্র এক সেকেণ্ড আগে রানাকে ঠেলে হলদে সাবমেরিনে ভরছিল ও, দেখল বন্ধ হয়ে গেছে হ্যাচ, পরক্ষণে গোটা জলযান ধুপ করে গিয়ে পড়ল পানির ভিতর!

কুয়াশার চারপাশের গার্ডারে লেগে পিছলে যাচ্ছে ৬৬ ইউনিটের হাইপারচার্জড বলেট।

মেইনটেন্যান্স শ্যাক পেরিয়ে ছুটছে লোকগুলো ওর দিকেই। উঠে পড়ল সাবমেরিন ক্যাটওয়াকে।

বাধ্য হয়ে একমাত্র কাজটিই করল কুয়াশা। ডাইভ দিয়ে। পড়ল দ্বিতীয় সাবমেরিনের গায়ে। ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেট চারপাশ দিয়ে।

.

প্রাণ বাঁচাতে লড়ছে রানা ও পেরোনভ।

কোনও নিয়ম মানছে না কেউ। এখন কাজে আসবে না কোনও কৌশল। রাস্তার ছেলেদের মারামারির মতই লড়াই চলছে।

মিনি-সাবমেরিনের বদ্ধ জায়গায় গড়াগড়ি খাচ্ছে ওরা, লাথি দিচ্ছে, ঘুষি মারছে পরস্পরের অণ্ডকোষ লক্ষ্য করে।

রানার হাতের অস্ত্র খালি, কিন্তু পেরোনভের কসাক তলোয়ার অন্য জিনিস।

সেকারণেই সাবমেরিন পানিতে পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রানা। পেরোনভের কব্জির উপর নামিয়ে এনেছে পিস্তলের বাঁট।

রাশান তার তলোয়ার ছেড়ে দিতেই শুরু হয়েছে কুস্তি।

আগুন জ্বলছে রানার হৃদয়ে, এইমাত্র হারিয়ে বসেছে তার প্রিয় আপাকে। ভয়ঙ্কর জেদ কাজ করছে ওর মনে।

এদিকে খুন করতে ভালবাসে সাইকোপ্যাথ পেরোনভ।

একে অপরকে ছিটকে ফেলছে সাবমেরিনের দেয়ালে। মনে বিষ, প্রতিটি আঘাতে রক্ত বের করছে শত্রুর।

এক ঘুষিতে পেরোনভের চোয়ালের হাড় ভেঙে দিল রানা।

রানার নাকের হাড় ভাঙল পেরোনভ। তার আরেকটা ঘুষি খসিয়ে দিল ওর ইয়ারপিস।

নিখুঁতভাবে রানাকে ট্যাকল করল পেদরোনভ, ছিটকে ফেলল সাবমেরিনের কন্ট্রোল প্যানেলের উপর।

চাপ পড়েছে কোনও বাটনে, সঙ্গে সঙ্গে ডুবতে লাগল মিনি সাব।

ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে নিজেকে সরিয়ে আনল রানা, তারই ফাঁকে দেখল ব্যালাস্ট বাটন অন হয়েছে।

গভীরে রওনা হয়েছে এএসডিএস।

হঠাৎ করেই পানির নীচে ডুব দিল সাবমেরিন। দুদিকের দুই হেমিস্ফেয়ারিক গম্বুজ দিয়ে রানা দেখল, তলিয়ে গেছে গোটা মিসাইল হোন্ড।

চারপাশ বড় নীরব। যেদিকে চোখ যায়, শুধু গাঢ় নীল।

জাহাজের মেঝে, মিসাইল সাইলো, মৃতদেহ–সবই সাগরের নীচে।

স্টারবোর্ডে কাত হয়েছে এমভি লোটাস। কমপক্ষে বিশ ডিগ্রি হেলে পড়েছে মেঝে।

সাবের মেঝে থেকে তলোয়ার কুড়িয়ে নিয়েছে পেদরোনভ। ধীর গতিতে নেমে চলেছে মিনি-সাবমেরিন। আবারও পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। একপাশ থেকে তলোয়ার চালিয়েছে রাশান মেজর।

তলোয়ার নেমে আসবার সময় খপ করে পেরোনভের কব্জি ধরে ফেলল রানা।

ভোঁতা আওয়াজ শুনল ওরা। মিসাইল হোল্ডের মেঝেতে নেমেছে এএসডিএস। জাহাজের হেলে পড়া মেঝেতে নেমে স্টারবোর্ডের কার্গো দরজার দিকে রওনা হয়েছে সাবমেরিন।

বাঁকা হয়ে গেল রানার দুনিয়া।

বেকায়দাভাবে সাবমেরিন রওনা হতেই পা পিছলে ভারসাম্য হারাল রানা ও পেরোনভ, পড়ে গেল মেঝেতে।

এমভি লোটাসের ডোরওয়েতে পৌঁছে গেছে সাবমেরিন। পরক্ষণে খসে পড়ল খোলা সাগরে।

ছোট্ট হলদে সাবমেরিন নামতে লাগল সাগর-তল লক্ষ্য করে। নীচে ইংলিশ চ্যানেলের কালো জল, মাথার উপর এমভি লোটাস।

মাথার উপরে যেন প্রকাণ্ড কোনও মহাকাশযান।

অথবা মস্ত নীল তিমি, চাপা দেবে সামান্য কোনও পোকাকে!

ধীরে নামছে সুপারট্যাঙ্কার। কিন্তু ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ভরা, ফলে এক্সপ্রেস এলিভেটারের মতই নেমে চলেছে মিনি-সাবমেরিন।

আরও কিছু ঘটছে। খাড়াভাবে নামতে লাগল হলদে সাবমেরিন।

ইংলিশ চ্যানেলের গড় গভীরতা এক শ বিশ মিটার। অবশ্য, এখানে শারবার্গের সাগরের গভীরতা মাত্র এক শ মিটার। এই সামান্য দূরত্ব পেরোতে বেশিক্ষণ লাগবে না খুদে সাবমেরিনের।

প্রায়ান্ধকার পরিবেশে লড়ছে রানা ও পেরোনভ। মিনি সাবের ইট্রুমেন্ট প্যানেল থেকে আসছে নীলচে ভুতুড়ে আলো।

শালা, তোকে খুন করব, তারপর কেটে নেব তোর মাথা! গর্জে উঠল পেরোনভ। রানার হাত থেকে ঝটকা দিয়ে ছুটিয়ে নিতে চাইছে তলোয়ার ধরা হাতের কব্জি।

এখন পর্যন্ত মোটামুটিভাবে স্ট্যাণ্ডার্ড মুভ নিয়েছে দুজন। কিন্তু এবার মেরিনদের বলা দ্য লেকটার মুভব্যবহার করতে চাইল পেরোনভ। সভ্য মানুষ ওভাবে লড়ে না।

বড় বড় দাঁত দিয়ে রানার গাল কামড়ে ধরতে চাইল সে।

চমকে গিয়ে ঝট করে মুখ পিছিয়ে নিল রানা। এ সুযোগটাই আশা করছিল পেদরোনভ–ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল তলোয়ারের কব্জি। সাঁই করে তলোয়ার চালাল রানার ঘাড় লক্ষ্য করে। কিন্তু ঠিক তখনই সাগরের তলে পৌঁছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সাবমেরিন। ধুপ করে মেঝের উপর আছাড় খেল দুজন।

বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়াল ওরা।

লাফিয়ে সামনে বাড়ল পেরোনভ, একপাশ থেকে চালিয়েছে তলোয়ার। ওই একইসময়ে সামনে বেড়েছে রানা, ঢুকে পড়েছে পেদরোনভের দুর্গে। ইউটিলিটি ভেস্ট থেকে ধাতব কী যেন নিয়েছে, ঝট করে ঢুকিয়ে দিয়েছে রাশানের মুখের ভিতর!

অবাক হওয়ারও সময় পেল না মিখাইল পেরোনভ, মাত্র বুঝতে শুরু করেছে, দ্বিধা না করেই কাছে চলে এসেছে শত্রু।

মাউন্টেনিয়ারিং পিটন অ্যাক্টিভেট করল রানা। চট করে সরিয়ে নিল নিজের মুখ। দৃশ্যটা দেখতে চায় না।

জোরালো স্ন্যাপ! আওয়াজ তুলল পিটন। ভয়ঙ্কর ঝটকা দিয়ে খুলে গেল কাঁকড়ার পায়ের মত দাঁড়া। পেয়েও গেল আঁকড়ে ধরবার মত জায়গা–গেঁথে গেল পেদরোনভের উপর এবং নীচের চোয়ালে।

কী ঘটল, ভালভাবে দেখল না রানা, কিন্তু শুনল পরিষ্কার।

অসুস্থকর কড়াৎ আওয়াজ তুলে বুকের দিকে নামল পেরোনভের নীচের চোয়াল। কিন্তু ওটার এতটা নীচে আসবার কথা নয়।

ঘুরে রানা দেখল, ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছে পেরোনভের মুখের। খুলে গেছে নীচের চোয়াল, ভেঙেও গেছে। উপরের চোয়ালে আরও বেশি ক্ষতি করেছে পিটন। কয়েকটা দাঁড়া আঁচড় কেটেছে পেরোনভের মগজে।

হঠাৎ করেই থমকে গেছে লোকটা, থরথর করে কাঁপছে। গোটা দেহ।

দুহাঁটুর উপর ভর দিয়ে ধুপ করে বসে পড়ল রাশান মেজর।

অনায়াসেই তার তলোয়ারটা নিল রানা, সিধে হয়ে দাঁড়াল শত্রুর সামনে।

পিটপিট করে ওকে দেখছে পেদরোনভ।

রানার ক্ষিপ্ত মন চাইল কেটে নেবে মেজরের মাথা। ওই। কাজই করে লোকটা অন্যদের প্রতি।

কিন্তু তলোয়ার তুলল না রানা।

বুঝে গেছে, চাইলেও এ কাজ করতে পারবে না।

দুহাঁটুর উপর ভর করে টলছে পেদরোনভ, আরও কয়েক সেকেণ্ড ওভাবে বসে রইল, তারপর দড়াম করে মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে। মস্ত হাঁ করা মুখ থেকে গলগল করে বেরোল রক্ত।

লড়াই শেষ।

আবারও খুলে যাওয়া ইয়ারপিস কানে আটকে নিল রানা। শুনল কুয়াশার কণ্ঠ, রানা! সাড়া দাও! তুমি কি বেঁচে আছ?

হ্যাঁ, জবাব দিল রানা। সাগরের নীচে। আপনি কোথায়?

অন্য সাবমেরিনে। তোমার সাবমেরিনের বাইরের বাতি। জ্বালো।

তাই করল রানা।

সর্বনাশ! বিড়বিড় করল কুয়াশা।

কী হয়েছে? জানতে চাইল রানা।

জবাব দিল না কুয়াশা, পাল্টা জানতে চাইল, সাবমেরিনে পাওয়ার আছে?

ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলে কয়েকটি বাটন টিপল রানা। চালু হলো না ইঞ্জিন। অক্সিজেন আছে, কিন্তু প্রপালশানের উপায় নেই। কেন, আপনি নেমে আসতে পারবেন না? হয়তো সরিয়ে নিতে পারবেন আমাকে?

ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারব না।

ঠিক সময় মানে? সমস্যা কী?

বিশাল… আ… সমস্যা…

সমস্যাটা কী খুলে বলুন।

উপরের দিকে তাকাও।

সাবমেরিনের গম্বুজের ভিতর দিয়ে উপরে চাইল রানা।

এবার সব পরিষ্কার দেখল।

নেমে আসছে প্রকাণ্ড সুপারট্যাঙ্কারের খোল!

যেন চাঁদের মস্ত এক টুকরো!

সোজা আসছে ওর দিকেই!

ঢোক গিলল রানা। বুঝে গেছে, ওর সাবমেরিনের উপর চেপে বসবে এক লক্ষ দশ হাজার টনি সুপারট্যাঙ্কার।

এতই বড়, নেমে আসবার সময় সাগরে তৈরি করছে। কম্পন।

র-র-র-র-র-র-র শব্দটা ভীষণ ভীতিকর।

আগে কখনও এই দৃশ্য দেখিনি, বিড়বিড় করল রানা। চট করে মাইকে বলল, কুয়াশা?

ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারব না, হতাশ স্বরে বলল বৈজ্ঞানিক।

ডানে-বামে চাইল রানা।

কোনও উপায় খুঁজতে হবে। সাঁতার কেটে জাহাজের আওতা থেকে বেরোতে পারবে না। ওই মাল এক হাজার ফুট লম্বা, চওড়ায় দুই শ ফুট।

এবার চিড়ে চ্যাপ্টা হবে ও!

বাঁচবার উপায় নেই! কিন্তু মৃত্যুর আগে একটা কাজ করতে পারে। সেটা হবে মস্ত একটা অর্জন।

ইংলিশ চ্যানেলের তলে স্যাটালাইট মাইক চালু করল রানা।

খবির! নিউ ইয়র্কে তোমার অবস্থা কী?

দখল করে নিয়েছি করপোরেশন। মারা পড়েছে শত্রুরা। এখন আমাদের হাতে কন্ট্রোল কন্সেল। ওটার সঙ্গে স্যাটালাইট আপলিঙ্ক যোগ করে দিয়েছি। এখন এগারোটা বায়ান্ন। ডিসআর্ম করার জন্য আট মিনিট পাবেন, স্যর।

উপরে চাইল রানা। নেমে আসছে সুপারট্যাঙ্কার। প্রায় নীরব এক মস্ত দানব। যে গতিতে নামছে, একমিনিট পেরোবার আগেই সাগর-তলে পৌঁছবে।

তোমার হাতে আট মিনিট, খবির, কিন্তু আমার হাতে সময় নেই, শান্ত স্বরে বলল রানা। এখনই ডিসআর্ম করতে হবে মিসাইল।

দেরি করল না রানা, ওয়ারটারপ্রুফ পাউচ থেকে বের করল টাচলক-৯ ইউনিট, ওটার সঙ্গে যুক্ত করল স্যাটালাইট আপলিঙ্ক।

চালু হয়ে গেছে ইউনিট:

স্যাট-লিঙ্ক: কানেক্ট করপোরেশন-০৫-আপলিঙ্ক

কানেকশন মেড।
অ্যাকটিভেট রিমোট সিস্টেম।
মিসাইল লঞ্চ সিকিউয়েন্স ইন প্রগ্রেস।
প্রেস এন্টার টু ইনিশিয়েট ডিসআর্ম সিকিউয়েন্স।
ফার্স্ট প্রটোকল (প্রক্সিমিটি) স্যাটিসফায়েড।
ইনিশিয়েট সেকেণ্ড প্রটোকল।

.

নিউ ইয়র্কের জাহাজের মিসাইল কন্ট্রোল কন্সেলের লাল ও সাদা বৃত্ত দেখা দিল রানার স্ক্রিনে।

চট করে একবার উপরে চাইল রানা। নীল সাগর চিরে নামছে প্রকাণ্ড এমভি লোটাস জাহাজ।

দ্বিতীয়বার ওদিকে চাইল না রানা, চালু করল ডিসআর্ম সিকিউয়েন্স।

নেমে আসবার গতি বেড়েছে সুপারট্যাঙ্কারের… আগের চেয়ে দ্রুত আঙুল চলছে রানার। আশি ফুট উপরে সুপারট্যাঙ্কার।

দপ করে জ্বলে উঠল একটা লাল বৃত্ত, ওটা স্পর্শ করল রানা।

এখন সত্তর ফুট উপরে এমভি লোটাস…

ষাট..

চারপাশের সাগরে সুপারট্যাঙ্কার থেকে ছড়িয়ে পড়ছে জোরালো রররমমমমমম! আওয়াজ।

পঞ্চাশ ফুট… চল্লিশ…

শেষ লাল বৃত্ত স্পর্শ করল রানা। টিপটিপ করে জ্বলে উঠল ডিসপ্লে:

সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
স্যাটিসফায়েড।
থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি):
অ্যাকটিভ।
প্লিয এণ্টার অথোরাইযড ডিসআর্ম কোড।

ত্রিশফুট, তারপর চেপে বসবে এমভি লোটাস!

ছোট্ট সাবমেরিনের চারপাশের পানি কালচে হয়ে উঠেছে। উপর থেকে ছায়া ফেলেছে মস্ত জাহাজ।

রানা ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড এন্ট্রি করল:

৪,৩১,১২,৬০৯

থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি):
স্যাটিসফায়েড।
অথোরাইযড  ডিসআর্ম কোড এন্টার্ড
মিসাইল লঞ্চ অ্যাবোর্টেড।

মৃদু হাসল রানা। ভাবল, সবই শেষ হয় একসময়। সবই। দুঃখই বা কীসের? সাধ্যের বাইরে কিছুই তো আর করা যায় না।

ওর মনটা চাইল চোখ বুজে অপেক্ষা করবে। কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে চেয়ে রইল নেমে আসা মস্ত জাহাজের দিকে।

মনে পড়ল সোহানার অপূর্ব হাসি। মিষ্টি হাসত রেবেকা সাউল, ওকে বা সুলতাকে ফেরাতে পেরেছে ও? তিশা? সুস্থ হয়ে উঠবে, কখনও ভাববে ওর কথা। আগেই বিদায় নিল নিশাত আপা। জীবনটা দিয়েই দিল ওর জন্যে। …আচ্ছা, যখন শুনবে রানা আর নেই, চোখ ভিজে যাবে কট্টর বুড়োর? সোহেল বোধহয় চাকরি ছেড়ে দেবে। গিল্টি মিয়া যখন জানবে ও নেই, বুক চাপড়ে হাউমাউ করে কাঁদবে। আর রাঙার মা… এবার আর পীরের দরবারে যাবে না কিছুতেই। আর কখনও না।…রানা এজেন্সির দায়িত্ব বুঝে নেবে কেউ। কিছুই থেমে থাকে না কারও জন্যে।

আরও মিসাইল থাকলে অন্য কেউ ঠেকাবে ওগুলোকে।

মায়াভরা এই পৃথিবীটা সত্যি সুন্দর ছিল, ভাবল রানা। এবং খুব হঠাৎ করেই বিদায় নিতে হচ্ছে ওকে।

বড়জোর বিশ সেকেণ্ড? সত্যিই বড় দ্রুত নেমে এল সুপারট্যাঙ্কার। থরথর করে কাঁপতে লাগল সাগরতল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল বিকট বুম! আওয়াজ। নানাদিকে ছিটকে গেল বালির মেঘ। কিন্তু তখন সাবমেরিনের ভিতর নেই রানা।

এমভি লোটাস বিশফুট উপরে পৌঁছতেই চারপাশে আরও কালো ছায়া ফেলল জাহাজটা। নিজের চিন্তায় ডুবে ছিল রানা। তখনই শুনল এএসডিএসের গায়ে ভোতা ধাতব আওয়াজ।

ঝট করে ওদিকে চাইল রানা। অবাক হলো খুব, ওর ছোট্ট সাবমেরিনের ধাতব দেহে আটকে গেছে একটা ম্যাগহুক। ওটার দড়ি জাহাজের খোলের ওপাশে।

কানের ভিতর ধমকে উঠল কুয়াশা: রানা! জলদি! বেরোও!

ঝড়ের গতিতে কাজে নামল রানা। মাত্র একবার দম নিল, পরক্ষণে টিপে দিল হ্যাচ বাটন।

হ্যাচ খুলতেই হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকল পানি। মাত্র দু সেকেণ্ড লাগল সাবমেরিন পুরে যেতে। মুহূর্তে বেরিয়ে এল রানা, খপ করে ম্যাকহুকের দড়ি ধরে দুটো টান দিল।

ওই একইসময়ে দড়ির অপরপ্রান্তে হুকের ডিম্যাগনেটাইয সুইচ টিপে দিয়েছে কুয়াশা। লঞ্চার বিদ্যুদ্বেগে টানতে লাগল দড়ি। সাগরের তলে রওনা হলো রানা। ওর মাথার একটু উপরে নামছে সুপারট্যাঙ্কার। মাত্র তিনফুট নীচে ঝড়ের গতিতে সরসর করে পিছিয়ে চলেছে বালির এবড়োখেবড়ো প্রান্তর।

পাঁচ সেকেণ্ড পর জাহাজের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল রানা। ওর দুপায়ের আধ ফুট পিছনে ইংলিশ চ্যানেল কাঁপিয়ে নেমে এল সুপারট্যাঙ্কার। প্রচণ্ড আওয়াজে কানের তালু ঝনঝন করে উঠল ওর। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল বিপুল বালি, সেই মেঘের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলল রানা।

মেঘের ওদিকে ওর জন্য অপেক্ষা করছে কুয়াশা, বসে আছে দ্বিতীয় এএসডিএস-এর হ্যাঁচে। একহাতে নতুন পনি বটল। অন্যহাতে তিশার ম্যাগহুক।

রানা পৌঁছতেই ওর হাতে পনি বটল ধরিয়ে দিল কুয়াশা। বড় করে দুবার দম নিল রানা।

দশ সেকেণ্ড পেরোবার আগেই মিনি-সাবে ঢুকল ওরা। নতুন করে সাব রিপ্রেশারাই করল কুয়াশা। বের করে দিল বাড়তি পানি।

কিছুক্ষণ পর বিক্ষুব্ধ, বৃষ্টিস্নাত ইংলিশ চ্যানেলে ভেসে উঠল দুই দুঃসাহসী বাঙালি যুবকের হলদে সাবমেরিন। মস্ত সব ঢেউ ডুবিয়ে দিতে চাইল ওদেরকে। তখনই সাবের উপর পড়ল অত্যুজ্জ্বল হ্যালোজেন স্পটলাইট। মাত্র দশফুট উপরে কালো শকুন নিয়ে নেমে এসেছে রঘুপতি।

বারো

স্থানীয় সময়: সন্ধ্যা ছয়টা পাঁচ মিনিট

এখন আমেরিকার ই.এস.টি, বারোটা পাঁচ মিনিট।

ইংলিশ চ্যানেলের আকাশে দক্ষিণ দিক লক্ষ্য করে বিদ্যুদ্বেগে ছুটছে কুয়াশার কালো শকুন।

চুপচুপে ভেজা পোশাকে গানারের সিটে বসে পড়েছে কুয়াশা। রানা অবশ্য পায়চারি করছে বিমানের বম বে-তে। বের করেছে মডিফায়েড পাম পাইলট। বাকি রয়ে গেছে এখনও কিছু কাজ।

আবারও মিসাইল উৎক্ষেপের তালিকা বের করেছে। তিন তালিকা তুলনা করে দেখবে।

আগের দুই তালিকার প্রথম তিন জাহাজ ঠিকই আছে। কিন্তু পাল্টে গেছে শেষের জাহাজগুলোর মিসাইল।

সোর্স শিপ – ডেলিভারি সিস্টেম – ডাব্লিউএইচ – অরিজিন টার্গেট – টাইম

হোপ স্কাই হর্স-৩ ডাব্লিউ ৮৮ ১১১০০-০১ ১১৬২২১.৬০ ২৩২৭-০১ ৪০০১-০০ ১২.১৫ (টাইওয়ান স্ট্রেইটস) (বেইজিং)

সেইম ১১১০০-০১ ১১৪৪৫-৭০ ২৩২৮-০০ ২২৪৩-২৮ ১২.৩০
(টাইওয়ান স্ট্রেইটস) (হংকং)

ডলফিন ঘৌরি-২ ০৭৭২৫-০৫ ২৩২৭-০১ ১৮৫ ২৩২৭.০১ ২৯৫৮.০৬ ১২.৪৫
(অ্যারাবিয়ান সি) (নিউ দিল্লি)

অগ্নি-২ ০৭০৪০.৪৪ ০৭৩৩২-৬১ ২৩২৭-০০ ৩২৩০-৫১ ১২.৪৫
(অ্যারাবিয়ান সি) (ইসলামাবাদ)

জ্যাকিউলিন জেরিকো-২বি ডাব্লিউ-৮৮ ০৪৪০২.২৪ ০৪১৪৫,০৯ ১৬৫০.৪৯ ২১৩০.০১ ১৪.০০

শেষের জাহাজটা আগে ছিলই না।

প্রথম দুজাহাজের জিপিএস লোকেশন কী আগেই জানিয়েছে। খবির।

সোর্স – শিপ – ডেলিভারি সিস্টেম – ডাব্লিউএইচ – অরিজিন – টার্গেট – টাইম

হোপ স্কাই হর্স-৩ ডাব্লিউ ৮৮ ১১১০০-০১ ১১৬২২১.৬০ ২৩২৭-০১ ৪০০১-০০ ১২.১৫
(টাইওয়ান স্ট্রেইটস) (বেইজিং)

সেইম ১১১০০-০১ ১১৪৪৫-৭০ ২৩২৮-০০ ২২৪৩-২৮ ১২.৩০
(টাইওয়ান স্ট্রেইটস) (হংকং)

ডলফিন ঘৌরি-২ ০৭৭২৫-০৫ ২৩২৭-০১ ২৩২৭.০১ ২৯৫৮.০৬ ১২.৪৫
(অ্যারাবিয়ান সি) (নিউ দিল্লি)

অগ্নি-২ ০৭০৪০.৪৪ ০৭৩৩২-৬১ ২৩২৭-০০ ৩২৩০-৫১ ১২.৪৫
(অ্যারাবিয়ান সি) (ইসলামাবাদ)

রানা টের পেল, হঠাৎ করেই গোটা পরিস্থিতির নতুন ডিমেনশন এনে দিয়েছে এ তালিকা।

এমভি হোপ জাহাজ থেকে বেইজিং ও হংকঙের উপর যে মিসাইল ফেলা হবে, ওগুলো তাইওয়ানের স্কাই হর্স আইসিবিএম এর ক্লোন। বোমা হিসাবে থাকছে আমেরিকান ওয়ারহেড।

এদিকে এমভি ডলফিন থেকে নিউ দিল্লির উপর যে মিসাইল ফেলবে, ওটা পাকিস্তানি ঘৌরি-২ নিউক্লিয়ার মিসাইলের ক্লোন। আবার একই জাহাজ ইসলামাবাদে ফেলবে ভারতীয় অগ্নি-২-এর ক্লোন নিউক্লিয়ার মিসাইল।

সর্বনাশ… বিড়বিড় করল রানা।

তাইওয়ানিরা নিউক্লিয়ার স্ট্রাইক করলে পাল্টা কী ব্যবস্থা। নেবে চিন?

স্রেফ উড়িয়ে দেবে ওই ছোট দ্বীপ।

ভারত এবং পাকিস্তান পরস্পরের রাজধানীর উপর আণবিক বোমা ফেললে?

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশও

রানা বুঝল না কেন খবিরের দেয়া তালিকার সঙ্গে এই তালিকা মিলছে না।

গভীরভাবে ভাবতে চাইল রানা।

কোথা থেকে এই তালিকা পেয়েছে খবির?

মোসাদ এজেন্ট ডেনিস ই, ম্যাকিনের কাছ থেকে। সে লোক বেশ কয়েক মাস চেষ্টা করে পেয়েছিল ম্যাজেস্টিক-১২-র কাছ থেকে।

আর নতুন এই তালিকা আমি পেয়েছি কোথা থেকে? অতীত নিয়ে ভাবতে চাইল রানা।

ও… হ্যাঁ… কয়েক মুহূর্ত পর বলল।

মনে পড়েছে।

তখন তিশার পাশে ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নের পাথুরে অ্যান্টি রুমে বসে ছিল। আর কুয়াশা ছিল মোসিউ ড্যাবলারের অফিসে। হ্যাঁক করছিল লোকটার কমপিউটার।

হোল্ডের দরজা থেকে রানা জানতে চাইল, কুয়াশা, আপনি যখন ড্যাবলারের সঙ্গে দুর্গে ছিলেন, সে কি একবারও বলেছে ওই অফিস কার?

কাঁধ ঝাঁকাল কুয়াশা। হ্যাঁ। বলেছিল ওই অফিস তার নয়। ওটা দুর্গের মালিকের।

ডেমিয়েন ডগলাস?

হ্যাঁ, কেন?

সবই বুঝতে পেরেছে রানা।

ওই অফিসে আরও একটা কমপিউটার চালু ছিল। কোনও ড্রয়ারে, বা সাইড টেবিলে। আপনি নিজেই বলেছিলেন, আপনার পাম পাইলট যে-কোনও কমপিউটারের হার্ড ডিস্ক থেকে ডকুমেন্ট হ্যাঁক করে। ওই কমপিউটার ছিল ডেমিয়েন ডগলাসের।

তাতে সমস্যা কী?

পাম পাইলটের স্ক্রিন উঁচু করে নতুন তালিকা দেখাল রানা। এটা ম্যাজেস্টিক-১২-র প্ল্যান নয়। তারা গোটা দুনিয়া জুড়ে কোল্ড, ওঅর তৈরি করতে চেয়েছিল। টেরোরিস্ট মিসাইল আঘাত হানবে। সেগুলো হবে শাহাব বা টেপও-ডং-২। এজন্যেই গ্লোবাল জিহাদের টেরোরিস্টদের লাশ রেখেছিল ড্রাগন প্লান্টে। একই কাজ করে সুপারট্যাঙ্কারে, যাতে সবাই বোঝে, টেরোরিস্টরা চুরি করেছে নোয়ায শিপ।

কিন্তু এই তালিকা অন্যকিছু। ডগলাসের কোম্পানি একেবারে আলাদা লির্ড মিসাইল বসিয়েছে নোয়ায শিপে ওগুলোর কথা জানে না ম্যাজেস্টিক-১২। টেরোরিযমের উপর গ্লোবাল ওঅর নয়, তার চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় ডেমিয়েন। দুনিয়ার প্রতিটি শক্তিশালী দেশে পড়বে মিসাইল। আর দোষ পড়বে শত্রু দেশের।

পশ্চিমাদের উপর পড়বে টেরোরিস্টদের মিসাইল। ভারত আর পাকিস্তান একে অপরের উপর আণবিক বোমা ফেলবে। চিনের শহরে পড়বে তাইওয়ানিদের মিসাইল।

আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা।

বাড়তি পদক্ষেপ নিয়েছে ডেমিয়েন ডগলাস। এটা এম-১২ র প্ল্যান নয়। ডগলাসের প্ল্যান এটা। এর ফলে কোনও কোল্ড ওঅর শুরু হবে না। অন্য কিছু হবে। গোটা দুনিয়া জুড়ে মহাযুদ্ধ বাধবে। শৃঙ্খলা বলতে দুনিয়ায় কিছুই থাকবে না।

তার মানে তুমি বলছ, বড়লোক সংঘের সবাইকে বোকা। বানিয়ে নিজেই যা করার করবে ডেমিয়েন ডগলাস? জানতে চাইল কুয়াশা।

ঠিক তা-ই বলছি, বলল রানা। ওর মনে পড়ল ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নে ডেমিয়েনের বলা কথাটা: কেউ কেউ আজও জানে না। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে ওই আফ্রিকায়।

ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে আফ্রিকায়, বলল রানা, প্রতিটি জাহাজে ছিল আফ্রিকান কমাণ্ডো। ইরিত্রিয়ান বা নাইজেরিয়ান। চট করে পাম পাইলটের স্ক্রিনে নতুন ডকুমেন্ট আনল রানা।

আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার!

স্ক্রিনে লেখা:

একযেকিউটিভ ইটিনেরারি

দ্য প্রোপোযড অর্ডার অফ ট্র্যাভেল ইয অ্যায ফলোয: আসমারা (২৪/০৬), লৌণ্ডা (২৪/০৬), আবুজা (২৭/০৬), নাযামেনা (২৭/০৬) এবং ব্রুক (২৯/০৬).

০১/০৭ –আসমারা (এম্বেসি)

০৩/০৭–লৌণ্ডা (থাকছি ওলিফ্যাণ্টের ভাতিজার ওখানে)

গতবছর আফ্রিকায় যাওয়ার সময় এই যাত্রা তালিকা করেছিল ডেমিয়েন ডগলাস।

আসমারা: ইরিত্রিয়ার রাজধানী।
লৌণ্ডা: অ্যাঙ্গোলার রাজধানী।
আবুজা: নাইজেরিয়া।
নাযামেনাঃ চাঁদ।
তব্রুক লিবিয়ার সবচেয়ে বড় এয়ারফোর্স বেস।

ডেমিয়েন ডগলাস গিয়ে ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করছিল না। আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি দেশের সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে।

কীসের সেটা?

যদি দুনিয়ার শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের ভিতর যুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, বলল রানা, একবার ভেবেছেন দুনিয়ার অন্যান্য এলাকায় কী ঘটবে?

পুরনো গায়ের ঝাল মেটাবে অনেক দেশ, বলল কুয়াশা। নতুন করে শুরু হবে এথনিক ক্লিনসিং। সার্বরা খুন করবে ক্রোয়েটদের। রাশানরা শেষ করবে চেচেনদেরকে। কুর্দদের জবাই করবে ইরাক ও তুরস্ক। সুযোগসন্ধানীরা সুবিধা আদায় করবে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চেষ্টা করেছিল জাপান। অন্যদেশের উপর হামলা করবে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী দেশ। প্রাকৃতিক সম্পদ এবং এলাকা দখল করবে। আমাদের বাংলাদেশের মত গরীব দেশকে পায়ের নীচে পিষে ফেলবে শক্তিশালী দেশ। আস্তে করে মাথা নাড়ল বৈজ্ঞানিক। চারপাশে শুরু হবে ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলা।

আবারও জাহাজের তালিকা স্ক্রিনে আনল রানা।

শেষ এন্ট্রির উপর চোখ পড়তেই নতুন করে মনোযোগ দিল।

জ্যাকিউলিন জেরিকো-২বি ডাব্লিউ-৮৮ ০৪৪০২.২৪ ০৪১৪৫,০৯ ১৬৫০.৪৯ ২১৩০.০১ ১৪.০০

জেরিকো-২৮ ক্লোন মিসাইল, ভাবল রানা। ওটা লং-রেঞ্জ ব্যালেস্টিক মিসাইল। ইজরায়েলের। ওই মিসাইলে থাকবে আমেরিকার ডাব্লিউ-৮৮ ওয়ারহেড।

ওটার টার্গেট কী?

খবিরের আইপি-র ম্যাপ ব্যবহার করল রানা, প্লট করল। জিপিএস কোঅর্ডিনেট।

ম্যাপ অনুযায়ী টার্গেট খুঁজতে শুরু করেছে রানার আঙুল। পেয়েও গেল।

সর্বনাশ… বিড়বিড় করে বলল।

শেষ ক্লোন মিসাইল ইজরায়েলিদের, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আমেরিকার তৈরি টার্গেট সৌদি আরব।

মিসাইল আঘাত হানবে মক্কার কাবাঘরের ওপর। ম্যাপ দেখছে কুয়াশা। হঠাৎ করেই নীরবতা নেমেছে বিমানের ককপিটে।

আমেরিকার বোমা মাথায় নিয়ে মুসলিমদের সবচেয়ে পবিত্র শহরে হামলা করবে ইজরায়েলিদের মিসাইল।

আজই হজ। লাখে লাখে মুসলিম জড় হয়েছে মক্কায়। ইচ্ছা করেই নির্দিষ্ট এই তারিখে আণবিক বোমা ফেলছে। ডেমিয়েন ডগলাস।

মক্কা উড়ে যাওয়ার পর পরই আগুন জ্বলে উঠবে গোটা দুনিয়া জুড়ে। কোনও দেশে নিরাপদ থাকবে না কোনও মানুষ।

আণবিক হামলার পর স্বাভাবিকভাবেই চরম প্রতিশোধ নিতে চাইবে গোটা বিশ্বের মুসলমান।

এরপর যে মহাযুদ্ধ, তা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিটি মুসলিম দেশের।

ওটাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কিছুদিনের ভিতর ধ্বংস হবে গোটা মানব-সভ্যতা।

আজই হজ, কুয়াশা, বলল রানা। হিসাব কষেই এই দিনটাকে বেছে নিয়েছে ডেমিয়েন ডগলাস।

কোথা থেকে মিসাইল ফেলবে? জানতে চাইল কুয়াশা।

জিপিএস কো-অর্ডিনেটস অনুযায়ী শেষ লিযার্ড মিসাইলের লঞ্চ লোকেশন প্লট করল রানা। কুঁচকে উঠল ভুরু।

ওটা কোনও জাহাজ থেকে নয়, বলল। স্থলভূমি থেকে। ইয়েমেনের ভেতর জায়গাটা।

ইয়েমেন? রানার দিকে চাইল কুয়াশা। সৌদি আরবের দক্ষিণের দেশ। মক্কা থেকে সামান্য দূরেই।

ইয়েমেন… ভাবতে শুরু করেছে রানা। ইয়েমেন…

আমেরিকান সেনাবাহিনী ওকে সাইবেরিয়ায় পাঠানোর আগে ব্রিফ করেছিল। তখন শুনেছিল ইয়েমেনের কথা।

ইয়েমেনে আছে ক্রাস্ক-৮ ক্লোন মিসাইল, অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল রানা, কোল্ড ওঅরের সময় পাবলো-৯-এর ফ্যাসিলিটির মতই বেশকিছু দেশে ল্যাণ্ড বেইযড  আইসিবিএম ফ্যাসিলিটি করেছিল সোভিয়েতরা। ক্লায়েন্ট দেশ ছিল সিরিয়া, সুদান ও ইয়েমেন।

ঝড়ের মত ভাবছে রানা।

পাবলো-৯ শহরটা কিনে নিয়েছে স্করপিয়ন শিপিং কোম্পানি লিমিটেড। ওটা ডেমিয়েন ডগলাসের। ড্রাগন করপোরেশনের সাবসিডিয়ারি।

রানা চেয়ে আছে কুয়াশার দিকে। আমাদের বোধহয় দক্ষিণ পুব লক্ষ্য করে রওনা হয়ে যাওয়া উচিত।

আস্তে করে মাথা দোলাল কুয়াশা। এবং ব্যবহার করা উচিত আফটারবার্নার। …রঘুপতি?

প্রথমবারের মত দ্বিধা দেখা দিল রোববাটের চেহারায়। বস, একটা কথা… আমরা পূর্ণগতি তুললেও দুঘণ্টার ভেতর ইয়েমেনে পৌঁছতে পারব না। ছয় হাজার কিলোমিটার পেরোতে হবে। কাজেই দরকার পড়বে কমপক্ষে চার ঘণ্টা সময়। তা ছাড়া, আফটারবার্নার ব্যবহার করলে যে অকটেন লাগবে, তাতে আমরা বড়জোর ফ্রেঞ্চ আল্পস পর্যন্ত যেতে পারব।

ফিউয়েল নিয়ে ভাবতে হবে না, বলল রানা, আকাশেই ফিউয়েলিঙের ব্যবস্থা করতে পারব। তা ছাড়া, আমরা সুখোই ফাইটার জেট নিয়ে ইয়েমেনে যাচ্ছি না।

আপনারা যা বলেন, বলল রঘুপতি। কাত করে নিল বিমান, রওনা হলো দক্ষিণ-পুব লক্ষ্য করে। চালু করেছে আফটারবার্নার।

স্যাটালাইট মাইকে যোগাযোগ করতে চাইল রানাঃ মিস্টার ডেলাস, আপনি কি এখনও লাইনে আছেন?

জী, সংক্ষিপ্ত জবাব এল লণ্ডন থেকে।

একটা কোম্পানির কী কী অ্যাসেট আছে জানতে চাই। ওটার নাম স্করপিয়ন শিপিং কোম্পানি। ইয়েমেনে ওদের স্থাবর কী আছে, জানা দরকার। বিশেষ করে ওটা যদি হয় পুরনো। সোভিয়েত মিসাইল সাইট।

আরও দুটো ব্যাপারে সাহায্য চাই। প্রথম কথা, ইউরোপের। এক্সপ্রেস প্যাসেজ লাগবে আমার। এ ছাড়া কয়েকবার মিড এয়ার রিফিউয়েলিং দরকার পড়বে। আপনাকে আমাদের ট্র্যান্সপণ্ডার সিগনাল পাঠিয়ে দেব।

জী। আর দ্বিতীয় কাজটি?

আমার জন্যে বিশেষ দুটো আমেরিকান বিমানে ফিউয়েল ভরে রাখবেন। ওই দুই বিমান এখন আছে ইটালির মিলানের অ্যারোস্টাডিয়া ইটালিয়া এয়ারশোতে।

পরের তিরিশ মিনিট ঝড়ের গতিতে কেটে গেল।

দুনিয়ার প্রায় সমস্ত দেশের সরকারের নির্দেশে দেরি না করেই কাজে নামল নানাধরনের সশস্ত্রবাহিনী।

তেরো

আরব সাগর।

ভারত উপকূল থেকে সামান্য দূরে। অক্টোবর ১৫।

স্থানীয় সময় রাত নয়টা পাঁচ মিনিট। ও ইউএসএ, ই.এস.টি. দুপুর বারোটা পাঁচ মিনিট।

প্রায় শান্ত ভারত মহাসাগরে ভাসছে সুপারট্যাঙ্কার এমভি ডলফিন। যেন চেয়ে আছে ভারত ও পাকিস্তানের উপকূলের দিকে। উৎক্ষেপ করতে তৈরি পেটে রাখা মিসাইল নিয়ে।

জাহাজের কেউ জানল না, দুই মাইল পিছনে তেড়ে আসছে

একটা লস অ্যাঞ্জেলেস-ক্লাস অ্যাটাক সাবমেরিন।

স্বাভাবিক কারণেই জাহাজের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে সাবমেরিনকে দেখতে পেল না আফ্রিকান কমাণ্ডোরা। এবং যখন পিছনে পৌঁছে গেল সাবমেরিন, জাহাজের রেডার সঙ্কেত দিল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

একইসময়ে এমভি ডলফিনে লাগল দুটো মার্ক-৭৮ টর্পেডো। ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে তলি খসে গেল জাহাজের, একমিনিটও লাগল না ডুবে যেতে।

.

তাইওয়ান স্ট্রেইটস।

চিন ও তাইওয়ানের মাঝের আন্তর্জাতিক জলসীমা। স্থানীয় সময় রাত একটা দশ মিনিট।

অক্টোবর ১৫। আমেরিকার ই.এস.টি, বারোটা দশ মিনিট। অক্টোবর ১৪।

ভারতীয় মহাসাগরে এমভি ডলফিনের কপালে যা ঘটেছে, ঠিক তাই হলো এমভি হোপ-এর।

তাইওয়ান স্ট্রেইটের সি লেনে নিশ্চিন্তে খাপ পেতে বসে ছিল। জাহাজটা। দূরে দুটো সুপারট্যাঙ্কার এবং একটি ফ্রেইটার। এমন সময় এমভি হোপের তলি খসিয়ে দিল ওয়ায়ার-গাইডেড দুটো আমেরিকান মার্ক-৪৮ টর্পেডো।

অন্য জাহাজের কয়েকজন রাতের প্রহরী কর্তৃপক্ষকে জানাল; দিগন্তে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের আগুন দেখেছে তারা। সেই সঙ্গে বিকট আওয়াজ।

রেডিয়ো করা হলো এমভি হোপকে। কিন্তু জবাব দিল না কেউ। জাহাজটা যেখানে ছিল, সেখানে কোনও জাহাজ খুঁজে পাওয়া গেল না।

এমভি হোপ অদৃশ্য হয়েছে।

যে সাবমেরিন ওটাকে ডুবিয়ে দিয়েছে, তাকে কেউ দেখেনি। পরবর্তীতে মার্কিন সরকার জোর গলায় বলবে, ওই এলাকায় তাদের কোনও সাবমেরিনই ছিল না।

.

ওয়েস্ট কোস্ট, ইউএসএ।

সান ফ্রান্সিসকোর সামান্য দূরের সাগর। অক্টোবর ১৫। স্থানীয় সময় সকাল নয়টা বারো মিনিট। নিউ ইয়র্কে দুপুর বারোটা বারো মিনিট।

নোয়ায শিপ এমভি রুবল নামের সুপারট্যাঙ্কারের হোল্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে বারোজন ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন, একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে একডজন আফ্রিকান কমাণ্ডোর লাশ। এইমাত্র জাহাজের মিসাইল কন্ট্রোল কন্সেলের সঙ্গে স্যাটালাইট আপলিঙ্ক যুক্ত করেছে কেভিন কনলন।

পুরো এক সেকেণ্ডও লাগল না ওই সিগনাল রানার কাছে কালো শকুনে পৌঁছুতে। ও রয়েছে ফ্রান্সের আকাশে, চলেছে। ইতালি লক্ষ্য করে।

রানা টাচলক সিস্টেম ব্যবহার করে দূর থেকে মিসাইল ডিসআর্ম করছে, এই সময়টা কন্সেলের সামনেই থাকল কেভিন। নিজের দেহ দিয়ে আড়াল করল আপলিঙ্ক। দুই ইরিত্রিয়ান কমাণ্ডো ধরা পড়েনি, এখনও আড়াল থেকে গুলি করছে। একটু পর পরই গ্রেনেড আসছে তাদের তরফ থেকে।

ভয়ে থরথর করে কাঁপছে কেভিন। আশপাশ দিয়ে ছুটছে বুলেট। একটু দূরে গ্রেনেড ফাটল। কন্সেল আড়াল করেই রাখল কেভিন।

অবশ্য, দুই মিনিট পেরোবার আগেই মেরিনদের হাতে মারা পড়ল দুই ইরিত্রিয়ান কমাণ্ডো।

তার ষোলো সেকেণ্ড পর কালো শকুনে বসে এমভি রুবলের লঞ্চ সিস্টেম অ্যাবোর্ট করে দিল রানা। কাজটা শেষ হতেই মস্ত শ্বাস নিয়েই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল কেভিন কনলন।

.

অ্যারোস্টাডিয়া এয়ারফিল্ড।

মিলান, ইটালি। অক্টোবর ১৫। স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটা। নিউ ইয়র্কে দুপুর একটা।

অ্যারোস্টাডিয়া এয়ারফিল্ডের রানওয়েতে সরাসরি তুমুল হাওয়া ফেলছে শক্তিশালী সব রেট্রোস, ভাসতে ভাসতে টারমাকে নেমে এল কুয়াশার কালো শকুন।

এরই ভিতর আঁধার নামতে শুরু করেছে উত্তর ইটালি জুড়ে, অবশ্য এয়ার শো-তে গত পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ওভারটাইম করছে ইউএস এয়ার ফোর্সের কন্টিনজেন্ট। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে কঠোর নির্দেশ দেয়া এসেছে, ফিউলিং করতে হবে বিশেষ দুই এয়ারোপ্লেনের।

দেখবার মত মস্ত বি-৫২ বোমারু বিমানের এক শ গজ দূরে রানওয়েতে নেমেছে রাশান সুখোই ফাইটার বিমান।

প্রকাণ্ড বোমারু বিমানের দুই ডানা থেকে ঝুলছে বুলেট আকৃতির দুই কালো বিমান, যেন বড় আকারের দুই মিসাইল।

ওগুলো আসলে মিসাইল নয়: এক্স-১৬ বিমান।

অনেকেই ভাবেন, মাক থ্রির বেশি গতি তোলা অসম্ভব। দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী বিমান এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড।

কথাটা প্রায় ঠিকই।

কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর গতি সহজেই অতিক্রম করেছে একটি বিমান। সত্যি বলতে, ওটার গতি কয়েক গুণ বেশি। ঘণ্টায় সাত হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করতে সক্ষম ওটা। মাক সিক্সের চাইতেও বেশি। অবশ্য, অপারেশনাল স্ট্যাটাস দেয়া হয়নি ওই বিমানকে।

বিমানটি নাসার তৈরি। নাম: এক্স-১৬।

বেশিরভাগ বিমান ব্যবহার করে জেট ইঞ্জিন, কিন্তু সীমাবদ্ধতা রয়েছে জেটের। ওই জেট কাজে লাগিয়েই মাক থ্রি গতি পেয়েছে এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড।

কিন্তু এক্স-১৬ অন্য জিনিস। ওটাকে চালায় রকেট। মুভিং পার্ট বলতে গেলে কিছুই নেই। সলিড হাইড্রোজেন ফিউয়েল জ্বেলে বিদ্যুদ্বেগে ছোটে। জেট বিমানের মত নয়, বরং মিসাইলের মত কাজ করে ওই বিমান। যারা চোখে দেখেছে, তারা বলেছে, ওটা আসলে একটা মিসাইলই, ওটার ভিতর স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে রাখা হয় পাইলটকে।

আজ পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে মোট পাঁচটি এক্স-১৬। এখন। তাদের দুটোকে অ্যারোস্টাডিয়া ইটালিয়া এয়ারশোতে দেখছে। রানা। কয়েক দিন পর ওই দুই বিমানের প্রদর্শনী হবে।

কালো শকুন থেকে নেমে টারমাক পেরোতে শুরু করল রানা। পাশেই রইল কুয়াশা ও রঘুপতি।

বি-৫২ বোমারু বিমানের ডানা থেকে ঝুলছে দুই এক্স-১৬। কাছ থেকে দেখল রানা।

বড় বিমান নয় এক্স-১৬। দেখতে কুৎসিতই বলা চলে। সুন্দর করবার চেষ্টাই করা হয়নি, ডিযাইন করা হয়েছে বাতাস চিরে অকল্পনীয় গতিতে ছুটে যাওয়ার জন্য।

টেইলফিনে বাঁকা অক্ষরে লেখা: নাসা।

দুই কালো বিমানের নীচে লেখা: ইউএস এয়ার ফোর্স।

ওদের সামনে এসে পরিচিত হলেন দুই কর্নেল।

একজন আমেরিকান, অন্যজন ইটালিয়ান।

মেজর রানা, বললেন আমেরিকান কর্নেল, আপনার জন্য এক্স-১৬ তৈরি। পুরো ফিউয়েল ভরা হয়েছে। যে-কোনও সময়ে রওনা হতে পারেন। কিন্তু একটা সমস্যা হয়েছে। গতকাল আমাদের এক পাইলট ট্রেনিঙের সময় দুর্ঘটনায় পড়ে পাঁজরের হাড় ভেঙেছে। ওর যা অবস্থা, ধারণা করছি, এই বিমানে উঠে জি। ফোর্স সহ্য করা অসম্ভব।

এটা বড় সমস্যা নয়, বলল রানা। এমনিতেও নিজের পাইলট সঙ্গে নিতাম। রঘুপতির দিকে চাইল ও। তুমি মাক সিক্স সহ্য করতে পারবে?

সামান্য মাথা দোলাল রঘুপতি, ঠোঁটে মৃদু হাসি।

আমরা ন্যাশনাল রেকনেসেন্স অফিস থেকে কিছু স্যাটালাইট রেইডার স্ক্যান পেয়েছি, বললেন আমেরিকান কর্নেল। আপনারা যাওয়ার পথে বিপদে পড়তে পারেন।

ক্লিপবোর্ডের মত ছোট পোর্টেবল ভিউস্ক্রিন রানার দিকে। এগিয়ে দিলেন তিনি।

দক্ষিণ-পুব মেডিটারেনিয়ান এলাকার ইনফ্রা-রেড ছবি। চেনা। গেল সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর।

একটা ছবি অনেক উপর থেকে তোলা। অন্যটা যুম করা হয়েছে।

প্রথম ইমেজে রানা দেখল, সুয়েজ খাল এলাকায় লাল অসংখ্য বিন্দু ভাসছে মেঘের মত।

দ্বিতীয় স্যাটালাইট ছবিতে পরিষ্কার দেখা গেল চারপাশ। লাল মেঘ আসলে দেড় শ বিন্দু।

বিন্দুগুলো কীসের? জানতে চাইল কুয়াশা।

জবাব দিতে হলো না কর্নেলকে।

বুঝে গেছে রানা। বলল, ওগুলো বিমান। ফাইটার জেট। কমপক্ষে পাঁচটি আফ্রিকান দেশের। ফ্রেঞ্চরা আগেই জেনেছিল ওগুলো আকাশে উঠেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি কেন উঠল। কারণটা এখন জানি। আফ্রিকার পাঁচটা শক্তিশালী দেশের প্রধানরা আশা করছে, এবার বদলে যাবে পৃথিবীর ক্ষমতার বলয়। এরা চায় না আমরা মক্কার দিকে যাওয়া মিসাইলটা ঠেকিয়ে দিই। ওই মিসাইল ডেমিয়েন ডগলাসের রক্ষা-কবজ। আকাশে ওঠা বিমানগুলো পাহারা দেবে শেষ মিসাইলটাকে। ওটার দিকে কাউকে যেতে দেবে না।

মাত্র তিন মিনিট পর রানওয়ে ধরে ভয়ঙ্কর গর্জন ছাড়তে ছাড়তে রওনা হলো বি-৫২। ডানার দুদিকের বাইরের অংশে ঝুলছে দুই এক্স-১৬।

ডানদিকের এক্স-১৬-র ককপিটে রঘুপতির পিছনে বসেছে মাসুদ রানা। ছোট জায়গায় প্রায় কুঁকড়ে আছে রোবট। অন্য বিমানে নাসার পাইলটের পিছনের সিটে কুয়াশা।

ইউটিলিটি ভেস্টে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটকে নিয়েছে রানা টাচলক ৯ ডিসআর্ম ইউনিট। কোমরে ঝুলছে নানান অস্ত্রের পাউচ।

ওরা যে পরিকল্পনা করেছে, তা প্রায় অসম্ভব।

যেহেতু রানা ছাড়া কেউ লির্ড মিসাইল ডিসআর্ম করতে পারবে না, তাই স্ক্রাস্ক-৮ ক্লোন মিসাইলের খুব কাছে যেতে হবে ওর্কে। পাশে তখন থাকবে কুয়াশা।

বাধা আসবে নানাদিক থেকে। হামলা করতে পারে আফ্রিকান কমাণ্ডো দল। এটা মাথায় রেখে এডেন থেকে একদল মেরিনকে পাঠাতে বলেছে রানা। অবশ্য, তারা সঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারবে কি না, তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

লণ্ডন থেকে যোগাযোগ করল চার্লস ডেলাস।

মিস্টার রানা, যা চেয়েছিলেন, বোধহয় পেয়েছি, বলল। ইয়েমেনের মরুভূমির চার হাজার একর জমি কিনে নিয়েছে। স্করপিয়ন শিপিং কোম্পানি। জায়গাটা এডেন থেকে দুই শ মাইল। দক্ষিণ-পশ্চিমে, লোহিত সাগরের মুখে। পুরনো সোভিয়েত সাবমেরিন রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি ছিল। আমাদের স্যাটালাইটের ছবি আশি দশকের। কিন্তু মনে হচ্ছে, ওখানে কয়েকটা প্রকাণ্ড ওয়্যারহাউস আছে। এ ছাড়া…

ওটাই, বলল রানা। কোঅর্ডিনেটস্ পাঠান।

তাই করল চার্লস ডেলাস।

বিমানের ট্রিপ কমপিউটারে সংখ্যাগুলো তুলে দিল রানা।

দক্ষিণ ইয়েমেন পর্যন্ত যেতে হলে পেরোতে হবে পাঁচ হাজার ছয় শ বিশ কিলোমিটার।

সাত হাজার কিলোমিটার গতিবেগে এক্স-১৬-র লাগবে আটচল্লিশ মিনিটের মত।

একঘণ্টা পর মক্কার উদ্দেশে রওনা হবে আইসিবিএম।

হাতে বাড়তি সময় নেই।

তুমি তৈরি, রঘুপতি? বলল রানা।

আপনি যখন বলবেন, জবাব দিল ভদ্র রোবট।

কিছুক্ষণ পর এক্স-১৬ বিমানকে ছেড়ে দেয়ার উচ্চতায় পৌঁছে। বি-৫২ বোমারু বিমানের পাইলট বলল; দই এক্স-১৬-কে জানাচ্ছি, এইমাত্র মেডিটারেনিয়ানে ইউএসএস আব্রাহাম থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। আপনাদের অ্যাটাক রুটে শুধু ওই জাহাজই আছে। প্রতিটি বিমান আকাশে তুলছে তারা। এফ-১৪ এবং এফ/এ-১৮। আপনি বোধহয় এই মুহূর্তে সত্যিই খুব। গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, মিস্টার রানা। ফ্লাইট সিস্টেম চেক করছি। একমিনিট পর আপনাদেরকে রিলিয দেব।

পাইলটের সিগনাল কেটে গেল।

রানা এবং রঘুপতির কানে এল কুয়াশার কথা, নিচু স্বরে বলল ও, রঘুপতি, তুমিই পৃথিবীর সেরা পাইলট। মাথায় রাখবে, আমাকে যেন অপমানিত হতে না হয়। নীচ দিয়ে ছুটে যাবে। প্রয়োজনীয় তথ্য তোমার চিপসে আছে।

জী, বস, আছে, বলল রঘুপতি। প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ।

আর, রানা… ডাকল কুয়াশা।

বলুন?

আমার বন্ধু রঘুপতিকে নিয়ে ফিরে এসো, তাই চাই।

চেষ্টার ত্রুটি করব না।

আবারও বলে উঠল বি-৫২ বোমারু বিমানের পাইলট, ফ্লাইট সিস্টেম চেক কমপ্লিট। এবার লঞ্চ করব। রিলিযের জন্য তৈরি থাকুন। আমার গণনা শেষ হলেই… পচ… চার…

সরাসরি সামনে চাইল রানা, বড় করে দম নিল।

থ্রি…

শক্তহাতে কন্ট্রোল স্টিক ধরল রঘুপতি।

টু…

বিমানের আরেক ডানার প্রান্তে ঝুলছে রানাদের বিমান, ওদিকে চাইল কুয়াশা।

ওয়ান… মার্ক!

ধাতব ক্লাঙ্ক-ক্লাঙ্ক! আওয়াজ উঠল।

বি-৫২ বোমারু বিমানের ডানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে দুই এক্স-১৬।

আকাশের বুকে বি-৫২ বিমান থেকে নেমে গেল দুই এক্স ১৬, তখনই বলে উঠল রঘুপতি, এনগেজ করছি রকেট থ্রাস্টার… এখন!

থ্রাস্টার কন্ট্রোল বাটন টিপল রঘুপতি।

সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল এক্স-১৬ বিমানের টেইল কোন্। পুরো এক শফুট পিছনে গেল আফটারবার্নারের জ্বলজ্বলে সাদা আগুন।

আগে কখনও এমন ভয়ঙ্কর ঝুঁকি খায়নি রানা। পেরেকের মত গেঁথে গেল পুরু গদির সিটে।

আকাশ চিরে রওনা হয়েছে এক্স-১৬। বিকট কড়কড় আওয়াজ তুলছে সনিক বুম। যেন চামড়া ছিলে নেবে আকাশের। একটানা গর্জন ছাড়ছে, বিমানের রকেট। মেডিটারেনিয়ানের চারপাশের সব জায়গা থেকে শোনা গেল ওই গম্ভীর আওয়াজ।

দক্ষিণ-পুব লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে দুই এক্স-১৬। সামনে পড়বে সুয়েজ খাল ও লোহিত সাগর। আরও কিছু দূর গেলেই পরিত্যক্ত ইয়েমেনের সাবমেরিন ফ্যাসিলিটি। ওখান থেকে রওনা হবে লির্ড মিসাইল, উড়িয়ে দেবে পবিত্র শহর মক্কা। ২০৩

অবশ্য, তার আগেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে মানব-সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মিশ্র এরিয়াল আর্মাডা।

পুরো বিশমিনিট পর দূরে দেখা গেল উড়ন্ত বিমান বহর।

ওরা আমাদের জন্যে তৈরি, নিচু স্বরে বলল রঘুপতি। কমলা আকাশে অসংখ্য পোকার মত উড়ছে ওগুলো। একের পর এক স্কোয়াড্রন। আফ্রিকার পাঁচটি দেশের। ফাইটার বিমান। মিশরের উপকূলে যেন ভাসমান প্রাচীর। পাহারা দিচ্ছে সুয়েজ খাল। এরিয়াল আর্মাডায় নানান ধরনের ফাইটার বিমান রয়েছে।

পুরনো বিমান, নতুন বিমান, নীল বিমান, লাল বিমান–মিসাইল বহন করতে পারে এমন সব উড়োজাহাজই উঠেছে। আকাশে। এসব বিমান কেনা হয়েছে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রচুর ব্যবহারের পর তাদের আয়ু যখন প্রায় শেষ, তখন বিক্রি করে দিয়েছে এদের কাছে কম দামে।

সুখোই এসইউ-১৭–তৈরি করা হয়েছিল উনিশ শ ছিষটি সালে। অনেক আগেই রাশান সেনাবাহিনী বাতিল করেছে।

মিগ-২৫ ফক্সব্যাট- আশির দশকে আধুনিক বিমান তৈরি হওয়ার পর ওটা পরিত্যাগ করে রাশান এয়ার ফোর্স।

মিরাজ ভি/৫০- ওই জিনিস শত শত বিক্রি করেছে ফরাসিরা। কিনেছিল লিবিয়া, যায়ার ও ইরাক।

ভাসমান আর্মাডার ভিতর রয়েছে আক্রমণাত্মক চেক বিমান এল-৫৯ অ্যালট্রেস। আফ্রিকার দেশগুলোর এয়ার ফোর্সে খুব জনপ্রিয়।

এফ-২২ র‍্যাপ্টার বা এফ-১৫ই ফাইটারের মত আধুনিক নয়। ওগুলো, কিন্তু আধুনিক সব বিমানের মতই ওগুলোরও রয়েছে। এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল। সেগুলো আধুনিক। সাইডওয়াইত্তার, ফিনিক্স, রাশান আর-৬০টি ইত্যাদি। সবই বিক্রি হয় রোমানিয়া ও ইউক্রেনের চোরাই অস্ত্র বাজারে। বিপুল টাকার কারণে নতুন ফাইটার কেনা কঠিন, কিন্তু দেশগুলো সহজেই ডজন ডজন ভাল মিসাইল কিনতে পারে।

সামনে চেয়ে ভাবছে রানা, আর যাই হোক, এরা অসংখ্য।

সবচেয়ে ইকুইপড় দশটা এফ-২২ ফাইটার বিমানও এই ভাসমান আর্মাডার কাছে কিছুই নয়। টেকনোলজি কোনও কাজেই আসবে না।

তোমার কি মনে হয়, রঘুপতি?

আমাদের এই বিমান লড়াই করার জন্যে তৈরি করা হয়নি, মিস্টার রানা, নিরপেক্ষ কণ্ঠে বলল রোবট।

গতির জন্য তৈরি। এই জিনিস যদি টিকিয়ে রাখতে হয়, আমাদেরকে অনেক নীচ দিয়ে সর্বোচ্চ গতিতে যেতে হবে। আজ পর্যন্ত কোনও পাইলট এই কাজ করেনি। ওদের ছোঁড়া মিসাইলকে পিছনে ফেলতে হবে।

মিসাইল পিছু নেবে, বাহ, নতুন অভিজ্ঞতা হবে! মনে মনে বলল রানা।

আমাদের কাছে অস্ত্র বলতে সামান্য সিঙ্গল ব্যারেলের একটা বন্দুক, আবারও বলল রঘুপতি। নাকের কাছে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বোধহয় ডেকোরেশনের জন্যেই।

তখনই নতুন কণ্ঠ শুনল রানা।

দুই এক্স-১৬, আমি ইউএসএস আব্রাহাম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের ক্যাপ্টেন জন গ্রাহাম। আপনারা আমাদের স্কোপে এসে পড়েছেন। এন রুটে পাবেন দ্য স্কেলিটন স্কোয়াড। তারা বাধা দেবে শত্রুদেরকে। এদিকে পাঁচটা প্রাউলার বিমান আকাশে তুলেছি আমরা। এক শ মাইল জুড়ে ইলেকট্রনিক জ্যামিং করবে আপনাদের জন্যে। সমস্যা মাত্র শুরু হয়েছে, জেন্টলমেন। কিন্তু আশাকরি আমরা আকাশে একটা সুইয়ের ফুটো তৈরি করতে পারব। ওটার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যাবেন আপনারা। চুপ হয়ে গেলেন ভদ্রলোক, কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, ও, আরেকটা কথা, মিস্টার রানা, পরিস্থিতি সম্পর্কে সবই রিপোর্ট করেছি প্রেসিডেন্টকে। গুড লাক। আমরা আপনাদের পিছনে আছি, স্যর।

ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন, বলল রানা। রোবটের দিকে চাইল। রঘুপতি, এবার সর্বোচ্চ গতি তোলো।

কোনও মন্তব্য করল না রঘুপতি।

পরক্ষণে ঝাঁকি খেল রানা।

এক লাফে গতি উঠল ঘণ্টায় সাত হাজার কিলোমিটার। অর্থাৎ, প্রতি সেকেণ্ডে গতি দুহাজার মিটার। সুপারসনিক গতির সাতগুণ বেশি।

শত্রু বিমানের প্রাচীরের দিকে ছুটতে গিয়ে আকাশ চিরে দিল দুই এক্স-১৬।

আফ্রিকার বিমানগুলোর বিশ মাইলের ভিতর পৌঁছে যেতেই আর্মাডা থেকে নানান ধরনের মিসাইল ছোঁড়া হলো। সংখ্যায় চল্লিশটারও বেশি। লেজে ধোঁয়া নিয়ে ছুটে এল রানাদের দিকে।

কিন্তু প্রথম মিসাইল ছাড়া রাশান মিগ-২৫ ফক্সব্যাট হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হলো কমলা আগুনের ভিতর।

প্রায় একইসময়ে বিস্ফোরিত হলো ছয়টি আফ্রিকান ফাইটার। এআইএম-১২০ অ্যাম্ৰাম এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল উড়িয়ে দিল অগ্রসরমান বিশটি মিসাইল। আকাশে তৈরি হলো আগুনের গোলক। লেজে করোটি ও হাতের হাড়ের চিহ্ন আঁকা আমেরিকার এফ-১৪ ফাইটার নেমে পড়েছে আফ্রিকার আর্মাডার বিরুদ্ধে।

ইউএসএস আব্রাহাম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের স্কেলিটন স্কোয়াড মানেই এক ডজন এফ-১৪ টমক্যাট, পিছনে ক্ষিপ্রগতি এফ/এ-১৮ হর্নেট।

হঠাৎ করেই শুরু হলো সভ্যতার সবচেয়ে আধুনিক এরিয়াল ডগফাইট।

বাঁক নিয়ে আফ্রিকান বিমান বহরের তলা দিয়ে ছুটে চলল দুই এক্স-১৬ বিমান। সামনের আকাশে আগুনের বিস্ফোরণ দেখলেই আরও নীচে নামছে ওদুটো, এড়িয়ে চলেছে শত্রুদেরকে। ডাইভ। দিতে শুরু করেছে বোমারু ফাইটার। বিদ্যুতি মিসাইল ও ট্রেসার বুলেট ছাড়ছে।–সান্ধ্যকালীন কমলা আকাশে খেপে উঠেছে যেন অসংখ্য ফাইটার বিমান, লড়ছে প্রাণপণে। মিগ, মিরাজ, টমক্যাট, হর্নেট- একপাশ থেকে আরেক পাশে গড়িয়ে চলেছে আকাশে, শত্রুবিমান লক্ষ্য করে হামলা করছে। বিস্ফোরিত হচ্ছে বিমান।

এক পর্যায়ে আকাশের দিকে পেট তুলে উল্টে গেল রানার এক্স-১৬। বিদ্যুদ্বেগে পেরিয়ে গেল একটি আফ্রিকান ফাইটার বিমানকে। কিন্তু সামনেই পড়ল আরেকটি যায়ারিয়ান ফাইটার নাকে নাকে বাড়ি লাগবে, এমনসময় বিস্ফোরিত হলো আফ্রিকান বিমান। নীচ থেকে এসেছে অ্যাম্ৰাম মিসাইল। বিস্ফোরণের আগুনের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে গেল রানার এক্স-১৬। ডানা ও ককপিটের উপর অংশে লাগল জ্বলন্ত ধাতু। রঘুপতির দিকের ককপিটে ছলাৎ করে লাগল শত্রুবিমানের মৃত পাইলটের তাজা রক্ত।

রকেট বিমান লক্ষ্য করে একের পর এক মিসাইল এল, কিন্তু গতি কমল না রানাদের বিমানের।

এক্স-১৬ বিমানের কাছে এসেই উন্মাদ হয়ে উঠছে মিসাইল, ছিটকে যাচ্ছে নানাদিকে। মনে হলো অদৃশ্য কোনও বুদ্বুদ ঘিরে রেখেছে দুই বিমানকে।

কথাটা মিথ্যা নয়।

ইউএস নেভির ইএ-৬বি প্রাউলার ওই কাজই করছে। এক্স ১৬ থেকে দশমাইল দূরে ব্যবহার করছে ডিরেকশনাল এএন/ এএলকিউ-৯৯এফ ইলেকট্রনিক জ্যামিং পড।

শক্তপোক্ত প্রাউলার বিমানের পাইলটরা ভাল করেই জানে, সুপারফাস্ট এক্স-১৬ বিমানের সঙ্গে গতি তুলে এগুতে পারবে না। কাজেই একের পর এক বিমান সামনে রেখেছে তারা, জ্যাম করছে সিগনাল। মিসাইল, কামানের গোলা ও ট্রেসার বুলেট থেকে পাহারা দিচ্ছে রকেট বিমানকে। সামনের প্রাউলার বিমানগুলো যেন র‍্যালি রানারের মত দৌড়ের উপর আছে।

এক্স-১৬, আমি প্রাউলার লিডার, নতুন কণ্ঠ শুনল রানা হেডসেটে। আমরা আপনাদেরকে ক্যানেল পর্যন্ত পাহারা দিতে পারব। কিন্তু আমাদের গতি কম বলে পরে আর কোনও সাহায্য করতে পারব না। তখন থেকে যা করার আপনাদেরকেই করতে হবে।

ধন্যবাদ, আমাদের জন্যে যথেষ্ট করেছেন, বলল রানা।

সামনে দেখুন, মিস্টার রানা, নির্লিপ্ত স্বরে বলল রঘুপতি।

প্রাউলার বিমানের লং রেঞ্জ ইলেকট্রনিক প্রোটেকশনের কথা মাথায় রেখে নতুন স্ট্রাটেজি নিয়েছে আফ্রিকান ফাইটার বহর।

ক্যামিকাজি ডাইভ শুরু হলো এক্স-১৬ লক্ষ্য করে।

মিসাইলের হোমিং সিস্টেম গুবলেট করে দিতে বা হালকা ট্রেসার বুলেট সরিয়ে দিতে পারে ইলেকট্রনিক কাউন্টারম্যের, কিন্তু আত্মঘাতী বিমানকে বাধা দেবার সাধ্য তার নেই।

দুই এক্স-১৬ লক্ষ্য করে ডাইভ দিল ছয়টি ফাইটার জেট। আকাশ চিরে দিল বিকট তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ছুটবার সময় ট্রেসার বুলেট ছুঁড়ছে বিমানগুলো।

পরস্পর থেকে সরে গেল দুই এক্স-১৬।

ডানদিকে বাঁক নিয়েই ডাইভ দিল রঘুপতি, ওদিকে অন্য এক্স-১৬ কাত হলো ডানদিকে একফুট সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ডাইভ বমার। কিন্তু তার আগেই একটা ক্যাজিকামি বিমানের ট্রেসার বুলেট লাগল ক্যানোপিতে। অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল বুলেট। যাওয়ার পথে ফুটো করে দিয়ে গেল কুয়াশার পাইলটের মগজ।

বিমানের ককপিটের চারপাশে ছিটকে লেগেছে মগজ।

আকাশে গড়াতে শুরু করল কুয়াশার এক্স-১৬, নিয়ন্ত্রণহীন। চলেছে পুব লক্ষ্য করে।

সিট থেকে সামনে চলে এল কুয়াশা, দ্রুতহাতে সিটবেল্ট খুলে পিছনে সরিয়ে দিল পাইলটের লাশ। নিজে বসল কন্ট্রোলের সামনে। ভূমধ্যসাগরে আছড়ে পড়বার আগেই সিধা করতে চাইল বিমান।

ঝড়ের গতিতে উঠে আসছে সাগর। গতি আরও বাড়ল। তারপর… বিকট আওয়াজ উঠল: বুম!

.

অদ্ভুত বিমান নিয়ে সাগরের কাছে নেমে এসেছে রানা ও রঘুপতি, মাত্র বিশফুট নীচে অসংখ্য ঢেউ। লাফিয়ে উঠছে সাদা পানি গিযারের মত।

একইসময়ে পিছনের সাগরে নামল বেশ কয়েকটা মিসাইল।

সামনে সুয়েজ খাল, জানাল রঘুপতি।

বিশ মাইল দূরে সুয়েজ খালের মুখ। আধুনিক সি লেনের শুরুতেই দুপাশে রয়েছে দুটো মস্ত পিলার, ওদিকে লোহিত সাগর।

পুরো এলাকা জুড়ে আকাশে উড়ছে অসংখ্য জেট বিমান। বামে যাও, রঘুপতি, দূরে চেয়ে আছে রানা। নির্দেশ পালন করতে দেরি করেনি রোবট।

পাশ কাটিয়ে পিছনে পড়ল দুই চেক এল-৫৯এস। সোজা সাগরে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল।

রানার দুপাশে এখন শুধু সুয়েজ খাল।

সামনে প্রাউলার থেকে আর কোনও ইলেকট্রনিক নিরাপত্তা পাওয়া যাবে না।

বিদ্যুদ্বেগে সুয়েজ খাল পেরোতে শুরু করেছে রানার এক্স-১৬। পানির তিরিশ ফুট উপর দিয়ে ছুটছে। এড়িয়ে চলেছে। নোঙর করা জাহাজগুলোকে। অনেক উপরে এরিয়াল আর্মাডা।

ব্লকেড পর্যন্ত পৌঁছে গেছে রানা।

কিন্তু আফ্রিকার একটা ফাইটার বিমানের পাইলট কীভাবে যেন জোগাড় করেছে আমেরিকার তৈরি দুই ফিনিক্স মিসাইল, ওগুলোকে লঞ্চ করল সে।

খালের মত অগভীর সাগর চ্যানেলে ছুটে চলেছে এক্স-১৬।

ওটার চেয়েও গতি বেশি দুই মিসাইলের।

একইসময়ে আত্মহত্যার জন্য দুই ফাইটার ঝাঁপ দিল রানার এক্স-১৬ লক্ষ্য করে। কাঁচির ফলার মত দুদিক থেকে নামছে। লুডোর গুটির মত বিমান গড়িয়ে দিল রোবট রঘুপতি।

মাত্র পাঁচ ইঞ্চি দূর দিয়ে সাঁৎ করে বেরিয়ে গেল দুই বিমান। সোজা গিয়ে পড়ল খালের বালিময় পারে। ছিটকে উঠল বালি ও আগুন।

রানাদের এক্স-১৬ বিমানের লেজের কাছে পৌঁছে গেল দুই ফিনিক্স মিসাইল। অবাক চোখে রানা দেখল, মিসাইলের গায়ে স্ট্যানসিল করা: এক্সএআইএম-৫৫এ-রবার্টস্ মিসাইল সিস্টেম।

রঘুপতি… গলা ফাটাল রানা।

দেখেছি, মিস্টার রানা, পাল্টা বলল রঘুপতি।

কী করবে?

এলো বলে! স্বাভাবিক স্বরে বলল রঘুপতি। আমিও তৈরি।

হঠাৎ করেই ডানদিকে বাঁক নিতে লাগল রঘুপতি, চলেছে খালের পার ধরে, তৈরি করছে মস্ত একটা বৃত্ত।

আবারও রওনা হয়ে গেল ভূমধ্যসাগর লক্ষ্য করে। পিছু নিল দুই মিসাইল। একইসময়ে প্রায়-বৃত্ত তৈরি করল ওগুলো। জি ফোর্স পাত্তা দিচ্ছে না।

উপকূল পাহারা দিচ্ছে আফ্রিকান আর্মাডা। এদিকে রয়েছে সবমিলে ছয়টি ফাইটার। সেগুলোর পাইলটরা দেখল, মস্ত একটা বৃত্ত তৈরি করে আবারও ওদের দিকেই ফিরছে এক্স-১৬।

আকাশ পাহারা দিতে চাইল পাইলটরা। ভাবছে, আজকের দিনটা আসলে তাদের।

ভুল ধারণা।

একদল মৌমাছির মত ভাসছে তারা, আর তাদের মাঝ দিয়ে বুলেটের মত গেল এক্স-১৬। ওটার দুই পাশে মাত্র দশ ফুট দূরে রইল দুই আফ্রিকান মিগ।

আর তখনই পৌঁছে গেল দুই ফিনিক্স মিসাইল।

বুম! বুম!

হাজার টুকরো হলো দুই মিগ। মস্ত এক বৃত্ত তৈরি করে। আবারও সুয়েজের সরু খালে ফিরল এক্স-১৬। আকাশ চিরে চলেছে দক্ষিণ-পুব লক্ষ্য করে।

কিন্তু বৃত্ত তৈরি করতে গিয়ে দু শ কিলোমিটার ঘুরতে হয়েছে এক্স-১৬-কে। সেসময় তার সেরা মিসাইল লঞ্চ করেছে এক আফ্রিকান বিমান। আমেরিকার চোরাই এআইএম-১২০ অ্যাম্ৰাম মিসাইল ওটা, দুনিয়া সেরা।

রানার এক্স-১৬ বিমানের পিছু নিয়েছে অ্যাম্ৰাম। ক্ষুধার্ত হাঙরের মত মাঝের দূরত্ব পার করছে ওটা।

ওটাকে পিছনে ফেলতে পারছি না, বলল রঘুপতি। কতক্ষণ পিছনে তাড়া করবে? নিশ্চয়ই এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দেবে? ফিউয়েল শেষ হলে…

না, হাল ছাড়বে না, তিক্ত স্বরে বলল রানা। ওটা অ্যাম্ৰাম! দিন-রাত ধাওয়া করবে! আর টার্গেটকে নাগালে পেলেই…

এ ধরনের বিমানের পিছু তো নেয়নি। পুরো গ্রুটল খুলে দিচ্ছি।

ইয়ারপিসে ওরা শুনতে পেল অন্য একটা কণ্ঠ।

চার্লস ডেলাক্স। মনে হলো মরমে মরছে লোকটা।

ইয়ে, মিস্টার রানা, খারাপ খবর আছে।

বলুন?

আমাদের স্যাটালাইট এইমাত্র আইসিবিএম-এর লঞ্চ সিগনেচার ধরেছে। ওটা রওনা হয়েছে। দক্ষিণ ইয়েমেন থেকে। ক্যারেকটেরিস্টিক থেকে ধারণা করা হচ্ছে জেরিকো-২বি ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল। সোজা চলেছে মক্কার উত্তর অংশ লক্ষ্য করে। মিস্টার রানা, ডেমিয়েন ডগলাস জানে আমরা পিছু নিয়েছি। কাজেই আগেই লঞ্চ করেছে মিসাইল।

হতবাক হয়ে আকাশের দিকে চাইল রানা। পরক্ষণে বলল, এত কাছে এসে পিছাব না আমরা।

জবাবে চুপ করে রইল চার্লস ডেলাস।

বুকের স্ট্র্যাপে আটকে রাখা অস্ত্রগুলো দেখল রানা। ওগুলো ব্যবহার করতে চেয়েছিল। উড়িয়ে দিত মিসাইল। কিন্তু কিছুই এখন কাজে আসবে না। আস্তে করে হাতে নিল টাচলক-৯ ডিসআর্ম ইউনিট। আস্তে করে মাথা দোলাল।

পরক্ষণে চমকে গেল।

দ্বিতীয়বার দেখল টাচলক-৯ ইউনিট।

মিস্টার ডেলাস, আপনি কি মিসাইলের সিগনালের টেলিমেট্রি জানেন?

হ্যাঁ।

তথ্যটা পাঠিয়ে দিন।

বেশ।

কয়েক মুহূর্ত পর বিপ আওয়াজ তুলল রানার ট্রিপ কমপিউটার। স্ক্রিনে দেখা দিয়েছে মানচিত্র। একটা জ্বলন্ত তীর দেখিয়ে চলেছে লির্ড মিসাইলকে, ছুটে চলেছে মক্কা শহরের উত্তরাংশ লক্ষ্য করে।

কমপিউটারকে নিজের ট্রান্সপত্তার সিগনাল দিল রানা। স্ক্রিনে। দেখা দিল দ্বিতীয় আইকন। ওটা চলেছে দক্ষিণ লক্ষ্য করে।

স্ক্রিনে ফুটে উঠল ফ্লাইট ডেটা: সিগনাল আইডি, এয়ারস্পিড, অল্টিচ্যুড ইত্যাদি।

ওকে প্রায় অঙ্ক কষতেই হলো না।

ছবিটা পরিষ্কার।

চোদ্দ

মক্কা শহর লক্ষ্য করে দুদিক থেকে চলেছে দুই এয়ারক্রাফট এক্স-১৬ ও লির্ড মিসাইল। আমেরিকান স্যাটালাইটের অটোমেটেড রিকগনিশন সিস্টেম নিশ্চিত করেছে, দুই রকেটের একটা জেরিকো-২বি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল।

প্রায় একই গতি নিয়ে ছুটে চলেছে দুই এয়ারক্রাফট। মক্কা শহরের দুদিক থেকে আসছে ওগুলো।

রঘুপতি, নিচু স্বরে ডাকল রানা।

জী?

আমরা আর ইয়েমেনে যাব না।

আমিও তাই ধারণা করছি, স্যর, বলল রঘুপতি। এবার কী করবেন?

কমপিউটারের বাটন টিপতে শুরু করেছে রানা। দ্রুত অঙ্ক কষছে। ও যেকাজ করতে চাইছে, তা প্রায় অসম্ভব।

এখনও মক্কা শহর থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে ওরা।

ওদের টার্গেট সময়:

আটটা তিরিশ মিনিট।

লিয়ার্ড মিসাইলের বিষয়ে ক্যালকুলেশন শেষ করল রানা।

ওই মিসাইল সামান্য দূরে থাকবে।

টার্গেট টাইম:

৯:০১…

৯:০০…

৮:৫৯…

ভাল, মনে মনে বলল রানা। ওরা বাড়তি তিরিশ সেকেণ্ড পাবে। ওই সময়ে মক্কার আকাশে ঘুরে আবারও মিসাইলের পিছু নিতে পারবে।

ঝুঁকিটা টের পেয়ে গম্ভীর হয়ে গেল রানা। বুকে আটকে নেয়া টাচলক-৯ ইউনিট চট করে দেখল। ফিসফিস করে বলল, মাত্র ষাট ফুট। রঘুপতির দিকে চাইল। রঘুপতি, কখনও কোনও মিসাইলের পিছু নিয়েছ?

টার্গেট টাইম:

৬:০০…

৫:৫৯…

৫:৫৮…

ক্রমেই নেমে আসছে আঁধার। বুলেটের গতি নিয়ে ছুটে চলেছে রানার এক্স-১৬, পিছনে আসছে অ্যাম্ৰাম মিসাইল।

স্যর, আপনি কি চান আমি মিসাইলের পাশে পৌঁছে যাই? জানতে চাইল রঘুপতি।

হ্যাঁ, তাই চাই। সেক্ষেত্রে আশাকরি আইসিবিএম ডিসআর্ম করতে পারব। সেজন্য ষাট ফুটের ভেতর পৌঁছাতে হবে।

কিন্তু মাক সিক্স গতি নিয়ে মিসাইলের পাশে বিমান চালাতে পারে না কেউ।

তুমি হয়তো পারবে। যেখানে বসে আছে, সেখান থেকে রোবটের মুখে হাসি দেখল রানা।

আপনি আসলে কী চান, স্যর?

আইসিবিএম অনেক উপরে ওঠে, তারপর নেমে আসে টার্গেট লক্ষ্য করে, বলল রানা। এই মুহূর্তে লির্ড মিসাইল আছে সাতাশ হাজার ফুট উচ্চতায়। মক্কার উপর পৌঁছে যাওয়ার পরেও ওই উচ্চতায় থাকবে, তারপর দেবে ডাইভ। মাক সিক্স গতির কারণে টার্গেটে পৌঁছুতে ওটার লাগবে বড়জোর পাঁচ সেকেণ্ড। কিন্তু ওটাকে ডিসআর্ম করতে হলে কমপক্ষে পঁচিশ সেকেণ্ড লাগবে আমার। কাজেই ওই মিসাইলের পাশে থাকতে হবে সাতাশ হাজার ফুট উচ্চতায়। ওটা একবার নাক নিচু করলে সব শেষ। তার আগেই মিসাইলের পাশে পৌঁছাতে হবে তোমাকে–পারবে?

আশা করি পারব, স্বাভাবিক স্বরে বলল রঘুপতি। জানেন, স্যর, আপনি প্রায় আমার বসের মতই। উনিও ভাবেন আমি সব কিছু পারি। আর আমার ব্রেন চিপস্ বলছে, এই কাজ আমি ঠিকই পারব।

টার্গেট টাইম:

২:০১…

২:০০…

১:৫৯…

আকাশ চিরে ছুটে চলেছে এক্স-১৬ বিমান। পিছনে আসছে অ্যাম্ৰাম মিসাইল।

লোহিত সাগর পেরোতে শুরু করে উচ্চতা বাড়াতে লাগল রঘুপতি। কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল সাতাশ হাজার ফুট উপরে।

এইমাত্র পিছনে পড়ল মক্কা, জানাল রঘুপতি। এবার ঘুরে ফিরতি পথ ধরব। চোখ রাখুন সামনে। কিছুক্ষণ পর দেখবেন

আসছে লিযার্ড মিসাইল।

বামে বাঁক নিচ্ছে রঘুপতি, বিদ্যুদ্বেগে আকাশ পিছনে ফেলছে রকেট বিমান। মস্ত অর্ধবৃত্ত তৈরি করছে। সেটা শেষ হলে পৌঁছে যাওয়ার কথা নিউক্লিয়ার মিসাইলের পাশে। একইসঙ্গে ছুটবে। মক্কা শহর লক্ষ্য করে। ২১৫

কিন্তু এক্স-১৬ হঠাৎ করেই কোর্স পাল্টে নেয়ায় অনেক কাছে পৌঁছে গেল অ্যাম্ৰাম মিসাইল। এক্স-১৬ লক্ষ্য করে ক্ষিপ্ত বাঘের মত আসছে ওটা। এখন আছে মাত্র এক শ মিটার পিছনে, ক্রমেই এগিয়ে আসছে।

টার্গেট টাইম:

১:২০…

১:১৯…

১:১৮…

ওই যে আপনার নিউক্লিয়ার মিসাইল, ঠিক সামনে, হঠাৎ করেই বলল রঘুপতি।

জি ফোর্সের ঝক্কির ভিতর রঘুপতির কাঁধের উপর দিয়ে চোখ সরু করে দূরে চাইল রানা।

আরবের আকাশে নেমে এসেছে সন্ধ্যা। পশ্চিম ও মধ্য গগনে সামান্য কমলা রং। কয়েক সেকেণ্ড পর পরিষ্কারভাবে মিসাইলটা দেখল রানা। প্রকাণ্ড ওটা। তুমুল গতি নিয়ে চলেছে আকাশ চিরে।

সায়েন্স ফিকশন সিনেমার স্পেসশিপের মতই দেখতে ইজরায়েলি আইসিবিএম জেরিকো-২বি। তেলতেলে দেহ নিয়ে ছুটছে মক্কা শহর লক্ষ্য করে।

মস্ত টিউবের মত। সত্তর ফুট দৈর্ঘ্যের চকচকে চুরুট। বর্শার মত ফুটো করছে আকাশ। লেজে জ্বলজ্বল করছে ম্যাগনেসিয়ামের ভয়ঙ্কর আগুন। পিছনে দীর্ঘ ধোঁয়ার রেখা। ওই ধোঁয়া অজগরের মত পাক খেয়ে দূর-দিগন্তে হারিয়ে গেছে ইয়েমেনের আকাশে।

বিকট গর্জন ছাড়ছে মিসাইল।

একটানা বুউউউউউউম! আওয়াজ তুলছে। নিজেও বিকট আওয়াজ ছাড়ছে এক্স-১৬, শেষ করে এনেছে অর্ধবৃত্ত।

পিছনে লেগে আছে পিন আকৃতির অ্যাম্ৰাম মিসাইল। টার্গেট টাইম:

১:০০…

০:৫৯…

০:৫৮…

আর বড়জোর কয়েক সেকেণ্ড, তারপর…

অর্ধবৃত্ত তৈরি করেই তীরের মত জেরিকো-২বি মিসাইলের কাছে পৌঁছে গেল রানার এক্স-১৬।

আকাশ চিরে ছুটছে লির্ড মিসাইল ও রকেট বিমান। কিন্তু এখনও পাশাপাশি হয়নি দুই এয়ারক্রাফট।

আইসিবিএম-এর সামান্য বামে পিছনে ছুটছে রানার বিমান। এ দূর দিগন্তে ঘন কালো ধোঁয়া ছুঁড়ছে আইসিবিএম।

টার্গেট টাইম:

০:৫০…

০:৪৯…

০:৪৮…

মিসাইলের চেয়ে সামান্য বেশি গতি রকেট বিমানের। পৌঁছে গেল পাশে। চারপাশে রইল শুধু ভয়ঙ্কর গর্জন। ওই আওয়াজ সুপারসনিক গতির কারণে। একটানা চলছে: বুউউউউউ!

টার্গেট টাইম:

০:৪০…

০:৩৯…

০:৩৮…

আরও কাছে নিয়ে যাও, রঘুপতি, গলা ছাড়ল রানা।

সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ পালন করল রোবট।

এক্স-১৬ পৌঁছে গেল মিসাইলের লেজের কাছে। বিকট আওয়াজ ছাড়ছে আইসিবিএম-এর টেইল কোন্।

কোনও সাড়া দিল না টাচলক-৯ ইউনিট। এখনও মিসাইলের সিপিইউ-এর কাছে পৌঁছতে পারেনি।

তিলতিল করে সামনে বাড়ল এক্স-১৬। ধীরে ধীরে পিছনে পড়ছে মিসাইলের পিছন দিক।

আরও কাছে যাও! নির্দেশ দিল রানা।

টার্গেট টাইম:

০:৩৪…

০:৩৩…

০:৩২,

ককপিট ক্যানোপি থেকে নীচে মক্কা শহরের হরেক রঙের বাতি দেখল রানা।

নীচে শুরু হয়েছে ঘন বসতি।

টার্গেট টাইম:

০:২৮…

০:২৭…

০:২৬…

মিসাইলের পেটের কাছে পৌঁছে গেল এক্স-১৬। আর তখনই বি আওয়াজ তুলল ডিমআর্ম ইউনিট। স্ক্রিনে দেখা দিল:

ফার্স্ট প্রটোকল (প্রক্সিমিটি): স্যাটিসফাইড,
ইনিশিয়েট সেকেণ্ড প্রটোকল।

এবার… বিড়বিড় করল রানা। চট করে একবার দেখে নিল আইসিবিএম।

রিফ্লেক্স প্যাটার্নের সিকিউয়েন্স শুরু করেছে ডিসআর্ম ইউনিট। টাচস্ক্রিনে আঙুল স্পর্শ করতে লাগল রানা। আকাশে সুপারসনিক আওয়াজ তুলে ছুটছে দুই এয়ারক্রাফট।

গতি ঘণ্টায় প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার। আর তখনই শুরু হলো সর্বনাশের! এক্স-১৬ বিমানের খুব কাছে পৌঁছে গেল অ্যাম্ৰাম মিসাইল।

স্কোপে চেয়ে আছে রঘুপতি। শান্ত স্বরে বলল, স্যর… আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তারপর…

আগের কাজ আগে শেষ করি, চাপা স্বরে বলল রানা। পুরো মনোযোগ দিয়েছে রিফ্লেক্স রেসপন্স টেস্টে।

টার্গেট টাইম:

০:১৯…

০:১৮…

০:১৭…

এক্স-১৬ বিমানের লেজের আগুনের কাছে পৌঁছে গেছে। অ্যাম্ৰাম মিসাইল।

লিথাল রেঞ্জে প্রায় পৌঁছে গেছে, শান্ত স্বরে বলল রঘুপতি। আম্রামের জন্য লিথাল রেঞ্জ বিশ গজ।

এরপর আঘাত হানতে হয় না মিসাইলকে। কাছে বিস্ফোরিত হওয়াই যথেষ্ট।

আপনি পাঁচ সেকেণ্ড পাবেন, স্যর, উদাস সুরে বলল রঘুপতি।

আমার এত সময় নেই, কাজের ফাঁকে বলল রানা। চোখ সরল না স্ক্রিন থেকে। ঝড়ের বেগে চলছে আঙুল।

টার্গেট টাইম:

০:১৬…

০:১৫…

০:১৪…

আমি কিন্তু, স্যর, চাইলেও সরে যেতে পারি না, করুণ শোনাল রঘুপতির কণ্ঠ। নইলে ষাট ফুটের চেয়ে দূরে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে সব চেষ্টা ব্যর্থ হবে।…দুই সেকেণ্ড!

টাচস্ক্রিন স্পর্শ করছে রানা।

টার্গেট টাইম:

০:১৩…

০:১২…

আর এক সেকেণ্ড, স্যর।

লিথাল রেঞ্জে পৌঁছে গেল অ্যাম্ৰাম মিসাইল।

এক্স-১৬ বিমানের টেইলপাইপের বিশ গজ দূরে ওটা।

অনেক দেরি হয়ে গেল, স্যর, করুণ সুরে বলল রঘুপতি।

মনে হয় না, নতুন একটা কণ্ঠ বলল ওদের ইয়ারপিসে।

সুপারসনিক ঝোড়ো গতির ভিতর রানার এক্স-১৬ বিমানের পাশে হাজির হয়েছে কালো কী যেন। ঝট করে সরে গেল ওটা, পিছনে টেনে নিয়ে চলেছে অ্যাম্ৰাম মিসাইল

পরক্ষণে ওটার লেজে লাগল অ্যাম্ৰাম।

আকাশে ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই সিটে ঘুরে বসল রঘুপতি। তার চোখ পড়ল অর্ধেক হয়ে যাওয়া একটা এক্স-১৬ বিমানের উপর। ছিটকে নীচে রওনা হয়েছে ধ্বংসাবশেষ। পিছন দিক বাম্পায়িত হয়েছে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে।

আমার আর থেকে কী লাভ… রানা শুনল রোবটের করুণ হাহাকার। স্যর বুঝি আর নেই!

ওই বিমান ছিল কুয়াশার এক্স-১৬।

পাইলট মারা যাওয়ার পরও রানার বিমানের পিছু নিয়ে এসেছে এতদূর, রানাদের বিমান দুবার বাঁক নেয়ার সুযোগ নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল খুব কাছে। কিন্তু এইমাত্র রানার বিমানকে অ্যাম্রাম থেকে বাঁচাতে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে কুয়াশা।

আকাশ থেকে খসে পড়ছে দুটুকরো হয়ে যাওয়া বিমান।

কিন্তু হঠাৎ ধ্বংসাবশেষ থেকে ছিটকে বেরোল একটা প্যারাশুট।

টার্গেট টাইম:

০:১১…

০:১০…

বলতে গেলে বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনেইনি রানা। পুরো মনোযোগ দিয়েছে টাচস্ক্রিনের রিফ্লেক্স প্যাটার্নে।

সাদা… লাল… সাদা… সাদা… লাল…

টার্গেট টাইম:

০:০৯…

ওটা খাড়া ভাবে নামতে শুরু করছে, স্যর, দুঃখিত সুরে বলল রঘুপতি।

হঠাৎ করেই কোর্স পাল্টে নিল মিসাইল। খাড়াভাবে নামছে মক্কা শহর লক্ষ্য করে।

এক্স-১৬ বিমানের কন্ট্রোল স্টিক নাড়ল রঘুপতি। অনুসরণ করছে মিসাইলের। খাড়াভাবে পিছু নিল মিসাইলের, পাশেই থাকছে।

টাচস্ক্রিন থেকে চোখ সরাল না রানা। ঝড়ের মত চলছে। আঙুল।

টার্গেট টাইম:

০:০৮.

দুটো বুলেটের মত পৃথিবী লক্ষ্য করে নামছে মিসাইল ও এক্স-১৬।

০:০৭…

মক্কার বাতি ছুটে আসছে ওদের দিকে।

টার্গেট টাইম:

০:০৬…

নেচে চলেছে রানার আঙুল।

বিপ আওয়াজ তুলল টাচলক-৯ ইউনিট:

সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
স্যাটিসফায়েড।
থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি):
অ্যাকটিভ।
প্লিয এণ্টার অথোরাইযড ডিসআর্ম কোড।

টার্গেট টাইম:

০:০৫…

বিদ্যুদ্বেগে ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড এন্ট্রি করল রানা সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে ফুটে উঠল:

থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি): স্যাটিসফাইড।
অথোরাইযড ডিসআর্ম কোড
এন্টার্ড।
মিসাইল লঞ্চ অ্যাবোর্টেড।

পরক্ষণে যা ঘটল সেজন্য রানা তৈরি ছিল না।

মক্কা শহরের সুউচ্চ মিনারগুলোর অনেক উপরের আকাশে সুপারসনিক গতি নিয়ে ছুটতে গিয়ে সেলফ ডেস্ট্রাক্ট মেকানিম কাজ করল লির্ড মিসাইলের সিপিইউ-এর ভিতর। বিস্ফোরিত হলো মিসাইল। মস্ত পটকা যেন, চারপাশে ছিটকে গেল আগুনের লাল ফুলকি।

সবই এত দ্রুত ঘটল, হাওয়ায় ভর করে টুকরোগুলো পৌঁছল শত মাইল দূরে। পরবর্তীতে জেরিকো-২বি মিসাইলের নানান টুকরো মিলবে বহু দূরের মরুভূমিতে।

কিন্তু ভিন্ন পরিণতি হলো,  লির্ড মিসাইলের বিস্ফোরণের ফলে পুরো নিয়ন্ত্রণ হারাল রঘুপতি। রকেটের মত নামতে লাগল বিমান।

কন্ট্রোল স্টিক হাতে সত্যিকারের বীরের মতই লড়ল রঘুপতি, কিন্তু বিমানের কাছ থেকে কোনও সুবিধা আদায় করতে পারল না। অবশ্য একটা কাজ রঘুপতি করতে পারল।

ঘন বসতিপূর্ণ মক্কা শহরের বুকে বিধ্বস্ত হলো না এক্স-১৬।

কয়েক সেকেণ্ড পর আকাশ থেকে উল্কার মত ছিটকে পড়ল বিমান মরুভূমির ভিতর। খাড়াভাবে নেমেছে, থরথর করে কাঁপিয়ে দিল জমিন। পঞ্চাশ মাইল দূর থেকেও সে কম্পন টের পেল সবাই।

আঁধার মরুভূমির আকাশ সাদা হয়ে উঠল বিস্ফোরণের ফলে।

অনেক চেষ্টা করেও মাক থ্রি-র চেয়ে গতি কমাতে পারেনি রঘুপতি।

বালিতে নেমেই বিস্ফোরিত হয়েছে এক্স-১৬। মস্ত আগুনের গোলা জন্ম নিল। কারও বাঁচবার সাধ্য নেই ওই বিস্ফোরণের পর।

ওই সংঘর্ষের মাত্র দুই সেকেণ্ড আগে অবশ্য বিমান থেকে ছিটকে আকাশে উঠেছে দুই ইজেকশন সিট স্বর্গের দিকে। ওই দুই সিটে রয়েছে মাসুদ রানা ও রঘুপতি।

প্যারাশুটে ভর করে ধীরে ধীরে মরুভূমির মেঝেতে নামল দুই ইজেকশন সিট।

একমাইল দূরে মস্ত গর্ত তৈরি করেছে এক্স-১৬।

ইজেকশন সিট নামবার পরেও রানা নড়ল না। নিজের সিট রেন্ট খুলে নেমে পড়ল রঘুপতি, কাছে গিয়ে অসহায়ভাবে রানার দিকে চেয়ে রইল সে।

প্রচণ্ড গতি সুপারসনিক ইজেকশনের কারণে জ্ঞান হারিয়েছে রানা।

কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে গেল, তারপর জেগে উঠল রানা। টের পেল, মুখে বিন্দু বিন্দু রক্ত। বেদম ব্যথা শুরু হয়েছে মাথা জুড়ে। ছিঁড়ে পড়তে চাইছে দুই চোখ। প্রচণ্ড গতি ইজেকশনের কারণে এই ব্যথা স্বাভাবিক।

ফ্লাইট সিটে বসে চারপাশে ছায়ামূর্তি দেখল রানা। কারা যেন আনবাকল করছে ওর সিটবেল্ট।

কণ্ঠস্বর শুনল: শুয়োরের বাচ্চা ওই গতি সহ্য করে নামল কী করে?

বাদ দাও, শালাকে শেষ করে দাও। যে-কোনও সময়ে মেরিনরা আসবে।

আবছা চেতনার ভিতর ইংরেজি শুনছে রানা। উচ্চারণ আমেরিকানদের মতই। সন্দেহ জন্ম নিল রানার মনে।

অবশ লাগছে, তখনই নড়তে পারল না। একটা ছোরা কেটে দিল ওর সিটবেল্ট।

রানা আবছা দেখল, ঝুঁকে এসেছে এক পশ্চিমা লোক। পরনে মিলিটারি পোশাক। এক মুহূর্ত পর টের পেল, ওটা ইউএস স্পেশাল ফোর্স ডেল্টা ডিটাচমেন্টের পোশাক।

মেজর রানা, নিচু স্বরে বলল সে।

অস্পষ্ট শুনল রানা। মাথা খাটাতে ইচ্ছে করছে না ওর।

সবই ঠিক আছে, মেজর রানা। আপনি এখন নিরাপদ। আমরা ডেল্টা ফোর্স। আপনার পাশেই আছি। আমরা আপনার বন্ধুকেও তুলে এনেছি। কয়েক মিনিট পর পৌঁছে যাবেন তিনি।

আপনারা… থেমে গেল রানা, কয়েক মুহূর্ত পর বলল, আপনারা কারা? কোথা থেকে এসেছেন?

ডেল্টা ফোর্সের লোকটা হাসল। কিন্তু সেই হাসি বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। আমার নাম জন উইলসন। ডেল্টা ফোর্সে আছি। এসেছি এডেন থেকে। কিন্তু ভাববেন না, মেজর। আমরা আপনার পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।

ডানবাহুর মাংসে কী যেন বিঁধেছে, টের পেল রানা। পরক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

স্বপ্ন দেখছে রানা।

ফ্লাইট সিট থেকে ওকে তুলে নেয়া হয়েছে। কে যেন দুই হাতে আটকে দিল ফ্লেক্স-কাফ। ওকে তুলে দেয়া হলো একটা প্রাইভেট লিয়ার জেট বিমানে। রওনা হয়ে গেল আকাশযান, রানওয়ে থেকে লাফিয়ে উঠে গেল আকাশে।

আবছাভাবে শুনল কার যেন কণ্ঠ।

জন উইলসন বলছে: …তখনই ফোন দিল আইএসএস-এর পরিচিত ওই লোক। সবার খবর তার জানা, আগে আইসিসিতে ছিল। দেখতে ভয়ঙ্কর কুৎসিত। যেন আস্ত ইঁদুর। নাম কোভাক। ব্র্যাড কোভাক। ইঁদুর বলেই ডাকে সবাই।

হঁদুর সবই জানে। ও জানত, আমি এডেনে আছি। আমাকে জানিয়েছে, মাসুদ রানার মাথার ওপর পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার। বলেছিল ইয়েমেনের উদ্দেশে রওনা হয়েছে রানা। আরও বলেছে, আমি যদি আগ্রহী হই, আমার জন্য বিশ্বাসী কয়েকজনকে জোগাড় করে দেবে সে।

জানিয়েছে, মাসুদ রানার সঙ্গে থাকবে বিজ্ঞানী কুয়াশা। তার মাথার ওপরেও পুরস্কার ঘোষণা করেছে আমেরিকান সরকার। পাঁচ মিলিয়ন ডলার। আরে ভাই, আমি তো বিনা। পয়সায় কুয়াশাকে তুলে দিচ্ছিলাম আপনাদের হাতে। আপনারা যখন বলছেন পাঁচ মিলিয়ন ডলার বাড়তি দেবেন, তো খুবই ভাল কথা। অপেক্ষা করুন। আমরা পৌঁছে যাব।

.

বিমান উড়ে চলেছে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল রানা।

কখন যেন ভাঙল ঘুম। খুব অস্বস্তি লাগল। এখনও ওর পরনে ইউটিলিটি ভেস্ট। কিন্তু পকেট থেকে সব অস্ত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শুধু রয়ে গেছে মুড়িয়ে রাখা একটা সোভিয়েত কেমিকেল বডি ব্যাগ। ওটা কোনও অস্ত্রই না। কোনও কাজে আসবে না।

নড়ে উঠে চোখ মেলল রানা। কুয়াশা আর রঘুপতিকে দেখতে পেল। তাদের কব্জিতে ফ্লেক্স-কাফ। পিছনের সারির সিটে ওরা। পাহারা দিচ্ছে ডেল্টা ফোর্সের সেন্ট্রিরা। চোখ বুজে বসে আছে। রঘুপতি। কিন্তু কুয়াশার চোখ খোলা। রানাকে নড়ে উঠতে দেখেছে। আবারও চোখ বুজল রানা। বড় ঘুম, বড্ড ঘুম।

আবারও ঘুমিয়ে পড়ল রানা। আবার কখন যেন জেগে গেল।

জানালা দিয়ে দেখল, রাতের কালো আকাশ নেই এখন, ফ্যাকাসে নীল রং ধরেছে।

ভোর হচ্ছে।

আবারও পুরুষ কণ্ঠ শুনল রানা।

আমরা ওদেরকে কোথায় নেব?

একটা দুর্গে, বলল জন উইলসন। ওটা ফ্রান্সে।

পনেরো

ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

ব্রিটানির উপকূল, ফ্রান্স।

ষোলো অক্টোবর।

সকাল সাতটা।

সাগর এবং পাহাড়ি এলাকায় ঝমঝম করে নেমেছে বৃষ্টি। তারই মাঝে ডেমিয়েন ডগলাসের ব্যক্তিগত এয়ারস্ট্রিপে নেমে এল রানাকে নিয়ে জেট বিমান।

বন্দি রানা, কুয়াশা ও রঘুপতিকে তুলে দেয়া হলো একটা কাভার্ড ট্রাকে। ওদের পাহারায় থাকল ডেল্টা ফোর্সের পাঁচ সৈনিক নিয়ে জন উইলসন। পাহাড়ি পথে ছুটে চলল গাড়ি। গত দুদিন আগে এই রাস্তা ধরেই গিয়েছিল রানা, তিশা ও কুয়াশা।

পথের শেষে প্রকাণ্ড কালো দুর্গ, ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

কিছুক্ষণ পর মূল স্থলভাগ পেরিয়ে গেল ট্রাক, উঠে পড়ল মস্ত ড্র-ব্রিজে। এই পথেই পৌঁছুতে হবে দুর্গে।

তুমুল বৃষ্টি চলছে, সেই সঙ্গে বজ্রপাত। বারবার নীল আলোয় চমকে উঠছে ধূসর আকাশ।

ট্রাকে আসবার পথে সংক্ষেপে, জন উইলসনের বিষয়ে জানিয়েছে কুয়াশা রানাকে। তার ভাই হত্যা করতে চেয়েছিল কুয়াশাকে, পাল্টা খুন হয়ে যায়। তখন থেকে ওকে খুঁজছে জন উইলসন।

উইলসন বাউন্টি হান্টার নয়, বলেছে কুয়াশা। বাউন্টি হান্টিঙের প্রথম নিয়মই ভেঙেছে সে।

কী নিয়ম সেটা? জানতে চেয়েছে রানা।

যদি জীবিত বা মৃত কাউকে নিয়ে যেতে বলা হয়, তা হলে বাউন্টি হান্টাররা লোকটাকে জীবিত রাখে না, বলেছে কুয়াশা।

লাশ কখনও কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

এইমাত্র নুড়িপাথর ভরা উঠানে ঢুকল কাভার্ড ট্রাক। কড়া ব্রেক কষে থেমে গেল দুর্গের পাশে।

ধাক্কা দিয়ে ট্রাক থেকে নামানো হলো রানা, কুয়াশা ও রঘুপতিকে। অস্ত্র হাতে ওদেরকে কাভার করল উইলসন এবং তার লোক।

সবার জন্য অপেক্ষা করছিল ব্যাঙ্কার মোসিউ ড্যাবলার।

দাঁড়িয়ে আছে ক্লাসিক গাড়ির গ্যারাজের গেটে। বরাবরের মতই পরনে নিখুঁত সুট।

তার পাশেই কার্ট কে. এবেলহার্ড। তার সঙ্গে রয়েছে। এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-এর দশজন বাউন্টি হান্টার। এরা ডেমিয়েন ডগলাসের প্রাইভেট সিকিউরিটি ফোর্স হিসাবে কাজ করছে।

মেজর উইলসন, খুশির সুরে বলল ড্যাবলার। ওয়েলকাম টু ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন। আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।

গ্যারাজের পথ দেখাল সে। শেষমাথায় কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল অ্যান্টি-রুমে। আগেও এখানে এসেছে, মনে পড়ল রানার। অবশ্য, এবার আগের সুড়ঙ্গ ব্যবহার না করে পাথরের একটা দরজার সামনে দাঁড়াল ড্যাবলার। চারপাশ পরিত্যক্ত মনে হলো রানার কাছে। দরজা খুলে যেতেই সরু একটা পেঁচানো মেডিইভেল স্টেয়ারকেস শুরু হলো।

পাশের দেয়ালে একটু দূরে দূরে জ্বলছে মশাল। ঘুরে ঘুরে অনেক নীচে নেমেছে সিঁড়ি। রেলিং নেই। কিছুক্ষণ নেমে যাওয়ার পর ওরা বুঝল, ঢুকে গেছে দুর্গের অনেক গভীরে।

সিঁড়ির শেষ ধাপে নামবার পর সামনে পড়ল পাথরের গায়ে পরু এক লোহার দরজা।

গোপন সুইচ টিপল ড্যাবলার। গুড়গুড় আওয়াজ তুলে সিলিঙের দিকে উঠল দরজা। একপাশে সরে দাঁড়াল ড্যাবলার, হাতের ইশারা করল। প্রথমে বন্দিদেরকে নিয়ে ঢুকতে হবে উইলসন এবং তার লোকদেরকে।

দলের সবাইকে নিয়ে দরজা পেরিয়ে গেল উইলসন। সামনে রেখেছে রানা, কুয়াশা ও রঘুপতিকে।

এপাশে মস্ত একটা গোল জলাশয় দেখল রানা। কূপের মত, কিন্তু বিশাল আকারের।

কৃপের দেয়ালের উপর অংশে ছলকে লাগছে সাগরের ঢেউ।

কূপের নানা জায়গায় পাথুরে মঞ্চ।

নীচের সাগরে ঘুরছে দুটো টাইগার শার্ক। রানা বুঝে গেল, এটাই সেই ডানজন। এখানেই বন্দি হয়েছিল কুয়াশা ও তিশা।

একপাশে একটা বারো ফুটি গিলোটিন দেখল রানা। এটাই কুয়াশার কাছ থেকে শোনা সেই শার্ক পিট।

ওদের পিছনে সিলিং থেকে নেমে পাথুরে মেঝের খাঁজে আটকে গেছে স্টিলের দরজা।

বুদ্ধিমানের মতই বাইরে রয়ে গেছে ড্যাবলার। শার্ক পিটে রানাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরেকজন। লোকটার চুল গাজরের রঙের। মুখটা ইঁদুরের মত চোখা।

হাই, কোভাক, বলল উইলসন। সামনে বেড়ে হ্যাণ্ডশেক করল।

হাত মিলিয়ে সরে দাঁড়াল কোভাক, রানার দিকে চাইল। নির্বিকার চেহারা।

তা হলে তুমিই বিসিআই-এর মাসুদ রানা, বলল। নানা সমস্যা করেছ। তোমার সাইবেরিয়ার মিশন গুছিয়ে দিতে অনেক সময় দিয়েছি। পরিবেশ তৈরি করেছি। এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-এর মার্সেনারিদের পাঠিয়েছি। অ্যাটলক আর রবিন কার্লটনকে ওখানে পাঠিয়েছি তোমাকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে। তারপর তোমার কমিউনিকেশন বন্ধ করেছি। হার্লি অ্যাটলক আর রবিন কার্লটন ভাল যোদ্ধা ছিল না, কিন্তু তুমি অন্যকিছু। বেঁচেই থাকলে।

কিন্তু এবার বেশিক্ষণ বাঁচবে না। পালাতেও পারবে না। মরতেই হবে। রানাকে পাকড়ে ধরা ডেল্টা সৈনিকের দিকে চাইল কোভাক। ওকে তোলো গিলোটিনে।

জন উইলসনের দুই সৈনিক ধাক্কা দিয়ে রানাকে নিয়ে গেল গিলোটিনের সামনে। ঘাড় ধরে বসিয়ে দেয়া হলো বন্দিকে। ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দিল নতুন কাঠের আড়া। হামাগুড়ির ভঙ্গিতে বসতে হয়েছে রানাকে। পিঠে ফ্লেক্স-কাফে আটকানো

না! ডানজনের আরেকপ্রান্ত থেকে ধমকে উঠল একটা কণ্ঠ।

ওদিকে ঘুরে চাইল সবাই। পিটের অনেকটা উপরে ব্যালকনি, ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ডেমিয়েন ডগলাস।

পাশে এবেলহার্ড এবং তার দশ বাউন্টি হান্টার। আবারও উদয় হয়েছে মোসিউ ড্যাবলার।

ওর চোখ যেন থাকে গিলোটিনের ব্লেডের ওপর, বলল ডেমিয়েন। দেখুক কীভাবে নামে ক্ষুর।

নির্দেশ পালন করল ডেল্টা ফোর্সের দুই সৈনিক।

ক্ষুরধার ব্লেডের দিকে চোখ রানার। বারো ফুট উপরে কাঠের ফ্রেমে গিলোটিন, আয়নার মত চকচক করছে।

বাংলাদেশি মেজর, বলল ডেমিয়েন, নিজ বুদ্ধি এবং যোগ্যতায় বর্তমানের সভ্যতা রক্ষা করেছ। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেঁচে গেল, যাদেরকে তুমি চেনোও না। তারাও শোনেনি তোমার নাম। সত্যিই তুমি মস্ত হিরো। কিন্তু তোমার বিজয় কয়েক দিনের জন্যে। কারণ আমি বেঁচে থাকছি। শাসন করব এই গোটা দুনিয়াকে। তোমার সময় ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু আমার সময় মাত্র শুরু। এবার বুঝবে হিরো হতে গেলে কী ধরনের ক্ষতি মেনে নিতে হয়। মিস্টার কোভাক, ব্লেড নামিয়ে দাও ওর গলার উপর। তারপর গুলি করে আঁঝরা করবে হিরো মাসুদ রানাকে। এরপর…

ডেমিয়েন! ডানজনের ভিতর গমগম করে উঠল রানার কণ্ঠ।

সবাই থমকে গেল।

শান্ত, শীতল কণ্ঠে রানা বলল, আমি তোমাকে শেষ করব।

শীতল হাসল ডেমিয়েন ডগলাস। এই জীবনে নয়, মেজর। কোভাক, ব্লেড!

গিলোটিনের পাশে পৌঁছে গেছে ইঁদুর মুখে কোভাক। রানার দিকে চাইল, তারপর খপ করে ধরল লোহার লিভার।

ওই একইসময়ে কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে কোল্ট ৪৫ রিভলভার তুলল জন উইলসন।

নরকে দেখা হবে, মাসুদ রানা, বলল কোভাক।

 পরক্ষণে টান দিল লিভারে, খুলে দিয়েছে ব্লেড। সরসর করে নেমে এল ইস্পাতের চকচকে পাত। কিছুই করবার নেই রানার, চুপ করে চেয়ে রইল।

ওর গলা লক্ষ্য করে নামছে ব্লেড। শেষ পর্যায়ে আস্তে করে চোখ বুজল রানা। পরক্ষণে আওয়াজ উঠল: ঠং। রানার মৃত্যু এভাবে এল না। কোনও ব্যথাই টের পেল না ও। আবারও চোখ মেলল।

ওর গলা থেকে মাত্র একফুট উপরে থেমে গেছে গিলোটিনের ব্লেড। ওটাকে আটকে দিয়েছে একটা পাঁচ ব্লেডের শুরিকেন। গভীরভাবে গেঁথে গেছে কাঠের ফ্রেমে। আর নামতে দিচ্ছে না। ইস্পাতের পাত।

এইমাত্র ছোঁড়া হয়েছে শুরিকেন, কাঠে গেঁথে এখনও থরথর করে কাঁপছে পাত।

একইভাবে রক্ষা করা হয়েছে কুয়াশাকে। শুরিকেন ছিটকে যাওয়ার পর মুহূর্তে একটা বুলেট বিঁধেছে জন উইলসনের ডান কব্জিতে। ছিটকে পড়েছে রিভলভার পানিতে। লোকটার কব্জির ক্ষত থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে রক্ত।

ঘুরে চাইল রানা। অবাক হয়ে দেখল, শার্ক পিটের পানি। থেকে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর এক মূর্তি।

পরনে ধূসর ইউনিফর্ম, মুখে স্কুবা গিয়ার একহাতে শুরিকেন ছুঁড়ছে, অন্য হাতে গর্জন ছাড়ছে অস্ত্র।

ওই কালিমূর্তি যেন স্বয়ং মৃত্যুদূত। নিশাত সুলতানা। নিশাত আপা।

পানি-সমতল ভেঙে ছিটকে উঠেছে সে, এ মুহূর্তে দুই হাতে এম-৭ মেশিন পিস্তল। গুলি করছে ঝড়ের গতিতে। দুই গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ল দুই ডেল্টা সৈনিক, মৃত।

চারপাশে নড়তে শুরু করেছে সবাই।

নিশাতের হঠাৎ আগমনে কুয়াশা ও রঘুপতি টের পেয়েছে, এখন ওদের উপর কারও চোখ নেই। সবাই দেখছে রানাকে।

লাফিয়ে উঠে দুপা-র তলা দিয়ে দুহাত ঘুরিয়ে আনল। কুয়াশা ও রঘুপতি। সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে হাতের প্লাস্টিকের ফ্লেক্স-কাফ।

নির্দেশনা লাগল না নিশাত সুলতানার। দুই গুলিতে উড়িয়ে দিল কুয়াশা ও রঘুপতির হ্যাণ্ড-কাফ। মুহূর্তে মুক্ত হয়ে গেল কুয়াশা ও রঘুপতি।

উপরের ব্যালকনিতে নিজ লোকদের কাজে নামতে ইশারা করল কার্ট কে. এবেলহার্ড। চারজনকে পাঠাল ব্যালকনি থেকে নীচের পিট লক্ষ্য করে। অন্য ছয়জনকে নিয়ে ব্যালকনির পিছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সে। করিডোরে থেমেই বের করল এম-১৬। পাহারা দিয়ে ডানজন থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে ডেমিয়েন ডগলাসকে।

এদিকে ডেল্টা ফোর্সের মৃত এক লোকের পাশে পড়ে থাকা। কোল্ট কমাণ্ডো রাইফেল তুলে নিল কুয়াশা। এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-এর চার লোক ব্যালকনি থেকে নামছে, তাদের উদ্দেশে গুলি পাঠাল ও।

কুয়াশার পাশে রঘুপতি এখনও নিরস্ত্র, কয়েক লাফে সামনে বেড়েই থাবা মারল এক ডেল্টা সৈনিকের নাকে। লোকটার মগজে গেঁথে গেল নাকের হাড়। ধুপ করে পড়ল লাশ।

রঘুপতি! নির্দেশ দিল কুয়াশা। রানাকে সরিয়ে নাও!

ঝড়ের গতিতে গিলোটিনের দিকে ছুটল রোবট।

গোলাগুলি শুরু হওয়ায় গিলোটিনের পাশে লুকিয়ে পড়েছে কোভাক, সামান্য দূরেই রানা।

মুহূর্তের জন্য গোলাগুলি থেমেছে বুঝেই গিলোটিনের ফ্রেম। থেকে শুরিকেন খুলে নিতে চাইল কোভাক।

এবার ব্লেড নামবে রানার গলা লক্ষ্য করে। খপ করে শুরিকেন ধরল লোকটা। কিন্তু তখনই মারাত্মক উল্টো এক চড় খেয়ে ছিটকে পড়ল সে।

পাথুরে মঞ্চের কিনারায় পড়েছে। খেয়াল করল, ওর চোখে চোখ রেখে পানি থেকে চেয়ে আছে একটা টাইগার শার্ক। শক খাওয়া লোকের মত ছিটকে উঠে দাঁড়াল কোভাক।

ওদিকে রানার পাশে ঝাঁপিয়ে পড়েছে রঘুপতি, ওকে কাভার দিচ্ছে রাইফেল হাতে কুয়াশা। প্রতিটি গুলি অব্যর্থ।

হ্যাচকা টানে গিলোটিনের কাঠের আড়া তুলে ফেলল। রঘুপতি, মুক্ত করে দিল রানাকে।

কুয়াশার এক গুলি ছিঁড়ে দিল রানার ফ্লেক্স-কাফ। আর তখনই হঠাৎ করেই রানাকে পিছনে সরিয়ে দিল রঘুপতি। নিজে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে।

পরক্ষণে এক রাশ গুলি ঝাঁঝরা করে দিল রঘুপতির বুক। ছিটকে বেরোল নীল রক্ত, ওর প্রাণশক্তি।

কুপের একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে গুলি করছে উইলসন। ডান কব্জি রক্তাক্ত, অন্যহাতে কোল্ট কমাণ্ডো রাইফেল। বারবার টিপছে ট্রিগার।

না! হাহাকার করে উঠল কুয়াশা। ধ্বংস হতে দেখছে নিজ সৃষ্টি।

উইলসনের দিকে অস্ত্র ঘোরাল কুয়াশা, কিন্তু ফুরিয়ে গেছে ওর রাইফেলের ম্যাগাযিন।

নিজেই ছিটকে রওনা হলো কুয়াশা, এক সেকেণ্ড পর ডাইভ দিয়ে পড়ল উইলসনের দুই পায়ে। ভয়ঙ্কর ট্যাকল করেছে। হুড়মুড় পরে হাঙরের কূপে ঝুপ করে পড়ল দুজন।

গিলোটিন থেকে মুক্ত হয়েই ঘুরে চাইল রানা, টলতে টলতে ইস্পাতের দরজার দিকে চলেছে কোভাক। ওদিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে শার্ক পিট থেকে।

রানা ছুট লাগাল তার পিছনে। কিন্তু জ্যাকেট থেকে রিমোট কন্ট্রোল বের করেছে লোকটা।

সরসর করে উপরে উঠল দরজা। তাড়া খাওয়া কুকুরের মত ছুটল কোভাক।

ঝড়ের গতিতে পিছু নিয়েছে রানাও, তারই ফাঁকে গ্রেট মাইকে বলল, আপা!

কাছেই এক মঞ্চের পিলারের আড়াল নিয়েছে নিশাত সুলতানা, পিস্তল হাতে গুলি করছে দুই ডেল্টা সৈনিককে লক্ষ্য করে। তারই ফাঁকে শুনেছে রানার ডাক।

গুলি পাঠাল কোভাকের উদ্দেশে। কিন্তু লাগল না গুলি।

অবশ্য একটি দিয়ে বেরোবার সাহস হারাল লোকটা, কাভার নিল একটা পাথুরে মঞ্চের।

নিশাতের গুলির কারণে বাড়তি সুবিধা পেল না রানা।

উল্টো বাড়তি সুবিধা পেল নিশাতের দিকে গুলি পাঠানো ডেল্টা সৈনিকরা।

এক রাশ গুলি বিধল নিশাতের বুকে।

ওর বুকে রয়েছে বুলেট প্রুফ ফ্লেক ভেস্ট। ঝাঁকি খেয়ে পিছিয়ে গেল ও। একের পর এক বুলেট লাগছে বুকে।

ছিটকে পিছিয়ে গেল নিশাত, এবং সে সুযোগে নিখুঁত লক্ষ্যভেদ করতে চাইল এক ডেল্টা সৈনিক। রাইফেল তাক করেছে নিশাতের মাথা লক্ষ্য করে।

কিন্তু তখনই ঝপাস্ করে পানিতে পড়ল নিশাত। মাথার উপর দিয়ে গেল অন্তত বিশটা গুলি।

মুহূর্তের জন্য নীরবতা নামল ডানজনে।

এক সেকেণ্ড পর ভেসে উঠল নিশাত, বুলেট উগরে দিল দুহাতের পিস্তল।

ওর দিকেই গুলি করছে ডেল্টা সৈনিকরা। কিন্তু তখনই মুখে-বুকে বুলেট খেয়ে ছিটকে পড়ল তারা।

সন্তুষ্টির হাসি হাসল নিশাত। আর তখনই টের পেল, অতিরিক্তি নড়ছে চারপাশের পানি।

ঝট করে ঘুরে গেল নিশাত… দেখল মস্ত একটা ঢেউ তেড়ে আসছে ওকে লক্ষ্য করে। উঁচু হয়ে উঠেছে টাইগার শার্কের ডর্সাল ফিন।

সর্বনাশ! ফিসফিস করল নিশাত। মাছের খাবার হতে চাই! পিস্তল তুলেই গুলি শুরু করল ও হাঙর লক্ষ্য করে।

গতি কমছে না হাঙরের।

গুলি লাগছে, কিন্তু ঢেউয়ের ভিতর দিয়ে মস্ত চোয়াল হাঁ করে আসছে ওটা।

টাশশ! টাশশ! আওয়াজ তুলছে পিস্তল। গতি কমল না হাঙরের।

পানিতে ফেনা তৈরি করেছে, আরও মস্ত হাঁ করেছে ছুটে এল নিশাতের পা লক্ষ্য করে!

চোয়ালে খপ করে পুরে ফেলল একটা পা। পরক্ষণে চিবাতে লাগল নিশাতের বাম পা।

সামান্যতম ব্যথা লাগল না নিশাতের। ওই নকল পা টাইটেনিয়ামের তৈরি। মুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল হাঙরের দুটো দাঁত।

খা-না! টাইগার শার্কের মগজ লক্ষ্য করে পিস্তল তুলল নিশাত।

টাশশ করে উঠল পিস্তল।

পানির ভিতর মস্ত একটা ঝাঁকি খেল হাঙর, ছিটকে পিছিয়ে গেল। এখনও পা চোয়ালের ভিতর। এক সেকেণ্ড পর ভেসে উঠল ওটার লাশ। এখনও মুখের ভিতর নিশাতের, পা। শেষ। মুহূর্তেও শিকার ছাড়তে চায়নি।

বেদম এক লাথি দিয়ে হাঙরের লাশ সরিয়ে দিল নিশাত, ছাড়িয়ে নিল পা। লাফ দিয়ে উঠে এল ডানজনে, অনেক কাজ পড়ে আছে ওর।

হাঙরের সঙ্গে যখন লড়াই করছে নিশাত, সেই একই সময়ে কোভাকের পিছু নিয়েছে রানা। এবং ধরেও ফেলেছে তাকে। চার ফুট দূর থেকে ডাইভ দিয়ে চলে গেল রানা দরজার কাছে।

আইএসএস এজেণ্ট লাথি দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল রানাকে। কিন্তু হাঁটুর পাশে ধাক্কা দিয়ে ভারসাম্য নষ্ট করে দিল রানা ওর। পরমুহূর্তে লাফিয়ে উঠেই ঘুষি বসাল রানা লোকটার চোয়ালে। ছিটকে পড়ল সে দেয়ালে। আর বেরোতে পারবে না ডানজন থেকে। সিধে হয়ে দাঁড়াবার আগেই তার চোয়ালে নামল রানার ভয়ঙ্কর ঘুষি। ভাঙা নাক থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত

রানার পর পর দুই ঘুষি ভেঙে দিল কোভাকের চোয়াল। সুযোগই পেল না লোকটা, তাকে দুই হাতে মাথার উপর তুলে নিল রানা, পরক্ষণে ছুঁড়ে ফেলল গিলোটিনের তক্তার উপর। ধড়মড় করে উঠে পালাতে চাইল কোভাক।

গিলোটিন ব্যবহার করবি, না? ঝড়ের মত সামনে বেড়েছে রানা, খপ করে শুরিকেন ধরেই টান দিয়ে সরিয়ে নিল ফ্রেম থেকে।

নাহ! আর্তনাদ করে উঠল কোভাক। এখনও সরতে পারেনি গিলোটিনের তলা থেকে। নাহ!

তখনই খটাৎ আওয়াজে তার গর্দানের উপর নামল গিলোটিনের ব্লেড।

গলা থেকে ছিটকে আরেকদিকে রওনা হলো কোভাকের মুণ্ডু, যেন ফুটবল। এখনও দেখছে, পিটপিট করছে দুই চোখ। কয়েক সেকেণ্ড পর শিথিল হলো গালের পেশি। দৃষ্টিতে রয়ে গেছে ভয়।

গিলোটিনের দশ গজ দূরে হাঙরের পুলে ভেসে উঠেছে কুয়াশা, এখনও লড়ছে জন উইলসনের বিরুদ্ধে।

ডেল্টা ট্রেনিং কাজে লাগাতে চাইছে উইলসন, কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না। পরস্পরের মুখ ও বুক লক্ষ্য করে ঘুষি মারছে। দুজন। জাপানি এক মস্ত গুরুর কাছে খালি হাতের লড়াই শিখেছে কুয়াশা। অনায়াসেই উইলসনের ঘুষি বা চপ এড়িয়ে যাচ্ছে। দুজনই জানে, এই লড়াই শেষে বাঁচবে মাত্র একজন।

পানির ভিতর মুখোমুখি হয়ে হঠাৎ করেই ভেসে উঠল দুজন। কিন্তু ছোট্ট একটা পিস্তল দেখা দিয়েছে উইলসনের হাতে। ওটার মাযল ঠেকিয়ে দিল কুয়াশার থুতনিতে।

জিতে গেছে সে লড়াইয়ে।

জানতাম তুই পালাতে পারবি না, কুয়াশা! দাঁতে দাঁত চেপে বলল উইলসন। এবার আমার ভাই স্বর্গে ভাল থাকবে!

কখনও পালাতে চাইনি, পাল্টা বলল কুয়াশা।

তাই? দাঁতে দাঁত পিষল উইলসন।

হ্যাঁ! হঠাৎ করেই কাঁধের ভয়ঙ্কর শক্তি ব্যবহার করে উইলসনকে ঘুরিয়ে দিল কুয়াশা। ওদিক দিয়ে ছুটে আসছে দ্বিতীয় টাইগার শার্ক!

পূর্ণ গতি নিয়ে উইলসনের বুকে গুঁতো দিল দশফুটি হাঙর। এক খাবলা মাংস তুলল বুক থেকে। আরাম করে চিবাতে শুরু করেছে। পরের খাবলা মাংস নিল পাঁজর থেকে। কুয়াশার পাঁচ ইঞ্চি দূরে আরাম করে ভেজে ব্যস্ত হাঙর। উইলসনের হাতের রক্তের লোভনীয় গন্ধেই ছুটে এসেছে। পাত্তাই দিল না কুয়াশাকে।

বিকট চিৎকার জুড়েছে জন উইলসন। তাকে জীবন্ত খেয়ে ফেলছে মস্ত হাঙর!

লাফ দিয়ে কূপের পারে উঠে এল কুয়াশা। একবার দেখল রক্তাক্ত ফেনার ভিতর এখনও পাগলের মত হাত নাড়ছে লোকটা। এক সেকেণ্ড পর তলিয়ে গেল।

রানার দিকে রওনা হয়ে গেল কুয়াশা।

ওদের দেখা হলো গিলোটিনের পিছনে

এইমাত্র রঘুপতিকে ওখানে সরিয়ে নিয়েছে রানা। ডানজনে কূপের ওদিকে এখনও রয়ে গেছে চার ডেল্টা সৈনিক, গুলি করছে ওদেরকে লক্ষ্য। কয়েকটা অস্ত্র জোগাড় করেছে রানা। দুটো কোল্ট কমাণ্ডো। অ্যাসল্ট রাইফেল, একটা এমপি-৭, কুয়াশার এইচঅ্যাণ্ডএইচ ৯এমএম পিস্তল এবং বৈজ্ঞানিকের ইকুইপমেন্ট ভরা ইউটিলিটি ভেস্ট। শেষের জিনিসটা এসেছে এক মৃত ডেল্টা সৈনিকের কাছ থেকে।

ওদের পাশে পৌঁছে গেল নিশাত।

শেষবার আপনাকে দেখেছি এমভি লোটাস সুপারট্যাঙ্কারের মেইনটেন্যান্স শ্যাকে নিশাতকে বলল কয়াশা। তখন হেণ্ডিকের। লোক আরপিজি ছুঁড়ল। কোথায় লুকিয়েছিলেন? মেঝে তো ছিল পরিষ্কার।

মেঝে দিয়ে কী হবে? বলল নিশাত। ওই শ্যাক ঝুলছিল হোল্ডের ছাত থেকে। ছাতে আবার একটা হ্যাচ ছিল। সোজা। উঠে গেছি ওখানে। আর তারপর তো কচুর গোটা জাহাজ…

আপনি কী করে জানলেন আমরা এখানে থাকব? জানতে চাইল কুয়াশা।

ভেস্ট থেকে ওয়াটারপ্রুফ পাউচ বের করল নিশাত, ওটা থেকে নিল পাম পাইলট। আপনার কাছে দারুণ সব মজার খেলনা আছে, মিস্টার কুয়াশা। আর… রানার দিকে চাইল নিশাত। স্যরের হাত ভরা আছে মাইক্রোডটে।

আপনাকে ফিরে পেয়ে ভাল লাগছে, বলল রানা।

গিলোটিনে ঠং করে লাগল এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র বাউন্টি হান্টারদের গুলি।

চট করে ঘুরে চাইল রানা। মাত্র দশগজ দূরে খোলা দরজা।

আমি চললাম ডেমিয়েন ডগলাসের পিছনে, বলল রানা।

আপা, আপনি রঘুপতির পাশে থাকুন। শেষ করে আসবেন শত্রুদেরকে। কুয়াশা, আপনি আমার সঙ্গে যেতে চান?

একবার রঘুপতিকে দেখল কুয়াশা, তারপর বলল, আমি। তোমার সঙ্গে যাব।

রানার পরনে এখনও কুয়াশার দেয়া ইউটিলিটি ভেস্ট। একটা রাইফেল কুয়াশাকে দিল রানা। এ ছাড়া ৯মএম পিস্তল এবং নানা কিছু ভরা ভেস্ট। নিন, আপনার কাজে আসবে। চলুন রওনা হয়ে যাই। আপা, আপনি আমাদেরকে কাভার দেবেন।

অস্ত্র ঘুরিয়ে নিল নিশাত, এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউর লোকগুলোকে লক্ষ্য করে কাভার ফায়ার শুরু করল।

দরজার দিকে ছুট দিল রানা। ওর পিছনে কুয়াশা। অবশ্য তার আগে নিশাতের কাছ থেকে কী যেন নিয়েছে।

ওটা দিয়ে কী করবেন, মিস্টার কুয়াশা? পিছন থেকে জানতে চাইল নিশাত।

রানার পিছনে পাথুরে ডোরওয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল কুয়াশা, মন বলছে কাজে আসবে।

দেয়ালের ব্র্যাকেটে রাখা মশালের লালচে আলোয় ঝড়ের গতিতে প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল দুজন নিজেদের কাজে খুবই দক্ষ। একে অপরকে কাভার দিচ্ছে। মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠছে কোল্ট কমাণ্ডো অ্যাসল্ট রাইফেলের মাযল।

সুযোগই পেল না এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র ছয় মার্সেনারি।

রানা আগেই ধারণা করেছিল এবেলহার্ড এদিকে রাখবে তার লোকদেরকে।

স্টেয়ারওয়েলের তিনটি ধাপে দুজন করে রেখেছে সে। গুলি করছে দেয়ালের অ্যালকোভ থেকে।

ঝড়ের গতিতে উঠতে থাকা দুই যোদ্ধার গুলির তোড়ে উড়ে গেল দুই মার্সেনারি। লাশ হয়ে পড়ে রইল সিঁড়ির ধাপে।

পরের ল্যাণ্ডিঙের দুই মার্সেনারি কিছুই শোনেনি। বাঁকের ওদিক থেকে এল দুটো শুরিকেন, বুমেরাঙের মত আঘাত হানল দুই সৈনিকের কপালে। কেটে ঢুকে গেল মগজে, সেখানেও কয়েক পাক ঘোরার পর থামল।

তৃতীয় ধাপের দুই মার্সেনারি সতর্ক। তারা একটা ফাঁদ পেঠেছে।

স্টেয়ারওয়েলের উপরে সুড়ঙ্গে অপেক্ষা করছে। পিছনে অ্যান্টি-রুম। ওদিক দিয়ে যাওয়া যায় ফুটন্ত তেলের সুড়ঙ্গে। শেষমাথায় ডেমিয়েন ডগলাসের অফিসে অপেক্ষা করছে কার্ট কে. এবেলহার্ড। পাহারা দিচ্ছে ডগলাস ও ড্যাবলারকে।

স্টেয়ারওয়েলের উপরে পৌঁছে থামল রানা ও কুয়াশা। উঁকি দিতেই দেখল সুড়ঙ্গে দুই মার্সেনারি। এদেরকে শেষ করতে পারলে অন্যদেরকে কোণঠাসা করতে পারবে।

এবার ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা। আগের জায়গায় রয়ে গেল কুয়াশা।

ঝড়ের মত অ্যান্টি-রুম পেরোল রানা, গুলি করছে সুড়ঙ্গের দুই মার্সেনারিকে লক্ষ্য করে।

পাল্টা গুলি পাঠাল তারাও।

রানা, না! পিছন থেকে সতর্ক করতে চাইল কুয়াশা। ওটা একটা ফাঁ…

অনেক দেরি হয়ে গেছে ওর।

অ্যান্টি-রুমের তিনদিকে ইস্পাতের দরজা নেমে এল সড়সড় করে। চতুর্থ দরজা আটকে দিল স্টেয়ারওয়েলের দিক। এখন আর অ্যান্টি-রুম থেকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে পারবে না কুয়াশা।

বিকট আওয়াজে নেমেছে ইস্পাতের দরজা।

আলাদা হয়ে গেছে রানা ও কুয়াশা।

সুড়ঙ্গে আটকা পড়েছে রানা। সামনের মেঝেতে পড়ে আছে। দুই মার্সেনারি। একজন মারা গেছে, অন্যজন গুঙিয়ে চলেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায়, বাঁচবে না।

অ্যান্টি-রুমে রয়ে গেল কুয়াশা। বদ্ধ সুড়ঙ্গে থমকে দাঁড়াল রানা।

স্পিকারে ডেমিয়েনের কণ্ঠ শুনল: মেজর রানা, খুশি হয়েছি। তোমাকে চিনতে পেরে। কুয়াশার দক্ষতাও দেখলাম। তবে এবার বিদায় নিতে হবে তোমাদের দুজনকেই।–অ্যান্টি-রুমে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। সিলিঙের দিকে চোখ যেতেই দেখল, ওখানে পাথুরে দেয়ালে গেঁথে দেয়া হয়েছে ছয়টি মাইক্রোওয়েভ এমিটার।

সর্বনাশ! ফিসফিস করল কুয়াশা।

কিন্তু এখন খেলা শেষ, স্পিকারে গমগম করছে। ডেমিয়েনের কণ্ঠ, এবার ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়ে বিদায় নেবে তোমরা।

নিজের অফিসে প্লাস্টিকের ছোট জানালা দিয়ে ওদিকে চাইল ডেমিয়েন। সামনে ফুটন্ত তেলের সুড়ঙ্গ। ওখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা, বন্দি।

গুডবাই, জেন্টলমেন।

টেবিল থেকে রিমোট কন্ট্রোল তুলে নিয়ে দুটো বাটন টিপল ডগলাস। দুই বুবি ট্র্যাপ চেম্বারে চালু হয়েছে দুই মরণ ফাঁদ।

কুয়াশার অ্যান্টি-রুমে গুনগুন করে উঠল মাইক্রোওয়েভ এমিটার। ওদিকে রানার সুড়ঙ্গের নালা দিয়ে নামতে শুরু করেছে ফুটন্ত তেল।

প্রথমে অ্যান্টি-রুমে ভ্রমর গুঞ্জন শুনল ডেমিয়েন ডগলাস। তখনই গুলির আওয়াজ শুরু হলো।

আগেও কেউ কেউ এমন চেষ্টা করেছে।

বেরিয়ে যেতে চেয়েছে অ্যান্টি-রুম থেকে। কিন্তু ইস্পাতের দরজার কারণে কিছুই করবার থাকে না। গুলি করে উড়িয়ে দেয়া যায় না মাইক্রোওয়েভ এমিটার, গেঁথে দেয়া হয়েছে রিইনফোর্সড পাথুরে দেয়ালে।

ডেমিয়েন ডগলাসের জানালার ওপাশে বিস্ফোরণের আওয়াজ চলছে। সুড়ঙ্গে নামছে ফুটন্ত হলদে তেল। ওদিকে আর রানাকে দেখতে পেল না ডগলাস।

দেখবার দরকার পড়ে না। তার জানা আছে এখন কী ঘটছে।

গোটা সুড়ঙ্গে নামছে স্প্রে করা আগুন গরম তেল। মাসুদ রানার বিকট আর্তনাদ শুনল ডেমিয়েন।

অবশ্য, দুই মিনিট পরেই মিলিয়ে গেল কুয়াশা ও রানার আর্তনাদ। আর গোলাগুলির আওয়াজ নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে স্টিলের দরজা খুলে দিল ডেমিয়েন ডগলাস।

আর তখনই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখল।

টানেলের মেঝেতে পড়ে আছে এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-এ দুই মার্সেনারি, পুড়ে গেছে। তাদের একজনের দুই হাত আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে আকাশে উঠেছে। ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়ে মরেছে লোকটা। আড়াল চেয়েছিল ফুটন্ত তেল থেকে।

কিন্তু সুড়ঙ্গের কোথাও মাসুদ রানাকে দেখা গেল না।

অবশ্য টানেলের শেষে অ্যান্টি-রুমের দরজার কাছে কালো। মানব দেহ আকৃতির কী যেন।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে।

জিনিসটা একটা কালো পলিমার-প্লাস্টিক বডি ব্যাগ। মার্কোভ টাইপ-৩। সোভিয়েতরা বহু যত্ন নিয়ে তৈরি করেছিল। রানার ভেস্ট থেকে সবই কেড়ে নিয়েছিল জন উইলসন, রয়ে গিয়েছিল মাত্র একটা জিনিস–ওই ব্যাগ যে-কোনও কেমিকেল কন্টামিনেশন ঠেকাতে পারে। আরও একটা কাজ পারে, অনায়াসেই ঠেকিয়ে দেয় ফুটন্ত তেল!

বডি ব্যাগের যিপার টেনে খুলল রানা, ভোজবাজির মত বেরিয়ে এল এম-৭ মেশিন পিস্তল হাতে।

ওর প্রথম গুলিতে ডেমিয়েন, ডগলাসের হাত থেকে উড়াল দিল রিমোট কন্ট্রোল। খোলাই থাকল টানেলের দরজা।

দ্বিতীয় গুলিতে উড়ে গেল ডেমিয়েন ডগলাসের বাম কান। রানার হাতে অস্ত্র দেখেই ডোরফ্রেমের আড়াল নিয়েছে লোকটা।

এক সেকেণ্ড দেরি হলে উড়ে যেতে কপাল।

সরু টানেলে ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ল রানা, হাতে উদ্যত এমপি-৭।

অফিসের ডোরওয়ে থেকে পাল্টা গুলি পাঠাল কার্ট কে. এবেলহার্ড।

দুজনের তুমুল গোলাগুলিতে টানেলের কলামে লেগে পাথরের কুচি নানাদিকে ছুটল।

এবেলহার্ডের পিছনের সিলিং থেকে মেঝে পর্যন্ত। প্যানোরামিক উইণ্ডো ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল।

দুজনই আড়াল নিয়েছে। এখন মূল কথা: আগে শেষ হবে কার গুলি? রানার, না এবেলহার্ডের? আগেই ফুরিয়ে গেল রানার অস্ত্রের গুলি। অফিসের ডোরওয়ে এখনও দশ ফুট দূরে।

পাথুরে সরু এক কলামের আড়ালে সরে গেল রানা। ভালভাবে লুকাতে পারেনি।

হাসল কার্ট কে, এবেলহার্ড। এবার রানাকে বাগে পেয়েছে সে।

কিন্তু তখনই আবারও এবেলহার্ডের দিকে এল একরাশ গুলি। বুলেট আসছে রানার পিছনে টানেলের শেষে অ্যান্টি-রুম থেকে।

অবাক হয়েছে রানা, ঘুরে চাইল ওদিকে।

সুড়ঙ্গে ঢুকেছে কুয়াশা, ঝড়ের মত আসছে। আগুন ঝরছে। কোল্ট কমাণ্ডো অ্যাসল্ট রাইফেলের মাযল থেকে।

অ্যান্টি-রুমের দিকে চোখ গেল রানার।

মেঝেতে পড়ে আছে ডজনখানেক ৯এমএম গুলির খোসা। মাইক্রোওয়েভ এমিটার ঠেকাতে গুলি করেছে কুয়াশা।

কিন্তু ওই খোসাগুলো সাধারণ বুলেটের নয়। খোসার উপর অংশে কমলা রঙের ব্যাণ্ড।

সাধারণ বুলেটে কিছুই হতো না। অ্যান্টি-রুমের মাইক্রোওয়েভ এমিটারের, কিন্তু কুয়াশার গ্যাস-এক্সপ্যাণ্ডিং বুল স্টপার অন্য জিনিস।

কুয়াশা গুলি করছে বুঝতেই আর দেরি করল না রানা, রওনা হয়ে গেল অফিস লক্ষ্য করে।

গুলির মুখে পিছাতে হচ্ছে এবেলহার্ডকে। কয়েক সেকেণ্ড পর ফুরিয়ে গেল তার গুলির ম্যাগাযিন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, ফুরিয়ে গেছে কুয়াশার গুলিও।

তীরের মত গিয়ে অফিসে ঢুকল রানা। ওর ডানহাতি পর পর দুটো ঘুষি নামল এবেলহার্ডের ভাঙা নাকে।

ব্যথায় আহত বাঘের মত গর্জন ছাড়ল লোকটা। রানার সঙ্গে শুরু হয়ে গেল হ্যাণ্ড-টু-হ্যাণ্ড কমব্যাট।

একপক্ষে বাংলাদেশ আর্মির প্রাক্তন মেজর, অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্ধর্ষ রেকণ্ডো।

পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওরা। কিন্তু এ সুযোগে সামনে বাড়ল ব্যাঙ্কার ড্যাবলার, হাতের আস্তিন থেকে বের করেছে চকচকে ছোরা। লাফিয়ে গিয়ে রানার পিঠে ফলা বিধিয়ে দিতে চাইল সে।

রানার মেরুদণ্ডের এক ইঞ্চি দূরে পৌঁছে গেল ক্ষুরধার ফলা। কিন্তু তখনই লোকটার কব্জির উপর ভয়ঙ্কর চাপ এল। কাত হয়ে অবাক চোখে কুয়াশার চোখে চাইল ড্যাবলার।

তুমি দেখছি কোনও আইনই মানো না, বলল কুয়াশা। চাপ বাড়ছে হাতের। কিন্তু অন্য আস্তিন থেকে আরেকটা ছোরা বের করেই কুয়াশার ঊরুতে গেঁথে দিল ড্যাবলার। আবারও ছোরা তুলল সে, বিদ্যুদ্বেগে চালাল শত্রুর বুক লক্ষ্য করে।

সামান্য ছুঁয়েছে ছুরির ফলা, তাতেই ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল কুয়াশার প্রশস্ত বুক থেকে। এ লোককে অবজ্ঞা করা যায় না। পিছিয়ে গেল কুয়াশা। আগের চেয়ে অনেক সতর্ক। এত ধারাল ছোরা আগে দেখেনি।

ব্যাঙ্কারের প্রতিটি পদক্ষেপ এখন মাপা।

সুইস গার্ডসে ছিলে, না ড্যাবলার? পরবর্তী হামলা ঠেকাতে প্রস্তুতি নিল কুয়াশা। জানতাম না। ভাল।

আমার যে ব্যবসা, সতর্ক থাকতে হয়, বাঁকা হাসল। ড্যাবলার।

দরজার কাছে একে অপরকে কাবু করতে চাইছে রানা ও এবেলহার্ড।

রানার চেয়ে আকারে বড় এবেলহার্ড, শক্তিও বেশি। তার। চেয়ে বড় কথা, তার ট্রেনিংও একই মাপের।

বিদ্যুদ্বেগে সরছে রানা। এড়িয়ে যাচ্ছে মারাত্মক সব ঘুষি।

কিন্তু গত কয়েক দিনের পরিশ্রম, এক্স-১৬ বিমান ক্র্যাশের ধকল, তারপর ফ্রান্সে ওকে ধরে আনা–সব মিলে ও অত্যন্ত ক্লান্ত।

ওর একটা ঘুষি অনায়াসে এড়িয়ে গেল এবেলহার্ড, পরক্ষণে এক ঘুষিতে রানার নাকের হাড় গেঁথে দিতে চাইল মগজে। ওই এক আঘাতেই মারা পড়বে শত্রু। ২৪৫

শেষসময়ে টলতে টলতে পিছিয়ে গেল রানা। বুঝে গেছে ভারসাম্য রাখতে পারবে না, কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগে গায়ের জোরে ঘুষি বসিয়ে দিল এবেলহার্ডের অ্যাডাম্স্ অ্যাপলের উপর।

পরক্ষণে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল দুজন।

দরজার চৌকাঠে পড়েছে এবেলহার্ড, হাপরের মত হাঁপিয়ে চলেছে। তারই পাশে ডোরফ্রেমে পিঠ ঠেকিয়ে বসল রানা।

গোঙানোর মাঝে বুটের খাপ থেকে ওয়ারলক হান্টিং নাইফ। বের করল এবেলহার্ড।

দেরি করে হয়ে গেছে তোমার, চাপা স্বরে বলল রানা।

বিস্ময়ের ব্যাপার: ওর হাতে কোনও অস্ত্র নেই।

তার চেয়েও ভাল কিছু পেয়েছে।

ওর হাতে এখন ডেমিয়েন ডগলাসের রিমোট।

রবিন আর অ্যাটলকের হয়ে এটা দিলাম তোমাকে, রিমোটের বাটন টিপে দিল রানা।

ছাত থেকে সড়াৎ করে নামল ইস্পাতের ভারী দরজা। খটাৎ আওয়াজে নামল এবেলহার্ডের মাথার উপর। লোকটা ঝুঁকি খেয়ে পাথুরে মেঝেতে সটান হলো। দরজা চেপে বসেছে মাথার উপর। ফটাক! আওয়াজ তুলে ফেটে গেল লোকটার করোটি, নানাদিকে ছিটকে গেল ধূসর মগজ ও টকটকে লাল রক্ত।

কার্ট কে. এবেলহার্ড মারা যাওয়ায় ঘুরে চাইল রানা। ঝট করে তুলে নিল লোকটার ছোরা।

যার জন্য এসেছে, তাকে দেখল ডেস্কের পিছনে।

বাইরে ভয়ঙ্কর বাজ পড়ল। আকাশ চিরে দিল নীল বিদ্যুৎ। পিছনের জানালা দিয়ে ঝরঝর করে ভিতরে পড়ছে বৃষ্টি।

চুপ করে রানাকে দেখছে ডেমিয়েন ডগলাস, ডেস্কের আড়াল থেকে তুলল ডানহাত। ভয়ঙ্কর-দর্শন মাউযার পিস্তলটা দেখাল। ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের দুই চোখের মণি হাসছে। একটা পচা ডিমের মত, অন্যটা নীল।

ওই একইসময়ে ড্যাবলারকে বাগে পেল কুয়াশা। ঝট করে সরে গেল বামদিকে। ওর দেহের পাশ দিয়ে পিছনের কাঠের প্যানেলে বিধল ড্যাবলারের ছোরা। পরক্ষণে দুই হাতে লোকটাকে মাথার উপর তুলে নিল কুয়াশা। ভয়ঙ্করভাবে আছড়ে ফেলল। মেঝেতে পড়ে ঠাস্ আওয়াজ তুলল ড্যাবলারের মাথা। দু টুকরো হয়ে গেছে করোটি। মাত্র একবার ঝাঁকি দিয়েই স্থির হলো। প্রায় একইসময়ে ভেস্ট থেকে ব্লো টর্চ বের করেছে কুয়াশা, নীল আগুন জ্বেলে নিয়েই ওটা ছুঁড়ে দিল ডেমিয়েন। ডগলাসের উদ্দেশে।

চট করে ব্লো টর্চের গতিপথ থেকে সরে গেল বিলিয়োনেয়ার।

তোদের মাফ নেই, চাপা স্বরে বলল। পিস্তলের মাযল তাক করল রানার নাকে। ট্রিগারে চেপে বসছে তর্জনী।

গত কয়েকদিনের বেদম পরিশ্রমে ফুরিয়ে গেছে রানার শক্তি। ভেঙে আসছে শরীর। কিন্তু হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে এবেলহার্ডের ছোরাটা ছুঁড়ল ডেমিয়েনের বুক লক্ষ্য করে।

ছোরার পিছনে ঝড়ের গতিতে ছুটতে শুরু করেছে রানা। যে-কোনও সময়ে বুকে বা মাথায় বিধবে বুলেট।

ছুটবার ফাঁকে হঠাৎই থেমে গেল রানা। এইমাত্র ফুটো হয়ে গেছে লোকটার বুক ও গলা! পিস্তলের ট্রিগার টেপার সময়ও পায়নি বিলিয়োনেয়ার।

ডেমিয়েনের বুকে বিঁধেছে রানার ছোরা এবং কুয়াশার শুরিকেন দুটুকরো করে দিয়েছে তার পিস্তল ধরা হাত। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল ডেমিয়েন, বুঝল না এত ব্যথা কীসের। আরও এক পা পিছাল অজান্তে, তারপর উধাও হলো ভাঙা প্যানোরামিক উইণ্ডোর ওপাশে।

বিকট আর্তচিৎকার ভেসে এল নীচ থেকে।

দ্রুত পায়ে জানালার সামনে পৌঁছে গেল রানা। দুর্গ থেকে চার শ ফুট নীচে খলখল করছে আটলান্টিক মহাসাগর। ইতোমধ্যেই অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে ডেমিয়েন। সরু একটা তাকে নামল প্রথমে। ওখান থেকে মাথাটা ফাটিয়ে নিয়ে ছিটকে পড়ল নীচের সাগরে। মুহূর্তে ঢেউয়ের তলে টুপ করে ডুবে গেল ভাঙাচোরা মূর্তিটা।

জানালায় রানার পাশে এসে দাঁড়াল কুয়াশা। একটা কথাও বলল না ওরা। চেয়ে রইল নীচের সাগরের দিকে। এত উপর থেকে পড়লে কেউ বাঁচে না। ডেমিয়েন ডগলাসও নেই।

.

দশ মিনিট পর দিগন্তে মেঘের আড়াল থেকে মুখ তুলল সোনালি সূর্য। সেই আলোয় ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নে আসা-যাওয়ার পথে দেখা দিল একটা অ্যাস্টন মার্টিন গাড়ি। তুমুল গতি। স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে কুয়াশা। পাশেই রানা। পিছন সিটে নিশাত সুলতানা ও রঘুপতি। দুর্গের এয়ারফিল্ড লক্ষ্য করে চলেছে গাড়ি।

একপেশে সংক্ষিপ্ত লড়াই হলো এয়ারফিল্ডে। দুই পাইলটের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো ড্রাগন কর্পোরেশনের একটা হেলিকপ্টার। আরোহীদেরকে নিয়ে সূর্যের দিকে রওনা হয়ে গেল ওটা।

ষোলো

পরের এক সপ্তাহে দুনিয়া জুড়ে বেশকিছু অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা ঘটল।

ইটালির মিলানে অ্যারোস্টাডিয়া ইটালি এয়ারশোতে চুরি হলো। এক হ্যাঙার থেকে চুরি গেল একটা ফাইটার বিমান।

নামকরা ইউএস এক্স-১৬ রকেট বিমান ওই শো-তে দেখানো সম্ভব হয়নি। তার উপর এখন এ ধরনের চুরি! ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখল না জনসাধারণ।

সাক্ষ্য দিল কেউ কেউ, কালো ওই বিমান সরাসরি আকাশে উঠেছিল। দেখতে ছিল রাশান সুখোই এস-৩৭ অ্যাটাক ফাইটার বিমানের মতই। অবশ্য, কর্তৃপক্ষ জোর গলায় বলল, তাদের

শো-তে এ ধরনের কোনও বিমানই ছিল না।

অক্টোবরের ষোলো তারিখে আমেরিকার কয়েকজন জেনারেল ও অ্যাডমিরালকে গ্রেফতার করা হলো। উধাও হয়ে গেল কয়েকজন কর্নেল ও মেজর।

পরবর্তী তিন দিনে খুন হলো বেশ কয়েকটি বাউন্টি হান্টিং সংগঠনের বাছা বাছা কিছু লোক। লড়তে গিয়ে করুণভাবে মারা গেল ডেভিড এন. হেণ্ডিক ও তার ইউনিটের সবাই। গা ঢাকা দিল বাউন্টি হান্টার পোলিশ ও জাপানি ললনা মাসু হোকামা।

এদিকে দুনিয়ার সেরা বড়লোক পরিবারগুলোয় নেমে এল খুবই দুঃখজনক সব মৃত্যু।

দুর্ঘটনার কারণে নানাভাবে মরল বিত্তবান লোকগুলো।

দক্ষিণ আফ্রিকায় সাফারিতে গিয়ে উধাও হলো ফ্রান্সিস ওলিফ্যান্ট। তার গোটা প্রাইভেট হান্টিং পার্টির কেউ ফিরল না।

তারই চারদিন পর হার্ট অ্যাটাকে ঘুমের ভিতর মারা গেল গ্রিক শিপিং ম্যাগনেট ওয়েণ্ডেল রোচ।

অ্যাসপেন লজে উপপত্নীর বাড়িতে মৃত পাওয়া গেল র‍্যানডলফ কিলিয়ানকে।

কাউন্ট্রি ম্যানশনে খুন হলো ডিন ম্যাকেনকোর্ট।

নিউ ইয়র্কের হেডকোয়ার্টারের সামনে ফার্মাসিউটিক্যাল টাইকুনকে পিষে দিল এক ট্রাক। পরে আর ট্রাক বা ড্রাইভারের কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।

উত্তরাধিকারীরা তাদের সাম্রাজ্য বুঝে নিল। বরাবরের মতই চলতে থাকল পৃথিবী। কিন্তু ওসব দুর্ঘটনার কারণে গোপন একটা মেমো পাঠানো হলো ইউএসএ-র প্রেসিডেন্টের কাছে।

কাগজে শুধু লেখা ছিল:

স্যর, সব কাজ শেষ। ম্যাজেস্টিক-১২ এখন আর নেই।

.

চিরহরিৎ মায়াময় বাংলাদেশ।

রাজধানী ঢাকা থেকে সামান্য দূরে, আশুলিয়া।

অক্টোবরের তেইশ তারিখ। সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা। জঙ্গলমত জায়গায় সুন্দর একটি ছোট্ট বাড়ি ওটা। নিশাতের বাবার।

সামনের ফুলের বাগানে হরেক ফুল ফুটেছে, চারপাশ মৌ মৌ করছে মিষ্টি সুবাসে।

কাঠের চেয়ার নিয়ে বাগানে এসে বসেছে কয়েকজন। চলছে নানান গল্প।

বাগানের ডানদিকে কয়লার আগুনে চড়িয়ে দেয়া হয়েছে আস্ত খাসি, কাবাব তৈরি হচ্ছে। আরেক চুল্লিতে ঝলসাচ্ছে নানরুটি।

নিশাত সুলতানার বাবা আজকের বাবুর্চি, খুশিমনে নিজের কাজে ব্যস্ত।

অতিথিদের সঙ্গে রয়েছে এক সাদা চামড়ার যুবক।

তাকে খুলে বলা হয়েছে কীভাবে রানা, নিশাত, তিশা ও খবির জড়িয়ে গিয়েছিল বাউন্টি হান্টে। আর কীভাবেই বা ওদেরকে বারবার রক্ষা করেছে বৈজ্ঞানিক কুয়াশা।

সব শোনার পর নিজ কাহিনি সংক্ষেপে বলল শ্বেতাঙ্গ যুবক। তার নাম কেভিন কনলন।

একপর্যায়ে বলল, আমেরিকান সরকার: মৃত্যু-হুঁলিয়া তুলে নিয়েছে কুয়াশার মাথার ওপর থেকে। এখন ইচ্ছে করলেই ও দেশে যেতে পারবেন তিনি।

উনি তা চান, তাই ভাবছেন? হাসল নিশাত। নামের মতই কুয়াশায় ঢেকে রাখতে চান নিজেকে।

সবাই গল্প করছে, কিন্তু হঠাৎ করেই চেয়ার ছাড়ল রানা। তিশা, আমি একটু ঘুরে আসি।

আস্তে করে মাথা দোলাল তিশা। আগেই বলেছে, জীবনেও বাঁধতে চাইবে না রানাকে সংসারের জালে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয় তিশা বাংলাদেশ আর্মি থেকে ওকে ছুটি দেয়া হয়েছে।

নিশাত ও খবিরও ছুটি পেয়েছিল। কিন্তু আগামীকাল যোগ দিতে হবে অফিসে।

কোথায় যাবেন, স্যর? পিছন থেকে জানতে চাইল খবির। আগেও ন্যাওটা ছিল রানার, এখন আরও বেশি হয়েছে। আমি সঙ্গে আসব?

না, লাগবে না। একটু হেঁটে আসি। বাগান পেরিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল রানা। অস্পষ্ট, করুণ এক সুর শুনেই রওনা হয়েছে।

বিশগজ যাওয়ার পর ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। আস্তে আস্তে হাঁটছে। এ বুঝে গেছে, এই সাঁঝে কে বাজাচ্ছে সরোদে রহস্যময় মধুর। রাগ শিবরঞ্জনী।

মস্ত শিল্পী ওই মানুষ। অদ্ভুত কষ্ট বুকে। যেন হারিয়ে বসেছে প্রেয়সীকে। আর কখনও দেখা হবে না।

পনেরো গজ যাওয়ার পর জঙ্গলের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেল। রানা। সামনে হাওড়ের মত জলভূমি।

মাঝারি একটা লঞ্চ ভাসছে বিশ ফুট দূরে। কোনও আলো নেই ডেকে। আকাশ জুড়ে আঁধার নামছে। চারপাশ কেমন কুয়াশাময়। বড় মায়া নিয়ে বাজছে সরোদ। চুপ করে বেদনাময় সুর শুনছে রানা, কিছুক্ষণ পর বাতি জ্বলে উঠল লঞ্চের ডেকে।

সরসর আওয়াজ শুনল রানা।

স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মত কিছু ঘিরে ফেলছে ওই লঞ্চকে।

কুয়াশা? গলা চড়িয়ে ডাকল রানা। কেমন আছেন আপনি?

ভাল, তুমিও ভাল থেকো, জবাবে গমগম করে উঠল পুরুষ। কণ্ঠ। হয়তো আবারও দেখা হবে আমার বা তোমার কোনও বিপদে।

ডুবে যেতে লাগল লঞ্চ।

বিজ্ঞানীর অদ্ভুত জলযানের দিকে চুপ করে চেয়ে রইল। রানা।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে তলিয়ে গেল লঞ্চ।

ওখানে রইল শুধু কয়েকটা ঢেউ।

পানিতে তৈরি হলো স্রোত।

একটু পর অবাক করা লঞ্চের কোনও চিহ্নই রইল না।

তুমি সত্যি রহস্যময়, কুয়াশা, বিড়বিড় করল রানা। ঘুরে হাঁটতে লাগল নিশাতদের বাগানবাড়ি লক্ষ্য করে।

***   

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *