মাসুদ রানা ৪৩৪ – বাউণ্টি হাণ্টার্স (দ্বিতীয় খণ্ড) – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ২০১৪
রচনা: বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে
এক
যে সরু, সর্পিল, পাহাড়ি সড়ক জন্ম নিয়েছে ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন থেকে, তার নাম গ্ৰা খুয়ে দে লা মেখ–বা দ্য গ্রেট ওশান রোড। উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের ওই উপকূলীয় সড়কে প্রচণ্ড গতি তুলে ছুটে চলেছে পলায়নরত মাসুদ রানার র্যালি কার।
একের পর এক পাথুরে ক্লিফের মাথা ছুঁয়ে গেছে পথ। অনেক নীচে প্রকাণ্ড, সুনীল আটলান্টিক; দৃশ্যটা সত্যিই শ্বাসরুদ্ধকর। চুলের কাঁটার মত অসংখ্য বাঁক নিয়েছে রাস্তা, চট করে দেখা যায় না সামনে বা পিছনে কী আছে। দুপাশে কংক্রিটের নিচু গার্ড-ফেন্স, দুদিকে খাড়াভাবে নেমেছে চার শ ফুট পাহাড়। কোথাও কোথাও পাহাড়ের বুকে দীর্ঘ টানেল।
ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নের আশপাশের চোদ্দ মাইল এলাকার মালিক ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট ডেমিয়েন ডগলাস। এখন যে পথে ছুটছে রানা ও তিশার গাড়ি, তাও ডগলাসের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। প্রাইভেট রোড। তার দুজায়গায় মিশেছে দুই শাখা রাস্তা। একটা উঠেছে পাহাড় বেয়ে ডগলাসের ব্যক্তিগত এয়ারস্ট্রিপে। অন্যটা বারবার বাঁক নিয়ে নেমেছে বহু নীচের সাগর-তীরে। ওখানে ডগলাসের মস্ত বোটশেড।
এ মুহূর্তে অপূর্ব সুন্দর সাগর উপকূলীয় সড়কে ঘণ্টায় এক শ আশি কিলোমিটার বেগে ছুটছে রানার ইলেকট্রিক ব্ল ডাব্লিউআর-এক্স র্যালি কার। ইঞ্জিনের গর্জন বলতে সামান্য হুইসস আওয়াজ। এনগেজ করা হয়েছে টার্বো চার্জার। শক্তিশালী অল-হুঁইল-ড্রাইভ সিস্টেমের ফলে উপকূলীয় সড়কের তীক্ষ্ণ সব বাঁক পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি অনায়াসে।
কিন্তু পিছনে আসছে ড্রাগন কর্পোরেশনের একই গতির পাঁচ পাঁচটা সুপার কার। প্রথমে পোর্শ, এরপর ফেরারি, পিছনে তিন পিউজো।
আপনি কোথায়, কুয়াশা, থ্রোট-মাইকে বলল রানা। দুর্গ থেকে বেরিয়েছেন? …আমরা সমস্যার ভেতর আছি।
আসছি, বেশিক্ষণ লাগবে না, জবাবে শান্ত স্বরে জানিয়ে দিল কুয়াশা।
রানা বা তিশা জানে না, কিন্তু ওদের গাড়ির একমাইল পিছনে দুর্গ থেকে ছিটকে বেরিয়েছে আরেকটি গাড়ি–এইমাত্র বিদ্যুদ্বেগে ড্র-ব্রিজ পেরিয়ে এল ওটা।
ল্যামবোরঘিনি ডায়াবলো। ভি-১২। রিয়ার স্পয়লার। নিচু ছাত। অন্য গাড়ির চেয়ে গতি বেশি। কুচকুচে কালো।
স্যাটালাইট রেডিয়ো সিস্টেমে যোগাযোগ করল রানা, আপা! …শুনছেন?
তখনই নিশাতের সাড়া পাওয়া গেল। আমি কাছেই, স্যর!
আমরা এখন দুর্গে নেই, বলল রানা। চলেছি উত্তর দিকের রাস্তা ধরে।
ওখানে কী ঘটল, স্যর?
শুরুতে সবই ঠিক ছিল, কিন্তু একটু পর টের পেলাম উদয় হয়েছে একদল বাউন্টি হান্টার।
ওই দুর্গ উড়িয়ে দেননি কেন? জিজ্ঞেস করল নিশাত, কণ্ঠে কৌতুক।
খুশি হতেন? মৃদু হাসল রানা। সময় পেলাম কই, তা ছাড়া আমরা তো তখন ভেতরেই ছিলাম। …আপনারা কতটা দূরে?
প্রায় পৌঁছে গেছি, বলল নিশাত। সঙ্গে রঘুপতি। কালো শকুনে চেপে আসছি। খবির লণ্ডনে, বাউন্টি হান্টের বিষয়ে তথ্য জোগাড় করবে। …আধঘণ্টার ভেতর আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
তিরিশ মিনিট… বিড়বিড় করল রানা। আমরা কি অতক্ষণ টিকব?
শুনতে পেয়েছে নিশাত, বলল, যেভাবে হোক টিকে থাকুন, স্যর। অনেক কথা বলার আছে।
কম-বেশি পঁচিশটা শব্দে যা বলার বলুন, বলল রানা।
বাউন্টি হান্টের ব্যাপারে সবই জেনে গেছে আমেরিকান সরকার। প্রেসিডেন্ট আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আপনাকে জীবিত রাখার জন্যে যা লাগবে, তা-ই করতে চেয়েছেন। আপনি বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী হয়ে উঠেছেন, স্যর। দুনিয়ার যে কোনও আমেরিকান এম্বেসি বা কনসুলেটে গেলেই নিরাপত্তা পাবেন।
চুলের কাটার মত তীক্ষ্ণ বাঁক নিল রানার ডাব্লিউআরএক্স। সামনে বহু দূর দেখা গেল। উঠে এসেছে ওরা পাহাড়ের কাঁধে।
আঁকাবাঁকা, একের পর এক বাঁক নিয়ে সেই দিগন্ত পর্যন্ত গেছে উপকূলীয় সড়ক। কালো ফিতার মত। মাইলের পর মাইল পাহাড়ের কোলে-কাঁখে চড়ে বা মাথার উপর দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
ইউএস সরকার আমাকে বাঁচাতে চাইছে? মৃদু হাসল রানা, নিশ্চয়ই নিজ স্বার্থেই? ইউএস সরকার অন্য সবার মস্ত ক্ষতি করে দিয়ে নিজেদের ভালর দিকে সবসময় খেয়াল রাখে।
রানা… নিচু স্বরে বলল তিশা। সামনে দেখো।
তিশাকে দেখে নিয়ে পরক্ষণে দূরে চাইল রানা। বিড়বিড় করে বলল, মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ভাগ্যদেবী। ড্রাগন কর্পোরেশন। বোধহয় ওদের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ করেছে!
আধমাইল দূরে ওশান রোডে মিলেছে শাখা রাস্তা। ডানদিকের ওই পথ গেছে পাহাড়ের কাঁধে। ওদিকে রয়েছে। এয়ারস্ট্রিপ। এবং ওদিক থেকেই রওয়ানা হয়েছে দুটো প্রকাণ্ড সেমি-ট্রেইলার রিগ। অবশ্য পিছনে ট্রেইলার নেই। খাড়া ঢাল বেয়ে প্রচণ্ড গতি নিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজে নেমে আসছে রানা ও তিশার গাড়ির দিকে!
ওই দুই রিগের পিছন আকাশে ভাসছে ড্রাগন কর্পো: লেখা আধুনিক বেল জেট রেঞ্জার কপ্টার। এসেছে এয়ারফিল্ডের দিক থেকেই।
ড্রাগন কর্পোরেশনের কেউ রেডিয়ো করেছে, ভাবছে রানা। এয়ারফিল্ডে যা ছিল, সব পাঠিয়ে দিয়েছে ওদেরকে ঠেকাবার জন্য।
মুখোমুখি ধাক্কা দিতে চায় বোধহয়, বলল তিশা।
না, মাথা নাড়ল রানা। ওরা অ্যাক্সিডেন্ট চাইছে না। পথ ব্লক করবে।–এয়ারস্ট্রিপ ও গ্রেট ওশান রোডের সঙ্গমে পৌঁছে গেছে দুই ট্রাক। গতি কমিয়ে বাঁক নিল, থেমে গেল স্কিড করে। গোটা পথ জুড়ে ব্লকেড তৈরি করেছে।
এখন আর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
আপা, রেডিয়ো করল রানা, আলাপের সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি পারেন পৌঁছে যান।
পাহাড়ি, আঁকাবাঁকা পথে ছুটছে ডাব্লিউআরএক্স, ক্রমেই কাছে চলে আসছে সেমি-ট্রেইলার রিগদুটো।
কিন্তু রোড ব্লকেডের দুই শ গজ দূরে ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজে ব্রেক কষল রানা। রাস্তার মাঝে থেমে গেল ডাব্লিউআরএক্স।
মুখোমুখি হয়েছে দুই পক্ষ। দুটো রিগ। একটি র্যালি কার। চট করে রিয়ার ভিউ মিররে পিছনদিক দেখল রানা। তুমুল গতি তুলে আসছে পাঁচ সুপার কার।
ওগুলোর পিছনে যেন এদিকে ঝুঁকে এসেছে কালো, গম্ভীর, প্রকাণ্ড পাথুরে দুর্গ। হঠাৎ করেই ওই দুর্গের উঠান থেকে লাফিয়ে আকাশে উঠল দুটো হেলিকপ্টার। চেজ শুরু করল তারাও। পেরোনভের দুই এমআই-৩৪ চপার।
বিপদেই পড়া গেল! বলল তিশা।
জবাবে কিছুই বলল না রানা, ওর চোখ চলে গেল সামনের রাস্তার উপর।
দুই শ গজ দূরে দুই রিগ, ওগুলোর মাথার উপর ড্রাগন কর্পোরেশন লেখা কপ্টার। বামদিকে পাথুরে জমিন নেমেছে চার শ ফুট নীচে। রাস্তা থেকে পড়ে যাওয়া ঠেকাতে রয়েছে বড় জোর দুই ফুট উঁচু এক কংক্রিট দেয়াল।
ওই দেয়াল, ভাবল রানা।
পিছনের গাড়ি প্রায় পৌঁছে গেছে, চাপা স্বরে বলল তিশা।
আসুক, রানার চোখ কংক্রিটের গার্ড রেইল ফেন্সের উপর। দেয়ালের ওপাশে ঝুলছে ড্রাগন কর্পোরেশনের হেলিকপ্টার। ওটা আছে রাস্তা সমতলে।
কাজটা সম্ভব, বিড়বিড় করল রানা, সরু হয়ে গেছে দুই চোখ।
কী সম্ভব? রানার দিকে ঘুরে চাইল তিশা।
এখনই দেখবে।
অ্যাক্সেলারেটার পেডাল টিপে ধরল রানা। দুই রিগের দিকে ছিটকে রওনা হলো ডাব্লিউআরএক্স র্যালি গাড়ি।
কয়েক সেকেণ্ডে তুমুল গতি তুলল। টার্বো-চার্জার থেকে প্রচণ্ড শক্তি পাচ্ছে চার চাকা। সস্স্স্স্স্! আওয়াজ তুলছে। ইঞ্জিন।
প্রতি ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটার… আশি… এক শ.. এক শ বিশ… রাস্তার মাঝের দুই বাধার দিকে ছুটছে ডাব্লিউআরএক্স।
ড্রাগন কর্পোরেশনের দুই রিগের ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে দেখছে, উন্মাদটা করে কী!
পরের সেকেণ্ডে হঠাৎ করেই বামে সরল রানার গাড়ি, চলে গেল কংক্রিটের গার্ড-রেইল ফেন্সের পাশে।
ক্রিচ-ক্রিচ-ক্রিচ-ক্রিচ! আওয়াজে কংক্রিটের গায়ে ঘষা খেল গাড়ি।
বামপাশের দুই চাকা ঘেষ্টে চলেছে কংক্রিটের ব্যারিয়ারে। পরক্ষণে ধুপ আওয়াজে কংক্রিটের উপর চেপে বসল দুই চাকা।
অ্যাসফল্ট ছেড়েছে গাড়ির বামদিক। দেয়ালের উপর দিয়ে ছুটছে দুই চাকা। কাত হয়ে গেছে গাড়ি পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি।
বাঁকা হয়ে সামনের দিক দেখছে রানা ও তিশা।
যথেষ্ট জায়গা কিন্তু নেই, রানা, চেঁচিয়ে উঠল তিশা। আঙুল তুলে দেখাল দেয়ালের খুব কাছে রিগ।
ঠিকই বলেছে তিশা।
আমার কাজ শেষ হয়নি, পাল্টা বলল রানা।
ঝটকা দিয়ে ডানদিকে ঘোরালো স্টিয়ারিং হুইল। ফলাফল হলো তাৎক্ষণিক।
হোঁচট খেল ডাব্লিউআরএক্স, সামনের টায়ার ডানদিকে সরতে শুরু করেছে। ফলে গাড়ির পিছন অংশ সরছে বামে দেয়ালের ওপাশে বেরিয়ে গেল পিছন দিক–অনেক নীচে সাগর ও পাথুরে সৈকত…
কংক্রিটের গার্ড-রেইলের উপর দিয়ে জোরালো ছ্যার-ছ্যার ছ্যার আওয়াজে সরছে গাড়ি। পিছনের দুই চাকা ঝুলছে সাগরের চার শ ফুট উপরে।
গতি প্রচণ্ড, পিছলে চলেছে গাড়ি গার্ড রেইল ফেন্সের উপর ভর করে। সামনের দুই চাকা দেয়ালের এপাশে, পিছনের দুই চাকা সাগরের দিকে। চার চাকার একটাও স্পর্শ করছে না রাস্তা।
দুই হাতে চোখ ঢাকল তিশা।
দেয়ালে আড়াআড়িভাবে পেট রেখে ছুটছে ডাব্লিউআরএক্স। জোরালো খসখস-খস! আওয়াজ তুলছে নীচের অংশ। নানাদিকে ছিটকাচ্ছে লাল-হলুদ আগুনের ফুলকি।
দুই রিগের ড্রাইভার হতবাক হয়ে দেখল, ওদেরকে পাশ কাটাতে শুরু করেছে পাগল লোকটা!
ওদিকে সামান্য জায়গা, বেরুতে পারবে না কোনও গাড়ি।
অথচ অকল্পনীয় দৃশ্য দেখল তারা।
সাগরের দিকে নামছে গাড়ির পিছনের দুই চাকা।
পড়ে যাচ্ছি, রানা! আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল তিশা।
না, চাপা স্বরে বলল রানা।
ঠিকই বলেছে ও।
তখনই গাড়ির পিছনদিক দড়াম করে লাগল ড্রাগন। কর্পোরেশনের কপ্টারের নাকে।
নিচু দেয়ালের পাশেই ঝুলছিল যান্ত্রিক ফড়িং। ওটার নাকে বেদম গুঁতো দিয়ে আবারও রাস্তায় ফিরল ডাব্লিউআরএক্স। কুচকুচে কালো অ্যাসফল্টের সমতল জমিতে ধুপ করে নামল চার চাকা।
আগেই পিছনে পড়েছে দুই ট্রাক, সামনের রাস্তা ফাঁকা।
পরের কয়েক সেকেণ্ডে এক শ কিলোমিটার গতি পেল র্যালি কার।
পিছনে বাঁক নিচ্ছে দুই ট্রেইলার, শত্রুকে অনুসরণ করবে।
এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র মার্সেনারিরা ডেমিয়েন ডগলাসের কাছ থেকে ধার নিয়েছে দুই ইউরোপিয়ান স্পোর্টস কার–লাল ফেরারি ও রুপালি পোর্শ, দুটোরই বিদ্যুদ্গতি।
দুই ট্রেইলারের মাঝ দিয়ে সাঁই করে বুলেটের মত বেরিয়ে এল ফেরারি ও পোর্শ। কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল রানা ও তিশার ঘাড়ের কাছে।
পোর্শের দুই মার্সেনারি কাজে লাগাল ওপেন-এয়ার টারগা ছাতের সুবিধা, একজন উঠে দাঁড়িয়েছে অস্ত্র হাতে, পরক্ষণে গুলিবর্ষণ শুরু করল রানার গাড়ির উপর।
ওদিকে ফেরারির প্যাসেঞ্জার উইণ্ডো দিয়ে কোমর বের করেছে আরেক গানম্যান, সে-ও গুলি করছে রানাদের উদ্দেশে।
একরাশ গুলির আঘাতে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল রানাদের গাড়ির পিছনের কাঁচ। চট করে পিছনে চাইল রানা।
একটা কথা বলবে, রানা? প্রশ্ন করল তিশা।
নিশ্চয়ই–সেটা কী?
কোথায় শিখেছ এই ড্রাইভিং? বিশেষ কোনও স্কুলে?
আমার আপন চাচার কাছে প্রথম সবক নিয়েছিলাম। কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে চাইল রানা। উনি যৌবনে অফেন্সিভ ড্রাইভিং স্কুল নামে একটা প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন ব্রিটেনে। একেবারেই চলেনি স্কুল। কিছুদিন হলিউডের স্টান্ট ড্রাইভারও ছিলেন। কিশোর বয়সে আমাকে শেখান গাড়ি চালনার নানা কৌশল।
জোরালো টাশ-টাশ-টাশ-টাশ! আওয়াজ শুরু হয়েছে।
রাস্তার বিটুমেন চিবিয়ে তুলছে একসারি বুলেট, এসে লাগছে ড্রাইভিং দরজার পাশে। পরের সেকেণ্ডে মাথার উপর দিয়ে গেল দ্রুতগতি এমআই-৩৪ কপ্টার।
ওটাতে করে এসেছে কোবরা বাউন্টি হান্টাররা।
দু সেকেণ্ড পর ক্লিফের পাশ দিয়ে ডানে বাঁক নিল রাস্তা। পিছু নিয়েছে কপ্টার, ওটার বুলেট বর্ষণ এড়াতে আরেকদিকে সরে গেল রানা।
তখনই বিকট আওয়াজ শুনল।
রাস্তার ডানদিকে লাফিয়ে উঠেছে ক্লিফের পাথুরে দেয়াল। নানাদিকে ছিটকে গেল ছোট-বড় পাথর ও কাঁকড়। এক সেকেণ্ড আগে ওই জায়গা পেরিয়ে এসেছে রানার র্যালি কার।
চট করে ওদিকে চাইল রানা, পরক্ষণে খুঁজতে চাইল ওই প্রবল বিস্ফোরণের উৎস।
এবার দেখতে পেল। আশ্চর্য! বিড়বিড় করল।
উপকূলের দিকে আসছে এক রণতরী। সরে এসেছে দিগন্তের কাছে জড় হওয়া নেভাল ভেসেলগুলো থেকে।
ওই রণতরী ফ্রান্সের তুরভিল-ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। নাকের কাছে শক্তিশালী ৩.৯ ইঞ্চির কামান। প্রতিটা গোলা উগরে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভলকে উঠছে কামানের মুখ থেকে ধূসর ধোঁয়া। কয়েক সেকেণ্ড পর পর থরথর করে বুক কাঁপিয়ে দেয়া বিকট বুম! বুম! বুম! আওয়াজ আসছে।
মাত্র এক সেকেণ্ড পর ভয়ঙ্কর আওয়াজ আবারও শুনল রানা।
বুম!
বুম!
বুম!
পাশের ক্লিফে এবং রাস্তার উপর নামছে একের পর এক শেল। ঝরঝর করে গাড়ির উপর পড়ছে ছোট পাথর ও কাকর। তীরগতি তুলে ছুটছে রানা। লাফিয়ে আকাশে উঠল সামনের অ্যাসফল্ট ও কাকর। ওই জায়গায় দেখা গেল গভীর গর্ত। গোলা বর্ষণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে পথের অর্ধেক।
রাস্তায় গোলা নামতেই তৈরি হয়েছে মস্ত গর্ত। তীব্রগতি গাড়ি সরিয়ে নিয়ে সামনের বিপদ এড়িয়ে গেল রানা। আকাশ থেকে ঝরঝর করে পড়ছে নুড়ি পাথর, ধুলো ও কাকর। তারই ভিতর দিয়ে ওপাশে ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়ি। চট করে একবার পিছনে চাইল রানা। রাস্তায় তৈরি হয়েছে প্রায় গোলাকার গর্ত। অনেক নীচের সাগরের দিকে নেমেছে। একপাশ।
গ্রেট ওশান রোডের ডানে ও বায়ে নামছে একের পর এক শেল। আঁকাবাঁকা পথে এগুতে শুরু করেছে রানা। সামনে জন্ম নিচ্ছে মস্ত সব গর্ত, আর সেগুলোর কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওর গাড়ি।
রানার পিছনের আকাশে ঝুলছে ড্রাগন কর্পোরেশনের কপ্টার। ওটাও ডেস্ট্রয়ারের গোলা এড়াতে ব্যস্ত।
কিন্তু কোবরা কমাণ্ডোদের দুই এমআই-৩৪ কপ্টার কোনও কিছুকেই পাত্তা দিচ্ছে না। রানার পিছু নেয়া বন্ধ না করে ব্যবহার করছে পাশের কামান। একের পর এক গোলা পড়ছে। রাস্তার বুকে।
ঠিক তখনই আরেকটি বাঁক পেরোল রানা। সামনে পড়ল পাহাড়ের বুকে টানেল। দেরি না করে উচ্চতা বাড়াতে লাগল। দুই রাশান কপ্টার, পেরিয়ে গেল পাহাড়। ওগুলোকে আর দেখা গেল না।
টানেলে ঢুকেই রানা ও তিশা টের পেল, হঠাৎ করেই নেমেছে নীরবতা।
কিন্তু তা কয়েক মুহূর্তের জন্য।
ওদের পিছনে পৌঁছে গেছে ড্রাগন কর্পোরেশনের দুই স্পোর্টস্ কার–ফেরারি ও পোর্শ–বিকট গর্জন ছাড়ছে দুই ইঞ্জিন। দুই গাড়ির গানাররা গুলি করছে ওদের গাড়ি লক্ষ্য করে।
টানেলের বামে সাগরের দিকে সরে গেল রানা। তখনই টের পেল, এটা আসলে টানেল নয়। বামদিকে পাথরের দেয়ালের মাঝে ফাঁকা সব জায়গা। সামান্য দূরে দূরে সরু কিছু কলাম ধরে রেখেছে দেয়ালকে। ঝড়ের গতিতে কলামগুলো পিছনে পড়ছে। ড্রাইভিং সিট থেকে ঝাপসা দেখা গেল ওদিকে অনেক নীচে সাগর।
তথ্যটা মাত্র মগজে ঢুকেছে রানার, এমন সময় দেখল দ্রুতগতি কলামগুলোর ওদিকে হাজির হয়েছে কোবরা কমাণ্ডোদের কপ্টার। খোলা টানেলের ভিতর গুলি করছে।
রাস্তার বিটুমেন খুবলে তুলছে বুলেট, খটাখট বিধছে রানার গাড়ির গায়ে, লাগছে গিয়ে টানেলের ওদিকের দেয়ালে।
দেরি না করে সরতে লাগল রানা, গাড়ি চলে গেল। ডানদিকের দেয়ালের পাশে। কমে গেছে গতি।
তখনই এল পিছনের দুই স্পোর্টস্ কার। পিছন থেকে বেদম গুঁতো দিল পোর্শ। বাম থেকে চেপে আসতে চাইল ফেরারি। খুশি মনে গুলি করছে দুই গাড়ির দুই কমাণ্ডো।
ডাব্লিউআরএক্সের ভিতর ভ্রমরের আওয়াজ তুলল একরাশ গুলি। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল রানার পাশের কাঁচ।
এবং টানেলের শেষে দেখা দিল ভয়ঙ্কর এক আকৃতি। রাস্তা থেকে সামান্য উপরে ভাসছে কোবরা ইউনিটের দ্বিতীয়। এমআই-৩৪ কপ্টার। পুরো তৈরি, বাগিয়ে রেখেছে পাশের মিসাইল পড। এবার আসবে মৃত্যুবাহী মিসাইল!
হতাশ ভঙ্গিতে সিটে হেলান দিল তিশা। কোনও আশার বাণী শোনাতে পারল না রানা। কপ্টারের মিসাইল পড়গুলো থেকে হঠাৎ করেই ছিটকে বেরোল, মিসাইল। পিছনে ছিটিয়ে দিল হলদে আগুন। কিন্তু তখনই বিস্ফোরিত হলো ওই কপ্টার। ফরাসিদের ডেস্ট্রয়ার থেকে এসে পড়েছে শেল। ওই একই সময়ে বিস্ফোরিত হলো এমআই-৩৪-এর মিসাইল। পড় থেকে মাত্র বেরুতে শুরু করেছিল।
ভয়ঙ্কর শক্তিশালী নেভাল শেল উড়িয়ে দিয়েছে কোবরা কপ্টার, ছিটকে চলে গেল ওটা রাস্তার আরেক পাশে। ওখানেই থামল, পরক্ষণে অ্যালিউমিনিয়ামের ক্যানের মত খসে পড়ল সরাসরি চার শ ফুট নীচে। জেনেশুনে টার্গেট করা হয়নি কপ্টারকে, বুঝে গেছে রানা। ওটা চলে এসেছিল আসলে গোলার গতিপথের উপর।
যাক, একটা গেল… স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল তিশা।
একবার ওকে দেখে নিয়ে ড্রাইভিঙে মনোযোগ দিল রানা। টানেল থেকে ছিটকে বেরোল ডাব্লিউআরএক্স, ঝড়ের গতিতে পেরিয়ে গেল এমআই-৩৪ কপ্টারের পতনের জায়গাটা। এখনও ওকে কোণঠাসা করে রেখেছে ড্রাগন কর্পোরেশনের দুই গাড়ি।
পাথুরে দেয়ালের পাশ দিয়ে তুমুল গতি তুলে ছুটছে রানা।
দেখতে না দেখতে কয়েক শ ফুট পেরিয়ে গেল তিন গাড়ি, তারপর রানা, দেখল সামনে হাঁ করা আরেকটা টানেল। ওটা আছে বড়জোর দুই শ গজ দূরে।
দড়াম!
রানার গাড়ির বামপাশে চেপে এল ফেরারি, পাথুরে দেয়ালের দিকে ঠেলছে।
দুই হাতে খপ করে স্টিয়ারিং ধরল রানা। পিছন থেকে গুতো দিচ্ছে পোর্শ। রানা প্রথমে বুঝল না কী কারণে ওকে ঠেলছে এরা। পরক্ষণে টের পেল।
টানেলের আর্চওয়ের ডানদিকে রয়েছে পাথুরে দেয়াল।
ওদিকে ঠেলছে ফেরারি ও পোর্শের খুনিগুলো। রানা যে গতিতে ছুটছে, সোজা গিয়ে বিধ্বস্ত হবে আর্চওয়ের পাশে।
হিসাব কষে ফেলল রানা। হাতে আছে বড়জোর পাঁচ সেকেণ্ড!
এবার? রানা? ভয় পেয়েছে তিশা।
দেখো না! ড্রাইভিঙের ফাঁকে বলল রানা।
আর চার সেকেণ্ড… সরু রাস্তা ধরে ছুটছে তিন রেসিং কার। তিন সেকেণ্ড… ডানদিকের পাথুরে দেয়ালের দিকে ঠেলছে ফেরারি।
জেদি, একগুঁয়ে বাচ্চার মত জায়গা ছাড়তে চাইছে না রানা। শক্ত হাতে ধরে আছে স্টিয়ারিং হুইল।
আর্চওয়ের একটু আগে পৌঁছেই প্রবল ঘষা খেয়ে উপরে উঠল ডাব্লিউআরএক্সের ডানদিকের দুই চাকা।
পিছন থেকে ভয়ঙ্কর গুতো দিল পোর্শে।
এবার? আশা ছেড়ে দিয়েছে তিশা।
আর এক সেকেণ্ড, তারপর…
যেন উল্টো ওদের দিকে বিদ্যুদ্বেগে আসছে আর্চওয়ে।
ঠিক আছে, এইবার! নিচু স্বরে বলল রানা।
তখনই কাজে নামল।
এবার আর্চওয়ের মুখে বিধ্বস্ত হবে গাড়ি। কিন্তু ফেরারিকে ডানদিকের দেয়ালে ওকে চাপিয়ে দেয়ার সুযোগ করে দিল রানা।
পরক্ষণে দেয়ালে ষাট ডিগ্রি কাত হলো ডাব্লিউআরএক্স, দেয়াল বেয়ে উঠছে ডানদিকের দুই চাকা।
সময় যেন ধীর হয়ে গেল। তখনই অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় ঘটনাটা ঘটল…
আর্চওয়ের পাঁচ গজ আগে ছিটকে দেয়ালে উঠেছে রানার ইলেকট্রিক ব্লু র্যালি কার….
পর সেকেণ্ডে শূন্যে গড়ান দিল ওটা…
ছাত নীচে, মেঝে আকাশে। পাশেই ছুটছে নিচু ছাতের ফেরারি। ওটার উপর নামল রানার গাড়ি।
মুহূর্তের জন্য ফেরারির পিঠে পিঠ রেখে স্থির থাকল ডাব্লিউআরএক্স। আকাশের দিকে তাক করেছে ঘুরন্ত চাকা।
পরক্ষণে গড়ান দিয়ে নিরাপদে ধপ করে নামল টানেলে। চলে এসেছে সাগরের দিকে। লাল রঙের সুপার কারের পাশেই ছিটকে বেরোল টানেল থেকে। এখন ডানদিকে ফেরারি।
কিন্তু পোর্শের ড্রাইভার বা গানম্যানের কপাল মন্দ।
রানার লেজেই ছিল ওরা, ভেবেছিল একেবারে শেষসময়ে সরে যাবে। কিন্তু পোর্শের ডাইভার ভাবতেও পারেনি রানার গাড়ি শূন্যে পাক খেয়ে আবারও রাস্তায় নামবে সিধে হয়ে। মাত্র এক সেকেণ্ড ওদিকে চেয়েছে সে, কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
আর্চওয়ের দেয়ালে ভয়ঙ্কর গতি নিয়ে আছড়ে পড়েছে। পোর্শ। ফলে তৈরি হয়েছে মস্ত আগুনের গোলা।
কপাল নিয়ে এসেছে ফেরারির ড্রাইভার ও গানম্যান। কিন্তু ফুরিয়ে গেল ওই সামান্য ভাগ্য।
এখন বামদিকে রানা, উল্টো ডানদিকের দেয়ালের দিকে ঠেলছে ফেরারিকে।
পাশের গাড়ির ডাইভারের চেয়ে ঢের দক্ষ ও। গুতো দিল ফেরারির সামনের দিকে। ফলে হঠাৎ করেই তীক্ষ্ণ বাঁক নিল ওটা, প্রচণ্ড বেগে লাগল টানেলের ডান দেয়ালে। বিধ্বস্ত হয়েই উল্টে ছিটকে পড়ল খেলনার মত। থামল না, স্থির হলো গিয়ে বামদিকের দেয়ালে লেগে। ভোতা ধুপ আওয়াজ তুলে স্থির হলো পিঠের উপর ভর করে। তার আগেই লাশ হয়ে গেছে যাত্রীরা।
টানেল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল রানা ও তিশার গাড়ি, আর তখনই পাশে পৌঁছে গেল কোবরা বাউন্টি হান্টারদের এমআই-৩৪।
প্রচণ্ড গতি তুলে পাহাড়ের কাঁধে ছুটছে গাড়ি, পাশেই কপ্টার। ডানদিকের ডোরওয়ে খুলে যেতেই দেখা গেল এক স্নাইপারকে। এক ঝাঁক গুলি ছুঁড়ল সে।
টের পেল রানা, যতই দ্রুত চলুক গাড়ি, ওই সামরিক কপ্টার দ্বিগুণ গতি তুলতে পারবে। পাশে থাকছে অনায়াসে।
তিশা! তাড়া দেয়ার সুরে বলল রানা, ওই কপ্টার সরাতে হবে! স্নাইপারকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করো!
খুশি মনে! বলল তিশা, গতি কমাও!
অ্যাক্সেলারেটারের উপর চাপ সরতেই গতি কমল, ডাব্লিউআরএক্সের, আর সেই সুযোগে বাইরের দিকে ডেযার্ট ঈগল পিস্তল তাক করল তিশা।
পর পর দুটো গুলি ছুঁড়ল ও। দুটোই লক্ষ্যভেদ করেছে।
কপ্টারের দরজায় হোঁচট খেয়ে নীচে পড়তে লাগল স্নাইপার।
কিন্তু কোমরে পুরু নাইলনের দড়ি। চল্লিশ ফুট পড়বার পর ঝটকা খেয়ে থামল লাশ।
দুর্দান্ত লক্ষ্যভেদ, প্রশংসা করল রানা।
পাল্টা চেঁচিয়ে উঠল তিশা, রানা! সামনে দেখো! আরেকটা শাখা রাস্তা! সত্যিই, দুভাগে ভাগ হয়েছে সামনের পথ। একটা গেছে। নীচের দিকে। ডানদিকেরটা মূল গ্রেট ওশান রোড।
বামে যাব, না ডানে, ভাবল রানা। সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হলো ওর জন্য।
ডানদিকের রাস্তার উপর বিস্ফোরিত হয়েছে ডেস্ট্রয়ারের গোলা।
বামে যাওয়াই উচিত।
ক্রিঁচ-ক্রিঁচ আওয়াজ তুলে বাঁক নিল রানার ডাব্লিউআরএক্স। আপত্তি তুলছে চাকাগুলো। রওনা হয়ে গেল ওরা নীচের দিকে। যাওয়া রাস্তা ধরে।
পিছু নিল এমআই-৩৪
দুই
রানা ও তিশার গাড়ির কয়েক শ গজ পিছনে গ্রেট ওশান রোডে তুমুল গতি তুলে ছুটছে কুয়াশার কুচকুচে কালো ল্যামবোরঘিনি ডায়ালো।
রানার গাড়ি ঠেকাতে যে ব্লকেড তৈরি করেছিল দুই সেমি ট্রেইলার, সে-দুটো এখন সামনে। আরও দূরে দুর্গ থেকে ছিনতাই করা ড্রাগন কর্পোরেশনের অন্য তিন পিউজো র্যালি কার।
খুব দ্রুত কমে আসছে দূরত্ব। পিউজো র্যালি কারগুলোর পঞ্চাশ গজ সামনে রাস্তার বাঁকে পৌঁছে গেছে রানার নীল ডাব্লিউআরএক্স।
কিন্তু ওটার উপর হামলে পড়েছে অবশিষ্ট কোবরা এমআই ৩৪ কপ্টার।
বামে সাগরের দিকে চাইল কুয়াশা, তেড়ে আসছে ডেস্ট্রয়ার। মুহূর্তের জন্য দেখা গেল পাখির মত দুই আকৃতি, সোজা আসছে উপকূলীয় রোড লক্ষ্য করে।
চট করে বুঝে গেল কুয়াশা, ওই দুই ফাইটার জেট এসেছে দিগন্তের কাছে বসে থাকা ফ্রেঞ্চ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে।
সর্বনাশ, বিড়বিড় করল কুয়াশা। গোটা ফ্রেঞ্চ সরকারকে যেন কিনে নিয়েছে ওই ডেমিয়েন লোকটা!
আবারও ঘুরে চাইল সামনে। মোড়ের বামদিকের রাস্তা ধরে নেমে চলেছে রানার গাড়ি, পাহাড়ের কোলে হারিয়ে গেল।
তখনই রানার শত্রুদেরকে অদ্ভুত একটি কাজ করতে দেখল কুয়াশা।
দুভাগে ভাগ হয়ে গেল তারা।
শাখা রাস্তায় রানার পিছু নিল ড্রাগন কর্পোরেশনের একটিমাত্র পিউজো। অন্যদুটো বিস্ফোরণে তৈরি মস্ত এক গর্ত পাশ কাটিয়ে চলে গেল ডানদিকের রাস্তা ধরে।
কয়েক মুহূর্ত পর মোড়ে পৌঁছে গেল দুই ট্রেইলার, ওগুলোও বাঁক নিল বামদিকে। পাহাড় বেয়ে নামছে ঝড়ের গতিতে। হিসাব কষেই এ কাজ করা হয়েছে, ভাবল কুয়াশা।
কোনও পরিকল্পনা আছে তাদের।
কুয়াশা নিজেও পৌঁছে গেল মোড়ে, এবং দ্বিধা না করেই রওনা হয়ে গেল বামের রাস্তায়।
প্রচণ্ড গতি তুলছে ল্যামবোরঘিনি ডায়াবলো।
.
নীচের বোটহাউসের দিকে সস্স্স্ আওয়াজ তুলে ছুটছে রানা ও তিশার ডাব্লিউআরএক্স গাড়ি। ঝড়ের বেগে পেরিয়ে যাচ্ছে অন্ধ সব তীক্ষ্ণ বাঁক।
গতি আরও তুলছে রানা, এমনসময় পিছন থেকে এল বৃষ্টির ফোঁটার মত অসংখ্য বুলেট। খটাখট লাগছে গাড়ির পিছনে ও আশপাশের পাথরের দেয়ালে। এসব গুলি আসছে উড়ে আসা এমআই-৩৪ কপ্টার থেকে। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে সাইড মাউন্টেড মেশিনগানদুটো।
এখনও শিথিলভাবে ঝুলছে কপ্টারের মৃত স্নাইপার, একবার এদিক আবার ওদিক সরছে লাশ। কখনও কখনও ধুপ করে নামছে রাস্তার উপর। রক্তের দাগ রয়ে যাচ্ছে কালো অ্যাসফন্টে।
পিছন থেকে গুলি করছে হলদে পিউজোর প্যাসেঞ্জার। জানালা দিয়ে কোমর বের করে দিয়েছে, হাতে টায়ার।
.
সামনে গুলি চলছে, এবং মাত্র দু শ গজ পিছনে পৌঁছে গেছে। কুয়াশা- তুমুল গতি তুলছে ল্যামবোরঘিনি ডায়াবলো।
এসএর মত বাঁকে সহজেই দুই সেমি-ট্রেইলারকে পাশ কাটাল কুয়াশা। দুই ড্রাইভার দেখল, ল্যামবোরঘিনির পিছনে পড়েছে ওরা।
পরের মুহূর্তে হলদে পিউজোর পিছনে পৌঁছল কুয়াশা। ডানদিক দিয়ে পাশ কাটাতে চাইল। কিন্তু এঁকেবেঁকে এগুতে শুরু করেছে পিউজো, পথ ছাড়বে না। বামপাশ দিয়ে বেরোতে চাইল কুয়াশা, মেঝের সঙ্গে টিপে ধরল অ্যাক্সেলারেটার। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়েছে। অনেক নীচে সাগর। রাস্তার ওদিকে সরেই বিদ্যুদ্বেগে ওভারটেক করল পিউজোকে।
ডাইভার শুধু দেখল, বামপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল কালো এক রকেট–আর তখনই ড্রাইভারের জানালা দিয়ে ভিতরে পড়ল এম-৬৭ গ্রেনেড। ঠক-ঠক আওয়াজ তুলে মেঝের উপর স্থির হলো বোমা।
এইমাত্র তীরের মত ছিটকে চলে গেছে ল্যামবোরঘিনি, আর পরের সেকেণ্ডে বিস্ফোরিত হলো হলদে পিউজো। চারপাশে ছিটিয়ে গেল লাল-হলুদ আগুন। সামনের বাঁকে পৌঁছে গেল জ্বলন্ত পিউজো, গার্ড রেইল ফেন্স ভেঙে ছিটকে পড়ল অনেক নীচের সাগরে।
রানার ডাব্লিউআরএক্সের বিশগজ পিছনে পৌঁছেছে কুয়াশা। মাথার উপর ভাসছে এমআই-৩৪ কপ্টার।
রানার সামনে দীর্ঘ রাস্তা, শেষমাথায় অন্ধকার টানেল। ওটার মাধ্যমে পৌঁছুবে প্রকাণ্ড বোটশেডে।
রানা, রেডিয়ো করল কুয়াশা। পিছনে গুলি কোরো না। আমি ল্যামবোরঘিনির ভিতর!
কালো ল্যামবোরঘিনি? অবাক হইনি, বলল রানা। খুশি হলাম পৌঁছে গেছেন। কিছু ভেবেছেন হেলিকপ্টারের ব্যাপারে?
চারপাশ দেখতে শুরু করেছে কুয়াশা।
রানা ডাব্লিউআরএক্স নিয়ে সামনে, দ্রুত আসছে টানেল। গাড়ির উপর আকাশে ছুটছে এমআই-৩৪ কপ্টার। মৃত স্নাইপার ঝুলছে দড়ি থেকে। মাঝে মাঝে ধুপধাপ পড়ছে অ্যাসফল্ট রাস্তার উপর। ওই লাশ ডায়াবলোর ঠিক সামনে।
কপ্টার… স্নাইপার… টানেল… ভাবতে শুরু করেছে কুয়াশা। এখন শুধু দরকার এস্কেপ ভেহিকেল।
রিয়ার ভিউ মিররে চাইল কুয়াশা। চোখ পড়ল ট্রাকের গ্রিলের উপর। ওটা ম্যাক রিগ লম্বা নাক ঘড়ঘড় আওয়াজ
তুলে নেমে আসছে পিছনের রাস্তায়।
অনেক ধন্যবাদ, মনে মনে বলল কুয়াশা। কপ্টার নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার, রানা, জানিয়ে দিল।
ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ল ল্যামবোরঘিনি, পৌঁছে গেল এমআই-৩৪ কপ্টারের পেটের নীচে। এখন আর ওকে দেখতে পাবে না যান্ত্রিক ফড়িং থেকে। ধুপ আওয়াজ তুলে ঝুলন্ত স্নাইপারের লাশে গুঁতো দিল ল্যামবোরঘিনি। জোর ধাক্কা খেয়ে বনেটের উপর উঠে এল লাশ। পরের মুহূর্তে এসে ঢুকল ডায়াবলোর খোলা টারগা ছাতের কারণে গাড়ির ভিতর।
দেরি না করে আলখেল্লার পকেট থেকে হ্যাণ্ডকাফ নিল কুয়াশা। একদিকের কড়া আটকে দিল মৃত স্নাইপারের সেফটি হার্নেসে, অন্যটা আটকা পড়ল ল্যামবোরঘিনির স্টিয়ারিং হুইলে।
ক্রুজ কন্ট্রোল বাটন টিপল কুয়াশা, ছিটকে উঠে দাঁড়াল সিটে, পরক্ষণে বেরিয়ে এল টারগা ছাতে।
একইসময়ে ল্যামবোরঘিনির পিছনে পৌঁছে গেল প্রকাণ্ড ম্যাক রিগ, ভয়ঙ্কর গুতো দিল গাড়ির পিছনে।
কিন্তু ওই ধাক্কার জন্য তৈরি ছিল কুয়াশা, দুই গাড়ি ছোঁয়া ছুঁই করতেই মহাব্যস্ত হয়ে উঠল, ও। মুহূর্তে পেরোল। ল্যামবোরঘিনির পিছনের চ্যাপ্টা অংশ। হাতে উঠে এসেছে পিস্তল, গুলি শুরু করল ম্যাক রিগের উইণ্ডশিল্ড লক্ষ্য করে।
কপালে গুলি খেয়ে অক্কা পেল ড্রাইভার। ততক্ষণে ল্যামবোরঘিনি পেরিয়ে এসেছে কুয়াশা। লাফ দিয়ে উঠল ম্যাক রিগের দীর্ঘ নাকে।
পরের সেকেণ্ডে ট্রাকের ভাঙা উইণ্ডশিল্ড গলে বসে পড়ল কুয়াশা ড্রাইভিং সিটে। সামনের দৃশ্য পরিষ্কার দেখল। বুঝে গেছে কী ঘটতে চলেছে।
পাহাড়ি টানেলে তীর বেগে ঢুকল রানার ডাব্লিউআরএক্স।
কোবরা কপ্টারের পাইলট ভালই জানে তাকে টানেল এড়িয়ে যেতে হবে। পাহাড় পেরিয়ে আবারও শত্রুকে ধরতে হবে সামনে গিয়ে। উচ্চতা বাড়াতে চাইল পাইলট, কিন্তু সম্ভব হলো না। আবারও চেষ্টা করল, ফলাফল আগের মতই হতাশাজনক।
উঠতে পারছে না হালকা এমআই-৩৪। নোঙর হিসেবে কাজ করছে ছুটন্ত ল্যামবোরঘিনি। দুসেকেণ্ড পর পাইলট বুঝল, কী হতে চলেছে। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
ড্রাইভারহীন ল্যামবোরঘিনি তুমুল বেগে গিয়ে ঢুকল টানেলের ভিতর। আর টানেলের উপর দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইল এমআই-৩৪ কপ্টার। আতঙ্কে বিস্ফারিত হলো পাইলটের দুই চোখ। কপ্টারের সঙ্গে রয়ে গেছে স্নাইপারের দড়ি!
ওটা হ্যাচকা টানে হিড়হিড় করে নিয়ে চলেছে ওর কপ্টারকে!
তখনই ঘুরে গেল ল্যামবোরঘিনির স্টিয়ারিং হুইল। প্রচণ্ড গতি নিয়ে একপাশের দেয়ালে বিধ্বস্ত হলো গাড়ি। তার আগেই জোর টান খেয়ে পাহাড়ের বুকে আছড়ে পড়েছে এমআই-৩৪। বিস্ফোরিত হলো কপ্টার, বলের মত মস্ত আগুনের গোলা উঠে গেল আকাশে। ঝরঝর করে পাহাড় থেকে পড়তে লাগল আগুন ও আবর্জনা।
এসব পাত্তা না দিয়ে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে ম্যাক রিগ নিয়ে টানেলে ঢুকে পড়ল বাঙালি বৈজ্ঞানিক, পাশ কাটিয়ে গেল। পরিত্যক্ত, জ্বলন্ত ল্যামবোরঘিনি।
.
টানেলের শেষমাথা পেরিয়ে ঝড়ের মত বেরোলো রানার গাড়ি। আবারও উঠতে শুরু করেছে পাহাড়ি পথে।
তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েই দেখল খাড়াভাবে উঠে গেছে রাস্তা। একটু পর পর একের পর এক বাক। সামনে কী আছে দেখা যায় না। জানে না, রাস্তার অনেক উপরে দ্য গ্রেট ওশান রোডে খাপ পেতে আছে দুই হলদে পিউজো।
রানার পিছু না নিয়েও সংক্ষিপ্ত পথে ওখানে পৌঁছেছে তারা। এখন তীর গতি তুলে ফিরতি পথে আসছে।
গতি হ্রাস না করলে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে দু পক্ষের।
স্পিড বাড়িয়ে চলেছে রানা নিজেও, পাহাড় বেয়ে উঠছে। পিছনে দুই যান্ত্রিক দানব–একটা কুয়াশার দীর্ঘ নাকওয়ালা ম্যাক রিগ, অন্যটা নাক থ্যাবড়ানো কেনওঅর্থ।
বিদ্বেগে অন্ধ এক বাঁক পেরোল রানার ডাব্লিইআরএক্স, আর তখনই অচিন্ত্যনীয় প্রতিরোধের মুখে পড়ল।
বাঁকের সামনে ভ্রমরের মত ভাসছে ফাইটার জেট বিমান!
ওটার নাক তাক করা নীচের দিকে। ডানা থেকে চেয়ে আছে। অনেক কটা মিসাইল!
ওই বিমান চট করে চিনল রানা।
ড্যাসল্ট মিরাজ ২০০০এনটিআই। হ্যারিয়ার জাম্প জেটের মতই। সাধারণ মিরাজ ২০০০এন থেকে বদলে নেয়া হয়েছে। এ জিনিস থাকে শুধু ফরাসিদের সবচেয়ে বড় এবং নতুন সব এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে। বিমানটা দেখতেও প্রায় হ্যারিয়ারের মতই, পেট মোটা, কুঁজো, আর দুজনের ককপিটের দুপাশে সেমি সারকুলার এয়ার ইনটেক।
লেসারের মত ট্রেসার বুলেট উগলে দিল মিরাজ।
রানার গাড়ির চারপাশে এসে বিঁধছে গুলি।
মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরল রানা, তীব্র গতিতে পেরিয়ে গেল ভাসমান বিমানকে।
কিন্তু ভারী ওজন নিয়ে আকাশে ঘুরে গেল মিরাজ, এবং বুলেটের ঝড় পিছু নিল রানাদের।
আরেকটা বাঁক পেরিয়ে গেল ডাব্লিউআরএক্স। বেশ কয়েকটা ট্রেসার বুলেট লাগল পিছনের বাম্পারে।
তিশা! চাপা স্বরে বলল রানা, স্টিয়ারিং হুইল নাও!
পাশ থেকে ড্রাইভিং সিটে চলে এল তিশা।
এদিকে রানা খুঁজে নিল কমব্যাট ওয়েবিং থেকে বিশেষ কিছু বুলেট। ওগুলোর চিবুকে কমলা রঙের ব্যাণ্ড।
ষাঁড়ও বলে ওগুলোর আঘাতে থামে?
ফাইটার বিমান ঠেকাতে পারে?
ডেযার্ট ঈগল পিস্তলের ম্যাগাষিনে বুলেট ভরতে শুরু করেছে রানা। কাজটা শেষ করেছে, এমনসময় সামনের রাস্তায় দেখা দিল দ্বিতীয় মিরাজ বিমান। ওটার মেশিনগান ছুঁড়ছে গুলি। নলের মুখ থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে লাল আগুন।
কিন্তু রানা এখন তৈরি।
সরে গেছে প্যাসেঞ্জার সিটে, জানালা দিয়ে বের করে দিল। কোমর, বিমানের দিকে তাক করল ডেযার্ট ঈগল পিস্তল।
গাড়ির সামনের রাস্তা কামড়ে তুলছে মিরাজের বুলেট। ওই একইসময়ে গুলি করল রানা ভাসমান বিমানের দিকে। বু! বুম্! বুম! আওয়াজ তুলছে ডের্ট ঈগল।
প্রতিটা গুলি বিধল বিমানের দুপাশের এয়ার ইনটেকের ভিতর। একইসময়ে ঝাঁঝরা হলো ডাব্লিউআরএক্সের উইণ্ডশিল্ড।
একমুহূর্ত পর বোঝা গেল বাঙালি বৈজ্ঞানিকের গ্যাস এক্সপ্যাণ্ডিং বুলেট আসলে কী দুর্দান্ত জিনিস।
মিরাজের ইনটেক ফ্যানে প্রথম বুলেট বিধতেই চারপাশে ছিটকে গেছে গ্যাস; চুরচুর করে দিয়েছে ফ্যানের ব্লেডগুলো। ফলে জ্যাম হয়েছে বিমানের ইঞ্জিন। আর তখনই অনায়াসে জেট ইঞ্জিনের ভিতর ঢুকেছে অন্য সব গুলি। ফলাফল খুবই খারাপ: বিমানের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হাইলি ভলাটাইল ফিউয়েল ইনজেকশন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মাত্র দুটো বুলেট লাগল ছয় শ মিলিয়ন ডলারের ফ্রেঞ্চ বিমানের বারোটা বাজাতে।
খেপে উঠল ইঞ্জিনগুলো, উন্মাদের মত বনবন করে পাক খেল বিমান, চারপাশে ছিটিয়ে দিল ট্রেসার বুলেট পরক্ষণে বিকট বুম! আওয়াজ হলো। অসংখ্য টুকরো হলো ফ্রেঞ্চ ফাইটার। ঝরঝর করে নেমে এল তরল জ্বলন্ত তেল। বিমানের ভাঙাচোরা কাঠামো ধুপ করে নামল রানার পঞ্চাশ গজ দূরের রাস্তায়।
জানালা থেকে পিছিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে বসল রানা, আর তখনই…
দেখল ড্রাইভিং সিট থেকে ছিটকে গেছে তিশা।
কাঁধে ভয়ঙ্কর ক্ষত, বেরুতে শুরু করেছে রক্তের স্রোত। ড্রাইভিং সিটের দুই ইঞ্চি জায়গা উড়ে গেছে বুলেটের আঘাতে, ওখানে ছিল তিশার কাধ।
ঝট করে পা বাড়িয়ে ব্রেক পেডাল টিপে ধরল রানা, প্রায় তখনই থামল গাড়ি বিধ্বস্ত মিরাজের সামান্য আগে।
তিশা, অসহায় শোনাল রানার কণ্ঠ, খুব ব্যথা?
চোখের ভারী পাতা খুলল তিশা। গুঙিয়ে উঠল, ব্যথা…. রানা… খুব…
গাড়ি থেকে বেরিয়ে তিশার দরজার পাশে চলে এল রানা। খুলে ফেলল দরজা। দুহাতে তুলে নিল তিশাকে। রেডিয়ো করল, কুয়াশা! আপনি কোথায়?
প্রথম রিগে। পিছনে আসছে আরেকটা। তুমি কোথায়… না, দেখতে পেয়েছি।
তিশা আহত। ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
বেশ, আমি থামলেই চট করে তুলে দেবে ট্রাকে, বলল কুয়াশা। ঠিক পিছনেই থাকবে অন্য ট্রাক।
এবার কুয়াশাকে দেখল রানা, পাহাড়ি পথে উঠে আসছে। ম্যাক রিগ নিয়ে। ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলছে ইঞ্জিন। গতি দ্রুত।
ব্রেকের বিশ্রী কিচকিচ আওয়াজ তুলে ডাব্লিউআরএক্সের পাশে থামল ট্রাক।
ঝট করে দরজা খুলে দিল কুয়াশা।
তিশাকে ক্যাবে তুলে দিল রানা। দড়াম করে দরজা বন্ধ করতে না করতেই রওনা হলো কুয়াশা ট্রাক নিয়ে। পিছনের বাঁকে দেখা দিয়েছে নাক বোঁচা কেনওঅর্থ রিগ। পূর্ণ গতি। বিকট গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন।
মিরাজ বিমানের ধ্বংসস্তূপ মাড়িয়ে রওনা হলো কুয়াশার ম্যাক রিগ। গতি মাত্র তুলছে। দ্বিতীয় রিগ এল সব এলোমেলো করে দিয়ে, নানাদিকে ছিটিয়ে পড়ল অবশিষ্ট মিরাজ বিমান। প্রচণ্ড গতি কেনওঅর্থের, ভয়ঙ্করভাবে গুঁতো দিল কুয়াশার ম্যাক রিগের পিছনে।
বিশ মাইল বেগে চলেছে ম্যাক রিগ, ধাক্কা খেয়ে চমকে গেল রানা, কুয়াশা এবং তিশা।
ফুট বোর্ডে দাঁড়িয়ে আছে রানা।
একইসময়ে বলল কুয়াশা এবং ও, সামনে থেকে আসছে। আরও দুই র্যালি কার!
পরস্পরের দিকে চাইল ওরা। যেন নিজেকে দেখছে আয়নায়।
ওর কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।
ফাইটার বিমানের মেশিনগান থেকে গুলি লেগেছে, বলল রানা।
ও, চুপ হয়ে গেল কুয়াশা।
পাহাড় বেয়ে উঠছে দুই ট্রাক। একস্ট স্ট্যাগ থেকে ভলকে ভলকে বেরুচ্ছে কালো ধোঁয়া।
তখনই দেখা দিল দুই হলদে পিউজো র্যালি কার।
চওড়া বাঁক ঘুরে বেরিয়ে এসেছে।
তীরের মত নেমে আসছে পাহাড়ি পথে। ওই একই পথে সগর্জনে উঠছে রানা ও কুয়াশার ট্রাক।
দুই গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটের দুই গানম্যান পাশের জানালা দিয়ে বের করে দিয়েছে কোমর। হাতে একে-৪৭ রাইফেল।
ডালে বসা পাখির মত খতম হবে গুলি শুরু করল দুই গানম্যান, আর তখনই ডানদিকের গাড়ি উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল কুয়াশার ট্রাক। ড্রাগন কর্পোরেশনের দ্বিতীয় পিউজো তীরের মত সরে গেল আরেকদিকে। চেপে বসল পাহাড়ে। হোঁচট খেয়ে থামল কয়েক মুহূর্ত পর। ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে হলদে পিউজোকে পেরিয়ে গেল দ্রুতগামী দুই ট্রাক।
পাহাড়ের মাথায় উঠে এল ম্যাক রিগ, সামনে আবারও সমতল মেইন রোড। দুই রাস্তার সঙ্গমে পৌঁছে গেছে ট্রাক।
কিন্তু পিছনে লেগে আছে নাক-থ্যাবড়া কেনওঅর্থ ট্রাক। ওটার পিছু নিয়েছে অবশিষ্ট হলদে পিউজো। নতুন উদ্যমে শুরু হলো ধাওয়া। অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তা পেয়ে ছিটকে সামনে বাড়ল র্যালি কার, কিন্তু তখনই বিস্ফোরিত হলো রাস্তার সঙ্গমস্থল। বিকট আওয়াজে কানে ঝিঁঝি লাগল। চারপাশে ছিটকে উঠেছে ধুলোর মেঘ। ফ্রেঞ্চ ডেস্ট্রয়ার থেকে এসে পড়েছে গোলা।
একটা বাঁক পেরিয়ে এল দুই প্রকাণ্ড রিগ। বামে অনেক নীচে সুনীল সাগর। সামনে পাহাড়ের কোলে আরেকটা টানেল। সুড়ঙ্গ গেঁথে আছে পাহাড়ের বুকে, ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। আগের টানেলগুলোর চেয়ে দীর্ঘ।
গর্জন ছাড়তে ছাড়তে নব্বই মাইল বেগে টানেলে ঢুকে পড়ল কুয়াশার ট্রাক। আর তখনই কেনওঅর্থের পাশে পৌঁছে গেল হলদে পিউজো। প্যাসেঞ্জার জানালা দিয়ে শরীর বের করে গুলি ছুঁড়ছে গানম্যান। একরাশ গুলি এল ম্যাক রিগের পিছনের চাকা লক্ষ্য করে।
বিস্ফোরিত হলো ম্যাকের পিছনের চাকাগুলো।
ধাপ-ধাপ আওয়াজে রাস্তা চাপড়াতে শুরু করেছে ফাটা রাবার। পিছন দিকটা মাছের লেজের মত এপাশ-ওপাশ ঝাঁপটে চলেছে।
মস্ত রিগের পিছন দিক পিছলে সরে যেতে লাগল একপাশে।
এদিকে সুযোগ পেয়ে এগুতে শুরু করেছে কেনওঅর্থ রিগ।
আমাদের পাশে পৌঁছে যাচ্ছে! সতর্ক করল রানা।
বদ্ধ টানেলের ভিতর ম্যাক রিগের ডানদিকে হাজির হলো নাক বোঁচা কেনওঅর্থ রিগ।
ব্যবস্থা নিচ্ছি, বলল কুয়াশা। তুমি হুইল ধরো!
ড্রাইভারের সিট ছেড়ে উঠে পড়েছে বিজ্ঞানী, ছুটে ঢুকে পড়ল ম্যাকের স্লিপিং কম্পার্টমেন্টে। রিগের পিছনের সমতল ট্রেইলার কানেকশন সেকশনের জানালা দিয়ে পর পর দুবার গুলি করল। পরের মুহূর্তে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল ঝোড়ো হাওয়ার ভিতর।
বাঁকা টানেলে পাশাপাশি ছুটছে দুই প্রকাণ্ড রিগ।
সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে চলেছে সাগরের দিকের কলামগুলো।
ড্রাইভিঙের মাঝে আহত তিশার দিকে চাইল রানা। ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়েছে বেচারি। কাছেই কোথাও জোরালো বুমবুম আওয়াজ শোনা গেল।
ঝট করে বামে চাইল রানা। অস্পষ্ট সব কলামের ওপাশে হাজির হয়েছে দ্বিতীয় মিরাজ ফাইটার। গুলি করছে ওদের ট্রাক লক্ষ্য করেই।
পরিস্থিতি খুবই খারাপ, মনে মনে বলল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ডানদিকে পাশাপাশি চলল কেনওঅর্থ রিগ। ক্যাবের ভিতর ড্রাগন কর্পোরেশনের দুই লোক। ম্যাক রিগ পাশে পেয়েই নিজেদের ট্রাকের বামের দরজা খুলল গানম্যান।
এবার উঠে আসবে শত্রুর ট্রাকে।
লোকটার দিকে ডেবার্ট ঈগল পিস্তল তুলল রানা, টিপে দিল ট্রিগার।
ক্লিক!
চেম্বারে গুলি নেই।
দুই ট্রাকের মাঝের সামান্য জায়গাটা লাফিয়ে পেরিয়ে এল ড্রাগন কর্পোরেশনের গানম্যান, ধুপ করে নামল প্যাসেঞ্জার নামবার সিঁড়ির ধাপে। জানালা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল রাইফেলের নল, এবার গুলি করবে…
ওই একইসময়ে উরুর খাপ থেকে ম্যাগহুক নিয়েছে রানা, যন্ত্রটা তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার।
ফুযযযয… আওয়াজ তুলল ম্যাগহুক।
ফায়ার করেনি ম্যাগনেটিক বাল্ব। দুর্বল ফিসফিস আওয়াজ, শেষ হয়ে গেছে প্রপালশন গ্যাস।
একে-৪৭-এর মাযলের দিকে চেয়ে গলা শুকিয়ে গেল রানার।
বুঝে গেছে, এবার লাশ হবে তিশা আর ও।
সবই বুঝতে পেরেছে ড্রাগন কর্পোরেশনের গানম্যান, মুখে ফুটে উঠল টিটকারির হাসি। তর্জনী দিয়ে আস্তে করে দাবিয়ে দিল ট্রিগার।
ওই একইসময়ে কেনওঅর্থ ট্রাক বামে চেপে আসতেই সত্যিকারের প্যানকেক হলো লোকটা। দুই ট্রাকে এত জোরে গুঁতো লেগেছে, মুহূর্তের জন্য রাস্তা ছেড়ে শূন্যে উঠল চাকাগুলো।
চেপ্টে যাওয়া মশার মত হয়ে গেল গানম্যানের দেহ, বিস্ফোরিত হয়েছে সারাশরীর থেকে রক্ত। পিরিচের মত হয়ে গেল লোকটার দুই চোখ, খসে পড়ল ট্রাক থেকে নীচের রাস্তায়। চাপা পড়ল ট্রাকের পিছনের চাকার তলে।
আর লোকটা সরে যেতেই রানা দেখল, এখন কেনওঅর্থ ড্রাইভ করছে নতুন এক লোক–কুয়াশা!
ড্রাগন কর্পোরেশনের গানম্যান কেনওঅর্থ থেকে ম্যাক রিগের দরজার ফুটবোর্ডে নেমে আসতেই, তার ট্রাকের উল্টো দিকে পৌঁছে গেছে কুয়াশা–ম্যাক রিগের পিছনের সেকশন পেরিয়ে হাজির হয়েছে কেনওঅর্থ রিগের ডানদিকের দরজায়।
বাঁকা টানেলে পাশাপাশি ছুটছে দুই প্রকাণ্ড দানব। পিছনে আসছে শেষ হলুদ পিউজো।
রানার ম্যাক রিগ ভীষণ দুলছে এদিক-ওদিক, নানাদিকে পিছলে চলেছে পিছনের চাকা।
রেডিয়ো করল রানা, কুয়াশা, ট্রাক নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। তৈরি থাকুন, আমরা আপনারটায় উঠছি।–
ঠিক আছে, সরে আসছি, বলল কুয়াশা। আগে তিশাকে পাঠাও।
ম্যাক রিগের একেবারে পাশে চলে এল কেনওঅর্থ।
সিটবেল্ট ব্যবহার করে স্টিয়ারিং হুইল স্থির রাখল রানা, লাথি দিয়ে খুলল প্যাসেঞ্জার দরজা দুহাতে তুলে সাবধানে সরাতে শুরু করেছে তিশাকে।
ওই একইসময়ে ড্রাইভারের দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিল কুয়াশা।
কিন্তু তখনই এল একরাশ গুলি।
খটাখট লাগছে দুই ট্রাকের বডিতে।
পিছনের পিউজোর লোকগুলো লক্ষ্যস্থির করতে পারেনি।
নিরাপদেই তিশাকে কুয়াশার ট্রাকের প্যাসেঞ্জার সিটে তুলে দিল রানা।
তিশা নিরাপদ বুঝে যেতেই নিজেও মাঝের দূরত্ব পেরুতে চাইল রানা। কিন্তু দিগন্ত থেকে এল কমপক্ষে কয়েক শ গুলি। কুয়াশার ট্রাকে উঠবার সুযোগ নেই, আসছে অসংখ্য বুলেট।
ঝট করে সামনে চাইল রানা। বুঝতে দেরি হলো না কোথা থেকে এল এত গুলি।
বাঁকা টানেলের শেষে বাতাসে ভাসছে দ্বিতীয় মিরাজ ২০০০এম-১১ ফাইটার। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ছয় ব্যারেলের মিনি গান। নলগুলো থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে কমলা আগুন।
চোখের সামনে সসসস্ আওয়াজ তোলা ট্রেসার রাউণ্ডগুলো দেখল রানা। এবার সব গুলি আসছে ওর দিকেই। ম্যাক রিগের ধাতব গ্রিলে লেগে ঠনঠনঠন আওয়াজ তুলছে উত্তপ্ত বুলেট সারি।
মুহূর্তে আগুন ধরল ম্যাকের ইঞ্জিনে। চারপাশে ছিটকে গেল হাইড্রলিক ফ্লুইড। এক সেকেণ্ড পর উইণ্ডশিল্ডের ওপাশে কিছুই দেখা গেল না। দুই পায়ে ব্রেক পেডাল চেপে ধরল রানা। কিন্তু তখনই বুঝল, ওই ব্রেক এখন অতীতের জিনিস। স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাতে চাইল। সামান্য নড়ল ওটা। চাপা শ্বাস ফেলল রানা, বিড়বিড় করে বলল, দাঁড়া, ফাইটার বিমান, আমি যদি শেষ হই, তোকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।
পাশে কেনওঅর্থ রিগ রেখে নিতম্ব নাচাতে নাচাতে চলেছে রানার ম্যাক রিগ।
ওটার উপর বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে মিরাজের পাইলট। থামছে না শত শত বুলেটের বৃষ্টি।
টানেলের শেষে পৌঁছে গেছে দুই ট্রাক। বাধ্য হয়ে তার ট্রাক নিয়ে সরে গেল কুয়াশা। বাকের শেষে এসে ডানদিকে সরছে সে, কিন্তু রানার ম্যাক রিগ একই পথে চলেছে। বনেটের উপর দাউ দাউ আগুন। ছিন্নভিন্ন হয়েছে পিছনের চাকা। এখন আর বাঁক নেবে না ওই ট্রাক। সোজা চলেছে তুমুল গতি তুলে।
বুঝে গেল রানা, এবার কী ঘটতে চলেছে। এবং সেটা ঠেকাতে কিছুই করতে পারবে না ও। আস্তে করে শ্বাস নিল রানা। মেনে নিয়েছে পরাজয়।
বাঁক নিল না ওর ট্রাক, সোজা উড়িয়ে দিল গার্ড রেইল ফেন্স, ছিটকে বেরিয়ে গেল বিকেলের রোদে। শূন্যে ভাসতে শুরু করেছে ট্রাক। সরাসরি চলেছে ভাসমান মিরাজ ফাইটার বিমানের দিকে।
ছুঁড়ে মারলে যেভাবে আকাশে ওঠে ঢিল, ঠিক সেভাবে নাক আকাশে তুলেছে ম্যাক রিগ, বনবন করে ঘুরছে চাকা, পিছনে রেখে যাচ্ছে জ্বলন্ত বনেটের কালো ধোঁয়া। কিন্তু নীচের দিকে নাক তাক করবার আগেই সজোরে গুঁতো দিল মিরাজ বিমানের নাকে। ভয়ঙ্কর ধাক্কা খেয়ে মস্ত হোঁচট খেল বিমান, আর ওটার উপর চেপে বসল মস্ত ট্রাক।
ভীষণভাবে দুলতে লাগল লাথি খাওয়া মিরাজ–পরক্ষণে বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হলো। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া আগুনের গোলা ভেসে উঠল নীল আকাশে।
পরক্ষণে নীচে রওনা হলো আগুনের গোলক, নামছে সোজা চার শ ফুট নীচের সাগরে। নাকে করে নিয়ে চলেছে আহত ম্যাক রিগকে।
কয়েক সেকেণ্ড পর বিপুল আওয়াজ তুলে সাগরের ঢেউয়ের ভিতর ঝপাস করে নামল সবই।
রানার কাছে সামান্যতম দড়িও ছিল না, আর বিকল ছিল ম্যাগহুক, আটকা পড়েছিল বিধ্বস্ত দুই যন্ত্র দানবের মাঝে।
সবই দেখেছে কুয়াশা ও তিশা। পাহাড়ের কাঁধে তীরের মত ছুটছে ওদের কেনওঅর্থ।
ডুকরে কেঁদে উঠল তিশা: রানা… রানা…
নিজ চোখে দেখেছে, রানাকে নিয়ে দেয়াল ভেঙে ছিটকে পড়েছে ম্যাক রিগ। গুঁতো দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেছে মিরাজ বিমানকে। তখনই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো। ভাঙাচোরা বিমান ও ট্রাক নেমে গেল চার শ ফুট নীচে। কয়েক সেকেণ্ড পর ঝপাস্ করে সাগরে পড়ল সবই।
না, ওই বিস্ফোরণ এবং পতনের পর বাঁচবার উপায় থাকে কারও।
আয়ত দুই চোখ অশ্রুতে ভরে গেছে তিশার। না… না… আল্লা… না… মুখ নিচু করে নিল ও, নীরবে কাঁদছে।
ওর সাহস ছিল মস্ত পুরুষ সিংহের মত, চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুয়াশা। দ্রুত ভাবতে শুরু করেছে। এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত এই ভয়ানক বিপদ থেকে বেরিয়ে যাওয়া।
তখনই শাঁ করে ওর ট্রাক পেরিয়ে গেল শেষ পিউজো। চমকে গিয়ে সামনের রাস্তা দেখল কুয়াশা। ওদিকে রয়েছে অস্বাভাবিক একটি স্থাপনা। দেখতে ছোট কোনও দুর্গের মতই। ওটার ভিতর দিয়ে গেছে রাস্তা।
পাথুরে কোনও খুদে দুর্গ, ছাতে হাঙরের দাঁতের মত খোঁচা খোঁচা ব্যাটলমেন্ট।
জিনিসটা আসলে দোতলা গেটহাউস। বোধহয় ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নের সমানই বয়স ওটার।
স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, ডেমিয়েনের সম্পত্তির শেষ সীমানা ওটাই।
গেটওয়ের শেষে শক্তপোক্ত ড্র-ব্রিজ। দৈর্ঘ্যে হবে বিশ ফুট। ওটা সরিয়ে নিলে ওদিকের রাস্তার সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হবে। আপাতত পেতে রাখা আছে ড্র-ব্রিজ। কিন্তু গেটহাউসে পৌঁছে গেল পিউজো।
ওটা থেকে ছিটকে নামল এক লোক, ঝেড়ে দৌড় দিল দালানের ভিতর। কয়েক সেকেণ্ড পর কুয়াশা লক্ষ্য করল, ধীরে ধীরে উপরে উঠছে ড্র-ব্রিজ।
না… চাপা স্বরে বলল কুয়াশা। টিপে ধরল অ্যাক্সেলারেটার।
বিকট গর্জন ছাড়ল কেনওঅর্থ রিগ, গতি বাড়ছে। ঝড়ের গতিতে কাছে চলে আসছে মেডিইভেল গেটহাউস। লোহার পুরু দুই শিকলে ভর করে উঠে আসছে ড্র-ব্রিজ। খুবই কঠিন হবে সঠিক সময়ে ওটা পেরিরে যাওয়া। বিদ্যুদ্বেগে ছুটছে প্রকাণ্ড ট্রাক। ধীরে ধীরে এক ফুট এক ফুট করে উঠছে ড্র-ব্রিজ। এরই ভিতর উঠে এসেছে তিন ফুট। পিউজোর অন্য লোকটা গুলি শুরু করেছে ট্রাক লক্ষ্য করে। আর মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে ট্রাক। মাথা নিচু করে নিল কুয়াশা।
তখনই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল উইণ্ডশিল্ড। তীরের মত আসছে ড্র-ব্রিজ…
সগর্জনে গেটহাউসে পৌঁছে গেল ট্রাক, ছিটকে পিছিয়ে গেল। এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র লোক…
তুমুল গতি নিয়ে র্যাম্পের মত সেতুর উপর উঠল ট্রাক.. গতি ঘণ্টায় কমপক্ষে এক শ মাইল। সেতুর শেষমাথায় পৌঁছে আকাশে ছিটকে ভেসে উঠল ট্রাক, মুহূর্তে পেরিয়ে গেল মাঝের শূন্যতা, তারপর আবারও জোরালো ধপ আওয়াজ তুলে নামল চাকা।
আবারও ফিরেছে ট্রাক শক্ত জমির উপর।
পর পর তিনবার লাফিয়ে উঠল রিগ, তারপর ওটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল কুয়াশা।
ফোঁস করে আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ল। তখনই বিস্ফোরিত হলো ট্রাকের সামনের রাস্তা। যেন তৈরি হয়েছে মাশরুমের মেঘ।
এইমাত্র ওখানে নেমেছে ডেস্ট্রয়ারের গোলা।
কষে ব্রেক করল কুয়াশা। পিছলে যেতে শুরু করেছে ট্রাক। তীক্ষ্ণ বাঁক নিচ্ছে। কয়েক সেকেণ্ড পর থামল গহ্বরের মত এক নতুন গর্তের পারে।
চট করে তিশার দিকে চাইল কুয়াশা, পুরোপুরি হতাশ।
বাস্পায়িত হয়েছে ওদের সামনের পথ। ওখানে মস্ত গভীর গর্ত। তিরিশ ফুট দূরে আবারও শুরু হয়েছে রাস্তা।
ফাঁদে পড়েছে ওরা। দুপাশে খাড়া পাহাড়। পিছনে এবং সামনে খাড়া গহ্বর।
এমনসময় হাজির হলো ড্রাগন কর্পোরেশন কপ্টার। এতক্ষণ নিরাপদ দূরত্ব থেকে সবই দেখছিল তারা।
ট্রাকের পাশে এসে ভাসতে লাগল কপ্টার। হেলমেট রেডিয়ো ব্যবহার করে হুমকি দিল পাইলট:
খবরদার! নেমে এসো ট্রাক থেকে!
তিন
ইংল্যাণ্ড।
অক্টোবর ১৪। ইউনাইটেড স্টেটস্ এম্বেসি, লণ্ডন। বিকেল সাড়ে চারটা।
…তাদের মতে জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে, তার মাধ্যমে বেশিদূর এগুতে পারবে না আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব। ম্যাজেস্টিক-১২ সেপ্টেম্বর এগারোতে হামলা করেনি বা করায়নি, কিন্তু এর ফলে যে সুবিধা পাওয়া গেছে, তা পূর্ণভাবেই ভোগ করছে তারা…
.
টিভির পর্দায় যে লোক বলে চলেছে, সে মোসাদের মৃত এজেন্ট
ডেনিস ই, ম্যাকিন। আজ খুন হয়েছে কুইন্স টাওয়ারের ছাতে।
গভীর মনোযোগে টিভি দেখছে খবির। ওর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্টেটস ডিপার্টমেন্টের চার্লস ডেলাস।
ডেস্কের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে অসংখ্য ডকুমেন্ট।
সবই ম্যাজেস্টিক-১২ এবং বাউন্টি হান্ট সম্পর্কে জোগাড় করেছিল ডেনিস ই, ম্যাকিন।
ডকুমেন্টগুলো আবারও পড়তে শুরু করেছে খবির। বেশ কিছু ছবিও আছে।
একটায় দেখা যাচ্ছে, এক ইকোনোমিক সামিটে লিমাযিন থেকে নামছে একদল লোক।
গোপনে কান পাতা হয়েছে ফোনে, পাতা ভরা তার বর্ণনা। চুরি করা হয়েছে ইউএসএ-র নিরাপত্তা বিভাগের ফাইল।
দুটো ডকুমেন্ট হাপিস হয়েছে ভয়ঙ্কর কুখ্যাত ফ্রেঞ্চ সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা ডিজিএসই থেকে। প্রথম ডোশিয়েতে। উল্লেখ করা হয়েছে, ছয়মাস আগে বিশ্ব-সেরা কজন ব্যবসায়ীকে একটি ডিনারে আমন্ত্রণ জানান ফ্রেঞ্চ প্রেসিডেন্ট।
দ্বিতীয় ডকুমেন্ট নিউক্লিয়ার বোমার মতই। কয়েক দিন আগে ডিজিএসই বন্দি করেছে টেরোরিস্ট অর্গানাইযেশন গ্লোবাল জিহাদের চব্বিশজন জঙ্গীকে, তারা একটা ট্যাঙ্কার বিমান ব্যবহার করে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আইফেল টাওয়ার। গ্লোবাল জিহাদ আল-কায়দার মতই, গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাইছে ইসলামি জঙ্গীবাদ।
ডকুমেন্টটা পড়তে শুরু করে নিচু সুরে শিস বাজাল খবির। গ্লোবাল জিহাদের টেরোরিস্টদের সঙ্গে বন্দি হয়েছিল দলের অন্যতম নেতা শাহেদ করিম। সাধারণত বড় কোনও ইসলামি নেতা ধরা পড়লে দুনিয়া জুড়ে হই-হই শুরু হয়। কিন্তু, শাহেদ করিমকে গোপনে আটকে রাখে ফ্রেঞ্চ কর্তৃপক্ষ।
মার্জিনে মন্তব্য লিখেছে ডেনিস ই, ম্যাকিন: এদের সবাইকে ডিজিএসই-র ব্রেস্ট হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোনও বিচারের ব্যবস্থা করা হয়নি। খবরের কাগজে কিছুই উল্লেখ ছিল না। ওই চব্বিশজনকে আর কখনও দেখাও যায়নি। লিযার্ড/নোয়ায প্রজেক্টের সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ থাকতে পারে। …ফরাসিরা কি এম-১২ কাউন্সিলের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছে? এ বিষয়ে বিশদ খোঁজ নেওয়া উচিত।
সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসাবে কাজ করছে মোসাদের ডিভিডি ডিস্ক। দুজন বয়স্ক এজেন্ট ইন্টারোগেট করছে ম্যাকিনকে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ম্যাকিন লোকটা যেন ডিনামাইটের উপর বসে ছিল। প্রথমেই সে ব্যাখ্যা দিয়েছে, আসলে ম্যাজেস্টিক-১২ কী।
ম্যাকিনের তৈরি ফাইলের তালিকা অনুযায়ী ওই কাউন্সিলেরচেয়ারম্যান ফ্রান্সিস ওলিফ্যান্ট। মিলিটারি ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। বয়স সত্তর। ওলিফ্যান্ট-রোজ ইণ্ডাস্ট্রিজের প্রধান। ডিফেন্স কন্ট্রাক্টর। হিউ এবং ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের মত মিলিটারি এয়ারক্রাফটের জন্য স্পেয়ার পার্টস তৈরি করে ও-আর ইণ্ডাস্ট্রিজ। ভিয়েতনাম বা ডের্ট স্টর্ম যুদ্ধে হাজার হাজার কোটি ডলার মুনাফা করেছে তার কর্পোরেশন।
ভাইস-চেয়ারম্যান মস্ত ব্যবসায়ী ওয়েণ্ডেল রোচ, দুনিয়া খ্যাত গ্রিক কন্টেইনার শিপিং ম্যাগনেট।
র্যানডলফ কিলিয়ান, পৃথিবীর সবচেয়ে সফল বিনিয়োগকারী।
ডিন ম্যাকেনকোর্ট, বিশ্বের সেরা এবং বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি সেভেন সি-র হর্তাকর্তা।
ডেমিয়েন ডগলাস এম-১২ কাউন্সিলের সদস্য। চেয়ারম্যান এবং সিইও ড্রাগন কর্পোরেশন। এসব কোম্পানি প্রচুর মিসাইল ও রণতরী তৈরি করে।
আরও কজন বিপুল ক্ষমতাশালী লোকের নাম আছে। ম্যাকিনের ওই তালিকায়।
খুচরা জিনিস বিক্রি করে মস্ত বড়লোক হয়েছে, এমন কয়েকজনের নাম ওই তালিকায় নেই। হলিডে ইন রিসোর্টের পরিবারের কেউ, জাপানি ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, হোণ্ডা বা ফ্রেঞ্চ কসমেটিক্স কোম্পানির লিলি মাখসাখের নাম অনুপস্থিত।
অথচ সুন্দরী মহিলা লিলি মাখসাখের নাম সবাই জানে, সে আছে বিশ্বের প্রথম দশজন ধনীর তালিকায়।
মেজর ডেনিস ই, ম্যাকিন টিভির পর্দায় জানিয়ে চলেছে: এম-১২ কাউন্সিলের বারোজনের ওই তালিকার সবাই বিপুল সম্পত্তি করেছে একটিমাত্র বিষয়কে পুঁজি করে।
নিচু স্বরে কথা বলছে ম্যাকিন:
এরা হাজার হাজার কোটি ডলার মুনাফা করেছে একটিমাত্র বিষয়কে সম্বল করে। তা হচ্ছে যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে র্যান্ড কিলিয়ান প্রতিষ্ঠা করেন একটি লৌহ রাজ্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধ কতটা অপরিহার্য তা নিয়ে প্রচুর বক্তৃতা দেন ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট ফ্রান্সিস এলিফ্যান্ট ষাট দশকে। যুদ্ধ করতে চাইলে দরকার বিপুল তেল এবং লোহা। তৈরি করা হয়েছে হাজার হাজার রণতরী, হেলিকপ্টার, অস্ত্র, বোমা, ফার্মাসিটিক্যালস ইত্যাদি দরকারী জিনিস। মস্ত ব্যবসা আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলতে হলে চাই দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ। আসলে যুদ্ধই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ব্যবসা।
বলে চলেছে ম্যাকিন:
খেয়াল করুন, কীভাবে ঠেকাবার চেষ্টা করা হচ্ছে ইসলামি জঙ্গীবাদ। গত দশ বছরে আফগানিস্তানের পাহাড়ে কমপক্ষে বিশ হাজার বোমা ফেলেছে ইউএসএ। ফলে কী হয়েছে? কোনও সেতু, সাপ্লাই রুট, বা মিলিটারি নার্ভ সেন্টার বিনষ্ট হয়নি। কিন্তু যখনই ফেলা হয়েছে বিশ হাজার বোমা, তখনই নতুন বোমার চাহিদা তৈরি হয়েছে। তার মানেই, আমেরিকার সরকার কিনতে বাধ্য হয়েছে নতুন বোমা। আফগানিস্তানের পর কী হলো? অবাক কাণ্ড, খুঁজে পাওয়া গেল নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। এবার আবারও ইরাক।
পর্দায় ভেসে উঠেছে আরেকটা কাট:
এসব ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের ক্ষমতা বা প্রভাবকে ছোট করে দেখবেন না। তারাই জন্ম দেয় প্রেসিডেন্টদেরকে। আবার তারাই ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেয় পছন্দ না হলে। বিল ক্লিন্টনের ইমপিচমেন্ট থেকে শুরু করে প্রাক্তন কেজিবি এজেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনকে রাশার ক্ষমতায় পৌঁছে দেয়া–এসবই করেছে ম্যাজেস্টিক-১২। তারাই ঠিক করেছে এরপর ক্ষমতায় কে বসবে, এবং কতক্ষণ থাকবে। এরা সরাসরি প্রেসিডেন্টদের ক্যাম্পেইনে টাকা লগ্নি করেনি, কিন্তু ইচ্ছে করলেই প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিতে পারে।
ম্যাজেস্টিক-১২ যোগাযোগ রেখেছে দুনিয়ার সেরা সব ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কর্তাদের সঙ্গে। প্রাক্তন সিআইএ-র ডিরেক্টর ছিলেন ফ্রান্সিস এলিফ্যাণ্টের ব্যবসায়ীক পার্টনার। এমআই-৬-এর প্রধান ওয়েলে রোচের শালা। ডেমিয়েন ডগলাসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে ডিজিএসই-র ডিরেক্টর।
আসলে, হাসল মৃত ডেনিস ই, ম্যাকিন, কোনও দেশের বড় নেতাদের নাড়ির খবর বেশি জানবে কারা? সন্দেহ কী ওই দেশেরই ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস!
টিভির পর্দায় গম্ভীর হয়ে গেল ম্যাকিন।
ম্যাজেস্টিক-১২ বিশ্বের সবকিছুর চেয়ে ঢের বেশি ভালবাসে বড় ধরনের যুদ্ধকে। আসলে এসব যুদ্ধই অকল্পনীয় বড়লোক করে তুলেছে তাদেরকে। আর যে যুদ্ধ বাধেইনি, সেই না-লড়াই করা যুদ্ধে, অর্থাৎ ইউএস ও সোভিয়েতদের কোল্ড ওঅরের ফলে অন্যসব বড়লোকের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে এরা।
পরবর্তীতে ডেযার্ট স্টর্ম, বসনিয়া, সোমালিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক যুদ্ধ… কিন্তু এরা সোনার খনি পেয়েছিল কোল্ড ওঅরের সময়। তখনই আমস্ রেস শুরু করে আমেরিকা ও রাশা, ফলে প্রচ্ছন্নভাবে লড়াই বাধে দুই দেশের। লাখ লাখ মানুষ মরতে থাকে কোরিয়া ও ভিয়েতনামের যুদ্ধে। আর ওই কোল্ড ওঅরের সুবিধা নিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার মুনাফা করে ম্যাজেস্টিক-১২।
কিন্তু সবকিছুরই শেষ আছে। উনিশ শ একানব্বই সালে সর্বনাশ হলো তাদের। পতন হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের।
ফাটল-ধরা বাঁধের মত ভেঙে পড়ল বার্লিন প্রাচীর। সাধারণ আমেরিকান ভোক্তাদের মনে হলো, উপভোগ করা উচিত জীবনটা। তাদের মত করেই নানা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে লাগল দুনিয়ার আর সব দেশের মানুষ। এতে খুবই উপকৃত হলো সাধারণ ব্যবসায়ীরা। তারা মস্ত বড়লোকদের তালিকায় জায়গা করে নিতে লাগল। বিশ্বের নানাদিকে ছড়িয়ে গেল তাদের পণ্য। এর ফলে দুনিয়া-সেরা ধনীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। আমেরিকার মিলিটারি ম্যানুফ্যাকচাররা বুঝল, তারা হারাতে শুরু করেছে ব্যবসা। তাদের চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা করতে লাগল খুচরা পণ্যের ব্যবসায়ীরা। নাইকি, কোকা-কোলা, মাইক্রোসফট… বা ইউরোপিয়ান কোম্পানি বিএমডাব্লিউ বা লরেল… তারাই বাজার। দখল করতে লাগল।
কাজেই মহাচিন্তিত হয়ে উঠল ম্যাজেস্টিক-১২-র সদস্যরা। বুঝে গেল, যেভাবে হোক নতুন করে ফিরে পেতে হবে নিজেদের সাম্রাজ্য।
সামনের ফাইল থেকে আরেকটা ডকুমেন্ট নিল ম্যাকিন। ওটা তুলে ধরল ক্যামেরার দিকে।
…এটা নতুন এক কোল্ড ওঅরের খসড়া।
হাতের উপর চোখ নামিয়ে আনল খবির, ওই ডকুমেন্ট এখন। ওর হাতেই।
দ্রুত পড়তে শুরু করল খবির।
ওখানে লেখা:
সোর্স শিপ ডেলিভারি সিস্টেম ডাব্লিউএইচ অরিজিন টার্গেট টাইম
লোটাস শাহাব-এস টিএনবি ৫৬০১.০১ ০০০০১.৬৪ ১১.৪৫
লোটাস শাহাব-এস টিএনবি ৫০০০২.০০ ৫২৩১.০০ ১১.৪৫
সেইম ৩৫৭০১.২০ ০৪২১-০১ ১১.৪৫
সেইম ৫০০২.০০ ৪৯০০.২৪ ১১.৪৫
সেইম ৩৫৭০১-২০১২৩১৩-১৫ ১১.৪৫
সেইম ৫০০০২ ৫৩৫৮.৭৪ ১১.৪৫
কর্পোরেশন সেইম ২৮৭৪৪-০৫ ২৬৭৪৩-১৭ ১২.০০
কর্পোরেশন সেইম ৪১০৫-৫৪ ৪১০৩.৬৪ ১২.০০
সেইম ২এ৭৪৩-০৪ ২৬২৪১-০৪ ১২.০০
সেইম ৪১০৫-৫এস ৩৬৩৬-৬০ ১২.০০
রুবল টেপও-ডং-২ এন-৮ এনএফএল ৩২২২২-বি ২৩২২২-৬৯ ১২.১৫
রুবল টেপও-ডং-২ এন-৮ এনএফএল ৩৭৪৪-৭৬৩৭৪৫-৬৫ ১২.১৫
সেইম ২৩২২২-৬৩ ২৪২৩০-৫০ ১২.১৫
সেইম ৩৭৩৪-৭৫ ৩৪৩৩-০২ ১২.১৫
সেইম ২৩১৫৭-০৬ ২৩১৫৬.৫০ ১২.১৫
সেইম ৩৭৪৫-৭৪ ৪১৩১-৫১ ১২.১৫
হোপ সেইম ১১১০০-০১ ১১৬২২১.৬০ ১২.১৫
হোপ সেইম ২৩২৭-০১৪০০১-০০ ১২.১৫
সেইম ১১১০০-০১১১৪৪৫-৭০ ১২.৩০
সেইম ২৩২৮-০০ ২২৪৩-২৮ ১২.৩০
ডলফিন শাহাব-এস টিএনবি ০৭৭২৫-০৫২৩২৭-০১ ১২.৪৫
ডলফিন শাহাব-এস টিএনবি ২৩২৭.০১২৯৫৮.০৬ ১২.৪৫
সেইম ০৭০৪০৪৪ ০৭৩৩২-৬১ ১২.৪৫
সেইম ২৩২৭-০০৩২৩০-৫১ ১২.৪৫
………………
একের পর এক নাম ও সংখ্যা দেখছে খবির। প্রথমে আগামাথা কিছুই বুঝল না। কিন্তু ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠল। চিনে ফেলল দুটো নাম:
শাহাব-৫ এবং টেপও-ডং-২।
দুই দেশের বিখ্যাত দুই লং-রেঞ্জ ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল।
শাহাব-৫ তৈরি করেছে ইরান। এবং উত্তর কোরিয়া তৈরি করেছে টেপও-ডং-২।
একবার আল-কায়েদা গ্লোবাল জিহাদের মত সন্ত্রাসী সংগঠন নিউক্লিয়ার বোমাবাহী মিসাইল পেলে প্রথমেই পশ্চিমাদের বড় সব শহরে ফেলবে। ফলাফল হবে ভয়ঙ্কর। পাল্টা প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পশ্চিমারা তাদের আণবিক বোমাবাহী মিসাইল ফেলবে এশিয়ার ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর রাজধানীর উপর।
সন্ত্রাসীরা এসব মিসাইলে নিউক্লিয়ার বোমা, রেখেছে।
টিএন-৭বি বা এনএফএল।
নোটেশনের মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, টিএন-৭বি ও এন-৮ নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড।
টিএন-৭বি ফরাসীদের আণবিক ওয়ারহেড। উত্তর কোরিয়ার আণবিক ওয়ারহেড এন-৮।
বাংলাদেশ আর্মির কমিশণ্ড অফিসার পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য কিছুদিন পর পরীক্ষা দেবে খবির, কাজেই নানা অস্ত্র ও বোমা বিষয়ে লেখাপড়া করছে, নইলে ওর মাথার উপর দিয়ে। যেত এসব।
অন্য চিন্তা এল ওর মনে। এই তালিকা কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের নয়। এটা তৈরি করেছে ম্যাজেস্টিক-১২। তখনই চক্কর দিয়ে উঠল খবিরের মাথা।
এমন কী হতে পারে, গোপনে টেরোরিস্ট অর্গানাইযেশনের নাম ভাঙিয়ে দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে চাইছে ম্যাজেস্টিক ১২?
চট করে প্য বাটন টিপে আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল ম্যাকিনের কথা।
বলে চলেছে ইজরায়েলি এজেন্ট:
নতুন এক শীতল লড়াই শুরু হয়েছে টেরোরিযমের বিরুদ্ধে।
আর ইউএস-এর দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টকে কাজে লাগিয়ে দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ তৈরি করতে চাইছে ম্যাজেস্টিক-১২। ওই দুই প্রজেক্ট: লিযার্ড এবং নোয়ায শিপ। নোয়ায শিপগুলো আসলে লঞ্চ ভেসেল। কেউ বুঝবে না ওগুলো কন্টেইনার শিপ বা সুপারট্যাঙ্কার নয়। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি ছদ্মবেশী মিসাইল লঞ্চিং রণতরী। সুপারট্যাঙ্কারগুলো তৈরি করেছে ওয়েণ্ডেল রোচের শিপিং গ্রুপ। এদিকে এসব জাহাজের মিসাইল লঞ্চ সিস্টেম তৈরি করেছে ভার্জিনিয়ার নরফোক ও গুয়ামের ড্রাগন কর্পোরেশনের প্লান্টগুলো। স্বাভাবিক চেহারার সুপারট্যাঙ্কার ও কন্টেইনার শিপ–দুনিয়ার যে-কোনও সাধারণ বন্দরে অপেক্ষা করবে। কারও নজর পড়বে না ওগুলোর উপর। ইউএস সরকার এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছে: নোয়ায শিপ।
এদিকে লিয়ার্ড প্রজেক্ট আরও ভয়ঙ্কর। আগে কখনও ইউনাইটেড স্টেটস এত বিপজ্জনক প্রজেক্ট হাতে নেয়নি। কাজ করা হয়েছে মিসাইলগুলোর ভিতর। আপনারা আগেই জেনেছেন, ডকুমেন্টের ওই মিসাইলগুলো আসলে সম্পূর্ণ শাহাব বা টেপও-ডং নয়।
ওগুলো আসলে ইউএস-এর তৈরি ক্লোন মিসাইল। নিশ্চয়ই জানেন, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি মিসাইলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রতিটির ব্যক্তিগত চলনবলন আলাদা। ফ্লাইট সিগনেচার, কন্ট্রেইল ওয়েক ইত্যাদি। এমন কী আঘাত হানবার পরেও সেসব বৈশিষ্ট্য রয়ে যায়। আর এটাই এক্সপ্লয়েট করবে লিয়ার্ড প্রজেক্ট। ইউএস-এর সবচেয়ে কালো প্রজেক্ট ওটি। সরকার নিজেই তৈরি করছে নকল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল। এবং এসব মিসাইলের বৈশিষ্ট্য হবে অন্য কোনও দেশের মিসাইলের মত।
ক্লোন মিসাইল।
কিন্তু লিয়ার্ড প্রজেক্ট শুধু ইরানিয়ান শাহাব বা উত্তর কোরিয়ার টেপও-ডং-এ সীমাবদ্ধ নেই। ভারতীয় অগ্নি-২, পাকিস্তানী ঘৌরি-২, তাইওয়ানিজ স্কাই হর্স, ইউকের ট্রাইডেন্ট ১১ ডি-৫, ফ্রেঞ্চ এম-৫, ইজরায়েলি জেরিকো ২বি এবং রাশান এসএস-১৮ মিসাইলকে অনুকরণ করে তৈরি করা হয়েছে ইউএস-এর এসব মিসাইল।
এগুলো নানামুখী যুদ্ধ সৃষ্টির জন্যে। আক্রান্ত দেশ ভাববে অমুক দেশ হামলা করেছে তাদের উপর। অর্থাৎ ইউএসএ কোনও দেশের ঘাড়ে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাইলে নকল কোনও মিসাইল ফেলবে। দোষ হবে অন্য দেশের।
লিয়ার্ড প্রজেক্টের পুরো দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল ড্রাগন কর্পোরেশনকে। আর নকল সুপারট্যাঙ্কার ও কন্টেইনার শিপগুলো তৈরি করেছে ওয়েণ্ডেল রোচের কর্পোরেশন। এবং সেকারণেই দুনিয়া জুড়ে ভয়ঙ্কর প্রলয় ঘটতে পারে। দুই প্রজেক্টের দুই কন্ট্রাক্টার কোম্পানিরই মালিক, এম-১২-র সদস্যরা।
এবং অক্টোবরের পনেরো তারিখে সকাল পৌনে বারোটার সময় বৃষ্টির মত পড়বে নিউক্লিয়ার মিসাইল। আগে কখনও এমন দেখেনি মানুষ। সব কোঅর্ডিনেট করা। নিখুঁত। পনেরো মিনিটের ব্যবধানে একের পর এক মিসাইল পড়বে। গোটা দুনিয়ার মিডিয়া একটা খবর জানাতে না জানাতেই নতুন মিসাইল হিটের খবর আসতে থাকবে। দুনিয়ার মস্ত সব শহর ধ্বংসস্তূপ হবে। লণ্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, বার্লিন… ভয়ঙ্কর গোলমাল বাধবে। আতঙ্কিত হয়ে উঠবে সবাই। ভাবতে থাকবে: এর পর না জানি কোন শহর ধ্বংস হবে!
আর মিসাইলের বৃষ্টি শেষ হলে, তদন্তকারী অফিসাররা বুঝতে শুরু করবে মিসাইলগুলোর ক্যারেকটারিস্টিক ও ব্লাস্ট সিগনেচার। সমস্ত বৈশিষ্ট্য দেখে বোঝা যাবে, এসব মিসাইল ছিল ইরান ও উত্তর কোরিয়ার।
টেরোরিস্ট দেশের মিসাইল।
ঘৃণা ভরে ইরান ও উত্তর কোরিয়াকে পরিত্যাগ করবে বেশিরভাগ দেশ। আর স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জনগণ আতঙ্ক কাটিয়ে খেপে উঠবে। ফলাফল: জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে তুমুলভাবে নামবে শক্তিশালী দেশগুলো। গত কয়েক বছর ধরেই ওই লড়াই চলছে। এবং কমপক্ষে আগামী পঞ্চাশ বছর চলবে ভয়ঙ্কর লড়াই। শুরু হবে নতুন কোল্ড ওঅর। ব্যস্ত হয়ে উঠবে মিলিটারি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সগুলো। আগে কখনও এত অস্ত্র লাগেনি কোনও দেশের। এবং নানাধরনের অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে ম্যাজেস্টিক-১২ শত-সহস্র বিলিয়ন ডলার মুনাফা করবে।
খবিরের মনে হলো, ঘুরছে ওর মাথা। এসব কী শুনছে ও? ছদ্মবেশী সুপারট্যাঙ্কার। ক্লোন মিসাইল। সবই তৈরি করেছে আমেরিকান সরকার। প্রয়োজনে সর্বনাশ করে দেবে যে-কোনও দেশের। নকল মিসাইল ফেলে দুই দেশের ভিতর যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে।
আপাতত এসব হয়তো করবে না আমেরিকান সরকার, কিন্তু ক্লোন মিসাইল প্রস্তুতকারীরা বা ম্যাজেস্টিক-১২-র সদস্যরা তাদের প্রয়োজনে এখনই নতুন কোনও যুদ্ধ বাধাতে চাইছে।
নিউ ইয়র্ক, লণ্ডন, প্যারিস, বার্লিন….
ক্ষতিগ্রস্ত এসব দেশের সেনাবাহিনী ছাড়বে কেন, তারাও পাল্টা হামলা করবে শত্রুদেশে। মরবে কোটি কোটি মানুষ।
আবারও তালিকায় মনোযোগ দিল খবির। সংখ্যাগুলো কো-অর্ডিনেট।
দুধরনের কো-অর্ডিনেট। লঞ্চ করা হবে জাহাজ থেকে। আর পড়বে গিয়ে নির্দেশিত শহরে।
এবার নোয়ায শিপ প্রজেক্টের সুপারট্যাঙ্কারগুলোর নাম পড়ল খবির। লোটাস, কর্পোরেশন, রুবল, হোপ এবং ডলফিন। এসব জাহাজ ব্যবহার করে নতুন বিশ্ব সৃষ্টি করতে চাইছে ম্যাজেস্টিক-১২।
খবির ভাবল, এসবের সঙ্গে মাসুদ স্যর বা অন্য কয়েকজনের সম্পর্ক কী?
তাদেরকে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে কেন?
কীসের জন্য বাউন্টি হান্ট?
আগামীকাল দুপুরের আগেই কেন তাদেরকে শেষ করতে হবে?
ম্যাকিনের একটা কথা মনে পড়ল ওর। কুইন্স টাওয়ারের ছাতে বৃষ্টির ভিতর লোকটা বলেছিল:
সবই রিফ্লেক্সের ব্যাপার। বলতে পারেন সুপারফাস্ট রিফ্লেক্স। ওই তালিকার নয়জন দুনিয়া সেরা। অনায়াসে পাশ করবে সি স্নেক টেস্ট। এরা ডিসআর্ম করতে পারবে টাচলক-৯। আর ওটাই হচ্ছে ম্যাজেস্টিক-১২-র পরিকল্পনা। ওই পরিকল্পনা কাজে লাগাতে হলে আগে ওই লোকগুলোকে শেষ করতে হবে…
টাচলক-৯ মিসাইল সিকিউরিটি সিস্টেম। হা, ওটাই ম্যাজেস্টিক-১২-র মূল পরিকল্পনা। টাচলক-৯… ভাবছে খবির। সামনে পড়ে থাকা ফোল্ডারগুলো ঘাটতে শুরু করেছে। খুঁজছে টাচলক-৯ বিষয়ে তথ্য। বেশিক্ষণ লাগল না ফাইলটা পেতে।
বড় করে মলাটে লেখা:
ড্রাগন কর্পোরেশন- পেটেন্টেড টাচলক
সিকিউরিটি সিস্টেম
ডকুমেন্টগুলো ড্রাগন কর্পোরেশন এবং ইউএস ডিপার্টমেন্ট অভ। ডিফেন্সের। প্রথম ডকুমেন্টের মলাটে লেখা:
টপ সিক্রেট
খবির মলাট সরিয়ে প্রথম পাতার প্যারাগ্রাফে চোখ বোলাল।
ডিসআর্ম সিস্টেম-টাচলক-৯
এ ধরনের ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক অস্ত্রের বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা অত্যন্ত জরুরি। লিযার্ড সিরিজের মিসাইলে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ড্রাগন কর্পোরেশনের পেটেন্টেড টাচলক-৯ ডিসআর্ম সিস্টেম। বর্তমান বিশ্বে। সবচেয়ে নিরাপদ অ্যান্টি-ট্যামপার মেকানিম এটি। অভিনব তিনটি নিরাপত্তামূলক প্রোটোকল ব্যবহার করবে টাচলক-৯। একইসময়ে তিনটি নির্দিষ্ট সিকিউয়েন্স ব্যবহৃত না হলে প্রোটোকল অনুযায়ী সিস্টেম (বা ডি অ্যাকটিভেশন) চালু করা সম্ভব হবে না।
এই সিস্টেমের মূল কাজ সমাধা করবে দ্বিতীয় প্রোটোকল। এটি প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্ন রেকগনিশন প্রিন্সিপালের উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি (হেনেস অ্যাণ্ড সিম্পসন, এমআইটি ১৯৯৪, ১৯৯৭, ২০০১), ফলে এ সিস্টেম কারও চেনা থাকলে, এবং প্রচুর প্র্যাকটিস থাকলে, শুধু তখনই চাহিদা অনুযায়ী কেউ সিকিউয়েন্স প্যাটার্ন পূরণ করতে পারবে। এই সিস্টেম কারও অচেনা হলে, এবং তার মোটর-নিউরাল রিফ্লেক্স অস্বাভাবিক দ্রুত না হলে কেউ-ই এই সিস্টেমকে বশ করতে পারবে না (ওপি. সিইটি. জেফ ওয়াকার এবং ফ্রেড বেইন্স, ইউএসএএমআরএমসি, ন্যাটো এমএনআর আর স্টাডি)।
এসব প্রিন্সিপাল অনুযায়ী, ফিল্ড টেস্ট-এ দেখা গেছে, কর্তৃপক্ষ নয় এমন কেউ টাচলক-৯ ব্যবহার করতে চাইলে এই সিস্টেম থাকে প্রায় ৯৯.৯৫% নিরাপদ। অন্য যে-কোনও মিলিটারি সিকিউরিটি সিস্টেম ব্যবহারে এতটা সাফল্য পাওয়া যায়নি।
প্রোটোকল সমূহ:
টাচলক-৯ ইউনিটের তিনটি প্রোটোকল:
১। প্রক্সিমিটি কর্তৃপক্ষ নন এমন কেউ টাচলক-৯ ইউনিট আর্মিং/ডিসআর্মিং করতে চাইতে পারে, কাজেই এই ইউনিট ডেলিভারি সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়নি। প্রথম প্রোটোকল ডেলিভারি সিস্টেমের প্রক্সিমিটি। লিয়ার্ড মিসাইলের সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিটের ষাট (৬০) ফুট দূর থেকে চালু করা সম্ভব হবে টাচলক-৯।
২। লাইট-সেন্সর রেসপন্স ইউনিট: একবার ষাট ফুটের ভিতর ওই ইউনিট নিয়ে গেলে, তখনই শুধু ওয়ায়ারলেস মডেমের মাধ্যমে ডিসআর্ম সিস্টেমের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে ড্রাগন কর্পোরেশনের অত্যাধুনিক লাইট-সেন্সর ইন্টারফেস কাজ শুরু করবে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী জরুরি দায়িত্ব পালন করবে প্যাটার্ন রিকগনিশন সিস্টেম। (দেখুন ন্যাটো এমএনআরআর রিসার্চ প্রোগ্রাম রেজাল্ট, ইউএসএএমআর এমসি।)
৩। সিকিউরিটি কোড: ডিসআর্ম বা ওভাররিড কোড বন্ধ করতে হলে এন্ট্রি ব্যবহার করতে হবে।
শেষ লাইনে হাতে লিখেছে ডেনিস ই. ম্যাকিন:
ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড নির্দিষ্ট করা হয়েছে জেনারেল রেমণ্ড কে, গ্র্যাঞ্জারের মাধ্যমে। নতুন তথ্য অনুযায়ী ওই মার্সেন প্রাইম সংখ্যা এখনও জানা সম্ভব হয়নি।
প্রোটোকল সেকশনে সংযুক্ত করা হয়েছে আরেকটি পৃষ্ঠা। ওটা মোসাদের ইন্টারসেপ্ট করা টেলিফোন ট্র্যান্সক্রিপ্ট:
ট্র্যান্স লগ: বি-২-৩০০২-৮৭৯
ডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৫১৬ আওয়ার্স ই.এস.টি.
রেক ফ্রম: ড্রাগন কর্পো, নরফোক, ভিএ, ইউএসএ
কাটসা: ডেনিস ই. ম্যাকিন (৪৪৩-৭৬০২)।
ভয়েস ওয়ান (জেংকিন্স, আর.জে. ড্রাগন চিফ অভ ইঞ্জিনিয়ারিং): স্যর, ডি.ও.ডি ইন্সপেকশন রিপোর্ট ভাল। আমাদের অগ্রগতি দেখে তারা খুবই খুশি। বিশেষ প্রশংসা করেছে টাচলক-৯ পরীক্ষা করে। যিশু, এরা যেন নতুন খেলনা পাওয়া বাচ্চা হয়ে উঠেছিল। বারবার কোড ভাঙতে চেয়েছে।
ভয়েস টু (ডেমিয়েন ডগলাস, ড্রাগন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও সিইও): খুবই খুশি হলাম, জেংকিন্স। এক্সেলেন্ট। আর কিছু?
ভয়েস ওয়ান (জেংকিন্স); এরা জানতে চেয়েছে পরেরবার কখন ইন্সপেকশন করবে। ডি.ও.ডি. পরবর্তী তারিখ চাইছে।
ভয়েস টু (ডেমিয়েন ডগলাস): অক্টোবর মাসের পনেরো তারিখ হলে কেমন হয়? আমাদের প্রজেক্টের কয়েকজন পার্টনার সময়টা পেলে খুশি হবে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল খবির।
তার মানে কোনও কারণে ওই তারিখকে নির্ধারণ করা হয়েছে।
অক্টোবরের পনেরো। অর্থাৎ আগামীকাল।
ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্সের ইন্সপেক্টররা হাজির হবে ডেমিয়েন ডগলাসের ইন্সটলেশন প্লান্টে।
পরের ডকুমেন্ট পড়তে শুরু করেছে খবির। এবং ঠিক তখন। হঠাৎ করেই বুঝল, কেন শুরু হয়েছে বাউন্টি হান্ট।
সব ডকুমেন্টের ভিতর এই সামান্য নথি, কিছুই নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ওটা ড্রাগন কর্পোরেশনের একটি ইন্টারনাল ই-মেইল:
ফ্রম: আর. জে.
টু: অল ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ, প্রজেক্ট সি-০৫১
ডেট: অক্টোবর ১, ৮:৪৫ পি.এম.
সাবজেক্ট: নেক্সট ডি.ও.ডি, ইন্সপেকশন
লেডিজ অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আপনাদেরকে জানাই আমার কৃতজ্ঞতা। আমাদের ছয়মাসের পরিশ্রম পণ্ড হয়নি। খুব ভালভাবেই শেষ হয়েছে ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্স কমিটির ইন্সপেকশন। আপনারা প্রচণ্ড পরিশ্রম। করেছেন, তাই সবাইকে জানাই ধন্যবাদ।
ডি.ও.ডি.-র তারা মুগ্ধ হয়েছেন আমাদের অগ্রগতি দেখে। হতবাক হয়েছেন আমাদের টেকনোলজিকাল উন্নতি দেখে।
এবং বহু সাধনার পর শেষ হয়ে এসেছে আমাদের কাজ। অক্টোবরের ১৫ তারিখে নরফোক ইন্সটলেশন প্লান্টে শেষ ইন্সপেশনের জন্য দুপুর বারোটার সময় জড় হব আমরা। অবশ্য সবাইকে জায়গা করে দেয়া সম্ভব নয়। আপনাদের পক্ষ থেকে হাজির হবেন প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের প্রধান। এ ইন্সপেশনের এক সপ্তাহ আগে থেকেই কঠোর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্সের ভিতর দিয়ে যেতে হবে।
আর.জে.
টনক নড়ে গেছে খবিরের।
আগামীকাল অক্টোবরের ১৫।
ড্রাগন কর্পোরেশনের ভার্জিনিয়ার নরফোক-এ মিসাইল নির্মাণ ফ্যাসিলিটিতে ইন্সপেশনে যাবে আমেরিকার নিরাপত্তা বিভাগের অফিসাররা।
তখনই টের পাবে, ওই প্লান্টে কিছু বদলে গেছে। পাল্টে নেয়া হয়েছে কিছু মিসাইল। বা কিছু মিসাইল কম থাকবে। বা আরও কিছু। তখনই আমেরিকার সরকার খুঁজতে বাধ্য হবে। মাসুদ স্যরকে। কারণ গোটা দুনিয়ায় তিনিই একমাত্র মানুষ যিনি টাচলক সিস্টেম ডিসআর্ম করতে পারেন।
এমন মানুষ, যার রিফ্লেক্স টাইফুনের মত। ওই তালিকা। ওখানে স্যরের মত আরও কয়েকজন আছে।
আরেকটা চিন্তা ঢুকেছে খবিরের মগজে। যে কারণেই হোক, ডেমিয়েন ডগলাস এবং ম্যাজেস্টিক-১২ চাইছে আমেরিকার সরকার আগামীকাল ইন্সপেকশন করুক। কারণটা কী, বুঝতে পারছে না ও। কিন্তু ওই লোকগুলোর পরিকল্পনার একটা অংশ ওই ইন্সপেকশন।
আরেকটি বিষয় আরও পরিষ্কারভাবে বুঝল খবির।
ওই বাউন্টি হান্ট বোধহয় সতর্ক করে দেয়ার জন্য। এম-১২ সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে, আমাদের সঙ্গে লাগতে এসো না।
এখন ওসব বাদ যাক।
আগামীকাল দুপুর বারোটার আগেই আমেরিকার সরকার। হাড়ে হাড়ে টের পাবে, মস্ত কোনও গোলমাল আছে ড্রাগন কর্পোরেশনের নরফোক প্লান্টে। লিযার্ড মিসাইল বদলে গেছে। বা উল্টোপাল্টা করছে নোয়ায লঞ্চ শিপগুলো। আর ওই পরিবর্তন ম্যাজেস্টিক-১২ কাউন্সিলের প্রয়োজন। নইলে হয়তো শুরুই হবে না নতুন কোল্ড ওঅর।
আমাদের দ্রুতগতি বিমান লাগবে, গম্ভীর সুরে বলল খবির। ঘুরে চাইল চার্লস ডেলাসের দিকে। আপনাদের দেশের নিরাপত্তা বিভাগে যোগাযোগ করুন। বলবেন, যেন আগেই শুরু হয় নোয়ায-লিয়ার্ড ইন্সপেকশন। গুয়ামের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সতর্ক করুন। তদন্ত করা হোক ড্রাগন কর্পোরেশনের সব প্লান্টে।
তাই করা হবে, কথা দিল ডেলাস।
নানান সংখ্যার লঞ্চ লিস্ট আবারও দেখল খবির। ওখানে রয়েছে লঞ্চ সাইটের জিপিএস কো-অর্ডিনেট এবং টার্গেট। খুঁজে বের করুন কোথা থেকে এসব মিসাইল উৎক্ষেপ করবে। আর ওগুলো পড়বেই বা কোথায়।
নিজেই দেরি না করে সামনের কমপিউটারে জিপিএস প্লটিং প্রোগ্রাম চালু করল খবির। স্যাটালাইট রেডিয়োতে বলল, স্যর! আমি খবির! ভয়ঙ্কর খারাপ খবর আছে…
চার
ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নের কাছেই।
ব্রিটানির উপকূল, দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স।
অক্টোবরের, ১৪। বিকেল সাড়ে পাঁচটা।
একটু আগে কুয়াশা ও তিশার ট্রাকের সামনে ঝুলছিল ড্রাগন কর্পো লেখা কপ্টার। এখন দুই বন্দিকে নিয়ে পাহাড়ের উপর দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। ওই কপ্টার ফোট্রেস
দো শ্যাটিয়নে ফিরিয়ে নিচ্ছে কুয়াশা ও আহত তিশাকে।
পাহাড়ের পায়ের কাছে সাগরের গভীর অংশে ভাসছে একজন। একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওই কপ্টারের দিকে।
মাসুদ রানা।
জ্বলন্ত ম্যাগ রিগ রাস্তা ছাড়তেই গিয়ে লাগল ভাসমান মিরাজ ফাইটারের নাকে, কিন্তু তখন ওখানে ছিল না রানা।
রাস্তা থেকে ট্রাকের চাকা সরতেই ড্রাইভারের দিকের দরজা। খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মুহূর্তের জন্য ওর মাথার উপর দিয়ে গেছে ট্রাক।
তারপর ফাইটারে গিয়ে লাগল ইয়াজদাহা রিগ। তখনই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো। আওয়াজে তালা লেগে গেল কানে। চারপাশে ছিটকে গেল ভাঙাচোরা, পোড়া ধাতব টুকরো।
ওই বিস্ফোরণের তিরিশ ফুট নীচেই ছিল রানা। সাঁই-সাই করে পড়ছে, আর তখনই দেখল, উপরে কমলা আগুনের গোলা। তিশা বা কুয়াশা ওর পতন দেখেনি। ট্রাক থেকে খসে পড়বার সময় নিজেকে সত্যিকারের বুলেট মনে হয়েছে রানার।
প্রথমে ভেবেছিল ম্যাকহুক ব্যবহার করবে। পরক্ষণে মনে পড়ল, ওটার প্রপেল্যান্ট শেষ।
পড়তে লাগল ও, কিন্তু তখনও ট্রাকের গতিবেগের কারণে একপাশে ছিটকে যাচ্ছে। পাশ কাটিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে খাড়া পাহাড়ের প্রাচীর। গতি প্রচণ্ড। নীচে দেখল সাগরের অসংখ্য ঢেউ। তীরের মত উঠে আসছে সব। এত উপর থেকে সাগরে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে ফেটে চুরচুর হবে দেহ। ব্যাপারটা অনেক উপর থেকে টমেটো ছেড়ে দেয়ার মতই।
কিছু তো করো! নিজেকে ধমক দিয়েছে রানা।
মন উল্টো বলল: গাধা! আমি আবার কী করব!
তখনই মনে পড়ল ওর…
বুকের ওয়েবিঙের রিপকর্ডে হ্যাচকা টান দিল ও।
ওই রিপকর্ড ছিল পিঠে ঝুলে থাকা অ্যাটাক প্যারাশুটের। হারকিউলিস বিমানে উঠবার পর থেকেই ওটা সঙ্গে ছিল। জিনিসটা এতই চ্যাপ্টা, ভুলেই গিয়েছিল ওটার অস্তিত্ব।
ফটাশ আওয়াজ তুলে মাথার উপর ছাতার মত খুলে গেল। অ্যাটাক প্যারাশুট, তখনও আশি ফুট নীচে সাগর।
প্যারাশুট পুরোপুরি মন্থর করল না রানার পতন।
তবে নিরাপদেই নামল সাগরে। ঝপাস্ করে পড়েই তলিয়ে গেল। পরের কয়েক সেকেণ্ডে খুলে ফেলল প্যারাশুটের দড়ি দড়া। নেমে চলেছে নীল পানির ভিতর। চল্লিশ ফুট উপরে বিস্ফোরিত হয়েছে পানি। মস্ত সব বুদ্বুদ তৈরি হলো।
আগেই প্রাণপণে সরতে শুরু করেছে রানা।
কয়েক মুহূর্ত পর নেমে এল ভারী ম্যাক রিগ ও ভাঙা মিরাজের কাঠামো। ধাতব অংশগুলো তখনও আগুনের মত গরম, ফেস-ফেস আওয়াজ তুলছে। রানাকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেল অনেক গভীরে। তার আগেই নিভে গেছে সব জ্বালা।
পঁয়তাল্লিশ সেকেণ্ড পর পাহাড়ের সামান্য দূরে ভেসে উঠল রানা। দেখল, সাগরের একটা জায়গা জুড়ে ফাইটার বিমানের অংশ এবং তেল জ্বলছে।
সাবধানে নিজেকে লুকিয়ে রাখল রানা, নানা আবর্জনার ভিতর ভাসছে। দুই মিনিট পর দেখল, পাহাড়ের মাথা টপকে ফিরতি পথ ধরেছে কপ্টার, চলেছে দুর্গের দিকে।
তিশা আর কুয়াশা পালাতে পেরেছে? ভাবল রানা, নাকি বন্দি ওরা কপ্টারের ভেতর?
তিশা! প্রায় ফিসফিস করে থ্রোট মাইকে বলল রানা। আমি বেঁচে আছি। তুমি কোথায়?
জবাবে মৃদু কাশি শুনল রানা। ওদের পুরনো কৌশল। আপাতত কথা বলতে পারবে না তিশা। ওকে বন্দি করা হয়েছে।
একের জন্য হ্যাঁ, দুইয়ের জন্য না–তুমি কি একটু আগে দেখা ড্রাগন কর্পোরেশনের কপ্টারে?
খুক করে কাশির আওয়াজ এল।
তুমি কি ভয়ঙ্করভাবে আহত?
কাশির আওয়াজ। সত্যি গুরুতর আহত?
অস্পষ্ট দুবার কাশি।
কাঠের মত শুকিয়ে গেল রানার গলা।
তোমার সঙ্গে কুয়াশা আছেন?
ছোট্ট কাশি।
ওরা কি তোমাদেরকে দুর্গে নিয়ে যাচ্ছে?
মৃদু কাশি।
ওখানে অপেক্ষা করবে, আমি পৌঁছে যাব।
তীরের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করবে, তার আগে চারপাশ দেখে নিতে চাইল রানা। ধক্ করে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। মাত্র দু শ গজ দূরে এসে থেমেছে ফ্রেঞ্চ ডেস্ট্রয়ার।
এইমাত্র একদিকের ডেক থেকে সাগরে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে ছোট প্যাট্রল বোট। ওটার নিচ ডেকে কমপক্ষে বারোজন লোক।
সাগরে নামতেই বৈঠা মেরে রওনা হয়ে গেল বোট
আসছে ঠিক ওর দিকেই। চুপ করে ভেসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করবার নেই।
নিশ্চয়ই অ্যান্টার্কটিকার ওই সাবমেরিন দুর্ঘটনার কথা ভুলে গেছে ওরা, মনে মনে বলল রানা। পরক্ষণে চোখ রাঙানি দিল নিজেকে। তুই হলে কখনও ভুলতি, ব্যাটা?
তখনই কানের ভিতর কথা বলে উঠল ইয়ারপিস।
স্যর! আমি খবির! ভয়ঙ্কর খারাপ খবর আছে!
সন্দেহ কী, মনে মনে বলল রানা। হ্যাঁ, খবির, বলো।
কথা শুনতে পারবেন? সময় লাগবে।
সময় সংক্ষিপ্ত। আটলান্টিকের ঢেউয়ের মাঝে উঠছে নামছে রানা। বলতে যখন চাও, সংক্ষেপে বলো। চোখ রেখেছে বোটের উপর। ওটা মাত্র দেড় শ গজ দূরে। দুঃখের কথা, এবার পৃথিবী ত্যাগ করছি।
নিশ্চয়ই যাবেন, স্যর… তওবা-তওবা! কী হয়েছে, স্যর?
বাদ দাও। কী বলবে বলো।
এখন জেনেছি কেন আপনাকে মেরে ফেলতে চাইছে।
খবির, রেডিয়ো প্যাঁচ করো। তিশা আর কুয়াশাও কথাগুলো। শুনুক। যদিও ওরা কথা বলতে পারবে না।
রেডিয়োর নির্দিষ্ট বাটন টিপে নিল খবির।
সংক্ষেপে বলল সুপারট্যাঙ্কার ও লিয়ার্ড ক্লোন মিসাইলের কথা। নতুন করে কোল্ড ওঅর তৈরি করতে চাইছে এম-১২। বড় শহরগুলোর উপর মিসাইল ফেলবে তারা। টাচলক-৯ সিস্টেম সম্পর্কে বলল, ওটা দিয়ে মিসাইল ডিসআর্ম করতে পারবে ওই তালিকার কয়েকজন। নতুন করে ইউএস ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড বসিয়েছেন জেনারেল এ্যাঞ্জার। ম্যাকিন বলেছে, ওটা মার্সেন প্রাইম সংখ্যা।
কথাগুলো শুনে ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। মার্সেন প্রাইম… এসব সংখ্যা তো… ওর চোখে ভেসে উঠল জেনারেল এ্যাঞ্জারের ছিন্ন মাথা। ভদ্রলোককে ড্রাগ দিয়েছিল ব্রিটিশ এজেন্টরা। ঠিক কথাই বলছিলেন লিযার্ড প্রজেক্ট সম্পর্কে। আর নোয়ায শিপ.. দুটোই জড়িত প্রজেক্ট। জাহাজ আর মিসাইল মিলে… সব ছদ্মবেশী মারণাস্ত্র। প্রতি সপ্তাহে বদলে নেয়া হবে ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড়। এ মুহূর্তে ওটা সেভেন্থ মার্সেন…
বিমানে ড্রাগ দেয়া জেনারেলের কথা শুনে রানা ভেবেছিল, ভদ্রলোক নেশার ভিতর আবোল-তাবোল বলছেন মার্সেনারিদের বিষয়ে।
তা নয়।
সত্যি কথাই বলছিলেন জেনারেল।
মাত্র বলতে শুরু করেছিলেন সংখ্যা।
খবির সংক্ষেপে সব বলছে, আর একইসময়ে কমপিউটারে লঞ্চ লিস্ট থেকে জিপিএস কো-অর্ডিনেন্টস্ অনুযায়ী টার্গেট কী তা খুঁজতে শুরু করেছে চার্লস ডেলাস। এক সেকেণ্ড পর বলল, আমি প্রথম তিনটা জাহাজের কো-অর্ডিনেটস্ পেয়ে গেছি। পরের লাইনের সংখ্যাগুলো টার্গেট করা শহর।
প্রিন্টআউট বের করে খবিরের হাতে ধরিয়ে দিল সে। কাগজে হাইলাইট করা হয়েছে নির্দিষ্ট সব জায়গার নাম।
চট করে কাগজে চোখ বোলাল খবির। বলল, স্যর, প্রথম জাহাজ ইংলিশ চ্যানেলে। শারবার্গের কাছে। একটু দূরে নরম্যাণ্ডি সৈকত। ওই জাহাজ থেকে লণ্ডন, প্যারিস ও বার্লিনের উপর মিসাইল ফেলা হবে। পরের দুই জাহাজ থেকে মিসাইল পড়বে নিউ ইয়র্ক ও স্যান ফ্রান্সিসকোতে। প্রতিটি জাহাজ কয়েকটা করে শহর উড়িয়ে দেবে।
চুপ করে আছে রানা। এক শ গজ দূরে পৌঁছে গেছে প্যাট্রল বোট।
মনোযোগ দিয়ে কথা শোনো, খবির, বলল রানা। তখনই। নিচু ঢেউ ছলাৎ করে লাগল ওর মুখে। থু-থু করে লবণাক্ত পানিঃ মুখ থেকে ফেলল রানা। এসব জাহাজের বারোটা বাজিয়ে দিতে। পারে সাবমেরিন। যদি তলিয়েই যায় জাহাজ, একটা মিসাইলও। লঞ্চ করতে পারবে না। আমেরিকানদের জানাও, নোয়ায শিপ প্রজেক্টের প্রতিটি জাহাজের জিপিএস লোকেশন লাগবে, তারপর অ্যাটাক সাবমেরিন দিয়ে নিজেদের জাহাজ ডুবিয়ে দিক ওরা।
আলাপে যোগ দিল ডেলাস, এতে কাজ হতে পারে। কিন্তু সব ট্যাঙ্কার ভোবাতে পারব না আমরা।
সেক্ষেত্রে জাহাজে উঠতে হবে। সাইলোর ভেতর ডিসআর্ম করতে হবে মিসাইল। শুনলাম, ডিসঅর্ডার হিসেবে লাইট সিগনাল রেসপন্স ইউনিট ব্যবহার করা হবে। ইউনিটের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে ডিসআর্ম প্রোগ্রামের–তথ্য। ষাট ফুটের ভেতর পৌঁছাতে হবে, নইলে কাজ করবে না মিসাইলের কন্ট্রোল কন্সেল। একইসময়ে সব জায়গায় উপস্থিত হওয়া অসম্ভব। বুঝতেই পারছেন, প্রতিটি জাহাজে উঠতে হবে আপনাদের সৈনিকদের। মিসাইলের সঙ্গে আমার স্যাটালাইট কানেকশন থাকতে হবে।
স্যর,-প্রতিটি জাহাজে উঠতে হবে? জানতে চাইল খবির।
হ্যাঁ, খবির। সাবমেরিন জাহাজগুলোকে ডুবিয়ে দিতে না পারলে, প্রতিটি নোয়ায শিপেই উঠতে হবে। মিসাইলের কলোলের ষাট ফুটের ভিতর যেতে হবে। কলোলের স্যাটালাইট আপলিঙ্ক আমার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আর তখনই আমি টাচলক ইউনিট ব্যবহার করে সবকটা মিসাইল থামিয়ে দিতে পারব।
খাইছে, স্যর! বলল খবির। তো আমি কী করব এখন?
আরেকটা ঢেউ ডুবিয়ে দিল রানাকে। ভেসে উঠেই বলল ও, আগে প্রথম তিন জাহাজ ঠেকাও। প্রথমে যাবে নিউ ইয়র্কে, খবির। আর মিস্টার ডেলাসকে বলো মানচিত্রে এসব জাহাজের অবস্থান স্থির করুন। প্রথম জাহাজ আছে ইংলিশ চ্যানেলে। ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডি সৈকতগুলোর কাছেই শারবার্গ। কেভিন কনলনের সঙ্গে যোগাযোগ করো। ওকে স্যান ফ্রান্সিসকোতে পাঠাও। এমন লোক চাই, যারা এসব ট্যাঙ্কার। ভাল করে চেনে। যদি বাঁচি, আমি নিজেই ইংলিশ চ্যানেলের জাহাজে উঠব। আরেকটা কথা, খবির, কেভিনের কাছে জিজ্ঞেস করবে, সেভেন্থ মার্সেন প্রাইম নাম্বার কী। যদি না জানে, যেন জেনে নেয়।
আর শেষ কথা, আগামীকাল বারোটার আগেই যেন ড্রাগন কর্পোরেশনের মিসাইল তৈরির কারখানায় হাজির হয় ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্সের ইন্সপেক্টররা। জানতে চাই ওখানে কী ঘটল।
আগেই ওই কাজ করতে বলে দিয়েছি, বলল খবির।
গুড।
আপনি এখন কী করবেন, স্যর?
রানার মাথার পাশে এসে থেমেছে ফ্রেঞ্চ প্যাট্রল বোট। রক্তচোখে ওকে দেখছে নাবিকরা। বাগিয়ে ধরেছে ফ্যামাস অ্যাসল্ট রাইফেল।
এখনও খুন করেনি, নিচু স্বরে বলল রানা। বোধহয় কথা বলতে চাইছে কেউ। তার মানে, এখনই মরব না। দেখা যাক।
কী হয়। …আউট, রানা।
অস্ত্রের মুখে বোটে তুলে নেয়া হলো ভেজা বেড়ালের মত চুপসে যাওয়া মাসুদ রানাকে।
.
ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির হেডকোয়ার্টার।
সাব-লেভেল থ্রি। পেন্টাগন। অক্টোবর ১৪। রাত সাড়ে দশটা।
এইমাত্র অফিসে ফিরেছে কেভিন কনলন। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত, পরনে নোংরা পোশাক। এতই খারাপ লাগছে শরীর, মন চাইছে। গলা ছেড়ে কাঁদতে। দুপাশে দুই কঠোর চেহারার পুলিশ।
পুলিশ-স্টেশনে ওর বস জন ওয়ার্নের মতই আরেক গাধা অফিসার ওকে আটকে রেখে বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তার ধারণা, কেভিনই একের পর এক খুন করছে বীভৎসভাবে। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ব্যাটা বসিয়ে রেখেছে চারঘণ্টা। এবং পরে অসংখ্য প্রশ্নের জবাবে পেট থেকে বেরয়নি কিছুই ওর। কেভিন বলতে পারত, চাকরি করে ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির হেড কোয়ার্টারে। কিন্তু কিছুই বলেনি। মনে ছিল ভীষণ ভয়, এরাই হয়তো খুনি বা বাউন্টি হান্টার এবার হয়তো শেষ করে দেবে ওকে। অনেক পরে ভাবল, হতাশ হয়ে ছেড়ে দেবে অফিসার। কিন্তু গাধাটা যখন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আগামীকাল কোর্টে খুনি হিসাবে ওকেই চালান দিতে চাইল, বাধ্য হয়ে অফিসের ঠিকানা এবং ফোন নম্বর দিয়েছে। এর আধঘণ্টা পর গম্ভীর দুই পুলিশের পাহারায় ওকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে পেন্টাগনের এই অফিসে।
কেভিনের জন্যই অপেক্ষা করছিল জন ওয়ার্ন, রাগে গরগর করছে মনে মনে। অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে তার। কিন্তু মেরিয়ান রয়ে গেছে কনলনের খবর পাওয়ার জন্য, কাজেই… এখন পাশে দাঁড়িয়ে আছে রূপসী মেয়েটি।
কনলন! গর্জে উঠল ওয়ার্ন, শুনি, কোন চুলায় গিয়েছিলে!
এবার আজকের মত ছুটি নেব, নিচু স্বরে বলল কনলন।
তা তো নেবেই, বাঁকা হাসল ওয়ার্ন। কিন্তু তার আগে
কিছু কথার জবাব দিতে হবে। পেন্টাগনের সিকিউরিটি রেগুলেশনের ৪০২ এবং ৪০৩ আইনের আওতায় নিয়ম ভাঙার কারণে…
বড্ড ক্লান্ত কনলন, হতাশ হয়ে মেনে নিল এবার তাকে ঝাড়া হবে জঘন্য ভাষায়। ওয়ার্ন লোকটা আস্ত ডাকাত। আর সামনে কোনও সুন্দরী মেয়ে থাকলে তো…
…এবং এরপর ঘাড় ধরে বের করে দেয়া হবে তোমাকে এই অফিস থেকে। আর চাকরি থাকছে না তোমার। এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে, বিশেষ কেউ নও তুমি। …তোমার গায়ে টোকা দেয়া যাবে না, তাই ভেবেছ! তোমার মত কাপুরুষ… চট করে মেরিয়ানের দিকে দেখে নিল ওয়ার্ন। একদিন এ সুযোগ পাবে ভেবে নিরানন্দ জীবন পার করছিল সে। হ্যাঁ, তোমার মত কাপুরুষরাই এ দেশের মস্ত ক্ষতি করছে। আর যারা আমার মত দেশের জন্য লড়াই করতে ভয় পায় না, যারা শক্ত হাতে ধরতে জানে অস্ত্র, নিজ জীবন দিয়ে দিতে পারে…
কথাটা শেষ করতে পারল না সে।
কারণ তখনই ঝড়ের মত অফিসে এসে ঢুকল বারোজনের রেকনেসেন্স মেরিনদের একটি দল। পরনে পূর্ণ ব্যাটল ড্রেস, হাতে ভারী অস্ত্র –কোল্ট কমাণ্ডো অ্যাসল্ট রাইফেল, এমপি-৭, চোখে খুনির দৃষ্টি।
বিস্ফারিত হলো কেভিন কনলনের দুই চোখ।
মেরিনদের নেতা দাঁড়িয়ে পড়ল ঘরের মাঝে। কঠোর সুরে বলল, আমি মেজর স্কট মোসলে, ইউনাইটেড স্টেটস্ অভ মেরিন কর্পস। কেভিন কনলনকে খুঁজছি।
মস্ত ঢোক গিলল কেভিন।
হাঁ হয়ে গেছে সুন্দরী মেরিয়ান। কী অপরাধ করেছে আপাত নিরীহ কেভিন? মনটা দমে গেল ওর। সত্যি পছন্দ করতে শুরু করেছিল ভদ্র এই যুবককে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে…
ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে, ওয়ার্ন। কী হয়েছে, স্যর? মিহি সুরে বলল, কী করেছে এই কালপ্রিট?
ওয়ার্নের সামনে থামল মেজর। বিশালদেহী লোক সে। সারা দেহে পোক্ত পেশি। ব্যাটল ড্রেসে তাকে আজকালকার সিনেমার সব রোবটের মত দেখাচ্ছে।
তুমি বোধহয় জন ওয়ার্ন? বলল সে, আমার কাছে নির্দেশ এসেছে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। ভয়ঙ্কর এক আন্তর্জাতিক দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে। আর সেকারণে মিস্টার কনলন এ মুহূর্তে দেশের চার নম্বর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি
আমাকে বলে দেয়া হয়েছে, দরকার পড়লে জীবন দিয়েও তাকে রক্ষা করতে হবে। এখনই এস্কোর্ট করে নিয়ে যাব ওঁকে। কাজেই, মিস্টার ওয়ার্ন, সামনে থেকে সরে যাও।
হতবাক হয়ে ছাগলের মত ঘোলাটে চোখে চেয়ে রইল ওয়ার্ন। একেবারেই ভেঙে চুর-চুর হয়ে গেল বুকটা। হাড় শয়তান কেভিন কনলনকে বাদ দিয়ে এখন আর ওর প্রতি আগ্রহ দেখাবে মেরিয়ান?
মুগ্ধ চোখে কেভিনের দিকে চেয়ে আছে মেরিয়ান।
অবাক চোখে নোংরা পোশাক পরা যুবককে দেখছে মেজর।
ইতস্তত, করল কনলন, কাকে বিশ্বাস করবে আর কাকে করবে না, বুঝতে পারছে না। আজ দুপুর থেকে যা শুরু হয়েছে!
মিস্টার কনলন, বলল মেজর মোসলে, মিস্টার রানার তরফ থেকে এক বাংলাদেশি সার্জেন্ট আমাকে পাঠিয়েছে। জানিয়েছে, আবারও আপনার বিশেষ সাহায্য প্রয়োজন মিস্টার রানার। আমার কথা বিশ্বাস না করলে…
রেডিয়ো বাড়িয়ে দিল মেজর।
ওটা নিল কেভিন।
ওয়ায়ারলেস যন্ত্রটা থেকে কথা বলে উঠল সার্জেন্ট খবির।
আধঘণ্টা পর চার্টার্ড এক এগযেকিউটিভ জেট বিমানে উঠল কনলন।
প্রায় সুপারসনিক গতি তুলে রওনা হলো বিমান স্যান ফ্রান্সিসকো শহর লক্ষ্য করে।
এয়ারপোর্টে যাওয়ার পথে ওকে ব্রিফ করেছে খবির। খুলে বলেছে কী কারণে কেভিনের সহায়তা মাসুদ রানার প্রয়োজন। আরেকটা বিষয় জানতে চেয়েছে: কী আসলে সেভেন্থ মার্সেন প্রাইম নাম্বার।
সেভেন্থ মার্সেন নাম্বার? বলেছে কনলন, ওটা বের করতে কলম লাগবে, কয়েকটা কাগজও। আর… ও, একটা সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর।
এ মুহূর্তে প্যাসেঞ্জার কেবিনে বসে মাথা খাটাতে শুরু করেছে ও। খসখস করে লিখছে প্যাডে। গভীর মনোযোগ। খেয়ালই নেই দেশের আরেক প্রান্ত লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে একা।
অবশ্য একা বললে চরম মিথ্যা হবে, ওর দেখভাল ও পাহারার কাজে রয়েছে ইউএস মেরিন কর্পসের বারোজনের চৌকস একটি দল।
পাঁচ
হোয়াইট হাউস।
ওয়াশিংটন, ইউএসএ। অক্টোবর ১৫। সকাল সোয়া নয়টা। অনেক লোকের গুনগুন হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে। নানাদিকে ছুটছে এইড।
সিকিয়োর ফোনে কথা বলছেন মস্ত সব জেনারেল ও অ্যাডমিরালরা।
প্রত্যেকের মুখে একটু পর পর নোয়ায শিপ, লিয়ার্ড প্রজেক্ট এবং মাসুদ রানার নাম উচ্চারিত হচ্ছে।
কিন্তু কেউ হদিস দিতে পারছে না বিসিআই-এর এজেন্ট মাসুদ রানা কোথায়।
নেভির এক অ্যাডমিরালের আগে হনহন করে হেঁটে মস্ত রুমে ঢুকলেন প্রেসিডেন্ট। তাঁর কানে ফোন রেখে পিছনে হাঁটছেন অ্যাডমিরাল রনসন।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, নিচু স্বরে বললেন, গতকালই চার্লস ডেলাক্রুসের সঙ্গে কথা হয়েছে। মিস্টার রানা বলেছিল অ্যাটাক সাবমেরিন ব্যবহার করতে। কিন্তু আমরা তার সঙ্গে একমত নই। কোথাকার কোন্ ভেতো বাঙালি বলবে, আর আমরা তার কথায় নাচতে থাকব… স্যর, আপনি নিশ্চই চান না ইউএস নেভি ওই লোকের সামান্য অঙ্গুলি নির্দেশে…
আহ, অ্যাডমিরাল, ধমকের সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট। আগেই এসব আমাকে জানানো হয়নি কেন?
আপনি তখন অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন, স্যর। মেজর রানা যা বলেছেন, তাই করুন, বললেন প্রেসিডেন্ট। উনি যা চান, তাই যেন করা হয়। যদি বলেন সাবমেরিন পাঠাতে, তাই করবেন। যদি বলেন, নর্থ কোরিয়াকে ব্লক করতে হবে, আমরা তাই করব। ভেবেছিলাম আগেই এসব বুঝতে পেরেছেন আপনারা! মাসুদ রানার প্রতিটি কথার বিরুদ্ধে আমার কান ভাঙাচ্ছেন আপনারা! অথচ আপনাদের মাথায় ঢুকছে না, ওই একটি লোকের কাঁধে ভর করে চলছে বর্তমান সভ্যতা! তাকে চিনি, বিশ্বাসও করি। নিজের জীবন সঁপে দিতে পারি তাঁর হাতে নিশ্চিন্তে। তিনি, যে নিউক্লিয়ার বোমা ফেলতে বলেননি, এতেই আপনাদের খুশি থাকা উচিত। অক্ষরে অক্ষরে ভদ্রলোকের কথা মত কাজ করুন, পরে আমাকে পরামর্শ দেবেন। এ মুহূর্তে ডিপ্লয় করুন আমাদের প্রতিটি অ্যাটাক সাবমেরিন।
.
ড্রাগন কর্পোরেশন শিপবিল্ডিং অ্যাণ্ড মিসাইল অ্যাটাচমেন্ট প্লান্ট, নরফোক, ভার্জিনিয়া।
অক্টোবর ১৫। সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিট।
এ মুহূর্তে ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্সের ইন্সপেক্টরদের ঘিরে রেখেছে ইউনাইটেড স্টেটস মেরিনের দুটো দল। নোয়ায শিপ ও লির্ড জয়েন্ট প্রজেক্ট বিষয়ক ভার্জিনিয়ার নরফোক প্লান্টের দিকে চলেছে সবাই।
কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেল সবাই ড্রাগন কর্পোরেশনের আকাশ ছোঁয়া প্রকাণ্ড সব দালানের সামনে। মস্ত জায়গা নিয়ে ওই প্লান্ট। একের পর এক দালান। একটার সঙ্গে আরেকটা সংযুক্ত। রয়েছে বিশাল সাতটি ড্রাই-ডক। আকাশের নাক তুলেছে অসংখ্য ক্রেন।
এই প্লান্টেই তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক মিসাইল সিস্টেম। ইউএস নেভাল ছদ্মবেশী ভেসেলে বসিয়ে দেয়া হয়েছে সেসব মিসাইল। কখনও কখনও নিজেরাও মস্ত সব জাহাজ তৈরি করে এখানে ড্রাগন কর্পোরেশন।
এ মুহূর্তে একটি ড্রাই-ডকে চুপ করে বসে আছে মস্ত এক সুপারট্যাঙ্কার। ওটাকে প্রায় ঘিরে রেখেছে একের পর এক ক্রেন। ওগুলো অনেক উপরের আকাশে উঠেছে।
অবাক কাণ্ড, সাড়ে নয়টার বেশি বাজে, কিন্তু কোথাও নেই কেউ।
ঝড়ের মত প্লান্টে ঢুকল মেরিনরা। বাধা এল না কোথাও থেকে। গোলাগুলি নেই, লড়াই হওয়ারও সম্ভাবনাও নেই। কয়েক মিনিটের ভিতর প্লান্ট সিকিয়োর বলে ঘোষণা দেয়া হলো।
রেডিয়োতে মেরিন কমাণ্ডার জানাল: আপনারা ডি.ও.ডি.-র ছেলেরা আসতে পারেন। কিন্তু আগেই সতর্ক করছি, ভিতরের পরিস্থিতি মোটেও ভাল নয়!
গন্ধটা দম আটকে দেয়ার মতই। একেবারে পচে গেছে মানুষের লাশ।
জমাট বাঁধা থকথকে রক্ত ও লাশগুলোর ক্ষতের উপর ভনভন করে উড়ছে হাজারে হাজারে রক্ত-মাংস লোভী মাছি।
প্রধান অফিস এলাকায় বয়ে গেছে রক্তের স্রোত, দেয়ালে ছিট-ছিট খয়েরি দাগ। বেঞ্চগুলোর উপর কাদার মত রক্ত গড়িয়ে নেমেছে স্টেয়ারকেস বেয়ে, তৈরি করেছে বীভৎস লালচে স্ট্যালাকটাইটিস।
ড্রাগন কর্পোরেশনের কর্মীদের কপাল ভাল, ইন্সপেকশন শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই তাদেরকে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছিল। সিকিউরিটি লকডাউন করা হয়েছিল বলেই তাদেরকে করুণভাবে মরতে হয়নি।
কোম্পানির সিনিয়র সব ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপার্টমেন্ট প্রধানদের কপাল মন্দ। পাশাপাশি পড়ে আছে মেইন ল্যাবের সামনে, ছাড়া হয়নি কাউকে। এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। মৃতদেহগুলোর পিছনের দেয়ালে ছলাৎ করে লেগেছে রক্ত।
গত একসপ্তাহ ধরে মহাআরামে লাশ খেয়েছে অসংখ্য ইঁদুর।
অন্যান্য লাশ থেকে দূরে পাঁচটি মৃতদেহ। তারা ড্রাগন কর্পোরেশনের লোক নয়।
এমন নয় যে ড্রাগন কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা লড়াই ছাড়াই মরেছে। তাদের সিকিউরিটি ফোর্স আগন্তুকদের কজনকে শেষ করেছে।
এই পাঁচ লাশ পড়ে আছে প্লান্টের নানা জায়গায়। পাশেই তাদের একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল।
পরনে কালো মিলিটারি পোশাক। মাথায় আরবী কালো হাওলি বা বিড়ে।
প্রত্যেকের কাঁধে বিশেষ ডাবল-সিমিটার টাটু। ওটা ব্যবহার করে টেরোরিস্ট অর্গানাইযেশন গ্লোবাল জিহাদ।
কিছুক্ষণের ভিতর ক্ষতি অ্যাসেস করল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের ইন্সপেক্টররা। তাদেরকে সহায়তা করল এফবিআই ও আইএসএস–এর এজেন্টরা।
গুয়ামের ড্রাগন প্যাসেফিক প্লান্টে ইন্সপেকশন করতে যাওয়া দ্বিতীয় টিম থেকে ফোন এল। একইরকম ম্যাসাকার করা হয়েছে ওখানেও।
এ খবর পাওয়ার পর বিশেষ একটি সিকিয়োর ফোনে হোয়াইট হাউসের এইডের সঙ্গে যোগাযোগ করল ডি.ও.ডি.-র এক সিনিয়র ইন্সপেক্টর।
খবর খুব খারাপ, স্যর, বলল সে, নরফোকে আমরা পনেরোটা লাশ পেয়েছি। নয়জন ইঞ্জিনিয়ার, ছয়জন সিকিউরিটি স্টাফ। শত্রু খতম হয়েছে পাঁচজন। সবাই টেরোরিস্ট। লাশের ফরেনসিক থেকে বোঝা গেছে, এরা মারা গেছে ছয়দিন আগে। ঠিক কখন খুন হয়েছে, বুঝবার উপায় নেই। একই ঘটনা ঘটেছে। গুয়ামে। অবশ্য মাত্র একজন টেরোরিস্ট মরেছে।
নরফোকের পাঁচ টেরোরিস্টকে আইডেন্টিফাই করেছে এফবিআই। এরা গ্লোবাল জিহাদের লোক। তাদের একজন ওই সংগঠনের কাতলা, নাম শাহেদ করিম। কিন্তু এসবের সবচেয়ে খারাপ দিক হচ্ছে, স্যর: এই হত্যাকাণ্ডে আরও অনেক টেরোরিস্ট জড়িত ছিল। নরফোকের প্লান্ট থেকে হারিয়ে গেছে তিনটি সুপার-ট্যাঙ্কার। গুয়াম থেকে গেছে দুটো।…এবং, স্যর, এসব সুপার-ট্যাঙ্কারের সঙ্গে উধাও হয়েছে লিয়ার্ড প্রজেক্টের মিসাইলও।
.
এইমাত্র ফ্রেঞ্চ উপকূলীয় এয়ারস্পেসে ভেসে উঠেছে একটি কুচকুচে কালো ফাইটার বিমান।
গতকাল সন্ধ্যায় হাজির হয়েছে পাহাড়ি এলাকায়। একটু আগেও লুকিয়ে ছিল দুই পাহাড়ের মাঝের সংকীর্ণ উপত্যকায়। ঝোঁপঝাড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল ওটাকে।
বিকেল তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
মন্থরগতিতে ভ্রমরের মত উপকূলীয় দুর্গ শ্যাটিয়নের দিকে চলেছে কালো বিমান।
রঘুপতি, বলল নিশাত, হঠাৎ কোথায় চললে? আমরা কিন্তু এখনও মাসুদ স্যর বা অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি।
তা ঠিক।
তা হলে কোথায় চলেছি?
জরুরি কাজে। জানবেন, কিন্তু পরে।
বিরক্ত হলো নিশাত। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে এবার কথাটা পাড়ল, একটা কথা জানতে চাই তোমার কাছে।
বলুন।
তোমার মত, এত ভাল রোবট ভয়ঙ্কর ওই বিজ্ঞানীর সঙ্গে কেন? গতরাতে খবিরের সঙ্গে কথা বলে, এবং পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানলাম অসংখ্য মানুষ মেরেছে কুয়াশা।
মানুষটা তিনি মোটেও খারাপ নন, নিচু স্বরে বলল রঘুপতি। মনে হলো না এসব কথা শিখিয়ে দেয়া, চিন্তা-ভাবনা করেই বলেছে।
কোন দিক দিয়ে ভাল?
কখনও কখনও খুন করেন বটে, কিন্তু তার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ থাকে। ধরুন না কয়েক বছর আগের ওই সুদানের ঘটনা। আল-কায়দার ওপর হামলা করতে গেল আমেরিকান ডেল্টা ইউনিট। বোধহয় আমেরিকান আর্মিতে তাদের গুপ্তচর ছিল, আগেই সরে পড়েছিল আল-কায়দার সবাই। ওই ওয়্যারহাউসে কাউকে না পেয়ে খেপে গেল ডেল্টা ফোর্স। এক মাইল দূরে ছিল বসের গবেষণাগার, ওটা ধ্বংস করে দিল।
কখনও কারও সঙ্গে সামান্যতম বিশ্বাসঘাতকতা করেননি বস। ডেল্টা ইউনিট তাঁকে বন্দি করে নিয়ে গেল পোর্ট সুদানের এক পরিত্যক্ত লাইটহাউসে। কপ্টারে সিআইএ-র লোক ছিল। সে ইন্টারোগেট করল: বসের নতুন জেনেটিক গবেষণার সব তথ্য চাই তার।
তিনি যখন কিছুই বললেন না, মেরে ফেলতে চাইল তাঁকে।
বাঁচল কী করে তোমার বস?
ওঁকে কপ্টার থেকে নামিয়ে লাইটহাউসে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। আগেই কৌশলে হ্যাণ্ডকাফ খুলে ফেলেছিলেন বস। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা এক সৈনিকের অস্ত্র কেড়ে নেন। তাঁকে ঠেকাবার আগেই ডেল্টা ফোর্সের ওই তেরোজনকে হত্যা করেন। বন্দি করতে চেয়েছিলেন সিআইএ-এর লোকটাকে। কিন্তু পাল্টা গুলি করতে গিয়ে মরল সে। অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করেননি বস।
খুব সংক্ষেপে বললে, জানাল নিশাত। এরপর কী হলো?
ওই লোকগুলোকে হত্যার জন্য দায়ী করা হলো বসকে। তার মাথার উপর পাঁচ মিলিয়ন ডলারের বাউন্টি ঘোষণা করল আমেরিকান সরকার। পরে একটা স্কোয়াড পাঠানো হলো বসকে শেষ করতে। তাদের একজনও আর ফিরতে পারেনি।
চুপ হয়ে গেছে রঘুপতি।
কথা বাড়াল নিশাত।
নীচে পাহাড়ি রাস্তা। এখানে-ওখানে মস্ত সব গর্ত। পথের শেষে ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।
চিন্তায় ডুবে গেছে নিশাত।
গতকাল সন্ধ্যা থেকে বারবার যোগাযোগ করতে চেয়েও মাসুদ স্যরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
.
ফ্রেঞ্চ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার।
সামান্য দূরে উপকূল। ১৫ অক্টোবর।
বিকাল তিনটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
গতকাল উপকূলীয় সাগর থেকে প্যাট্রল বোটে তুলে নেয়ার পর রানাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ফ্রেঞ্চ ডেস্ট্রয়ারে। ওখান থেকে ওকে নিয়ে রওনা হলো প্রকাণ্ড এক নেভাল পিউমা কপ্টার। পৌঁছে দিল চার্লস দ্য গল ক্লাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে।
ফ্লাইট ডেকে কপ্টার অবতরণ করতেই নীচে নামতে লাগল এলিভেটার। পৌঁছে গেল নীচের একটা ডেকে। রানা দেখল। সারি সারি অসংখ্য মিরাজ ফাইটার, অ্যান্টি সাবমেরিন বিমান, ফিউয়েল ট্রাক ও জিপগাড়ি।
ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নামাতেই এগিয়ে এল চারজন সিনিয়র ফ্রেঞ্চ অফিশিয়াল।
তাদের একজন নেভির অ্যাডমিরাল। দ্বিতীয়জন আর্মির জেনারেল। তৃতীয়জন এয়ারফোর্সের কমোডর। চতুর্থ লোকটার পরনে ধূসর সুট।
তার নির্দেশেই রানার ডান বাহুতে কী যেন ড্রাগ পুশ করল এক সেকেণ্ড কমাণ্ডার।
তখনই ভীষণ ঘুম পেল রানার, পরক্ষণে লুটিয়ে পড়ল মেঝের উপর।
আমাদের জন্য আরও তথ্য আসছে, তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব ওর, মিলিটারির তিন উচ্চপদস্থ অফিসারকে জানাল ধূসর সুট।
কফিনের মত বদ্ধ এক কুঠুরিতে নিয়ে আটকে রাখা হলো। অচেতন রানাকে।
আবার যখন চেতনা ফিরল ওর, চুপ করে পড়ে রইল। চোখের পাতা সামান্য ফাঁক করে চারপাশ দেখল। মিটমিট করে জ্বলছে হলদে বাল।
দুই হাত পিঠে হ্যাণ্ডকাফে আটকানো। রানা টের পেল, হাতে ঘড়ি আছে। অনেক কসরত করে ঘড়ি দেখল। ফ্রেঞ্চ স্থানীয় সময় অনুযায়ী এখন দুপুর একটা। পেটে প্রচণ্ড খিদে। গলা ও বুক শুকনো কাঠের মত খটখটে। ছিঁড়ে পড়বে যেন মাথা, প্রচণ্ড ব্যথা।
একবার গিয়ে দরজা পরখ করেছে, ওই ভারী লোহার কবাট ভাঙবার সাধ্য ওর নেই।
ফিরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকল রানা।
অনেকক্ষণ পর খটাং আওয়াজ তুলে খুলে গেল দরজা। ভিতরে এসে ঢুকল চারজন সশস্ত্র নাবিক। হ্যাচকা টানে তুলে নেয়া হলো রানাকে, ধাক্কা দিয়ে বের করে আনা হলো কফিন থেকে।
সরু করিডোরে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলল ওকে। সিলিঙে টিমটিমে হলদে আলো।
দুমিনিট পর চওড়া প্যাসেওয়েতে পড়ল ওরা। রানার দুপাশে দুজন, পিছনে দুজন। আবারও সেই প্রকাণ্ড হল ঘরে হাজির হলো ওরা।
আগের মতই অসংখ্য মিরাজ ফাইটার, অ্যান্টি সাবমেরিন বিমান, ফিউয়েল ট্রাক ও জিপগাড়ি।
হাজির হয়েছে সেই চার অফিশিয়াল।
অবশ্য রানার চার প্রহরী ছাড়াও এখন বাড়তি দুজন গার্ড অস্ত্র হাতে তৈরি।
চারপাশ দেখে নিল রানা। এটা মেইন্টেন্যান্স হ্যাঙার। কোথাও পারসোনেলদের দেখা গেল না।
অদ্ভুত থমথম করছে মস্ত ঘর।
নীরবতা ভাঙল আর্মির জেনারেল, তা হলে তুমি সত্যিই বিসিআই-এর মাসুদ রানা। অ্যান্টার্কটিকায় একা শেষ করেছিলে আমার সেরা প্যারাট্রুপারদের।
অ্যাডমিরাল বলল, ওই দুঃখজনক দুর্ঘটনার সময় গোটা সাবমেরিন হারিয়েছি। আজও ওটাকে খুঁজে পাইনি আমরা।
শালারা কিচ্ছু ভোলেনি, ভাবল রানা। দ্বিগুণ হলো ওর মাথার ব্যথা।
ধূসর সুট পরা লোকটা সামনে বাড়ল। অত্যন্ত চৌকস সে। নিখুঁত উচ্চারণে ফ্রেঞ্চ বলে। ব্যাটাকে খুবই বিপজ্জনক মনে হলো রানার।
মোসিউ রানা, আমার নাম প্লেসি মোহনি, এসেছি ডিরেক জেনাখালে দে লা সিকিউখিতি এক্সেতেখিয়েখ থেকে।
ডিজিএসই বা বহির্বিশ্ব নিরাপত্তা ডিরেক্টরেট জেনারেল, ভাবল রানা। আমেরিকানদের আইএসএস-এর মতই, ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সংগঠন। মোসাদের কথা বাদ দিলে দুনিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি ওটা।
গলা এমনিতেই শুকিয়ে আছে, ঢোক গিলতে গিয়ে রানা টের পেল জিভও শুকিয়ে গেছে।
মিস্টার মোহনি, বলুন তো ব্যাপারটা কী? কর্কশ স্বর বেরোল ওর কণ্ঠ থেকে। ফ্রান্স তা হলে ম্যাজেস্টিক-১২ কাউন্সিলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে? নাকি শুধু ডেমিয়েন ডগলাসের সঙ্গে?
বুঝলাম না কী বোঝাতে চাইছেন, হালকা সুরে কথাটা উড়িয়ে দিল মোহনি। আমরা শুধু জানি, মোসিউ ডগলাস আমাদের জন্যে, অর্থাৎ ফ্রান্সের জন্যে চমৎকার ট্যাকটিকাল অ্যাডভানটেজ তৈরি করেছেন। তাঁর সংগঠনকে বাহাবা না দিয়ে পারছি না আমরা।
আমাকে ধরে এনেছেন কেন?
আমি খুশি হব তোমার হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিতে পারলে, বলল আর্মি জেনারেল।
আর ওটা তোমার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে খাব আমি, বলল অ্যাডমিরাল।
আমি কিন্তু আপনাদের মত নই, অনেক প্র্যাকটিকাল, শান্ত স্বরে বলল মোহনি। পরেও আপনারা যার যার ইচ্ছে পূরণ করতে পারবেন। তার আগে আমার কিছু প্রশ্ন আছে ওর কাছে। জানতে চাই মোসিউ ডগলাসের পরিকল্পনা পুরো ফুলপ্রুফ কি না।
পাশের বেঞ্চে ব্রিফকেস রাখল সে। ওটা খুলতেই দেখা গেল ছোট ধাতব ইউনিট। জিনিসটা হার্ড বাউণ্ড বইয়ের সমান হবে।
কোনও মিনি-কমপিউটার, ভাবল রানা। যন্ত্রটার মাঝে দুটো স্ক্রিন। উপরের অংশে বড় স্ক্রিন। নীচের স্ক্রিন ছোট এবং ডানদিকে।
উপরের স্ক্রিনে একের পর এক লাল ও সাদা গোলাকার কী যেন। জ্বলজ্বল করছে।
নীচের ছোট স্ক্রিনে দশ ডিজিটের কি-প্যাড। আধুনিক সব টেলিফোনেই ওই জিনিস থাকে।
মেজর রানা, বলল মোহনি, জিনিসটা দেখছেন? এটাই টাচলক-৯ সিকিউরিটি সিস্টেম। আমরা জানতে চাই আপনি এটা ডিসআর্ম করতে পারেন কি না।
ছয়
ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।
ব্রিটানির উপকূল, ফ্রান্স। ১৫ অক্টোবর। বিকাল চারটা।
প্রায়ান্ধকার পাতাল ঘরে টেনে হিঁচড়ে আনা হয়েছে আহত তিশাকে। টান খেয়ে আরও ছিঁড়ে গেছে কাঁধের জখম। নতুন
করে ক্ষত থেকে পড়ছে রক্ত। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তিশার। প্রায়। অচেতন, ঘোরের ভিতর দেখল চারপাশে গোলাকার পাথুরে দেয়াল। সাগরের পানিতে ডুবে গেছে মেঝে। ঘরের গভীর অংশে সাঁতার কাটছে দশফুটি দুই হাঙর।
কয়েক মুহূর্তের জন্য জ্ঞান হারাল তিশা। চেতনা ফিরল খটাৎ আওয়াজ পেয়ে।
গিলোটিনের গর্দান রাখবার কাঠের তাকিয়ার উপর নেমেছে কাঠের আড়া, ওটা কঠিনভাবে চেপে ধরেছে ওর গ্রীবা। কাঠের তাকিয়া আড়তদারের ক্যাশবাক্সের আকৃতির, তবে বড়।
বিন্দুমাত্র মাথা নাড়াতে পারল না তিশা।
খটাং আওয়াজে গিলোটিনের লক আটকে দিল এক সশস্ত্র লোক।
আগে কখনও একে দেখেনি তিশা। মাথার চুলগুলো গাজর রঙের। চোখদুটো যেন কূপ, চাহনি মৃতের। চেহারাটা ক্ষুধার্ত ইঁদুরের মুখের মত।
কেন যেন শিউরে উঠল তিশা ভয়ে। মনে পড়ল রানার কথা। এখন যদি মস্ত মনের মানুষটা থাকত, যেমন করে হোক ওকে সরিয়ে নিত এখান থেকে।
চোখ তুলে উঁচু গিলোটিনের দিকে চাইল। বারো ফুট উপরে ঝুলছে ক্ষুরধার ব্লেড।
জ্বরের ঘোরে মুখ বিকৃত করল তিশা। ব্যথা। ভয়ঙ্কর। আগুনের মত জ্বলছে বুক ও কাঁধের ক্ষত। বোধহয় ভিতরে রয়ে গেছে ট্রেসার বুলেট। হাঁটু গেড়ে বসতেও কষ্ট হচ্ছে এখন।
ওই ইঁদুর-মুখের পাশে আরেক বাউন্টি হান্টার–কার্ট কে. এবেলহার্ডের বামহাত। সাইকোটিক এক্স রয়াল মেরিন। নাম ফিলিপ। একটু আগে কে যেন তাকে ওই নামে ডেকেছে। লোকটার হাতে শটায়ার-এইউজি অ্যাসল্ট রাইফেল। মাযল তাক করেছে ওর মাথা বরাবর।
লোকটার পরনে বিঘুঁটে কালো আলখেল্লা। যেন শেষ নেই পকেটের, ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে নানান অদ্ভুত ডিভাইস।
এমন কী পনি বটল ও মাউন্টেনিয়ারিং পিটন পর্যন্ত। সেগুলোর ভিতর আছে।
ওই আলখেল্লা কুয়াশার। মুখ তুলে চাইল তিশা। দেখতে পেল বৈজ্ঞানিককে।
পনেরো ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। সাগরের পানিতে দুই ইঞ্চি তলিয়ে গেছে পাথরের ওই মঞ্চের মেঝে। চোখ বুজে আছে বিজ্ঞানী। সানগ্লাস নেই। কূপের কারুকাজ করা পাথুরে দেয়ালে আটকে রাখা হয়েছে তাকে। দুই হাত শিকল দিয়ে বাঁধা। নল কাটা বন্দুকের দুই হোলস্টার এখন ফাঁকা।
উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠেছে জলমগ্ন ডানজনে।
গমগম করে উঠল একটা পুরুষ কণ্ঠ:
ঘুরতে ঘুরতে দূর থেকে দূরে সরছে বাজপাখি, আর শুনতে পেল না তার মালিকের কণ্ঠ। সবই যেন সরছে, কিছুই থাকছে না কেন্দ্রে। তারপর রইল শুধু বিশ্ব জুড়ে চরম অরাজকতা। …আমার ভুল না হয়ে থাকলে ওটা লিখেছেন ইয়েটস্।
দর্শকদের, ব্যালকনিতে হাজির হয়েছে ডেমিয়েন ডগলাস। পাশে বাউন্টি হান্টার কার্ট কে, এবেলহার্ড।
শার্ক পিটের দিকে চাইল ডগলাস, ভঙ্গি দেখে মনে হলো কলোসিয়াম থেকে দেখছেন কোনও রোমান সম্রাট। তার চোখ স্থির হলো তিশার উপর। বেচারি আছে কূপের পঞ্চাশ গজ দূরে।
অরাজকতা শুরু হয়েছে গোটা দুনিয়া জুড়ে, লেফটেন্যান্ট তিশা করিম, আবৃতির সুরে বলল ডেমিয়েন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, তাতে আমি খুবই খুশি। …তুমি খুশি নও?
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে তিশা, চাপা স্বরে বলল, না।
ডানজনের ভিতর প্রতিটি শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
তিশা করিম খুশি নয়, বলল ডেমিয়েন। চাইল কুয়াশার দিকে। কী বলব আপনাকে কুখ্যাত বৈজ্ঞানিক, না বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক? আপনার কাজ অত্যন্ত আপত্তিকর মনে হয়েছে। আমার। আপনি এই চমৎকার মানুষ-শিকার বন্ধ করতে চেয়েছেন। বারবার রক্ষা করেছেন মাসুদ রানাকে। যদিও জানেন, এর ফলাফল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর: চরম শাস্তি দেয়া হবে আপনাকে।
চুপ করে আছে কুয়াশা, চেয়ে রইল বিলিয়োনেয়ারের চোখে।
বুঝতে পারছি কাউন্সিলের প্ল্যানে বাধা দিতে চাইছে কেউ, বলল ডেমিয়েন। মাসুদ রানাকে রক্ষা করতে কে টাকা দিচ্ছে আপনাকে, কুয়াশা?
চুপ রইল কুয়াশা। মনে পড়েছে ওর প্রেমিকা লিলি মাখসাখের কথা। কথাটা ও-ই প্রথমে তুলেছিল, প্যারিসে।
প্রতি তিনটে কথায় অন্তত একবার যার নাম তোমার মুখে আসে, সেই মাসুদ রানাকে খতম করে দিচ্ছে ম্যাজেস্টিক-১২। তারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী। তুমি চাইলে তোমার প্রিয়। রানাকে সতর্ক করতে পারো।
লিলি ভাল করেই জানে কুয়াশার জন্য কী-ই না করেছে। মাসুদ রানা। তুলে নেয়া হয়েছে পুলিশের হুলিয়া, বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বিপুল টাকা দেয়া হয়েছে গবেষণাগার তৈরির জন্য। এখন আর পলাতক আসামী নয় কুয়াশা।
লিলির মুখে কথাটা শোনার পর সেদিন থেকেই খোঁজ-খবর নিতে শুরু করে কুয়াশা।
আপনি কিন্তু নিজের সর্বনাশ করছেন, চেহারায় হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে কুয়াশার দিকে চাইল ডেমিয়েন। ভেবে দেখুন, আমি যখন প্লয়ার্স দিয়ে হ্যাচকা টানে আপনার জিভটা ছিঁড়ে নেব, আফসোস করবেন আগেই মুখ খোলেননি কেন।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কুয়াশা। কথা বলল না।
দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে নিয়ে বলল তিশা, আমরা। তোমাদের সব প্ল্যান জানি, শয়তানের চেলা। তোমরা নতুন করে কোল্ড ওঅর তৈরি করতে চাইছ। আসলে পারবে না। প্রতিটি দেশের সরকার জেনে যাবে সব। আমরা এরই ভেতর আমেরিকান সরকারকে সবই জানিয়েছি।
নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ করল ডেমিয়েন।
মাই ডিয়ার লেফটেন্যান্ট তিশা, তুমি কি সত্যিই মনে করো। আমি কোনও সরকারকে ভয় পাই? প্রতিটি দেশের সরকার মানেই পেট-মোটা মাঝবয়সী একদল চোর-চোট্টার ক্লাব। নিজেদের লাল ফিতার বাঁধনে আটকা পড়েছে। গরীব দেশের সরকারের কথা বাদই দিই, পশ্চিমা সরকারগুলোরও একই অবস্থা সেখানে ঢুকে পড়েছে লোভী একদল অপদার্থ। উঁচু পদে যাওয়ার জন্যে কামড়া-কামড়ি করছে নর্দমার ইঁদুরের মত। সবারই চাই প্রেসিডেনশিয়াল বিমান, প্রাইম মিনিস্ট্রিয়াল। অফিস… ইত্যাদি। একটা আচ্ছন্নতার ভেতর আছে এরা।–আর নতুন এই কোল্ড ওঅর, নিচু হয়ে গেল ডেমিয়েনের কণ্ঠ, এই প্ল্যান আসলে কাউন্সিলের মূল প্ল্যান নয়, ওটা আমার সৃষ্টি আমার প্ল্যানে রয়েছে সত্যিকারের দূরদৃষ্টি।
ইয়েটস-এর কবিতার কথাই ভাবো, লেফটেন্যান্ট–সেই বাজপাখির মালিকের কথা, যে কিনা আর বাজপাখিটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। ভাবো এমন এক দেশের কথা, যে দেশ ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র কোনওভাবেই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। যেন নিজস্ব চিন্তা রয়েছে এসব অস্ত্রের। আঁচ করতে পারো ওগুলো কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে? ওদের সৃষ্টিকর্তার চেয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে ওরা। স্বাধীন হয়ে গেছে।
এবার ভাবো ইউএস ডিফেন্স ইণ্ডাস্ট্রির কথা। এ ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছে। কী ঘটবে যদি তাদের কর্তৃপক্ষের কথা কানে না। তোলে মিসাইল নির্মাতারা? যদি মিলিটারি ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ঠিক করে তারা আর ইউনাইটেড স্টেটস্ সরকারকে চায় না?
আপনারা ভাবছেন দখল করে নেবেন আমেরিকা? অবাক সুরে বলল তিশা।
কেন নয়? বাধা দেবে কে? হেসে উঠল ডেমিয়েন।
রানার মত আরও অনেকে বাধা দেবে, জোর দিয়ে বলল তিশা।
তোমরা ভাবছ বর্তমান দুনিয়াটাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে? ডগলাসের ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। আমরা যেখানে। আমেরিকাকেই পাত্তা দিচ্ছি না, সেখানে গরীব দেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কজন কী করবে? আগামীকাল থেকে আমাদের পা চাটতে শুরু করবে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা দেশ। আগে থেকেই পা চাটছে অনেকে। …আর তুমি বলছ মাসুদ রানার কথা। হ্যাঁ, আমাদের মিউঁচুয়াল ফ্রেণ্ড। …গুণ আছে তার, কি বলো? তুমি কি জানো, কাউন্সিল বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে তার বিষয়ে? লিস্টে তার নাম রাখা হয়েছে সেই কারণেই। মিথ্যা কথা বলে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল সাইবেরিয়ায়, এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, যাতে সহজেই ফাঁদে পা দেয় তোমার হিরো। বলতে বাধ্য হচ্ছি, কাউন্সিলের ওই কাঁচা প্ল্যান কাজে আসেনি।
অন্য সব প্ল্যানও বানচাল হবে।
কিন্তু তোমার প্রেমিক এখনও বেঁচে আছে, তিশার কথায় কান না দিয়ে বলল ডেমিয়েন। এটা বড় একটা সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।
এত ব্যথার ভিতরও হঠাৎ স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে গেল তিশার। ডেমিয়েন ডগলাসের দিকে চাইল। পরক্ষণে হিমশীতল স্রোত নামল মেরুদণ্ড বেয়ে। লোকটার চোখে কী যেন, আগে কখনও এমন ভয় লাগেনি ওর।
ডেমিয়েন ডগলাসের ওই দৃষ্টি কুয়াশাও দেখেছে, চমকে গেছে। মস্ত কোনও ক্ষতি করতে তৈরি হয়েছে লোকটা!
সোজা হয়ে দাঁড়াল কুয়াশা, শিকল আটকে রেখেছে দুই হাত। বুঝতে পারছে, ছিঁড়তে পারবে না গায়ের জোরে।
এখন কথা হচ্ছে, শুরু করল ডেমিয়েন, সাধারণ কোনও গল্প-কাহিনিতে আমার মত ভয়ঙ্কর ভিলেন বন্দি করে রাখত নায়কের প্রেমিকা লেফটেন্যান্ট তিশা করিমকে। নইলে কীভাবে বাগে পাবে নায়ককে? আর এ কথাই গতকাল থেকে ভাবছিল আমাদের কার্ট কে. এবেলহার্ড।
কিন্তু? বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল তিশা।
কিন্তু এই সিনেমার ভিলেন সাধারণ নয়, বলল ডেমিয়েন।
চুপ হয়ে গেছে সে। কঠোর চোখ দেখছে তিশাকে।
এটাই তফাৎ সাধারণ ভিলেনের সঙ্গে আমার, বলল ডেমিয়েন, আমি বাড়তি কিছু করতে চাই। নইলে মাসুদ রানা গর্ত থেকে বেরোবে কেন? যেন তার মনে হয় কাউন্সিলের প্ল্যানের পিছনে না দৌড়ে আমার পিছনে আসা অনেক জরুরি। …মিস্টার কোভাক!
ঠিক তখনই দেখা দিল ইঁদুর-মুখো কোভাক, খপ করে ধরল
সে গিলোটিনের রিলিজ লিভার।
ভয় পেল তিশা। চোখে আতঙ্কিত দৃষ্টি। ও বাঁচতে চায়। সারাটা জীবন পাশে থাকতে চায় রানার।
কুয়াশার চোখে চোখ পড়ল ওর। চাপা স্বরে বলল, মিস্টার কুয়াশা, যদি বেরিয়ে যেতে পারেন, আমার হয়ে একটা কথা বলবেন রানাকে? তিশার কণ্ঠ কাতর।
তা কী? শুকনো গলায় জানতে চাইল কুয়াশা।
বলবেন, আমি ওকে হ্যাঁ বলতাম।
আরেকবার ডেমিয়েনের দিকে চাইল কোভাক।
এবার টান দাও লিভারে, নির্দেশ দিল ডগলাস।
খবরদার, ডগলাস, কুকুরের বাচ্চা! গর্জে উঠল কুয়াশা, খুন হয়ে যাবি তুই আমার হাতে!
থমকে গেল ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। পরক্ষণে হাসল। তাই, কুয়াশা? কীভাবে মারবে আমাকে?
এবার কোভাককে নির্দেশ দেবে সে। বারো ফুট উপর থেকে রওনা হবে ক্ষুরধার ব্লেড। বিদ্যুদ্বেগে নামবে তিশার মরাল গ্রীবা লক্ষ্য করে।
কাঠের তাকিয়ায় জোরালো থাক্ আওয়াজ হবে! গিলোটিনের পায়ের কাছে খসে পড়বে মস্তকহীন তিশার দেহ।
আচ্ছা, কুয়াশা, কেন ভাবছ আমার ক্ষতি করতে পারবে? হাত তুলে কোভাককে থামতে ইশারা করল ডগলাস।
তিশা মনের চোখে দেখল, কাটা গলা থেকে জলপ্রপাতের মত ছিটকে বেরোচ্ছে রক্ত। ভিজে যাচ্ছে পাথরের মঞ্চ, ওই স্রোত নামছে মঞ্চের নীচে সাগরের পানিতে। চোখ বুজে ফেলল ও।
কারণ, আমি প্রতিশোধ নেব, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কুয়াশা। আমার হাত থেকে রক্ষা নেই তোর।
গিলোটিনের লিভারে হাত রেখে ডগলাসের দিকে চাইল কোভাক। তার ভাবতেই ভাল লাগছে, সুন্দরী মেয়েটির মাথা থেকে ধড় আলাদা হলেই পানিতে মিশবে রক্ত। আগ্রহী হয়ে ছুটে আসবে দুই হাঙর। তীরের মত দুটো ধূসর ছায়া ওরা, হাজির হয়েছে গিলোটিনের মঞ্চের কাছেই।
আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার, বলে উঠল ডগলাস। পারলে নিজেকে বাঁচাও!
শিকল ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে কুয়াশা, চেয়ে আছে ডগলাসের দিকে।
কোভাক! ধমকের সুরে ডাকল ডগলাস, আপাতত গিলোটিনের কাজ বন্ধ। জরুরি কাজ দেব তোমাকে, আমার অফিসে এসো। …আর হান্টার, চোখে মাযল ঠেকিয়ে নরকে পাঠিয়ে দাও কুয়াশাকে।
ডগলাসের দিকে চেয়ে আছে তিশা। ভাবছে, লোকটা বদ্ধ উন্মাদ, বড় দ্রুত পাল্টে নেয় সিদ্ধান্ত।
চোখে পড়ছে উজ্জ্বল আলো, কিন্তু সামান্যতম ব্যথা পাত্তা না দিয়েই ঘুরে চাইল কুয়াশা ডগলাসের দিকে। রাগে গনগন করছে সুদর্শন মুখ।
ডেমিয়েন ডগলাসের মৃত মাছের মত ঘোলা চোখে শীতল দৃষ্টি। মুখ যেন কোনও মুখোশ। ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্যালকনির দরজা পেরিয়ে চলে গেল নিজ অফিসের দিকে।
ইঁদুরের মুখের মত চেহারার কোভাক পিছু নিল একান্ত বাধ্য পোষা কুকুরের মত। গিলোটিনের পিছন দিকের লোহার দরজা খুলে উধাও হলো।
একইসময়ে হঠাৎ করেই কুয়াশার দিকে এগুতে লাগল ফিলিপ হান্টার, এগযেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-এর খুনি। হাতে রুপালি রেমিংটন শটগান, পরনে কুয়াশার কালো আলখেল্লা। পকেট ভরা নানান ডিভাইস।
ব্যালকনি থেকে হাত নেড়ে বলল কার্ট কে. এবেলহার্ড, গাধাটার চোখে মাযল ঠেকিয়ে গুলি করতে বলেছে, তারপর খাইয়ে দেবে হাঙর দিয়ে।
ইয়েস, স্যর, বলল হান্টার। আর কচি মালটা?
চাইলে রক্তাক্ত মেয়েটাকে ভোগ করতে পারো, পরে ওকে কূপের ভেতর ছেড়ে দিয়ো।
ইয়েস, স্যর। খুশিতে সবকটা দাঁত বেরিয়ে গেল।
কুয়াশা হত্যা এবং এরপর রূপসী মেয়েটিকে ধর্ষণের দৃশ্য দেখবার জন্য অপেক্ষায় রইল রেকণ্ডো কার্ট কে. এবেলহার্ড।
গিলোটিনের মঞ্চ থেকে শুরু হওয়া সরু সেতু পেরুতে শুরু করেছে বিশালদেহী হান্টার, কয়েক সেকেণ্ড পর পৌঁছে গেল কুয়াশার দেয়াল ঘেঁষা মঞ্চে। প্রতি পদক্ষেপে ছলাৎ ছলাৎ করে লাফিয়ে উঠছে সাগরের অগভীর পানি।
আসছে আততায়ী, চোখ কুঁচকে আশপাশ দেখে নিল কুয়াশা।
কোনও সুযোগ নেই বাঁচবার। চোখে দেখছে না বললেই চলে। দুই হাত শিকলে বাঁধা। অনেক কাছে চলে এসেছে খুনি।
ঝড়ের মত ভাবছে কুয়াশা, নীচের ঠোঁট এত জোরে কামড়ে ধরেছে, রক্ত বেরিয়ে গেল। কয়েক সেকেণ্ড পর রক্ত মেশানো থুতু ফেলল দূরে।
ছয়ফুট দূরে থামল ফিলিপ হান্টার। রেঞ্জের বাইরে রয়ে গেছে। কিছুই করতে পারবে না কুয়াশা। দুই পা দিয়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরা অসম্ভব। লাথি দেয়াও সম্ভব নয় অণ্ডকোষে।
কুয়াশার রুপালি রেমিংটন তুলল হান্টার, শিকারের চোখের দিকে মাযল তাক করেছে। অবিশ্বাস্য চিকন পিনপিনে কণ্ঠে বলল, আমি শুনেছিলাম তুমি বিজ্ঞানের জাদুকর। কোথায়? কিছুই তো করতে পারলে না!
আমি কে তা বুঝবে, থুতনি দিয়ে হান্টারের পায়ের দিকে দেখাল কুয়াশা।
ভুরু কুঁচকে ফেলল ফিলিপ হান্টার।
নিজের পায়ের দিকে চাইল। পানির ভিতর ওর বুটের পাশেই হাজির হয়েছে এক টাইগার শার্ক। এইমাত্র ওখানে রক্ত ভরা থুতু ফেলেছে কুয়াশা।
বাঙালি বৈজ্ঞানিক যা আশা করেছিল, ঠিক তাই হলো।
আরে… দশ ফুটি হাঙরের কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য দুই পা সরে এল লোকটা।
আর পড়ল তার চেয়েও বিপজ্জনক আরেক শিকারির আওতার ভিতর।
পরক্ষণে দশ নম্বর সাইক্লোনের বিপুল বেগের হাওয়ার মত নড়ে উঠল কুয়াশা। ৯১
চাবুকের মত উপরে ঝটকা দিয়ে উঠল ওর দেহ, পরক্ষণে পিছন থেকে দুই পায়ে পেঁচিয়ে ধরল হান্টারের বুকের পাঁজর। উরুর চাপ আরও বাড়ল, কুয়াশা শুনতে পেল বিশ্রী মড়াৎ-মড়াৎ মড়াৎ আওয়াজ। মটমট ভাঙছে লোকটার পাঁজরের হাড়।
প্রচণ্ড ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল ফিলিপ হান্টার, ছটফট করছে। অজগরের ভয়ঙ্কর বাঁধনের ভিতর।
তাকে নিজের কাছে সরিয়ে আনল কুয়াশা। ওর চাই ডিভাইস ভরা আলখেল্লা। পরক্ষণে একহাতে পকেট থেকে তুলে নিল মাউন্টেনিয়ারিং পিটন, ওটা বিধিয়ে দিল বামহাতের শিকলের উপর, ঝট করে খুলে দিল রিলিজ। প্রচণ্ড শক্তিশালী স্প্রিং ঠং আওয়াজ তুলে বিস্তৃত করল পিটনকে…
সঙ্গে সঙ্গে মড়াৎ করে ভাঙল পুরনো লোহার শিকলের আঙটা, মুহূর্তে খুলে গেল বামহাত।
উপরের ব্যালকনি থেকে সবই দেখছে কার্ট কে. এবেলহার্ড। অস্ত্র ঘোরাল সে কুয়াশার দিকে। কিন্তু দুই পায়ের জোরে নিজের আগে হান্টারকে রাখল বৈজ্ঞানিক।
তা ছাড়া, ফিলিপের কাছ থেকে আরও কিছু পাওয়ার আছে ওর।
মুক্ত বামহাতে দ্বিতীয় জিনিসটা তুলে নিল আলখেল্লার পকেট থেকে।
জিনিসটা খুদে ব্লো-টর্চের পাউচ।
ঝটকা দিয়ে থলে থেকে ব্লো-টর্চ নিল কুয়াশা, পরক্ষণে টিপে দিল ট্রিগার। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে জিনিসটা কাজে নামল ফিলিপ হান্টারের পিঠে।
জেগে উঠেছে মিনি ব্লো-টর্চ, ছিটকে বেরোল সুপারহিটেড নীল শিখা।
চিকন কিন্তু বিকট সুরে আর্তনাদ ছাড়ল ফিলিপ হান্টার।
গজালের মত নীল শিখা সহজেই পড়পড় করে ঢুকেছে তার দেহে, দুই সেকেণ্ড পর বেরিয়ে গেল দেহের সামনের দিক দিয়ে–যেন জ্বলজ্বলে তলোয়ার।
ফ্যাকাসে সাদা মখে হতবাক হয়ে গেছে মতপ্রায় বাউন্টি হান্টার, আস্তে করে এলিয়ে পড়ল কুয়াশার বুকে।
তুমি না খুব মজা করবে? চাপা স্বরে বলল বৈজ্ঞানিক। আরও ভালভাবে বাগিয়ে ধরেছে ব্লো-টর্চ। পুড়িয়ে খাক করে দিচ্ছে লোকটার দেহের অভ্যন্তর।
কয়েক সেকেণ্ড পর একেবারে শিথিল হয়ে গেল হান্টার।
তাকে পড়ে যেতে দিয়ে একইসময়ে টান দিয়ে ফিতাহীন আলখেল্লা খুলে নিল কুয়াশা। পরক্ষণে পিটন ব্যবহার করল ডানহাতের শিকলের উপর। মটাৎ করে ভাঙল আঙটা।
ফিলিপ হান্টার ধুপ করে পড়তেই ব্যালকনি থেকে কুয়াশাকে দেখতে পেয়েছে এবেলহার্ড। অস্ত্রের মাযল তাক করল সে কুয়াশার বুকে।
কিন্তু বাঙালি বৈজ্ঞানিক এখন পুরো মুক্ত।
মৃত হান্টারের লাশের ওপাশে ক্ষিপ্ত বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল কুয়াশা। সামনের মৃতদেহে বিধল একের পর এক গুলি।
কয়েক সেকেণ্ডে আলখেল্লা পরে নিল কুয়াশা, লাফিয়ে উঠেই রক্তে ভরা পানিতে টাইগার শার্কের নাকের কাছে ছুঁড়ে ফেলল লাশ। পরক্ষণে এবেলহার্ডকে হতবাক করে তুলে নিল রেমিংটন শটগান।
ভয়ঙ্কর শক্তিশালী গুলি লাগল এবেলহার্ডের মাথার পাশের দেয়ালে। ছিটকে গিয়ে পিছনে ঝাঁপিয়ে পড়ল, লোকটা।
দৌড়াতে শুরু করেছে কুয়াশা। গুলি করছে উপরের ব্যালকনি লক্ষ্য করে।
রেলিঙের ওপাশে লুকিয়ে পড়েছে এবেলহার্ড। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে গিলোটিনের কাছে পৌঁছে গেল কুয়াশা। দুটো গুলি পাঠাল ব্যালকনি লক্ষ্য করে, পরমুহূর্তে রেমিংটন নামিয়ে রেখেই দুই হাতে ধরল কাঠের তাকিয়ার উপরের অংশ।
অবিশ্বাস্য শক্তি নিয়ে মড়মড় করে ভেঙে ফেলল তিশার গ্রীবার উপরের কাঠের আড়া।
তিশা, পিছু নাও! চাপা স্বরে বলল বৈজ্ঞানিক। ভয় নেই!
কূপ ও মেঝের গভীর অংশে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক পানি।
ঘুরছে হাঙর।
ফিলিপ হান্টারের লাশ পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এক হাঙর, মস্ত সব কামড়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে মৃতদেহ। আর তর সইল দ্বিতীয় হাঙরের, সে-ও যোগ দিল উৎসবে।
তিশা আর ছুটতে পারছে না।
দৌড়ের ফাঁকে থেমে ওকে কাঁধে তুলে নিল কুয়াশা। দেখল, আবারও ব্যালকনির রেলিঙের ওপাশে উঠছে এবেলহার্ডের মাথা।
একহাতে রেমিংটন থেকে পর পর দুটো গুলি পাঠিয়ে দিল কুয়াশা ব্যালকনির দিকে।
কানের কাছে গুলির জোরালো ভ্রমর গুঞ্জন শুনে আবারও লুকিয়ে পড়ল লোকটা।
তিশাকে নিয়ে গভীর পুলের পাশে পৌঁছে গেছে কুয়াশা। দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানির ভিতর।
ক্ষত-বিক্ষত লাশ নিয়ে টানাটানি করছে দুই হাঙর। রক্তাক্ত ফেনা নানাদিকে ছিটকাচ্ছে।
পেরিয়ে গেল কয়েক মিনিট, তারপর থামল হাঙরের দাপাদাপি। আবারও শান্ত হলো পানি।
কোথাও দেখা গেল না কুয়াশা বা তিশাকে।
ভয়ঙ্কর ডানজন বা মৃত্যু-কূপে নেই ওরা।
ছয় মিনিট পর আহত তিশাকে নিয়ে ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নের বাইরের সাগরে খেপা ঢেউয়ের মাঝে ভেসে উঠল কুয়াশা। বাম কাঁধে তিশা, ডানহাতে পনি-বটল। ওটা থেকে অক্সিজেন দিয়েছে তিশাকে, নিজেও শ্বাস নিয়েছে।
দুর্গের নীচের শার্ক পিট থেকে গেছে দীর্ঘ প্যাসেজ, শেষে বেরিয়েছে ভোলা সাগরে। ওই দীর্ঘ পথ পেরিয়ে সাগর-সমতলে উঠে আসতে ওই মিনি স্কুবা বটল ব্যবহার করেছে কুয়াশা।
ডানজনের কূপে ঝাঁপিয়ে পড়বার আগে ডান কব্জির নির্দিষ্ট এক জায়গায় টোকা দিয়েছে। পরে আবারও ছোট্ট অপারেশন করে খুদে মাইক্রোচিপস নতুন করে অ্যাকটিভেট করবে।
সাগর-সমতলে ভেসে ওঠার পর পরই কুয়াশা দেখল, মাথার ওপর নেমে আসছে কুচকুচে কালো সুখোই এস-৩৭ ফাইটার বিমান। ওটার থ্রাস্টারের কারণে খেপে উঠেছে চারপাশের সাগর।
কয়েক সেকেণ্ড পর বিমান থেকে নীচে পড়ল হানেস।
খুলে গেছে বিমানের বম, বে।
একমিনিট পেরোবার আগেই তিশাকে নিয়ে বিমানের পেটে উঠল কুয়াশা।
আপনি ঠিক আছেন, বস? জানতে চাইল রঘুপতি। নতুন সানগ্লাস বাড়িয়ে দিল কুয়াশার দিকে।
ওটা নাকের উপর বসিয়ে নিল কুয়াশা, আস্তে করে মেঝেতে শুইয়ে দিল তিশাকে। জবাব দিল না রঘুপতির কথার, অবশ্য সামান্য মাথা দোলাল।
ককপিট থেকে বেরিয়ে এসেছে নিশাত, চমকে গেছে আহত তিশাকে দেখে, বসে পড়ল ওর পাশে।
তিশা!
আমি ঠিক আছি, আপা, দুর্বল স্বরে বলল তিশা। রানা… রানা… ও কোথায়?
রঘুপতি, রানার সঙ্গে যোগাযোগ করেছ? জানতে চাইল কুয়াশা। মাইক্রোডট রেখেছিলাম পাম পাইলটে। ওই গুড়ো লাগার কথা ওর হাতে।
অনেক আগেই তাকে পেয়েছি, বস, বলল রঘুপতি। সে আছে উপকূল থেকে সামান্য দূরে এক ফ্রেঞ্চএয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে। কথা বলিনি।
মনে মনে বলল নিশাত, রঘুপতি শালাকে বলেছিলাম, তুমি ভাল রোবট, তা মোটেও না–ভাল না কচু! শালা আগেই মুখ খুললে দুশ্চিন্তা থেকে রক্ষা পেতাম।
তিশার ক্ষত পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল নিশাত।
বিমানে ফার্স্ট এইড বক্স আছে, আপাতত তিশার পাশেই থাকুন, চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করুন, নিশাতকে বলল কুয়াশা। চাপা শ্বাস ফেলে বলল, এবার রানাকে বের করে আনতে হবে ওই জাহাজ থেকে।
সাত
উপকূল থেকে সামান্য দূরের আটলান্টিক মহাসাগর।
ফ্রেঞ্চ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ব্রিঁয়া পওলাস।
হ্যাঙারের পাশের এক স্টিলের ছোট ঘরে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে রানাকে। পিছনে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেছে দরজা।
একটা টেবিল ও চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই ঘরে।
রানা এখনও জানে না, টেবিলে প্লেসি মোহনির টাচলক-৯ ডিসআর্মিং ইউনিট। পাশেই উজ্জ্বল, লাল বাতি জ্বেলে বসে আছে। ফসফরাস গ্রেনেড।
ঘরের এক কোণে কালো কাঁচের ওপাশে ক্যামেরার ঝিরঝির আওয়াজ শুনল রানা।
মেজর মাসুদ রানা, স্পিকারে ভেসে এল ডিজিএসই-এর এজেন্টের কণ্ঠ, এটা খুব সহজ পরীক্ষা। আপনার সামনের টেবিলে যে ফরফরাস গ্রেনেড, তাঁর সঙ্গে শর্টওয়েভ রেডিয়োর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে টাচলক ইউনিট। গ্রেনেডটা ডিসআর্ম করতে হলে ব্যবহার করতে হবে ওই টাচলক ইউনিট। পরীক্ষার শেষে পৌঁছলে আপনি ডিসআর্ম কোড ব্যবহার করবেন। কোড: ১২২। মাত্র একমিনিট পর বিস্ফোরিত হবে গ্রেনেড। …এবার আপনার সময় শুরু হচ্ছে… আর আছে ঊনষাট সেকেণ্ড!
ঝট করে মেঝে ছেড়ে চেয়ারে গিয়ে বসল রানা, সারা গায়ে ব্যথা। কাছ থেকে দেখতে শুরু করেছে টাচলক-৯ ইউনিট।
জিনিসটা দুই ভাগে ভাগ করা; বামদিকে রয়েছে ছোট ছোট আটটি বৃত্তাকার লাল আলোর খোপ, আর ডানদিকে একই সমান পঁচিশটা সাদা আলোর খোপ। লাল বা সাদা যে-কোনও খোপে জ্বলে উঠবে আলো, এবং পরমুহূর্তে নিভে যাবে। রানার কাজ: নিভে যাওয়ার আগেই আলোকিত খোপ আঙুল দিয়ে স্পর্শ করা। এই প্যানেলের নীচে রয়েছে অনিয়মিতভাবে সংখ্যা লেখা বারোটি চাবি। বাতি ছোঁয়ার কাজে সফল হলে ওখানে কোড টিপতে হবে। স্ক্রিনে সঠিক কোড লেখা হলেই ডিজআর্ম হবে গ্রেনেড।
মেইন স্ক্রিন ভরে উঠছে সাদা ও লাল বৃত্তে বামে লাল, ডানদিকে সাদা। নীচের স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে বার্তা:
ফার্স্ট প্রটোকল (প্রক্সিমিটি); স্যাটিসফাইড.
ইনিশিয়েট সেকেণ্ড প্রটোকল।
এবার মেইন স্ক্রিনে দপদপ করতে শুরু করেছে সাদা বৃত্ত–প্রতিটি বৃত্ত মুহূর্তের জন্য টিপটিপ করছে। প্রতিবার সামান্য। সময়ের জন্য। ধীর গতিতে র্যাম সিকিউয়েন্স চলছে:
সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
ফেইল ডিসআর্ম অ্যাটেম্পট।
রেকর্ডেড।
থ্রি ফেইল্ড ডিসআর্ম অ্যাটেম্পট উইল
রেজাল্ট ইন ডিফল্ট ডেটোনেশন।
সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
রি-অ্যাকটিভেটেড।
আশ্চর্য তো! স্ক্রিনের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করল রানা।
আর পঞ্চাশ সেকেণ্ড, মেজর, জানিয়ে দিল মোহনি। নিয়ম মেনে সঠিক সময়ে ওই গোল বাতিগুলো স্পর্শ করুন।
বুঝলাম।
আবারও জ্বলতে শুরু করেছে সাদা বৃত্ত। একের পর এক।
চল্লিশ সেকেণ্ড…
দ্রুত হতে শুরু করেছে সাদা বৃত্তের সিকিউযেন্স। বৃত্তের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত চলছে রানার আঙুলগুলো। স্ক্রিনে একটি করে বৃত্ত স্পর্শ করছে।
হঠাৎ করেই বামদিকের ডিসপ্লেতে জ্বলজ্বল করে উঠল। একটা লাল বৃত্ত।
ওটার জন্য তৈরি ছিল না রানা। কিন্তু স্পর্শ করেছে সঠিক সময়ে। আগের মতই জুলতে এবং নিভতে লাগল সাদা বৃত্ত, গতি বাড়ছে আরও। ওগুলোর সঙ্গে বেড়ে গেল রানার আঙুল
নড়বার গতি।)
ত্রিশ সেকেণ্ড… ভালই তো করছেন, মেজর।
জ্বলে উঠেছে আরেকটা লাল বৃত্ত। এবার অনেক দেরি করে ফেলেছে রানা। জোরালো বিপ আওয়াজ ছাড়ল স্ক্রিন:
সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
ফেইল্ড ডিসআর্ম অ্যাটেম্পট রেকর্ডেড।
থ্রি ফেইল্ড ডিসআর্ম অ্যাটেম্পটস্ উইল
রেজাল্ট ইন ডিফল্ট ডেটোনেশন।
সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন):
রি-অ্যাকটিভেটেড।
ধুশশালা! বিড়বিড় করল রানা। চট করে দেখে নিল টেবিলে পড়ে থাকা গ্রেনেড। তারপর ভুলে গেল ওটার কথা।
আবারও সাদা বত্ত জলতে-নিভতে শুরু করেছে। শেষ বা তৃতীয়বারের জন্য চালু হয়েছে সিকিউয়েন্স।
পঁচিশ সেকেণ্ড বাকি…
কিন্তু এবার পুরোপুরি তৈরি রানা, জানা হয়ে গেছে কী করতে হবে। স্ক্রিনের উপর নাচতে লাগল ওর আঙুল। এক একটা সাদা বৃত্ত জন্ম নিতেই চট করে স্পর্শ করছে। একইভাবে আঙুল নাচতে লাগল লাল বৃত্তের উপর।
দশ সেকেণ্ড… নয়…
এবার ঝড়ের গতিতে জ্বলতে লাগল বৃত্ত। মুহূর্তে জ্বলছে লাল বৃত্ত, পরক্ষণে আবার যে-কোনও সাদা বৃত্ত- কি-বোর্ডে টাইপ করবার মত করে দ্রুত চলছে রানার আঙুল। তারই ফাঁকে ভাবল, পরীক্ষা চলছে আমার রিফ্লেক্সের।
আট… সাত…
ডিসপ্লে থেকে চোখ সরাল না রানা। নেচে চলেছে ওর আঙুল। ডান চোখে এসে পড়ল এক ফোঁটা ঘাম।
ছয়… পাঁচ…
নেচে চলেছে জ্বলন্ত সব বৃত্ত।
সাদা-লাল-সাদা-সাদা-লাল-সাদা…
চার… তিন…
স্ক্রিনে লাফিয়ে উঠল একটা মেসেজ:
সেকেণ্ড প্রটোকল (রেসপন্স প্যাটার্ন);
স্যাটিসফায়েড।
থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি):
অ্যাকটিভ।
প্লিয এণ্টার অথোরাইড
ডিসআর্ম কোড।
দুই…
কিপ্যাডে বিদ্যুদ্বেগে টাইপ করল রানা, টিপে দিল এণ্টার।
ছোট স্ক্রিনে ভেসে উঠল সংখ্যা।
এক….
একইসময়ে রানা টের পেল, কাজ হয়েছে
থার্ড প্রটোকল (কোড এন্ট্রি):
স্যাটিসফায়েড।
ডিভাইস ডিসআর্মড।
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা, হেলান দিয়ে বসল চেয়ারে।
কিন্তু আচমকা খুলে গেছে দরজা, ঘরে এসে ঢুকল প্লেসি মোহনি। হাততালি দিল বাচ্চাদের মত করে।
বাহ্, সাবাশ মেজর রানা! বাহ! ভেরি গুড!
মোহনির পিছনে ঘরে এসে ঢুকেছে দুই গণ্ডারের মত নেভাল কমাণ্ডো, দাঁড়িয়ে গেল রানার দুই পাশে।
খুশি মনে হাসল, মোহনি। সত্যিই চমত্তত হয়েছি। থ্যাঙ্ক ইউ, মেজর। আমরা ম্যাজেস্টিক-১২-র দাবি সম্পর্কে নিশ্চিত। হলাম। প্রশংসা না করে পারছি না এই ডিসআর্ম সিস্টেমের। সন্দেহ কী, ওটা ভবিষ্যতে বহুবছর নানান কাজে ব্যবহার করবে রিপাবলিক অভ ফ্রান্স। সত্যিই দুঃখজনক যে আপনাকে শেষ করে দিতে হবে। বয়েজ, মেজর রানাকে আবারও হ্যাঙারে নিয়ে যাও। ওঁকে ঝুলিয়ে দেবে অন্যজনের পাশে।
পাঁচ মিনিট পেরোবার আগেই হ্যাঙারের ভেতর মেঝে থেকে তিন ফুট উপরে ভেসে উঠল মাসুদ রানা। ফোর্কলিফটের লিফটিং প্রঙের দুই আড়ার উপর বাঁধা দুই পা। দুই কব্জির দুই হ্যাণ্ডকাফ আটকে দেয়া হয়েছে ভেহিকেলের ভার্টিকাল স্টিল রানারের সঙ্গে।
ব্রিঁয়া পওলাস এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের নির্জন মেইন হ্যাঙার বে-র এক কোণে পার্ক করা হয়েছে এই ফোর্কলিফট। সামনে বেশ কয়েকটা রাফায়েল ফাইটার জেটের : একস্ট। একটা ফাইটারের সামনে অর্ধচন্দ্রের মত করে চেয়ার ফেলা হয়েছে, সেখানে বসেছে তিন ফ্রেঞ্চ মিলিটারি অফিসার ও ডিজিএসই এজেন্ট।
রানাকে পাহারা দেয়া এক গার্ডকে খুশি খুশি স্বরে বলল প্লেসি মোহনি, যাও, নিয়ে এসো ব্রিটিশ গুপ্তচরটাকে।
পাশের দেয়ালে একটা বাটন টিপল লোকটা, আর তখনই উপরের দিকে উঠতে লাগল দেয়াল। বাস্তবে ওটা প্রকাও একটা স্টিলের দরজা। ওখান দিয়ে বেরোয় ফাইটার বিমান।
ওদিকটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
আঁধার থেকে বেরিয়ে এল দ্বিতীয় ফোর্কলিফট। ওটার লিফটিং প্রঙে বন্দি আরেক লোক।
ঠিক রানার মত করেই ক্রুসিফাই করা হয়েছে তাকেও। তফাৎ, এ লোকের ওপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার করা হয়েছে।
মুখ-হাত রক্তাক্ত, শুকনো রক্তে খয়েরি, হয়ে গেছে শার্ট। বুকের উপর নেমে এসেছে মানুষটার থুতনি।
আপনি হয়তো ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট রিচার্ড কে, ডওসনকে চেনেন না, মেজর রানা, বলল মোহনি।
ডওসন, ভাবল রানা।
সে এমআই-৬-এর লোক। বাউন্টি হান্ট তালিকার ভিতর ছিল। ধরে আনা হয়েছে।
গত কিছুদিন ধরে এম-১২-র বিষয়ে তথ্যের ভাণ্ডার হয়ে উঠেছিল ডওসন, বলল মোহনি। আমরা জানতে পেরেছি, গত দুবছর ধরে এম-১২-র চেয়ারম্যান ফ্রান্সিস ওলিফ্যাণ্টের কর্পোরেশনের ভিতর ঢুকে কাজ করছিল। কিন্তু ডওসন যেমন নজর রেখেছিল ওলিফ্যাণ্টের ওপর, ঠিক সেভাবেই তাকে খেয়াল করছিলাম আমরা।
গতকাল ডওসন আমাদেরকে দিয়েছে চমৎকার কিছু তথ্য, যেগুলো না পেলেই চলত না। আমাদের জানিয়েছে, এম-১২-র। এক তরুণ সদস্যের উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছিল ফ্রান্সিস ওলিফ্যান্ট। আর সে সদস্য আবার আমাদের বন্ধু ডেমিয়েন। ডগলাস।
ডওসনের বক্তব্য অনুযায়ী, ফ্রান্সিস ওলিফ্যান্ট বারকয়েক বলেছে, ওই ছোকরা ডগলাস বিরক্ত করছে নতুন করে প্ল্যান। করার জন্য।
এদিকে ডেমিয়েন ডগলাস মনে করছে ম্যাজেস্টিক-১২-র প্ল্যান যথেষ্ট দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নয়। আপনার তদন্ত অনুযায়ী, মেজর রানা, কী মনে হয়, নতুন করে প্ল্যান করা উচিত?
ডেমিয়েন ডগলাস আপনাদের বন্ধু মানুষ, শুকনো গলায় বলল রানা। তাকেই না হয় জিজ্ঞেস করুন।
দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্সের কোনও বন্ধু নেই।
কারণটা বুঝতে পারছি।
সহকারী রয়েছে আমাদের, বলল মোহনি। কিন্তু শত্রুদের মত করেই তাদের ওপরেও নজর রাখা হয়।
আপনি ডগলাসকে বিশ্বাস করেন না, মন্তব্য করল রানা।
এক সেকেণ্ডের জন্যেও না।
অথচ তাকে রক্ষা করছেন, যা খুশি করতে দিচ্ছেন–কেন?
যতক্ষণ আমাদের স্বার্থ এক, অসুবিধা কী? …কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমাদের স্বার্থ আলাদা হতে শুরু করেছে।
আপনারা এখন ভাবছেন, ও নাচাতে শুরু করেছে, বলল রানা।
ঠিকই বলেছেন।
চুপ করে পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ম্যাজেস্টিক-১২-র লিযার্ড মিসাইল তাক করা হয়েছে প্যারিসের দিকেও।
হ্যাঁ। তা আমরা জানি। এ জন্যে তৈরি ছিলাম। আমাদের দেশ খোঁজখবর রেখেছে ম্যাজেস্টিক-১২-র বিষয়ে। আর সে কারণেই গ্লোবাল জিহাদের টেরোরিস্টদের লাশ জোগাড় করে দিয়েছি আমরা। মিসাইলের আঘাতে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকা, জার্মানি ও ব্রিটেন। শেষে থাকবে পশ্চিমা সুপার পাওয়ার বলতে শুধু ফ্রান্স। তখনই সবাই জানবে, আমাদের এই দেশ ঠেকিয়েছে বদমাশদেরকে।
মিসমার হবে নিউ ইয়র্ক, বার্লিন এবং লণ্ডন, কিন্তু কিছুই হবে না প্যারিসের। এবং ফ্রান্স একমাত্র দেশ, যে ঠেকাবে টেরোরিস্ট মিসাইল।
সেপ্টেম্বর এগারোর পর পাল্টা হামলা করতে তিন মাস। সময় লেগেছে আমেরিকার। একবার ভাবুন কমপক্ষে পাঁচটা মস্ত শহর নিশ্চিহ্ন হলে ওরা কেমন হতবাক হবে? কিন্তু এসব ভয়ঙ্কর হামলা থেকে নিরাপদ থাকবে ফ্রান্স। পশ্চিমা একমাত্র রাষ্ট্র, যেটা ঝড়ের মত কাজ করবে। একমাত্র দেশ, যা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী- যার কিছুই হয়নি। আর এ কারণে ফ্রান্স হয়ে উঠবে নতুন কোল্ড ওঅরে সত্যিকারের বিশ্বনেতা।
মেজর রানা, ম্যাজেস্টিক-১২-র আমাদের বন্ধুরা আশা করছে এসব থেকে বিপুল টাকা পাবে। তাদের কাছে টাকা মানেই ক্ষমতা। কিন্তু দ্য রিপাবলিক অভ ফ্রান্স ওই ধরনের ক্ষমতা চায় না। আরও অনেক গুরুতুপূর্ণ জিনিস আশা করে ফ্রান্স। আমরা বদলে দেব বিশ্বের ক্ষমতার দাঁড়িপাল্লা। আমরা দুনিয়া চালাতে চাই।
বিংশ শতাব্দী ছিল আমেরিকার। সে সময়ে একের পর এক দেশ দেউলিয়া হয়েছে। আর একুশ শতাব্দী হবে ফ্রান্সের।
তিন সেনাপতি, এবং ডিজিএসই-র এজেন্টের দিকে চেয়ে রইল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, আপনারা স্রেফ সুখস্বপ্ন দেখছেন।
ব্রিফকেস থেকে কয়েকটা ছবি বের করল মোহনি, ভাসমান রানাকে দেখাল।
আলাপ চলুক। এসব ছবি মোসিউ ডগলাসের। গতবছর আফ্রিকায় তোলা হয়েছে।
খবরের কাগজের ছবি: আফ্রিকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে ডেমিয়েন ডগলাস। একের পর এক ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করছে। হাত নাড়ছে উল্লসিত জনতা।
সে যে কত ভাল, তা দেখাতে ওই টুর করে, বলল মোহনি। আর ওই ট্যুরে দেশগুলোর বড় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে। স্ট্র্যাটেজিকালি সিগনিফিকেন্ট আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর ডিফেন্স মিনিস্টারদের সঙ্গেও মিটিং হয়। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে: নাইজেরিয়া, ইরিত্রিয়া, চাঁদ, অ্যাঙ্গোলা, ইয়েমেন এবং লিবিয়া।
চুপ করে আছে রানা।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল মোহনি, তারপর বলল, গত বারো ঘণ্টার ভিতর নাইজেরিয়া, ইরিত্রিয়া, চাঁদ, ইয়েমেন এবং অ্যাঙ্গোলার এয়ারফোর্স আকাশে তুলেছে তাদের সমস্ত যুদ্ধ বিমান। সব নেমে এসেছে লিবিয়ার পুবের এক এয়ারফিল্ডে। এসব দেশের এয়ারফোর্স বড় নয়। কিন্তু একইসঙ্গে আকাশে উঠলে ওই এরিয়াল আর্মাড়াকে তাচ্ছিল্য করবে না কোনও দেশ। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মেজর রানা, ওরা ওখানে কী করছে?
ভাবতে শুরু করেছে রানা।
মেজর রানা?
জবাব দিল না রানা।
কানের ভিতর শুনল ডেমিয়েন ডগলাসের কথা: কেউ কেউ আজও জানে না পৃথিবীর ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে ওই আফ্রিকায়।
আফ্রিকা…
মেজর রানা? তাগাদার সুরে বলল মোহনি।
চোখ পিটপিট করল রানা। এক সেকেণ্ড পর দ্বিধা নিয়ে বলল, আমি আসলেই জানি না, কী করতে চায় ওরা।
এই একই কথা বলেছেন মোসিউ ডওসন, বলল মোহনি। সম্ভবনা রয়েছে, আপনারা সত্যি কথাই বলছেন। আবার এমনও হতে পারে, আপনাদেরকে একটু উৎসাহিত করা উচিত। তাতে হয়তো…
ডওসনের ফোর্কলিফটের ড্রাইভারকে ইশারা করল সে।
দেরি না করে ইঞ্জিন চালু করল ড্রাইভার। কয়েক ফুট বামে। সরে গেল। উঁচু করে তুলেছে ফোর্কলিফটের প্রং-দুটো। ঠিক সামনে রাফায়াল ফাইটার জেটের থ্রাস্টার। লাফ দিয়ে সিট ছাড়ল ড্রাইভার, গাড়ি থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় শুরু করেছে।
কারণটা কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল রানা।
রোওওওঅ্যাঅ্যাঅ্যার! আওয়াজে জেগে উঠেছে ফাইটার বিমানের ইঞ্জিন। ককপিটের ভিতর এক ফ্রেঞ্চ পাইলটকে দেখল রানা।
বিকট আওয়াজ শুনে বুক থেকে থুতনি তুলল ডওসন, দেখল ঠিক সামনে রাফায়াল ফাইটারের রিয়ার থ্রাস্টার। সামান্যতম পাত্তা দিল না। অনেক বেশি ক্লান্ত, মরে যেতেও আপত্তি নেই এখন। এত শক্তিও নেই যে হাতের বাঁধন ছিড়বার চেষ্টা করবে।
ককপিটের লোকটার দিকে ইশারা করল মোহনি। লোকটা চালু করল বিমানের থ্রাস্টার কন্ট্রোল। আচমকা রাফায়াল যুদ্ধ-বিমানের পিছনের থ্রাস্টার থেকে ছিটকে বেরোল অবিশ্বাস্য সাদা আগুনের জিভ। গপ করে গিলে নিল ডওসনকে।
ভয়ঙ্কর তাপ উড়িয়ে দিতে চাইল বিধ্বস্ত এজেন্টকে। উত্তপ্ত হাওয়া ছিটকে লাগতেই মুহূর্তে ছাই হলো তার চুল। ঝলসে গেল চোখ-মুখ। এক সেকেণ্ডের দশভাগ সময়ে পুরো কাবাব হয়ে গেল শরীর। মাংস পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই বমি পেল রানার।
কয়েক সেকেণ্ড পর বন্ধ হলো ফাইটার বিমানের ইঞ্জিন। থমথম করতে লাগল হ্যাঙার।
ডওসন হয়ে গেছে চারটে ঝলসানো টুকরো, ঝুলছে ফোর্কলিফটের প্রংগুলো থেকে।
ঢোক গিলতে চেষ্টা করল রানা। জিভ শুকনো।
ওর দিকে ঘুরল মোহনি। এবার স্মৃতিচারণ সহজ হবে, তাই না?
ডেমিয়েন বা আফ্রিকার দেশ সম্পর্কে কিছুই জানি না, শুকনো স্বরে আবারও বলল রানা। ওই লোক বা ওসব দেশ কী। করছে আমার জানার কথা নয়। প্রথমবারের মত এসব শুনছি।
তা হলে আপনাকে আর দরকার নেই আমাদের, বলল। মোহনি। এবার অ্যাডমিরাল ও জেনারেলের উপভোগের সময়। তারা আপনার আনন্দময় মৃত্যু দেখতে চান।
রানার ফোর্কলিফটের ড্রাইভারের দিকে মাথার ইশারা করল। মোহনি। সামনে বাড়ল ভেহিকেল। থামল পোড়া ডওসনের ফোর্কলিফটের পাশে। রাফায়াল ফাইটারের দ্বিতীয় রিয়ার গ্লাস্টারের ঠিক সামনে থেমেছে।
থ্রাস্টারের কুচকুচে কালো গভীর গহ্বর দেখল রানা।
জেনারেল? বয়স্ক আর্মি অফিসারের দিকে চাইল মোহনি। রানার কারণে অ্যান্টার্কটিকায় গোটা প্যারাট্রুপার ইউনিট হারিয়েছে ওই লোক। চাইলে প্রতিশোধ নিতে পারেন, জেনারেল।
আনন্দের সঙ্গে।
চেয়ার ছাড়ল জেনারেল, মই বেয়ে গিয়ে উঠল রাফায়ালের ককপিটে। রানার উপর থাকল তার চোখ।
ককপিটে ঝুঁকল সে, হাত বাড়িয়ে দিল ফ্লাইট স্টিকের দিকে। বুড়ো আঙুল চলে গেল আফটারবার্ন সুইচের সামনে।
গুড বাই, মেজর রানা, স্বাভাবিক স্বরে বলল মোহনি। আপনাকে ছাড়াই দুনিয়াকে চলতে হবে। ভাল থাকুন।
জেনারেলের বুড়ো আঙুল চেপে বসল বার্ন সুইচের উপর।
কিন্তু তখনই হঠাৎ করেই বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ হলো মেইন হ্যাঙারের উপরে।
বাজতে শুরু করেছে ক্ল্যাক্সোন।
গোটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার জুড়ে দপ করে জ্বলে উঠল ওয়ার্নিং লাল ইমার্জেন্সি বাতি।
বার্নার সুইচে চাপ না দিয়ে ঘুরে চাইল জেনারেল।
হঠাৎ ছুটতে ছুটতে এসে নেভির অ্যাডমিরালের সামনে থামল এক এনসাইন। স্যর! আমাদের ওপর হামলা করা। হয়েছে!
কী? গর্জে উঠল অ্যাডমিরাল। কারা হামলা করল?
মনে হয়, স্যর, একটা রাশান ফাইটার!
রাশান ফাইটার? বল কী! ভুলে গেছ, এটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার! কে আসবে লড়তে? আবার বলছ একটামাত্র ফাইটার বিমান!
.
ব্রিঁয়া পওলাসের ফ্লাইট ডেকের উপর ভাসছে কুয়াশার কালো শকুন, বৃষ্টির মত চারপাশে ছুঁড়ছে বুলেট, পার্ক করা একের পর এক ফাইটার বিধ্বস্ত হচ্ছে মিসাইলের আঘাতে।
এইমাত্র সুখোই যুদ্ধ-বিমানের ডানার নীচ থেকে ছিটকে বেরিয়েছে চারটে মিসাইল, ওগুলো খুঁজে নিল চারটা টার্গেট।
ডেকে বসে থাকা এক রাফায়াল ফাইটার উড়ে গেল মিসাইলের আঘাতে। একইসময়ে ছিন্নভিন্ন হলো দুটো অ্যাণ্ড এয়ারক্রাফট মিসাইল স্টেশন। চতুর্থ মিসাইল সাঁৎ করে ঢুকল মেইন হ্যাঙার বে-র ভিতর। বিধ্বস্ত হলো এক অ্যাওয়াক্স বিমান, নানাদিকে ছিটকে গেল অংশগুলো।
কালো শকুনের ককপিটে জাদু দেখাতে শুরু করেছে রঘুপতি।
ওর পিছনে গানারের সিটে কুয়াশা, রিভলভিং চেয়ারে বিমানের তিন শ ষাট ডিগ্রি দেখছে। একের পর এক টার্গেট উড়ে যাচ্ছে বুলেট বা মিসাইলের আঘাতে।
নিশাত! তৈরি? জানতে চাইল কুয়াশা।
ককপিটের পিছনে কনভার্টেড বম বে-তে এসে দাঁড়িয়েছে নিশাত। কড়া ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে তিশাকে। নিশাতের সঙ্গে এখন এমপি-৭, এম-১৬, ডের্ট ঈগল পিস্তল এবং একটা রকেট লঞ্চার প্যাক। ওটা ছিল বাউন্টি হান্টার পোলিশের। শেষ অস্ত্রটা ঝুলিয়ে নিয়েছে পিঠে।
আমি তৈরি।
তা হলে যান!
খুলে গেল বম বে-র দরজা, ম্যাগহুকের দড়ি ধরে সড়াৎ করে নেমে এল নিশাত।
ওদিকে ফ্রেঞ্চ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের কন্ট্রোল টাওয়ারে হৈ-চৈ শুরু হয়েছে।
রেডিয়ো মাইকে গলা ছেড়ে চিৎকার করছে কমিউনিকেশন টেকনিশিয়ানরা। তথ্য দিচ্ছে ক্যাপ্টেনকে।
আমাদের রেইডারের নীচেই ছিল!
কোনও ধরনের স্টেলথ মেকানিম…
ফ্লাইট ডেকে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট স্টেশনগুলোর উপর মিসাইল…
দেরি না করে ক্যাটাপুল ব্যবহার করে ফাইটার…
স্যর! লোপা থেকে বলছে পরিষ্কার দেখছে…
ফায়ার করতে বলো!
ক্যারিয়ারের গ্রুপের একটা ডেস্ট্রয়ার থেকে নির্দেশমত রওনা হলো অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল সোজা এল কালো শকুন লক্ষ্য করে।
গম্ভীর মুখে জানতে চাইল কুয়াশা, রঘুপতি, পোলিশের বিমানের নষ্ট ইলেকট্রনিক কাউন্টারমেযারগুলো ঠিক করেছ?
নিশ্চয়ই, বস!
প্রচণ্ড গতি নিয়ে কালো ফাইটারের দিকে আসছে মিসাইল। কিন্তু একেবারে কাছে চলে আসতেই কাজ শুরু করল। শকুনের ইলেকট্রনিক জ্যামিং শিল্ড। নাক ঘুরিয়ে নিল মিসাইল, ছুটল আরেকদিকে। লাগল গিয়ে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের। বাইরের দিকের খোলে।
এস্কোর্টস! সিয ফায়ার! সিয ফায়ার! গলা ফাটাল জাহাজের ক্যাপ্টেন। ওই বিমান অনেক কাছে! ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্ট! খুঁজে বের করো ওটা কী ধরনের জ্যামিং করছে। নিউট্রালাইয করো! ফাইটার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হবে ওই বিমানকে।
.
রাফায়াল ফাইটারের পিছনে থ্রাস্টারের সামনে এখনও ক্রুসিফাই হয়ে ঝুলছে রানা।
হঠাৎ করেই কাত হলো প্রকাণ্ড জাহাজ। ওটার উপর আঘাত হানছে একের পর এক মিসাইল।
ফ্রেঞ্চ সেনাপতিরা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রেডিয়ো নিয়ে। উপযুক্ত জবাব চাই তাদের।
অবশ্য, রাফায়াল বিমানের ককপিটে রয়ে গেছে আর্মির জেনারেল। চমক কেটে যেতেই জ্বলন্ত চোখে চাইল রানার। দিকে। ঠিক করেছে, ছাড়বে না এই সুযোগ।
আবারও আফটারবার্ন সুইচের দিকে হাত চলে গেল তার। খপ করে ধরল কন্ট্রোল স্টিক। আর একইসময়ে একটা বুলেট ঢুকল তার মগজে। ককপিটের চারপাশে ছিটকে গেল ধূসর জেলি।
এত হৈ-চৈয়ের মাঝে কেউ খেয়াল করেনি ওপেন এয়ার স্টারবোর্ড এলিভেটারের ফাঁকা জায়গা দিয়ে মাকড়সার মত করে নেমে এসেছে এক ছায়ামূর্তি।
বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা।
একহাতে এমপি-৭, অন্যহাতে এম-১৬। ঝড়ের মত ঢুকে পড়েছে হ্যাঙার বে-র ভিতর। ছুটছে রানাকে লক্ষ্য করে। যেন প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে স্বয়ং দেবী মা-কালী।
রানাকে পাহারা বাদ দিয়েছে ফ্রেঞ্চ স্কোয়াড, সরে গেল ভেহিকেল ও বিমানের কাছ থেকে। ঠেকাবে নিশাতকে।
কিন্তু ভীষণ প্রলয়ের মত এসেছে নিশাত, গর্জে উঠল দুহাতের অস্ত্র। বামে, ডানে, মাঝের লোকগুলো ছিটকে পড়ল গুলি খেয়ে।
বামের দুই গুলি শেষ করে দিয়েছে দুই প্যারাট্রুপারের জীবন। মুখে গুলি খেয়েছে তারা। পিস্তলের মত করে এম-১৬ ডানদিকে তাক করেছে নিশাত, ওর পর পর তিনটে বুলেট ছিটকে ফেলল তিন কমাণ্ডোকে।
রাফায়াল বিমানের ডানা থেকে গুলি করল এক প্যারাট্রুপার। ওই একইসময়ে সমারসল্ট করে আরেক দিকে সরে গেছে নিশাত। তারই ফাঁকে ওর গুলি ঝাঁঝরা করল লোকটার বুক গলা।
হুলুস্থূলের ভিতর দুটো স্মোক গ্রেনেড ছুঁড়ল নিশাত, সত্যিকার প্রতিশোধ-পরায়ণ প্রেতাত্মার মত ছিটকে আগে বাড়ছে।
ধূম্রজালের ভিতর গুলি খেয়ে ধুপ-ধাপ মেঝেতে পড়ল চার ফ্রেঞ্চ প্যারাট্রুপার। নিশাতের পরবর্তী গুলিতে অক্কা পেল অ্যাডমিরাল। ডিজিএসই-র এজেন্ট হঠাৎ বুঝল, পাঁচ ব্লেডের শুরিকেন বিঁধেছে তার অ্যাডামস অ্যাপলে। খুব কষ্ট পেয়ে মরতে হবে তাকে।
পরের কয়েক সেকেণ্ডে রানাকে ঝুলিয়ে রাখা ফোর্কলিফটের পাশে পৌঁছে গেল নিশাত।
কী খবর, ভাইডি?
সুস্থ হয়ে গেলাম আপনাকে দেখে, আপা, হাসতে চাইল রানা। তিশার খবর জানেন?
বেঁচে আছে। আপনার বন্ধু উদ্ধার করে এনেছেন, ওকে দুর্গের ভেতর থেকে।
কুয়াশার কাছ থেকে নেয়া দুটো পিটন ব্যবহার করে রানার হ্যাণ্ডকাফ ফাটিয়ে ফেলল নিশাত। পরের সেকেণ্ডে মেঝেতে নামল রানা।
তবে নিশাত ওকে অস্ত্র দেয়ার আগেই প্লেসি মোহনির দেহের পাশে পৌঁছে গেল ও। মৃতপ্রায় এজেন্টের পাশ থেকে খপ করে তুলে নিল কী যেন। আবার চলে, এল নিশাতের পাশে। এবার ওর হাতে এমপি-৭ এবং ডেযার্ট ঈগল পিস্তল গুঁজে দিতে ভুল করল না নিশাত।
আসুন ব্যাটাদের আচ্ছারকম সর্বনাশ করি, বাচ্চাদের মত করে বলল ক্যাপ্টেন।
দুজনের চোখে চোখ পড়তেই হেসে ফেলল রানা। খেয়াল করেছে নিশাতের পিঠে আরপিজি।
আপা, আপনার কথা ফেলতে পারি? ঘুরেই একটু দূরের জিপের দিকে দৌড় দিল রানা।
.
এদিকে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে টু-বাই-টু ক্যাটাপুল্ট লঞ্চিং শুরু হয়েছে। চারটা স্টেট-অভ-দ্য-আর্ট রাফায়াল ফাইটার ছুটতে শুরু করেছে রানওয়ে ধরে। মুহূর্তে ছিটকে উঠল আকাশে।
সামান্য গিয়েই আবারও ঘুরল ওগুলো, ভয়ঙ্কর ফর্মেশন তৈরি করে ফিরতে লাগল ভাসমান কালো শকুনকে লক্ষ্য করে।
ওরা আসছে, বস্! সতর্ক করল রঘুপতি।
দেখেছি।
রিভলভিং সিটে ঘুরে গেল কুয়াশা, টিপতে শুরু করেছে। ট্রিগার। ভঙ্গিটা অনেকটা ভিডিয়ো গেম নিয়ে ব্যস্ত কচি ছেলেদের মত।
তীরের মত ওদের দিকে আসছে দুই রাফায়াল ফাইটার, দপদপ করে জ্বলতে লাগল কামানের মুখ।
কালো শকুনের চারপাশ দিয়ে ছুটছে অসংখ্য কমলা রঙের গুলি। আওয়াজ তুলছে হু-হুঁস। বাতাসে গড়াতে শুরু করে সরে গেল রাশান বিমান। রিভলভিং বেলি মাউন্টেড গান দিয়ে উল্টো গুলি করছে কুয়াশা। একপলকের জন্য তিশার কথা ভাবল। অচেতন মেয়েটিকে আরামদায়ক কম্বলে মুড়িয়ে ভাল করে বেঁধে রেখেছে ওরা, কোনওদিকে ছিটকে গিয়ে আহত হবে না।
কালো শকুনের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেল প্রথম দুই বিমান, রইল শুধু দুই সনিক বুম। আসলে মনোযোগ সরিয়ে দিতে চেয়েছে তারা। আসল শো শুরু হলো এবার।
সাগরের ঢেউ ছুঁয়ে এল অন্য দুই ফাইটার, যেন তো দেবে কালো শকুনের পিছনে।
এখনও এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের স্টারবোর্ড এলিভেটারের উপর ভাসছে কুয়াশার ফাইটার। চরকির মত ঘুরে গেল ওটা, মুখোমুখি হলো নতুন দুই বিমানের।
ধ্যাৎ! কাউন্টারমের স্ক্রিনে চেয়ে আছে রঘুপতি। ওরা আমাদের জ্যামিং ফ্রিকোয়েন্সির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। …বারবার অন/অফ করছে। এবার আর মিসাইল জ্যাম করতে পারব না।
নতুন দুই রাফায়াল ফাইটার থেকে দুটো করে মিসাইল ছোঁড়া হলো।
মিসাইল লক্ষ্য করে কামান দাগতে শুরু করেছে কুয়াশা। ফেলে দিল দুটো মিসাইল, কিন্তু তোপ এড়িয়ে আসছে অন্য দুই মিসাইল। প্রথমে নীচে নেমে গেল ওগুলো, তারপর আবারও উঠে এল শকুন লক্ষ্য করে।
রঘুপতি…
সগর্জনে কুয়াশাদের বিমানের দিকে আসছে মিসাইল। খেয়াল করে দেখছে রঘুপতি, একেবারে শেষসময়ে বুঝল কী করা উচিত।
বিদ্যুদ্বেগে আসছে মিসাইলদুটো, এবার এসে লাগবে কালো। শকুনের বুকে…
কিন্তু কালো শকুনকে আরেক দিকে সরাল রঘুপতি, সৎ কবে ঢুকে পড়ল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের স্টারবোর্ডের প্রকাণ্ড এলিভেটারের দরজা দিয়ে। ভাসতে ভাসতে জাহাজের মেইন হ্যাঙারে ঢুকে পড়েছে রঘুপতি।
ডেস্ট্রয়ার সোপার মিসাইলের সঙ্গে ইলেকট্রনিক ডিটেকশন সিস্টেম ছিল না, নিজেদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে আঘাত হেনেছে, কিন্তু ফাইটার বিমানের মিসাইল তা নয়, জাহাজ এড়িয়ে দূর-সাগরে গিয়ে ডুবে গেল ওগুলো। ওখানে তৈরি হলো মস্ত দুটো ফোয়ারা।
এদিকে ক্যারিয়ারের টাওয়ারে রেইডার অপারেটার হতবাক হয়ে চেয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। পরক্ষণে রেডিয়ো মাইকে চেঁচিয়ে উঠল: হারামজাদা কোথায় গেল?
কী? …আবারও বলো…
ওটা কোথায়? জানতে চাইল ক্যাপ্টেন। ওরা কোথায়?
স্যর, আমাদের জাহাজের ভেতর!
ফ্রেঞ্চ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের গুহার মত প্রকাণ্ড হ্যাঙারে ভাসছে কালো শকুন।
চমৎকার, রঘুপতি! প্রশংসা না করে পারল না কুয়াশা। গুলি পাঠাতে শুরু করেছে পার্ক করা ফাইটার বিমান লক্ষ্য করে। বিধ্বস্ত হচ্ছে হেলিকপ্টার ও ট্রাক।
যেন কারও লিভিং রুমে আটকা পড়েছে মস্ত কোনও পাখি, হ্যাঙারের সামনে বাড়ছে কালো শকুন। ওটার ইঞ্জিনের ঝোড়ো হাওয়া আস্ত সব ফিউয়েল ট্রাক উল্টে ফেলছে দেয়ালের উপর।
চারপাশের সবকিছু ধ্বংস করতেই এসেছে রাশান ফাইটার। একবার ছাতে সামান্য ঘষা খেল পিছনের উঁচু ডানা।
রেডিয়োতে বলে উঠল কুয়াশা, নিশাত! আপনি কোথায়?
.
হ্যাঙারের পিছন লক্ষ্য করে ছুটছে একটি জিপ, গতি তুলেছে কমপক্ষে এক শ কিলোমিটার, এড়িয়ে যাচ্ছে উল্টে পড়া বিমান ও ট্রাককে। স্টিয়ারিং হুইলে নিশাত সুলতানা, পিছনের সিটে কুঁজো হয়ে বসেছে রানা।
হ্যাঙার বে-র প্রায় শেষে পৌঁছেছি, স্যর! বলল নিশাত, উড়িয়ে দেয়ার মত কিছু পেলেন?
আপনি রানাকে পেয়েছেন? জানতে চাইল কুয়াশা।
হ্যাঁ।
আমরা কি আপনাদেরকে তুলে নেব?
রানার দিকে চাইল নিশাত। ওর দিকে পিঠ দিয়ে বসে আছে রানা, আরপিজির প্যাক ঘটছে।
আবারও বলছি, আপনাদেরকে তুলে নেব? দ্বিতীয়বার জানতে চাইল কুয়াশা।
না, এখনই নয়! গলা উঁচিয়ে বলল রানা। আপা, কুয়াশাকে বেরিয়ে যেতে বলুন। দুই মিনিট পর নরক হয়ে উঠবে চারপাশ। এ জাহাজের কাছ থেকে যেন অনেক সরে যায়। আমাদের দেখা হবে বাইরে।
শুনলাম, কয়েক মুহূর্ত পর বলল কুয়াশা। ঘুরে চাইল রঘুপতির দিকে। রঘুপতি, বেরিয়ে যাও হ্যাঙার থেকে!
ইয়েস, বস্, বলল রোবট। কিন্তু… হ্যাঙার বে-র আরেক প্রান্তে দ্বিতীয় ওপেন এয়ার এলিভেটার চোখে পড়েছে।
সামনে বাড়ল সুখোই, পিছনে তৈরি হলো ঝড়। আর সব শব্দ ছাপিয়ে উঠেছে, ইঞ্জিনের বিকট আওয়াজ। কয়েক সেকেণ্ড পর পোর্ট সাইডের এলিভেটারের মাধ্যমে বেরিয়ে এল ওরা কাঁচা সোনার মত রোদে। আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই।
.
দ্রুতগামী জিপের পিছনে আরপিজি প্যাক ঘটছে রানা। একপাশে রকেট লঞ্চার, এ ছাড়া রয়েছে নানান এক্সপ্লোসিভ টিপড় রকেট চার্জ।
এক সেকেণ্ড পর যেটা খুঁজছিল, পেয়ে গেল রানা। ওটা কুখ্যাত সোভিয়েত পি-৬১ প্যালাডিয়াম চার্জ।
প্যালাডিয়াম চার্জের বাইরের খোলস প্যালাডিয়াম ধাতু দিয়েই তৈরি, কিন্তু ভিতরে রয়েছে এনহ্যান্সড় হাইড্রোফ্লোরিক অ্যাসিড এবং ওটার একমাত্র কাজ সিভিলিয়ান নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট ধ্বংস করা।
নিউক্লিয়ার অস্ত্রের কোর-এ কমপক্ষে ৯০% এনহ্যান্স ইউরেনিয়াম থাকে। সিভিলিয়ান পাওয়ার প্লান্টের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের কোর-এ রাখা হয় মাত্র ৫% ইউরেনিয়াম। এদিকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের রিঅ্যাক্টরে থাকে ৫০% ইউরেনিয়াম। ফলে সিভিলিয়ান পাওয়ার প্লান্ট বা নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের রিঅ্যাক্টর থেকে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন হয় না। অবশ্য লিক করতে পারে রেডিয়েশন–যেমন হয়েছিল চেরনোবিলে–ছাতির মত আকাশে ওঠে না ওই জিনিস।
প্রতি সেকেণ্ড বেরোতে থাকে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন–ভয়ঙ্কর ফ্লেমেবল গ্যাস–ওটা ঠেকাতে ব্যবহার করা হয় রেকমবাইনার। ওটা বিপজ্জনক হাইড্রোজেন (H)কে রূপান্তরিত করে নিরাপদ (H2O)তে।
কিন্তু প্যালাডিয়ামের সঙ্গে হাইড্রোজেন মিশলে তৈরি হয় উল্টো প্রতিক্রিয়া। বহুগুণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে হাইড্রোজেন। সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণে দাহ্য গ্যাস। ওটার সঙ্গে প্যালাডিয়াম মিশতে থাকলেই জন্ম নেবে ভয়ঙ্কর হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড।
দুই স্তরে কাজ করে পি-৬১ চার্জ ডেটোনেটর।
প্রাথমিক বিস্ফোরণ ঘটতেই মিশে যায় প্যালাডিয়াম ও হাইড্রোজেন, বিপুল পরিমাণে বাড়তে থাকে গ্যাস। এবং বোমার দ্বিতীয় স্তরে ওই গ্যাস ও অ্যাসিড জ্বলে ওঠে।
– ফলাফল প্রলয়ঙ্করী বিস্ফোরণ। নিউক্লিয়ার ব্লাস্টের মত অতটা ভয়ঙ্কর নয়, তবে দুনিয়ার আর সব বোমার চেয়ে শক্তিশালী। পি-৬১ চার্জ সহজেই ফাটিয়ে দিতে পারে যে কোনও এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের রিইনফোর্সড় পুরু খোল।
ওদিকে চলুন, আপা! ওই যে রিঅ্যাক্টরের এগস্ট ভেন্ট!
হ্যাঙার বে-র শেষে প্রকাণ্ড দুই সিলিখ্রিকাল ভেণ্ট দেখল নিশাত। ভেন্টের উপরাংশে ঘুরছে মস্ত ফ্যান, জাহাজের পিছন দিয়ে বের করে দিচ্ছে বাড়তি হাইড্রোজেন।
হ্যাঙার বে পেরোতে শুরু করেছে দ্রুতগামী জিপ, পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে জ্বলন্ত সব ফাইটার বিমানকে।
জিপের পিছনে উঠে দাঁড়িয়েছে রানা, কাঁধে উপর তুলে নিল। আরপিজি, তাক করল এগস্ট চিমনির বিশালাকার ফ্যানে।
আমি ফায়ার করার পর, আপা, ছুটবেন উপরে যাওয়ার র্যাম্প লক্ষ্য করে! বড়জোর তিরিশ সেকেণ্ড, তারই ভেতর প্রথম স্তরের রিঅ্যাকশন শেষে শুরু হবে দ্বিতীয় স্তর! মনে রাখবেন, তিরিশ সেকেণ্ডের মধ্যে জাহাজ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে!
ঠিক আছে!
লঞ্চারের সাইটের মাধ্যমে টার্গেট স্থির করল রানা। নিপাত যাক রিপাবলিক অভ ফ্রান্স, মনে মনে বলল।
টিপে দিল ট্রিগার।
দুপ আওয়াজ ছাড়ল লঞ্চার। হ্যাঙারের উপরের অংশের দিকে রওনা হয়ে গেল প্যালাডিয়াম টিপড় আরপিজি। তীরের মত চলেছে, পিছনে রেখে যাচ্ছে সরল রেখার ধোঁয়ার লেজ।
ডানদিকের এগস্ট ভেল্টের ফ্যান উড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকল প্যালাডিয়াম চার্জ, নীচের দিকে রওনা হয়ে হারিয়ে গেল। উত্তাপ খুঁজছে ওটা।
আরপিজি রওনা হতেই অ্যাক্সেলারেটার–মেঝেতে টিপে ধরেছে নিশাত, চরকির মত জিপ ঘুরিয়ে নিয়েই উঠতে লাগল সুড়ঙ্গের মত র্যাম্প বেয়ে। খাড়া এ পথ উপরের ডেকে যাওয়ার।
বারবার বাঁক নিয়ে ঘোরানো পথে ঝড়ের গতিতে র্যাম্প বেয়ে উঠছে জিপ
তীক্ষ আওয়াজ তুলে পিছলে যেতে চাইছে চাকা। তারই ভিতর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পেটের অভ্যন্তর থেকে শুনতে পেল ওরা চাপা বুম্ আওয়াজ।
টার্গেটে লেগেছে প্যালাডিয়াম চার্জ।
স্টপওয়াচ চালু করল রানা।
০০.০১…
০০.০২…
.
ব্রিঁয়া পওলাসের আকাশে চার রাফায়াল ফাইটারের সঙ্গে ডগফাইটে ব্যস্ত কালো শকুন। বাতাসে শোঁ-শোঁ আওয়াজ তুলে বারবার বাক নিচ্ছে। তারই ফাঁকে মিসাইল ছুঁড়ে উড়িয়ে দিল এক রাফায়াল ফাইটার। ওটাই ছিল কালো শকুনের শেষ মিসাইল।
কঙ্গেল থেকে তীক্ষ্ণ বীইইইপ! আওয়াজ পেল রঘুপতি। নিচু স্বরে বলল, ওরা পুরো বুজে দিয়েছে আমাদের কাউন্টারমের ফ্রিকোয়েন্সি! শেষ হয়ে গেছে মিসাইল শিল্ড!
তখনই ওদের বিমানের পিছু নিল এক রাফায়াল ফাইটার। সাগরের উপর দিয়ে ঝড়ের গতিতে চলেছে দুই বিমান। সুখোই এর লেজের কাছে পৌঁছে গেছে রাফায়াল, ছুঁড়ছে কমলা রঙের ট্রেসার।
কালো শকুন ছুটছে তুমুল গতি তুলে, তারই ভিতর রিভলভিং গানার সিটে ঘুরে বসল কুয়াশা। টিপে ধরেছে ট্রিগার, ব্যবহার করছে বিমানের পেটের নীচের রিভলভিং গান। এক ঝাঁক গুলি ঝাঁঝরা করে দিল ফ্রেঞ্চ ফাইটারের ককপিট। ছিটকে উড়ে গেল ওটার ক্যানোপি। তার আগেই লাশ হয়ে গেছে পাইলট। নাক নিচু করে সাগরে গিয়ে পড়ল যুদ্ধ-বিমান। বিস্ফোরিত হলো বিপুল পানি, সঙ্গে বিকট আওয়াজ।
বস্! হঠাৎ বলল রঘুপতি, সামনের দিকের অস্ত্র লাগবে! এখনই!
সিটসহ ঘুরে গেল কুয়াশা, দেখল এইমাত্র পড়ে যাওয়া রাফায়ালের পিছনে ছিল আরও দুটো ফ্রেঞ্চ ফাইটার!
এবার মিসাইল লঞ্চ করবে রাফায়াল ফাইটার..
এক সেকেণ্ড পর কুয়াশা দেখল, বিমানের ডানা থেকে রওনা হয়েছে ধোঁয়ার দুটো আঙুল, সোজা আসছে কালো শকুনকে লক্ষ্য করে।
আকাশে গড়াতে শুরু করেছে রঘুপতি, ব্যবহার করল। সেকেণ্ডারি কাউন্টারমেযার: ওই সিস্টেমকে বলা হয় প্লামা স্টেলথ। আসলে আইয়োনাইড় গ্যাসের পার্টিকেল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয় বিমান। ওটা ছোট একটা মেঘ যেন।
অনেক কাছে এসেও বিভ্রান্ত হলো দুই মিসাইল, ভি-এর মত দুদিকে রওনা হলো আইয়োন মেঘ দেখে। সুখোই থেকে ছিটকে সরছে মিসাইল, এক সেকেণ্ড পর দেখা গেল প্রথমটা প্রচণ্ড গতি নিয়ে নামল সাগরে। দ্বিতীয়টা ঘুরে গেল আকাশে, ছুটতে লাগল।
এখনও ছুটে আসছে দুই রাফায়াল ফাইটার, তাদের সঙ্গে কলিশন কোর্সে রয়ে গেছে কুয়াশার ব্রিমান।
ঝট করে ঘুরেই গুলিবর্ষণ শুরু করল কুয়াশা।
উড়ে গেল একটা রাফায়াল বিমানে বামদিকের ডানা। এক সেকেণ্ড পর বিকট আওয়াজ তুলে দুই বিমানকে বিদ্যুদ্বেগে। পিছনে ফেলল রঘুপতি।
অবশিষ্ট রইল একটি মাত্র রাফায়াল ফাইটার, কিন্তু সেটাও টিকল না। কুয়াশার বিমান ওটাকে পেরোবার পর পরই নিজের মিসাইলের আঘাতে দুই টুকরো হলো ফ্রেঞ্চ বিমান। ওই শেষ মিসাইল সুখোই-এর প্লামা স্টেলথ মেকানিমকে এড়িয়ে গিয়েছিল, কাছেই আরেকটা বিমান দেখে বিন্দুমাত্র ভুল করেনি।
শেষ বিস্ফোরণ দেখবার জন্য ঘরে, চাইল কয়াশা ও রঘুপতি। কিন্তু এমনসময় ভারী বুম্! আওয়াজ পেল ওরা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের দিক থেকে।
.
গতি আরও বাড়ান, আপা! রানা চেয়ে আছে স্টপওয়াচের দিকে।
০০.০৯…
০০.১০…
বিদ্যুদ্বেগে র্যাম্প বেয়ে উঠছে জিপ।
হঠাৎই পোর্টে ত্রিশ ডিগ্রি কাত হয়ে গেল প্রকাণ্ড জাহাজ।
যেতে থাকুন, আপা! তাড়া দিল রানা।
প্যালাডিয়াম চার্জের প্রথম আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাইড্রোজেন রেকমবাইনার। ওই আওয়াজ গম্ভীর।
তার মানে ক্যারিয়ারের কুলিং টাওয়ারে বিপুল ড্রাইড্রোজেন। তৈরি হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে তুমুল গতি তুলে। ঠিক ত্রিশ সেকেণ্ড পর প্যালাডিয়াম চার্জ ডেটোনেট করবে, আগুন ধরিয়ে দেবে। হাইড্রোজেনে। ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের।
০০.১১…
০০.১২…
র্যাম্প বেয়ে উঠে সোনালী রোদে বেরিয়ে এল জিপ, কড়া ব্রেক কষে থেমে গেল।
হুলুস্থূল চলছে ফ্লাইট ডেকে।
ধোঁয়া উঠছে বিধ্বস্ত বিমান থেকে, একই অবস্থা অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানগুলোর। মারা পড়েছে বেশ কয়েকজন নাবিক। নাকের উপর ভর করে কুর্নিশ দিচ্ছে এক রাফায়াল ফাইটার–ভেঙে গেছে সামনের হুইল। ওটার কারণে ব্রিঁয়া পওলাসের দ্বিতীয় টেকঅফ রানওয়ে কাজে আসবে না। ওই বিমান টেকঅফ করতে রওনা হয়েছিল, এমন সময় কালো শকুনের মিসাইল ওটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।
চট করে পরিস্থিতি বুঝে নিল রানা।
আপা! কুর্ণিশ করা বিমানের দিকে চলুন! উড়বে না তো! পাল্টা চেঁচাল নিশাত।
০০.১৫…
০০.১৬…
হুলুস্থূলের ভিতর ভাঙা বিমানের পাশে পৌঁছে গেল জিপ। নিশাত ঠিকই বলেছে, সামনের হুইল ভেঙে পড়ায় আর উড়তে পারবে না ওই বিমান।
০০.১৭…
০০.১৮…
আমি ওই বিমান ওড়াতে চাই না, বলল রানা, এটা ওড়াতে চাই।
লাফ দিয়ে জিপ থেকে নামল ও, উবু হয়ে তুলে নিল ক্যাটাপুল্ট হুক। বিধ্বস্ত বিমানের সামনের হুইলের সঙ্গে যুক্ত ছিল ওটা। ট্র্যাপেযেইডাল ক্যাটাপুল্ট হুক, বাষ্পচালিত ক্যাটাপুল্ট নয়। এই জিনিস ফ্লাইট ডেকের শুরু থেকে গুলতির মত ছুঁড়তে হয়। নব্বই মিটার ব্যবহার করে বিমান আকাশে তুলে দেয়।
রানা দেরি না করে ক্যাটাপুল্ট হুক আটকে দিল জিপের সামনের অ্যাক্সেলে, হুকের অন্য অংশ গেল ডেক ক্যাটাপুল্টে।
০০.১৯…
০০.২০…
স্যর, আপনি কি ঠাট্টা করছেন? জিপের সামনের রানওয়ে দেখছে নিশাত। রানওয়ে ফুরিয়ে গেছে বো-র শেষে। তারপর বহু দূরে দিগন্ত। ফ্লাইট ডেকে পেতে রাখা হয়েছে ক্যাটাপুল্টের রেইল। যেন দুই রেল লাইন। শেষে খাড়া হয়ে উঠেছে। রানওয়ে।
০০.২১…
০০.২২…
নিশাতের পাশে লাফ দিয়ে জিপে উঠল রানা।
গিয়ার নিউট্রাল করুন, সিট বেল্ট বেঁধে নিন, বলল রানা।
০০.২৩…
০০.২৪…
খপ করে তুলে সিট বেল্ট আটকে নিল নিশাত। একই কাজ করেছে রানা।
০০.২৫…
এমপি-৭ বের করেছে রানা, মাযল তাক করল ক্যাটাপুল্ট কন্ট্রোলের উপর। কালো শকুনের হামলা হওয়ার পর পরিত্যক্ত হয়েছে এদিকটা।
০০.২৬…
মাত্র একবার ট্রিগার টিপল রানা।
০০.২৭…
পরক্ষণে সাঁৎ আওয়াজ হলো।
রানার গুলি লাগতেই লঞ্চ লিভার ছেড়ে দিল ক্যাটাপুল্টকে। জীবনে প্রথমবারের মত অত ভয়ঙ্কর গতি পেল ওই জিপ।
নব্বই মিটার পেরোবে মাত্র ২.২ সেকেণ্ডে।
সিটে গেঁথে গেল নিশাত ও রানা। টের পেল, কোটরের ভিতর ঢুকে যেতে চাইছে চোখ।
অবিশ্বাস্য গতি তুলে রানওয়ে পেরোতে শুরু করেছে জিপ। চারপাশ ঝাপসা দেখল ওরা। জিপের সামনের দুই চাকা ফাটল পঞ্চাশ মিটার পেরোতেই।
তবুও রকেটের মত চলল গাড়ি, যেন ছিটকে বেরিয়ে এসেছে কামানের ব্যারেলের ভিতর থেকে গোলা–ভয়ঙ্কর গতি তুলে দিয়েছে ক্যাটাপুল্ট।
ফাইটার জেটের মত অত গতি পেল না জিপ, ফাইটার তার নিজের থ্রাস্টারও ব্যবহার করে।
রানা ও নিশাত আকাশে উড়ে যাওয়ার জন্য আগ্রহী নয়।
ওরা শুধু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে বিস্ফোরণ হওয়ার আগেই পিতৃপ্রদত্ত প্রাণ নিয়ে নেমে যেতে চাইছে।
রানওয়ের শেষে পৌঁছে গেছে জিপ। ছিটকে উঠল আকাশের দিকে। সাঁই-সাঁই করে চলেছে বাতাস কেটে। নাক আকাশে, বনবন করে ঘুরছে চাকা। আর ওদের পিছনে ফেটে পড়ল গোটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার!
কোথাও কোনও আগুন রইল না। রইল না কোনও ধোঁয়ার মেঘ। এসবের বদলে ভয়ঙ্কর বিকট এক আওয়াজ হলো: বুমমমম! থরথর করে কাঁপতে লাগল চারপাশ। চমকে উঠেছে যেন গোটা সাগর।
বাইরের দিকে ছিটকে গেল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের খোল–জ্বলন্ত হাইড্রোজনের বিপুল ধাক্কা খেয়ে প্রসারিত হলো প্রতিটি ইস্পাতের দেয়াল- যেন টিভি পর্দার ইনক্রেডিবল হাক, বেরিয়ে আসছে পোশাক ছিঁড়ে।
বিশাল নক্ষত্র বিস্ফোরণের মত করে আকাশে ছিটকে উঠল লাখ লাখ রিভেট। একমাইল দূরে পৌঁছে গেল, পরবর্তী এক মিনিট ধরে টুপটাপ সাগরে পড়ল। একটু আগে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের পিছন ডেক থেকে আকাশে উঠেছিল এক কপ্টার, রিভেট-বর্ষণে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ওটা মাঝ আকাশে।
প্রকাণ্ড জাহাজের আস্ত সব স্টিলের পাত গিয়ে লাগল কাছের ডেস্ট্রয়ারগুলোর পাশে। তুবড়ে দিল জাহাজের একদিক, চুরমার হলো ব্রিজের জানালার সব কাঁচ।
ব্রিঁয়া পওলাসের সবচেয়ে ক্ষতি হলো পিছনদিকে। ওখানেই ছিল বিস্ফোরণের এপিসেন্টার কুলিং ভেণ্ট। জাহাজের পাত ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতেই ওখানে তৈরি হয়েছে মস্ত খোড়ল। হুড়মুড় করে ওই গর্ত দিয়ে ভিতরে ঢুকতে লাগল আটলান্টিক মহাসাগরের নীল ঢেউ।
ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় এবং সেরা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। ব্রিঁয়া পওলাস অনানুষ্ঠানিকভাবে ডুবতে লাগল চোখের সামনে।
মস্ত জাহাজের বো থেকে আকাশে উঠেছে রানা ও নিশাতের জিপ, বাতাস চিরে ছুটেছে বহুদূর লক্ষ্য করে। ডাঙায় চলা একটা জিপ গাড়ির পক্ষে যতদূর ওড়া সম্ভব উড়ে নামতে শুরু করল, নীচে। আগেই সিটবেল্ট খুলে ফেলেছে রানা ও নিশাত, পানিতে পড়ার ঠিক পাঁচ সেকেণ্ড আগেই দুজন দুদিকে লাফ দিল। জাহাজের ফ্লাইট ডেক থেকে পুরো পঁচিশ মিটার নীচে সাগর। কিন্তু ওরা লাফিয়ে পড়েছে বিশফুট ওপর থেকে। দুই সেকেণ্ড পর ঝুপ করে সাগরে নামল রানা ও নিশাত। বেকায়দাভাবে পড়ে ব্যথা পেল, ওদের বুট আগে নেমেছে। পানিতে, তীরের মত নেমে যেতে লাগল ওরা। এক সেকেণ্ড পর আবছা ভাবে শুনতে পেল বিকট আওয়াজ। ওদের পিছনে বিস্ফোরিত হয়েছে জাহাজ, চারপাশে বুলেটের মত ছিটকে গেছে লক্ষ লক্ষ নাট-বল্ট-রিভেট।
দ্রুত ডুবছে বিশাল এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। আগে ডুবল পিছন দিক। দেখবার মতই দৃশ্য। যারা বেঁচে রইল, ছুটল লাইফ বোট সাগরে নামাতে। কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল ডেক থেকে সাগরে। কয়েক সেকেণ্ড পর যেন লেজের উপর দাঁড়িয়ে গেল মস্ত জাহাজ, আকাশে তুলেছে বো। এরই ভিতর তলিয়ে গেছে। পিছনদিক।
ওটার দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল ফ্রেঞ্চ ক্যারিয়ার গ্রুপের অন্যান্য জাহাজের সবাই।
কেউ ভাবতে পারেনি এ ধরনের ফুলস্কেল ওঅর চলবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনও দেশ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হারায়নি।
হতবাক হয়েছে বলেই হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেরি হলো ফ্রেঞ্চদের। ওই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের একমিনিট পর আটলান্টিকের ঢেউয়ের দশফুট উপরে নেমে এল কালো এক রাশান ফাইটার, হার্নেসে করে বিক্ষুব্ধ পানি থেকে চটপট তুলে নিল দুজন মানুষকে বম বে-তে।
ওই দুজনকে তুলে নিয়েই আবারও আকাশ চিরে ছুটতে লাগল সুখোই ফাইটার, পিছন থেকে চেয়ে রইল ব্রিঁয়া পওলাস। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গ্রুপের আর সব জাহাজ।
বম বে-তে এসে ঢুকল কুয়াশা। মেঝেতে শুয়ে ছিল নিশাত, বৈজ্ঞানিককে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল।
অচেতন তিশার দিকে চাইল রানা, ওর জ্ঞান ফেরেনি?
ঘুমের কড়া ওষুধ দিয়েছি, বলল নিশাত, ক্ষত ড্রেসিং করেছি। গুরুতর আঘাত, কিন্তু এখনও ইনফেকশন হয়নি।
প্রথমে লণ্ডনে যাব, সিদ্ধান্ত নিল রানা, তিশার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
কালো শকুন এলিজাবেথ হসপিটালের সামনে নামতে পারে, বলল কুয়াশা। রেডিয়ো করে রানা এজেন্সির ছেলেদের জানিয়ে দাও ওখানে থাকতে। ওরা হসপিটালে ভর্তি করবে মেয়েটিকে।
কুয়াশার দিকে চাইল রানা। ঠিক আছে। এরপর ইংলিশ চ্যানেলের দিকে কোর্স স্থির করবে রঘুপতি। ওখানেই শারবার্গে রয়েছে প্রথম নোয়ায শিপ।
আস্তে করে মাথা দোলাল কুয়াশা, আবারও গিয়ে ঢুকল ককপিটে। বেড়ে গেল সুখোই ফাইটার বিমানের গতি, চলেছে। লণ্ডনের দিকে।
আট
আপার নিউ ইয়র্ক বে, ইউএসএ।
অক্টোবর ১৫। সকাল এগারোটা পঁচিশ।
চোদ্দ মিনিট আগে জেএফকে এয়ারপোর্টের টারমাক স্পর্শ করেছে ব্ল্যাকবার্ড ফাইটার জেট বিমান। আর এই মুহূর্তে মেরিন কর্পসের সিএইচ-৫৩ই সুপার স্ট্যালিয়ন হেলিকপ্টারে বসে আছে হোসেন আরাফাত খবির। স্ট্যাচু অভ লিবার্টির উপর দিয়ে উড়ে চলেছে কপ্টার আপার নিউ ইয়র্ক বে লক্ষ্য করে। পিছনে নিউ, ইয়র্কের বিস্তৃত পর্বতের মত স্টিল ও কাঁচের তৈরি প্রকৃতি।
কপ্টারের হোল্ডে খবিরের পাশে বসেছে পুরো সশস্ত্র বারোজন রেকন্যাসেন্স মেরিন।
ওই প্লান্টে টেরোরিস্টদেরকে পেয়েছেন আপনারা? চিৎকার করে মাইকে জানতে চাইল খবির, খানিকটা বিস্মিত। কথা বলছে ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্স টিমের দলনেতা এরিক হাডসনের সঙ্গে। তারা অভিযান করেছিল ড্রাগন প্লান্টে।
হ্যাঁ, তারা ছিল। সবাই গ্লোবাল জিহাদের লোক। তাদের। সঙ্গে শাহেদ করিমও ছিল। ওখানে ভয়ঙ্কর লড়াই হয়েছে।
গ্লোবাল জিহাদ, বিড়বিড় করল খবির। পরক্ষণে বলল, কিন্তু এসব তো ঠিক মিলছে না… চুপ হয়ে গেল ও।
হঠাৎ করেই বুঝতে শুরু করেছে সব। দোষ দেয়ার জন্য কাউকে দরকার ম্যাজেস্টিক-১২-র।
দোষ দিতে হলে টেরোরিস্ট অর্গানাইযেশনের চেয়ে ভাল। প্রার্থী আর কারা হতে পারে?
ড্রাগন কর্পোরেশন কী-ই বা করবে, যদি গ্লোবাল জিহাদের টেরোরিস্টরা তাদের মিসাইল ও জাহাজ ছিনতাই করে?
কিন্তু সত্যিকারের গ্লোবাল জিহাদ টেরোরিস্টদের পাবে কী করে ম্যাজেস্টিক-১২?
ফ্রান্স, বিড়বিড় করল খবির। ওরা জোগাড় করে দিয়েছে।
পাশেই বসেছে মেরিনদের নেতা ডেভিড, কথাগুলো শুনতে পেয়েছে। জিজ্ঞেস করল, খবির, আসলে এসব কী হচ্ছে? ভয়ে সিটিয়ে গেছে সবাই। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় টেরোরিস্ট অ্যাটাক আসছে। আমাদের নিজেদের মিসাইল ফেলবে ওরা আমাদেরই ওপর।
কাজটা টেরোরিস্টদের নয়, ডেভিড, বলল খবির। এসবই চলছে ব্যবসা বড় করার জন্যে। বিশ্বাস করুন, প্লান্টে লড়াই শুরু হওয়ার আগেই মারা পড়েছে ওসব টেরোরিস্ট। ম্যাজেস্টিক ১২-কে গোপনে সহায়তা দিয়েছে ফ্রেঞ্চ সিক্রেট সার্ভিস। লাশ পৌঁছে দিয়েছে। এর এদিক ওদিক হয়নি।
স্ট্যাটেন আইল্যাণ্ডের কাছে নোঙর ফেলা কন্টেইনার শিপ ও সুপারট্যাঙ্কারগুলোর দিকে চাইল খবির। মাল বোঝাই সব জাহাজ, অপেক্ষা করছে হাডসন ও ইস্ট রিভারে ঢুকবার জন্য।
নোয়ায শিপ প্রজেক্টের কারণে এখন যে-কোনও জাহাজ হতে পারে মিসাইল লঞ্চ ভেসেল।
আমরা জানব কী করে কোন্ জাহাজটা? জানতে চাইল পাইলট।
জিপিএস কোঅর্ডিনেট ২৮৭৪৪-০৫-৪১০৫-৫৪ অনুযায়ী গেলেই ওখানে জাহাজটা পাব, বলল খবির।
সংখ্যাগুলো জেনে নিয়ে ডায়াল অ্যাডজাস্ট করে নিল পাইলট, জিপিএস লোকেটার অনুযায়ী এগুতে শুরু করেছে।
শতবারের মত পাম কমপিউটারে লঞ্চ লিস্ট দেখল খবির। মাসুদ রানার সঙ্গে কথা বলবার সময় নোয়ায শিপের জিপিএস লোকেশন বের করেছিল চার্লস ডেলাস।
কাজটা শেষে ওরা ম্যাপে তুলে নেয় কোথায় রয়েছে জাহাজগুলো।
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির শহরগুলোর উপর নিউক্লিয়ার টিপৃড় মিসাইল ফেলবে তিনটা জাহাজ। এ ছাড়া, আরও রয়েছে দুটো নোয়ায শিপ। একটা আরব সাগরে। ইণ্ডিয়া ও পাকিস্তানের উপর ফেলবে মিসাইল। অন্যটা তাইওয়ান স্ট্রেইটে। বেইজিং ও হংকঙে ফেলবে টেপও-ডং আইসিবিএম।
আল্লা… ফিসফিস করল খবির। পরক্ষণে স্যাটালাইট মাইকে যোগাযোগ করতে চাইল: কনলন? আপনি কোথায়? পশ্চিমে কী ঘটছে?
.
প্রশান্ত মহাসাগর।
স্যান ফ্রান্সিসকো বে থেকে দুই মাইল দূরে। স্থানীয় সময় সকাল আটটা পঁচিশ মিনিট।
নিজেও একটা সুপার স্ট্যালিয়ন কপ্টারে বসে উড়ে চলেছে। কেভিন কনলন, তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে মেরিন রেকন টিম। থরথর করে কাঁপছে কেভিনের দুই হাঁটু, এ ছাড়া চেহারা দেখে বুঝবার উপায় নেই ও ভীত।
ওর মাথার চেয়ে দেড়গুণ বড় হেলমেট পরেছে, আর যে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরিয়ে দেয়া হয়েছে ওকে, ওটা দ্বিগুণ আকারের। কোলের উপর রেখেছে রিয়াল টাইম স্যাটালাইট আপলিঙ্ক ইউনিট। বিশালদেহী সব মেরিনদের মাঝে নিজেকে ওর বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে।
এ মুহূর্তে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ ছুঁয়ে ছুটে চলেছে সুপার স্ট্যালিয়ন। সামান্য দূরে স্যান ফ্রান্সিসকো উপকূলে নোঙর ফেলেছে একটি সুপারট্যাঙ্কার।
হাই, খবির, নতুন থ্রোট মাইকে গলা ছাড়ল কেভিন। আমরা পৌঁছে গেছি ওই সুপারট্যাঙ্কারের কাছে। মস্ত জাহাজ। যেমন হওয়ার কথা, ঠিক তেমনই। মিলে গেছে জিপিএস কো অর্ডিনেটুস পজিশন। সুপারট্যাঙ্কারের নাম এমভি রুবল, রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে ভার্জিনিয়ার নরফোকে। ওটার মালিক ড্রাগন শিপিং কোম্পানি, ড্রাগন কর্পোরেশনের সাবসিডিয়ারি।
হাঁটু কাঁপা থামলে ভাল হতো, ভাবল কেভিন।
আর বের করেছি আপনার মার্সেন প্রাইম, নতুন তথ্য দিল। ম্যান, সত্যিই দারুণ জিনিস ম্যাথমেটিক্সের মার্সেন নাম্বার। আজ পর্যন্ত পাওয়া গেছে মাত্র কিছু। এদের কোনও কোনওটা দুই মিলিয়ন ডিজিটের। খুবই রেয়ার প্রাইম নাম্বার। নির্দিষ্ট ফরমুলা অনুযায়ী পাওয়া যায়। মার্সেন প্রাইম = ২^p – ১ যেখানে p হচ্ছে প্রাইম সংখ্যা। কিন্তু উত্তরও হতে হবে প্রাইম সংখ্যা। তিন সংখ্যা হচ্ছে প্রথম মার্সেন প্রাইম। কারণ ২২-১ = ৩। ২ এবং ৩ আসলে প্রাইম সংখ্যা। কত ছোট সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে, বুঝতে পারছেন? কিন্তু শেষে কোথায় ঠেকবে কেউ জানে না। সপ্তম মার্সেন প্রাইম ৪,৩১,১২,৬০৯। ওটার বেস প্রাইম সংখ্যা বুঝতে পারছেন, ২^১৯ – ১ = ৪,৩১,১২,৬০৯, তার মানে প্রাইম…
উত্তর তা হলে ৪৩…
৪,৩১,১২,৬০৯, আবারও বলল কেভিন। এবার ধীরে ধীরে উচ্চারণ করছে।
দাঁড়ান লিখে নিই, বলল খবির। আপনি দুটো করে সংখ্যা বলতে থাকুন। ওদিকের কথা শুনে খসখস করে প্যাডে সংখ্যা লিখতে শুরু করেছে ও।
কয়েক মুহূর্ত পর উম্, হ্যাঁ, আর নেই, হতাশ স্বরে বলল কেভিন।
কিছুক্ষণ আগে স্যরের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসেও এ কথা জানিয়ে দিয়েছি, বলল খবির, ওই সংখ্যাগুলো স্যরকে জানিয়ে দেব। অনেক ধন্যবাদ, কেভিন।
সিগনাল কেটে গেল।
নিজের বিশ্বাসঘাতক দুই পায়ের দিকে চাইল কেভিন।
এ ধরনের কাজে যাওয়ার সময় এমনই হয়, মিস্টার কনলন, কেভিনের কম্পমান দুই হাঁটু দেখিয়ে সান্ত্বনা দিল মেরিনদের নেতা স্কট মোসলে। কিন্তু মিস্টার রানা যখন আপনাকে বিশ্বাস করেন, তার মানেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আপনি সক্ষম।
এ কথা বললেন, তাই ধন্যবাদ, বিড়বিড় করল কেভিন।
সগর্জনে সুপারট্যাঙ্কারের দিকে ছুটছে সুপার স্ট্যালিয়ন কপ্টার।
.
ইংলিশ চ্যানেল।
অক্টোবর ১৫। ফ্রান্স উপকূল।
বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিট। ইউএস ই.এস.টি. সকাল এগারোটা পঁচিশ মিনিট।
এই একটু আগে লণ্ডনের এলিজাবেথ হাসপাতালের লনে নেমেছিল কালো শকুন। তিশাকে বুঝে নিয়েছে রানা এজেন্সির ছেলেরা। দেরি হয়নি হাসপাতালের কেবিন পেতে।
সময় নষ্ট না করেই আবারও ইংলিশ চ্যানেলের উদ্দেশে রওনা হয়েছে রানা, কুয়াশা, নিশাত ও রঘুপতি।
এ মুহূর্তে ভাবছে রানাঃ এর শেষ কোথায়? বাউন্টি হান্টারদের দিয়ে শুরু। না, তারও আগে পনেরোজনের মৃত্যু চেয়েছে ম্যাজেস্টিক-১২। এদের কারণে মারা পড়েছে বহু মানুষ। এখন মস্ত বিপদে পড়েছে গোটা দুনিয়া। আরও ঘোট পাকিয়েছে ডেমিয়েন ডগলাস। পুরো দুনিয়ার ক্ষমতা চাই তার।
দূর সাগরে চোখ রেখেছে কুয়াশা, নিশাত ও রোবট রঘুপতি, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল রানার। আবারও রেডিয়ো করেছে খবির।
সব তথ্য পাঠিয়ে দিচ্ছি, স্যর, সময় নষ্ট না করেই বলল সার্জেন্ট।
টিপ আওয়াজ তুলল রানার পাম পাইলট: স্ক্রিনে ভেসে উঠল খবিরের প্লট করা সমস্ত নোয়ায শিপের হিসাব। চোখ বিস্ফারিত হলো রানার। আরব সাগর… তাইওয়ান স্ট্রেইটস্…
আর আপনার জন্যে সেভেন্থ মার্সেন সংখ্যা বের করেছে কেভিন কনলন, বলল খবির। ওটা ৪,৩১,১২,৬০৯। ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল আবারও।
বাম তালুতে সাবধানে সংখ্যা লিখে নিল রানা, তারপর বলল, ৪,৩১,১২,৬০৯, ঠিক আছে, খবির?
কে জানে, স্যর, হতাশ স্বরে বলল সার্জেন্ট।
কেভিনকে বোলো, এসব শেষে ওর সঙ্গে দেখা করব। …রানা আউট।
চ্যানেল পাল্টে নিল রানা, প্যাঁচ করল লণ্ডনের ইউএস এম্বেসিতে। মিস্টার ডেলাক্রুস, আপনাদের সাবমেরিনের কী খবর?
কিছুক্ষণ আগে লণ্ডনে ডেলাসের সঙ্গে কথা হয়েছে। রেডিয়োতে।
তাতে শ্বাস ফেলে স্বস্তি পেয়েছে ভদ্রলোক। যোগাযোগ করে ওয়াশিংটনে জানিয়ে দিয়েছে, মাসুদ রানা সুস্থ আছেন।
আমার কাছে ভাল-খারাপ, দুধরনেরই খবর আছে, বলল। ডেলাস।
ভাল খবর আগে দিন।
ভাল খবর হচ্ছে, আমাদের লস এঞ্জেলেস-ক্লাস অ্যাটাক সাবগুলো আছে আরব সাগর ও তাইওয়ান স্ট্রেইটে। প্রয়োজন পড়লে সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চ-বোটগুলোকে ডুবিয়ে দেবে।
এবার খারাপ সংবাদ?
আর খারাপ সংবাদ হচ্ছে: সঠিক সময়ে অন্য তিন লঞ্চ বোট, মানে নিউ ইয়র্ক, স্যান ফ্রান্সিসকো এবং ইংলিশ চ্যানেলের জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না আমাদের সাবমেরিন। এরা অনেক আগেই উৎক্ষেপ করবে মিসাইল। খবির আর কনলনকে গিয়ে উঠতে হবে ওই দুই জাহাজে, ডিসআর্ম করতে হবে মিসাইল।
বুঝলাম, বলল রানা।
পেয়ে গেছি! নিচু স্বরে বলল রঘুপতি। খেপা সাগরে নোঙর করা এক সুপারট্যাঙ্কারের দিকে আঙুল তাক করেছে। এদিক ওদিক দুলছে মস্ত জাহাজ।
হাওয়া ছেড়েছে বেশ। কাত হয়ে উৎক্ষিপ্ত বর্শার মত নামছে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। ধূসর আকাশ চিরে দিল গাঢ় নীল বিদ্যুৎ ঝিলিক। খেপে উঠেছে সাগর। এদিক-ওদিক দুলছে প্রকাণ্ড জাহাজ। শক্তিশালী ফ্লাডলাইটে ভাসছে প্রকাণ্ড ডেক। ফ্রান্সের উপকূলে ওই জাহাজের মত মাল খালাস করবার জন্য অপেক্ষা করছে আরও অনেক জাহাজ।
ট্র্যান্সপণ্ডার সিগনাল আইডেনটিফাই করে বুঝেছি, ওটাই এমভি লোটাস, জিপিএস লোকেশনও মিলে গেছে।
গুড ওঅর্ক, রঘুপতি, বলল রানা। মিস্টার ডেলাস, আপনার সহায়তার জন্যে ধন্যবাদ। এবার কাজে নামতে হবে আমাদেরকে।
কুয়াশা ও নিশাতের দিকে ঘুরে চাইল রানা। ধরে নিতে পারি ওরা বাধা দেবে। সেক্ষেত্রে গোলাগুলি হবে। এটা প্রথম জাহাজ, এটার মিসাইল ঠেকাতে পারলে দূর থেকেও অন্য জাহাজের মিসাইল ডিসআর্ম করতে পারব। কারও কোনও প্রশ্ন?
আমার কোনও প্রশ্ন নেই, বলল কুয়াশা।
দিন শেষে সব ভাল হোক, মন্তব্য করল নিশাত।
তা হলে তৈরি হয়ে নিন, আপা। আমরা জাহাজে নামছি, গম্ভীর সুরে বলল রানা।