বাউণ্টি হাণ্টার্স ১.২

এগারো

নিকষ অন্ধকারে চোখ মেলেছে উজ্জ্বল হেডলাইট। ধুলোভরা গুহায় যুদ্ধে ব্যস্ত তলোয়ারের মত নাচছে বাতিগুলো।

তুমুল গতিতে সরু টানেলে সগর্জনে চলেছে কুয়াশার ড্রিফটরানার। আকারে হামভি ট্রাকের মতই, বড় একটা পিকআপ, বললেও দোষ হবে না। পিছনে দীর্ঘ ট্রে। প্রায় ঘিরে রাখা হয়েছে। ড্রাইভারের কম্পার্টমেন্ট। অবশ্য, ট্রে-র দিক থেকে দেয়াল বা জানালা দিয়ে আলাদা করা হয়নি ড্রাইভিং সেকশনকে। কেউ চাইলে ট্রে পেরিয়ে দুসারি সিট টপকে আসতে পারবে সামনে।

কালো টানেল চৌকো, নিরেট গ্র্যানিটের। পুরু কাঠের কলাম। ও বিম ওজন নিয়েছে পাথুরে ছাতের। নিক্ষিপ্ত তীরের মত গেছে। সরল পথ। ড্রিফটরানারের দুপাশে বড়জোর এক ফুট জায়গা, তারপর প্রস্তর প্রাচীর। প্রচণ্ড গতি ট্রাকের। ছাতের চারফুট উপরে সিলিং। পিছনে চলে এসেছে কোবরা ইউনিট।

কুয়াশার ড্রিফটরানারের পিছনে রানার এলএসভি, ওতে করে আসছে তিন রাশান কমাণ্ডো। তাদের যান অনেক দ্রুতগামী, সরে যেতে পারে ঝট করে। উন্মাদের মত আসছে ড্রাইভার, ড্রিফটরানারের উপর ভিযেড-৬১ মেশিন পিস্তল থেকে গুলি শুরু করছে তার দুই সঙ্গী।

এলএসভির ছুটন্ত হেডলাইটের রশ্মি ভাসিয়ে দিয়েছে নিশাত, আফজাল ও কৃষ্ণকে। পাল্টা গুলি শুরু করল ওরা।

এলএসভির পিছনে আরও তিন ড্রিফটরানার, আসছে স্পেন্যায ইউনিটের মেজর মিখাইল পেরোনভ সহ সতেরোজন কমাণ্ডো।

ছোট কাফেলা, পাথুরে টানেলে ভয়ঙ্কর গতি তুলেছে।

আপা! ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্ট থেকে চেঁচাল রানা। সময়?

তিন মিনিট!

এই সুড়ঙ্গ কতদূর গেছে? কুয়াশার কাছে জানতে চাইল। রানা।

মোটামুটি চার মাইল।

ঠিক সময়ে বেরুতে না পারলে… চুপ হয়ে গেল খবির।

নিশাত, খবির, আফজাল ও কৃষ্ণের অস্ত্রের মাযল থেকে ছিটকে বেরুচ্ছে লালচে আগুন। পালাক্রমে গুলি করছে দ্রুতগামী এলএসভির উপর। দুজন গুলি করলে অন্য দুজন অস্ত্র রিলোড করছে।

এ নিয়ম মেনে ঝট করে বসে পড়ল নিশাত ও খবির, ব্যস্ত হয়ে উঠল অস্ত্রে গুলি ভরতে। ওদের জায়গা নিল আফজাল ও কৃষ্ণ। তখনই তুমুল বৃষ্টির মত এল কয়েক পশলা বুলেট। মুহুতে উধাও হলো কৃষ্ণের মুখ, ওখানে রইল শুধু থকথকে রক্ত ও চেরা মাংস। কণ্ঠে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ল আফজাল। গাড়ি থেকে ওর পতন ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেকাল খবির। ধরে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু মস্ত সুযোগ পেয়ে গেল কোবরা ইউনিটের কমাণ্ডারা।

গুলি ভরবার ফাঁকে পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে নিশাত, ঘুরেই দেখল কী ঘটছে। এলএসভির প্যাসেঞ্জার সিট থেকে সামনে বেড়েছে দুই যাত্রী, উঠেছে গাড়ির বনেটে, লাফ দিয়ে নামল ড্রিফটরানারের পিছনের ট্রে-তে।

আফজালকে দুহাতে ধরে আছে খবির।

এবার আর রক্ষা নেই ওর।

খবিরের মাথা লক্ষ্য করে অস্ত্র তুলল কোবরা ইউনিটের দুই সদস্য।

তারই ফাঁকে খবির দেখল, আস্তে করে কাত হয়ে গেল আফজালের মাথা। মারা গেছে ছেলেটা।

গুলিভরা অস্ত্র নেই নিশাতের হাতে, ঝড়ের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই রাশান সৈনিকের উপর।

পর মুহূর্তে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে ট্রে-র মেঝেতে পড়ল ওরা তিনজন। দুপাশে সাঁই-সাই পিছিয়ে চলেছে টানেলের পাথুরে, ধূসর দেয়াল।

কুয়াশা ও রানা সবই দেখতে পেয়েছে। সিট থেকে উঠেই ঘুরে দাঁড়াল রানা।

এটা নাও! গুড়গুড় করে উঠল কুয়াশার কণ্ঠ। বাড়িয়ে দিয়েছে রুপালি রেমিংটন। ওদেরকে সাহায্য করার পর পিছনের গাড়ি ঠেকাতে চেষ্টা কোরো!

ড্রিফটরানারের ট্রে-তে ডাইভ দিয়ে নামল রানা। দেখল, মেঝেতে দুই কমাণ্ডের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে নিশাত। মৃত আফজালকে দুহাতে ট্রে-তে তুলে নিল খবির। নাকের কাছে হাজির হয়েছে এলএসভি। বদ্ধ টানেলে দিনের আলো দিচ্ছে উজ্জ্বল হেডলাইট। একজনকে লাথি মেরে ফেলে দিল রানা ট্রে থেকে, অপরজনকে মাথার ওপর তুলে ছুঁড়ে দিল নিশাত পিছনের গাড়ির দিকে। পিষে গেল সে এলএসভির চাকার নীচে।

দুহাতে রুপালি রেমিংটন তুলল রানা, গুলি করল এলএসভি লক্ষ্য করে।

জোর লাথি দেয়ার মত ঝাঁকি মারল বন্দুক। তার চেয়ে ঢের অবাক করা একটা কাজ করল। বিশেষ কোনও গুলি ব্যবহার করে কুয়াশা।

ওই অদ্ভুত গুলির কারণে নানাদিকে ছিটকে গেল এলএসভির বডি, লাফিয়ে উঠেছে চেসিস থেকে। মুহূর্তের জন্য আকাশে ভাসল এলএসভি, তারপর কাত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পাশের দেয়ালে। তীব্র গতিতে উল্টে গেল লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল, ডিগবাজি দিতে শুরু করে পিছু নিল সামনের ড্রিফটরানারের। কয়েক মুহূর্ত পর ধুপ করে পড়ল মুচড়ে যাওয়া ছাতে ভর করে।

আশ্চর্যজনক, গাড়ির ড্রাইভার এখনও সুস্থ!

কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়।

পরের সেকেণ্ডে পিছন থেকে ছিন্নভিন্ন হলো এলএসভি। লক্ষ টুকরো হলো পিছনের ড্রিফটরানারের আঘাতে। বিস্ফোরিত। এলএসভি মাড়িয়ে বেরিয়ে গেল পর পর তিনটে ড্রিফটরানার।

কয়েক মুহূর্ত পর আবারও কুয়াশার ড্রিফটরানারের পিছনে হাজির হলো রাশান কমাণ্ডোরা।

ধূসর ধুলো উড়িয়ে ছুটছে কুয়াশার যান।

রাশানদের সামনের ট্রাকের গতি প্রচণ্ড, গুঁতো দিল রানাদের গাড়ির পিছনে।

বেদম ঝাঁকি খেল দুই জিপ।

তখনই কয়েক লাথিতে ভেঙে পড়ল রাশানদের সামনের গাড়ির উইণ্ডশিল্ড। বনেটে উঠে এল কয়েকজন। কিছু করবার সময় বা সুযোগই পেল না রানা। আবছা আলোর সুড়ঙ্গে ওদের ড্রিফটরানারের ট্রে-তে লাফিয়ে নেমে এল তিন কমাণ্ডো। খবির বা নিশাতকে পাত্তাই দিল না, সামনে বাড়ল রানার মুখোমুখি হতে। হাতে উদ্যত মেশিন পিস্তল।

রিয়ার ভিউ মিররে এদের দেখেছে কুয়াশা। দেরি না করে দাঁড়িয়ে গেল ব্রেক প্যাডেলের উপর।

মস্ত হোঁচট দুলিয়ে দিল ওদের ড্রিফটরানারকে।

হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। হেঁচড়ে সামনে এগোলো নিশাত, খবির ও মৃত আফজাল। পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিল রানা।

পিছনের তিন জিপ যেন পলকা ডোমিনো, হামলে পড়ল পরস্পরের উপর। কর্কশ আওয়াজ উঠল লোহা ভাঙার।

রানাদের ড্রিফটরানারে তিন কোবরা কমাণ্ডে ছিটকে পড়ল সামনে। অস্ত্র হাত ছাড়া করল তাদের একজন, কিছু ধরতে চাইল। দুহাতে। ডানদিকের লোকটা মেঝেতে পড়েছে রানার পাশেই, এবং তৃতীয় লোকটা উড়ে গিয়ে পড়ল ড্রাইভারের কম্পার্টমেন্টের ভিতর। নাক-মুখ ঘেঁচে গেল ড্যাশবোর্ডে লেগে। কয়েক মুহূর্ত পর মুখ তুলে দেখল, চোখের দিকে চেয়ে আছে রুপালি বন্দুক। ব্যারেলে জ্বলছে নীল বিন্দু, আলোকিত করে তুলেছে তার নাকটাকে।

এক সেকেণ্ড পর গর্জে উঠল কুয়াশার বন্দুক।

টাশ্‌শ্‌!

তরমুজের মত বিস্ফোরিত হলো টুপারের মাথা। টমেটোর সুপের মত নানাদিকে ছিটকে গেল রক্ত।

আবারও মেঝের সঙ্গে টিপে ধরল কুয়াশা অ্যাক্সেলারেটার, ঝটকা দিয়ে সামনে বাড়ল গাড়ি।

তাল সামলে নিয়েছে অন্য দুই স্পেন্যায় কমাণ্ডো। তাদের লক্ষ্য মাসুদ রানা।

অস্ত্রহীন ওরা সবাই।

খাপ থেকে সড়াৎ করে ওয়ারলক হান্টিং নাইফ বের করল দুই রাশানের একজন, অন্যজন চট করে মেঝে থেকে তুলে নিল। ভিযেড-৬১ মেশিন পিস্তল। ঘুরেই গুলি করতে চাইল।

কিন্তু তখনই ঝট করে ঘুরে চাইল কুয়াশা, বুঝতে দেরি হয়নি বিপদে পড়েছে রানা।

বিদ্যুদ্বেগে নড়ে উঠেছে বাঙালি গুপ্তচর।

কারাতের চপে মেশিন পিস্তল সরিয়ে দিল ও, অন্যহাতে খপ করে ধরতে চাইল অস্ত্রের নল।

তখনই গর্জে উঠল শত্রুর মেশিন পিস্তল। পাশ কাটিয়ে গেল গুলি, কিন্তু বুঝতে দেরি হলো না রানার, একা দুজনকে ঠেকাতে পারবে না ও।

ছোরা হাতে লাফিয়ে সামনে বাড়ল কোবরা ইউনিটের দ্বিতীয় কমাণ্ডো, একপাশ থেকে চালাল ওয়ারলক হান্টিং নাইফ।

এবার কচ করে কাটা পড়বে রানার গলা। কিন্তু তার আগেই ঝটকা দিয়ে সিট ছেড়েছে কুয়াশা, অবিশ্বাস্য গতিতে উপস্থিত হলো ট্রে-র মুখে। দুকাঁধে বাইসনের শক্তি, অনায়াসেই ঠেলে ফেলল দুরাশান কমাণ্ডোকে। ভিযেড-৬১ হাতে লোকটাকে রানার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়েছে বৈজ্ঞানিক, এক টানে ভরে দিল ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্টের ভিতর।

তখনই পিছন থেকে গুতো দিল রাশান ড্রিফটরানার।

জোরালো হোঁচট খেল কুয়াশা ও দুই স্পেন্যায় কমাণ্ডো। উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে গিয়ে ড্রিফটরানারের বনেটে পড়ল ওরা।

ভাঙেনি উইণ্ডশিল্ড, ওই কাঁচ শাটারপ্রুফ, মাকড়সার জালের মত ফাটল ধরেছে ওখানে। ধুপ আওয়াজ তুলে ছিটকে গেছে। ফ্রেম থেকে, বনেটে নেমেই স্থির হয়েছে। চৌকো কাঁচের তৈরি চিড় ধরা ম্যাট্রেস যেন।

সুরু টানেলে তুমুল গতি তুলছে চার ড্রিফটরানার।

প্রথমবারের মত রানা দেখল, গ্যাস প্যাডেলে স্টিলের একটা দণ্ড ঠেস দিয়ে রেখে ড্রাইভিং সিট ছেড়েছে কুয়াশা। সরলরেখার মত সোজা টানেলে ছুটছে জিপ। দুপাশের পাথুরে দেয়ালে এদিক-ওদিক লাগছে গাড়ির বডি।

বনেটের উপর দু কমাণ্ডের সঙ্গে হাতাহাতি লড়ছে কুয়াশা। রানাকে শেষ করতে আবারও ফিরতে চায় ছোরাওয়ালা। এদিকে নিজেকে বনেটে স্থির করতে গিয়ে হারিয়ে বসেছে তার সঙ্গী ভিযেড-৬১।

উইণ্ডশিল্ড নিয়ে পড়বার সময় সবচে বিপদে পড়েছে কুয়াশা। পা-দুটো ঝুলছে দ্রুতগামী ড্রিফটরানারের নাকের কাছে। একহাতে ধরেছে বুল-বার। তারই ফাঁকে দেখল, আবারও হাঁচড়ে-পাঁচড়ে রানার দিকে ফিরতে চাইছে ছোরাওয়ালা। ডানহাতে তার বুট আঁকড়ে ধরল কুয়াশা, হ্যাচকা টানে নিয়ে এল নিজের পাশে। পরের টানে সে গিয়ে পড়ল ড্রিফটরানারের সামনে।

ড্রিফটরানারের নীচে যাওয়ার সময় বিকট আর্তনাদ ছাড়ল কমাণ্ডো, পরক্ষণে চাপা পড়ল চাকার নীচে। লাফিয়ে উঠল গোটা গাড়ি, পেরুল লোকটাকে। কয়েক সেকেণ্ডে তাকে চেপ্টে দিল পুরো কাফেলা। চতুর্থ ট্রাক যাওয়ার পর দেখা যাবে, পড়ে আছে। হাড় চুর চুর হওয়া এক রক্তাক্ত লাশ।

কোবরা ইউনিটের দ্বিতীয় লোকটা সবই দেখেছে। লাথি দিতে শুরু করেছে কুয়াশার হাতে। কিন্তু লাফিয়ে উঠে খপ করে তার বেল্ট ধরল বৈজ্ঞানিক, নিজের দিকে টানতে লাগল।

না! ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, না!

ভয় কীসের? কঠিন সুরে বলল কুয়াশা। বনেটের শেষ প্রান্তে টেনে আনল কমাণ্ডোকে। পাশাপাশি হলো দুজন। রাশান লোকটা নিজেও প্রকাণ্ডদেহী, থরথর করে কাঁপছে রাগে-ভয়ে। দুহাতে খপ করে ধরল কুয়াশার গলা।

আমি যদি পড়ি, তোকেও মরতে হবে! গর্জে উঠল।

বেশ, শান্ত স্বরে বলল কুয়াশা। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই পা সরিয়ে নিল ড্রিফটরানারের বাম্পারের উপর থেকে। সঙ্গে নিয়েছে রাশান কমাণ্ডোকে। ট্রাকের সামনে ধুলোময় পথে পড়ল দুজন।

মেঝেতে পড়েই গড়ান দিল স্পেন্যায ট্রুপার, তখনই মড়াৎ আওয়াজ তুলে চেপ্টে গেল ড্রিফটানারের সামনের চাকার নীচে। কুয়াশার মত করে খপ করে ধরতে পারেনি উইণ্ডশিল্ডের ম্যাট্রেস।

পড়বার সময় ফাটল ধরা কাঁচের মাদুর সঙ্গে নিয়েছে কুয়াশা। নীচে রেখেছে ওটাকে, নেমে এসেছে বুনো বিড়ালের মত। কয়েক মুহূর্ত সামনে বেড়েছে কাঁচের মাদুর, তখনই ওটার উপর দিয়ে সগর্জনে পেরুল প্রথম ড্রিফটরানার।

দেখতে না দেখতে হু-হুঁ করে কুয়াশাকে পেরিয়ে গেল চার ড্রিফটরানার।

মাদুরে নিশ্চিন্তে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কুয়াশা। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। চতুর্থ গাড়ি পেরুতেই ব্যস্ত হয়ে উঠল বিজ্ঞানী। আলখেল্লা থেকে নিয়েছে দ্বিতীয় শটগান। শক্ত করে ব্যারেল ধরে ব্যবহার করেছে পিস্তল-গ্রিপ, বাধিয়ে নিয়েছে চতুর্থ গাড়ির রিয়ার বাম্পারের নীচে।

সাঁৎ করে পিঠের তলা থেকে সরে গেছে কাঁচের মাদুর। আঁধার টানেলে কুয়াশাকে নিয়ে ছুটে চলেছে কাফেলার পিছনের গাড়ি। পাথুরে মেঝেতে বেকায়দাভাবে ঠোকর লাগছে কুয়াশার পা।

ব্যারেল বেয়ে সামনে বাড়ল বিজ্ঞানী, কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছল পিছনের ড্রিফটরানারের ট্রের কাছে। এবার উঠে পড়বে গাড়িতে। নতুন করে লড়বে শত্রুদের বিরুদ্ধে।

.

দেরি না করে ড্রিফটরানারের ড্রাইভিং সিটে বসে পড়েছে মাসুদ রানা। উইণ্ডশিল্ড নিয়ে বনেটে কুয়াশা পড়বার পর, লাথি দিয়ে অ্যাক্সেলারেটার আটকে রাখা ইস্পাতের দণ্ড সরিয়ে দিয়েছে ও, ড্রাইভ করছে ঝড়ের গতিতে।

রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, দুই স্পেন্যায কমাণ্ডের সঙ্গে আনআর্মড কমব্যাটে ব্যস্ত নিশাত-খবির।

কিন্তু দ্বিতীয় ড্রিফটরানার থেকে ওদের যানের ট্রেতে নামল আরও দুই ট্রুপার। তেড়ে এল ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্ট লক্ষ্য করে।

ওরা সংখ্যায় অনেক, ড্রাইভিঙের ফাঁকে ভাবল রানা।

কোবরা ইউনিটের নতুন দুই সৈনিকের হাতে উদ্যত আগ্নেয়াস্ত্র। যখন তখন খতম হবে রানা। খনির ভেহিকেল বিষয়ে একটা কথা চট করে মনে পড়ল ওর। দেরি না করে হাত বাড়িয়ে দিল সিটবেল্টের দিকে।

আপা! খবির! শক্ত করে কিছু ধরুন!

ড্রাইভিং সিট থেকে আরেকদিকে হাত বাড়াল রানা, জোর ধাক্কা দিয়ে খুলে দিল প্যাসেঞ্জার দরজা।

ফলাফল বিস্ময়কর।

আচমকা কাজ করল ড্রিফটরানারের হ্যাণ্ডব্রেক। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। যেন কোনও মাইনার আহত না হয়, সেজন্য খনির সব ভেহিকেলে থাকে ওই সেফটি ফিচার। দরজা খুললেই নিউট্রাল হয় গিয়ার, সঙ্গে সঙ্গে কাজ করে হ্যাণ্ডব্রেক।

প্রস্তুত ছিল না, ফলে দ্বিতীয় ড্রিফটরানার বেদম গুঁতো দিল রানাদের গাড়ির পিছনে। পরের দুই গাড়ি যেন বুজে আসা বাদ্যযন্ত্র অ্যাকর্ডিয়ন।

পিছন থেকে গুতো আসতেই বেকায়দাভাবে হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়ল রানার পিকআপ ট্রাক।

শত্রুদেরকে শেষ করতে এসে মস্ত বিপদে পড়েছে দুই কোবরা কমাণ্ডো, একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। প্রথমজন রানাকে পাশ কাটিয়ে উইণ্ডশিল্ডের ফাঁকা জায়গা দিয়ে উড়ে গেল। নামল কমপক্ষে পনেরো ফুট দূরে। ড্রাইভিং কেবিনের ছাতে বেধে গেল দ্বিতীয়জনের থুতনি, ছিটকে বেরিয়ে গেল দুই পা, কিন্তু আটকা পড়ল তার মাথা–কড়াৎ আওয়াজে ভাঙল ঘাড়।

এদিকে রানার কথায় হাতাহাতি বাদ দিয়ে খপ করে ট্রের একপাশ ধরেছে নিশাত ও খবির। ড্রিফটরানার থামতেই ছিটকে সামনে বাড়ল দুই স্পেন্যায কমাণ্ডে। হুমড়ি খেয়ে পড়ল ড্রাইভিং ও প্যাসেঞ্জার সিটের পিছনে।

মাথায় বাড়ি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল তাদের একজন। অন্যজন সামান্য আহত, উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তার মাথার উপর নামল নিশাতের এমপি-৭-এর বাট। জ্ঞান হারিয়ে ধুপ করে পড়ল লোকটা।

দুই অচেতন কমাণ্ডোকে গাড়ি থেকে ফেলে দিল খবির ও নিশাত।

কাজ শেষ, হাত বাড়িয়ে প্যাসেঞ্জার সিটের দরজা বন্ধ করল। রানা, মেঝের সঙ্গে টিপে ধরল অ্যাক্সেলারেটার।

নতুন উদ্যমে সামনে বাড়ল গাড়ি। খুব ক্ষতি হয়নি পিছনের ড্রিফটানারগুলোর যাত্রীদের। পিছু নিল তারা সামনের পিকআপের।

সংখ্যায় ট্রপাররা এখনও কমপক্ষে দশজন। কিন্তু তখনই নিজের কাজ শুরু করল কুয়াশা। পিছনের গাড়ি গুঁতো খেয়ে থামতেই ট্রে বেয়ে উঠছিল, ফলে আহত হয়নি। নতুন করে চার ড্রিফটরানার রওনা হতেই উঠে এল পিছনের গাড়িতে। কোনও সুযোগই পেল না কোবরা ইউনিটের কমাণ্ডারা।

বাধা দিতে চাইল, অস্ত্র তুলল শত্রুকে শেষ করতে। কিন্তু কুয়াশা যেন নিজেই একটা মেশিন গান।

পিছনের ট্রেতে বন্দুকের গুলি খেয়ে উড়ে গেল দুই কোবরা কমাণ্ডো। প্রথমজন মরল মাথায়, বুলেট নিয়ে। একহাতে দ্বিতীয়জনের গলা চেপে ধরল কুয়াশা, মাথাটা ঠেলল ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্টের ছাতের চেয়ে উপরে। দ্রুতগতিতে পিছিয়ে যাওয়া এক ওভারহেড বিমে লাগল সৈনিকের মাথা, ধড় থেকে গোটা মুণ্ডু খটাং করে ছিটকে গেল আরেকদিকে।

পরক্ষণে ড্রাইভারের কম্পার্টমেন্টে হাজির হলো কুয়াশা, টাশশ আওয়াজ তুলল খাটো নলের রেমিংটন, উগরে দিল লালচে আগুন। ছিন্নভিন্ন হলো যাত্রী।

হতবাক হয়ে ঘুরে চাইল ড্রাইভার।

কিন্তু তাকে পাত্তাই দিল না কুয়াশা, এক গুলিতে উড়িয়ে দিল উইণ্ডশিল্ড, পর মুহূর্তে ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে লাফিয়ে উঠে এল তৃতীয় ট্রাকের ট্রের উপর।

এ ট্রাকে রয়েছে মেজর পেরোনভ। কুয়াশাকে দেখতে পেয়েই আড়াল খুঁজতে চাইল সে। ড্রিফটরানারের মাঝ ধরে এগোচ্ছে বৈজ্ঞানিক। উড়ে গেল দুপাশের কমাণ্ডোরা। পাল্টা গুলি করতে চাইল দুএকজন, কিন্তু তাদের চেয়ে অনেক দ্রুত কুয়াশা। কী করে যেন আগেই বুঝছে এরপর কী করবে সৈনিকরা।

ড্রাইভিং কম্পার্টমেন্টের দিকে কুয়াশা যেতেই ড্যাশবোর্ডের নীচে লুকিয়ে পড়তে চাইল পেরোনভ।

মাত্র এক সেকেণ্ড তাকে দেখল কুয়াশা, স্থির করল এখানে সময় নষ্ট করবে না। রওনা হলো রানার ড্রিফটরানার লক্ষ্য করে।

রাশান মেজরকে শেষ না করেই লাফিয়ে দ্বিতীয় ট্রাকে নামল কুয়াশা।

.

এদিকে তুমুল গতি তুলেছে রানা। গাড়িতে শত্রু নেই। বহু দূরে ছোট্ট চারকোনা সাদা আলো। ওদিক দিয়ে বেরুতে পারবে সুড়ঙ্গ থেকে।

ওর পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে এসে বসল নিশাত। স্যর, এরা কারা? আর কালো আলখেল্লা পরা ওই বৈজ্ঞানিক?

পরে কথা হবে, আপা, বলল রানা। খেয়াল করল, পিছনের ড্রিফটরানারের বনেটে উঠেছে কুয়াশা। শুধু জেনে রাখুন, আশপাশে যত লোক, তাদের ভিতর ওই কুয়াশা একমাত্র মানুষ, যে আমাদেরকে খুন করতে চাইছে না।

পরে হয়তো চাইবে, পিছনের ট্রে থেকে বলল খবির, একে এড়িয়ে যাওয়াই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ।

আমারও তাই মনে… চুপ হয়ে গেল নিশাত।

সুড়ঙ্গের শেষভাগে পৌঁছে গেছে ওরা। উজ্জ্বল সাদা চৌকো আলো আসছে দূর থেকে। ওখানে পৌঁছুতে আর বড়জোর দুই শ গজ পেরুতে হবে। অন্য কারণে কথা থামিয়ে দিয়েছে নিশাত।

সুড়ঙ্গের শেষে খোলা আকাশে ভাসছে পৈশাচিক এক দানবীয় জিনিস, যেন প্রাগৈহাসিক কোনও টেরোডাকটিল।

ওটা জেট ফাইটার বিমান। কালো রঙের। সুখোই এস-৩৭, ভাসছে সুড়ঙ্গের মুখে।

খাড়া নাক তাক করেছে ড্রিফটরানার লক্ষ্য করে। ঝুলে আসা ডানায় ভরা আছে মিসাইল। অশুভ এক বাজপাখি যেন। মুখোমুখি হওয়ার জন্য চেয়ে আছে ভয়ঙ্কর চেহারা করে।

ধুপ আওয়াজ পেল রানা। ড্রিফটরানারের ট্রেতে নেমেছে কুয়াশা, সিটের কাছে পৌঁছে বলল, ভয় নেই। ফাইটার বিমানের দিকে ইশারা করল। ওটা আমাদেরকে সরিয়ে নেবে। রিস্ট গার্ড-এ বাটন টিপল, চালু হয়ে গেল রেডিয়ো। রঘুপতি, আসছি! পিছনে শত্রুদের ড্রিফটরানার। ব্যবহার করবে সাইডওয়াইণ্ডার। আবারও বলছি, ডানদিকের ডানা থেকে মিসাইল। নিচু করে তাক করবে। দুই শ মিটারের জন্য আর্ম করো। গতবছর যেমন হয়েছিল আর্জেন্টিনায়।

ইয়েস, বস! গম্ভীর কণ্ঠ শুনল ওরা।

রানাকে বলল কুয়াশা, আপত্তি না থাকলে ড্রাইভ আমি করি।

সিট থেকে সরে গেল রানা, সেখানে বসল কুয়াশা। এক সেকেণ্ড পর মাপা হাতে মোচড় দিল স্টিয়ারিং হুইলে।

দেয়াল ঘেঁষে ছুটছে পিকআপ, আরেকবার হুইলে মোচড় দিল কুয়াশা, তখনই ধপ্ আওয়াজ তুলে বামদিকের চাকাগুলো উঠে গেল দেয়ালে। গতি কমল না, কিন্তু পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কাত হয়ে ছুটছে গাড়ি।

ঠিক আছে, রঘুপতি, এবার! রিস্ট মাইকে বলল কুয়াশা।

দিগন্তে ভাসছে কালো ফাইটার, ডানদিকের ডানা থেকে ছিটকে বেরোল ধোঁয়ার রেখা। ফাপা আওয়াজ তুলে সুড়ঙ্গের ভিতর রওনা হয়ে গেছে সাইডওয়াইণ্ডার।

মিসাইল আসছে মাটি ঘেঁষে, গতি প্রচণ্ড।

রানা দেখল, মিসাইল আসছে বা দেয়াল ছুঁয়ে। দেখতে না দেখতে পৌঁছে গেল নাকের কাছে। তারপর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কাত হওয়া ড্রিফটরানারের তলা দিয়ে হুস্ আওয়াজ তুলে বেরিয়ে গেল। বিধল গিয়ে পিছনের ট্রাকের নাকে।

ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো। ভেঙে পড়ল সুড়ঙ্গের চারপাশ। লক্ষ টুকরো হলো প্রথম স্পেন্যায ড্রিফটরানার। ওটার নিতম্বে নাক গুজল পরের ড্রিফটরানার। শেষেরটা হুমড়ি খেল সামনের গাড়ির উপর। মুহূর্তে থামল তিন গাড়ির গতি।

আর একইসময়ে সুড়ঙ্গের মুখ থেকে ছিটকে উজ্জ্বল আলোয় বেরিয়ে গেল রানাদের ড্রিফটরানার।

পাহাড়ের খাড়া উপত্যকা এদিকটা। পথ গেছে এঁকেবেঁকে নীচে।

সামান্য দূরে একহাজার ফুট নেমেছে খাদ। পাশেই ভাসছে সুখোই ফাইটার।

নিশাতের দিকে চাইল কুয়াশা। বোমা পড়তে কতক্ষণ বাকি?

হাতঘড়ি দেখল ক্যাপ্টেন। তিরিশ সেকেণ্ড।

খুশি হবে না মেজর পেদরোনভ। রিস্ট মাইকে বলল কুয়াশা, রঘুপতি, পরের বাঁকে দেখা করো। রানার দিকে চাইল। আমার সঙ্গে যেতে আপত্তি আছে?

না।

পঁচিশ সেকেণ্ড পর পাহাড়ের সমতল এক প্ল্যাটফর্মের মত জায়গায় নামল চকচকে সুখোই। তখনই পৌঁছে গেল রানাদের ড্রিফটরানার।

কালো বিমানের পাশে গাড়ি রাখল কুয়াশা।

তখনই ওরা দেখল, হাজির হয়েছে সি-১৩০ হারকিউলিস বিমান। তিশার রেখে যাওয়া লেসার ডাইয়োডের কারণে সহজেই খুঁজে নিয়েছে খনির শাফট। পেট থেকে ছেড়ে দিল একুশ হাজার পাউণ্ডের এমওএবি বোমা।

নিখুঁতভাবে কাজ করেছে গাইডেন্স সিস্টেম। সাঁই-সাই করে নামছে বোমা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল টার্মিনাল ভেলোসিটিতে। মুহূর্তে মস্ত বোমা মিলিয়ে গেল খনির চিমনির ভিতর। সময় গনতে শুরু করেছে রানা। ওয়ান থাউযেও ওয়ান… ওয়ান থাউযেণ্ড টু…. ওয়ান থাউযেণ্ড থ্রি… এবার বিস্ফোরিত হওয়ার কথা ওই বোমা। তখনই থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা পাহাড়।

আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মত কান ফাটানো বিকট বুমবুম! আওয়াজ শুরু হয়েছে।

যেন মাথার উপর নামছে ভয়ঙ্কর বজ্র।

সুখোই বিমানের ককপিটে দুজন বসতে পারে, তরতর করে মই বেয়ে উঠছে খবির ও নিশাত।

কুয়াশাকে ইশারা করল রানা, যেন আগে ওঠে বিমানে।

মাথা নাড়ল বিজ্ঞানী। তুমি আগে।

বাধ্য হয়ে মই বাইতে শুরু করল রানা, কিন্তু টলে উঠতে হলো ওকে জোরালো ভূমিকম্পের কারণে।

চোখ গেল আকাশছোঁয়া চূড়ার দিকে। ওখানে লাফিয়ে উঠেছে বিপুল মাটি-পাথর-ধুলোবালি।

বুঝতে দেরি হলো না, কী ঘটছে। চাপা স্বরে বলল রানা, জলদি! অ্যাভালাঞ্চ শুরু হয়েছে!

বারো

বিমানের মই বেয়ে উঠবার ফাঁকে খনি-সুড়ঙ্গের দিকে চাইল। রানা। এইমাত্র টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছে দুই লোক। দুই সেকেণ্ড পর রকেট গতিতে টানেল থেকে বেরোল তপ্ত তীব্র। হাওয়া, সঙ্গে ছিটকে এল কোবরা ইউনিটের ব্যবহৃত অবশিষ্ট তিন ড্রিফটরানার।

মাটিতে পড়ে যাওয়া ওই দুজনকে পাশ কাটিয়ে ডিগবাজি দিতে দিতে পাহাড়ি খাদের পারে পৌঁছে গেল তিন ড্রিফটরানার, দিগন্তের দিকে রওনা হলো আকাশ পথে কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডে পর খসে পড়ল কার্টুনের দৃশ্যের গাড়িগুলোর মত। এক হাজার। ফুট নামল কয়েক সেকেণ্ডে, বিস্ফোরিত হলো সব র‍্যাভিনে পড়ে।

তখনই পাহাড়ের উপর থেকে এল ভয়ঙ্কর গুড়গুড় আওয়াজ।

সুখোই বিমান যেখানে সমতলে নেমেছে, তার চেয়ে কমপক্ষে একহাজার ফুট উপরে শুরু হয়েছে ভূমিধস। নড়ে উঠল পাহাড়ের গোটা চূড়া, বিপুল পাথর-মাটি নিয়ে হুড়মুড় করে নামতে লাগল ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসের মত আওয়াজ তুলে।

আপা-খবির! জলদি! মই বেয়ে উঠতে শুরু করে দ্বিতীয়বার তাড়া দিল রানা।

গতি বাড়ছে পাথর-মাটির ধসের। নানাদিকে ছিটকাচ্ছে বিপুল ধুলো।

ভয় লাগিয়ে দেয়া গুড়গুড় আওয়াজের উপর দিয়ে গম্ভীর সুরে বলল কুয়াশা, ওঠো বম বে-তে।

হাচড়েপাছড়ে খুদে ককপিট পেরিয়ে পিছনের বম বে-তে পৌঁছে গেল নিশাত ও খবির।

বম বে জায়গাটা বদলে নিয়েছিল পোলাণ্ডের বাউন্টি হান্টার পোলিশ, ব্যবহার করত কারাগারের মত করে।

কয়েক সেকেণ্ড পর ককপিট পেরোল রানা, বসে পড়ল রিয়ার গানারের সিটে। পাঁচ সেকেণ্ড পর ওকে পাশ কাটিয়ে বম বে-তে ঢুকল কুয়াশা।

চোখের সামনে নেমে আসছে পাহাড়ি ভূমিধস। যে-কোনও সময়ে চাপা পড়বে ওরা।

গম্ভীর কণ্ঠে বলল কুয়াশা, রঘুপতি!

ব্যস্ত, বস!

সামনের সিটে থ্রটল নিয়ে কী যেন করছে লোকটা। এক সেকেণ্ড পর ভাসতে শুরু করল সুখোই ফাইটার।

রানা দেখল, টগবগে পানির মত বলকে উঠছে উপরের অ্যাভালাঞ্চ। ঝড়ের গতিতে নামছে প্লাবনের মত। বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ছে মস্ত সব পাথর। কানে তালা লেগে গেল ভয়ঙ্কর আওয়াজে।

মৌমাছির মত ভেসে উঠছে সুখোই, পাশেই পাহাড়ের ক্লিফের চূড়া। তখনই হাজির হলো মাটি-বালি ও পাথরের ভয়ঙ্কর স্রোত। ছোট-বড় পাথর লাফিয়ে ধরতে চাইল কালো বিমানকে। চারপাশে বিকট আওয়াজ। খট-খটাং আওয়াজে বিমানের পেটে লাগছে ছোট পাথরগুলো। পরক্ষণে চূড়া পেরোল সুখোই। কয়েক ফুট নীচ দিয়ে গেল ভূমিধস, চলেছে অনেক নীচে।

আপনাদের মৃত্যু ছিল খুব কাছে, মন্তব্য করল রঘুপতি।

তিন মিনিট পর ইউএন-এর শিবিরে রানার ইয়াক-১৪১ ফাইটার বিমান থেকে এক মাইল দূরে মাউণ্ট স্ট্যানলির আরেকটি ঢালে সমতল জায়গা দেখে নেমে এল সুখোই এস-৩৭ ফাইটার বিমান।

ককপিটের মই বেয়ে মাটিতে নামল রানা, কুয়াশা, নিশাত ও খবির। বিমানে রয়ে গেছে থামের মতই দীর্ঘদেহী রঘুপতি, অবশ্য কয়েক মুহূর্ত পর নেমে এল ইঞ্জিন বন্ধ করে।

ওর নাম রঘুপতি, বিশ্বস্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট, সবার সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিল কুয়াশা।

জবাবে একটা কথাও বলল না লম্বু।

অন্যদের চেয়ে একটু সরে দাঁড়াল রানা, ডুবে গেছে চিন্তার গভীরে। গতকাল থেকে যা ঘটেছে, সেসব নিয়ে ভাবছে। তখনই খড়মড় করে উঠল ওর ইয়ারপিস।

মেজর রানা, আমি কেভিন কনলন, আপনি কোথায়?

কঙ্গো, জবাবে বলল রানা।

শুনুন, যে লিস্ট দিয়েছিলেন, সে তালিকায় একজনের নাম। নেই। কুয়াশার কথা বলেছিলেন, তার নাম আছে এফবিআই ও আইএসএস-র ওয়ান্টেড লিস্টে।

বলতে থাকো, বলল রানা। এ তথ্য ওর জানা আছে।

ওই লোক ভয়ঙ্কর… পেন্টাগনের আণ্ডারগ্রাউণ্ড অফিসে জ্বলজ্বলে কমপিউটারের সামনে বসে আছে কনলন। অফিস পুরো ফাঁকা। মনিটরে কুয়াশার ছবি, দূরপাল্লার ক্যামেরায় তোলা হয়েছে। ছুটছে বৈজ্ঞানিক, দুহাতে রেমিংটন শটগান।

লেখাগুলো পড়তে লাগল কনলন, এ লোকের আসল নাম মনসর আলী। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ মত। দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে ছয় ফুট। কিছুদিন হলো চোখের সমস্যার কারণে ব্যবহার করছে সানগ্লাস। ধারণা করা হচ্ছে, আণবিক রিয়্যাকশনে রেটিনাল ক্ষতি হয়েছে। সহ্য করতে পারে না সাধারণ আলো।

কুয়াশার দিকে চোখ চলে গেল রানার। পরনে কালো আলখেল্লা। কোমরের দুপাশে দুই খাপে নল কাটা দুই বন্দুক। সুখোই বিমানের পাশে দাঁড়িয়ে খবিরের কথা শুনছে।

সে ইউনাইটেড স্টেটসের চরম শত্রু। সুদানে শেষ করার চেষ্টা করে আমেরিকান আর্মি। আইএসএস-এর ধারণা: তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল স্থানীয় আলকায়েদার। বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়া। হয় তার গবেষণাগার। ধরা পড়ে, কিন্তু বেরিয়ে যায় তেরোজন ডেল্টা ডিটাচমেন্টের সৈনিককে খুন করে।

পাঁচ মাস পর দেখা দেয় আর্জেন্টিনায়। আমেরিকান সামরিক বাহিনী পাঠায় নেভির ছয় সিল কমাণ্ডোকে। একজনও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি।

এরপর উধাও হয় মনসুর আলী। সেই সময়ে রাশান ডেপুটি প্রেসিডেন্টের মেয়েকে অপহরণ করে একদল কিডন্যাপার। তখন হঠাৎ করেই উদয় হয় কুয়াশা, নয়জনকে মেরে কেড়ে নেয় ওই মেয়েকে, পৌঁছে দেয় বাবার হাতে। আইএসএস-র ধারণা: চাইলে পৃথিবীর দ্বিতীয় সেরা বাউন্টি হান্টার হতে পারত সে।

কালো বিমানের দিকে চাইল রানা।

ডানার দিকে রওনা হয়েছে রঘুপতি।

চাইলে দ্বিতীয় সেরা বাউন্টি হান্টার হতে পারত? এখন সেরা। কে? জানতে চাইল রানা।

আগেও বলেছি তার কথা। নামটা: ডেভিড এন. হেন্ড্রিক। এক সেকেণ্ড, মনসুর আলীর কথা শেষ করতে পারিনি। প্রিয় মেয়েকে পাওয়ার পর তাকে সরকারের তরফ থেকে একটা ইয়াক-১৪১ যুদ্ধবিমান দেন ডেপুটি প্রেসিডেন্ট। দুনিয়ার যে কোনও রাশান বেস থেকে হাই-অকটেন রিফিউয়েল করতে দেয়া হয়। লোকে ওই বিমানের নাম দিয়েছে কালো দাঁড়কাক।

আচ্ছা, বলল রানা। এখন দেখছি সুখোই এস-৩৭ ফাইটার। প্লেন। ওর দিকে পা বাড়িয়েছে কুয়াশা।

ভয়ঙ্কর লোক ওই মনসুর আলী, আবারও বলল কনলন, আপনার বোধহয় খুব সতর্ক হওয়া উচিত।

এখন আর সে উপায় নেই, বলল রানা। আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরে কথা হবে।

খুট আওয়াজ তুলে কেটে গেল যোগাযোগ।

দাঁড়কাক তোমাকে দিয়েছি, নিজে জুটিয়ে নিয়েছি কালো শকুন, গম্ভীর মুখে বলল কুয়াশা, নিজের তৈরি অত্যাধুনিক ইয়ারপিসে সবই শুনেছে। এখন থেকে ওই সুখোই ব্যবহার করব। হাতের ইশারা করল। এসো, আলাপ সেরে নেয়া যাক।

বৈজ্ঞানিকের পাশে বিমানের দিকে পা বাড়িয়ে বিস্মিত হলো রানা।

সুখোই ফাইটারের ফিউয়েল ট্যাঙ্কের ক্যাপ খুলেছে রঘুপতি। বুকপকেট থেকে বের করেছে ইস্পাতের নল, ওটা ভরে দিল ট্যাঙ্কে, অন্যপ্রান্ত মুখে পুরে চো-চো করে গিলতে লাগল হাই অকটেন!

চট করে বাঙালি বৈজ্ঞানিকের দিকে চাইল রানা।

হতবাক হয়ে লম্বুর কীর্তি দেখছে নিশাত ও খবির।

ও রোবট, স্বাভাবিক সুরে বলল কুয়াশা, আমার তৈরি। সামান্য কাধ ঝাঁকিয়ে পাল্টে ফেলল প্রসঙ্গ, খবিরের কাছে শুনলাম সাইবেরিয়ায় পৌঁছবার পর কী ঘটেছে।

তখন থেকেই এই লড়াই শুরু, মন্তব্য করল নিশাত।

দুদিনের লড়াইয়ে ওদের এক শজন শেষ, জানাল খবির।

আপা, আপনি কি আঁচ করতে পারেন তিশা কোথায়? নিশাতের কাছে জানতে চাইল রানা।

শেষবার দেখেছি সবুজ লেসার সাইট পরা একদল লোককে। তখন ছিটকে পড়লাম কনভেয়ার বেল্টে, তারপর…

তখন ওই মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে, জানাল কুয়াশা। কাজটা ডেভিড এন. হেন্ড্রিক ও তার লোকজনের।

আপনি জানলেন কী করে? জিজ্ঞেস করল খবির।

রঘুপতির দিকে ইশারা করল বৈজ্ঞানিক। খুলে বলো।

মুখ থেকে পাইপ সরাল লম্বু, ফিউয়েল ট্যাঙ্কের ক্যাপ আটকে দিয়ে পকেটে রেখে দিল নল, খুব নরম সুরে বলল: বসকে ভেন্টে নামিয়ে দেয়ার পর চলে এলাম পিছনের ওই সুড়ঙ্গ-মুখে। বসের নির্দেশে ছড়িয়ে দিলাম মাইক্রোডট অ্যারোসল। কাজ শেষে গেলাম একমাইল দূরে, যেমন বলেছেন বস।

পাঁচ মিনিট পর এলেন আপনারা, কিন্তু এর একমিনিট আগে ওই সুড়ঙ্গের সামনে নামল প্রকাণ্ড এক চিনুক কপ্টার দুপাশে দুই লিংক্স অ্যাটাক চপার। তখনই এল দুটো এলএসভি এবং একটা ড্রিফটরানার। সোজা উঠে গেল চিনুকের ভিতর। তারপর ভেসে উঠল হেলিকপ্টার, পাহাড়ের উপর দিয়ে চলে গেল পুবে।

কীভাবে জানলে ওদের সঙ্গে তিশা আছে? জানতে চাইল রানা।

বুকের উপর হাত রাখল রঘুপতি। আমার কাছে ছবি আছে। বস বলেছিলেন, তিনি খনিতে থাকতে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে। যেন ছবি তুলে রাখি।

লম্বুকে নতুন চোখে দেখছে রানা। এই ধেড়ে মাল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চালাতে পারে হোভার কেপেবল রাশান ফাইটার অর্থাৎ এর আছে ফিযিক্স ও অ্যারোডাইনামিক্সের উপর গভীর জ্ঞান। কথা বলে ভূত্যের মত নরম সুরে। দক্ষ সৈনিকের মত নির্দেশ মেনে নেয়ার জন্য জন্ম। আরও কী গুণ একে দিয়েছে কুয়াশা, কে জানে!

ছবি দেখাও ওকে, বলল কুয়াশা।

বোতাম সরিয়ে শার্টের নীচে কী যেন টিপল রঘুপতি। এক সেকেণ্ড পর বেরোল ডিজিটাল স্ক্রিন। ওটা বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। স্ক্রিনে খনির ওদিকের সুড়ঙ্গের বাইরের দৃশ্য। র‍্যাম্প পেতে বসে আছে চিনুক হেলিকপ্টার। তিন সেকেণ্ড পর পাল্টে গেল দৃশ্য।

দেখা গেল খনির পিছনের, সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়েছে দতগামী কয়েকটা গাড়ি। সামনে চলেছে এক লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল।

রানার পাশ থেকে বলল কুয়াশা, প্যাসেঞ্জার সিটে তিনটে সাদা বাক্স দেখছ? মেডিকেল ট্র্যান্সপোর্ট কেস। ওখানে রয়েছে। তিনটে কাটা মাথা।

স্ক্রিনে এবার দেখা দিল ঝাপসা ছবি। দুই এলএসভির পিছনে ছুটছে এক ড্রিফটরানার।

পিছনের ট্রে খেয়াল করুন, বলল রঘুপতি। প্রায় প্রত্যেকের পরনে কালো পোশাক। কিন্তু একজন… তার মাথায় হেলমেট নেই। পরনে ইউএন-এর ইউনিফর্ম। তিশাকে দেখতে পেল রানা।

খুবই ঘোলাটে ছবি, কিন্তু চেনা যায় পরিষ্কার। ড্রিফটরানারের রিয়ার ট্রের উপর পড়ে আছে, অচেতন। ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল রানার। দুনিয়ার সেরা বাউন্টি হান্টারের হাতে আটকা পড়েছে তিশা। যে করে তোক উদ্ধার করতে হবে ওকে।

না, রানা, যা ভাবছ, তা ভুল চিন্তা, বলল কয়াশা, যেন মন পড়ছে। হেন্ড্রিক চায় তুমি ওর হাতের মুঠোয় চলে যাও। কোনও তাড়াহুড়ো করতে যেয়ো না। আমি জানি কোথায় থাকবে তিশা। ভুলেও ওকে খুন করবে না হেন্ড্রিক। ওই মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ওর, নইলে তোমাকে হাতের মুঠোয় পাবে না।

আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কী ভাবে? জানতে চাইল রানা।

কারণ, আমি নিজে হলেও ওই একই কাজ করতাম, বলল কুয়াশা।

পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে দুজন। কয়েক মুহূর্ত পর রানা। বলল, আপনি এই বাউন্টি হান্ট সম্পর্কে কতটা জানেন?

কাঁধ ঝাঁকাল বৈজ্ঞানিক। তুমি নিশ্চয়ই জানো বহু কারণে। বাউন্টি হান্ট করা হয়, রানা? অন্য দেশের কাছে গুপ্ত তথ্য বিক্রি করতে চাইছে, এমন বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরকে শেষ করতে এমন করা হয়। কোনও কিডন্যাপারকে ধরে আনবার জন্যেও দেয়া হয়। টাকা। কিন্তু এসব কারণে তোমাকে খুন করতে চাইছে না এরা। …এখনও জানি না কারা টাকা দিচ্ছে। কিন্তু এটা জানি, টাকা দেয়া হবে এক সুইস ব্যাঙ্কারের হাত দিয়ে। তার নাম পি. এস. ড্যাবলার। এ ধরনের কাজে অভিজ্ঞতা আছে তার। আর টাকা যখন দেবেই, কার কাছ থেকে টাকা আসছে তা নিয়ে ভাবতে যায় না বাউন্টি হান্টাররা। গত দু-এক দিন থেকে শুরু হয়েছে মাথা কেটে নেয়ার প্রতিযোগিতা। প্রতিজনের জন্যে তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার। মোটমাট প্লনেরোটা মাথা। সবমিলে চার শ পঁচানব্বই মিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর যে-কোনও বড় আর্থিক পুরস্কারের চেয়ে অনেক বেশি দেয়া হচ্ছে।

মিলিয়ন-মিলিয়ন ডলার, খুশি-খুশি সুরে বলল রঘুপতি।

সন্দেহ নিয়ে তাকে দেখল নিশাত ও খবির।

আপনাদের ভয় নেই, ভয় সব মেজর রানার, হাসির সুরে বলল রঘুপতি।

রোবটের কৌতুক ভাল লাগছে না, খেঁকিয়ে উঠল নিশাত।

আমারও ভাল লাগে, তা নয়, বলল কুয়াশা। কিন্তু মানবিক গুণ দিতে গিয়ে এমন হয়েছে। রানার দিকে চাইল। আগামীকাল নিউ ইয়র্ক সময় দুপুর বারোটার আগেই শেষ হবে শিকার পর্ব।

একবার হাতঘড়ি দেখল রানা। কঙ্গোর সময় অনুযায়ী বাজে প্রায় সকাল আটটা। চিন্তা থেকে জেগে উঠল রানা, কুয়াশাকে বলল, এবার কী করতে চান?

আপাতত তোমার পাশে থাকব, মানুষ-শিকারের সময়টা পেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত, বলল বৈজ্ঞানিক। আমি তোমাকে বন্দি করিনি, তুমি মুক্ত থাকবে, যেখানে খুশি যেতে পারো। পাশে পাবে। আমাকে।

কেন আমার জন্যে এতকিছু করছেন? সরাসরি জানতে চাইল রানা।

মৃদু হাসল বাঙালি বৈজ্ঞানিক। বলতে পারো নিজ অন্তরের তাগিদে। গতবার যখন আমাদের দেখা হলো, তারও আগে অনেক কিছুই জেনেছি তোমার বিষয়ে। বুঝতে সময় লাগেনি, আমাদের ওই ছোট্ট, সুন্দর, সবুজ, মায়াময় দেশটাকে সত্যিই প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসো তুমি। আর এটা জানা আমার জন্যে যথেষ্ট। রাশার এক সরকারী গবেষণাগারে কাজ করছিলাম গুপ্ত পরিচয়ে, তখনই জানলাম মেরে ফেলা হবে তোমাকে। এর পর দেরি করিনি।

চুপ করে থাকল রানা।

হৃদয়ের গভীরে অনুভব করল, এই ভিন দেশেও মস্ত এক উপকারী সত্যিই ওকে সাহায্য করবে।

তা ছাড়া আরও একটা কারণ আছে, বলল কুয়াশা। সেটা খুব সম্ভব তুমি জান। তোমারই কারণে আমার বিরুদ্ধে অতীতের সব অভিযোগ তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তোমার বস সে দিকটা ম্যানেজ করেছেন। তিনি আমারও শ্রদ্ধেয় একজন নিষ্কলঙ্ক মানুষ। এখন আমি বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক, যখন খুশি নিজের দেশে ফিরতে পারি।

আপনি জানলেন কী করে তিশাকে কোথায় নেবে? জানতে চাইল ও।

মাইক্রোডট অ্যারোসলের কারণে, বলল কুয়াশা। হেণ্ডিকের লোক আসার আগেই ওই জিনিস ছড়িয়ে দিয়েছে রঘুপতি।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা।

শুনেছে মাইক্রোডট টেকনোলজির কথা।

ওটা হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের সেরা ন্যানোটেকনোলজি। মাইক্রোডট আসলে মাইক্রোস্কোপিক সিলিকন চিপস, একেকটা বড়জোর পিনের ডগার সমান বা তার চেয়েও ছোট। কিন্তু প্রতিটির রয়েছে অকল্পনীয় কমপিউটিং ক্ষমতা। অনেকে ধারণা করছে, ভবিষ্যতে মাইক্রোডট ব্যবহার করে তৈরি করা হবে লিকুইড বেড সুপারকমপিউটার- সে তরলের কণাগুলোর থাকবে বিপুল চিন্তাশক্তি।

আপাতত মাইক্রোডট ব্যবহার হচ্ছে দামি সব গাড়ি খুঁজে বের করবার জন্য।

ধরে নেয়া যাক, কোনও ফেরারি গাড়িতে স্প্রে করা হলো। মাইক্রোডট পেইন্ট, তারপর ওই গাড়ি যেখানেই থাকুক না কেন, দুনিয়ার যে-কোনও জায়গায়, তা খুঁজে নিতে লাগবে বড়জোর কয়েক সেকেণ্ড

বারোটা বাজবে গাড়িচোরের।

রঘুপতি সুড়ঙ্গের মুখে মাইক্রোডটের মেঘ ছড়িয়ে দেয়ায়, ওই। এলাকায় ছিল কয়েক বিলিয়ন খুদে কমপিউটার।

হেন্ড্রিক, তার লোক, ভেহিকেল বা তিশার দেহে আটকে গেছে আমার তৈরি মাইক্রোডট, বলল কুয়াশা। বেল্ট থেকে নিল ছোট্ট পাম কমপিউটার। ওটা, বড়জোর পিডিএ-র সমান। মনে হলো ওয়াটারপ্রুফ।

স্ক্রিনে দুনিয়ার মানচিত্র।

সুদানের দিকে রওনা হয়েছে ঝিলমিলে অসংখ্য কণা। ডেভিড এন. হেন্ড্রিক ও তার দল।

ওই মাইক্রোডট দুনিয়ার যে-কোনও জায়গা থেকে এই স্ক্রিনে দেখতে পাবে, বলল কুয়াশা।

এখন ওর পরিকল্পনা স্থির করতে হবে, কীভাবে কী করবে ভাবতে শুরু করেছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, আমাদের প্রথমে জানতে হবে কেন এসব ঘটছে।

শতবারের মত বুক পকেট থেকে বাউন্টি লিস্ট বের করল ও। ওর কাঁধের পিছন থেকে লিস্টি পড়ল নিশাত ও খবির।

কাজটা বোধহয় মোসাদের, নিচু স্বরে মন্তব্য করল নিশাত। এইমাত্র একটা এন্ট্রির উপর চোখ পড়েছে।

ওখানে লেখা: ম্যাকিন, ডেনিস ই.। ইজরায়েল, মোসাদ।

কী কারণে এমন ভাবছেন, আপা? জানতে চাইল রানা।

খনির ভেতর ইজরায়েলের মোসাদ সম্পর্কে কী যেন বলছিল টেরোরিস্ট আলাল হোসেন। তারপর এক লোক ঘঁাচ করে কেটে নিল ওর মাথা। বদ্ধ উন্মাদ ছিল লোকটা, বলছিল: সোভিয়েত গবেষণাগারে তার কিছুই হয়নি, ইউএস ক্রুজ মিসাইল পড়লেও সে পাত্তা দেয়নি, মোসাদও তাকে কখনও ছুঁতে পারবে না। আগেও চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে তারা।

মোসাদ… বিড়বিড় করল রানা। স্যাটালাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে চাইল কেভিন কনলনের সঙ্গে। কেভিন, তুমি এখনও লাইনে আছ?

জবাব এল, যতক্ষণ কফি আছে, আমিও অফিসে আছি।

কেভিন, আলাল হোসেন আর ডেনিস ই. ম্যাকিনের মধ্যে ক্রস-ম্যাচ করতে পারবে?

এক সেকেণ্ড, বলল প্রতিভাবান কোড উইয়ার্ড। হ্যাঁ, তথ্য আসতে শুরু করেছে। ইউএস-ইজায়েলি ইন্টেলিজেন্স একই সঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিল। মেজর ডেনিস ই, ম্যাকিন ছিল আলাল হোসেনের কাটসা, বা কেস অফিসার। কাজ ছিল ওই টেরোরিস্টের ওপর চোখ রাখা। হাইফাতে পোস্টিং হয়। কিন্তু গতকাল তাকে পাঠানো হয়েছে লণ্ডনে মোসাদ হেডকোয়ার্টারে।

লণ্ডন? বিড়বিড় করল রানা। মনের ভিতর তৈরি হচ্ছে। নাতিদীর্ঘ পরিকল্পনা।

গতকাল লড়াইয়ের শুরু থেকেই এক পা এক পা করে পিছাতে হচ্ছে ওকে। এবার সামনে বাড়তে চাইছে ও।

আপা, লণ্ডনে মেজর ম্যাকিনের সঙ্গে দেখা করতে আপত্তি আছে আপনার? সে হয়তো এই পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করতে পারবে।

আপনার জন্যে খুশি মনে যাব, বলল নিশাত।

আমিও তা হলে আপার সঙ্গেই যাই, বলল খবির।

ভাল হয়, বলল রানা।

মন দিয়ে ওদের কথা শুনল কুয়াশা, কিন্তু কোনও মন্তব্য করল না।

আরেকটা কথা, মেজর রানা, ভেসে এল কনলনের কণ্ঠ। আগে বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে বলা হয়নি। কথাগুলো ইউএস আর্মি মেডিকেল রিসার্চ অ্যাণ্ড মেটারিয়াল কমাণ্ডের তথ্য। ওই ন্যাটো এমএনআরআর স্টাডি? ওসব তথ্য রয়ে গেছে আমার নাগালের বাইরে। দুমাস আগে জরুরি হয়ে ওঠে ওসব। এবং ওই সময়ের পর ইউএসএএমআরএমসি কমপিউটার থেকে সব মুছে ফেলা হয় বা ধ্বংস করা হয় সমস্ত কাগজ। শুধু জেনেছি, অ্যারিঘোনার এক ওয়্যারহাউসে রয়ে গেছে। একটামাত্র কপি।

কিন্তু যারা মেডিকেল রিসার্চ কমাণ্ডের তথ্য জড় করেছিলেন, তাঁদের দুজনের ঠিকানা জোগাড় করেছি। এঁদের নাম বেইন্স ও ওয়াকার। একবছর আগে অবসর নিয়েছেন বেইন্স। এখন থাকেন। ফ্লোরিডার এক রিটায়ারমেন্ট ভিলেজে। কিন্তু মাত্র দুমাস আগে ইউএসএএমআরএমসি থেকে অবসর নিয়েছেন ওয়াকার। এখন ভার্জিনিয়ার জন্স হসপিটালের ইআর বিভাগের চিফ ফিজিশিয়ান। জায়গাটা পেন্টাগন থেকে বেশি দূরে নয়।

তাই? বলল রানা, কেভিন, একদিনের জন্যে ফিল্ড অফিসার হবে?

আমার আপত্তি নেই, অফিস থেকে বেরুতে পারলে বাঁচি। আমার বর্তমান বস্ দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য গাধার পোঁদ!

তা হলে সুযোগ বের করে বেরিয়ে পড়ো, যাও সেন্ট জন্স হসপিটালে। আলাপ করে দেখো মিস্টার ওয়াকারের সঙ্গে।

প্রথম সুযোগে তা-ই করব আমি, রাখলাম, লাইন কেটে গেল।

আর আপনি কী করবেন, স্যর? রানার কাছে জানতে চাইল নিশাত। মিস্টার কুয়াশার সঙ্গে… চট করে রহস্যময় বৈজ্ঞানিককে দেখে নিল ও। বিশ্বাস করছে না এক ফোঁটাও।

মৃদু কুঁচকে গেল কুয়াশার ভুরু। কোনও মন্তব্য করল না।

স্যর, আমাদের সঙ্গেই চলুন, বলল খবির।

এই বাউন্টি হান্টের গোড়ার কাছে পৌঁছুতে চাই, বলল রানা। প্রথমে যাব ফ্রান্সের ওই দুর্গে।

স্যর, আপনি নিশ্চয়ই সদর-দরজায় গিয়ে টোকা দেবেন না? জানতে চাইল নিশাত।

না, তা করব না, বলল রানা। আগে জোগাড় করব কাটা মুণ্ডু। তারপর ওটা নিয়ে যাব পুরস্কার আদায় করতে।

তার মানে, স্যর… বিস্ফারিত হলো নিশাতের চোখ। কারও ধড় থেকে কেটে নেবেন মাথা?

না, অন্য কাজ করব, অন্যমনস্ক হয়ে কুয়াশার পাম কমপিউটারের দিকে চাইল রানা! স্ক্রিনে দেখল, কোথায় চলেছে। দুনিয়াসেরা বাউন্টি হান্টার ডেভিড এন. হেন্ড্রিক ওরফে ডেভিল। এখন জানি কোথায় পাব তাজা মাথা। সেসব জোগাড় করব, তারপর ফিরিয়ে আনব তিশাকে।

তেরো

পাইন রিটায়ারমেন্ট ভিলেজ।

মায়ামি, ফ্লোরিডা।

অক্টোবর ১৩। সন্ধ্যা মাত্র সাতটা।

সামনের ডেস্কের নার্সের বুঝবার উপায় ছিল না ওই লোক ভয়ঙ্কর খুনি।

নরম সুরে জানতে চাইল নার্স, কোনও সাহায্যে আসতে পারি?

জবাবে লোকটা মাথা নেড়ে বলল, সে এসেছে পাইন রিটায়ারমেন্ট ভিলেজের অসুস্থ এক রোগীর ব্যক্তিগত জিনিসগুলো হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার জন্য।

খুনি লম্বা ও চিকন, গায়ের রং কুচকুচে কালো, ফুলে ওঠা কপাল। সবমিলে মনে হয়, আফ্রিকান লোক। সাক্ষীরা জানবে না, কিন্তু দুনিয়া জুড়ে বাউন্টি হান্টিং সমাজে তার নাম: দি আফ্রিকান।

ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর আততায়ী সে।

পরনে সাদা ল্যাবকোট। দালানে ঢুকে খুব শান্ত পায়ে হাঁটছে। পাশ কাটিয়ে গেল নার্সকে হাতে অর্গান-ডেলিভারি সাদা বক্স।

কয়েক সেকেণ্ডে খুঁজে নিল নির্দিষ্ট ঘর, ভিতরে ঢুকে দেখল এক বয়স্ক লোক ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। নাম তার ফেড বেইন্স।

পাইন রিটায়ারমেন্ট ভিলেজের কর্তপক্ষ থেকে শুরু করে প্রত্যেকে পছন্দ করে তাকে, খুব হাসিখুশি মানুষ। সবাই জানে, পেশায় বেইন্স ডাক্তার ছিল, একবার গলফ কোর্সে বয়স্ক এক রেসিডেন্টের হার্ট অ্যাটাক হলে তার প্রাণও বাঁচিয়েছিল।

কিন্তু অবাক ব্যাপার, আর সবার মত কখনও নিজের জীবনের সাফল্যের কথা বলে না সে।

জিজ্ঞেস করলে বড়জোর জানায়, ফোর্ট ডেট্রিকের ইউএস আর্মি মেডিকেল রিসার্চ অ্যাণ্ড মেটেরিয়াল কমাণ্ডের সায়েন্টিস্ট ছিল। আর্মড ফোর্সের জন্য সামান্য কিছু মেডিকেল টেস্ট করত। তারপর তো অবসরই পেল।

ঘুমন্ত বেইন্সের পাশে থামল দি আফ্রিকান, কোটের তলা থেকে বের করল ধারালো ম্যাচেটি…

দুঘণ্টা পর এয়ারপোর্টের লং-টার্ম কারপার্কে তার পরিত্যক্ত, গাড়ি পেল পুলিশ।

ততক্ষণে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের যিরো সিক্স-থ্রি ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে কুচকুচে কালো খুনি। পাশের সিটে সাদা অর্গান-ডেলিভারি বক্স।

জার্মানি। বার্লিন।

অক্টোবর, ১৩।

ইউনাইটেড স্টেট অভ আমেরিকার নাগরিক হ্যারিস এক্স. টেরেন্স। তারচেয়েও বড় কথা, সে চাকরি করে আইএসএস-এ। একসময়ে ছিল খুবই দক্ষ এজেণ্ট। আজকাল অফিস ছুটির পর হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ বুড়ো ইবলিশ।

কচি মেয়ের শরীর চাই প্রতিদিন। গণ্ডারের মত পিছন থেকে ভোগ করবে। ফুর্তি চরমে উঠলে বিকট হাঁক ছাড়বে উন্মত্ত কাউবয়ের মত, খামচে ধরবে নধর নিতম্ব।

বার্লিনের রেড লাইট ডিস্ট্রিক্টের এক পতিতার কাছ থেকে এ তথ্য পেয়েছে আজকের মেয়েটি।

আগের সেই দিন আর নেই হ্যারিস এক্স. টেরেন্সের। কোল্ড ওঅরের সময়ে সে ছিল ইস্টার্ন ব্লকের বিষয়ে এক নম্বর এক্সপার্ট, সবাই গুরুত্ব দিত তার প্রতিটি কথায়। এখন বার্লিনের আইএসএস অফিসে ডেস্ক জবে বসিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। হ্যারিসের বয়সও হয়েছে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মগজের ধার। আশির দশকের শেষভাগে যে দুর্দান্ত সব কাজ করেছে, আজকাল সেইসব স্মৃতির জাবর কাটে।

কেন, সোভিয়েত রাশা থেকে কিয়েভ ফাইল নিয়ে নরমানোভ পালিয়ে আসতে চাওয়ায় তাকে পশ্চিম ব্লকে সরিয়ে আনেনি সে?

এসব ভুলে যায় নতুন সব এজেন্ট।

আসলে মেনে নিয়েছে হ্যারিস, নতুন অচেনা এই বিশ্বে পুরনো, বুড়ো এক ঘেয়ো কুকুর হয়ে উঠেছে সে।

আজ রাতে সহজেই এই মেয়েটির উপর চোখ পড়েছিল।

অবাক হওয়ার কিছুই নেই। দেখবার মতই দীর্ঘ, পেলব, সুডৌল ঊরু। দামি যে-কোনও মডেলের মত সুঠাম দুকাপ। আর ওই পূর্ণ আপেলের মত ধবল দুই স্তন যেন এসেছে খোদ স্বর্গ থেকেই। ইউরোশিয়ান দুই চোখে নরম চাহনি।

হ্যারিস শুনেছে কেউ কেউ ওই মেয়েকে ডাকে: বরফ-শুভ্র রানি।

হ্যারিসের বিছানার উল্টোদিকে বারকাউন্টারে পার্স রেখে শাওয়ার নিতে গিয়েছিল মেয়েটি, এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে জন্মদিনের আদিম পোশাকে। দুহাত রেখেছে পিছনে, ফলে আরও উদ্যত হয়ে উঠেছে ধবধবে স্তন।

খুশিতে সাত পাটি দাঁত বেরোলো হ্যারিসের, ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায়, ঝটকা দিয়ে চিত হলো কিন্তু তখনই দেখল মেয়েটার হাতে খাটো একটা সামুরাই তলোয়ার।

সাঁই করে ওটা নেমে এল হ্যারিসের গলার উপর!

.

বেইরুত, লেবানন।

অক্টোবর ১৩। রাত নয়টা।

পরে সাক্ষীরা বলবে, খুনটা করেছে খুবই পেশাদার একদল আততায়ী। তাদের নিজেদের কারও কিছুই করবার ছিল না।

ধারণা করা হয়, সিনিয়র হামাস কমাণ্ডার আজিজ আমিনকে। ট্রেনিং দিয়েছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনী।

খুবই সতর্ক লোক, চারপাশ ভালভাবে দেখে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে ঢুকেছে।

আর তখনই ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলে লবির বাইরে থামল দুটো সেডান, নেমে এল আটজন কমাণ্ডো, ছিটকে ঢুকল বাড়ির ভিতর। তাদের একজনের হাতে সাদা একটা বাক্স। একপাশে লাল রেড ক্রস চিহ্ন আঁকা।

সাক্ষীরা অবশ্যই বলবে: আততায়ীদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ভিযেড-৬১ স্করপিয়ন মেশিন পিস্তল।

মাত্র দুমিনিট ব্যয় করেছে লোকগুলো। তারপর আবারও চাকার কর্কশ আওয়াজ তুলে বিদায় হয়েছে।

পাঁচ মিনিট পর নির্জন লবির একপাশে পাওয়া গেছে আজিজ আমিনকে। কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার মাথাটা।

চোদ্দ

ব্রিটানি, রিপাবলিক অভ ফ্রান্স।

অক্টোবর ১৪, স্থানীয় সময় এগারোটা পঞ্চাশ মিনিট। ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

নির্দিষ্ট মানুষটি সেই ছোটবেলা থেকেই সবসময় বিশৃঙ্খলা পছন্দ করত।

ভাবতেই তার ভাল লাগত উদ্দাম-উচ্ছল জীবন।

বৈধ-অবৈধ সরকার, ন্যায্য আইন বা সমাজ?

উঁহু!

মানব-সমাজে ন্যায়-নীতি-আইন-শৃঙ্খলা এসব থাকবে কেন!

ভাল লাগে তার নতুন করে বুঝতে, কীভাবে সুযোগ পেলেই ভয়ঙ্কর স্বার্থপর হয়ে ওঠে মানুষ!

হয়তো ধসে পড়ল গোটা ফুটবল স্টেডিয়াম, আর একে অপরকে মাড়িয়ে খুন করছে!

বা ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প। এটাই স্বাভাবিক যে সাধারণ মানুষ লুট করবে অন্যের সর্বস্ব।

আর যুদ্ধ বাধলে?

নানজিং, মাই লাই, স্ট্যালিনগ্রাদ… সবাই মিলে কী করে?

একে অপরের মা-বোনকে ধর্ষণ করে, খতম করে জানের শত্রুকে।

এমনই তো হবে মানুষ!

জীবন তো এমনই!

আহ্, ভাবতেই ভাল লাগে!

কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে টেলিকনফারেন্স শুরু হতে আরও দশ মিনিট।

তার মানেই বারো নম্বর সদস্যের হাতে সামান্য সময় আছে। সময়টা নষ্ট করা ঠিক নয়, ভাবছে সে। বারো নম্বর সদস্যের নাম ডেমিয়েন ডগলাস। বয়স মাত্র সাতাশ। কাউন্সিলের কনিষ্ঠ সদস্য। জন্ম নিয়েছিল বিপুল ধনদৌলতের মাঝে। বাবা আমেরিকান, মস্ত ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। মা ফ্রেঞ্চ নামকরা জমিদার পরিবারের মেয়ে।

ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছে, সবই জুগিয়ে দেয়া হয়েছে ডেমিয়েনকে। কোনও চাহিদা পূরণ হয়নি, এমন হওয়ারও উপায়। ছিল না। বাবা-মার একমাত্র সন্তান সে, চোখের মণি।

তার চাহনি সাপের মত শীতল, দ্বিতীয়বার চিন্তা করে কথা বলে সবাই। শাপে বর হয়েছে ওই সর্পদৃষ্টি। মস্ত সাহসীর বুক কাঁপিয়ে দিতে পারে মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে।

আরেকটা বড় অস্বাভাবিকতা: ডেমিয়েন ডগলাসের এক চোখের মণি গাঢ় নীল, অন্যটা পচা ডিমের কুসুমের মত হলদেটে।

অসংখ্য মস্ত সব কোম্পানির বিপুল মুনাফার কারণে তার। বর্তমান সম্পদ এখন ঊনষাট বিলিয়ন ডলার।

তার মার দিক থেকে পাওয়া সম্পত্তি ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

কাউন্সিলের নয় নম্বর সদস্যকে মোটেও পছন্দ করে না ডেমিয়েন।

সে-লোলাকের অন্যান্য সম্পদ তো আছেই, এ ছাড়া পেয়েছে। জন্মসূত্রে টেক্সাসের বেশ কয়েকটি তেলখনি।

নয় নম্বর সদস্যের বুদ্ধি স্বল্প বলে ধারণা করে ডেমিয়েন।

আটান্ন বছর চলছে লোকটার, কিন্তু আজও যে-কোনও কিছু নিয়ে এঁড়ে তর্ক করে।

এ কারণে তাকে গণ্ডারও বলা যেতে পারে।

যখন থেকে কাউন্সিলের মিটিঙে বসছে ডেমিয়েন, তখন থেকেই তার প্রতিটা কথায় আপত্তি তুলছে এই লোক।

আর এখন, এ মুহূর্তে নয় নম্বর দাঁড়িয়ে আছে ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নের চওড়া ডানজনের নীচতলায়। সঙ্গে দুই এইড ও দুই বডিগার্ড। চারপাশে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে পুরু পাথরের বৃত্তাকার দেয়াল। ভয়ে সাদা হয়ে গেছে দুই এইডের চেহারা। তাদের একজন মহিলা। দুই ব্যক্তিগত বডিগার্ডের দিকে চাইছে না নয়। নম্বর। অস্বস্তি বোধ করছে। চোখ ডানজনের নির্দিষ্ট জায়গায়।

ওই অংশকে বলা হয় শার্ক পিট।

মস্ত কুয়া পাথুরে দেয়ালে ঘেরা। ষোলো ফুট গভীর। বৃত্তাকৃতি। বৃত্তের ব্যাস দেড় শ ফুটের কম নয়।

কুয়ার মেঝেতে রয়েছে পাথরের ছোট-বড় মঞ্চ।

একটা বিষয় একেবারে পরিষ্কার: কাউকে এ পিটে নামিয়ে দিলে কারও সাহায্য ছাড়া নিজ চেষ্টায় উঠে আসতে পারবে না।

কুয়ার ঠিক মাঝখানে খাড়া নেমে গেছে দশফুট চওড়া একটা গর্ত, সেটা সাগরে গিয়ে মিশেছে।

কিছুক্ষণ হলো সাগরে আসতে শুরু করেছে জোয়ার।

শার্ক পিট বেয়ে কুলকুল আওয়াজে দ্রুত উঠছে পানি, বিশাল গর্তে ধীরে ধীরে বাড়ছে লোনা জল।

মেঝের পাথুরে মঞ্চগুলো হয়ে উঠছে যেন ছোট ছোট দ্বীপ।

একটু পর তলিয়ে যাবে সব।

নয় নম্বর সদস্য এবং বডিগার্ডদের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। দেখছে ডেমিয়েন ডগলাস, হাসছে মনে মনে।

এইমাত্র শার্ক পিটে হাজির হয়েছে কালোদুটো ছায়া। অলস ভঙ্গিতে সাঁতার কাটছে দ্বীপগুলোর মাঝ দিয়ে।

পানি-সমতলে ভেসে ওঠেনি, কিন্তু পরিষ্কার দেখা গেল ডর্সাল ফিন ও বুলেটাকৃতি মাথা।

মস্ত দুই টাইগার শার্ক ওগুলো। জোয়ার এলেই খাবারের খোঁজে আসে।

কয়েক সেকেণ্ড পর পানির নীচে দেখা দিল আরও দুই ছায়া। দুর্গের ডানজনের দক্ষিণ দিকে ব্যালকনি।

ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হওয়ার আগে ডানজনে গ্ল্যাডিয়েটারদের প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করত ফ্রেঞ্চ অভিজাত কর্তারা। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে লড়ত সাধারণ মানুষ। অবশ্য, ফোট্রেস দো শ্যাটিয়নে সবসময়ই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষুধার্ত সিংহ, বাঘ বা নেকড়েকে।

এই ডানজনের উঁচু ব্যালকনি থেকে পরিষ্কার দেখা যায় শার্ক পিট।

ব্যালকনির নীচে সবচেয়ে বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক ডিভাইস: বারো ফুট উঁচু গিলোটিন।

মজা পাওয়ার জন্য ওটা ডানজনে যোগ করেছে ডেমিয়েন। ডগলাস।

গিলোটিনের পায়ের কাছে কাঠের তাকিয়া। মাঝে মাথা রাখবার জন্য খোড়লের মত জায়গা। দুপাশের কাঠের স্লটে আটকে দেয়া হবে বন্দির দুই হাত। গিলোটিনের পাশে ক্র্যাঙ্ক হ্যাঁণ্ডেলের মাধ্যমে উপরে তুলতে হবে ক্ষুরধার ফলা। তারপর বড় একট লিভার সরিয়ে নিলেই…

উনিশ শ সাঁইত্রিশ সালে চায়নিজ শহর ন্যানজিঙে জাপানি সৈনিকরা যা করেছিল, সেটা পড়েই উৎসাহিত হয়েছে ডেমিয়েন।

ওই ভয়ঙ্কর তিন সপ্তাহে জাপানিরা বীভৎস অত্যাচার করেছিল চিনাদের উপর। খুন করেছিল তিন লাখ ষাট হাজার মানুষকে। পরে জানা গেল, জাপানি সৈনিকরা নিজেদের ভিতর চৈনিকদের মাথা কাটবার প্রতিযোগিতা করছিল। আরও খারাপ কিছু করত। যেমন, কারও বাবাকে বলা হতো: তোমার মেয়েকে ধর্ষণ করতে হবে তোমার, নইলে… বা ছেলেকে বলা হতো: মা-র সঙ্গে যৌন মিলন করতে হবে তোমার, নইলে মরতে হবে তোমাকে।

এসব জেনে খুব আমোদ পেয়েছে ডেমিয়েন।

সাধারণ চিনা পুরুষরা অকল্পনীয়, নারকীয় এসব প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে সম্মানের মৃত্যু বরণ করত।

কিন্তু কেউ কেউ তা করেনি।

আর তাতেই দারুণ বিমোহিত হয়েছে ডেমিয়েন।

আশ্চর্য, নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে কতবড় পশু হতে পারে মানুষ?

চমৎকার ব্যাপার না?

এসব নিয়ে ভাবতে গিয়েই শার্ক পিটের ডানজনে গিলোটিন বসিয়েছে ডেমিয়েন।

মানুষকে দুধরনের মৃত্যুর ভিতর যে-কোনোটা বেছে নেয়ার সুযোগ করে দেয় সে।

মরতে পারো টাইগার শার্কের ভয়ঙ্কর হামলায়, অথবা চট করে মরতে পারো প্রায়-ব্যথাহীন গিলোটিনে যেটা খুশি!

ওর প্রচণ্ড আনন্দ হয় যখন কজনকে নামিয়ে দিতে পারে শার্ক পিটে, বলতে পারে: গিলোটিনে চড়িয়ে শেষ করে দাও তোমাদের বসকে, তাহলেই আমি তোমাদেরকে ছেড়ে দেব। অথবা বলতে পারে: খুন করো ওই মহিলাকে, বন্ধ করো ওর চিৎকার, তোমাদের ছেড়ে দেব।

অবশ্য, শেষ পর্যন্ত কাউকেই ছাড়ে না সে।

অসহায় বন্দি মানুষগুলো প্রথমে বোঝে না, তাদেরকে নিয়ে কী নিষ্ঠুর খেলা খেলছে ডেমিয়েন।

কখনও কখনও দেখা যায়, তারা বাঁচবার জন্য নিজ হাতে খুন করছে প্রিয় কাউকে।

এতে গলা ফাটিয়ে হাসে ডেমিয়েন, তারপর খুনিকে খতম করার সময়ও একই রকম আনন্দে হেসে কুটিপাটি হয়।

নিজেকে তার সবসময় মনে হয় সত্যিকারের ঈশ্বর। চাইলে যখন-তখন কেড়ে নিতে পারে যে-কারও জীবন। আবার ফিরিয়েও দিতে পারে।

জীবিত বা মৃত লোকের জিন ব্যবহার করে ঠিক তারই মত অন্য কাউকে সৃষ্টি করতে পারে।

টাকা তার জন্য কোনও সমস্যা নয়।

এ-মুহূর্তে কুয়ার পাথুরে দেয়াল বেয়ে উঠে আসতে চেষ্টা করছে পাঁচজন অসহায় মানুষ, যার যার জান বাঁচাতে ব্যাকুল। কী ঘটতে চলেছে টের পেয়ে গেছে পরিষ্কার।

তাদেরকে ঘিরছে সাগরের জল, উঠছে প্রতি সেকেণ্ডে।

দেয়াল বেয়ে খামচে দুফুট উঠল নয় নম্বরের মহিলা এইড, ধরতে পেরেছে ছোট কিছু পাথর কিন্তু তা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। প্রকাণ্ডদেহী এক গার্ডও পাথরগুলো দেখেছে, মহিলাকে টেনে নামিয়ে দিয়ে নিজে উঠতে লাগল।

দক্ষিণ ব্যালকনি থেকে দেখছে ডেমিয়েন। ভাবছে: এদের একজনের দাম ছত্রিশ বিলিয়ন ডলার। অন্যদের বেতন বছরে কমপক্ষে এক লাখ বিশ হাজার ডলার।

কিন্তু বাস্তবে কারও মূল্য কম বা বেশি নয় এ মুহূর্তে।

একেই বলে বিশৃঙ্খলা, ভাবল ডেমিয়েন। ওটা এমনই জিনিস, সমান করে দেয় সবাইকে।

দেখতে না দেখতে পিটের মেঝেতে জমল পাঁচ ফুট উঁচু পানি। উঠে এল সবার গলা লক্ষ করে। আগের চেয়ে সহজে গহ্বরের ভিতর ঘুরছে টাইগার শার্কগুলো। মানুষগুলো প্রথমে যে মঞ্চে ছিল, সেটা তলিয়ে গেছে।

পাঁচ মানব সন্তান। চারটে হাঙর। দৃশ্যটা আন্দদায়ক নয় তো কী!

অসহায় মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে ছুটে গেল একটা টাইগার শার্ক, গুঁতো দিল একজনের বুক-পেটে। পরক্ষণে উপড়ে নিল লালচে চাকা-চাকা মাংস। দোদুল্যমান পানির ভিতর ছড়িয়ে পড়ল তাজা রক্ত। লালচে ফেনা ছুটে গেল নানাদিকে।

রক্তাক্ত বডিগার্ড তলিয়ে যেতেই হাউমাউ করে উঠল সবাই।

জীবন ভিক্ষা চাইল নয় নম্বর সদস্যের মহিলা এইড। ডেমিয়েনকে মাথা নাড়তে দেখে প্রাণ দিতে চাইল গিলোটিনের নীচে। ব্যবস্থা করে দিল ডেমিয়েনের লোক নিরাপদ দূরত্ব থেকে।

পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যে ধারালো ফলা বিচ্ছিন্ন করল মহিলার মাথা। বাকি দুজনকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে তিন হাঙর।

নিজেও গিলোটিন বেছে নিল নয় নম্বর সদস্য। হাঙরের মুখে পড়বার চেয়ে গিলোটিন ঢের ভাল। লিভারটা তাকেই টানতে হলো।

কিছুক্ষণ পর গিলোটিনের মঞ্চে নাচতে লাগল উদ্যত, খ্যাপা সাগর, নীরবে মুছে দিল সমস্ত প্রমাণ।

হাঙরগুলো তৃপ্তি নিয়ে চিবাচ্ছে লাশগুলো।

আর কিছু দেখবার নেই, একবার আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজ অফিস লক্ষ্য করে রওনা হয়ে গেল ডেমিয়েন ডগলাস।

জরুরি টেলিকনফারেন্স শুরু হবে একটু পর।

.

পাথুরে দেয়াল জুড়ে প্রকাণ্ড সব টেলিভিশন পর্দা, সেখানে দেখা দিয়েছে পরিচিত কজনের মুখ।

এঁরা কাউন্সিলের সদস্য, মিটিঙের জন্য সময় দিচ্ছেন দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে।

নিজের সিটে বসে পড়ল ডেমিয়েন ডগলাস।

পাঁচ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ায় তার মস্ত শিপিং এবং ডিফেন্স কন্ট্রাক্টিং সাম্রাজ্য পেয়েছে সে। এই অসংখ্য কোম্পানির গোলকধাঁধার নাম ড্রাগন কর্পোরেশন। বহু কিছুর ভিতর ডেস্ট্রয়ার ও লং-রেঞ্জ মিসাইল তৈরি করে ড্রাগন কর্পোরেশন। সরবরাহ করা হয় ইউএস সরকারকে। বাবা মারা যাওয়ার পর পাঁচ বছরে ড্রাগন কর্পোরেশনের মুনাফা পাঁচগুণ বাড়িয়ে ফেলেছে ডেমিয়েন।

এর কিছুদিনের ভিতর ওকে কাউন্সিলে যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন বর্তমান চেয়ারম্যান। আপত্তি করেনি ডেমিয়েন।

নয় কোথায়, বারো? তার না তোমার সঙ্গে থাকার কথা? টেলিভিশনের পর্দায় নড়ে বসল চেয়ারম্যান।

মৃদু হাসল ডেমিয়েন। সুইমিংপুলে সাঁতরাতে গিয়ে পায়ের পেশিতে খিচ ধরেছে। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তার তাকে দেখছে।

সব ঠিক আছে তো?

হ্যাঁ, চিন্তা করবেন না, দ্বিধা না করে বলল ডেমিয়েন। নোয়ার জাহাজগুলো পৃথিবীর নির্দিষ্ট প্রতিটি জায়গায় পজিশন নিয়েছে। গতসপ্তাহে ডিজিএসই-র লোক শেষ করে দিয়েছে আমেরিকান সৈনিকদের। আমার নরফোকের ফ্যাসিলিটি রক্তে ভাসছে। আমরা ইউএস ইন্সপেক্টরদের জন্যে তৈরি। কাজ করছে সমস্ত সিস্টেম। সিগনাল দিলেই শুরু হবে সব। মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল ডেমিয়েন, গ্লাস তুলে এক ঢোক পানি গিলে নিয়ে বলল, অবশ্য, মিস্টার চেয়ারম্যান, আগেও বলেছি, এখনও দেরি হয়ে যায়নি, আমরা বাড়তি কাজটাও সেরে নিতে পারি।

বারো! কড়া সুরে বললেন চেয়ারম্যান। আগেই স্থির হয়েছে। সব, এবং এখন কাজ থেকে পিছিয়ে যাব না। আমি দুঃখিত, কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি, যদি আবারও ওই বাড়তি কাজের কথা তোলেন, সেক্ষেত্রে আপনার জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করা হবে।

আস্তে করে মাথা দোলাল ডেমিয়েন। আপনার যা ইচ্ছে, মিস্টার চেয়ারম্যান।

কাউন্সিলের শাস্তি যে করে হোক এড়াতে হবে।

পঞ্চাশের দশকে কাউন্সিলের আইন ভেঙে জাপানের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করায় চরম শাস্তি দেয়া হয় জোসেফ কেনেডিকে, তার হারাতে হয় বিখ্যাত দুই সন্তানকে। আর চার্লস লিবার্গের শিশু সন্তানকে কিডন্যাপ করে খুন করা হয়। ভদ্রলোককে ঘোষণা দিতে বাধ্য করা হয়: আমি আসলে অ্যাডলফ হিটলারকে খুবই পছন্দ করি। উনিশ শ ত্রিশের দিকে কাউন্সিলের অমতে নাযিদের সঙ্গে ব্যবসা করবার কারণে চরম শাস্তি পেতে হয় তাকে।

এরপর গত কয়েক বছর আগে কী হলো?

কাউন্সিলের সদস্য ছিল না এনরন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, একেবারে শেষ করে দেয়া হলো অতবড় কর্পোরেশন এবং তার ডিরেক্টরদেরকে।

টেলিকনফারেন্স চলতে থাকল।

দ্বিতীয়বার টু শব্দ করল না ডেমিয়েন ডগলাস।

বর্তমান ইশ্যর বিষয়ে তার ধারণা: কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্যের চেয়ে অনেক বেশি জানে সে।

যিম্বাবুইয়ের এক্সপেরিমেন্ট তার নিজ আইডিয়া। আর ওটার কারণেই জানা গেছে, এর পর কী ঘটতে চলেছে বিশ্বে। দশকের পর দশক ইউরোপিয়ানদের হাতে অর্থনৈতিক অত্যাচার সইবার পর দারিদ্র-পীড়িত আফ্রিকার জনগণ বা সরকারগুলো এখন মানতে রাজি নয়, শ্বেতাঙ্গদের ব্যক্তিগত কোনও সম্পত্তি থাকতে পারে।

তা ছাড়া, গ্লোবাল পপুলেশন গ্রোথের উপর থুবফোর্ড রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর সব হিসাব বদলে যেতে শুরু করেছে।

পশ্চিমাদের জনসংখ্যা কমছে আশঙ্কাজনক হারে। এবং এর ফলে আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছে দরিদ্ররা।

কিন্তু এ মুহূর্তে কাউন্সিলে এসব উপাত্ত তুলে তর্ক জুড়লে মস্ত বিপদে পড়বে ডেমিয়েন।

আরও কিছুক্ষণ পর শেষ হলো কাউন্সিলের টেলিকনফারেন্স, অবশ্য অনলাইনে রয়ে গেল কজন কাউন্সিল সদস্য নিজেদের ভিতর গল্পগুজব করছে।

চুপচাপ তাদেরকে দেখছে ডেমিয়েন ডগলাস।

কথার ছলে এক সদস্য জানাল, …গতকাল ওই ড্রিলিং স্বত্ব কিনেছি এক বিলিয়ন ডলারে। বললাম, হয় এক বিলিয়ন, নইলে বাদ থাক তোমাদের সঙ্গে ব্যবসা। উপায় আছে নির্বোধ-গাধা ওই আফ্রিকান সরকারগুলোর সর্বোচ্চ নেতাদের?

হাসছে কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। আর গতকাল ক্লাবে লিলি মাখসাখের সঙ্গে দেখা। খুব আগ্রহী মনে হলো ওকে। আবারও জানতে চাইল, কাউন্সিলে পদ দেয়া হবে কি না। আমি বললাম, কত বিলিয়ন ডলার তোমার, লিলি? বলল, তিরিশ বিলিয়ন। জিজ্ঞেস করলাম, আর তোমার কোম্পানির? গর্ব করে বলল, এক শ সত্তর বিলিয়ন। এবার বললাম, বাহ্, যথেষ্ট আছে তো তোমার, তো চলে এসো মেন্স রুমে, আমাকে এক শট দারুণ খেলা দিলেই সিট পাইয়ে দেব। এরপর আর থাকল না মেয়ে, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল ক্লাব ছেড়ে!

শালা আস্ত ডাইনোসর, ভাবল ডেমিয়েন। পুরনো সব ধারণা নিয়ে পার করে দিল জীবনটা!

মস্ত ব্যবসায়ীর মুখে এসব মানায় না!

বাটন টিপে দিল ডেমিয়েন, অফ করে দিল সিগনাল। মুহূর্তে কালো হয়ে গেল চারপাশের টেলিভিশনের পর্দা।

পনেরো

সাইপ্রাস দ্বীপের পশ্চিমাকাশ চিরে চলেছে কালো সুখোই ফাইটার বিমান।

মাথার উপর নীলাকাশ, নীচেও একই রং গাঢ় নীল ভূমধ্যসাগর।

অক্টোবর ১৩। স্থানীয় সময় দুপুর বারোটা।

কুয়াশার তৈরি মাইক্রোডট জানাচ্ছে কোথায় চলেছে বাউন্টি হান্টার ডেভিড এন. হেণ্ডিকের বিমান।

কঙ্গোর স্ট্যানলি পর্বতমালার কয়লা খনি ত্যাগ করবার পর মাত্র একবার অবতরণ করেছে হেণ্ডিকের বিমান। তাদের জন্য স্থির করা মিশরীয় এয়ারফিল্ডে নামতেই দুভাগে ভাগ হয়েছে। কন্টিনেন্টাল সোলজারদের ইউনিট ৬৬।

একটি বিমানে উঠেছে এক দল, তাদের গন্তব্য লণ্ডন।

অন্য দলটি রয়ে গেছে আগের সেই বিমানেই। ওই কার্গো বিমানের কমপিউটার ডেটা অনুযায়ী ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিম উপকূল লক্ষ্য করে রওনা হবে তারা।

লণ্ডনের দিকে অগ্রসরমাণ বিমানটি চকচকে গালফস্ট্রিম ১৪. এগযেকিউটিভ জেট, ঝোড়ো গতি তুলছে।

পনেরো মিনিট পর ফ্রান্স লক্ষ্য করে রওনা হয়েছে রয়াল এয়ার ফোর্সের সি-১৩০জে হারকিউলিস বিমান। রিফিউলিং এবং চেকআপের সময়ও দেয়া হয়নি।

তখনই ঘণ্টি বেজেছে রানার মগজে। বুঝে গেছে, হেন্ড্রিককে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে ব্রিটিশ সরকার। চারপাশে যা ঘটছে, তার সবই জানে তারা। তাদেরই অনুরোধে ওই বিমান নামতে দিয়েছিল মিশরীয় কর্তৃপক্ষ।

লক্ষণটা ভাল নয়। আকাশ চিরে ছুটছে কুয়াশার কালো সুখোই বিমান। এ মুহূর্তে বম বে-তে বসে আছে রানা। দুশ্চিন্তার কারণে কপাল কুঁচকে আছে।

হেন্ড্রিকের বিমানের বহু দূরে দিগন্তের ওপাশে উড়ছে কুয়াশার সুখোই, ব্যবহার করছে স্টেলথ ফিচার।

আমার জানা তথ্য অনুযায়ী, ওটা হেন্ড্রিকের কমন ট্যাকটিক, জানাল কুয়াশা। দুই ভাগে ভাগ করেছে দলকে। প্রথমটা ডেলিভেরি টিম, অন্যটা স্ট্রাইক টিম। শেষেরটার কাজ পরবর্তী টার্গেটকে খতম করা। এবং একই সময়ে ডেলিভারি টিম গন্তব্যে পৌঁছে দেবে বিচ্ছিন্ন মাথা।

স্ট্রাইক টিম যাচ্ছে লণ্ডনে, মন্তব্যের সুরে বলল রানা। এবারের কাজ বোধহয় ডেনিস ই, ম্যাকিনকে শেষ করা।

আমারও তা-ই ধারণা, সায় দিল কুয়াশা।

এবার? কী করবেন, স্যর? রানার দিকে চেয়ে জানতে চাইল নিশাত।

চট করে একবার কুয়াশাকে দেখল রানা। ওর মন চাইছে এখনই হারকিউলিস বিমানে হামলা করতে।

ওখানে অসহায় অবস্থায় বন্দি তিশা।

সম্ভব হলে ফ্রান্সগামী ওই বিমানের পিছু নেব, বলল রানা।

আপত্তি এল না কয়াশার তরফ থেকে, বরং কমপিউটার কঙ্গেলে দটো বাটন টিপল। কয়েক মুহর্ত পর বলল, ঠিক আছে, ওদের কমপিউটারের ফ্লাইট ডেটা পেলাম। নব্বই মিনিট পর তুরস্কের পশ্চিমে মিড-এয়ার রিফিউয়েলিং করবে।

কোথা থেকে টেকঅফ করবে ট্যাঙ্কার বিমান? জানতে চাইল রানা।

সাইপ্রাস দ্বীপের ব্রিটিশদের অ্যাকরোটিরি এয়ারফোর্স বেস থেকে, বলল কুয়াশা। এরিয়াল ট্যাঙ্কারটা ভিসি-১০। আকাশে উঠবে পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর।

চট করে নিশাত ও খবিরকে দেখল রানা। পরক্ষণে কুয়াশাকে বলল, আপনার আপত্তি না থাকলে আমি চাই আপা আর খবিরকে লণ্ডনে পৌঁছে দিক রঘুপতি। আপনি ওদের নেতৃত্ব দিলে খুশি হব। হেন্ড্রিকের ওই দল ম্যাকিনকে শেষ করার আগেই পৌঁছতে হবে। সেজন্যে সুখোই ফাইটার লাগবে।

লণ্ডনে গিয়ে আমাদের কাজ কী হবে, স্যর? জানতে চাইল নিশাত।

বলছি, বলল রানা। সোজা লণ্ডনে যাবেন। আর আমি নামব সাইপ্রাসে…

আমার আপত্তি আছে। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি, বলল বৈজ্ঞানিক, অন্তত এই বাউন্টি হান্ট শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। নিশাত ও খবিরকে খুলে বলতে লাগল, কী করতে হবে লণ্ডনে পৌঁছবার পর।

.

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর এয়ার-টু-এয়ার রিফিউয়েলিঙের জন্য সাইপ্রাস দ্বীপের ব্রিটিশ এয়ার বেস থেকে আকাশে উঠল ভিকার্স ভিসি-১০, পেটমোটা বিমান।

কিন্তু বিমানের চার ক্রু ভুলেও জানল না রিয়ার কার্গো বে-তে উঠেছে অচেনা দুই লোক।

অ্যাকটিভ স্টেলথ পর্দার আড়ালে বিমান থেকে মাসুদ রানা এবং কুয়াশাকে সাইপ্রাসের সাগরতীরে নামিয়ে দিয়েছে রঘুপতি।

এরপর লণ্ডন লক্ষ্য করে রওনা হয়েছে তিনজনের দলটি।

রানা ভেবেছিল বিএসএস-এর চিফ মার্ভিন লংফেলোর সঙ্গে যোগাযোগ করবে, তার সাহায্য নিয়ে ওই রিফিউয়েলিং বিমানে উঠবে।

কিন্তু পরে নাকচ করেছে চিন্তাটা।

সাগরতীর থেকে মাত্র দশ মিনিটে পৌঁছে গেছে প্রায় পরিত্যক্ত ব্রিটিশ এয়ার বেসে। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে লুকিয়ে পড়েছে। ঝোঁপঝাড়ের ভিতর। পরবর্তী দশ মিনিট নজর রাখবার পর, উঠে পড়েছে ভিসি-১০এর পেটে।

বিমান আকাশে উঠবার কিছুক্ষণ পর তুরস্কের আকাশসীমা পেরোলো ভিসি-১০। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আগেই অনুমতি নিয়েছে, পরবর্তী কয়েক মিনিট পর কঙ্গো থেকে আসা আরএএফ হারকিউলিসের পাশে পৌঁছে গেল ট্যাঙ্কার বিমান।

দুই বিমানের পাইলটের ভিতর নিশ্চয়ই কথা হয়েছে। হারকিউলিস বিমানের সামনে চলে গেল ভিসি-১০। পিছনের বিমান থেকে সামান্য উপরে ভাসছে। রিয়ার হ্যাচ থেকে বাড়িয়ে দেয়া হলো দীর্ঘ ফিউয়েল হোস। সত্তর মিটার দীর্ঘ ওই নলকে অনেকে বলে বুম। শেষমাথায় স্টিলের গোলাকার ড্রোউগ। ওটার অন্য অংশ আটকে দেয়া হবে পিছনের বিমানের ট্যাঙ্কের পাইপে।

ট্যাঙ্কার বিমানের পিছনে অপেক্ষা করছে একাকী অপারেটার। তার কাজ কাঁচে ঢাকা কমপার্টমেন্টে উপুড় হয়ে শুয়ে পিছনের হারকিউলিস বিমানের রিসিভিং প্রোবে বুম আটকে দেয়া।

হারকিউলিসের রিসিভিং প্রোব দিগন্তের দিকে না তাক করা পাইপ। ওটা আছে কার্গো বিমানের ককপিট উইণ্ডোর খানিকটা উপরে।

আকাশে বিপদ না ঘটিয়েই ব্যালে ড্যান্স শেষ করেছে দুই বিমানের পাইলট।

ট্যাঙ্কারের বুম অপারেটার বাড়িয়ে দিয়েছে নল। স্থির রাখছে জিনিসটা। পিছনে সামান্য নীচে আসছে হারকিউলিস।

কারক্লাঞ্চ! আওয়াজ তুলে হারকিউলিসের রিসিভিং পোব লক হলো ড্রোউগে। কাজে নামল ভাসমান দুই বিমানের মাঝের নল, হারকিউলিসের পেটে ঢুকতে লাগল হাই-অকটেন।

ওদিকে খেয়ালই নেই কুয়াশার। এইচঅ্যাণ্ডকে পিস্তলে ভরছে অদ্ভূত কয়েকটা নাইন এমএম রাউণ্ড। এসব গুলির থুতনির নীচে কমলা রঙের ব্যাণ্ড আঁকা।

এ জিনিস ব্যবহার করলে ছুটন্ত ষড়ও হোঁচট খেয়ে পড়ে, রানাকে বলল। কখনও কখনও ব্যবহার করি। গ্যাস এক্সপ্যাণ্ডিং নাইন মিলিমিটার রাউণ্ড। হলো পয়েন্ট গুলির চেয়ে ঢের ভাল। টার্গেটের বুক বা পেটে লাগলে স্রেফ বিস্ফোরিত হবে লোকটা।

বিস্ফোরিত হবে? ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা।

কোমর থেকে দুটুকরো হয়ে যাবে। কয়েকটা লাগবে?

না, ধন্যবাদ।

তাও রাখো, রানার কমব্যাট ওয়েবিঙে কমলা ব্যাণ্ডের কয়েকটা গুলি গুঁজে দিল কুয়াশা। পরে লাগতে পারে।

বৈজ্ঞানিকের আলখেল্লার অসংখ্য পকেট খেয়াল করছে রানা।

কী নেই ওখানে!

পনি বটল, ছোট ব্লো-টর্চ, মাউন্টেনিয়ারিং পিটন..

ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। ছোট একটা পাউচের মত জিনিসটা দেখে চমকে গেছে। ওটা বোধহয় রোল ব্যাগ!

ওটা কি বডি ব্যাগ? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ, মাকোভ টাইপ-১১১, জানাল কুয়াশা, এ জিনিস তৈরিতে সেরা ছিল সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা। অন্যদেশের বিজ্ঞানীরা ওদের ধারেকাছেও যেতে পারেনি।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা।

মার্কোভ টাইপ-১১১ আসলে কেমিকেল বডি ব্যাগ। সঙ্গে ডাবল-স্ট্রেংথ যিপলক ও পলি-কোটেড নাইলন দেয়াল।

নিরাপদে রাখা সম্ভব ভয়ঙ্কর দূষণে মৃত লোকের লাশ। ছড়িয়ে পড়বে না কোনও বিপদ। প্লেগ, কেমিকেল ওয়েপন্স, এমন কী সুপার হিটেড রেডিয়োঅ্যাকটিভ আবর্জনাও আটকে রাখবে নিজের পেটে। চের্নোবিল দুর্ঘটনার পর এমন অসংখ্য বডি ব্যাগ ব্যবহার করেছিল রাশানরা।

অবশ্য এসব দেখে নয়, রানা হাসল পিটনগুলো দেখে।

মনসুর আলী ওরফে বিজ্ঞানী-বৈমানিক কুয়াশা নানা কাজেই বডি ব্যাগ রাখতে পারে, কিন্তু তাই বলে বিমানে চেপে যাওয়ার সময় পিটন কেন?  

বিমান দুর্ঘটনার পর খসে পড়বে আকাশ থেকে, তখন নামবে কোনও পাহাড়ে, তারপর আবারও আকাশ ছোঁয়ার জন্য শুরু করবে ক্লাইমিং?

এসব পিটন ছোট স্প্রিং লোডেড কাঁচির মত জিনিস।

যে-কোনও ছোট ফাটলকে সর্বশক্তিতে খামচে ধরে, পাহাড়ে উঠবার সময় ক্লাইমাররা এই জিনিসের সঙ্গে আটকে নেয় দড়ি। দেয়াল বা ফাটলের উপর এত জোরে কামড় বসায় পিটনের প্রিং, যে অনায়াসেই ঝুলতে পারে পর্বতারোহী।

মনে মনে বলল রানা, এ জিনিস দিয়ে করে কী লোকটা?

একটা কথা জানতে চাই, কৌতূহল মেটাতে প্রশ্ন করল ও, পিটন দিয়ে কী করবেন?

অলসভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল বৈজ্ঞানিক হয়তো দেয়াল বেয়ে উঠতে কাজে লাগবে।

জিজ্ঞেস করল রানা, নিশ্চই আরও বহুকিছু আছে আপনার কাছে? যেমন ধরুন অত্যাচার করার মত কিছু?

রানার চোখে চোখ রাখল কুয়াশা। সামান্য হাসল। একেবারে নেই, তা নয়। তবে নির্যাতন নয়, ওগুলো অন্য কাজে ব্যবহার করি।

রিফিউয়েলিং প্রায় শেষ, আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল ওরা।

তুমি বুমার লোকটার ব্যবস্থা নাও, রানাকে বলল বৈজ্ঞানিক। নতুন একটা নাইন এমএম পিস্তল বের করেছে। আমি ককপিটের ক্রুদের ব্যবস্থা করছি।

একটা কথা, বলল রানা। একবার হারকিউলিসে উঠলে যা। খুশি করতে পারেন, কিন্তু আমি চাই না এ বিমানের কেউ মারা যাক। সম্ভব হলে বন্দি করবেন পাইলট ও অন্যদেরকে। পরে যেন নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারে ওরা।

তাতে সময় নষ্ট হবে! আপত্তির সুরে বলল কুয়াশা।

এ বিমানের কেউ সামান্যতম অন্যায় করেনি আমাদের প্রতি, যুক্তি দিল রানা।

ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবল বৈজ্ঞানিক, তারপর বলল, ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারি।

ধন্যবাদ, কুয়াশা, এর বেশি কিছু চাইছি না আপনার কাছ থেকে, বলল রানা।

অস্ত্র হাতে দুদিকে রওনা হলো দুই জগতের দুই প্রতিভাবান বাঙালি।

.

ব্রিটিশ সি-৩০ হারকিউলিস বিমানের ককপিটে পনেরো খণ্ডের জানালা দিয়ে খুব ভালভাবেই দেখা যায় চারপাশ। দুই পাইলট খেয়াল করছে, একটু সামনে ও উপরে ঝুলছে ভিসি-১০ বিমানের পাখির নিতম্বের মত অংশ। ওখান থেকে আসছে ফিউয়েল হোস–নানাদিকে সরছে মস্ত অজগরের মত। শেষাংশ এসে লাগবে ককপিটের উপরের রিসিভিং প্রোব-এ।

জীবনে বহুবার মিড-এয়ার রিফিউয়েলিং করেছে দুই পাইলট। একবার দুই বিমানের মিলন হলেই অটো-পাইলট চালু করবে পাইলট। তখন থেকে একমাত্র কাজ হয়ে উঠবে ফিউয়েল পাম্পিং স্ট্যাটাস লক্ষ্য করা। জানালা দিয়ে চারপাশের সুন্দর

শ্য দেখবার সময় পাবে না তখন।

এবং সে কারণেই ক্রুদের কেউ জানল না, সামনের বিমান থেকে বেরোল যমের মত কালো পোশাক পরা এক লোক। ফিউয়েল হোস বেয়ে ঝুলতে ঝুলতে এল সে, তোয়াক্কা করছে না। বিপদের। দক্ষ স্টান্টম্যানের মত নামছে ককপিট লক্ষ্য করে। পরক্ষণে এক পশলা গুলিতে বিস্ফোরিত হলো জানালার কাঁচ।

দৃশ্যটা সত্যিই অদ্ভুত।

আকাশের বিশ হাজার ফুট উপরে ভাসছে প্রকাণ্ড দুই বিমান। সামনের উড়োজাহাজের পিছন থেকে দীর্ঘ ঝুলঝুলে ফিউয়েল হোস গেছে পিছনের আকাশযানের কপালে।

আর দোদুল্যমান হোস বেয়ে নামছে দুই লোক, যেন ছোট্ট দুই পুতুল। _ হোস ঘিরে তৈরি করেছে দড়ির নূপ। একহাতে দড়ির দুই প্রান্ত চেপে ধরে নেমে আসছে কুয়াশা ও রানা। অন্যহাতে হেকলার অ্যাণ্ড কচ্ অটোমেটিক পিস্তল। হারকিউলিস বিমানের ককপিট লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করছে।

অসংখ্য কাঁচের টুকরো চোখে-মুখে বিধতেই সিট ছেড়ে লাফিয়ে ককপিটের মেঝেতে উপুড় হলো দুই পাইলট।

সামনে থেকে আসছে প্রবল ঝোড়ো হাওয়া।

অটোমেটিক পাইলটে চলছে বিমান, আগের মতই স্থির।

তীব্র গতিতে ফিউয়েল হোস থেকে বিমানের ককপিটে পৌঁছল কুয়াশা, লাফিয়ে নামল মেঝেতে। মুখে হাই-অল্টিচ্যুড মুখোশ, পিঠে আল্টা-কমপ্যাক্ট এমসি-৪/৭ অ্যাটাক প্যারাশুট।

পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুই পাইলট চেয়ে রইল, দৃষ্টি বিস্ফারিত, সম্পূর্ণ হতবাক।

কাছের জনের মাথায় অস্ত্র তাক করেছে কুয়াশা। খতম করতে পারবে এক গুলিতে দুই পাখি। অন্যহাতে কোমর থেকে নিল হ্যাণ্ডকাফ, দুজনের কব্জিতে আটকে দিল ইস্পাতের দুই কড়া। পিস্তলের জোরালো দুই টোকা পড়ল তাদের চাদির উপর।

সন্তুষ্ট হলো কুয়াশা। আপাতত কমপক্ষে একঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকবে এরা।

কই, তুমি কোথায়, রানা! রেডিয়ো মাইকে বলল কুয়াশা।

আপনার পিছনেই! জানাল রানা। পরক্ষণে নামল ককপিটের মেঝেতে। মুখে ব্রেদিং মাস্ক, পিঠে ঝুলছে খুদে ও চ্যাপ্টা অ্যাটাক প্যারাশুট।

.

হারকিউলিস বিমানের কার্গো হোল্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালো পোশাক পরা আট কমাণ্ডো, একটু দূরে সুট পরিহিত দুজন। এদের সঙ্গে রয়েছে দুই বন্দি।

কন্টিনেন্টাল সোলজার বাউন্টি হান্টিং সংগঠনের ৬৬ ইউনিটের লোক আট কমাণ্ডো। তাদের কাজ পুরস্কার ঘোষণাকারী ব্যাঙ্কারের কাছে ছিন্ন মাথা পৌঁছে দেয়া।

সুট পরা যে দুজন, কেউ জানে না তাদের সঠিক নাম। অবশ্য, এদের রয়েছে এমআই-সিক্সের পরিচয়পত্র।

এককথায়, তারা কাজ করে ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের হয়ে।

দুই বন্দির একজন বাংলাদেশ আর্মির লেফটেন্যান্ট তিশা করিম। অন্যজন জেনারেল রেমও কে. এ্যাঞ্জার। তাঁকে কঙ্গোর ইউএন শিবির থেকে কিডন্যাপ করেছে ডেভিড এন. হেখ্রিকের লোক।

এইমাত্র জ্ঞান ফিরেছে তিশার। চারপাশ দেখছে। ও আছে হারকিউলিস বিমানের চওড়া কার্গো হোল্ডে। পিঠের কাছে আটকা পড়েছে ওর দুই কব্জি ফ্লেক্সকাফে।

ক ফুট দূরে জেনারেল রেমণ্ড কে, গ্র্যাঞ্জার। এই ভদ্রলোক ইউএস মেরিন কর্পসের অন্যতম সিনিয়র অফিসার। ফেলে রাখা হয়েছে এক হামভি জিপের বনেটের উপর। চার খণ্ড দড়িতে টানটান করে বাঁধা চার হাত-পা, যেন চিত অবস্থায় ক্রুশবিদ্ধ হয়েছেন। হামভির দুই সাইড মিররের দণ্ডের সঙ্গে আটকে দেয়া হয়েছে হ্যাণ্ডকাফ, অন্য দুই কড়া বন্দি করেছে তাঁর দুই কব্জি।

ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে জেনারেলের ইউনিফর্মের আস্তিন। বাহুতে শক্ত করে বাঁধা রাবারের টুনিকে।

বন্দির দুপাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুই এমআই-সিক্স এজেন্ট।

চেতনা ফিরতেই তিশা দেখেছে, সুটওয়ালা দুজনের ভিতর বেঁটে লোকটা পকেট থেকে বের করছে হাইপোডারমিক নিডল।

ওটা গেঁথে দিল জেনারেলের বাহুতে।

কয়েক মিনিট লাগবে, সঙ্গীকে চাপা স্বরে জানাল বাঁটকু।

মাথা তুললেন জেনারেল, জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ।

হ্যালো, জেনারেল এ্যাঞ্জার, মৃদু হাসল লম্বা ইন্টেলিজেন্স অফিসার। আপনার ধমনীতে যে ড্রাগ দেয়া হয়েছে, ওটার নাম ইএ-৬২৭। জানি, যে পদমর্যাদার অফিসার আপনি, এ জিনিসের নাম আগেই শুনেছেন। এটা নিউরাল ডিজইনহিবিটার- এমন এক ড্রাগ, ঘোলা করে দেবে মস্তিষ্ক। মগজের নিউরোট্রান্সমিটার বা গ্যাবার ক্ষতি করবে। সোজা কথায়, এ ডাগ ব্যবহার করলে সব প্রশ্নের জবাব দিতে শুরু করবেন আপনি।

ক্ক…কী? অবাক হয়ে বাহুর দিকে চাইলেন গ্র্যাঞ্জার।

…৬২৭? …নাহ্…

দূর থেকে দেখছে বাউন্টি হান্টিং দলের লোকগুলো। তাদের নেতা অসাধারণ সুপুরুষ এক যোদ্ধা। একে কঙ্গোর কয়লা খনিতে দেখেছে তিশা। কুচ করে কেটে নিয়েছিল আস্ফালনরত আলাল হোসেনের মাথা।

ঠিক আছে, এবার আলাপ করা যাক, জেনারেল, বলল লম্বা এজেন্ট। দ্য ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড।…ওটা কী?

ভুরু কুঁচকে ফেললেন জেনারেল। কী যেন ভাবতে শুরু করেছেন। চিন্তাগুলোকে বাধা দিতে চাইলেন প্রাণপণে। কুঁচকে গেল গাল।

আমি… আমি… জানি না… কীসের কোড… বেসুরো কণ্ঠে বললেন।

জানেন তো অবশ্যই, জেনারেল। মনে করুন ইউনাইটেড স্টেটস আর ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোডের কথা। ওই কোড সিস্টেমকে। আজ ভোরে আপনি আমেরিকা থেকে কঙ্গোতে পৌঁছুনোর আগে এক ইউএস মিলিটারি প্রজেক্টের এন্ট্রি কোড জেনেছেন। ওই প্রজেক্টের নাম নোয়ায শিপ। আমরা নোয়ায শিপ সম্বন্ধে সবই জানি, জেনারেল। কিন্তু জানি না ওই কোড। আর ওই কোড আমরা জানতে চাই। …এবার বলুন, কী ওই কোড?

অবাক হয়ে শুনছে তিশা।

ওটা নাকি এমন এক নিউমেরিকাল কোড, যেটা ওভাররিড করবে ইউএস মিলিটারি সিকিউরিটি সিস্টেমের সব কিছুকে।

পিটপিট করে চাইলেন জেনারেল এ্যাঞ্জার। ড্রাগের বিরুদ্ধে লড়ছেন। না… নেই তো… এমন কিছু…

না, জেনারেল, জোর দিয়ে বলল লম্বা লোকটা, ওই জিনিস বাস্তবে আছে। আর আপনি ইউএস মিলিটারির সর্বোচ্চ পাঁচজন। কর্মকর্তার একজন। আমার বোধহয় ডোজ বাড়াতে হবে।

কোটের পকেট থেকে সিরিঞ্জ বের করল সে, জেনারেলের বাহুতে গেঁথে দিল নিডল।

গুঙিয়ে উঠলেন জেনারেল। …না…

শিরশির অনুভূতি তৈরি করে শিরার ভিতর দিয়ে চলেছে ইএ ৬২৭।

ঠিক তখনই বিস্ফোরিত হলো বিমানের ককপিটের জানালা।

গুলির আওয়াজ শুনেছে সবাই।

শুরু হলো শো-শো হাওয়ার জোরালো আওয়াজ।

.

কুয়াশা হারকিউলিস বিমানের ককপিটে পৌঁছে যাওয়ার কয়েক সেকেণ্ড পর ওর পাশে নামল রানা। তার আগেই ঝট করে সামনে বেড়ে দুই পাইলটের কব্জিতে হ্যাণ্ডকাফ আটকে দিয়েছে কুয়াশা। মাথায় পিস্তলের বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছে তাদেরকে।

এবার দুটো গুলি করতে পারি? মৃদু হাসল বৈজ্ঞানিক।

খুশি মনে!

আসলে পারি না। আঙুল তুলে ককপিট ড্যাশবোর্ডের টিভি মনিটর দেখাল কুয়াশা। ওই পর্দা আসলে হারকিউলিস বিমানের রিয়ার হোল্ড দেখাচ্ছে।

রানা লক্ষ করল, ককপিটের দরজার কাছেই কমপক্ষে বারোটা ক্রেট। ওপাশে হামভির বনেটের উপর চিত হয়ে পড়ে আছেন জেনারেল এ্যাঞ্জার। একটু দূরে কালো ইউনিফর্ম পরা আট সশস্ত্র লোক। জেনারেলের দুপাশে সুট পরা দুই লোক। আর কার্গো হোল্ডে হামভির বামে, দেয়ালের বেঞ্চে বসে আছে তিশা। ওর দুই হাত পিঠের পিছনে আটকে রাখা হয়েছে হ্যাণ্ডকাফে। ১৮৫

ওরা সংখ্যায় অনেক বেশি, বলল রানা। গোলাগুলি শুরু হলে…

জানি, কাজেই হ্রাস করতে হবে ওদের অস্ত্র।

আলখেল্লার পকেট থেকে দুটো ছোট জিনিস বের করেছে বৈজ্ঞানিক। হলদেটে। আকার ও আকৃতিতে নারকেলি বরইয়ের

কাজ কী ওগুলোর? জানতে চাইল রানা।

ব্রিটিশ এসি-২ চার্জের মত।

আপনার তৈরি অ্যাডহেসিভ-চাফ গ্রেনেড?

আস্তে করে মাথা দোলাল কুয়াশা। অ্যান্টি ফায়ারআর্ম চার্জ।

গুড!

কাউন্টার টেরোরিস্ট অপারেশনে এ ধরনের গ্রেনেড ব্যবহার করে এসএএস এক্সপার্টরা। সশস্ত্র কিডন্যাপারদের বিরুদ্ধে দারুণ কাজ করে। আসলে সাধারণ ফ্লাশব্যাং গ্রেনেড, কিন্তু আলাদা গুণও আছে।

তুমি তৈরি, রানা? মনে রেখো, একটা গুলি হলেই জ্যাম হবে অস্ত্র। …এবার দেখা যাক আমার বরই কেমন কাজ করে।

ককপিটের দরজা সামান্য ফাঁক করল কুয়াশা, কার্গো হোল্ডের ভিতর ছুঁড়ে ফেলল দুই গ্রেনেড। পরক্ষণে ধেয়ে গেল ওগুলোর পিছনে।

ককপিটের ওপাশে কাঠের কার্গো ক্রেট ডিঙিয়ে হোল্ডে ঢুকল দুই হলদে নারকেলি বরই, হামভির পাশের মেঝেতে পড়েই বিস্ফোরিত হলো।

প্রথমে দেখা দিল অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো, পরক্ষণে ভয়ানক তীক্ষ্ণ শব্দ হলো: ফট্টাশ! ফট্টাশ!

যেন ফাটিয়ে দেবে কানের পর্দা।

চমকে গেছে সবাই, ঢেকে ফেলেছে দুই চোখ।

এবার তৃতীয় কাজ দেখাল কুয়াশার গ্রেনেড।

বিস্ফোরিত হতেই ওগুলোর পেট থেকে নানাদিকে ছিটকে গেল অতি ক্ষুদ্র হাজারে হাজারে সাদা-ধূসর কণা। ভরে উঠল কার্গো বে। এখন আর ভালভাবে চারপাশ দেখবার উপায় নেই।

বাতাসে ভাসছে অজস্র সাদা-ধূসর কণা, একটু দূরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন চারদিক ঢেকে দেয়া হয়েছে পর্দা দিয়ে। ঘন কুয়াশা পড়লে বা তুমুল তুষারপাতের সময় এমন হয়।

রানা খেয়াল করল, কুয়াশার গ্রেনেডের অ্যাডহেসিভ জিনিসটা ভয়ঙ্কর আঠালো। যেখানে লাগছে, সেখানেই সেটে যাচ্ছে।

ঝট করে রাইফেলের দিকে হাত বাড়াল কাছের কমাণ্ডে। কিন্তু তার কপালে জুটল খাটো তীর। ওটা এসেছে কুয়াশার বাহুর সঙ্গে লাগানো খুদে ক্রসবো থেকে।

দ্বিতীয় কমাণ্ডো চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল। খট আওয়াজ উঠল তার কপালে। কুয়াশার বাম বাহুর ক্রসবোর তীর বিঁধেছে লোকটার মগজে।

অবশ্য ততীয় কমাণ্ডে, টিপে দিল কোল্ট কমাণ্ডা অ্যাসল্ট রাইফেলের ট্রিগার।

জ্যাম হয়ে গেছে।

লোকটার অস্ত্রের ব্যারেলের অভ্যন্তর অংশ আঠালো করে দিয়েছে কুয়াশার আবিষ্কার। বিকল হয়েছে ব্যারেল, রিসিভার এবং প্রতিটি মুভিং পার্ট। ওই রাইফেল আর গুলি করবে না, বড়জোর গদা হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ম্যাগহুকের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড এক বাড়ি মেরে লোকটার খুলি দাবিয়ে দিল রানা, থেঁতলে গেছে শত্রুর মগজ।

পাঁচ সেকেণ্ডও লাগল না তিন লাশ মেঝেতে পড়তে। কিন্তু পরিস্থিতি বুঝে নিয়েছে বাউন্টি হান্টার কমাণ্ডোরা, পরের দুই সেকেণ্ডে রানা ও কুয়াশার পাশের কাঠের ক্রেটে খট-খট আওয়াজে বিধল দুটো ওয়ারলক হান্টিং নাইফ।

জবাবে আলখেল্লার পকেট থেকে ভয়ঙ্কর কুৎসিত এক অস্ত্র বের করল কুয়াশা। জীবনে কখনও এত অশুভ জিনিস দেখেনি রানা।

না, দেখেছে।

ওটা খুদে চার ফলার নিনজা গ্রোয়িং নক্ষত্র–শুরিকেন।

ওটা রানার পাঞ্জার সমান হবে, চার ফলার ভিতর অংশে গোল ডিস্কে একটা গর্ত।

একহাতে দারুণ দক্ষতায় দেহের একপাশ থেকে নক্ষত্র ছুঁড়ল কুয়াশা। বাতাস চিরে সসস্ আওয়াজ তুলে ছিটকে গেল শুরিকেন।

পাশাপাশি দাঁড়ানো ৬৬ ইউনিটের দুই কমাণ্ডোর গলা খচ! খচ! শব্দে কাটা পড়ল!

ধড়াস্ করে মেঝেতে পড়ল দুই লাশ। মেঝের উপর গড়াতে শুরু করেছে তাজা রক্ত

আঁশটে গন্ধে ভরে গেল আশপাশ।

পাঁচটা গেল, ভাবছে রানা।

আরও তিনজন বাকি… এ ছাড়া রয়েছে সুট পরা দুই…

ঠিক তখনই খপ করে ওর কব্জি ধরল কে যেন। হাতে অসম্ভব শক্তি। পরক্ষণে প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে আবারও ককপিটের দরজার কাছে পৌঁছে গেল রানা। তাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে পড়ল মেঝেতে। মুখ তুলেই দেখল, ওর দিকে আসছে। বিশালাকৃতি এক ট্রুপার। লোকটা মস্ত কোনও কালো গ্রিজলি ভালুক যেন। দৈর্ঘ্যে কমপক্ষে সাত ফুট। দুহাতে কিলবিলে পেশি। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে চেহারা।

তুই এখানে কী চাস? ঘোৎ করে উঠল কালো পাহাড়।

কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই নড়তে শুরু করেছে রানা—লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েই ডানহাত ঘুরিয়ে চালাল ম্যাকহুক। ওটার বাঁট নামল লোকটার উঁচু চোয়ালের উপর।

জোরালো খট্টাস্ আওয়াজ হলো।

এবার বাপরে, গেছিরে বলে আর্তনাদ ছাড়বে লোকটা, ভাবল। রানা। কিন্তু কালো মানিক সামান্যও নড়ল না।

বাপরে, বিড়বিড় করল রানা নিজেই।

তখনই প্রচণ্ড এক ঘুষি নামল ওর চোয়ালে। ব্যথা ছাড়া আর কিছুই টের পেল না, উড়তে শুরু করেছে পিছনে। ছিটকে গিয়ে পড়ল জানালা ভাঙা ককপিটের ভিতর। নিজেকে ছেঁড়া কাপড়ের নড়বড়ে পুতুল মনে হচ্ছে ওর। ড্যাশবোর্ডে গুতো খেয়ে ধুপ করে পড়ল মেঝেতে।

কষ্ট করে উঠতে হলো না, এক লাফে পৌঁছে গেল দানব, একহাতে রানার গলা ধরে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে নিল।

তুই যেদিক দিয়ে এলি, সেদিক দিয়েই যা–ওই ভাঙা জানালা দিয়ে।

কোনও আপত্তির সুযোগ পেল না রানা, সময় নষ্ট না করেই ওকে ভাঙা জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলল কালো মানিক।

খোলা আকাশে সাঁতার কাটছে রানা।

বহু নীচে ঝিলমিল করছে নীল ভূমধ্যসাগর!

ষোল

ভাসমান অজস্র সাদা-ধূসর কণা ভরা কার্গো হোল্ডে ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ছে কুয়াশা, শত্রুদের উদ্দেশে ছুঁড়ছে জাপানি নক্ষত্র। তারই ফাঁকে একবার চট করে পিছনে চাইল। ভাবছে, রানার কোনও অ্যাক্টিভিটি নেই কেন!

পরক্ষণে চমকে গেল কুয়াশা।

দেখল, ককপির্টের ভাঙা জানালা টপকে চড়ুই পাখির মত উধাও হয়ে গেল রানা!

যাহ্! বিড়বিড় করল কুয়াশা।

রানার মত ওর নিজের পিঠেও প্যারাশুট। চট করে বুঝে নিল, আকাশ থেকে পতনের ফলে মরবে না রানা।

তা না হয় হলো, কিন্তু একা এতজনের বিরুদ্ধে লড়াই খুবই কঠিন, ভাবল কুয়াশা। রেডিয়ো মাইকে বলল, রানা, ঠিক আছ?

জোরালো হাওয়ার উপর দিয়ে এল জবাব, আছি, আবারও উঠে আসছি।

.

বিশ হাজার ফুট উচ্চতায় ভাসছে হারকিউলিস বিমান। সামনে এবং একটু উপরে ভিসি-১০ ট্যাঙ্কার। ওটা থেকে কেউ উঁকি দিলে দেখবে, পিছনের বিমানের নোজ কোন-এ সেঁটে আছে এক মহাসাহসী লোক। সে যেন সুপারম্যান, শুধু বুক দিয়ে ঠেকিয়ে দেবে অত বড় বিমানের অগ্রগতি!

প্রকাণ্ড হারকিউলিস বিমানের নাকে ঝোড়ো হাওয়া পাত্তা না দিয়ে নীচের দুনিয়া দেখছে রানা। কপাল ভাল, সঙ্গে ছিল ম্যাগহুক, এবং ওটার ম্যাগনেটিক বা ওকে আটকে রেখেছে কার্গো বিমানের নাকে।

ভাঙা জানালায় উঁকি দিয়েছে কালো দানব, কুঁচকে ফেলেছে ঘন ভুরু।

কয়েক মুহূর্ত পর জানালা থেকে সরল। পেরোল কিছুক্ষণ, তারপর আবারও ফিরল, এখন হাতে ভয়ঙ্কর চেহারার কোল্ট ৪৫ রিভলভার। বোধহয় ককপিটেই ছিল। চোখে পড়েনি কুয়াশার।

রানার মাথার সামান্য উপর দিয়ে গুলি বেরিয়ে যেতেই ধূর শালা! বলে উঠল দানব।

মর শালা! মনে মনে বলল রানা। আশা করেছিল কালা পাহাড় ভাববে শত্রু পড়ে গেছে। রিয়ার হোল্ডে ফিরবে ব্যাটা, আর সে সুযোগে আবারও ককপিটে ফিরবে ও।

কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি।

বেল্ট থেকে তিশার ম্যাগহুক নিয়ে ব্যবহার করল ম্যাগনেটিক বালব। ঠং আওয়াজে ওটা সেঁটে গেল বিমানের নীচের অংশে। এবার দুই ম্যাগহুকের সাহায্য নিয়ে রওনা হলো রানা। বিমানের নাক থেকে খসে পড়েছে, হারিয়ে গেল কালো মানিকের লাইন অভ ফায়ার থেকে। কার্গো বিমানের তলে পেণ্ডুলামের মত ঝুলছে, বিশ হাজার ফুট নীচে নীল সাগর এবং দূরে রুক্ষ পাথুরে জমিন।

ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড থ্রোট মাইকে বলল রানা, কুয়াশা! চেষ্টা করুন এক্সটার্নাল ডোর খুলে দিতে!

.

কার্গো বে-র ভিতর ঝট করে সরে গেছে কুয়াশা। এইমাত্র বুকের পাশ দিয়ে গেল উড়ন্ত ছোরা। ওই একই সময়ে সুট পরা এক লোকের বুকে বিঁধল ওর শুরিকেন।

লাল বড় কন্ট্রোল বাটনের উপর চোখ পড়ল ওর। ওটাই নিয়ন্ত্রণ করে হারকিউলিস বিমানের কার্গো র‍্যাম্প।

কুয়াশার একটা শুরিকেন গেল লাল বাটন লক্ষ্য করে।

আওয়াজ উঠল; খটাং!

ঠিকভাবেই লেগেছে শুরিকেনের এক বাহু, অন্য এক বাহু কন্সোলের সঙ্গে চেপে ধরেছে বাটনটাকে। সঙ্গে সঙ্গে নিচু হুমমমম আওয়াজ তুলে খুলতে লাগল হারকিউলিস বিমানের কার্গো র‍্যাম্প।

ঠিক আছে, রানা, খুলছে কার্গো র‍্যাম্প! জানিয়ে দিল কুয়াশা।

বৈজ্ঞানিকের কথা পরিষ্কার শুনল রানা, দুই হাত সর্বস্ব পিঁপড়ের মত চলেছে হারকিউলিস বিমানের পেট বেয়ে। মাথার উপরে সেঁটে আছে দুই ম্যাগনেটিক বালব। ও-দুটোর সাহায্য নিয়ে সামনে বাড়ছে। একটা ম্যাগনেটিক বালব ডিম্যাগনেটাই করে আবারও বিমানের অন্য অংশে আটকে নিচ্ছে ম্যাগনেট। ঝুলতে ঝুলতে পেরিয়ে এল প্রায় ষাট ফুট দৈর্ঘ্যের কার্গো হোল্ড। আর সামান্য পথ, তারপর সামনেই পড়বে খোলা রিয়ার র‍্যাম্প।

.

খোলা রিয়ার লোডিং র‍্যাম্পের কারণে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকছে। কার্গো বে-তে। বিমানের পেট থেকে তীরের মত বেরুচ্ছে ভাসমান সাদা-ধূসর কণা, যেন শুরু হয়েছে ইনডোর ব্লিার্ড।

কার্গো হোল্ডের ভিতর তিশার কাছে পৌঁছে গেছে কুয়াশা। চট করে বসে পড়ল মেয়েটির পাশে।

তোমাকে সরিয়ে নেব, নিচু স্বরে বলল। হাতে ছুরি, এবার কাটবে ফ্লেক্স-কাফ, কিন্তু তখনই কালো দুই প্রকাণ্ড হাত জোর টান দিল পিছন থেকে।

হোঁচট খেয়ে হামভির পাশে পড়ল কুয়াশা, ছুটে গেল হাতের ছোরা।

নিজের কাভার থেকে বেরিয়ে এসেছে বাউন্টি হান্টি দলের নেতা। হামভির ডানদিকে লুকিয়ে ছিল।

ওর সানগ্লাস কেড়ে নাও! নির্দেশ দিল সে।

পরক্ষণে দানবের প্রচণ্ড ঘুষি নামল কুয়াশার সানগ্লাসে।

মড়াৎ করে ভাঙল দুই কাঁচের মাঝের ডাণ্ডি।

ঝরঝর করে খসে পড়ল ভাঙা দুই কাঁচ।

স্বাভাবিক আলো কুয়াশার চোখে পড়তেই ওহ! বলে উঠল। তীব্র ব্যথা পেয়ে বুজে ফেলেছে দুই চোখ।

পরক্ষণে বুকে নেমে এল আরেক ভয়ঙ্কর ঘুষি।

ওকে গাড়ির সামনে ধরো, বলল দলের নেতা। ঝটপট সরিয়ে দিল হামভির চাকার গোঁজগুলো। লাফ দিয়ে উঠল গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে। পিষে দেব ওর হাঁটু!

নির্দেশ পালন করতে দেরি হয়নি কালো দানবের।

দৃষ্টিহীন, অসহায় কুয়াশাকে ধরেছে হামভির চাকার সামনে। নিজে বসেছে পিছিয়ে।

গর্জে উঠল ইঞ্জিন, পরক্ষণে হামভির গিয়ার ফেলল সুদর্শন নেতা। মেঝের সঙ্গে টিপে ধরল অ্যাক্সেলারেটার।

ঝাঁকি খেয়ে সামনে বাড়ল হামভি। চাকার চাপে গুঁড়ো করে দেবে কুয়াশার দুই হাঁটুর বাটি।

এক সেকেণ্ড পর খুশি হয়ে উঠল বাউন্টি হান্টারদের নেতা। সামনের লোকটার দেহের উপর চেপে বসেছে মস্ত জিপ। একটু গিয়েই একটা ক্রেটের গায়ে লেগে থামল গাড়ি।

ধুশশালা! চেঁচিয়ে উঠল কালো মানিক।

কী হলো? জানতে চাইল তার নেতা।

অন্য বদমাশটা ফিরেছে!

কেউ খেয়াল করেনি, আবারও হারকিউলিস বিমানে উদয় হয়েছে মাসুদ রানা।

বাউন্টি হান্টারদের নেতা এবং কালো মানিক ভেবেছিল হোল্ডে শত্রু বলতে ওই কালো আলখেল্লা পরা লোকটাই।

এ দিকে হোল্ডে পৌঁছেই রানা দেখেছে, জীবিত শত্রু বলতে সুর্দশন লোকটা, কালা পাহাড় এবং সুট পরা এক এজেন্ট।

কেউ জানে না ম্যাগহুকের সাহায্য নিয়ে ফিরেছে ও, হামভির ডানদিকের সরু গলি ধরে পৌঁছে গেছে সামনে। হ্যাচকা টানে। সরিয়ে নিয়েছে কুয়াশাকে। ওই একই সময়ে গাড়ির নীচে ঠেলে দিয়েছে একটা লাশকে। সেই সঙ্গে প্রাণপণ শক্তিতে জোরালো একটা লাথি লাগিয়ে দিল কালো মানিকের নাক-মুখ সই করে।

কুয়াশাকে নিয়ে হোল্ডের বামদিকের দেয়ালে আছড়ে পড়েছে। রানা, সামান্য দূরেই তিশা।

একহাতে দুই জখমী চোখ চেপে ধরেছে কুয়াশা, মুখ থেকে বেরোচ্ছে না সামান্যতম কাতর ধ্বনি।

সময় নেই, তিশার পাশে বসে পড়ল রানা, বাড়িয়ে দিল। নিজের ছোরা। জলদি, তিশা! চললাম, জেনারেলকে মুক্ত করতে হবে!

হামভির বনেটে রয়ে গেছেন এ্যাঞ্জার।

গাড়ির সাইড মিররের ডাণ্ডার সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছে দুই হ্যাণ্ডকাফ |

হাতে ছোরা নিয়েই জানাল তিশা, দাঁড়াও! ৬৬ ইউনিটের এক লোকের লাশের কোমর থেকে আগেই সরিয়ে নিয়েছে এক গোছা চাবি। দুটো চাবি বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। হ্যাণ্ডকাফ খুলবে এগুলো!

চাবি হাতে উঠে দাঁড়াল রানা, কিন্তু তখনই ড্রাইভিং ডোর লাথি দিয়ে খুলল বাউন্টি হান্টারদের নেতা। ওই একই সময়ে রানা দেখল, কাঠের এক ক্রেট থেকে টান দিয়ে ছোরা বের করে নিল ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের লম্বা লোকটা।

দুই শত্রুর মাঝে আটকা পড়েছি, ভাবল রানা। দেরি না করে দুদিকে প্রসারিত করল দুহাতের দুই ম্যাগহুক। আঠালো কণা, ভরা বাতাসে মাত্র একবার সুযোগ পাবে ও।

দ্বিতীয়বার ভাবল না রানা।

সুদর্শন লোকটার বুকে বিঁধল না ম্যাগহুকের বাল। অবশ্য, খটাং করে লাগল দরজার উপর। এইমাত্র নামতে শুরু করেছিল লোকটা, খুব কাছ থেকে ম্যাগনেটিক বালব ব্যবহার হতেই বজ্রের মত আওয়াজ তুলে বন্ধ হলো আর্মার্ড দরজা। এতই জোরে যে, ছিটকে গিয়ে গাড়ির ভিতর পড়ল লোকটা।

দ্বিতীয় ম্যাগহুকের ম্যাগনেটিক বা লেগেছে সিক্রেট এজেন্টের বুকে। প্রচণ্ড আঘাতে দুভাঁজ হয়ে গেল লোকটা, মটমট করে ভাঙল পাঁজরের হাড়। উড়ে গিয়ে পড়ল সে পিছনের ক্রেটগুলোর পাশে।

ততক্ষণে ছোরার পোচে হাতকড়া কেটে ফেলেছে তিশা, চলে। এল হামভির সামনে। রানার কাছ থেকে চাবির গোছা নিয়ে খুলতে শুরু করেছে জেনারেলের বাম কব্জির কড়া।

ঠিক আছে, বলল তিশা, এবার অন্য কব্জি…

কিন্তু এমনি সময়ে তিশার অজান্তে হামভির পাশে উঠে দাঁড়াল কালো দানব, সত্যিকারের পাহাড়ের মতই। নাক-মুখ রক্তাক্ত।

এক লাফে তিশার পাশে পৌঁছে গেল রানা, জেনারেলের উপর চোখ রাখো। আমার সিগনাল পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করবে।

কীসের সিগনাল? জানতে চাইল তিশা।

জবাব না দিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়াল রানা, মেঝেতে পড়ে থাকা একটা লাশের বুক থেকে খুলে নিল কুয়াশার দুই শুরিকেন।

রানার মত করেই কুঁজো হয়েছে দানব, হাসছে রক্তাক্ত হলদে দাঁত বের করে।

দানবের নীরব আহবানে সাড়া দিল রানা।

হামভি থেকে সরে গেল দুজন, পৌঁছল রিয়ার লোডিং র‍্যাম্পে। বিমানের হাঁ করা দরজা দিয়ে দেখা গেল নীল আকাশ ও সাদা মেঘ। হু-হুঁ করে বাতাস আসছে ভিতরে।

বুনো পশ্চিমের পুরনো আমলের দুই গান ফাইটারের মত মুখোমুখি হলো দুজন, দূরত্ব মাত্র ছয় ফুট।

একজন দানবের মত প্রকাণ্ড। অন্যজন তার অর্ধেক। রানার হাতে চার ফলাওয়ালা শুরিকেন। শত্রুর হাতে মস্ত এক ছোরা। শুরু হলো রানা ও কালা পাহাড়ের লড়াই।

ছোরা হাতে ঝট করে সামনে বাড়ল দানব, কিন্তু শুরিকেনের ফলা দিয়ে ছোরার হামলা ঠেকিয়ে দিল রানা।

ঠং-ঠং! আওয়াজ উঠল।

এবার লাফ দিয়ে সামনে বেড়ে একপাশ থেকে ছোরা চালাল দানব।

ঠনাৎ আওয়াজ তুলে ছোরার ফলা সরিয়ে দিল রানা। কালা পাহাড় এবং ও লড়ছে কার্গো হোল্ডের শেষাংশে।

এদিকে জেনারেল এ্যাঞ্জারের ডান হাতও খুলে দিয়েছে তিশা। মুক্ত হয়েছেন ভদ্রলোক। হ্যাণ্ডকাফের অপর অংশ এখনও সাইড মিররের ভাণ্ডার সঙ্গে লাগানো। হামভি থেকে বিবশ জেনারেলকে নামতে সাহায্য করল তিশা, শুইয়ে দিল মেঝেতে।

বিড়বিড় করছেন গ্র্যাঞ্জার: হায় ঈশ্বর… ওই কোড… ইউনিভার্সাল কোড, হ্যাঁ, ঠিক, ওটা আছে, আছে, কিন্তু জানে মাত্র কয়েকজন… হ্যাঁ, আমি নোয়ায শিপগুলোর একটার কমপিউটারে… কিন্তু এ ছাড়াও… অন্য আরও একটা প্রজেক্ট… লিযার্ড…

কার্গো হোল্ডের পিছনে লড়ছে রানা ও কালো দানব। ছোরা ও শুরিকেনের টক্কর লাগছে ঠং-ঠনাৎ আওয়াজে। হামভির ডানদিকে সরে এল দুজন। সামান্য দূরে তিশা ও গ্র্যাঞ্জার। পিছাতে শুরু করেছে রানা, মনে হলো যুদ্ধে হারবে করুণভাবে।

তিশা! গলা চড়ল রানার, তুমি সিগনালের জন্য তৈরি?

হ্যাঁ। কিন্তু সিগনালটা কী?

এটাই সিগনাল!

পরমুহূর্তে কালা পাহাড় ছোরার স্ল্যাশ করতেই বিদ্যুদ্বেগে নড়ে উঠল রানা, দুই হাতে খপ করে ধরে ফেলল তার ডান বাহু। শত্রুর হাতটা টেনে বসিয়ে দিল হামভির বনেটের উপর। পাশেই সাইড মিররের ডাণ্ডা থেকে ঝুলছে হ্যাণ্ডকাফ। একটু আগে ওটাতে বন্দি ছিলেন জেনারেল এ্যাঞ্জার।

এবার, তিশা!

ঝট করে প্রতিক্রিয়া দেখাল তিশা, ঝাঁপিয়ে চলে এল বনেটের উপর, পরক্ষণে দানবের ছোরা ধরা কব্জি বন্দি হলো হ্যাণ্ডকাফের ভিতর। ধাতব ক্লিক আওয়াজ শুনে বিস্ফারিত হলো লোকটার দুই চোখ।

হামভির সাইড মিররের ডাণ্ডির সঙ্গে আটকা পড়েছে সে!

দেরি না করে জেনারেলের পাশে চলে গেল রানা।

আপনি সুস্থ, জেনারেল? জানতে চাইল।

ভড়ভড় করে বলে চলেছেন এ্যাঞ্জার: ওহ্, ঈশ্বর! শুধু  নোয়ায শিপগুলো না… লিয়ার্ড প্রজেক্টও… হায় যিশু… ওই দুই প্রজেক্টই… নোয়ায শিপ আর মিসাইল। গোপন করার জন্যে… প্রতি সপ্তাহে একবার করে বদলে… দেয়া হয় ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড। আর এখন… সেভেন্থ… সেভেন্থ ম্… ম… মার্সেন… মার্সেন…

কানের কাছেই হুউশ আওয়াজ পেল রানা। ঝলসে উঠেছে চকচকে ইস্পাত। ঝটকা খেল জেনারেলের মাথা। গলা থেকে। ফিনকি দিয়ে বেরোল রক্ত।

এক সেকেণ্ড পর কাঁধ থেকে খসে পড়ল ভদ্রলোকের মাথা! ফুটবলের মত মেঝের উপর দুই গড়ান দিয়ে থামল রানার পায়ের সামনে। ধড় থেকে কারও মাথা কেটে নিলেও কখনও কখনও তিরিশ সেকেণ্ড চেতনা থাকে। জেনারেল এ্যাঞ্জারের দুই চোখ পিট পিট করে দেখছে রানাকে। গলার কাটা জায়গা থেকে গলগল করে পড়ছে রক্ত। বীভৎস দৃশ্য। আরও তিন সেকেণ্ড বিড়বিড় করে কী যেন বলল বেচারা, তারপর আস্তে করে শিথিল হলো গালের পেশি।

ঝট করে মুখ তুলে চাইল রানা।

ডেভিড এন. হেভ্রুিকের সুদর্শন ডেপুটি দাঁড়িয়ে আছে হামভির পাশে। হাতে দীর্ঘ ম্যাচেটি, ওটা থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত।

রক্তিম দুই চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে লোকটার, যেন বদ্ধ উন্মাদ। ম্যাচেটি হাতে ঝড়ের বেগে সামনে বাড়ল।

কোপ ঠিকভাবেই নামত রানার ঘাড়ে, কিন্তু পিছন থেকে কে যেন খপ করে ধরল লোকটার কব্জি, আছড়ে ফেলা হলো হামভির বনেটের উপর। স্প্রিঙের মত লাফ দিল ম্যাচেটি, পাঞ্জা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ওই একই সময়ে ক্লিক আওয়াজে সুদর্শন লোকটার কব্জি আটকে গেল হামভির অন্য হ্যাণ্ডকাফে।

ঝটকা দিয়ে ঘুরে চাইল বাউন্টি হান্টারদের নেতা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা, চোখে নতুন সানগ্লাস।

আগেও তোমার ঢের কীর্তির কথা শুনেছি, গম্ভীর কণ্ঠে বলল বৈজ্ঞানিক। বিপদে পড়লে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাও। কিন্তু

এবার জানতে চাই, তুমি পাখির মত উড়তে পারো কি না!

হামভির ড্রাইভিং দরজার পাশে চলে গেল কুয়াশা, ভিতরে হাত ভরে রিভার্স গিয়ার ফেলল। ইশারা করল রানা ও তিশার দিকে। একটু সরে যাও তোমরা।

ভয়ঙ্কর আতঙ্ক নিয়ে কুয়াশার দিকে চেয়ে রইল কালা পাহাড় ও তার বস।

তোমাদের সঙ্গে নরকে দেখা হবে না, কারণ আমি ওখানে যাব না, চাপা স্বরে বলল কুয়াশা, পরক্ষণে অ্যাক্সেলারেটার প্যাডেলে চেপে আটকে দিল ম্যাচেটি।

পিছাতে লাগল হামভি, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল খোলা রিয়ার কার্গো র‍্যাম্পে। গতি তুলেছে বিশ কিলোমিটার। মুহূর্তে বিমান থেকে বেরিয়ে গেল হামভির পিছন দিক, পরের সেকেণ্ডে কালা পাহাড় এবং তার বস্ হারিয়ে গেল চোখের সামনে। থেকে। সোজা চলেছে বিশ হাজার ফুট নীচে।

হামভি উধাও হতেই রানার বুকে মুখ গুঁজেছে তিশা, নীরবে কাঁদছে। বিড়বিড় করে বলল, আমি না তোমার কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়েছি, আমি কেন কাঁদব?

সবাই কাঁদে, কখনও কখনও, মৃদু স্বরে বলল রানা। আলতো হাতে তিশার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিল।

কয়েক সেকেণ্ড পর কুয়াশার উপস্থিতি খেয়াল হতেই রানার কাছ থেকে সরে গেল তিশা। জিজ্ঞেস করল, আসলে কী ঘটছে, স্যর?

এরা বাউন্টি হান্টার, বলল রানা। পনেরোজনের একটা তালিকা পেয়েছে, তার ভেতর আমার নামও আছে। তোমাকে আটকেছিল আমাকে হাতে পাওয়ার জন্যে।

সাইবেরিয়া, বাউন্টি হান্টার, একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ, পোলিশ বাউন্টি হান্টার, স্পেন্যায কোবরা ইউনিট সংক্ষেপে সবই খুলে বলল রানা। কথা শেষে দেখাল বাউন্টি লিস্টি।

আর ওই লোক? চাপা স্বরে বলল তিশা। চোখের ইশারায়। দেখাল কুয়াশাকে। তার কী ভূমিকা?

কথাগুলো শুনতে পায়নি কুয়াশা, এইমাত্র ককপিটে গিয়ে। ঢুকেছে। ট্যাঙ্কার বিমান থেকে সরিয়ে নেবে কার্গো বিমানকে।

ওঁর নাম কুয়াশা, মস্ত বড় এক বাঙালি বিজ্ঞানী, বলল রানা। জানি না কেন, আমাকে পছন্দ করেন, তাই ঠিক করেছেন আপাতত পাশে থেকে সাহায্য করবেন আমার বিপদে।

তোমাকে সাহায্য করবেন? অবাক হলো তিশা।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা।

হেড কোয়ার্টারে যোগাযোগ করে জানাতে হবে আমি বেঁচে আছি, ভিন্ন প্রসঙ্গে গেল তিশা।

ককপিটে গিয়ে রেডিয়োতে জানিয়ে দিতে পারবে, বলল রানা। বলে দিয়ে তোমার ফিরতে দেরি হবে। আরও কী যেন বলবে, এমন সময় কাঠের ক্রেটগুলোর কাছ থেকে শুনল গোঙানির আওয়াজ।

ঝট করে ওদিকে ঘুরে গেল রানা ও তিশা।

ক্রেটগুলোর পায়ের কাছে পড়ে আছে সুট পরিহিত ব্রিটিশ এজেন্ট। দুহাতে ধরেছে ভাঙা পাঁজরগুলো। এর বুকেই ম্যাগহুক ব্যবহার করেছিল রানা।

ধরাশায়ী লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ওরা।

জোর করে দম নিতে চেষ্টা করছে লোকটা, মুখের কোণে রক্ত ও ফেনা।

ঝুঁকে তাকে পরীক্ষা করল রানা। আস্তে করে মাথা নাড়ল। পাঁজরের হাড়গুলো ফুটো করে দিয়েছে ফুসফুস। তিশার দিকে চাইল। একে চেনো?

না চেনার মতই, বলল তিশা। জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম এ লোক আর তার সঙ্গী জেনারেল এ্যাঞ্জারকে জিজ্ঞেসাবাদ করছে। কড়া কোনও ডিসিনহিবিটিং ড্রাগ দিয়েছিল। জানতে চাইছিল আমেরিকার ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড। জোর দিয়ে বলছিল জেনারেল কোড জানেন। নোয়ায শিপ প্রজেক্ট না কী নিয়ে যেন… কাঁধ ঝাঁকাল তিশা।

তাই? আস্তে করে বলল রানা। ডিসিনহিবিটিং ড্রাগ? ওর চোখ পড়েছে মেঝের একটু দূরে পড়ে থাকা মেডিকেল কিটের উপর। ওখান থেকে খসে পড়েছে কয়েকটা সিরিঞ্জ, নিডল ও সেরামের বোতল। সেরামের একটা বোতল তুলে নিয়ে লেবেলটা। পড়ল রানা। মারাত্মক আহত লোকটার দিকে আবারও চাইল। ঠিক আছে, দেখা যাক নিজেদের আনা জিনিস ওর কেমন লাগে।

ক্রেটের পাশে লোকটাকে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিল রানা।

তখনই ককপিট থেকে ফিরল কুয়াশা।

গুঙিয়ে চলেছে সুট পরা ব্রিটিশ এজেন্ট।

তার আস্তিন গুটিয়ে দিয়ে শিরার ভিতর দুই শ মিলিগ্রাম ইএ ৬২৭ ইনজেক্ট করল রানা।

পাশে এসে থামল কুয়াশা। ট্যাঙ্কার থেকে সরে গেছি। আপাতত অটো-পাইলটে চলছে বিমান। আগের কোর্স অনুসরণ করছি। ফ্রান্সের উপকূলে ব্রিটানির প্রাইভেট এক এয়ারফিল্ডে নামব। এইমাত্র যোগাযোগ করেছিল রঘুপতি। লণ্ডনের চল্লিশ মাইল দূরে পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডে তোমার দুজনকে নামিয়ে দেবে ও।

গুড। রানা ভাবছে এরপর কী করবে নিশাত ও খবির। ওদেরকে যেতে হবে লণ্ডনে, মোসাদের হেডকোয়ার্টারে।

বন্দি ব্রিটিশ এজেন্টের দিকে মনোযোগ দিল রানা।

বারকয়েক আপত্তি তুলতে চাইল লোকটা, কিন্তু মুখের লাগাম খুলে দিয়েছে ডিসিনহিবিটিং ড্রাগ।

তার নাম জেমস ব্রিক, এমআই-৬-এর সদস্য।

এই যে বাউন্টি হান্ট, এটা সম্পর্কে তুমি কী জানো? জিজ্ঞেস করল রানা।

প্রতিটি মাথার জন্য দেবে তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার। সতেরোটা মাথা। আগামীকাল নিউ ইয়র্ক সময় দুপুর বারোটার আগে

সবাইকে শেষ করতে হবে।

কারা এত টাকা দিচ্ছে?

নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ করল এজেণ্ট। আপত্তি আছে বলতে, কিন্তু ড্রাগের কারণে কয়েক সেকেণ্ড পর বাধ্য হয়ে মুখ খুলল, তাদের অনেক নাম। হাইডেলবার্গ গ্রুপ… নিউ ইয়র্ক গ্রুপ… স্টার কাউন্সিল… ম্যাজেস্টিক-১২… এম-১২… এরা। দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। এরাই চালায় বিশ্ব। এদের কথায় কান ধরে ওঠবস করে সরকার। দরকার পড়লে যে-কোনও দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভাঙে। যা চায়, তাই করতে পারে এরা। যদি…

থেমে গেছে লোকটা।

রানা টের পেল, শিরিশ কাগজের মত শুকিয়ে গেছে ওর গলা।

খুলে বলো, নিচু স্বরে বলল কুয়াশা।

তাদের নামগুলো বলো, তাড়া দিল রানা।

তাদের নাম জানি না, বলল ব্রিক। খোঁজ নেয়া আমার কাজ নয়। আমি বিশেষজ্ঞ আমেরিকান মিলিটারি বিষয়ে। শুধু জানি ম্যাজেস্টিক-১২ আছে। তারাই আয়োজন করেছে বাউন্টি হান্ট।

বুঝলাম। এবার বলো এই বাউন্টি হান্ট সফল হলে তাদের কী লাভ।

জানি না, মাথা নাড়ল ব্রিক। আমার কাজ ছিল জেনারেল গ্র্যাঞ্জারের মুখ থেকে ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড জেনে নেয়া। ওই কোড তুলে দেয়ার কথা ছিল বাউন্টি হান্টার হেন্ড্রিকের হাতে। ওটা দিয়ে ম্যাজেস্টিক-১২ কী করবে, আমি জানি না।

তার মানে এমআই-৬ সবই জানে?

রিচার্ড কে, ডওসন। তার কাছ থেকে ভিতরের খবর জানতে পারবেন। ম্যাজেস্টিক-১২ সম্পর্কে বা বাউন্টি হান্ট সম্পর্কে সবই তার জানা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এমআই-৬ জানে না সে এখন। কোথায়। দুদিন আগে হারিয়ে গেছে। নোয়ায শিপ বা লিয়ার্ড প্রজেক্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে খুঁজে বের করুন তাকে।

রিচার্ড কে. ডওসন, বিড়বিড় করল রানা। নামের লিস্ট বের করে পড়ল: ডসন, রিচার্ড কে, ইউকে, এমআই-৬।

নিশ্চয়ই নিজের কাভার হারিয়েছে লোকটা, বলল রানা। নইলে তার নাম এই লিস্টে তুলত না ম্যাজেস্টিক-১২।

নতুন আঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইল রানা। নোয়ায শিপ বা লিয়ার্ড প্রজেক্ট সম্পর্কে জেনারেল এ্যাঞ্জারের কাছ থেকে কী জানতে চাইছিলে?

ভুরু কোঁচকাল ব্রিক। ড্রাগের বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু মুখ খুলল: নোয়াজ শিপ ইউএস নেভির প্রজেক্ট। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নেভি বেশকিছু রণতরীকে ছদ্মবেশে ভিড়িয়ে দিয়েছিল কমার্শিয়াল ফ্রেইটারগুলোর বহরে। তাদের একটা জাহাজের নাম ছিল নোয়ায শিপ। এখন ওই একই কাজ করছে ইউএস নেভি। ছদ্মবেশী রণতরী রাখছে। দুনিয়ার জরুরি সব জায়গায়। দরকার পড়লে যখন তখন হামলা করবে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল ব্যবহার করে। অথচ, জাহাজ দেখলে যে-কেউ ভাববে, ওগুলো সাধারণ মালবাহী জাহাজ বা সুপারট্যাঙ্কার।

সত্যি কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেবে আমেরিকা? আনমনে বলল তিশা।

ঠিক আছে, নোয়ায শিপ বিষয়ে জানলাম, বলল রানা। এবার বলো লিয়ার্ড প্রজেক্ট কী।

জানি না।

সত্যি কথা বলো, নইলে ড্রাগের ডোজ বাড়াতে বাধ্য হব।

গুঙিয়ে উঠল জেমস ব্রিক। শুধু জানি, নোয়ায শিপ প্রজেক্টের সঙ্গে জড়িত লিয়ার্ড প্রজেক্ট। ভয়ঙ্কর কোনও পরিকল্পনা আছে এসবের পিছনে। জানি না তা কী। ওটার জন্যে হাইয়েস্ট ইউএস সিকিউরিটি ক্লাসিফিকেশন দেয়া হয়েছে।

ভুরু কুঁচকে উঠেছে রানার, ভাবছে।

জট ছাড়াতে পারছে না কিছুরই। ওর কাছে রয়েছে সামান্য কয়েকটা জিগসর টুকরো। সবই প্রকাণ্ড কোনও জিগস পাযলের অংশ। এক এক করে টুকরোগুলো ঠিক জায়গায় বসাতে পারলে ফুটে উঠবে পুরো দৃশ্য। তখন বোঝা যাবে সবই।

কে এসব জানে, মিস্টার ব্রিক? বলল রানা, কার কাছ থেকে ইউএস মিলিটারির তথ্যগুলো পাচ্ছে এমআই-সিক্স?

মোসাদের কাছ থেকে, ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্রিক। লণ্ডনের ক্যানারি ওয়ার্ফে ফিল্ড অফিস খুলেছে ওরা। গত মাসে কয়েকদিনের জন্যে ওদের অফিসে ছারপোকা রাখতে পেরেছিলাম আমরা। বিশ্বাস করুন, এম-১২. নোয়ায শিপ, লিয়ার্ড প্রজেক্ট বা আপনার ওই লিস্টির সবই জানে মোসাদ। কেন আপনাদেরকে শেষ করে দেয়া হচ্ছে, তাও জানে। শুধু তাই নয়, আরও একটা বিষয় ওরা জানে।

সেটা কী? জানতে চাইল রানা।

মোসাদ জানে অক্টোবরের পনেরো তারিখে কী ঘটাবে ম্যাজিস্টিক-১২।

সতেরো

কুইন্স টাওয়ার।

ক্যানারি ওয়ার্ফ, লণ্ডন। অক্টোবর, ১৪। স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে তিনটা।

চল্লিশতলা কুইন্স টাওয়ারের গা বেয়ে অত্যন্ত দ্রুতগামী একটি কাঁচমোড়া এলিভেটারে চেপে সাঁই-সাঁই করে উঠছে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা ও সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত খবির।

একটু দূরে কাদাটে, মন্থরগতি টেমস, মস্ত কোনও অজগরের মত গা মুচড়ে হারিয়ে গেছে দূরের বাঁকে। চার দিগন্তে পুরনো লণ্ডন, অবশ্য এ মুহূর্তে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝমঝম বৃষ্টির ধূসর পর্দা লুকিয়ে রেখেছে সব।

প্রাচীন শহর লণ্ডনকে কাঁচকলা দেখাতেই যেন জন্ম নিয়েছে। ক্যানারি ওয়ার্ক পরিষ্কার, ঝকমকে স্টিল ও কাঁচের তৈরি মস্ত সব দালান। বিযনেস ডিসট্রিক্ট। আকাশের বুকে খোঁচা দিচ্ছে। অসংখ্য স্কাইস্ক্র্যাপার। মাঝে মাঝে ম্যানিকিউর করা পার্ক। একটু দূরে ব্রিটেনের সবচেয়ে উঁচু দালান: অপূর্ব সুন্দর ক্যানারি ওয়ার্ক টাওয়ার। লণ্ডনের এদিকটা যেন আগামী কোনও শতকের জন্য

প্রস্তুত। এ ধূসর আকাশ পাশ কাটিয়ে উঠছে নিশাত ও খবিরের লিফট। কুইন্স টাওয়ারে যাত্রীদেরকে নিয়ে ওঠা-নামা করছে আরও চারটে লিফট–একেকটা দ্রুতগামী কাঁচের বাক্স যেন।

নিশাত-খবিরের পরনে সাধারণ পোশাক: সুয়েড জ্যাকেট, নীল ডেনিম জিন্স, টার্টলনেক জাম্পার। শেষের জিনিসটার কল্যাণে ঢাকা পড়েছে থ্রোট মাইক। পায়ে শক্তপোক্ত বুট। কোমরের পিছনে .৪৫ ক্যালিবারের কোল্ট রিভলভার।

ওদের লিফটে উঠেছে চমৎকার কাটের সুট পরা সুন্দরী এক এগযেকিউটিভ তরুণী। চওড়া কাঁধের দানবীয় নিশাতের পাশে যেন বামন হয়ে গেছে সে।

বড় করে শ্বাস নিল নিশাত, আস্তে টোকা দিল মেয়েটির কাঁধে। তোমার পারফিউম সত্যিই ভাল। জিনিসটার নাম কী?

লেডিস চয়েস, বলল তরুণী।

আমিও একটা কিনব, আন্তরিক হাসল নিশাত।

আজ রাশান যুদ্ধ-বিমানে অ্যাকটিভ স্টেলথ চালু রেখে ব্রিটিশ এয়ারস্পেসে ঢুকে পড়েছিল রঘুপতি, ওদেরকে নামিয়ে দিয়েছে লণ্ডনের বাইরের এক পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডে। ওখানে প্রায় ধসে পড়া এক দালানে উঠেছিল ওরা। দেরি না করে দাঁড় করিয়েছে। খসড়া পরিকল্পনা। এরপর যোগাযোগ করেছে রানা এজেন্সির শাখা প্রধান রাজিব আহসানের সঙ্গে। সে ব্যবস্থা করে দিয়েছে। চার্টার হেলিকপ্টারের। আর আজই সোয়া তিনটের সময় বাঙালি পাইলট ওদেরকে নামিয়ে দিয়েছে ক্যানারি ওয়ার্ফের কমার্শিয়াল হেলিপোর্টে।

পিং! আওয়াজ তুলল এলিভেটারের স্পিকার। আটত্রিশতলার মেঝের সঙ্গে মিশে গেছে ওটার মেঝে। খুলে গেল দরজা।

প্রকাণ্ড রিসেপশন এরিয়ায় বেরিয়ে এল নিশাত ও খবির। ইলেকট্রনিকাল বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে:

সিলভারম্যান, নিউটন অ্যাণ্ড যেমির লইয়ার্স ফার্ম।

মস্ত দালানের উপরের তিনতলা জুড়ে প্রতিষ্ঠানটি। আটত্রিশ, ঊনচল্লিশ ও চল্লিশ তলা ভাড়া নিয়েছে তারা।

অন্য সব বড় শহরের নামকরা ল ফার্মের অফিসের রিসেপশন এরিয়ার মতই এ অফিস। অত্যন্ত দামি প্রতিটি আসবাবপত্র। প্রচুর জায়গা ছাড়া হয়েছে মস্ত অফিসে। কাঁচের ওদিকে অনেক নীচে লণ্ডন।

সাধারণ মানুষ এ অফিসে ঢু দিলে বুঝবে না সিলভারম্যান, নিউটন অ্যাণ্ড যেমির লইয়ার্স ফার্ম আসলে একেবারেই ভিন্ন কাজে ব্যস্ত।

তাদের মূল কাজটি আইনী সহায়তা দেয়া নয়।

এ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে অসংখ্য অফিস বা মিটিং রুম, কিন্তু উনচল্লিশ তলার তিনটে অফিসে ভুলেও প্রবেশ করেন না উকিল সায়েবরা।

ওই তিনটে কামরা ইজরায়েলি সিক্রেট সার্ভিসের।

আন্তর্জাতিক সিক্রেট সার্ভিসগুলোর এজেন্টদের ভিতর চালু হয়ে গেছে একটা কথা: বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স সংগঠন হচ্ছে মোসাদ।

তারাই নানান হামলা থেকে রক্ষা করছে ইজরায়েল রাষ্ট্রকে।

সেজন্য প্রতিটি দেশে নিজেদের লোক রেখেছে। সবার আগে। তাদের কানে পৌঁছে যায় আন্তর্জাতিক সমস্ত তথ্য।

একটা চিন্তা থেকেই কাজ করে ওই সংগঠনের সবাই। প্রথম কথা: রক্ষা করতে হবে ইজরায়েলী স্বার্থ। দ্বিতীয় কথা: রক্ষা করতে হবে ইজরায়েলী স্বার্থ। শেষ কথা: রক্ষা করতে হবে ইজরায়েলী স্বার্থ। এর বাইরে কিছু ভাববার দরকার নেই। প্রয়োজন পড়লে শেষ করে দাও যে-কাউকে।

আমি কোনও সাহায্যে আসতে পারি? নিশাতের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসল রিসেপশনিস্ট।

পারেন, বলল নিশাত, আমরা এসেছি ডেনিস ই, ম্যাকিনের সঙ্গে আলাপ করতে।

দুঃখিত, কিন্তু ওই নামের কেউ তো এই অফিসে কাজ করেন না।

তা হলে চেয়ারম্যান বা তার পার্টনারদের জানান, ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা এবং সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত খবির এসেছে, দ্বিধা না করেই বলল খবির। আরও বলবেন, আমরা এসেছি

মেজর ম্যাকিনের সঙ্গে দেখা করতে। মেজর মাসুদ রানার তরফ, থেকে আমাদেরকে পাঠানো হয়েছে। আরও ভাল হয় বললে, বিসিআই-এর মাসুদ রানা দুজনকে পাঠিয়েছেন।

সত্যিই দুঃখিত, স্যর, কিন্তু…।

কথার মাঝে থেমে গেল মেয়েটি, এইমাত্র বেজে উঠেছে রিসেপশনিস্টের ফোন। রিসিভার তুলে নিল সে, কয়েক মুহূর্ত শুনে খবিরের দিকে চাইল। আপনাদেরকে নিয়ে যেতে লোক পাঠাচ্ছেন চেয়ারম্যান। একটু অপেক্ষা করুন।

একমিনিট পর দূরের একটা দরজা খুলে গেল, বেরিয়ে এল চমত্ত্বার সুট পরা এক ভদ্রলোক। নিশাত ও খবির লক্ষ্য করল, তার সুটের নীচে ফুলে আছে উযি সাবমেশিনগান।

পিং! আওয়াজ শুনল ওরা। এইমাত্র থেমেছে একটা এলিভেটার। তারপর আরেকটা। ভুরু কুঁচকে ফেলল খবির, ঘুরে চাইল। ওই একইসময়ে খুলতে লাগল এলিভেটারের দুই দরজা।

পরক্ষণে হুড়মুড় করে এলিভেটার থেকে বেরিয়ে এল কমপক্ষে দশজন লোক। প্রত্যেকে সশস্ত্র। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে কন্টিনেন্টাল সোলজার ৬৬ ইউনিটের নেতা ডেভিড এন. হেন্ড্রিক।

যাহ শালা! বিড়বিড় করল খবির।

কালো পোশাকে একেকজনকে ওর মনে হলো সাক্ষাত যম। হাতে মেটালস্টর্ম রাইফেল। পরক্ষণে মাযলগুলোর মুখে ঝলসে উঠল কমলা আগুন।

তার এক সেকেণ্ড আগে রিসেপশন ডেস্কের ওদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিশাত ও খবির। চারপাশ ঝাঁঝরা হলো হাইপার মেশিনগানের গুলিতে। জোরালো ঝিরঝির আওয়াজ তুলছে। অস্ত্রগুলো।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসা চৌকশ পোশাকের লোকটা কিমা হয়ে গেল শতখানেক গুলি খেয়ে। ছিটকে গেল মেঝের একদিকে। কপালে একটিমাত্র গুলি নিয়ে শুয়ে পড়ল সুন্দরী ইজরায়েলি রিসেপশনিস্ট। এ ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ছে ডেভিড এন. হেণ্ডিকের দলের সবাই। অবশ্য রয়ে গেছে তাদের একজন। এইমাত্র রিসেপশন ডেস্কের ওদিকে লাফিয়ে পড়া সিভিলিয়ান দুজনকে শেষ করবে সে।

সময় নষ্ট না করে কাউন্টার ঘুরে ওদিকে গেল লোকটা। আর তখনই গর্জে উঠল দুটো অস্ত্র।

নাকে বাড়তি দুটো ফুটো নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল বাউন্টি হান্টার। ধোঁয়া বেরুনো রিভলভার হাতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল নিশাত ও খবির।

ওরা ম্যাকিনের জন্যে এসেছে, চাপা স্বরে বলল নিশাত। এসো, খবির!

ওরা যেন অনুসরণ করছে ভয়ঙ্কর কোনও টর্নেডোর গতিপথ। মেইন অফিস এরিয়ায় পৌঁছে গেল।

ডেস্কগুলোর উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সুট পরিহিত পুরুষ ও মহিলা আইনজীবীরা। সারাদেহে রক্তাক্ত সব গর্ত। ছিন্নভিন্ন। হয়ে গেছে ওঅর্ক স্টেশনগুলো। ১৪-২০৯

ঝড়ের গতিতে ওপেন-প্ল্যান অফিস পেরিয়ে গেল হেন্ড্রিকের দল। ঝরঝর করে ভেঙে পড়ছে সামনের সমস্ত কাঁচ। বিস্ফোরিত হচ্ছে কমপিউটার মনিটর। বিশ্রী আওয়াজ তুলছে মেটালস্টর্ম মেশিনগান।

দূরে জ্যাকেটের তলা থেকে উযি বের করল এক সিকিউরিটি গার্ড–কিন্তু ওই পর্যন্তই, হাইপারভেলোসিটি মেটালস্টর্ম বুলেট ঝাঁঝরা করে দিল তাকেও।

বাঁক নেয়া অপূর্ব সুন্দর এক ইন্টারনাল স্টেয়ারকেস বেয়ে ঊনচল্লিশ তলা লক্ষ্য করে ঝড়ের বেগে উঠছে বাউন্টি হান্টাররা।

তাদের পিছনে ছুটতে শুরু করল নিশাত ও খবির।

কয়েক মুহূর্ত পর উঠে এল স্টেয়ারকেসের উপর অংশে। ওখান থেকে দেখল, দলের অন্যদের কাছ থেকে সরে গেল তিন বাউন্টি হান্টার, ঢুকে পড়ল ইন্টারোগেশন রুমে। তাদের গুলি শেষ করে দিল দুই সিনিয়র মোসাদ এজেন্টকে। তৃতীয়জনকে খুন করল না, তাকে হেঁচড়ে নিয়ে বেরিয়ে এল। দূর থেকে যুবককে ডেনিস ই, ম্যাকিন বলেই ধারণা করল নিশাত ও খবির। সুদর্শন, বয়স হবে পঁচিশ। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

দেরি না করে সামনে বাড়ল নিশাত ও খবির। শেষ কয়েকটি ধাপ পেরিয়েই গুলি করল তিন বাউন্টি হান্টারকে লক্ষ্য করে। কাঁচির দুই ফলার মত নিখুঁতভাবে কাজ করছে ওরা। খবিরের গুলিতে শুয়ে পড়ল বামদিকের লোকটা। ডানদিকের লোকটা মরল নিশাতের বুলেটে। পরক্ষণে ওদের দুজনের গুলিতে আত্মা খাঁচাছাড়া হলো তৃতীয় লোকটার।

ধপ করে মেঝের উপর পড়ল ম্যাকিন।

এক দৌড়ে তার দুপাশে পৌঁছে গেল নিশাত ও খবির, টেনে তুলে বসিয়ে দিল ইজরায়েলি এজেন্টকে।

আপনি ম্যাকিন? জানতে চাইল নিশাত, ডেনিস ই. ম্যাকিন?

হ্যাঁ, কিন্তু…

আমরা আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। বিসিআই-এর মেজর মাসুদ রানা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন।

এক সেকেণ্ড পর পরিচিতির ছাপ পড়ল যুবকের চোখে। বিসিআই-এর মাসুদ রানা… ওই লিস্টের…

বুম!

এক বাউন্টি হান্টার একটু দূরের অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই গুলি করেছে খবির।

আপা! কথা বলার সময় নেই এখন!

ঠিক! ছুটবার ফাঁকে কথা চলুক! টান দিয়ে ম্যাকিনকে দাঁড় করিয়ে দিল নিশাত। সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠবেন! জলদি!

ওরা তিনজন দৌড়ে পৌঁছে গেল স্টেয়ারকেসে, ঝড়ের গতিতে উঠতে লাগল উপরতলা লক্ষ্য করে। পাশে পড়ল দেয়ালে বসানো চমৎকার এক সেট পিকচার উইণ্ডো। অনেক নীচে লণ্ডন। কিন্তু অন্য দৃশ্য দেখেছে নিশাত ও খবির। আকাশ চিরে হাজির হয়েছে অশুভ চেহারার একটা অ্যাসল্ট হেলিকপ্টার। দালানের বাইরে পজিশন নিচ্ছে। ওই কপ্টারের পাইলট এবং অন্য এক লোক চেয়ে আছে নিশাত, খবির ও ম্যাকিনের দিকে।

ব্রিটিশ মিলিটারির হিউ গানশিপের মতই একই জিনিস ওই হেলিকপ্টার লিঙ্কস। পাশে টো মিসাইল ও ছয় ব্যারেলের মিনিগান।

দৌড়ে ওঠো! ম্যাকিন-খবিরকে তাড়া দিল নিশাত। ওঠো! ওঠো! ওঠো! জলদি!

গুলি শুরু করেছে লিঙ্কস।

ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল পিকচার উইণ্ডোর কাঁচ। বেঁকে নেমে যাওয়া স্টেয়ারকেস ধসে গেল কপ্টারের গুলির আঘাতে। নড়বড় করছে সিঁড়ির ধাপগুলো। চারপাশে এক পশলা বৃষ্টির মত বয়ে গেল ভাঙা কাঁচের ঝড়। নিশাত ও খবির দুপাশ থেকে খপ করে ধরল ম্যাকিনকে, তাকে মাঝে রেখে তুমুল গতিতে উঠতে লাগল। গুলির তোড়ে খসে পড়ল নীচের কয়েকটা ধাপ। চল্লিশতলায় পৌঁছে গেল ওরা, ডাইভ দিয়ে পড়ল মেঝেতে। এক সেকেণ্ড দেরি করলে ওদেরকে নিয়ে নীচে রওনা হতো ভাঙা সিঁড়ি।

.

ঊনচল্লিশ তলা অফিসের ক্ষয়-ক্ষতির ভিতর হাঁটছে ডেভিড এন. হেন্ড্রিক, হেডসেট রেডিয়োতে মন দিয়ে শুনছে দলের সবার রিপোর্ট।

দিস ইয এয়ারবোর্ন ওয়ান। ওরা চল্লিশতলায়। পরনে সাধারণ পোশাক। কোনও ভুল না হলে ম্যাকিন ওদের সঙ্গে।

এয়ারবোর্ন টু। ছাতে ল্যাণ্ড করছি, নামিয়ে দেব দ্বিতীয় ইউনিটকে।

দিস ইয় এয়ারবোর্ন থ্রি। আমরা উত্তর-পুবে। পৌঁছব চল্লিশ…

টেকনিকাল টিম। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সব এলিভেটার। আটত্রিশ তলায় আটকা পড়েছে, চারটে এলিভেটার। এখন আর কেউ ওগুলোতে করে…

বয়েজ, বলল হেন্ড্রিক। ওই দুই পিঁপড়েকে শেষ করো। ধরে আনো ম্যাকিনকে।

দূরে জোরালো গুঞ্জন তুলছে বাউন্টি হান্টারদের তিন লিঙ্কস। কপ্টার। কয়েক মুহূর্ত পর ওগুলো পৌঁছে গেল কুইন্স টাওয়ারের উপর। যেন বিরক্তি ধরিয়ে দেয়া নীল মাছি, নামবে কারও আম দই-কলা মাখা খাবারের পাতে।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর ছাতে নামল একটা কপ্টার। অন্যদুটো চক্কর কাটতে থাকল সবচেয়ে উপরের তিনতলা অফিস ঘিরে। উঁকি দিচ্ছে প্রতিটি অফিসের জানালায়।

একের পর এক জানালা বিস্ফোরিত হবার আওয়াজ পেয়েছে অনেকেই। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ যোগাযোগ করেছে পুলিশের সঙ্গে।

.

চল্লিশতম ফ্লোরের হলওয়ে ধরে ছুটে চলেছে নিশাত ও খুবির, নিজেদের মাঝে প্রায় বয়ে নিয়ে চলেছে ম্যাকিনকে।

আমাদেরকে জানান, ছুটতে ছুটতে বলল নিশাত, ওই তালিকা… আপনি বা মাসুদ রানা ওই তালিকার ভেতর কেন?

ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে এজেন্ট। ম্যাজেস্টিক… ম্যাজেস্টিক-১২। ওখানে তুলে দিয়েছে আমাদের নাম। আমি লিস্টে আছি কারণ, জেনে ফেলেছি কারা ম্যাজেস্টিক-১২-র সদস্য। ওরা ওদের পরিকল্পনা গুছিয়ে নেয়ার আগেই হয়তো ওদেরকে ধরিয়ে দিতে পারি।

আর মাসুদ রানা? জানতে চাইল নিশাত।

তাকে শেষ করতে চায় অন্য কারণে। অত্যন্ত গিফটেড লোক রানা। তালিকার পনেরোজনের একজন। ইচ্ছা করলেই পাশ করবে সি স্নেক টেস্ট। পৃথিবীতে মাত্র নয়জন ডিসআর্ম করতে পারবে টাচলক-৯। ওটা ব্যবহার করা হয় লিযার্ড মিসাইল সিকিউরিটি সিস্টেমে…

কথা শেষ করতে পারল না ম্যাকিন, ওদের ডানদিকে দড়াম করে খুলে গেল ফায়ার ডোের, ছিটকে বেরিয়ে এল চারজন ৬৬ ইউনিটের লোক–হাতে মেটালস্টর্ম রাইফেল, জ্বলজ্বল করছে। সবুজ লেসার সাইট।

কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাবার সময় পেল না খবির ও ম্যাকিন, কিন্তু সতর্ক ছিল নিশাত- দুজনকে ঠেলে পার করিয়ে দিল একটা বাঁক। নিজেও থামল না, ঝেড়ে দৌড় দিল দীর্ঘ আরেক হলওয়ে ধরে। পিছনে ধেয়ে এল হাইপারমেশিনগানের শত শত গুলি।

উত্তরদিকের করিডোর ধরে ছুটছে খবির ও ম্যাকিন। পিছন থেকে গুলি খেয়ে যখন তখন পাখির মত মরবে। বামদিকে ছোট একটা অফিস দেখে ম্যাকিনকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল খবির।

এই অফিস কানা গলির মত।

দুশশালা! কপালকে দোষ দিল খবির। এক দৌড়ে পৌঁছে গেল জানালার সামনে। ওর মনে হলো, নাকের সামনে দিয়ে গেল একটা লিঙ্কস হেলিকপ্টার।

তখনই দরজার বুকে বসানো কাঁচের ওপাশের দৃশ্য দেখল খবির। আবারও চাইল জানালার দিকে।

যে চার বাউন্টি হান্টার বেরিয়ে এসেছিল ফায়ার স্টেয়ারওয়েল থেকে, তারা এখন দুই ভাগে ভাগ হয়েছে–একদল আসছে ওদেরকে শেষ করতে। অন্য দুজন গেছে নিশাতের ব্যবস্থা। নিতে।

খবির ও ম্যাকিনকে করিডোর পেরিয়ে বিশ গজ দূরের অফিসে ঢুকতে দেখেছে প্রথম দলের দুই কমাণ্ডো। সাবধানে, নিঃশব্দে চলল তারা। ৫০০৪ সংখ্যা লেখা দরজার দুপাশে থামল।

টেকনিকাল টিম, ডলার ফাইভ বলছি, হেডসেটে ফিসফিস করল বয়স্ক কমাণ্ডো। ফ্লোর স্কেম্যাটিক চাই। অফিস নাম্বার ৫০০৪।

সঙ্গে সঙ্গে এল জবাব: কানাগলি ওটা, ডলার ফাইভ। ওদের আর কোথাও যাওয়ার নেই।

উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রুপারকে ইশারা করল বয়স্ক কমাণ্ডো।

জবাবে ভিড়িয়ে রাখা দরজায় বেদম এক লাথি বসাল তরুণ কমাণ্ডে। গর্জে উঠল হাতের মেটালস্টর্ম রাইফেল।

কিন্তু ঝাঁঝরা হলো না কেউ।

অফিস পুরো ফাঁকা।

মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত জানালার দামি কাঁচ আগেই ভেঙে পড়েছে। ঝিরঝির করে মেঝেতে নামছে লণ্ডনের বৃষ্টির ফোঁটা।

কোথাও নেই খবির। উধাও হয়েছে ম্যাকিন।

৬৬ ইউনিটের দুই কমাণ্ডো লাফিয়ে গিয়ে ঢুকল অফিসে, দ্রুত পায়ে পৌঁছে গেল কাঁচ ভাঙা জানালার সামনে। নীচে চাইল।

দেখবার কিছুই নেই। নীচে নেমে গেছে টাওয়ারের কাঁচের দেয়াল। সামান্য দূরে পার্ক, চকচক করছে বৃষ্টিস্নাত সবুজ ঘাসগুলো।

এবার উপরে চোখ গেল দুই বাউন্টি হান্টারের। শুনতেও পেল সর-সর আওয়াজ। উইণ্ডো ওয়াশার্স প্ল্যাটফর্মের নীচের অংশ এইমাত্র পেরিয়ে গেল এই তলা। কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছুবে ছাতে।

উইণ্ডো ওয়াশার্স প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে খবির ও ম্যাকিন, কুইন্স টাওয়ারের গা বেয়ে উঠছে।

শক্তপোক্ত দুই উইঞ্চ-ক্রেনের সাহায্যে ঝুলছে আয়াতাকার প্ল্যাটফর্ম। ছাত থেকে কয়েক ফুট বেরিয়ে এসেছে ক্রেনের দুই বাহু।

দুই আততায়ী বাউন্টি হান্টার অফিসে হামলা করবার কয়েক সেকেণ্ড আগে নিজেই খবির গুলি করে উড়িয়ে দিয়েছে জানালার কাঁচ। ম্যাকিনকে নিয়ে উঠে পড়েছে ক্যাটওয়াকে।

প্রথমে কাঁধে ইজরায়েলি এজেন্টকে উঠতে দিয়েছে খবির, তারপর যুবক উপরের প্ল্যাটফর্মে উঠতেই নিজেও উঠে এসেছে। ঝট করে সরিয়ে নিয়েছে দুই পা। তখনই অফিসে ঝড়ের গতিতে ঢুকেছে লোকদুটো।

.

নিশাতের পিছু নিয়ে আসছে হাইপারচার্জড বুলেট। যান্ত্রিক একটা পা নিয়ে হরিণীর মত ছুটছে বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন, চলেছে পশ্চিমদিকের হলওয়ে ধরে। পিছু নিয়েছে ৬৬ ইউনিটের দুই কমাণ্ডো।

কানের পাশ দিয়ে বুলেট বেরিয়ে যেতেই তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে বামের অফিসে ঢুকল নিশাত।

ও আছে সুসজ্জিত এক বোর্ডরুমের ভিতর।

চকচকে কাঠের মেঝে। চেয়ারগুলো চামড়া দিয়ে মোড়া। আগে কখনও এত বড় বোর্ডরুম টেবিল দেখেনি নিশাত। দৈর্ঘ্যে ওটা হবে কমপক্ষে তিরিশ ফুট।

শালার ব্যাটারা, বিড়বিড় করল নিশাত। কাজ একটাই, মক্কেলের পকেট ফাঁকা করা!

দালানের কোনায় এই অফিস। পুরো এক দেয়াল জুড়ে মেঝে থেকে শুরু করে সিলিং পর্যন্ত একটিমাত্র মস্ত জানালা। বাইরের দারুণ দৃশ্য দেখলে আটকে আসতে চায় শ্বাস। চোখে পড়ে পুরনো লণ্ডন। অন্যদিকে দালানের বাইরের এলিভেটার।

নিশাত একটু আগে বুঝেছে, ওর এই কোল্ট রিভলভার দিয়ে মেটালস্টর্ম রাইফেলের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। কাজেই দরজার আড়ালে সরে এল ও।

কয়েক সেকেণ্ড পর দুড়ম আওয়াজ তুলে খুলে গেল দরজা। টর্নেডোর মত হাজির হলো লোকদুটো।

প্রথম লোকটা ওকে লক্ষ্য করবার আগেই তার মাথার পাশে গুলি করল নিশাত। অন্য লোকটা ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল। দেরি না। করে ট্রিগার টিপে দিল নিশাত। কিন্তু ক্লিক শব্দটা কানের কাছে হাতুড়ির বাড়ির মত আওয়াজ তুলল।

মর জ্বালা!

গুলি শেষ।

রিভলভারের চেম্বারে আছে শুধু গুলির খোসা।

দ্বিতীয় কমাত্তোর উপর ঝাঁপিয়ে নামল নিশাত, দুজন ছিটকে পড়ল বোর্ডরুম টেবিলের চকচকে পিঠে।

নানাদিকে গেল লোকটার হাতের মেটালস্টর্ম রাইফেলের গুলি।

মেঝে ও সিলিং পর্যন্ত কাঁচের জানালা, তার বুকে লাগল শ খানেক বুলেট। তৈরি হলো অসংখ্য মাকড়সার জাল।

বোর্ডরুম টেবিলের উপর হামলাকারীর বিরুদ্ধে লড়তে চাইল। নিশাত। লোকটা বিশালদেহী, শক্তিশালী। কোমরের খাপ থেকে বের করেছে ছোরা। ওই একই কাজ করেছে নিশাতও, দুজনের ছোরা টক্কর দিতেই ঠন আওয়াজ উঠল।

লড়বার ফাঁকে চোখের কোণে দরজা দেখল নিশাত। ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে দুই লোক।

কিন্তু তারা ৬৬ ইউনিটের কেউ নয়।

দামি সুট পরা দুই ইজরায়েলি, কাঁধ থেকে ঝুলছে উযি সাবমেশিনগান। শার্টের বুকে রক্তের ছাপ।

মোসাদের সিকিউরিটি গার্ড।

দুই ইজরায়েলি দেখছে বোর্ডরুমের টেবিলের উপর লড়ছে। দুজন।

শালার বাউন্টি হান্টার! মেঝেতে থুতু ফেলল ডানদিকের লোকটা।

চলে এসো! বলল অন্যজন, আবারও ফিরল হলওয়েতে। ওরা আসছে!

প্রথম গার্ড টিটকারির হাসি নিয়ে লড়াইরত নিশাত ও প্রকাণ্ড লোকটাকে দেখল। পকেট থেকে বের করল হাই-পাওয়ার্ড আরডিএক্স গ্রেনেড। খুলে ফেলল ক্যাপ, ছোট আনারসটা ছুঁড়ে ফেলল বোর্ডরুমের ভিতর। পরের সেকেণ্ডে উধাও হলো, দুই ইজরায়েলি গার্ড।

হামলাকারীর বিরুদ্ধে লড়বার ফাঁকে নিশাত দেখেছে, উড়ে এসেছে গ্রেনেড। হঠাৎ করেই ওটার গতি যেন ধীর হয়ে উঠল। মাত্র একবার মেঝেতে কপাল ঠুকল, পরক্ষণে অদৃশ্য হলো প্রকাণ্ড টেবিলের নীচে।

খটাৎ আওয়াজ পেল নিশাত।

এইমাত্র মস্ত টেবিলের গাছের গুঁড়ির মত মোটা এক পায়ার গায়ে লেগেছে গ্রেনেড। পরক্ষণে বিস্ফোরিত হলো বোমা।

এর প্রতিক্রিয়া হলো ভয়ঙ্কর।

টেবিলের এক অংশ উড়ে গেল করিডোরের দিকে। চারপাশে ছিটকে গেল হাজার হাজার কাঠের কুচি।

টেবিলের অন্য অংশ এখনও কমপক্ষে পঁচিশ ফুট দৈর্ঘ্যের, ভিন্ন পরিণতি হলো ওটার ভাগ্যে।

গ্রেনেডের কনকাশন ফোর্স মেঝে থেকে শূন্যে তুলে ফেলল অত বড় টেবিল, ছুটে যাওয়া রেলগাড়ির বগির মত রওনা হয়ে গেল। গতি প্রচণ্ড, দেখতে না দেখতে পেরোল বোর্ডরুম, বুলেটের মত গিয়ে লাগল ঘরের পশ্চিমের জানালায়।

এক সেকেণ্ড আগেই নিশাত বুঝেছে এরপর কী ঘটবে।

সুসজ্জিত, আরামদায়ক বোর্ডরুমের ফাটা কাঁচের জানালা বিস্ফোরিত করে ব্যাটারিং র‍্যামের মত বেরিয়ে গেল টেবিল চল্লিশতলা উঁচু আকাশে।

ভীষণ হোঁচট খেল ওটা।

হঠাৎ নিশাত টের পেল, পিছলে পড়ছে। মুখে ঝরঝর করে। নামছে বৃষ্টির শীতল জল।

চার শ ফুট নীচে রাস্তা!

দৃশ্যটা অদ্ভুত। টাওয়ারের উপরের তলা থেকে গলা বের করেছে মস্ত টেবিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য, তারপর হঠাৎ করেই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ তৈরি করে ঝুঁকে রওনা হয়ে গেল নীচে!

অবশ্য, এ পতন পলকের জন্য।

টেবিলের উপরাংশ গিয়ে বাধল সিলিঙে, এদিকে মেঝের কিনারায় আটকা পড়ল পুরু দুই পায়। ফলে হঠাৎ করেই আবারও ঝুঁকি খেয়ে থামল টেবিল, ঝুলছে উঁচু দালানের সবচেয়ে উঁচু তলা থেকে।

সরসর করে পিছলে পড়ছে নিশাত, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে টেবিলের বুকে ঘঁাচ করে বিধিয়ে দিল ছোরা। হাতলের তামার ফিঙ্গারহোল্ডে চেপে বসল দুই হাত। প্রায় খাড়া টেবিলের শেষে ঝুলছে ওর দুই পা।

নিশাতের হামলাকারী অত দ্রুত নড়তে পারেনি। ঝট করে টেবিলের দুপাশ ধরতে গিয়ে ফেলে দিয়েছে ছোরা। কিন্তু কপাল মন্দ, ধরা হয়নি কিছুই। অবশ্য ভাগ্য তার ভাল, সে ছিল উপরে। ঝরা পাতার মত নেমে এল নিশাতের ছোরার উপর বুট রেখে। বন্ধ হলো তার পতন।

নিশাতের কব্জির উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে।

ব্যথায় ছিঁড়ে যেতে চাইল নিশাতের হাত। মুখ তুলে চাইল। উপর থেকে চেয়ে আছে লোকটা, হাসছে বত্রিশ দাঁত বের করে!

টেবিলের দু পাশ ধরে ফেলেছে ব্যাটা, এবার নিশাতের কব্জির উপর লাথি মারতে লাগল।

দাঁতে দাঁত খিচে টিকে থাকতে চাইল নিশাত। একের পর এক লাথি পড়ছে কব্জির উপর। ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেল মুখ। কখনও কখনও তামার ফিঙ্গারহোল্ডে লাথি নামছে, তখন সামান্য কমছে ব্যথা।

তখনই শুনতে পেল শব্দটা: ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ… ওই আওয়াজ হেলিকপ্টারের রোটরের। মাথা কাত করে ওদিকে চাইল নিশাত। সামান্য দূরে প্রকাণ্ড বোলতার মত ভাসছে লিঙ্কস কপ্টার।

হায়রে কপাল… বিড়বিড় করল নিশাত।

ওর কব্জির উপরে ভর করে পাইলটকে একহাতে ইশারা করল বাউন্টি হান্টার। বোঝাতে চাইছে যেন কপ্টার নিয়ে নীচে আসে।

সবই বুঝেছে পাইলট, কপ্টার নিয়ে এল নিশাতের পায়ের নীচে। সাঁই-সাই ঘুরছে রোটর। ঝাপসা আকৃতি তৈরি করেছে। সাদা কোনও চরকির। নিশাতের দুই পা থেকে মাত্র দশফুট নীচে ঘুরছে দুরন্ত পাখা।

সন্তুষ্ট হয়েছে বাউন্টি হান্টার। নতুন উদ্যমে শুরু হলো লাথি। কড়াৎ!

চারপাশের এত আওয়াজের ভিতরও নিজের আঙুলের হাড় ভাঙবার শব্দ শুনল নিশাত।

বাউন্টি হান্টারের উদ্দেশ্যে গলা ফাটাল: হারামজাদা, তোর মা বেশ্যা ছিল, আর তোর বাপ ছিল রাস্তার কুকুর!

তিনগুণ জোরে লাথি নামল।

নিশাতের বুট পরা দুই পায়ের দশ ফুট নীচে জোরালো গুঞ্জন তুলছে রোটর ব্লেডগুলো।

জোরালো শেষ লাথি মারতে তৈরি বাউন্টি হান্টার। ঝট করে। পা ছুঁড়ল…

ওই একই সময়ে অদ্ভুত কাজ করল নিশাত। টেবিলের বুক থেকে হ্যাচকা টানে খুলে নিল ছোরা! পিছলে পড়তে শুরু করেছে দুজন!

এবার টেবিলের শেষ অংশ পেরিয়ে নামবে গিয়ে ঘুরন্ত রোটরগুলোর ভিতর!

নিজ চোখকে বিশ্বাস করছে না নিশাতের হামলাকারী।

পায়ের নীচে ছুরিটা ছিল শক্ত মাটির মত, ভরসা করা যাচ্ছিল। ওটার উপর, কিন্তু এখন সব সরে যেতেই বোর্ডরুমের টেবিল থেকে পিছলে পড়ছে সে।

টেবিলের শেষাংশে পৌঁছে গেল নিশাত। কিন্তু হামলাকারীর মত অপ্রস্তুত নয় ও।

টেবিলের শেষ কিনারা পেরুতেই আবারও ছোরা চালাল ও। এবার কোপ দিয়েছে টেবিলের উল্টোদিকে হাত থেকে ছুটল না। ছোরার হ্যাঁণ্ডেল। জোরালো আঁকি খেয়ে থেমে গেল নিশাত।

ওর পাশ দিয়ে পড়ার সময় নিশাতকে ধরার জন্য হাত বাড়াল লোকটা, সঙ্গে সঙ্গে জোরালো এক থাবড়া হাকাল নিশাত, কড় কড় আওয়াজে ভাঙল লোকটার দুপাটির দশটা দাঁত বেরিয়ে গেল বাউন্টি হান্টার, পেরোল টেবিল। নীচে…

দৃশ্যটা যেন হয়ে উঠল স্লো মোশন ছায়াছবির মত।

লোকটার আতঙ্কিত চেহারা দেখল নিশাত। ডিমের মত বড় হয়ে উঠেছে ব্যাটার দুই চোখ। মস্ত হাঁ করেছে, ভাঙা দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওর আলাজিভ। পড়ছে… পড়ছে…

মাত্র এক সেকেণ্ড পর রোটর ব্লেডগুলোর উপর পড়ল সে। জোরালো একটা ভোঁতা আওয়াজ হলো।

মুহূর্তে হারিয়ে গেল লোকটা, তার জায়গায় চারপাশে বিস্তৃত হলো লাল একটা নক্ষত্র।

ছড়িয়ে গেল রক্তের কোটি কণা।

কপ্টারের উইণ্ডস্ক্রিনে ছলাৎ করে লেগেছে একরাশ লাল তরল। ঝাপসা হয়ে গেল উইণ্ডস্ক্রিন। দালানের পাশ থেকে সরে গেল লিঙ্কস কপ্টার।

তাতে স্বস্তির শ্বাস ফেলবারও সময় পেল না নিশাত।

বৃষ্টির ভিতর টের পেল, এইমাত্র নড়ে উঠেছে টেবিল!

নতুন করে হোঁচট খেয়ে নামছে। ঝট করে মুখ তুলে চাইল নিশাত।

চল্লিশতলার মেঝেতে আটকা পড়া টেবিলের দুই পায়ার একটা মচকে গেছে!

এবার সোজা নীচে রওনা দেবে গোটা টেবিল!

অ্যাই মিয়া, এটা কোনও বিচার হলো তোমার? আকাশের দিকে চেয়ে গলা ফাটাল নিশাত। না! আমি মরব না!

চারপাশে চোখ বোলাল। ও আছে দালানের এক পাশে। ঝুলছে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে।

সামান্য নীচে একটু দূরে কাঁচ ঘেরা একটা এলিভেটার। ওটা দালানের দক্ষিণের শুরুতেই আটত্রিশ তলায় থেমেছে।

ঠিক আছে, ফিসফিস করে নিজেকে বলল নিশাত। শান্ত থাকো। ভাবো, তোমার বস্ মাসুদ রানা হলে কী করত।

নিশ্চয়ই ম্যাগহুক ব্যবহার করত?–ভাবল।

বেল্ট থেকে ম্যাগহুক নিয়ে মাযল তাক করল চল্লিশতলার সিলিঙে, তারপর টিপে দিল ট্রিগার।

কিছুই হলো না। ম্যাগহুক ফায়ার করেনি।

শুধু ক্লিক আওয়াজ তুলেছে ট্রিগার, ব্যারেলের ভিতর থেকে বেরোল দুর্বল ফিজ-ফিজ শব্দ। ফুরিয়ে গেছে গ্যাস প্রোপেল্যান্ট।

যাহ শালা! রাগে গরগর করল নিশাত। এমন তো হয় না। রানার বেলায়!

তখনই আবারও হোঁচট খেল টেবিল। সড়াৎ করে নামল আরও দুফুট। ম্যানুয়ালি দড়ি গোটাতে শুরু করেছে নিশাত, কাজটা করতে হচ্ছে দাঁতের জোরে। তারই ফাঁকে বিড়বিড় করছে: ঠিক না, এসব একদম ঠিক না। শালার কপাল আমাকে জুতিয়ে দিচ্ছে!

চল্লিশতলার মেঝের কিনারায় টলমল করছে টেবিল। গুঙিয়ে উঠছে পায়া। যে-কোনও সময়ে ভেঙে পড়বে।

যথেষ্ট দড়ি পাওয়া গেছে বুঝতেই অন্যহাতে ম্যাগহুকের এ্যাপলিং হুক চল্লিশতলার মেঝে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল নিশাত।

মেঝের কিনারায় পড়ল এ্যাপলিং হুক, ভাঙা উইণ্ডাসিলে

আটকে গেল আঁকশি। তখনই জানালা থেকে ছুটে গেল টেবিল!

দেরি না করে ছোরা ছেড়ে দিল নিশাত, আরেক হাতে টেবিলে জোর এক ধাক্কা দিয়ে সরে গেল দূরে।

এ বষ্টিঝরা আকাশে নীচে রওনা হয়ে গেল টেবিল, পড়ছে দালানের গা ঘেঁষে।

দড়ি থেকে ঝুলছে নিশাত, দোল খেয়ে সরল বাড়ির কোণে, পৌঁছতে চাইল এলিভেটারের কাঁচের দেয়ালের পাশে। একবার খপ করে কাঁচের বাক্সের ছাতের কিনারা ধরতে পারলেই…

সাত সেকেণ্ড পর সিলভারম্যান, নিউটন অ্যাণ্ড যেমির লইয়ার্স ফার্মের বোর্ডরুমের প্রকাণ্ড টেবিল আছড়ে পড়ল ফুটপাথে, মুহূর্তে লাখখানেক টুকরো হলো।

.

উইণ্ডো-ওয়াশার্স প্ল্যাটফর্মে চেপে ছাতের পাশে পৌঁছে গেছে খবির ও ম্যাকিন। রেলিং টপকে চট করে লুকিয়ে পড়ল এগস্ট চিমনির আড়ালে। উঁকি দিয়ে দেখল, ছাতে নেমেছে হেণ্ডিকের লিঙ্কস কপ্টার। ঝমঝম বৃষ্টির ভিতর এখনও ঘুরছে রোটরগুলো।

আলাপ চলুক, ম্যাকিনকে বলল খবির। এই ম্যাজেস্টিক ১২ একটা তালিকা তৈরি করেছে। আর চাইছে মাসুদ স্যরকে মেরে ফেলতে। ওই তালিকায় আরও…

এসব করছে সি সেক টেস্টের কারণে, বলল ম্যাকিন। কারণ, ধরে নেয়া হয়েছে মাসুদ রানা এবং অন্য আটজন ওই টেস্টে পাশ করবে। ন্যাটো ওই টেস্টের নাম দিয়েছে: মোটর নিউরন র‍্যাপিডিটি অভ রেসপন্স টেস্ট।

মোটর নিউরন র‍্যাপিডিটি অভ রেসপন্স টেস্ট? বলল খবির, তার মানে রিফ্লেক্সের বিষয়?

ঠিকই ধরেছেন, বলল ম্যাকিন। সবই রিফ্লেক্সের ব্যাপার। বলতে পারেন সুপারফাস্ট রিফ্লেক্স। ওই তালিকার নয়জন দুনিয়া সেরা। অনায়াসে পাশ করবে সি স্নেক টেস্ট। এরা ডিসআর্ম করতে পারবে টাচলক-৯। আর এটাই হচ্ছে ম্যাজেস্টিক-১২-র পরিকল্পনা। আর ওই পরিকল্পনা কাজে লাগাতে হলে আগে এই লোকগুলোকে শেষ করতে হবে।

একটা মিসাইল সিকিউরিটি সিস্টেম…

হ্যাঁ, কিন্তু মনে কোনও ভুল ধারণা রাখবেন না। এই বাউন্টি হান্টের পরিকল্পনা ম্যাজেস্টিক-১২-এর মস্ত পরিকল্পনার সামান্য অংশ।

ওই মহাপরিকল্পনা কী?

বর্তমান দুনিয়ার রাজনৈতিক সমস্ত অবস্থান পাল্টে দেয়া। মূল কথা: তারা ছড়িয়ে দেবে গোটা দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধ। নিজেদের খুশিমত আবারও জন্ম দেবে নতুন রাষ্ট্র। খবিরের কানের কাছে। বলল ম্যাকিন, আমার কথা শুনুন। এ বিষয়ে আস্ত ফাইল জোগাড় করেছি, দুইতলা নীচেই আছে ওটা। গত দুদিন ধরে আমার কাছ থেকে এসব তথ্য সংগ্রহ করছিল মোসাদ। ওই ফাইলে আছে কেন, কী কারণে ম্যাজেস্টিক-১২ বা এর সদস্যরা বাউন্টি হান্টের আয়োজন করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ভয়ঙ্কর সেই মহাপরিকল্পনা কী তা…

আকাশ থেকে পড়া বাঙ্গির মত বিস্ফোরিত হলো ম্যাকিনের গোটা মাথা। ওটা যেন ছিল রক্তভরা পাতলা রাবারের বেলুন।

কিছুই টের পায়নি খবির।

ওর পিছন থেকে মেটালস্টর্ম রাইফেলের বিশটা বুলেট উড়িয়ে দিয়েছে মোসাদ এজেন্টের আস্ত মুখ।

চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল খবির। ত্রিশ গজ দূরে ফায়ার স্টেয়ার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে স্বয়ং ডেভিল ডেভিড এন. হেন্ড্রিক, কাঁধে মেটালস্টর্ম রাইফেলের বাঁট।

ঝট করে ম্যাকিনের দিকে চাইল খবির। ভাঙা পুতুলের মত

পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ! আর একটা কথাও বেরোবে না ওই মুখ। থেকে। মাথাটাই নেই তো তার আর কীসের মুখ বা কথা!

এবার নিজের জান বাঁচা, বাপু! ঘুরেই ঝেড়ে দৌড় লাগাল খবির। হাতে উদ্যত রিভলভার, গুলি করছে হেলিকপ্টারের পাশ দিয়ে। চলেছে ওই কপ্টার লক্ষ্য করেই। একবার চড়তে পারলে চিন্তা নেই। নিজের হাতে ওকে কপ্টার চালানো শিখিয়েছেন মাসুদ স্যর।

.

টারজানের মত ঝুলতে ঝুলতে চলেছে নিশাত, দুপায়ের দুই লাথিতে ঝরঝর করে ভেঙে পড়ল এলিভেটারের কাঁচের দেয়াল। পরক্ষণে মেঝেতে নামল ও।

টাওয়ারের দক্ষিণে আটত্রিশতলায় প্রথম এলিভেটার থেকে। দেখল, প্রায় প্রতিটি এলিভেটার একই উচ্চতায় স্থির।

পাশাপাশি তিন এলিভেটার আটত্রিশতলায়। পরেরটা, অর্থাৎ চতুর্থ এলিভেটার নেই। কোনও কারণে ডেকে নেয়া হয়েছে। নীর্চে। মাঝের ওই ফাঁক বাদ দিলে ওদিকে পঞ্চম এলিভেটার। সেটাও আটকা পড়েছে আটত্রিশতলায়।

কন্ট্রোল প্যানেলের ওপেন বাটন টিপে দিল নিশাত।

ওর মনে হচ্ছে, দাঁড়িয়ে আছে ফিশবউলে। যে-কোনও সময়ে ওর খোঁজ নিতে আবারও ফিরবে লিঙ্কস কপ্টার। তার আগেই সরে যেতে হবে, নইলে নিশ্চিত মৃত্যু…

ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ… আসছে লিঙ্কস কপ্টার। ঘুরে চাইল নিশাত। পৌঁছে গেছে ওটা। ওর কাঁচের এলিভেটারের পশ্চিমে ভাসছে। এবার খরগোশের উপর ছোঁ দেবে ঈগল।

বারবার ওপেন বাটন টিপে চলেছে নিশাত। বিড়বিড় করে বলল, মর জ্বালা! কাজ করে না এই বাটন?

তখনই লিঙ্কসের সাইড মাউন্টেড মিসাইল পড়গুলো থেকে ভুস করে উঠল একরাশ ধোঁয়া। ও

অবাক হলো নিশাত। ওকে শেষ করতে মিসাইল মেরেছে শালারা! পড থেকে ছিটকে বেরোল টো মিসাইল। যেন দিগন্ত থেকে এল নিশাতের এলিভেটার লক্ষ্য করে। এইমাত্র খুলতে শুরু করেছে এলিভেটারের দরজা।

শো-শো গর্জন ছাড়তে ছাড়তে বিদ্যুদ্বেগে নিশাতের নাক লক্ষ্য করেই আসছে মিসাইল।

মস্ত শরীরটা চাপাচাপি করে দুই দিকের কবাট ঠেলে ওদিকের মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিশাত

তখনই এলিভেটারের পশ্চিম কাঁচ ভেঙে ভিতরে ঢুকল মিসাইল। ওটার লেজের উত্তপ্ত আগুন ঝলসে দিল এলিভেটারের ভিতরের অংশ। পরক্ষণে আরেকদিকের কাঁচের দেয়াল ভেঙে গিয়ে ঢুকল পাশের এলিভেটারের বুকে।

দৃশ্যটা বিস্ময়কর।

কুইন্স টাওয়ারের দক্ষিণ-দেয়াল ছুঁয়ে চারটে এলিভেটার ভেদ করে কাঁচ ভাঙবার ঝনঝনঝনঝন আওয়াজ তুলে টেমসে গিয়ে পড়ল মিসাইল। পানির মস্ত গিইজার তৈরি হলো নদীর বুকে।

কঠিন ক্যাচ ধরতে চাওয়া আনাড়ি ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মত আটত্রিশতলার রিসেপশন এরিয়ায় ধুপ করে পড়েছে নিশাত। মুখ। তুলেই দেখল, এখনও ধীরে ধীরে খুলছে এলিভেটারের কাঁচের দরজা।

চোখের কোণে দেখল, বিধ্বস্ত রিসেপশন এরিয়ায় চার বাউন্টি হান্টার। বেশি দূরে নেই তারা!

নিশাত তাজ্জব বনে গেছে, কিন্তু ওর চেয়ে কম বিস্মিত হয়নি লোকগুলো।

শালার তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলোর ভেতর পড়েছি! বিড়বিড় করল নিশাত।

ঝট করে যার যার মেটালস্টর্ম রাইফেল ঘোরাল লোকগুলো।

ওই একই সময়ে লাফ দিয়ে উঠে সিধে হলো নিশাত, বুঝে গেছে মাত্র একটা জায়গায় যেতে পারবে: ক্ষিপ্র চিতার মত এক লাফে গিয়ে ঢুকল এলিভেটারের ভিতর।

লুকিয়ে পড়ল কন্ট্রোল প্যানেলের আড়ালে। এক সেকেণ্ড পর হাইপারমেশিনগানের অজস্র তপ্ত বুলেট ঢুকল খোলা দরজা দিয়ে।

দমকা হাওয়া ছেড়েছে, সেই সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি- পুরো ভিজে গেছে নিশাত। বিধ্বস্ত এলিভেটার হয়ে উঠেছে বড়জোর খোলা প্ল্যাটফর্ম, ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে লণ্ডন শহর।

টাওয়ারের দক্ষিণে চোখ গেল নিশাতের।

ওদিকে পাশাপাশি তিনটে এলিভেটার।

বাঁচতে চাইলে ঝুঁকি নে, বিড়বিড় করল। নইলে নির্ঘাত মরবি!

কাজেই দৌড় শুরু করল নিশাত।

আটত্রিশতলায় প্রথম এলিভেটার থেকে ছুটতে শুরু করেছে। একটু পর পর তিন ফুট জায়গা ফাঁকা, তারপর একের পর এক বিধ্বস্ত এলিভেটার।

দ্বিতীয় এলিভেটারে নামতেই আবারও হাজির হলো লিঙ্কস কপ্টার। নেমে এল চিলের মত, যেন ছোঁ দেবে। চালু করেছে মিনি-গান, ঝড়ের মত এল শত শত বুলেট, চুরচুর করে দিল দালানের কাঁচ।

ভাসতে ভাসতে ঘুরছে কপ্টার, ওটার ঝোড়ো বুলেটকে পিছনে ফেলে ছুটছে নিশাত। মাত্র একফুট পিছনে তেড়ে আসছে নিশ্চিত মৃত্যু। লাফিয়ে পড়ল তৃতীয় এলিভেটারের ভিতর।

এবার? চার নম্বর এলিভেটার নামিয়ে নেয়া হয়েছে অনেক নীচে। পাঁচ নম্বর এলিভেটারের আগে হাঁ করে আছে অতল খাদ। দৌড়ের গতি রোধ করল না নিশাত। মাঝের ফাঁক অনেক বেশি চওড়া পুরো বারো ফুট।

কিছু পাত্তা না দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিশাত। সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে দুই হাত। আশা করছে আটত্রিশতলা বাড়ি থেকে পড়ে মরবে না। কেন যেন ওর মনে হলো: পৌঁছুতে পারবে পঞ্চম এলিভেটারে।

কিন্তু কপাল সবসময় সাহায্য করে না।

ঝাঁপিয়ে পড়েই বুঝে গেল নিশাত, দূরের ওই গন্তব্যে পৌঁছুবে না ও।

পঞ্চম এলিভেটারের মেঝের এক ইঞ্চি দূরে হাত পৌঁছতেই শুরু হলো পতন।

অবশ্য এলিভেটারের মেঝের কিনারায় ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলে আটকে গেল ম্যাগহুকের এ্যাপলিং হুক।

কাজ করছে না ম্যাগহুক, কিন্তু নিশাতের হাত থেকে পুরো একফুট সামনে বেড়ে আছে ওটা।

এর বেশি বাড়তি সুযোগ আশা করেনি নিশাত।

স্টিলের আঁকশির এক ফুট নীচে ঝুলছে ও।

লঞ্চার বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, এমন সময়… আবার শুরু হলো ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ-ধুপ আওয়াজ! লিঙ্কস অ্যাটাক হেলিকপ্টার!

আবারও হাজির হয়েছে ওটা। চলে এসেছে নিশাতের এলিভেটারের খুব কাছে। কিন্তু এই কপ্টারের পিছনে উদয় হয়েছে আরেকটা কপ্টার।

ওটাও লিঙ্কস।

সামনের লিঙ্কস কপ্টারের পাইলটের হাসিটা পরিষ্কার দেখল নিশাত।

লোকটা খুশি মনে হাত নাড়ল, পরক্ষণে খপ করে ধরল গান ট্রিগার।

এলিভেটার প্ল্যাটফর্মের নীচে ঝুলতে ঝুলতে মাথা নাড়ল নিশাত। দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে।

কেউ চিরকালের জন্য আসে না।

বনবন করে ঘুরছে লিঙ্কসের মিনি-গান ব্যারেল। কিন্তু চোখের কোণে আরেকটা নড়াচড়া দেখল নিশাত।

এই লিঙ্কস কপ্টারের পিছনে ধূসর ধোঁয়া ছাড়ছে কী যেন… ওই যে পিছনের লিঙ্কস হেলিকপ্টারটা… তখনই সামনের কপ্টারের কোমরে বিধল মিসাইল।

ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হলো। থরথর করে কেঁপে উঠল বাতাস। সে সঙ্গে প্রচণ্ড আওয়াজ। যেন গা পুড়িয়ে দেবে আগুনের হলকা। নিশাতের চোখের সামনে হাজার টুকরো হলো বাউন্টি হান্টারদের কপ্টার। টাওয়ারের দেয়াল ঘেঁষে নীচে রওনা হয়ে গেল জ্বলন্ত টুকরোগুলো। গা থেকে উঠছে তেলতেলে ধোঁয়া।

বিধ্বস্ত কপ্টারের পোড়া কাঠামো প্রচণ্ড আওয়াজে আছড়ে পড়ল টাওয়ারের সামনের সবুজ ঘাসের লনে। বিস্ময় নিয়ে দ্বিতীয় লিঙ্কস কপ্টারের দিকে চাইল নিশাত। নিজের দলের লোককে শেষ করেছে ওই পাইলট?

তখনই চিনল তাকে। লেখক টু খবির!

ইয়ারপিসে নিশাত শুনল পরিচিত কণ্ঠ, আপা, কী করেন? ছাতে পেলাম এই মাল। বেচবে না পাইলট। এখন ঘুমিয়ে আছে।

বৃষ্টির ভেতর। তারপর এইমাত্র দেখলাম আপনি এখানে।

হাচড়ে-পাছড়ে এলিভেটারের মেঝেতে উঠে এসেছে নিশাত। বলল, পরে কথা হবে, ছুডু বাই! আগে মৃত্যু-প্রাসাদ থেকে সুন্দরী রাজকন্যা আপাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও!

নিশ্চই তাই করব। কিন্তু আগে একটা কাজ করে দেবেন, আপা?

.

তিন মিনিট পর।

ঊনচল্লিশতলার এক করিডোর ধরে রেলগাড়ির মত ছুটল নিশাত, হাতে উদ্যত কোল্ট।

চারপাশ একেবারে বিধ্বস্ত হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে বুলেটের ক্ষত-বিক্ষত চিহ্ন। কোথাও আস্ত নেই একটা কাঁচও।

বাউন্টি হান্টাররা এখনও থেকে থাকলে, তাদের কাউকে দেখা গেল না।

ওটা আছে ইন্টারনাল স্টেয়ারকেসের কাছে, ইয়ারপিসে খবিরের কথা শুনল নিশাত। যে ঘরের কাছে ম্যাকিনকে পেয়েছিলাম। ওটা বোধহয় কোনও ধরনের ইন্টারোগেশন রুম।

বুঝতে পেরেছি, বলল নিশাত।

বাঁকা সিঁড়ির কাছেই ওই ঘরের দরজা।

কয়েক সেকেণ্ডে ওখানে পৌঁছে গেল ক্যাপ্টেন। ঘরে ঢুকে একটু দূরে দেখল টু-ওয়ে মিরর। ওদিকে ইন্টারোগেশন রুম। আয়নার এদিকে দুটো আধুনিক মুভি ক্যামেরা। টেবিলের পাশে পুরু ম্যানিলা ফোল্ডার এবং দুটো কেসে ডিভিডি।

আসলেই ইন্টারোগেশন রুম, থ্রোট মাইকে বলল নিশাত। ফাইল ফোল্ডার পেয়েছি। ডিভিডি দুটোও। এবার কী করতে বলো?

সব নিন। এ ছাড়া ম্যাজেস্টিক-১২ বা টাচলক-৯ সম্পর্কে যা। কিছু পাবেন, নেবেন। ক্যামেরার পেটেও কিছু থাকতে পারে।

মেঝের উপর কাত হয়ে পড়ে থাকা ছোট স্যামসোনাইট সুটকেস সিধে করল নিশাত। ওটার ভিতর ভরতে লাগল ফাইল ও ডিভিডি। দুই ক্যামেরাও এটে গেল।

অনেক নীচে অসহায় শিশুর ওঁয়া-ওঁয়া কান্না জুড়েছে পুলিশের একাধিক গাড়ির সাইরেন। যথেষ্ট হয়েছে, ভাবল নিশাত। বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। ছুটতে শুরু করেছে সিঁড়ির দিকে। উঠবে ছাতে।

মাত্র পাঁচ মিনিট পর অন্য একটা সিঁড়ি ব্যবহার করে ছাতে পৌঁছে গেল, ছুটছে বৃষ্টির ভিতর।

আগেই লিঙ্কস কপ্টার নামিয়ে এনেছে খবির। দরজা খুলে দিতেই ঝটপট উঠে পড়ল নিশাত।

পঁচিশ সেকেণ্ড পর ছাত ছেড়ে আকাশে উঠল কপ্টার, বৃষ্টির ভিতর ধোঁয়াভরা কুইন্স টাওয়ারকে পিছনে ফেলে রওনা হয়ে গেল।

আঠারো

ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রধান অফিস।

সাব-লেভেল তিন, পেন্টাগন। অক্টোবর, ১৪। সকাল সাড়ে এগারোটা।

খুব নিরীহ ভঙ্গিতে অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল কেভিন কনলন, যাবে ডক্টর ওয়াকারের কাছে সেন্ট জন্স হসপিটালে কিন্তু এমন সময় বুনো দাঁতাল শুয়োরের মত হামলে পড়ল ওর মোটকু বস।

তো, কোথায় চললেন, কনলন স্যর? টিটকারির সুরে বলল জন ওয়ার্ন। প্রকাণ্ডদেহী লোক সে, আগে আর্মিতে ছিল, দুবার ইরাকে লড়াই করে এসেছে। আর ওই কথাটা একটু পর পর আশপাশের সবাইকে মনে করিয়ে দেয়।

বাস্তবে নির্বোধ লোক। দুনিয়ার আর সব গাধার মতই, কোনও নিয়ম বা আইন থেকে নড়তে সম্পূর্ণ নারাজ। অথচ জটিল সমস্যার সমাধান হয়তো রয়েছে একেবারে হাতের নাগালে।

আমি একটু কফির জন্যে বেরুচ্ছি, বলল কেভিন।

আমাদের অফিসের কফির দোষটা কী, শুনি স্যর?

এর চেয়ে হাইড্ৰফ্লোরিক অ্যাসিড ভাল।

ঠিক তখনই অফিসে এসে ঢুকল ডানাকাটা পরী, তরুণী মেরিয়ান বিটন। সে মেইল: ক্লার্ক। আর ওই মুখ দেখলে জ্বলজ্বল করে কনলনের দুই চোখের তারা। কিন্তু দুঃখের কথা, ওর মতই কীসের যেন ভাষা খুঁজে পায় জন ওয়ার্নের কুতকুঁতে চোখ।

হাই, মেরিয়ান, নিজের সেরা হাসিটা দিল কেভিন।

হাই, কনলন, লাজুক হাসল তরুণী।

গলা চড়িয়ে বলল ওয়ার্ন, তুমি না অফিস ছেড়ে যাচ্ছিলে, কনলন? যাও, ঘুরে এসো। আসার সময় স্টারবাক থেকে আমার জন্যে গ্র্যাণ্ড ফ্রেপাচিনো এনো।

শালা, তোর নিকুচি করি, মনে মনে গাল দিল কেভিন। ত্যাগ করল। আপনি যা বলেন, ওয়ার্ন।

অ্যাই, ধমক দিল বস। আগেও বলেছি, আমাকে সার্জেন্ট ওয়ার্ন বলেই ডাকবে। তোমার মত মেরুদণ্ডহীন সামান্য কিবোর্ড টেপা ছোকরা আমাকে যা খুশি ডাকবে, সেজন্যে ইরাকে গুলি খাইনি আমি। সত্যি যখন বিপদে পড়ে দেশ, তখন আমার মত লোকই বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। চওড়া হাসি দিল সে মেরিয়ানের দিকে চেয়ে। তখন পিস্তলটা কি তোমার হাতে থাকবে, না আমার হাতে, কনলন?

অপমানে লাল হয়ে গেছে কেভিনের গাল। আস্তে করে শ্বাস ফেলে বলল, আপনি যা বলেন, ওয়ার্ন।

যা বললাম, এখন থেকে মনে রাখবে, ছোকরা!

বিরক্তি চেপে মেরিয়ানের দিকে সামান্য নড় করল কেভিন, বেরিয়ে এল অফিস ছেড়ে।

.

ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড, সেন্ট জন্স হসপিটাল।

আর্লিংটন, ইউএসএ। অক্টোবর ১৪। দুপুর পৌনে বারোটা।

সেন্ট জন্স হাসপাতালের ই.আর. বিভাগে ঢুকে রিসেপশন। কাউন্টারের সামনে থামল কেভিন কনলন। ২৩৩

বেলা বাড়ছে, কিন্তু আজ রোগী বা দর্শনার্থীদের ভিড় নেই। ওয়েটিং এরিয়ায় যোম্বির মত পেট ভাসিয়ে কাউচে বসে আছে পাঁচজন বয়স্ক লোক ও এক মুটকি মহিলা।

হাই, আমি কেভিন কনলন, ডক্টর জেফ ওয়াকারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।

অলসভঙ্গিতে বাবলগাম চিবিয়ে চলেছে ডেস্ক নার্স। এক মিনিট। …ডক্টর ওয়াকার! আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এক ভদ্রলোক!

পর্দা ঘেরা এক বেড-বে থেকে বেরিয়ে এল দ্বিতীয় নার্স। বেলিণ্ডা, শশশশ! উনি চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমি গিয়ে তুলে দিচ্ছি।

আবারও হলওয়েতে গিয়ে ঢুকল দ্বিতীয় নার্স।

ওই একই সময়ে রিসেপশন কাউন্টারে কনলনের পাশে থামল। অত্যন্ত দীর্ঘ এক কালো ভদ্রলোক। গরিলার মত ঢালু কপাল, ছড়ানো নাকের দুই ফুটো।

এই মাল খোদ আফ্রিকার, ভাবল কেভিন।

চোখে এলভিস সানগ্লাস। গায়ে বাদামি ট্রেঞ্চকোট।

কনলন বা নার্স জানে না, বাউন্টি হান্টারদের সমাজে এই লোকের নাম: দি আফ্রিকান।

গুড ইভনিং, আড়ষ্ট উচ্চারণে বলল সে। আমি ডক্টর, জেফ ওয়াকারকে খুঁজছি।

বাউন্টি হান্টারের দিকে ঘুরেও চাইল না কনলন। টের পেয়ে গেছে ওই লোক কে। ধুপ-ধাপ লাফাতে শুরু করেছে হৃৎপিণ্ড

তালগাছের মত উঁচু লোকটা যেন পেশাদার বাস্কেটবল খেলোয়াড়। তার বুক পর্যন্ত পৌঁছুবে না কেভিনের মাথা।

বাবলগাম দিয়ে বড় বল তৈরি করল নার্স। আজকে দেখি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন ডক্টর ওয়াকার! ওদিকে আছেন। বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছেন। এইমাত্র জিনা গেল ডেকে তুলতে।

কথাটা মাত্র শেষ করেছে, এমনসময় চোখ ডলতে ডলতে অথোরাইযড পার্সোনেল ওনলি লেখা করিডোর থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার।

বয়স্ক মানুষ। মাথার চুল ধূসর। কুঁচকে গেছে গাল। শার্টের উপর সাদা ল্যাবকোট। পকেট থেকে চশমা বের করে নাকের উপর চাপিয়ে নিলেন।

ডক্টর ওয়াকার? জানতে চাইল দি আফ্রিকান।

জী, কালো লোকটার দিকে এগিয়ে এলেন ডক্টর।

বাদামি ট্রেঞ্চকোটের তলা থেকে অস্ত্রটা বেরুতেই সবার আগে চোখে পড়ল কেভিনের।

একটা সিযেড-২৫ সাবমেশিনগান। বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত অস্ত্র। দেখতে অনেকটা উযির মত, কিন্তু আরও ন্যাংটো যেন দুই ভাই ওরা। পিস্তল গ্রিপের ভিতর থাকে চল্লিশ রাউণ্ড গুলি।

ডাক্তারের দিকে অস্ত্র তুলল লোকটা, পাত্তাই দিল না বেশ কজন সাক্ষী থাকবে। দেরি না করে টিপে দিল ট্রিগার।

লম্বু খুনির বিরুদ্ধে মাত্র একটা কাজই সম্ভব ছিল, ঠিক তাই করল কেভিন।

ওর ডানহাত ছিটকে লাগল পিস্তলের পাশে, ফলে ডক্টর ওয়াকারের মাথার তিন ইঞ্চি দূর দিয়ে গিয়ে দূরের দেয়ালে বিধল গোটা পনেরো গুলি। এ কাউচে বসা বয়স্ক লোকগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ল মেঝেতে। তাদের একজনের উপর পড়েছে ইয়া মোটা মহিলা। নীচে চাপা পড়ে মুরগির মত কক-কক্ আওয়াজ তুলল বেচারা লোকটা।

চিৎকার শুরু করেছে ডেস্কের নার্স।

ঘুরেই পিছনের করিডোরের মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওয়াকার, পরক্ষণে উঠেই শুরু করলেন দৌড়।

দি আফ্রিকানের উল্টো হাতের প্রচণ্ড এক চড় খেয়ে ছিটকে গেল কেভিন, হুড়মুড় করে পড়ল একটু দূরে রাখা জ্যানিটরের ট্রলিতে।

সামান্যতম দুশ্চিন্তা নেই আফ্রিকান খুনির, রিসেপশন ডেস্ক পাশ কাটিয়ে চলে গেল স্টাফ ওনলি লেখা করিডোরে। এবার

সিযেড-২৫ দিয়ে খতম করবে ডাক্তার ওয়াকারকে।

একটা একটা করে গুলি করছে কিছুই পাত্তা না দিয়ে।

নানাদিকে ছিটকে পালাতে শুরু করেছে নার্সরা।

এইমাত্র করিডোরের একদিকের সাপ্লাই রুমে গিয়ে ঢুকেছেন। ডাক্তার, বাইরের দেয়াল ও কবাটে ফুলিঙ্গ তুলল গোটা দশেক গুলি।

ট্রলির উপর ছড়িয়ে পড়া জ্যানিটরের সাপ্লাইগুলোর মাঝে শুয়ে আছে কেভিন। দেখল, পাশেই পেটমোটা সাদা পাউডারের ব্যাগ। গায়ে পুরু নীল কালিতে লেখা:

যিয়োলাইট-ক্লোরিন ইণ্ডাস্ট্রিয়াল-স্ট্রেংথ।
ক্লিনিং এজেন্ট অ্যাভয়েড স্কিন কন্ট্যাক্ট।

খপ করে ব্যাগ তুলে নিল কেভিন, লাফ দিয়ে নামল ট্রলি থেকে। আর সবাই পালাতে শুরু করেছে, কিন্তু উল্টো দিকে রওনা হয়ে গেল ও। এক ছুটে ঢুকল স্টাফ ওনলি করিডোরে, দেখতে পেল আফ্রিকান লোকটা থেমেছে এক দরজার সামনে, হাতে উদ্যত সিযেড-২৫।

পাঁচ ফুট দূর থেকে ক্লোরিনের ব্যাগ ছুঁড়ে দিল কেভিন। লক্ষ্যভেদ নির্ভুল হলো। খুনির মাথার পিছনে গিয়ে লাগল ব্যাগ। চারপাশে ছিটকে উঠল সাদা গুড়ো।

ভয় পেয়ে নেড়ি কুকুরের মত কেঁউ করে উঠল খুনি, ঝট করে সরে গেল দরজার সামনে থেকে। একহাতে চাপড়াতে শুরু করেছে মাথা। সেই সঙ্গে ভয়ঙ্কর নর্তন-কুর্দন। এলভিস সানগ্লাসের কাছে পুরু হয়ে জমেছে সাদা পাউডার। যিয়োলাইটে ত্বক ও মাংস চিড়চিড় করে পুড়ছে, বড় বড় ফোস্কা পড়তে শুরু করেছে শরীরে।

ঝড়ের গতিতে সামনে বাড়ল কেভিন, দুই হাঁটুর উপর ভর করে ধুপ করে বসল। দি আফ্রিকানের পায়ের পাশে থেমেছে। দরজার ওপাশে ওই তো ডাক্তার! কয়েকটা সাপ্লাই শেলফের নীচে মাথা গুঁজে দুই হাতে ঢেকে রেখেছেন মুখ।

ডক্টর ওয়াকার! কথা শুনুন! আমি কেভিন কনলন! ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি থেকে এসেছি! কোনও হিরো নই! কিন্তু আর কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না! যদি বাঁচতে চান, আমার সঙ্গে আসুন!

হাত বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তার। উঠে দাঁড়িয়েছে কেভিন, দেরি না করে খপ করে তাঁর হাত ধরল, টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল। ভদ্রলোককে। কালো লোকটাকে পাশ কাটিয়ে ছুট দিল দুজন। তীরের মত বেরিয়ে গেল রিসেপশন কাউন্টারের পাশ দিয়ে। কয়েক মুহূর্ত পর পৌঁছে গেল অটোমেটিক স্লাইডিং ডোরের সামনে। ওরা বেরিয়ে এল দুপুরের কড়া রোদে। পিছনে কর্কশ আওয়াজ ছাড়তে শুরু করেছে সিযেড-২৫।

ধাওয়া করছে দি আফ্রিকান। একবার হাতের নাগালে কেভিন বা ওয়াকারকে পেলে রক্ষা নেই।

ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দালানের সামনে পার্ক করা অ্যাম্বুলেন্স।

উঠে পড়ন! তাড়া দিল কনলন। দরজা খুলে লাফিয়ে উঠল ড্রাইভিং সিটে। প্রায় একইসময়ে প্যাসেঞ্জার সিটে বসল ডাক্তার।

ইগনিশন চাবি মুচড়ে দিতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। কেভিন অ্যাক্সেলারেটর টিপে ধরতেই ছিটকে রওনা হলো গাড়ি। দড়াম করে বন্ধ হলো দুই দরজা। কিন্তু তারই ভিতর শোনা গেল। জোরালো ধুপ আওয়াজ। কে যেন উঠেছে গাড়ির পিছনে।

যাহ্… বিড়বিড় করল কেভিন।

সাইড মিররে লম্বা, কালো লোকটাকে দেখছে।

সে দাঁড়িয়ে আছে-অ্যাম্বুলেন্সের রিয়ার বাম্পারে। দুহাতে শক্ত করে ধরেছে ছাতের কিনারা।

কিচকিচ আওয়াজ তুলে বাঁক নিল গাড়ি, আণ্ডারকাভার টার্নিং বে থেকে বেরিয়ে এল মূল পার্কিং লটে। ইচ্ছা করে একটা ড্রেনের উপর দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেল কেভিন। আশা করেছিল বাম্পার থেকে খসে পড়বে লোকটা। কীসের কী, সে থাকল। মাতালের মত ভীষণ দুলছে গাড়ি, পেরিয়ে গেল আরেকটা বড় নর্দমা কেভিন নিশ্চিত হয়ে গেল, এত ঝাঁকুনির ভিতর কেউ টিকবে না।

কিন্তু এক সেকেণ্ড পর দড়াম করে খুলে গেল অ্যাম্বুলেন্সের পিছন দরজা, রিয়ার কম্পার্টমেন্টে এসে ঢুকল লোকটা।

যাশ্‌শালা! বিড়বিড় করল কেভিন।

এখন লোকটার কাছে সিযেড-২৫ নেই। অ্যাম্বুলেন্সে উঠতে গিয়ে ব্যবহার করতে হয়েছে দুহাত, ফলে হারাতে হয়েছে অস্ত্রটা।

এখন আর অ্যাম্বুলেন্স থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। ট্রেঞ্চকোটের তলা থেকে বের করল দীর্ঘ ম্যাচেটি। কেভিন আর ওয়াকারের দিকে রক্তচোখে চাইল লোকটা।

ক্ষুরধার ম্যাচেটির দিকে চেয়ে গলা শুকিয়ে গেল কেভিনের।

রিয়ার কম্পার্টমেন্ট পিছনে ফেলে এগিয়ে আসছে বাউন্টি হান্টার। উঠে পড়ল চাকাওয়ালা স্ট্রেচারে, এগুতে শুরু করেছে।

যা করবার এখনই, ভাবল কেভিন।

সামনে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তা। একটা রাস্তা বামদিকে গেছে একযিটের দিকে, অন্যটা বাঁক নিয়েছে ডানদিকে। ওদিকে কংক্রিটের র‍্যাম্প গিয়ে উঠেছে হাসপাতালের বহুতল পার্কিং লটে।

ডানদিকের রাস্তা বেছে নিল কেভিন। বনবন করে ঘোরাল স্টিয়ারিং হুইল, ফ্লোরের সঙ্গে টিপে ধরল অ্যাক্সেলারেটার। ছুটে চলেছে র‍্যাম্পের দিকে। দ্রুত উঠছে, কাজেই পেয়ে বসল সেন্ট্রিফিউগাল ফোর্স। তাল হারাতে বাধ্য হলো খুনি। দড়াম করে বাড়ি খেল পাশের দেয়ালে। থেমে গেল তার অগ্রগতি।

কিন্তু শুধু উঠবার সময় এই সুযোগ পাব, ভাবল কেভিন। পার্কিং এরিয়া মাত্র ছয়তলা।

উঠতে পারবে আর মাত্র পাঁচতলা, তার আগেই ভেবে বের করতে হবে কিছু।

.

কেভিন, ডাক্তার এবং বাউন্টি হান্টার যখন পার্কিং লটে সই-সাঁই করে উঠছে, ওই একইসময়ে রাস্তা থেকে গভীর মনোযোগে তাদেরকে লক্ষ করছে অন্য কেউ।

সে অপূর্ব সুন্দরী, দীঘল দুই ঊরু যেন কোনও দেবীর। সুডৌল কাঁধ, কিন্তু পেশিবহুল। শীতল, কাঠবাদামাকৃতি চোখদুটো জাপানি।

নাম তার মাসু হোকামা, কিন্তু বাউন্টি হান্টারদের সমাজে তার নাম: তুষার-শুভ্র রানি। এরই ভিতর হ্যারিস এক্স, টেরেন্সের মাথা কেটে নিয়েছে সে। এখন এসেছে ডাক্তার জেফ ওয়াকারকে কতল করতে।

শুধু কালো চামড়ার পোশাক পরে সে। পরনে এখন হিপস্টার প্যান্ট, বাইকার জ্যাকেট। পায়ে কিলার বুট। বেণী করে রেখেছে। দীর্ঘ কৃষ্ণ চুল। জ্যাকেটের নীচে দুই শোল্ডার হোলস্টারে হাই টেক টায়ার এসপিপি মেশিন পিস্তল।

রাস্তার বাঁকে এনএসএক্স হোণ্ডা স্পোর্টস কারের ইঞ্জিন চালু করল মাসু, রওনা হয়ে গেল বহুতল পার্কিং লট লক্ষ্য করে।

.

পেঁচিয়ে ওঠা র‍্যাম্পে জোরালো কিচকিচ শব্দ তুলছে দ্রুতগামী অ্যাম্বুলেন্সের চাকা। গাড়ির পিছনের দুকবাট দড়াম দড়াম খুলছে বন্ধ হচ্ছে।

তৃতীয় লেভেলে উঠে এসেছে ওরা।

আর মাত্র তিনটে তলা, তারপর উঠবে ছাতে- আর তখন আবারও সামনে বাড়বে দি আফ্রিকান।

অবশ্য আগেই কেভিন ঠিক করেছে, এরপর কী করবে।

ছয়তলা ছাত থেকে ফেলে দেবে অ্যাম্বুলেন্স আর তার আগে ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে ডাক্তারকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ছাতে। গাড়ির ভিতর থাকুক শালা বদমাশ খুনি!

ডক্টর ওয়াকার! গলা ছাডল কেভিন। চট করে চাইল বাউন্টি হান্টারের দিকে। আমার কথা মন দিয়ে শুনুন! আমরা হয়তো পরে আর কথা বলার সুযোগ পাব না! আন্তর্জাতিক বাউন্টি হান্ট শুরু হয়েছে! টার্গেট করা হয়েছে আপনাকে!

আমাকে? কেন!

এখন আপনার মাথার দাম তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার। আপনারা ন্যাটোর একটা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। আমার ধারণা সেজন্যেই আপনাকে শেষ করতে চাইছে। আপনার সঙ্গে ছিলেন ডক্টর বেইন্স। মনে পড়ে? এমএনআরআর স্টাডি। ওই পরীক্ষা কী বিষয় নিয়ে ছিল?

ভুরু কুঁচকে ফেললেন ডাক্তার। শকের ভিতর আছেন। একের পর এক প্রশ্ন জন্ম নিচ্ছে মনে। তবে বুঝতে পেরেছেন, সত্যিই তাকে শেষ করতে চাইছে কেউ।

এমএনআরআর? ওটা ছিল… ওটা…

তীব্র গতি তুলেছে অ্যাম্বুলেন্স। চারতলায় উঠে এসে গতি কমল না গাড়ির।

ওটা ছিল… সোভিয়েত কোবরা টেস্টের মতই। এমন টেস্ট, যেটাতে…

ডাক্তারের কথা শুনছে কেভিন, কিন্তু তার ফাঁকে- চট করে পিছনে চাইল। ভীষণ ভয় পেল। অনেক কাছে চলে এসেছে খুনি। হাতে ধারালো ম্যাচেটি! এবার ওর ঘাড়ের উপর নামবে ওটা! কচাৎ করে কাটা পড়বে মাথা!

বাঁচার উপায় নেই!

পালাবে কোথায়?

শ-শ আওয়াজ তুলে নেমে এল ম্যাচেটি। আটকা পড়ল কেভিনের সিটের হেডরেস্টের ফোমের ভিতর।

হেডরেস্টের ভিতরের পুরু রডে লেগে জোরালো ধাতব আওয়াজ তুলেছে ম্যাচেটি। কেভিন টের পেল, ওর ডান কানের আধ ইঞ্চি দূরে থেমেছে ক্ষুরধার ফলা।

হায় যিশু! বিড়বিড় করল কেভিন।

ঘাড়ের কাছে পৌঁছে গেছে বাউন্টি হান্টার। এত বাঁক নেয়া, এত দ্রুত ওঠা, কিন্তু সবকিছুর ভিতর এগিয়ে এসেছে লোকটা!

গাড়ি উঠে এসেছে লেভেল পাঁচ-এ।

সরু হয়ে গেল কেভিনের দুচোখ। দূরে চেয়ে রইল। মরতেই যখন হচ্ছে, তো আর ভয় পেয়ে কী হবে?

দাবিয়ে দিল গ্যাস পেডাল।

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখাল অ্যাম্বুলেন্স, ঝটকা দিয়ে বাড়ল গতি।

চল্লিশ মাইল বেগে উঠে এল শেষ বাঁকে, আরেকটু হলে কাত হয়ে আছড়ে পড়ত গাড়ি দুচাকার উপর ভর করেছে।

কয়েক মুহূর্তে পৌঁছে গেল প্রকাণ্ড ছাতে।

উপরে একটা গাড়িও নেই–ঘাসহীন ন্যাড়া বিরান প্রান্তরের মত চারপাশ ফাঁকা। অ্যাম্বুলেন্সের স্টিয়ারিং হুইল বনবন করে ঘুরিয়ে নিল কেভিন, আবারও ধুপ করে চার চাকার উপর ভর করল গাড়ি। দ্রুত আরেকদিকে সরছে বলে উল্টো দিকের দেয়ালে আছড়ে পড়ল বাউন্টি হান্টার। কেভিনের হেডরেস্টের ফোমের ভিতর রয়ে গেল তার ম্যাচেটি।

নতুন উদ্যমে গতি তুলছে কেভিন।

গাড়ির নাক তাক করেছে দূরের রেলিং লক্ষ্য করে।

ডক্টর! লাফ দিতে তৈরি থাকুন! গলা উঁচিয়ে বলল কেভিন।

রকেটের মত ছুটছে অ্যাম্বুলেন্স, কয়েক মুহূর্তে পৌঁছবে রেলিঙে।

ওটা খুবই পলকা। লাথি খেলে খসে পড়তে পারে। সিটে নড়েচড়ে বসল কেভিন। তৈরি থাকুন! এক… দুই… তি…

পিছন থেকে ড্রাইভারের সিটের উপর হামলে পড়ল খুনি। দুই হাতে ধরেছে কেভিন এবং ডাক্তারের ঘাড়। নড়তে দেবে না!

হতভম্ব হয়ে গেল কেভিন।

এবার ওরা বেরুবে কী করে? ঝড়ের মত আসছে রেলিং। গতিরুদ্ধ করা এখন অসম্ভব!

বাঁচার জন্য শেষ চেষ্টা করল কেভিন। চরকির মত ঘুরিয়ে দিল স্টিয়ারিং হুইল। একইসময়ে দাঁড়িয়ে গেল ব্রেক পেডালের উপর।

ছ্যার-ছ্যার আওয়াজ তুলে পিছলে গেল অ্যাম্বুলেন্সের পিছনদিক। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে স্কিডিং।

রেলিং উড়িয়ে দিয়ে নীচে গিয়ে পড়বার কথা অ্যাম্বুলেন্সের, কিন্তু বাঁক-নেয়ার ফাঁকে ব্রেক কষতেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে চার চাকা–বন বন করে এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরল গাড়ি। দড়াম করে পিছন দিক গিয়ে লাগল রেলিঙে।

হালকা রেলিং উড়িয়ে দিয়ে শূন্যে বেরিয়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সের পিছনদিক, ছাতে রয়ে গেছে সামনের সামান্য অংশ। তারপর শুরু হলো পতন। গাড়ির ভিতর থেকে বেরুতে পারেনি কেভিন, ডাক্তার বা বাউন্টি হান্টার।

এবার ষাট ফুট নীচে গিয়ে পড়বে ওরা।

কিন্তু ভাঙা রেলিঙের রডের জালে বাঁধা পড়ল অ্যাম্বুলেন্সের সামনের বাম্পার। ওটাই আটকে রাখল পতন। অবশ্য বেকায়দা ভাবে নামল গাড়ি, ঘড়ির পেণ্ডুলামের মত ঝুলতে লাগল।

অ্যাম্বুলেন্সের চোখ এখন বেহেস্তের দিকে। খুলে গেছে পিছনে দুই কবাট। প্যাসেঞ্জার সিটে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে আছেন ডাক্তার ওয়াকার। আছেন ভালই, কিন্তু কেভিনের কপাল মন্দ।

গাড়ি রেলিঙে গুতো দিতেই হ্যাচকা টানে কেভিনকে নিজের পাশে নিয়ে এসেছে বাউন্টি হান্টার। পরক্ষণে ছুঁড়ে ফেলেছে পিছন দিকে।

আর অ্যাম্বুলেন্স খাড়া হতেই ফুটবলের মত ডিগবাজি খেয়েছে দুজন।

গাড়ির পিছনের দুই কবাট হাট করা- ওরা দেখেছে, ষাট ফুট নীচে পাকা সিমেন্টের চাতাল।

কেভিন ও দি আফ্রিকান হাতের কাছে যা দেখেছে, খপ করে ধরতে চেয়েছে।

প্রকাণ্ডদেহী লোকটা ধরেছে চাকা লক করা স্ট্রেচার।

দেয়ালের একটা র‍্যাক ধরেছে কেভিন।

খাড়া অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর ঝুলছে ওরা, সামান্য নীচে হাঁ হয়ে আছে দরজার দুই কবাট। একবার ওদিক দিয়ে পড়লে ভর্তা হয়ে যাবে দুজন।

মনেই হলো না ভয় বলে কিছু আছে বাউন্টি হান্টারের। এখনও ডাক্তারের মাথাটা চাই তার।

একহাতে স্ট্রেচার ধরেছে, অন্যহাত বাড়াল ম্যাচেটি খুলে নিতে। ধারালো অস্ত্রটা এখনও আটকে আছে হেডরেস্টে।

না! চাপা স্বরে বলল কেভিন, র‍্যাক ধরে উঠছে।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ওর।

একহাতে চাকাওয়ালা স্ট্রেচার ধরেছে, অন্য হাতে খপ করে ম্যাচেটির হাতল ধরল খুনি। হ্যাচকা টানে খুলে নিল অস্ত্রটা।

রক্তচোখে কেভিনকে দেখল লোকটা, মুখে ফুটে উঠল ভয়ঙ্কর অশুভ হাসি। ঠোঁট ফাঁক হতেই হলদে বড়বড় দাঁতগুলো বেরিয়ে এসেছে।

বাই-বাই! চরম আঘাত হানবার জন্য সামান্য কাত হয়ে ম্যাচেটি তুলল খুনি।

তাই? আনমনে বলল কেভিন। ম্যাচেটি ঠিকই দেখেছে।

হাত ঘরিয়ে ম্যাচেটি চালাল বাউন্টি হান্টার। ধারালো ফলা নামছে কেভিনের মাথা লক্ষ্য করে। কিন্তু ওই একইসময়ে পায়ের লাথিতে স্ট্রেচারের চাকার লক খুলে দিল কেভিন।

ফলাফল হলো বিস্ময়কর।

ভারী পাথরের মত, রওনা হলো স্ট্রেচার। মুহূর্তে পেরিয়ে গেল খোলা দরজা, সঙ্গে নিয়ে চলেছে দি আফ্রিকানকে!

বিকট চিৎকার ছাড়ল লোকটা।

ধরে আছে স্ট্রেচারের পায়া। গোল হয়ে উঠেছে রক্তলাল দুই চোখ 1.

দেখতে না দেখতে দূরে চলে গেল সে।

পড়বার সময় উল্টে গেল স্ট্রেচার। আগে মেঝের উপর পড়ল বাউন্টি হান্টার। ভয়ঙ্কর বিশ্রী থ্যাপ আওয়াজ উঠল। ফেটে গেল দেহের সব যন্ত্রপাতি। তবুও বেঁচে রইল সে।

অবশ্য, তা এক মুহূর্তের জন্য।

তখনই তার মাথার উপর নামল ভারী স্ট্রেচার। চিনাবাদামের খোসার মত ফাটল লোকটার করোটি। নানাদিকে ছিটকে গেল তাজা রক্ত ও ধূসর মগজ।

পরের দুমিনিট ব্যস্ত থাকল কেভিন ও ডাক্তার ওয়াকার। খাড়া অ্যাম্বুলেন্সের ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের ভিতর দিয়ে উঠল বনেটে। ওখান থেকে রডের জাল ধরে ছাতে।

কিনারায় শুয়ে পড়ল দুজন, হাঁপাচ্ছে বেদম।

একবার নীচে উঁকি দিল কেভিন। সামান্য নীচে ঝুলছে অ্যাম্বুলেন্স। বকবক শুরু করেছেন ডাক্তার। সামলে নিতে পারেননি শক।

ওই টেস্ট… মোটর নিউরন… মোটর নিউরন র‍্যাপিডিটি অভ রেসপন্স… আমরা দুনিয়ার সেরাদের রেসপন্স টেস্ট করছিলাম। সবধরনের প্রতিক্রিয়া… চোখের দৃষ্টি… মুখের কথা… স্পর্শ করবার গতি… সব রিফ্লেক্স ছিল ওই টেস্টের মূল বিষয়।

প্রায় তিন লাখ লোকের রিফ্লেক্স টেস্ট করি। প্রত্যেকের রিফ্লেক্স আলাদা। তাদের ভিতর সেরা মাত্র কয়েকজন, অন্যরা মন্থর, বা আরও ধীর।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ বলেনি কেন ওই টেস্ট করতে হবে… অবশ্য নানাকিছু আঁচ করে নিয়েছিলাম আমরা। একদল বলছিল, এসব হচ্ছে কমাণ্ডো টিম সিলেকশনের জন্যে। আবার অন্যদল বলছিল, এসব হচ্ছে নতুন এক সিকিউরিটি সিস্টেম তৈরির জন্যে। ওই সিস্টেম দুনিয়া-সেরা… ব্যালেস্টিক মিসাইলের টাচলক-৯ সিকিউরিটি সিস্টেম… তারপর হঠাৎ করেই বন্ধ হলো ওই টেস্ট। বলা হলো ডিপার্টমেন্ট অভ ডিফেন্স প্রাথমিক প্রজেক্টটি বাতিল ২৪৫

করেছে। আর তাদের জানা হয়ে গেছে…

খচ্‌! খটাং!

অ্যাম্বুলেন্সের দিকে চেয়ে ছিল কেভিন, মন দিয়ে শুনছিল কথাগুলো, পাশে আওয়াজ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে চাইল।

হাঁ হয়ে গেল ওর মুখ। পাশে শুয়ে আছেন ডাক্তার ওয়াকার, কিন্তু মাথাটা নেই। ধড়ের গলা থেকে গলগল করে বেরুচ্ছে রক্ত, ছড়িয়ে পড়ছে ছাতে।

মাথাহীন লাশের ওপাশে দাঁড়ানো এক জাপানি অপরূপা, হাতে খাটো সামুরাই তলোয়ার। অন্যহাতে চুলের মুঠো ধরে তুলে রেখেছে ডাক্তারের মাথা।

মাসু হোকামা। বাউন্টি হান্টার। অলসভঙ্গিতে ডাক্তারের মাথা দোলাল সে। হাঁ করে চেয়ে রইল কেভিন।

মসৃণগতিতে খাপে তলোয়ার ভরল মেয়েটি, হোলস্টার থেকে নিল টায়ার এসপিপি মেশিন পিস্তল, লক্ষ্য স্থির করল কেভিনের কপালে।

অস্ত্রের সাইটের উপর দিয়ে কেভিনকে দেখছে। পলক পড়ছে না দুচোখে। চাহনি বরফের মত শীতল। এক সেকেণ্ড পর অদ্ভুতভাবে ভুরু কোঁচকাল রূপসী, থুতনি তাক করল কেভিনের দিকে। রিনরিনে কণ্ঠে বলল, তুমি বোধহয় বাউন্টি হান্টার নও?

না… তিক্ত স্বরে বলল কেভিন। তা নই।

তা হলে দি আফ্রিকানের সঙ্গে লড়ছিলে কেন?

আমার এক বন্ধুর নাম উঠেছে ওই বাউন্টি লিস্টে। আমি ওকে সাহায্য করতে চাই।

আচ্ছা? অবাক হয়েছে যুবতী। এই লোক তোমার বন্ধু?

না, তা নয়, আমার বন্ধু এখন অন্য দেশে।

আর তুমি আফ্রিকানের সঙ্গে লড়েছ বন্ধুর জন্যে?

হুঁ।

ভুরু স্বাভাবিক হলো: মাসুর, সত্যিকারের কৌতূহল নিয়ে বলল, বন্ধু-পাগল, তোমার বন্ধুটির নাম কী?

মাসুদ রানা।

আর তোমার নাম?

কেভিন কনলন।

কেভিন কনলন, আস্তে করে উচ্চারণ করল জাপানি যুবতী। আগে কখনও কারও প্রতি কাউকে এত বিশ্বস্ত হতে দেখিনি।

দেখোনি? বলল কেভিন।

না। মাথা নাড়ল মাসু। তোমার কাছ থেকে বহু কিছু শেখার আছে তোমার বন্ধুর। তুমি রীতিমত প্রেমে ফেলে দিচ্ছ আমাকে। এতে ক্ষতি হবে আমাদের।

তাই?

হ্যাঁ। আস্তে করে মাথা দোলাল তরুণী। তারপরও বাঁচতে দেব তোমাকে। দেখা যাক বন্ধুকে সাহায্য করতে পারো কি না। হয়তো আবারও দেখা হবে আমাদের। তখন পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, কেভিন কনলন, তখন যদি তোমার বন্ধুকে বাঁচাতে চাও, আমি বাধ্য হয়েই তোমাকেও শেষ করব। তখন কোনও সুবিধা পাবে না আমার কাছ থেকে।

অস্ত্রটা হোলস্টারে রেখে দিল মাসু, চরকির মত ঘুরে রওনা হয়ে গেল। ডাক্তারের মাথাটা নিয়ে উঠে পড়ল নিচু ছাতের স্পোর্টস্ কারে।

রওনা হয়ে গেল গাড়ি। হাই স্পিড হোণ্ডার দিকে চেয়ে রইল কেভিন।

ওর চোখ ফিরল ডাক্তারের মুণ্ডহীন ধড়ের উপর।

মাঝ আকাশ থেকে অনল বর্ষণ করছে সূর্য।

দূর থেকে কাছে আসছে পুলিশের গাড়ির সাইরেন। লাশের দিকে চেয়ে গলগল করে বমি শুরু করল কেভিন।

.

লণ্ডনের পশ্চিমে চল্লিশ মাইল দূরে।

পরিত্যক্ত হোয়াইটমোর এয়ারফিল্ড। ব্রিটিশ সময় বিকেল চারটা।

এইমাত্র চোরাই লিঙ্কস কপ্টার নিয়ে পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডে। নামতে শুরু করেছে নিশাত ও খবির।

ওদেরকে এখানেই নামিয়ে দিয়েছিল রঘুপতি।

নিশাত-খবির আশা করেনি এখনও বসে থাকবে রঘুপতি। রোবট জানিয়েছিল, কিছুক্ষণ পর বিজ্ঞানীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য ফ্রান্সে যাবে।

কিন্তু ওরা উড়ন্ত কপ্টার থেকে দেখল, পুরনো হ্যাঙারের বাইরে পার্ক করা রয়েছে কালো বিমান। ওটাকে ঘিরে ফেলেছে।

পুলিশের গাড়ি। মাথার উপর জ্বলছে লাল-নীল আলো।

বিমানের পাশেই রানওয়েতে বিষাদ নিয়ে বসে আছে। রঘুপতি, অসহায় চেহারা। ট্রেঞ্চকোট পরা ছয়জন লোক ঘিরে। রেখেছে তাকে। এ ছাড়া লোকগুলোর সঙ্গে রয়েছে ভারী অস্ত্র সজ্জিত এক প্লাটুন রয়াল মেরিন।

কপ্টার নিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসতেই আটক করা হলো। নিশাত ও খবিরকে।

ওদের দিকে এগিয়ে এল ট্রেঞ্চকোটদের একজন। বয়সে যুবক সে, হাতে সেলফোন। ওদিকের কারও সঙ্গে কথা বলছে।

উচ্চারণে বোঝা গেল, সে আমেরিকান।

ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা এবং সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত খবির, আমি চার্লস ডেলাস। লণ্ডন অফিসের ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টে আছি। জানতে পেরেছি, আপনারা বিসিআই এজেন্ট মাসুদ রানাকে সহায়তা করছেন। তিনি প্রাণ বাঁচাতে লড়ছেন। আরও জেনেছি, একটি আন্তর্জাতিক বাউন্টি হান্ট চলছে।…আমি কি ঠিক বলেছি?

আস্তে করে মাথা দোলাল নিশাত ও খুবির।

হ্যাঁ… তা ঠিকই বলেছেন, বলল নিশাত।

ইউনাইটেড স্টেটস সরকার এই বাউন্টি হান্ট সম্পর্কে বহু কিছুই জেনেছে। তথ্য যা পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে: আমাদের দেশের জন্য বিসিআই এজেণ্ট মাসুদ রানাকে জীবিত রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। …আপনারা কি জানেন তিনি এখন কোথায়?

হয়তো জানি, বলল নিশাত, আগে বলুন কেন ওঁকে চাই আপনাদের।

মস্ত কোনও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়েছেন আপনারা? টিটকারির সুরে জানতে চাইল খবির।

লালচে হয়ে গেল চার্লস ডেলাক্রসের গাল। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।

আরে বলে ফেলুন, হালকা সুরে বলল নিশাত। আমরা মুখ খোলার আগে আপনাদের পেটের খবর জানতে চাই।

প্লিয, ম্যাম, আমি সামান্য বার্তাবাহক, নরম স্বরে বলল যুবক। পুরো কাহিনি শুনবার ক্লিয়ারেন্স নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাদের কোনও ক্ষতি করে দেয়া বা আটক করবার দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়নি। বলা হয়েছে: এক বা একাধিক লোক ওই বাউন্টি হান্টের পিছনে জড়িত। তাদের এমনই ক্ষমতা, ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এর বাইরে কোনও তথ্য আমাকে দেয়া হয়নি। জানিও না তেমন কিছু।

শুধু জানিঃ ইউনাইটেড স্টেটস্‌ অভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছেন আমাকে। নির্দেশের শুরুতেই উনি জানিয়ে দিয়েছেন: আপনারা সাহায্য চাইলে, তা দেব আমরা। মেজর রানাকে জীবিত রাখবার কাজে আসবে, এমন যে-কোনও কিছু চাইলেই দেয়া হবে। কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সে ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়েছে। আপনারা প্রয়োজনে অস্ত্র চাইতে পারেন। নির্দেশ অনুযায়ী সঙ্গে সঙ্গে তা জোগান দেব। যদি টাকা লাগে, সঙ্গে সঙ্গে হাজির করব। মুখ ফুটে শুধু জানান পরিমাণ। যদি চান এয়ার ফোর্স ওয়ানে করে কোথাও যাবেন, সঙ্গে সঙ্গে তাই করা হবে।

তা হলে একদিনের জন্য প্রেসিডেন্ট হতে চাই, বিড়বিড় করল খবির।

কী কারণে আপনাকে বিশ্বাস করব আমরা? জানতে চাইল নিশাত।

ওর দিকে সেলফোন বাড়িয়ে দিল ডেলাস। ওটা নিয়ে কানে লাগাল নিশাত।

ওদিকে কে? কী বলবেন শুনি?

ক্যাপ্টেন নিশাত? গম্ভীর কণ্ঠ বলল।

সঙ্গে সঙ্গে ওই কণ্ঠ চিনে ফেলল নিশাত। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট।

এয়ার বেস যিরো নাইন মিশনে ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওর।

ওই গলা অন্য কারও নয়।

ক্যাপ্টেন নিশাত, বললেন প্রেসিডেন্ট। ইউনাইটেড স্টেটস সরকারের সমস্ত ক্ষমতা আপনি ব্যবহার করতে পারেন। যা লাগবে, শুধু জানিয়ে দিন আণ্ডারসেক্রেটারি ডেলাসকে। যে ভাবে হোক জীবিত রাখতে হবে মেজর রানাকে। …আপাতত মিটিঙে যোগ দেব। পরে আবারও কথা হবে।

খুট করে কেটে গেল, ফোন যোগাযোগ।

তার মানে মস্ত বিপদে পড়িনি, বিড়বিড় করল নিশাত।

ওঁর কথা তো নিজ কানেই শুনলেন, বলত, ডেলাক্রস। এ মুহূর্তে কী চাই আপনাদের?

চোখে চোখে কথা হলো নিশাত ও খবিরের।

খবির, বলল নিশাত, তুমি যাও এঁর সঙ্গে, খুঁজে বের করবে আসলে কী ঘটছে। এদিকে আমি যাব স্যরকে সরিয়ে নিতে।

আস্তে করে মাথা দোলাল খবির।

ঘুরে দাঁড়িয়ে রঘুপতির দিকে চাইল নিশাত। কিন্তু কথা বলল ডেলাসের উদ্দেশে, ওকে চাই আমি। ওর বিমানটাও লাগবে। ভরে দেবেন বিমানের ট্যাঙ্ক। এ ছাড়া ইংল্যাণ্ড ছাড়ার অনুমতিও চাই। আমরা জানি এ মুহূর্তে কোথায় আছেন মাসুদ স্যর। আগে ওঁকে সরিয়ে আনতে হবে।

আমি বোধহয় অনেক দ্রুত ওঁকে সরিয়ে…

হয়তো, ডেলাসকে থামিয়ে দিল নিশাত, কিন্তু আমরা এখনও। আপনাকে বিশ্বাস করি না। রঘুপতিকে দেখাল। ও সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত। তা ছাড়া, ওর বদলে অন্য কেউ এত দ্রুত আমাকে ফ্রান্সে পৌঁছে দিতে পারবে না।

ঠিক আছে, নিজের এক লোকের দিকে চাইল ডেলাস। বিমানে ফিউয়েল পাম্প করো। আকাশ ফাঁকা রাখতে বলো।

খবিরের দিকে ফিরল সে। আর আপনি কী করবেন, সার্জেন্ট?

আপা, আপনার কপাল ভাল থাকুক, বলল খবির। স্যরকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন।

তা আমি করব, নিশ্চয়তা দিয়েই বলল নিশাত। পা বাড়াল রঘুপতি ও সুখোই ফাইটার বিমানের দিকে।

পাঁচ মিনিট পর ভরে গেল বিমানের ট্যাঙ্ক। পরের মিনিটে আকাশে উঠল ফাইটার, আফটারবার্নার ব্যবহার করে তীব্র গতি তুলে রওনা হয়ে গেল।

নিশাত ও রঘুপতিকে নিয়ে বিমান উধাও হতেই ডেলাসের দিকে চাইল খবির। আমার একটা ডিভিডি প্লেয়ার লাগবে।

উনিশ

ব্রিটানি-আটলান্টিক উপকূল, ফ্রান্স।

ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

বিকেল সাড়ে চারটা।

মেইন ল্যাণ্ড ও দুর্গের মাঝের প্রকাণ্ড পাথুরে সেতু পেরুতে শুরু করেছে তিনজন মানুষ–মাসুদ রানা, কুয়াশা ও তিশা করিম। প্রত্যেকের হাতে একটা করে সাদা মেডিকেল ট্রান্সপোর্ট বক্স।

তিনটে বাক্স মানেই তিনটে ছিন্ন মাথা।

রানা আপাতত দুনিয়ার সেরা কাক্ষিত লোকগুলোর একজন। জানে, ঢুকতে চলেছে ক্ষুধার্ত সিংহের গুহায়। এখান থেকেই পরিচালিত হচ্ছে বাউন্টি হান্ট।

মেকআপ করে রানা ও তিশার মুখ সামান্য বদলে দিয়েছে। কুয়াশা

রানা ও তিশার পরনে বাউন্টি হান্টার দল কন্টিনেন্টাল সোলজারদের কালো ব্যাটল ইউনিফর্ম, মাথায় হেলমেট। সবই এসেছে হারকিউলিস বিমান থেকে। নিজেদের অস্ত্র তো আছেই, এ ছাড়া রয়েছে মেটালস্টর্ম রাইফেল। পরিস্থিতি বোঝাবার জন্য চোয়ালে দুটো রক্তাক্ত রুমাল বেঁধেছে রানা। চোখে রে-ব্যান সানগ্লাস। মুখের বেশিরভাগই ঢাকা পড়েছে।

ওর পকেটে রয়েছে কুয়াশার মডিফায়েড পাম পাইলট।

দুর্গের ডোরবেল বাজাল কুয়াশা। আগের মতই ওর পরনে কালো আলখেল্লা! নিচু স্বরে সে বলল, বাক্সগুলো আমার হাতে দিয়ে দাও। অ্যাসেসরের কাছে দেব। সে অপেক্ষা করতে বলবে। তোমাদেরকে। শুনেছি জায়গাটা কারাগারের মত।

কারাগারের মত?

হুঁ। অ্যাসেসর চায় না কোনও বাউন্টি হান্টার তার অফিসে ঢুকুক। নইলে কমপিউটার ব্যবহার করে ফাণ্ড সরিয়ে নিত। কেউ। শুনেছি আগেও এমন হয়েছে। কাজেই নিজেকে রক্ষা করতে ভয়ঙ্কর সব পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যাসেসররা। …আর যার কথা ভাবছি, এ লোক সে হলে তাকে খুনি-পিশাচও বলতে পারো।

আস্তে করে কাধ ঝাঁকাল কুয়াশা। যাই হোক, চোখ রেখো পাম পাইলটের স্ক্রিনে। দেখা যাক কমপিউটার থেকে কী ধরনের তথ্য আসে। হয়তো জানা যাবে কে বা কারা শুরু করেছে এই বাউন্টি হান্ট।

নিজের পকেটে একই ধরনের পাম পাইলট রেখেছে কুয়াশা। ওটা ইফ্রা-রেড ব্যবহার করে ডেটা ট্রান্সফার করে। কোনও তারের সংযোগ লাগে না, কমপিউটারের হার্ডডিস্ক থেকে নিয়ে নিজের মগজে রাখে তথ্য। সোজা কথায়, কুয়াশার যন্ত্র যে কোনও কমপিউটারের ডেটা চুরি করতে পারে। সেজন্য ওটাকে। নিতে হয় কমপিউটারের দশফুটের ভিতর।–

খুলে গেল দুর্গের প্রকাণ্ড কবাট।

সুসজ্জিত পোশাকে দেখা দিল মোসিউ ড্যাবলার।

কাকে চাই, মোসিউরস?

আমি কুয়াশা। অনেকে চেনেন মিস্টার ফগ নামে।

আগেও আপনার নাম শুনেছি… প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। …কী করতে পারি আপনার জন্যে?

বাধ্য হয়ে বাউন্টি হান্ট করছি। টাকার প্রয়োজন সবারই।

তাই?

মোসিউ ড্যাবলার, আমি এবং আমার সঙ্গের দুজন বাউন্টির টাকা নিতেই এসেছি।

নিশ্চয়ই নেবেন, শুকনো স্বরে বলল ড্যাবলার। আপনাদের দুজনের পরনে দেখছি কন্টিনেন্টাল সোলজারদের ছেষট্টি ইউনিটের পোশাক।

এরা ওই ইউনিটেরই লোক, জানাল কুয়াশা। আমাকে সহায়তা করছে।

জানতাম না ডেভিড এন. হেন্ড্রিক নতুন লোক নিয়েছে।

আজকাল ভাল লোক পাওয়া কঠিন, বলল কুয়াশা। হেণ্ডিক ভাগ্যবান লোক।

তা অবশ্য ঠিক, মাথা দোলাল ড্যাবলার। বেশ, আমার সঙ্গে আসুন।

দুর্গের শো-রুমের মত গ্যারাজে এসে ঢুকল সবাই।

দুর্লভ গাড়িগুলো দেখে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না রানা। কী নেই গ্যারাজে: সারা দুনিয়ার সেরা সব গাড়ি।

সবার আগে হাঁটছে ব্যাঙ্কার ড্যাবলার। সামনে রেখেছে। হ্যাণ্ডকার্ট, ওটার উপর তিনটি সাদা বাক্স।

চমৎকার দুর্গ, মন্তব্য করল কুয়াশা।

সত্যিই দেখার মত, প্রশংসা ঝরল ব্যাঙ্কারের কণ্ঠে।

দুর্গের মালিক কে?

অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত এক ভদ্রলোক।

তার নাম জানতে…

দুঃখিত, অনেক সময় আমাকে বাধ্য হয়েই মক্কেলের নাম গোপন করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও বলে দেয়া হয়েছে, মুখ বুজে রাখতে হবে।

আচ্ছা। চুপ হয়ে গেল কুয়াশা। কয়েক মুহূর্তে পর জানতে চাইল, সঙ্গে অস্ত্র রাখলে আপত্তি নেই তো?

না, নেই। মনে হলো না চিন্তিত ড্যাবলার। ওই জিনিস। এখানে কাজে আসবে না।

গ্যারাজের শেষে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। সামনেই গোলাকার পাথুরে অ্যান্টিরুম। এখান থেকে দূরে হারিয়ে। গেছে সরু সুড়ঙ্গ।

থামল ড্যাবলার। আপনার দুই সঙ্গীকে এখানেই থাকতে হবে, মিস্টার কুয়াশা।

রানা ও তিশার দিকে মাথার ইশারা করল কুয়াশা। ভাববেন। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে দরজা বোধহয় লক করে দেয়া হবে।

দেয়াল ঘেঁষা চামড়ার আরামদায়ক কাউচে বসে পড়ল রানা ও তিশা।

মশাল প্রজ্জ্বলিত সরু টানেলে কুয়াশাকে পথ দেখাল ব্যাঙ্কার। আগুনের হলদে আলো পড়ছে চারপাশে।

প্যাসেজওয়ের শেষে পৌঁছে গেল ওরা। সামনে অত্যন্ত দামি আসবাবপত্রে সজ্জিত অফিস। কুয়াশাকে টানেলে রেখে অফিসে ঢুকে পড়ল ব্যাঙ্কার। হাতে রিমোট কন্ট্রোল।

দড়াম! দড়াম! দড়াম!

টানেলের দুদিকে নামল স্টিলের দরজা। টানেলে আটকা পড়ল কুয়াশা। অ্যাণ্টিরুমে বন্দি হয়েছে রানা ও তিশা।

চোখের পাতাও পড়ল না কুয়াশার।

কাটা মাথাগুলো পরীক্ষা করতে শুরু করেছে ব্যাঙ্কার। এসব কঙ্গোতে সংগ্রহ করেছিল ডেভিড এন. হেন্ড্রিক। আলাল হোসেন, আজিজ আমিন ও চার্লস আর. কোসলোস্কির মাথা। ওগুলোর উপর প্রয়োগ করা হচ্ছে লেসার স্ক্যান, ডেন্টাল পরীক্ষা, ডিএনএ টেস্ট

দীর্ঘ পাথুরে টানেলে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা। অপেক্ষা করছে। আপাতত বন্দি।

দেয়ালে ফুটন্ত তেলের নর্দমা চোখে পড়ল তার।

জঘন্য, বিড়বিড় করে বলল।

স্টিলের দরজার বুকে পুরু প্লাস্টিকের জানালা। ওদিক দিয়ে দেখা গেল ড্যাবলারের অফিসের ভেতরের অংশ।

ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে সুইস ব্যাঙ্কার। ডেস্কের ওদিকে মস্ত পিকচার উইণ্ডো। বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ে আটলান্টিক মহাসাগর। নীলের বিস্তৃতি উদাস করে তোলে মন। নিজের প্রিয় বঙ্গোপসাগরের কথা মনে পড়ল কুয়াশার। কী অদ্ভুত সুন্দর ওর দেশের সাগরটা।

দূরে দেখা গেল দিগন্তের কাছে একের পর এক নেভাল। ভেসেল। ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট… মস্ত এক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে ঘিরে রেখেছে। প্রকাণ্ড জাহাজটাকে চিনল কুয়াশা- চার্লস দ্য গল ক্লাস ক্যারিয়ার, নিউক্লিয়ার পাওয়ার্ড।

সাগরে জড় হয়েছে ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ।

ফ্রেঞ্চদের।

.

অ্যাণ্টিরুমে চুপ করে বসে আছে মাসুদ রানা ও তিশা।

সিলিঙের কাছে ছরছর আওয়াজ তুলছে কী যেন। ওদিকে চাইল রানা।

অদ্ভুত চেহারার ছয়টি অ্যান্টেনা, গেঁথে আছে দেয়ালে। দেখে মনে হলো, কোনও ধরনের স্টেরিয়ো স্পিকার।

অবশ্য, রানা বুঝে গেল ওগুলো মাইক্রোওয়েভ এমিটার।

ছিরছির আওয়াজটা আসছে সিকিউরিটি ক্যামেরা থেকে।

আমাদের ওপর চোখ রাখছে, নিচু স্বরে বাংলায় বলল রানা।

দুর্গের দূরের কোনও কামরায় সাদা-কালো মনিটরে রানা ও তিশাকে দেখছে এক লোক গভীর মনোযোগে। বিশেষ করে নজর তার রানার ব্যাণ্ডেজ ও সানগ্লাসের উপর।

.

সমস্ত টেস্ট শেষ করেছে মোসিউ ড্যাবলার। টানেলে বন্দি কুয়াশার দিকে চাইল সে।

মিস্টার কুয়াশা, ইন্টারকমে বলল, কগ্র্যাচুলেশন্স। প্রতিটি মাথা পারফেক্ট স্কোর করেছে। আপনারা পাবেন নিরানব্বই মিলিয়ন ডলার।

রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপল সে, স্লট থেকে উপরে উঠল তিন দরজা।

ড্যাবলারের অফিসে ঢুকল কুয়াশা। মস্ত ডেস্কের পিছনে বসে পড়ল সুইস ব্যাঙ্কার। ল্যাপটপের কিবোর্ডে টোকা দিতে শুরু করেছে।

হুম, কিবোর্ডে আরও কয়েকটা টোকা দিল, আপনারা বাউন্টির টাকা কোন্ অ্যাকাউন্টে ট্র্যান্সফার করবেন?

আপনার ব্যাঙ্কেই আমার অ্যাকাউন্ট আছে, ওখানে পাঠিয়ে দিন, ওই কমপিউটারের উপর চোখ কুয়াশার। পাম পাইলটের ট্রান্সমিট বাটন টিপে দিল।

দুই কমপিউটারের ভিতর তথ্য আদান-প্রদান শুরু হয়েছে।

.

পাথরের অ্যাণ্টিরুমে পাম পাইলট জেগে উঠেছে, দেখল রানা।

দ্রুত আসছে ডেটা। নাম, সংখ্যা এবং ডায়াগ্রাম ফুটে উঠছে স্ক্রিনে:

সোর্স। ডেলিভারি সিস্টেম। লি-এইচ। অরিজিন। টাগের্ট। টাইম।

ট্যালবট :

সাহাব-৫ টিএন৭টি ৩৫৭০২. ০০০০১. ১১:৪৫

সাহাব-৫ টিএনবি ৩৫৭০২. ০০৪২০ ১১:৪৫

সাহাব-৫ টিএন৭বি ৩৫৭০৩., ০১৩১২. ১২:০০

অ্যামব্আ:

সাহাব-৫ টিএন৭বি ২৬৭৫৩. ২ ফ্লাইট? ১২:০০

একযেকিউটিভ ইটিনেরারি

দ্য প্রোপোযড অর্ডার অফ ট্র্যাভেল ইয অ্যায ফলোয: আসমারা (২৪/০৬), লৌণ্ডা (২৪/০৬), আবুজা (২৭/০৬), নাযামেনা

(২৭/০৬) এবং ব্রুক (২৯/০৬).

০১/০৭- আসমারা (এম্বেসি)

০৩/০৭–লৌণ্ডা (থাকছি ওলিফ্যাণ্টের ভাতিজার ওখানে)

শেষ ডকুমেন্ট চিনল রানা। একটা বাউন্টি লিস্ট।

নাম – দেশ – অর্গানাইযেশন

১ ক্যাপলান এম, স্কট – ইউ.কে. – এসএএস

২. ডওসন কে. রিচার্ড – ইউ.কে. – এমআই-৬

৩. অ্যাটলক, হার্লি – ইউএসএ – ডেল্টা

৪. আমিন, আজিজ – লেবানন – আলকায়েদা

৫. কার্লটন, রবিন – ইউএসএ – মেরিন

৬. চার্লস আর, কোসলোস্কি – ইউ.কে. – এসএএস

অন্যান্য ডকুমেন্ট ডাউনলোড করছে পাম পাইলট, কিন্তু সাবধানে আড়াল তৈরি করে হত্যা তালিকায় চোখ বোলাল রানা।

একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র অন্যতম নেতা কার্ট কে, এবেলহার্ডের কাছ থেকে যে তালিকা পেয়েছিল, তার সঙ্গে এর সামান্য তফাৎ আছে।

কিছু নাম ছাই রঙে হাই লাইট করা। মৃতের জন্য ধূসর রং, ভাবল রানা। মেরুদণ্ড বেয়ে নামল শীতল অনুভূতি। লাশ হয়ে গেছে অনেকেই।

স্কট এম. ক্যাপলান এবং রেমণ্ড কে. এ্যাঞ্জারের নাম ওই। তালিকায় তুলে দিতে পারবে রানা। স্পেন্যায বাউন্টি হান্টাররা, ক্যাপলানকে শেষ করেছে কঙ্গোর খনির ভিতর। আর কার্গো বিমানে নিহত হয়েছেন জেনারেল রেমণ্ড কে. গ্র্যাঞ্জার।

এ তালিকার পনেরোজনের ভিতর এখনও বেঁচেবর্তে আছে মাত্র পাঁচজন।

তালিকায় আরও মনোযোগ দিল রানা। ভীষণ অস্বস্তি মনে, কিন্তু বিষয়টি কী বুঝতে পারছে না… তারপর আরেকটা ডকুমেন্টে অ্যাসেসর শব্দটা চোখে পড়ল। ওই ডকুমেন্ট ওপেন করল রানা। ওটা একটা ই-মেইল:

বিষয়: অ্যাসেসরের কমিশন

অ্যাসেসরের প্রাপ্য কমিশন দেয়া হবে ইন্টারনাল ইলেকট্রনিক ফাণ্ডের মাধ্যমে। অ্যাসেসর টাকা পাবেন স্করপিয়ন-১৫ প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের (নং ১২৪-৪৪৪-২৪) মাধ্যমে। প্রতিটি অ্যাসেসমেন্টের জন্য তাঁকে দেয়া হবে ইউএস ৫ মিলিয়ন ডলার। এজিএম-সুইস ব্যাঙ্কের মর্মাসিউ পি. এস. ড্যাবলার অ্যাসেসরের দায়িত্ব নেবেন।

শব্দগুলোর উপর আবারও চোখ বোলাল রানা।

স্করপিয়ন-১৫ প্রাইভেট লিমিটেড, ভাবল। টাকা দেবে ওই কোম্পানি থেকেই। তারাই আয়োজন করেছে বাউন্টি হান্ট। চমৎকার পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠ বলে উঠল, গুড মর্নিং। মুখ তুলে চাইল রানা ও তিশা।

পাথুরে সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়েছে এক হ্যাণ্ডসাম যুবক, এইমাত্র। গ্যারাজ থেকে ঢুকেছে অ্যান্টিরুমে। বয়স পঁচিশ থেকে সাতাশ। পরনে ডিযাইনার জিন্স। টি-শার্টের উপর রালফ লরেন্স শার্ট। অত্যন্ত অভিজাত মনে হলো তাকে।

যুবকের চোখে অস্বাভাবিকতা দেখল রানা।

তার এক চোখের মণি গাঢ় নীল, অন্যটা পচা ডিমের কুসুমের মত হলদেটে।

আমার দুর্গে আপনাদের স্বাগতম, যুবক হাসল। কিন্তু ওই হাসি কেন যেন রানার ভাল লাগল না। মনে হলো, এ লোক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। জানতে পারি আপনারা কারা?

ক্লিন্ট, জন ক্লিণ্ট, নিজ পরিচয় দিল রানা। ইনি জেসিকা রনসন। মিস্টার ফগের সঙ্গে এসেছি। কয়েকটি বাউন্টি এনেছি। মোসিউ ড্যাবলারের জন্যে।

ও, আচ্ছা… বলল যুবক। রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। করমর্দনের জন্য।

ডেমিয়েন… ডেমিয়েন ডগলাস। আপনাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে খুব ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। আপনাদের জন্যে কোনও ড্রিঙ্ক বা খাবারের ব্যবস্থা করি? করমর্দনের সময় রানাকে দেখল। মনোযোগ দিয়ে। আপনি চাইলে আমার ব্যক্তিগত ডাক্তার আপনার ব্যাণ্ডেজ পাল্টে দিতে পারে। ক্ষতগুলোও পরিষ্কার করা উচিত।

চট করে সরু টানেল দেখল রানা। চোখ খুঁজছে কুয়াশাকে।

প্লিয, আসুন… সিঁড়ি দেখাল ডগলাস।

কোনও আপত্তি তোলা একেবারেই অনুচিত হবে, উঠে দাঁড়াল রানা ও তিশা। অনুসরণ করল লোকটার।

আগেও আপনাকে দেখেছি, পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা। টিভিতে…

মাঝে মাঝে আমাকে ওই রুপালি পর্দায় মুখ দেখাতে হয়।

আপনি আফ্রিকায় ছিলেন, বলল রানা, গতবছর। একের পর এক ফ্যাক্টরি উদ্বোধন করছিলেন। খাবারের ফ্যাক্টরি। নাইজেরিয়ায়…

এখন সামান্যতম মিথ্যা বলছে না রানা।

আফ্রিকার কজন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করছিল এ লোক। সামনের মস্ত মাঠে ছিল হাজারো শ্রমিক, হাসি-খুশি।

ওরা আবার চলে এসেছে ক্লাসিক সব গাড়ির গ্যারাজে।

আপনার স্মৃতি জোরালো, বলল ডগলাস। ইরিত্রিয়া, চাঁদ, অ্যাঙ্গোলা এবং লিবিয়ায় গিয়েছিলাম। এসব দেশে বসাই নতুন ফুড প্রসেসিং প্লান্ট। কেউ কেউ আজও জানে না পৃথিবীর ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে ওই আফ্রিকাতেই।

আপনার গাড়ির কালেকশন সত্যিই ঈর্ষণীয়, মন্তব্য করল।

ওগুলোকে খেলনা বলতে পারেন, বলল ডগলাস। সামান্য খেলনা। এর বেশি কিছু নয়।

গ্যারাজের একদিকের শাখা টানেলে ঢুকল ওরা। সুড়ঙ্গের মেঝে কুচকুচে কালো, দুই দেয়াল ধবধবে সাদা।

আমি অবশ্য নানান খেলনা নিয়ে খেলতে ভালবাসি, বলল ডেমিয়েন। মানুষ নিয়ে খেলতেও মজা লাগে। কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ কী করে, তা দেখে খুব উৎসাহিত হই।

কাঠের মস্ত এক দরজার সামনে পৌঁছে গেছে ওরা। দরজার ওদিকে হাসির আওয়াজ। পুরুষ কণ্ঠ। যেন পার্টি চলছে ওদিকে।

আপনি বলছিলেন কঠিন পরিস্থিতির কথা, বলল রানা। গলা শুকিয়ে গেছে। আসলে কী বোঝাতে চাইছেন, ডগলাস?

যেমন ধরুন, পশ্চিমারা বোঝে না কেন ইসলামপন্থীরা বোমা দিয়ে নিজেদেরকে উড়িয়ে দেয়। ছোটবেলা থেকে পশ্চিমা বাচ্চাদেরকে শেখানো হয় লড়তে হবে সমানে সমানে। লড়াই যেন হয় ন্যায্য। ফ্রেঞ্চরা দশ কদম দূর থেকে ডুয়েল করত, ইংরেজরাও দূরত্ব দিয়ে জস্টিং করত, আমেরিকার বুনো পশ্চিমের শহরের রাস্তায় মুখোমুখি লড়ত গানশ্লিংগাররা। পশ্চিমা দুনিয়ায় লড়াই জিনিসটা ন্যায় সঙ্গত। কারণ ধরে নেয়া হয়েছে, দুই পক্ষই বিজয়ী হতে চাইবে। এটা সত্যিকারের ন্যায্য চিন্তা।

ডেমিয়েন থেমে যেতেই বলল রানা, কিন্তু আত্মহত্যাকারী বোমাবাজরা অন্যভাবে চিন্তা করে, আপনি বোধহয় তাই বোঝাতে চাইছেন?

ঠিকই ধরেছেন, বলল ডগলাস। বোমাবাজ বিজয়ী হতে চায়। কিন্তু লড়াই তাদের কাছে মূল্যহীন। আরও মস্ত এক লড়াই তাদের সামনে। মানসিক লড়াই ওটা। ইচ্ছের বিরুদ্ধে মরতে চায় কেই-বা, তবুও এরা শেষ করে নিজ জীবন আশা করে আরও বহু মানুষ কষ্ট পাবে এবং মরবে তার কারণে। আত্মহত্যাকারী বোমাবাজ মনে করে এর মাধ্যমে আত্মিকভাবে বিজয়ী হবে সে।

যখন কোনও পশ্চিমা ছিন্নভিন্ন হচ্ছে বোমার আঘাতে, ধরে নেয়া হচ্ছে, সে যাবে নরকে। নিজ চোখে এসব মানুষকে মরতে দেখেছি। কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছি। ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, বা হাঙরের মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে কাউকে… আসলে মানুষের সত্যিকারের আতঙ্ক দেখতে ভাল লাগে আমার। যখন বোঝে কীভাবে মরতে চলেছে, তখন মুখে ফোটে দারুণ আতঙ্ক। দারুণ দৃশ্য!

দরজা খুলতে শুরু করেছে ডেমিয়েন ডগলাস। আর তখনই সব বুঝে গেল রানা। সমস্যা ওই মাস্টার লিস্টেই।

হার্লি অ্যাটলক এবং রবিন কার্লটনের নাম ধূসর শেডে। গতকাল সকালে সাইবেরিয়ায় নিহত হয়েছে ওরা। এবং মৃতের তালিকায় তুলে দেয়া হয়েছে ওদের নাম।

অর্থাৎ, টাকা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে!

অথচ সাইবেরিয়ার ওই ওয়্যারহাউস বা বাউন্টি হান্টারদের ধুলোয় মিশে যাওয়ার কথা মিসাইলের আঘাতে!

প্রকাণ্ড দরজা খুলেছে।

ওদিকে মস্ত ডাইনিং রুম।

টেবিল ঘিরে একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র কমপক্ষে বিশজন বাউন্টি হান্টার!

সামনে দামি খাবার, পাশে দুর্লভ সোনালি পানীয়, কাছের অ্যাশট্রেতে সিগারেট বা চুরুট।

টেবিলের একমাথায় ব্যাণ্ডেজে মোড়া ভাঙা নাক নিয়ে নতুন। পোশাকে বসে আছে কার্ট কে. এবেলহার্ড!

ধড়াস্ করে মস্ত লাফ দিল রানার হৃৎপিণ্ড।

আর এ ধরনের প্রতিক্রিয়াই দেখি সাধারণ মানুষের মুখে, বলল ডগলাস। সরু ঠোঁটে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হাসি। স্বাগতম আমার দুর্গে, মেজর মাসুদ রানা!

যা বুঝবার বোঝা হয়ে গেছে।

পরস্পরের দিকে চাইল রানা ও তিশা, পরক্ষণে ঘুরেই ঝেড়ে দৌড় লাগাল।

যেন লেজ আকাশে তুলে উড়ে চলেছে।

পিছনে পড়ে রইল ডাইনিং রুম। করিডোর ধরে তীরের মত ছুটছে রানা ও তিশা। পিছনে শুনল ডগলাসের পেটফাটা হাসির আওয়াজ।

একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র বাউন্টি হান্টাররা লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়েছে, খপ করে তুলে নিয়েছে যার যার অস্ত্র, পরক্ষণে শুরু করল ধাওয়া।

পাঁই-পাঁই করে ভাগছে ওদের সাধের তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার!

দুর্গের মালিক ডেমিয়েন ডগলাসকে ঝোড়ো গতিতে পাশ কাটাল লোকগুলো।

.

এত দামি গাড়ির কোনটা নেব ভাবতে গিয়ে মাথা গরম হচ্ছে, মুখ থেকে ব্যাণ্ডেজ ছুঁড়ে ফেলল রানা।

গ্যারাজের দরজার কাছ থেকে নিচু স্বরে বলল তিশা, যেটা তোমার খুশি। চট করে কাঁধের উপর দিয়ে করিডোরের দিকে চাইল। ধুপধাপ বুটের আওয়াজ আসছে। বড়জোর দশ সেকেণ্ড পাবে, রানা। দ্রুতগতি কোনও গাড়ি নাও।

একসেকিউশন জিটি-২? রুপালি রঙের। খোলা টারগা টপ। ভয়ঙ্কর শক্তিশালী গাড়ি, যেন বুনো মোষ।

না, পছন্দ হলো না, সরে গেল রানা। চলে এল একই গতির র‍্যালি কারের পাশে। ওটা ইলেকট্রিক ব্লু টার্বো-চার্জ সুবারু ডাব্লিউআরএক্স।

নয় সেকেণ্ড পর গ্যারাজে এসে ঢুকল একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র বাউন্টি হান্টাররা। তখনই দেখল, শো-রুম থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে ডাব্লিউআরএক্স। এরই ভিতর গতি। তুলেছে ষাট মাইল!

শো-রুমের শেষমাথায় গ্যারাজের দরজা খুলছে। মস্ত কবাটের পাশে তিশা, হাতে ডোর ওপেনার রিমোট কন্ট্রোল। ।

গুলি শুরু করল বাউন্টি হান্টাররা।

তখনই পলকের জন্য তিশার পাশে থামল রানার র‍্যালি কার।

উঠে পড়ো, তিশা!

কুয়াশার কী হবে, রানা?

উনি বুঝবেন আমাদের সমস্যা।

জটিল, কঠিন সমস্যা, বিড়বিড় করল তিশা। সুবীরুর প্যাসেঞ্জার জানালা দিয়ে চড়ুই পাখির মত উড়ে ভিতরে নামল ও।

সামনে দুর্গের দেয়াল ঘেরা উঠান।

গ্যারাজের মুখে স্পেন্যায কোবরা দলের মেজর মিখাইল পেরোনভর্কে দেখতে পেল ওরা।

মস্ত হাঁ করে অবাক হয়ে চেয়ে রইল সে। পাশে কোবরা ইউনিটের ছয় কমাণ্ডো। একজনের হাতে মেডিকেল ট্রান্সপোর্ট বক্স।

নুড়িপাথরে, ভরা উঠানের আরেকদিকে নেমেছে এমআই-৩৪ হেলিকপ্টার। স্পেন্যায কমাণ্ডোদের পিছনে এখনও বনবন করে ঘুরছে রোটর।

যাহ, সমস্যা আরও বাড়ল, দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিশা।

.

গ্যারাজের দিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনে মোসিউ ড্যাবলারের অফিসে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল, কুয়াশা।

চট করে চাইল অ্যাণ্টিরুমের দিকে। ওখানে রানা বা তিশা নেই। আবার কী হলো, বিড়বিড় করল কুয়াশা। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এল অফিস থেকে।

কমপিউটার থেকে চোখ তুলেও চাইল না মোসিউ ড্যাবলার।

.

গ্যারাজের মুখে মেজর মিখাইল পেদরোনভের সামনা-সামনি হয়েছে রানার টার্বো-চার্জড ডাব্লিউআরএক্স।

পরস্পরের চোখে চাইল দুই দেশের দুই পুরুষ।

রাশান মেজরের চোখ থেকে বিদায় নিল বিস্ময়, সেখানে ঠাই নিল ভয়ঙ্কর ঘৃণা।

গতি তোলো, রানা! চাপা স্বরে বলল তিশা।

মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরল রানা।

ঝটকা দিয়ে রওনা হলো র‍্যালি কার। সৎ করে বেরিয়ে গেল গ্যারাজ থেকে। দুপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ রক্ষা করল স্পেন্যায কমাণ্ডোরা।

তীর গতি তুলে দুর্গের উঠানে বেরোল ডাব্লিউআরএক্স, পিছনে ছিটিয়ে দিচ্ছে নুড়িপাথর। পেরোল প্রকাণ্ড পোর্টকালিস, ড্র-ব্রিজে উঠে চলেছে মেইনল্যাণ্ডের দিকে।

এইমাত্র ভূমিশয্যা থেকে উঠেছে মেজর মিখাইল পেদরোনভ, তখনই দেখল গ্যারাজ থেকে শাশা করে ছিটকে বেরিয়ে গেল। দামি পাঁচটা গাড়ি। পিছু নিয়েছে ডাব্লিউআরএক্স র‍্যালি কারের।

সামনে লাল ফেরারি, পিছনে রুপালি পোর্শ জিটি-২, এর পর একে একে তিনটি পিউজো র‍্যালি কার। শেষ তিন গাড়ির পাশে ড্রাগন করপোরেশনের স্পনসরশিপ লোগো।

শালারা! রাগে গরগর করল মেজর পেরোনভ। ওই যে ভাগছে শালার মাসুদ রানা! রওনা হও! রওনা হও! ধরে আনো! একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র আগেই শালার মাথাটা চাই। চামড়া ছিলে জ্যান্ত শালার গায়ে লবণ দেব আগে!

এইমাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে তার লোক। তাদের চারজন ছুটল কপ্টারের দিকে।

পিছনে রয়ে গেল পেদরোনভ ও দুই কমাণ্ডে, হাতে ছিন্ন। মাথার বাক্স।

এবার সত্যিই শুরু হয়েছে রানা ও. তিশার পিছনে ধাওয়া। ২৬৭

ওরা পালাবে কোথায়? একাকী, অসহায় কুয়াশার পরিণতি কী হবে?

দুর্গ এবং এই বিরান এলাকায় কেউ তো বন্ধু নয় ওদের!

(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *