বাউণ্টি হাণ্টার্স ১.১

মাসুদ রানা ৪৩৩ – বাউণ্টি হাণ্টার্স (প্রথম খণ্ড) – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী

প্রথম প্রকাশ: ২০১৪
রচনা: বিদেশি কাহিনির ছায়া অবলম্বনে

মাসুদ রানা

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই, গোপন মিশন নিয়ে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে। বিচিত্র তার জীবন। অদ্ভুত রহস্যময় তার গতিবিধি। কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর, সুন্দর এক অন্তর। একা। টানে সবাইকে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায় না। কোথাও অন্যায়-অবিচার-অত্যাচার দেখলে রুখে দাঁড়ায়। পদে পদে তার বিপদ-শিহরন-ভয় আর মৃত্যুর হাতছানি। আসুন, এই দুর্ধর্ষ, চিরনবীন যুবকটির সঙ্গে পরিচিত হই। সীমিত গণ্ডিবদ্ধ জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটানে তুলে নিয়ে যাবে ও আমাদের। স্বপ্নের এক আশ্চর্য মায়াবী জগতে। আপনি আমন্ত্রিত। ধন্যবাদ।

এক

রিপাবলিক অভ ফ্রান্স।

প্যারিস থেকে সামান্য দূরে ব্যক্তিগত মস্ত এক পার্কের মাঝে রাজকীয় বাগানবাড়ি!

অক্টোবরের বারো তারিখ। সন্ধ্যা সাতটা।

বোর্ডরুমের মিটিঙে যাঁরা এসেছেন, সংখ্যায় তারা বারোজন! সবাই পুরুষ। সবাই বিলিয়োনেয়ার।

এই বারোজনের ভিতর ষাট বছরকে পিছনে ফেলেছেন দশজন। অন্য দুজন বিশের কোঠায়। এদের বাবা এই কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন, নইলে হয়তো এখানে বসবার সুযোগ মিলত না এদের। কাউন্সিল নিশ্চিত হয়েছে–এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবার কোনোই কারণ নেই।

এই কাউন্সিলে যোগ দিতে পূর্বপুরুষের বিপুল সম্পদ পেতে হবে, এমন নয়। তবে, এই কাউন্সিলের প্রায় সবাই তাদের বাবার কাছ থেকেই জন্মসূত্রে পেয়েছেন হাজার হাজার কোটি ডলার।

বিশেষ এই কাউন্সিলের তরফ থেকে সাধারণত কাউকে সদস্য-পদ নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় না।

এঁরা টাকার কুমির নন, একেকজন ডলার-পাউণ্ড ও ইউরো কারেন্সির মস্ত সব কিলার ওয়েইল।

দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সফ্টওয়্যার কোম্পানির মালিক এই কাউন্সিলের সহ-প্রতিষ্ঠাকারী।

পরেরজন বিখ্যাত কয়েকটি সুইস ব্যাঙ্কের মালিক। তৃতীয়জন সৌদি তেল কুবের। চতুর্থজন বিশ্বের সবচেয়ে সফল স্টক ব্যবসায়ী।

পঞ্চমজন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শিপিং কোম্পানির হর্তাকর্তা। ষষ্ঠজন ইউএস ফেডারেল রির্ভের ভাইস চেয়ারম্যান।

পাঁচ বছর আগে মৃত বাবার কাছ থেকে মস্ত এক ইস্পাত রাজত্ব পেয়েছে একজন। তার কোম্পানিগুলো ইউএস সরকারকে সরবরাহ করে মিলিটারি হার্ডওয়্যার এবং মিসাইল।

কাউন্সিলে কোনও মিডিয়া ব্যারন নেই এর মূল কারণ, ধরে নেয়া হয়েছে, ধার এবং শেয়ার বাজারের কারণে যখন-তখন হ্রাস বা বৃদ্ধি পাবে তাদের সম্পদ। এই কাউন্সিল আসলে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে বড় সব ব্যাঙ্কের মাধ্যমে, কাউন্সিলের সদস্যরাই আকাশে তোলে বা ধুলোয় মিশিয়ে দেয় মিডিয়া ব্যারনদেরকে।

একই কারণে কাউন্সিলে কোনও জাতীয় নেতা নেই। কাউন্সিলের সবাই জানে, খুব দ্রুত হারিয়ে যায় নেতাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা। মিডিয়া ব্যারনদের মতই, রাজনীতিকদের দাপট হঠাৎ করেই শেষ হয়। তার চেয়েও বড় কথা, এই কাউন্সিল অতীতে নানা দেশে প্রেসিডেন্ট তৈরি করেছে, আবার পছন্দ না হলে কান ধরে নামিয়ে দিয়েছে গদি থেকে। একই কথা খাটে স্বৈরশাসকদের বিষয়েও।

অনেক আগেই স্থির হয়েছে, কাউন্সিলে রাখা হবে না কোনও মহিলাকে।

অতীতে কাউন্সিলাররা একমত হন, কোনও মহিলাকে মিটিঙে বসতে দেয়া হবে না। তা সে রানি হলেও নয়। নামকরা ফরাসী কসমেটিক্স কোম্পানির মালিক লিলি মাখসাখের থাকতে পারে ত্রিশ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু কখনও তাকে আসতে দেয়া হবে না এই মিটিঙে।–উনিশ শ আঠারো সাল থেকে প্রতি বছর দুবার করে মিটিঙে বসছে এই কাউন্সিল।

কিন্তু এ বছর নয়বার মিটিঙে বসেছেন তারা।

এই বছর আসলে নানাদিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ।

সুইটয়ারল্যাণ্ডের ড্যাভোসে বাৎসরিক ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামে মিলিত হয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া দুনিয়ার বড় সব ট্রেড অর্গানাইযেশনের মিটিঙেও। এমন কী একবার মিটিং হয়েছে। ক্যাম্প ডেভিডে। তখন অবশ্য ওখানে ছিলেন না ইউএসএ-র প্রেসিডেন্ট।

আজকের মিটিং বসেছে মস্ত বাগানবাড়িতে।

দেখা গেল প্রত্যেকে হা-সূচক ভোট দিয়েছেন।

তা হলে সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ, বললেন চেয়ারম্যান। ১৩ অক্টোবর থেকেই শিকার শুরু। আজই গতানুগতিক চ্যানেলে প্রকাশ করা হবে টার্গেটদের নাম। যারা বাউন্টি নিয়ে আসবে, তাদের কাছ থেকে মাল বুঝে পেলে পাওনা পরিশোধ করবেন এজিএম-সুইসের মোসিউ পি. এস. ড্যাবলার।

সবমিলে পনেরোটি টার্গেট। এ ছাড়া পরে আরও দুটো টার্গেট দেয়া হবে। প্রতিটি বাউন্টির জন্য দেয়া হবে তেত্রিশ মিলিয়ন ইউএস ডলার।

এর একঘণ্টা পর শেষ হলো মিটিং। টেবিলে পড়ে রইল নোট। সবার নোটপ্যাড উপুড় করে রাখা, কিন্তু চেয়ারম্যানের সামনে টেবিলের উপর উল্টে গেছে প্যাডের পাতা।

ওখানে রয়েছে নামের একটি লিস্টি:

নাম – দেশ – সংগঠন

ক্যাপলান, স্কট এম. – ইউকে – এসএএস

ডসন, রিচার্ড কে. – ইউকে – এমআই-৬

অ্যাটলক, হার্লি. – ইউএসএ – ডেল্টা

এরিখ, সোলে টি. – ফ্রান্স – ডিজিএসই

কোসলোস্কি, চার্লস্ আর. – ইউকে – এসএএস

ওয়েলন, জে. – ইউএসএ – ডেল্টা

আজিজ আমিন – লেবানন – হামাস

রেইসার্ট, জন আর. – ইউএসএ – ইউএসএএমআরএমসি

রবিন, কার্লটন – ইউএসএ – ইউএস মেরিন

হ্যারিস, টেরেন্স এক্স. – ইউএস – আইএসএস

ম্যাকিন, ডেনিস ই. – ইজরায়েল – মোসাদ

রানা, মাসুদ চৌধুরি. – বাংলাদেশ – বিসিআই

গ্র্যাঞ্জার, রেমণ্ড কে. – ইউএসএ – ইউএস মেরিন

আলাল, হোসেন – সৌদি আরব – আল-কায়েদা

অ্যামনন, আব্রাম – ইজরায়েল – আইএএফ

দুনিয়া-সেরা এলিট মিলিটারি ইউনিট, যেমন ব্রিটিশদের এসএএস, ইউএস আর্মির ডেল্টা ডিটাচমেন্ট, মেরিন কর্পস, ইজরায়েলি এয়ার ফোর্স, বা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি মোসাদ, বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স, সিআইএ ওরফে আইএসএস এর সদস্যদের ওই তালিকাকে হালকাভাবে নেয়া যায় না। এ ছাড়া, আল-কায়েদা ও হামাসের সদস্যদের নামও রয়েছে ওই তালিকায়।

বিশেষ কাজে দক্ষ ওই লোকগুলো দুনিয়া জুড়ে নাম করেছে। তাদের বিপজ্জনক পেশার কারণে।

কিন্তু ভয়ঙ্কর শক্তিশালী কাউন্সিল স্থির করেছে–ওই পনেরোজনকে আগামীকাল থেকে কুকুরের মত তাড়িয়ে হত্যা করা হবে। সেজন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র তিনটি দিন।

দুই

১৩ অক্টোবর।

স্থানীয় সময় সকাল নয়টা।

সাইবেরিয়ার এ অংশে শোঁ-শো বইছে তুমুল মেরুঝড়, ধবল বরফ ছাওয়া জমির বুকে তীর্যক ভাবে নেমে আসছে নরম তুষারের পুরু শুভ্র চাদর।

পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ইউএসএ-র ই.এস.টি. রাত নয়টা, ১২ অক্টোবর।

ঝড়ের অনেক উপর দিয়ে সাইবেরিয়ার আকাশে শব্দের গতির চেয়ে জোরে রকেটের মত ছুটে চলেছে একটি বিমান।

কোন রাশান স্টেশনের রেইডার স্ক্রিনে একবারের জন্যও ধরা পড়েনি। প্রচণ্ড গতি ভেঙে দিয়েছে সাউণ্ড ব্যারিয়ার, কিন্তু কোনও সনিক বুম নেই। এই বিমান ব্যবহার করছে অত্যাধুনিক ওয়েভ-নেগেটিভিং সেন্সর।

সাধারণত এ ধরনের মিশনে পাঠানো হয় না মহামূল্যবান এই বিমান। রাগী ভুরুওয়ালা ককপিট উইণ্ডো, কালো রেইডার অ্যাবসর্বেণ্ট রং এবং অদ্ভুত ডানা নিয়ে বিদ্যুদ্বেগে চলেছে বি-২ স্টেল্থ বোমারু বিমান। ওটা বহন করতে পারে চল্লিশ হাজার পাউণ্ড অর্ডন্যান্স তার ভিতর থাকতে পারে লেসার গাইডেড বোমা বা এয়ার লঞ্চডু থার্মোনিউক্লিয়ার ক্রুজ মিসাইল।

কিন্তু আজকে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস ও রাশার সাইবেরিয়ার মাঝের এই সুদীর্ঘ ভ্রমণে বোমারু বিমানে কোনও বোমা বা মিসাইল নেই।

মডিফাই করা হয়েছে বিমানের বম বে, সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে হালকা কিন্তু দ্রুতগামী একটি ভেহিকেল। পাশেই ছয়জন ইউনাইটেড স্টেটস মেরিন এবং দুজন বাঙালি সেনা। শেষের দুজনের একজন প্রাক্তন মেজর, অন্যজন বাংলাদেশ আর্মির সার্জেন্ট। দুজনই কমাণ্ডো যোদ্ধা।

স্টেলথ বোমারু বিমানের ককপিটে এসে ঢুকল বিসিআই এজেন্ট, মাসুদ রানা। ওর জানা নেই, গতকাল এই মায়াবী জগৎ থেকে ওকে বিদায় দিতে জারি করা হয়েছে নির্দেশ দেখামাত্র হত্যা করতে হবে মাসুদ রানাকে, কেটে আনতে হবে তার মাথা। এ আসলে গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাউন্টি হান্ট। ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর কিন্তু সুযোগ্য একদল লোক খুঁজতে শুরু করেছে মাসুদ রানাকে।

ধূসর সাইবেরিয়ার আকাশে চোখ মেলে দিয়েছে রানা। পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি দীর্ঘ ও, সুঠামদেহী। কাট চুলগুলো ঢাকা পড়েছে সাদা-ধূসর কেভলার হেলমেটের নীচে। মুখে এখন চিন্তার ছাপ। প্রচণ্ড চাপের মুখেও শীতল থাকে ওর ক্ষুরধার মস্তিষ্ক। যারা ওর অধীনে কাজ করেছে, তারা বলে: ও এক অদ্ভুত মানুষ, ওর উপর ভরসা করা যায় নিশ্চিন্তে। সঙ্গিকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজ জীবনের ওপর ঝুঁকি নিতে সামান্যতম দ্বিধা করে না।

গত কয়েক ঘণ্টা অত্যন্ত ব্যস্ত ছিল মাসুদ রানা। সে কথাই ভাবছে বি-২ বোমারু বিমানের ককপিটের ভিতর দাঁড়িয়ে।

ফোনটা এসেছিল হঠাৎ করেই। লস অ্যাঞ্জেলেসে রানা এজেন্সির নিজস্ব অফিসে চুপ করে ফাইল দেখছিল রানা। চটকা ভাঙল ল্যাণ্ড ফোনের রিং শুনে।

রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল রানা। হ্যালো?

মেজর রানা? গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল ওদিক থেকে।

কে বলছেন, প্লিজ।

জরুরি আলাপ আছে আপনার সঙ্গে, বলল লোকটা। আপনি হয়তো এ বিষয়ে আগ্রহী হতে পারেন।

আপনি কে? আবার জানতে চাইল রানা।

আমি কর্নেল বব জেনকিন্স, মেরিন ফোর্সে আছি।

বলুন। ততক্ষণে পুরো সচেতন হয়ে উঠেছে রানা।

ফোন করেছি আপনার এক বন্ধুর খবর জানাতে, খুকখুক করে কাশলেন ভদ্রলোক।

কার বিষয়ে জানাতে চান? জিজ্ঞেস করল রানা।

মেরিন ফোর্সের মেজর রবিন কার্লটন। গতকাল সন্ধ্যায় রিকন ইউনিট নিয়ে সাইবেরিয়ায় গেছে সে। সঙ্গে এক রিকন ডেল্টা ডিটাচমেন্ট। হঠাৎ করেই থেমে গেলেন তিনি।

রানার মনে পড়ল, অ্যান্টার্কটিকার তুষার ছাওয়া এক নির্জন স্টেশনের কথা। ওখানে মস্ত বিপদ থেকে ওকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল রবিন কার্লটন। হাসিখুশি মানুষ, উদার মনের, বন্ধুদের জন্য ঝুঁকি নিতে মোটেও দ্বিধা করে না। অল্প কিছুদিনের ভিতর ওরা হয়ে উঠেছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

কয়েক মুহূর্ত পর বললেন কর্নেল, ইউএসএ-র কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া একদল সন্ত্রাসী দখল করে নিয়েছে। সাইবেরিয়ার এক পরিত্যক্ত মিলিটারি শহর। তাদের ইচ্ছা: ওখানে গুদামজাত নিউক্লিয়ার মিসাইল ব্যবহার করে উড়িয়ে দেবে আরবের কয়েকটি দেশের রাজধানী। দুএকটা ফেলবে ওয়াশিংটন ডি.সি.-র ওপরেও।

এসব আমাকে জানাচ্ছেন কেন? সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল রানা।

কারণ, আজ দুপুরে যোগাযোগ করেছে মেজর রবিন কার্লটন। ওই পরিত্যক্ত শহরে হেভিলি আর্মড সন্ত্রাসীরা সংখ্যায় ওদের চেয়ে অনেক বেশি। শহরের কেন্দ্রে ঢুকবার পর ওদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। মস্ত বিপদে রয়েছে আপনার বন্ধু। বিরতি দিলেন কর্নেল, তারপর আবারও বললেন, আপনি এখন মেজর কার্লটনের কণ্ঠস্বর শুনবেন। রিসিভারের ভিতর খট আওয়াজ হলো, তারপর কথা বলে উঠল রবিন কার্লটনের রেকর্ড করা কণ্ঠ, স্যর, পাতাল সাইলোর কাছে কোণঠাসা হয়েছি। মারা গেছে আটজন, বাকি কজন রয়ে গেছি না থাকার মতই। জানি না, এ ফাঁদ থেকে বেরুতে পারব কি না। আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। বাইরে থেকে সাহায্য না পেলে মরতে হবে… রবিনের কণ্ঠ হারিয়ে গেল, বদলে বলে উঠলেন কর্নেল, আমরা চাই না রাশা জানুক আমাদের নেভি ও আর্মির দুই দল কমাণ্ডোকে পাঠানো হয়েছে তাদের দেশের ভিতর।

চুপ করে অপেক্ষা করছে রানা।

আমরা আপাতত আরেকটা দল পাঠাব। কিন্তু সম্পূর্ণ প্রস্তুত রিকন ইউনিট এ মুহূর্তে এ রাজ্যের এ অংশে আমাদের হাতে নেই। ভোরের দিকে ডেল্টা ডিটাচমেন্টের এক প্লাটুন রওনা হবে, কিন্তু ততক্ষণে বহুকিছুই ঘটে যেতে পারে সাইবেরিয়ায়। রাশান আর্মির হাতে ধরা পড়তে পারে আমাদের ছেলেরা। সেক্ষেত্রে মস্ত সমস্যা হবে আন্তর্জাতিক আঙিনায়। এর ফলে পারস্পরিক দোষারোপ থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও শুরু হতে পারে। সবই করতে হচ্ছে গোপনে। …ঠিক হয়েছে, আপনার পরিচিত সুযোগ্য এক নন-কমিশণ্ড অফিসারের অধীনে প্রাথমিকভাবে কজন মেরিন সৈনিক পাঠাব আমরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে একটা বি-২ স্টেলথ বমার, কিন্তু অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যাঁমিলটনের সঙ্গে আলাপ করবার সময় তিনি বললেন, আপনি হয়তো যেতে চাইবেন বন্ধুকে উদ্ধার করার জন্য। আমরা আসলে চাইছি আপনি এ দলের নেতৃত্ব নিন। আপনি চাইলে আমরা আপনাকে–এবং আপনার সঙ্গীদেরকে পুরোপুরি সশস্ত্র অবস্থায় বি-২ স্টেলথ মারে তুলে দিতে পারি।

এক মুহূর্ত ভাবল রানা, তারপর বলল, আপনার ফোন নাম্বার দিন। অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যাঁমিলটনের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে ফোন দেব।

লিখে নিন নাম্বার। গড়গড় করে সংখ্যাগুলো দুবার বললেন ভদ্রলোক, তারপর রেখে দিলেন ফোন।

প্যাডে কর্নেলের ফোন নাম্বার তুলে নিয়েছে রানা। এবার অত্যাধুনিক কমপিউটারে খুঁজে নিল ফোন ডিরেকটরি। মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো, লস অ্যাঞ্জেলেসের বাইরের এক এয়ার বেস থেকেই ফোন এসেছে।

এরপর দেরি না করে যোগাযোগ করতে চাইল রানা নুমার চিফ অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যাঁমিলটনের সঙ্গে।

ভদ্রলোক এ সময়ে থাকেন নুমা অফিসে। তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে কল দিল রানা।

একবার রিং হতেই ওদিক থেকে ভেসে এল, হ্যালো, রানা? কী খবর, মাই বয়?

ভাল আছি, স্যর। আপনি কেমন আছেন?

ভাল।

স্যর, আমি ফোন করেছি শিয়োর হতে, আপনি মেরিন কর্নেল বব জেনকিন্সের সঙ্গে কথা বলেছেন।

হ্যাঁ, বিশ মিনিট আগে। যা শুনলাম, তোমার বন্ধু রবিন কার্লটন লড়ছে মৃত্যুর সঙ্গে।

তা জানতেই ফোন করেছিলাম, স্যর, বলল রানা।

তুমি কি যেতে চাও ওকে সাহায্য করতে?

আমার সঙ্গে কমাণ্ডো যোদ্ধা বলতে মাত্র এক তরুণ, বলল রানা। ওকে নিয়ে রওনা হতে পারি। অবশ্য, তার আগে চিফের অনুমতি নিতে হবে।

যদি যেতে চাও, চটপট তৈরি হয়ে নিতে হবে। শুনলাম, এক ঘণ্টার ভিতর রেডি হবে বি-২ স্টেলথ বমার। …রাহাতের অনুমতি পেলে দেরি না করেই পৌঁছে যেতে হবে এয়ার বেস এইচ. এন. ম্যাকেঞ্জিতে।

জী, বলল রানা। কথা না বাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে ফোন। রেখে দিল।

এবার যোগাযোগ করল বিসিআইএর চিফের সরাসরি ফোনে।

বলো, রানা? গুড়গুড় করে উঠল মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কণ্ঠ।

সংক্ষেপে পরিস্থিতি খুলে বলল রানা। ওর কণ্ঠ বলে দিল, বন্ধুকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হবে।

রানা জানে না, রাহাত খানও চাইছেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রতি ওর আন্তরিকতা যেন কখনও নষ্ট না হয়।

বেশ, ঘুরে এসো, কয়েক মুহূর্ত পর বললেন তিনি। তোমার সঙ্গের ছেলেটার নাম তো সার্জেন্ট হোসেন আরাফাত খবির? ওর তো এখনও আর্মির ছুটি শেষ হয়নি। যদি যেতে চায়, মনে করি না কেউ আপত্তি তুলবে।

তিনি আর কিছুই বলছেন না, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন রানা কিছু বলে কি না, তারপর রেখে দিলেন ফোন।

এবার রানা এজেন্সির এজেন্ট শাহাদাত হোসেনকে ফোন দিল রানা। শাহাদাঁতের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টেই উঠেছে খবির। দুচার কথায় পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিতেই খবিরকে ধরিয়ে দিল সে।

তুমি যদি আমার সঙ্গে যেতে চাও, আধঘণ্টা পর তোমাকে তুলে নেব, খবিরকে বলল. রানা।

কোথায় যেতে হবে, স্যর? জানতে চাইল খবির।

সাইবেরিয়ায়।

নতুন কোনও মিশন, স্যর?

হ্যাঁ। তবে এবার দেশের জন্য কাজ করছি না।

তাই? …আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি, স্যর, বলল খবির।

মাত্র একটি মিশনে রানার অধীনে কাজ করেই বিপুল শ্রদ্ধা জন্মেছে ওর মানুষটার প্রতি। বুঝে গেছে, মস্ত হৃদয় আছে। স্যরের। ওঁর নিখাদ ভালবাসা স্পষ্ট অনুভব করা যায় বুকের ভেতর।

.

মেরুঝড় পিছনে ফেলে উত্তর সাইবেরিয়ার এক পরিত্যক্ত সোভিয়েত ইন্সটলেশন লক্ষ্য করে আকাশ চিরে ছুটে চলেছে বি ২ বোমারু বিমান।

সোভিয়েত আমলে ওই আর্মি শহরের নাম ছিল: পাবলো-৯। ওটা পেনাল অ্যাণ্ড মেইনটেন্যান্স ইন্সটলেশন। ওখানে কঠোর শ্রম দিত কারাবন্দিরা।

আর্কটিকের পাবলো-৯ কারাগার-নগরীতে আটটি কম্পাউণ্ড। কমিউনিস্ট আমলে ওসব কম্পাউণ্ডের নাম ছিল: পাবলো-১, পাবলো-২, পাবলো-৩ ইত্যাদি।

মাত্র দুদিন আগেও পাবলো-৯ ছিল বহুদিন আগে ভুলে, যাওয়া সোভিয়েত আউট-স্টেশন- আধা-কারাগার, আধা মেইনটেন্যান্স ফ্যাসিলিটি। ওখানে কাজ করতে বাধ্য করা হতো রাজনৈতিক বন্দিদেরকে। এমন অসংখ্য কারাগার-নগরী বা

ফ্যাসিলিটি ছড়িয়ে আছে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে। এসব শহর যেমন প্রকাণ্ড, তেমনি কদর্য। তেলমাখা সব দালান ও কারখানায় ভর্তি।

উনিশ শ একানব্বই সাল পর্যন্ত ওসব কারাগার-নগরীই ছিল ইউএসএসআর-এর ইণ্ডাস্ট্রিয়াল হৃৎপিণ্ড। কিন্তু এখন সঙ্গত কারণেই এসব কারাখানা-নগরীর বেশিরভাগ পরিত্যক্ত। তুষারের ভিতর কোল্ড ওয়ারের ভূতগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির দিকে।

কিন্তু মাত্র একদিন আগে, বারো তারিখে বদলে গেছে সব।

আমেরিকার কয়েকটি কারাগার থেকে পলাতক সম্পূর্ণ সশস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত তিরিশজন বন্দি দখল করে নিয়েছে পরিত্যক্ত ৯ পাবলো-৯। গতকাল আমেরিকান সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে, আরব ভূখণ্ডের কয়েকটি রাজধানী এবং ওয়াশিংটন ডি.সি. শহর উড়িয়ে দেবে রাশার তৈরি এসএস-১৮ নিউক্লিয়ার মিসাইল দিয়ে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়লে ওই মিসাইলগুলো রয়ে গিয়েছিল সাইলোর ভিতরেই।

পলাতক বন্দিদের মাত্র দুটো দাবি: এক–তাদের দলের আর সবাইকে কারাগার থেকে মুক্ত করে দিতে হবে। তুলে দিতে হবে বিমানে। অনুসরণ করা চলবে না। দুই বন্দিদের হাতে দিতে হবে পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার। তারাই ঠিক করবে কোথায় যাবে বা কাকে দেবে ওই বিপুল অর্থ।

তাদের কথা যদি মেনে না নেয়া হয়, নিউক্লিয়ার মিসাইল হিটের দায়-দায়িত্ব নিতে হবে আমেরিকান সরকারকে।

এরপর থেকে দরদাম করছে আমেরিকান নেগোশিয়েটাররা।

এদিকে আমেরিকান সরকার ব্যাপক খোঁজ-খবর নিয়েছে।

পাবলো-৯ কোল্ড ওয়ার শেষে পরিত্যক্ত সাধারণ কোনও ইন্সটলেশন ছিল না।

মিথ্যা বলছে না পলাতক সন্ত্রাসীরা।

কমিউনিস্ট রেজিম জানায়নি কিছুই গণতান্ত্রিক সরকারকে, কিন্তু পাবলো-৯-এ রয়ে গেছে ষোলোটি নিউক্লিয়ার মিসাইল।

ওগুলো এসএস-১৮ নিউক্লিয়ার-টিপড ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল চুপ করে বসে আছে পাতাল সাইলোর ভিতর।

ইউএস স্যাটালাইট যে ছবি তুলেছে, তাতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, পাবলো-৯ আসলে কোনও কারখানা-নগরী নয়, ওটা একটি মিসাইল-লঞ্চ সাইট। প্রাক্তন সোভিয়েত আমলের ক্লায়েন্ট দেশগুলো, যেমন সুদান, সিরিয়া, কিউবা এবং ইয়েমেনে এখনও রয়ে গেছে এমন গোপন অনেক সাইট।

পাবলো-৯-এ প্রস্তুত রয়েছে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল, এ তথ্য পাওয়ার পর আমেরিকান সরকারের উচ্চমহল থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে: ওই পলাতক সন্ত্রাসীদেরকে যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবী থেকে বিদায় দিতে হবে।

এবং সেজন্য আর্মি এবং নেভির রিকন ইউনিট সাইবেরিয়ায়। পাঠানো হয়েছে।

আর্মির তরফ থেকে গেছে কাউন্টার-টেরোরিস্ট ইউনিট ডেল্টা ডিটাচমেন্ট। ওই দলের নেতৃত্বে রানার পরিচিত টেরোরিজম স্পেশালিস্ট মেজর হার্লি অ্যাটলক। তাদের পাশে লড়বে মেরিন রিকন ইউনিট, নেতৃত্বে রানার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মেজর রবিন কার্লটন।

এই দুই মেজর কোণঠাসা হয়ে পড়ায় এবং আপাতত লস অ্যাঞ্জেলেসে ডেল্টা ডিটাচমেন্ট প্রস্তুত না থাকায়, আর্মি ও নেভি থেকে স্থির করা হয়েছে: আপাতত পাঠানো হবে একটি মেরিন টিম, যেটার দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশের মেজর মাসুদ রানা।

মাঝরাতের পরে রওনা হবে আরেকটি ডেল্টা ডিটাচমেন্ট।

বি-২ স্টেলথ বিমানের ককপিটে দাঁড়িয়ে মেরিন কর্নেল আব্রাহাম কনেলির ব্রিফিঙের কথাগুলোই ভাবছিল মাসুদ রানা। ঘুরে দাঁড়িয়ে আবারও গিয়ে ঢুকল বম বে-তে, ওর মুখে হাই অল্টিচ্যুড মুখোশ।

সামনেই মাঝারি আকারের কার্গো কন্টেইনার। ওটার ভিতর রয়েছে ফাস্ট অ্যাটাক কমাণ্ডো স্কাউট ভেহিকেল। আমেরিকান মিলিটারিতে আর্মার্ড সব ভেহিকেলের ভিতর ওটা সবচেয়ে হালকা এবং দ্রুতগামী যেন স্পোর্টস্ কার ও হামভির সংকর।

কন্টেইনারের ভিতর ভেহিকেলের সিটে বসেছে ছয়জন রিকন মেরিন সদস্য এবং বাংলাদেশ আর্মির সার্জেন্ট খবির। রানাসহ আটজনকে নিয়ে এই টিম। সবার পরনে সাদা-ধূসর বডি আর্মার, সাদা-ধূসর হেলমেট, সাদা-ধূসর ব্যাটল ড্রেস ইউনিফর্ম। সামনে চেয়ে আছে সবাই, গম্ভীর মুখ।

সবার উপর চোখ বুলিয়ে নিল রানা, নিজেকে কেমন বুড়ো মনে হলো ওর। এ দলে সবাই তরুণ। কারও বয়স তেইশ হয়নি। আর ওর? আটাশ পেরিয়েছে বেশ কদিন আগে।

কাছের তরুণের দিকে চাইল রানা। গিগস, হাতের কী অবস্থা?

বিমানে উঠবার পর দেয়ালে হোঁচট খেয়ে কবজি মচকে গিয়েছিল তরুণের।

এখন ঠিক আছে, স্যর, উৎসাহ নিয়ে বলল কর্পোরাল গিগস। ভীষণ অবাক হয়েছে, আগে কখনও কোনও অফিসারকে এভাবে জুনিয়রদের ভালমন্দ জিজ্ঞাসা করতে দেখেনি।

আস্তে করে মাথা দোলাল রানা। চট করে মনে পড়েছে তিশা ও নিশাতের কথা। এই মিশনে ওরা থাকলে ভাল হতো। কিন্তু তা হওয়ার নয়। ওরা এখন ইউএন-এর তরফ থেকে কঙ্গোর মাউণ্ট স্ট্যানলি পাহাড় এলাকায়, লড়ছে অর্থপিশাচ ও রক্তলোভী এক ওয়ার লর্ডের বাহিনীর বিরুদ্ধে।

খবিরের দিকে চাইল রানা। চুপচাপ মানুষ খবির। নাটবল্টর মত পোক্ত সৈনিক। বেশিরভাগ সময় কুঁচকে থাকে ওর পুরু দুই ভুরু। দিনকে দিনকে হয়ে উঠছে ওর বাবার মত। অবশ্য, হোসেন আরাফাত দবিরের মত হাসির কথা মুখে আসে না ওর।

চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরুল রানার বুক চিরে। মনে পড়ে গেছে খবিরের বাবার স্মৃতি। দুর্দান্ত যোদ্ধা ছিল সে। কিন্তু মন ছিল ফুলের মত নরম। ছোট্ট একটা মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে ধরা পড়ে শত্রুর হাতে, ভয়ঙ্করভাবে মরতে হয় তাকে। ওই করুণ দৃশ্য এখনও রানার চোখে ভাসে।

মন সরিয়ে নিয়ে, ভাইব্রামাইকে স্যাটালাইট রেডিয়োতে যোগাযোগ করল রানা। গলার পাশে ওই ভাইব্রেশন-সেন্সিং মাইক্রোফোন ঠিক ধরবে ওর ভয়েস বক্সকে। জিএসএক্স-৯ নতুন ব্যাণ্ডে আপলিঙ্ক পৌঁছে দেবে স্যাটালাইটে। ইউএস মিলিটারির সর্বাধুনিক কমিউনিকেশন সিস্টেম ওটা। পোর্টেবল জিএসএক্স-৯ ইউনিটের কারণে রানার কণ্ঠ কয়েক হাজার মাইল দূর থেকেও পরিষ্কার শুনবে ইউএস মিলিটারি রিসিভার। আবার ওদিকের কথাও একইরকম স্পষ্ট শুনবে রানা।

বেস, স্ট্যালিয়ন থ্রি বলছি, সিচুয়েশন জানান।

রানার ইয়ারপিসে ভেসে এল একটি, কণ্ঠ। ওই স্বর আলাস্কার ম্যাককোল এয়ার ফোর্স বেসের রেডিয়ো অপারেটারের।

স্ট্যালিয়ন থ্রি, বেস থেকে বলছি। শত্ৰু-দলের সঙ্গে লড়ছে। স্ট্যালিয়ন টু ইউনিট। জানিয়েছে, মিসাইল সাইলো দখল করে নিয়েছে ওরা। শত্রুদের বেশ কজনকে শেষ করেছে। এখন অপেক্ষা করছে রিইনফোর্সমেন্টের জন্য। স্ট্যালিয়ন টু ইউনিট আরও জানিয়েছে, মেইন মেইনটেন্যান্স বিল্ডিঙের ভিতর এখনও রয়ে গেছে কমপক্ষে বারোজন টেরোরিস্ট।

ঠিক আছে, বলল রানা। আমাদের পরে যাদের আসার কথা, তাদের কী খবর?

ফোর্ট লিউইস থেকে আসছে পুরো এক কোম্পানি আর্মি রেঞ্জার। সংখ্যায় এক শ জন। আপনারা পৌঁছবার একঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছুবে।

ঠিক আছে। সুইচ টিপে রেডিয়ো বন্ধ করল রানা।

আর্মার্ড স্কাউট ভেহিকেলের ভিতর বলে উঠল লেখক টু খবির, ওরা কী বলেছে, স্যর?

ঘুরে চাইল রানা। পিছনে আরেকদল আসছে। আর একটু পর ড্রপ করব আমরা।

পাঁচ মিনিট পর স্টেলথ বোমারু বিমানের পেট থেকে খসে পড়ল বাক্সের মত কার্গো কন্টেইনার, মাটির দিকে রওনা হলো রকেটের গতি তুলে।

কন্টেইনারের ভিতর আর্মার্ড গাড়ির পেটে বসে আছে রানা ও তার দলের সবাই। সাঁই-সাই করে নেমে চলেছে- থরথর করে বেদম কাঁপছে প্রত্যেকে। সিটবেল্ট না থাকলে ছিটকে পড়ত।

ভেহিকেলের দেয়ালে ঝুলন্ত অ্যান্টিমিটারের দিকে চেয়ে আছে রানা, নীচের দিকে নামছে কাঁটা।

পঞ্চাশ হাজার ফুট… পঁয়তাল্লিশ হাজার ফুট… চল্লিশ হাজার… তিরিশ… বিশ… দশ হাজার…

পাঁচ হাজার ফুট উপরে এনগেজড হবে প্যারাশুট, নিস্পৃহ স্বরে বলল লোডমাস্টার, কর্পোরাল এ. এন. ক্যালভার্ট। ঠিক জায়গায় ল্যাণ্ডিঙের জন্য টার্গেট ঠিক করেছে জিপিএস গাইডেন্স সিস্টেম। এক্সটার্নাল ক্যামেরাগুলো ভেরিফাই করেছে এল যেড ক্লিয়ারেন্স।

দ্রুত ঘুরতে থাকা অ্যান্টিমিটারের দিকে চোখ রানার।

আট হাজার ফুট।

সাত হাজার ফুট… ছয় হাজার ফুট…

সব ঠিক থাকলে পাবলো-৯-এর পনেরো মাইল পুবে নামবে ওরা। দিগন্তের ওপাশে ওই ইন্সটলেশনের ফ্যাসিলিটি থেকে ওদেরকে দেখতে পাবে না কেউ।

এনগেজিং প্রাইমারি শুটস ঘোষণা করল ক্যালভার্ট।

এবার ভয়ঙ্কর ঝাঁকি খেল পড়ন্ত কন্টেইনার, ভীষণ চমকে গেল সবাই। খুব দুলে উঠেছে পুরো বাক্স। সিটে কাঁপতে শুরু করেছে ওরা। ছয় ফিতার সিট-বেল্ট ও রোববার না থাকলে মারাত্মকভাবে জখম হতো।

তখনই হঠাৎ করে কন্টেইনারের তিনদিকের প্যারাশুট ভাসিয়ে তুলল ওদেরকে।

পরিস্থিতি, ক্যালভার্ট? জানতে চাইল রানা।

কন্টেইনারের এক্সটার্নাল ক্যামেরা ও জয়স্টিক দিয়ে ওদেরকে নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে চলেছে কর্পোরাল।

দশ সেকেণ্ড। উপত্যকার মাঝে সরু মেটো পথে নেমে আসছি। আপনারা সবাই শক্ত হয়ে বসুন। তিন… দুই… এক…

জোরালো ধুপ আওয়াজ তুলে শক্ত জমিতে নেমে এল কন্টেইনার। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের দিকে খুলে গেল বাক্সের সামনের দেয়াল। ফোর-হুঁইল-ড্রাইভ কমাণ্ডো স্কাউট লাইট অ্যাটাক ভেহিকেল ও বাক্সের চারপাশের সংকীর্ণ অংশে এসে। ঢুকল ফ্যাকাসে আলো। এক সেকেণ্ড পর কন্টেইনারের ভিতর থেকে পিছলে সাইবেরিয়ার ধূসর দিনে বেরিয়ে এল যুদ্ধযান।

কাদাভরা সরু পথে রওনা হয়ে গেল ওরা। দুপাশে তুষারে ছাওয়া টিলা। ঢালে অসংখ্য ধূসর গাছ, পাতা বলতে কিছুই নেই। সবই কংকালের মত নিথর। তুষারের কার্পেটের এখানে ওখানে ছুরির মত উঠে এসেছে তীক্ষ্ণ কালো সব পাথর।

রুক্ষ এলাকা, নিষ্ঠুর। আমাদের নরকের ঠিক উল্টো, ঠাণ্ডা।

আবারও এলাম সাইবেরিয়ায়, মনে মনে বলল রানা। লাইট অ্যাটাক ভেহিকেলের পিছন সিটে বসেছে, বলে উঠল থ্রোট মাইকে: স্ট্যালিয়ন ওয়ান, আমরা স্ট্যালিয়ন থ্রি। আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

ওদিক থেকে কোনও জবাব এল না।

আবারও বলছিঃ স্ট্যালিয়ন ওয়ান, আমরা স্ট্যালিয়ন থ্রি। আমার কথা শুনছেন?

জবাব নেই কারও তরফ থেকে।

এবার রবিন কার্লটনের মেরিন ইউনিট বা স্ট্যালিয়ন টু-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইল রানা।

সাড়া নেই।

চিন্তিত হয়ে পড়েছে রানা, আলাস্কার বেসের সঙ্গে যোগাযোগ করল স্যাটালাইট ফ্রিকোয়েন্সিতে।

বেস, আমরা থ্রি। স্ট্যালিয়ন ওয়ান বা টু-র সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে আপনাদের কন্ট্যাক্ট আছে?

অ্যাফারমেটিভ, মেজর রানা, জবাব এল আলাস্কা থেকে। এই তো একটু আগে কথা হয়েছে। তখন…

হঠাৎ করেই থেমে গেল সিগনাল। খডমড আওয়াজ শুরু হয়েছে ইয়ারপিসে। ক্যালভার্ট? কর্পোরালের দিকে চাইল রানা।

সরি, বস, সিগনাল হারিয়ে গেছে, ভেহিকেলের ওয়াল কন্সোলের কাছ থেকে বলল তরুণ। আমাদের কিছু করার নেই। …শুনেছিলাম এসব নতুন স্যাটালাইট রিসিভার কখনও নষ্ট হবে না।

ভুরু কুঁচকে গেল রানার। জানতে চাইল, কোনও জ্যামিং সিগনাল হতে পারে?

জী-না, স্যর। খোলা রেডিয়ো এয়ারস্পেসে আছি। ওই সিগনাল কেউ ঠেকাতে পারবে না। সমস্যা বোধহয় ওদিকে।

ওদিকে… বিড়বিড় করল রানা। এবার ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল, আমরা ভিশু্যয়াল রেঞ্জে পৌঁছব কখন?

স্কাউটের ড্রাইভার এক মেরিন সার্জেন্ট, নাম বব গ্রেসন। রানা ছাড়া অন্যদের চেয়ে বয়সে বড়। তিরিশ সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে আমাদেরকে দেখা যাবে, স্যর।

সামনে ঝুঁকে বসল রানা, গ্রেসনের কাঁধের উপর দিয়ে চাইল।

স্কাউটের নীচে দ্রুত পিছিয়ে চলেছে কালো কাদাময় পথ। ঢালু এক টিলার চূড়ার দিকে চলেছে ওরা।

ওই টিলা পেরুলে সামনে দূরে চোখে পড়বে পাবলো-৯।

তিন

রাশান পরিত্যক্ত ইন্সটলেশনের দিকে যখন ছুটে চলেছে রানা ও তার দল, ওই একই সময়ে আলাস্কার ম্যাককোল এয়ার ফোর্স বেসে জন রেমন নামের তরুণ এক রেডিয়ো অফিসার হতাশ ও বিরক্ত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেছে মেরিন এবং বাংলাদেশি টিমের সিগনাল।

কয়েক সেকেণ্ড আগে রেমনকে হতবাক করে কমিউনিকেশন ফ্যাসিলিটির সমস্ত যন্ত্র বিকল হয়েছে, দপ্ করে নিভে গেছে কন্সেলের বাতি। অথচ বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে ঘরে।

রেডিয়ো অফিসার কী করবে ভাবছে, এমন সময় খুলে গেল ঘরের দরজা, এসে ঢুকলেন এয়ার রেস ম্যাককোলের কমাণ্ডার।

স্যর, বলল রেমন, আমরা…

জানি, বাছা, নরম স্বরে বললেন সিও। সবই জানি।

বেস কমাণ্ডারের পিছনে আরেক লোককে দেখল রেডিয়ো অফিসার। নতুন ওই লোককে আগে দেখেনি সে। বয়স্ক, দীর্ঘ এবং শক্তপোক্ত। চুলগুলো গাজর রঙের, মুখটা ছুঁচোর মুখের মত চোখা। পরনে সিভিলিয়ন সুট, একবারও চোখের পাতা পড়ে না তার। শীতল চোখে ঘরের চারপাশ দেখে নিল সে।

বেস কমাণ্ডার নিচু স্বরে বললেন, বাছা, কিছু করার নেই, ইন্টেলিজেন্স ইশ্য। আমাদের হাত থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ওই মিশন।

.

স্কাউট অ্যাটাক ভেহিকেল শুভ্র তুষারাবৃত টিলার চূড়া পেরুতেই দূরে চাইল রানা। সামনে বিস্তৃত উপত্যকার কোলে অতীত কীর্তি নিয়ে থম মেরে পড়ে আছে পরিত্যক্ত পাবলো-৯- তুষার ছেয়ে দিয়েছে সব দালানের ছাত ও দেয়াল।

হ্যাঙার, স্টোরেজ শেড, বিশাল মেইনটেন্যান্স ওয়্যারহাউস, একপাশে পনেরোতলা কাঁচ-কংক্রিটের দানবীয় অফিস টাওয়ার, নিচু বেশকিছু দালান- এসব নিয়ে শ্রম-নগরী পাবলো-৯।

বিশফুট উঁচু রেযার ওয়ায়ার ফেন্স ঘিরেছে গোটা কম্পাউণ্ডকে। দুমাইল দূরে রাখার উপকূল, বরফ ঢাকা সৈকতে অবিরাম মাথা কুটছে আর্কটিক সাগরের শীতল ঢেউ।

কোল্ড ওয়ার শেষে সমস্ত গুরুত্ব হারিয়ে বসেছে পাবলো-৯, নিথর পড়ে আছে মূল্যহীন মৃত মানুষের মত।

নগরীর রাস্তাগুলো নির্জন। সবই ঢেকে দিয়েছে শুভ্র তুষার। রানার ডানদিকে মেইন মেইনটেন্যান্স ওয়্যারহাউস, আকারে চারটে ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। ওয়্যারহাউসের এক দেয়ালে হেলান দিয়ে দানবীয় স্কুপ তৈরি করেছে অসংখ্য লোহা-লক্কড় এবং ভাঙা যন্ত্রপাতি।

বামে প্রকাণ্ড ছাউনি, ওখান থেকে ছাতওয়ালা এক সেতু গেছে সুউচ্চ অফিস টাওয়ারে। পনেরোতলা অফিসের ছাত থেকে নেমেছে দীর্ঘ ছোরার মত সব বরফের টুকরো, মাধ্যাকর্ষণকে কাঁচ কলা দেখিয়ে দিব্যি আছে বছরের পর বছর।

শহরের উপর ভয়ানক হামলা করেছে বরফ-শীতল পরিবেশ। তুষার বা বরফ সরিয়ে নেয়ার কেউ নেই, কাজেই ফেটেছে সব দালানের জানালাগুলোর কাঁচ ওখানে যেন অসংখ্য মাকড়সার জাল। এখানে-ওখানে কাঁচ-ভাঙা সব চৌকো গর্ত, দালানে ঢুকছে হু-হুঁ হাওয়া।

ভুতুড়ে নগরী পাবলো-৯-এর পাতালে কোথাও থম মেরে বসে আছে ষোলোটি নিউক্লিয়ার মিসাইল।

শহরের প্রবেশ-পথের ফটক উড়িয়ে দেয়া হয়েছে আগেই। আশি কিলোমিটার গতি তুলে ওদিক দিয়ে ঢুকে পড়ল রানাদের স্কাউট। ঢালু পথ বেয়ে উঠছে কমপ্লেক্সের দিকে। আর্মার্ড কারের পিছনে ৭.৬২ এমএম মেশিনগান টারেটে এক মেরিন সৈনিক।

ড্রাইভার গ্রেসনের কাঁধের উপর দিয়ে কমপিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখেছে রানা। বলল, লোকেটর দিয়ে খুঁজে দেখো ডেল্টা ও মেরিন ফোর্স কোথায়।

কি-বোর্ডে টোকা দিতে শুরু করেছে গ্রেসন। কমপিউটার স্ক্রিনে ভেসে উঠল পাবলো-৯-এর মানচিত্র।

এক মানচিত্রে দেখানো হয়েছে কমপ্লেক্সের এক পাশ।

ওদিকে মুখোমুখি দুটো ব্লক।

এক ব্লকে অফিস টাওয়ার, উল্টো ব্লকে প্রকাণ্ড মেইনটেন্যান্স শেড।

দুই বিশাল দালানের প্রথমতলায় বেশকিছু লাল বিন্দু।

বিল্ডিং এবং ছাউনির ভিতর রয়েছে ডেল্টা ও মেরিন। ইউনিট।

কিন্তু মানচিত্রের ভিতর কোথায় যেন গোলমাল রয়েছে।

এক সেকেণ্ড পর বুঝল রানা, টিপটিপ করা লাল বিন্দুগুলো। মোটেও নড়ছে না।

একদম স্থির।

শিরশির করে উঠল রানার ঘাড়ের খাটো চুলগুলো। সার্জেন্ট গ্রেসন, নিচু স্বরে বলল, গিগস, ওয়ারেন আর ক্যালভার্টকে নিয়ে অফিস টাওয়ার কাভার করবে তুমি। এদিকে খবির, জন ও টমিকে নিয়ে মেইনটেন্যান্স বিল্ডিং সিকিয়োর করব আমি।

ঠিক আছে, স্যর।

ফাঁকা সরু এক রাস্তা ধরে চলেছে স্কাউট। ভাসমান কংক্রিট ওয়াকওয়ের নীচ দিয়ে পেরিয়ে গেল গাড়ি, নানাদিকে ছিটকে পড়ল তুষারের স্তূপ।

কয়েক সেকেণ্ড পর বিশাল মেইনটেন্যান্স ওয়্যারহাউসের সামনে ছোট পারসোনেল দরজার পাশে থামল আর্মার্ড কার।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল স্কাউটের পিছনের হ্যাচ, স্নো ক্যামোফ্লেজ পরনে রানা এবং অন্য তিন যোদ্ধা ছিটকে গিয়ে ঢুকল ওয়্যারহাউসের সংকীর্ণ পারসোনেল দরজা দিয়ে।

ওরা নেমে যেতেই বাঁক নিয়ে রওনা হলো স্কাউট, চলেছে।

কাঁচ ঢাকা অফিস টাওয়ারের দরজা লক্ষ্য করে।

আর্মার্ড কারের চলে যাওয়া লক্ষ করেনি রানা, তার আগেই মেইনটেন্যান্স বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকে পড়েছে পিস্তল হাতে।

ওর সঙ্গে রয়েছে হেকলার অ্যাণ্ড কচ-এর পুরনো এমপি-৫ এর পুত্র এমপি-৭। ওটা খাটো ব্যারেলের মেশিন পিস্তল। ছোটখাটো, কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র। এ ছাড়া রয়েছে ডের্ট ঈগল সেমি-অটোমেটিক পিস্তল, কে-বার ছোরা এবং পিঠের হোলস্টারে আর্মালাইট এমএইচ-১২। ওটা দেখতে দুই গ্রিপ ওয়ালা অস্ত্রের মত–ম্যাগনেটিক এ্যাপলিং হুক লঞ্চার।

এই মিশনের জন্য রয়েছে স্ট্যাণ্ডার্ড কিট। বাড়তি গুলি, ছয়টা হাই-পাওয়ার্ড থার্মাইট-অ্যামাটল ডিমোলিশন চার্জ। ওগুলো যে-কোনও বড় দালানকে, তা সে যত বড়ই হোক, সেকেণ্ডে ধসিয়ে দিতে পারবে।

দুসারি অফিস-ঘরের মাঝের করিডোর দিয়ে চলেছে রানা ও তার দলের তিনজন। কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল একটা দরজার সামনে। ওখানে থামল ওরা। কোনও আওয়াজের জন্য অপেক্ষা করল কান খাড়া করে।

কয়েক সেকেণ্ড পেরিয়ে গেল, টু শব্দ নেই। খুব সাবধানে কবাট খুলল রানা। ওদিকে বিশাল এলাকা, একেবারে ফাঁকা।

এবার এক ধাক্কায় দিয়ে পুরো দরজা খুলে ফেলল রানা, সঙ্গে সঙ্গে চমকে গেল।

ইয়াল্লা!

ওয়্যারহাউসের এই দরজা থেকে শুরু হয়েছে ওঅর্ক এরিয়া। বহুদূর পর্যন্ত প্রকাণ্ড হ্যাঙার বে, ছাতের ফাটল ধরা কাঁচ দিয়ে আসছে সাইবেরিয়ার ধূসর আকাশের মরাটে আলো।

কিন্তু সাধারণ হ্যাঙার বে নয় এই ওয়্যারহাউস।

পেনাল কলোনির পুরনো কোনও মেইনটেন্যান্স ছাউনিও নয়।

মস্ত দালানের মেঝের চারভাগের তিনভাগ এলাকা জুড়ে কংক্রিটের তৈরি চারকোনা এক বিশাল গহ্বর।

আর ওই খাদের ভেতর কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক মঞ্চ।

তার ওপর নিশ্চিন্তে বসে আছে দু শ মিটার লম্বা প্রকাণ্ড এক সাবমেরিন।

সত্যিই মস্ত, কাছ থেকে মনে হলো অস্বাভাবিক বড়। যেন বসে আছে রাজ-সিংহাসনে।

কংক্রিটের ব্লকগুলো চারপাশের আসবাবপত্র। যেন পিঁপড়ের দল তৈরি করেছে খুদে সব আকুতি।

গুঁড়ো হওয়া বরফ ও তুষার ছেয়ে দিয়েছে সবকিছুকে।

সাবমেরিনের ওপর দিয়ে গেছে ক্রেন ও ক্যাটওয়াক। সবই দানবীয় শেডের কংক্রিট মেঝেতে মিশেছে। সরু এক গ্যাংওয়ে উঠেছে সাবমেরিনের তিনতলা উঁচু কনিং টাওয়ারে। কিছুটা দূরে শেডের উপরের ব্যালকনি। সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের মেঝে এবং ব্যালকনির মেঝে একই উচ্চতায়।

বিস্ময় কাটিয়ে এসব তথ্য হজম করতে চাইছে রানা।

তবে প্রথমে চিনল সাবমেরিনটাকে। ওটা টাইফুন। ইউএসএসআর-এর নিউক্লিয়ার আর্সেনালবাহী সাগরগামী নৌযানগুলোর ভিতর সেরা যুদ্ধযান ছিল। টাইফুন ক্লাস সাবমেরিনকে বলা চলে প্রতাপশালী কমিউনিস্ট রাজের মুকুট। মাত্র ছয়টি ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিন তৈরি করা হয়েছিল, কিন্তু পশ্চিমা লেখকদের বিভিন্ন উপন্যাস এবং হলিউডি ছায়াছবি বিখ্যাত করে তুলেছে ওগুলোকে। টাইফুন ক্লাস সাবমেরিন দেখতে দারুণ আকর্ষণীয়, কিন্তু বাস্তবে ভরসা করা যেত না তার ওপর। যন্ত্রাংশ প্রতি মাসেই আপগ্রেড করতে হতো, এ ছাড়া লেগেই ছিল মেইনটেন্যান্স-এর সমস্যা। অবশ্য, ওই জলযান আজ পর্যন্ত মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় সাবমেরিন।

মেইনটেন্যান্স শেডের ভিতর সাবমেরিনের সামনের টর্পেডো বে-তে কাজ করা হচ্ছিল, এমন সময় পরিত্যক্ত হয় শ্ৰম-নগরী পাবলো-৯। সাবের নাকের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে টর্পেডো টিউব। একটা একটা করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে খোলের প্লেটগুলো।

কিন্তু আর্কটিক সাগর থেকে দুই মাইল ভেতরের কোনও মেইনটেন্যান্স শেডে কীভাবে আসে টাইফুন ক্লাস সাবমেরিন?

এর জবাব নীরবে দিল বিশাল মেইনটেন্যান্স বিল্ডিং।

টাইফুন সাবমেরিনের ড্রাই ডকের আরেক দিকে রানা। দেখল, দেয়ালের মত খাড়া, উঁচু, প্রকাণ্ড এক প্লেট-স্টিল সি গেট।

ওই কবাটের ওদিকে রয়ে গেছে সাগরের পানি।

ইনডোর স্টেডিয়ামের মত এক জায়গায় প্রায় জমাট বেঁধেছে থকথকে বরফ। ওই শীতল পানিকে ড্রাই ডক থেকে দূরে রেখেছে বাঁধের মত সি গেট।

রানা আন্দাজ করল, ওই পানির নীচে রয়েছে কোনও সুড়ঙ্গ। সেটা সোজা মাটির নীচ দিয়ে চলে গেছে সাগরে। নইলে মেরামতের জন্য সাবমেরিন আসত না পাবলো-৯-এ। অনেক আগেই ধরা পড়ত আমেরিকান গুপ্তচর স্যাটালাইটের চোখে।

এখন সবই বুঝতে শুরু করেছে রানা।

পাবলো-৯ আর্কটিক উপকূল থেকে পুরো দুই মাইল ভিতরে, এবং মানচিত্রে বলা হয়েছে, ওটা রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য সশ্রম কারাগার।

কিন্তু বাস্তবে এ শহর ছিল টপ সিক্রেট সোভিয়েত সাবমেরিন রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি।

অবশ্য, এসব নিয়ে ভাববার বিশেষ সময় পেল না রানা। কারণ ঠিক তখনই দেখল দেহগুলো।

ড্রাই ডকের গহ্বরের পাশেই পড়ে আছে: চারটে দেহ।

পরনে ইউএস সামরিক বাহিনীর তুষারের ফ্যাটিগ, দেহে সব ধরনের আর্মার… এবং প্রত্যেকে অনেক আগেই মারা গেছে গুলি খেয়ে!

ওদিকের মেঝেতে আছে রক্তের প্রলেপ। লাশের মুখে ছলাৎ করে লেগেছে, বুকে, সারাদেহেও। জমে যাওয়ার আগে ছড়িয়ে পড়েছিল মেঝেতে রক্তের স্রোত।

শালার মাদারফাঁকার, শ্বাস আটকে ফেলেছে কর্পোরাল টমি ম্যাগান। যিশু! এরা ছিল ডেল্টা ডিটাচমেন্টের যোদ্ধা, সেরাদের সেরা! যুবকের চোখে রানার মতই সবুজ রে-ব্যান সানগ্লাস।

চুপ হয়ে গেছে রানা। দেখছে লাশগুলোর ইউনিফর্ম বদল করা হয়েছিল মালিকের ইচ্ছেমত। কারও ডান কাঁধের প্লেট খুলে নেয়া হয়েছে, আবার কারও স্নো গিয়ারের কনুইয়ের আস্তিন নেই।

এ কাজ করে আমেরিকান সামরিক বাহিনীর ডেল্টা যোদ্ধারা।

গহ্বরের ভিতর আরও দুটো দেহ, ওগুলো পড়ে আছে। তিরিশ ফুট নীচে। গুলি খেয়ে ঝাঁঝরা হয়েছে।

জমে যাওয়া রক্তের চারপাশে শত শত বুলেটের খোসা। পাল্টা গুলি করেছে ডেল্টা যোদ্ধারা।

রানার মনে হলো, এরা একইসময়ে চারপাশে গুলি করেছে, এবং তখনই মারা পড়েছে শত্রুদের হাতে।

.

অস্পষ্ট ফিসফিসে কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

সব মিলে কজন?

এখানে চার। সবুজ টিম বলছি, অফিস টাওয়ারে ঢুকেছে আরও চারজন।

ওদের কথা বাদ দাও। এদের ভেতর মাসুদ রানা কোজন?

সবুজ সানগ্লাস।

স্নাইপার রেডি হও। বলামাত্র গুলি করবে।

.

একটা মতদেহ মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে রানার।

প্রায় বরফের মূর্তির মত জমাট বেঁধে গেছে নিজেও।

প্রথমে দেখতে পায়নি, কারণ দেহের উপরের অংশ ঝুলছিল ড্রাই ডকের খাদের ভিতর। কিন্তু এখন পরিষ্কার দেখা গেল।

সব মিলে ছয়টা দেহ। কিন্তু বিশেষ এই মানুষটির মাথা কেটে নেয়া হয়েছে গর্দান থেকে।

দৃঢ় হয়ে গেল চোয়াল, চুপ করে চেয়ে রইল রানা। মুহূর্তের

জন্য বমি এল। তারপর বিদায় নিল বাজে অনুভূতিটা।

কাটা গর্দান থেকে ঝুলছে থকথকে, লালচে মাংস। পুরো কাটা পড়েছে ইসোফ্যাগাস ও শ্বাসনালী।

হায় আল্লা, চাপা স্বরে বলল খবির, পৌচেছে রানার পাশে। আসলে এখানে হচ্ছেটা কী, স্যর?

বিশাল এই দালানে রানা ও তার তিন সৈনিক ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে দেখছে চারপাশ। ড্রাই ডকের পারে ও নীচে লাশ।

কিন্তু ওরা জানে না, ওদের উপর চোখ রেখেছে কমপক্ষে বিশজন লোক। তারা রয়েছে হল-এর কি স্ট্যাটেজিক পয়েন্ট এ। প্রত্যেকের পরনে একই পোশাক–স্নো ফ্যাটিগ। কিন্তু হাতে বিভিন্ন অস্ত্র।

নীরব উত্তেজনা নিয়ে আমেরিকান ও বাংলাদেশি যোদ্ধাদের দিকে চেয়ে আছে তারা, কমাণ্ডার একবার খুন করতে নির্দেশ দিলেই শুরু হবে হত্যাযজ্ঞ।

মস্তকহীন দেহের পাশে বসেছে মাসুদ রানা, লাশটা দেখছে।

ডেল্টা ডিটাচমেন্টের যোদ্ধাদের সঙ্গে আইডি ট্যাগ বা প্যাঁচ নেই। কিন্তু ট্যাগ বা প্যাঁচ লাগল না রানার, ও ভাল করেই চেনে বিশেষ এই লোকটিকে। সবই বলে দিল দেহের গড়ন।

এ মেজর হার্লি অ্যাটলক, ডেল্টা ডিটাচমেন্টের নেতা।

চারপাশ একবার দেখে নিল রানা। আশপাশে কোথাও দেখা গেল না মাথাটা। ভুরু কুঁচকে গেল ওর। বিসিআই-এর একটি খবর মনে পড়ে গেছে। আবারও হার্লি অ্যাটলকের উপর স্থির হলো ওর চোখ। শুধু যে লোকটার মাথা কাটা হয়েছে, তা নয়, নিয়ে যাওয়া হয়েছে…

মেজর রানা, ওর ইয়ার পিসে বিস্ফোরিত হলো একটা কণ্ঠ। সার্জেন্ট গ্রেসন বলছি। আমরা অফিস টাওয়ারে। যা দেখছি বিশ্বাস করবেন না।

দেখো বিশ্বাস করি কি না। জানাও, কী হয়েছে।

অফিস টাওয়ারে আমাদের আগে আসা মেরিনরা সবাই শেষ। আর, স্যর… মেজর কার্লটনের মাথা কেটে নিয়ে গেছে কোন্ এক কুকুরের বাচ্চা!

মেরুদণ্ড বেয়ে হিমশীতল স্রোত নামল রানার। ঝড়ের গতিতে ভাবতে শুরু করেছে। চোখ বোলাচ্ছে চারপাশের হল এ। ফাটল ধরা জানালাগুলোর কাঁচ সাত রঙা আলো ফেলছে। বরফে ছাওয়া ধূসর দেয়ালে।

পাবলো-৯ পরিত্যক্ত, কেউ নেই, কিন্তু..

কোথাও নেই আমেরিকান সন্ত্রাসীরা…

হঠাৎ করেই হারিয়েছে রেডিয়ো কন্ট্যাক্ট। এর অর্থ…

ডেল্টা ও মেরিন ফোর্সের সবাই খতম। শুধু তাই নয়, হার্লি অ্যাটলক ও রবিন কার্লটনের মাথা কেটে নেয়া হয়েছে।

এখন বুঝতে শুরু করেছে মাসুদ রানা।

সার্জেন্ট গ্রেসন! থ্রোট-মাইকে নিচু স্বরে বলল রানা। এক্ষুণি এসো! ফাঁদে ফেলেছে, বদ্ধ খাঁচায় আটকে ফেলেছে আমাদের!

কথার ফাঁকে রানার চোখ গিয়ে পড়েছে ডকের হল-এ ছোট তুষারের এক স্তূপের উপর। ওমনি দেখেছে ওটার পিছন থেকে উঁকি দিয়েছে এক লোক। পোশাক ক্যামোফ্লেজ করা, হাতে কোল্ট কমাণ্ডো অ্যাসল্ট রাইফেল। তাক করেছে ওরই মাথা লক্ষ্য করে!

ঠিক তখনই হল-এর চারপাশ থেকে শুরু করল গুলি। বিশজন আততায়ীর গুলির তোড়ে মুহূর্তে ড্রাই ডক ফ্যাসিলিটি হয়ে উঠল রণক্ষেত্র।

বাঁচবার জন্য ডাইভ দিয়ে আরেক পাশে গিয়ে পড়ল রানা, আর তখনই ওর মাথার উপর দিয়ে হুশ-হুঁশ আওয়াজ তুলে। বেরোল দুটো বুলেট।

রানার মতই একই কাজ করেছে লেখক টু খবির ও কর্পোরাল জন হুক, ডাইভ দিয়ে পড়েছে ডেল্টা যোদ্ধাদের লাশের মাঝে। মেঝেতে লেগে রঙিন স্ফুলিঙ্গ তুলে নানাদিকে ছুটছে অজস্র বুলেট।

কিন্তু কপাল মন্দ দ্বিতীয় মেরিন টমি ম্যাগানের। চোখে রানার মতই সবুজ রে-ব্যান সানগ্লাস। কোনও সুযোগই পেল না

সে, অন্তত বিশটা গুলি বিধল ওর বুক-পেটে। ঝটকা দিয়ে নাচতে নাচতে পিছিয়ে গিয়ে ছিটকে পড়ল লাশটা মেঝেতে

জলদি! গলা ফাটিয়ে নির্দেশ দিল রানা, সাবমেরিনের নীচে! খবির ও জন হককে প্রায় ক্র্যাশ-ট্যাকল করল ও, সরিয়ে দিল লাইন অভ ফায়ার থেকে। গড়াতে শুরু করেছে তিনজন, উপরের এই পার থেকে খসে পড়ল ড্রাই ডকের দিকে। এক সেকেণ্ড পর উপরের মেঝে খুবলে নিয়ে ওদের মাথার উপর দিয়ে গেল কয়েক শ গুলি

রানা এবং ওর সৈনিকরা নীচে পড়ছে, তবে হেভিলি আর্মড ৩-ফোর্সের নেতার চোখের আড়ালে সরতে পারল না।

কমাণ্ডারের নাম কার্ট কে, এবেলহার্ড, অতীতে সাউথ আফ্রিকান এলিট রেকনেসেন্স কমাণ্ডো বাহিনীর মেজর ছিল।

তা হলে এই সে বিখ্যাত মাসুদ রানা, ভাবল এবেলহার্ড। দ্রুত পড়তে দেখছে সে বাঙালি কমাণ্ডোকে। এ লোকই শেষ করেছে ইউটাহ স্টেটে বিজ্ঞানী, কর্নেল বয়েস ইংগিলসকে। সত্যিই দারুণ রিফ্লেক্স লোকটার! কিন্তু, বাছা…

নিজের অবস্থান থেকে ধীরেসুস্থে নেমে এল কার্ট কে. এবেলহার্ড। সত্যিকারের নক্ষত্র ছিল সে রেকণ্ডো বাহিনীতে। প্রাক্তন ওই বর্ণবাদী বাহিনীর অনেকেই আজও তাকে মস্ত হিরো মনে করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র এলেও প্রথমে অনেকেই বুঝতে পারেনি এবেলহার্ড আসলে রক্তপিশাচ ও বর্ণবাদী। কিন্তু তারপর কালো এক সৈনিককে বুট ক্যাম্পে খুন করে বসল সে। যুবক সৈনিককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল হ্যাণ্ড-টু-হ্যাণ্ড ট্রেনিঙের সময়। এ কাজ আগেও করেছে, কিন্তু শেষবার ধরা পড়ল।

আসলে কার্ট কে, এবেলহার্ডের মত সৈনিক কখনও খুন না। করে থাকতে পারে না। সে সাইকোপ্যাথ, সোশিওপ্যাথ, খুনি–সামরিক বাহিনী থেকে জোর করে অবসর দেয়া হলে বাধ্য হয়ে সরে যেতে হলো তাকে। জঙ্গি দেশ পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনও দেশেই সামরিক বাহিনীতে রাখা হয় না তার মত উন্মাদ বেজন্মাদের।

অবসর নেয়ার কিছু দিনের ভিতর এবেলহার্ডকে ভাড়া করা হলো বিপুল টাকার বিনিময়ে। এই বিশেষ ইউনিটের কমাণ্ড তুলে দেয়া হলো তার হাতে। এটি হয়ে উঠল দুনিয়ার সেরা মার্সেনারি অর্গানাইযেশনের স্পেশাল অপারেশন টিম। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে অপারেট করে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী, বর্ণবাদী ওই কোম্পানি। নাম: একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ বা ই.এস.ওয়াই.।

ই.এস.ওয়াই, বেশিরভাগ সময় আফ্রিকান স্বৈরশাসকদের হয়ে কাজ করে, বদলে তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করে ডায়মণ্ড মাইনিঙের মুনাফার একটা বড় অংশ। এ ছাড়া, সুযোগ পেলেই ই.এস.ওয়াই লোভনীয় সব আন্তর্জাতিক বাউন্টি হান্ট-এ অংশ নেয়।

আর আজ যে দারুণ আর্কষণীয় বাউন্টি হান্ট শুরু হয়েছে, তাতে অংশ না নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সতেরোজন লোককে শেষ করে দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। প্রতিটা মাথার জন্য মিলবে তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার করে। কাউন্সিলে ই.এস.ওয়াই-র লোক ছিল, আর তার মাধ্যমে খবর পেয়ে এরই ভিতর দুটো মাথা জোগাড় করে ফেলেছে তারা। তৃতীয় মাথাটাও আজই একটু পরে তার হাতে আসবে।

এবেলহার্ডের পাশে থামল তার রেডিয়ো অপারেটার। স্যর, সবুজ টিম বলছে তারা অফিস টাওয়ারে মেরিনদের সঙ্গে লড়তে শুরু করেছে।

আস্তে করে নড করল এবেলহার্ড। তাদের জানাও, কাজ শেষ হলে যেন ব্রিজ ধরে ড্রাই ডকে ফেরে।

স্যর, আরেকটা কথা, বলল রেডিয়ো ম্যান।

বলো?

র‍্যানডলফ ছাদে, বলছে এক্সটার্নাল রেইডারে পাওয়া যাচ্ছে। দুটো ইনকামিং সিগনাল। চুপ হয়ে গেল যুবক। কয়েক মুহর্ত পর বলল, দুই সিগনেচার থেকে ওর মনে হয়েছে, ওই দুই যুদ্ধবিমান রাশান। একটাতে রয়েছে বাউন্টি হান্টার পোলিশ, অন্যটাতে মিস্টার ফগ।

কতটা দূরে তারা?

পোলিশের আসতে লাগবে পঁচিশ মিনিট। আর মিস্টার ফগের আসতে পনেরো মিনিট।

নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল এবেলহার্ড। পোলিশ ভয়ঙ্কর চতুর বাউন্টি হান্টার। সত্যিকারের হারামজাদা লোক। আর মিস্টার ফগ রহস্যময় এক বৈজ্ঞানিক। আগেও একবার এক মেয়েকে কেড়ে নিয়েছিল ওদের হাত থেকে। কেউ জানে না সে দেখতে কেমন, বা কোথায় তার আস্তানা। শুধু জানা গেছে, সে সুঠামদেহী, চোখে থাকে সানগ্লাস। পরনে কালো আলখেল্লা।

এ ধরনের মিশন মন থেকে ঘৃণা করে এবেলহার্ড। ঘৃণা করে বাউন্টি হান্ট। সঠিক সময়ে টার্গেট দখল করলেও চুতিয়া শালার বাউন্টি হান্টাররা হাজির হয়, ছোঁ দিয়ে কেড়ে নেয় শিকার। সোজা কথায়, এক বাউন্টি হান্টার চুরি করে আরেক বাউন্টি হান্টারের মাল। হাতে পেলেই গিয়ে টাকা বুঝে নিয়ে উধাও হয়।

সামনা-সামনি দুই দল মিলিটারি লড়লে যে দল জিতেছে তাদেরকে বিজয়ী ধরে নেয়া যায়, কিন্তু বাউন্টি হান্ট জিনিসটা ঠিক তেমন নয়। বাউন্টি হান্ট-এ সে জিতবে, যে সঠিক সময়ে ফিরতে পারবে পুরস্কার নিয়ে।

ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল এবেলহার্ড: পোলিশকে ঠেকাতে পারব আমি। ও একটা গণ্ডার কিন্তু আমিও কম না। আমরা ওকে এদিকে ভিড়তেই দেব না। কিন্তু ফগ ব্যাটা… সে বড় ধরনের সমস্যা করতে পারে।

সাবমেরিন গহ্বরের দিকে চাইল ই.এস.ওয়াই. কমাণ্ডার। মাইক্রোফোনে বলল, যা করার তাড়াতাড়ি করো। দেরি না করে মাসুদ রানার মুণ্ডু নিয়ে এসো আমার কাছে।

.

ড্রাই ডকের দেয়াল ঘেঁষে পড়ছে মাসুদ রানা, হোসেন আরাফাত খবির ও কর্পোরাল জন হক। ওরা তিরিশ ফুট নীচে ধপ করে এ পড়ল ডেল্টা ডিটাচমেন্টের দুই যোদ্ধার লাশের উপর।

জলদি! মুভ! মুভ! মুভ!

কংক্রিটের হঁটের উপর বসে আছে বিশাল কালো টাইফুন সাবমেরিন, দুই যোদ্ধাকে ওটার নীচে টেনে নিল রানা।

একেকটা কংক্রিটের ব্লক ছোটখাট গাড়ির সমান। এমন চারটে সারি ওজন নিয়েছে বিশাল সাবমেরিনের। ফলে টাইফুনের নীচে তৈরি হয়েছে সরু সব গলি। মাথার উপর সাবমেরিনের কালো স্টিলের খোল।

আঁধার গলির ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে ছুটতে শুরু করেছে রানা, তারই ফাঁকে থ্রোট-মাইকে বলে উঠল: গ্রেসন! সার্জেন্ট গ্রেসন! শুনছ?

ব্যস্ত কণ্ঠে ভেসে এল পাল্টা জবাব: মেজর! শিট! বৃষ্টির মত গুলি করছে! আর সবাই শেষ, স্যর। আমি… বাজে ভাবে আহত! সরে যেতে পারব না! দুঃখিত, স্যর, আমার পক্ষে আর… ওহ… না…

ওদিকে পটকার মত কয়েকটা গুলির আওয়াজ শুনল রানা। পরক্ষণে কেটে গেল সিগনাল।

পিছনে মোলায়েম কয়েকটা আওয়াজ শুনল রানা। চরকির মত ঘুরেই এমপি-৭ তুলল। কংক্রিটের ব্লকের তৈরি জঙ্গলের ওদিকে দড়ি বেয়ে গহ্বরে নামছে শত্রদল।

পিছনে খবির ও জনকে নিয়ে সামনে বাড়ল রানা। ছায়াময় গলির মত জায়গা। মাথার উপর টাইফুন সাবমেরিন। পিছন থেকে আসতে শুরু করেছে বুলেট।

ওদের পিছনে কংক্রিটের গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়েছে শত্র। সংখ্যায় কমপক্ষে দশজন। রণকৌশল অনুযায়ী একে অপরকে কাভার দিচ্ছে, সামনে বাড়ছে ছুটে ছুটে। দীর্ঘ গলিগুলোর ভিতর ভারী গুলিবর্ষণ চলছে। ড্রাই ডকের শেষে সি গেটের দিকে ছুটছে। রানার দল।

দৌড়ের ফাঁকে শত্রুদের দেখছে রানা। বুঝে নিচ্ছে তাদের ট্যাকটিক্স। নজর রেখেছে তাদের অস্ত্র কী ধরনের। স্ট্যাণ্ডার্ড রণকৌশল ব্যবহার করছে লোকগুলো। তাড়িয়ে নিয়ে শত্রুকে কোণঠাসা করতে চাইছে। কিন্তু তাদের অস্ত্রগুলো…

এরা কারা? রানার পাশে ছুটতে ছুটতে প্রশ্ন করল খবির।

জানি না, বলল রানা। তবে আঁচ করছি। কথাটা শুনতে ভাল লাগবে না তোমার।

বলুন তাও?

ওদের অস্ত্রগুলোর দিকে খেয়াল দাও।

চট করে পিছনের আততায়ীদের অস্ত্রের উপর চোখ বুলিয়ে নিল খবির। সাদা মুখোশ পরা কয়েকজনের হাতে এমপি-৫, আবার অন্যদের কাছে ফ্রেঞ্চ ফ্যামাস অ্যাসল্ট রাইফেল বা আমেরিকান কোল্ট কমাণ্ডো রাইফেল। দুয়েক জনের সঙ্গে একে ৪৭ বা চায়নিজ একে-৫৬।

দেখেছ অস্ত্র? ছোটার ফাঁকে বলল রানা। নানান জিনিস ওদের কাছে।

কুকুরগুলো তা হলে মার্সেনারি? জানতে চাইল খবির।

তাই তো মনে হচ্ছে।

কিন্তু আমাদের খুন করতে চায় কেন?

এখনও জানি না।

আমরা এখন কী করব? অসহায় সুরে বলল কর্পোরাল জন হক।

সেটাই ভাবছি, বলল রানা। চট করে দেখল মাথার উপরে সাবমেরিনের স্টিলের খোল। ওর চোখ খুঁজছে এসকেপ রুট।

একটা কংক্রিটের ব্লকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা, উঁকি দিল ওদিকে। দূরে দেখা গেল ড্রাই ডক পিট। এ গহ্বরের পুবে সাগরের বরফ-ঠাণ্ডা বিপুল পানিকে সরিয়ে রেখেছে ওই উঁচু স্টিলের সি গেট।

ড্রাই ডকের মেকানিক্স নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে রানা।

মস্ত টাইফুন সাবমেরিনকে এই ডকে আনতে গিয়ে নামাতে হয়েছে সি গেট। পানিতে টইটম্বুর হয়েছে ড্রাই ডক। নইলে ভিতরে আসত না ইয়াজদাহা নৌযান। কাজটা শেষে আবারও উঁচু করা হয়েছে সি গেট, তারপর আবারও পানি সরিয়ে খালি করেছে ড্রাই ডক। সে সময় কংক্রিটের ব্লকগুলোর উপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে সাবমেরিন। নৌযানের উপর কাজ শুরু করবার আগে পরিচ্ছন্ন, শুকনো পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।

আর ওই সি গেট…

এখন তীক্ষ্ণ চোখে ওদিকটা দেখছে রানা। আঁচ করছে ওই কবাটের ওপাশে রয়ে গেছে সাগরের মস্ত সুড়ঙ্গ। এবার উল্টো দিক দেখল রানা। ওদিকে সাবমেরিনের বো। ওখানেই দেখল

ওদের বাঁচবার একমাত্র উপায়।

খবির ও জনের দিকে ফিরল রানা, জানতে চাইল, তোমাদের সঙ্গে ম্যাগহুক আছে?

জী, স্যর, বলল জন হক।

আছে, স্যর, বলল খবির।

জিনিসটা ব্যবহারের জন্যে তৈরি থাকো, বলল রানা। চট করে আবারও দেখল প্রকাণ্ড স্টিলের সি গেট। ওটার উচ্চতা প্রায় তিনতলা, চওড়ায় কমপক্ষে নব্বই ফুট। পিঠের হোলস্টার থেকে ম্যাগহুক বের করে ফেলল ও।

আমরা কি ওই পথে বেরোব, স্যর? জানতে চাইল জন হক, ভয়ে কেঁপে গেল সাঁতার না জানা আমেরিকান সৈনিকের গলা।

না। উল্টো দিকে যাব। কিন্তু সেটা করতে হলে আগে উড়িয়ে দিতে হবে সি গেট।

সি গেট উড়িয়ে দেবেন? হাঁ হয়ে গেল জন হক। চট করে খবিরের দিকে চাইল।

কাঁধ ঝাঁকাল খবির। ওঁর কৌশল অন্যরকম।

ঠিক তখনই ওদের চারপাশের কংক্রিটের ব্লকে লাগল এক পশলা গুলি। সি গেটের দিক থেকে এসেছে।

কাভার নেয়ার জন্য উবু হলো রানা, চট করে উঁকি দিল, ওদিকটা। পিটের ওদিকে নেমে পড়েছে কমপক্ষে আরও দশজন। মার্সেনারি সৈনিক।

রানা টের পেল, শিরিষের মত শুকিয়ে গেছে গলা। পিটের মাঝখানে ওরা, আর ওদের দুপাশে রক্ত-লোভী লোকগুলো।

এগুতে শুরু করেছে মার্সেনারিদের নতুন দল।

যা করার এখনই, খবির ও হককে বলল রানা।

চার

ড্রাই ডকের উপর থেকে নজর রেখেছে কার্ট কে, এবেলহার্ড। দেখল, মাসুদ রানা এবং ওর দুই সঙ্গীকে দুপাশ থেকে চেপে ধরতে চলেছে মার্সেনারিরা।

শীতল হাসি হাসল কার্ট কে, এবেলহার্ড।

বড় সহজেই লোকটাকে মুঠোয় পাওয়া গেছে।

.

কমব্যাট ওয়েবিং থেকে দুটো থার্মাইট-অ্যামাটল ডেমোলিশন চার্জ বের করেছে রানা। চাপা স্বরে বলল, খবির, হক, ম্যাগহুক তৈরি?

মুখে জবাব না দিয়ে ম্যাগহুক বের করে ফেলেছে দুই সৈনিক।

এবার মনোযোগ দাও, টাইফুন সাবমেরিনের পোর্ট সাইটে সরে গেল রানা। ম্যাগহুক তুলেই ফায়ার করল। এত কম রেঞ্জে তাক ফস্কে যাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

জোরাল শব্দ হলো: ঠং!

রানার মত একই কাজ করল, খবির ও হক।

ঠং! ঠং! দুই আওয়াজ ছড়িয়ে গেল মস্ত ড্রাই ডকে।

সাবমেরিনের পিছন দিক দেখে নিল রানা। বলল, জলোচ্ছাস এলেই ম্যাগহুকের দড়ি গুটিয়ে নেবে। উঠবে সাবমেরিনের বাইরের দিক দিয়ে।

জলোচ্ছাস? বলল হক, কিন্তু জলোচ্ছাস আসবে কোথা…

জবাব দিল না রানা। হাতের দুই ডেমোলিশন চার্জ দেখাল। চট করে টিপে দিল টাইমারের সিলেক্টর সুইচ।

থার্মাইট-অ্যামাইল চার্জে তিন রঙের টাইমার সুইচ থাকে লাল, সবুজ এবং নীল। লাল সুইচের কারণে পাঁচ সেকেও সময় পাওয়া যায়। সবুজ সুইচ সময় দেবে তিরিশ সেকেণ্ড। এবং নীল পুরো এক মিনিট।

রানা টিপেছে লাল সুইচ।

দেরি না করে ছুঁড়ে দিল বেসবলের মত। উড়ে গেল ওগুলো ড্রাই ডকের মাঝ দিয়ে। মার্সেনারিদের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে লাগল প্লেট-স্টিলের সি গেটে। ঠনাৎ করে পড়ল গেটের পায়ের কাছে।

ওদিকটাই গেটের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা। গেট ওখানে মিশেছে কংক্রিটের ডানদিকের দেয়ালে।

পাঁচ সেকেণ্ড…

চার…

ভাগার সময় ব্যথা লাগবে… বলল খবির। ম্যাগহুকের দড়ি পেঁচিয়ে নিল বাম বাহুতে। দেখাদেখি একই কাজ করল জন হক।

ওয়ান! ফিসফিস করল রানা। চেয়ে আছে বাঁধের দিকে। এবার!

বুম করে ফাটল বোমা।

থার্মাইট-অ্যামাটল ডেমেলিশন চার্জের দুই বিস্ফোরণ কাঁপিয়ে দিল গোটা ড্রাই ডক বিল্ডিঙের দেয়াল।

ঝলসে উঠল অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো। সি গেট দেখে মনে হলো সাক্ষাৎ নরকের দরজা। চারপাশে ছিটকে গেল কটগন্ধী। ধোঁয়া, কংক্রিট ব্লকগুলোর গলির মাঝ দিয়ে ছুটল। ধোঁয়া ঘিরে ফেলেছে কাছের আততায়ীদেরকে। চলার পথে যা পেল, ঢেকে ফেলল। ঢাকা পড়ল রানা, খবির ও হক।

এক সেকেণ্ডের জন্য নামল থমথমে নীরবতা।

পরক্ষণে বিকট কড়াৎ! শব্দ হলো। সাগরের বিপুল পানির চাপে ভেঙে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত সি গেট। কমপক্ষে এক শ মিলিয়ন লিটার পানি ঢুকল গহ্বরের ভিতর। ধাক্কা খেয়ে সরে গেল ধোঁয়া, সে জায়গা নিল মস্ত এক জলপ্রাচীর।

গা শিউরে দেয়া আওয়াজ তুলছে আগ্রাসী সাগরের পানি। গহ্বর ধরে ছুটে এল গুড়-গুড় শব্দ তুলে। পাক খেয়ে উঠছে। ফেনা। জলপ্রাচীর গড়িয়ে আসছে অ্যানাকোণ্ডা সাপের মত।

উড়ে গেল কাছের মার্সেনারিরা, তাদেরকে তলিয়ে দিয়ে ছুটে গেল পানির দেয়াল পশ্চিমদিক লক্ষ্য করে। যে-কোনও সময়ে চাপা পড়বে রানা, খবির ও হক।

পরের সেকেণ্ডে, ওদেরকে গিলে নিল সাগর-দানব। এক মুহূর্ত আগে ওরা যেখানে ছিল, সেখান থেকে ছোঁ দিয়ে তুলল। উপরের খোলে ঠুকে গেল মাথা, ছেঁড়া পুতুলের মত ছিটকে চলেছে ওরা টাইফুন সাবমেরিনের বো-র দিকে।

রক্ষা পেল না মার্সেনারিদের দ্বিতীয় দলও। গড়িয়ে যাওয়া। পানির দেয়াল ছিটকে ফেলল তাদেরকে ড্রাই ডকের কংক্রিটের দেয়ালে। তলিয়ে গেল বেশিরভাগ মার্সেনারি। ভরে উঠতে শুরু করেছে দু শ মিটার দৈর্ঘ্যের পিট।

অবশ্য, রানারা কেউ ছিটকে পড়ল না কংক্রিট দেয়ালে। সিংহের মত গর্জনরত পানির দেয়াল ওদেরকে তুলে নিতেই শক্ত করে ধরেছে ওরা ম্যাগহুক লঞ্চার, টিপে দিয়েছে ম্যাগনেটিক হুকের সুইচ। বিদ্যুদ্বেগে দড়ি গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে লঞ্চার।

টাইফুন সাবমেরিনের বো-র পাশে পৌঁছে যেতেই চেঁচিয়ে উঠল রানা, দড়ি গুটিয়ে নেয়া বন্ধ করো!

ম্যাগহুকের গ্রিপের বাটন টিপে দিয়েছে নিজে। ফলে দড়ি টেনে নেয়া বন্ধ করেছে ক্ল্যাম্পিং মেকানিম।

রানার মত একই কাজ করল খবির ও হক।

ঝটকা খেয়ে থেমে গেছে ওরা টাইফুন সাবমেরিনের বো-র পাশে। চারপাশে খলখল করে হাসছে সাগর। ওদেরকে ভিজিয়ে দিচ্ছে লক্ষ মিহি জলকণা।

পাশেই টাইফুন সাবমেরিনের পোর্ট সাইডের খোলা টর্পেডো টিউব আগেই দেখেছে রানা।

পাবলো-৯ পরিত্যক্ত হওয়ার সময় ওটা রিপেয়ার-হচ্ছিল।

এখন ছুটন্ত পানির সামান্য উপরে খোলা টর্পেডো টিউব।

ভেতরে ঢোকো! মাইকে চেঁচাল রানা। টিউবের ভেতর!

পানির উচ্চতা বাড়ছে। রানার নির্দেশে সাপের মত পিছলে টর্পেডো টিউবে ঢুকল খবির ও হক। এগুতে হচ্ছে জলস্রোত কেটে। সাবমেরিনের ভিতর ঢুকে পড়েছে সাগর।

কয়েক সেকেণ্ড পর নীরবতা নামল চারপাশে।

সবার শেষে টর্পেডো টিউবে ঢুকেছে রানা। খাটো সুড়ঙ্গ শেষে নিজেকে আবিষ্কার করল সোভিয়েত টাইফুন-ক্লাস। ব্যালেস্টিক মিসাইল সাবমেরিনের পেটে।

শীতল স্টিলের রাজ্যে অনুপ্রবেশ করেছে ওরা।

ঘরের মাঝে টর্পেডোর কয়েক সারি র‍্যাক, সব খালি। ছাতে পাইপের সারি। বদ্ধ এ পরিবেশে আজও রয়ে গেছে ভয়ের গন্ধ, সাবমেরিনারদের ঘামের গন্ধ।

দুই খোলা টর্পেডো টিউব দিয়ে ঘরে এসে পড়ছে মোটা দুই জলের ধারা। ক্রমেই ভরে উঠছে ঘর।

প্রায়ান্ধকার পরিবেশ। আলো বলতে টর্পেডো টিউব দিয়ে আসা সামান্য ধূসর আভা।

এমপি-৭-এর ব্যারেলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে নিল ওরা।

এসো, প্রত টর্পেডো রম থেকে বেরিয়ে এল রানা। সামনে এগোচেই হাটু পানি ভেঙে।

ওরা চলে এল টাইফুল সাবমেরিনের ভয় জাগানো সাইলো হল-এ।

দীর্ঘ ব্যারাকের মত ঘর, অনেক উপরে ছাত। পাশাপাশি বিশটি প্রকাণ্ড সাইলো, মেঝে থেকে হাত পর্যন্ত। দেখলে কেন যেন মনে হয় দানৰীয় চুরুট! সাইলোর পাশে নিজেদেরকে বামন মনে হলো ওদের!

এসব সাইলো পাশ কাটিয়ে ছুটতে শুরু করেছে রানা। খেয়াল করল, কোনও কোনও সাইলোর হ্যাচ খোলা।

ভিতরে মিসাইল নেই।

তবে কমপক্ষে ছয়টা সাইলোর হ্যাচ পুরোপুরি বন্ধ।

আন্দাজ করা যায় ভিতরে রয়ে গেছে মিসাইল।

এবার কী, স্যর? জানতে চাইল খবির।

কন্ট্রোল রুম! বলল রানা, এদের ব্যাপারে তথ্য দরকার।

কাছের রাং-ল্যাডার বেয়ে উঠল রানা, চলে এল ফ্লাই-এ।

তিরিশ সেকেণ্ড পর পৌঁছে গেল টাইফুন সাবমেরিনের কন্ট্রোল রুমে।

চারপাশে ধুলো। ঘরের প্রতি কোণে মাকড়সার ঝুল। রানা, খবির ও হকের ফ্ল্যাশলাইটের রশিতে দেখা গেল, কোথাও কোথাও ধুলোর তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে চকচকে ইস্পাতের কন্সেল।

কমাণ্ড প্ল্যাটফর্মে গিয়ে থামল রানা, ওখানেই পেরিস্কোপ। মেঝে থেকে স্কোপ তুলল ও, ঘুরে চাইল খবিরের দিকে।

দেখো তো বিদ্যুৎ পাওয়া যায় কি না। সাবমেরিনের সঙ্গে বেসের ইলেকট্রিকাল কানেকশন থাকার কথা। ওমনিবাস সেন্ট্রাল কন্ট্রোল সিস্টেমের সুইচ খুঁজে বের করো। ওটা অন করলেই পাব ইএসএম আর রেডিয়ো। অ্যান্টেনা অন লাইনে থাকার কথা।

জী, খুঁজতে শুরু করেছে খবির।

পেরিস্কোপ পুরো উপরে তোলা। জিনিসটা প্রাথমিক পর্যায়ে। রয়ে গেছে, বৈদ্যুতিক শক্তি লাগে না। স্কোপে চোখ রাখল রানা।

পরিষ্কার দেখা গেল ড্রাই ডক হল। সাবমেরিনের পাশে নাচছে সাগরের পানির ঢেউ। উপরে ড্রাই ডকের মেঝের পারে ছয়জন মার্সেনারি, চেয়ে আছে এদিকে। এখনও ভরে উঠছে ড্রাই ডক।

পেরিস্কোপ সরিয়ে অন্যদিকে চাইল রানা। ওর চোখ গেল ড্রাই ডকের দোতলা উঁচু ব্যালকনির উপর।

ওখানে আরও বেশ কজন মার্সেনারি। তাদের ভিতর একজন ক্ষ্যাপা নর্তকের মত হাত নাড়ছে। নির্দেশ দিচ্ছে বোধহয়। ছয় মার্সেনারি ছুটল গ্যাংওয়ের দিকে। ওই গ্যাংওয়ে টাইফুন সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের ব্যালকনির মেঝের সমান উচ্চতায়।

লোকগুলোকে দেখছে রানা। তাড়া দিল, খবির? বিদ্যুৎ পেলে?

কী যে কী বুঝি না, স্যর, হতাশ স্বরে বলল খবির। রাশান ভাষা জানি না!

চট করে ওর পাশে চলে গেল রানা। সুইচগুলো দেখতে শুরু করেছে। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় পটাপট কটা সুইচ টিপল। হুমমম্ আওয়াজ তুলে কী যেন চালু হয়েছে। জ্বলে উঠল বাতি।

এই যে, স্যর, বলল খবির।

ওর হাত থেকে ধুলোভরা হেডফোন নিল রানা। কানেশন দিল সাবমেরিনের ইলেকট্রনিক সাপোর্ট মেযারের অ্যান্টেনার সঙ্গে। শেষ জিনিসটা প্রতিটি আধুনিক সাবমেরিনেই থাকে। ইএসএম অ্যান্টেনা দুরন্ত স্ক্যানার। বেশিরভাগ রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি ধরবে, নজর রাখবে কোথায় কী হচ্ছে।

কানে হেডসেট বসিয়ে নিতেই কণ্ঠস্বর শুনল রানা।

…উন্মাদ হারামজাদা উড়িয়ে দিয়েছে সি গেট!

…ঢুকে পড়েছে টর্পেডো টিউবে! শালারা আছে সাবমেরিনের ভেতর!

শোনা গেল একটা শান্ত কণ্ঠ।

আবারও পেরিস্কোপে চোখ রেখেছে রানা। ব্যালকনি লেভেলে একজনকে দেখল। গম্ভীর ভঙ্গিতে কথা বলছে ওই লোক।

…সবুজ দল, কনিং টাওয়ারের মাধ্যমে সাবমেরিনে ঢোকো। নীল দল, আরেকটা গ্যাংওয়ে খুঁজে নাও। ওটাকে সেতু হিসেবে ব্যবহার করবে। দুজনের দল তৈরি করবে। সাবমেরিনের সামনে দিয়ে ঢুকবে একদল, অন্যদল পিছনের এসকেপ হ্যাচ দিয়ে…

লোকটার কণ্ঠ খেয়াল করছে রানা।

কড়কড়ে স্বরে কথা বলছে সে। উচ্চারণ দক্ষিণ আফ্রিকান শ্বেতাঙ্গদের মত। শান্ত, কোনও উত্তেজনা নেই কণ্ঠে।

লোকটার দিকে চেয়ে কু ডাকতে লাগল রানার মন।

এইমাত্র বানে ভেসে গেছে কমপক্ষে বারোজন সৈনিক, তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সে। চেহারায় রাগের কোনও অনুভূতি নেই।

স্যর, রেইডার থেকে বলছি। দুটো ইনকামিং এরিয়াল কন্ট্যাক্ট পাওয়া গেছে। একটা ইয়াক-১৪১ স্ট্রাইক ফাইটার, অন্যটা সুখোই ফাইটার, স্যর।

জানতে চাইল কমাণ্ডার, ইটিএ?

বর্তমান গতি অনুযায়ী প্রথমটা পৌঁছবে পাঁচ মিনিট পর, অন্যটা এসে যাবে তার দশ মিনিট পর।

মনে হলো চিন্তা করছে কমাণ্ডার। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ক্যাপ্টেন হডসন, তোমার দলের সবাইকে এখানে পাঠিয়ে দাও। প্রথম ফাইটার সম্ভবত মিস্টার ফগের। দ্বিতীয়টাতে আছে বাউন্টি হান্টার পোলিশ। ওকে নিয়ে ভাবছি না, কিন্তু মিস্টার ফগ সমস্যা তৈরি করতে পারে। তার উদ্দেশ্য আমাদের কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়। প্রতিযোগীরা আসার আগেই এদিকের কাজ শেষ করতে চাই।

সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে, জবাবে বলল ফ্রেঞ্চ কণ্ঠস্বর।

বিদ্যুদ্বেগে ভাবতে শুরু করেছে রানা।

ঝড়ের মত এসে হাজির হবে লোকগুলো। কনিং টাওয়ার, ফরওয়ার্ড ও.রিয়ার এসকেপ হ্যাচ গলে আসবে।

রিইনফোর্সমেন্ট আসছে তাদের।

কিন্তু আসছে কোথা থেকে?

আবারও ভাবো, নিজেকে বলল রানা।

তোমার শত্রুরা আসলে কারা?

কোনও ধরনের মার্সেনারি দল।

তারা এখানে এসেছে কেন?

বিসিআই-এ থেকে রানা শুনেছিল শুরু হতে পারে মস্ত এক বাউন্টি হান্ট। যেন সাবধানে থাকে।

আর এখন অ্যাটলক ও রবিনের মাথা কেটে নিয়েছে তারা।

আর কী জানি? ভাবল রানা।

দক্ষিণ আফ্রিকান কমাণ্ডার বলেছে, তাদের প্রতিযোগীরা আসতে শুরু করেছে।

এখন এই পরিস্থিতিতে ওর নিজের কী করা উচিত?

বেশি কিছু করার নেই।

কোনওভাবেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না ম্যাককোল এয়ার ফোর্স বেসে।

এখান থেকে সরে যাওয়ারও উপায় নেই।

অপেক্ষা করতে হবে কখন পৌঁছুবে রেঞ্জার ফোর্স।

কোনও ভুল না হয়ে থাকলে তারা আসবে তিরিশ মিনিট পর।

কিন্তু এই তিরিশ মিনিট ওরা টিকে থাকবে কী করে?

সময় এখন শত্রুদের পক্ষে।

এদের প্রতিযোগীদের কথা বাদই থাক, এদের হাতে অফুরন্ত সময়। ডালে বসে থাকা পাখির মত ওদেরকে মারতে পারবে।

ভাবছে রানা, প্রথমেই পাল্টে দিতে হবে এই পরিস্থিতি। প্রথম কাজ হওয়া উচিত শত্রুদের অফুরন্ত সময় সংক্ষিপ্ত করে দেয়া।

চারপাশে চাইল রানা। কন্ট্রোল রুমে জ্বলছে পাইলট লাইটস।

তার মানে বিদ্যুৎ আছে।

ভাল।

তার মানে…

সিল করা ছয় মিসাইল সাইলোর কথা ভাবতে শুরু করেছে। রানা।

অন্য হ্যাচগুলোর মুখ খোলা, কিন্তু ওই ছয়টা…

ভিতরে মিসাইল থাকতে পারে।

নিশ্চয়ই ওয়ারহেড সরিয়ে ফেলেছিল রাশানরা।

কিন্তু মিসাইল হয়তো রয়ে গেছে হ্যাঁচের ভিতর।

এদিকে এসো, জন হককে পেরিস্কোপের দিকে ইঙ্গিত করল রানা। ওদের ওপর চোখ রাখো।

রানার হাত থেকে পেরিস্কোপ নিল কর্পোরাল। দ্রুত সামনের কন্সেলের কাছে চলে গেল রানা। খবির, কাজে হাত লাগাও।

কী করতে হবে, স্যর? জানতে চাইল খবির।

জানতে চাই সাবমেরিনের মিসাইল এখনও কাজ করে কি না।

পাওয়ার সুইচ টিপতেই জ্যান্ত হয়ে উঠল কলে। পর্দায় ভেসে উঠল কোড স্ক্রিন। আইএসএস-এর কমপিউটার থেকে হ্যাঁক করা অল-পারপাস সোভিয়েত কোড বিসিআই-এর জন্য ডাউনলোড করেছিল রায়হান রশিদ, মনে আছে রানার। ম্যাককোল এয়ার ফোর্স বেসে ওই একই কোড ওকে দেয়া হয়েছিল পাবলো-৯-এর জরুরি ডিজিটাল কিপ্যাড খুলবার জন্য। ওটা ওকে মুখস্থ করিয়েছিল গলাছেলা শুকনের মত এক কর্নেল।  ওটা ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড। আলটিমেট ইলেকট্রনিক স্কেলিটন কি, ডিযাইন করা হয়েছিল সিনিয়র সোভিয়েত পারসোনেলদের জন্য। আট ডিজিটের কোড। সোভিয়েত আমলের প্রতিটি কিপ্যাড লকে কাজ করত। একই জিনিস আমেরিকানদেরও রয়েছে, ওটা জানেন শুধু প্রেসিডেন্ট ও জনা কয়েক অত্যন্ত সিনিয়র সামরিক অফিসার।

ব্যালকনিতে ছয়জনকে দেখছি, গ্যাংওয়ের দিকে আসছে! জানাল জন হক, গ্রাউণ্ড ফ্লোরে আরও চারজন। একটা সেতু নিয়ে এসেছে, সাবমেরিনে উঠতে চায়!

একবার রানাকে দেখল খবির, তারপর এমপি-৭ হাতে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

ব্যস্ত হাতে কন্সেলে সুইচ টিপছে রানা। একের পর এক তথ্য আসছে পর্দায়।

হ্যাঁ, টাইফুন সাবমেরিনের সামনের সাইলোয় রয়ে গেছে। বেশ কয়েকটা মিসাইল।

তাই, আনমনে বলল রানা!

সাইলোর ভিতর রয়েছে মিসাইল, কিন্তু সরিয়ে নেয়া হয়েছে নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড। সংখ্যায় মিসাইল ছয়টি।

আমার শুধু একটা দরকার, ভাবল রানা। খবিরের দিকে না। চেয়েই বলল, খুলে দাও সাইলোর ছয় হ্যাচ। সপ্তম হ্যাচও খোলা রাখবে।

বাড়তিটা দিয়ে কী করবেন, স্যর? জানতে চাইল খবির।

পরে বলব।

কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে গেল খবির। একমিনিট পর খুঁজে পেল নির্দিষ্ট জিনিস। টিপতে লাগল হ্যাচ সুইচ। ওগুলো সাইলো রুমের ডান পাশে।

.

অদ্ভুত দৃশ্য দেখে চোখ বিস্ফারিত হলো কার্ট কে. এবেলহার্ডের। ড্রাই ডকের মাঝে টাইফুন ক্লাস সাবমেরিন, এবং ওটার পিঠে উঠছে তার লোক। ফরওয়ার্ড ও রিয়ার হ্যাচ গলে ভিতরে ঢুকবে। কিন্তু সেজন্য বিস্মিত হয়নি এবেলহার্ড, অন্য কারণে বিড়বিড় করে বলল, লোকটা করছেটা কী?

হাইড্রলিক কজার উপর ভর করে খুলে যাচ্ছে সাবমেরিনের ফরওয়ার্ড মিসাইল হ্যাচ।

.

কী করতে চান, স্যর? জানতে চাইল খবির।

যুদ্ধের জন্যে বেঁধে দেয়া সময় বদলে দেব, বলল রানা। অন্য স্ক্রিন আনল কমপিউটারে। দেখা গেল পাবলো-৯-এর। জিপিএস কো-অর্ডিনেটস।

এবার কমপিউটারকে জরুরি তথ্য দিল রানা। ওর নির্দেশ অনুযায়ী উৎক্ষেপণ করা হবে মিসাইল। ওটা আকাশ চিরে ছুটবে বিশ মিনিট, এরপর টার্গেট করা কো-অর্ডিনেটস্ অনুযায়ী আঘাত হানবে।

ছয়টি মিসাইলই কাজ করবে, এমনটা আশা করছে না রানা।

গত কয়েক বছরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সলিড-ফিউয়েল রকেট বুস্টারের ও-রিং সিল। হয়তো একটা মিসাইলও ফায়ার হবে না।

কিন্তু শুধু একটা কাজ করলেই চলবে ওর।

এক এক করে মিসাইলগুলোকে জাগাতে চাইল রানা।

সাড়া দিল পঞ্চম মিসাইল।

ওটার সবুজ রঙের গো লাইট জ্বলে উঠেছে।

এবার কমপিউটার চাইল ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল-কোড।

ইউনিভার্সাল ডিসআর্ম কোড ব্যবহার করল রানা।

অথোরাইযেশন মেনে নেয়া হলো।

দেরি না করে ফায়ার বাটন টিপে দিল রানা।

.

আগেই আওয়াজ শুনেছে কার্ট কে. এবেলহার্ড, এবার চোখের সামনে দেখল আশ্চর্য দৃশ্য।

সাবমেরিনের বুকের গভীরে আওয়াজ উঠছে ধ্রমমমমমম্। পরক্ষণে কান ফাটিয়ে দেয়া সাঁৎ শব্দের বিস্ফোরণ হলো। সাবমেরিনের ফরওয়ার্ড হ্যাঁচের একটা থেকে শোও করে বেরিয়ে গেল এসএস-এন-২০ ব্যালেস্টিক মিসাইল।

যেন আকাশে উঠছে স্পেস শাটল। চারপাশে ছুটল বিপুল ধোঁয়া, উন্মাদের মত ছড়াতে শুরু করেছে, পুরো ঢেকে ফেলল ড্রাই ডক হল। ধূসর কুয়াশায় হারাল প্রকাণ্ড টাইফুন সাবমেরিন বা মার্সেনারিরা।

বিদ্যুদ্বেগে উঠছে মিসাইল, চুরমার করল ফাটল ধরা কাঁচের ছাত, দেখতে না দেখতে হারিয়ে গেল সাইবেরিয়ার ধূসর আকাশ থেকে।

বিচলিত হলো না এবেলহার্ড। শান্ত স্বরে বলল, তোমরা হামলা শুরু করো। …ক্যাপ্টেন হডসন, কোথায় রিইনফোর্সমেন্ট?

কেউ দিগন্ত থেকে শ্ৰম-নগরী পাবলো-৯কে দেখলে তার চোখে পড়বে অবিশ্বাস্য দৃশ্য: মৃত শহরের মাঝ থেকে দীর্ঘ ধোঁয়ার কলাম রকেটের মত উঠছে আকাশ চিরে।

এবং সত্যিই ওই দশ্য দেখেছে দুজন।

তারা বসে আছে রাশান সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি ইয়াক ১৪১ ফাইটার জেট বিমানের ককপিটে।

ওই বিমান ছুটে চলেছে পাবলো-৯ লক্ষ্য করে।

পাঁচ

টাইফুন ক্লাস সাবমেরিনের কন্ট্রোল রুমে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা। জন হকের কাছে জানতে চাইল, ওরা কোথায়?

চারপাশ ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে, স্যর, বলল কর্পোরাল। কিছুই দেখছি না।

পেরিস্কোপের ওদিকে শুধু ঘন ধূসর ধোঁয়া। জায়গাটা সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের ছোট্ট ঘর। কনিং টাওয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত সরু এক গ্যাংওয়ে ওখানে, চলে গেছে সোজা ব্যালকনির মেঝেতে।

দেখছি না কিছু…

পেরিস্কোপ ঘষা দিয়ে গেল এক লোক। প্রকাণ্ডদেহী, মুখে গ্যাস মাস্ক।

ওরে বাবা! আইপিস থেকে ছিটকে পিছিয়ে এল জন হক। যিশু! ওরা চলে এসেছে! আমাদের মাথার ওপর!

তাতে সমস্যা নেই, বলল রানা। নীচে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে এগুতে শুরু করেছে। এবার আমরা সরে যাব, দেখা হবে না ওদের সঙ্গে।

মিসাইল সাইলো হল-এ খবিরের সঙ্গে মিলিত হলো রানা ও হক। ছুটতে শুরু করেছে রানা, ওর দেখাদেখি অন্য দুজন। মেঝেতে জমেছে এক ফুট পানি।

খালি একটা সাইলোর সামনে থামল রানা, ইশারা করল খবির ও হককে। আগেই খোলা হয়েছে এই সাইলোর হ্যাচ। গোলাকার ঘরে ঢুকে পড়ল ওরা।

দৈত্যাকার চুরুটের মত মিসাইল সাইলো, উপরে উইঞ্চ। মনে হলো ওটা খুব ছোট। দেখা গেল সাবমেরিনের খোলা আউটার হাল হ্যাচ। সপ্তম সাইলোর ভিতর ঢুকেছে রানা। মেঝে থেকে শুরু করে ছাতে পৌঁছে গেছে রাং ল্যাডার।

মই বেয়ে উঠতে শুরু করল রানা ও তার দুই সৈনিক।

সাইলোর ছাদ সমতলে মাথা পৌঁছে যেতেই উঁকি দিল রানা। দেখল, সাবমেরিনের ফরওয়ার্ড এসকেপ হ্যাঁচের ভিতর হারিয়ে গেল দুই মার্সেনারি। তারা ছিল মাত্র তিন মিটার দূরে।

ভাল, ভাবল রানা। এরা গিয়ে ঢুকছে সাবমেরিনের পেটে, আর ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে।

আরও ভাল, ড্রাই ডক ও সাবমেরিন এখনও ডুবে আছে সাদাটে ধোঁয়ায়।

ব্যালকনির দিকে গেল রানার চোখ।

মার্সেনারিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকান কমাণ্ডার।

ওই লোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই, ভাবল রানা। সাইলো থেকে বেরিয়েই ছুটতে শুরু করল ও। এবার রাং ল্যাডার বেয়ে উয়ে পড়বে টাইফুন সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারে। ওখান থেকে যাবে ওদিকের ব্যালকনিতে।

রানা এবং দু সৈনিক তরতর করে উঠে এল কনিং টাওয়ারে, ছুটতে লাগল সরু গ্যাংওয়ে ধরে। চলেছে সামান্য উপরের ওই ব্যালকনির মেঝের দিকে।

ব্যালকনির আরেক পাশে ছোট ইন্টারনাল অফিস। দরজায় দাঁড়িয়ে রেডিয়োতে নির্দেশ দিচ্ছে মার্সেনারি কমাণ্ডার। ধোঁয়ার মাঝে সাবমেরিনের দিকে চেয়ে আছে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক সশস্ত্র বডিগার্ড।

ধূসর ধোঁয়ার কাভার নিয়ে কনিং টাওয়ার থেকে ব্যালকনির দিকে ছুটছে রানা ও দুই সৈনিক।

আরও কয়েক সেকেণ্ড পর লাফিয়ে উঠল দক্ষিণ আফ্রিকান মার্সেনারি কমাণ্ডার এবং তার বডিগার্ড।

খবরদার! কানের কাছে গর্জে উঠেছে রানা। একই সময়ে গুলি করল বডিগার্ড ও জন হক। বুকে রানার গুলি নিয়ে ছিটকে পড়ল বডিগার্ড। আগেই তার গুলি খেয়ে ধপ করে পড়ে গেছে জন হক।

তখনই হোলস্টার থেকে ছোঁ দিয়ে পিস্তল নিল মার্সেনারি কমাণ্ডার, দেখল খুবই কাছে মাসুদ রানা। ডাইভ দেয়ার পর গড়িয়ে যাওয়ার ফাঁকে গর্জে উঠল রানার ডেযার্ট ঈগল। ওর দুই গুলি বিধল কার্ট কে, এবেলহার্ডের বুকে এবং হাতে।

ঝটকা খেয়ে চারফুট পিছিয়ে গেল লোকটা। পিস্তল পড়েনি হাত থেকে। ধাক্কা খেল অফিসের বাইরের দিকের দেয়ালে। বসে পড়েছে মেঝেতে।

হক! ঠিক আছ? জানতে চাইল রানা। উঠে দাঁড়িয়ে এক লাথিতে উড়িয়ে দিল এবেলহার্ডের পিস্তল।

কাঁধে গুলি খেয়েছে জন হক, কুঁচকে রেখেছে মুখ।

ওর ক্ষত পরীক্ষা করল খবির।

মাংস ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।

এবেলহার্ডেরও তেমন কিছুই হয়নি। স্লো গিয়ারের নীচে ছিল বুলেট ভেস্ট। অফিসের বাইরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। বিদঘুঁটে চেহারা করে বামহাতে টিপে ধরেছে আহত ডান কব্জি।

তার কপালে ডেযার্ট ঈগলের নলের মুখ ঠেকাল রানা। কে তুমি, এবং এখানে কেন?

কেশে চলেছে এবেলহার্ড। শ্বাস নিতে চাইছে হাঁপিয়ে।

আরেকবার বলব: তুমি কে, এবং এখানে কেন?

কর্কশ কণ্ঠে ফিসফিস করল সে, আমার নাম… কার্ট কে, এবেলহার্ড… একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র সঙ্গে আছি।

মার্সেনারি, মনে মনে বলল রানা। মুখে বলল, এখানে কেন তোমরা? কী কারণে আমাদেরকে খুন করতে চাইছ?

সবাইকে না, মেজর। শুধু তোমাকে।

আমাকে এত বিশেষ খাতির করার কারণ?

ডেল্টা ডিটাচমেন্টের মেজর হার্লি অ্যাটলক, মেরিন ফোর্সের মেজর রবিন কার্লটন আর তোমাকে চেয়েছি আমরা।

কেন?

এসব জেনে লাভ কী তোমার? বাঁকা হাসল এবেলহার্ড।

কথা বাড়াবার সময় নেই। দেরি না করে লোকটার আহত কব্জির উপর ডান বুট চাপিয়ে দিল রানা। সামান্য মাড়িয়ে দিতেই উফ করে উঠল লোকটা।

সরাসরি রানার চোখে চাইল। চোখ থেকে ঝরছে গোক্ষুরের বিষ।

তোমাদের মাথার ওপর পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। যারা তোমাদের মাথা কাটবে, তারা বাউন্টির পুরস্কার পাবে।

বুকের ভিতর ভয়ের শিহরন টের পেল রানা। বামহাতে বুক পকেট থেকে মোচড়ানো কাগজ বের করল এবেলহার্ড। ওটা বাড়িয়ে দিল। পড়ে দেখো।

প্রায় ছো দিয়ে কাগজটা নিল রানা। পড়তে শুরু করেছে।

ওটা মানুষের নামের লিস্ট।

রানা চট করে দেখে নিল, ওই লিস্টে আছে হার্লি অ্যাটলক, রবিন কার্লটন এবং ওর নাম।

প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চকচক করছে চোখ, এবেলহার্ড বলে উঠল, এবার তুমি দুনিয়ার সেরা বাউন্টি হান্টারদের দেখবে, মেজর। একই কথা খাটে তোমার মত অন্য সবার বেলায়ও। দরকার পড়লে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবীদের আটকে রাখবে বাউন্টি-হান্টাররা, যে গর্তেই লুকাও, সেখান থেকে বের করে আনবে তোমাদের।

শীতল অনুভূতি নামল রানার মেরুদণ্ড বেয়ে।

ঘনিষ্ঠদের বন্দি করে ভয়ঙ্কর অত্যাচার করতে পারে বাউন্টি হান্টাররা।

কেন যেন নিশাত সুলতানা আর তিশার কথা মনে পড়ল। রানার। ওরা আছে আফ্রিকায় কঙ্গোর মাউন্ট স্ট্যানলি পর্বতে, ইউএন-এর হয়ে লড়ছে ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক রক্তপিশাচ ওয়ার লর্ডের বিরুদ্ধে।

চট করে বর্তমানে ফিরল রানা।

কী কারণে মাথা কাটছ তোমরা? জানতে চাইল।

নাক দিয়ে ঘোৎ আওয়াজ বের করল এবেলহার্ড।

আবারও ডান বুট বাড়িয়ে দিল রানা রক্তাক্ত কব্জির দিকে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, ব্যাখ্যা দিচ্ছি, দাঁত খিঁচিয়ে বলল এবেলহার্ড। তোমার মাথার দাম তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার। ওই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে আরও ষোলজনের মাথার ওপর। ফ্রান্সের এক দুর্গে এসব মাথা পৌঁছে দিলেই টাকা পাওয়া যাবে। আগে কখনও এত টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়নি। শেষে হয়তো দেখবে, তোমাদের সংগঠন থেকেই বড়কর্তারা পাগল হয়ে উঠেছে যার যার লোকের মাথা কাটতে।

বাংলাদেশের কেউ আমার গায়ে একটা টোকাও দেবে না, গর্ব নিয়েই বলল রানা।

ভীষণ বাকা হাসল এবেলহার্ড। আমাদের কাছে তথ্য আছে। রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে যাদের আসার কথা, সেসব রেঞ্জার ফোর্ট লিউইস থেকে এখনও রওনাই হয়নি। হবেও না। যা করার করতে হবে তোমার নিজেকেই। মনে রেখো, মেজর রানা, তুমি এখানে একা… আর আমরা তৈরি তোমার জন্যে। আমরা ঠিকই কেটে নেব তোমার মাথা।

মগজে ঝড় চলছে, দ্রুত ভাবতে শুরু করেছে রানা।

এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে, আগে ভাবেনি। অবশ্য বিসিআই থেকে সামান্য আভাস ওর কাছে পাঠানো হয়েছিল। দুদিন আগে এ-ও জানিয়ে দেয়া হয়, ওটা অনিশ্চিত তথ্য।

ভাবনার ভিতর এবেলহার্ডকে অদ্ভুত একটা কাজ করতে দেখল রানা। দ্বিতীয়বারের মত চোখ সরিয়ে নিল লোকটা। কিছু একটা দেখছে ওর পাশ দিয়ে পিছনে।

আধ পাক ঘুরে চাইল রানা। চমকে উঠেই বিস্ফারিত হলো ওর দুই চোখ।

ড্রাই ডকের মাঝের লেকে জমতে শুরু করেছে বরফ, কিন্তু গভীর থেকে বলকে উঠছে আগ্নেয়গিরির লাভার মত বুদ্বুদ। জোরালো ঠা-ঠাস আওয়াজ তুলে ফাটল পাতলা বরফের সাদা আস্তরণ।

বুদ্বুদের ভিতর দিয়ে উঠে আসছে কী যেন।

ওটা কি প্রকাণ্ড কোনও তিমি?

না, ভুস করে ভেসে উঠল স্টিলের কালো খোল।

ওটা সোভিয়েত আমলের অ্যাকুলা-ক্লাস অ্যাটাক সাবমেরিন!

অ্যাকুলা সাবমেরিন খুব বেশি বিক্রি হয়নি, তবে আন্তর্জাতিক আর্মস মার্কেটে ক্রমেই বিখ্যাত হয়ে উঠছে। কিছুদিন হলো বিক্রি করছে রাশান সরকার, এতে আসছে বিপুল টাকা।

রানা বুঝে গেছে, একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ আসলে রাশার কাস্টমার। অথবা উল্টোটাও হতে পারে।

বরফ জমতে থাকা লেকে সামনে বাড়ছে অ্যাকুলা। খুলে গেছে হ্যাচ, বেরিয়ে আসছে একদল সশস্ত্র মার্সেনারি। তীরে নামবার জন্য গ্যাংওয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কয়েক সেকেণ্ড পর ডাঙায় নামবে তারা।

কুঁচকে গেল রানার ভুরু।

এখন ওকে মোকাবিলা করতে হবে কমপক্ষে তিরিশজন মার্সেনারির।

শয়তানির হাসি হাসল এবেলহার্ড।

হাসতে থাকো! বলল রানা। চট করে হাতঘড়ি দেখল। আমাকে ধরার জন্যে বেশি সময় পাবে না। নেমে আসছে। কেয়ামত। তখন থাকবে না এই বেস। তার আগ পর্যন্ত যত খুশি ফুর্তি করো।

খটাৎ আওয়াজ হলো।

এবেলহার্ডের নাকের হাড়ে নামিয়ে এনেছে রানা ডের্ট ঈগলের নল।

কাত হয়ে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল লোকটা, অচেতন।

জলদি! খবিরের পাশে চলে গেল রানা। ওকে ধরে তোলো।

জন হককে উঠতে সাহায্য করল দুজন মিলে।

টলছে কর্পোরাল। আমি নিজেই দাঁড়াতে পারব, বলল। আর তখনই বিস্ফোরিত হলো ওর বুক। ছিটকে বেরোল একগাদা রক্ত। ঠোঁটে জমা হলো ছোট কয়েকটা রক্তাক্ত বুদ্বুদ ফুটো হয়ে গেছে ফুসফুস। রক্তে ভিজে গেল রানার চেস্টপ্লেট।

অবাক চোখে দেখল খবির, নিভে এল জন হকের চোখের আভা। পড়ে গেল ও গ্রিল করা ক্যাটওয়াকে, মারা গেছে। পিছন থেকে গুলি করা হয়েছে তাকে। হঠাৎ হাজির হওয়া সাবমেরিনের মার্সেনারিরা নামছে ড্রাই ডকের হল-এ।

বিমর্ষ চোখে একবার কর্পোরালের লাশ দেখল রানা। মানতে কষ্ট হচ্ছে, খবির এবং ও ছাড়া ওর টিমের কেউ বেঁচে নেই!

চট করে চারপাশ দেখল রানা।

পরিত্যক্ত সাইবেরিয়ান বেসে আটকা পড়েছে ওরা দুজন। ওদেরকে খুন করতে আসছে কমপক্ষে চল্লিশজন মার্সেনারি। ওর পাশে লড়তে পারে এমন যোদ্ধা মাত্র খবির। আসবে না কোনও রিইনফোর্সমেন্ট।

পালাতে পারবে না কোথাও!

খবিরের দিকে চেয়ে ইশারা করল রানা, ছুটতে শুরু করল। দুজন।

প্রাণ বাঁচাতে হবে। অন্তত চেষ্টা করতে হবে শেষ পর্যন্ত।

এক পশলা গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তিনদিকের প্লাস্টারবোর্ড দেয়াল।

রানাকে খুন করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র নতুন গ্রুপ। উঠে আসছে রাং ল্যাডার বেয়ে। ড্রাই ডক হল ধরে পালাতে শুরু করেছে তাদের শিকার।

কিন্তু ভাগতে দিলে চলবে না, বিসিআই-এর মাসুদ রানার মুণ্ডু চাই-ই চাই।

মার্সেনারিদের যারা ঢুকেছে টাইফুন সাবমেরিনে, এখন বুঝে গেছে পালিয়ে গেছে মাসুদ রানা।

তারা আবারও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ডেকে, হাতে আগুন ঝরানো অস্ত্র।

পশ্চিমদিক লক্ষ্য করে লেজ তুলে ভাগছে রানা ও খবির। উঠতে হবে কংক্রিটের ওভারপাস সেতুর উপর।

ওই সেতু গেছে ড্রাই ডক থেকে পাবলো-৯-এর অফিস টাওয়ারে।

সেতুর দিকে ছুটবার সময় রানা দেখল, ব্যস্ত হয়ে উঠেছে একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র মার্সেনারিরা কেউ কেউ উঠছে ব্যালকনিতে। অন্যরা দেখেছে মেঝেতে দুই পলাতক, চলেছে ড্রাই ডকের সেতুর দিকে।

একটা বিষয় বুঝেছে রানাঃ মার্সেনারিরা আসার আগেই যেভাবে হোক যেতে হবে অফিস টাওয়ারে, নেমে পড়তে হবে ওই সেতু থেকে। যদি তা না পারে, আটকা পড়বে পনেরোতলা দালানে।

ওভারপাস সেতু ধরে পাখির মত উড়ে চলেছে দুজন। পিছনে পড়ছে ফাটল ধরা কংক্রিটের বুকে জানালার ফ্রেম।

তীরের মত সেতু পেরোল ওরা, ঝড়ের গতিতে ঢুকল অফিস টাওয়ারে। ওখানেই ব্রেক কষে থেমে গেল।

ওরা আছে এক ব্যালকনির শুরুতে।

ছোট ক্যাটওয়াক। পনেরোতলা দালানে এমন অনেকগুলো আছে। সঙ্গে অসংখ্য মই।

মাঝের মস্ত গোলাকার জায়গা একেবারেই ফাঁকা।

এটা আসলে কোনও অফিস টাওয়ারই নয়। ফাঁকা গ্লাস ও স্টিলের কাঠামো। নকল জিনিস। দেখলে মনে হয় দানবীয় গ্রিনহাউস।

চারপাশের চিড় ধরা কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা গেল সাইবেরিয়ার মৃত প্রকৃতি।

আকাশছোঁয়া দালানের মেঝের দিকে চেয়ে সবই বুঝে গেল রানা।

চারটে প্রকাণ্ড আইসিবিএম মিসাইল সাইলো ডেবে আছে। মেঝেতে। মাথার অনেক উপরে দালানের নকল ছাত। আজ পর্যন্ত ইউএস স্পাই স্যাটালাইট খুঁজে পায়নি এর অস্তিত্ব।

রানা আঁচ করল, পাবলো-৯-এর অন্য অফিস দালানও একই জিনিস।

একতলা নীচে সাইলোর পাশে দশটা মৃতদেহ।

আগে আসা মেরিন কর্পসের সৈনিক ও অফিসার, একটু দূরে সার্জেন্ট গ্রেসনের স্কোয়াড।

সবাই মৃত। চট করে হাতঘড়ি দেখল রানা। কাউন্টডাউন চলছে। টিকটিক করে নেমে চলেছে সময়। সঠিক সময়ে পাবলো-৯-এ ফিরবে সাবমেরিনের মিসাইল। ১৫:৩১… ১৫:৩০… ১৫:২৯…

তাড়া দিল রানা, নীচে নামতে হবে।

কাছের রাং-ল্যাডার লক্ষ্য করে ছুটল ওরা। তখনই পিছন থেকে এল এক ঝাঁক বুলেট। মনে মনে কপাল চাপড়ল রানা।

আগেই একতলার মেঝেতে পৌঁছে গেছে মার্সেনারিরা। ড্রাই ডক ওয়্যারহাউস থেকে তুষার ভরা রাস্তা ধরে এসেছে এই টাওয়ারে।

কী যেন বিড়বিড় করল রানা।

এবার কী, স্যর? জানতে চাইল খবির।

উপায় নেই, ওপরে ওঠো, বলল রানা।

মই বেয়ে ঝড়ের মত উঠতে লাগল ওরা।

কয়েক সেকেণ্ড পর মনে হলো, বাঁদরের মত বেয়ে উঠতে হচ্ছে রাং-ল্যাডার, কিন্তু ওপরে কলার কাঁদি নেই!

মার্সেনারিদের গুলি এড়াতে চাইছে, লাফিয়ে উঠছে ব্যালকনি বা পরের মইয়ে। দশতলা উঠবার পর থামল রানা। প্রথমবারের মত সাহস করে নীচে চাইল।

ধক করে উঠল ওর বুক। মন থেকে বিদায় নিল সব আশা। মন বলে দিল: রানা রে, এবার আর পারলি না তুই!

টাওয়ারের মেঝেতে কংক্রিট মিসাইল সাইলোর চারপাশে জড় হয়েছে মার্সেনারি ফোর্সের সবাই।

সংখ্যায় কমপক্ষে পঞ্চাশজন।

দুভাগে ভাগ হয়ে গেল তারা, মাঝে দাঁড়াল এক লোক।

সে কার্ট কে, এবেলহার্ড।

ভচকে যাওয়া নাক থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে এখনও।

একবার হাতে পেলে ব্যাটা কী করবে, ভাবতে গিয়ে স্বস্তি পেল না রানা। ওদেরকে ধাওয়া করতে প্রথমেই মই বেয়ে পাঠাবে মার্সেনারি। ওদের গুলি ফুরিয়ে গেলে খুন করবে যেমন ভাবে খুশি।

ওরা সিটিং ডাক।

কোনও স্ট্রাটেজি নেই।

ফাঁকা টাওয়ারে গমগম করে উঠল এবেলহার্ডের কণ্ঠ: মেজর রানা! ভাল দৌড়াতে পারো! কিন্তু পালাতে পারবে না কোথাও! জানেই বাঁচবে না! প্রতিধ্বনিত হতে লাগল কথাটা।

কমব্যাট ওয়েবিং থেকে কী যেন বের করেছে লোকটা। জিনিসগুলো চিনল রানা। থমকে দাঁড়িয়ে গেল। জিনিসগুলো ছোট এবং সিলিণ্ডারের মত। থার্মাইট-অ্যামাটল ডেমোলিশন চার্জ।

সংখ্যায় চারটে। রানার সঙ্গের মৃত মেরিনদের কাছ থেকে পেয়েছে বোধহয়।

পরিষ্কার এবেলহার্ডের পরিকল্পনা বুঝল রানা। চার মার্সেনারির হাতে একটা করে চার্জ দিল লোকটা। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল দালানের চারদিকের চার পিলার। ঝট করে ওয়েবিং থেকে নিয়ে ফিল্ড বিনকিউলার চোখে লাগাল রানা।

থার্মাইট চার্জগুলোর রঙিন সুইচ চোখে পড়ল–লাল, সবুজ ও নীল।

টাইমার চালু করো! নির্দেশ দিল এবেলহার্ড।

থার্মাইট-অ্যামাটল চার্জের নীল টাইমার বাটন টিপল লোকগুলো।

নীল টাইমার মানে একমিনিট, ভাবল রানা।

মস্ত ঢোক গিলল ও।

মাত্র ষাট সেকেণ্ড পাবে খবির আর ও, তারপর চুরমার হবে কাঁচের দালান।

হাতঘড়ির স্টপওয়াচ চালু করল রানা।

০০:০১… ০০:০২… ০০:০৩…

মেজর রানা, ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করব তোমার লাশ! তখন কেটে নেব ওই মগজহীন মাথাটা! প্রস্রাব করব তোমার গলার ভেতরে! …সোলজার্স, আউট!

আশপাশে ঢিল পড়লে যেভাবে চমকে যায় পাখি, সেভাবে ছিটকে গেল মার্সেনারিরা। ছুটতে শুরু করেছে সবাই গ্রাউণ্ড ফ্লোরের একটি লক্ষ্য করে।

অসহায় চোখে চেয়ে রইল রানা ও খবির।

কঁচ ঢাকা জানালার এপাশ থেকে চাইল রানা। নীচে বরফ ঢাকা জমিন।

দালান থেকে বেরিয়ে চারপাশ ঘিরে ফেলেছে মার্সেনারিরা, হাতে উদ্যত অস্ত্র।

অজান্তে ঢোক গিলল রানা।

খবির আর ও অসহায়ভাবে আটকা পড়েছে কাঁচের দালানে।

এবং সবই বিস্ফোরিত হবে মাত্র বায়ান্ন সেকেণ্ড পর!

মার্সেনারিদের দিকে চেয়ে আছে রানা, তখনই শুনল অদ্ভুত জোরালো আওয়াজ।

শুরু হয়েছে গুমগুম শব্দ। কোনও জেট ফাইটার বিমান।

ওটার কথা আগেও শুনেছি, চাপা স্বরে বলল রানা।

কী বললেন, স্যর? জানতে চাইল খবির।

তখন টাইফুন সাবমেরিনে ছিলাম। মার্সেনারি কমাণ্ডারকে জানিয়েছিল এরিয়াল কন্ট্যাক্টের কথা। ইয়াক-১৪১ স্ট্রাইক ফাইটার। ওটাতে করে আসছিল মিস্টার ফগ নামের কেউ।

সে কি বাউন্টি হান্টার?

খুব সম্ভব, এদের প্রতিযোগী। ইয়াক-১৪১ ফাইটার নিয়ে আসছে। আর ইয়াক-১৪১ হচ্ছে… থেমে গেল রানা। এসো, খবির! জলদি!

কাছের রাং-ল্যাডারে পৌঁছে গেল ওরা। দেরি না করে মই বেয়ে উঠতে লাগল তীরের গতিতে। যেতে হবে অফিস টাওয়ারের ছাতে।

কয়েক সেকেণ্ড পর ছাতের হ্যাচ ঝটকা দিয়ে খুলল রানা, উঠে এল খোলা আকাশের নীচে। এক সেকেণ্ড পর ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল খবির। সাইবেরিয়ার হিমশীতল কনকনে হাওয়ায় থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে দুজন।

স্টপওয়াচের সংখ্যাগুলো উপরে উঠছে।

০০:২৮)

০০:২৯

০০:৩০

পাবলো-৯-এর পরিত্যক্ত সব দালান ও সাইবেরিয়ার বরফ ঢাকা টিলাগুলোর ভিতর খুবই ছোট দুটো আকৃতি রানা ও খবির।

ছাতের কিনারায় চলে গেল রানা, খুঁজছে ইঞ্জিনের আওয়াজের উৎস।

০০:৩২

০০:৩৩

০০:৩৪

ওই যে!

নিচু গম্বুজ মাথায় নিয়ে এক দালান, তার পাঁচ শ গজ দূরে পশ্চিমে ভাসছে ইয়াকোভলেভ-১৪১ স্ট্রাইক ফাইটার।

ব্রিটেনের হ্যারিয়ার ফাইটারের আদলে তৈরি হয়েছে রাশান ফাইটার, আজ পর্যন্ত যত বিমান তৈরি হয়েছে, তার ভিতর সবচেয়ে কুৎসিত আকাশযান।

চৌকো দেহ, পিছনে মোটা আফটারবার্নিং ইঞ্জিন। ওটাকে সুন্দর করবার কোনও চেষ্টাই করা হয়নি।

কজার সাহায্যে আফটারবার্নার ঘুরিয়ে নামিয়ে নেয়া হয়, একই জায়গা থেকে উঠতে-নামতে পারে বিমান, ভাসতে পারে হেলিকপ্টারের মত।

০০:৩৮

০০:৩৯.

০০:৪০

এমপি-৭ বের করে ভাসমান ইয়াকের নাক লক্ষ্য করে ম্যাগাযিনের তিরিশটা গুলি খরচ করল রানা।

আকর্ষণ করতে চাইছে মনোযোগ। এতে কাজও হলো।

সেই যুগে টেরোডাকটিলের খাবারে বাগড়া দিলে বোধহয় এমনই করত, বাতাসে ভর করে সরে গেল ইয়াক-১৪১ ফাইটার জেট। মনে হলো রানা এবং খবিরকে দেখতে পেয়েছে পাইলট। হোঁচট খেয়ে সামনে বাড়ল কুশ্রী বিমান, দ্রুত ছুটে এল কাঁচের টাওয়ারের দিকে।

আসেন, ফগা ভাই! বোকার মত চিৎকার করল খবির।

০০:৪৮

০০:৪৯

০০:৫০…

কাছে চলে এসেছে ইয়াক-১৪১, থামল টাওয়ারের পঞ্চাশ গজ উপরে।

যথেষ্ট কাছে আসেনি।

পাইলটকে পরিষ্কার দেখল রানা। ফ্লাইট হেলমেটের কারণে মুখ দেখা গেল না, কুঁচকে রেখেছে ভুরু।

ব্যস্ত হাতে ইশারা করছে খবির। ফাটিয়ে ফেলছে গলা।

০০:৫১

০০:৫২

০০:৫৩

কয়েক ফুট সামনে বাড়ল জেট বিমান।

পঁয়তাল্লিশ গজ সামনে আকাশযান।

০০:৫৪

আল্লার দোহাই! চেঁচাল খবির।

চট করে ছাতের মেঝের দিকে চাইল রানা।

এবার ফাটবে থার্মাইট চার্জ।

০০:৫৫

দেরি হয়ে গেছে, বলল রানা। ঘুরে চাইল খবিরের দিকে, চোখে ইশারা। চট্র করে বের করল মেরিনদের ম্যাগহুক।

ওকে দেখে একই কাজ করল খবির।

আমি যা করি, ঠিক তাই করো, বলল রানা। নইলে বাঁচবে না!

পনেরোতলা ছাত থেকে দৌড় শুরু করল ওরা!

০০:৫৬।

ঝেড়ে দৌড় দিয়েছে, তিন সেকেণ্ড পর কিনারায় পৌঁছেই ঝাঁপ দিল।

০০:৫৭

মাত্র তিন সেকেণ্ড পর একমিনিট ছুঁয়ে দিল স্টপওয়াচ।

বেড়ে থাকা প্যারাপেট থেকে উড়াল দিয়েছে রানা ও খবির, আর তখনই ওদের নীচে বিস্ফোরিত হলো গোটা দালানের নীচের অংশ। চারপাশে ছিটকে গেল কংক্রিটের ধূসর ধুলোর মেঘ।

পুরো দুই শ ফুট উঁচু দালানের সমস্ত কাঁচের দেয়াল, কংক্রিট পিলার ও ছাত একই জায়গায় ভুশ করে বসে গেল। রানা ও খবিরের নীচে যেন মস্ত কোনও গাছ ভূমিসাৎ হলো।

ইয়াক-১৪১ বিমানের পাইলট অবাক বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইল। চোখের সামনে থেকে উধাও হয়েছে পনেরোতলা বাড়ি। মুড়মুড় করে গুড়ো হলো সব, ধীরগতিতে রওনা হলো নীচে।

মস্ত এক মেঘের কুণ্ডলী তৈরি করল ধুলো।

দ্বিধান্বিত হয়ে উঠেছে জেট বিমানের পাইলট।

কয়েক সেকেণ্ড আগে ছাতে দেখেছে রানাকে। এ-ও জানে বাউন্টির লিস্টে আছে রানা। ওখান থেকে এক লোককে নিয়ে লাফিয়ে পড়ে রানা। আর তখনই ধসে গেল বাড়িটা।

কিন্তু কোথাও দেখা যাচ্ছে না রানা বা সেই লোকটাকে।

ভেসে উঠছে ছাতার মত প্রকাণ্ড ধুলোর মেঘ, ছেয়ে ফেলছে। আধ মাইল এলাকা। ১৯

বিধ্বস্ত সাইটের উপর চক্কর কাটল পাইলট। খুঁজছে কোথায় গিয়ে পড়েছে ওই দুজন।

দি ওই সাইট চারদিক ঘিরে ফেলেছে একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ মার্সেনারিরা। বাড়ি ভেঙে পড়তেই দৌড়ে সামনে বাড়ল।

কিন্তু কোথাও নেই মাসুদ রানার লাশ।

অস্ত্রগুলো তৈরি রাখল পাইলট, নামতে লাগল একটু দূরের একটা বাড়ির ছাতে।

.

পাবলো-৯-এর ছোট এক দালানের ছাতে নামল ইয়াক-১৪১ অ্যাটাক জেট বিমান। পিছনের রিয়ার থ্রাস্টার উড়িয়ে দিল ছাতে জমা সব আবর্জনা।

বিমান নেমে আসতেই খুলে গেছে ক্যানোপি, বেরিয়ে এল। দীর্ঘদেহী, সুঠাম এক লোক। হাতে রেমিংটন বন্দুক।

দশফুট দূরে গিয়ে থামল। নীচে চাইল ছাতের কিনারা থেকে।

বিমান থেকে নেমেছে তাল গাছের মত লম্বা সাত ফুটি এক লোক। বসের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

তখনই পিছন থেকে বলে উঠল কে যেন: অস্ত্রটা ফেলো! ঘুরেও চাইল না কালো আলখেল্লা পরা লোকটা। আড়ষ্ট হয়ে গেছে সাত ফুটি।

ইয়াক-১৪১-এর পেটের তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে রানা, হাতে উদ্যত এমপি-৭। নল তাক করেছে লোকদুটোর দিকে।

তোমার বোধহয় রওনা হয়ে যাওয়া উচিত, রানা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কালো আলখেল্লাধারী। এবং বলেছে সে খাস বাংলা ভাষায়!

কুয়াশা! চমকে গেল রানা।

সেই কুয়াশা! বছরখানেক আগে ম্যাহোনি হলে ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা। আটকা পড়েছিলেন আহত অবস্থায়। বস্টনে জিয়োভানি, গুইদেরোনির আস্তানা ম্যাহোনি হল জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে। যাওয়ার পর আবার গিয়েছিল রানা ওখানে কুয়াশার খোঁজে। দুর্গের মত বাড়িটা থেকে কোন্ গুহা খুঁজে নিয়ে নিজের প্রাণ রক্ষা করেছিল কুয়াশা, সেটা দেখে এসেছে নিজ চোখে। নিশ্চিন্ত হয়ে পরবর্তী একমাস ধরে মহানন্দে, বিপুল উদ্যমে ফেনিস কাউন্সিলের সর্বনাশের কাজটা সেরেছিল ও।

সেই কুয়াশা! হারিয়ে গিয়েছিল কুয়াশার অন্তরালে।

যদ্দূর জানি, বিপদের মুখে আছে তোমার বান্ধবী তিশা, ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা। ওরা ওকে তুলে আনতে চাইছে।

কুয়াশার সঙ্গী ধীর গতিতে ঘুরে দাঁড়াল, চোখে-মুখে বিন্দুমাত্র চিন্তার ছাপ নেই।

কাঁচের টাওয়ার ধসে পড়তেই ছাত থেকে খোলা আকাশে লাফিয়ে পড়েছে রানা ও খবির, এবং পনেরোতলা থেকে পড়বার সময় ব্যবহার করেছে ম্যাগহুক। ম্যাগনেটিক হেড গিয়ে লেগেছে ইয়াক ফাইটারের নাকের নীচে। সামান্য ঠক আওয়াজ শুনতে পায়নি কুয়াশা। আকাশ থেকে পড়তে শুরু করে হঠাৎ করেই থেমে গেছে রানা এবং খবিরের পতন।

এরপর বিমান কাছের দালানের ছাতে নেমে আসবার আগেই ইণ্টারনাল স্কুলার ব্যবহার করেছে ওরা, উঠে এসেছে ফাইটারের নাকের কাছে। নীচে উড়ছিল ঘন ধুলো, ওদেরকে দেখেনি মার্সেনারিরা। এ ফাইটার বিমান ল্যাণ্ডিঙের সময় অসুবিধা হয়েছে, ছাতের অজস্র ধুলোবালি ও আবর্জনা লেগেছে চোখে-মুখে। তবে ক্ষতি হয়নি ওদের।

ইয়াক-১৪১ নামতেই নীচ থেকে গড়িয়ে সরে গেছে ওরা।

তখন রানার সহজ পরিকল্পনা ছিল: যেভাবে হোক দখল করবে বিমানটা।

খবির চেনে না রহস্যমানব বৈজ্ঞানিক কুয়াশা বা তার সঙ্গীকে, তাদের দিকে তাক করে রেখেছে অস্ত্র। ব্যাটা আবার বাংলা বলে!

আপনিও কি বাউন্টি হান্ট করছেন? কুয়াশার কাছে জানতে চাইল রানা।

না, আস্তে করে মাথা নাড়ল বিজ্ঞানী।

এখানে এলেন কীভাবে?

জানা ছিল তোমার গর্দান নিতে চাইছে বাউন্টি হান্টাররা। কাজেই খোলা ছিল চোখ-কান। জানলাম, ফ্রান্সের এক দুর্গে তোমাদের মাথা পৌঁছে দিলে প্রতি জনের জন্যে দেবে তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার।

আপনি জানেন কোন দুর্গে নিতে হবে?

ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন, বিড়বিড় করল রানা। এত টাকা কারা দিচ্ছে, জানেন? আমাদেরকে খুন করতে চাইছে কেন?

মাথা নাড়ল কুয়াশা। এখনও জানতে পারিনি। আমার লোক খোঁজ-খবর করছে। …এবার রানা, তোমার রওনা হয়ে যাওয়াই ভাল।

আপনাদেরও থাকার উপায় নেই, বলল রানা। চট করে হাতঘড়ি দেখল। এগারো মিনিট পর চারপাশ নরক করে দেবে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেস্টিক মিসাইল

তুমি রওনা হও, আমাদের অন্য ব্যবস্থা আছে, বলল কুয়াশা।

বিজ্ঞানীর চোখে চাইল রানা। বুঝে গেল, যা বলবার বলে দিয়েছে প্রতিভাবান মানুষটা।

ঘুরেই বিমানের মইয়ের দিকে চলল রানা, কয়েক সেকেণ্ডে উঠে পড়ল ককপিটে।

রানাকে যেন বন্দুক হাতে রক্ষা করছে মস্ত মনের রহস্যময়। বিজ্ঞানী কুয়াশা।

রানার পিছনের সিটে বসে খবির বলল, স্যর, একদিন আমেরিকানদের এই কচুর ম্যাগহুক সত্যিই কাজে আসবে না। সেদিন…

তুমি নেতিবাচক মনের লোক, খবির। এখন থেকে ইতিবাচক চিন্তা শুরু করো, নইলে নিজেও সুখী হবে না, কাউকে সুখীও করতে পারবে না।

ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রানা, আগেও ব্যবহার করেছে হ্যারিয়ার বিমান, বুঝতে অসুবিধা হলো না কীভাবে চালাতে হবে ইয়াক ১৪১ স্ট্রাইক ফাইটার জেট।

ভাটিকাল টেক-অফ থ্রাস্টার চালু করল রানা, ছাত থেকে ভেসে উঠল বিমান। ব্যবহার করল, আফটারবার্নার, বিদ্যুদ্বেগে ছুটতে শুরু করেছে বিমান সাইবেরিয়ার টিলাগুলোর মাথা ছুঁয়ে।

নিচু দালানের ছাতে ঢ্যাঙা সঙ্গীর পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কুয়াশা। যেন মস্ত এক কালো বাদুড়, পতপত করে উড়ছে তার কালো আলখেল্লা।

ছয়

পিছনে হারিয়ে গেছে পরিত্যক্ত রাশান ইন্সটলেশন। চুপ করে বসে আছে রানা ইয়াক-১৪১ স্ট্রাইক ফাইটারের ককপিটে।

পিছনের সিট থেকে বলল খবির, স্যর, কী ভাবছেন? আমরা। কি ওই দুর্গে যাব?

যাওয়া উচিত, বলল রানা। তবে আপাতত ওখানে যাওয়া জরুরি নয়।

এবেলহার্ডের কাছ থেকে পাওয়া বাউন্টি লিস্ট পকেট থেকে বের করল রানা। জরুরি এটা, আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল কাগজে। ভাবছে, এই পনেরোজনের মাঝে মিল কোথায়।

সংক্ষেপে বলতে গেলে: প্রত্যেকে এরা লড়াকু মানুষ হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।

ব্রিটেনের লোক স্কট এম. ক্যাপলান, কাজ করে এসএএস-এ, রিচার্ড কে. ডসন এমআই-৬-এর নাম করা গুপ্তচর। ইহুদী রাষ্ট্র ইজরায়েলের আইএএফ-এ কাজ করে পাইলট আব্রাম অ্যামনন। মেজর জেনারেল রেইমণ্ড কে. গ্র্যাঞ্জার ইউএসএ-এর মেরিন বাহিনীর লোক। আমেরিকার ওই বাহিনীতে এত কম বয়সে তাঁর মত অত উচ্চ পদে খুব কম লোকই পৌঁছুতে পেরেছে।

মিডল-ইস্টের লেবানন ও সৌদির দুই সন্ত্রাসী আজিজ আমিন। এবং হোসেন আলাল রয়েছে তালিকায়।

হোসেন আলাল… ভাবতে শুরু করেছে রানা।

ওই লোক ছিল ওসামা বিন লাদেনের বামহাত।

উত্তর আফগানিস্তানে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে আমেরিকান বাহিনী। তাদেরই আরেকদল খুঁজছে তাকে কঙ্গোর মাউন্ট স্ট্যানলি পর্বতে। ওখানে রয়েছে তিশা ও নিশাত।

কুয়াশার বক্তব্য মনে পড়ল রানার।

বিজ্ঞানী বলেছিল: যদ্দূর জানি, বিপদে আছে তোমার বান্ধবী তিশা।

এবার কার্ট কে, এবেলহার্ডের কথাগুলো খচখচ করতে লাগল। রানার মনে।

লোকটা বলেছে: দরকার পড়লে আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু বান্ধবীদের আটকে রাখবে বাউন্টি-হান্টাররা… গর্ত থেকে বের। করে আনবে তোমাদের।

ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা।

কঙ্গোর মাউন্ট স্ট্যানলি পর্বতে খোঁজা হচ্ছে হোসেন–আলালকে। তার মাথা নেয়ার ফাঁকে তিশা বা নিশাতকে আটকে ফেললে ক্ষতি কী বাউন্টি হান্টারদের?

সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না রানার।

দক্ষিণ-পশ্চিম দিগন্তের দিকে সেট করল ইয়াকের অটো পাইলট। গন্তব্য আফ্রিকার কঙ্গো।

.

সার্জেন্ট খবিরকে নিয়ে মাসুদ রানা পাবলো-৯ ত্যাগের এগারো মিনিট পর ইন্সটলেশনের আকাশে দেখা দিল সাদা ধোঁয়ার দীর্ঘ আঙুল। নামছে টাইফুন সাবমেরিনের এসএস-এন-২০ মিসাইল। বিশ মিনিট আগে ওটাকে উৎক্ষেপ করা হয়েছিল।

বজ্রপাতের মত সুপারসনিক গতিতে আসছে পাবলো-৯ লক্ষ্য করে।

ছয় হাজার ফুট…

তিন হাজার ফুট..

এক হাজার ফুট…

পর মুহূর্তে ড্রাই ডকের চার শ ফুট উপরে বিকট আওয়াজে বিস্ফোরিত হলো ভয়ঙ্কর মিসাইল।

লক্ষ-কোটি টুকরো হয়েছে পটকার মত। পাশ থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট এক লেসার-গাইডেড মিসাইল ধ্বংস করে দিয়েছে ওটাকে।

কোনও ক্ষতি না করেই মিসাইলের চকচকে টুকরো ঝরঝর করে ঝরে পড়ল পাবলো-৯-এর বুকে।

ধোঁয়া সরে যেতেই শ্ৰম-নগরীর আকাশে দেখা দিল দ্বিতীয় ভাসমান ফাইটার জেট বিমান।

ওটা আগে আসা বিমানের চেয়ে সরু, দৈর্ঘ্যে ঢের বেশি। দেহ কালো রঙের। অন্য রং বলতে শুধু নোজ কোন সাদা। বিমানের ডানাদুটো ঢালু হয়ে সামান্য সামনে বেড়েছে। ককপিটে বসতে পারে দুজন।

কালো বিমান সুখোই এস-৩৭। রাশার তৈরি, মৌমাছির মত ভাসতে পারে, পুরনো ইয়াক-১৪১ বিমানের চেয়ে অনেক আধুনিক। বেশ কিছুদিন হলো চোরাই অস্ত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে এ জিনিস।

সাইবেরিয়ান বেসের ওয়্যারহাউসের আকাশে ওটা যেন কোনও বাজপাখি। নীচে চেয়ে পরিস্থিতি বুঝতে চাইছে পাইলট।

রাস্তাগুলো নির্জন, কোথাও দেখা গেল না একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র মার্সেনারি।

কয়েক মিনিট সার্ভেইল্যান্স করবার পর প্রকাণ্ড ড্রাই ডক ওয়্যারহাউসের একপাশে খোলা জমিতে নেমে এল বিমান।

ককপিট থেকে নামল মাঝারি আকৃতির এক লোক, হাতে এএমডি অ্যাসল্ট রাইফেল। জিনিসটা হাঙ্গেরির তৈরি, একে-৪৭ এর মতই। অবশ্য সামনে রয়েছে হ্যাণ্ডগ্রিপ।

চারপাশ দেখে নিল সে।

শহরে মাসুদ রানাকে খুঁজতে শুরু করবে কি না ভাবছে। কিন্তু তার ডানদিকের বরফ ঢাকা: জমি থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল দীর্ঘদেহী এক লোক, ডানহাতে অস্ত্র। বামহাতে খপ করে ধরল পাইলটের ঘাড়। তা মাত্র তিন সেকেণ্ডে জন্য।

নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল পোল্যাণ্ডের বাউন্টি হান্টার। ছেড়ে দিতেই মুখ থুবড়ে পড়ল তুষারে।

একটু দূরের ড্রাই ডক ওয়্যারহাউসের আড়াল থেকে বেরোল সাত ফুটি দানব। পিটপিট করে দেখছে বসকে।

কুয়াশা একপলক দেখল বাউন্টি হান্টারকে, তারপর স্যাঙাৎকে পাহারা দিতে ইশারা দিল। নিজে চলে গেল ড্রাই ডকের ছোট এক গেটের সামনে।

এদিক দিয়েই ভিতরে ঢুকেছিল মাসুদ রানা। সাদা তুষারের বুকে বিক্ষিপ্ত সব পদচিহ্ন। ড্রাই ডক ওয়্যারহাউসে ঢুকল কুয়াশা। কেউ নেই।

ভিতরে রয়ে গেছে গোলাগুলির কটু ধোঁয়া। ড্রাই ডকের মাঝে চুপ করে বসে আছে টাইফুন সাবমেরিন।

উধাও হয়েছে একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ মার্সেনারিরা।

কোথাও দ্বিতীয় কোনও সাবমেরিন নেই।

মেঝেতে ডেল্টা ডিটাচমেন্ট সৈনিকদের লাশ, কেটে নেয়া হয়েছে একটা লাশের মাথা।

পুরস্কার সংগ্রহ করছে বাউন্টি হান্টাররা। ঝুঁকে একটা লাশ স্পর্শ করল কুয়াশা। দেহ এখনও উষ্ণ। রানার সঙ্গে আসা আমেরিকান সৈনিক টমি ম্যাগানের লাশ। ড্রাই ডকের পাশে উপুড় হয়ে ভাসছে কয়েকটা মৃতদেহ।

মাপা পদক্ষেপে সি গেটের পাশে চলে গেল কুয়াশা। দেখে নিল কীভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে সুড়ঙ্গের ফটক।

মনে মনে রানার প্রশংসা না করে পারল না বিজ্ঞানী।

সঙ্গীরা মারা যাওয়ার পর ফাঁদে আটকা পড়েছিল বাঙালি গুপ্তচর। তখন উড়িয়ে দিয়েছে ডাই ডকের সি গেট। যেসব মার্সেনারি ওর পিছু নিয়েছিল, তাদেরকে শেষ করেছে জলোচ্ছ্বাস তৈরি করে।

প্রকাণ্ড দালানের মাঝের লেকের পারে থামল কুয়াশা। মেঝের ছাপগুলোর দিকে চাইল। লোকগুলোর পায়ে ছিল কমব্যাট বুট।

এরা বোধহয় পরে এসেছে। বুটের সোলের ছাপ নানা ধরনের। ভেজা জায়গা মাড়িয়ে এদিকের মেঝেতে উঠেছে। কুয়াশা আঁচ করল, দ্বিতীয় কোনও সাবমেরিন এসেছিল। তার মানেই একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ।

খুব দ্রুত সরে পড়েছে তারা। অনেক বেশি জলদি।

যে বা যারা বাউন্টি হান্টের আয়োজন করেছে, সে বা তারা এদেরকে নতুন কোনও তথ্য জোগান দিয়েছে।

একটা আওয়াজ শুনল কুয়াশা, ঝট করে ঘুরে চাইল ক্ষিপ্ত বেজির মত। উঁচু করে ধরেছে খাটো ব্যারেলের রেমিংটন ৮৭০ পাম্প শটগান।

ওই আওয়াজ এসেছে ওয়্যারহাউসের দোতলার ব্যালকনি থেকে।

কয়েক সেকেণ্ডে কাছের রাং-ল্যাডারের পাশে পৌঁছে গেল। কুয়াশা, দ্রুত উঠে এল ছোট, ইন্টারনাল অফিসের ব্যালকনিতে।

অফিসের দরজার কাছে পড়ে আছে দুটো দেহ। প্রথমজন মারা গেছে।

অন্যজন সম্ভবত মার্সেনারি। পাশেই ফ্রেঞ্চদের তৈরি অ্যাসল্ট রাইফেল। লোকটা এখন বিত।

তবে বেশিক্ষণ নেই সে। গুলি লেগেছে মুখে, উড়ে গেছে চোয়ালের বড় একটা অংশ।

লোকটাকে আরেকবার দেখল কুয়াশা। চোখে কোনও করুণা নেই।

মার্সেনারি ডানহাত বাড়িয়ে দিল কুয়াশার দিকে। চোখে। মিনতি। ভাই… দয়া করুন… সাহায্য করুন…

এক পলক দেখল কুয়াশা।

এই লোক বাঁচবে না।

কারও কিছু করার নেই, চুপচাপ মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করো, ঘুরে দাঁড়াল কুয়াশা।

ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে মার্সেনারি। তা হলে মেরে রেখে যান, সেটাই অনেক দয়া হবে। ওভাবে বাঁচতে দিন!

ঘুরে চাইল কুয়াশা, পরক্ষণে বন্দুকের এলজি শেল গেঁথে দিল লোকটার মগজে।

পাঁচ মিনিট পর কালো, সরু সুখোই অ্যাটাক ফাইটারের সামনে হাজির হলো কুয়াশা। ওর পিছন পিছন বিমানের ককপিটে উঠে পড়ল সাত ফুটি মইয়ের মত লোকটা।

একমিনিট পেরুবার আগেই আকাশে ভাসল ফাইটার, চলেছে পশ্চিম লক্ষ্য করে।

সুখোই রওনা হতেই নড়ে উঠেছে বাউন্টি হান্টার পোলিশ। উঠে বসে চেয়ে রইল খুইয়ে বসা ফাইটারের দিকে। তার কাছে। তথ্য আছে, বুঝতে পারল কোথায় চলেছে ওই বিমান।

সরু হয়ে গেল পোলিশের দুই চোখ।

সাত

অক্টোবরের ১৩ তারিখ।

ব্রিটানি, রিপাবলিক অভ ফ্রান্স। ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন।

ফ্রান্সের রুক্ষ উত্তর-পশ্চিম এলাকায় পাহাড়ি এক দুর্গ ওটা, অতলান্তিক মহাসাগরের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

১২৮৮ সালে তৈরি করেছিল উন্মাদ এক কাউণ্ট জ্যান দো শ্যাটিয়ন।

মোটেও সাধারণ কোনও ফ্রেঞ্চ দুর্গ নয় এ ফোট্রেস। ফ্রান্সের বেশিরভাগ ফোর্টিফায়েড দালান তৈরির সময় দুর্গের সৌন্দর্যের দিকে খেয়াল রাখা হয়েছে, কিন্তু ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন নির্মাণকালে এর ব্যবহারিক যৌক্তিকতার উপর জোর। দেয়া হয়।

গম্ভীর চেহারার কুৎসিত, পাথরের দুর্গ।

নিরেট পাথরের পুরু দেয়াল জায়গায় জায়গায় ক্ষত-বিক্ষত। সে আমলের অন্যান্য দুর্গের তুলনায় ঢের আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহৃত হয়েছে। নির্মাণের সময় জায়গা বাছাই করা হয়েছিল দক্ষতার সঙ্গে, ফলে সেসময় এ দুর্গ আক্রমণ ছিল আত্মঘাতী।

মূল কারণ: এ দুর্গ তৈরি হয়েছে একটামাত্র প্রকাণ্ড পাথরখণ্ডের উপর। ওই পাথর উঠে এসেছে সাগরের বুক থেকে। দানবীয় বোল্ডার ও মস্ত দুর্গ রয়েছে উপকূলের উঁচু জমি থেকে পুরো ষাট গজ দূরে। মাঝে ডাইনীর মত খলখল করে হাসছে খ্যাপা সাগর।

পাতাল থেকে সাগর-ফুড়ে-ওঠা পাহাড়ের তিনদিকে দুর্গের পুরু প্রাচীর। ওদিকে সোজা খাড়াভাবে সাগরে নেমেছে পাহাড়। ওই ভিত্তির পায়ে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে আটলান্টিক। দুর্গ রয়েছে পুরো চার শ ফুট ওপরে।

স্থলভূমির সঙ্গে যোগাযোগ বলতে ষাট গজ দীর্ঘ পাথরের সেতু। দুর্গের দিকে সেতুর প্রথম বিশ গজ ড্রব্রিজ, প্রয়োজনে তুলে নেয়া যায়।

এ মুহূর্তে ড্রব্রিজ পেরিয়ে দুর্গের আঙিনায় পা রাখল দুই বাউন্টি হান্টার। একবার দেখে নিল গম্ভীর, কালো, প্রকাণ্ড দুৰ্গটাকে। এত উপরে আটলান্টিকের ঝোড়ো হাওয়া উড়িয়ে নিতে চাইছে তাদেরকে।

দুই বাউন্টি হান্টার তাদের মাঝে সাদা একটা বাক্স বহন। করছে। বাক্সের উপর আঁকা রেড ক্রস। নীচে লেখা:

হিউম্যান অর্গান: ডু নট ওপেন এক্সপ্রেস ডেলিভারি।

ফোট্রেসের সাত শ বছরেরও বেশি পুরনো পোর্টকালিসের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেল দুই বাউন্টি হান্টার। এক মুহূর্ত পর। ইস্ততত করে ঢুকে পড়ল দুর্গের ভিতর।

উঠানে ঢুকতেই ছোটখাটো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলো। তার পরনে কড়া ইস্ত্রি করা সুট। নাকের ডগায় ঝুলছে ওয়ায়ার ফ্রেমের পিন্স-নেয়।

শুভ সকাল, মোসিউস্, বললেন ভদ্রলোক। আমি মোসিউ ড্যাবলার। …আপনাদেরকে কী সাহায্য করতে পারি?

দুই আমেরিকান বাউন্টি হান্টারের পরনে সুয়েড জ্যাকেট ও। জিন্স। পায়ে কাউবয় বুট। পরস্পরকে দেখল তারা।

আকারে বড়জন ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, আমরা এসেছি। দুএকটা বাউন্টির পুরস্কার নিতে।

মোসিউ ড্যাবলার ভদ্রতা করে হাসলেন। নিশ্চয়ই। …আর, কী নাম আপনাদের?

প্রকাণ্ডদেহী বাউন্টি হান্টার জানাল, আমি ফ্যারেল, অ্যালেক্স ফ্যারেল। টেক্সাস রেঞ্জার। …আর এ আমার ভাই নাইজেল।

সম্মান দেখিয়ে বাউ করলেন ড্যাবলার। আচ্ছা, বিখ্যাত ফ্যারেল ব্রাদার। আসুন, ভেতরে যাওয়া যাক।

দুই বাউন্টি হান্টারকে পথ দেখিয়ে মস্ত, এক গ্যারাজে নিয়ে এলেন তিনি। ভিতরে দেখা গেল দুর্লভ, দামি গাড়ির কালেকশন। শুরুতেই লাল রঙের ফেরারি মডেনা, পাশেই রপালি পোর্শ জিটি ২, এরপর অ্যাস্টন মার্টিন ভ্যাঙ্কুইশ। এ ছাড়া রয়েছে বেশকিছু রেসিং র‍্যালি কার। আর এই শো-রুমের ঠিক মাঝখানে রাজার মত গর্বিত ভঙ্গিতে বসে আছে একটা গাড়ি, চকচকে কালো এক ল্যামবোরঘিনি ডায়াবলো।

সুপারকারগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছে দুই আমেরিকান বাউন্টি। হান্টার। তাদের পরিকল্পনা ঠিক চললে শীঘ্রি তারাও দু একটা আমেরিকান পেশিবহুল গাড়ি ব্যবহার করবে।

ওগুলো কি আপনার, স্যর? ঘোঁৎ করে উঠল অ্যালেক্স ফ্যারেল। মোসিউ ড্যাবলারের পিছনে হেঁটে চলেছে।

সামান্য হেসে চুপ করে কিছু যেন ভাবলেন ড্যাবলার। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, না, ওগুলো আমার নয়। আমি সুইটহার ল্যাণ্ডের সামান্য এক ব্যাঙ্কার, কাজ করছি ক্লায়েন্টের হয়ে। ফাণ্ড বাটোয়ারা করে দেব। …এসব গাড়ি দুর্গের মালিকের, আমার নয়।

গ্যারাজের শেষে পাথরের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচু এক সমতলে নামিয়ে আনলেন ড্যাবলার দুই ফ্যারেল ভাইকে।

তারা যেন প্রবেশ করেছেন মেডিইভেল আমলে।

পৌঁছে গেলেন গোলাকার পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা অ্যান্টি রুমে। এ ঘর থেকে ডানে গেছে সরু সুড়ঙ্গ। পাতালপুরির। দুপাশের দেয়ালে ধিকিধিকি জ্বলছে মশাল। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে হলদেটে আগুনের আলোছায়া।

এখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন মোসিউ ড্যাবলার। ঘুরে দাঁড়িয়ে দুই ভাইয়ের ছোটজনের উদ্দেশে বললেন, তরুণ মোসিউ নাইজেল, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন। আপনার ভাই আর আমি পরীক্ষা করব বাউন্টি।

ছোট ভাইকে নিশ্চিন্ত করতে মাথাটা সামান্য নড় করল অ্যালেক্স ফ্যারেল।

প্রকাণ্ডদেহী ফ্যারেলকে নিয়ে আবারও হাঁটতে লাগলেন।

ড্যাবলার। মশালের আলো ভৌতিক করে তুলেছে পরিবেশ।

সুড়ঙ্গ শেষে অপূর্ব এক অফিস কামরা। একদিকের গোটা দেয়াল পিকচার উইণ্ডো। ওদিক দিয়ে দেখা গেল আদিগন্ত আটলান্টিক মহাসাগরের অকল্পনীয়, অপরূপ দৃশ্য।

পাথরের সুড়ঙ্গের শেষে দাঁড়িয়ে পড়লেন মোসিউ ড্যাবলার। প্রিয, আপনার কোনও আপত্তি না থাকলে কেসটা দিন।

সাদা মেডিকেল ট্রান্সপোর্ট বাক্স ড্যাবলারের হাতে তুলে দিল বাউন্টি হান্টার।

মোসিউ ড্যাবলার বললেন, এখানে একটু অপেক্ষা করতে হবে।

অফিসে গিয়ে ঢুকলেন ড্যাবলার, দরজার বাইরে রয়ে গেল। টেক্সান বাউন্টি হান্টার। সে এখনও পাথুরে সুড়ঙ্গে।

ডেস্কের সামনে গেলেন ড্যাবলার, ওখান থেকে তুলে নিলেন। ছোট রিমোট কন্ট্রোল, টিপ দিলেন নির্দিষ্ট বাটনে।

ঘটাং! ঘটাং! ঘটাং!

সুড়ঙ্গের ভিতর আটকা পড়ল অ্যালেক্স ফ্যারেল। ছাত থেকে নেমেছে ইস্পাতের দেয়াল। প্রায় বাক্সের মত করে তুলেছে সুড়ঙ্গ।

একইসময়ে দুই ইস্পাতের দেয়াল আড়াল করেছে গোলাকার পাথরের অ্যান্টি-রুমের দুই দরজা।

উপরের ওই গ্যারাজে যাওয়ার উপায় নেই এখন। সরু সুড়ঙ্গে ঢুকবার মুখেও পুরু ইস্পাতের দেয়াল। ওদিকে রয়ে গেছে নাইজেল ফ্যারেলের বড় ভাই। তৃতীয় ইস্পাতের দেয়াল আলাদা করেছে সুড়ঙ্গ থেকে, অফিস।

নিজ অফিসে আলাদা হয়ে গেছেন মোসিউ ড্যাবলার।

প্রতিটি ইস্পাতের দরজায় রয়েছে খুদে থার্মোপ্লাস্টিকের জানালা।

নিজ নিজ বন্দিশালা থেকে বাইরে দেখতে পাবে দুই বাউন্টি হান্টার।

ছাতের স্পিকারে ভেসে এল মোসিউ ড্যাবলারের কণ্ঠ: জেন্টলমেন, শান্ত থাকুন। নিশ্চয়ই বোঝেন, কোটি ডলারের বাউন্টি হান্টে কত মানুষ আগ্রহী হবে? অল্প কথায় বলা যায়: অনেকেই টাকার লোভে নিজের কপাল ঠুকে দেখতে চাইবে। আমি আপনাদের অসম্মান করছি না। তবে আপাতত যেখানে আছেন, ঠিক সেখানেই থাকবেন–আর আমি পরীক্ষা করব আপনারা সঠিক মানুষের মাথা এনেছেন কি না।

মেডিকেল ডেলিভারি বাক্স ডেস্কের উপর রাখলেন ড্যাবলার, দক্ষ হাতে খুলে ফেললেন ঢাকনি।

তার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে দুটো বিচ্ছিন্ন মুণ্ডু।

একজনের মুখে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ছিট-ছিট দাগ, চেয়ে আছে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে।

অন্য মাথাটার বেহাল অবস্থা। খুব পুড়ে গেছে বামপাশ মোটেও বিরক্ত মনে হলো না ড্যাবলারকে।

দুহাতে সার্জিকাল গ্লাভস পরে নিল, শান্ত চেহারায় বাক্সের ভিতর থেকে বের করে আনল রক্তের দাগওয়ালা মাথাটা। কমপিউটারের পাশের স্ক্যানিং ডিভাইসে রাখল।

আচ্ছা! এ মস্তক কার বলে দাবি করছেন আপনি? ইন্টারকমে অ্যালেক্স ফ্যারেলের কাছে জানতে চাইল ড্যাবলার।

ইজরায়েলি ডেনিস ই, ম্যাকিন, বলল বাউন্টি হান্টার।

ডেনিস ই, ম্যাকিন, কমপিউটারের কিবোর্ডে কয়েকটা টোকা দিল ড্যাবলার। হুম্… মোসাদ এজেন্ট… ডিএনএ-র কোনও রেকর্ড নেই। বেশিরভাগ ইজরায়েলির মতই। তাতে কিছু যায় আসে না। এ বিষয়ে আমাকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্য উপায় ব্যবহার করতে হবে।

কাটা মাথার নীচে স্ক্যানিং ডিভাইস চালু করল ড্যাবলার। সিএটি স্ক্যানারের মতই, বিচ্ছিন্ন মাথার উপর বেশ কয়েক ধরনের লেসার বিম ব্যবহার করল যন্ত্রটা।

স্ক্যানিং শেষে রক্তাক্ত মাথার মুখ হাঁ করাল ড্যাবলার, কয়েকটা দাঁত ধরল লেসার স্ক্যানারের উপর।

কিবোর্ডে আবারও কয়েকটা বাটন টিপল।

কমপিউটারের রেকর্ডের সঙ্গে ছিন্ন মাথার অ্যানালাইসিস করা রেকর্ড মিলাতে শুরু করেছে।

বিপ করে উঠল কমপিউটার।

মাথা দুলিয়ে হেসে ফেলল মোসিউ ড্যাবলার।

ক্রস-রেফারেন্স অনুযায়ী স্কোর পাওয়া গেল ৮৮.২৩%। আগেই আমাকে বলা হয়েছে, ভেরিফিকেশন করার সময় ৭৫% বা তার বেশি মিললে বাউন্টির টাকা বুঝিয়ে দিতে হবে। জেণ্টলমেন, প্রথম মাথার ক্র্যানিয়াল শেপ এবং ডেন্টাল রেকর্ড অনুযায়ী এ লোকই মোসাদের মেজর ডেনিস ই. ম্যাকিন। আপনারা এখন তেত্রিশ মিলিয়ন ডলারের মালিক।

পাথরের আলাদা খাঁচার ভিতর হাসল দুই বাউন্টি হান্টার।

এবার দ্বিতীয় মাথা নিল ড্যাবলার। জানতে চাইল, আর ইনি কে?

টেক্সাস রেঞ্জার অ্যালেক্স ফ্যারেল বলল, আজিজ আমিন। হামাসের লোক। তাকে পেয়েছি মেক্সিকোতে। ড্রাগ লর্ডের কাছ থেকে এক চালান এম-১৬ রাইফেল কিনছিল।

সত্যি, কী আশ্চর্য, বলল ড্যাবলার।

দ্বিতীয় মাথাটা জায়গায় জায়গায় পুড়ে কালো। দাঁতের অর্ধেক উধাও। গুলি বা হাতুড়ির আঘাতে এমন হতে পারে।

ক্র্যানিয়াল এবং ডেন্টাল লেসার টেস্ট শুরু করল ড্যাবলার।

শ্বাস আটকে অপেক্ষা করছে দুই বাউন্টি হান্টার। বুঝতে শুরু করেছে, কেন ড্যাবলার দুই মাথা ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখছে।

করোটি এবং ডেন্টাল রেকর্ড থেকে মিলল ৭৮.৭৬% স্কোর।

মোসিউ ড্যাবলার বলল, সন্দেহ নেই মারাত্মক আগুন এবং বুলেটের ক্ষতির কারণে পার্সেন্টেজ হয়েছে ৭৮.৭৬%। আর আপনারা তো জানেনই, আমাকে আগেই বলে দেয়া হয়েছে, কী করতে হবে। ছিন্ন মস্তকের ৭৫% মিললে বা তার চেয়ে বেশি মিললে আমি বুঝিয়ে দেব পুরো টাকা।

এক কান থেকে আরেক কানে চলে গেল দুই ভাইয়ের হাসি।

কিন্তু কথা রয়ে যায়, নির্দিষ্ট ব্যক্তির ডিএনএ-র রেকর্ড না পেলে তখন দিতে হবে পুরস্কার, বলল ড্যাবলার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমার রেকর্ড অনুযায়ী এই লোকের ডিএনএ-র স্যাম্পল আছে।

মুখ থেকে দপ করে নিভে গেল দুই ভাইয়ের হাসি। দূর থেকে পরস্পরের দিকে চাইল।

ও, হ্যাঁ, আমার রেকর্ড অনুযায়ী, আবারও শুরু করল ড্যাবলার, উনিশ শ আটানব্বই সালে স্কটল্যাণ্ডে বন্দি হয় আজিজ আমিন। গ্রেফতার করা হয়েছিল বেআইনী আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে। তখন রক্তের স্যাম্পল নেয়া হয় তার। এবং রেকর্ড করা হয় ডিএনএ।

কথাটা শুনেই ভীষণ ভয় পেল অ্যালেক্স ফ্যারেল।

মোসিউ ড্যাবলার ততক্ষণে পোড়া মাথার বাম গালে হাইপোডারমিক নিডল গেঁথে দিয়েছে। সংগ্রহ করছে রক্ত।

ওই শুকিয়ে যাওয়া রক্ত রাখা হলো কমপিউটারের পাশের এক অ্যানালাইসার-এ।

একবার বিপ্ করে উঠল যন্ত্রটা। আগের মত মৃদু আওয়াজ নয়, জোরালো।

ভুরু কুঁচকে ফেলল ড্যাবলার, হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেছে। তাকে এখন মারাত্মক বিপজ্জনক লোক বলে মনে হচ্ছে।

জেন্টলমেন… বলল সে।

বরফের মূর্তির মত জমে গেছে দুই বাউন্টি হান্টার।

চুপ হয়ে গেছে সুইস ব্যাঙ্কার, ভঙ্গি দেখে মনে হলো তাকে ভীষণ অপমান করা হয়েছে। জেন্টলমেন, এই মাথা নকল। এটা আজিজ আমিনের মাথাই নয়।

দাঁড়ান, একমিনিট… বলে উঠল অ্যালেক্স ফ্যারেল।

মিস্টার ফ্যারেল, দয়া করে চুপ করো, বলল ড্যাবলার। কসমেটিক সার্জেরি যথেষ্ট ভাল ছিল। ডাক্তার ভাল প্লাস্টিক সার্জেন। ভিশু্যয়াল আইডেন্টিফিকেশন উধাও করতে পোড়ানো হয়েছে মাথা। চালাকি করেছ তোমরা। কিন্তু এসব কৌশল পুরনো। নতুন করে বসিয়ে নেয়া হয়েছে দাঁত। কিন্তু তোমরা জানতে না তার ডিএনএ-র রেকর্ড আছে আমাদের হাতে।

না, জানতাম না, ঘড়ঘড় করে বলল অ্যালেক্স ফ্যারেল।

ম্যাকিনের মাথাও তা হলে নকল?

ওটা জোগাড় করেছে আমাদের পরিচিত এক বাউন্টি হান্টার, মিথ্যা বলল অ্যালেক্স। সে বলেছিল ওই মাথা…

কথা যাই হোক, তোমরা আমার কাছে এনেছ, মোসিউ ফ্যারেল। কাজেই দায়-দায়িত্ব তোমাদের। পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সততা এ মুহূর্তে তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। বলো, ম্যাকিনের মাথাও কি নকল?

হ্যাঁ, চোর-চোর চেহারা করল অ্যালেক্স।

তোমরা আইন ভেঙেছ, মিস্টার ফ্যারেল। এটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। এ ধরনের জালিয়াতি পছন্দ করেন না আমার ক্লায়েন্ট। আমি কি তোমাদেরকে পরিষ্কারভাবে বোঝাতে পারলাম?

একটা কথাও বলল না অ্যালেক্স ফ্যারেল।

কিন্তু এ পরিস্থিতির কথা ভেবেই আমাকে স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, বলল ড্যাবলার। চাইল অ্যালেক্সের চোখে। মোসিউ ফ্যারেল, তুমি যে টানেলে আছ, ওটা কী তা জানো?

না।

ও-আচ্ছা, আসলে ভুলেই গিয়েছিলাম তোমরা আমেরিকান। নিজেদের প্রেসিডেন্টের নাম ছাড়া দুনিয়ার ইতিহাস বলতে কিছুই জানো না। বড়জোর জানো প্রতিটি রাজ্যের রাজধানীর নাম। তোমাদের জানার কথা নয় মেডিইভেল আমলে কী ধরনের যুদ্ধ চলত ইউরোপে।… তোমরা কি জানো এ বিষয়ে?

চুপ করে রইল অ্যালেক্স ফ্যারেল।

কাঁধ ঝকাল ড্যাবলার। মোসিউ ফ্যারেল, তুমি যে টানেলে আছ, আগে সেখানে আটক করা হতো দুর্গে হামলাকারীদেরকে। ওই টানেল ধরে আসত শত্রু সৈনিক, আর তখন দেয়ালের নালা থেকে ছিটকে পড়ত ফুটন্ত তেল। ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়ে মরত লোকগুলো।

ঝট করে টানেলের দুদিকের দেয়াল দেখল অ্যালেক্স ফ্যারেল।

দেয়ালে সত্যিই ছাতের কাছে বাস্কেট বলের সমান সব গর্ত!

অবশ্য, পরবর্তীতে সামান্য আধুনিকীকরণ হয়েছে এই দুর্গের, বলল ড্যাবলার। নইলে নতুন টেকনোলজি কাজে লাগানো যেত না। এবার ছোট ভাইয়ের দিকে দেখো।

চরকির মত ঘুরল অ্যালেক্স, পিংপং বলের মত হয়ে উঠেছে। দুই চোখ। পুরু ইস্পাতের দরজায় বসানো প্লাস্টিকের জানালা দিয়ে চাইল ছোট ভাইয়ের দিকে।

এবার, বিদায় দাও ভাইকে, স্পিকারে বলল ড্যাবলার।

অফিসের ভিতর আবারও উঁচু করে ধরেছে রিমোট কন্ট্রোল। নতুন একটা বাটন টিপল।

মুহূর্তে শুরু হলো যান্ত্রিক গুঞ্জন। ওটা চালু হয়েছে নাইজেলের গোলাকার অ্যান্টি-রুমে। ক্রমেই বাড়ছে গুঞ্জন। যেন লাখ লাখ ভিমরুল উড়তে শুরু করেছে।

প্রথমে মনে হলো কিছুই হচ্ছে না নাইজেল ফ্যারেলের। তারপর হঠাৎ করেই ঝটকা খেল সে। বুকে এসে ঠেকল চিবুক। ডানহাতে খামচে ধরল বুক। পরক্ষণে চেপে ধরল দুই কান। পরের সেকেণ্ডে দুই কান থেকে ছিটকে বেরোল তাজা রক্ত।

বিকট চিৎকার জুড়েছে সে।

অসহায় চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে চেয়ে রইল অ্যালেক্স ফ্যারেল। তার চোখের সামনে ঘটছে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা।

তীব্র হয়ে উঠেছে গুঞ্জনের আওয়াজ, হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হলো তার ছোট ভাইয়ের বুক। ছিটকে বেরোল গোটা বুকের খাঁচা। ফিনকি দিয়ে নানাদিকে গেল রক্ত, সঙ্গে মাংস ও শিরা।

অ্যান্টি-রুমের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল নাইজেল ফ্যারেল। তার আগেই চোখ থেকে বিদায় নিয়েছে দৃষ্টি। ছিন্নভিন্ন বুক নিয়ে মরে পড়ে থাকল সে।

ভীষণ চমকে গেছে অ্যালেক্স ফ্যারেল। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই চরকির মত ঘুরল। মুক্তির জন্য চারপাশে চাইল।

পালাবার পথ নেই কোথাও!

গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল অ্যালেক্স ফ্যারেল, হারামজাদা কুত্তার বাচ্চা! তুই বলেছিলি সৎ থাকলে আমাদেরকে ছেড়ে দিবি!

শীতল হাসল ড্যাবলার। বোকা আমেরিকান! ভাবছ প্রাণ ভিক্ষা চাইবে আর মাফ পেয়ে বেরিয়ে যাবে এখান থেকে? আমি বলেছিলাম, সততা তোমাদেরকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমি ঠিক করেছি, তোমাদেরকে সাহায্য করব না।

ছোট ভাইয়ের ক্ষত-বিক্ষত লাশ চোখে পড়ছে জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের। তা হলে ওর মত করে আমাকে শেষ করবি তুই?

বাঁকা হাসল ড্যাবলার। ওভাবে নয়। তোমার মত নই, আমি ইতিহাসের ভক্ত। কখনও কখনও পুরনো পথ অনেক বেশি আনন্দদায়ক। রিমোট কন্ট্রোলের তৃতীয় বাটন টিপল সুইস। ব্যাঙ্কার।

ছাতের গর্তগুলো থেকে অ্যালেক্স ফ্যারেলের উপর ঝরঝর করে ঝরতে শুরু করল উত্তপ্ত তেল। সব মিলে এক হাজার লিটার।

এক ফোঁটা তেল পড়তেই হ্যাঁৎ করে পুড়ছে চামড়া ও মাংস। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পুড়ে গেল অ্যালেক্স ফ্যারেলের গোটা মুখ। পোশাকে যেখানে লাগল তেল, সে অংশের চামড়া পুড়িয়ে ঢুকল মাংসের ভিতর।

ধুপ করে মেঝেতে পড়ল সে। ছটফট করতে করতে বিকট আর্তনাদ ছাড়ছে।

ভয়ঙ্কর কষ্ট থামল একসময়। মারা গেছে লোকটা। কেউ শুনল না তার শেষ আর্তনাদ।

আটলান্টিক মহাসাগরের অনেক উপরে ব্রিটানির উপকূলে ফোট্রেস দো শ্যাটিয়ন, সবচেয়ে কাছের শহর কমপক্ষে বিশ মাইল দূরে।

আট

সেন্ট্রাল আফ্রিকা।

অক্টোবর ১৪

ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ দ্য কঙ্গো।

এ দেশ কঙ্গো ফ্রি স্টেট, বেলজিয়ান কঙ্গো, রিপাবলিক অভ কঙ্গো বা যায়ার নামে বারবার পরিচিত হয়েছে–গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত এক জনবহুল রাষ্ট্র।

প্রথম গৃহযুদ্ধে এ দেশের সরকারকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিয়ে বিপুল খনিজসম্পদ দখল করবার জন্য হামলা শুরু করেছিল রুয়াণ্ডা ও ইউগাণ্ডার সেনাবাহিনী। এবং উনিশ শ আটানব্বই সালে আবারও দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। শান্তিচুক্তি হলো দুহাজার তিন সালে, কিন্তু পুব অঞ্চলে আসলে থামেইনি লড়াই।

বাস্তব কথা: অসহায় কোটি কোটি মানুষের জন্য কিছুই করতে পারেনি ইউএনও।

দুহাজার নয় সালে কঙ্গোর বুকে প্রতিমাসে খুন হতো পঁয়তাল্লিশ হাজার মানুষ। আজ পর্যন্ত মারা গেছে বিশ থেকে চুয়ান্ন লাখ মানব সন্তান। তাদের নব্বইভাগ লড়াইয়ের কারণে খুন হয়নি, তাদেরকে মরতে হয়েছে ম্যালেরিয়া, ডায়ারিয়া, নিউমো নিয়ার মত রোগের আক্রমণে। খাবারের অভাবে ধুকছে মস্ত এই দেশ, অথচ ঠিকভাবে চাষবাস করলে এবং খনিজসম্পদ আহরণ করলে এ দেশ হতে পারত স্বর্গ। দুর্ভিক্ষ এবং ছড়িয়ে পড়া মহামারীর মত রোগে মরছে লাখে লাখে মানুষ, তাদের বড় অংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।

নতুন পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে: প্রতিবছর চার লক্ষ নারী ধর্ষিত হচ্ছে ওখানে।

বাসস্থান, পানি, খাবার এবং ওষুধের অভাবে নরক হয়ে আছে। গোটা দেশ।

খুনি ওয়ার লর্ডদের সরিয়ে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে শেষপর্যন্ত এ দেশে নাক গলিয়েছে ইউএন।

মাউণ্ট স্ট্যানলি পর্বতমালার পূর্বাঞ্চল।

এ অঞ্চল যেন দাউ দাউ আগুনে পোড়া নরক।

গরমের জন্য নয়, চারমাস হলো নতুন করে লড়াই বেধেছে এদিকে।

মাউন্ট স্ট্যানলি এলাকায় ইউএন-এর শান্তিবাহিনী রুখতে চাইছে ইউগাণ্ডা সরকার সমর্থিত রক্ত-পিশাচ, ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর ওয়ারলর্ড কিলাই বাবাম্বার বাহিনীকে। নইলে নতুন করে খুন হবে লাখে লাখে মানুষ, দেশের অন্য সব অংশে ছড়িয়ে পড়বে যুদ্ধ।

এ দেশে ইউএন-এর শান্তিবাহিনীতে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, মালয়েশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশের সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিক।

নিজেদের কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক পাঠিয়ে দিয়েই দায়িত্ব সেরেছে আমেরিকা ও ব্রিটেনের সরকার, কিন্তু গাট মেরে বসে আছে নেতৃত্বে। বরাবর তা-ই করে ওরা। এসব অফিসার সৈনিকরা রয়ে যাচ্ছে অন্য দেশের অফিসার ও সৈনিকদের পিছনে। সোজা কথায়, গা বাঁচিয়ে চলছে তারা। মরলে কালো চামড়ার মানুষ মরুক। সিএনএন, ফক্স টেলিভিশন বা বিবিসির সাংবাদিকরা এখানে এসে এসব দেখেও দেখছে না, যদিও জানে তাদের বাহিনী কী করছে। বড় করে দেখানো হচ্ছে সামান্য কজন সামরিক অফিসার ও তাদের সৈনিকদের। ভঙ্গি নেয়া হচ্ছে, আসল লড়াই যেন তারাই করছে।

কদিন হলো বৃষ্টির দেখা নেই, ধুলোর ঝড় তৈরি করে ছুটছে লেফটেন্যান্ট তিশা করিমের আট চাকার হালকা আর্মার্ড ভেহিকেল। আর মাত্র দু শ গজ পেরুলেই পৌঁছবে ওয়ারলর্ড কিলাই বাবাম্বার নতুন ঘাঁটি পাহাড়ি খনির সুড়ঙ্গ-মুখে।

দ্রুতগামী এলএসভির চারপাশে লাগছে শিলাবৃষ্টির মত একরাশ গুলি, পিছন থেকে খনির মুখে অসীম দক্ষতায় আর্টিলারি কাভারেজ দিচ্ছে বাঙালি সৈনিক সার্জেন্ট হালিম পাঠান।

গত পাঁচ দিনে এটা শান্তিবাহিনীর নবম হামলা।

পাহাড়ের জটিল সুড়ঙ্গ-পথ দখল করতে চাইছে তারা।

আটদিন আগে জানা গেছে, দলের সেরা সৈনিকদের নিয়ে ফ্রেঞ্চদের পরিত্যক্ত খনির ভিতর ঘাঁটি গেড়েছে কিলাই বাবাম্বা।

এরা সত্যিকারের টেরোরিস্ট।

এদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা দিচ্ছে এ খনি, মিথেন গ্যাসের মৃত্যুফাঁদ।

কয়লা থেকে বেরোয় মিথেন, অত্যন্ত দাহ্য গ্যাস। পরিবেশে পাঁচ শতাংশ থাকলে বিস্ফোরিত হতে পারে। সামান্য আগুনের ফুলকি থেকেই নরক হয়ে উঠতে পারে চারপাশ।

পরিত্যক্ত খনির ভিতর তাজা অক্সিজেন সরবরাহে রয়েছে চিমনির মত ভেণ্ট, কিন্তু সম্ভব ছিল না সুড়ঙ্গগুলোর গভীরে বাতাস পাঠানো।

এককথায়: আক্রমণকারী বাহিনী চাইলেও এখানে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না।

গত কয়েকদিনে বোঝা গেছে: কিলাই বাবাম্বার সৈনিকরা আত্মসমর্পণ করবে না। এ খনির আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ-পথগুলোকে নিজেদের শেষ ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে।

খনি-মুখে রয়েছে রি-ইনফোর্সড কংক্রিট আর্চওয়ে, বড় যে কোনও ট্রাক ঢুকবে।

শুরু থেকেই প্রতি-আক্রমণ করছে বাবাম্বার সৈনিকরা। এরা সেরা। তবে দলের অনেকে ইতিমধ্যে আবারও ফিরেছে নিজ দেশে।

খনি-মুখ থেকেই খাড়া প্রাচীরের মত আকাশে উঠেছে পাহাড়। ওখানে ছড়িয়ে অবস্থান নিয়ে স্নাইপিং করছে কিলাই বাবাম্বার বারো-চোদ্দজন দক্ষ সৈনিক।

পাহাড়ের আরও অনেক উপরে, চূড়ায় রয়েছে খনির দুই এয়ার ভেণ্ট। প্রতিটি দশ মিটার চওড়া শাফট, খনি থেকে সোজা। উঠেছে আকাশে। ওগুলোর মাধ্যমে তাজা বাতাস ঢুকবার কথা খনিতে। কিন্তু কিছুদিন আগে কিলাই বাবাম্বার সৈনিকরা ওই দুই শাফটের উপর ক্যামোফ্লেজ ঢাকনি বসিয়েছে। ফলে ভিতরের লোকগুলোর উপর চোখ রাখবার উপায় নেই গুপ্তচর বিমানের।

ওই দুই শাফট দখল করতে হবে এখন জাতিসঙ্ঘ বাহিনীকে।

খনির ভিতর ঢুকে উড়িয়ে দিতে হবে ভেণ্টদুটোর ঢাকনি, ওখানে বসাতে হবে টার্গেটিং লেসার। তা হলেই নির্দিষ্ট জায়গা খুঁজে নেবে সি-১৩০ বোমারু বিমান, নিখুঁতভাবে বোমা ফেলতে পারবে শাফটে।

ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা ও লেফটেন্যান্ট তিশা করিমের কাজ শেষে ওদের, দলের একমাত্র কর্তব্য হবে একুশ হাজার পাউণ্ড ওজনের অর্ডন্যান্স বোমা পড়বার আগেই লেজ গুটিয়ে ভেগে যাওয়া।

আজ ভোরের প্রথম এবং দ্বিতীয় আক্রমণ সফল হয়েছে।

সুড়ঙ্গ-পথের মুখ দখল করে নিয়েছে বাঙালি-ভারতীয় নেপালি এবং মালয়েশিয়ান সৈনিকরা।

অবশ্য তৃতীয় আক্রমণ ছিল আত্ম-বিধ্বংসী। রাশার তৈরি রকেট-প্রপেল্ড গ্রেনেডের ক্রসফায়ারে পড়েছে শান্তিবাহিনীর সৈনিকরা। দুটো হালকা সাঁজোয়া যান বিধ্বস্ত হয়েছে, বাঁচতে পারেনি একজন সৈনিকও।

নিশাত সুলতানা ও তিশা করিমের আক্রমণ চতুর্থ প্রচেষ্টা।

ওদেরকে এগোবার সুবিধা দেয়ার জন্য শত্রুদের গুলি আকর্ষণ। করছে আরও দুটো রণযান। এদিকে নিশাত ও তিশার পিছু নিয়ে। আসছে আট চাকার আরও একটি সাঁজোয়া যান।

তারা প্রায় পৌঁছে গেছে খনি-মুখের কাছে। খনির ভিতর শক্ত অবস্থানে ফেলছে মর্টার শেল।

এতে কাজ হচ্ছে।

অন্য দুই রণযানে লাগছে অটোমেটিক অস্ত্রের গুলি, চারপাশে বিস্ফোরিত হচ্ছে আরপিজি। কাভার নেয়া অবস্থান থেকে ছিটকে সামনে বাড়ছে তিশার এলএসভি-২৫। পিছনে আসছে দ্বিতীয় আট চাকার রণযান।

খনি-মুখের উপরের পাহাড়ে গিয়ে পড়ছে মর্টার শেল, এদিকে তীরের মত চলেছে এলএসভি দুটো, কয়েক সেকেণ্ড পর ঢুকে পড়ল অন্ধকার খনির ভিতর। থেমে গেল গুলিবর্ষণ, কিন্তু নিশাত তিশা এবং ওদের সৈনিকরা ঢুকে পড়েছে নতুন এক নরকে।

আমেরিকান বড় অফিসারদের কেউ কেউ ভরসা রাখতে শুরু করেছে কালো চোখের, কালো চুলের, মিষ্টি চেহারার তিশার উপর। তারা শুনেছে: স্বয়ং আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তিশা করিমের প্রশংসা করেছেন তাদের চেয়ে ঢের বড় অফিসারদের কাছে। এরা আরও শুনেছে: গোপন, এক ইউএস এয়ার ফোর্স বেসে প্রেসিডেন্টের প্রাণরক্ষা করেছিল এ মেয়ে।

সেসব বাদই যাক, দেখতে তিশা দারুণ সুন্দরী। অবশ্য কেউ তল খুঁজে পায়নি ওর। মিষ্টি হেসে সবাইকে কীভাবে যেন এড়িয়ে যায়। দুএকজন আগ্রহী হলেও সামান্যতম প্রশ্রয় পায়নি। আর একটি ব্যাপার কারও চোখ এড়ায়নিঃ নিজের জন্য তিশার সামান্যতম চিন্তা করতে হয় না, কারণ ভয়ঙ্কর এক মহিলা ওকে সর্বক্ষণ আড়াল করে রাখে, যেন আপন ছোট বোন।

সে ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা। ছয় ফুট দৈর্ঘ্য নিয়ে মস্ত এক দৈত্য যেন। এক পা নকল, কিন্তু সৈনিক হিসেবে দক্ষতা তাতে এক বিন্দু কমেনি।

মাউন্ট স্ট্যানলি পাহাড়ে আজকের হামলার নেতৃত্বে রয়েছে। সে। পাশে রয়েছে তিশা।

.

রানার ইয়াক-১৪১ অ্যাটাক ফাইটার জেট প্রায় দুই মাক গতি তুলে বাতাস চিরে ছুটে চলেছে পশ্চিম লক্ষ্য করে। মাটির মাত্র পঞ্চাশ ফুট উপর দিয়ে উড়ে চলেছে বিমান।

প্রায় একদিন হতে চলল পাবলো-৯-এর লড়াই পিছনে ফেলে এসেছে রানা ও খবির।

এ সময়ে রাশার নভোসিবিরস্ক-এর পরিত্যক্ত এক সামরিক বিমানবন্দরে নেমে তেল খুঁজে নিয়ে ইয়াক-১৪১ অ্যাটাক ফাইটারের পেট পুরিয়ে নিয়েছে রানা, বিশ্রাম নিয়েছে ওরা। সেখান থেকে রওনা হওয়ার পর নেমেছে কাজাখস্তানের আরেকটি পরিত্যক্ত এয়ারপোর্টে। এরপর থেমেছে তুরস্কের আরমির-এ, তখন বিসিআই-এর স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে ফিউয়েল জোগাড় করেছে। ওখান থেকে নেমেছে রানা মিশরের নিউ ভ্যালি গভার্নোরেট-এর কাছে এক মরুভূমিতে। তখন এক মিশরীয় বন্ধুর সহায়তা নিয়েছে। ট্রাকে করে তার আনা ফিউয়েল সংগ্রহ করে চলে এসেছে সে ডিআর কঙ্গোর মাউন্ট স্ট্যানলি পর্বতমালায়।

এবার খুঁজে নিতে হবে: রানাকে ইউএন-এর ক্যাম্প, নামতে হবে ইয়াক-১৪১ অ্যাটাক ফাইটার নিয়ে।

শেষবার যখন ফিউয়েল নিয়েছে, তখন মিশরীয় বন্ধু যথেষ্ট হাই অকটেন, আনতে পারেনি। কাজেই প্রায় ফুরিয়ে এসেছে জরুরি রসদ।

অবশ্য এ নিয়ে বেশি ভাবছে না রানা। ওর গর্দান থেকে মাথা আলাদা করতে চাইছে বাউন্টি হান্টাররা, কিন্তু তিশা, নিশাত ও খবিরের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ও। স্থির করেছে, দেরি না করে সতর্ক করবে তিশা-নিশাতকে, খুলে বলবে কেন ওদেরকে জিম্মি করতে চাইছে একদল রক্তপিশাচ।

সাইবেরিয়া থেকে রওনা হওয়ার সময় রানা ঠিক করেছে, ভুলেও বিশ্বাস করবে না আলাস্কার কোনও এয়ার বেসকে। কাজেই একটু আগে ইউএস-এর ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির দুর্বল এক স্যাটালাইটের ফ্রিকোয়েন্সি খুঁজে নিয়েছে।

ওর পরিচয় ভেরিফাই হতেই সরাসরি পেন্টাগনের সাইফার অ্যাণ্ড ক্রিপটোঅ্যানালাইসিস ডিপার্টমেন্টের কেভিন কনলনের সঙ্গে এইমাত্র যোগাযোগ করেছে ও।

হ্যাঁ, বলুন, কেভিন কনলন বলছি, তরুণ কণ্ঠ শুনল রানা। ইয়ারপিসে।

হাই, কনলন, আমি মাসুদ রানা, বলল রানা।

আরেহ, মেজর রানা! চমকে গেছে যুবক। অনেকদিন হলো দেখা নেই আপনার! কেমন আছেন? আজ কী ধ্বংস করলেন?

মৃদু হাসল রানা। তেমন কিছুই না। শুধু গত চব্বিশ ঘণ্টায় বন্যা তৈরি করেছি একটা টাইফুন-ক্লাস সাবমেরিনের ভেতর, লঞ্চ করেছি রাশান একটা ব্যালেস্টিক মিসাইল, ওটা সম্ভবত ধুলো করে দিয়েছে এক ড্রাই ডক আর মস্ত ওয়্যারহাউস।

তা হলে তো কোনও কাজই করেননি, মেজর!

আরও কিছু করতে হলে তোমার সহায়তা দরকার, কাজের কথায় এল রানা।

নির্দ্বিধায় বলে ফেলুন।

এয়ার বেস যিরো নাইন দুর্ঘটনার পর রানার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে কেভিন কনলনের, পছন্দ করে ওরা পরস্পরকে। রানা, নিশাত, তিশা এবং খবিরের মত কেভিন কনলনও প্রেসিডেন্টের

কাছ থেকে সাহসিকতার জন্য পেয়েছিল ক্লাসিফায়েড মেডাল।

রানার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তার এরপর। রানা এজেন্সির অফিসেও এসেছে। প্রতিবার তাকে লাঞ্চ বা ডিনার না খাইয়ে ছাড়েনি রানা। মুগ্ধ হয়ে গেছে আমেরিকান যুবক বাঙালি একদল যুবক-যুবতীর নিঃস্বার্থ আন্তরিক আচরণ দেখে। ওরা একদম আপন করে নিয়েছিল কনলনকে।

সেসব অতীতের কথা, বর্তমানে পাহাড়ি এলাকার উপর দিয়ে তীর গতিতে ছুটে চলেছে ইয়াক-১৪১। রানা মনের চোখে দেখল ডেভিড কনলনকে পেন্টাগনের আণ্ডারগ্রাউণ্ড ঘরে কমপিউটারের সামনে বসে আছে যুবক, পরনে মুক্স টি-শার্ট, জিন্স, পায়ে নাইকি, নাকে চশমা, একের পর এক চিবিয়ে চলেছে চিউইং গাম। যেন গ্রাজুয়েট কলেজের কল্প-কাহিনির হ্যারি পটার। কিন্তু এই হ্যারি পটার যে-কোনও কোড ক্র্যাক করার ব্যাপারে সত্যিকারের জিনিয়াস।

আসলে কী ধরনের সাহায্য চাই, রানা? জানতে চাইল কনলন।

তিনটে বিষয়ে জানতে চাই, কনলন, বলল রানা।

বলে ফেলুন।

প্রথম কথা: খুঁজে বের করতে হবে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ দ্য কঙ্গোর মাউন্ট স্ট্যানলি পাহাড়ে ঠিক কোথায় আছে তিশা করিম। নির্দিষ্ট জিপিএস লোকেশন দরকার।

যিশু, বলেন কী! ওটা তো অপারেশনাল ইনফর্মেশন। জানতে চাওয়ার ক্লিয়ারেন্স নেই আমার। ওই তথ্য খুঁজতে গেলে আমাকে গ্রেফতারও করতে পারে।

ক্লিয়ারেন্স জোগাড় করো, গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। সেজন্য যা করবার করো। আমাকে যে মিশনে সাইবেরিয়ায় পাঠানো হয়েছিল, সেখান থেকে পালাতে হয়েছে। খুন হয়ে গেছে ছয়জন তরতাজা মেরিন সৈনিক। বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল আমেরিকান সামরিকবাহিনীর কেউ। ফাঁদে ফেলা হয়েছিল, একদল বাউন্টি হান্টারের হাতে তুলে দিয়েছিল আমাদেরকে। প্রায় কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না, কনলন।

ঠিক আছে, আমি দেখছি। আর অন্য দুটি বিষয় কী?

একসেকিউশন সলিউশন ফর ইউ-র কমাণ্ডার এবেলহার্ডের কাছ থেকে পাওয়া মানুষের নামের লিস্ট বের করল রানা। এই লিস্টের নাম অনুযায়ী তাদের বর্তমান অবস্থান জানতে চাই।

বাউন্টি লিস্টের নামগুলো একে একে জানাল রানা।

এদের মাঝে অনেক মিল। ক্যারিয়ার হিস্ট্রি, স্নাইপিং স্কিল, চুলের রং… যা পাও জানাও। ভাল হয় প্রতিটি ডেটাবেসে ক্রস চেক করলে।

ঠিক আছে। …বেশ, আর তিন নম্বর গুরুত্বপূর্ণ কাজ?

ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা, ভাবছে। তৃতীয় কাজ: খুঁজে বের করো সাইবেরিয়ার পাবলো-৯ রাশান বেস। জানা দরকার কেন ওখানে অ্যাম্বুশ করা হলো আমাদেরকে। কে করাল কাজটা।

.

অন্ধকারাচ্ছন্ন গুহার ভিতর ব্রেক কষে পিছলে থেমে গেল তিশা করিমের আট চাকার এলএসভি। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল গাড়ির পিছনের দুই কবাট, লাফিয়ে নামল ছয়জন সৈনিক, হাতে উদ্যত অস্ত্র।

এলএসভি থেকে নেমে পড়ল নিশাত ও তিশা, ওদের পরনে কাদাটে রঙের ফ্যাটিগ, একই রঙের হেলমেট ও বডি আর্মার। হাতে এমপি-৭ এবং পিস্তল আকতির ক্রসবো।

গুহার এ অংশ চওড়া, ছাত অনেক উঁচু। দেয়ালগুলো কংক্রিট দিয়ে তৈরি। মেঝের বুক চিরে দর আঁধারে হারিয়ে গেছে ট্রেনের লাইন। ওদিকের সুড়ঙ্গ বেশ খাড়াভাবে নীচে নেমে গেছে। এ ধরনের সুড়ঙ্গকে বলা হয় ড্রিফট, এ পথেই নামতে হয় খনির ভিতর।

রক বার্ড, আমি নিশাত, থ্রোট মাইকে বলল মহিলা ক্যাপ্টেন। আমরা ভেতরে ঢুকে পড়েছি। …আপনারা কোথায়?

এক ভারতীয় কণ্ঠ বলল, রক বার্ড বলছি, ক্যাপ্টেন নিশাত। ভগবান, এখানে নরক নেমেছে! আমরা আছি খনির পুবের কিনারায়! ড্রিফট থেকে দুই শ ফুট নীচে! দুই শাফটের সামনে বাঙ্কার করে অপেক্ষা করছে ওরা, আর…

সিগনাল হারিয়ে গেল।

রক বার্ড? রক বার্ড? তিশার দিকে চাইল নিশাত।

আস্তে করে মাথা দোলাল তিশা।

পাশে দাঁড়ানো দু সৈনিককে বলল, আফজাল, কৃষ্ণ, ওপরে গিয়ে আরপিজির ফক্সহোলগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিন। ইন্টারনাল টানেল থাকার কথা। শেয়ালগুলোকে শেষ করার পর খনিতে নামতে পারব আমরা।

জী, লেফটেন্যান্ট, রওনা হয়ে গেল বাংলাদেশ ও নেপালের দুই সৈনিক।

অন্যরা আমাদের সঙ্গে চলো, নির্দেশ দিল নিশাত।

.

মাউন্ট স্ট্যানলি পর্বতমালার উপর দিয়ে ছুটছে রানার অ্যাটাক ফাইটার জেট বিমান। চিন্তিত হয়ে উঠেছে রানা, যা ফিউয়েল আছে তাতে বড়জোর দশ মিনিট চলবে ইয়াক-১৪১, তারপরও আকাশে রয়ে গেলে বিধ্বস্ত হবে।

এমন সময় আবারও জেগে উঠল রেডিয়ো।

কেভিন কনলন।

শুনছেন, রানা? দুচারটে তথ্য পেলাম। তিশা করিমের খোঁজ পাওয়া গেছে। তার ইউনিট আছে কর্নেল ক্লিন্ট ওয়াই. উডের

অধীনে। ধীরে ধীরে বলে গেল সে জিপিএস কোঅর্ডিনেট।

ঠিক আছে, বলল রানা। টাইপ করে ট্রিপ কমপিউটারে তুলে নিয়েছে কো-অর্ডিনেটস।

এবার বলল কনলন, আপনার ওই লিস্টের ব্যাপারে। কয়েকটা তথ্য পেয়েছি। পনেরোজনের সাতজনের নাম সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছি ন্যাটোর পারসোনেল ডেটাবেসে। স্কট এম. ক্যাপলান, জে ওয়েলন, চার্লস আর. কোসলোস্কি, স্টিফেন আর. এডওয়ার্ডস, রবিন এন. কার্লটন, জন আর, রেইসার্ট আর আপনি। ন্যাটোর নয় সালের ডিসেম্বরের জয়েন্ট সার্ভিস এমএনআরআর স্টাডিতে আছেন আপনারা। ব্রিটিশদের সঙ্গে আমেরিকানদের কোনও জয়েন্ট মেডিকেল স্টাডি মনে হচ্ছে। আপনি ওদের মাঝখানে কোথা থেকে কীভাবে কাবাবের হাডিড হলেন, বুঝলাম না।

কোথায় করা ওই পরীক্ষা? জানতে চাওয়ার পর মনে পড়ল। রানার। নুমার তরফ থেকে ববি মুরল্যাণ্ড আর ওকে পাঠানো হয় টেস্ট-এ। বিসিআই অনুমতি দেয়ায় গিয়েছিল রানা।

তথ্য দিল কনলন: ইউএসএএমআরএমসি। আর্মি মেডিকেল রিসার্চ অ্যাণ্ড মেটেরিয়াল কমাণ্ড।

ওটার বিষয়ে আরও তথ্য জোগাড় করা যায়?

নিশ্চয়ই।

আর কী জানলে?

আজ ভোরে কাজাখস্তানের আকাশে অচেনা এক এয়ারক্রাফট থেকে ট্রান্সমিশন ধরেছে আমাদের ইশেলন স্পাই স্যাটালাইট। আপনার ওই লিস্টের কয়েকটি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পড়ে শোনাচ্ছি: বেস, আমি হেণ্ডিক। কঙ্গোতে ধরা পড়েছে জেনারেল রেম কে, এ্যাঞ্জার। এখন কঙ্গোর মাউণ্ট স্ট্যানলির খনির দিকে চলেছি। লিস্টের বেশ কয়েকজনকে পেয়ে যাব ওখানে। একই জায়গায় চারজন, ভাবা যায়? স্কট এম. ক্যাপলান, এরিখ টি, সৌলে, চার্লস আর. কোসলোস্কি আর আলাল হোসেন। তা ছাড়া, ওখানে পেতে পারি মাসুদ রানার বান্ধবীকে।

গম্ভীর হয়ে গেল রানা।

বলে চলেছে কনলন: একটা নোটিফিকেশন দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই লোকের কথা বলবার ভঙ্গি ব্রিটিশদের মত। আর ওই কণ্ঠের মালিক আসলে… থেমে গেল সে।

বলো? তাড়া দিল রানা।

আবারও পড়ছে কনলন: ওই কণ্ঠ চেনা গেছে, ওটা ডেভিড এন. হেন্ড্রিকের। ব্রিটিশ ওই এসএএস-এর প্রাক্তন কর্নেলের কলসাইন ছিল দ্য ডেভিল। চুপ হয়ে গেল কনলন। কয়েক মুহূর্ত পর শুরু করল আবার, দুহাজার দশ সালের দিকে সে ছিল বিশাল লোক, কিন্তু তারপর কোর্ট মার্শাল হয়। তার খাতির ছিল। এসএএস-এর প্রধানের সঙ্গে। বাজে এক লোক। নাম ছিল জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসন।

হ্যাঁ, জুলিয়াস বি. গুণ্ডারসনকে চিনতাম, বলল রানা।

ডেভিড এন. হেণ্ডিকের দশবছরের জেল হয়, কিন্তু হোয়াইটমুর প্রিযনে নেয়ার সময় পালিয়ে যায়। খুন করে ফেলে। যায় দশজন প্রহরীকে। সে এখন আছে ফ্রিল্যান্স বাউন্টি হান্টিং অর্গানাইযেশন কন্টিনেন্টাল সোলজার-এর সঙ্গে। ইউনিট ৬৬, বা সিএস-৬৬-এর প্রধান। কাজ করছে পর্তুগালে।…রানা, আপনি আমাকে এ কী নরকে ঠেলছেন? শুকনো হাসল কনলন। তাই বলে অবশ্য ভয় পাচ্ছি না। চুপ হয়ে গেল সে।

বুঝতে পারছি খুবই সতর্ক থাকতে হবে, নইলে আমার গর্দান নেবে এরা, চট করে একবার খবিরকে দেখল রানা।

আর আপনার বলা সেই পাবলো-৯, বলল কনলন, ওটার ব্যাপারে শুধু জানতে পেরেছিঃ উনিশ শ সাতানব্বই সালের মে মাসে ওই ফ্যাসিলিটি বিক্রি করে দেয়া হয় এক আমেরিকান কোম্পানি, স্করপিয়ন শিপিং কোম্পানির কাছে। ওই কোম্পানির যে শিপিং বিজনেস আছে, শুধু তাই নয়, তাদের অয়েল ইন্টারেস্টও আছে। সাইবেরিয়ার উত্তরাংশে দশ হাজার হেক্টর জমি কিনে এক্সপ্লোরেশন করার সময় তাদের ভাগে পড়ে পাবলো

এক মুহূর্ত ভাবল রানা, তারপর বলল, আর কিছু?

না, আর কিছু না।

তোমাদের আইএসএস-এর কাছ থেকে কিছু তথ্য পেলে ভাল হতো, বলল রানা। ১০১

কী বিষয়ে জানতে চান?

বৈজ্ঞানিক কুয়াশা সম্পর্কে। জানা জরুরি ওদের মূল্যায়ন কেমন। ওদের সঙ্গে তার টক্কর লেগেছিল কেন।

আমি খোঁজ নেব, কথা দিল তরুণ অ্যানালিস্ট।

অনেক ধন্যবাদ, কেভিন, বলল রানা। নতুন কিছু পেলে। জানিয়ে দিয়ো।

নিশ্চয়ই, ঠিক আছে।

রেডিয়ো থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে আফটারবার্নার চালু করল রানা।

সাত মিনিট পর মৌমাছির মত ভাসতে ভাসতে মাটির দিকে নামতে লাগল ইয়াক-১৪১। বিমানের নীচে ছিটকে উঠছে বিপুল ধুলো। একটু দূরেই আমেরিকান সব ভেহিকেল ও কমাণ্ড তাঁবু।

নয়

কালো ফাইটার সামরিক শিবিরের মাঝে নেমে আসতেই চারপাশ থেকে ওটাকে ঘিরে ফেলেছে সৈনিকরা। আনঅথোরাইড রাশান বিমান দেখে ভয়ঙ্কর চেহারা করেছে মেরিনরা, হাতে উদ্যত অস্ত্র। কিন্তু ক্যানোপি খুলে রানা ও খবির নামতেই ওদেরকে চিনে ফেলল মেরিন অফিসার মেজর জন কালাহান। সৈনিকদের মাঝ দিয়ে এগিয়ে এল সে, চোখে বিস্ময়। মেরিন বাহিনীতে অত্যন্ত সম্মানিত লোক মাসুদ রানা, তার কারণে এ বাহিনীকে অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে আমেরিকার অন্যসব বাহিনী।

হাত বাড়িয়ে রানার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল সে। আপনি হঠাৎ কোথা থেকে? জানতে চাইল।

পরে বলব, সংক্ষিপ্ত জবাব দিল রানা। আগে আমাদেরকে নিয়ে চলুন কর্নেল উডের কাছে।

আস্তে করে মাথা দোলাল মেজর কালাহান। একদল মেরিন সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে রানা ও খবিরকে এস্কোর্ট করল অফিসার।

পাহাড়ের ছোট এক টিলার নীচে কমাণ্ড তাঁবু। খনির মুখ থেকে তিন হাজার গজ দূরে। ধুলোভরা ঝোঁপঝাড় ও গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল ওদিক থেকে ফিরছে দুটো রণযান।

কর্নেল উড দাঁড়িয়ে আছে ম্যাপ টেবিলের সামনে, গলা ফাটিয়ে ফেলছে রেডিয়োতে।

আসবার সময় মেজর কালাহান জানিয়েছে, স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় মেজাজ অত্যন্ত খাট্টা কর্নেলের, কাজেই সে নিজে তাঁবুর ভিতর ঢুকতে চায় না।

সামান্যতম ইতস্তত না করেই কর্নেলের গুহায় ঢুকে পড়ল রানা ও খবির। ৬ চেঁচিয়ে চলেছে লোকটা: আরে, বললেই হলো? কীভাবে কী করবে আমি শিখিয়ে দেব? অত বুঝি না, ওদিকের রেডিয়ো সিগনাল চালু করো! দরকার হলে খনির ভেতর অ্যান্টেনার কেবল নেবে! বোমারু বিমান আসার আগেই ওদেরকে সরে আসতে বলতে হবে!

লোকটা সামান্য থামতেই বলল রানা, কর্নেল উড, আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি, কিন্তু আসতে হলো জরুরি কাজে। …আমি মেজর মাসুদ রানা, ক্যাপ্টেন নিশাত সুলতানা আর লেফটেন্যান্ট তিশা করিমকে দরকার আমার। ওরা…

টেবিলের সামনে চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল কর্নেল। কী? কোন্ চুতিয়া তুমি, শালা!

নামটা মাসুদ রানা, আবারও বলল রানা, শান্ত রাখছে মেজাজ। জানি ওই খনির ভেতর ওয়ারলর্ডের বাহিনী আছে, কিন্তু আরও খারাপ কেউ থাকতে পারে। তারা বাউন্টি হান্টা…

মেজর, তুমি এমওএবি বোমা নিয়ে সি-১৩০ হারকিউলিস বোমারু বিমানের পাইলট না হয়ে থাকলে, আমি তোমার কথা শুনতে চাই না। বাইরে গিয়ে চুপ করে বসে থাকো…

আরে! ওটা কী? বাইরে চেঁচিয়ে উঠেছে কে যেন।

তাঁবু থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল কর্নেল। একই সময়ে রানা, ও খবিরও। কিছুক্ষণের জন্য ওরা দেখল বিশাল এক রাশান ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার ঝুলতে শুরু করেছে খনি-মুখের সামনে। নেমে পড়ল ওটা ধুলো উড়িয়ে।

কপ্টার থেকে লাফিয়ে নামল মুখোশ পরা কমপক্ষে বিশজন লোক। ছুটে ঢুকে পড়ল খনির ভিতর।

লোকগুলো গুহায় হারিয়ে যেতেই আবারও আকাশে উঠল রাশান কপ্টার, কামান দাগতে শুরু করেছে কিলাই বাবাম্বার স্নাইপারদের উপর। একমিনিট পেরুনোর আগেই কপ্টার নিয়ে সন্তুষ্ট মনে পাহাড়ের উত্তরদিকে রওনা হয়ে গেল পাইলট, দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল চূড়াগুলো টপকে।

এটা কী হলো? পাহাড়ের দিকে চেয়ে আছে কর্নেল।

এমআই-১৭, জানাল স্পটার, গায়ে রাশান ইনসিগনিয়া! স্যর, ওরা যারা নামল, সবাই স্পেন্যায ইউনিটের লোক!

শালার চুতিয়া দেশ, পুরো চুতিয়া… বিড়বিড় করল কর্নেল। ঘুরে চাইল। ঠিক আছে, এককথায় বলো কী চাও, মেজর।

কিন্তু আশপাশে নেই মাসুদ রানা বা হোসেন আরাফাত খবির।–ভুরু কুঁচকে গেল উডের। তখনই দেখল চাকা পিছলে সামনে বাড়ছে একটু দূরের এক লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল। ভিতরে কেলে ব্যাটা মাসুদ রানা আর তার ঝোঁপের মত মোটা ভুরুওয়ালা চ্যালা!

খনির সামনের নো-ম্যানস-ল্যাণ্ড লক্ষ্য করে ছুটছে রণযান। পিছনে একগাদা ধুলো।

খনির উপরের পাহাড় থেকে শুরু হয়েছে গুলি। খটাখট লাগছে চাকাগুলোর আশপাশে।

লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল ডুন বাগির মত, উইণ্ডস্ক্রিন বা আর্মার নেই। কিন্তু ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জারের জন্য খাঁচা তৈরি করেছে। একরাশ রোল বার। এ হালকা রণযান তুলতে পারে তুমুল গতি, একদিক থেকে আরেকদিকে সরে অবিশ্বাস্য দ্রুত।

এলএসভি নিয়ে খনির কাছে বৃত্তাকারে ঘুরছে রানা, তৈরি করছে বিপুল ধুলো, লুকিয়ে পড়ছে ওই মেঘেরই ভিতর। এখন আর আশপাশে আসছে না স্নাইপারদের গুলি।

একটু পর খনি মুখের দিকে গাড়ির নাক তাক করল রানা। আবারও পশলা পশলা বুলেট আসতে লাগল।

তখনই হঠাৎ করেই খনি-মুখের উপরের পাহাড়ে কয়েকটা বিস্ফোরণ হলো। ছয়জন স্নাইপারের আস্তানা উড়ে গেল আকাশে। ঝরঝর করে নীচে পড়ছে ধুলো, মাটি ও পাথর।

থেমে গেছে গুলি।

খনির ভিতর থেকে হামলা করেছে কেউ, শেষ করে দিয়েছে। স্নাইপারদের ঘাঁটি।

মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরল রানা, সৎ করে ঢুকে পড়ল খনি-সুড়ঙ্গের ভিতর।

.

সমতল থেকে ছয় শ ফুট নীচে পাথুরে সুড়ঙ্গ ধরে হেঁটে চলেছে। তিশা করিম। ঘুটঘুঁটে আঁধারে বাতি বলতে হেলমেট ও এমপি-৭-এর ফ্ল্যাশলাইট।

তিশার সঙ্গে মাত্র তিনজন সৈনিক।

একটু পর পর মিথেনোমিটার দেখছে তিশা। ওই যন্ত্র মাপছে পরিবেশের মিথেনের মাত্রা।

আপাতত দেখিয়ে চলেছে: ৫.৮১%। তার মানে, পরিস্থিতি ভাল নয়। ওরা এখনও রয়ে গেছে খনির বাইরের দিকের অংশে। এদিকটা যেন জটিল গোলকধাঁধা।

চৌকো, নিচু সব সুড়ঙ্গ। রেলগাড়ির সুড়ঙ্গের মত আকৃতির, সবই ডানদিকে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেছে দূরে। কিছু গেছে গাঢ় আঁধারে, অন্যগুলো হঠাৎ করেই শেষ হয়েছে কানাগলির মত।

চারপাশ ধূসর রঙের।

পাথুরে দেয়াল, নিচু ছাত, এমন কী ওই ছাত ধরে রাখা কট কট আওয়াজ তোলা পিলার-বিমও ধূসর।

চারপাশের সবকিছুতে ভুতুড়ে ধূসর ছাইয়ের মত পাউডার।

ওই পাউডার থেকে রক্ষা নেই কিছুর। লাইমস্টোনের গুড়ো, এ দিয়ে দেয়ালগুলোর অত্যন্ত দাহ্য কয়লার গুঁড়োর তেষ্টা মিটিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ফলে তৈরি হয়েছে আরও বেশি বিপজ্জনক আগুনের ফাঁদ।

খাড়া ড্রিফট টানেল শেষে এক নেপালি কমাণ্ডোর দেখা পেল তিশা। রেডিয়ো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তাকে পাঠানো হয়েছিল বার্তাবাহক হিসাবে।

এখান থেকে বামে কনভেয়ার বেল্ট, জানাল সে। ওখান থেকে বেল্ট গেছে শত্রুদের ব্যারিকেডে। বেল্ট থেকে সরবেন না, সরলে হারিয়ে যাবেন।

নেপালি কমাণ্ডের কথা অনুযায়ী ছুটতে শুরু করেছে তিশার দল। আরও দু শ মিটার যাওয়ার পর বাঁক নিল পাথুরে টানেল। ওখানে দেখা গেল ভাসমান কনভেয়ার বেল্ট।

মিথেনোমিটার দেখিয়ে চলেছে:

৫.৭২%… ৫.৬৩%… খনির এত গভীরে কমতে শুরু করেছে মিথেনের মাত্রা।

ভাল, ভাবল তিশা।

তখনই চারপাশ দেখে ফিরল নিশাত সুলতানা। তিশার পাশে। ছুটবার ফাঁকে বলল, বুঝলে, তিশা, রানা আর তুমি, এবার বিয়েটা করে ফেললে…

আপা, থাক না এসব, আপত্তির সুরে বলল তিশা। খোলামেলা আলোচনা ভাল লাগছে না তার।

এই মিশন শেষে রানার সঙ্গে ওর যাওয়ার কথা ইতালি। বিখ্যাত অ্যারোস্টাডিয়া ইতালি এয়ার শো হবে মিলানে। হৈ-চৈ পড়ে গেছে, নাসার রকেট বিমান এক্স-১৬এস ওখানে প্রথমবারের মত দেখানো হবে। ওটা আজ পর্যন্ত মানবসৃষ্ট সবচেয়ে দ্রুতগামী বিমান। এয়ার ফিল্ড থেকে সামান্য দূরে চমৎকার এক ভিলা ভাড়া নিয়েছে রানা, জানিয়ে দিয়েছে নিশাত আর খবিরকে, ওদেরকেও যেতে হবে ওর সঙ্গে। আর ধরে নিয়েছে নিশাত, এবার হয়তো সত্যি সত্যি ভালবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করবে মাসুদ রানা।

রানা কিন্তু তোমাকে সত্যি…

নিশাতকে থামিয়ে দিল তিশা, ও তো কিছু বলেনি, আপা।

কদিন আগে বলছিল, তিশা যদি ফিরিয়ে দেয়… আমি বললাম… থেমে গেল নিশাত।

ওরা পৌঁছে গেছে বাঁকে। ওদিক থেকে আসছে গুলির আওয়াজ।

আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে ওরা। থেমে গেছে আলাপ। ওদিকে উঁকি দিল ওরা।

দূরে দেখা গেল আঁধারে হেলমেটের ফ্ল্যাশলাইটের বাতি। ছায়ার মত ছোটাছুটি করছে মিত্রপক্ষের কয়েকজন। ব্যারেল ও বাক্সের মত পুরনো মাইনিং ইকুইপমেন্টের তৈরি এক ব্যারিকেডের আড়াল নিয়েছে তারা।

ওই ব্যারিকেডের ওদিকে গুরুত্বপূর্ণ এয়ার ভেন্ট।

বদ্ধ, চৌকো, নিচু ছাতের সুড়ঙ্গের এই দুনিয়া যেন চেপে বসতে চাইছে বুকের উপর। সামনে ফাঁকা জায়গা দেখে স্বস্তির ভাব এল ওদের মনে।

ওদিকটা কমপক্ষে সাততলা।

জ্বলজ্বল করছে ফসফরাস ফ্লেয়ার, যেন কোনও পাতাল ক্যাথেড্রাল।

ছাত ফুড়ে সোজা উঠেছে দশ মিটার চওড়া দুই এয়ার ভেন্ট। আর তার নীচে তুমুলভাবে লড়াই চলছে দুই দল যোদ্ধার।

কিলাই বাবাম্বার যোদ্ধারা পুরোপুরি প্রস্তুত।

প্রকাণ্ড গুহায় নিজেদের শক্তপোক্ত ব্যারিকেড তৈরি করেছে তারা। মিত্রবাহিনীর ব্যারিকেড অনেক নাজুক।

বাবাম্বার লোক ব্যবহার করেছে বড় সব মাইনিং ইকুইপমেন্ট। তার ভিতর রয়েছে পরিত্যক্ত সব ভেহিকেলের হেমিস্ফেয়ারিকাল ড্রিল, ফ্রন্ট-এণ্ড লোডার, কয়লাভরা টিপ-ট্রে ও পুরনো সাদা হামভির মত ট্রাক। শেষেরগুলো ড্রিফটরানার।

মিত্র ব্যারিকেডের পিছনে পৌঁছে গেল নিশাত, তিশা এবং ওদের সৈনিকরা।

গুহার আরেকদিকে শত্রুদল। সংখ্যায় কমপক্ষে এক শ জন। পরনে কাদাটে সাদা শার্ট ও ছেঁড়া প্যান্ট। কয়লার গুঁড়োর কারণে ভূতের মত লাগল লোকগুলোকে। নানান অস্ত্র তাদের হাতে।

একে-৪৭, এম-১৬এস এবং আরপিজি।

পাতাল-গুহায় পাহাড়ের উপর থেকে তাজা বাতাস আসছে, ফলে নিশ্চিন্তে গুলি ছুঁড়ছে।

তিশা এবং নিশাত আলাদা হয়ে গেল। ব্যারিকেডের দুপাশে অবস্থান নিয়েছে। মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের সংখ্যা বড়জোর বিশ। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও মালোয়েশিয়ার যোদ্ধা।

এদের নেতা ভারতীয় মেজর জয়ন্ত মিত্র খেয়াল করেছে নিশাত ও তিশার দল পৌঁছে গেছে।

একে বলে রক্তাক্ত দুঃস্বপ্ন! গুলির আওয়াজের উপর দিয়ে বলল সে। কোনওভাবেই সরবে না এরা! আর একটু পর পর… হায় রাম! ওই যে আসছে আরেকটা! অ্যাই, গুলি করে ফেলে দাও!

চট করে মিত্র ব্যারিকেডের উপর দিয়ে ওদিকে চাইল তিশা।

সামনের ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেছে এক কিশোর বয়সী আফ্রিকান ছেলে, এখনও গোঁফ জন্মায়নি তার। ছিটকে এল মোটরসাইকেলে চেপে, বামহাতে একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল।

বাবা কিলাই বাবাম্বা! চিৎকার ছাড়ছে, সেসঙ্গে গুলিবর্ষণ।

তিশার মনে হলো, কিশোর সৈনিকদের ড্রাগে অভ্যস্ত করে তুলেছে ওয়ারলর্ড। নইলে এভাবে আত্মহত্যা করত না কেউ।

ছেলেটার বুকে ব্যাণ্ডেজের মত চার খণ্ড সি৪।

তাকে গেঁথে ফেলল উপমহাদেশীয় তিন সৈনিক। থেমে গেল। তাদের অটোমেটিক রাইফেল।

ছুটন্ত মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে গেল আত্মঘাতী কিশোর। মেঝেতে পড়তেই ভেসে উঠল একরাশ ধুলো, আর তখনই বিস্ফোরিত হলো দেহটা।

এক সেকেণ্ড আগে সে ছিল, পরের সেকেণ্ডে উধাও।

তিশার দিকে চাইল মেজর জয়ন্ত মিত্র। এরা পুরো উন্মাদ! একটু পর পর একজন একজন করে আসছে মরতে! তবে বড় কথা, আমাদের ব্যারিকেডের কাছে আসার আগেই শেষ করতে পারছি! বোধহয় পিছনে সাপ্লাই গুহা! জেনারেটার, গ্যাসোলিনের অভাব নেই, সঙ্গে প্রচুর খাবার, পানি আর অ্যামিউনিশন! মনে করি না আগামী এক বছরে ওরা নড়বে ওখান থেকে!

আমরা যদি এদেরকে ঘুরে পিছনে যাই? বলল তিশা, ডানদিকে একসারি সুড়ঙ্গের দিকে ইশারা করল।

না, ওদিকে বুবি-ট্র্যাপ! ট্রিপ ওয়ায়ার! ল্যাণ্ড মাইন! ওদিকে পাঠিয়ে শেষ করেছি আমার দুইজন ট্রেই সৈনিক! লড়াইয়ের জন্যে বেশ কদিন ধরে অপেক্ষা করছে এরা! মুখোমুখি লড়াই ছাড়া উপায় নেই। আমার আরও লোক দরকার!

তখনই দেখা গেল, পিছনের সুড়ঙ্গে অস্ত্রের ব্যারেলের ফ্ল্যাশলাইট।

ওদের অন্তত আরও বিশজন সৈনিক আসছে।

যাক, রিইনফোর্সমেন্ট, খুশি হয়ে বলল মেজর মিত্র।

রওনা হয়ে গেল সে।

ওদিকে চোখ রেখেছে তিশা, দেখল ওই দলের নেতার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল মেজর।

অবাক তো, ভাবল তিশা। কর্নেল উড বলেছিল পরের টিম আসবে কমপক্ষে বিশ মিনিট পর। তা হলে এরা এত দ্রুত পৌঁছায়…

তিশা দেখল, হাত নেড়ে ব্যারিকেড দেখাল মেজর মিত্র। পরিস্থিতি বোঝাতে শুরু করেছে। নতুন দলের দিকে পিঠ দিয়েছে। সে। আর তখনই নতুন দলের নেতা ঝট করে কী যেন বের করল বেল্ট থেকে। জিনিসটা চালাল মেজর মিত্রের ঘাড়ের উপর।

প্রথমে বুঝল না তিশা, কী ঘটছে। সামান্যতম নড়ল না মেজর জয়ন্ত মিত্র। পরক্ষণে সবই বুঝল তিশা, হতবাক হয়ে গেল।

ছিটকে একদিকে রওনা হয়েছে মেজরের মাথা। এক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে ধড়াস্ করে মেঝেতে পড়ল বেচারার প্রাণহীন ধড়।

চমকে যাওয়ারও সময় পেল না তিশা, গর্জে উঠেছে নতুন। দলের সাবমেশিনগান।

গুলি শুরু করেছে পিছন থেকে।

বিদ্যুদ্বেগে স্টিলের মিনি-স্কিপগুলোর ওপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিশা। চারপাশে বিধছে বুলেট। এক সেকেণ্ড পর তিশার পাশে ঝাঁপিয়ে নেমে এল নিশাত এবং ওর দলের অন্য দুই সৈনিক।

মিত্রপক্ষের অন্যান্য অফিসার ও সৈনিকের কপাল এত ভাল নয়।

পিছন থেকে আসা বুলেটের ঝড় শেষ করে দিয়েছে সবাইকে খোলা জায়গায়। অসংখ্য রক্তাক্ত গর্ত তৈরি হয়েছে তাদের দেহে। থরথর করে কাঁপছে লাশগুলো গুলি খেয়ে।

আল্লা, এ কী! জং ধরা স্টিলের মিনি-স্কিপের দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়েছে তিশা।

ওরা আটকা পড়েছে দুই দলের মাঝে। একদল সামনে। একদল পিছনে। ওদের অবস্থা স্যাণ্ডউইচের মত।

আমাদের বাঁচতে হবে, তিশার কানের কাছে বলল নিশাত। এসো!

কোথায়, আপা?

এদিকে!

লাফ দিয়ে উঠে নিশাতের পাশে ছুটল তিশা।

পিছনে আসছে দলের দুই সৈনিক।

মিনি-স্কিপের ওদিকে দুই ব্যারিকেডের মাঝের সুড়ঙ্গ ধরে ছুটতে গিয়ে বেড়ালের ক্ষিপ্র গতি তুলল ওরা।

.

তিশা ও নিশাত যখন পাতাল-সুড়ঙ্গ ধরে ছুটছে; ওই একই সময়ে খনি-মুখে গুহার ভিতর ব্রেক কষে থামল রানা ও খবিরের লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল।

সামনের ড্রিফটের মেঝেতে রোলার কোস্টারের মত ট্র্যাক দেখল রানা। দূরে, বহু নীচে গেছে দুই সমান্তরাল লাইন। তখনই পাশের এক টানেল থেকে ছিটকে বেরোল দুই লোক।

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল রানা, ও খবির, হাতে এমপি-৭ সাবমেশিনগান। একই কাজ করল লোকদুটো।

আফজাল না? জানতে চাইল রানা, কুঁচকে গেছে ভুরু। আফজাল হোসেন?

স্যর, আপনি? অস্ত্র নামিয়ে নিল ডানদিকের লোকটা। আরেকটু হলে আপনাকে খুনই করে ফেলতাম, স্যর!

এইমাত্র পাহাড়ের উপর কিলাই বাবাম্বার স্নাইপারদের শেষ করে ফিরেছে তারা।

আফজালের পাশের লোকটার নাম কৃষ্ণ গোপাল হাওলাদার।

লেফটেন্যান্ট তিশাকে খুঁজছি, বলল রানা। সে কোথায়?

নীচে, স্যর, বলল আফজাল।

তিরিশ সেকেণ্ড পর লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেলে চেপে, ঢালু ড্রিফট বেয়ে নীচে রওনা হয়ে গেল রানা, পাশে খবির। ভাগাভাগি করে বসেছে রিয়ার গানারের সিটে অন্য দুই সৈনিক।

দূরে গিয়ে পড়েছে এলএসভির হেডলাইট। তিরিশ ডিগ্রি ঢালু পথ, বুক চিরে রেলগাড়ির লাইন।

পথের শেষে পৌঁছে এলএসভির গিয়ার নিউট্রাল করল রানা, পরক্ষণে ব্যবহার করল ব্যাক গিয়ার। বনবন করে উল্টো ঘুরতে লাগল চাকাগুলো। নেমে যাওয়ার গতি কমছে।

রানার স্ট্যাটেজি কাজে এল, কয়েক সেকেণ্ডে কমে গেল নীচে যাওয়ার গতি। পরের দশ গজ যাওয়ার পর আবারও এলএসভির ফার্স্ট গিয়ার ফেলল রানা, গতি তুলল গাড়ির।

ড্রিফট টানেলের শেষে গোলকধাঁধার মত জায়গা। পাশ কাটাল ওরা নেপালি কমাণ্ডোর লাশ।

.

পুরোপুরি খোলা জায়গায় নিশাত, তিশা এবং ওদের দুই সৈনিক।

মাত্র তিরিশ গজ দূরে শত্রুদের ব্যারিকেড।

ওখানে রয়েছে কমপক্ষে দুই শ ড্রাগ অ্যাডিক্ট আফ্রিকান সৈনিক।

তিশাদের দলটাকে শেষ করে দেয়ার মস্ত সুযোগ তাদের। তিশা ধরেই নিয়েছে, এবার মরতে হবে ওদেরকে। কিন্তু মরতে হলো না।

অবশ্য গুলির আওয়াজ পেল তিশা। ওই গুলি শুরু হয়েছে শত্ৰুদলের ব্যারিকেডের পিছনে।

ভুরু কুঁচকে গেল তিশার। আগে কখনও এমন গোলাগুলির আওয়াজ শোনেনি।

গুলি চলছে বড় দ্রুত। অস্ত্রটা হতে পারে ছয় ব্যারেলের মিনি-গান। এরপর যা দেখল তিশা, অবাক না হয়ে পারল না। কিলাই বাবাম্বার ব্লকেড উড়ে যাচ্ছে গুলির ঝড়ে।

ব্যবহার করা হচ্ছে কমপক্ষে এক লাখ হাইপারভেলোসিটি বুলেট।

হুলুস্থুল পড়ে গেছে কিলাই বাবাম্বার বাহিনীর ভিতর। নিজেদের ব্যারিকেড টপকে পালাতে চাইছে সবাই। ছুটে আসছে নো-ম্যান্স-ল্যাণ্ড লক্ষ্য করে। পিট্টি খাওয়া কুকুরের মত ভেগে আসছে। একটু আগে একইভাবে তিশাদেরকে খতম করতে চাইছিল তারা।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার বুঝল তিশা।

ওদের চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর একদল লোক ধাওয়া করেছে। ড্রাগ অ্যাডিক্ট টেরোরিস্টদেরকে।

নিজেদের ব্যারিকেড ফেলে পালাচ্ছে আফ্রিকানরা, কোমরে পিঠে-মাথায় বুলেট খেয়ে মরছে। নানাদিকে ছিটকে পড়ছে লাশগুলোর কাঁচা মাংস ও রক্ত।

ব্যারিকেড পেরুবার সময় টুকরো টুকরো হয়ে গেল এক আফ্রিকান টেরোরিস্ট। এক মুহূর্ত আগে সবুজ টার্গেটিং লেসার। স্থির হয়েছিল তার উপর।

সবুজ লেসার… ভাবল তিশা।

তিশা! পাশ থেকে চেঁচাল নিশাত, কী হচ্ছে বুঝতে পারছ?

বোধহয়, পাল্টা জানাল তিশা। আমরা এখানে দুই দল নই, কমপক্ষে চারটা দল! আপা, আসুন! জলদি!

কোথায় যাবে?

একটা কাজ নিয়েই তো এসেছি। আসুন, সেটা শেষ করি!

কুঁজো হয়ে নো-ম্যান্স্-ল্যাণ্ড ধরে ছুটতে লাগল নিশাত ও তিশা। ঢুকে পড়ল কনভেয়ার বেল্টের নীচে। ছুটছে বামদিকের এয়ার ভেণ্ট লক্ষ্য করে।

ভাসমান কনভেয়ার বেল্টের উত্তরাংশে পৌঁছে গেল, আর তখনই ব্যারিকেডের ওদিক থেকে তাড়া খেয়ে এল মাঝবয়সী চার টেরোরিস্ট।

তাদের তিনজন আছড়ে-পাছড়ে উঠল কয়েকটা বাক্সের উপর। ওগুলো রাখা ছিল সিঁড়ির ধাপের মত। উপরের বাক্স থেকে লাফ দিয়ে কনভেয়ার বেল্টে নামল তারা। চতুর্থজন টিপে দিল কন্সেলের পেটমোটা সবুজ বাটন।

সগর্জনে চালু হয়ে গেল কনভেয়ার বেল্ট।

পরের মুহূর্তে দেখা গেল, বেল্টের উপরে ওঠা তিন টেরোরিস্ট রওনা হয়েছে তুমুল গতি তুলে।

চলেছে মিত্র ব্যারিকেডের দিকে।

চতুর্থজন লাফিয়ে উঠল বেল্টে, সে-ও রওনা হলো দক্ষিণ দিক লক্ষ্য করে।

বেল্টের গতি দেখেছ! বলল নিশাত।

আপা, চলুন! শত্রু ব্যারিকেডের দিকে ছুটছে তিশা।

খোলা জায়গা পেরিয়ে পৌঁছে গেল ওরা মজবুত ব্যারিকেডের ওপাশে। জায়গাটা সাততলা ক্যাথেড্রালের মত।

মৃদু ওয়াটের ইলেকট্রিক সাদা বাতি জ্বলছে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে ভুতুড়ে আলো।

পরিষ্কার ওরা বুঝল, কী কারণে ব্যারিকেড টপকে পালাতে চেয়েছে কিলাই বাবাম্বার সৈনিকরা।

হাজির হয়েছে কালো পোশাক পরা পনেরোজন কমাণ্ডো। চোখে সবুজ রঙের নাইট-ভিশন গগলস।

টেরোরিস্টদের পিছনে উত্তর-পুবের ছোট টানেল থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা।

তাদের হাতের অস্ত্র দেখে চমকে গেছে তিশা-নিশাত। ওই জিনিসের ভয়েই প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে টেরোরিস্টরা।

এ দলের সৈনিকের হাতে মেটালস্টর্ম এম১০০ অ্যাসল্ট রাইফেল।

রেল গান।

মেটালস্টর্ম অস্ত্রে সাধারণ মুভিং পার্ট থাকে না। প্রতিটি বুলেটের জন্য ট্রিগার হিসাবে কাজ করে র‍্যাপিড-সিকোয়েন্স ইলেকট্রিক শক। ফলে মাত্র এক মিনিটে ফায়ার করা যায় দশ হাজার গুলি। ধাতুর ঝড় তৈরি করে, কাজেই নাম হয়েছে অস্ত্রের মেটালস্টর্ম।

নতুন এই দলের লোকগুলোর চোখে ভুতুড়ে সবুজ লেসারসাইটিং ডিভাইস।

আপাতত এদের পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত তিশা ঠিক করল, এরা কৃষ্ণ-হরিৎ ফোর্স।

এদের একটা বিষয় বড় অস্বাভাবিক।

এরা পাত্তাই দিচ্ছে না ওদেরকে। তাড়া করছে পলায়নরত টেরোরিস্টদের।

চারপাশে হুলুস্থুল।

এই সুযোগে বামের এয়ার ভেণ্টের ধুলোময় মেঝেতে পৌঁছল তিশা। ব্যস্ত হাতে বসাল মেঝেতে নাক উঁচু করা মর্টার লঞ্চার।

একমিনিট পর গলা উঁচিয়ে বলল তিশা: ক্লিয়ার! টিপে দিল ট্রিগার।

জোরালো হুম্প আওয়াজ তুলে আকাশে রওনা হলো মর্টার রাউণ্ড। রকেটের মত উধাও হলো এয়ার ভেণ্ট ধরে।

পরক্ষণে পাহাড়ের উপর থেকে এল বিকট বুম! আওয়াজ।

ছয় শ ফুট উপরের পাহাড়ে আঘাত হেনেছে মর্টার শেল।

হাজারো টুকরো হয়ে উড়ে গেল কিলাই বাবাম্বার দলের বসানো ক্যামোফ্লেজ ঢাকনি।

ঝরঝর করে নীচে পড়ল আবর্জনা। একই সময়ে গুহার ভিতর এল ধূসর প্রাকৃতিক আলো।

আবর্জনার বৃষ্টি শেষে আবারও সামনে বাড়ল তিশা, ওকে ঘিরে রেখেছে দলের অন্যরা। দেরি না করে শাফটের নীচে বসিয়ে দিল তিশা আধুনিক কমপ্যাক্ট লেসার ডাইয়োড।

টিপে দিল সুইচ।

সঙ্গে সঙ্গে চিমনি থেকে বেরিয়ে আকাশ স্পর্শ করল অত্যুজ্জ্বল রক্তিম লেসার বিম।

অল ইউনিটস, নিশাত সুলতানা বলছি, রেডিয়ো করল নিশাত। আপনারা মনোযোগ দিন! সেট করা হয়েছে লেসার! দশ মিনিটের ভেতর হাজির হবে বোমারু বিমান! এবার ত্যাগ করুন খনি এলাকা!

.

ইউএন-এর সামরিক শিবিরে কন্সেলের সামনে পিঠ সোজা করে বসল কমিউনিকেশন অফিসার। হড়বড় করে বলল, কর্নেল! খনি থেকে বেরুচ্ছে টার্গেটিং লেসার। আমাদের কাজ শেষ।

এক পা সামনে বাড়ল কর্নেল উড।

সি-১৩০-এর সঙ্গে যোগাযোগ করো, জানিয়ে দাও ওরা লেসার পাবে। এভ্যাকিউয়েশন ক্রুদের বলো খনির-মুখে অপেক্ষা করতে। কেউ বেরোলে সরিয়ে নেবে। দশ মিনিট পর ইতিহাস হবে ওই খনি। সবাইকে আশপাশ থেকে সরে যেতে বলো।

.

একইসঙ্গে ঘুরে চাইল নিশাত, তিশা এবং ওদের দুই সৈনিক।

ওরা রয়ে গেছে কিলাই বাবাম্বার ব্যারিকেডের পিছনে। এবার বেরিয়ে যেতে হবে খনি-মুখের ঢালু পথ ধরে। মাত্র কয়েক গজ যেতেই থামতে হলো ওদেরকে। কিলাই বাবাম্বার ব্যারিকেডের সামনে নো-ম্যানস্-ল্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে চার টেরোরিস্ট। তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে কৃষ্ণ হরিৎ ফোর্স। মেটালস্টর্ম রাইফেলের বিম পড়ছে শত্রুদের মুখে।

ব্যারিকেডের পিছন থেকে উঁকি দিল তিশা।

কৃষ্ণ-হরিৎ দলের নেতা সামনে বাড়ল, খুলে ফেলল স্কি মাস্ক। নামকরা পুরুষ মডেলদের মত দৃঢ় চোয়াল, সত্যিকারের হ্যাণ্ডসাম। দুচোখ নীল। টেরোরিস্টদের একজনকে বলল, তুমি আলাল? …আলাল হোসেন?

থুতনি বাঁকা করে ঘাড় কাত করল আরব।

আমিই আলাল হোসেন, আড়ষ্ট স্বরে বলল, তুমি চাইলেও আমাকে খুন করতে পারবে না।

কৃষ্ণ-হরিৎ দলের নেতা জানতে চাইল, কেন পারব না?

কারণ আমার রক্ষাকারী স্বয়ং আল্লা, বলল আলাল হোসেন। তুমি জানো না? আমাকে পাঠানো হয়েছে মুসলিম জাহানকে উদ্ধার করতে! গলা চড়ে গেল তার, রাশানদের জিজ্ঞেস করো! মুজাহিদিনদের শেষ করেছে, তাজিক জেলখানায় পাতাল-ঘরে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছে কিন্তু ঠিক ছিলাম আমি। জিজ্ঞেস করো আমেরিকানদের! আফ্রিকান এম্বেসির ওপর ক্রজ মিসাইল হামলা হলেও আমি ছিলাম পুরো সুস্থ! গলা আরও চড়ছে তার, জিজ্ঞেস করো মোসাদকে! ওরা জানে! তাদের বারোজন আততায়ী আমাকে খুন করতে চেয়ে খতম হয়ে গেছে নিজেরাই! দুনিয়ায় কোনও বাপের ব্যাটা নেই যে আমাকে খুন করতে পারে! আমাকে পাঠানো হয়েছে আল্লার তরফ থেকে! আমি আল্লার বার্তাবাহক! কেউ পারবে না আমার কেশাগ্র স্পর্শ করতে!

তুমি ভুল ভাবছ, নরম স্বরে বলল কৃষ্ণ-হরিৎ দলের নেতা। পরক্ষণে এক হাতে আলালের চুলের ঝুঁটি চেপে ধরল সে। বলল, দ্যাখো, পারে কি না!

বলেই ডানহাতের ম্যাচেটি চালিয়ে ঘঁাচ করে কেটে নিল কল্লাটা। লাশ মেঝে স্পর্শ করবার আগেই ঘুরে দাঁড়াল সে।

বিস্ফারিত হলো তিশার চোখ।

সামান্য হাঁ হয়ে গেছে নিশাত।

দশ

চেয়ে আছে তিশা ও নিশাত।

অলসভঙ্গিতে আলাল হোসেনের কাটা মাথা সাদা মেডিকেল বাক্সের ভিতর রাখল কৃষ্ণ-হরিৎ দুলের নেতা।

আস্তে করে শ্বাস ফেলল নিশাত। এখানে হচ্ছে কী, তিশা?

জানি না, আপা, বলল তিশা। জানার সময়ও নেই, বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

পিছনে পায়ের ধুপ-ধাপ আওয়াজ পেয়ে ঘুরে চাইল ওরা।

ওদের দিকেই আসছে একদল আফ্রিকান টেরোরিস্ট, লক্ষ্য কনভেয়ার বেল্ট। বিকট শব্দে চিৎকার জুড়েছে, মাথার উপর তুলে রেখেছে গুলিশূন্য একে-৪৭।

পিছন থেকে তেড়ে আসছে একদল কৃষ্ণ-হরিৎ কমাণ্ডো। তিশার গুলিতে ছিটকে পড়ল চার টেরোরিস্ট।

একই কাজ করল নিশাত, গুলি করে ফেলে দিল তিন। আফ্রিকান সৈনিককে।  দুই মহিলা অফিসারের দুই সৈনিক কোনও সুযোগ পেল না, তার আগেই ধাক্কা খেয়ে পদ দলিত হলো। ওদের গায়ের উপর দিয়ে ছুটে গেল লোকগুলো। শেষ কজন রাইফেলের কুঁদো ব্যবহার করেছে তিশাদের সৈনিকদের মাথার উপর। চাপা পড়েছে বেচারাদের মরণ আর্তনাদ।

এরা অনেক! তিশা বলল নিশাতকে। বামদিকে ডাইভ দিল নিজে, সরে গেল বাবাম্বার সৈনিকদের সামনে থেকে।

ওদিকে বাক্সগুলোর উপর উঠছে নিশাত, তারই ফাঁকে গুলি ছুঁড়ল শত্রু লক্ষ্য করে। অবশ্য তা কসেকেণ্ডের জন্য মাত্র, তারপর টেরোরিস্টদের ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ল চলন্ত কনভেয়ার বেল্টের উপর।

টেরোরিস্টদেরকে কনভেয়ার বেল্টে চেপে পালাতে দেখে অবাক হয়েছে কৃষ্ণ-হরিৎ দলের কমাণ্ডেরা।

তাদের একজন চলে গেল বেল্টের কন্ট্রোল কন্সেলের সামনে, টিপে দিল বড়সড় হলদে বাটন।

গুহার ভিতর আরও বাড়ল যান্ত্রিক গর্জন। ধুলোময় মেঝে থেকে ঘুরে চাইল তিশা।

মিত্রবাহিনীর ব্যারিকেডের ওদিকে কনভেয়ার বেল্টের শেষে। চালু হয়ে গেছে পাথর-ভাঙা প্রকাণ্ড এক মেশিন।

জিনিসটা মস্ত দুটো রোলার, মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেঙে পড়বে কনভেয়ার বেল্টে রাখা পাথর।

রোলারদুটোর গায়ে হাজার হাজার দাঁত। চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইল তিশা।

প্রাণ বাঁচাতে কনভেয়ার বেল্টে উঠেছে টেরোরিস্টরা, এবং এদের মাঝে আটকা পড়েছে নিশাত আপা।

এখন আর নামতে পারবে না। সাই-সাই করে ছুটে চলেছে রক ক্রাশারের ঘুরন্ত পাথর-ভাঙা মেশিন ষাট গজ দূরে। ওদিকে গুলি শুরু করল নিশাত। কিন্তু তিশা দেখল, খপ করে নিশাতের দুই হাত ধরে ফেলেছে দুই টেরোরিস্ট। তিনজনই হুড়মুড় করে পড়ল বেল্টের উপর।

কনভেয়ার বেল্ট থেকে লাফিয়ে নামছে বাবাম্বার লোক। কিন্তু নিশাতকে আটকে রাখা দুজন পুরো নেশাগ্রস্ত। জাপ্টে ধরেছে ক্যাপ্টেনকে।

দ্রুত চলছে কনভেয়ার বেল্ট, রক ক্রাশারের সামনে পৌঁছে আবারও ফিরছে তলা দিয়ে। বেল্টের গতি ঘণ্টায় কমপক্ষে তিরিশ ১ কিলোমিটার প্রতি সেকেণ্ডে আশি মিটার।

হাতাহাতি করতে গিয়ে অস্ত্র হারিয়ে বসেছে নিশাত, লড়বার ফাঁকে পরিষ্কার বাংলায় চিৎকার করল, শুয়োরের বাচ্চারা! ছয় ফুটি শরীরে ষাঁড়ের শক্তি ওর, ঠেকিয়ে রেখেছে দুই শত্রুকে–কিন্তু বাগে আনতে পারছে না।

তোরা ভেবেছিস মেরে ফেলবি, না? ডানদিকের লোকটার মুখে থুতু ফেলল নিশাত। জীবনেও পারবি না!

উঠে দাঁড়িয়েই বামপাশের জনের অণ্ডকোষে কষে লাথি দিল ও। আর্তনাদ করে উঠল টেরোরিস্ট। খপ করে তার হাত ধরল নিশাত, টান দিয়ে কাঁধের উপর দিয়ে ছিটকে ফেলল রক

ক্রাশারের দিকে। পাথর-ভাঙা মেশিন মাত্র বিশ গজ দূরে।

আড়াই সেকেণ্ডে রক ক্রাশারে পৌঁছবে টেরোরিস্ট। অন্তর থেকে বুঝল নিশাত, এবার নেমে পড়তে হবে। কিন্তু দুহাতে ওকে জাপ্টে ধরল দ্বিতীয় লোকটা, ফেলে দিল। বেল্টের উপর।

রক ক্রাশারের দিকে পিছন ফিরেছে টেরোরিস্ট। দ্রুত সামনে বাড়ছে বেল্ট।

পেটে ভর করে শুয়ে আছে নিশাত। যদি ঢেকে রক ক্রাশারে, আগে ঢুকবে ওর মাথা।

আবারও ওকে জড়িয়ে ধরল লোকটা, যেন ধর্ষণ করবে।

ছাড়, শুয়োরের বাচ্চা! চেঁচিয়ে উঠল নিশাত।

কিলাই বাবাম্বার সৈনিক ঢুকছে রক ক্রাশারের ভিতর। মারা যাওয়ার সময় কিচকিচ আওয়াজ তুলল ইঁদুরের মত।

চোখের সামনে রক্তের বিস্ফোরণ দেখল নিশাত। ভিজে গেল গোটা মুখ। তখনই হঠাৎ বুঝল সব।

ফুরিয়ে গেছে সময়। অনেক দেরি করে ফেলেছে। এবার মরবে ও! ধীর হয়ে গেল সময়।

এখনও নিশাতের হাত আঁকড়ে ধরে আছে টেরোরিস্ট, রক ক্রাশারের ভিতর ঢুকে গেছে দুপা। তারপর কোমর এবং…

খুব কাছ থেকে দেখল নিশাত, খপাৎ করে লোকটাকে গিলে ফেলল মেশিন। এক সেকেণ্ডে উধাও হলো সাড়ে ছয় ফুটি দেহ।

প্লাৎ শব্দে নানাদিকে ছিটকে গেল আঠালো রক্ত।

দ্বিতীয়বার ভিজে গেল নিশাতের মুখ। কয়েক ইঞ্চি দূরে রোলারদুটো, দেখল নিশাত। চোখে পড়ল রক্তে ভেজা প্রতিটি এবড়োখেবড়ো দাঁত। নিশাতের হাতদুটো ঢুকছে মেশিনের ভিতর। আর তখনই কে যেন হ্যাচকা টানে তুলে নিল ওকে শূন্যে। নীচে বনবন করে ঘুরছে রক ক্রাশার!!

কনভেয়ার বেল্টের মাত্র দু ইঞ্চি উপরে টেনে তুলেছে। নিশাতকে, ফলে এখন আর সামনে বাড়ছে না ও।

ভুরু কুঁচকে ফেলল নিশাত

ভঙ্গিটা এমন: জরুরি কাজে বাগড়া দেয়া কেন!

একহাতে উপরের স্টিল ওভারহেড বিম ধরে ঝুলছে কে যেন, অন্য হাতে ধরেছে নিশাতের কলারের বডি আর্মার।

আপা, একবার আমাকে বলেছিলেন: আমাদের ফেলে কোথায় চলেছ, বলল মাসুদ রানা। ওই কথা তো এখন আমিও জানতে চাইতে পারি।

পাঁচ সেকেণ্ড পর শক্ত জমিতে নামল নিশাত। ঝুপ করে ওর পাশে নামল রানা। ওদের কাভার দিল খবির, আফজাল ও কৃষ্ণ গোপাল। একটু দূরে মিত্রবাহিনীর ব্যারিকেডের কাছে ওদের লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল।

তিশা কোথায়? হৈ-চৈয়ের ভিতর জানতে চাইল রানা।

ওদিকের ব্যারিকেডের কাছে, জানাল নিশাত।

ওদিকে চাইল রানা।

স্যর, কী হচ্ছে এখানে? জানতে চাইল নিশাত, এরা কারা?

এখনও জানি না এরা কারা, এবং কী হচ্ছে, বলল রানা।

শুধু জানি এরা বাউন্টি হান্টার। তাদের একদল খুঁজছে তিশাকে।

খপ করে রানার কনুই ধরল নিশাত। স্যর, খারাপ খবর! বোমারু বিমানের জন্যে টার্গেটিং লেসার বসিয়ে দিয়েছি আমরা! আমাদের হাতে… চট করে হাতঘড়ি দেখল ক্যাপ্টেন। আর মাত্র আট মিনিট! এর পর উড়ে যাবে খনি একুশ হাজার পাউণ্ডের বোমার আঘাতে!

তার আগেই তিশাকে খুঁজে বের করতে হবে, বলল রানা।

.

কিলাই বাবাম্বার লোকদের স্ট্যাম্পিড থামার পর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তিশা আর তখনই দেখল কয়েকটা সবুজ লেসার বিম পড়ল ওর বুকের আর্মারের উপর।

মুখ তুলে চাইল তিশা। ঘিরে ফেলা হয়েছে ওকে।

এরাও কালো-সবুজ ফোর্স। দলে ছয়জন, তাক করেছে মেটালস্টর্ম রাইফেল।

এদের একজন এগিয়ে এল সামনে। হেলমেট খুলতেই দেখা গেল তার মুখ।

ওই মুখ জীবনে ভুলবে না তিশা।

কখনও না!

এ লোক যেন উঠে এসেছে হরর সিনেমা থেকে। ।

অতীতে ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে গিয়েছিল মাথা। বিকটভাবে কুঁচকে গেছে করোটির চামড়া, সেখানে ফোস্কার মত সব ফুসকুড়ি, একটা চুলও নেই। গলে চোয়ালে মিশে গেছে কানের লতির নীচের অংশ।

কিন্তু এখন খুশিতে চকচক করছে লোকটার চোখ।

তুমি লেফটেন্যান্ট তিশা করিম, তাই না? ভদ্র সুরে বলল। তিশার হাত থেকে সরিয়ে নিল এমপি-৭।

জ্ব-জী, বলল বিস্মিত তিশা।

প্রথম কৃষ্ণ-হরিৎ দলের নেতার মতই এ লোকের উচ্চারণ ব্রিটিশ। বয়স হবে চল্লিশ। অভিজ্ঞ। চতুর।

তিশার পিঠের খাপ থেকে ম্যাগক সরিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে।

ওটা রাখতে দিতে পারি না, কী বলো, ডার্লিং, পারি? …তিশা করিম, তোমার বয়স চব্বিশ। চতুর হরিণী বলা হয় তোমাকে। আর্মি ট্রেইনিং ক্লাসে প্রথম হয়েছিলে। বাংলাদেশ আর্মির সঙ্গে আছ। সাহায্য করেছ আমেরিকান মেরিন অভিযানে। তার চেয়েও বড় কথা: তোমাকে খুবই পছন্দ করে বিসিআই এজেণ্ট মাসুদ রানা।

আপাতত তুমি কাজ করছ কর্নেল ক্লিণ্ট ওয়াই, উডের সঙ্গে। …আর এবার বলছি আমার নাম: আমি ডেভিড এন. হেন্ড্রিক। কলসাইন: দ্য ডেভিল। এরা আমার লোক, আমরা কাজ করছি। কন্টিনেন্টাল সোলজার নামের বাউন্টি হান্টারদের সংগঠনে। আমাদের ইউনিট নম্বর ৬৬। আশা করি তুমি রাগ করবে না; আপাতত কিছু দিনের জন্যে তোমাকে সরিয়ে নেব আমরা।

ডেভিলের কথা শেষ হতেই পিছন থেকে একহাতে তিশাকে জড়িয়ে ধরল এক বাউন্টি হান্টার, অন্যহাতে ভেজা রুমাল। নাক মুখে চেপে ধরল ট্রাইক্লোরোমিথেন (ক্লোরোফর্ম)। চোখের সামনে লাল-নীল-সাদা নক্ষত্র দেখল তিশা, ঝটকা-ঝটকি করল পাঁচ সেকেণ্ড, তারপর জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ল।

ডেভিলের পাশে এসে থামল সুদর্শন সেই লোক। এ-ই কেটে নিয়েছে আলাল হোসেনের মাথা। এখন লোকটার হাতে তিনটে মাথা রাখা যাবে এমন এক মেডিকেল ট্রান্সপোর্ট কন্টেইনার।

স্যর, ডেভিলকে বলল, এখন আমাদের হাতে আলাল, কোসলোস্কি আর ক্যাপলানের মাথা থাকার কথা। কিন্তু ক্যাপলানের মাথা আগেই উধাও। আমার ধারণা, তাকে শিকার করেছে কোবরা ইউনিটের লোক।

চিন্তিত চেহারায় মাথা দোলাল হেন্ড্রিক। হুম, মেজর পেরোনভ আর ওর স্পেন্যায কোবরা ইউনিট। …ডার্কহ্যাম, ভাল দেখিয়েছ তুমি। এই অভিযানে যথেষ্ট মাথা পেয়েছি আমরা। তিশার অচেতন দেহের দিকে চাইল। আর এ মেয়ের কারণে হয়তো পাব আরেকটা পুরস্কার। সবাইকে জানিয়ে দাও, পিছন-দরজা দিয়ে বেরোব। দেরি না করে উঠতে হবে বিমানে। একটু পর বোমা পড়বে খনির ওপর। রওনা হয়েছে আমেরিকান বমার।

.

বাঁক নিল রানার লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল, কড়া ব্রেক কষে থামল কিলাই বাবাম্বার ব্যারিকেডের কাছে। চারপাশে ছড়িয়ে গেল ধূসর ধুলো।

লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামল রানা, নিশাত, খবির, আফজাল এবং কৃষ্ণ। অস্ত্র হাতে খুঁজতে শুরু করেছে তিশাকে।

আপা, বোমা পড়তে কতক্ষণ বাকি? জানতে চাইল রানা।

ছয় মিনিট, স্যর!

আশপাশে কোথাও দেখা গেল না তিশাকে।

কালো-সবুজ দল অদৃশ্য হয়েছে।

কেউ নেই কিলাই বাবাম্বার ব্যারিকেডের ওদিকে। লড়াই শেষ। পড়ে আছে অসংখ্য লাশ।

কনভেয়ার বেল্টের কাছেই ব্যারিকেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিশাত। আস্তে করে মাথা দোলাল। তিশাকে শেষবার এখানে দেখেছি তখন এক টেরোরিস্টের মাথা কেটে নিল সুন্দর দেখতে এক লোক। তাদের দলের সবার পরনে ছিল কালো ইউনিফর্ম। সবুজ লেসার ফেলছিল। তখনই ওদিক থেকে পালাতে লাগল। কিলাই বাবাম্বার সৈনিকরা।

মস্ত গুহার উত্তর-পুব কোনা দেখাল নিশাত। ওদিকে রয়েছে এয়ার ভেন্ট। ওপাশে গ্যারাজের দরজাঁর মত এক টানেল।

ওখানে আরও কিছু দেখেছে রানা, মেঝের উপর একটা ম্যাগহুক।

দ্রুত পায়ে গিয়ে ম্যাগহুক তুলে নিল রানা, অস্ত্রের উপর সাদা মার্কার কলম দিয়ে লেখা: তিশা করিম।

এটা তিশার ম্যাগহুক। অর্থাৎ, ওকে ধরে নিয়ে গেছে বাউন্টি হান্টারের একটা দল, পরে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে ওর সঙ্গে।

অস্ত্রটা বেল্টে আটকে নিল রানা। ফিরে চলল সবার উদ্দেশে। নিশাতের ভাঙা কথা শুনতে পেল: …হ্যাঁ, এদিকে চতুর্থ দল এসেছে।

চতুর্থ দল, আপা? জানতে চাইল রানা। তারা কারা?

খনির ভেতর আমরা চারটা দল ছিলাম, বলল নিশাত। ইউএন-এর ফোর্স, কিলাই বাবাম্বার সৈনিক, কালো পোশাক পরা সবুজ লেসারওয়ালা ওরা, আর চতুর্থ আরেক দল। ওই দল মিত্রবাহিনীর ব্যারিকেডের কাছে ব্রিটেনের এসএএস বাহিনীর ক্যাপ্টেন স্কট এম. ক্যাপলানকে পায়।

মেরে ফেলেছে তাকে? জানতে চাইল রানা।

মাথা কেটে নিয়েছে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল রানা, তারপর বলল, তা হলে ওরা বাউন্টি হান্টার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: চতুর্থ দল কোথায়?

স্যর… মনে হয় ওরা এখানেই… শুরু করেও থেমে গেল খবির।

কিলাই বাবাম্বার ব্যারিকেডের চারপাশে ভূতের মত উদয় হয়েছে একদল লোক। সংখ্যায় কমপক্ষে বিশজন। পরনে কাদাটে রঙের ফ্যাটিগ। মুখে স্কি-মাস্ক। পায়ে হলদে রাশান কমব্যাট বুট। আফ্রিকান ওয়ারলর্ডের সৈনিকদের ব্যারিকেডের সামান্য দূরে তাদের ড্রিফটরানার ভেহিকেল।

বেশিরভাগ কমাণ্ডোর হাতে ভয়ঙ্করদর্শন খাটো ব্যারেলের ভিযেড-৬১ স্করপিয়ন মেশিন পিস্তল।

রাশান স্পেৎন্যাযের স্পেশাল ফোর্স ব্যবহার করে ওই অস্ত্র। রানার দলকে বাগে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল তারা।

ঘিরে ফেলা দলটি থেকে সরে এল এক লোক। কাঁধের বার এর কারণে বোঝা গেল, সে মেজর। কঠোর সুরে বলল, হাত থেকে ফেলোলা অস্ত্র।

এক পলক দ্বিধা করল রানা, তারপর হাতছাড়া করল অস্ত্র। ওর দেখাদেখি অন্যরাও। এবার রানার দিকে এল দুই স্পেন্যায সোলজার। দুপাশ থেকে রানার দুই হাত ধরল তারা, মুচড়ে ঠেলে দিল পিঠের উপর।

মেজর রানা, তোমাকে দেখে খুশি হলাম, বলল স্পেন্যায় মেজর। আমাদের ইন্টেলিজেন্স বলেনি তুমি এই সাইটে থাকবে। মন্দ লাগছে না বাড়তি বোনাস পেয়ে। তেত্রিশ মিলিয়ন ডলার খারাপ কী? তা ছাড়া, ভাল লাগছে সম্মানের কথা ভেবে। আমার হাতে বিদায় নেবে দুনিয়া-সেরা গুপ্তচর।

রানার দিকে চেয়ে আছে রাশান মেজর। তবে সবাই বোধহয় বাড়তি প্রশংসা করত। …ঠিক আছে, এবার বসে পড়ো হাঁটু গেড়ে, হাতদুটো মাটিতে।

না বসে দাঁড়িয়েই রইল রানা। মাথা কাত করে দেখাল তিশার বসানো লেসার ডাইয়োড়। ওদিকে ওই ডিভাইসটা দেখেছ? ওটার কারণে হাজির হবে লেসার গাইডেড একুশ হাজার পাউণ্ডের একটা বোমা। আর বড়জোর পাঁচ মিনিট, তারপর… আমি বলছি, হাঁটু গেড়ে বসো! চিৎকার করে বলল রাশান মেজর।

ক্যাথেড্রালের মত জায়গায় ভেণ্টের ঠিক নীচে ও। ধূসর আলো আসছে উপর থেকে।

রানার ডান হাঁটুর পিছনে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে আঘাত করল এক বাউন্টি হান্টার। ধপ করে বসতে হলো ওকে।

পিঠের খাপ থেকে সড়াৎ আওয়াজে খাটো কসাক ফাইটিং তলোয়ার নিল রাশান মেজর। আবছা আলোয় চকচক করছে তীক্ষ্ণধার ইস্পাতের ফলা।

সত্যি বলতে কি, হতাশই হয়েছি, রানার দিকে এগুতে শুরু করেছে মেজর, ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে চলেছে তলোয়ার। ভেবেছিলাম অনেক কষ্টে বাগে পাব তোমাকে। এখন দেখছি, তুমি শালা একেবারেই কিছুই নও।

দুহাতে-হ্রাতল ধরে মাথার উপর তলোয়ার তুলল সে। মাথাটা সামান্য একটু ঝকাল রানা নিশাতের উদ্দেশে। ঝপ করে বসে পড়ল নিশাত, হাতে তুলে নিয়েছে ফেলে দেয়া অস্ত্র। সাই করে নামছে ক্ষুরধার তলোয়ারের ফলা। ঠিক তখনই চরকির মত ঘুরে মেজরকে ল্যাং মারল রানা। লোকটা ধুপ করে পড়তেই থাবা মেরে কেড়ে নিল কসাক তলোয়ার, একইসময়ে তার কোমরের হোলস্টার থেকে তুলে নিয়েছে পিস্তল। গুলি শুরু করবে, এমন সময়…

বাউন্টি হান্টারদের ওপর স্থির হলো নীল লেসারের ফোঁটা। পরক্ষণে উড়ে গেল দুই গার্ড। ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে গুলির আঘাতে।

ঝট করে ঘুরে চাইল রানা, উঠে দাঁড়িয়েছে। তলোয়ার ফেলে একহাতে ঘাড় ধরে টেনে তুলল রাশান মেজরকে। অন্য হাতে পিস্তল, মাযল ঠেকিয়ে দিয়েছে শত্রুর কপালে।

প্রত্যেকের চোখ স্থির হয়েছে বিশেষ এক লোকের উপর।

খোলা জায়গায় এয়ার ভেন্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে সে, যেন মস্ত কোনও বাদুড়। দুই হাতে দুটো রুপালি রেমিংটন শটগান। এমনভাবে ধরেছে, যেন ভারী বন্দুক নয়, ছোট্ট দুটো পিস্তল। শটগানের ইস্পাতের ব্যারেলে হাইটেক নীল লেসার সাইটিং ডিভাইস।

দুপাশে ট্রাইপডে তৈরি রিমোট অপারেটেড এফএন-এমএজি মেশিনগান। নাকের উপর নীল লেসার সাইট। একটা লেসার। পড়েছে স্পেন্যায মেজরের বুকে। অন্যান্য লেসার ঘুরছে রাশান ট্রপের উপর।

নতুন এই আগন্তুককে চিনে ফেলেছে রানা। কুয়াশা! চোখে অ্যান্টি-ফ্ল্যাশ গগলস।

রানা খেয়াল করল, এয়ার ভেন্টে নেমেছে পুরু দড়ি। চোখের সামনে সড়াৎ করে উপরে রওনা হয়ে গেল ওটা, যেন ভুতুড়ে কোনও ভয়ঙ্কর সাপ।

মিখাইল পেদরোনভ, গমগম করে উঠল কুয়াশার গম্ভীর কণ্ঠ, আবারও দেখা হলো।

মনে হলো না কুয়াশাকে দেখে খুশি হয়েছে রাশান মেজর। লক্ষ্য করেছে, তার নিজের বুকে নীল লেসারের বিন্দুটা সম্পূর্ণ স্থির। চুপ করে রইল সে।

নীল লেসারের আওতা থেকে দূরে সরে দাঁড়াল রানা।

সামনে বাড়ল কুয়াশা। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত স্পেন্যায ইউনিটের মাঝ দিয়ে এগুতে শুরু করেছে, পাত্তাই দিচ্ছে না কাউকে।

রানা দেখল, কুয়াশার আলখেল্লার বুকে-পেটে কমপক্ষে বিশটা পকেট। ফুলে আছে দুপাশের পকেটগুলোও। বেরিয়ে আছে দুএকটা মিলিটারি ডিভাইসের ডগা। তার ভিতর রয়েছে। হ্যাণ্ডকাফ, মাউন্টেন ক্লাইমিং পিটন, হাতে ধরা যায় এমন ছোট একটা স্কুবা ট্যাঙ্ক বা পনি বটল। এমন কী বাদ পড়েনি খুদে ওয়েল্ডিং টর্চও।

কখন কী লাগে বলা যায় না, রানার উদ্দেশে পরিষ্কার বাংলায় বলল কুয়াশা।

রাশান এক ট্রুপারকে পাশ কাটাতে শুরু করেছে বাঙালি বৈজ্ঞানিক, তখনই হঠাৎ অস্ত্র তুলল লোকটা।

কড়াৎ আওয়াজে গর্জে উঠল অস্ত্র। ঝলসে উঠল আগুন।

অন্ততঃবিশটা গুলি বুকে নিয়ে ছিটকে পড়ল রাশান ট্রপার।

ঘুরন্ত রোবোট মেশিনগান ঝিরঝির আওয়াজ তুলল, তার আগেই আবারও নল তাক করেছে আরেক দিকে।

মনে হলো না কুয়াশা চিন্তিত, সোজা এসে দাঁড়াল রানা এবং রাশান মেজরের সামনে। মৃদু হাসল রানার দিকে চেয়ে। দেখছি কোবরা ইউনিটের দেখা পেয়ে গেছ। মেজর পেরোনভের আচরণে কষ্ট পেয়ো না। দুদিন ধরে মানুষের মাথা কাটার কাজ নিয়েছে। …আর আমি এসেছি আকাশে তিশাদের লেসার দেখে। …এবার কাজের কথায় আসা যাক: বোমা পড়বে কখন?

রানা মুখ খুলবার আগেই বলল নিশাত, সাড়ে চার মিনিট পর। আরেকবার হাতঘড়ি দেখে নিল ও।

মিস্টার ফগ, আপনি যদি মাসুদ রানার মাথা নেন, আমরা আপনাকে দুনিয়ার শেষমাথা পর্যন্ত ধাওয়া করব, হুমকির সুরে বলল মেজর পেরোনভ। নিজ হাতে আপনাকে খুন করব।

মিখাইল, আরও গম্ভীর হয়ে গেল কুয়াশার কণ্ঠ: জেনে রাখো, তুমি সারাজীবন চেষ্টা করলেও আমার একটা চুল স্পর্শ করতে পারবে না।

জানেন, এখনই আপনাকে শেষ করে দিতে পারে আমার লোক?

তার আগেই তোমাকে মরতে হবে, মিখাইল, বলল কুয়াশা। দরাজ গলায় হেসে উঠল। দেখলে না, সে চেষ্টা করতে গিয়ে তোমার লোকটার কী দশা হলো? উপায় নেই, মেজর। ভাল। যোদ্ধা, কিন্তু বাস্তবে তুমি একটা সাইকোটিক পেশেন্ট। মানুষ মারতে পছন্দ করো, কিন্তু মরতে খুব আপত্তি আছে তোমার। মরণকে ভীষণ ভয় তোমার। কিন্তু আমার কথা আলাদা, মরতে আমার দ্বিধা নেই।

কথাগুলো হজম করতে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল মেজর পেরোনভের মুখ, সবই শুনেছে তার লোক।

রানা টের পেল, রাশান মেজরকে হালকাভাবে উড়িয়ে দিয়েছে প্রতিভাবান বাঙালি বৈজ্ঞানিক।

এসো, রানা, মেঝে থেকে এমপি-৭ তুলে রানার হাতে ধরিয়ে দিল কুয়াশা। তোমার দলের সবাইকে বলো, আমার সঙ্গে যেতে হবে।

দ্বিতীয় দফা গুলিবর্ষণ হলো না, স্পেন্যায ইউনিটকে এড়িয়ে কুয়াশার পিছনে রওনা হয়ে গেল রানার দল।

ইনি কে, স্যর? রানার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলল নিশাত।

পেরোনভের পিস্তলটা দূরে ছুঁড়ে ফেলল রানা, নিচু স্বরে বলল, এমন এক বাঙালি বৈজ্ঞানিক, যাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে বাংলাদেশ–কিন্তু অতীতে কিছু কারণে এঁকে খুঁজছিল পুলিশ।

পরে রানার কাছ থেকে ওসব জেনে নিয়ো, মেয়ে, বলল কুয়াশা। শুধু জেনে রাখো, আমি তোমাদের ক্ষতি চাই না।

ওরা পৌঁছে গেছে পুবে কিলাই বাবাম্বার ব্যারিকেড়ের কাছে। ওখান থেকে সামান্য দূরে শুরু হয়েছে একটা টানেল।

ব্যারিকেডের শেষে একটা ড্রিফটরানার ট্রাক। ওটার দরজা হ্যাচকা টানে খুলল কুয়াশা। এসো, ওঠো। হলো

রানা ক্যাবে উঠতেই পিছু নিল ওর দলের অন্যরা।

থমথমে রাগ নিয়ে দেখছে কোবরা ইউনিটের স্পেন্যায সৈনিকরা।

ড্রিফটরানারের ড্রাইভিং সিটে বসল কুয়াশা, মুচড়ে দিল। ইগনিশন চাবির কান। রানার দিকে চাইল। তৈরি থাকো। রিমোট মেশিনগানের কাভার হারিয়ে গেলেই ওরা ধাওয়া করবে।

আমি তৈরি, বলল রানা।

গুড।

মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটার টিপে ধরল কুয়াশা, ঝটকা দিয়ে সামনে বাড়ল ড্রিফটানার, দেখতে না দেখতে ঢুকে পড়ল আঁধার টানেলে।

কুয়াশা ও রানারা উধাও হতেই নড়ে উঠল স্পেন্যায সৈনিকরা, লাফিয়ে গিয়ে উঠল তাদের ড্রিফটরানারগুলোয়।

লোক বেশি বলে রানার লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেলে চাপল। তিনজন।

গর্জে উঠল ইঞ্জিনগুলো। শুরু হলো পলাতকদের অনুসরণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *