বাইরের আলো
সারাদিন অসংখ্য কাজ। পর পর সব ছক-বাঁধা কাজ ঠিক হয়ে আছে আগে থেকেই। এমনকি দুপুরে খাওয়ার অবসর পর্যন্ত নেই, লাঞ্চের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে একজনের সঙ্গে, সেখানেও কাজের কথা হবে।
দাড়ি কামাবার যন্ত্রটাতে ঘরর ঘরর করে আওয়াজ হচ্ছে, তবু মনীশ দ্রুত চিন্তা করে যাচ্ছে যে, এর মধ্যে কোনো কাজটা আজ বাদ দেওয়া যায় কিনা। আজ ইন্দ্রাণী আসবে, মনীশের কি উচিত নয়, এয়ারপোর্টে গিয়ে তাকে নিয়ে আসা? প্রথম বিদেশে আসছে, এয়ারপোর্টে একটা চেনা মুখ দেখলে ভালো লাগে।
কিন্তু কী করে যাবে মনীশ? শিকাগো এখান থেকে একশো আশি মাইল দূর। যাওয়া-আসায় অন্তত পাঁচ ঘন্টা ছিনিয়ে নেওয়া একেবারে অসম্ভব।
আর ভেবে লাভ নেই, মনীশ মন ঠিক করে ফেলল। কলেজ থেকে মনীশ ভেঙ্কটকে পাঠিয়ে দেবে গাড়ি দিয়ে। সে নিয়ে আসবে ইন্দ্রাণীদের কোনো অসুবিধে হবে না।
ইন্দ্রাণীরা এখানে আসছে কেন? ইন্দ্রাণীর স্বামীর কী একটা অফিসের কাজ পড়েছে ভ্যাঙ্কুবারে। ইন্দ্রাণীও আসবে সঙ্গে। সরকারি কাজ, শুধু সোজাসুজি ভ্যাঙ্কুবার যাওয়া-আসার ভাড়া দেবে। মাঝখানে ওরা একটু বেড়িয়ে নিতে চায়। মা চিঠি লিখেছিলেন মনীশকে, ইন্দ্রাণীরা তোর ওদিকেই কাছাকাছি যাচ্ছে, তোর ওখানে একদিনের জন্য থাকতে চায়, তোর কি অসুবিধে হবে?
কাছাকাছি। মায়ের ধারণা, এরোপ্লেনে করে যারাই ভারতের বাইরে আসে, তারাই তাঁর ছেলের কাছাকাছি যায়। কোথায় ভ্যাঙ্কুবার আর কোথায় সিডার র্যাপিডস! তবু মনীশ তো আর আপত্তি করতে পারবে না। সে সংক্ষেপে লিখে দিয়েছিল, আসতে পারে।
এরপর সব দিনক্ষণ জানিয়ে ইন্দ্রাণী নিজে লেখেনি, লিখেছিল তার স্বামী। ইংরেজিতে! গত এগারো বছরে একটাও চিঠি লেখেনি ইন্দ্রাণী।
রান্নাঘরে গিয়ে ডিম আর সসেজ ভেজে নিল তাড়াতাড়ি। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়ল মনীশ। ফ্রিজ প্রায় খালি, কিছু খাবার-দাবারও আনিয়ে রাখতে হবে। আজ এসব দায়িত্বও দিতে হবে ভেঙ্কটকে। ভেঙ্কট ছেলেটি ভালো, খুব কথা শোনে।
গাড়ির ওপর বরফ জমে আছে। কাচেও বরফের আস্তরণ। ভেতরে ঢুকে মনীশ হিটার চালু করে দিল। ভেঙ্কটকে তুলে নিয়ে প্রথমে কলেজে যেতে হবে। পর পর তিনটি ক্লাস, তারপর প্রফেসার ফ্রিডম্যানের সঙ্গে লাঞ্চ, তারপর ফ্যাকাল্টি মিটিং তারপর যেতে হবে সেইনস শহরে, সেখানে একটা সেমিনার আছে, ফিরে এসেই সাড়ে ছটায় নোবেল লরিয়েট ড. ভ্যান অ্যালেনের রিসেপশান, আটটার সময় ডিন অব দ্য ফ্যাকাল্টি ড. এঙ্গেল কী একটা কাজের কথার জন্য তাঁর বাড়িতে ডেকেছেন…। ইন্দ্রাণীরা পাঁচটার মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে।
সস্তার বাড়ি ভাড়ার জন্য ভেঙ্কট থাকে শহর থেকে খানিকটা দূরে। মনীশ ব্যস্ততার প্রতিমূর্তি হিসেবে দুরন্ত গতিতে তার থান্ডারবার্ড গাড়িটা চালাচ্ছে। মাত্র কয়েকদিন আগে বরফ পড়া শুরু হয়েছে, সব গাছের পাতা এখনো ঝরেনি, এখনও রাস্তার দু-পাশের মেপল গাছ থেকে টুপটাপ করে খসে পড়ছে পাতা। একটুখানি দূরত্বের মধ্যেই মনীশ পর পর, তিনটি মরা পাখি দেখতে পেল। অনেকটা ছাতারে ধরনের পাখি, এরা শীতের শুরুতেই এক এক করে মরে। এরা বোধহয় বেশিদূর উড়ে যেতে পারে না।
একটা বড়ো গাছের তলায় মনীশ হঠাৎ গাড়িটা থামাল। হাত থেকে গ্লাভস খুলে ফেলে ধরাল একটা সিগারেট। মনটা আজ বড়ো চঞ্চল হয়ে আছে। দেশ থেকে মাঝে মাঝেই তো এরকম দু-একজন আসে। সুপ্রিমকোর্টে একটা মামলা হয়ে যাবার পর এখন ভারতের যে-কেউ টিকিট কেটে বিদেশের যে-কোনো জায়গায় বেড়াতে যেতে পারে। যাদের টাকা আছে তারা অনেকেই এখন এক মাস দেড় মাসের জন্য হুড়োহুড়ি করে পৃথিবীর অর্ধেকটা ঘুরে দেখে যায়। তবে ফরেন এক্সচেঞ্জের কড়াকড়ির জন্য তাদের হাতে যেহেতু বেশি টাকা থাকে না, তাই বিদেশে যে-কোনো সূত্রে কোনো আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-পরিজন খোঁজে। মনীশের কাছেও আগে এসেছে চার-পাঁচ জন, এদের দু-এক জনের জন্য বেশ বিরক্তিই বোধ করেছে মনীশ। নিছক বাঙালি দেখামাত্রই খুশি হয়ে ওঠার মতন মনোবৃত্তি অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে মনীশের।
আজ যদি তার অসুখ হত? মনীশ ভাবল অসুস্থ হয়ে পড়লে তো সে আজ কোনো কাজেই যেতে পারত না। বাড়ি ফিরে গিয়ে মনীশ টেলিফোনে সবাইকে জানিয়ে দেবে? কেউ অবিশ্বাস করবে না। এমনকি সে কতখানি অসুস্থ, সে খোঁজও নিতে আসবে না কেউ। এদেশে সেরকম নিয়ম নেই। কিন্তু সত্যিকারের অসুস্থ হওয়া আর অসুখের ভান করার মধ্যে অনেক তফাত। বাজে লোকরা ওসব করে। গত দশ বছরের মধ্যে এরকম কিছু একদিনও করেনি। তার স্বভাব পালটে গেছে। সে পারবে না।
মনীশ আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল এবং একটু পরেই সারাদিনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
সন্ধে সাড়ে ছটার সময় উডস্টক হোটেলের রিসেপশানে একগাদা লোকের মধ্যে দেঁতো হাসি হেসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ এক সময় মনীশের মনে হল, ইন্দ্রাণীরা এতক্ষণ নিশ্চয় তার বাড়িতে এসে বসে আছে। কী রকম চেহারা হয়েছে ইন্দ্রাণীর, তা এক্ষুনি দেখতে ইচ্ছে করে মনীশের। ইন্দ্রাণী অনেক বদলে গেছে। দশ-এগারো বছরে সবাই বদলায়।
কিন্তু এক্ষুনি তো যাবার উপায় নেই। ভেঙ্কটকে বলে রাখা আছে, ওদের খাবার-টাবারের সব ব্যবস্থা করে দেবে। কাল শুক্রবার, কাল দুপুর তিনটের পর থেকে মনীশের আর কোনো কাজ নেই। শনি রবি তো পুরো ছুটি। ইন্দ্রাণীরা কতদিন থাকবে কে জানে!
মনীশ ছুটি পেল রাত দশটায়। খানিক আগে ঝুরঝুর করে বরফ পড়তে শুরু করেছে। একদম হাওয়া নেই, থমথমে আবহাওয়া, এতেই বোঝা যায় রাত্রে প্রচুর তুষারপাত হবে। এই শুরু হয়ে গেল, এখন চলবে তিন-চার মাস।
রাস্তা-ঘাট নির্জন, মনীশ ট্যাক্সিতে হু-হু করে বাড়ি ফিরে এল। তার বাড়িটা প্রায় অন্ধকার। টর্চের আলো নেভান, বসবার ঘরের আলো নেভান, শুধু একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
মনীশ একটু হাসল। যারা নতুন আসে, তারা প্রত্যেকেই এরকম করে। আলো নিভিয়ে রেখে খরচ বাঁচাতে চায়। ভারতীয় অভ্যেস। মনীশ তার শোওয়ার ঘর ছাড়া আর সব ক-টি ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখে সারারাত। সবাই রাখে। একে একে আলো জ্বালতে জ্বালতে ভেতরে ঢুকল মনীশ। বসবার ঘরে ঢুকে ওভারকোটটা খোলামাত্র তার শীত করতে লাগল। সেন্ট্রাল হিটিংও চালায়নি নাকি? ভেঙ্কটকে তো সব বলে দিয়েছিল মনীশ।
গেস্ট রুমটায় ইন্দ্রাণীদের জন্য বিছানা-টিছানা পেতে সব বন্দোবস্ত করে গিয়েছিল। শুধু সেই ঘরটায় আলো জ্বলছে। ওরা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি এর মধ্যে। দরজা বন্ধ।
একটু পরেই খুট করে দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এল ইন্দ্রাণী। সোয়েটার, কোট সবকিছু পরা। মনীশ তখন টেবিলের ওপর থেকে খবরের কাগজগুলো সরাচ্ছিল, শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
না। মনীশের বুক কাঁপল না। বুক অনেক কঠিন হয়ে গেছে। ইন্দ্রাণীর চেহারা খুব একটা বদলায়নি, সামান্য একটু মোটা হয়েছে, চোখ-মুখের সেই ধারালো ভাবটা আর নেই। তার ফলে তাকে এখন বেশ লাবণ্যময়ী মনে হয়।
একটু হেসে মনীশ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ? কোনো অসুবিধা হয়নি তো।
ইন্দ্রাণী এক পা এগিয়ে এসে বলল, এ কি চেহারা হয়েছে তোমার! প্রথমে চিনতেই পারিনি।
মনীশ বলল, কই, আমার চেহারা তো বদলায়নি তেমন। কয়েকটা চুল পেকেছে শুধু।
ইন্দ্রাণী বলল, মোটেই না, তোমার চোয়াল দুটো আগে এত চওড়া মতন ছিল না, কাঁধ দুটো উঁচু হয়ে গেছে, তুমি অনেক লম্বা হয়ে গেছ।
মনীশ বলল, বাঃ, এই বয়েসে আবার কেউ লম্বা হয় নাকি? তোমার স্বামী কোথায়? ঘুমিয়ে পড়েছেন?
না, ডাকছি।
ইন্দ্রাণীর স্বামী প্রবীর ঘোষ বেরিয়ে এল একটা ড্রেসিং গাউন পরে। মনীশের চেয়ে বয়েসে সামান্য ছোটো মনে হয়, মাঝারি ধরনের চেহারা, মুখখানা বেশ ভালো মানুষ ভালো মানুষ ধরনের।
ইন্দ্রাণীর স্বামীকে আগে দেখেনি মনীশ। ইন্দ্রাণীর বিয়ের এক মাস আগে চলে আসে এদেশে। তখন অবশ্য ঠিক ছিল পোস্ট ডক্টরেট রিসার্চ করে তিন বছর বাদেই সে দেশে ফিরে যাবে। তারপর দশ বছর কেটে গেছে মনীশের আর ফেরা হয়নি।
আর কেউ জানে না শুধু ইন্দ্রাণীই বুঝেছিল যে মনীশ ইচ্ছে করেই তাড়াহুড়ো করে ইন্দ্রাণীর বিয়ের আগে চলে এসেছিল। সেই জন্যই ইন্দ্রাণী কি তার স্বামীকে দেখাতে নিয়ে এসেছে?
প্রবীরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল। প্রথমে কিছু ভদ্রতার কথা। প্লেন দেরি করেনি তো? ভেঙ্কট ঠিক সময়ে গিয়েছিল? খাওয়া হয়ে গেছে? মনীশ খুব দুঃখিত যে সে এয়ারপোর্টে যেতে পারেনি।
ইন্দ্রাণী জিজ্ঞেস করল, মনীশদা, তুমি খাবে না?
পার্টিতে টুকিটাকি খাবার খেয়েছে মনীশ। পুরো ডিনার খায়নি। তার আর কিছু খাবার ইচ্ছেও নেই। সারাদিন ঘোরাঘুরি আর এত লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সে ক্লান্ত বোধ করছে।
কাবার্ড থেকে একটা ব্র্যান্ডির বোতল আর কয়েকটা গ্লাস বার করে মনীশ জিজ্ঞেস করল প্রবীরকে, আপনি কি ব্র্যান্ডি খাবেন? কিংবা অন্য কিছু? আমার কাছে আছে—
প্রবীর ইন্দ্রাণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি খাব?
ইন্দ্রাণী মনীশের দিকে চেয় বলল, না, ও খাবে না। ওর সহ্য হয় না।
মনীশ শুধু নিজের গেলাসে ঢেলে একটা ছোটো চুমুক দিল। দেশ থেকে তার আত্মীয়-স্বজন এসেছে বলে যতখানি উৎসাহিত হয়ে ওঠা উচিত ছিল, ততটা হতে পারছে না। পাছে ওরা কিছু মনে করে, তাই মনীশ নকল উৎসাহ দেখিয়ে বলল, তোমরা কিছুদিন থাকছ তো? কাল বিকেল থেকে আমার ছুটি আছে, গাড়ি নিয়ে কোথাও বেড়াতে বেরিয়ে পড়া যাবে। আমি তো ভেবেছিলাম, আজই তোমাদের নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যাব, কিন্তু একটু বেশি রাত হয়ে গেল।
তবু এখনও যাওয়া যায়—
প্রবীর বলল, আর খাওয়া! আপনার বোন তো কিছুই খেতে চাইছে না, প্লেনে চড়ার জন্য এখনও নাকি গা গুলোচ্ছে।
বোন? কথাটা মনীশের কানে খট করে লাগল। হ্যাঁ, সকলেই অবশ্য বলবে যে ইন্দ্রাণী তার বোন। বেশ কাছাকাছি একটা সম্পর্ক আছে। তার মায়ের খুড়তুতো বোনের মেয়ে। শুধু মনীশই এই সম্পর্কটা মানতে চায়নি। সে কোনোদিন দেখেনি তার মায়ের কাকাকে। অল্প বয়সে তিনি মারা যান। ইন্দ্রাণীদের বাড়ি মজঃফরপুরে। কলকাতায় এম এ পড়তে এসেছিল ইন্দ্রাণী, একটা হোস্টেলে থাকত, কী একটা গোলমালে হোস্টেলটা বন্ধ হয়ে যায়, তখন মনীশের মা ইন্দ্রাণীকে তাঁদের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন কয়েক মাস। ঠিক ভাই-বোন নয়, অনেকটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়েছিল, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে মনীশের। সে পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু ইন্দ্রাণীর যখন বিয়ের ঠিক হল, তখন মনীশ আপত্তি জানায়। ইন্দ্রাণী অন্য কারুর হয়ে যাবে, এটা সে কিছুতেই মানতে পারছিল না। মনীশের সঙ্গে ইন্দ্রাণীর বিয়ে যেন একটা অসম্ভব প্রস্তাব, এমনকি ইন্দ্রাণী পর্যন্ত রাজি হয়নি।
সে কতদিন আগেকার কথা। এখন সেই অভিমানের সামান্য চিহ্নও মনীশের বুকের মধ্যে জমা নেই।
ইন্দ্রাণী বলল, আমরা কাল বিকেলেই চলে যাব।
মনীশ অবাক হয়ে বলল, কাল বিকেলেই?
প্রবীর বলল, শনিবার ভ্যাঙ্কুবারে আমার মিটিং। রবিবার একটা কেবলস ফ্যাক্টরি দেখতে যেতে হবে। সোমবার কন্ট্রাক্ট সাইন হবার কথা।
মনীশ বলল, মাত্র একদিনের জন্য এখানে এলেন? কিছুই তো দেখা হবে না!
প্রবীর বলল, সরকারি কাজ, এ তো ঠিক বেড়াতে আসা নয়। ফেরার পথে আপনার বোনকে একটু বিলেত প্যারিস ঘুরিয়ে নিয়ে যাব। নিউ ইয়র্কেও দুদিন থাকার কথা আছে।
তারপর প্রবীর একটা ছোটো কাশি দিয়ে বলল, আপনার সঙ্গে একটা দরকারি কথা ছিল!
মনীশ জানে এবার প্রবীর কোন দরকারি কথা বলবে। সবাই ওই একটাই কথা বলে।
প্রবীর বললে, আপনি তো দেশে কিছু টাকা পাঠান। সেই টাকাটা আমরা দেশে পে করে দেবো। তার বদলে আপনি যদি কিছু ডলার দিতে পারেন আমাদের, জানেনই তো, মেয়েদের কিছু কেনাকাটার শখ থাকে।
মনীশ জিজ্ঞেস করল, কত?
প্রবীর বলল, এই আড়াইশো তিনশো ডলার। চারশো পেলে আরও ভালো হয়। মনীশ খানিকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সেটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। কাল সকালেই ব্যবস্থা করে দেবো।
শুধু মনীশকে দেখার জন্যই ইন্দ্রাণী এত দূর ছুটে আসেনি। এসেছে স্বার্থের কারণে।
ইন্দ্রাণী কথা ঘোরাবার জন্য বলল, তোমার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। খুব সুন্দর বাড়ি। এত বড়ো বাড়িতে তুমি একা থাক?
মনীশ বলল, এদেশে চাকর-বাকর পাওয়া যায় না, আর কে থাকবে?
ইন্দ্রাণী আর প্রবীর চোখাচোখি করল।
মনীশ বলল, আগে একটা কুকুর রেখেছিলাম। তা আমি সারাদিন বাড়ি থাকি না, ওকে ঠিকমতন খাবার দেওয়া হয় না, তাই অন্য একজনকে দিয়ে দিয়েছি কুকুরটা।
ইন্দ্রাণী উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়াল। ফ্যাকাসে আলোয় দেখা যায় অবিরল তুষারপাত। পথঘাট এর মধ্যেই সাদা হয়ে গেছে।
ইন্দ্রাণী বলল, কী সুন্দর, না? ইচ্ছে করে এই বরফের মধ্যে ছুটোছুটি করতে। কখনও এমন বরফ পড়া দেখিনি।
মনীশ বলল, যাও না। ভালো লাগবে।
প্রবীর বলল, ওর দারুণ সর্দি হয়েছে। আর ঠান্ডা লাগলে নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। মনীশ হাসতে হাসতে বলল, গায়ে বরফ লাগলে সর্দি সেরে যায়।
ইন্দ্রাণী ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, সত্যি?
মনীশ বলল, সত্যি। যারা প্রথম প্রথম আসে, অনবরত ঠান্ডা-গরমে তাদের সর্দি লেগে যায়। ঘরের মধ্যে গরম, বাইরে ঠান্ডা। মাঝে মাঝে একটু ঠান্ডা লাগিয়ে সহ্য করিয়ে নিতে হয় শরীরটাকে।
ইন্দ্রাণী বলল, চল না, আমরা তাহলে বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।
মনীশ প্রবীরের দিকে তাকিয়ে বলল, চলুন।
প্রবীর বলল, ওরে বাবা, আমি যাব না। আমার একদম ঠান্ডা সহ্য হয় না। আপনারা ঘুরে আসুন না।
ইন্দ্রাণী বলল, ও ভয়ানক শীত-কাতুরে। ও থাক, চল আমরা একটু বেড়িয়ে আসি!
প্রবীর বলল, তাই যান।
মনীশ এক চুমুকে গেলাসের ব্র্যান্ডিটা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে প্রবীরের কনুই ছুঁয়ে বলল, আরে মশাই, চলুন চলুন, ভালো লাগবে। দেখবেন, বরফের মধ্যে বেশি শীত করে না। কাছেই সিডার নদী, দেখবেন জমে গিয়ে বরফ হয়ে গেছে। প্রবীর মিনমিন করে বলল, আমি ওভারকোট আনিনি।
ইন্দ্রাণী বললে, ও না যেতে চায়, থাক না। জোর করে লাভ নেই। চলো আমরা ঘুরে আসি।
মনীশ বলল, আমার একটা একস্ট্রা ওভারকোট আছে, ওকে দিচ্ছি। আর ইন্দ্রাণী, তোমাদের ঘরের ওয়ার্ডরোবে দেখো একটা লাল রঙের কোট আছে। সেটা তোমার হয়ে যাবে।
ইন্দ্রাণী কোটটা নিয়ে এসে বলল, এটা কার? এটা তো মনে হচ্ছে মেয়েদের।
মনীশ সংক্ষেপে বলল, ওটা ছিল আমার স্ত্রীর। নিয়ে যায়নি।
ইন্দ্রাণী আর প্রবীর আবার চোখাচোখি করল।
ইন্দ্রাণী জিজ্ঞেস করল, তোমার স্ত্রী…সে এখন কোথায়?
মনীশ সংক্ষেপে জানাল, সে এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে, দেড় বছর আগে তার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। চলো যাওয়া যাক।
দেশে এই নিয়ে ফিসফাস চলছিল অনেক দিন, মনীশ একটা মেমকে নিয়ে থাকে। তাই দেশে ফেরার দিকে তার মন নেই। মনীশ অবশ্য এক চিঠিতে লিন্ডা নামের সেই মেয়েটিকে বিয়ে করার কথা জানিয়েছিল। কেউ ঠিক বিশ্বাস করেনি। আত্মীয়-স্বজন কেউ দেখল না, সে আবার কী রকম বিয়ে? যাক, মেয়েটা তাহলে ঘাড় থেকে নেমে গেছে।
ইন্দ্রাণী জিজ্ঞেস করল, মনীশদা, মাসিমা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন, তুমি আর বিয়ে করবে কি না?
মনীশ বলল, তুমি বুঝি আমার মায়ের চর হয়ে এখানে এসেছ? ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করবে?
ইন্দ্রাণী বলল, ও মা, চর আবার কী? মাসিমা বলেছেন তুমি চার-পাঁচ লাইনের বেশি চিঠি লেখো না।
প্রথমে বড়ো দরজা তারপর জালের দরজাটা খুলে ফেলে মনীশ বলল, এসো।
তারপর প্রবীরকে জিজ্ঞেস করল, গাড়িতে যাবেন, না হেঁটে? হাঁটলেই বেশি মজা লাগবে।
ইন্দ্রাণী বলল, হেঁটেই যাব।
বাইরে পা দিয়েই সে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠল। সামনে ছোটো বাগানটাতে সে দৌড়ে গিয়ে বললে, ওমা, গায়ে কী সুন্দর বরফ পড়ছে, কিন্তু ভিজে যাচ্ছে না তো কিছু, ফুলের পাপড়ির মতন।
আজ চাঁদ ওঠার কথা, কিন্তু চাঁদ দেখা যায় না। সারা আকাশ জুড়ে রয়েছে কিছুটা আবছা আলো। উইলো গাছগুলোর ডালে এমনভাবে বরফ জমে আছে যেন মনে হয় থোকা থোকা সাদা ফুল। চতুর্দিক একদম নিস্তব্ধ। বরফ পড়ার সময় কোনো শব্দ শোনা যায় না।
ওরা হাঁটতে লাগল সিডার নদীর দিকে। ইন্দ্রাণী একেবারে ছেলেমানুষের মতন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই রাস্তা থেকে তুলে নিচ্ছে পেঁজা বরফ। হাতের মুঠোতে নিয়ে গোল বল তৈরি করছে। তারপর সেগুলো ছুড়ে দিচ্ছে গাছের দিকে। একটা বল সে সোজা মনীশের মুখের ওপর ছুড়ে মেরে বলল, তুমি ভীষণ গম্ভীর আর অন্যরকম হয়ে গেছ।
হেসে, কোনো কথা না বলে গা থেকে বরফের গুঁড়োগুলো ঝেড়ে ফেলল মনীশ। প্রবীর একটু পিছিয়ে পড়েছে। তার জন্য অপেক্ষা করল। প্রবীর কাছে আসতেই সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, নিন।
প্রবীর বলল, আমি ঠান্ডায় পকেট থেকে হাত বের করতেই পারছি না। আপনি খান।
প্রবীরের অবস্থা সত্যিই কাহিল। সুতরাং, আর বেশিক্ষণ বেড়ানো চলে না। যাওয়া হল না নদী পর্যন্ত।
ইন্দ্রাণী বলল, এই জন্যই তো বলেছিলাম, ওকে থেকে যেতে। ও ফিরে যাক না, মনীশদা চলো, তুমি আর আমি নদীটা দেখে আসি।
মনীশ বলল, উনি একা একা থাকবেন কেন? কাল সকালে গাড়িতে তোমাদের চট করে ঘুরিয়ে আনব এখন!
ফিরে এসে মনীশ নিজের গেলাসে আবার একটা ব্র্যান্ডি ঢালল। প্রবীরকে বলল, আপনিও একটু খেয়ে নিলে পারতেন। ঠান্ডাটা কেটে যেত।
প্রবীর ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞেস করল, খাবো?
ইন্দ্রাণী বলল, আচ্ছা একটুখানি খাও, একটুখানি।
তখন উৎসাহিত হয়ে প্রবীর বলল, তুমিও একটু খাও না, সর্দি হয়েছে, ভালো লাগবে।
লাল রঙের কোর্টটা গা থেকে খুলে ফেলে ইন্দ্রাণী বলল, এটা কিন্তু আমার গায়ে বেশ ফিট করে গেছে। তোমার বউ বুঝি আমার মতন লম্বা ছিল?
মনীশ বলল, তুমি ওটা নিয়ে যেতে পারো। এখানে তো কোনো কাজে লাগে না। তোমার কাজে লাগবে, ক্যানাডায় বেশ শীত।
ইন্দ্রাণী বলল, ও তোমার জিনিসগুলো দিতে ভুলে গেছি।
দৌড়ে সে ঘরের মধ্যে চলে গেল। ফিরে এল তিন-চারটে প্যাকেট নিয়ে। তার মা পাঠিয়েছেন দু তিন রকম আচার আর পাঁপড়। ছখানা গেঞ্জি (ও দেশে গেঞ্জির নাকি খুব দাম!) আরও টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র। একটা প্যাকেটে একটা র-সিল্কের ঝলমলে শার্ট।
ইন্দ্রাণী বলল, শার্টটা আমি তোমার জন্য এনেছি।
মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখলেও গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নতুন কিছু নয়, সবাই আনে। যারাই দেশ থেকে এসে একদিন দু-দিনের জন্য তার এখানে এসে থাকে, ডলার চায়, তারাই উপহার আনে একটা করে শার্ট। আশ্চর্য, সবাই র-সিল্কের শার্ট আনে কেন? ওই রকমের জামা কতদিন পরবে?
দেশে থাকতে মনীশ খুব ঝাল খেতে ভালোবাসত। এখন তার খানিকটা আলসারের মতো দেখা দিয়েছে বলে সে আর ঝাল খেতে পারে না। মা সে কথা জানেন না, এখনও লোকজন এলেই তার হাতে ঝাল আচার পাঠাবেন। গেঞ্জি পরার রেওয়াজই নেই এদেশে। স্নেহের দান, তবু অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকে।
খুব সুন্দর হয়েছে শার্টটা, মনীশ বলল।
প্রবীর বেশ তৃপ্ত হল কথাটা শুনে। একটা উদ্যত হাই চেপে সে বলল, ইন্দ্রাণী অনেক দোকান ঘুরে এটা কিনেছে। কিছুতেই ওর পছন্দই হয় না।
ইন্দ্রাণী বলল, একবার পরে দেখো না, মাপ ঠিক হয়েছে কিনা।
মনীশ খানিকটা ত্রস্তভাবে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক হবে নিশ্চয়ই, এইতো কলারের মাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
ইন্দ্রাণী তবু বলল, একবার পরেই দেখো না বাবা! আমরাও একটু দেখি!
এখন ওদের সামনে নিজের জামা-টামা খুলে তারপর মনীশকে এই জামা পরতে হবে? একটা বিশ্রী বোকা বোকা ব্যাপার। সে খানিকটা জোর দিয়ে বলল, কাল সকালে পরে দেখাব।
কাল সকালে কখন তোমাকে বেরুতে হবে?
আমাকে ঠিক সাড়ে আটটার মধ্যে বেরুতেই হয়। তবে কাল তিনটের মধ্যে ফ্রি হয়ে যাব।
ততক্ষণে আমাদের এয়ারপোর্টে যাবার সময় হয়ে যাবে। তোমার সঙ্গে তো তাহলে গল্পই করা হবে না একদম। এতদুর থেকে এলাম—
মনীশ চুপ করে রইল। কিন্তু মনে মনে বলল, তোমরা তো আমার সঙ্গে গল্প করতে আসনি। এসেছই মাত্র একদিনের সময় নিয়ে। বড়ো বড়ো শহরের তুলনায় এ জায়গাটা প্রায় একটা গন্ডগ্রাম, এখানে কেউ বেড়াতে আসে না, আসে শুধু কয়েক ঘন্টার জন্য বিশ্রাম নিতে আর কিছু ডলারের সন্ধানে।
মনীশদা, তুমি কখন ঘুমোও?
ঠিক নেই, কোনো কোনো দিন দুটো আড়াইটে বেজে যায়।
আজ আমরা অনেকক্ষণ গল্প করবো।
তোমরা আজ ক্লান্ত, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো বরং, সারাদিন প্লেনে এসেছ।
আমি একটুও ক্লান্ত হইনি। একটু গা বমি করছিল, এখন কেটে গেছে।
প্রবীরবাবুর ঘুম পেয়ে গেছে।
প্রবীরের সত্যই ঘন ঘন হাই উঠছে। তবু সে সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, আমি আরও জেগে থাকতে পারি, কিন্তু মনীশবাবু সারাদিন খেটেখুটে এসেছেন। ওরই এখন বিশ্রাম দরকার।
ইন্দ্রাণী ঝঙ্কার দিয়ে বলল, বসে বসে গল্প করতে আবার পরিশ্রম হয় নাকি? তোমার ঘুম পেয়েছে, তুমি বরং শুয়ে পড়ো গিয়ে। মনীশদার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
মনীশ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আজ তোমরা শুয়েই পড়ো। এতখানি প্লেন জার্নির একটা স্ট্রেন আছে। কাল সকাল সকাল যদি উঠতে পারো, গাড়িতে তোমাদের এক চক্কর ঘুরিয়ে আনতে পারি। অবশ্য দেখবার বিশেষ কিছু নেই।
ইন্দ্রাণীর ফরসা মুখে একটা লালচে ভাব এল। সে ঘরটার চারদিকে তাকিয়ে বলল, তোমার এই বাড়িটার সবই ভালো, কিন্তু এই পর্দাগুলো কার পছন্দ, তোমার না তোমার বউয়ের?
মনীশ হেসে বললেন আমার—কেন?
ইন্দ্রাণী বলল, আমি হলে অন্য পর্দা লাগাতাম। এই সবুজ রংটা একদম মানায় না।
মনীশ বললে, আমার পছন্দ খুব খারাপ সবাই বলে। গুড নাইট, কাল সকালে দেখা হবে।
মনীশ নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। দরজার কাছে গিয়ে বলল, বাইরের আলো সারারাত জ্বালাই থাকে। তোমাদের অসুবিধে হলে অবশ্য নিভিয়ে দিতে পারো।
ঘরে ঢুকেই প্রবীর দ্রুত পোশাক বদলে গরম কম্বলের তলায় ঢুকে পড়ল। মুখটুকু শুধু বার করে বলল, ভুল করে যেন জানলা খুলে ফেলো না। তাহলে মারা যাব!
ইন্দ্রাণী ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে সেই লাল কোটটা—সেটা সে বিরক্তির সঙ্গে ছুড়ে দিল একপাশে। তার আগেকার বউয়ের ব্যবহার করা কোট মনীশদা তাকে দিয়ে দিতে চায়। ইন্দ্রাণী মোটেই ওটা নেবে না।
এই ঘরে ড্রেসিং টেবিল কেন? এটাই কি লিন্ডার ঘর ছিল? এই বিছানায় সে শুত?
মনীশদা আজকাল বড্ড কম কথা বলে। আগে মোটেই এরকম ছিল না। ঘন্টার পর ঘন্টা দুজনে গল্প করে কাটিয়েছে। বিদেশে এসে মানুষ বড্ড বদলে যায়। শুধু কাজ আর কাজ। আমরা এসেছি, তবু একদিন সে ছুটি নিতে পারল না? এত কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করে হবে কী?
অন্যমনস্কভাবে চুল আঁচড়ে যাচ্ছে তো আঁচড়েই যাচ্ছে ইন্দ্রাণী। অনেক কথা মনে পড়ছে। বিদেশে আসার কথা উঠলেই ইন্দ্রাণী মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল, অন্তত একদিনের জন্যে হলেও মনীশদার এখানে আসবেই। একবার তাকে দেখে যাবে। মনীশদা রাগ করেছিল তার ওপর, কিন্তু ইন্দ্রাণীও যে কতটা দুঃখ চেপে রেখেছিল, তা কি মনীশদা বোঝেনি? মেয়েদের পক্ষে সংস্কার ভাঙা কি সোজা কথা? বিদেশে কাজিনদের মধ্যে আকছার প্রেম হয়, বিয়ে হয়, কিন্তু আমাদের দেশে…।
মুখে এখন ক্রিম ঘষছে ইন্দ্রাণী। এক সময় সে নাক ডাকার শব্দ শুনতে পেল। প্রবীরের এই স্বভাব, শোওয়া মাত্র ঘুম। নতুন জায়গায় এসেও তার ঘুমের অসুবিধে হয় না! ইন্দ্রাণীর সহজে ঘুম আসবে না।
আরও কিছুক্ষণ পরে পোশাক বদলে, আলো নিভিয়ে সে জানলার পাশে দাঁড়াল। কাচের মধ্য দিয়ে বাইরের বরফ পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মন কেমন করে।
ইন্দ্রাণী বাইরে বেরিয়ে এসে মনীশের ঘরের দরজার সামনে একটু দাঁড়াল। তার বুক কাঁপছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে আস্তে দরজাটা ঠেলবার পর সেটা খুলে যেতেই সে খুশি হয়ে উঠল। সে জানত।
ঘরে ঢুকে দেখল, মস্ত বড়ো খাটের একধারে পাশ ফিরে শুয়ে আছে মনীশ। মাথার কাছে একটা টেবল-ল্যাম্প জ্বালা।
পা টিপে টিপে ইন্দ্রাণী মনীশের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর সে অবাক হল। মনীশের চোখ বোজা, মনীশ ঘুমিয়ে পড়েছে।
মনীশ ঘুমিয়ে পড়েছে? এইটুকু সময়ের মধ্যে? এই যে সে বলল, কোনো কোনো দিন দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত জাগে! আর আজই সে ঘুমিয়ে পড়ল, এ কি সম্ভব?
অনেকদিন আগে, ইন্দ্রাণীর বিয়ের আগে, যখন সে মনীশদের বাড়িতে থেকে এম এ পরীক্ষা দিচ্ছিল, সেই সময় সে একদিন রাত একটার সময় মনীশের ঘরে ঢুকেছিল, হাতে অনেকগুলো জানলার পর্দা। মনীশেরও তখন রাত জেগে পড়াশোনা করার স্বভাব ছিল। ইন্দ্রাণীকে দেখে অবাক হয়েছিল মনীশ, খুশিও হয়েছিল। ইন্দ্রাণী বলেছিল, তোমার জানলার পর্দা কাচা হয়েছিল আজ, লাগিয়ে দেওয়া হয়নি, তাই লাগিয়ে দিতে এলাম।
পর্দা লাগাতে, এত রাত্রে?
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে ইন্দ্রাণীকে জোর করে কোলে তুলে মনীশ নিয়ে গিয়েছিল বিছানায়।
আজও শুতে যাবার আগে সেই পর্দার কথা উল্লেখ করে ইন্দ্রাণী ভেবেছিল, মনীশ ঠিক বুঝতে পারবে। মনীশ ভুলে গেছে সেদিনের কথা? ইন্দ্রাণী সব মনে রেখেছে, আর মনীশ ভুলে যাবে? যে দেশে এমন সুন্দর বরফ পড়ে, যে দেশে বরফ-রঙা শরীরের মেয়েদের সঙ্গে যখন তখন বিয়ে আর ডিভোর্স হয়, সে দেশে থাকলে বুঝি এইসব স্মৃতি আর মনে পড়ে না?
ইন্দ্রাণী ঘরটার চারপাশে তাকাল। বইয়ের র্যাক, দরজার দু-পাশে দুটো জম-কালো স্ট্যান্ড ল্যাম্প, একটা সুন্দর ছোট্ট গোল টেবিল, দেয়ালে দুটি বাঁধানো আঁকা ছবি। ইন্দ্রাণী হলে গোল টেবিলটা খাটের ওপাশে না রেখে এপাশে সরিয়ে দিত, ছবি দুটো জানলার পাশ থেকে সরিয়ে এনে দিত মাঝখানে।
কিন্তু এসব ভেবে লাভ কী? তার তো কোনো অধিকার নেই।
সে মৃদু গলায় ডাকল, মনীশদা!
মনীশ চোখ খুলল না।
ইন্দ্রাণী হাত বাড়িয়ে মনীশের গায়ে ধাক্কা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু সরিয়ে নিল। সে আর কত নীচে নামবে? জেগে উঠে যদি মনীশ তাকে অপমান করে?
সে তো কতবার চেষ্টা করেছে, মনীশের সঙ্গে একটু নির্জনে কথা বলার। প্রবীরকে বাড়িতে রেখে তারা দুজনে একটু বাইরে বেড়িয়ে আসতে পারত না? প্রবীর কিছু মনে করত না। সবাই তো জানে, মনীশ তার ভাই। কিন্তু মনীশদা ইচ্ছে করে প্রত্যেকবার তাকে এড়িয়ে গেছে। এত গাঢ় ঘুমও তো মনীশের আগে কখনও ছিল না।
আস্তে আস্তে ইন্দ্রাণী বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার পাঁচ ও সাত বছরের দুটি ছেলে-মেয়েকে রেখে এসেছে নিজের মায়ের কাছে। কলকাতায় যোধপুর পার্কে জমি কিনে রেখেছে প্রবীর। সেখানে তাদের নতুন বাড়ি হবে। ইন্দ্রাণীর ভবিষ্যৎ জীবনটা ছক-বাঁধা হয়ে গেছে। আর কিছু বদলাবার উপায় নেই।
নিজেদের ঘরে এসে আলো জ্বালতেই দেখল, নাক ডাকা বন্ধ করে দু-চোখ মেলে প্রবীর স্পষ্ট তাকিয়ে আছে।
ইন্দ্রাণীর শরীরটা একবার কেঁপে উঠল। সে কিছু অন্যায় করেনি, প্রবীর কি তা বুঝতে পারবে। প্রবীর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, বাইরের আলোটা বড়ো চোখে লাগছিল, তাই ভাবলাম নিভিয়ে দিয়ে আসি।
প্রবীর বলল, কিন্তু নেভাতে ভুলে গেছ। যাও নিভিয়ে দিয়ে এস।