বাংলা সাহিত্যের গ্রন্থপঞ্জি: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাবলি বিষয়ক একটি বিবরণ
হেরমান ব্রকহাউস*
সমস্ত ধরনের জ্ঞানকে বিস্তৃততম পরিসরে ছড়িয়ে দিতে ভারতবর্ষের প্রাকৃত ভাষাগুলির উন্নতি অবশ্যই একটি অতি শক্তিশালী এবং অতীব জরুরি উপায়। ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ইতিমধ্যেই মৃত, বা ক্রমশ স্থিরভাবে মৃত্যুপথগামী এর চর্চা। পশ্চিম থেকে যে-সদানূতন-সংস্কৃতির-উপাদান মহাশক্তিভরে ভারতবর্ষে বয়ে এসে তার শিলীভূত বৌদ্ধিক জীবনকে নতুন শোণিতপ্রবাহে প্রাণিত করে তুলবে, ওই ভাষার পক্ষে সেটিকে আত্মস্থ করা অসম্ভব। বহু শতক যাবৎ সংস্কৃত শুধুমাত্র পণ্ডিতদের বুলি হয়েই রয়ে গেছে, সে আর লোকমুখে জিয়ন্ত ভাষা নেই। লোক ভাষা বা প্রাকৃত ভাষাগুলি বহু কাল ধরেই সাহিত্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত, কিন্তু তাও বিশেষভাবে শুধু ছন্দে বাঁধা কাব্যরচনার জন্যেই, এবং ওইসমস্ত কাব্য প্রাচীন সংস্কৃত রচনাগুলির মোটের উপর হুবহু নকল ছাড়া আর কিছুই নয়। গদ্যে কেবলমাত্র দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনে লেখা চিঠি, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি বাদে আর প্রায় কিছুই লেখা হত না। আর এই গদ্য, শৈলীর দিক দিয়ে ছিল অমার্জিত ও অসুন্দর, ব্যাকরণের দিক দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল; দৃঢ়-ভিত্তি-স্থাপিত নিয়মিত নয়। চিন্তা-বিনিময়ের একটি শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে ভারতীয় প্রাকৃত ভাষাগুলিকে উচ্চ সমৃদ্ধির অধিকারী করে তুলতে মহৎ অবদান ছিল তর্কাতীতভাবে মিশনারিদের। এই কাজের মাহাত্ম্য বুঝতে দেরি হয়নি নেটিভদের, যারা এই আদিপ্রদত্ত কর্মপ্রেরণারই আত্যন্তিক সাফল্যর সঙ্গে পুনঃ পুনঃ শরণাগত হচ্ছে।
উপরন্তু উত্তর ভারতে ওরকম তিনখানি প্রাকৃত ভাষা রয়েছে হিন্দি, মরাঠি, ও বাংলা, যে-ভাষাগুলিতে ইতিমধ্যেই উন্নত গদ্যে লেখা সমৃদ্ধ সাহিত্যভাণ্ডার আছে। শেষোক্ত ভাষা কোনও ক্ষুদ্র প্রাদেশিক উপভাষামাত্র নয় বরং প্রায় তিন কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে, এবং এই ভাষার লেখক একটা বিরাট পাঠক সমাজের উদ্দেশে কলম ধরেন। বাঙালি লেখক, যাঁরা নজির-গড়া লেখনীর জোরে জাতির উন্নতির জন্য সচেষ্ট এবং এই মহান উদ্যোগে জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন, তাঁদের ভিতর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় অন্যতম। জর্মন ভারততাত্ত্বিক সমাজ এই খ্যাতনামা পণ্ডিতকে, তাঁর কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ, তাদের সংগঠনের সদস্য নির্বাচন করেছে, আর তিনি এর দরুন কৃতজ্ঞতার চিহ্ন হিসেবে নিজের সমগ্র রচনাবলি আমাদের উক্ত সমাজের গ্রন্থাগারে অন্তর্ভুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেন। সবমিলিয়ে ষোলোটি প্রকাশিত কাজগুলির, বাইশটা ছোট-বড় খণ্ডে বিবৃত, মধ্যে একটি সংস্কৃত সুগম-পাঠ বা ক্রেস্টোম্যাথি, এবং একটি বাংলায় লেখা বইয়ের ইংরিজি তরজমা বাদে সবগুলিই বাংলা ভাষাতে লেখা। লেখক যে কী কৃতার্থ কৌশলে তাঁর বিষয় নির্বাচন করেছেন আর কতখানি ঐকান্তিকভাবে জনগণ শিক্ষার এই জরুরি পদ্ধতিটাকে গ্রহণ করেছে, তাঁর কাজ কী বিশাল পাঠককুলের সন্ধান পেয়েছে, এইসব বৃত্তান্ত চমৎকারী, এবং তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থগুলির উপরে বহু সংস্করণরূপ আশীর্বাদই এসবের প্রমাণ।
বইগুলির একটা ছোট আলোচনাই এখানে যথেষ্ট, কারণ বিষয়বস্তুর দিক থেকে সেগুলির আমাদেরকে খুব নতুন কিছুই দেওয়ার নেই। আমি শুরু করছি সেই কাজগুলির উল্লেখ দিয়ে, যেগুলি ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা এবং অনুবাদ, সম্পাদনা ইত্যাদির মাধ্যমে ভারতীয় সাহিত্যের প্রাচীন স্মৃতিস্তম্ভটিকে আমাদের কাছে হাজির করে।
১) ঋজুপাঠ : অথবা সংস্কৃতের সহজ শিক্ষা, প্রথম ভাগ, ষষ্ঠ সংস্করণ, কলিকাতা, ১৮৬৪। ৬৬ পৃ.। ৮। দ্বিতীয় ভাগ। পঞ্চম সংস্করণ, কলি. ১৮৬৪, ৯০ পৃ.। তৃতীয় ভাগ, তৃতীয় সং., কলি. ১৮৬১, ১১৫ পৃ.।
এটি দেবনাগরী অক্ষরে একটি সংস্কৃত সুগমপাঠ১ (Chrestomathy)। প্রথম ভাগে রয়েছে পঞ্চতন্ত্র থেকে ২১টি গল্প। ২য় ভাগে বাল্মীকি-রামায়ণ থেকে, বিশেষত মহাকাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে, রয়েছে পাঠ। ৩য় ভাগে আছে হিতোপদেশ-এর অংশবিশেষ; বিষ্ণুপুরাণ থেকে তিনটি কাহিনি: ১) ইন্দ্রম প্রতি দুর্বাসাস্য কোপঃ (উইলসন-এর অনুবাদে ৭০ পৃ.); ২) ধ্রুবোপাখ্যান (উইল. পৃ. ৮৬) ৩) ভরতোপাখ্যান (উইল. পৃ. ২৪৩); তারপর মহাভারত থেকে পাঁচটি কাহিনি; ভট্টি-কাব্য-র প্রথম তিন খণ্ড, এবং শেষে ঋতুসংহার থেকে তিনটি শ্লোক।
২) সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব : তৃতীয় সং., কলি. ১৮৬৩। ৮। ৮২ পৃ.।
লেখক প্রথম ১-১৮ পৃষ্ঠা আলোচনা করেছেন সংস্কৃত ভাষা, তার মহিমা, তার সম্পদ, ইত্যাদি নিয়ে। এভাবে তিনি তীব্রভাবে ভারতীয় পদ্যরচয়িতা, যেমন নলোদয়-এর কবি, ইত্যাদির লীলাময়তার উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে আগ্রহী হয়েছেন। চারুভাষের দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রধানত শিশুপালবধ, ভট্টি-কাব্য এবং কাদম্বরী থেকে অংশবিশেষ বেছে নেওয়া হয়েছে। ১৮ পৃষ্ঠা থেকে শেষ অবধি সাহিত্যালোচনা; কিন্তু শুধুমাত্র যেটিকে আমরা অনাধ্যাত্মিক, বা জাগতিক সাহিত্য বলে থাকি। প্রত্যেক বিখ্যাত কাব্যর নামানুসারে তাকে সাজিয়ে তার নান্দনিক আলোচনা, আর: ছোট্ট করে ব্যাখ্যা। বিবরণটা শুরু হয় ‘মহাকাব্য’ দিয়ে (রঘুবংশ ইত্যাদি; গীতগোবিন্দ-কে পর্যন্ত লেখক এর অন্তর্গত বলে মনে করেন)। এর পরে আসে ‘খণ্ড-কাব্য’, যেগুলি শুধুই একটি কাহিনি বুনে চলে, যার ভিতর লেখক রেখেছেন মেঘদূত, ঋতুসংহার, সূর্যশতক, এবং অদ্ভুতভাবেই, নলোদয়।
এরপর আসছে ‘কোষ-কাব্য’, অর্থাৎ নীতিকবিতা, যেমন, অমরুর ও ভর্তৃহরির উপদেশাবলি। এরপরে ‘গদ্যকাব্য’, অথবা গদ্যে লেখা কবিতা, যেমন, কাদম্বরী, বাসবদত্তা ইত্যাদি। তৎপশ্চাৎ ‘চম্পূ-কাব্য’; অত্যন্ত নির্মিত গদ্যে, পদ্যের মিশেল দেওয়া, কবিতা; এই ধরনটা নিয়ে অবশ্য লেখক কোনও বিশেষ আলোচনা করেননি। পরে এসেছে ‘দৃশ্য-কাব্য’, অথবা নাট্যকাব্য এবং শেষে ‘উপাখ্যান’, অথবা উপন্যাস-রূপককাহিনি-রূপকথার উল্লেখ, প্রধানত পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ ও কথাসরিৎসাগর–এর কথা।
৩) সংস্কৃত ব্যাকরণ উপক্রমণিকা : ত্রয়োদশ সং., কলি. ১৮৬৪। ১৩১ পৃ. ৮।
এই ছোট ব্যাকরণ পুরোটাই আমাদের ইউরোপীয় ব্যাকরণের বিশ্লেষণ পদ্ধতিকে আদর্শ করে এগিয়েছে। প্রধানত সারণির আকারে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নিয়মাদি অতি সংক্ষিপ্ত, অথচ পুরানো দেশীয় বৈয়াকরণদের দুর্বোধ্য সংক্ষেপ এড়ানো গেছে।
৪) ব্যাকরণ কৌমুদী : ৪ খণ্ডে, পঞ্চম সং. কলি. ১৮৬২-৬৪, ৮, খণ্ড ১, ১১৪ পৃ.। খণ্ড ২-৩, ২২৩ পৃ., খণ্ড ৪, ২৩৪ পৃ.।
সংস্কৃত-ভাষার একটি বিশদ ব্যাকরণ এটি, অথচ প্রথম ৩টি ভাগে সেই আমাদের ইউরোপীয় আদর্শের আগাগোড়া অনুবর্তন। প্রথম খণ্ডে রয়েছে অক্ষর পরিচয়, ধ্বনিমাধুর্যের নিয়ম, শব্দরূপ, অব্যয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় জুড়ে রয়েছে কৃৎ-প্রত্যয় ও ক্রিয়া। ৪র্থ খণ্ডে ফিরে এসেছে সেই আদি-ভারতীয় সূত্ররূপ। ওই পদ্ধতিতে কারক-এর ব্যবহারগুলি, তদ্ধিত প্রত্যয়, স্ত্রী প্রত্যয় ও সমাস দেখানো হয়েছে।
৫) মহাভারত উপক্রমণিকা ভাগ : বাংলায় মহাভারত। দ্বি. সং., কলি., ১৮৬২, ৮, ১৮৬ পৃ.।
মহাভারত-এর প্রথম খণ্ড [আদি পর্ব]-র প্রথম বাষট্টি অধ্যায়ের হুবহু অনুবাদ এটি। টীকা-ব্যাখ্যা সহযোগে।
৬) শকুন্তলা— কালিদাস প্রণীত অভিজ্ঞানশকুন্তলম নাটকের উপাখ্যানভাগ : সপ্তম সং., কলি. ১৮৬৪, ৮, ১২০ পৃ.।
বিখ্যাত নাট্যটির উপন্যাসাকারে এই রচনা নিঃসন্দেহে ল্যাম্-এর টেল্স ফ্রম শেক্সপিয়র দ্বারা অনুপ্রাণিত। আমাদের রচয়িতা অবশ্য কালিদাস-এর নাট্যটি প্রতি পদে অনুসরণ করেছেন, মনোমুগ্ধকর শ্লোকগুলির অনুবাদ করে দিয়েছেন, সংলাপের গোটা অংশও।
৭) সীতার বনবাস : পঞ্চম সং., কলি., সম্বৎ ১৯২১, ৮, ১৩৪ পৃ.।
পুরোটাই কালিদাস-এর ওই রচনার মতো করে ভবভূতির উত্তররামচরিতম নাট্যটিকে এখানে রূপ দেওয়া হয়েছে।
৮) বেতালপঞ্চবিংশতি : অষ্টম সং., কলি. ১৮৬১, ৮, ২১৫ পৃ.।
এই জনপ্রিয় গল্পমালাটি প্রায় ভারতবর্ষের সমস্ত ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে এবং ইতিমধ্যেই এসবের অনেকগুলিতে ছাপাও হয়ে গেছে। প্রথম বাংলা অনুবাদটি বেরিয়েছিল ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে, শ্রীরামপুরে।
৯) বর্ণপরিচয় : দুই খণ্ড, কলি., সম্বৎ ১৯২১, ৮, প্রথম ভাগ: অসংযুক্ত বর্ণ, ২৭তম সং., ৩০ পৃ. দ্বিতীয় ভাগ: সংযুক্ত বর্ণ, ১৮তম সং., ৪০ পৃ.।
এটি একটি বাংলা অক্ষর পরিচয় পুস্তক; ইউরোপীয় আদর্শর হুবহু অনুসরণ। পুস্তিকাটির যে প্রচুর সংখ্যক সংস্করণ হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় এর জনপ্রিয়তা, আর এভাবে শিশুকে বাংলা অক্ষর পরিচয় সহজ পদ্ধতিতে শেখাতে বইটি মস্ত সাহায্য করবে।
১০) আখ্যানমঞ্জরী: দ্বিতীয় সং., কলি., সম্বৎ ১৯২১, ৮, ১১৬ পৃ.।
ইংরিজি থেকে অনুবাদ করা কুড়িটি নীতিশিক্ষামূলক কাহিনির একটি সংকলন এটি।
১১) কথামালা : নবম সং., কলি., ১৮৬৪, ৮, ১০৩ পৃ.।
ঈশপ-এর গল্পগুলির মধ্যে ৬৮টির বাংলা অনুবাদ।
১২) বোধোদয় : ২৪তম সং., কলি., ১৮৬৪, ৮, ৮৪ পৃ.।
রয়েছে জ্ঞানজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ের উপর ছোট ছোট টীকা; যেমন ঈশ্বর, আত্মা, মানবজাতি, ইন্দ্রিয়সকল, ভাষা, কাল ও তার বিভাজন ইত্যাদি।
১৩) জীবনচরিত : চেম্বার-এর শিক্ষাধারা থেকে বাংলায় অনূদিত। ষষ্ঠ সং., কলি., ১৮৬২, ৮, ৯৬ পৃ.।
এখানে আটজন ইউরোপীয় বিখ্যাত পণ্ডিতদের জীবনী দেওয়া আছে, যাঁরা চরম কঠিন পরিস্থিতি থেকে বহু কষ্টসাধ্য শ্রমে জ্ঞানচর্চার জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চতম প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তির নাম, স্থাননামগুলো ইংরিজি উচ্চারণ মোতাবেক এমনভাবে দেওয়া আছে, কিছুটা বিকৃতভাবে, যাতে সেগুলিকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। নামগুলি: বলণ্টিন জামিরে ডুবাল, গ্রোশ্যস, নিকলাস কোপারনিকাস, গালিলিয়, সর আইজাক নিউটন, সর উইলিয়ম হর্শেল, লিনিয়স, সর উইলিয়াম জোন্স, তামস জেঙ্কিন্স।২ শেষে কিছু পারিভাষিক শব্দ দেওয়া আছে, প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে। লেখক বেশ দক্ষতা সহকারে শব্দগুলির সংস্কৃতে অনুবাদ করেছেন : যেমন, উদ্ভিদবিদ্যা, কুলাদর্শ, জাতীয় বিধান, নৈসর্গিক বিধান, ইত্যাদি।
১৪) চরিতাবলী : ৮ম সং., কলি., ১৮৬৪, ৮, ১১২ পৃ.।
উনিশজন ইউরোপীয় পণ্ডিতের জীবনী এখানে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তার বেশিরভাগ বড়ই ছোট আর ভাসা-ভাসা। দু’জন জর্মন পণ্ডিতের কথাও রয়েছে, ‘স্যাকসনি’র ‘শেমনিয়েজ’ থেকে ‘হিন্’— ইনি সেই বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ; আর ‘উইংকিলমান’; এ ছাড়াও রুশ কবি লমনসফ-এরও একটি ছোট জীবনী আছে।
১৫) বাঙ্গালার ইতিহাস : দ্বিতীয় ভাগ, সিরাজউদ্দৌল্লাহর রাজত্বলাভ থেকে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক লাটসাহেবের শাসনান্ত অব্দি। ১২তম সং., কলি., সম্বৎ ১৯২১, ৮, ১৬৩ পৃ.।
বাঙালির ইতিহাসের এই দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্যায়। মিশনারি মার্শম্যান-এর আগে-করা একটি কাজের অনুসরণমাত্র।
১৬) বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব : প্র. কলি., সম্বৎ ১৯১৯, ৮, ২২২ পৃ.।
১৭) ম্যারেজ অব হিন্দু উইডোজ : দ্বিতীয় সং., কলি., ১৮৬৪, ৮, II; এবং ১৩৬ পৃ.।
ভারতে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা এক অস্বাভাবিক প্রথা৩, জন্ম থেকেই, অন্তত খুব ছোট বয়স থেকে, মেয়েরা বাগ্দত্তা হয়ে যায়। বিয়েটা তাই পছন্দাপছন্দ ছাড়াই ঘটে যায়। এই কুৎসিত প্রথার সঙ্গে আরও একটি নিষ্ঠুর প্রথা যুক্ত হয়েছে, একজন বিধবা আর বিয়ে করতে পারবে না। এটা শুধু সেইসমস্ত নারীদের জন্যেই নয় যারা বিবাহ করে ফেলেছে, মায়েরা, যাদের বিবাহমাধ্যমে সন্তান জন্মে গেছে; তাদের জন্যও এই আইন খাটবে। যারা অল্পবয়সে বাগ্দত্তা, বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই যাদের প্রায়শই বাগ্দান হয়ে গিয়ে থাকে। বাগ্দত্ত পুরুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকেও বিবাহ নিষিদ্ধ বিধবাদের শ্রেণিতে ঠেলে দেওয়া হয়। অনন্ত কষ্টকর অস্তিত্ব যাপনে বাধ্য করা হয় এইসমস্ত বিধবাদের। প্রত্যেক কুপ্রথারই থাকে পক্ষপাতী, এবং ভারতীয় আইনে এমন অনেক প্রবচন আছে যেগুলি এসব অস্বাভাবিক প্রথাগুলির সমর্থন বলে মনে হয়। যদিও আজ ইংরাজদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনন্দে আছে রাজনৈতিক স্বাধীনতাপ্রাপ্ত৪ ভারতবর্ষ, ধীরে ধীরে এই কুপ্রথার বিরোধ তৈরি হচ্ছে, এবং মার্জিতসংস্কার পিতাগণ এই নবযুগে মাঝে মাঝেই তাঁদের ইচ্ছুক কন্যাদের বিধবাবিবাহে সম্মতি দিচ্ছেন। প্রাচীন প্রথার অন্ধ অনুগতজনদের শিবিরে যে এ নিয়ে একটা ঝড় উঠবে, সেটা বোধগম্য; এইসব বিধবাবিবাহগুলোকে প্রায় নাস্তিক্যর সমতুল্য এবং শাস্ত্রবিরোধী বলে ব্যাখ্যা করা হল। আমাদের রচয়িতাকে এসবই প্ররোচনা দিয়েছিল তাঁর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে লিখিত পুস্তিকাতে এই মতখণ্ডনে অগ্রসর হতে, এবং তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করলেন যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রবিরোধী নয়। রচনাটি বহুল প্রকাশিত; এবং ইতিমধ্যেই তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে যেটি লেখক আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বিপক্ষীয়রা তাঁর পুস্তিকা সম্বন্ধে একটি কলকাতায় প্রকাশিত ইংরিজি পত্রিকাতে অসূয়াপূর্ণ আলোচনা করলে তিনিও তাঁর লেখাটি ইংরিজিতে প্রকাশ করবার সিদ্ধান্ত নেন। এই ইংরিজি লেখাটি বাংলার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ নয়, বরং শুধু মূল বক্তব্যটি ফের বলা।
পাঠকের উপরে এই বিতর্কমূলক রচনাটির একটি মঙ্গল প্রভাব পড়েছে। জ্ঞানের সর্বশক্তিতে ভরপুর হয়ে তিনি সমস্ত প্রাপ্ত শাস্ত্রবিধি ও অন্যান্য পবিত্রমান্য প্রাসঙ্গিক উৎসগুলি মূলে বা সঠিক অনুবাদে হাজির করলেন এবং সেগুলির প্রাজ্ঞ ব্যাখ্যা উপস্থিত করলেন। অথচ বরাবর তাঁর দেখবার দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিল গোঁড়া ব্রাক্ষণ্যবাদী। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, যে, তাঁর অভাগিনী বিধবাদের প্রতি এতখানি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও, শাস্ত্র যদি কোনও বাস্তব যুক্তি দিয়ে বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে তাঁকে দাঁড় করায়, তিনি পিছপা হবেন না। কিন্তু তা তো নয়, বাজে অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কেবল চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উদ্ধৃত গ্রন্থাংশর বিরোধিতা লেখক যে মূল তর্ক সহায়ে উপস্থিত করেন তা এইরকম: ধর্মশাস্ত্রকে লেখক দু’টি বিরাট ভাগে ভাগ করেছেন। প্রাচীন সত্যযুগাদির সামাজিক অবস্থা সংক্রান্ত একটি ভাগে; অন্যটি কলিযুগের অনুকূল বিধিব্যবস্থাদি। সমকালীন অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে গেলে এই দ্বিতীয়টির দ্বারস্থ হতে হবে। আজকের জন্য অতীতের স্বর্ণযুগের নিয়মাদি খাটে না।
অবশ্য এই ভিত্তিতে যুক্তি দেওয়া আমাদের মনমতন নয়, কিন্তু এক্ষেত্রে যে মানবহিতৈষণার হাতে হাত ধরে ভারতীয় পাণ্ডিত্য এগিয়েছে, এতে আমরা সত্যিই খুশি। লেখকের কাছ থেকে বিদায় নিই এই ভরসায় যে আমাদের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি যতখানি জ্ঞানের অধিকারী ততখানিই উষ্ণ হৃদয়াবেগের। জনগণের উচ্চতম মঙ্গলের জন্য তিনি তাঁর সবটুকু বিলিয়ে দিচ্ছেন। আরও দীর্ঘকাল তিনি তাঁর জাতির আলোকপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কর্ম করতে থাকুন।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
* Hermann Brockhaus (28 Jan 1806 – 5 Jan 1877): কথা-সরিৎসাগর ও হাফেজ এর সম্পাদক। জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যভাষা পড়াতেন।
১. অনুবাদ করে দিয়েছেন অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। Chrestos = useful; matheia = knowledge. ফরাসিরা Anthologie-ই বলেন; কিন্তু ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল ইত্যাদি দেশীয় ভাষায় Chrestomathie-র ঈষৎ বানান বদল করা রূপই প্রচলিত।
২. এরকম উচ্চারণ-বিশুদ্ধির ভূরি ভূরি উদাহরণ সব ভাষাতেই রয়েছে। Bonnerjee, Vivekananda বা Midnapore, Burdwan শব্দগুলোকে কি উচ্চারণ-শুদ্ধ বলা যায়?
৩. Hässlich — ugly শব্দটা Brockhaus-এর।
৪. সিপাহি-বিদ্রোহ-অতিক্রান্ত ভারত সম্পর্কে একটি মারাত্মক উক্তি। — অনুবাদক।
বঙ্গানুবাদ: জয় বন্দ্যোপাধ্যায়