বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত

আগেই বলেছি (বাঙলার মনীষা ও সাহিত্যসাধনা অধ্যায় দ্রষ্টব্য) যে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে চর্যাগানসমূহ। তারপর মুসলমানগণ কর্তৃক বিজিত হবার পূর্বে বাঙলায় নাথধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে। নাথধর্মকে অবলম্বন করে বাঙলায় এক সাহিত্য গড়ে উঠেছিল, যাকে আমরা ‘নাথসাহিত্য’ বলি। এই সাহিত্যের উপজীব্য হচ্ছে দুটি কাহিনী, একটি গুরু মীননাথ ও তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথকে নিয়ে। অপরটি রাজা মানিকচন্দ্র তাঁর স্ত্রী ময়নামতী ও পুত্র গোপীচাঁদকে নিয়ে। নাথ সম্পদ্রায়ের আরাধ্য দেবতা হচ্ছেন মহাদেব। যোগের সাহায্যে জীবন্মুক্তি, অসাধ্য সাধন ও মৃত্যুর ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করা ইত্যাদি ওঁদের লক্ষ্য বলে নাথ সম্প্রদায় শৈব যোগী সম্প্রদায়রূপে আখ্যাত। এই ধর্মটি একসময় অখিল ভারতীয় ধর্মে পরিণত হয়েছিল এবং কেবল বাংলা ভাষাতে নয়, নাথধর্মের উপাখ্যানগুলি নিয়ে মারাঠী, গুজরাতী, পাঞ্জাবী, সিংহলী প্রভৃতি নানা ভাষায় নানা সাহিত্য গড়ে উঠেছিল। চর্যাগীতের মতো এঁদের সাহিত্যে ও গূঢ় সাধনতত্ত্ব হেঁয়ালি ভাষায় রচিত। যথা, গোপীচন্দ্ৰ সন্ধিগ্ধমনা হয়ে মাতা ময়নামতীকে জিজ্ঞাসা করেছেন—কোন বিরিখির বোঁটা আমি মা কোন্ বিরিখের ফল। মা, উত্তর দিতেছেন—”মন বিরিখের বোঁটা তুই তনু, বিরিখের ফল ॥ গাছের নাম মনুহর, ফলের নাম রসিয়া। গাছের ফল গাছে থাকে, বোঁটা পড়ে খসিয়া ॥ কাটিলে বাঁচে গাছ, না কাটিলে মরে। দুই বিরিখের একটি ফল জাননি সে ধরে ॥ এটা ‘ময়নামতীর গান’ থেকে উদ্ধৃত। দ্বিতীয় কাহিনীটি ‘ময়নামতির গান ছাড়া, মানিকচন্দ্র রাজার গান’ ‘গোপীচন্দ্র রাজার গান’ ‘গোবিন্দচন্দ্রের সন্ন্যাস’ ইত্যাদি নানা নামে মৌখিক ও লিখিতরূপে পাওয়া গিয়েছে। কাহিনীটি প্রথম একখানি প্রাচীন পুঁথি থেকে সংকলন করে নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় ‘মীনচেতন’ নামে প্রকাশ করেন। তারপর একাধিক পুঁথি তুলনা করে মুন্সী আবদুল করিম ‘গোরক্ষবিজয়’ নামে প্রকাশ করেন। আরও অধিকসংখ্যক পুঁথির সাহায্যে বিশ্বভারতী থেকে পঞ্চানন মণ্ডল ‘গোর্খবিজয়’ নামে প্রকাশ করেন। পুঁথিগুলিতে নানারকম ভণিতা আছে, যথা, ভীমদাস বা ভীমসেন রায়, শ্যামদাস সেন, ভবানীদাস, ফয়জুল্লা ও সুকুমার মামুদ। দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বা তার কাছাকাছি কোন সময় নাথধর্মের উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। তবে কাহিনীগুলি প্রথমে মৌখিক আকারে ছিল, পরে লিখিতরূপ ধারণ করেছিল, কেননা যে সকল পুঁথি পাওয়া গিয়েছে, সেগুলি সবই তিনশোর বছরের অধিক পুরানো নয়। এখানে উল্লেখনীয় যে বাংলা ভাষার প্রাচীন রূপের এক নিদর্শন রয়েছে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত ‘শেষ শুভোদয়া’ গ্রন্থের এক প্রেমগীতিতে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে এই প্রেমগীতিটি দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল। ‘শেখ শুভোদয়া’য় বিবৃত হয়েছে রামপালের মৃত্যু ও বিজয়সেনের রাজ্যপ্রাপ্তি।

দুই

বাঙলার আদি কবি চণ্ডীদাস (১৪১৭-৭৭)। পদাবলী সাহিত্যের তিনিই প্রবর্তক। রাধা ও কৃষ্ণের মিলনের মাধ্যমে ‘সহজ’ সাধনার উদ্বোধন করাই পদাবলী সাহিত্যের উদ্দেশ্য ছিল। ‘পদাবলী’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীতে জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে (১/৩) যদিও পদাবলী বলতে সাধারণত শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্যের লীলাবিষয়ক গীত বুঝায়। দাক্ষিণাত্যে ও মিথিলায় শিবকে নিয়ে ও বাঙলায় উমাকে নিয়েও কিছু পদ রচিত হয়েছিল। এ সাহিত্যের ভাষা অতি সরল। যেমন, চন্ডীদাসের এক পদগীত আরম্ভ হচ্ছে- ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম। কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্রাণ।’ আর একজন পদকর্তার রচনায় পাই-’ওপার হতে বাজাও বাঁশি এপার হতে শুনি। অভাগিয়া নারী আমি সাঁতার নাহি জানি।

নিজের মন-মন্দিরে চন্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের যে শাশ্বত প্রেমলীলা অনুভব করেছিলেন, তাই গভীর ভাবানুভূতির সঙ্গে অভিব্যক্ত করেছেন তাঁর রচিত পদসমূহে। চন্ডীদাসের এই গভীর অনুভূতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—’ঠাকুর ঠাকুর কর তুমি, ঠাকুর কোথা পাবে। দিলদরিয়ার কপাট খোল ঠাকুর দেখতে পাবে’। বস্তুত চণ্ডীদাসের কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কৃষ্ণপ্রেমে উন্মদিনী রাধার হৃদয়-আর্তির সকরুণ কাহিনী।

আগেই বলেছি যে চণ্ডীদাস ছিলেন সহজ-সাধনার কবি। কথিত আছে তিনি রামী নামে একজন রজকিনীর সঙ্গে এই সহজ-সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। ‘রজকিনী ‘ শব্দটা ‘ধোবানী’ অর্থেই সকলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় এর অর্থ অন্য। সহজ-সাধনা যে তান্ত্রিক সাধনরাই একটা বিশেষরূপ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাধা ছিল ‘যোগিনীপারা’। সেজন্য আমার মনে হয় যে ‘রজকিনী’ শব্দটা তান্ত্রিক সাধকদের অর্থে গ্রহণ করা অন্যায় হবে না। রেবতীতন্ত্রে ‘চণ্ডালী,’ ‘যবনী’, ‘বৌদ্ধা,’ ‘রজকী’ প্রভৃতি চৌষট্টি প্রকার কুলস্ত্রীর বিবরণ আছে। নিরুত্তরতন্ত্রকার বলেন, ওই সকল চণ্ডালী, রজকী প্রভৃতি শব্দ বর্ণ বা বর্ণসঙ্করবোধক নয়, কার্য বা গুণের বিজ্ঞাপন। বিশেষ বিশেষ কার্যের অনুষ্ঠান করলে সকল বর্ণোদ্ভবা কন্যাই ওই সমস্ত আখ্যা প্রাপ্ত হয়। যেমন, পূজাদ্রব্যং সমালোক্য রজোহবস্থা প্রকাশয়েত। সর্ববর্ণোদ্ভবা রম্যা রজকী সা প্রকীর্তিতা। মানে পূজাদ্রব্য দেখে যে কোন বর্ণোদ্ভবা কন্যা রজোহবস্থা প্রকাশ করে, তাকে রজকী বলে এখানে উল্লেখযোগ্য যে চন্ডীদাস বাশুলীদেবীর সেবক ছিলেন। বাশুলী বা বিশালাক্ষী চৌষট্টি যোগিনীর অন্যতমা। রামী সম্বন্ধে আমি যে প্রশ্ন এখানে তুলেছি, আমার মনে হয় বাঙলা সাহিত্য নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন, তাঁদের এটা গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে।

বস্তুত চণ্ডীদাস সম্বন্ধে আমাদের কাছে অনেক কিছু অজ্ঞাত থেকে গিয়েছে। তার কারণ, চণ্ডীদাসকে আমরা বিশেষভাবে জেনেছি মাত্র একশো বছরের কিছু আগে। চণ্ডীদাসের কথা আমাদের প্রথম শোনান রাজেন্দ্রলাল মিত্র তাঁর ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-এ একটি প্রবন্ধে বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় সম্পর্কে। তারপর জগদ্বন্ধু ভদ্র বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশ করে চণ্ডীদাস ও অন্যান্য বৈষ্ণব কবিদের রচিত পদাবলিগুলি আমাদের নজরে আনেন। এর কিছু পরে অক্ষয়চন্দ্র সরকার চন্ডীদাসের সঙ্গে বাঙালী পাঠককে পরিচিত করিয়ে দেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নীলরতন মুখোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত ‘চণ্ডীদাস পদাবলী’র একটা সংস্করণ বের করে। বটতলার প্রকাশন সংস্থাসমূহ থেকেও ‘চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি, পদাবলী’র এক সংস্করণ বেরোয়।

চন্ডীদাসের নামে যে সকল পদাবলী পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে নানা রকম ভণিতা দেখতে পাওয়া যায়। যথা ‘চণ্ডীদাস’ বড়ু চণ্ডীদাস’ ‘দ্বিজ চন্ডীদাস’ ‘দীন চন্ডীদাস’ প্রভৃতি। সুতরাং স্বভাবতেই মনে হয় যে, একাধিক চণ্ডীদাস ছিলেন। তার মধ্যে বড়ু চণ্ডীদাস (চতুর্দশ শতাব্দী) রচিত একখানা গ্রন্থের পুঁথি বসন্তরঞ্জন রায় মহাশয় বাঁকুড়া থেকে আবিষ্কার করে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নাম দিয়ে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশ করেন। এর প্রকাশক হচ্ছে বঙ্গীয়-সাহিত্য- পরিষদ। কিন্তু এই বড়ু চণ্ডীদাস কে? এ সমস্যা আজও মীমাংসিত হয়নি। কেননা, এর পুঁথিতে ‘বড়ু চণ্ডীদাস’ ভণিতা ছাড়া, বার পাঁচেক ‘অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস’ ভণিতাও আছে। তবে পদাবলী রচয়িতা চণ্ডীদাসের ভাষার সঙ্গে বড়ু চণ্ডীদাসের ভাষার প্রভেদ আছে। বড়ু চণ্ডীদাসের ভাষায় নমুনা-’মূছিআঁ পেলায়িবোঁ বড়াই শিবের সিঁদুর।। বাহুর বলায় মোর করিবো শঙ্খচুর ॥ কাহ্ন বিনা সবখন পোড়এ পরানী। বিষাইল কাণ্ডের ঘাএ যেহেন হরিণী। বিদ্যাপতি (১৩৬০-১৪৮০) মূলত মৈথিলী কবি ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলি মৈথিলী ভাষাতেই রচিত। তবে দু-একটি পদ বাংলা থেকে তফাত নয়। যেমন, ‘বালা রমণী রমণে নাহি সুখ। মদন দ্বিগুণ দেয় দুখ ॥’

চৈতন্য পূর্বযুগের পদাবলীর মধ্যে আমরা সাধারণত দুটি ধারা দেখতে পাই। একটি বিদ্যাপতির, অপরটি চন্ডীদাসের। বিদ্যাপতির পদ অলংকারসমৃদ্ধ, আর চণ্ডীদাসের সহজও সরল এবং অলংকারবর্জিত। বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের বৃহত্তম সংকলন হচ্ছে গোকুলানন্দ সেনের ‘পদকল্পতরু’। চৈতন্যের সমসাময়িক পদকর্তা হিসাবে নাম করে ছিলেন নরহরি সরকার, গোবিন্দ আচার্য, মুরারি গুপ্ত বলরাম দাস, বংশীবদন, গোবিন্দমাধব, বাসুদেব ঘোষ ও রামানন্দ বসু। চৈতন্য-উত্তর, যুগে পদকর্তা হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন জ্ঞানদাস, রায়শেখর, লোচন দাস, গোবিন্দ দাস, কবিরাজ, নরোত্তম ঠাকুর ও বলরাম দাস। অনেক মুসলমান কবিও পদাবলী রচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীর পরিবর্তে শাক্ত পদাবলীরই প্রাধান্য দেখি।

বৈষ্ণব সাহিত্য বিশেষভাবে পুষ্ট হয় চৈতন্যেত্তর যুগে। শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩) নিজে কোন সাহিত্য রচনা করেননি। কিন্তু তাঁর তিরোভাবের পর তাঁর মহিমাময় জীবন অবলম্বনে এক জীবনী-সাহিত্য রচিত হয়। মহাপ্রভুর দৈবী মহিমাই এই সকল জীবনী-কাব্যে বিবৃত হয়েছে। এই জীবনী-কাব্যের মধ্যে প্রাধান্য হচ্ছে বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ বা ‘চৈতন্যভাগবত’ ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের (১৫৩০-১৬১৫) ‘চৈতন্যচরিতামৃত’। এ দুটি রচিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে। এ ছাড়া, আর একখানা সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে গোবিন্দদাসের ‘কড়চা’ আরও যাঁরা বৈষ্ণব সাহিত্য রচনায় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মুরারি গুপ্ত, পরামনন্দ সেন, লোচনদাস, জয়ানন্দ মিশ্র, হরিচরণ দাস, ঈশান নাগর প্রমুখ। এ ছাড়া বৈষ্ণব মহাজন পদাবলী রচনায় যাঁরা খ্যাতিলাভ করেছিলেন, তাঁদের নাম আগেই দিয়েছি।

সপ্তদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব পদাবলীর প্রাচুর্য থাকলেও (এ সময় অনেক মুসলমান পদকর্তারও প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল) মনে হয় চৈতন্যের ভাবপ্রেরণা কিছু হ্রাস পেয়েছিল, কেননা, সূফী ধর্মের সহিত সহজিয়া ধর্মের কিছু মিল থাকায় লৌকিক স্তরে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম-সাধনার কতকটা সমন্বয় হয়েছিল ও তা সাহিত্যে প্রকাশ পেয়েছিল বাউলসম্প্রদায়ের গানে।

তিন

মুসলমানগণ কর্তৃক বাঙলা বিজিত হবার পর, বাঙলাদেশ সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চা বিপর্যস্ত হয়। অন্তত উচ্চকোটি সমাজে আমরা এ সম্বন্ধে এক শূন্যময় পরিস্থিতি লক্ষ্য করি। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এর কোন ছেদ পড়েনি। গ্রামে যে সকল লৌকিক দেবদেবীর প্রভাব ছিল, তাঁদের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে পালাগান গাইবার জন্য মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত হয়েছিল। এই পালাগানসমূহকে ‘পাঁচালী’ বা পাঞ্চালিকা বলা হত, এবং সেগুলি রাতের পর রাত নাচ ও বাজনার সঙ্গে গাওয়া হত।

মঙ্গলকাব্যসমূহ বিশেষভাবে রচিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে, যখন বাঙলাদেশে স্বাধীন সুলতানদের আমলে দেশে আবার শান্তি সমৃদ্ধি ফিরে আসে। তখন হিন্দু জায়গিরদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙলাদেশে আবার কাব্যচর্চার সূত্রপাত হয় ও মঙ্গলকাব্যসমূহ রচিত হতে থাকে, যথা—মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল ইত্যাদি। মনসামঙ্গলের উদ্দেশ্য ছিল মনসা বা সর্পদেবীর পূজা মাহাত্ম্য প্রচার করা। কাহিনীর নায়ক- নায়িকা ছিল চাঁদ সদাগর ও তাঁর পুত্র লখীন্দর ও পুত্রবধূ বেহুলা। শতাধিক কবি মনসামঙ্গল রচনা করে গিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হচ্ছেন প্রাক্-চৈতন্যযুগে হরিদত্ত, বিজয়গুপ্ত (১৪০৬-৪৮), বিপ্রদাস (১৪১৭- ৯৫) ও নারায়ণদেব এবং চৈতন্যোত্তর যুগে কেতকাদাস, ক্ষেমানন্দ, দ্বিজ বংশীদাস, জীবন মৈত্র প্রভৃতি। মনসামঙ্গলের ভাষা খুব সরল, যথা—’জাগ ওহে বেহুলা সায় বেনের ঝি। তোর পাইল কালনিদ্রা মোরে খাইল কি মনসামঙ্গলে যেমন একটি কাহিনী আছে, চণ্ডীমঙ্গলে আছে দুটি কাহিনী। একটি ব্যাধ কালকেতু-লহনা খুল্লনা ও আর একটি ধনপতি সদাগর শ্রীমন্ত সদাগর সম্পর্কিত।

চণ্ডীমঙ্গলের কবিদের মধো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মানিক, দত্ত, দ্বিজ মাধব ও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী। মুকুন্দরামের ভাষার নমুনা-’সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙা পিতল। ঘসিয়া মাজিয়া বাপা করেছ উজ্জ্বল ॥’

মুকুন্দরামকেই অনুসরণ করে অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় রচনা করেছিলেন তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। শ্রুতিমধুর শব্দের জন্য এখানা ছিল শব্দের ‘তাজমহল’। ওই অষ্টাদশ শতাব্দীতেই মেদিনীপুর কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্ত সিংহের সভাকবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য রচনা করেছিলেন তাঁর ‘শিবায়ন’ কাব্য। শিবায়ন কাব্যে শিবকে সাধারণ কৃষক ও শিবজায়াকে কৃষকপত্নী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁদের প্রতিবেশির নিকট ঋণ করে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু ঋণের কি মর্মান্তিক বেদনা, তা কবি বর্ণনা করে বলেছেন—’গতে ঋণে বিষয়ে কুক্কুর-রতিবশে। প্রবেশে পরম সুখ প্রাণ যায় শেষে।

মঙ্গলকাব্যসমূহের একটা বড় শাখা হচ্ছে ধর্মমঙ্গল। ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য অবলম্বন করে এগুলি রচিত। কিন্তু এর কাহিনী একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে ধর্মমঙ্গল কাব্যসমূহে ডোম জাতীয় নরনারীর বীরত্ব কীর্তিত হয়েছে। ময়ূরভট্টকেই ধর্মমঙ্গলের আদিকবি বলা হয়। অবশ্য তাঁর পূর্বে রামাই পণ্ডিত ‘শূন্যপুরাণ’ রচনা করেছিলেন। ময়ূরভট্টের ভাষার নমুনা – ‘স্বামী মৈল সংগ্রামে সংসার ভাবি বৃথা। চিতানলে ছয় বধূ হৈল অনুমৃতা।। পুত্রশোকে মৈল রাণী ভখিয়া গরল। সর্বশোকে কর্ণসেন হইল পাগল ॥ আর যাঁরা ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেছিল তাঁদের মধ্যে সহদেব চক্রবর্তী, রূপরাম চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তী।

লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তনের জন্য আরও যেসব মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কালিমামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দর কাব্য, শীতলামঙ্গল, যষ্ঠীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, রায়মঙ্গল, সূর্যমঙ্গল গঙ্গামঙ্গল, কপিলামঙ্গল প্রভৃতি। কালিকামঙ্গল বা বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী অলম্বন করেই ভারতচন্দ্র তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। অন্নদা ছিল রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের গৃহদেবতা।

চার

মঙ্গলকাব্য, ছাড়া, মধ্যযুগের পুরাণ ও মহাকাব্যসমূহকে অবলম্বন করেও কাব্য রচনা হয়েছিল। এই যুগেই রচিত হয়েছিল অনন্ত ও কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। সুলতান হুসেন শাহের অধীনে চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খাঁর আদেশে পরমেশ্বর দাস কর্তৃক রচিত হয়েছিল ‘পাণ্ডববিজয়’ নামে মহাভারতের একটি কাব্যানুবাদ। পরাগলের পুত্র ছুটি খাঁর আদেশে শ্রীকর নন্দী অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের ‘অশ্বমেধ পর্ব।। বস্তুতঃ এ যুগের অনেক মুসলমান শাসনকর্তাই উৎসাহিত করেছিলেন অনুবাদ কাব্য রচনায়, বহু বাঙালি কবিকে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা, অর্থ ও ভূমিদান ও রাজকীয় উপাধি দিয়ে। বলাবাহুল্য এই সকল অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে হিন্দুসমাজের সংস্কৃতি ও আদর্শ আবার সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। সেটা প্রকাশ পায় রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদ প্রাচুর্য থেকে। অনন্তই প্রথম রামায়ণ অনুবাদ করেন। তারপর করেন কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাস ছাড়া ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্থে রামায়ণ রচনা করেছিলেন মহিলা কবি চন্দ্রাবতী। ইনি, ‘মনসার ভাসান’ রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। তাঁর বংশে-পরিচয়ে তিনি বলেছেন—’বিধিমতে প্ৰণাম করি সকলের পায়। পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ণ গায় ॥ সুলোচনা মাতা বন্দি দ্বিজবংশী পিতা। যার কাছে শুনিয়াছি পুরাণের কথা ॥’ চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কাব্যের গানগুলি আজও মৈমনসিংহ জেলার মেয়েরা বিবাহ, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি সামাজিক উৎসবে গেয়ে থাকে। পরবর্তী রামায়ণকারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রঘুনন্দন গোস্বামী, কৈলাস বসু, রামশঙ্কর দত্ত, ভবানী দাস, দ্বিজ লক্ষ্মণ, শঙ্কর চক্রবর্তী, দ্বিজ ভবানীনাথ, রামানন্দ ঘোষ, রামপ্রসাদ রায় প্রভৃতি কবিগণ।

কাশীরামের সুবিখ্যাত ‘মহাভারত’ রচিত হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। কথিত আছে যে, কাশীরাম কাব্যখানিকে সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি এবং এটাকে সম্পূর্ণ করেছিলেন তাঁর সম্পর্কিত ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম ঘোষ। আরও যাঁরা এসময় মহাভারতে অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, যষ্ঠীধর সেন, নিত্যানন্দ ঘোষ, গঙ্গাদাস ও রামেন্দ্রদাস। এছাড়া, শ্রীমদ্‌ভাগবত, ব্ৰহ্ম- বৈবর্তপুরাণ, কাশীখণ্ড, হরিবংশ প্রভৃতি অনেক গ্রন্থেরই বাংলায় অনুবাদ হয়েছিল।

পাঁচ

বাংলা সাহিত্যের একটা বিশিষ্ট শাখা হচ্ছে শাক্ত পদাবলী। এর উদ্ভব ও বিকাশ অষ্টাদশ শতাব্দীতে হয়েছিল। শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ কবি হচ্ছে রামপ্রসাদ সেন। তাঁর সঙ্গীতের অনেক জায়গায় তিনি পরিবেশক রূপক ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘মাগো তারা ও শংকরী, কোন বিচারে আমার পরে করলে দুঃখের ডিক্রীজারী। এক আসামী ছয়টা প্যাদা বল্ মা কিসে সামাই করি, আমার ইচ্ছে করে ওই ছয়টাকে বিষ খাইয়ে প্রাণে মারি। পলাইতে স্থান নাই মাগো বল মা কিসে উপায় করি। ছিল স্থানের মধ্যে অভয়চরণ তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি।’ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি যে-সকল শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন, তা আজও অমর হয়ে আছে। আর যেসব শাক্ত কবির উদ্ভব ঘটেছিল তাঁরা হচ্ছেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, পাঁচালীকার দাশু রায় ও কবিওয়ালা রাম বসু, মিরজা হুসেন, এন্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা প্রমুখ। এন্টনি ফিরিঙ্গির এক বিখ্যাত গান — ‘আমি ভজন-সাধন জানিনে মা, নিজে তো ফিরিঙ্গি। যদি দয়া করে কৃপা কর হে শিবে মাতঙ্গী।’

বাঙালীর স্বভাবের কমনীয়তা, রস ও সৌন্দর্যবোধ ও মাধুর্য বাঙালীকে কাব্যের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সেজন্য উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত বাঙালী গদ্য সাহিত্য রচনা করেনি। গদ্যের ব্যবহার মাত্র চিঠিপত্র ও দলিলাদি সম্পাদনের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল। গদ্যসাহিত্যের অভ্যুত্থান ঘটে উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে, যদিও অষ্টাদশ শতাব্দীর দু-একখানা গদ্যগ্রন্থ পাওয়া গিয়েছে। তখন থেকেই গদ্য বাংলা সাহিত্যে এক বিরাট ভূমিকা গ্রহণ করে।

ছয়

আগেই বলেছি যে মধ্যযুগের বাংলা গণ-সাহিত্যের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল মঙ্গলকাব্যসমূহ। মঙ্গলকাব্যসমূহ এক একটা কাহিনী অবলম্বনে রচিত— কেবল চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে দুটি আখ্যান ছিল। মঙ্গলকাব্যের কাহিনীগুলির নায়ক- নায়িকারা হচ্ছে ইছাই ঘোষ ও লাউসেন, রানী ময়নামতীও তাঁর ছেলে রাজা গোবিন্দচন্দ্র, ব্যাধ কালকেতু ও তাঁর স্ত্রী খুল্লনা, চাঁদ সওদাগর ও তাঁর পুত্র লখীন্দর ও পুত্রবধূ বেহুলা, ধনপতি সদাগর ও তার পুত্র শ্রীমন্ত সদাগর। এ কাহিনীগুলি হয়তো অনেকেরই জানা নেই। সেজন্য, সংক্ষেপে কাহিনীগুলি এখানে বিবৃত করছি।

প্রথমেই ইছাই ঘোষ ও লাউসেনের কথা বলব। এই কাহিনী নিয়েই ধর্মমঙ্গল সাহিত্য রচিত। ইছাই ঘোষ ছিলেন অজয় নদ তীরবর্তী ত্রিষষ্ঠীগড়ের সামন্তরাজ সোম ঘোষের পুত্র। তাঁর আরাধ্যা দেবী ছিলেন শ্যামরূপা। আরাধ্যা দেবীকে সন্তুষ্ট করে ইছাই ঘোষ প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেন। অজয়ের দক্ষিণ তীরে বন কেটে তিনি ঢেকুর নামে এক নূতন গড় নির্মাণ করেন। এই গড়ের মধ্যে তিনি এক দেউল নির্মাণ করে, নিজ আরাধ্যা দেবী শ্যামরূপার এক কনক মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। গৌড়েশ্বর পালরাজ কিছুকাল সোম ঘোষকে বন্দি করে রেখেছিলেন। ইছাই পিতার এই লাঞ্ছনার কথা ভুলতে পারেননি। পালরাজের অনুচর ঢেকুরে কর আদায় করতে এলে, ইছাইয়ের হাতে লাঞ্ছিত হয়। ইছাইকে দমন করবার জন্য গৌড়েশ্বর নিজ শ্যালক মহামদকে পাঠিয়ে দেন। যুদ্ধে ঢেকুরে অবস্থিত কর্ণসেন নামে এক সামন্তরাজের ছয় পুত্র নিহত হয়। কর্ণসেনের রানী শোকে প্রাণত্যাগ করেন। কর্ণসেন গৌড়ের রাজা শরণাপন্ন হন। মহামদের অনুপস্থিতিতে গৌড়েশ্বর, মহামদের অপর এক ভগিনী রঞ্জাবতীর সঙ্গে কর্ণসেনের বিবাহ দেন। মহামদ এতে চটে যান। রঞ্জাবতীর কোনদিন সন্তান হয়নি। তারপর ধর্মঠাকুরকে তপস্যায় তুষ্ট করে, তিনি লাউসেন নামে এক শক্তিশালী পুত্র পান। মহামদ গোড়া থেকেই ভাগিনেয় লাউসেনকে মারবার চেষ্টা করে। কিন্তু বিফল হয়ে অবশেষে তাকে কামরূপ রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করবার জন্য পাঠিয়ে দেন। মহামদ ভাবেন যে লাউসেন নিশ্চয়ই যুদ্ধে নিহত হবে। কিন্তু ধর্মঠাকুরের বরে লাউসেন কালু ডোম নামে এক শক্তিশালী অনুচর পায়। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে, ফেরবার পথে লাউসেন মঙ্গলকোটে বর্ধমানে রাজকন্যা অমলা ও বিমলাকে বিবাহ করে। তার আগে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে কামরূপ রাজার মেয়ে কলিঙ্গাকে বিবাহ করেছিল। তিন রানী নিয়ে লাউসেন ফিরে আসে। মহামদ তখন তাঁকে ঢেকুরে ইছাই ঘোষের সঙ্গে লড়াই করতে পাঠিয়ে দেয়। অনেক যুদ্ধ ও ছলচাতুরীর পর লাউসেন ইছাইয়ের শিরশ্ছেদন করে।

এবার ময়নামতীর কাহিনী শুনুন। ময়নামতী ছিল অতি ধার্মিক রাজা মানিকচন্দ্রের রানী। তাঁর দেওয়ানের অত্যাচারের বিক্ষুব্ধ প্রজারা রাজার মৃত্যুকামনা করে ধর্মনিরঞ্জনের পূজা দেয়। রাজার মৃত্যু ঘটে। যমদূতেরা তাঁর প্রাণ নিয়ে যমপুরী রওনা হলে, রানী ময়নামতী তার পশ্চাদ্ধাবন করে যমপুরীতে প্রবেশ করে সকলকে ত্রস্ত করে তোলে। অবশেষে গুরু গোরখনাথের মধ্যস্থতায় স্থির হয় মৃত রাজার প্রাণ আর ফিরিয়ে দেওয়া হবে না; তবে ময়নামতী একটি পুত্র লাভ করবেন। মানিকচন্দ্রকে দাহ করবার সময়, রানী ময়নামতী সহমরণে যান। কিন্তু আগুন তাঁর দেহ দগ্ধ হল না। রানী গোবিন্দচন্দ্ৰ বা গোপীচাঁদ নামে এক পুত্র লাভ করেন। গোপীচাঁদ বড় হয়ে হরিশ্চন্দ্র রাজার মেয়ে অদুনাকে বিয়ে করে তার অনুজা পদুনাক্ষে যৌতুকস্বরূক পান। ময়নামতী দিব্যজ্ঞানে জানলেন যে, হাড়ি-সিদ্ধার শিষ্য হয়ে, সন্ন্যাস গ্রহণ না করলে ১৮ বছর বয়স গোপীচাঁদের মৃত্যু হবে। রাজা সন্ন্যাস গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন; যুবতী রানীরাও বাধা দিল। পরে গোপীচাঁদ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। ১২ বছর পরে দেশে ফিরে এসে তিনি সুখে জীবনযাপন করতে থাকেন।

মনসামঙ্গলের কাহিনী হচ্ছে চম্পকনগরের চাঁদ সদাগরের কনিষ্ঠ পুত্র লখীন্দর ও তাঁর পত্নী বেহুলাকে নিয়ে রচিত। মনসার কোপে বিয়ের রাত্রে সর্পদংশনে লখীন্দরের মৃত্যু হয়। পতিপ্রাণা বেহুলা একটি কলার ভেলায় করে লখীন্দরের মৃতদেহ নিয়ে দেবপুরের উদ্দেশ্যে অপরিচিত পথে যাত্রা করেন। অনেক বাধাবিঘ্ন বিপদ-আপদ অতিক্রম করে দেবপুরের ধোবানী নেতার সহায়তায় গন্তব্যস্থানে পৌঁছান।

সেখানে নৃত্যগীতে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে, তিনি লখীন্দরের পুনর্জীবন লাভ করেন। কৌশলে বেহুলা মনসার কোপে নিহত চাঁদ সদাগরের আরও ছয় মৃত পুত্রের জীবন ও নৌকাডুবিতে সমুদ্রতলাশায়ী ধনরত্ন সব উদ্ধার করে চাঁদ সদাগরের কাছে ফিরে আসেন। শিবভক্ত চাঁদ মনসার পূজা করতে অস্বীকার করেন, কিন্তু অনেক অনুনয়-বিনয় ও কান্নাকাটি করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বেহুলা চাঁদকে দিয়ে মনসার পূজা করান।

চণ্ডীমঙ্গল ও কাব্যসমূহে দুটি আখ্যান বিবৃত হয়েছে। একটি বণিক ধনপতি সম্পর্কে ও অপরটি কালকেতু সম্পর্কে। এই দুটি কাহিনীই আমরা আগের এক অধ্যায়ে দিয়েছি। সুতরাং এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করব না।

যোষিগণ কর্তৃক পূজিতা এই সকর নারীদেবতা সম্পর্কিত কাহিনী বাঙলার অলিখিত জাতীয় সাহিত্যমানসে সজীব ছিল। এগুলিকেই অবলম্বনে করে মধ্যযুগের বাঙলায় এক বিরাট গণ-সাহিত্য গড়ে উঠেছিল।

সাত

মধ্যযুগে অনেক মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সকল মুসলমান কবিরা হিন্দু দেবদেবীর মাহাত্ম্য, রাধাকৃষ্ণের পদাবলী, নরনারীর প্রণয়কাহিনী ও নীতিমূলক অনেক বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের কাব্যসমূহ রচনা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে আরাকান রাজসভার কবি দৌলত কাজীই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হচ্ছে ‘সতী ময়নামতী’ বা লোরচন্দ্রাণী’। এই কাব্যে তিনি দেবদেবীর মাহাত্ম্যের পরিবর্তে বাস্তব জগতের নরনারীর প্রণয়কথা ও সুখ-দুঃখের চিত্র অঙ্কিত করে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভগ্ন করেছিলেন। মিয়া সাধন নামক হিন্দী কবি রচিত ‘ময়নাকো সত’ নামক কাব্যের কাহিনী অনুসরণে রচিত হলেও দৌলত কাজী তাঁর কাব্যের অসাধারণ কবিত্বপ্রতিভা ও মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আরাকান রাজ্যের অপর কবি সৈয়দ আলাওলও একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্যসমূহের মধ্যে ‘সয়ফুলমূলক্ বদিউজ্জমাল, ‘হপ্তপয়কর’ ‘তোহফা’ ইসলামধর্মী গ্রন্থ। কিন্তু যে কাব্যটির জন্য তিনি বাঙালী হিন্দুসমাজে প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন, সেটি হচ্ছে ‘পদ্মাবতী’। এটি ইতিহাস আশ্রিত এক রোমান্টিক প্রেমকাহিনী। মধ্যযুগের সাহিত্যে কাব্যটি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘সতী ময়নামতী’ ও পদ্মাবতী’—এই দুই কাব্যের মানুষের প্রেম, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয়েছে অপূর্ব ছন্দ ও ভাষায়। দৌলত কাজী কোন কোন জায়গায় ব্রজবুলিরও সার্থক ব্যবহার করেছেন। যথা ‘শাঙন গগন সঘন ঝরে নীর। /তবু মোর না জুরয়ে এ তাপ শরীর।/ মদন অধিক জিনি বিজুরীর রেহা।/ থরকএ যামিনী কম্পায় মোর দেহা ॥’ দৌলত কাজী ও আলাওল দুজনেই সপ্তদশ শতাব্দীর লোক। আগেই বলেছি যে পদাবলী সাহিত্য রচনাতেও মুসলমান কবিরা অসাধারণ অনুভূতি ও নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন। ন্যূনপক্ষে ১২১ জন মুসলমান পদকর্তার নাম আমরা জানি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *