বাংলা মহাভারতের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ

বাংলা মহাভারতের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ

মধ্যযুগের অন্যান্য বাংলা অনুবাদকাব্যের মতো মহাভারতের বঙ্গানুবাদ ও তুর্কি আগমনের পর সূচিত হয়েছিল। তবে প্রথম অনুবাদক কে ও তাঁর আবির্ভাবকাল কখন পন্ডিতদের মধ্যে তা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। প্রাচীনতর অনুবাদকদের মধ্যে সঞ্জয়, কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দীর নাম সাহিত্যের ইতিহাসে পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরও কয়েকজন কবি মহাভারত অনুবাদে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে এঁদের কেউই মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেননি। দ্বিজ অভিরাম, দ্বিজ কৃষ্ণরাম, দ্বিজ রঘুনাথ অশ্বমেধপর্বের অনুবাদ করেছিলেন। দ্রোণপর্বের অনুবাদ নন্দরাম দাস, দ্বৈপায়ন দাস, গোপীনাথ দত্ত প্রমুখ। নিত্যানন্দ ঘোষ একাই অনেকগুলি পর্বের অনুবাদ করেছিলেন। তবে এঁদের রচনা পাঠক বা শ্রোতার মনে তেমন রেখাপাত করেনি। সেদিক থেকে সপ্তদশ শতকের কবি কাশীরাম দাশ বিশেষভাবে স্মরণীয়। তবে কাশীরামও মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করতে পারেননি। মহাভারতের কোনো কোনো পুথিতে নিম্নলিখিত শ্লোক পাওয়া যায় :

আদি সভা বন বিরাটের কত দূর।
ইহা লিখি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।

অন্যান্য তথ্যের সূত্রে জানা যায় কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম, পুত্র ঘনশ্যাম ও জামাতা জিৎ মিলিতভাবে অষ্টাদশ পর্বের মহাভারতের অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এই পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ একাধিক ব্যক্তির যৌথ রচনা হলেও সাধারণভাবে কাব্যটি ‘কাশীদাসী মহাভারত’ নামে পরিচিত। কাব্যের নাম ‘ভারত পাঞ্চালী’। কাশীরামের নামাঙ্কিত পুথির সূত্রে জানা যায় কবি ষোড়শ শতকের শেষে ও সপ্তদশ শতকের গোড়ায় কাব্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন। কাশীরাম বাংলা মহাভারতের সম্পূর্ণ রচয়িতা না হলেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল সর্বব্যাপী। এই সর্বব্যাপিতার ঐতিহ্য স্মরণ করেই মধুসূদন দত্ত কাশীরামকে ভগীরথের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ভগীরথ যেমন স্বর্গ থেকে মত্যে গঙ্গা আনয়ন করেছিলেন :

সেইরূপে ভাষাপথ খননি স্ববলে

ভারতরসের স্রোতঃ আনিয়াছ তুমি

জুড়াতে গৌড়ের তৃষা সেবিমল জলে

নারিবে শোধিতে ঋণ কভু গৌড়ভূমি।

বাংলা মহাভারতের পরম্পরার মধ্যে কাশীরাম দাসের আধিপত্য লক্ষ্য করে মধুসূদন তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘হে কাশী কবীশদলে তুমি পুণ্যবান’। এই শ্রদ্ধা আসলে তাঁর প্রতি সমগ্র বাঙালি জাতির শ্রদ্ধা। এই জন্য উনিশ শতকের গোড়ায় যখন পুথির আধার থেকে বিভিন্ন প্রাচীন বাংলা কাব্যকে উদ্ধার করে মুদ্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন মহাভারতের ক্ষেত্রে কাশীরামের নামাঙ্কিত মহাভারত দিয়ে তার সূত্রপাত হয়। এই উপলক্ষ্যে ১৮০১-০৩ সালে শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকে কাশীদাশী মহাভারতের প্রথম চারপর্ব মুদ্রিত হয়। এর পর ১৮৩৬ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় সম্পূর্ণ মহাভারত প্রকাশিত হয়।

বাংলা মহাভারতের মুদ্রণ প্রয়াস বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় উনিশ শতকের গোড়ায় সূচিত হলেও তার অংশবিশেষের মুদ্রণ ও প্রকাশের উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় তারও আগে অষ্টাদশ শতকের সত্তরের দশকে। এখানেও বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতা। এই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন Grammar of the Bengal Language (১৭৭৮) গ্রন্থের প্রণেতা ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০)। ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মসূত্রে তিনি দুদফায় ভারতে আসেন। প্রথম দফায় তিনি ১৭৭২ থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করেন। এই সময়ে কোম্পানির কাজের সূত্রে তিনি বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচিত হন এবং বুঝতে পারেন ইংরেজদের পক্ষে বাংলাদেশে ব্যাবসা-বাণিজ্যের কাজ করতে হলে তাদের বাংলা শেখা জরুরি। ইতিমধ্যে তিনি গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। হেস্টিংস তাঁকে দেশীয় আইনের ইংরেজি অনুবাদ ‘A Code of Gentoo Laws’ (১৭৭৬) তৈরি করার দায়িত্ব দেন। এই সূত্রে হ্যালহেড তাঁকে ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝান। হেস্টিংসের নির্দেশে তিনি ব্যাকরণ লিখতে উদ্যাগে হন। তবে Code এর কাজ করার সময় এগারো জন সংস্কৃত পন্ডিতের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পান এবং এই সূত্রে তিনি সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা অবহিত হন এবং ব্যাকরণে সংস্কৃতের সম্পর্ক তুলে ধরার পরিকল্পনা করেন। ভূমিকায় এ ব্যাপারে তিনি লিখেছেন :

The following work presents the Bengal language merely as derived from its parent the Shanscruit. In the course of my design I have avoided, with some care, the admission of such words as are not natives of the country, and for that reason have selected all my instances from the must authentic and antient compositions. (preface, pp xxi-xxii)

এইসব ‘most authentic and antient composition’-এর জন্য তিনি একাধিক বাংলা কাব্যের পুথি সংগ্রহ করেছিলেন এবং ব্যাকরণের বিভিন্ন বিষয় বোঝাবার জন্য উদাহরণ হিসাবে এই সব কাব্যের শব্দ, বাক্যাংশ ও বাক্য উদ্ধার করেছেন। এ বিষয়ে আরও নির্দিষ্ট করে তিনি বলেছেন :

I shall here insert a short specimen of the Bengal Language and character as an exercise for the learner. It is an Episode extracted from the Dron Porb, or fifth book of the Mohahharaaraat, the grand Epic Poem of India. Throughout this work I mean to confine myself to examples taken from Poetry only; as we are sure that Verse must cost the author some time and study in the composition; and is therefore likely to be the most conformable to the true genius and character of the language: and the regularity of the measure is a great check upon the ignorance, or carelessness of the copyist. (p. 36)

বলাবাহুল্য দ্রোণপর্বের উদ্ধৃতাংশটি আংশিক মাত্র, পূর্ণাঙ্গ নয়। তবু বাংলা উদ্ধৃতাংশের সঙ্গে তার যে ইংরেজি অনুবাদ দেওয়া হয়েছে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এই অনুবাদটুকুই বাংলা মহাভারতের অংশবিশেষের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টিতে দেখলে বলা যায় এই অনুবাদের মাধ্যমেই বাংলা মহাভারতের রচনাংশ ভাষান্তরে ইংরেজ তথা বিদেশি পাঠকের কাছে সর্বপ্রথম পৌঁছেছে। এর গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা উদ্ধৃতাংশটির ইংরেজি অনুবাদসহ অবিকল প্রতিমুদ্রণ প্রকাশ করলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *