বাংলা ভাষা ও চর্চা: আধুনিক স্রোত ও ধারা – স্বরূপ দে

বাংলা ভাষা ও চর্চা: আধুনিক স্রোত ও ধারা – স্বরূপ দে

ভাষা মনের ভাবকে প্রকাশ করে। মনের মধ্যে যে আবেগ, অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তা বাইরে প্রকাশের মাধ্যমই হল ভাষা। এই ভাষাই মানুষকে, মানুষের সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। ফলতঃ সৃষ্টি হয় সাহিত্যের।জার্মান ভাষাবিদ হূমবোল্ট বলেন ‘Ihre Sprache its ihr Geist, und ihr Geist ihre Sprache।’১ অর্থাৎ মানুষের ভাষাই হল তার আত্মা, আর তার আত্মাই হল তার ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই মানুষ সামাজিক ভাব আদান-প্রদান, সংঘবদ্ধ ও গোষ্ঠীবদ্ধ হয়। ভাষাই মানুষকে উন্নততর জীব হিসেবে স্বতন্ত্রতা দেয়। রবীন্দ্রনাথ ভাষা ও সাহিত্যের কথা বলতে গিয়ে বাহ্যজগৎ ও অভ্যন্তরের জগৎ তথা অন্তর জগতের কথা বলেছেন। ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি তাঁর ‘Aspects of the Theory of syntax’ গ্রন্থে বলেছেন, “…… in the technical sence, linguistic theory is mentalistic, since it is concerned with discovering a mental reality under lying actual behavior।”২ পৃথিবীতে অসংখ্য ভাষা রয়েছে। সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে চার হাজার। প্রত্যেক ভাষারই নির্দিষ্ট নিজস্ব বুনন, গঠনকাঠামো তথা ব্যাকরণ আছে। ব্যাকরণই হল ভাষার মূল। প্রত্যেক ভাষার মতো বাংলা ভাষারও নিজস্ব ব্যাকরণ কাঠামো রয়েছে। আর তাঁর উপরেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলা সাহিত্য। লিওনার্ড ব্লুমফিল্ড বলেছেন:

“An unfortunate outgrowth of the general grammar idea was the belief that the grammarian or lexicographer, fortified by his powers of reasoning, can ascertain the logical basis of language and prescribe how people out to speak.”৩

ভাষাচর্চার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রথমেই সেই ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবী জুড়ে ভাষাচর্চার সূত্রপাত হয়েছে। মূলত চারটি দেশ পৃথিবীতে প্রাচীনকালে ভাষাচর্চার প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটায়। দেশগুলি হল যথাক্রমে ভারত, গ্রীস, রোম ও মিশর। তবে এদের মধ্যে প্রাচীন ভারতবর্ষেই সর্বপ্রথম ভাষাচর্চার নজির মেলে বলে অনুমান করেছেন ভাষা পর্যটকেরা। বৈদিক ভাষায় লিখিত বেদই (ঋকবেদ) ভারত তথা পৃথিবীর ভাষাচর্চার প্রাথমিক নিদর্শন। সেই গ্রন্থেই ‘বাক্’ শব্দের প্রথম উল্লেখ ঘটে। দেবরাজ ইন্দ্র এই শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন ও তার বিশ্লেষণ করেন। ঋকবেদে বলা হয়েছে, “চত্বারি বাক্‌পরিমিতা পদানি ……” (১/১৬৪/৬৫)। ব্যাকরণ শব্দের বিশ্লেষণও বেদে পাওয়া যায় – ব্যাকরণ = বি + আ + √কৃ + অনট। এর পরবর্তীতে উপনিষদ, বেদাঙ্গ, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি গ্রন্থে প্রাচীন ভারতবর্ষে ভাষাচর্চা ঘটে। তারও পরে, ৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে সংস্কৃত ভাষায় পাণিনি ব্যাকরণ তথা ভাষাচর্চার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘অষ্টাধ্যায়ী’ রচনা করেন। আটটি অধ্যায়ে ৩২টি উপঅধ্যায়ে চার হাজার ভাষা সূত্রকে সেখানে পাণিনি লিপিবদ্ধ করেন। এরপরে পতঞ্জলি থেকে শুরু করে কাত্যায়ণ, চন্দ্রগোমী থেকে শুরু করে বামন, ভর্তৃহরি সকলেই প্রাচীন ভারতবর্ষে ভাষাচর্চা করেছেন। যদিও এই ভাষাচর্চা হয়েছিল মূলত বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাকে কেন্দ্র করে। বাংলা ভাষার তখন কোন অস্তিত্ব ছিল না।

প্রাচীন ভারতবর্ষের মতো সমান্তরালভাবে গ্রীস, রোম ও মিশরেও ভাষাচর্চার সূত্রপাত ঘটেছে। প্রাচীন গ্রীসে ভাষাচর্চার সূত্রপাত ঘটে সফিস্ট সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের দ্বারা। এরপরে ক্রমে ক্রমে হেরোডোটাস, প্লেটো (৪২৭ খ্রি. পূ. – ৩৪৮ খ্রি. পূ.) ও অ্যারিস্টটলের (৩৮৪ খ্রি. পূ. – ৩২২ খ্রি. পূ.) মধ্য দিয়ে গ্রীসের ভাষাচর্চা তরান্বিত হয়। রোমেও ভাষাচর্চা শুরু হয় গ্রীক প্রভাবপুষ্ট হয়ে। সেখানে ভারো থেকে কুইন্তিলিয়ানুস, দোনাতুস, প্রিস্কিয়ানুস ভাষাচর্চার ক্রমান্বতি ঘটায়। মিশরেও ভাষাচর্চার সূত্রপাত হয়।

প্রাচীন ভারতবর্ষে ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে যতটা উন্নতিসাধন ঘটেছিল, মধ্যযুগে ঠিক ততটাই অবক্ষয়িত হয়েছিল। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে ভাষাগ্রন্থের তথা ভাষাচর্চার তেমন নজির মেলে না। আধুনিক যুগ অর্থাৎ উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের ভাষাচর্চা আবার নব কলেবর প্রাপ্ত হয়। বাংলা ভাষাচর্চাও শুরু হয়। মূলত শ্রীরামপুর মিশনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাচর্চার সূত্রপাত ঘটে। যদিও পৃষ্টপোষক হিসেবে বিদেশিরাই বাংলা ভাষাচর্চা শুরু করেন। উইলিয়াম কেরি, জন টমাস, মার্শম্যান, ওয়ার্ড, বার্নসডন ছিলেন তাঁদের মধ্যে সর্ব-অগ্রগণ্য। যদিও শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কর্মচারী হালহেড তাঁর ‘A Grammar of the Bengali Language’ গ্রন্থে প্রথম ধাতুতে খোদাই বাংলা অক্ষর ব্যবহার করেন। মূলত কোম্পানীর কর্মচারীগণকে বাংলা ভাষা শেখানোর তাগিদেই তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর পোর্তুগীজ মিশনারী মানোত্রল-দ্য-আসসুম্পসাঁউ ও দোম আন্তেনিও-দো-রোজারিও বাংলা ভাষাচর্চা ও গ্রন্থ রচনা করেন। মানোত্রলের ব্যাকরণ অভিধান গ্রন্থটির নাম ছিল ‘Vocabulario em idioma Bengalla e Portuguez’।৪ শ্রীরামপুর মিশনের পর ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় উইলিয়াম কেরী সহ একাধিক বাঙালি লেখক বাংলা ব্যাকরণচর্চায় হাত লাগান। কেরী, ‘কথোপকথন’ (১৮০১ খ্রি.) ইংরাজিতে ‘Dialouges’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। রচনা করেন একটি অভিধানও। যার নাম ‘A Dictionary of the Bengali Language in which words or tresed to their Origin and their Various minings given’। যদিও এই সব ব্যাকরণগুলি সিভিলিয়ান কর্মচারীদের উপযোগী হিসেবে বাংলা ভাষাচর্চা হয়েছিল। ক্রমে বিদেশিদের হাত থেকে বাংলা ভাষাচর্চা দেশিয় বৈয়াকরণের হাতে ন্যাস্ত হয়। শুরু হয় বাংলা ভাষা চর্চার নতুন কালপর্ব।

বাংলা ভাষায় প্রথম ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেন রামমোহন রায় (১৭৭৪ খ্রি. – ১৮৩৩ খ্রি.)। তাঁর রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থটি হল ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ (১৮৩৩ খ্রি.)। এখানে তিনি ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। বাংলা ভাষার কারক, সমাস, বচন, ধ্বনি, প্রত্যয় প্রভৃতি বিষয় এখানে উঠে আসে। যদিও রামমোহন রায় ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ লেখার পূর্বে ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ চর্চা করেছিলেন। গ্রন্থটির নাম ছিল ‘Bangalee Grammar in the English Language’ (১৮২৬ খ্রি.)। অনেকে এই ইংরেজি ভাষায় লিখিত ব্যাকরণটির অনূদিত রূপ হিসেবে ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’কে দেখেন। যাইহোক রামমোহনের হাতে বাংলা ভাষা চর্চার প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটে।

এরপর অনেকেই বাংলা ভাষাচর্চায় এগিয়ে আসেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শ্যামাচরণ সরকার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ খ্রি. – ১৮৯১ খ্রি.), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ খ্রি. – ১৮৯৪ খ্রি.), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ খ্রি. – ১৯৪১ খ্রি.) প্রমুখ। যদিও শ্যামাচরণ সরকার বাংলা ভাষাচর্চা করেন ইংরেজি ভাষায়। তাঁর ভাষা গ্রন্থটির নাম ‘Introduction to the Bangalee Language’ (১৮৫০ খ্রি.)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাংলা গদ্যকে শিল্পসম্মত ও অভিজাত রূপ দেওয়ার পাশাপাশি, বাংলা ভাষা নিয়েও একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথের মতে বিদ্যাসাগর ‘দেবতার চেয়েও দুর্লভ মানুষ’। বিদ্যাসাগর রচিত ব্যাকরণ গ্রন্থগুলি হল—

১. ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা’ (১৮৫১ খ্রি.)

২. ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩ খ্রি.)

৩. ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ (১৮৫৩ খ্রি. – ১৮৬২ খ্রি.)

৪. ‘বর্ণপরিচয়’ (১ম – ১৮৫৫ খ্রি., ২য় – ১৮৫৫ খ্রি.)

যদিও উপরিউক্ত প্রথম তিনটি গ্রন্থই সংস্কৃত ব্যাকরণের সাহিত্য, স্বরূপ, রূপনীতি ও তাত্ত্বিক দিক নিয়ে আলোচিত হয়েছে। ‘বর্ণপরিচয়’ বাঙালির লেখা, বাঙালির জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যাকরণ গ্রন্থ। বাঙালির অক্ষরজ্ঞান ঘটেছে এই গ্রন্থের মাধ্যমে। বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণের মূল ভিত হল বিদ্যাসাগরের এই ‘বর্ণপরিচয়’ গ্রন্থ। এই গ্রন্থে বিদ্যাসাগর স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয়, ‘ই’-কার, ‘ও’-কার, ‘আ’-কার প্রসঙ্গ, যুক্তবর্ণের ব্যবহার, অনুস্বার ও বিসর্গ যোগে শব্দের উদাহরণ, ‘ন’ ফলা, ‘ণ’ ফলা, ‘ম’ ফলার ব্যবহার করেছেন। নিম্নে ‘র’ ফলা, ‘ম’ ফলা, ‘ল’ ফলা, ‘ন’ ফলার উদাহরণ তুলে ধরা হল—

“‘র’ ফলা – প্রণয়, প্রাণ, প্রীতি, প্রেরণ।

‘ল’ ফলা – অম্ল, ম্লান, অম্লান।

‘ব’ ফলা – ধ্বনি, ধ্বংস, সাধ্বী।

‘ন’ ফলা – অন্ন, ভিন্ন, অবসন্ন, সন্নিধান।

‘ম’ ফলা – জন্ম, উন্মাদ।”৫

যুক্তবর্ণের ব্যবহারও দ্বিতীয় ভাগে সুন্দরভাবে বিবৃতি করেছেন। যেমন— ‘ঐক্য’, ‘বাক্য’, ‘মাণিক্য’ ইত্যাদি।৬ এর মধ্যে শ্রুতিমধুরতাও লক্ষণীয়। যা শিশু সুলভতাকে আকৃষ্ট করে। এরই সঙ্গে বিদ্যাসাগর এই গ্রন্থে উপদেশমূলক বিভিন্ন পাঠও রচনা করেছেন।

বাংলা ভাষাকে অগ্রগতি দিয়েছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রও। বাংলা ভাষাকে মান্যতা দেওয়ার জন্য তিনি ‘বঙ্গদর্শনে’র (১৮৭২ খ্রি., এপ্রিল) মতো পত্রিকার সৃষ্টি করেছেন। যদিও ভাষাচর্চামূলক নির্দিষ্ট কোন গ্রন্থ তিনি রচনা করেননি। বিভিন্ন প্রবন্ধের মধ্যে বাংলা ভাষাচর্চার নিদর্শন তিনি রেখেছেন। যেসব প্রবন্ধে ভাষাচর্চার প্রত্যক্ষ নিদর্শন মেলে সেগুলি হল— ‘বাঙ্গালা ভাষা’, বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’, ‘গীতিকাব্য’ ইত্যাদি। তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির উন্নতির জন্য আমরণ চেষ্টা করেছেন। তাই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শনের পত্র–সূচনা’য় বলেছেন:

“যতদিন সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙ্গালিরা বাঙ্গালা ভাষায় আপন উক্তি সকল বিন্যস্ত করিবেন, ততদিন বাঙ্গালির উন্নতির কোন সম্ভাবনা নাই।”৭

রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথও বাংলা ভাষাকে বিশ্ব মানচিত্রে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাই কবিতা, নাটক, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস লেখার পাশাপাশি ভাষাচর্চামূলক একাধিক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। তাঁর ভাষাচর্চাকেন্দ্রিক গ্রন্থগুলি বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য দিক ও পথ নির্দেশক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি হল—

১. শব্দতত্ত্ব (১৯০৯ খ্রি.)

২. ছন্দ (১৯৩৬ খ্রি.)

৩. বাংলা ভাষা পরিচয় (১৯৩৮ খ্রি.)

এছাড়াও বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করেছেন। আবিস্কার করেছেন বাংলা ব্যাকরণের নানা সূত্র ও নিয়মাবলী। ‘শব্দতত্ত্ব’ প্রবন্ধ গ্রন্থে একাধিক প্রবন্ধ রয়েছে। যেখানে তিনি বাংলা ভাষার বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপনা করেছেন। একদিকে ধ্বনির উচ্চারণ, স্বরবর্ণ অ, স্বরবর্ণ এ, টা টো টে, বাংলা শব্দদ্বৈত, ধ্বন্যাত্মক শব্দ নিয়ে যেমন আলোচনা করেছেন, তেমনি বাংলা কৃৎপ্রত্যয়, বাংলা বহুবচন নিয়েও সম্যক পরিচয় দিয়েছেন। আবার বীম্‌সের বাংলা ব্যাকরণ থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার ইঙ্গিত ও ভবিষ্যতও তিনি উপস্থাপন করেছেন। বাংলা ভাষার প্রতি আবেগবিহ্বল ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন:

“এ দেশে থাকিয়া যাঁহারা ইংরেজি শেখেন, তাঁহারা কেহ কেহ ব্যাকরণকে বাঁচাইয়াও ভাষাকে বধ করিতে ছাড়েন না।”৮

রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ নিয়েও একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যেখানে তিনি বাংলা ভাষার তির্যক রূপ, বিশেষ্য, বিশেষণ, প্রতিশব্দ, বাংলা বহুবচন, বাংলা চলিত ভাষার রূপ এবং বাংলা বানান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ গ্রন্থে বাংলা বচন, প্রত্যয়, ধাতু, লিঙ্গ, বিভক্তি, ক্রিয়ার রূপ, শব্দমূল ইত্যাদি নিয়ে আলোকপাত হয়েছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্বের এবং বাক্যতত্ত্বের সামগ্রিক পরিচয় তাঁর ভাষা প্রবন্ধ গ্রন্থে রেখেছেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে বারবার ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। যে আলোচনা ভবিষ্যত পথের দিশারি হয়েছে।

বঙ্গদেশে ভাষাচর্চা সাধারণত দুটি ধারা বহন করে আধুনিকতা প্রাপ্ত তথা এগিয়ে চলেছে। যথা— এক. ঐতিহাসিক ব্যাকরণের ধারা, দুই. বর্ণনামূলক ব্যাকরণের ধারা। বিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি তাঁর ‘Aspects of the Theory of Syntax’ (১৯৬৫ খ্রি.) গ্রন্থে ‘রূপান্তমূলক সঞ্জননী ব্যাকরণে’র কথা আধুনিককালে বলেছেন। যদিও চমস্কির ‘রূপান্তমূলক সঞ্জননী তত্ত্ব’ বা ‘বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞানে’র কথা অনেক আগেই পাণিনি, কাত্যায়ন, পতঞ্জলীর ব্যাকরণ গ্রন্থের মধ্যেই নিহিত ছিল। চমস্কি তা স্বীকারও করেছেন। তিনি পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ তথা ‘পাণিনিয় ব্যাকরণ’কে মর্যাদার সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বাংলা ভাষার ব্যাকরণচর্চা নিয়ে আধুনিককালে অনেক ভাষাতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদ্‌রা এগিয়ে এসেছেন। যেখানে এপার বাংলা ও ওপার বাংলা অর্থাৎ ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয়েই বাংলা ভাষার কলেবর বৃদ্ধি করেছে ও করছে। নিম্নে দুইদেশের বিভিন্ন ভাষাবিদ্‌ ও তাদের ভাষাচর্চার সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হল। তারই সঙ্গে সময়ের সঙ্গে ভাষার স্রোত বা ধারারও একটি রূপরেখা তুলে ধরা হল।

আধুনিককালে বাংলা ভাষাচর্চায় সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০ খ্রি. – ১৯৭৭ খ্রি.)। তিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাষাচর্চা করেছেন। তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি হিন্দি, ওড়িয়া, ফরাসি, লাতিন, গ্রিক, ইংরেজি, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বাংলা ভাষার বিকাশে তাঁর ভূমিকা প্রশংসাতীত। তিনি ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে শিক্ষাগুরু হিসেবে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডি.এল.বার্নেট ও পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যুল ব্লকের সাহচর্য পান। ১৯২১ সালে ‘Indo Aryan Linguistics – The origin and Development of the Bengali Language’৯ শিরোনামে গবেষণা করে ডি. লিট্. উপাধি লাভ করেন। বাংলা ভাষাচর্চায় তিনি একাধিক ইংরেজি ও বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন। ইংরেজি গ্রন্থগুলি হল— ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ (১৯২৬ খ্রি.), ‘A Brief Sketch of Bengali Phonetics’ (১৯২১ খ্রি.), ‘Bengali Self Taught’ (১৯২৭ খ্রি.), ‘A Bengali Phonetic Reader’ (১৯২৮ খ্রি.), ‘Indo-Aryan and Hindu’ (১৯৪২ খ্রি.), ‘Language and Linguistic Problems’ (১৯৪৩ খ্রি.), ‘Language and Literature of Modern India’ (১৯৪৫ খ্রি.), ‘Dravidian’ (১৯৬৫ খ্রি.), ‘Phonetics in the study of classical languages in the East’ (১৯৬৭ খ্রি.), ‘Balts and Aryan’ (১৯৬৭ খ্রি.)।

‘The Origin and Development of the Bengali Language’ একটি উল্লেখযোগ্য বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ। গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় লেখা। গ্রন্থটির দুটি পার্ট রয়েছে। প্রথম ভাগে ধ্বনিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেখানে ধ্বনির উচ্চারণ স্বরধ্বনি, ব্যাঞ্জনধ্বনির পরিচয় ইত্যাদি রয়েছে। এতে আটটি উপঅধ্যায় রয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে সুনীতিকুমার রূপতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখানে ৫টি অধ্যায় ও শব্দকোষ দিয়ে গ্রন্থটি সম্পন্ন করেছেন। এই ভাগে একদিকে শব্দবিদ্যা, শব্দকোষ, বাচ্য, পরিভাষা যেমন রয়েছে, তেমনি ক্রিয়া, বানান সমস্যা নিয়েও আলোচনা করেছেন।

‘A Brief Sketch of Bengali Phonetics’, ‘Bengali Self Taught’ ও ‘A Bengali Phonetics’ বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। এই সকল গ্রন্থে বর্ণ, ধ্বনি, ধ্বনির উচ্চারণ, শ্বাসাঘাত, সুরতরঙ্গ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ‘A Bengali Phonetic Reader’ গ্রন্থে সুনীতিকুমার বর্ণনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে জোনসের পদ্ধতিতে ধ্বনিমূল নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। আর ‘Language and Literature of Modern India’ গ্রন্থটি নব্যভারতীয় আর্যভাষার বিবরণধর্মী আলোচনা।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ইংরেজি গ্রন্থের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় লেখা বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থও রচনা করেছেন। নিম্নরূপে তা তুলে ধরা হল—

১. বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা (১৯২১ খ্রি.)।

২. ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৪৫ খ্রি.)।

৩. ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা (১৯৪৪ খ্রি.)।

৪. সরল ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (১৯৫৫ খ্রি.)।

৫. বাঙ্গালা ভাষা প্রসঙ্গ (১৯৭৫ খ্রি.)।

‘বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির নবম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থটিতে অপিনিহিতি, অভিশ্রুতি, স্বরসঙ্গতি, অপশ্রুতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি, বাংলা ভাষার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বাঙালি জাতির ইতিহাস ও গ্রাম্য শব্দ-সঙ্কলন রয়েছে।

‘ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থটি পাঁচটি উপঅধ্যায়ে রচিত। প্রত্যেকটি উপঅধ্যায় আবার একাধিক বিষয়ে বিন্যস্ত। ভাষার সাধু চলিত রূপের আলোচনা থেকে শুরু করে, বর্ণ, বর্ণমালা, শ্বাসাঘাত, অপিনিহিতি, অভিশ্রুতি, নত্ববিধান, ষত্ব-বিধান, কারক, বিভক্তি, শব্দ, ধাতু, প্রত্যয়, ক্রিয়া অর্থাৎ ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্বের সার্বিক দিক আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার ছন্দ ও অলংকারের পরিচয়ও রয়েছে। ‘ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা’ গ্রন্থটিতে আধুনিক আর্যভাষা সমূহের বিবরণ রয়েছে। আর ‘বাঙ্গালা ভাষা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষার উচ্চারণ, অভিধান, বাংলা বানান সমস্যা, বাংলা ভাষা শব্দ পরিচয় ইত্যাদি রয়েছে। গ্রন্থটি ২৪টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বাংলা ভাষাচর্চার মাধ্যমে বাংলা ভাষার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। ফলে তাঁর দেখানো পথে বাংলা ভাষাকে, ভাষাচর্চাকে অনেকেই সমৃদ্ধ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুকুমার সেন (১৯০১ খ্রি. – ১৯৯২ খ্রি.)। তিনি ছিলেন সুনীতিকুমারের ছাত্র। তিনি ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম. এ. পরীক্ষা পাশ করেন। তিনি ১৯৩৬ সালে ‘Historical Syntax of Middle and New Indo-Aryan’ শিরোনামে গবেষণা করে পি. এইচ. ডি ডিগ্রী লাভ করেন। ভাষা বিষয়ে গবেষণা করে তিনি ‘প্রেমচাঁদ রায় চাঁদ’ বৃত্তিও পান। তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলি হল—

১. ভাষার ইতিবৃত্ত (১৯৩৯ খ্রি.)

২. বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য (১৯৩৪ খ্রি.)

৩. An outline syntax of Middle Indo-Aryan (১৯৪০ খ্রি.)

৪. An Etymological Dictionary of Bengali (১৯৭২ খ্রি.)

বাংলা ভাষায় লিখিত প্রথম উল্লেখযোগ্য ব্যাকরণ গ্রন্থ হল ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’। এই গ্রন্থটি রচনায় সুকুমার সেন, সুনীতিকুমারের ‘O.D.B.L.’ গ্রন্থের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। গ্রন্থটিতে তিনি বাংলা ভাষার বিভিন্ন প্রসঙ্গের উপস্থাপনা করেছেন। গ্রন্থটিতে একদিকে যেমন ভাষা, উপভাষা, অপভাষা, মিশ্রভাষা, ধ্বনির পরিবর্তনের রীতি, সূত্রাবলী, ধ্বনিবিজ্ঞান, স্বরধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনি, অর্ধ-ব্যঞ্জন, দ্বি-ব্যঞ্জন, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা বংশের পরিচয় দিয়েছেন, তেমনি শব্দার্থতত্ত্ব, বাংলা শব্দভাণ্ডার, লিঙ্গ, বচন, কারক, উপসর্গ, প্রত্যয়, ক্রিয়া, শব্দ গঠন, বাক্য গঠন, পদবিধির আলোচনাও উঠে এসেছে। আঠারোটি অধ্যায় ও পরিশিষ্ট অংশ যোগে গ্রন্থটি রচিত।

নব্য ভারতীয় আর্যভাষার উপর সুকুমার সেনের আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল— ‘An Etymological Dictionary of Bengali’। সুকুমার সেন এই দুটি গ্রন্থ ছাড়াও আরও কয়েকটি ভাষাতত্ত্বমূলক গ্রন্থ লিখেছিলেন। যথা— এক. ‘The use of cases in the Vedic prose’ (১৯২৯ খ্রি.), দুই. ‘Old Persian Inscription’ (১৯৪১ খ্রি.)।

উনিশ শতকের আরও একজন উল্লেখযোগ্য ভাষাবিদ্, ভাষাতাত্ত্বিক হলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫ খ্রি. – ১৯৬৯ খ্রি.)। তিনি সুনীতিকুমারের অব্যবহিত পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম ২৪ পরগনায় আর মৃত্যু ঢাকাতে। তিনি পারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট. ও ধ্বনিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা লাভ করেন। তিনি প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত হন, পরে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের প্রথম অধ্যক্ষ ও কলা বিভাগের ডিনরূপে কর্মরত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ ‘Outline of an Historical Grammar of the Bengali Language’ (১৯২০ খ্রি.) প্রকাশিত হয়। এছাড়াও তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলি হল—

১. ‘ভাষা ও সাহিত্য’ (১৯৩১ খ্রি.)

২. ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ (১৯৩৫ খ্রি.)

৩. ‘আমাদের সমস্যা’ (১৯৪৯ খ্রি.)

৪. ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ (১৯৬৫ খ্রি.)

এই গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্তে’র জন্য সর্বাধিক প্রশংসা পান। এই গ্রন্থ রচনায় তিনি O.O.B.L. গ্রন্থ, পিশেলের গ্রন্থ থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। মোট ১৩টি অধ্যায় ও উপক্রমণিকা ও পরিশিষ্ট অংশযোগে গ্রন্থটি রচিত। গ্রন্থটিতে বাংলা ভাষার উৎপত্তি থেকে শুরু করে, বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, পদক্রম, শব্দকোষ, স্বরাঘাত, কারক, বাচ্য, প্রত্যয় ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ লেখা ছাড়াও একটি অভিধান রচনা করেন। যার নাম— ‘পূর্ব পাকিস্তানী আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’ (১৯৬৪ খ্রি.)।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাদ পরবর্তী একজন উল্লেখযোগ্য ধ্বনিবিজ্ঞানী হলেন মুহম্মদ আব্দুল হাই (১৯১৯ খ্রি. – ১৯৬৯ খ্রি.)। ধ্বনিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ করে তিনি সারসত্যকে তুলে ধরেছেন। বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব বিষয়ক তিনি অনেকগুলি গ্রন্থ লিখেছেন। যথাক্রমে— ‘A Phonetic and Phonological study of Nasals and Nasalization in Bengali’ (১৯৬০ খ্রি.), ‘The Sound Structure of English and Bengali’ (১৯৬১ খ্রি.), ‘ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব’ (১৯৬৪ খ্রি.)।

বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করেছেন বাংলাদেশের আরো দুজন ব্যক্তিত্ব। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, অপরজন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহাম্মদ দানীউল হল। আবুল কালামের উল্লেখযোগ্য ভাষাগ্রন্থ হল— ‘বাংলা ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৭৫), ‘বাংলা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম’, ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৮৫)। দানীউল হকের গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগ্রন্থগুলি হল— ‘ভাষাতত্ত্বের কথা’ (১৯৮৫), ‘ভাষার কথা: ভাষাবিজ্ঞান’ (১৯৯০), ‘ভাষা বিজ্ঞানের কথা’ (২০০২)। ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ গ্রন্থটি ৯টি অধ্যায়ে ও ‘ভাষাবিজ্ঞানের কথা’ গ্রন্থটি ১০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত হয়ে ভাষা চর্চিত হয়েছে।

বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা করেছেন পবিত্র সরকার, রামেশ্বর শ, পরেশচন্দ্র মজুমদার, পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের মত ব্যক্তিত্বও। পবিত্র সরকারের ‘ভাষা-দেশ কাল’, ‘ভাষা জিজ্ঞাসা’, রামেশ্বর শ এর ‘সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা’ (১৯৮৪), পরেশচন্দ্র মজুমদারের ‘বাঙলা ভাষা পরিক্রমা’ (১৯৭৭, ১৯৮০), পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের ‘ভাষাবিদ্যা পরিচয়’ (১৯৮৪) উল্লেখযোগ্য ভাষাগ্রন্থ।

এছাড়াও বাংলা ভাষাচর্চায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাংলা ভাষাগ্রন্থ রয়েছে। যথা— অতীন্দ্র মজুমদারের ‘ভাষাতত্ত্ব’ (১৯৬১), রফিকুল ইসলামের ‘ভাষাতত্ত্ব’ (১৮৮৯), শিশিরকুমার দাশের ‘ভাষাজিজ্ঞাসা’ (১৯৯২), দ্বিজেন্দ্রনাথ বসুর ‘বাংলা ভাষার আধুনিক তত্ত্ব ও ইতিকথা’ (১৯৭৫), হুমায়ুন আজাদের ‘বাক্যতত্ত্ব’ (১৯৮৪), মৃণাল নাথের ‘ভাষা ও সমাজ’ (১৯৯৯), নির্মল দাশের ‘বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও তার ক্রমবিকাশ’, রাজীব হুমায়ুনের ‘সমাজভাষাবিজ্ঞান’ (২০০১), সুভাষ ভট্টাচার্যের ‘ভাষার তত্ত্ব ও বাংলা ভাষা’ (২০১২), উদয়কুমার চক্রবর্তীর ‘ভাষাবিজ্ঞান’ (২০১৬), অনিমেষকান্তি পালের ‘ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা’ (২০০৪) ইত্যাদি। অনেক প্রবন্ধেও ভাষাচর্চা উঠে এসেছে। যেমন— মুনীর চৌধুরির ‘Phonemes of Bengali’, নাড়ুগোপাল দের ‘মানভূমের ভাষা বৈশিষ্ট্য: সাহিত্যে প্রয়োগ’, ‘কপালকুণ্ডলা: গদ্যশৈলীর বহুমাত্রিক পরিচয়’ ইত্যাদি। তবে একথা বলাই বাহুল্য পূর্ববঙ্গের ভাষাচর্চা, পশ্চিমবঙ্গের ভাষাচর্চা থেকে অনেক এগিয়ে আধুনিককালে। হিন্দী, ইংরেজি ভাষা বর্তমানে বাংলা ভাষার সবলতাকে নষ্ট করলেও বাংলা ভাষা তার অস্তিত্ব বজায় রাখবেই। বিশ্বভাষা মানচিত্রে বাংলা ভাষা আবার নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবে কালের কলেবরে তা বলাই বাহুল্য। বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব, ভালোবাসা ও চর্চাই বাংলা ভাষাকে বিশ্বজয়ী করবে।

তথ্যসূত্র:

১. Humboldt, Wilhelm: Uber die Verschiedenheit des menschli -chen Sprachbaues, Darmstadt, 1949, P. 41।

২. Chomosky, Noam: Aspect of the theory of syntax, Cambridge, The MIT Press, 1976, P. 4।

৩. Bloomfield, Leonard: Language, Delhi, Motilal banarasidass, 1963, P. 6-7।

৪. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার: বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, মর্ডান বুক এজেন্সী প্র. লি., পুনর্মুদ্রণ ২০১০–১১, কলকাতা, পৃ.-২৪৮।

৫. বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র: বিদ্যাসাগর রচনাবলী, সত্যম, প্রথম প্রকাশ, ১৪২৫ বঙ্গাব্দ, কলকাতা, পৃ.-৪৯৩।

৬. বিদ্যাসাগর, ঈশ্বরচন্দ্র: বিদ্যাসাগর রচনাবলী, সত্যম, তদেব, পৃ.-৪৯১।

৭. চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র: বঙ্গদর্শনের পত্র-সূচনা, বঙ্গদর্শন, প্রথম খণ্ড, ১৮৭৩ খ্রি. পৃ.-৩।

৮. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ: বীম্‌সের বাংলা ব্যাকরণ, শব্দতত্ত্ব, ষষ্ঠ খণ্ড, বিশ্বভারতী, মাঘ ১৪২১, পৃ.-৬১৩।

৯. Chatterji, Sunitikumar: The O.D.B.L., Part–I, Calcutta univers -ity Press, 1926, P. xi।

১০. শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ: বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, ভূমিকা, মাওলা ব্রাদার্স, প্রথম মাওলা ব্রাদার্স সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৮, পৃ.-১।

লেখক পরিচিতি: সহকারী অধ্যাপক, হিজলি কলেজ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *