বাংলা ভাষার আপদ-বিপদ

বাংলা ভাষার আপদ-বিপদ

মাননীয় সভাপতি, সম্পাদক ও সমবেত সুধীমন্ডলী,

আজ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শতোত্তর ষোড়শ প্রতিষ্ঠাদিবস। এটি একটি মহৎ উপলক্ষ্য। এই মহৎ উপলক্ষ্যে এই মঞ্চে এযাবৎ অনেক মনস্বী ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠাদিবসের ভাষণ দিয়েছেন। আজ আমার মতো একজন অকিঞ্চিৎকর ব্যক্তিকে এই দায়িত্ব পালনে আহ্বান করেছেন, এজন্য সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কর্মসূচি অনুসারে আজ আমার প্রতিষ্ঠাদিবসের ভাষণ উপস্থিত করার কথা। কিন্তু আজ এই মঞ্চে আমি যা উপস্থিত করব তাকে ভাষণ না বলে বলা উচিত প্রস্তাব। বলাবাহুল্য, ‘প্রস্তাব’ শব্দটি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে যে-অর্থে ব্যবহৃত হত এখানে সেঅর্থে গ্রাহ্য নয়, এটি ইংরেজি ‘proposal’ শব্দের বহুপরিচিত একটি প্রতিশব্দ। কাঠামোর দিক থেকে আমার প্রস্তাবের তিনটি অংশ : মুখবন্ধ, প্রস্তাবের প্রেক্ষিত ও মূল প্রস্তাব।

মুখবন্ধ অংশে কিছু বলতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ছে যে আজকের প্রতিষ্ঠাদিবসে পরিষদের বর্তমান ভবন-প্রতিষ্ঠারও শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে। সুতরাং সাহিত্য পরিষদের আজকের এই প্রতিষ্ঠাদিবসের দায়িত্ব অনেক বেশি, এই দিনে সমাজ হয়তো পরিষদের কাছ থেকে আরও বেশি দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার আশা করবে। বস্তুত সাহিত্য পরিষৎ গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবু মনে হয় তার ভূমিকা পালনের গতিপ্রকৃতি বরাবর সমমাত্রা রক্ষা করেনি। বিশেষত, বিগত বিংশ শতাব্দীর কথা ধরলে দেখা যায় পরিষদের কাজকর্ম ওই শতাব্দীর শেষার্ধের তুলনায় প্রথমার্ধের সময়সীমার মধ্যে এমন প্রত্যক্ষ সামাজিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল যার সামাজিক প্রতিক্রিয়া বাঙালি জীবনে সুদূরপ্রসারী হয়েছে। এমনকি এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা তার সুফল ভোগ করছি। হয়তো বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে দেশবিভাগোত্তর বিভাজন অনেকখানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে আবার সময় এসেছে সাহিত্য পরিষদের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন করে কোনো সামাজিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করা যায় কিনা তা বিবেচনা করার।

যাইহোক, সাহিত্য পরিষদের কাজকর্মের ক্ষেত্রে যে প্রত্যক্ষ উদ্দীপনার কথা উল্লেখ করেছি তার সূত্রপাত বিংশ শতাব্দীর একেবারে সূচনাপর্বে। দেশে তখন লর্ড কার্জনের নির্দেশে বঙ্গভঙ্গের আয়োজন চলছে। তারই অঙ্গ হিসাবে ব্রিটিশ সরকার ঠিক করল বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার ভাষামাধ্যম হবে বাংলার আঞ্চলিক কথ্য উপভাষা। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘The Bengalee’ পত্রিকা তার সম্পাদকীয়তে সরকারের এই পরিকল্পনাকে ‘The Partition Movement in Another Form’ বলে অভিহিত করেছিল। সংকটের মোকাবিলা করার জন্য রাজনৈতিক নেতারা আন্দোলন করেছিলেন। সাহিত্য পরিষৎ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়, তবু প্রশ্নটা যখন ভাষাকে নিয়ে তখন এই রাজনৈতিক ভাষাসংকটের মুহূর্তে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সেদিন নিষ্ক্রিয় থাকেনি। ১৩১১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ফাল্গুন পরিষদের নবম মাসিক অধিবেশনে শরৎকুমার রায়ের সভাপতিত্বে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং এ-বিষয়ে বিশদ পর্যালোচনার জন্য স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সারদাচরণ মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আরও চারজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। এরপর ২১ ফাল্গুন পরিষদের দশম মাসিক অধিবেশনে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে স্থির হয়, ‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়কে কোনো প্রকাশ্য স্থলে সাধারণকে আহ্বান করিয়া এতৎ সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠের জন্য আহ্বান করা হইবে।’ সেদিন ‘কর্তব্য নির্ধারণের জন্য কলিকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও প্রধান প্রধান সভার সম্পাদক ও সংবাদপত্রের সম্পাদকদিগকে পরামর্শ সভায় আহ্বান’ করা হয়। পরিষদের সিদ্ধান্ত মতো রবীন্দ্রনাথ ২৭ ফাল্গুন জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইন্সটিটিউশন হলে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সভাপতিত্বে এ-বিষয়ে ‘সফলতার সদুপায়’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। রাজনৈতিক চাপে ও বুদ্ধিজীবীদের প্রতিরোধে ব্রিটিশ সরকার তার পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু সাহিত্য পরিষৎ বা রবীন্দ্রনাথের কাজ এখানেই শেষ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের কোনো কোনো অংশে যোগ দিলেও সর্বাংশে যোগ দেননি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল নিছক বাইরের আন্দোলনে প্রকৃত দেশপ্রেম জাগে না, প্রকৃত দেশপ্রেম জাগে দেশ ও দেশের মানুষকে গভীরভাবে জানার মধ্য দিয়ে। তংর কথায় : ‘দেশের বাস্তবিক জ্ঞান এবং দেশের বাস্তবিক কাজের উপরে যখন দেশহিতৈষা প্রতিষ্ঠিত হয় তখনই তাহা মাটিতে বদ্ধমূল গাছের মতো ফল দিতে থাকে।’ এজন্য তিনি দেশের তরুণ প্রজন্মকে উদবুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন এবং সেই উদ্দেশ্যে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাংগঠনিক পরিকাঠামোটি ব্যবহার করতে চান। ৬ চৈত্র, ১৩১১ তারিখে পরিষদের কার্যনির্বাহক সমিতির এক বিশেষ অধিবেশনে ‘নিমন্ত্রিত’ হিসাবে উপস্থিত থেকে রবীন্দ্রনাথ ‘পরিষদের ভবিষ্যৎ উন্নতি ও প্রসারের নিমিত্ত’ কতকগুলি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই সভার কার্যবিবরণীতে আছে :

রবীন্দ্রবাবু প্রস্তাব করিলেন, পরিষদের একাদশ বৎসর অতীত হইতে চলিল। এখন কিছু কিছু কাজ হাতে কলমে করা আবশ্যক। ইতিহাস, নৃতত্ব এবং ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে পরিষৎ স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান আরম্ভ করুন। এজন্য ছাত্রগণকে নিযুক্ত, উৎসাহিত ও প্রলোভিত করা আবশ্যক। এখন পরীক্ষা দিয়া ছাত্রেরা অবসর পাইবে। এই অবসরে তাহারা স্ব স্ব গ্রামে ওই সকল বিষয়ের তথ্যসংগ্রহ করুক। পরিষৎ তাহাদিগকে এবিষয়ে উপদেশ দিয়া কার্য করিবার নিমিত্ত পরিচালন করুন। এখন শহরে বি. এ ও এফ. এ পরীক্ষার্থীরা উপস্থিত আছে। পরিষৎ একদিন তাহাদিগকে আমন্ত্রণ করুন এবং এবিষয়ে তাহাদিগকে বলুন। রবীন্দ্রবাবুর এই প্রস্তাবের উপকারিতা ও উপযোগিতা বুঝিয়া সকলেই ইহার অনুমোদন করিলেন এবং বহু আলোচনার পর স্থির হইল, বি. এ ও এফ. এ পরীক্ষার শেষদিন ছাত্রগণকে আমন্ত্রণ করিতে হইবে। ওই দিন রবীন্দ্রবাবু ‘ছাত্রগণের প্রতি নিবেদন’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করিবেন এবং হীরেন্দ্রবাবু, রামেন্দ্রবাবু, দীনেশবাবু প্রভৃতিও কিছু কিছু বলিবেন।

এরপর ১৭ চৈত্র, ১৩১১ তারিখে অপরাহ্ন ৬টায় ক্লাসিক থিয়েটারে পরিষদের এক বিশেষ অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ’ প্রবন্ধটি পাঠ করেন। প্রেক্ষাগৃহে অন্যান্য শ্রোতার সঙ্গে ‘সহস্রাধিক ছাত্র’ও উপস্থিত ছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধপাঠের পর হীরেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথের উপদেশমতো কাজে আত্মনিয়োগ করার জন্য ছাত্রদের আহ্বান জানান। বহু ছাত্র এতে সাড়া দেন এবং তাঁদের সংগৃহীত তথ্যাদি মাঝে মাঝে পরিষৎ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে এই যে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা এখন একটি বিশিষ্ট বিদ্যাশৃঙ্খলা হিসাবে পন্ডিতসমাজে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সময়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার গুরুত্ব স্থাপনের ব্যাপারেও পরিষদের সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ করা যায়। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য হিসাবে এফ. এ. ও বি. এ. অনার্স এবং এম. এ. পাঠক্রমের বিভিন্ন স্তরে দেশীয় ভাষার অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সেপ্রস্তাব ১৭—১১ ভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠিত হলে ১৩০১ বঙ্গাব্দে একটি কমিটি গঠন করে পরিষদের পক্ষ থেকে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্য বইতে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং পঠন-পাঠনেও বাংলা ভাষা প্রবর্তনের প্রস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পাঠানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির প্রস্তাব পুরোপুরি গ্রহণ করেনি, আংশিকভাবে গ্রহণ করে সিন্ডিকেটে একটি বিধান গৃহীত হয় :

An optional examination be held in original composition in Bengali and other vernaculars for the F.A. and B.A. candidates, proficiency in it entitling candidates to a special certificate.

পরিষদের প্রস্তাব পুরোপুরি গৃহীত না হলেও এই আংশিক স্বীকৃতির সূত্রে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা তথা মাতৃভাষার যে জয়যাত্রা সূচিত হল তার ধারা কালান্তরেও অব্যাহত রইল। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন প্রবেশিকা থেকে এম. এ. স্তর পর্যন্ত স্বতন্ত্র বিষয় হিসাবে বাংলা ভাষা-সাহিত্যের পঠনপাঠন ও পরীক্ষা গ্রহণ শুরু হল। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধীরে ধীরে আই. এ., আই. এস. সি, বি. এ. পাঠ্যক্রমে ইংরেজি ছাড়া সব বিষয় এবং বি. এস. সি. পরীক্ষার সব বিষয় বাংলায় পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয় (১৯৩৯)। ১৯৪০ সাল থেকে ইংরেজি ছাড়া অন্য সব বিষয়ের পরীক্ষা বাংলার মাধ্যমে গৃহীত হতে থাকে। এরপর ১৯৭২ সালে স্নাতক স্তরের কলা-বাণিজ্য বিভাগের সাম্মানিক পরীক্ষা এবং স্নাতকোত্তর স্তরের কলা-বাণিজ্য বিভাগ শাখার পরীক্ষা বাংলায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা তথা মাতৃভাষার এই যে উত্তরোত্তর গুরুত্ব বৃদ্ধি, এর পেছনে ছিল পরিষদের ১৩০১ সালের মূল প্রস্তাবের সুদূরপ্রসারী অনুপ্রেরণা। সেই প্রস্তাব আজ অতীতের বিষয় হলেও তার সুফল আমরা বর্তমানেও ভোগ করছি।

বাংলা ভাষার সামাজিক গুরুত্ব বৃদ্ধির ব্যাপারে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ অতীতে যে সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছিল সেটা এখন আমাদের সুখস্মৃতি। তবে পরিষদের এই শতাব্দী-প্রাচীন ভবনে সেই সুখস্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আজ একটি প্রশ্নও জেগে ওঠে, সেটা হল অতীতের সেই প্রত্যক্ষ সামাজিক ভূমিকায় কি পরিষদকে আবার আমরা দেখতে পাব না? বিশেষত বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার আপদ-বিপদ নিবারণের ক্ষেত্রে? একথা ঠিক যে যে-কোনো সজীব ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে ভাষার মূল ধারার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু ব্যতিক্রমী পার্শ্ব-লক্ষণও চলতে থাকে। কেউ কেউ একে গুরুত্ব না দিতে পারেন, কিন্তু সামাজিক সুবিধার জন্য যখন ভাষার একটি মান্য ধারাকে সমাজ মূল স্রোতরূপে গ্রহণ করে তখন এইসব ব্যতিক্রমী পার্শ্ব-লক্ষণগুলিকে উপেক্ষা করা চলে না। বাংলা ভাষার এই ব্যতিক্রমী পার্শ্ব-লক্ষণ ও আনুষঙ্গিক পরিস্থিতিকেই আমি বাংলা ভাষার আপদ-বিপদ বলে চিহ্নিত করতে চাই। বাংলা ভাষার এই আপদ-বিপদের বিবরণই আমার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে, তবে বিষয়টি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। সাধারণভাবে ‘আপদ’ ও ‘বিপদ’ শব্দদুটি পরস্পরের প্রতিশব্দ। কিন্তু শব্দ দুটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। পরিবারের সেই সদস্যকেই আমরা ‘আপদ’ বলে চিহ্নিত করি যার ভরণ-পোষণের দায় পরিবারকে বহন করতে হয়, কিন্তু সেই সদস্য পরিবারের নিয়ম-শৃঙ্খলা কিছুই মানে না। আর পরিবারের সেই ঘটনা বা পরিস্থিতিই ‘বিপদ’ বলে গণ্য হয় যার আবির্ভাবে পরিবারের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। বাংলা ভাষারও এই রকম কিছু ‘আপদ’ ও ‘বিপদ’ আছে যা আপনারা সকলেই জানেন। আমি অল্পস্বল্প উদাহরণ দেব মাত্র।

বাংলা ভাষার আপদের উদাহরণ হিসাবে যেসব বিষয়ের কথা উল্লেখ করব, ‘আপদে’র সাধারণ ধর্ম হিসাবে সেগুলি বাংলা ভাষার নিত্যপ্রয়োগের মধ্যেই আছে, কিন্তু সেগুলি বাংলা ভাষার মান্য নিয়মের তোয়াক্কা করে না। আপদের এইসব ব্যতিক্রম, অতিচার বা অনাচার আগেও ছিল, কিন্তু তার সামাজিক প্রভাব এত ব্যাপক ছিল না। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির সাহায্যে দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমগুলি সামাজিক ক্ষেত্রে এত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে যে এগুলি আর উপেক্ষা করা যায় না। যেমন, ভুল উচ্চারণ : টিভিতে আজকাল অস্থানে স্বরলোপ ও স্বরসংযোজনের দৃষ্টান্ত একাধিক ক্ষেত্রে দেখা যায়। যথা : স্বরলোপ—তাবড়ো তাবড়ো (নেতা)-র বদলে শোনা যায়, তাবড় তাবড় (নেতা); বঙ্গোপসাগর-এর বদলে ‘বঙ্গোপসাগর’, ‘ভাগবত’-এর বদলে ‘ভাগবত’ ইত্যাদি। অন্যদিকে অনুচিত স্বরাগম : সরবরাহ-র বদলে ‘সরোবরাহ’; তরতাজা-র বদলে ‘তরোতাজা’, আবহাওয়া-র বদলে ‘আবোহাওয়া’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ভুল বানান: ত-ৎ বিভ্রান্তি—‘উচিত’-এর বদলে ‘উচিৎ’, ‘ভবিষ্যৎ’-এর বদলে ‘ভবিষ্যত’ ইত্যাদি; ণ-ন বিভ্রান্তি—‘মূল্যায়ন’-এর বদলে ‘মূল্যায়ণ’, ‘রূপায়ণ’-এর বদলে ‘রূপায়ন’; ‘বনিতা’-র বদলে ‘বণিতা’ ইত্যাদি। স্ত-স্থ বিভ্রান্তি : (এক) প্রস্থ-র বদলে ‘প্রস্ত’, ‘মুখস্থ’-র বদলে ‘মুখস্ত’, ‘রোগগ্রস্ত’-র বদলে ‘রোগগ্রস্থ’। ভুল প্রয়োগ : ‘সমৃদ্ধিশালী’-র বদলে ‘সমৃদ্ধশালী’; বহুবচনের ভ্রান্ত দ্বিরুক্তি—যেসব ছেলেরা, সমস্ত নাগরিকবৃন্দ, গ্রামের সকল লোকেরা ইত্যাদি। প্রত্যয়ের ভ্রান্ত দ্বিত্ব : ‘উৎকর্ষ’-র বদলে ‘উৎকর্ষতা’, ‘সখ্য’-র বদলে ‘সখ্যতা’; ‘অসভ্যতা’-র বদলে ‘অসভ্যতামো’। এই রকম ‘আপদ’-এর আরও উদাহরণ আপনারাও দিতে পারবেন। কাজেই এ প্রসঙ্গে এখানেই ইতি টানলাম।

এবার ‘বিপদে’র কথায় আসি। আগেই বলা হয়েছে যে বিপদ ঘটনা বা পরিস্থিতি-নির্ভর। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে, শুনেছি এখনকার বাংলাদেশেও, উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রায় সকলেই এবং মধ্যবিত্ত ও নিম্মবিত্ত শ্রেণির একটা অংশ ঘরোয়া ব্যবহারের বাইরে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার তেমন কোনো সামাজিক উপযোগিতা অনুভব করছেন না। তাঁদের ধারণা হয়েছে, সাম্প্রতিক বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজি-ভাষী শিল্পোন্নত বিশ্বের প্রবেশদ্বার আগের চেয়ে অনেকখানি উন্মুক্ত হয়েছে। এর ফলে ইংরেজি-ভাষী জগতের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে জীবিকার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। নিজের সন্তানদের এই বিপুল বৈষকি উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তুতি হিসাবে তাই তাঁরা অতি-শৈশবকাল থেকেই তাদের শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষার বদলে ইংরেজি ভাষাকেই বেছে নিচ্ছেন এবং দিগবিদিকশূন্য হয়ে ব্যয়বহুল ইংলিশ-মিডিয়াম শিক্ষা-ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো জানুয়ারি ২০০৭-এ প্রকাশিত জাতীয় নলেজ কমিশনের রিপোর্টে তৃতীয় শ্রেণি থেকে সমস্ত পাঠ্যবিষয় একমাত্র ইংরেজি ভাষার মাধ্যমেই পড়া ও পড়ানোর জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে আবার শোনা যাচ্ছে যে রাজ্য সরকারও নাকি পরিস্থিতির অনিবার্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে প্রতিকারের জন্য কোনো ইতিবাচক বিকল্পের ব্যবস্থা না করে সরকারি স্কুলগুলিতেও ইংলিশ মিডিয়ামের ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা ভাবছেন। সরকার হয়তো ভাবছেন এতে অভিভাবকরা কম খরচে ইংলিশ মিডিয়ামের সুযোগ নিতে পারবেন, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটবে না। কারণ এতে স্কুলকে দেয় খরচ হয়তো কম থাকবে, কিন্তু ‘প্রাইভেট টিউশনি’ নামক সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থার ব্যয়বহুল দায়ভার তাঁদের কাঁধে অনিবার্যভাবেই থেকে যাবে। এখন কথা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির ফলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব কি বিপন্ন হয়ে পড়ছে? বাংলা ভাষার অবলুপ্তির মুহূর্ত কি সমাসন্ন? এর উত্তর হচ্ছে, না। এর ফলে বাংলা ভাষার অস্তিত্ব এই মুহূর্তেই বিপন্ন হচ্ছে না। কারণ, জনসংখ্যার নিরিখে যতজন ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে ঝুঁকছে তাদের তুলনায় আর্থ-সামাজিক কারণে বাংলা মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়ের সংখ্যা অনেক বেশি। তা ছাড়া, মিডিয়ার জগতে এখন দেখা যাচ্ছে অন্তত দুটি ইংরেজি কাগজের বাংলা সংস্করণ নিয়মিত বেরোচ্ছে এবং একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেল তাদের বাংলা অনুষ্ঠানগুলি বিদেশেও সম্প্রচার করার ব্যবস্থা করছে। এই কাজগুলি যারা করছে তারা বিচক্ষণ ব্যবসায়ী। তারা ব্যাবসার স্বার্থেই ‘মার্কেট’ সমীক্ষা করে দেখেছে যে পৃথিবী জুড়ে বাংলাভাষী মানুষের একটা বিরাট বাজার রয়েছে। এই বাজারের সবাই ইংরেজি জানে না, কিন্তু প্রত্যেকেই বাংলা জানে। এই বাজারকে ধরতে গেলে পণ্যের বিজ্ঞাপন বাংলা অনুষ্ঠানের খোপে ভরেই দিতে হবে। বৃহৎ পুঁজিগোষ্ঠী যে এখন রিটেল মার্কেটিং বা খুচরো বিপণনের দিকে ঝুঁকছে সেখানে এই কারণে স্থানীয় ভাষার এত কদর। সুতরাং আর কিছু না হোক, বাংলা ভাষার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। তাহলে, এই পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষার বিপদটা কোথায়? বিপদ হচ্ছে এইখানে যে ইংলিশ মিডিয়ামের দিকে যেসব বাংলাভাষী অভিভাবক ঝুঁকে পড়ছেন তাঁদের মধ্যে যাঁরা ধনী তাঁদের কথা আলাদা, কিন্তু যাঁরা বিভ্রান্তিবশে আর্থিক অসুবিধা সত্ত্বেও একাজ করছেন তাঁরা এক অসহায় অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়ে পড়ছেন। এরপর তাঁরা যখন দেখবেন বাংলা মিডিয়ামে পড়া মেধাবী ছেলেমেয়েরাও ইংরেজি তথা বিদেশি ভাষা শেখার আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বিদেশি ভাষা শিখে নিয়ে কাম্য জীবিকার ক্ষেত্রে সহজেই প্রবেশাধিকার পাচ্ছে তখন তাঁদের মনে হবে ইংলিশ মিডিয়ামের জন্য এত টাকা না ঢাললেও চলত। এই অবস্থায় তাঁদের সান্ত্বনা পাওয়ার জায়গাও থাকবে না। এই শোচনীয় আত্মবঞ্চনাই এই পরিস্থিতির বিপদের দিক। অন্যদিকে এই পরিস্থিতির আর একটি বিপদের দিক হচ্ছে, সমাজে শিক্ষার জন্য দু-রকম ভাষামাধ্যম চালু থাকলে সমাজে একটা ভাষাভিত্তিক নতুন শ্রেণিবিভাজন দেখা দেবে। মাতৃভাষায় শিক্ষার মাধ্যমে গোটা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে যে একটা ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সঞ্চারিত হয়, পাশাপাশি আর একটি সমান্তরাল ভাষামাধ্যম চালু থাকলে সেই ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ঐক্যবোধ দ্বিখন্ডিত হয়। এই অবস্থা সামগ্রিক জাতিসত্তার পক্ষেই বিপজ্জনক।

বাংলা ভাষার সামাজিক ক্ষমতায়ন বা গুরুত্ব বৃদ্ধির ব্যাপারে রাজ্য সরকার থেকে যে কিছু করা হয়নি তা নয়। বেশ কয়েক দশক আগেই কেন্দ্রীয় স্তরে সিদ্ধান্ত হয় যে, রাজ্যের সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কাগজে-কলমে নথিবদ্ধ হলেও হাতেকলমে সর্বত্রগামী হয়নি। অনেক বিভাগে বাংলা ব্যবহৃত হলেও আরও অনেক বিভাগে (যেমন—সর্বশিক্ষা, জেলাপরিষদ, পঞ্চায়েত, পূর্তদপ্তর ইত্যাদি) অপ্রত্যাশিতভাবে ইংরেজি ব্যবহার এখনো অব্যাহত। অর্থাৎ সরকারি বিভাগগুলিতে বাংলা ভাষার ব্যবহারের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্তরে একটা বাধ্যতামূলক সমন্বয়-ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। প্রশাসন ছাড়া বিচার বিভাগীয় কাজকর্মেও বাংলার ব্যবহার এখন সর্বব্যাপী নয়। সরকার-পোষিত বিভিন্ন পর্ষদ-সংসদ-বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির বিজ্ঞাপন এখনও ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়, অভ্যন্তরীণ কাজকর্মেও ইংরেজির প্রাধান্য বেশি। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের ভাষা বাংলা হলেও সেবাংলায় নেই কোনো শ্রী-ছাঁদ বা সৌষ্ঠব, (যেমন—ভূমি ও ভূমিসংস্কার দপ্তরের বিরাট বিরাট ‘প্রজ্ঞাপনে’র ভাষা)। এই কেন্দ্রীয় সমন্বয়ের অভাবে প্রশাসন-বিজ্ঞাপন-বিজ্ঞপ্তির ভাষার ‘আপদ’-এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে যা শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষার সামাজিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াকে একটা বিপজ্জনক লক্ষ্যচ্যুতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের মধ্যে যে-কেউ যদি একটা মাসের খবরের কাগজে প্রকাশিত বিভিন্ন সরকারি ও আধা-সরকারি বিভাগের বিজ্ঞাপনগুলির দিকে সতর্ক নজর রাখেন তবে পরিস্থিতির সংকট সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন।

বাংলা ভাষার বিপদের আরও অন্যদিক আছে। সে-বিপদের সূচনা স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। দেশ স্বাধীন হবার আগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতেন, ছেলেমেয়েদের শিক্ষা বাংলাতেই হতে পারত। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। কয়েক বছর আগে জাতীয় সাক্ষরতা মিশনের কাজে উড়িষ্যার খুর্দা জেলায় গিয়ে দেখেছি সেখানকার চিল্কা হ্রদ এলাকায় প্রায় ২৫/৩০ হাজার বাঙালি পরিবার আছে। তাদের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা অনুমোদিত। কিন্তু তার ওপরে আর বাংলা নেই, ওড়িয়া ভাষায় সব পড়তে হবে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত যে বাংলা পড়ার ব্যবস্থা সেখানে বাংলা পাঠ্য বইয়ের বড়ো অভাব। ঝাড়খন্ডে শুনেছি ৪০% মানুষ বাংলাভাষী, কিন্তু সেখানেও বাংলা ভাষার সামাজিক গুরুত্ব সরকারি স্তরে প্রতিষ্ঠিত নয়, সেক্ষেত্রে হিন্দিরই একাধিপত্য। এ ছাড়া দেশভাগের পর আন্দামান ও দন্ডকারণ্য অঞ্চলে অনেক বাংলাভাষী উদ্বাস্তুর পুনর্বাসন হয়েছিল, কিন্তু সে-পুনর্বাসন যতটা বৈষয়িক স্তরে, সাংস্কৃতিক স্তরে একেবারেই ততটা নয়। এ ছাড়া, ভারতের অন্যান্য অনেক জায়গাতেই বাংলাভাষী মানুষের দলবদ্ধ বসবাস আছে, কিন্তু সেসব জায়গাতেও বাংলা ভাষার সামাজিক গুরুত্ব নেই। বরং কোনো কোনো জায়গায় ভারতীয় বাংলাভাষীদের অন্যায়ভাবে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের মিথ্যা দায়ে জড়িয়ে দিয়ে তাদের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হেনস্থার শিকার করা হচ্ছে। তবে শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাইরের কথাই-বা বলি কেন? পশ্চিমবঙ্গেও কি বাংলা ভাষা সর্বত্রগামী? মাত্র চার-পাঁচ বছর আগে শিলিগুড়ি থেকে মিরিক পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন দেখেছি শিলিগুড়ির সমতল এলাকা ছাড়াবার পর থেকে মিরিক পর্যন্ত গোটা রাস্তায় বহু দোকান-পাট রয়েছে, কিন্তু বাংলাতে কোথাও কোনো সাইনবোর্ড নেই, বেশিরভাগই নেপালিতে, সামান্য কিছু ইংরেজি ও হিন্দিতে এবং হাতে গোনা কয়েকটি গুরুমুখীতে। মিরিকে গিয়ে একটিমাত্র খাবারের দোকানে বাংলা ও নেপালি সাইনবোর্ড দেখলাম, তা-ও বাঙালি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য। অন্যদিকে ডুয়ার্সের কোনো কোনো জায়গায় (যেমন, কালচিনি) জনসংখ্যার বিচারে বাংলার স্থান তৃতীয় বা চতুর্থ। সামনের দিকে আছে নেপালি বা হিন্দি। অথচ যেসব ছেলেমেয়ে ওই এলাকায় হিন্দি বা নেপালিতে শিক্ষাগ্রহণ করছে তাদের অনেকেরই মাতৃভাষা হিন্দি বা নেপালি নয়। উত্তরবঙ্গের একজন পুরোনো বাসিন্দা হিসাবে আমি কিন্তু বলতে পারি যে, পঞ্চাশ বছর আগে ওই এলাকায় বাংলার স্থান এত পেছনে ছিল না। আসলে তখন ওই এলাকায় অ-বাংলাভাষী জনসমষ্টির সঙ্গে বাংলাভাষী মানুষদের একটা সহজ সামাজিক সম্পর্ক ছিল, যা এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এলাকায় প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংস্কৃতিকর্মীরা এখন আশু লাভের হিসাব-নিকাশেই ব্যস্ত, ব্যাপকতর সামাজিক ভারসাম্যের দিকটি তাঁদের কাছে অনেক দিনই অবহেলিত। পশ্চিমবঙ্গের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও এই এলাকায় তাই বাংলা ভাষার এমন সামাজিক বিপন্নতা।

বাংলা ভাষার সামাজিক গুরুত্ব বৃদ্ধিতে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ অতীতে যে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার কথা স্মরণ করে এই সভার মাধ্যমে আমি পরিষদের কাছে প্রস্তাব রাখছি যে বাংলা ভাষার এখনকার আপদ-বিপদ নিরাকরণে পরিষদে একটি উপযুক্ত উপসমিতির মাধ্যমে একটি ভাষা-পরামর্শ-কেন্দ্র গঠন করা হোক। এই পরামর্শ কেন্দ্রে কাজ হবে এইরকম :

১. পরামর্শ-কেন্দ্রের অবৈতনিক সদস্যরা মুদ্রিত ও বৈদ্যুতিন প্রচার মাধ্যমে যেসব ‘আপদ’ লক্ষ করবেন তা সংগ্রহ করে আগে কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনা করে তারপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/সংস্থাকে সংশোধনের জন্য লিখবেন। নম্রভাবে যুক্তি দিয়ে ভুলটা ধরিয়ে দিলে যে কাজ হয় এমন সাফল্যের একাধিক নজির আমার কাছে আসে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। অনেক আগে বাংলা কাগজে Tear gas-এর বাংলা করা হত ‘কাঁদুনে গ্যাস’। কিন্তু অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় চিঠি লিখে ভুলটা ধরিয়ে দিলেন যে, টিয়ার গ্যাস নিজে কাঁদে না, অন্যকে কাঁদায়। কাজেই কথাটা হওয়া উচিত ‘কাঁদানে গ্যাস’। তারপর থেকে ‘কাঁদানে গ্যাস’ই চলছে।

২. কেন্দ্রের সদস্যগণ সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞপ্তি-বিজ্ঞাপন-প্রজ্ঞাপনে বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বাঙ্গীন ও সৌষ্ঠবমন্ডিত হচ্ছে কিনা সেদিকে সতর্ক নজর রাখবেন এবং বিশেষত বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদির বিজ্ঞাপনে ভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে সমতা ও সমন্বয়ের অভাব দেখা দিলে সেসম্পর্কে সংশ্লিস্ট কতৃপক্ষকে অবহিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করবেন।

৩. কোনো ব্যক্তি বা স্বীকৃত সংস্থা যদি তাঁদের ভাষাব্যবহারের ব্যাপারে (যেমন—বানান, উচ্চারণ, প্রয়োগ ইত্যাদি) কোনো পরামর্শ চান কেন্দ্রের সদস্যগণ বিষয়টি পর্যালোচনা করে উপযুক্ত পরামর্শ দেবেন।

৪. পশ্চিমবঙ্গে অন্য যেসব ভাষাগোষ্ঠী আছে তাদের স্বীকৃত সংস্থার সঙ্গে পরিষদের সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে কেন্দ্রে সদস্যগণ পরিষদকে পরামর্শ দেবেন।

৫. পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় পরিষদের শাখা-কার্যালয় ছিল বা আছে। সেগুলির উজ্জীবন ও পুনরুজ্জীবন ব্যাপারে কেন্দ্র পরিষদকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করবে।

৬. পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের নানা জায়গায় বাঙালিদের সামাজিক সংগঠন আছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পঠনপাঠনের ব্যবস্থা আছে। এইসব সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগস্থাপনের ব্যাপারে কেন্দ্র পরিষদকে সাহায্য করবে। এই সঙ্গে ওইসব জায়গায় পরিষদের নতুন শাখা স্থাপন করা যায় কিনা সে-ব্যাপারেও কেন্দ্র পর্যালোচনা করবে ও সুপারিশ দেবে।

৭. ভারতের বাইরে বাংলাদেশে ও বিদেশের অন্যান্য জায়গার বাঙালি সংগঠনের সঙ্গে যোগস্থাপনের ব্যাপারেও কেন্দ্র পরিষদকে সাহায্য করবে।

৮. পরিষদ যাতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সভাসমিতির মাধ্যমে বাংলাভাষী মানুষদের কাছে শিক্ষার সূচনাপর্বে মাতৃভাষা ব্যবহারের অপরিহার্যতা নিয়ে আলোচনার ব্যবস্থা করে সেজন্য কেন্দ্র পরিষদকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে এবং বাংলা মাধ্যমে বিদ্যালয়েও কীভাবে আধুনিক পদ্ধতির সাহায্যে ইংরেজি তথা বিদেশি ভাষা শেখার ব্যবস্থা করা যায় সেবিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে।

৯. পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ তার অনুমোদিত অ-বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়গুলিতে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের তৃতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা পড়া আবশ্যিক করেছে। পর্ষদ এজন্য প্রয়োজনীয় পাঠ্য বইও প্রকাশ করেছে। অনুরূপভাবে পশ্চিমবঙ্গে দিল্লি বোর্ডের যেসব ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল আছে সেখানেও যাতে তৃতীয় ভাষা হিসাবে বাংলা পড়া বাধ্যতামূলক করা হয় তার ব্যবস্থা করার জন্য পরিষদ রাজ্যসরকারকে অনুরোধ করবে। এব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশটিও এখানে স্মরণীয়। এক্ষেত্রেও পরামর্শ-কেন্দ্র পরিষদকে সাহায্য করবে।

১০. উল্লিখিত বিষয়গুলি ছাড়াও বাংলা ভাষার সামাজিক ক্ষমতায়ন তথা গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য যখন যে ব্যবস্থা নিতে হবে সেই ব্যাপারে পরিষদের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য কেন্দ্র পরিষদকে সাহায্য করবে।

__________________________________________________

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ১১৬তম প্রতিষ্ঠাদিবসে (৮শ্রাবণ, ১৪১৫) পঠিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *