বাংলা ব্যাকরণ : দ্বিশতবার্ষিকীর সীমান্তে দাঁড়িয়ে

বাংলা ব্যাকরণ : দ্বিশতবার্ষিকীর সীমান্তে দাঁড়িয়ে

আজ থেকে ঠিক দুশো বছর আগে অর্থাৎ ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪)-র ইংরেজিতে রচিত বাংলা ব্যাকরণ A Grammar of the Bengalee Language গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তবে কালানুক্রমের দিক থেকে এটি দ্বিতীয় সংস্করণ হলেও তাঁর ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ওই ব্যাকরণের প্রথম সংস্করণ থেকে এর তফাত বিস্তর। এই তফাত শুধু আকারগত দিক থেকেই নয় (প্রথম সংস্করণের পৃষ্ঠাসংখ্যা: Preface vi + 100; অপেক্ষাকৃত ছোটো হরফে ছাপা দ্বিতীয় সংস্করণের পৃষ্ঠাসংখ্যা: Preface i-vii + Errata + 184), প্রকারগত দিক থেকেও বটে। প্রকৃতপক্ষে ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর বাংলা ভাষার প্রকৃতি সম্পর্কে কেরির ধ্যানধারণার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃত পন্ডিতগোষ্ঠীর সাহচর্যে বাংলা ভাষার সংস্কৃত-ভিত্তির দিকে তাঁর দৃষ্টি ক্রমশ বিশেষভবে আকৃষ্ট হয়েছে, এবং সেজন্য ব্যাকরণের দ্বিতীয় সংস্করণে তিনি গ্রন্থের কাঠামো তথা বিষয়বিন্যাসের আমূল পরিবর্তন করেন। তাই দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় (৮মে ১৮০৫) কেরি এই সংস্করণকে ‘may be esteemed a new work’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এখানে একথাও উল্লেখ করা দরকার যে কেরির প্রথম সংস্করণ বা new work বলে অভিহিত দ্বিতীয় সংস্করণ—কোনোটাই বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ নয়, এর আগে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পোর্তুগিজ ভাষায় রচিত ও আসসুম্পসাওয়ের নামাঙ্কিত বাংলা ব্যাকরণ এবং ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হ্যালহেডের A Grammar of the Bengal Language প্রকাশিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের নিরিখে এ দুটি ব্যাকরণই যথাক্রমে বাংলা ভাষার প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাকরণ। কিন্তু বাংলা ব্যাকরণ রচনার ইতিহাসে এ দুটি বইয়ের কোনো ধারাবাহিক অনুবৃত্তি দেখা যায় না। সেদিক থেকে কেরির ‘new work’ বলে অভিহিত দ্বিতীয় সংস্করণটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ এরপর দীর্ঘদিন ধরে যেসব ইংরেজ গ্রন্থকার ইংরেজিতে বাংলা ব্যাকরণ লিখেছেন তাঁদের অনেকেই এই সংস্করণ বা তার ঈষৎ বিবর্ধিত পুনর্মুদ্রণকেই আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছেন, এমনকি স্কুলের বাঙালি ছাত্রদের জন্য ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে জন রবিনসন বাংলা ভাষায় বঙ্গভাষার ব্যাকরণ ও ধাতুসংগ্রহ নামে যে বাংলা ব্যাকরণটি প্রকাশ করেন তাতেও কেরির ব্যাকরণের পঞ্চম মুদ্রণ (যা দ্বিতীয় সংস্করণেরই ঈষৎ বর্ধিত রূপ)-কেই অবলম্বন করেছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কেরির ব্যাকরণ শুধু বিদেশিদের প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়নি, স্কুলে-পড়া দেশীয় ছাত্রদের ভাষাশিক্ষার কাজেও এর ব্যবহার করা হয়েছে। সেদিক থেকে বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাসে কেরির ব্যাকরণের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং এই ঘটনার দ্বিশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে কেরির ২৪৫তম জন্মদিনে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি যে বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ে সেমিনারের সূচনা করেছে তা খুবই যুক্তিপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

তবে কেরির ব্যাকরণ-প্রকাশের দ্বিশতবর্ষপূর্তির সীমানায় দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে তাকালে কাছে-দূরের বাংলা ব্যাকরণচর্চার ইতিহাস সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন অনিবার্যভাবে মনের মধ্যে উঁকি দিতে থাকে। যেমন : বাংলা ভাষার ইতিহাস-প্রণেতাদের মতে বাংলা ভাষার বিকাশ মোটামুটি খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীর দিকে, অথচ বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছে মাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, তা-ও আবার বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে ভিন্ন মহাদেশের অ-বাংলাভাষী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উদ্যোগে। এর কারণ কী? অথচ এমন তো নয় যে বাংলা দেশে বা বাঙালিদের মধ্যে ব্যাকরণচর্চার কোনো ঐতিহ্য দশম শতকের সময়ে ছিল না। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে ওই সময়ে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃত ব্যাকরণচর্চার সঙ্গে বাংলা দেশের সংযোগ ছিল প্রত্যক্ষ, এমনকি দশম শতকের কয়েকশো বছর আগে থেকে চন্দ্রগোমী (৫শতক), জিনেন্দ্রবুদ্ধি (৮ম শতক) প্রমুখ বাঙালি বৌদ্ধ পন্ডিতদের সংস্কৃত ব্যাকরণচর্চাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে নির্দিষ্ট বৈয়াকরণ সম্প্রদায় (School) গড়ে উঠেছিল। এছাড়া, দশম শতকের পরেও বাংলা দেশের টোল ও চতুষ্পাঠীতে ব্যাকরণের বিভিন্ন সংক্ষেপিত রূপান্তর পাঠ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত। পাণিনীয় ব্যাকরণের এই সংক্ষেপিত রূপান্তরের কাজে ক্রমদীশ্বর (১৩শ শতক), জুমরনন্দী (১৪শ শতক)-র মতো বাঙালি বৈয়াকরণেরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। ব্যাকরণের এইসব সংক্ষেপিত রূপান্তরের মধ্যে কাতন্ত্র বা কলাপ ব্যাকরণ পূর্ববঙ্গে এবং মুগ্ধবোধ ও জৌমর ব্যাকরণ পশ্চিমবঙ্গে বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। এর সঙ্গে কোথাও কোথাও সংস্কৃত ব্যাকরণের আদর্শে রচিত প্রাকৃত ব্যাকরণের বররুচি-প্রবর্তিত প্রাচ্য শাখারও অনুশীলন হত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তখনকার সমাজে ও দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষার প্রচলন থাকলেও তখনকার কোনো বাঙালি বৈয়াকরণ মাতৃভাষার ব্যাকরণ লিখতে উদবুদ্ধ হননি। কেউ কেউ বলতে পারেন, তখনকার বাঙালি বৈয়াকরণদের পেশাগত রক্ষণশীলতার জন্যই তাঁরা সংস্কৃত বা প্রাকৃত ছাড়া অন্য ভাষার ব্যাকরণ লেখার কথা চিন্তা করেননি। কিন্তু এই অনুমানও সমর্থনযোগ্য নয়, কারণ সেই সুদূর মধ্যযুগের অনড় সামন্ততান্ত্রিক পরিমন্ডলে সংস্কৃত পন্ডিতেরা পেশাগত রক্ষণশীলতা সত্ত্বেও উত্তর ভারতে সংস্কৃত ভাষার আশ্রয়ে ‘যাবনিক’ পারসি ভাষার ব্যাকরণ লিখেছেন (যেমন: কৃষ্ণদাসের পারসীপ্রকাশ ও কবি কর্ণপূরের পারসীপদপ্রকাশ) এবং দক্ষিণ ভারতে তাঁদের হাতে সংস্কৃত-রীতিতে তেলুগু ও কানাড়ি ভাষার একাধিক ব্যাকরণ রচিত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষার বাইরেও যে সমসাময়িক অন্য ভাষার দিকে দৃষ্টি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না, এমন নয়। এখানেই প্রশ্ন জাগে, যা উত্তর ভারতে ও দক্ষিণ ভারতে সম্ভব হয়েছিল তা পূর্ব ভারতে সম্ভব হয়নি কেন? উত্তরটা অবশ্যই খুঁজতে হবে তখনকার বঙ্গীয় সমাজব্যবস্থার ইতিহাসের মধ্যে।

তবে প্রশ্ন শুধু মধ্যযুগ নিয়ে নয়, উনিশ শতকের বঙ্গীয় নবজাগরণের মধ্যাহ্নলগ্নের বাংলা ব্যাকরণচর্চাকে নিয়েও। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা যাচ্ছে স্কুলে স্কুলে বাংলাভাষী শিক্ষার্থীদের বাংলা ব্যাকরণ পড়াবার আয়োজন বলবৎ হয়েছে এবং এর ফলস্বরূপ প্রচুর বাংলা ব্যাকরণ বই বাজারে চলে আসছে। তবে সেইসব ব্যাকরণে সংস্কৃত ব্যাকরণের ছাপ খুবই স্পষ্ট। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রহরে চিন্তামণি গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮১) বা নকুলেশ্বর বিদ্যাভূষণের (১৮৯৮) মতো স্বাতন্ত্র্যসন্ধানী গ্রন্থকারেরা তাঁদের ব্যাকরণে সংস্কৃত উপাদানের সঙ্গে বাংলা ভাষার সংস্কৃত-নিরপেক্ষ লৌকিক উপাদানগুলিরও পরিচয় দিতে চেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের বই জনপ্রিয় হয়নি, ব্যাবসায়িক দিক থেকেও বইগুলি অসফল। এই অবস্থা পরবর্তী বিংশ শতাব্দীতে সম্প্রসারিত হয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলা ভাষায় অনেক মূল্যবান সাহিত্যকর্ম সম্পন্ন হয়েছে। বুদ্ধিজীবীমহলে বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের অনাবশ্যক আধিপত্য থেকে মুক্ত করার বিবিধ প্রস্তাব উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের জগতে যথারীতি স্থিতাবস্থা। এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক প্রয়োজনে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এইসময়ে ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ রচনা করলেন (১৯৩৯), কিন্তু বইটির অ্যাকাডেমিক উৎকর্ষ থাকলেও বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য তাঁকে কিছুদিনের মধ্যেই এই বইয়ের ‘সরল’, ‘সংক্ষিপ্ত’, ‘সংশোধিত’, ‘নবীন’ ইত্যাদি সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছে। কেন এমন হল এবং কেন এমন হয়? শুধু সদ্যবিগত বিংশ শতাব্দীতেই নয়, সদ্যআরব্ধ একবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়াতেই যখন পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ সংগত কারণেই বাংলা ব্যাকরণের পাঠক্রমের পুনর্বিন্যাস করতে উদ্যোগী হন, তখন বাঙালিসমাজে শিক্ষার সুবিধাভোগী একটি ক্ষুদ্র অথচ প্রভাবশালী অংশের নেতৃত্বে এর বিরুদ্ধে রক্ষণশীল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সক্রিয় হয়ে উঠল। এখানেও একই প্রশ্ন : কেন এমন হল এবং কেন এমন হয়? এখানে প্রশ্নগুলো তুলে দেওয়া গেল, যাঁরা বাংলা ব্যাকরণের সমাজতত্ত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন, আশা করি তাঁদের আলোচনায় এসবের উত্তর পাওয়া যাবে।

২৮

মধ্যযুগে ইউরোপ ও ভারতে যে ব্যাকরণচর্চা হয়েছে তার শ্রেণিচরিত্র মোটামুটি একইরকম। শ্রেণিচরিত্রে এগুলি prescriptive বা বিধিনির্দেশমূলক। ভাষার নিজস্ব কাঠামোর বিচার না করে বিশেষ পন্ডিতি মানদন্ডে কোনটা শুদ্ধ কোনটা অশুদ্ধ তার বিধান দেওয়াই এই ব্যাকরণের কাজ। ইউরোপে এই পন্ডিতি মানদন্ডের নিয়ামক ছিল লাতিন ব্যাকরণের কাঠামো, আর ভারতে এই মানদন্ডের নিয়ামক ছিল সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঠামো। সংশ্লিষ্ট ভাষার নিজস্ব কাঠামো বা গড়ন যা-ই হোক না কেন, তার ব্যাকরণ লিখতে হলে ভারতের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঠামো এবং ইউরোপের ক্ষেত্রে লাতিন ব্যাকরণের কাঠামো অনুসরণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন চালু ছিল। এর পর অষ্টাদশ শতাব্দীর আশির দশকে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রদত্ত উইলিয়ম জোনসের বিখ্যাত ভাষণের (১৭৮৬) সূত্র ধরে ব্যাকরণবিদ্যার চর্চা আধুনিক যুগে প্রবেশ করল। প্রথমে তুলনামূলক ব্যাকরণ ও তারপরে ঐতিহাসিক ব্যাকরণের ধারা ইউরোপের ব্যাকরণবিদ্যা তথা ভাষাবিজ্ঞানচর্চার যে যুগান্তর আনল তার ঢেউ ভারতেও এসে পড়েছিল। এরই সূত্র ধরে বিমস (১৮৭২), রামকৃষ্ণ গোপাল ভান্ডারকর (১৮৭৭), হর্নলে (১৮৮০) ভারতীয় আর্য ভাষাগুচ্ছের যেসব তুলনামূলক ব্যাকরণ তৈরি করলেন, তাতে অন্যতম তুলনীয় ভাষা ছিল বাংলা। এই সূত্রে বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক ব্যাকরণ রচনারও প্রয়াস দেখা দিল। এই ধারার ব্যাকরণ রচনার প্রথম দিকে শ্রী শ্রীনাথ সেন (১৯০০ এবং ১৯০৯), যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (১৯১২), বিজয়চন্দ্র মজুমদারের (১৯২০) বিচ্ছিন্ন প্রয়াসের পর শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বাংলা ভাষার বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যাকরণ The Origin and Development of the Bengali Language (১৯২৬), যা মুখেমুখে ODBL নামে পরিচিত। এরপর এল ১৯৪৭-এর দেশভাগ পর্ব। দেশভাগের আগে পর্যন্ত অবিভক্ত বঙ্গে বাংলা ব্যাকরণচর্চার বিভিন্ন ধারায় একটা অভিন্ন আদর্শ অনুসৃত হত। দেশভাগের পর তখনকার পূর্বপাকিস্তানে পাশ্চাত্য দেশে প্রচলিত ব্যাকরণের অন্যান্য ধারাগুলি—সংগঠন ও বর্ণনামূলক ও পরে সঞ্জনন-সংবর্তনমূলক ধারার অনুশীলন শুরু হল। কিছু পরে সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গেও নতুন ধারাগুলির প্রবর্তন হল, যদিও তার প্রতিক্রিয়া বহু ব্যাপক নয়। এর সঙ্গে উপভাষা-ব্যাকরণ ও সমাজভাষার ব্যাকরণের চর্চা কিছুটা প্রসারিত হলেও ব্যাকরণের তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ধারার বেগ অনেকখানি মন্দীভূত হয়ে পড়ল।

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ব্যাকরণচর্চার ক্ষেত্রে যেসব নতুন ধারার সূত্রপাত হয়েছে বাংলা ব্যাকরণের দ্বিশতবার্ষিকীর সীমান্তে দাঁড়িয়ে খতিয়ে দেখা দরকার এইসব নতুন ধারায় বাংলা ব্যাকরণচর্চা সামাজিক দিক থেকে কতখানি ফলপ্রসূ হয়েছে। এই মূল্যায়ন ঠিকভাবে করতে পারলে আগামী দিনগুলিতে বাংলা ব্যাকরণচর্চাকে সামাজিক উপযোগিতার দিক থেকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলা সম্ভব হবে, নতুবা আজকের দিনে সমাজবিচ্ছিন্ন বিদ্যাচর্চার খুব একটা মূল্য আছে কি? আরও ভাবতে হবে, আমাদের মতো এমন গরিব দেশের পক্ষে এই ব্যষ্টিকেন্দ্রিক বিদ্যাবিলাস কতটা যুক্তিযুক্ত?

এই পরিচ্ছেদের প্রথম অনুচ্ছেদে বাংলা ব্যাকরণচর্চার বিভিন্ন ধারার যে সংক্ষিপ্ত সমীক্ষা করা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, যে ধারাকে ভিত্তি করে ব্যাকরণচর্চায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছিল সেই তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ধারার গতি এখন রুদ্ধপ্রায় এবং বলা ভালো কিছুটা অবজ্ঞাতও। এর ফলে সুনীতিবাবুর ODBL-এর পর কয়েকটি ছাত্রসহায়ক পাঠ্যবই ছাড়া বাংলা ভাষার ইতিহাস নিয়ে আর কোনো মৌলিক বই প্রকাশিত হয়নি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্পর্কে সব কথা কিংবা শেষ কথা ODBL—এই বলা হয়ে গিয়েছে, আর কিছু বলা বা সন্ধান করার নেই? বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার দিক থেকে এই উপলব্ধি বা মনোভাব কি খুবই যুক্তিযুক্ত? আমরা তো জানি, রবীন্দ্রনাথ একসময়ে বলেছিলেন যে বাংলার আঞ্চলিক উপভাষাগুলির তুলনামূলক অধ্যয়ন থেকেই বাংলা ভাষার প্রকৃত ইতিহাস জানা যাবে। সুনীতিবাবুর প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা পোষণ করেই একথা জিজ্ঞাসা করা যায় যে ODBL-এ বাংলার আঞ্চলিক উপভাষাগুলির তুলনামূলক পর্যালোচনা কতটা স্থান পেয়েছে? শুধু ODBL কেন, ODBL-এর বাইরেই-বা এই জরুরি কাজটা কতটা এগিয়েছে? উপভাষার তুলনামূলক অধ্যয়ন তো দূরের কথা, ছোটোখাটো অপেশাদার প্রবন্ধের বাইরে বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক ও সামাজিক উপভাষাগুলির বিধিবদ্ধ অধ্যয়ন খুব কি এগিয়েছে? যাঁরা এ কাজ কিছুটা হলেও করেছেন বিদ্বৎসমাজে তাঁদের স্বীকৃতি কতটা (মনে রাখতে হবে, একটা রুটিনমাফিক এম. ফিল. বা একটা পিএইচ. ডি. প্রাপ্তি সবসময়ে সামাজিক স্বীকৃতির প্রকৃত সূচক হয়ে ওঠে না)? তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণ সম্পর্কে আধুনিক ভাষাগবেষকদের মধ্যে যে উন্নাসিক অবহেলা লক্ষ করা যায় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বার্থের দিক থেকে তার একটা ক্ষতিকর দিকও আছে। অধুনালুপ্ত সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৭-র অক্টোবর বিপ্লবের পর সেখানে নিকোলাই ইয়াকোভলেভিচ মার (১৮৬৪-১৯৩৪)-এর নেতৃত্বে ভাষাবিজ্ঞানচর্চার ‘জাফেটিক তত্ত্ব’ নামে একটি নতুন তত্ত্বের অবতারণা করা হয়। এই নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে মার প্রচার করেছিলেন যে ভাষার বিকাশ বা বিবর্তনের মধ্যে কোনো বংশানুক্রমিক পরম্পরা নেই। ভাষার বিকাশ ঘটে crossing বা মিশ্রণের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রুশদেশে প্রায় তিন দশক ধরে খুব জোরালোভাবে চলেছিল। এই তত্ত্বে ভাষার বংশানুক্রমিক পারম্পর্যকে অস্বীকার করায় রুশদেশে ওই তিন দশকে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণের কার্যকারিতা ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে নাকচ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে প্রাভদা পত্রিকায় মার-এর তত্ত্বের মূল্যায়ন শুরু হয় এবং জোসেফ স্তালিন তখন ওইসব আলোচনায় অংশ নিয়ে ভাষার বিকাশ এবং বিবর্তন নিয়ে যেসব অভিমত প্রকাশ করেন তাতে অচিরেই মার-এর নয়া তত্ত্বের ভ্রান্তি ধরা পড়ে এবং ভাষার সঙ্গে সামাজিক সম্পর্কের প্রসঙ্গটি ক্রমশ গুরুত্ব পেতে থাকে। এর ফলে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণচর্চার সোৎসাহ পুনর্বাসন ঘটে। রাজনৈতিক কারণেও এই পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল। কারণ এর ফলে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সন্ধান এবং রাষ্ট্রের বাইরে বিশেষত চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে বংশানুক্রমিক অন্বয় সন্ধানের চেষ্টা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছিল। রুশদেশে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণচর্চার পুনরুজ্জীবন এইভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারত যখন রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক থেকে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে এবং ভারতেরই অঙ্গরাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গেও যখন প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রসারের সক্রিয় উদ্যোগ চলছে তখন তারই পরোক্ষ অথচ অব্যর্থ অনুষঙ্গী হিসাবে এখানেও কি তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণের প্রত্যাবর্তন জরুরি নয়? দু-চার জন মার্কিন বদান্যতাপুষ্ট দেশি পন্ডিত দেশের কথা ভুলে থেকে ভাষাতাত্ত্বিক আত্মরতিতে মগ্ন থাকুন, তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু ভারতের মতো বহু ভাষা ও বহু জাতির দেশে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও ঐক্যবোধের জন্যও তো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও ভাষা-গবেষণাকেন্দ্রগুলিতে তুলনামূলক-ঐতিহাসিক ব্যাকরণের সংগঠিত পুনরনুশীলন শুরু হওয়া দরকার। কারণ এইসব বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা-সংস্থার খরচ তো জোগায় গোটা দেশের সাধারণ মানুষ। সুতরাং দ্বিশতবার্ষিকীর সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে আমাদের আগামী দিনের বাংলা ব্যাকরণচর্চার অভিমুখ থাকবে কোন দিকে—স্বদেশের বিস্তৃত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থের দিকে, না সমাজবিস্মৃত বিদেশি ব্যাকরণতত্ত্বের খুচরো বিপণনের দিকে?

এরপর স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের কথায় আসা যাক। স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ যে-কোনো ভাষার ব্যাকরণচর্চার সবচেয়ে সংগঠিত এলাকা। বাংলা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের উদাহরণ দিলে দেখা যায় প্রতি বছর কয়েক লক্ষ ছাত্রছাত্রী নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে নিয়মিত ব্যাকরণচর্চা করে, এদের সঙ্গে আছেন বেশ কয়েক হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষানুরাগী অভিভাবক ও অভিভাবিকা। স্কুলে ভাষার ব্যাকরণকে প্রথম ভাষা-দ্বিতীয় ভাষা-তৃতীয় ভাষা ইত্যাদি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। এদের মধ্যে দ্বিতীয় ভাষা ও তৃতীয় ভাষার পড়ুয়ারা সংখ্যালঘু, তাই প্রথম ভাষার ব্যাকরণের উপরেই জোরটা বেশি পড়ে। প্রথম ভাষার সঙ্গে দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষার তফাত হচ্ছে, দ্বিতীয় ভাষা-তৃতীয় ভাষার ক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট ভাষাটি পড়ুয়ার মাতৃভাষা নয়, কিন্তু প্রথম ভাষার ক্ষেত্রে ভাষাটি পড়ুয়ার মাতৃভাষা। যারা স্কুলে মাতৃভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে বেছে নেয়, তারা আসলে ভাষাটি নতুন করে শেখে না, কারণ তার সূচনা স্কুলে যাবার আগেই পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে ঘটে যায়। তবে প্রতিবেশ থেকে যে ভাষারূপটির সঙ্গে তাদের পরিচয় হয় সেটি তাদের এলাকার কথ্য উপভাষা। স্কুলে গিয়ে তারা নিজেদের সেই কথ্য উপভাষার সংকীর্ণ গন্ডি ছাড়িয়ে ওই ভাষার মান্য রূপের বৃহত্তর রূপের সংগঠনটি শেখে। অর্থাৎ এই পর্যায়ে তাকে কিছুটা স্থায়ীভাবে গ্রহণ ও কিছুটা সাময়িকভাবে বর্জন করার অনুশীলন করতে হয়। এই অনুশীলনের দিকে লক্ষ রেখেই প্রথম ভাষার ব্যাকরণ-পাঠ শুরু হয়। তবে এই পাঠের সাফল্য নির্ভর করে মোটামুটি তিনটি বিষয়ের উপর: ১. ব্যাকরণের কাঠামো, ২. ব্যাকরণের বিষয়-নির্বাচন এবং ৩. ব্যাকরণের উপস্থাপনা-পদ্ধতি।

ভাষার নিজস্ব কাঠামো অনুসারেই তার ব্যাকরণের কাঠামো নির্ণীত হওয়া উচিত; কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই তা হয় না। আগে ইউরোপীয় ভাষাগুলির ক্ষেত্রে লাতিন ব্যাকরণের কাঠামো এবং ভারতীয় ভাষার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঠামো ব্যবহৃত হত, ফলে সংশ্লিষ্ট ভাষার সংগঠন বর্ণনায় অনেক ফাঁক থেকে যেত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাংলা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের দুটি কাঠামো বা (তাঁর ভাষায়) ‘প্যাটেন্ট’ লক্ষ করেছিলেন—একটি মুগ্ধবোধ প্যাটেন্ট, অন্যটি হাইলি প্যাটেন্ট, অর্থাৎ যথাক্রমে সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণের কাঠামো। বাংলা ভাষার গঠন অনুসারী কোনো নিজস্ব কাঠামো না থাকায় বাংলা ব্যাকরণে কোথাও কোথাও অসংগতি থেকে গিয়েছে। যেমন : বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন শব্দের অন্বয়গত অবস্থান তথা পদপরিচয় বোঝাতে গিয়ে সাধারণত সংস্কৃত ব্যাকরণের কাঠামো ধরে ‘কারক’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তাতে বাক্যস্থিত সব শব্দের অন্বয়গত পরিচয় পাওয়া যায় না, কারণ কারকের কাঠামো অনুসরণ করলে তাতে বাক্যের সম্বন্ধবোধক ও সম্বোধনবোধক শব্দগুলির স্থানসংকুলান হয় না। এক্ষেত্রে রামমোহন লাতিন তথা ইংরেজি ব্যাকরণের case-কাঠামো অনুসরণ করে ‘পরিণমন’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাঁর অব্যবহিত পরবর্তী স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণগুলিতে রামমোহনের প্রবর্তনা পরিত্যক্ত হয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের কারক-কাঠামোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভুল কাঠামো থেকে তৈরি হওয়া এই ধরনের অসংগতির আর-একটি উদাহরণ বাংলা ব্যাকরণের প্রচলিত বাচ্য প্রকরণ। সংস্কৃত ব্যাকরণের ‘কর্মবাচ্য’ এবং ইংরেজি ব্যাকরণের passive voice-এর কঠোর অনুশাসনে বাংলা ব্যাকরণেও ‘কর্মবাচ্য’ বলে বাচ্যের একটি শ্রেণির কথা আলোচনা করা হয়। অথচ আলোচনায় কর্মবাচ্যের উদাহরণ হিসাবে যেসব বাক্য ব্যবহার করা হয় সেগুলি বাংলা বাক্য নয়। যেমন : কতৃবাচ্য—আমি ভাত খেয়েছি; কর্মবাচ্য—আমার দ্বারা ভাত খাদিত বা খাওয়া হয়েছে। এখানে কর্মবাচ্যের উদাহরণ—বাক্যটির বদলে যদি লেখা যায় ‘আমার ভাত খাওয়া হয়েছে’, তবে বাক্যে স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য আসে, কিন্তু এই স্বাভাবিক বাক্যটি ভাববাচ্যের উদাহরণ, কর্মবাচ্যের নয়। আসলে বাংলায় বাচ্য মাত্র দুটি: কতৃবাচ্য ও ভাববাচ্য, কিন্তু বাংলা ব্যাকরণে বাংলার নিজস্ব গঠনপ্রকৃতির চেয়েও সংস্কৃত ও ইংরেজি বাক্য তথা ব্যাকরণের কাঠামোকে গুরুত্ব দেবার ফলে এই ইচ্ছাকৃত বিপত্তি। কাজেই আগামী দিনে যদি বাংলা ভাষার কোনো পূর্ণাঙ্গ ও যর্থাথ ব্যাকরণ লিখতে হয় তবে সঙ্গে সঙ্গে তার উপযুক্ত কাঠামোটি নির্ধারণ করার জন্যও তৎপর থাকতে হবে। স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের ক্ষেত্রে তো বটেই।

কাঠামোর মতো যথার্থ ব্যাকরণ লেখার জন্য চাই বিষয়-নির্বাচনের বিচক্ষণতা এবং উপস্থাপন পদ্ধতির নিপুণতা। অনেকসময়ে দেখা যায় ভাষার নিজস্ব প্রকৃতি ও ব্যাকরণ রচনার লক্ষ্যের কথা ভুলে যাওয়ায় বা উপেক্ষা করায় ব্যাকরণে এমন সব বিষয় স্থান পায় লক্ষ্যের সঙ্গে যাদের কোনো সামঞ্জস্য নেই। যেমন, স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ কোনো কথ্য উপভাষার ব্যাকরণ নয়, স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণের লক্ষ্য মান্য লেখ্য উপভাষার নিয়মকানুন দেখানো। অথচ বাংলা স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণে ‘অপিনিহিতি’ (যাকে কেউ কেউ একজাতীয় ধ্বনি-বিপর্যয় বলেই চিহ্নিত করতে চান) নামে একটি ধ্বনি-পরিবর্তনসূত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে—যা এখন শুধু বাংলার বঙ্গালি কথ্য উপভাষাতেই ব্যাপকভাবে দেখা যায়। কাজেই স্কুলপাঠ্য তথা মান্য ভাষার ব্যাকরণে ‘অপিনিহিতি’ প্রসঙ্গটি অবান্তর। তাই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নতুন পাঠক্রমের প্রথম দফায় ‘অপিনিহিতি’ প্রসঙ্গটি বাদ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রক্ষণশীলদের চাপে আবার তা ফিরে এসেছে। ‘সন্ধি’ সম্পর্কেও একই ধরনের রক্ষণশীল বাড়াবাড়ি। অন্যদিকে ব্যাকরণের উপস্থাপনা-পদ্ধতিকে সহজ ও স্বচ্ছন্দ করার জন্য পর্ষদের নতুন পাঠক্রমে কতকগুলি বহুপ্রচলিত অথচ অর্থের দিক থেকে অস্পষ্ট পরিভাষার বদলে সহজবোধ্য ও স্বচ্ছতর পরিভাষা প্রবর্তন করা হয়েছিল, কিন্তু সেখানেও রক্ষণশীলদের শিক্ষাসম্পর্কহীন অযৌক্তিক চাপ, এবং ফলত পুরোনো পরিভাষার অবাধ প্রত্যাবর্তন। এছাড়াও, স্কুলপাঠ্য বাংলা ব্যাকরণের সময়োপযোগী সংস্কার করার অন্য অসুবিধাও আছে। ব্যাকরণের পঠনপাঠনকে সহজ ও স্বচ্ছন্দ করার জন্য পাঠক্রমে পাঠবিন্যাসের ক্ষেত্রে আরোহ পদ্ধতি অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি নতুন পদক্ষেপ, কিন্তু পর্ষদের রিভিয়ু প্রক্রিয়ার দুর্বলতার সুযোগে অনেক বইতে পুরোনো অবরোহ পদ্ধতিরই অনুবৃত্তি বহাল আছে এবং আধুনিক বাজার-ব্যবস্থার কূটকৌশলে সেগুলো অযোগ্য হয়েও বাজার দখল করে রেখেছে। সুতরাং শুধু পাঠক্রমের সংস্কারই যথেষ্ট নয়, এর জন্য একদিকে দরকার এই সংস্কারের উপযোগিতা সম্পর্কে জনচেতনা সংগঠিত করা, অন্যদিকে দরকার পাঠ্যবইতে ও পঠনপাঠনে নতুন পাঠক্রমের মূল অভিপ্রায় প্রতিফলিত হচ্ছে কি না সেদিকে সক্রিয় নজরদারি। বলাবাহুল্য এ কাজ সহজ নয়, তবু নানাভাবে চেষ্টা জারি রাখতে হবে।

সবশেষে বাংলা ব্যাকরণ সম্পর্কে আর-একটা কথা এবং সেটা এই ‘হাইটেক’ একবিংশ শতাব্দীর পরিপ্রেক্ষিতে। এখন বিশ্বায়নের অজুহাতে ভারত-বাংলাদেশের শিক্ষিত বাংলাভাষী সমাজের একটা বড়ো অংশ মাতৃভাষাশিক্ষার বদলে ইংরেজি ভাষাশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, যেন মাতৃভাষাশিক্ষার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, জীবনের সর্বসিদ্ধি ইংরেজি ভাষাশিক্ষার মধ্যেই নিহিত। তাই গ্রামেগঞ্জেও এখন ইংলিশ মিডিয়ামের ব্যাপক ব্যাবসা। কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখা দরকার, মাতৃভাষাকে বর্জন করে ইংরেজিভাষার শিক্ষা আমাদের কতটা সিদ্ধি দিতে পারবে? আগামী দিনে ইংরেজিভাষী উন্নত দেশগুলিতে বাঙালিদের শতকরা কত অংশ যাবার সুযোগ পাবে? আউটসোর্সিঙের দৌলতে যখন মেধাবানকে তার নিজের দেশে রেখেই কাজে লাগানো যাচ্ছে তখন আগামী দিনে মেধাবীদের বিদেশযাত্রার সুযোগ কি আরও সংকুচিত হয়ে আসবে না? কল সেন্টারের জন্য যেটুকু ইংরেজি জানা দরকার তার জন্য তো বিদেশি ভাষা শেখার উপযোগী আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নিলেই কাজ চলে যায়, তার জন্য মাতৃভাষাকে অবহেলা করার দরকার আছে কি? যাই হোক, বাঙালিদের ইংরেজির বদলে মাতৃভাষার দিকে মুখ ফেরানোর আহ্বান জানানো বর্তমান লেখকের উদ্দেশ্য নয়। লেখকের উদ্দেশ্য আগামী দিনে বিদেশিদের মধ্যে বাংলা শেখার যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যেতে পারে তার সম্ভাবনা সম্পর্কে বাংলা ভাষাকে এখনও যাঁরা ভালোবাসেন এবং এমনকি বাংলা ভাষা নিয়ে যাঁরা ব্যাবসা করতেও ইচ্ছুক তাঁদের সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে উদবুদ্ধ করা। এখন যে বিশ্বায়নের কথা বলা হয় তা তো কোনো সাংস্কৃতিক বিশ্বায়ন নয়, তা আসলে বহুজাতিক পুঁজিপতিদের বিশ্বব্যাপী বাজার দখল করার লড়াই। বাজার দখলের লড়াইয়ে বাজারের জনসংখ্যা একটা বড়ো বিবেচ্য বিষয়। জনসংখ্যার দিক থেকে যেসব ভাষা পৃথিবীতে সামনের সারিতে আছে সেইসব ভাষার জনগোষ্ঠীই বহুজাতিক বণিকদের বাণিজ্যবিস্তারের প্রধান লক্ষ্যস্থল। সেদিক থেকে খুব অল্প দিনের মধ্যেই পৃথিবীব্যাপী বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী বহুজাতিক বিদেশি বণিকদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যস্থল হয়ে দাঁড়াবে। আন্তর্জাতিক হিসাব অনুসারে সারা পৃথিবীতে এখন প্রায় ২২ কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলে এবং এদের সকলেই ইংরেজি জানে না। কাজেই এই ২২ কোটি বাংলাভাষীর সুবৃহৎ বাজারে নিবিড়ভাবে ঢুকতে হলে ইংরেজিতে খুব-একটা কাজ হবে না, কাজ হবে বাংলা ভাষায়। আগামী দিনের বিজ্ঞাপনে, প্রচারমাধ্যমে এবং বৈদ্যুতিন বিপণনে তাই বাংলা ভাষারই প্রয়োগ ঘটবে অনেক বেশি পরিমাণে এবং সেই কারণে বিদেশিদের মধ্যে বাংলা শেখার আগ্রহও বাড়বে (টিভিতে বাংলা চ্যানেলের ক্রমিক সংখ্যাবৃদ্ধি এরই একটা সূচক)। কিন্তু এই ‘হাইটেক’-এর যুগে ভাষাশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ-বইয়ের বদলে বৈ-ব্যাকরণ (বৈ = বৈদ্যুতিন বা electronic)-এর ব্যবহার তথা ‘অন-লাইন’ ব্যবস্থাপনাই হবে সবচেয়ে কার্যকর ও সবচেয়ে জনপ্রিয়। বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর এই ‘অন-লাইন’ বাজারটি ধরার চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তা খুব বিক্ষিপ্তভাবে। বাংলা ব্যাকরণের দ্বিশতবার্ষিকীর সীমান্তে দাঁড়িয়ে আমরা চাই বাংলা ভাষার আরও বৈ-ব্যাকরণ তৈরি হোক এবং তাতে বাংলাভাষী মানুষদেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হোক। কারণ তাতে আর কিছু না হোক, যেসব হিসাব-নিপুণ শিক্ষিত বাঙালি মাতৃভাষার উপর ভরসা রাখতে পারেন না, তাঁরা হয়তো আগামী দিনে তাঁদের হিসাবের ছকটা বদলাতে পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *