আমরা পূর্বে এক প্রবন্ধে দেখাইয়াছি, বাংলায় নামসংজ্ঞা ছাড়া বিশেষ্যপদবাচক শব্দ মাত্রই সহজ অবস্থায় সামান্য বিশেষ্য। অর্থাৎ তাহা জাতিবাচক। যেমন শুধু “কাগজ’ বলিলে বিশেষভাবে একটি বা অনেকগুলি কাগজ বোঝায় না, তাহার দ্বারা সমস্ত কাগজকেই বোঝায়।
এমন স্থলে যদি কোনো বিশেষ কাগজকে আমরা নির্দেশ করিতে চাই তবে সেজন্য বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করা আবশ্যক হয়।
ইংরেজি ব্যাকরণে এইরূপ নির্দেশক চিহ্নকে Article বলে। বাংলাতেও এই শ্রেণীর সংকেত আছে। সেই সংকেতের দ্বারা সামান্য বিশেষ্যপদ একবচন ও বহুবচন রূপ ধারণ করিয়া বিশেষ বিশেষ্যে পরিণত হয়। এই কথা মনে রাখা কর্তব্য, বিশেষ্যপদ, একবচন বা বহুবচনরূপ গ্রহণ করিলেই, সামান্যতা পরিহার করে। একটি ঘোড়া বা তিনটি ঘোড়া বলিলেই ঘোড়া শব্দের জাতিবাচক অর্থ সংকীর্ণ হইয়া আসে– তখন বিশেষ এক বা একাধিক ঘোড়া বোঝায়– সুতরাং তখন তাহাকে সামান্য বিশেষ্য না বলিয়া বিশেষ বিশেষ্য বলাই উচিত। এই কথা চিন্তা করিলেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন আমাদের সামান্য বিশেষ্য এবং ইংরেজি Common name এক নহে।
বিশেষ বিশেষ্য একবচন
মোটামুটি বলা যাইতে পারে বাংলার নির্দেশক চিহ্নগুলি শব্দের পূর্বে না বসিয়া শব্দের পরেই যোজিত হয়। ইংরেজি ‘the room’–বাংলায় “ঘরটি’। এখানে “টি’ নির্দেশক চিহ্ন।
টি ও টা
ইংরেজিতে the আর্টিক্ল্ একবচন এবং বহুবচন উভয়ত্রই বসে কিন্তু বাংলায় টি ও টা সংকেতের দ্বারা একটিমাত্র পদার্থকে বিশিষ্ট করা হয়। যখন বলা হয়, “রাস্তা কোন্ দিকে’ তখন সাধারণভাবে পথ সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হয়– যখন বলি, “রাস্তাটা কোন্ দিকে’– তখন বিশেষ একটা রাস্তা কোন্ দিকে সেই সম্বন্ধেই প্রশ্ন করা হয়।
ইংরেজিতে ‘the’ শব্দের প্রয়োগ যত ব্যাপক বাংলায় “টি’ তেমন নহে। আমাদের ভাষায় এই প্রয়োগ সম্বন্ধে মিতব্যয়িতা আছে। সেইজন্যে যখন সাধারণভাবে আমরা খবর দিতে চাই, মধু বাহিরে নাই,তখন আমরা শুধু বলি, মধু ঘরে আছে– ঘর শব্দের সঙ্গে কোনো নির্দেশক চিহ্ন যোজনা করি না। কারণ ঘরটাকেই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করিবার কোনোই প্রয়োজন নাই। ইংরাজিতে এ স্থলেও ‘the room’ বলা হইয়া থাকে। কিন্তু যখন কোনো একটি বিশেষ ঘরে মধু আছে এই সংবাদটি দিবার প্রয়োজন ঘটে তখন আমরা বলি, ঘরটাতে মধু আছে। এইরূপ, যে বাক্যে একাধিক বিশেষ্যপদ আছে তাহাদের মধ্যে বক্তা যেটিকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতে চান সেইটির সঙ্গেই নির্দেশক যোজনা করেন। যেমন, গোরুটা মাঠে চরছে, বা মাঠটাতে গরু চরছে। জাজিমটা ঘরে পাতা, বা ঘরটাতে জাজিম পাতা। “আমার মন খারাপ হয় গেছে’ বা “আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে’– দুইই আমরা বলি। প্রথম বাক্যে, মন খারাপ হওয়া ব্যাপারটাই বলা হইতেছে– দ্বিতীয় বাক্যে, আমার মনই যে খারাপ হইয়া গিয়াছে তাহার উপরেই ঝোঁক।
“টি’ সংকেতটি ছোটো আয়তনের জিনিস ও আদরের জিনিস সম্বন্ধে “টা’ বড়ো জিনিস সম্বন্ধে বা অবজ্ঞা কিংবা অপ্রিয়তা বুঝাইবার স্থলে বসে। যে পদার্থ সম্বন্ধে আদর বা অনাদর কিছুই বোঝায় না, তৎসম্বন্ধেও “টা’ প্রয়োগ হয়। “ছাতাটি কোথায়’ এই বাক্যে ছাতার প্রতি বক্তার একটু যত্ন প্রকাশ হয়, কিন্তু “ছাতাটা কোথায়’ বলিলে যত্ন বা অযত্ন কিছুই বোঝায় না।
সাধারণত নামসংজ্ঞার সহিত “টা’ “টি’ বসে না। কিন্তু বিশেষ কারণে ঝোঁক দিতে হইলে নামসংজ্ঞার সঙ্গেও নির্দেশক বসে। যেমন, হরিটা বাড়ি গেছে। সম্ভবত হরির বাড়ি যাওয়া বক্তার পক্ষে প্রীতিকর হয় নাই, টা তাহাই বুঝাইল। “রামটি মারা গেছে’, এখানে বিশেষভাবে করুণা প্রকাশের জন্য টি বসিল। এইরূপ শ্যামটা ভারি দুষ্ট, শৈলটি ভারি ভালো মেয়ে। এইরূপে টি ও টা অনেক স্থলে বিশেষ পদের সঙ্গে বক্তার হৃদয়ের সুর মিশাইয়া দেয়। বলা আবশ্যক মান্য ব্যক্তির নাম সম্বন্ধেও টি বা টা ব্যবহার হয় না।
সামান্যতাবাচক বা সমষ্টিবাচক বিশেষ্যপদকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতে হইলে নির্দেশক প্রয়োগ করা যায়। যেমন, “গিরিডির কয়লাটা ভালো’, “বেহারের মাটিটা উর্বরা’, “এখানে মশাটা বড়ো বেশি’, “ভীম নাগ সন্দেশটা করে ভালো’। কিন্তু শুদ্ধ অস্তিত্ব জ্ঞাপনের সময় এরূপ প্রয়োগ খাটে না; বলা যায় না, “ভীমের দোকানে সন্দেশটা আছে।’
এখানে আর একটি লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, যখন বলা যায় “বেহারের মাটিটা উর্বরা’ বা “ভীমের দোকানের সন্দেশটা ভালো’ তখন প্রশংসা সূচনা সত্ত্বেও “টা’ নির্দেশক ব্যবহার হয় তাহার কারণ এই যে, এই বিশেষ্যপদগুলিতে যে-সকল বস্তু বুঝাইতেছে তাহা পরিমাণে অল্প নহে।
যখন আমরা কর্তৃবাচক বিশেষ্যকে সাধারণভাবে উল্লেখ করিয়া পরিচয়বাচক বিশেষ্যকে বিশেষভাবে নির্দেশ করি, তখন শেষোক্ত বিশেষ্যের সহিত নির্দেশক যোগ হয়। যেমন, “হরি মানুষটা ভালো’, “বাঘ জন্তুটা ভীষণ’।
সাধারণত গুণবাচক বিশেষ্যে নির্দেশক যোগ হয় না– বিশেষত শুদ্ধমাত্র অস্তিত্ব জ্ঞাপনকালে তো হয়ই না। যেমন, আমরা বলি, “রামের সাহস আছে।’ কিন্তু “রামের সাহসটা কম নয়’, “উমার লজ্জাটা বেশি’ বলিয়া উমার বিশেষ লজ্জা ও রামের বিশেষ সাহসের উল্লেখকালে টা প্রয়োগ করি।
ইংরেজিতে ‘this’ ‘my’ প্রভৃতি সর্বনাম বিশেষণপদ থাকিলে বিশেষ্যের পূর্বে আর্টিক্ল্ বসে না কিন্তু বাংলায় তাহার বিপরীত। এরূপ স্থলে বিশেষ করিয়াই নির্দেশক বসে। যেমন,”এই বইটা’, আমার কলমটি’।
বিশেষণপদের সঙ্গে “টা’ “টি’ যুক্ত হয় না। যদি যুক্ত হয় তবে তাহা বিশেষ্য হইয়া যায়। যেমন, “অনেকটা নষ্ট হয়েছে’, “অর্ধেকটা রাখো’, “একটা দাও’, “আমারটা লও’, “তোমরা কেবল মন্দটাই দেখো’ ইত্যাদি।
নির্দেশক-চিহ্ন-যুক্ত বিশেষ্যপদে কারকের চিহ্নগুলি নির্দেশকের সহিত যুক্ত হয়। যেমন, “মেয়েটির’, “লোকটাকে’, “বাড়িটাতে’ ইত্যাদি।
অচেতন পদার্থবাচক বিশেষ্যপদে কর্মকারকে “কে’ বিভক্তিচিহ্ন প্রায় বসে না। কিন্তু “টি’ “টা’-র সহযোগে বসিতে পারে। যেমন, “লোহাটাকে’, “টেবিলটিকে’ ইত্যাদি।
ক্রোশটাক্ সেরটাক্ প্রভৃতি দূরত্ব ও পরিমাণ-বাচক শব্দের “টাক্’ প্রত্যয়টি টা ও এক শব্দের সন্ধিজাত। কিন্তু এই “টাক্’ প্রত্যয়যোগে উক্ত শব্দগুলি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন ক্রোশটাক্ পথ, সেরটাক্ দুধ ইত্যাদি। কেহ কেহ মনে করেন এগুলি বিশেষণ নহে। কারণ, বিশেষ্য ভাবেও উহাদের প্রয়োগ হয়। যেমন, “ক্রোশটাক্ গিয়েই বসে পড়ল’, “পোয়াটাক্ হলেই চলবে’।
যদিচ সাধারণত টি টা প্রভৃতি নির্দেশক সংকেত বিশেষণের সহিত বসে না, তবু এক স্থলে তাহার ব্যতিক্রম আছে। সংখ্যাবাচক শব্দের সহিত নির্দেশক যুক্ত হইয়া বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন, একটা গাছ, দুইটি মেয়ে ইত্যাদি।
বাংলায় ইংরেজি Indefinite article-এর অনুরূপ শব্দ, একটি, একটা। একটা মানুষ বলিলে অনির্দিষ্ট কোনো একজন মানুষ বুঝায়। “একটা মানুষ ঘরে এল’ এবং “মানুষটা ঘরে এল’ এই দুই বাক্যের মধ্যে অর্থভেদ এই– প্রথম বাক্যে যে হউক একজন মানুষ ঘরে আসিল এই তথ্য বলা হইতেছে, দ্বিতীয় বাক্যে বিশেষ কোনো একজন মানুষের কথা বলা হইতেছে।
কিন্তু “একটা’ বা “একটি’ যখন বিশেষভাবে এক সংখ্যাকে জ্ঞাপন করে তখন তাহাকে indefinite বলা চলে না। ইংরেজিতে তাহার প্রতিশব্দ one। সেখানে একটা লোক মানে এক সংখ্যক লোক, কোনো একজন অনির্দিষ্ট লোক নহে।
যেখানে “এক’ শব্দটি অপর একটি বিশেষণের পরে যুক্ত হইয়া ব্যবহৃত হয় সেখানে সাধারণত “টি’ “টা’ প্রয়োগ চলে না, যেমন, লম্বা-এক ফর্দ, মস্ত-এক বাবু, সাতহাত-এক লাঠি।
বলা বাহুল্য, এক ভিন্ন অন্য সংখ্যা সহযোগে যেখানে টি, টা বসে সেখানে তাহাকে Indefinite article-এর সহিত তুলনীয় করা চলে না, সেখানে তাহা সংখ্যাবাচক বিশেষণ।
খানি, খানা প্রভৃতি আরো কয়েকটি নির্দেশক চিহ্ন আছে, তাহাদের কথা পরে হইবে।
বলা আবশ্যক সংস্কৃতের অনুকরণ করিতে গিয়া বাংলা লিখিত ভাষায় নির্দেশক সংকেতের ব্যবহার বিরল হইয়াছে। যাঁহারা সংস্কৃত রীতির পক্ষপাতী তাঁহাদের রচনায় ইহা প্রায় পরিত্যক্ত হইয়াছে। যেহেতু বাংলায় বক্তা ইচ্ছা করিলে কোনো একটি বিশেষ্যপদকে বিশেষভাবে নির্দেশ করিতেও পারেন নাও করিতে পারেন সেইজন্য ইহাকে বর্জন করা সম্ভব হইয়াছে। কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক রীতিকে ত্যাগ করিলে নিশ্চয়ই তাহাকে দুর্বল করা হয়। আধুনিক কালের লেখকগণ মাতৃভাষার সবস্ত স্বকীয় সম্পদগুলিকে অকুণ্ঠিতচিত্তে ব্যবহার করিবার চেষ্টা করিয়া ক্রমশই ভাষাকে প্রাণপূর্ণ ও বেগবান করিয়া তুলিতেছেন তাহাতে সন্দেহ নাই।
ভাদ্র, ১৩১৮