বাংলা প্রাইমারের ধারায় বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়
আবীর কর
তখনও বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। সময়কাল হল ১৮১৬, লঙ সাহেব প্রদত্ত বাংলা ক্যাটালগের তথ্যানুসারে যা বাংলা প্রাইমারের প্রথম প্রকাশকাল হিসেবে চিহ্নিত। ১৮১৬ সালে শ্রীরামপুর মিশনারিরা প্রকাশ করেছিলেন লিপিধারা নামে বর্ণশিক্ষার বই। যদিও এ যাবৎ বইটির কোনও হদিশ মেলেনি, তবে জেমস লঙ-এর তথ্য অনুসারে লিপিধারা নামে ১২ পৃষ্ঠার বইয়ে বাংলা বর্ণের আকৃতি অনুযায়ী ছিল বইটির বর্ণবিন্যাস। অর্থাৎ ভাষাতত্ত্বের পথ মেনে উচ্চারণভিত্তিক নয়, রূপগত বিচারে বর্ণের জ্যামিতিক ফর্ম মেনে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বর্ণ পরিচয়ের প্রথম বইটি। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’, যার প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্যপুস্তক রচনা ও প্রকাশনা। সেই ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে স্টুয়ার্ট সাহেব লিখলেন বর্ণমালা, এই গ্রন্থটিরও উল্লেখ মিলছে লঙ-এর ক্যাটালগ থেকে, লঙ সাহেবের বর্ণনা অনুসারে বর্ণমালা বইয়ের গোড়ায় ছিল বর্ণের পরিচয় পরে ‘ত্র্যক্ষর’ শব্দের বানান। এরপর লঙ-এর ক্যাটালগে যে-বইটির উল্লেখ আছে সেটি রাধাকান্ত দেবের বাংলা বানানের বই। তার বক্তব্য অনুযায়ী বইটি বানান শেখার বই, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫৬। কিন্তু এই বইটি নিয়ে সংশয়ের বিষয় হল এই যে, রাধাকান্ত দেবের আলোচনায় কোথাও এই গ্রন্থটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। সাহিত্য-সাধক চরিতমালা-য় রাধাকান্ত দেব সম্পর্কে আলোচনায় বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১)-এর নাম আছে, যেখানে বিষয় হিসেবে প্রাথমিক বাংলা, বাংলা ব্যাকরণ, ইতিহাস ভূগোল, গণিতের সংকলন লক্ষ করা যায়।
এই গ্রন্থে বাংলা প্রাইমারের বৈশিষ্ট্য হিসেবে লক্ষ করা যায় বাংলা বর্ণের পরিচয়ে বাংলা বর্ণ ও তৎসহ ইংরেজি উচ্চারণ সংবলিত বানানের উল্লেখ, যেমন ক ku, খ kha, গ gn, ঘ ghn এইভাবে ক্ষ khyu-k-shu বর্ণের পরিচয় তথা ইংরেজি উচ্চারণ। সেই বিচারে রাধাকান্ত দেবই প্রথম বাঙালি যিনি তাঁর বাংলা শিক্ষাগ্রন্থ-এ বাংলা বর্ণ পরিচয়ের সূত্রপাত করেছেন। এরপর ১৮২১-১৮৩৪ পর্যন্ত সময়কালটিতে বাংলা প্রাইমারের কোনও খোঁজ মিলছে না। ১৮৩৫ সালে প্রকাশিত হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র বসুর শব্দসার, আর ওই বছরই ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে পড়িবার বই, শ্রীরামপুরের তমোহর প্রেস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে অজ্ঞাত লেখকের বঙ্গ বর্ণমালা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই বইগুলি এখন কালের গর্ভে, পাঠচক্ষুর অন্তরালে।
আমাদের সন্ধানে পাওয়া এযাবৎ কালের প্রাচীনতম বাংলা প্রাইমার গ্রন্থ বালকের প্রথম পড়িবার বহি।১ যার প্রকাশকাল ১৮৩৬, প্রকাশক ‘কলিকাতা ট্রাক/ট্র্যাক সোসাইটি’। বইটিতে বর্ণপরিচয় অংশটি নেই, কিন্তু উনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাংলা প্রাইমারের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য ধরা আছে। বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে আছে ছোট ছোট বাক্য গঠন এবং পরে প্রাথমিক পাঠের আয়োজন। পাঠের বিষয় হল— নীতিশিক্ষা এবং বিদ্যালয়ের সুফল সম্পর্কিত বক্তব্য। এ ছাড়া আছে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারমূলক আখ্যান এবং হিন্দু ধর্মের মূর্তিপূজা সম্পর্কে বিরূপ ব্যাখ্যা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় গ্রন্থের বেশ কিছু বাক্যপাঠ নির্মিত হয়েছে হুবহু বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থে উল্লিখিত বাক্যপাঠের অনুকরণে।
এরপর ১৮৩৯-এ স্থাপিত হল ‘হিন্দু কলেজ পাঠশালা’ এবং ১৮৪০-এ ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’। হিন্দু কলেজ পাঠশালার জন্য প্রাইমার রচিত হল শিশুসেবধি ১ম ভাগ, ২য় ভাগ, লেখক রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ। ওই বছরই ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ থেকে প্রকাশিত হল বর্ণমালা ১ম ভাগ, পরে ১৮৪৪-এ প্রকাশিত হয় বর্ণমালা ২য় ভাগ। ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’র যন্ত্রালয়ে মুদ্রিত বর্ণমালা-র ২য় ভাগটি আমরা প্রত্যক্ষ করি, ড. আশিস খাস্তগীর সম্পাদিত পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত বাংলা প্রাইমার সংগ্ৰহ গ্রন্থ সংকলনে২। লক্ষণীয়, সে-গ্রন্থে তিন, চার এমনকী পাঁচ, ছয় অক্ষর বিশিষ্ট বানানের দীর্ঘ তালিকা এবং তারপর জ/য-কার ভেদে এবং শ/ষ/স-কার ভেদে আরও বাংলা বানান। পাশাপাশি ১৮৪১-এ ‘ক্যালকাটা ক্রিশ্চান স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে প্রকাশ পাচ্ছে জ্ঞানারুণোদয় নামে একটি প্রাইমার। ১৮৪৬ সালে ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ প্রকাশ করছে বর্ণমালা ১ম ভাগ, ২য় ভাগ যথাক্রমে ৩৬ পৃষ্ঠা ২ আনা মূল্য এবং ৫৬ পৃষ্ঠা ১ আনা ২ পাই মূল্য।
উনিশ শতকের বাংলা প্রাইমারের যাত্রাপথে প্রথম উল্লেখযোগ্য বাঁকবদল ঘটল ১৮৪৯ সালে। ১৮৪৯-এ, বেথুন সাহেব প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’। বেথুন সাহেবকে এই ফিমেল স্কুল স্থাপনের ক্ষেত্রে সাহায্য করতে যে যে অল্পসংখ্যক বাঙালি এগিয়ে এলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহপাঠী মদনমোহন তর্কালঙ্কার। তবে তিনি শুধুমাত্র বালিকা বিদ্যালয়ের সহযোগী হয়ে থামলেন না, সেকালের অনেক সামাজিক বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে ওই বালিকা বিদ্যালয়ে ভরতি করলেন তাঁর দুই মেয়েকে। সেই সময় মেয়েদেরকে শিক্ষাদানের অপরাধে সামাজিক বয়কটের মুখে পড়লেন, শুনলেন নানা ব্যঙ্গ-টিটকারি। কিন্তু স্ত্রীশিক্ষার সপক্ষে অবিচল মদনমোহন আরও এগিয়ে, বেথুন সাহেবের ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’-এর জন্য লিখলেন বাংলা প্রাথমিক শিক্ষার বই— শিশুশিক্ষা। যার আখ্যা পত্রিকায় মুদ্রিত হল ‘এতদ্দেশীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ব্যবহারার্থ’।
মদনমোহনের শিশুশিক্ষা হল বাংলা প্রাইমারের ধারায় প্রথম সিরিজ-গ্রন্থ; যার পাঁচটি ভাগ। সম্পূর্ণ ভাবনা মদনমোহনের হলেও এর মধ্যে প্রথম তিনটি ভাগ মদনমোহনের নিজস্ব— শিশুশিক্ষা ১ম ভাগ ১৮৪৯-এ, আর শিশুশিক্ষা ২য় ৩য় ভাগ ১৮৫০-এ প্রকাশিত হয়। সিরিজের ৪র্থ ভাগটি বোধোদয় নামে লেখেন বন্ধুবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর ৫ম ভাগের লেখক রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়; গ্রন্থনাম নীতিবোধ।
মদনমোহনের শিশুশিক্ষা বাংলা প্রাইমারের বিশৃঙ্খল পাঠকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করল, দিল এক সুচারু রূপ। এযাবৎ কাল প্রথমেই ব্যঞ্জনবর্ণ ও পরে স্বরবর্ণের পরিচয়কে তিনি প্রথম বিন্যস্ত করলেন প্রথমে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের পরিচয়দানে। শিশুর প্রথম পাঠকে অনর্থক দীর্ঘ বাক্য এবং সংস্কৃত সন্ধি-যুক্ত শব্দ থেকে রেহাই দিলেন মদনমোহন, পাঠকে করলেন সহজ-সরল। শিশুর প্রথম পাঠে ছিল বিদেশি গল্পের আক্ষরিক অনুবাদ, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানে অকারণে ভিড় করে ছিলেন খ্রিশ্চান-মিশনারিদের নিরাকার ঈশ্বর। মদনমোহন তাঁর শিশুশিক্ষা-য় এইসব জটিল পাঠকে বিদায় দিলেন। নীতিশিক্ষা, সদুপদেশ, সদাচারণ, সহবত শিক্ষার পাঠটি থাকল ঠিকই কিন্তু অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে। শিশুশিক্ষা-র প্রথম ভাগে থাকল বর্ণপরিচয় এবং তার পরীক্ষা, আর শিশুর সম্যক বর্ণপরিচয়ের পর সহজসরল অসংযুক্ত পাঠ। দ্বিতীয় ভাগে যুক্তাক্ষর শিক্ষণ ও বাংলার ছয়টি ঋতু সম্পর্কে পাঠ। আর তৃতীয় ভাগে শিশুদের মনোজ্ঞ বেশ কিছু নীতিগর্ভ আখ্যান। উল্লেখ্য, শিশুশিক্ষা-র রচয়িতা মদনমোহন ছিলেন সেই সময়ের এক প্রতিভাবান কবি, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শিশুশিক্ষা-র তিনটি ভাগেই জড়িয়ে ছিল কাব্যসুষমা, এমনকী গদ্য পাঠের শব্দচয়নেও ছড়ানো ছিল কবিতার সৌরভ। সবমিলিয়ে মদনমোহনের শিশুশিক্ষা তখন ভীষণ জনপ্রিয়, তাই স্বাভাবিকভাবেই ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না শিশুশিক্ষা, ছড়িয়ে পড়ল বাংলার সর্বত্র, পৌঁছে গেল সেই সময়ের নতুন বাংলা শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে।
মদনমোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের শিশুশিক্ষা ১ম ভাগ প্রকাশের ছ’বছর পর, বন্ধুর নির্দিষ্ট পথ ও পন্থাকে অনুসরণ করে, বাংলা প্রাইমারকে আরও ব্যাকরণসম্মত রূপে প্রকাশ করবেন বিদ্যাসাগর। শুরু হবে বর্ণপরিচয়-এর একাধিপত্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মদনমোহন তর্কালঙ্কার আজ বিস্মৃতির অন্তরালে। শিশুশিক্ষা গ্রন্থত্রয় আজ দুষ্প্রাপ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে শিশুশিক্ষা-র সেই অবিস্মরণীয় ছত্র: ‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।’ বা উচ্চারিত হয় ‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল/ কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।’ কবিতাটি ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল শিশুশিক্ষা ১ম ভাগের শেষ পাতে।৩ এই ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতার কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কার। যাঁর হাত ধরে বাংলা প্রাইমারের ক্ষেত্রে সূচিত হয়েছিল এক নতুন প্রভাত।
প্রাইমারের জগতে মদনমোহন তর্কালঙ্কার ১৮৪৯-১৮৫০-এ তাঁর শিশুশিক্ষা ১ম-৩য় ভাগের মধ্য দিয়ে যে প্রভাত বয়ে আনলেন, ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর মশাই সেই পথেই বর্ণপরিচয় ১ম/২য় ভাগের মধ্য দিয়ে সূচনা করলেন এক নতুন দিনের। বদলে গেল প্রাইমারের বৈশিষ্ট্য। বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হল এক নতুন বর্ণ-কাঠামোর, যা ভাষাতত্ত্বের কষ্টিপাথরে যাচাই করা। বর্ণ-শব্দ-বাক্যের ক্রমে এক ব্যাকরণসম্মত প্রাইমার নির্মাণ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বর্ণপরিচয় ১ম ভাগের ‘বিজ্ঞাপন’ তথা গ্রন্থের প্রস্তাবনাতে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্পষ্ট করে দিলেন বাংলা বর্ণমালার ব্যাকরণগ্ৰাহ্য রূপটি। একাধিক বর্ণের যোগ-বিয়োগে বিদ্যাসাগরের হাতে গড়ে উঠল আমাদের মান্য বাংলা বর্ণমালা। প্রথম ভাগের ‘বিজ্ঞাপন’-বক্তব্যটি ছিল—
… বহুকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালাভাষায় দীর্ঘ ঋ-কার ও দীর্ঘ ৯-কারের প্রয়োগ নাই। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণমধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণমধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে। ড ঢ য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ পদমধ্যে অথবা পদান্তে থাকিলে ড় ঢ় য় হয়।… ক ও ষ মিলিয়া ক্ষ হয়। সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ, এজন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।
১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মার কলমে বর্ণপরিচয় ১ম ভাগের নান্দীমুখে এই ‘বিজ্ঞাপন’টি হয়ে উঠল আমাদের প্রচলিত বাংলা বর্ণমালার এক অলঙ্ঘনীয় বিজ্ঞপ্তি। তবে মনে রাখা দরকার বর্ণপরিচয়ের ক্ষেত্রে উনিশ শতকের প্রথমার্ধের প্রাইমার রীতি মেনে প্রথমে ব্যঞ্জন ও পরে স্বরবর্ণের পরিচয়ের পরিবর্তে আমাদের বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিরিখে প্রথমে স্বর ও পরে ব্যঞ্জনবর্ণের এই ক্রমটি সূচিত হয়েছিল শিশুশিক্ষা-য়, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের হাতে। যদিও সংস্কৃতজ্ঞ মদনমোহন ষোলো স্বর আর চৌত্রিশ ব্যঞ্জনের সীমাটিকে মেনে চলেছেন, আর এখানেই ব্যাকরণমনস্ক বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব। তিনি তাঁর ব্যাকরণ প্রজ্ঞাকে মূল করে বাংলা ভাষায় অব্যবহারজনিত কারণে দীর্ঘ ঋ-কার ও দীর্ঘ ৯-কার-কে ‘পরিত্যক্ত’ করেছেন, অনুস্বার আর বিসর্গ এই দুই অযোগবাহ বর্ণকে ব্যঞ্জনবর্ণের মর্যাদা দিয়ে উভয়কে ব্যঞ্জনবর্ণের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, চন্দ্রবিন্দু-কে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ সম্মানে নতুন সদস্য করেছেন ব্যঞ্জন বর্ণমালায়। ড় ঢ় য়-কে অভিন্ন ব্যঞ্জনবর্ণের তালিকায় স্থান দেন, আর ক্ষ বর্ণটি যেহেতু ক এবং ষ মিলে, তাই একে অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থেকে বাদ দেওয়া হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য শিশুর প্রাথমিক বাংলা পাঠকে এই যে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে, প্রথম শ্রেণিতে অসংযুক্ত বর্ণ পরিচয় ও তৎসহ পাঠ এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে সংযুক্ত বর্ণ পরিচয় ও তৎসহ পাঠ—এই বিভাজনটির সূত্রপাত মদনমোহনের শিশুশিক্ষা ১ম ভাগ ও ২য় ভাগে আয়োজিত হলেও বিদ্যাসাগর মশাই গ্রন্থনামের সঙ্গে যথাক্রমে ‘অসংযুক্ত বর্ণ’ ও ‘সংযুক্ত বর্ণ’ শব্দকে মুদ্রিত করে এক পাকাপোক্ত নির্দেশ দিলেন, যেন-বা নির্দিষ্ট করে দিলেন দুই শ্রেণিতে দুই ভাগ পাঠের।
বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার সংযোজন-বিয়োজনে ষোলো স্বর বত্রিশ ব্যঞ্জনের বর্ণমালা হয়ে দাঁড়াল বারো স্বর ও উনচল্লিশ ব্যঞ্জন মিলিয়ে একান্ন বর্ণের সংসার। যদিও তার পরেও বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার ঘটেছে বর্ণপরিচয় ১ম ভাগের ষষ্টিতম সংস্করণে, যার ‘বিজ্ঞাপন’ বক্তব্যটি শিশুশিক্ষার্থীদের বর্ণ উচ্চারণের রীতিনীতি৪ সংবলিত হলেও তার শেষাংশে উল্লেখ আছে— ‘… বাঙ্গালা ভাষায় তকারের ত, ৎ, এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে। দ্বিতীয় কলেবরের নাম খণ্ড তকার। ঈষৎ, জগৎ প্রভৃতি সংস্কৃত শব্দ লিখিবার সময় খণ্ড তকার ব্যবহৃত হইয়া থাকে। খণ্ড তকারের স্বরূপ পরিজ্ঞানের নিমিত্ত বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষার শেষভাগে তকারের দুই কলেবর প্রদর্শিত হইল।’ এই সংস্কারের ফলে বাংলা বর্ণমালার বর্ণ সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল ১২ স্বর + ৪০ ব্যঞ্জন = ৫২ বর্ণ।
যদিও সমকালে কেউ কেউ বিদ্যাসাগরের এই সংস্কারকে ভালভাবে নেননি। কালীপ্রসন্ন ঘোষ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র বিদ্যাসাগরের নির্দিষ্ট বাংলা বর্ণমালা বিন্যাসের বিরোধিতা করেন। কিন্তু সেইসব সমালোচনা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর অবিচল থাকেন আর তাঁর সংশোধিত বাংলা বর্ণমালাটিও অবিকল থাকে। আজ অবধি মোটামুটিভাবে বিদ্যাসাগর-কৃত সেই বর্ণমালাকেই অনুসরণ করে চলেছে তামাম বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ।
১৮৫৫-পরবর্তী উনিশ শতক এমনকী বিশ শতকের প্রথম দুই দশক জুড়ে বাংলা প্রাইমারের নাম ও বৈশিষ্ট্যকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে বিদ্যাসাগর রচিত বর্ণপরিচয়। পরবর্তীকালে অধিকাংশ বাংলা প্রাইমারের গ্রন্থ-নামে জুড়ে গেছে ‘বর্ণপরিচয়’ শব্দটি। নব, নতুন, সহজ, সরল, সচিত্র, নানা বিশেষণে প্রকাশিত হয়েছে বর্ণপরিচয়। উল্লেখ্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়–কৃত সচিত্র বর্ণপরিচয়। আবার একেবারে ‘বর্ণপরিচয়’ নামেই বই প্রকাশ করেছেন অজস্র প্রাইমার রচয়িতারা। ১৮৭৬-এ বিদ্যাসাগর গ্রন্থদ্বয়ের আমূল সংস্কার ঘটালেন। প্রথম ভাগের ষাট এবং দ্বিতীয় ভাগের বাষট্টি তম সংস্করণের পর বর্ণপরিচয়-এর জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখন বিদ্যাসাগরের নাম ও ছবি ভাঁড়িয়ে ‘বর্ণপরিচয়’-এর মুখোশে বিক্রি হচ্ছে জাল বর্ণপরিচয়।
অন্যদিকে বর্ণপরিচয়-পরবর্তীকালে বর্ণপরিচয়-এর বৈশিষ্ট্য থেকে যেসব প্রাইমার স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন বহন করছে, তার মধ্যে উল্লেখ্য যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুসি ১ম ভাগ/১৮৯৭, ২য় ভাগ/১৯০৪। আরও পরবর্তীকালে সহজ পাঠ। হাসিখুসি-তে প্রথম দেখা গেল ছবি ও ছড়াকে মাধ্যম করে বর্ণ পরিচয় করানোর এক নতুন কৌশল। যোগীন্দ্রনাথ মূলত বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় গ্রন্থের বর্ণ পরিচয় অংশে সংশ্লিষ্ট বর্ণ যোগে যেসব শব্দ (অজগর, ইঁদুর, ঈগল, উট…), তাদের ছড়ার ছত্রে ব্যবহার করেছেন। বর্ণপরিচয়-এর মতো আলাদাভাবে শব্দ বানানের শিক্ষণ না রেখে আ-কার, ই-কার…-এর শিক্ষণকেও ছড়ার মধ্য দিয়ে পরিবেশন করলেন। পরিশেষে বর্ণপরিচয়-এর শেষে যে শুধুমাত্র গণিত সংখ্যা তার পরিবর্তে যোগীন্দ্রনাথ ছবিতে অঙ্ক সাজালেন, হারাধনের ‘দশটি ছেলে’র হারানো দিয়ে বিয়োগ এবং ফেরানো দিয়ে যোগ শেখালেন।
প্রাইমারের ধারায় স্বাতন্ত্র্যের অন্যতম দাবিদার নন্দলাল বসু অলংকৃত রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ। সেখানে সম্পূর্ণ বর্ণ পরিচয় নেই; পরিচয়টিকে আরেক বার ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য আছে সুযোগ। সহজপাঠ-এ শব্দ শেখানোর পর্বটিও নেই; ছোট ছোট শব্দযোগে পদ্যবন্ধ শিশুশিক্ষা-র সুরটিকে মনে করায়। সরল বাক্য বা গদ্য পাঠে সে-অর্থে বর্ণপরিচয়-এর কোনও প্রভাব নেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর-কৃত কার-আশ্রিত ধ্বনির ক্রমটি এবং অযোগবাহ বর্ণের ক্রম মেনেই মূলত গদ্য পাঠকে বিন্যস্ত করেছেন দুই ভাগে। অসংযুক্ত ও সংযুক্ত বর্ণের পাঠের এই দুই ভাগের সূত্রপাত মদনমোহনের হলেও তাতে সিলমোহর দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগর শিশুশিক্ষার্থীর যথার্থ বর্ণ পরিচয়ের উদ্দেশ্যে দু’টি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে ‘বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা’ রেখেছেন। বর্ণ পরিচয়ের এই পরীক্ষা বা অনুশীলন বিষয়টির অবতারণা বিদ্যাসাগরের মৌলিক নয়, বর্ণপরিচয় (১৮৫৫)-এর অনেক আগে এই পরীক্ষা/অনুশীলন বিষয়টি লক্ষ করা যায় শিশুসেবধি বর্ণমালা ১ম ভাগ-এ এবং ‘স্কুল বুক সোসাইটি’-র বর্ণমালা ১ম ভাগে, যথাক্রমে ‘বূৎক্রম ব্যঞ্জন’ ও ‘বূৎক্রম স্বর’ শিরোনামে। আর মদনমোহনের শিশুশিক্ষা ১ম ভাগে ওই পরীক্ষা/অনুশীলনকে বর্ণের আকৃতি মেনে বিন্যস্ত করেছেন লেখক স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণকে। উভয়ের শিরোদেশে নির্দেশ: ‘প্রস্তর অথবা কাষ্ঠফলকে নিম্নলিখিত ধারানুসারে বর্ণপরিচয় করাও’। বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণের লেখ্য রূপটি শেখানোর চেয়েও বর্ণের সম্যক পরিচয়দানে এবং শিশুশিক্ষার্থীর বর্ণপরিচয়ের পরীক্ষা গ্রহণে বেশি আগ্রহী।
এবার দেখা যাক বিদ্যাসাগরের শব্দ শিক্ষণের তালিকার তরিকা। একক বর্ণ যোগে শব্দ শিক্ষণে বর্ণপরিচয় (একাদশ সংস্করণ)-এ বানান তালিকা—
বর্ণপরিচয় গ্রন্থটিকে বিদ্যাসাগর বারবার সংশোধিত করেছেন। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ৫৩তম সংস্করণে উক্ত বানান তালিকাটি নিম্নরূপ—
আবার বিদ্যাসাগর-কৃত সংশোধিত ষষ্টিতম সংস্করণে ওই বানান তালিকা হল—
এই সংস্করণগত বানান তালিকা থেকে পাঠক বর্ণপরিচয়-এর এক রূপান্তর তথা বিবর্তন চিত্র পাবেন। এবার দেখা যাক বাংলা প্রাইমারের ধারায় বর্ণপরিচয়-এর এহেন শব্দ শিক্ষণের অবস্থানটি কোথায়। বর্ণপরিচয়-এর পূর্বতন প্রাইমারের মধ্যে উল্লেখ্য শিশুসেবধি বর্ণমালা সংখ্যায় একক বর্ণ যোগে দীর্ঘ বানান তালিকার প্রথমাংশ—
বর্ণপরিচয়-এর একাদশ সংস্করণের সঙ্গে উক্ত বানান তালিকার সাদৃশ্য যথেষ্ট। এই সার সার বানানের ধারায় শিশুশিক্ষা-র অধিকাংশ বানান বিন্যাস ছিল পদ্যবন্ধে। যা শিশুর পাঠাভ্যাসে সুরের মূর্ছনা জাগাত। উল্লেখ্য—
শব্দের এই পুনঃ পুনঃ ব্যবহারের পাশাপাশি অর্থবহ অন্ত্যমিলও রয়েছে—
সংস্কৃত কলেজের সহপাঠী, প্রেস ব্যাবসার সমভাগী, বন্ধুবর মদনমোহনের পদ্যবন্ধের মাধ্যমে শব্দ শেখানোর পদ্ধতিটি বিদ্যাসাগর নেননি। কার আশ্রিতের রূপ ও তার ব্যবহার (আ া ক া কা, ই ি ক ি কি) এবং পরে কার আশ্রিত বর্ণ যোগে ক্রমশ বানান তালিকার যে ব্যাকরণসম্মত রূপটি প্রাইমারে মদনমোহনই প্রথম নির্মাণ করেন, তাকে যথাযথ অনুসরণ করেছেন বিদ্যাসাগর। সচেতনভাবে পদ্যগন্ধটি পরিহার করে শিশুশিক্ষা-র পথ ও পদ্ধতিটি বর্ণপরিচয়-এ অনুসৃত হয়েছে।
বর্ণপরিচয়-এ শব্দ/বানান যে বারে বারে সংশোধিত হয়েছে সে তথ্য ও চিত্র আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, প্রসঙ্গক্রমে আরও জানাই বারংবার মুদ্রণে বানান তালিকাতে প্রয়োজনীয় যোগ-বিয়োগ ঘটিয়ে তাকে যথাযথ রেখেছিলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর মশাই বানান তালিকার এই সংস্কার যে শুধুমাত্র ভাষার বিচারে ব্যাকরণের পথ বেয়ে করেছেন তা নয়, বিষয় বিচারেও শব্দের সংস্কার ঘটাচ্ছেন। ঈশ্বর নামধারী ঈশ্বরচন্দ্র যে ঈশ্বর সম্পর্কে একপ্রকার নিস্পৃহ ছিলেন, এই তথ্য আজ সর্বজনবিদিত, বিষয়টিও বহু আলোচিত। ধর্ম বা ধর্ম সম্বন্ধীয় বিষয়ে বিদ্যাসাগরের নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে বর্ণপরিচয়-এর বানান তালিকাতেও। বর্ণপরিচয়-এর পুরনো সংস্করণে থাকা ধর্ম সম্বন্ধীয় বানানগুলিকে পরবর্তী সংস্করণে বিদ্যাসাগর বিয়োগ ঘটিয়েছেন।
বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের অষ্টম সংস্করণে সংযুক্ত বর্ণ শিক্ষণে কয়েকটি শব্দ বর্তমান যা হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত—
এ ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে লক্ষ্মী, সরস্বতী, পদ্মিনী শব্দগুলি আছে, লক্ষণীয় দ্বিষষ্টিতম সংস্করণে উক্ত শব্দগুলিকেও বিদ্যাসাগর পরিহার করে নিচ্ছেন, শুধু থাকছে ‘কৃষ্ণ’ শব্দটি সম্ভবত ‘কালো’ অর্থে।
শিশুর বাক্য পাঠ বিন্যাসেও বিদ্যাসাগর ব্যাকরণকেই মূল করেছেন, বাংলা ভাষায় ব্যাকরণসম্মত বাক্য গঠনে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়ার ক্রমটি লঙ্ঘিত হয়নি কোথাও, দৃষ্টান্ত—
আমার বই নাই।
তোমার কলম নাই।
যদুর কাগজ আছে।
মধুর ভালো দুয়াত।
নবীনের কালো কাপড়।
ভুবনের ছাতা নাই।
(৯ম পাঠ, বর্ণপরিচয়/১ম ভাগ, ১১ সং.)
অন্যদিকে বর্ণপরিচয়-এর অব্যবহিত পূর্বে মদনমোহন তাঁর শিশুশিক্ষা-য় শব্দ ও বাক্যের শিক্ষণ-প্রণালীতে খুব-একটা প্রভেদ রাখেননি, বর্ণপরিচয়ের পর ছোট ছোট শব্দযোগে বাক্য এবং সে-বাক্যের অধিকাংশতে অন্ত্যমিল ঘটিয়ে শিশুশিক্ষার্থীর পক্ষে উপাদেয় করে তোলার প্রয়াস লক্ষ করি।৫ যদিও শিশুশিক্ষা-তে (১৫ পাঠ – ১৯ পাঠ) সরল গদ্যে বাক্য-পাঠের আয়োজন রেখেছেন মদনমোহন, যে-ধারাটিকে পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর মান্যতা দিচ্ছেন তাঁর বর্ণপরিচয়-এ।৬ আর শিশুশিক্ষা-র পূর্বে একমাত্র শিশুসেবধি-তে স্বতন্ত্র শব্দ/বানান তালিকা এবং বাক্য-পাঠের আয়োজন দেখি, নতুবা সর্বত্রই দীর্ঘ বানান তালিকা এবং তারপর জটিল সন্ধিযুক্ত শব্দে সুদীর্ঘ বাক্য যোগে পাঠ। এর মধ্যে বালকের প্রথম পড়িবার বহি গ্রন্থের বাক্য-পাঠের সঙ্গে বর্ণপরিচয়-এর বাক্য-পাঠের কিছু মিল ধরা পড়ে। পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই—
বালকের প্রথম পড়িবার বহি | বর্ণপরিচয় |
(১ম সং., ১৮৩৬) | (৬০ সং., ১৮৭৬) |
ভাত খাও | ভাত খাও |
খেলা কর | খেলা কর |
কথা কহ | কথা কয় |
বহি পড় | পুথি পড় |
ঘোড়া অতিশয় দৌড়ে | ঘোড়া দৌড়িতেছে |
গরু ঘাস খায় | গোরু চরিতেছে |
পক্ষী উড়িতে পারে | পাখি উড়িতেছে |
এই সাদৃশ্য হয়তো সাধারণ বাক্য গঠনের সাদৃশ্য, অনুকরণ বা অনুসরণ নয়। তবে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের বাক্য-পাঠ যেখানে পাঠে এসে মিলেছে, সেই পাঠ-নির্মাণে বিদ্যাসাগর তাঁর পূর্বজ প্রাইমারগুলির বেশ কিছু বিষয়কে গ্রহণ করেছেন। বিশেষত শিশুশিক্ষা থেকে নীতিশিক্ষার পাঠ, সহবত শিক্ষা, শিশুর নিয়মিত পাঠাভ্যাসের বিষয়গুলি বর্ণপরিচয়-এ সরাসরি গৃহীত হয়েছে।৭ তবে এক্ষেত্রেও মনে রাখা দরকার, উনিশ শতকের বাতাবরণে শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে উক্ত বিষয়গুলিই প্রাধান্য পেয়েছে। খ্রিস্টান মিশনারিদের রচিত প্রাইমারেও নীতিশিক্ষার পাঠ সংযুক্ত ছিল। বিষয় এক হলেও বাক্য গঠনে, বক্তব্যের পরিবেশনে, ভিন্ন ভিন্ন প্রাইমারে ভিন্ন ভিন্ন স্বর শোনা যায়।৮
উল্লেখ্য মদনমোহন ও বিদ্যাসাগর বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন হয়েও উভয় উভয়ের বন্ধু, সেই একইরকম ‘শিশুশিক্ষা’ ও ‘বর্ণপরিচয়’-এর বক্তব্য ভিন্ন হলেও একপ্রকার বিষয়গত মিতালি চোখে পড়ে—
শিশুশিক্ষা / ১ম ভাগ | বর্ণপরিচয় / ১ম ভাগ |
(২য় সং., ১৮৫০) | (১১ সং., ১৮৫৮) |
ভোর হইয়াছে | আর রাতি নাই। ভোর হইয়াছে। |
আর শয়ন করিও না | আর শুইয়া থাকিব না। উঠিয়া মুখ |
এখন মুখ ধোও | ধুই। মুখ ধুইয়া কাপড় পরি। কাপড় |
ঘরের ভিতরে আলো হইয়াছে | পরিয়া পড়িতে বসি। ভাল করিয়া |
পাঠের পুথি হাতে লও | না পড়িলে পড়া বলিতে পারিব না। |
আগে নতুন পাঠ শিক্ষা কর | পড়া বলিতে না পারিলে গুরুমহাশয় |
পরে পুরাতন পাঠ একবার দেখ | রাগ করিবেন। নূতন পড়া দিবেন না। |
পাঠের কালে ভালো বলিতে না | |
পারিলে, এক পাঠিরা উপহাস করিবে, | |
গুরুমহাশয় ভাল বাসিবেন না |
উভয়ের পাঠ-বক্তব্য প্রায় এক, তবু মনে হয় মদনমোহনের বয়ানে শিশুশিক্ষার্থীর প্রতি নির্দেশে আছে নমনীয়তা। আর বিদ্যাসাগরের বয়ান যেন কঠোর অনুশাসনে বাঁধা। উভয়ের বিষয়ের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট সেই সময় বারো মাসেই সকালে পাঠশালা ছিল, আর পাঠশালায় সর্বাগ্রে পৌঁছনো ছিল ভাল শিক্ষার্থীর লক্ষণ। এ ছাড়া প্রভাতবেলা তো সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর পক্ষে সুস্বাস্থ্য ও পাঠাভ্যাসের উত্তম কাল, তাই শিশুকাল থেকেই তাদেরকে এই বিষয়ে (Early rising) সচেতন করার প্রয়াস লক্ষ করা যায়।
বর্ণপরিচয়-এ পাঠের মধ্যে ভীষণভাবে উল্লেখযোগ্য পাঠ হল গোপাল ও রাখালের পাঠ। এই পাঠদ্বয় সম্পর্কে সর্বাগ্রে যে-তথ্যটি জানানো দরকার তা হল পূর্বে গোপাল ও রাখালের পাঠ বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, ছিল দ্বিতীয় ভাগের গোড়ায় য-ফলা পরবর্তী ১ম পাঠ হিসেবে, ‘ঘোষালদের’ গোপালের কথা এবং তারপর র-ফলা ল-ফলা ব-ফলা পরবর্তী ২য় পাঠ হিসেবে ‘সরকারদের’ রাখালের কথা। পরবর্তীকালে কোনও সময়ের (?) কোনও সংস্করণে দু’টি পাঠ-কে বিদ্যাসাগর প্রথম ভাগের শেষে ভাল ও মন্দের আখ্যান স্বরূপ, গোপালের আখ্যানকে ‘১৯ পাঠ’-এ এবং রাখালের আখ্যানকে ‘২০ পাঠ’-এ অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কোন সংস্করণ থেকে এই বিষয়টির বিন্যাস এরকম হল তা স্পষ্ট নয়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত, ড. আশিস খাস্তগীর সম্পাদিত, বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ গ্রন্থে সংকলিত বর্ণপরিচয় ১ম ভাগের একাদশ সংস্করণে (১৮৫৮) গোপাল-রাখালের আখ্যান অনুপস্থিত, আবার উক্ত গ্রন্থে সংকলিত বর্ণপরিচয় ২য় ভাগের অষ্টম সংস্করণে (১৮৫৮) গোপাল ও রাখালের আখ্যান সংযুক্ত। আবার ১৮৬৭-তে বর্ণপরিচয় ১ম ভাগের ২৮তম সংস্করণে গোপাল ও রাখালের আখ্যানটি ১ম ভাগেই সম্পৃক্ত। তা হলে অনুমান করা যায় ১৮৫৮ থেকে ১৮৬৭— এই মধ্যবর্তীকালীন সময়ের কোনও সংস্করণে আখ্যানদ্বয়ের অবস্থানবদল ঘটেছে। গোপাল-রাখালের আখ্যানদ্বয়ের অবস্থানবদলের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত আখ্যানের অল্পবিস্তর পরিবর্তনও ঘটান বিদ্যাসাগর। আমাদের পরিচিত বা প্রচলিত গোপাল-রাখালের পাঠে তাদের কোনও জাতিগত পরিচয় নেই, যা ১৮৫৮-এর সংস্করণে ছিল; যথাক্রমে, ‘ঘোষালদের একটি ছেলে আছে। তার নাম গোপাল’ এবং ‘সরকারদের একটি ছেলে আছে। তার নাম রাখাল।’ আরও আশ্চর্যের ওই ঘোষালদের গোপালের আচার-আচরণ তথা বৈশিষ্ট্য অবশ্যই সুবোধ, কিন্তু সম্পূর্ণ আখ্যানে কোথাও ‘সুবোধ’ বিশেষণটি ছিল না, যা পরবর্তীকালে তাঁর অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে। এই যে ঈশ্বরচন্দ্রের গোপাল ও রাখাল যা ভাল ও মন্দের দুই প্রতিনিধি, এই বিপ্রতীপ আখ্যানের মৌলিকত্ব বিদ্যাসাগরের নয়। এই আখ্যান তাঁর পূর্বে আরও অনেকের কলমে লেখা হয়েছে।
পূর্বজ সেইসব প্রাইমার গ্রন্থে, ‘গোপাল’ নামধারী সবাই ‘সুবোধ’ তথা ভাল বা ‘রাখাল’ নামধারী সবাই অবাধ্য বা ‘মন্দ’, তা হয়তো নয়। নামে তারা ভিন্ন হলেও ভাল ও মন্দের পরাকাষ্ঠা স্বরূপ তারা ভীষণ পরিচিত। এ প্রসঙ্গে ড. আশিস খাস্তগীর তাঁর বাংলা গদ্যে নীতিশিক্ষা গ্রন্থে ‘গোপাল ও রাখাল: ঐতিহ্যের অনুবৃত্তি’ অংশে সন্ধান দিচ্ছেন ‘গোপাল’কে আমরা প্রথম দেখি ‘স্কুল বুক সোসাইটি’র নীতিকথা-২ গ্রন্থে, যার লেখক হলেন জে.ডি. পিয়ার্সন। সেখানে একেবারে ‘গোপাল’ নামের শিশুটি ভাবে-বৈশিষ্ট্যে বিদ্যাসাগরের গোপালের অগ্ৰজ সহোদর। এখানে গোপালের উলটো পিঠে আছে ‘ভোলানাথ’। আর শুধুমাত্র প্রাইমারের ক্ষেত্রে এই ভাল-মন্দের বৈশিষ্ট্যকে সুন্দরভাবে তুলে ধরছেন যিনি, তিনি হলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তাঁর শিশুশিক্ষা ৩য় ভাগ ‘ঋজুপাঠ’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় পাঠের শিরোনামই হল ‘সুশীল শিশুকে সকলে ভালবাসে’ এবং ‘দুরন্ত বালককে কেহ দেখিতে পারে না’। আরও উল্লেখ্য, মদনমোহনের ‘সামা’ ‘বামা’ তো একেবারে ঘোষাল পদবি সহ জাতিতে ও প্রকৃতিতে বিদ্যাসাগরের গোপালের সহোদরা। আর মদনমোহনের অতিশয় ‘অনাবিষ্ট’ বেণী বিদ্যাসাগরের হাতে হয়ে উঠেছে রাখাল।
বর্ণপরিচয় ২য় ভাগেও ভাল-মন্দের বিভাজনে, বেশ কিছু চরিত্র ও তাদের কথাকে নীতিগল্পের আবহে রেখেছেন বিদ্যাসাগর। যেখানে পড়া-প্রেমী সুবোধ বালকের দলে আছে ভুবন, অভয়, যারা খেলা-পাগল নবীন বা যাদবের ডাকে সাড়া দেয় না। আছে রাম, যে গোপালের মতো আপাদমস্তক ভাল। অন্য দিকে খেলা-পাগল রাখালের দলে আছে পড়াশোনায় অমনোযোগী যাদব, নবীন। এ ছাড়া আছে, পড়াশোনায় মনোযোগী কিন্তু চৌর্যবৃত্তির মতো একটি অসৎ গুণের অধিকারী মাধব।
ভাল-মন্দের এই বিপ্রতীপতার বাইরে আরও একপ্রকার চরিত্র বিদ্যাসাগর নির্মাণ করলেন, যেসব পাঠের মধ্যে খুব গভীরে নিহিত আছে গল্পবীজ, যা প্রথম শিক্ষার্থীকে দেয় গল্পের স্বাদ। বিদ্যাসাগরের হাতে গড়া সেইসব চরিত্ররা প্রথমে মন্দ পরে ঘটনাচক্রে সংশোধিত হয়ে ভাল চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। যেমন খেলা-পাগল নবীন যখন উপলব্ধি করে সকলেই ‘কাজের সময় কাজ’ করে ‘খেলার সময় খেলা’ করে তখন তার জাগরণ ঘটে। সে যথার্থই হয়ে ওঠে ‘নবীন’।
আবার কোনওরূপ সংশোধিত হল না যারা, পতনই যাদের অনিবার্য, তারা হল যাদব, মাধব আর হতভাগ্য ভুবন। যাদব অপেক্ষা মাধব, মাধব অপেক্ষা ভুবনের অধঃপতন সাংঘাতিক। খেলা-পাগল যাদব পড়াশোনার প্রতি প্রবল অনীহার কারণে পিতা-মাতার চক্ষুশূল হল, মাধব মেধাবী হয়েও চৌর্যবৃত্তির মতো একটি ‘মহৎ দোষ’-এর কারণে সকলের ঘৃণার পাত্র হল। (এই মাধবের গল্পটি একটু অন্যভাবে মদনমোহনের কলমে লেখা হয়েছে শিশুশিক্ষা-য়, ৩য় ভাগ, ১৮৫০) আর ভুবন তো বড়ই হতভাগ্য। (দশম পাঠ, শিরোনাম: ‘চুরি করা উচিত নয়’) তার চৌর্যবৃত্তিতে অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন স্বয়ং মাসি, এক পিতামাতৃহীন বালক যখন ছোটখাটো চুরির ফাঁদে পা রাখল তখন অভিভাবক মাসি তাকে এই বিষয়ে প্রতিহত না করে নীরব সমর্থক হয়ে থাকলেন। তার পরিণাম হয়ে উঠল বিষময়। ভুবন হয়ে উঠল পাকা চোর। এরপর একাধিক চুরির দায়ে বিচার এবং বিচারে ফাঁসি। নীতিশিক্ষামূলক গদ্যটি এখানে শেষ না হয়ে, এক অভূতপূর্ব বাঁক নিল।৯ ফাঁসির নির্দেশে ভুবনের চৈতন্য হল এবং শেষতম ইচ্ছা হিসেবে সে মাসির সঙ্গে দেখা করল এবং কানে কানে কথা বলার অছিলায় দাঁত দিয়ে মাসির কান কেটে মাসিকে শিক্ষা দিল, ভরা আদালতে। এবং সম্ভবত নিজের ফাঁসির দণ্ডকে আরও ত্বরান্বিত করল।
বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় ১ম/২য়-তে শিশুশিক্ষার্থীর মনে যে-অনুশাসনগুলি প্রবলভাবে গেঁথে দিতে চেয়েছিলেন, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মৌলিক বিষয় হল নিয়মনিষ্ঠ লেখাপড়া ও পড়াশোনা। দ্বিতীয়টি হল পিতা-মাতার বাধ্য হওয়া, এবং তারপর, মিথ্যে কথা না বলা, চুরি না করা, অন্যের মনে আঘাত না দেওয়া, ইত্যাদি। এইসব শিক্ষণই ছিল বিদ্যাসাগর তথা সমকালের প্রাইমার রচয়িতাদের মূল উদ্দেশ্য। বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের কলমে রচিত হয়ে সেইসব নীতিশিক্ষা আরও প্রবল থেকে প্রবলতর হল শিশু তথা সমাজের ভাবে ও ভাবনায়।
বাংলা প্রাইমারের একেবারে গোড়ার দিকে শিশুশিক্ষার্থীকে শুধুমাত্র নীতিশিক্ষা ( যথা— মিথ্যা কথা না বলা, পরের দ্রব্য চুরি না করা, পিতা মাতা ও গুরুজনদের সম্মান করা)-র পাঠই ছিল আর ছিল ধর্মীয় আখ্যান (খ্রিস্টান মিশনারির ক্ষেত্রে নিরাকার ব্রহ্ম, হিন্দু রচনাকারদের ঈশ্বর তথা জগদীশ্বর)। নীতিশিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার গুরুত্ব ও স্বাস্থ্য সচেতনতার পাঠ চালু করলেন মদনমোহন ও পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মদনমোহন তো গদ্যপাঠের পাশাপাশি শিশুশিক্ষার্থীর সম্মুখে এক অসামান্য ‘প্রভাত বর্ণন’ রাখলেন, প্রভাতকালে প্রকৃতির শোভা, তথা দিনমানের কর্মারম্ভে শিশুকে ডাক দিলেন— ‘উঠ শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ/ আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ’। তারপর থেকে উনিশ শতকের প্রাইমারে তো বটেই পরবর্তীকালেও শিশুশিক্ষার্থীর পাঠে প্রভাত তথা ভোরের বিষয়টি হয়ে উঠল আবশ্যক।১০ বিদ্যাসাগরও বিষয়টিকে মান্য করে গদ্য পাঠ রচনা করেছেন, সেই গদ্য পাঠে হয়তো মদনমোহনীয় প্রভাত বর্ণনের স্নিগ্ধতা নেই, সকলি কুসুম কলি ফোটার সৌন্দর্য নেই, মালতী ফুলের সৌরভ নেই, আলোর আনন্দে পুলকিত মন নেই, নেই শীতল বাতাসে শরীর জুড়ানোর উপায়। সেখানে পুরোটাই উত্তমপুরুষের বয়ানে ও অনুশাসনের নিগড়ে বাঁধা। রাত নেই, ভোর হয়েছে, আর শুয়ে থাকা নয়, এবার মুখ ধুয়ে কাপড় পরে, পড়তে বসা। কেননা ‘পড়া বলিতে না পারিলে গুরুমহাশয় রাগ করিবেন। নূতন পড়া দিবেন না।’ এই ভয়ংকর গুরুমহাশয় ও পড়া না-পারার আতঙ্ক, শিশুশিক্ষা-র গদ্য পাঠেও ছিল না। সেখানে খুব জোর, ‘এক পাঠিরা উপহাস করিবে, গুরুমহাশয় ভাল বাসিবেন না’। এর নেপথ্যে উভয় রচনাকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ পড়েছে। এক কবি, পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা ও অন্য এক গদ্যশিল্পী, পাঠ্যপুস্তক প্রণেতার এই পাঠ অর্থাৎ সকালবেলার পাঠাভ্যাস, পাঠশালা, গুরুমহাশয়ের বিষয়টি অনুসৃত হয়েছে শিশুশিক্ষা ও বর্ণপরিচয় পরবর্তী প্রায় সকল প্রাইমারে। বিষয়টির পর্বান্তর ঘটেছে ১৮৯৭ সালে, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাতে, হাসিখুসি প্রথম ভাগে, যেখানে প্রথম লক্ষণীয় শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা কোনওরকম শাসন-অনুশাসনের চাপে নয়, ভয়ংকর গুরুমশাইকে ছুটি দিয়ে সেখানে শিক্ষয়িত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন শিশুর মা। পাঠশালার ঘেরাটোপে নয়, শিশুর বর্ণ পরিচয় তথা প্রাথমিক শিক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে হাসি-খুশির সঙ্গে, বাড়ির সহজসরল পরিবেশে। একটু দেখা-শোনা করা যাক সে-পাঠ—
এই দেখ ঘ আর ঙ চ ছ
(বর্গীয়) জ আর ঝ চিনে শেষে,
ট ঠ ড ঢ চেনো হেসে হেসে।
আর যত বাকি থাকে, হবে তাহা কাল;
সবগুলি চেনা হ’লে, ছবি পাবে লাল!
এই যে মায়ের সান্নিধ্যে হাসি-খুশির সঙ্গে শিশুর বর্ণ পরিচয় তা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হাজারো বাধাবিপত্তির প্রতিকূলে যে স্ত্রীশিক্ষা চালু হয়েছিল, তারই সফল চিত্র হিসেবে ফুটে উঠল উনিশ শতকের শেষ ভাগে, মাকে শিক্ষয়িত্রীর ভূমিকায় পেয়ে; সৌজন্যে হাসিখুসি-র যোগীন্দ্রনাথ। আরও লক্ষণীয় শিশুর শিক্ষণ-প্রণালী। শিশুর এই যে নিঃসংকোচ নির্ভয় পাঠ, সীমিত পড়া এবং তারপর— ‘আর যত বাকি থাকে হবে তাহা কাল/ সবগুলি চেনা হলে ছবি পাবে লাল।’ বক্তব্যে পাঠ-সমাপ্তিতে যে উপহারের প্রতিশ্রুতি— এ উনিশ শতকের প্রাইমারে এক নতুন স্বর ও স্তর। এরপর, আরও কিছুকাল পর, ১৯৩০ সালে সহজ পাঠ-এর মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ শিশুর পাঠ-বিষয়কে নিয়ে যাবেন আরও এক অন্য মাত্রায়।
উনিশ শতক জুড়ে বাংলা প্রাইমারে বিশেষত বর্ণপরিচয়-এ শিশুশিক্ষার্থীর সুষ্ঠু নিয়মিত পাঠাভ্যাসের বড় ব্যাঘাতকারী হিসেবে যা চিহ্নিত হয়েছিল, সেই খেলাধুলাতে যোগীন্দ্রনাথের সায় ছিল, আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর সহজ পাঠ-এর প্রথম ভাগের গদ্যে একেবারে শিশুর দোসর হয়ে প্রস্তাব দিলেন— ‘বেলা যায়। তেল মেখে জলে ডুব দিয়ে আসি। তার পরে খেলা হবে। একা একা খেলা যায় না। ঐ বাড়ি থেকে কয়জন ছেলে এলে বেশ হয়। ঐ যে আসে শচী সেন, মণি সেন, বশী সেন, আর ঐ যে আসে মধু শেঠ আর খেতু শেঠ। ফুটবল খেলা খুব হবে।’— সহজ পাঠ-এর স্বভাব চঞ্চল, কল্পনাপ্রবণ, স্বপ্নের ডানা মেলে ওড়া ছেলেটি আর যাই হোক, বর্ণপরিচয়-এর নির্বান্ধব গোপাল আর গোপালের মতো ‘খানিক’ খেলার পাত্র নয়। বরং সে হল হাবে-ভাবে বেশ কিছুটা রাখাল-ঘনিষ্ঠ, সে-অর্থে সহজ পাঠ হল রাখালদের স্বপ্ন পূরণের হাতছানি।
নিছক নীতিশিক্ষা আর শুধুমাত্র শিশুর পাঠাভ্যাসের সপক্ষে গদ্য/পদ্য পাঠের একাধিপত্যে প্রথম বিষয়ে বৈচিত্র্যের পরিবর্তন আনলেন যোগীন্দ্রনাথ, আর সে-পাঠের অলংকরণে থাকলেন শিল্পী পূর্ণচন্দ্র ঘোষ। পরবর্তীতে সেই বিষয়কে আরও চিত্র-বিচিত্র করে রসসমৃদ্ধ করলেন রবীন্দ্রনাথ, আর পাঠ্য-বিষয়কে সাদা-কালোয় বাঙ্ময় করে তুললেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। বাংলা প্রাইমারের ভাব-ভাষা গেল বদলে।
তারপর থেকে নিয়ত বদল, হাতেখড়ি (১৯৪৮) / বিমলচন্দ্র ঘোষ, অলংকরণে সত্যজিৎ রায়, আদর্শ লিপি ও সচিত্র বর্ণপরিচয় (১৯৫৩) / রাধাকান্ত বসাক, নিজে পড় (১৯৫৬) / সুখলতা রাও, নবপাঠ মুকুল / শ্রীনরহরি ভট্টাচার্য, ছবি ও কথা / দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কিশলয় প্রথম ভাগ / পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ, আমার পাঠ / মহাশ্বেতা দেবী, দেখি শুনি পড়ি লিখি / সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সবুজ পাঠ / সুতপা ভট্টাচার্য, সংসদ বর্ণপরিচয় (২০০৫), আমার বই (২০১২) / পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ… তার পরও বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় আজও বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এক ভরসাস্থল। বর্ণপরিচয়-এর পাশাপাশি হাসিখুসি ও সহজ পাঠ তাদের আলাদা আলাদা অবস্থানে উজ্জ্বল। এর মধ্যে হাসিখুসি শিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক স্বীকৃত না হয়েও তার আপন রঙে-রসে শিশু-স্বীকৃত। তাই বাংলা শিক্ষারম্ভের গোড়ায় ‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে’ বইটি শিশুর বই-ব্যাগে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। আর সহজ পাঠ তো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এমনকী বেসরকারি বাংলা/ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে জানাই ১৯৬৯ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে শিক্ষামন্ত্রী সত্যপ্রিয় রায়ের ঘোষণা অনুসারে ১৯৭০ সালের শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্যের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে সহজ পাঠ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগকে পাঠ্যতালিকায় আনা হয়। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি গেজেট নোটিফিকেশন মারফত সরকার ঘোষণা করে: ‘বাংলা বর্ণ সম্পর্কে অপর্যাপ্ত জ্ঞানসম্পন্ন অনেক ছাত্র-ছাত্রী সহজভাবে সহজ পাঠ অনুসরণ করতে অসুবিধা ভোগ করছে। এই ফাঁক পূরণের জন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে ও পর্যায়ক্রমে বর্ণ পরিচয় এবং বিশেষ করে যুক্তাক্ষর শিক্ষা দেওয়ার উপযোগী সহায়ক পাঠ হিসেবে অন্য পাঠ্যপুস্তক সুপারিশ করা শ্রেয় বিবেচিত হয়।’ এইসময় ১৯৭১ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগকে পাঠ্যতালিকায় আনা হয়। কিন্তু সহজ পাঠ-কে বাতিল করা হয় না। এরপর ১৯৭৭ সালে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার আসার পর ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সহজ পাঠ-কে বাদ দিয়ে নতুন শিশু পাঠ্যগ্রন্থ চালুর কথা ওঠে। শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। একদিকে সহজ পাঠ-এর বিকল্প একটি পাঠ্যগ্রন্থ চালু করার অনমনীয় জেদ, অন্যদিকে ছিল সহজ পাঠ–কে কবি-কৃত এক বিরল শিশু গ্রন্থ প্রমাণের আবেগ। বিতর্কটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
ফিরে আসি বর্ণপরিচয় প্রসঙ্গে। প্রাগুক্ত ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি গেজেট নোটিফিকেশনের পর বর্ণপরিচয় প্রসঙ্গে সরকারিভাবে কোনও বিজ্ঞপ্তির কথা জানা নেই। আর বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ-পরবর্তী এবং ১৯৭১-এর পূর্ববর্তী সময়কালে, বর্ণপরিচয়-এর অবস্থা তথা অবস্থান তো আর এক কাহিনি। সংক্ষেপে বলি, ১৮৭৬-এ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় ১ম ভাগের ষাটতম এবং বর্ণপরিচয় ২য় ভাগের বাষট্টিতম সংস্করণ স্বহস্তে করে গেছেন। ওই সংস্করণ দু’টিকেই প্রামাণ্য হিসেবে ধরা হয়। তারপর আরও ১৫ বছর কাল বিদ্যাসাগর বেঁচে, ওই সময় বর্ণপরিচয় গ্রন্থদ্বয়ের পুনর্মুদ্রণ চলেছে এবং মুদ্রণ সংখ্যা বেড়েছে উত্তরোত্তর। ১৮৯১-এ ঈশ্বরচন্দ্রের প্রয়াণের পর বিদ্যাসাগর-পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁকে বিদ্যাসাগর অনেক আগেই যারপরনাই ‘যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী’ জ্ঞানে ত্যাজ্য পুত্র করেছেন এবং তাঁর উইলে কোনওরকম প্রাপ্য রেখে যাননি, সেই নারায়ণ হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে আদালতের শরণাপন্ন হলেন এবং ১৮৯২ সাল নাগাদ মূল উত্তরাধিকারীর অধিকার আদায় করলেন। এরপর আইনি অধিকারবলে নারায়ণ, বিদ্যাসাগর তাঁর উইলে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মাসোহারার ব্যবস্থা করেছিলেন তা অস্বীকার করলেন। বিদ্যাসাগরের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সহ বিদ্যাসাগর রচিত বইপত্রের দখল নিলেন। ১৮৯৬ নাগাদ বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় গ্রন্থদ্বয়ে হস্তক্ষেপ ঘটল নারায়ণের। এবং ওই হস্তক্ষেপের কালে বর্ণপরিচয়-এ সচিত্র অনুপ্রবেশ ঘটল অ-য়ে অজগর, আ-য়ে আম, ক-য়ে কোকিল, খ-য়ে খরগোশ…।১১ কিন্তু খুব বেশি দিন নারায়ণ বর্ণপরিচয়-কে তাঁর দখলে রাখতে পারলেন না, বিদ্যাসাগরের ইচ্ছাপত্র অনুসারে যাঁরা মাসোহারা পেতেন সেই বৃত্তিভোগীরা ১৯০৪ সাল নাগাদ আদালতের শরণাপন্ন হলেন। আদালতের নির্দেশ এল, বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি বন্ধক রেখে এবং গ্রন্থস্বত্ব থেকে মাসোহারা- ভোগীদের টাকা মিটিয়ে দিতে। সেইমতো রিসিভার নিযুক্ত হন হাইকোর্টের অ্যাটর্নি জ্যোতিষচন্দ্র মিত্র। পরবর্তীকালে রিসিভার হন ব্যারিস্টার প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী। বিদ্যাসাগরের সম্পত্তি ও গ্রন্থস্বত্ব বন্ধক রেখে কিছুদিন বৃত্তিভোগীরা তাঁদের প্রাপ্য অর্থ পেলেও একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। ততদিনে নারায়ণ-সংশোধিত বর্ণপরিচয়-এর রিসিভার সংস্করণ প্রকাশিত। একসময় বন্ধক রাখা সম্পত্তি ছাড়ানোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে পাঠ্যপুস্তকগুলির স্বত্ব বিক্রির জন্য ডাকা হল নিলাম। সেখানে সর্বোচ্চ দর হেঁকে বইগুলির স্বত্ব অধিকার করেন আশুতোষ দেব, যিনি এ. টি. দেব নামে অধিক পরিচিত। এরপর গ্রন্থস্বত্বের নিয়মানুসারে এ. টি. দেবের স্বত্বাধিকারীর মেয়াদ ফুরোলে যে-কোনও প্রকাশন সংস্থাই বর্ণপরিচয় প্রকাশের যথেচ্ছ স্বাধীনতা পেয়ে যান।
সেই সময় থেকে বর্ণপরিচয় হরেক বর্ণের প্রকাশন সংস্থা থেকে নানারকম পরিচয়ে প্রকাশিত। এর একটি ধারা হল বিদ্যাসাগর-কৃত প্রথম ভাগের ষাটতম এবং দ্বিতীয় ভাগের বাষট্টিতম সংস্করণটিকে প্রামাণ্য রেখে প্রকাশিত বর্ণপরিচয়। এই ধারায় আবার ‘নন্দন সংস্করণ’ ‘নির্মল সংস্করণ’ নানা নামে বিদ্যাসাগরের সাধুভাষাকে বদলে সময়োপযোগী চলিত করা হয়েছে। অন্য একটি ধারা হল নারায়ণের দ্বারা ব্যাপক সংস্কারে আমূল বদলে যাওয়া সাদা-কালো চিত্র যোগে বর্ণপরিচয়, যা পরবর্তীতে রিসিভার সংস্করণ, নিলামে এ.টি. দেব এবং পরবর্তীতে দেব সাহিত্য কুটিরেরই প্রবোধচন্দ্র মজুমদার এন্ড ব্রাদার্স দ্বারা প্রকাশিত হয়ে চলেছে। আর এই উভয় ধারাকে অগ্রাহ্য করে বর্ণপরিচয়-এর আরও একটি ‘ভয়ানক ধারা’ আজও রমরমিয়ে চলছে, বিশেষত গ্রামে-গঞ্জে-মফস্সলে, তা হল ‘জাল বর্ণপরিচয়’। যার সূত্রপাত হয়েছিল বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতেই,১২ সেই সময় বর্ণপরিচয়-এর বিপুল জনপ্রিয়তায় লুব্ধ হয়ে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা বিদ্যাসাগরের ছবি ও নাম ভাঁড়িয়ে ব্যাবসা চালিয়ে যায়, সেই ধারা আজও অব্যাহত। সচেতন পাঠক খেয়াল করলেই সুলভে পাবেন বিদ্যাসাগরের নাম ও পদবি যুক্ত গোলাপি মলাটের ‘বর্ণপরিচয়’, যার মলাট পাতায় লেখা “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পথাবলম্বনে” অমুকচন্দ্র অমুক! এইসব নানা বর্ণের নানা বর্ণপরিচয় শিশুর বইবাজারে ছেয়ে আছে।
তারও পরে, এখনও, বিদ্যাসাগরের নামে বর্ণপরিচয় গ্রন্থ বাঙালির মনে ভরসা জোগায়। শিক্ষিত সচেতন বাঙালি জানেন এখন বর্ণপরিচয় সাত নকলে আসল খাস্তা তবুও তার ভরসা বিদ্যাসাগরের তৈরি করা ওই বর্ণ-শব্দ-বাক্য ও পাঠের যে-ক্রম সেই তরিকাটিতে।
বর্ণপরিচয়-এর পর প্রাইমারে নানা বিষয়বৈচিত্র্য এসেছে, উন্নত থেকে উন্নততর ছাপাখানার দাক্ষিণ্যে বই হয়ে উঠেছে শিশুর মনের মতো রঙিন। কিন্তু সেখানে শিক্ষণের সেই বিদ্যাসাগরীয় আঁটুনিটি নেই, নেই পাঠের সেই শৃঙ্খলা। বিদ্যাসাগর সচেতনভাবেই ছবি ও ছড়ার তারল্যে চুবিয়ে দেননি বর্ণপরিচয়-কে। বর্ণপরিচয় যেন তার রচনাকারের মতোই ঋজুরেখ বৈশিষ্ট্যে স্থিতপ্রজ্ঞ, স্বীয় সিদ্ধান্তে অটল। ক্রমাগত নকল হতে হতে মূল হারিয়ে গেলেও বিদ্যাসাগরের নাম-মাহাত্ম্য বর্ণপরিচয়-এর নাম-গুণে এখনও বাঙালির মনে পাকাপোক্ত জায়গা করে রেখেছে। বাঙালি শিশুর ‘হাতেখড়ি’-র উৎসবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় হয়ে উঠেছে বাংলা ও বাঙালির পরম্পরা।
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. উনিশ শতকের বিস্মৃত বাংলা প্রাইমার, সংকলন ও সম্পাদনা: আবীর কর, পরশপাথর প্রকাশন, ২০১৪।
২. বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ (১৮১৬-১৮৫৫), সম্পাদনা: আশিস খাস্তগীর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০৬।
৩. মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘প্রভাত বর্ণন’ কবিতাটি একসময় বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের শেষে সংকলিত হয়। তারপর দ্বিষষ্টিতম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্মা সেই অংশকে ‘নিষ্কাশিত’ করেন; কিন্তু কোন সময় থেকে তা গ্রন্থে সংযোজিত হয়েছিল তা জানা যাচ্ছে না। বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ গ্রন্থে সংকলিত অষ্টম সংস্করণের দ্বিতীয় ভাগেও কবিতাটি সংযোজিত হয়নি, অর্থাৎ হয়েছে তারপর।
৪. বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় গ্রন্থের বয়ানে ও বিন্যাসে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন শিশুশিক্ষার্থীর সম্যক বর্ণ পরিচয়ে এবং সঠিক উচ্চারণে। এই প্রসঙ্গে বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ষাটতম সংস্করণের বিজ্ঞাপন-বক্তব্যটি উল্লেখ্য: ‘… প্রায় সর্বত্র দৃষ্ট হইয়া থাকে বালকেরা অ আ এই দুই বর্ণস্থলে স্বরের অ, স্বরের আ বলিয়া থাকে। যাহাতে তাহারা সেরূপ না বলিয়া কেবল অ আ এইরূপ বলে তদ্রূপ উপদেশ দেওয়া আবশ্যক।…’ শুধু তা-ই নয় বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগের অষ্টম সংস্করণের ‘৫ পাঠ’ অংশে ছিল: ‘যখন যে শব্দ উচ্চারণ করিবে স্পষ্ট করিয়া উচ্চারণ করিবে। স্পষ্ট উচ্চারণ না করিলে কেহ বুঝিতে পারিবে না।’
৫. বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের একাদশ সংস্করণ এবং দ্বিতীয় ভাগের অষ্টম সংস্করণ হল এযাবৎ সন্ধানে আসা সর্বাধিক পুরনো সংস্করণ। উক্ত বর্ণপরিচয় গ্রন্থদ্বয় ২০০৬ সালে, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত, আশিস খাস্তগীর সম্পাদিত বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ-এ আরও বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য বাংলা প্রাইমারের সঙ্গে সংকলিত।
সেই সময়ের আকাদেমি সচিব সনৎকুমার চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে জানা যায়, বাংলা আকাদেমির তৎপরতা এবং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সক্রিয় সহযোগিতায় বর্ণপরিচয়-এর দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থদ্বয় লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে এনে, উক্ত সংকলন গ্রন্থে ফ্যাকসিমিলি ছাপা হয়।
সম্প্রতি, বিজ্ঞাপনে যথেষ্ট সাড়া জাগিয়ে একটি বই বাজারে এসেছে, ‘পূর্বা প্রকাশন’ থেকে প্রকাশিত ‘শ্রীঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত।/ বর্ণপরিচয়/ বিলুপ্ত প্রথম ও শেষ সংস্করণের দুর্লভ পাঠ উদ্ধার/ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য/ সম্পাদিত’। প্রচ্ছদপটে ‘বিলুপ্ত প্রথম ও শেষ সংস্করণের দুর্লভ পাঠ উদ্ধার’ বাক্যবন্ধটি যথেষ্ট বিভ্রান্তিকর। কেননা গ্রন্থমধ্যে আমরা যা পাই তা হল শ্রীযুক্ত বিনয়ভূষণ রায়ের সৌজন্যে প্রাপ্ত বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়-এর তিপ্পান্নতম সংস্করণটিকেই প্রথম সংস্করণ প্রমাণ করার এক অন্যায্য প্রয়াস। আর ‘শেষ সংস্করণ’ বলতে ‘বর্ণপরিচয়’ প্রথম ভাগের ‘ষষ্টিতম সংস্করণ’, যার কোনওটিকেই কোনওভাবে ‘দুর্লভ’ আখ্যা দেওয়া যায় না আর ‘প্রথম আবিষ্কৃত’ কথাটি তো একেবারে অর্থহীন। উভয় সংস্করণই যথেষ্ট সহজলভ্য ও কম-বেশি সবার কাছেই পরিচিত।
এ ছাড়াও পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানাই, ২০০৬ সালে প্রকাশিত বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ-এ সংকলিত একাদশ সংস্করণটি সম্পর্কে সম্পাদক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য আশ্চর্যরকমভাবে নীরব থেকেছেন। তার বক্তব্য প্রথম সংস্করণ থেকে উনষাটতম সংস্করণে বিদ্যাসাগর কোনও সংস্কার ঘটাননি, তা শুধুই পুনর্মুদ্রণ। তাই তিপ্পান্নতম সংস্করণটি হল প্রথম সংস্করণ। আমরা যদি লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত একাদশ সংস্করণটিকে সম্পাদক-সদৃশ বিস্মৃত হই তাতেও তিপ্পান্নতম সংস্করণকে কিছুতেই প্রথম সংস্করণ বলা যায় না। যুক্তিসম্মতভাবে তা হল তিপ্পান্নতম মুদ্রণ। অন্যদিকে বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ-এ সংকলিত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের একাদশ সংস্করণ এবং দ্বিতীয় ভাগের অষ্টম সংস্করণ হল এখনও পর্যন্ত সন্ধানে আসা সর্বাধিক পুরনো সংস্করণ।
৬. শুধু যে শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগে পদ্যবন্ধের বিন্যাস আছে তা নয়, দ্বিতীয় ভাগে সংযুক্ত ব্যঞ্জনের শিক্ষাদানেও আছে: গ্য— আরোগ্য সুখের মূল। চ্য— কুবাচ্য কথার শূল। ত্র— মিত্রসম পাত্র নাই। দ্র— ভদ্রলোক কোথা পাই। ইত্যাদি।
৭. শিশুশিক্ষা: কদাচ মিছা কথা কহিও না। পাঠের সময় গোল করিও না। বিবাদ করা ভাল না। বর্ণপরিচয়: কখনও মিছা কথা কহিও না। পড়িবার সময় গোল করিও না। কাহারও সহিত ঝগড়া করিও না।
৮. শিশুশিক্ষা: বেলা হইল। পড়িতে চল। পুথি লও। পাঠশালায় চল। পাঠের কালে ভাল বলিতে না পারিলে, একপাঠিরা উপহাস করিবে। গুরুমহাশয় ভালবাসিবেন না। বর্ণপরিচয়: বেলা হইল। পড়িতে চল। তোমার বই কোথা। এস যাই আর দেরি করিব না। পড়া বলিতে না পারিলে গুরুমহাশয় রাগ করিবেন।
শিশুসেবধি: পিতা মাতা গুরু প্রতি শ্রদ্ধা কর। বর্ণমালা: পিতা মাতাকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করা ও তাহাদের কৃত শাস্তি সহা ভাল বালকের নিদর্শন। শিশুশিক্ষা: পিতার কথা শুনিবে/ মাতার সেবা করিবে। বর্ণপরিচয়: কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইও না। তাহারা যখন যাহা কহিবেন তাহা করিবে। কখন তাহার অন্যথা করিও না। পিতামাতার কথা না শুনিলে তাঁহারা তোমায় ভালবাসিবেন না। বাংলা গদ্যে নীতিশিক্ষা, আশিস খাস্তগীর, পুস্তক বিপণি, ২০০৪, পৃ. ১৪৫।
৯. ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’ শিরোনামের গল্পটিকে অনেকে বাংলা ভাষার প্রথম ছোট গল্প আখ্যা দিয়েছেন, যদিও গল্পটি ঈশপের গল্প অবলম্বনে রচিত, তা হলেও প্রথম শিক্ষার্থীর কাছে এ নিঃসন্দেহে এক ছোট গল্প।
১০. ‘প্রভাত বর্ণন’ অনুসারে বর্ণপরিচয়-এ কোনও প্রভাতমূলক কবিতা নেই, আছে গদ্য পাঠ। কিন্তু পরবর্তীতে মদনমোহনের জামাতা, যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শিক্ষা সোপান গ্রন্থে, সাতকড়ি দত্ত তাঁর প্রথম পাঠ গ্রন্থে প্রভাত বেলার কবিতা সংযুক্ত করেছেন। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ-এও দেখি ভোরবেলাকার দৃশ্যরূপ— ‘আলো হয়/ গেল ভয়’ বা ‘কালো রাতি গেল ঘুচে/ আলো তারে দিল মুছে।’
১১. বর্ণ সমন্বিত শব্দগুলি সম্ভবত বিদ্যাসাগর মহাশয় বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ ষাটতম সংস্করণের কালে সংযুক্ত করেন, কেননা তিপ্পান্নতম সংস্করণেও কোনও শব্দ দৃষ্টান্ত নেই। আর ১৮৯৬ নাগাদ বর্ণপরিচয়-এ শব্দের চিত্ররূপ ব্যবহৃত হল বিদ্যাসাগর-পুত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে।
১২. বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশাতে, অনুসন্ধান পত্রিকার ৩০ অগ্ৰহায়ণ, ১২৯৬, তারিখের সংবাদে এই বিষয়টি উল্লিখিত হয়। যদিও এই জুয়াচুরির সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের কোনও প্রতিক্রিয়া আমরা পাই না।