মৌলবাদীরা অশোভন, অযৌক্তিক, অগণতান্ত্রিক দাবি করবেই। তাদের দাবিকে গুরুত্ব দেবে না সরকার, শিল্পী সাহিত্যিক, সুস্থ-সচেতন মানুষ। তাই তো হওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা দেশে মৌলবাদীদের গুরুত্ব বুদ্ধিজীবীদের চেয়েও বেশি। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি না। বলছি বাংলা সাহিত্যের মুরুব্বির কথা। বাংলা সাহিত্যের মুরব্বি বাংলা একাডেমি গুরুত্ব তো দিয়েছেই, রীতিমত মাথায় বসিয়েছে মৌলবাদীদের। যাদের কাজ লেখক ও প্রকাশককে নির্ভাবনায় রাখা, নিরাপত্তা দেওয়া, তারাই কিনা শাস্তি দিচ্ছে ওঁদের। খুব বিচ্ছিরি শাস্তি।
রোদেলা প্রকাশনীটির গায়ে বোরখা পরিয়ে দিয়েছে বাংলা একাডেমি। রোদেলা প্রকাশনী থেকে বের হওয়া একটি বইকে নাকি বোরখাপক্ষের লোকদের চোখে বড় বেআব্রু ঠেকেছে। মৌলবাদীরা যারা সন্ত্রাস করে, কল্লা ফেলে দেওয়ার বা মুণ্ডু কেটে নেওয়ার হুমকি দেয়, তারা কি সত্যিই কোনও বই পড়ে? আমার কিন্তু মনে হয়না। যদি পড়েই, বড়জোর ধর্মগ্রন্থ পড়ে। তাদের কাছে কোন বইকে কী ঠেকলো, তার গুরুত্ব, আমরা যারা মৌলবাদের বিপক্ষের লোক, দিই কেন? যেহেতু ওরা খুব নোংরা লোক, ভয়ংকর লোক, হিংস্র লোক, হাসতে হাসতে মানুষের গলা কেটে ফেলে, হাসতে হাসতে মানুষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে? এর সমাধান কি তাহলে এইসব লোকের সামনে আমাদের নতজানু হওয়া, এইসব লোকের অন্যায়কে নির্বিচারে মেনে নেওয়া, নাকি রুখে দাঁড়ানো?
বাংলা একাডেমি কেন বোরখা পরালো রোদেলার গায়ে? কী ঘটেছে এবারের বইমেলায়? যা শুনলাম, তা হল: ‘রোদেলা প্রকাশনী’ থেকে ইরানের মুক্তচিন্তক আলি দস্তির ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’ বইটির অনুবাদ বেরিয়েছিল। কিন্তু অনুবাদ-বইটি প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মুসলিম মৌলবাদীদের তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। বাংলাবাজার এলাকায় প্রকাশনীর অফিস ওরা ভাঙচুর করেছে, অফিসের দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছে এদিকে বইমেলায় মৌলবাদীদের আদেশ মাথা পেতে বরণ করে নিয়েছে বাংলা একাডেমি। কোথায় দুঃসময়ে রোদেলার পাশে দাঁড়াবে, তা নয়, রোদেলা প্রকাশনীর স্টলই বন্ধ করে দিল।
ঢাকার একুশে বইমেলা বাংলা একডেমির তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। তারাই স্টল বন্ধ করার এবং খোলার কর্তা। বাংলাবাজারে রোদেলার অফিস আর বইমেলায় রোদেলার স্টল বন্ধ। লেখক অনেক আগেই মরে বেঁচেছেন। মৌলবাদীদের ভয়ে অনুবাদক এবং প্রকাশক এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
বইটির অনুবাদক আমাকে জানালেন, ‘বাজারে মুহাম্মদের জীবনীর নামে আছে কিছু স্তুতিগাথা সর্বস্ব পুঁথি। মোল্লাদের দাবি অনুযায়ী মুহাম্মদের শুধু প্রশংসা করতে হবে, কোনও সমালোচনা নয়?’ আমি খানিকটা বিস্মিত হই। অনুবাদক কি জানেন না যে মুহাম্মদের সমালোচনা করার অধিকার কারওর নেই! সমালোচনা করলে তাকে মেরে ফেলা হয়! মুহাম্মদ বেঁচে থাকতেও তাই করতেন। নিন্দুকদের জন্মের মতো সরিয়ে দিতেন।
বইয়ের ভূমিকাটি আমি পড়েছি। ওটি পড়লে মানুষের বুঝতে সুবিধে হতো ওতে মূলত কী আছে। কিন্তু পাঠককে বইটি তো নয়ই, বইটির ভূমিকাটিও পড়তে দেওয়া হচ্ছে না। ভূমিকাটি পড়ে আমার কিন্তু মনে হয়নি বইটি মুহাম্মদের নিন্দেয় ভর্তি। আলি দস্তি মনে করতেন, ভূমিকায় যা লেখা তা থেকেই বলছি, ‘মানুষ তার দক্ষতা, কৌশল, বুদ্ধিমত্তা আর পরিশ্রম দিয়ে অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হয়, তখন তার অসাধ্য সাধনকে অলৌকিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নবি মুহাম্মদও এক অর্থে অসাধ্য সাধন করেছেন। প্রায় একা একজন মানুষ অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আর কৌশল অবলম্বন করে নিজ জাতির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে প্রচণ্ড লড়াই করে নিজস্ব ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেছেন। অসংখ্য মানুষের ধর্মমতের বিলোপ ঘটিয়েছেন। নবী মুহাম্মদের এই ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিশাল কর্মযজ্ঞ কোনও অর্থেই ‘অলৌকিকতা’র মহিমা থেকে খাটো নয়।’
রোদেলা প্রকাশনীর বইটির বিরুদ্ধে সরকারি নিষেধাজ্ঞার দরকার হয়নি। কারণ সরকারের সম্মতিতে বা ইশারায় বাংলা একাডেমিই নিষেধাজ্ঞাটি আরোপ করেছে। সরকারের ওদিকে মাথা না ঘামালেও চলবে। দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি বা একাডেমি যদি এখন থেকে সরকারের রোলটা প্লে করে, তাহলে মুক্তচিন্তার কাঠগড়ায় সরকারকে না দাঁড়ালেও চলে। মনে আছে, সৈয়দ শামসুল হক আমার ‘ক’ বইটির প্রচার বিক্রি ইত্যাদি বাংলাদেশের হাইকোর্টকে দিয়ে স্থগিত করিয়েছিলেন আজ প্রায় বারো বছর আগে। বইটি এখনও আইনত নিষিদ্ধ। সৈয়দ হক সরকারের হয়ে বই নিষিদ্ধ করার কাজটি করেছিলেন।
সবচেয়ে দুঃখের এবং বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, রোদেলার ঘটনায় রোদেলার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি আমি। আমার সব বই বইমেলা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নিয়েছে আমার বইয়ের প্রকাশক ‘আগামী প্রকাশনী’। নাকি বাংলা একাডেমী আমার বই সরিয়ে নিতে ওদের বলেছে! এখনো জানি না। আজকাল কোনও দুর্ঘটনাই, বিশেষ করে সে দুর্ঘটনা যদি আমার জীবনে ঘটে, আমাকে খুব বিস্মিত করে না।
মৌলবাদীরা তো এবছর আমার বই নিয়ে বিক্ষোভ দেখায়নি! ইসলাম বা আল্লাহ-মুহাম্মদ নিয়েও আমার কোনও বই নেই, তবে আমার কেন কোনও রেহাই নেই ! কতকাল আমাকে এসব নিষেধাজ্ঞা নির্যাতন নির্বাসন পোহাতে হবে! মনে হচ্ছে, যতদিন বেঁচে থাকি ততদিন। কারও কারও জীবন এমন, হায়েনার খাদ্যের মতো। আমার জীবনটা ধীরে ধীরে সমাজের হায়েনাদের খাদ্যবস্তু হয়ে উঠেছে। আমার পক্ষে এই জীবনটাকে রক্ষা করা বোধহয় আর সম্ভব নয়।
২২ বছর আগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে যে বইমেলা হতো, সেখানে আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছিল, আমার বই পোড়ানো হয়েছিল, আমি যে স্টলে বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলাম সেই স্টল ভেঙে ফেলা হয়েছিল। সেদিন ওই বই পোড়ানো নারীবিরোধী-মৌলবাদী কুচক্রি লোকদের অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে তাদের হাতে হাত রেখে বাংলা একাডেমি আমাকে শাস্তি দিয়েছিল। বইমেলায় ঢোকা আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। নিষিদ্ধ করেছিল মহান বাংলা একাডেমি। আজ আমার মনে হচ্ছে, সেদিন মৌলবাদীদের পক্ষ না নিয়ে লেখকের পক্ষ যদি নিতো বাংলা একাডেমি, তাহলে মৌলবাদীদের এই দানবীয় শক্তি জুটতো না, যে শক্তি আজ জুটছে, যে শক্তি দিয়ে আলি দস্তির বইটিকে আজ আলোর মুখ দেখতে বাধা দিচ্ছে।
যত তুমি আপস করবে শত্রুর সঙ্গে, তত তুমি শত্রুকে শক্তিমান করবে। আজ আপস করলো বাংলা একাডেমি, তার ফল ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই পাবে। মৌলবাদীরা কান ধরে ওঠ বস করতে বললে সেটিও একদিন বাংলা একাডেমিকে করতে হবে।