বাংলা অর্থসহ সংস্কৃত স্তব
প্রথম স্তব
ব্রহ্মা কর্ত্তৃক দেবীর স্তব (শ্রীশ্রীচণ্ডী ১.৫৪-৬৭)
ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা
সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধামাত্রাত্মিকা স্থিতা॥৫৪
হে ব্রহ্মস্বরূপে! হে নিত্যে! তুমি দেবগণের হবির্দান-মন্ত্র (যজ্ঞে ঘৃত আহুতি দেওয়ার সময় যে মন্ত্র বলা হয়) স্বাহা স্বরূপা; তুমি পিতৃগণের উদ্দেশে প্রদানমন্ত্র (পিণ্ডদানের মন্ত্র) স্বধা-স্বরূপা; তুমিই বষট্কার (যজ্ঞে দেবতাদের আহ্বানমন্ত্র) ও অকারাদি স্বরবর্ণ; হে দেবি তুমি সুধা স্বরূপা; তুমিই বর্ণসমূহে হ্রস্ব-দীর্ঘ-প্লুতরূপ মাত্রাত্রয়-রূপা।
অর্দ্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্য্যা বিশেষতঃ।
ত্বমেব সা ত্বং সাবিত্রী ত্বং দেবী জননী পরা॥৫৫
যে অর্দ্ধমাত্রার উচ্চারণ বিশেষরূপ হয় না, তুমিই সেই অর্দ্ধমাত্রারূপে স্থিতা। হে দেবি! তুমিই সেই প্রসিদ্ধ গায়ত্রী-স্বরূপা। হে দেবি! তুমিই সেই সর্ব্বোৎকৃষ্টা জগজ্জননী প্রকৃতিস্বরূপা।
ত্বয়ৈব ধার্য্যতে সর্ব্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্ব্বদা॥৫৬
হে দেবি! তুমিই এই জগতের সৃষ্টি করিতেছ, তুমিই ইহাকে ধারণ করিতেছ, তুমিই ইহাকে পালন করিতেছ এবং প্রলয়কালে তুমিই এই জগৎকে গ্রাস করিয়া থাক।
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোঽস্য জগন্ময়ে॥৫৭
তুমি সর্গকালে (উৎপত্তির সময়) সৃষ্টিরূপা, তুমি পালনে স্থিতিরূপা, এবং হে জগন্ময়ি! এই জগতের বিনাশকালে তুমিই সংহাররূপা।
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ।
মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী॥৫৮
হে দেবি! তুমি মহাবিদ্যা, তুমি মহামেধা, তুমি মহামায়া, তুমি মহাস্মৃতি; হে দেবি! তুমি মহামোহ-জনিকা মহাদেবী এবং মহাসুরী।
প্রকৃতিস্ত্বঞ্চ সর্ব্বস্য গুণত্রয়বিভাবিনী।
কালরাত্রিমহারাত্রির্ম্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা॥৫৯
হে দেবি! তুমি সত্ত্ব-রজস্তমোগুণ স্বরূপে সকল চরাচরেরই প্রকৃতি। তুমি কালরাত্রি অর্থাৎ ভয়ঙ্কর যমস্বরূপা। তুমি মহারাত্রি, অর্থাৎ বস্তু মাত্রের আবরক তমোময় প্রলয়-স্বরূপা। তুমি ভয়ঙ্কর মোহরাত্রি অর্থাৎ জগতের মোহ-জনক সংসার-স্বরূপা।
ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্ব্বোধলক্ষণা।
লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিস্ত্বং শান্তিঃ ক্ষান্তিরেব চ॥৬০
হে দেবি! তুমি শ্রী, তুমি ঈশ্বরী, তুমি লজ্জা, তুমি বুদ্ধি এবং তুমি দিব্যজ্ঞানের একমাত্র লক্ষ্য। তুমি লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষান্তিস্বরূপা (ক্ষমাস্বরূপা)।
খড়্গিনী শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা।
শঙ্খিনী চাপিনী বাণভূষুণ্ডীপরিঘায়ুধা॥৬১
তুমি খড়্গিনী (যার হাতে খড়্গ), শূলিনী (যার হাতে শূল), গদিনী (যার হাতে গদা), চক্রিণী (যার হাতে চক্র), শঙ্খিনী (যার হাতে শঙ্খ) এবং চাপিনী (যার হাতে ধনুক)। হে দেবি! বাণ, ভূষুণ্ডী (লাঠি) এবং পরিঘও (মুগুরও) তোমার অস্ত্র।
সৌম্যা সৌম্যতরাশেষসৌমেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী।
পরাপরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী॥৬২
হে দেবি! তুমি সৌম্যা, সৌম্যতরা, অধিক কি, জগতে যত প্রকার সুন্দর পদার্থ আছে, তুমি তাহাদের সকলের অপেক্ষা সুন্দরী। হে দেবি! তুমি শ্রেষ্ঠা, শ্রেষ্ঠ হইতে শ্রেষ্ঠতরা এবং তুমিই শ্রেষ্ঠতরদিগেরও ঈশ্বরী।
যচ্চ কিঞ্চিৎ ক্কচিদ্বস্তু সদসদ্বাখিলাত্মিকে।
তস্য সর্ব্বস্য যা শক্তিঃ সা ত্বং কিং স্তূয়সে তদা॥৬৩
হে অখিলাত্মিকে! যাহা কিছু ভাব ও অভাবরূপ পদার্থ আছে, তাহাদের যে শক্তি, তুমিই সেই শক্তিস্বরূপা, অতএব তোমাকে কি প্রকারে স্তব করিব?
যয়া ত্বয়া জগৎস্রষ্টা জগৎপাতাত্তি যো জগৎ।
সোঽপি নিদ্রাবশং নীতঃ কস্ত্বাং স্তোতুমিহেশ্বরঃ॥৬৪
হে দেবি! জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কর্ত্তা সেই ভগবান বিষ্ণুকেই যখন তুমি নিদ্রাভিভূত করিয়া রাখিয়াছ, তখন আর কে তোমার স্তব করিতে সমর্থ হইবে?
বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণমহর্মীশান এব চ।
কারিতাস্তে যতোঽতস্ত্বাং কঃ স্তোতুংশক্তিমান ভবেৎ॥৬৫
হে দেবি! বিষ্ণু, ঈশান (শিব) ও আমাকে যখন তুমিই শরীর গ্রহণ করাইয়াছ, তখন অপর কোন্ ব্যক্তি তোমার স্তব করিতে সমর্থ হইবে?
সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্তৈরুদারৈর্দ্দেবি সংস্তুতা।
মোহয়ৈতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ॥৬৬
হে দেবি! সেই তুমি এই প্রকার স্বকীয় উদার প্রভাব-বর্ণন দ্বারা পরিতুষ্ট হইয়া এই দুরাধর্ষ মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়কে মোহিত কর।
প্রবোধঞ্চ জগৎস্বামী নীয়তামচ্যুতো লঘু।
বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুমেতৌ মহাসুরৌ॥৬৭
এবং জগৎস্বামী অচ্যূতকে প্রবোধিত কর। হে দেবি! এই মহাসুরদ্বয়কে বিনাশের জন্য শীঘ্র এই ভগবান্ বিষ্ণুর সংজ্ঞা দান কর।
—
দ্বিতীয় স্তব
মহিষাসুর বধের পরে ইন্দ্রাদি দেবগণ কর্ত্তৃক দেবীবন্দনা (শ্রীশ্রীচণ্ডী ৪.২-২৬)
দেব্যা যয়া ততমিদং জগদাত্মশক্ত্যা
নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্ত্যা।
তামম্বিকামখিলদেবমহর্ষিপূজ্যাং
ভক্ত্যা নতাঃ স্ম বিদধাতু শুভানি সা নঃ॥২
যাঁহার স্বকীয় প্রভাব দ্বারা এই চরাচর জগৎ বিস্তারিত হইয়াছে, সমস্ত দেবগণের শক্তিসমূহ মিলিত হইয়া যাঁহার মূর্ত্তিরূপে পরিণত এবং যিনি সমস্ত দেব ও মহর্ষিগণের পূজনীয়া, আমরা ভক্তিসহকারে সেই অম্বিকাকে প্রণাম করিতেছি; তিনি আমাদের মঙ্গল সম্পাদন করুন।
যস্যা প্রভাবমতুলং ভগবাননন্তো
ব্রহ্মা হরশ্চ ন হি বক্তুমলং বলঞ্চ।
সা চণ্ডিকাখিলজগৎপরিপালনায়
নাশায় চাশুভভয়স্য মতিং করোতু॥৩
ভগবান্ অনন্ত দেব, ব্রহ্মা ও মহেশ্বর যাঁহার প্রভাব ও বলের বর্ণন করিতে সমর্থ হন না, সেই চণ্ডিকা দেবী সমুদায় জগতের পরিপালনের নিমিত্ত এবং অমঙ্গল ও ভয়ের বিনাশের নিমিত্ত ইচ্ছা করুন।
যা শ্রীঃ স্বয়ং সুকৃতিনাং ভবনেষ্বলক্ষীঃ
পাপাত্মনাং কৃতধিয়াং হৃদয়েষু বুদ্ধিঃ।
শ্রদ্ধা সতাং কুলজনপ্রভবস্য লজ্জা
তাং ত্বাং নতাঃ স্ম পরিপালয় দেবি বিশ্বম্॥৪
যিনি পূণ্যবান্ ব্যক্তিদিগের গৃহে সম্পৎস্বরূপা (সাক্ষাৎ শ্রী), যিনি পাপীদিগের গৃহে অলক্ষীরূপা, যিনি অশেষ শাস্ত্রপাঠে নির্ম্মলান্তঃকরণদিগের হৃদয়ে বুদ্ধিস্বরূপা, যিনি স্বচরিত্রদিগের শ্রদ্ধাস্বরূপা এবং যিনি শুদ্ধবংশোদ্ভবদিগের লজ্জাস্বরূপা,– আমরা সেই তোমাকে নমস্কার করিতেছি; হে দেবি! তুমি বিশ্বের পরিপালন কর।
কিং বর্ণয়াম তব রূপমচিন্ত্যমেতৎ
কিঞ্চাতিবীর্য্যমসুরক্ষয়কারি ভূরি।
কিঞ্চাহবেষু চরিতানি তবাতি যানি
সর্ব্বেষু দেব্যসুরদেবগণাদিকেষু॥৫
তোমার এই প্রকার অচিন্ত্য রূপ, আমরা কেমনে বর্ণন করিতে সমর্থ হইব! হে দেবি! তোমার অসুরক্ষয়কারী অপরিমিত বীর্য্য এবং অসুর ও দেবগণের প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে সেই সকল অত্যুদ্ভুত ব্যবহারই বা আমরা কি প্রকারে বর্ণন করিব?
হেতুঃ সমস্তজগতাং ত্রিগুণাপি দোষৈ-
র্ন জ্ঞায়সে হরিহরাদিভিরপ্যপারা।
সর্ব্বাশ্রয়াখিলমিদং জগদংশভূত-
মব্যাকৃতা হি পরমা প্রকৃতিস্ত্বমাদ্যা॥৬
হে দেবি! তুমি বিকার-রহিত আদ্যা প্রকৃতি; অথচ সত্ত্ব, রজ ও তমোগুণাত্মিকা হইয়াও জগতের হেতুভূতা। রাগদ্বেষাদিযুক্ত বিষ্ণু মহেশ্বরাদিও তোমার প্রকৃত তত্ত্ব জানেন না। হে দেবি! তুমি অপারা এবং সকল পদার্থেরই আশ্রয়স্বরূপা। এই জগৎ তোমারই অংশভূত।
যস্যাঃ সমস্তসুরতা সমুদীরণেন
তৃপ্তিং প্রয়াতি সকলেষু মখেষু দেবি।
স্বাহাসি বৈ পিতৃগণস্য চ তৃপ্তিহেতু-
রুচ্চার্য্যসে ত্বমত এব জনৈঃ স্বধা চ॥৭
হে দেবি! সকল যজ্ঞেই তোমার নামোচ্চারণ করিলে সমস্ত দেবগণ তৃপ্তিলাভ করেন; যেহেতু তুমিই দেব ও ঋষিগণের তৃপ্তিজনক স্বাহা ও স্বধাস্বরূপা বলিয়া উচ্চারিত হইয়া থাক।
যা মুক্তিহেতুরবিচিন্ত্যমহাব্রতা চ
অভ্যস্যসে সুনিয়তেন্দ্রিয়তত্ত্বসারৈঃ।
মোক্ষার্থিভির্মুনিভিরস্তসমস্তদোষৈ-
বিদ্যাসি সা ভগবতী পরমা হি দেবি॥৮
হে দেবি! তোমার বৃহদুপাসনার বিষয় অচিন্ত্য এবং বশীকৃতেন্দ্রিয় (যারা ইন্দ্রিয়গুলিকে বশীভূত করেছেন), তত্ত্বসার ও দোষশূন্য মোক্ষার্থী মুনিগণ তোমাকে মুক্তির কারণ বলিয়া অভ্যাস করিয়া থাকেন। হে দেবি! অতএব তুমি ভগবতী সর্ব্বোৎকৃষ্টা মোক্ষবিদ্যা।
শব্দাত্মিকা সুবিমলর্গ্ যজুষাং নিধান-
মুদ্গীতরম্যপদপাঠবতাঞ্চ সাম্নাম্।
দেবী ত্রয়ী ভগবতী ভবভাবনায়
বার্ত্তা চ সর্ব্বজগতাং পরমার্ত্তিহন্ত্রী॥৯
হে দেবি! তুমি শব্দময় বেদত্রয়স্বরূপা এবং প্রণবযুক্ত মনোহর পদপাঠশালী ঋক্, যজুঃ ও সামবেদের আশ্রয়স্বরূপা। তুমি দেবী সর্ব্বৈশ্বর্য্যযুক্তা, তুমি সংসারের জীবনরক্ষার নিমিত্ত কৃষিস্বরূপা। হে দেবি! তুমিই নিখিল জগতের বিষম পীড়ার বিনাশকারিণী।
মেধাসি দেবি বিদিতাখিলশাস্ত্রসারা
দুর্গাসি দুর্গভবসাগরনৌরসঙ্গা।
শ্রীঃ কৈটভারিহৃদয়ৈককৃতাধিবাসা
গৌরী ত্বমেব শশিমৌলিকৃতপ্রতিষ্ঠা॥১০
হে দেবি! তুমি বুদ্ধিস্বরূপা; কারণ, সকল শাস্ত্রের সারই তোমার জ্ঞাত! হে দেবি! তুমি দুর্গা; কারণ, তুমি দুর্গম ভবসাগরে অদ্বিতীয় নৌকাস্বরূপা। তুমি মধুকৈটভারি নারায়ণের একমাত্র হৃদয়াধিবাসিনী লক্ষী এবং তুমিই মহাদেবের উৎকর্ষকারিণী গৌরী।
ঈষৎসহাসমমলং পরিপূর্ণচন্দ্র
বিম্বানুকারি কনকোত্তমকান্তি কান্তম্।
অত্যদ্ভুতং প্রহৃতমাপ্তরুষা তথাপি
বক্ত্রং বিলোক্য সহসা মহিষাসুরেণ॥১১
হে দেবি! তথাপি তোমার ঈষৎ হাস্যযুক্ত, নির্ম্মল পূর্ণচন্দ্র-বিম্বানুকারী (পূর্ণচন্দ্রের প্রতিবিম্বের মত), সুবর্ণকান্তি এবং মনোহর মুখ দেখিয়াও যে মহিষাসুর ক্রোধপুরঃসর (ক্রোধ সহকারে অর্থাৎ রেগে গিয়ে) অস্ত্রক্ষেপ করিয়াছিল, ইহাই অতি আশ্চর্য্য।
দৃষ্ট্বা তু দেবি কুপিতং ভ্রুকুটীকরাল-
মুদ্যচ্ছশাঙ্কসদৃশচ্ছবি যন্ন সদ্যঃ।
প্রাণান্ মুমোচ মহিষস্তদতীব চিত্রং
কৈর্জীব্যতে হি কুপিতান্তকদর্শনেন॥১২
তোমার কুপিত, ভ্রুকুটী-ভীষণ, উদয়কালীন শশাঙ্কসদৃশ ঈষৎ লোহিতচ্ছবি বদনমণ্ডল নিরীক্ষণ মাত্রেই (চাঁদ ওঠার ঠিক মূহুর্তে যেমন একটু লালচে দেখতে লাগে, সেইরকম তোমার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল এবং তা দেখে) যে মহিষাসুর প্রাণ পরিত্যাগ করে নাই, ইহা বড়ই আশ্চর্য্য! কুপিত অন্তককে (যমকে) দেখিয়া কেই বা বাঁচিয়া থাকিতে পারে?
দেবি প্রসীদ পরমা ভবতী ভবায়
সদ্যো বিনাশয়সি কোপবতী কূলানি।
বিজ্ঞাতমেতদধুনৈব যদস্তমেত-
ন্নীতং বলং সুবিপুলং মহিষাসুরস্য॥ ১৩
হে দেবি! তুমি প্রসন্না হও। তুমি পরমা ও মঙ্গলের জন্যই সমুৎপন্না (উদ্ভুত হয়েছ)। হে দেবি! তুমি কোপ করিলে সকলই তৎক্ষণাৎ বিনাশ করিয়া থাক, ইহা এখনই জানা গেল। যেহেতু মহিষাসুরের এই অতি মহৎ সৈন্য ও তাহাকে তুমি বিনাশ করিলে।
তে সম্মতা জনপদেষু ধনানি তেষাং
তেষাং যশাংসি ন চ সীদতি ধর্ম্মবর্গঃ।
ধন্যাস্ত এব নিভৃতাত্মজভৃত্যদারা
যেষাং সদাভ্যুদয়দা ভবতী প্রসন্না॥ ১৪
হে দেবি! তুমি প্রসন্ন হইয়া যাহাদিগকে অভ্যুদয় প্রদান কর (যাদের উত্থান ঘটাও), তাহারাই দেশে পূজিত হয়, তাহাদিগেরই ধন ও যশঃসমূহ সঞ্চিত হইয়া থাকে, তাহাদেরই ধর্ম্মবর্গ অবসন্ন হয় না, তাহারাই ধন্য এবং তাহাদিগেরই পুত্র পত্নী ও ভৃত্যবর্গ উদ্বেগহীন।
ধর্ম্ম্যাণি দেবি সকলানি সদৈব কর্ম্মা-
ণ্যত্যাদৃতঃ প্রতিদিনং সুকৃতী করোতি।
স্বর্গং প্রয়াতি চ ততো ভবতীপ্রসাদা-
ল্লোকত্রয়েঽপি ফলদা ননু দেবি তেন॥১৫
হে দেবি! তোমার প্রসাদেই পুণ্যশালী ব্যক্তিগণ প্রতিদিনই অতি আদরের সহিত ধর্ম্মজনক কর্ম্ম করিয়া থাকেন এবং মৃত্যুর পরে তোমার অনুগ্রহেই স্বর্গে গমন করেন; অতএব হে দেবি! তুমি লোকত্রয়েরই ফল প্রদান করিয়া থাক।
দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ
স্বস্থৈঃ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি।
দারিদ্র্যদুঃখভয়হারিণি কা ত্বদন্যা
সর্ব্বোপকারকরণায় সদার্দ্রচিত্তা॥১৬
হে দেবি! তুমি দুর্গত জন্তুগণ কর্ত্তৃক স্মৃত হইয়া তাহাদের ভয় হরণ কর (অর্থাৎ যেকোন প্রাণী যদি তোমায় স্মরণ করে তুমি তাদের ভয় দূর কর) এবং সুস্থব্যক্তিগণ তোমাকে স্মরণ করিলে, তুমি তাহাদের মঙ্গলজনিকা বুদ্ধি প্রদান কর। হে দারিদ্র্যদুঃখ-ভয়-হারিণি! তুমি ভিন্ন আর কাহার চিত্ত সকলের উপকারের জন্য সর্ব্বদা আর্দ্র রহিয়াছে?
এভির্হতৈর্জগদুপৈতি সুখং তথৈতে
কুর্ব্বন্তু নাম নরকায় চিরায় পাপম্।
সংগ্রামমৃত্যুমধিগম্য দিবং প্রয়ান্তু
মত্বেতি নূনমহিতান্ বিনিহংসি দেবি॥১৭
এই সকল অসুর মৃত হইলে জগৎ সুখলাভ করিবে এবং অসুরেরা চিরকাল নরক-জনক পাপ করে, করুক, কিন্তু ‘সংগ্রামমৃত্যুলাভ করিয়া ইহারা স্বর্গে প্রয়াণ করুক’ হে দেবি! এই মনে করিয়াই নিশ্চয় তুমি শত্রুগণকে বিনাশ করিয়া থাক।
দৃষ্ট্বৈব কিং ন ভবতী প্রকরোতি ভস্ম
সর্ব্বাসুরানরিষু যৎ প্রহিণোষি শস্ত্রম্।
লোকান্ প্রয়ান্তু রিপবোঽপি হি শস্ত্রপূতা
ইত্থ্যং মতির্ভবতি তেষ্বপি তেঽতিসাধ্বী॥ ১৮
দৃষ্টি মাত্রেই অসুরগণকে কি ভস্ম করিতে পারিতে না? তবে ‘রিপুগণও শস্ত্রপূত হইয়া স্বর্গে গমন করুক’ কেবল এই ভাবিয়াই সেই সকল শত্রুগণের প্রতি শস্ত্র-প্রয়োগ করিয়াছ। মৃত অসুরগণেরও উপকারের জন্য তোমার যে এবম্প্রকার (এই প্রকার) মতি, তাহা অতি সাধ্বী, সন্দেহ নাই।
খড়্গপ্রভানিকরবিস্ফুরণৈস্তথোগ্রৈঃ
শূলাগ্রকান্তিনিবহেন দৃশোঽসুরাণাম্।
যন্নাগতা বিলয়মংশুমদিন্দ্রখণ্ড-
যোগ্যাননং তব বিলোকয়তাং তদেতৎ॥১৯
হে দেবি! উগ্র খড়্গপ্রভা-সমূহের স্ফুরণে এবং শূলাগ্রের দীপ্তিসমূহে সেই অসুরগণের চক্ষু সকল যে বিনাশ প্রাপ্ত হয় নাই, ইহার কারণ অন্য কিছুই নহে; কেবল তোমার জ্যোৎস্নাশালী চন্দ্রবিম্বসদৃশ বদন নিরীক্ষণেই তাহাদের নয়ন অতি শীতল ছিল।
দুর্বৃত্তবৃত্তশমনং তব দেবি শীলং
রূপং তথৈতদবিচিন্ত্যমতুল্যমন্যৈঃ।
বীর্য্যঞ্চ হন্তৃ হৃতদেবপরাক্রমাণাং
বৈরিষ্বপি প্রকটিতৈব দয়া ত্বয়েত্থম্॥২০
হে দেবি! তোমার স্বভাব দুর্ব্বৃত্তদিগের অসচ্চরিত্রের প্রশমনকারী এবং তোমার রূপ তুলনারহিত ও চিন্তার অবিষয় (যা চিন্তা করা যায় না)। হে দেবি! তোমার বীর্য্য, দেব-পরাক্রমহারী অসুরগণের বিনাশক। এই প্রকারে শত্রুগণের উপরও তোমার কৃপা স্পষ্টীকৃত হইতেছে (স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে)।
কেনোপমা ভবতু তেঽস্য পরাক্রমস্য
রূপঞ্চ শত্রুভয়কার্য্যতিহারি কুত্র।
চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্ট্বা
ত্বয্যেব দেবি বরদে ভুবনত্রয়েঽপি॥২১
হে দেবি! কাহার সহিত তোমার এই পরাক্রমের তুলনা হয়? তোমার রূপ শত্রু-ভয়কারী (শত্রুর মনে ভয়ের জন্ম দেয়) অতি মনোহর। এমন রূপ স্বর্গ, মর্ত্ত্য বা পাতালে আর কাহার আছে? হে বরদে (যিনি বরদান করেন বা আশীর্বাদ বা অনুগ্রহ করেন তাঁকে সম্বোধন করা হচ্ছে) দেবি! ভুবনত্রয়মধ্যে তোমারই চিত্তে একত্রে দয়া ও সমর-নিষ্ঠুরতা দেখা যায়; আর কোথাও নাই।
ত্রৈলোক্যমেতদখিলং রিপুনাশনেন
ত্রাতং ত্বয়া সমরমূর্দ্ধনি তেঽপি হত্বা।
নীতা দিবং রিপুগণা ভয়মপ্যপাস্ত-
মস্মাকমুন্মদসুরারিভবং নমস্তে॥২২
হে দেবি! শত্রু বিনাশ করিয়া তুমি ত্রিভুবনের ত্রাণ করিলে, রণক্ষেত্রে সেই শত্রুগণকে বিনাশ করত স্বর্গ প্রদান করিলে এবং আমাদেরও উন্মদ-অসুর জন্য ভয় দূর হইল। অতএব হে দেবি! তোমাকে নমস্কার।
শূলেন পাহি নো দেবি পাহি খড়্গেন চাম্বিকে।
ঘন্টাস্বনেন নঃ পাহি চাপজ্যানিস্বনেন চ॥২৩
হে দেবি! আমাদিগকে শূল দ্বারা রক্ষা কর। হে অম্বিকে! আমাদিগকে খড়্গ দ্বারা রক্ষা কর। হে দেবি! ঘন্টা ও ধনুর্জ্জ্যা-শব্দে (ধনুকের গুণ বা ছিলার টংকার ধ্বনি) আমাদিগকে রক্ষা কর।
প্রাচ্যাং রক্ষ প্রতীচ্যাঞ্চ চণ্ডিকে রক্ষ দক্ষিণে।
ভ্রামণেনাত্মশূলস্য উত্তরস্যাং তথেশ্বরি॥২৪
হে চণ্ডিকে! স্বকীয় শূল ভ্রামণ করত আমাদিগকে পূর্ব্বে, পশ্চিমে, দক্ষিণে ও উত্তরে রক্ষা কর।
সৌম্যানি যানি রূপাণি ত্রৈলোক্যে বিচরন্তি তে
যানি চাত্যর্থঘোরাণি তৈ রক্ষাস্মাংস্তথা ভুবম্॥২৫
হে ঈশ্বরী! তোমার যে সকল সৌম্য রূপ এবং যে সকল সাতিশয় ভয়ঙ্করস্বরূপ ত্রিভুবনে বিচরণ করিতেছে, সেই সকল রূপে তুমি আমাদিগকে ও পৃথিবীকে রক্ষা কর।
খড়্গশূলগদাদীনি যানি চাস্ত্রাণি তেঽম্বিকে।
করপল্লবসঙ্গীনি তৈরস্মান্ রক্ষ সর্ব্বতঃ॥২৬
হে অম্বিকে! ত্বদীয় (তোমার) করপল্লবে (হাতে) খড়্গ-শূল-গদাদি যে সকল অস্ত্র রহিয়াছে, সেই সকল অস্ত্র দ্বারা আমাদিগকে সর্ব্বদিকে রক্ষা কর।
—
তৃতীয় স্তব
শুম্ভ নিশুম্ভ কর্ত্তৃক স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবগণ কর্ত্তৃক দেবীর স্তব (শ্রীশ্রীচণ্ডী ৫.৭-৩৬)
নমো দেব্যৈ মহাদেব্যৈ শিবায়ৈ সততং নমঃ।
নমঃ প্রকৃত্যৈ ভদ্রায়ৈ নিয়তাঃ প্রণতাঃ স্ম তাম্
রৌদ্রায়ৈ নমো নিত্যায়ৈ গৌর্ষ্যৈ ধাত্র্যৈ নমো নমঃ॥৭
দেবীকে নমস্কার, মহাদেবীকে নমস্কার, শিবাকে (শিবপত্নীকে অর্থাৎ দুর্গাকে বা ভবানীকে) সর্ব্বদা নমস্কার। প্রকৃতিকে নমস্কার, ভদ্রাকে নমস্কার; আমরা সংযত হইয়া সেই দেবীকে নমস্কার করি। রৌদ্রাকে (যিনি রুদ্ররূপিণী তাকে) নমস্কার। নিত্যা, গৌরী এবং ধাত্রীকে নমস্কার।
জ্যোৎস্নায়ৈ চেন্দুরূপিণ্যৈ সুখায়ৈ সততং নমঃ
কল্যাণ্যৈ প্রণতা বৃদ্ধ্যৈ সিদ্ধ্যৈ কুর্ম্মো নমো নমঃ॥৮
সেই প্রকাশরূপা, চন্দ্ররূপা, এবং পরমানন্দরূপা দেবীকে সতত নমস্কার করি। কল্যাণী ও বুদ্ধিরূপা দেবীকে নমস্কার। সিদ্ধিরূপা দেবীকে পুনঃপুনঃ নমস্কার করি।
নৈর্ঋতৈ ভূভৃতাং লক্ষ্ম্যৈ সর্ব্বাণ্যৈ তে নমো নমঃ॥৯
নৈর্ঋতি-স্বরূপা (অলক্ষ্মী বা সংহাররূপিণী) দেবীকে নমস্কার; ভূপতিদিগের গৃহে লক্ষ্মীরূপা দেবীকে নমস্কার। সর্ব্বাণীস্বরূপা তোমাকে নমস্কার, নমস্কার।
দুর্গায়ৈ দুর্গপারায়ৈ সারায়ৈ সর্ব্বকারিণ্যৈ।
খ্যাত্যৈ তথৈব কৃষ্ণায়ৈ ধূম্রায়ৈ সততং নমঃ॥১০
দুর্গা, দুর্গপারা (দুর্গত ব্যক্তিদের যিনি উদ্ধার করেন), সারা (সার বা শ্রেষ্ঠ অংশ অর্থাৎ ব্রহ্মরূপা) সর্ব্বকারিণী, খ্যাতি, কৃষ্ণা ও ধুম্রাস্বরূপ দেবীকে আমরা সতত নমস্কার করি।
অতিসৌম্যাতিরৌদ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমো নমঃ।
নমো জগৎ প্রতিষ্ঠায়ৈ দেব্যৈ কৃত্যৈ নমো নমঃ॥১১
যিনি অতিসৌম্যা (অত্যন্ত সুন্দরী) অথচ অতিরৌদ্রা (ভীষণ রুদ্ররূপিণী), সেই দেবীকে অতি বিনত হইয়া আমরা বারংবার নমস্কার করি। জগতের প্রতিষ্ঠারূপা (এই জগতের প্রাণশক্তি অর্থাৎ এই জগৎ যাতে প্রতিষ্ঠিত সেই) দেবীকে নমস্কার, কৃতিস্বরূপা দেবীকে নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতাঃ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১২
যে দেবী নিখিল প্রাণিনিবহে (প্রাণীসমূহে বা সকল প্রাণীতে) বিষ্ণুমায়া বলিয়া কীর্ত্তিত, সেই দেবীকে বারংবার নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীয়তে।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৩
যে দেবী নিখিল প্রাণিসমূহে চেতনারূপে অভিহিতা, সেই দেবীকে ভূয়োভূয়ঃ (পুনঃপুনঃ) নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৪
যে দেবী নিখিল প্রাণিনিবহে বুদ্ধিরূপে সংস্থিতা, সেই দেবীকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৫
যে দেবী নিখিল প্রাণীতেই নিদ্রারূপে স্থিতি করিতেছেন, সেই দেবীকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৬
যে দেবী নিখিল প্রাণীতেই ক্ষুধারূপে স্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু ছায়ারূপেণ সংস্থিতা ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৭
যে দেবী নিখিল (সমস্ত বা সমুদয়) ভূতেই (দ্রব্যে, পদার্থে, উপাদানে বা বস্তুতে) ছায়ারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৮
যে দেবী নিখিল ভূতে শক্তিরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু তৃষ্ণারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥১৯
যে দেবী নিখিল প্রাণীতেই তৃষ্ণারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু ক্ষান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২০
যে দেবী সকল প্রাণীতে ক্ষমারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু জাতিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২১
যে দেবী সকল প্রাণীতে জাতিরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু লজ্জারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২২
যে দেবী নিখিল প্রাণীতে লজ্জারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৩
যে দেবী সর্ব্বভূতে শান্তিরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শ্রদ্ধারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৪
যে দেবী নিখিল প্রাণীসমূহে শ্রদ্ধারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু কান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৫
যে দেবী সর্ব্বভূতে শোভারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু লক্ষ্মীরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৬
যে দেবী সর্ব্বভূতে লক্ষ্মীরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৭
যে দেবী সর্ব্বপ্রাণীতেই জীবিকারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু স্মৃতিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৮
যে দেবী নিখিল প্রাণীতে স্মৃতি-স্বরূপে বিদ্যমান রহিয়াছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু দয়ারূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥২৯
যে দেবী নিখিল প্রাণীতে দয়ারূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু তুষ্টিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥৩০
যে দেবী সর্ব্বপ্রাণীতেই সন্তোষরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥৩১
যে দেবী সকল ভূতেই মাতৃস্বরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥৩২
যে দেবী নিখিল প্রাণীতে ভ্রান্তিরূপে অবস্থিতি করিতেছেন, তাঁহাকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
ইন্দ্রিয়াণামধিষ্ঠাত্রী ভূতানাঞ্চাখিলেষু যা।
ভূতেষু সততং তস্যৈ ব্যাপ্তিদেব্যৈ নমো নমঃ॥৩৩
যিনি ইন্দ্রিয় ও ভূত সকলের অধিষ্ঠাত্রী এবং যিনি অখিল ভূতনিবহে ব্যাপ্তিরূপে বিদ্যমানা, সেই দেবীকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
চিতিরূপেণ যা কৃৎস্নমেতদ্ব্যপ্য স্থিতা জগৎ।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ॥৩৪
যিনি চৈতন্যরূপে এই নিখিল জগৎকে ব্যাপিয়া অবস্থিতি করিতেছেন, সেই দেবীকে নমস্কার, নমস্কার, নমস্কার।
স্তুতা সুরৈঃ পূর্ব্বমভীষ্টসংশ্রয়াৎ
তথা সুরেন্দ্রেণ দিনেষু সেবিতা।
করোতু সা নঃ শুভহেতুরীশ্বরী
শুভানি ভদ্রাণ্যভিহন্তু চাপদঃ॥৩৫
যা সাম্প্রতং চোদ্ধতদৈত্যতাপিতৈ-
রস্মাভিরীশা চ সুরৈর্নমস্যতে।
যা চ স্মৃতা তৎক্ষণমেব হন্তি নঃ
সর্ব্বাপদো ভক্তিবিনম্রমূর্ত্তিভিঃ॥৩৬
পূর্ব্বে আমরা অভীষ্ট লাভ করিয়া যাঁহাকে স্তব করিয়াছি, দেবরাজ ইন্দ্র যাঁহার বহুদিন সেবা করিয়াছেন এবং যিনি মঙ্গলসমূহের কারণ; প্রচণ্ড দৈত্যপীড়িত হইয়া আমরা এক্ষণে যে ঈশ্বরীকে নমস্কার করিতেছি; ভক্তিবিনম্রশরীর হইয়া আমরা স্মরণ করিলে যিনি তৎক্ষণাৎ আমাদের সকল বিপদ্ বিনষ্ট করেন, সেই ঈশ্বরী দেবী আমাদের সর্ব্ব প্রকার মঙ্গল করুন এবং বিপত্তি সকল বিনাশ করুন।
—
চতুর্থ স্তব
শুম্ভ নিহত হলে ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণ কর্ত্তৃক দেবীবন্দনা (শ্রীশ্রীচণ্ডী ১১.২-৩৪)
দেবি প্রপন্নার্ত্তিহরে প্রসীদ প্রসীদ মাতর্জগতোঽখিলস্য।
প্রসীদ বিশ্বেশ্বরি পাহি বিশ্বং ত্বমীশ্বরী দেবি চরাচরস্য॥২
হে শরণাগত-দুঃখহরে দেবি! প্রসন্না হও; হে অখিল-জগজ্জননি! প্রসন্না হও; হে বিশ্বেশ্বরি! প্রসন্না হও; তুমি বিশ্বকে রক্ষা কর। হে দেবি! তুমিই চরাচর বিশ্বের ঈশ্বরী। ২
আধারভূতা জগতস্ত্বমেকা মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাসি।
অপাং স্বরূপস্থিতয়া ত্বয়ৈতদাপ্যায্যতে কৃৎস্নমলঙ্ঘ্যবীর্য্যে॥ ৩
হে দেবি! তুমি জগতের অদ্বিতীয় আধারস্বরূপা; যেহেতু মহীস্বরূপে অবস্থিতি করিতেছ। হে দেবি! তুমি জলস্বরূপে অবস্থান করত এই সকল বিশ্বের তৃপ্তি সম্পাদন করিতেছ। দেবি! তোমার বীর্য্য অলঙ্ঘনীয়। ৩
ত্বং বৈষ্ণবী শক্তিনন্তবীর্য্যা বিশ্বস্য বীজং পরমাসি মায়া।
সম্মোহিতং দেবি সমস্তমেতৎ ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি হেতুঃ॥ ৪
হে দেবি! তুমি অনন্তবীর্য্যা বৈষ্ণবী-শক্তি, তুমি সংসারের হেতুভূতা পরমা মায়া; তুমি সমস্ত বিশ্বকেই সম্মোহিত করিয়া রাখিয়াছ। হে দেবি! পৃথিবীতে তুমিই প্রসন্না হইয়া মুক্তির হেতু হও। ৪
বিদ্যাঃ প্রমস্তাস্তব দেবি ভেদাঃ স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।
ত্বয়ৈকয়া পূরিতমম্বয়ৈতৎ কা তে স্তুতিঃ স্তব্যপরা পরোক্তিঃ॥ ৫
হে দেবি! সমস্ত বিদ্যাই তোমার মূর্ত্তিবিশেষ; হে জননী! তুমি একাই এই বিশ্ব ব্যাপিয়া রহিয়াছ। হে দেবি! অধিক আর কি বলিব, তুমিই স্তব্যগণের শ্রেষ্ঠা। ৫
সর্ব্বভূতা যদা দেবী স্বর্গমুক্তিপ্রদায়িনী।
ত্বং স্তুতা স্তুতয়ে কা বা ভবন্তু পরমোক্তয়ঃ॥ ৬
তুমি সর্ব্বভূতস্বরূপে বিদ্যমানা, তুমি স্বর্গ ও মুক্তিপ্রদান করিয়া থাক বলিয়া তোমার স্তব করি; কিন্তু দেবি! তোমার নির্গুণ ব্রহ্মস্বরূপের স্তব করিতে গেলে কোন্ উক্তি শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীর্ত্তিত হইবে? কিছুই না। কারণ তোমার গুণ নাই, নির্গুণের গুণকীর্ত্তনরূপ স্তব কি প্রকারে সম্ভবে? ৬
সর্ব্বস্য বুদ্ধিরূপেণ জনস্য হৃদি সংস্থিতে।
স্বর্গাপবর্গদে দেবি নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ৭
তুমি বুদ্ধিরূপে সকলের হৃদয়ে অবস্থিতি করিতেছ! হে স্বর্গমুক্তিপ্রদায়িনী! হে দেবি! হে নারায়ণি! তোমাকে নমস্কার। ৭
কলাকাষ্ঠাদিরূপেণ পরিণামপ্রদায়িনী।
বিশ্বস্যোপরতৌ শক্তে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ৮
হে বিশ্ববিনাশসমর্থে! তুমি কলা ও কাষ্ঠাদিরূপে জগতের পরিণাম বিধান করিয়া থাক। হে নারায়ণি! তোমাকে নমস্কার। ৮
সর্ব্বমঙ্গলমঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থসাধিকে।
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ৯
হে সর্ব্বমঙ্গল মাঙ্গল্যে (সমুদায় মঙ্গলস্বরূপা)! হে শিবে (পরমকল্যাণরূপিণী)! হে সর্ব্বার্থসাধিকে (সর্ব্বার্থসাধিনী)! হে শরণ্যে (সকলের রক্ষাকারিণী)! হে ত্র্যম্বিকে (ত্রিলোচনী)! হে গৌরি! হে নারায়ণি! তোমাকে নমস্কার। ৯
সৃষ্টিস্থিতিবিনাশানাং শক্তিভূতে সনাতনি।
গুণাশ্রয়ে গুণময়ে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১০
হে সনাতনি! হে গুণাশ্রয়ে! হে গুণময়ে! হে নারায়ণি! তুমি সৃষ্টি স্থিতি ও বিনাশের শক্তিস্বরূপা; তোমাকে নমস্কার। ১০
শরণাগতদীনার্ত্তপরিত্রাণপরায়ণে।
সর্ব্বস্যার্ত্তিহরে দেবি নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১১
হে দেবি! হে নারায়ণি! তুমি শরণাগত দীন ও আর্ত্তজনগণের পরিত্রাণকারিণী এবং সকলের দুঃখহারিণী; তোমাকে নমস্কার। ১১
হংসযুক্তবিমানস্থে ব্রহ্মাণীরূপধারিণী।
কৌশাম্ভঃক্ষরিকে দেবি নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১২
হে দেবি! নারায়ণি! তুমি ব্রহ্মাণীরূপে হংসযুক্ত বিমানে আরূঢ় হইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে কুশাভিমন্ত্রিত জল সেচন করিয়াছ; তোমাকে নমস্কার। ১২
ত্রিশূলচন্দ্রাহিধরে মহাবৃষভবাহিনি।
মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৩
হে নারায়ণি! তুমি মহেশ্বরীরূপে মহাবৃষভে আরোহণপূর্ব্বক অর্দ্ধচন্দ্র ও নাগভূষণে ভূষিত হইয়া ত্রিশূল ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৩
ময়ূরকুক্কুটবৃতে মহাশক্তিধরেঽনষে।
কৌমারীরূপসংস্থানে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৪
হে অনঘে (নিষ্পাপ)! হে নারায়ণি! তুমি কৌমারী রূপ ধারণপূর্ব্বক ময়ূর ও কুক্কুট (মোরগ বা মুরগি) গণে পরিবৃত হইয়া মহাশক্তি ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৪
শঙ্খচক্রগদাশার্ঙ্গগৃহীতপরমায়ুধে।
প্রসীদবৈষ্ণবীরূপে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৫
হে নারায়ণি! তুমি বৈষ্ণবী শক্তিরূপে রণস্থলে শঙ্খ, চক্র, গদা ও শার্ঙ্গধনু (বিষ্ণুর ধনুক) রূপ মহাস্ত্রনিচয় ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। তুমি প্রসন্না হও। ১৫
গৃহীতোগ্রমহাচক্রে দংষ্ট্রোদ্ধৃতবসুন্ধরে।
বরাহরূপিণি শিবে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৬
হে শিবে! হে নারায়ণি! তুমিই মহাবরাহরূপে জলমগ্না বসুন্ধরাকে পাতালতল হইতে উদ্ধৃত করিয়া প্রচণ্ড মহাচক্র ধারণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৬
নৃসিংহরূপেণোগ্রেণ হন্তুং দৈত্যান্ কৃতোদ্যমে।
ত্রৈলোক্যত্রাণসহিতে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৭
হে নারায়ণি! তুমি ভয়ঙ্কর নৃসিংহরূপে দৈত্যগণের বধে উদ্যত হইয়া ত্রৈলোক্য ত্রাণ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৭
কিরীটিনি মহাবজ্রে সহস্রনয়নোজ্জ্বলে।
বৃত্রপ্রাণহরে চৈন্দ্রি নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৮
হে নারায়ণি! তুমি ঐন্দ্রীয় শক্তিরূপে কিরীটোদ্ভাসিত মৌলী (মুকুটধারী) ও সহস্রনয়ন-শোভিতা হইয়া মহাবজ্র ধারণপূর্ব্বক বৃত্রাসুরের প্রাণ সংহার করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৮
শিবদূতীস্বরূপেণ হতদৈত্যমহাবলে।
ঘোররূপে মহারাবে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ১৯
হে নারায়ণি! তুমি শিবদূতী স্বরূপে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করিয়া উৎকট নিনাদ (গর্জন) দ্বারাই দৈত্যগণের মহতী সেনা বিনাশ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ১৯
দংষ্ট্রাকরালবদনে শিরোমালাবিভূষণে।
চামুণ্ডে মুণ্ডমথনে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ২০
হে নারায়ণি! তুমি দংষ্ট্রাকরালবদনা (বড় ও ভয়ঙ্কর দাঁত ও ভীতিজনক মুখবিশিষ্টা) চামুণ্ডারূপে শিরোমালা দ্বারা বিভূষিতা হইয়াছিলে এবং চণ্ড ও মুণ্ড নামক অসুরদ্বয়কে বিনাশ করিয়াছিলে; তোমাকে নমস্কার। ২০
লক্ষ্মি লজ্জে মহাবিদ্যে শ্রদ্ধে পুষ্টি স্বধে ধ্রুবে।
মহারাত্রি মহাবিদ্যে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ২১
হে নারায়ণি! তুমি লক্ষ্মী, লজ্জা, মহাবিদ্যা, শ্রদ্ধা, পুষ্টি, স্বধা, মহারাত্রি ও মোহরাত্রি-স্বরূপা; তুমি ধ্রুবা (নিত্যা); তোমাকে নমস্কার। ২১
মেধে সরস্বতি বরে ভূতি বাভ্রবি তামসি।
নিয়তে ত্বং প্রসীদেশে নারায়ণি নমোহস্তু তে॥ ২২
হে নারায়ণি! তুমিই মেধা, সরস্বতী, শ্রেষ্ঠা, বাভ্রবী (দুর্গা), ভূতি (বিভূতি, আটটি ঐশ্বর্য যথা অণিমা, মহিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিতা, বশিতা ও কামাবশায়িতা) ও তামসী; তোমাকে নমস্কার। ২২
সর্ব্বস্বরূপে সর্ব্বেশে সর্ব্বশক্তিসমন্বিতে।
ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে দেবি নমোহস্তু তে॥ ২৩
হে নিয়তে! হে ঈশে! তুমি প্রসন্না হও। হে দেবি! তুমি সর্ব্বস্বরূপা, সকলের ঈশ্বরী এবং সর্ব্বশক্তিসমন্বিতা; অতএব আমাদিগকে ভয়সমূহ হইতে রক্ষা কর। হে দুর্গে! হে দেবি! তোমাকে নমস্কার। ২৩
এতৎ তে বদনং সৌম্যং লোচনত্রয়ভূষিতম্।
পাতু নঃ সর্ব্বভূতেভ্যঃ কাত্যায়নি নমোহস্তু তে॥ ২৪
হে কাত্যায়নী! তোমার এই লোচনত্রয়-ভূষিত সৌম্য বদন, সকল ভূত হইতে আমাদিগকে রক্ষা করুক; হে দেবি! তোমাকে নমস্কার। ২৪
জ্বালাকরালমত্যুগ্রমশেষাসুরসূদনম্।
ত্রিশূলং পাতু নো ভীতের্ভদ্রকালি নমোহস্তু তে॥ ২৫
হে ভদ্রকালী! তোমার এই যে ত্রিশূল স্বভাবতই নিতান্ত প্রচণ্ড; তাহার উপর আবার শিখাসমূহ সমুদ্গত হওয়াতে, আরও ভয়ঙ্কর হইয়াছে; তুমি ইহা দ্বারা অশেষ অসুর সংহার করিয়াছ। এই ত্রিশূল আমাদিগকে ভয় হইতে রক্ষা করুক; তোমাকে নমস্কার। ২৫
হিনস্তি দৈত্যতেজাংসি স্বনেনাপূর্য্য যা জগৎ।
সা ঘন্টা পাতু নো দেবি পাপেভ্যো নঃ সুতানিব॥ ২৬
শব্দ দ্বারা সমুদয় জগৎ আপূরণপূর্ব্বক যে ঘন্টা দৈত্যতেজঃসমূহের বিনাশ করে, তোমার সেই ঘন্টা পুত্রের ন্যায় আমাদিগকে প্রতিকূল জন হইতে রক্ষা করুক; হে চণ্ডিকে! আমরা তোমাকে নমস্কার করি। ২৬
অসুরাসৃগ্বসাপঙ্কচর্চ্চিতস্তে করোজ্জ্বলঃ।
শুভায় খড়্গো ভবতু চণ্ডিকে ত্বাং নতা বয়ম্॥ ২৭
অসুরসমূহের রক্ত ও বসারূপ (মেদরূপ) পঙ্ক দ্বারা চর্চ্চিত ত্বদীয় হস্তশোভন খড়্গ আমাদিগের মঙ্গল করুক! ২৭
রোগানশেষানপহংসি তুষ্টা রুষ্টা তু কামান্ সকলানভীষ্টান্।
ত্বামাশ্রিতানাং ন বিপন্নরাণাং ত্বামাশ্রিতা হ্যাশ্রয়তাং প্রয়ান্তি॥ ২৮
হে দেবি! তুমি তুষ্টা হইয়া অশেষ রোগ সকল বিনাশ কর এবং রুষ্টা হইলে সকল অভিলষিত প্রিয় অপহরণ কর। হে দেবি! তোমার আশ্রিত মনুষ্যগণের বিপদ্ থাকে না এবং তোমাকে যাহারা আশ্রয় করে, তাহারা সকলের আশ্রয়স্বরূপ হয়। ২৮
এতৎ কৃতং যৎ কদনং ত্বয়াদ্য ধর্ম্মদ্বিষাং দেবি মহাসুরাণাম্।
রূপৈরনেকৈর্বহুধাত্মমূর্ত্তিং কৃত্বাম্বিকে তৎ প্রকরোতি কান্যা॥ ২৯
হে দেবি অম্বিকে! তুমি নানারূপে বহুপ্রকার মূর্ত্তি ধারণ করিয়া ধর্ম্মদ্বেষ্টা মহাসুরগণকে এই প্রকার যে বিনাশ করিলে, ইহা আর কে করিতে পারে? ২৯
বিদ্যাসু শাস্ত্রেষু বিবেকদীপেষ্বাদ্যেষু বাক্যেষু চ কা ত্বদন্যা।
মমত্বগর্ত্তেঽতিমহান্ধকারে বিভ্রাময়ত্যেতদতীব বিশ্বম্॥ ৩০
হে দেবি! তোমা ব্যতিরেকে আর কোন্ ব্যক্তি এই বিশ্বকে বিদ্যাসমূহে, শাস্ত্রসমূহে, বিবেকপ্রদীপে, আদ্যবাক্যসমূহে (বেদাদিগ্রন্থে) অথবা অতি মহান্ধকারে মমত্ব-গর্ত্তে ভ্রমণ করাইতে পারে? ৩০
রক্ষাংসি যত্রোগ্রবিষাশ্চ নাগা যত্রারয়ো দস্যুবলানি যত্র।
দানবানলো যত্র তথাব্ধিমধ্যে তত্র স্থিতা ত্বং পরিপাসি বিশ্বম্॥ ৩১
হে দেবি! যেখানে রাক্ষসগণ, যেখানে সর্পগণ, যেখানে শত্রুবর্গ, যেখানে দস্যুবল সমূহ ও যেখানে দাবানল, তুমি সেইখানে সেইখানেই এবং সমুদ্র মধ্যে অবস্থিতি করিয়া বিশ্বকে রক্ষা করিতেছ। ৩১
বিশ্বেশ্বরি ত্বং পরিপাসি বিশ্বং বিশ্বাত্মিকা ধারয়সীতি বিশ্বম্।
বিশ্বেশবন্দ্যা ভবতী ভবন্তি বিশ্বাশ্রয়া যে ত্বয়ি ভক্তিনম্রাঃ॥ ৩২
হে দেবি! তুমি বিশ্বেশ্বরী; যেহেতু এই বিশ্বকে রক্ষা করিতেছ। তুমি বিশ্বাত্মিকা; যেহেতু এই বিশ্বকে ধারণ করিয়া রহিয়াছ। হে দেবি! তুমি বিশ্বেশ্বরগণেরও বন্দনীয়া; কারণ যে ব্রহ্মাদি দেবগণ বিশ্বের আশ্রয়, তাঁহারাও তোমার প্রতি ভক্তি-নম্র হইতেছেন এবং যে সকল জন তোমার প্রতি ভক্তি-নম্র হন, তাঁহারও বিশ্বের আশ্রয় হন। ৩২
দেবী প্রসীদ পরিপালয় নোঽরিভীতের্নিত্যং যথাসুরবধাদধুনৈব সদ্যঃ।
পাপানি সর্ব্বজগতাঞ্চ শমং নয়াশু উৎপাতপাকজনিতাংশ্চ মহোপসর্গান্॥ ৩৩
হে দেবি! প্রসন্না হও; যেমন অসুর বধ দ্বারা এক্ষণে রক্ষা করিলে, সেইরূপ আমাদিগকে অরিভয় (শত্রুভয়) হইতে সর্ব্বদা রক্ষা কর! হে দেবি! এই রূপে সদ্যঃ সকল জগতের পাপগণ ও উৎপাতপরিণাম-জনিত মহোপসর্গ (উল্কাপাত প্রভৃতি) সকলকে প্রশান্ত কর। ৩৩
প্রণতানাং প্রসীদ ত্বং দেবি বিশ্বার্ত্তিহারিণি।
ত্রৈলোক্যবাসিনামীড্যে লোকানাং বরদা ভব॥ ৩৪
হে বিশ্বার্ত্তিহারিণী (বিশ্বের যাবতীয় দুঃখ সন্তাপ যিনি হরণ করিয়া থাকেন) দেবি! প্রণত ব্যক্তিগণের প্রতি প্রসন্ন হও। হে ত্রৈলোক্যবাসিনী -পূজনীয়ে! লোকসমূহের বরদা হও (লোকেদের বরদান কর)। ৩৪
—
দেবীসূক্ত
ঋগ্বেদ, দশম মণ্ডল, ১২৫তম সূক্ত
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা॥১
[বাগ্দেবীর উক্তি]—আমি রুদ্রগণ ও বসুগণের সাথে বিচরণ করি, আমি আদিত্যগণের সঙ্গে এবং তাবৎ দেবতাগণের সঙ্গে থাকি, আমি মিত্র ও বরুণ এই উভয়কে ধারণ করি, আমিই ইন্দ্র ও অগ্নি এবং দুই অশ্বিদ্বয়কে অবলম্বন করি।
অহং সোমমাহনসং বিভর্ম্যহং ত্বষ্টারমুত পূষণং ভগম্।
অহং দধামি দ্রবিণং হবিষ্মতে সুপ্রাব্যে যজমানায় সুন্বতে॥২
যে সোম আঘাত অর্থাৎ প্রস্তর নিষ্পীড়নের দ্বারা উৎপন্ন হন, আমিই তাঁকে ধারণ করি; আমি ত্বষ্টা ও পূষা ও ভগকে ধারণ করি, যে যজমান যজ্ঞসামগ্রী আয়োজনপূর্বক এবং সোমরস প্রস্তুত করে দেবতাগণকে উত্তমভাবে সন্তুষ্ট করে, আমিই তাকে ধন দান করি।
অহং রাষ্ট্রী সঙ্গমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্॥৩
আমি রাজ্যের অধীশ্বরী, ধন উপস্থিত করেছি, জ্ঞানসম্পন্ন এবং যজ্ঞোপযোগী বস্তু সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই হেন আমাকে দেবতাগণ নানা স্থানে সন্নিবেশিত করেছেন। আমার আশ্রয়স্থান বিস্তর, আমি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছি।
ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্।
অমন্তবো মাং ত উপ ক্ষিয়ন্তি শ্রুধি শ্রূত শ্রদ্ধিবং তে বদামি॥৪
যিনি দর্শন করেন, প্রাণধারণ করেন, কথা শ্রবণ করেন, অথবা অন্ন ভোজন করেন, তিনি আমার সহায়তাতে সেইসকল কার্য করেন। আমাকে যারা মান্য করে না, তারা ক্ষয় হয়ে যায়। হে বিদ্বান্! শ্রবণ কর; আমি যা বলছি, তা শ্রদ্ধার যোগ্য।
অহমেব স্বয়মিদং বদামি জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ।
যং কাময়ে তন্তমুগ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মাণং তমৃষিং তং সুমেধাম্॥৫
দেবতাগণ এবং মনুষ্যগণ যাঁর শরণাগত হয়, তাঁর বিষয় আমিই উপদেশ প্রদান করি। যাকে ইচ্ছা, আমি বলবান্ অথবা স্তোতা অথবা ঋষি, অথবা বুদ্ধিমান্ করতে পারি।
অহং রুদ্রায় ধনুরা তনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণোম্যহং দ্যাবাপৃথিবী আ বিবেশ॥৬
রুদ্র যখন স্তোত্রদ্বেষী শত্রুকে বধ করতে উদ্যত হন, তখন আমিই তাঁর ধনু বিস্তার করে দিই। লোকের জন্য আমিই যুদ্ধ করি। আমি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট হয়ে আছি।
অহং সুবে পিতরমস্য মূর্ধন্মম যোনিরপ্স্বন্তঃ সমুদ্রে।
ততো বি তিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বোতামূং দ্যাং বর্ষ্মণোপ স্পৃশামি॥৭
আমি পিতা আকাশকে প্রসব করেছি। সেই আকাশ এই জগতের মস্তকস্বরূপ। সমুদ্রে জলের মধ্যে আমার স্থান। সেই স্থান হতে সকল ভুবনে বিস্তারিত হই, আপন উন্নত দেহের দ্বারা এই দ্যুলোককে আমি স্পর্শ করি।
অহমেব বাত ইব প্র বাম্যারভমাণা ভুবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যৈতাবতী মহিনা সং বভূব॥৮
আমিই তাবৎ ভুবন নির্মাণ করতে করতে বায়ুর মতো বহমান হই। আমার মহিমা এমন বৃহৎ হয়েছে যে, দ্যুলোককেও অতিক্রম করেছে, পৃথিবীকেও অতিক্রম করেছে ।
—