বাংলার বিশিষ্ট সাধনা

বাংলার বিশিষ্ট সাধনা

অষ্টাদশ শতকে বাংলায় (যুক্তবঙ্গই এ প্রবন্ধের পটভূমিকা) ধর্মের নানা তরঙ্গ ওঠে। রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন, মিশনারি সাহেবরা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে বহু সাধারণ, বিশেষত নিম্নবর্ণের হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করেন, মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরকরণও পাশাপাশি চলছিল। ব্রাহ্মধর্ম প্রধানত শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে প্রসারিত হচ্ছিল। কিছু দরিদ্র অশিক্ষিত ও অবশ্য ব্রাহ্মণ, খ্রিস্টান ও ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছিল, কিন্তু ধর্মের জগতের উত্তাল তরঙ্গের ওঠাপড়া মূলত নগরকেন্দ্রিক ছিল এ সময়ে। হিন্দু সমাজে ন্যায় ও স্মৃতিশাস্ত্রের চর্চার কেন্দ্র ছিল নবদ্বীপ। নব্যন্যায় সূক্ষ্মবুদ্ধির সংস্কৃত-শিক্ষিত মানুষকে আকৃষ্ট করছিল। স্মৃতির অনুপুঙ্খ-চর্চা শাস্ত্র ও সমাজকে ক্রমশ সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছিল। ন্যায় ও স্মৃতি মুখ্যত যুক্তিতর্ক চিন্তা ও বিধিবিধানের জগৎ, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। চৈতন্যের প্রেমভক্তিনিষ্ঠ ধর্মে হৃদয়বৃত্তির যে স্ফুরণ ঘটেছিল সপ্তদশ শতকের শেষে তা ক্রমেই তর্ক ও আচারের শুষ্ক মরুবালুতে হারিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ ধর্মের দিক থেকে উপেক্ষিত ও বিভ্রান্ত বোধ করে।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে নানা রকম দুর্যোগ আচ্ছন্ন করেছিল যুক্তবঙ্গকে; দেশের অর্থনীতিতেও বড় দুর্দিন তখন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারি প্রথার প্রজাশোষণের দিকটি স্থায়ী হল, যেহেতু জমিদারের দেয়, রাজস্ব বরাবরের মতো নির্ধারিত হয়ে গেল, তাই খরা-অজন্মা-বন্যা যাই হোক না কেন, প্রজাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা যথাকালে দিতেই হবে; এতে দুঃস্থ বিপন্ন প্রজা সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ল। এর ফলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরই শুধু নয়, দু’-এক বছর পরপরই দুর্ভিক্ষ মন্বন্তর লেগেই রইল, দেশে নিরন্ন প্রজার হাহাকার বাড়তে লাগল। এ দেশে রেলওয়ে বসার প্রণালীতে জমির ক্ষতি হল। নদীর বাঁধ নষ্ট হল, ম্যালেরিয়া মহামারী হয়ে দেখা দিল। অসহায় দুঃখী প্রজার ওপরে অত্যাচার আরও বাড়িয়ে তুলল নীলকর সাহেবরা, চাষের জমিতে দাগ দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করত লোভী নীলকর সাহেবরা; ঋণের দায়ে জর্জরিত হতে লাগল চাষি। অভাবে নানা লোক দুর্বৃত্ত হয়ে দুঃস্থ মানুষদের ওপরে নানা ভাবে অত্যাচার করতে লাগল। ঠগি, ঠ্যাঙাড়ে, বর্গী নানা ভাবে পীড়ন করতে শুরু করল অসহায় প্রজাকে। সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল তাদের দুঃখের প্রতিকার ছিল না। সমাজে কঠোর শ্রেণিবিভাগ, কঠোরতর জাতিভেদ, সান্ত্বনা রইল না কোথাও। এ সব দুঃখই উৎসারিত হয়েছে উৎপীড়িত মানুষের প্রান্তিক সাধনার ধারায়, গানে, কবিতায়।

শহরে ইংরেজি স্কুল স্থাপিত হল, শিক্ষিত বাবুরা বিদেশি প্রভুর দফতরে ও ব্যবসায়ে কেরানি হয়ে, বানিয়ান হয়ে ঢুকল। বিদেশি শিক্ষা জনসমাজকে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের দু’পাশে ভাগ করে রাখল; বাবু ও চাষি, সাহেবের প্রসাদপুষ্ট বাবুরা পূর্বতন দুঃখী ইংরেজি-অশিক্ষিত সাধারণ গ্রাম্য মানুষ; মধ্যে দুস্তর ব্যবধান, ক্রমে যেন একে অন্যের ভাষাই বোঝে না, এমনই এক অবস্থার সৃষ্টি হল। এ যুগের প্রথম দিকে মুসলিম নবাবদের অনেক কর্মচারী যথেচ্ছ অত্যাচার করত হিন্দু প্রজাদের ওপরে, কখনও কখনও দাঙ্গাও হত এবং ক্ষেত্রবিশেষে নবাবের পক্ষপাতিত্ব পীড়নের চেহারায় দেখা দিত। নতুন ইংরেজ রাজত্বেও বহুদিন চালু ছিল এ অত্যাচার। এ অবস্থায় বাংলার তিন ভাগ মূর্খ, দরিদ্র, অসহায় মানুষের, জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সমাজে প্রচলিত ধর্ম তাকে কোন তিথিতে কী করণীয়, কী নয় তার ক্রমবর্ধমান তালিকা দিচ্ছে। প্রত্যবায় ঘটলে কী প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তার অনুষ্ঠান ও খরচের ফিরিস্তি দিচ্ছে, এতে সাধারণ মানুষ প্রায় দমবন্ধ অবস্থায় পৌঁছেছে। তার আশা-আকাঙ্ক্ষা মাথা খুঁড়ছে রুদ্ধদ্বার আচার-সর্বস্ব ভেদবুদ্ধিনিষ্ঠ জাতপাতের প্রাচীরে। হিন্দু এবং মুসলিম নিম্নবর্গের মানুষ দু’জনেই নিপীড়িত হচ্ছে সমাজের নীচের তলায়। মন্দির-মসজিদের শাসনে এরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এই খাঁচার পাখিরা যখনই পেরেছে উড়ে গেছে খাঁচা থেকে, প্রতিবাদের কথা বলেছে গানে কবিতায়, প্রতিষ্ঠা করেছে আপন বোধ-বিশ্বাসের ভরসায় নতুন বিশ্বাস-ভক্তি-মৈত্রীর উপাসনারীতি। গ্রাম্য বাংলায় এরা গান বেঁধেছে যে-বাংলা তার পড়শিরা বোঝে, যারা সমাজে নিষ্পিষ্ট হতে হতে পালিয়ে চলে এসেছে সহজ বিশ্বাসের খোলা বাতাসে।

বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব তখনও দেশ থেকে মিলিয়ে যায়নি, বৌদ্ধ এবং তন্ত্রের প্রভাবও আঞ্চলিক ভাবে রয়েছে। সহজযানের ধারা এ দেশের প্রাণের কাছাকাছি একটি ধারা; এর উদারতন্ত্রী মত হিন্দু-মুসলমান দু’জনের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিল। সহজিয়া সাধনাতে কঠোর রীতিনীতির বাঁধন নেই। সম্প্রদায়ভেদ নেই, গুরু এখানে দেবতা নন, পথপ্রদর্শক মাত্র, সাঁই, ঠাকুর। জীবনের নানা দুঃখ-সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানুষ যখন ধর্মে সান্ত্বনা খোঁজে তখনও যদি গুরু মধ্যস্থতার দক্ষিণা নেন, তা হলে দরিদ্র মানুষ সম্পূর্ণ নিরুপায় বোধ করে। বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক সহজিয়া সাধনা, সূফি ও বাউল সাধনার ধারা তাই ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল; এ সব ধর্মধারায় খাজনা মাশুল নেই, পুরোহিতের দৌরাত্ম্য নেই। অতএব মানুষে মানুষে নিঃশঙ্ক আত্মীয়তা, সহজ উপলব্ধির সহজ প্রকাশ, নীতিনিষ্ঠ নিরুদ্বেগ সহজ জীবনচর্চার মধ্যেই সাধনার আশ্রয়।

চণ্ডীদাসের কিছু পরবর্তী কালে কাজি দৌলত লেখেন, ‘নর সে পরম দেব/নর সে ঈশ্বর।’ তুলসীদাসের সমকালীন মালিক মুহম্মদ জৈসী হিন্দু উপাখ্যান কল্পনা করে ‘পদ্মাবৎ’ লেখেন, আলাওল রাধাকৃষ্ণকে উপজীব্য করে কাব্য রচনা করেছেন। চতুর্দশ শতকের শাহ মুহম্মদ সগির রচনা করেন ‘ইউসুফ-জোলেখা’ তাতে দু’সম্প্রদায়ের সাম্যের ওপরে তাঁর কবিতা পাই,

‘মোরা একভাষাতে মাকে ডাকি
একসুরে গাই গান
মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম
হিন্দু মুসলমান।’

এমনই কথা হিন্দু কবি মদন বাউল বলেন,

‘যদি করিস্ মানা ওরে বন্ধু
মানি এমন সাধ্য নাই
কোনো ফুলের নামাজ রং বাহারে
কারও গন্ধে নামাজ অন্ধকারে
বীণার নামাজ তারে তারে
আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।’

মুসলমান দরাফ খাঁ সংস্কৃত কবিতা রচনা করতেন, গঙ্গাস্তোত্রও রচনা করেন। মুসলমান গায়ক আজও রাধাকৃষ্ণ অবলম্বনে রচিত মার্গসঙ্গীত গান করে থাকেন অনায়াসে, সেদিনও করতেন। ঊনবিংশ শতকে কিছু হিন্দু পণ্ডিত আরবি ফারসি পড়তেন ও প্রয়োজনমতো লিখতেনও। সংস্কৃতির ঐকতানে দু’সম্প্রদায়েরই বিশিষ্ট দান ছিল। কিন্তু সাধারণ ভাবে অষ্টাবিংশ শতকের শেষার্ধে এক ধরনের ঊষরতা ছিল ধ্রুপদী সাহিত্য ও ধর্মধারায়। তখন মার্গ সাহিত্যও প্রাণ ভরাবার উপাদান বেশি জোগাতে পারছিল না। ভারতচন্দ্রের পরে উঁচুমানের সাহিত্যসৃষ্টি কমে এসেছিল, নিম্নরুচির খেউড়, তরজা, কবিগানে মানুষ মন ভরাবার চেষ্টা করছিল। সবদিকে দুঃসহ পরিবেশে বাংলার নানা প্রান্তে প্রান্তিক সাধনার ধারা প্রবর্তিত হচ্ছিল, তবে কেন্দ্রস্থল ছিল নদিয়া জেলা। চৈতন্যের নবদ্বীপ থেকে হরিভক্তির জোয়ারের জল সরে গেলেও জমি ভিজে ছিল। তাই হয়তো শ’দেড়েক বছর পরে নদিয়ারই নানা প্রান্তে নানা সাধনার কেন্দ্র স্থাপিত হল, বাংলার অন্যত্রও এর ঢেউ পৌঁছেছিল এবং সাধকরা সে সব অঞ্চলেও নিজেদের স্বত-উৎসারিত গানে আকাশ মুখর করছিল।

এই প্রতিবাদী ধারার মুখ্য সাধক লালন ফকির। এঁর জন্ম আনুমানিক ১৭৭৪ সালে, মৃত্যু সম্বন্ধে লোকে বলে যে, তিনি একশো ষোলো বছর বয়সে ১৮৯০ সালে মারা যান। লালনের জন্মকাল যেমন কতকটা কুয়াশায় ঢাকা, পিতামাতার পরিচয়ও তেমনই রহস্যাবৃত; কেউ বলে ইনি হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মে দৈবদুর্বিপাকে পরিবারচ্যুত হয়ে মুসলমানের আশ্রয়ে লালিত। চলতি গল্পটা হল বারুণীতে গঙ্গাস্নানে গিয়ে এঁর বসন্ত হয়, তখন পরিবারের সকলে এঁকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে গেলে, এক মুসলমান ফকির এঁকে পুনরুজ্জীবিত করেন। ইনি নিজে বলতেন, সাঁই দরবেশ এঁর গুরু। এর জীবনের বেশির ভাগ কাটে কুষ্ঠিয়ার কাছে ছেঁউড়িয়া গ্রামে। সহজিয়া, মরমিয়া সাধনার বহু গান ইনি রচনা করেন, বর্তমান প্রবন্ধে সেগুলি গৌণ। এখানে মুখ্য হল লালনের সমন্বয়বাদী বাণী। নিজের ‘জাত’ সম্বন্ধে কোনও পরিচয় দিতে এঁর আপত্তি ছিল: ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/লালন ভাবে জাতির কি রূপ/দেখলাম না এ নজরে।’ জাত ব্যাপারটা সম্বন্ধেই লালনের অসহিষ্ণুতা ছিল: ‘লালন বলে হাতে পেলে/জাত পোড়াতাম আগুন দিয়ে।’ জাতিভেদ এবং তারই অন্তর্গত সম্প্রদায়ভেদ সমাজে কী পরিমাণ বিষ ছড়াচ্ছিল, মানুষের মনুষ্যত্বের মর্যাদা কী ভাবে নষ্ট করছিল তা দেখেই এই পবিত্র ক্রোধ।

‘এক এক দেশে এক এক বাণী কোন্ খোদা পাঠায়?
যদি একই খোদার হয় বর্ণনা/তাতে ত ভিন্ন থাকে না,
মানুষের সকল রচনা
তাই তো ভিন্ন হয়।’

‘ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছে সাঁই।
হিন্দু কি যবন বলে তার কাছে জাতের বিচার নাই।’

কী অসাধারণ স্বচ্ছ দৃষ্টি এ সাধকের। হিন্দু, মুসলমান, সূফি দরবেশ, সাঁই, ফকিরদের সঙ্গে নিয়ত আলাপ-আলোচনা করে, এঁদের সাধনার অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাই নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে, যদি ঈশ্বর বলে কেউ থাকতেন, এ বিভেদ থাকত না। জাত-সম্প্রদায় এ সব মানুষেরই সৃষ্টি, তাই এত ভেদ। স্বর্গ নরক নিয়ে বহু যুক্তিতর্ক শাস্ত্রের অবতারণা সব ধর্মে, লালন বলেন,

‘কে জানে ম’লে জীব যাবে কোথায়?
হাতের কাছে পেলে যারে দেখ গো তায়।’

এই সম্পূর্ণ অনন্তরিত বোধ—হাতের কাছে যাকে পাচ্ছ সেই মানুষকে দেখ জীবনে; মৃত্যুর পরে কে কোথায় যায়, কেউ কোথাও যায় কি না, এ সব অনুমানের চর্চা নিষ্ফল। জাত দিয়ে মানুষকে পৃথক করে পুরোহিত, শাস্ত্র, সমাজ কিন্তু সত্যদর্শী সাধক বলেন,

‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানুষের উত্তম কিছু নাই।’

মহাভারতের আবারও প্রতিধ্বনি, ‘ন মানুষাচ্ছ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ’। আর তা-ই যদি হয় ত, যেহেতু হিন্দু-মুসলমান দুই-ই মানুষ, তাহলে দুজনের মধ্যে ভেদ ত কৃত্রিম, অসত্য।

সাধনা কী, ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছে সাঁই
হিন্দু কি যবন বলে’-
তার কাছে জাতের বিচার নাই।’

শুধু তাই নয়, স্পষ্ট উচ্চারণে বলেন,

‘জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে।’

এই বোধ তখন সমাজের গভীর বোধ-প্রবণ সাধারণ মানুষের মনে উদিত হয়েছিল, লালিত হচ্ছিল সংগোপনে শাস্ত্রের ভেদবুদ্ধি এড়িয়ে। লালনের জীবনীকার শিষ্য দুদ্দু শাহও বলেন,

তিনি আরও বলেন,

‘আগে মানুষ পরে ধর্ম জাতির নির্ণয়।
শূদ্র চাঁড়াল বাগ্‌দি বলার দিন
দিনে দিনে হয়ে যাবে ক্ষীণ।’

‘মহম্মদের জন্ম যদি হত এদেশে
বেহেশতের কোন ভাষা হত
বত এসে?’

আমরা আজও যে স্বপ্ন দেখি লালন সেদিন সেই স্বপ্ন দেখতে দেখতেই চলে গেছেন,

‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে-
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে…
‘জানি আল্লা আর রছুল বিভিন্ন নয়।
যুগলরূপে রাধাকৃষ্ণ বলি স্পষ্ট সর্বঘটে পটে রয়।
কিন্তু দুইজাতে এক সমান বটে
ভাবে পেলাম পরিচর্যা’

কত চাপে কত দুঃখে জাতিভেদদীর্ণ দুঃখী মানুষের এই আকুতি ভাষা পেয়েছিল সেদিন

লালনের গানে। ভেদবুদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব দেখে ক্ষুব্ধ লালন বলেন,

‘ফকিরি করবি খ্যাপা কোন রূপে
হিন্দু-মুসলমান দুইজন দুইভাগে
আছে বেহেস্তের আশায় মমিনগণ
হিন্দুদিগের স্বর্গেতে মন।

এর মধ্যে দু’-সম্প্রদায়ের নামপার্থক্যে নিষ্ঠা নিয়ে একটা শ্লোকও আছে। সমাধান পেয়েছেন এই বলে,

‘যে যা ভাবে সেইরূপে সে হয়
রামরহিম করিম কালা এক আল্লা জগৎময়।।’

দু’-সম্প্রদায়ের মধ্যে যখন দুর্লঙ্ঘ্য ভেদরেখা দিয়ে বিচ্ছেদ বজায় রেখেছে সমাজ তখন তারই মধ্যে থেকে তাকে ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিরঞ্জন দৃষ্টিতে মানুষকে দেখা, এটা নেহাত সহজ ছিল না। এই সহজ দৃষ্টির অধিকারী সাধকরা সমাজের বাইরে এসে নিজেদের উপলব্ধি ব্যক্ত করলেন এই সব অমর গানে।

সাহেবধনী সম্প্রদায়ের উদ্ভব নদিয়ার বৃত্তিচ্ছদা গ্রামে কুবির গোঁসাই বা কুবির কবিদার (জাতে যুগী পদবি সরকার) ও পরে তার প্রথম সহচর-সহচরী জাদু-বিন্দুর প্রবর্তনায়। এঁদের সাধনায় তন্ত্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে, ভক্তরা সব সমাজের নিম্নবর্গের। এঁদের ভগবৎ-সাধনা এ প্রবন্ধের আওতায় পড়ে না, কিন্তু সে সাধনার একটা বড় উপলব্ধি হল,

‘মানুষ বই আর কিছু নাই।’
‘এই মানুষে করবে বিশ্বাস
মানুষ মানুষের ভাবপ্রকাশ।’

সাহেবধনী নামটির মধ্যেও এই অসাম্প্রদায়িক মনোভাব আছে, অনেকটা সত্যপীরের মতোই এ নামে দু’টি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব নিহিত আছে।

সেই ব্রজধামের কর্তা যিনি
রাইধনী সেই নামটি শুনি
এই ধনী সেই সাহেবধনী,

কিংবা

‘আছে আর এক সত্যবাণী
দীনদয়াল সাহেবধনী নামের ধনী
ব্রজের রাই ধনী সেই ধনী নদেতে উদয়।’

অথবা

‘পিতা আল্লা মাতা আহ্লাদিনী।’
এই সাম্প্রদায়িক সমন্বয় চেষ্টা এই প্রস্থানের একটি মূল তত্ত্ব।
‘সৃষ্টিকর্তা এক নিরঞ্জন।
হিন্দু-যবন জাত নিরূপণ কিসের কারণ।’

যে যেমন সেই নাম সাধনা করে। হিন্দু আর মুসলমান যারে মানে ভক্তি অনুসারে।’ বা ‘সৃষ্টিকর্তা এক নিরঞ্জন। হিন্দু যবন জাত নিরূপণ দুই কিসের কারণ।’ অনায়াসে বলেছেন রাম কি রহিম-করিম-কালুল্যা-কালা। হরি হরি এক আত্মা। জীবনদত্তা এক চাঁদ জগৎ উজ্জলা।’ ভেদবুদ্ধিকে পাগলামি বলেছেন সাহেবধনীরা, ‘হিন্দু আর যবনের করণ বলব এখন কায়। এরা আসল ছেড়ে নকল ধরে ঠিক যেন পাগলের প্রায়।’ এই কথাই শুনি অন্যত্র,

‘মুসলমানের আল্লাতালা
হিন্দুর কৃষ্ণ ব্রহ্মা-বিষ্ণু ভাবে বিজেলার
এক ঘরে খেলা করে পিজরাত।
খানা দানাপানি একই জানি
বিরুদ্ধ যে ফুকরাতে।’

অর্থাৎ, আসলে হিন্দু-মুসলমান অভিন্ন কারণ তাদের আরাধ্য দেবতাও অভিন্ন, ভেদ শুধু নামে; এবং সেই নামের ভেদকে প্রকৃত ভেদ মনে করে সেইমতো আচরণ করাও মূর্খতা, পাগলামি। দু’ সম্প্রদায়ের শিষ্য এই একই বিশ্বাসে চলতেন, সাহেবধনীরা সম্প্রদায়ভেদ মানতেন না। যেখানে শিক্ষিত পুরোহিত শাস্ত্রকার ও মোল্লারা ভেদবুদ্ধির প্রসার ঘটাচ্ছিলেন সেখানে এই অশিক্ষিত মানুষগুলি অনায়াসে সম্প্রদায়ের ওপারে বিশুদ্ধ মানবরূপে মানুষকে দেখতে পেয়েছিলেন, এবং তাকেই সত্য বলে ঘোষণা করতে পেরেছিলেন।

নদিয়ার দেবগ্রাম অঞ্চলের ভাগা গ্রামে জন্মেছিলেন গরিক এক মুসলমান, নাম খুশি বিশ্বাস। ইনি নিজেকে চৈতন্যের অবতার বলতেন, এঁর শিষ্যরাও তাই বিশ্বাস করতেন ও বলতেন। সম্ভবত এঁরা গানে কবিতায় নিজেদের মত প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু সে সব বিশেষ কিছুই বর্তমান কালের কাছে পৌঁছয়নি। এঁরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করতেন এবং ফকিরি ঢং-এ বাউলগান করতেন। সব সম্প্রদায়ের লোকই খুশি-বিশ্বাসীদের মধ্যে ঠাঁই পেত। এঁরা আনুষ্ঠানিক ভাবে পরস্পরের মুখে অন্ন তুলে দিতেন এবং এই ক্রিয়াকে বলতেন ‘বিশ্বাস’ সম্ভবত প্রবর্তকের পদবি ‘বিশ্বাস’ শব্দটাও এর মধ্যে শ্লিষ্ট আছে। এঁরা নিজেদের মন্ত্রকে বলতেন ‘জতীমারনাম’ এবং এ শব্দটি গাছের পাতায় লিখে কবচের মধ্যে সেটি ভরে দিতেন। এঁরা এঁদের জ্ঞানবুদ্ধিমতে গ্রামের লোকের চিকিৎসা করতেন। উচ্চবর্ণের ও উচ্চশ্রেণির লোককে এঁরা নিজেদের দলে আনতেন না। এই সরল গ্রামীণ ধারাটি অনায়াসে হিন্দু-মুসলমানের ভেদ ঘুচিয়ে জাতপাত তুচ্ছ করে মানুষকে বড় করে দেখতে ও দেখাতে পেরেছিল।

কর্তাভজা সম্প্রদায় শ’ দুই বছর ধরে চলিত ছিল ঘোষপাড়াতে। আউলেচাঁদ, এ ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন, পরবর্তী কালে তাঁর প্রধান শিষ্য রামশরণের ছেলে দুলালচাঁদ (১৭৭৬–১৮৬৩) এ সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেন এবং দুলালচাঁদের মা সরস্বতী দেবী এই দলে ‘সতী-মা’ নামে প্রতিষ্ঠিতা হন। এ দলে গুরুর পরিচয় ‘কর্তা’, তিনি যাঁদের দীক্ষা দেন তাঁরা ‘মহাশয়’ এবং তাদের অনুচরদের নাম ‘বরাতি’– সদস্যরা, এই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। দলের বেশির ভাগই আসতেন গোয়ালা, সদগোপ, কলু, তাঁতি, মুচি এবং মুসলমানদের মধ্যে থেকে। উৎসবে অনুষ্ঠানে প্রথমে হত মুসলমান-ভোজন, এটা না হলে উৎসব অপূর্ণ অঙ্গহীন হত। খ্রিস্টান ধর্মের কিছু প্রভাব থাকায়, শুক্রবার দীক্ষাদান পাপস্বীকার, দশটি নিষেধ ইত্যাদি এর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়। আরাধ্য ‘দীনদয়াল’ নিরাকার; নৈবেদ্য চাল ডাল সবজি। হিন্দু ও মুসলমান এদের মধ্যে সমান প্রাধান্য পেত। যুক্তবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই এঁরা ছড়িয়ে পড়েন। দুলালচাঁদের মৃত্যুর পরে তাঁর শিষ্য পরম্পরা সম্প্রদায় পরিচালনা করতেন। এঁরা যে ‘ভাবের গীত’ করেন তার প্রধান বক্তব্য ওই ভেদবুদ্ধিকে অস্বীকার করা। বেদ, যজ্ঞ, পূজা, গঙ্গাজল, পুরোহিতের পবিত্রতা ও শরিয়ৎকে অস্বীকার করে এঁরা প্রতিষ্ঠিত করতে চান মানুষের প্রাধান্য ও পবিত্রতা। কর্তাভজারা অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে ঊনবিংশ শতক জুড়ে বিস্তৃত এলাকায় এই সাম্প্রদায়িক ঐক্যতত্ত্ব গানে কবিতায় প্রচার করেন, এখনও এঁরা ছোট ছোট অঞ্চলে এই সহজ আন্তরিক সাধনা করে থাকেন।

নদিয়া জেলার মেহেরপুরে জন্ম বলরাম হাড়ির (১৭৮৫–১৮৪৫)। তরুণ বয়সে উচ্চবর্ণের একজনের বাড়ির দরওয়ান ছিলেন, মিথ্যা সন্দেহে গৃহস্বামী তাকে সাংঘাতিক ভাবে মেরে নির্যাতন করেন। বলরাম পালিয়ে গিয়ে বহু বৎসর নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন। পরে সন্ন্যাসী হয়ে গ্রামে ফেরেন এবং তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ যুগী, চামার, চণ্ডাল ও মুসলমানদের নিয়ে একটি দল গড়েন। হিন্দু ও মুসলমান কোনও ধর্মের প্রতিই এঁদের বিন্দুমাত্র আনুগত্য ছিল না; ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা বৈদ্যকে এঁরা দলে নিতেন না। শাস্ত্র, পুরোহিত, পূজা, মূর্তি মন্দির-মসজিদ গঙ্গাজল এ সবের কোনও মাহাত্ম্য স্বীকার করতেন না। নিজস্ব কল্পনায় বলরাম একটি সৃষ্টিতত্ত্ব ও পুরাণকথা সৃষ্টি করে চালু করেন; তার মূল কথা হল সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং বলরামরূপে অবতীর্ণ, শিষ্যরা তাই বিশ্বাস করতেন। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্রের সকল অনুশাসন অগ্রাহ্য করাই এদের প্রধান উদ্দেশ্য, তারই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দু’টি তত্ত্ব; প্রথমত বিশ্ববিধাতা বলে যদি কেউ থাকেন তো তাঁর বিধানে কোনও সুবিচার নেই, মানুষকে অনর্থক কষ্ট দেওয়া যেমন তাঁর কর্ম তেমনি অকারণে যাকে তাকে সব সুখ-সম্পদ দেওয়াও তাঁর অন্য কর্ম। দ্বিতীয়ত, সমাজে উচ্চপদে যাঁরা আছেন, তাঁরা সবাই এই দুর্বিধানের সঙ্গে যুক্ত বলে তাঁদের অগ্রাহ্য করাই উচিত। বলরামি বা বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের তত্ত্ব বাইরে থেকে দেখলে নঞর্থক মনে হতে পারে, কিন্তু এঁরা জাত-সম্প্রদায়ভেদ অস্বীকার করে একদিকে যেমন মানুষমাত্রকেই— বিশেষত নিম্নবর্গীয় ও মুসলমানকে সমান মর্যাদা দিয়েছেন অন্য দিকে তেমনই ওই নিম্নবর্গীয় ও ব্রাহ্মণ্য সমাজে অবহেলিত মুসলমানদের মধ্যে একটা আশ্চর্য কঠিন আত্মমর্যাদার বোধ ও অনমনীয় মেরুদণ্ড সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এর জন্যে সমাজে উচ্চবর্ণের ও বিত্তকুলীনদের হাতে এঁরা বারেবারে অকথ্য অত্যাচার ভোগ করেছেন, কিন্তু বলরাম ছাড়া আর কারও কাছে কখনও মাথা নোয়াননি। সম্প্রদায়ভেদ যাদের সৃষ্টি তাদের অস্বীকার করার মধ্যেই নিহিত ছিল ওই ভেদকে অস্বীকার করা। গানে ও কথায় এই বোধটিই এঁরা প্রচার করেছেন।

যে সব সম্প্রদায়ের কথা আলোচনা হল তাদের মধ্যে উপাসনাপদ্ধতি ও ভগবদ্বিশ্বাসের প্রকৃতি ভিন্ন হলেও কয়েকটি বিষয়ে তাদের গভীর মিল আছে। মানুষে মানুষে কোনও ভেদ তারা মানেনি, সে মানুষ হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব, ব্রাহ্মণ চণ্ডাল যাই হোক না কেন। সব মানুষের সমান মর্যাদা আছে এবং এ ব্যাপারে সমাজের ভেদবুদ্ধির সঙ্গে কোনও আপোশ করতে তারা রাজি নয়। এবং প্রত্যেকটি ধারাই জনপ্রিয় ছিল, বহু মানুষ এদের অনুগামী ছিল, এবং আঞ্চলিক ভাবে এখনও আছে। এটা কী করে সম্ভব হল? ধর্মের যে মূল ধারাটি পুরাণ-স্মৃতির অনুশাসনে হিন্দুদের এবং কোরাণ-শরিয়তের অনুশাসনি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ করত, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে সেই শাস্ত্র পুরোহিতের চাপে বেশ কিছু মানুষ দমবন্ধ অবস্থায় পৌঁছেছিল। প্রধানত দু’টি কারণে, প্রথমত হিন্দু-মুসলমানের, পুরোহিত-মোল্লা দু’জনেই ভেদবুদ্ধির দ্বারা দু’ধর্মের সাধারণ মানুষকে পরস্পর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল, সেটা তারা মেনে নিতে পারছিল না। দ্বিতীয়ত, চৈতন্যের সময় থেকেই এ দেশে সম্প্রদায় ও জাতিভেদের একটা মানবিক বিকল্প— সংহতি, পরস্পরের কাছে ও পাশে থাকার সৌভ্রাত্রের একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন ছিল। তান্ত্রিক ও বৈষ্ণব উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাধারণ যে একটি সহজ সাধন-ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল তার মধ্যে শাস্ত্রপুরোহিতের দৌত্য ছিল না। সমাজের অবজ্ঞাত ও নির্যাতিত মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ধরা পড়ে যে, ব্রাহ্মণধর্ম বা শরিয়তির কড়াকড়ি বিভেদের প্রশ্রয় দেয়, বিত্তহীন ও নিম্নবর্ণের মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় না। বহুদিন বহু মানুষকে প্রতারণা করা সম্ভব, চিরদিন সব মানুষকে প্রতারণা করা যায় না। তাই অন্তরের উপলব্ধিতে মানুষ হিন্দু-মুসলমান প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার ফাঁকি ও অমানবিকতা বুঝতে পারে। এবং প্রতিবাদ করে।

এ প্রবন্ধে আলোচনার বিষয় হল সেই প্রতিবাদ। মুখ্য ধর্মধারা থেকে কিছু মানুষ বারেবারেই সরে এসে প্রতিবাদ করেছে তা প্রথম ভূমিকা প্রবন্ধেই আলোচিত হয়েছে। এখানে অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ থেকে যুক্তবাংলার সেই প্রতিবাদী ধর্মধারাকে, সেই উজানী ধর্মকে বোঝবার চেষ্টা আছে। এটি বাংলার নিজস্ব ধর্মপন্থা।

ভুলে গেলে চলবে না যে, বেদের ব্রাহ্মণ যুগে বিহারের সদানীরা নদী পেরোলে, বাংলায় এসে পড়লে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত, কারণ পূর্ব দিকের এ সব অঞ্চল ছিল অনার্যদের দেশ। এ সেই বাংলা– আর্যধর্মকে গ্রহণ করেছে বহুকাল পরে। গ্রহণ করেও নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। তত্ত্বকথায় ‘জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’ বলেনি, সহজে উচ্চারণ করেছে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’, এবং এ কথা বিশ্বাস করেছে বলেই বিভেদের শাস্ত্র মানতে পারেনি; ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল হিন্দু-মুসলমান পেরিয়ে সেই সত্যতর মানুষকে দেখতে পেয়েছে যে স্বে মহিন্নি প্রতিষ্ঠিত, যাকে প্রমাণ করতে বাঙালি সাধক প্রয়াসী হয়নি, অনেক সহজে হাত ধরে তাকে পাশে বসিয়ে খাইয়েছে। পরস্পরকে ভাই বলে মেনেছে বলেই এরা সকলেই মোটের ওপরে শাস্ত্র সম্বন্ধে উদাসীন বলেই উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে রাঢ় বঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত এরা ফিরেছে ভাইয়ের খোঁজে। কোনও তত্ত্বের অনুশাসন কোনও শাস্ত্রের নির্দেশে, কোনও পুরোহিতের রক্তচক্ষুর ভয়েই ভাইকে পর বলেনি। স্বল্প আয়ের নিচু ঘরোয়া বৃত্তি নিয়ে সামান্য উপার্জন করে চালিয়েছে, অথচ চোখকান খোলা রেখে পরিবর্তনশীল অর্থনীতি উৎপাদনব্যবস্থা, রাজনীতি সমাজব্যবস্থা সবই দেখতে পেয়েছে। এদের গানে ধরা আছে সে কথা। কোনও উচ্চাশা এদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়নি, এরা যেন বলেছে ‘সুখে পড়ে থাকি নিচুতেই/থাকি নিচুতে।’ বৃত্তিতে উপার্জনে নীচে থাকলেও এদের চোখ ছিল আকাশে ধরা, তাই চিন্তা বা উপলব্ধি নিচু ছিল না। যে মুক্তদৃষ্টি জাতধর্ম পেরিয়ে মানুষকে তার স্বরূপে দেখতে পায় সেই দৃষ্টি এই প্রান্তিক ধর্মধারার নিজস্ব দৃষ্টি, এবং এ দৃষ্টি হিন্দু বা মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকে স্বীকারই করেনি। কিন্তু তৎকালীন সমাজ এ দৃষ্টি সমর্থন করত না বলে সমাজের বিস্তর বাধা ও অত্যাচার এদের সইতে হয়েছে। তাতে কোনও আত্যন্তিক ক্ষতি হয়নি, কারণ সমাজ শাস্ত্র ছেড়েছুড়ে এরা বেরিয়ে এসেছিল সবাই।

‘মুক্তধারা’ ‘অচলায়তন’-এর ঠাকুর্দা, দা-ঠাকুরে এঁদের প্রতিবিম্ব রয়ে গেছে। সচেতন ভাবে সমাজ পরিবর্তনের ব্রত যেমন এঁদের ছিল না, তেমনি সমাজের বিধিনিষেধকে অতি সহজেই এঁরা উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন। কায়েমি স্বার্থকে সচেতন ভাবে আঘাত করার ব্রত এঁদের ছিল না, কিন্তু স্বভাবতই সমাজ ও তার নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করা, উপেক্ষাভরে বর্জন করাতে সমাজপতিদের অহমিকায় ঘা লেগেছিল, তাই অত্যাচার ও পরিহারে ত্রুটি হয়নি। কিন্তু যে চোখে মানবমৈত্রীর আলো লেগেছে তাতে বিভেদের কলুষ লাগতে পারে না। বিগত চার-পাঁচশো বছরের যে খবর পাই তাতে যুক্তবঙ্গের অধিকাংশ সাধনাই প্রতিবাদী, মানবমুখীন, সৌভ্রাত্রপন্থী। এই হল এ দেশের গৌণ কর্মধারার অন্তর্নিহিত প্ৰাণবস্তু; মুখ্য ধর্মস্রোতকে এড়িয়ে ফল্গুধারার মতো এই প্রতিবাদী ধারাটি সুচিরকাল এ দেশের সাধনাকে উদার ও বিভেদবর্জিত ঐক্যে প্রবাহিত রেখেছে। প্রচলিত এই মুখ্য ধর্মের ক্লেদ, মালিন্য, সংকীর্ণতা ও জাতিবিদ্বেষের ঊর্ধ্বে এরা নিজেদের আদর্শকে রাখতে পেরেছে।

প্রত্যন্ত প্রদেশে যে সমন্বয় সাধনার ধারা প্রবাহিত ছিল তার সমান্তরাল কিছু তরঙ্গ উঠেছিল শিক্ষিত সমাজের লেখাতেও। সাম্প্রদায়িক চিন্তা-আচরণ যে শুধু বিষাক্ত নয়, কৃত্রিম এবং অমানবিকও, এমন কথা অনেকেই বলেছেন। যে-বঙ্কিমচন্দ্রের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে নানা উল্লেখ ইতস্তত পাওয়া যায়, তিনি প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে কতকটা দোলাচলচিত্ত ছিলেন। সুস্থ বুদ্ধি প্রণোদনায় তিনিই তো ১২৮০ সালের পৌষ সংখ্যার ‘বঙ্গদর্শন’-এ মীর মশফ হোসেনের একটি রচনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাঁহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না। ইহার দৃষ্টান্ত আদরণীয়। বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানের দেশ। একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান এক্ষণে পৃথক। পরস্পরের প্রতি সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গলার প্রকৃত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দু-মুসলমানে ঐক্য জন্মে।’ এ মন্তব্য দ্বিধাহীন, আন্তরিক। আজ এ দেশ আবার ভেদবুদ্ধির দ্বারা আক্রান্ত। তাই এর গৌরবময় মানুষকেন্দ্ৰিক ঐতিহ্যটির আর একবার অনুশীলন করবার প্রয়োজন হয়েছে। কোনও প্রলোভনেই কোনও বিভ্রমেই যেন আমরা বাংলার এই উদারপন্থী সাধনা থেকে বিচ্যুত, লক্ষ্যভ্রষ্ট না হই। লালনের দেশের লোক যেন মানবধর্মকে তার মর্যাদায় রক্ষা করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *