বাংলায় মার্কস

বাংলায় মার্কস|
অঞ্জন চক্রবর্তী, অনুপ ধর

মার্কস বললেই মাথায় আসে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। মাথায় আসে ক্যাপিটাল। ভলিউম এক। দুই। তিন। মাথায় আসে জার্মান ইডিয়োলজি।খুব বেশি হলে। আসে না থিওরিস অফ সারপ্লাস ভ্যালু (জানুয়ারি ১৮৬২ থেকে জুলাই ১৮৬৩-র মধ্যে যা লেখা হয়েছে এবং যাকে অনেকেই ক্যাপিটাল-এর অসমাপ্ত চতুর্থ ভল্যুম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন)। আসে না ম্যাথেম্যাটিকাল ম্যানুস্ক্রিপ্টস (যা ১৮৭৩ থেকে ১৮৮৩-র মধ্যে লেখা হয়েছে; যেখানে মার্কসের আলোচ্য বিষয়: ক্যালকুলাস; এক বিশেষ ধরনের ক্যালকুলাস)। আসে না দি এথ্‌নোজিকাল নোটবুকস অফ মার্কস, আসে না গ্রামবাংলা নিয়ে মার্কসের লেখা। গ্রামবাংলা নিয়ে মার্কসের লেখা? মার্কস গ্রামবাংলা নিয়ে লিখেছেন? কবে লিখলেন? কখন লিখলেন? কেন লিখলেন?

মার্কস এথ্‌নোলজিকাল নোটবুকস-এর কাজ শুরু করেন ১৮৮০ সালে। এই নোটবইতে মার্কস লুইস হেনরি মর্গ্যান, জন বাড্ড ফীয়ার, হেনরি সামার মেইন, এবং জন লুব্বক-এর এথ্‌নোলজি সংক্রান্ত লেখাগুলোকে পড়ছেন, নোট নিচ্ছেন… সমালোচনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রিভিউ করছেন। মর্গ্যান, ফীয়ার এবং মেইন-এর লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছে ১৮৭৫ থেকে ১৮৮০-র মধ্যে। এবং ১৮৮০-তেই মার্কস লেখাগুলোর সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। লেখাগুলো মার্কসের জন্য খুলে দিয়েছে দক্ষিণ গোলার্ধ তথা প্রাচ্যের দরজা। হয়তো-বা একটু দেরিতেই; কারণ ১৮৮৩-তে মার্কস মারা যান…

…আর দক্ষিণ গোলার্ধ তথা প্রাচ্য মার্কসের জন্য খুলে দেয় ঔপনিবেশিকতার সাথে নিযুক্তি বা অন্বয়ের সম্ভাবনা। ঔপনিবেশিকতার জটিল ইতিহাসের সাথে নিযুক্তি— দক্ষিণ গোলার্ধ তথা প্রাচ্যর অর্থনীতির সাথে অন্বয় মার্কসকে নিয়ে যায় ক্যাপিটাল-এর এক (উত্তর)ঔপনিবেশিক পাঠের দরজায়‌‌। যা একইসাথে খুলে দেয় অর্থনীতির অন্দরে উত্তর-পুঁজিবাদী বা পুঁজিবাদ-উত্তরিত সম্ভাবনার পথ। উত্তর-ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-পুঁজিবাদী প্র্যাক্সিস কোথায় যেন সম্পর্কিত হয়ে পড়ে মার্কসের শেষ জীবনের লেখায়, কাজে, কথায়।

মার্কসের এই নোটস প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৪ সালে। অনেক অনেক দেরিতে। লরেন্স ক্রেডার সম্পাদিত এই নোটবুকস-এর একটা অংশ জন বাড্ড ফীয়ার-এর ‘এরিয়ান ভিলেজ’-এর উপর। নোটবুকস-এর এই অংশে মার্কস ফীয়ার-এর লেখাকে অবলম্বন করে নোটস নিচ্ছেন। লিখছেন বাংলার গ্রামসমাজের উপর। বাংলার গ্রামসমাজের উপর মার্কসের এই নোটস বা লেখার অনুবাদ করেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনেক বছর আগে, ১৯৮৭-তে; বারোমাস পত্রিকায় তা প্রকাশিতও হয়েছিল। ২০০০ সালের কাছাকাছি আমরা সেই লেখা পড়ি। সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর অধ্যাপক অঞ্জন ঘোষ সেই লেখার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লেখাটা আমাদের পরিচিত এবং প্রচলিত মার্কসবাদকে অনেকটাই বিপন্ন করে।

মার্কস এর কয়েক বছর পরে, রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘পল্লীসমাজ’ বলে অভিহিত করেছেন, যেন লিখছেন তারই উপরে। সালটা ১৮৮০ থেকে ১৮৮২ সম্ভবত। রবীন্দ্রনাথ এই গ্রামবাংলারই এক অনন্য ছবি আঁকবেন কিছু বছর পরে— ১৯২৩ থেকে ১৯২৬-এর মধ্যে— রক্তকরবী নাটকে। এবং একইসঙ্গে সামনে নিয়ে আসবেন মার্কসীয় এবং মার্কস-উত্তরিত রাজনীতির একটা আভাস— উদ্বৃত্ত আহরণের নানান স্তর, ক্ষমতাকাঠামোর সূক্ষ্ম জটিলতা, বিষয়ী সম্পর্কের বিন্যাসের প্রশ্নটা যেখানে এক পরম পারস্পরিকতায় বিধৃত হয়ে থাকে।

ফিরে আসি এথ্‌নোজিকাল নোটবুকস-এর আলোচনায়। এথ্‌নোলজির বাংলা কী হতে পারে? জাতিতত্ত্ব? তুলনামূলক নৃতত্ত্ব? অ্যানথ্রোপলজি যদি নৃতত্ত্ব হয়, তাহলে এথ্‌নোলজি যেন তুলনামুলক নৃতত্ত্ব বা কমপ্যারেটিভ অ্যানথ্রোপলজি, যেখানে দুই বা একাধিক জাতির মধ্যে তুলনামুলক আলোচনা চলছে। আলোচনা চলছে তাদের সমাজ-সংস্থার বিবর্তন নিয়ে। তাদের উদ্ভাবনের নানান ধাপ নিয়ে। তাদের মধ্যেকার তফাত, মানুষের সামগ্রিক সমাজ-বিবর্তনেরও… মানুষের সমাজের সামগ্রিক বিবর্তনেরও… একটা ধারণা দিচ্ছে মার্কসকে। প্রথমে প্রাচীন সাম্যাবস্থা, তারপর দাস-ব্যবস্থা, মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্র, আর আধুনিক স্তরে পুঁজিবাদ— এভাবেই কি এগিয়েছে মানু্ষ-সমাজ? ধাপে ধাপে? স্তরে স্তরে? একটা মোড অফ প্রোডাকশন থেকে অন্য একটা মোড অফ প্রোডাকশন-এ? একটা উৎপাদন সম্পর্ক থেকে অন্য একটা, অর্থাৎ একটা ‘নতুন’ উৎপাদন সম্পর্কে? সম্পূর্ণত? পুরোপুরি? না কি এই পথচলায় আছে জটিলতা? আছে কন্‌ট্রাডিকশন? গ্রামবাংলার গল্পটা কি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ‘বিজ্ঞান’-টাকে, কিছুটা হলেও, এলোমেলো করে দিচ্ছে? যে বিজ্ঞানটার জন্ম পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির ইতিহাস অভিজ্ঞতার নিরিখে (আর, ‘আন্তর্জাতিকতা’-র নামে যাকে চাপানো হয়েছে ‘না-পশ্চিমি’ দুনিয়ার উপর)। প্রাচ্যের পল্লিসমাজের জটিল কাঠামোটা— যেখানে মার্কস মুখোমুখি হচ্ছেন

(১) উদ্বৃত্ত আহরণের, তথা

(২) বিনিময়ের, তথা

(৩) শ্রমের নানান ধরনের সঙ্গে—

তা কি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পশ্চিমি পরিকথাটাকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে, কিছুটা হলেও? এথ্‌নোলজিকাল নোটবুকস-এর এই অংশে— পৃষ্ঠা ২৪৩ থেকে ২৭১-এর মধ্যে— আমরা যেন দুই ধরনের মার্কসবাদী বীক্ষার— বা মার্কসেরই দুটো সম্পর্কিত বীক্ষার— মুখোমুখি হই। একটি বীক্ষা ফীয়ার-পন্থী। অন্যটি যেন কিছুটা হলেও ফীয়ার পরিপন্থী।

১) একটি বীক্ষা প্রাচ্যবাদী— অর্থাৎ, একটি বীক্ষায় পাশ্চাত্য বিবর্তনের/ইতিহাসের/উন্নয়নের উপরের ধাপে, অগ্রসর এক স্তরে, আধুনিকতা বা যন্ত্রসভ্যতার গভীরে/অন্দরে তার জায়গা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। আর সিঁড়ির নীচের ধাপে, কুসংস্কার ও দারিদ্রের অন্ধকূপে পড়ে আছে প্রাচ্য। ফীয়ারের বিবরণ-বর্ণনা এবং মার্কসের নোটস থেকে জায়গায় জায়গায় মনে হবে যে বাংলার গ্রামজীবন এখনও ‘অ্যাবমিনেবল’ কন্ডিশনে রয়েছে (‘অল সর্টস অফ অ্যাবমিনেশন’)। কেন অ্যাবমিনেবল? কেন অ্যাবমিনেশন? বেশিরভাগ মানুষ গরিব। এতটাই গরিব, এমন গরিব… ইংলন্ডের পাঠক এই ধরনের দারিদ্র, না আন্দাজ করতে পারবেন, না কল্পনা করতে পারবেন। আশ্চর্যের বিষয়, এই ধরনের দারিদ্র ভারতবর্ষের সেই প্রদেশের বিশেষত্ব, যে প্রদেশ (অর্থাৎ বাংলা) বা রাজ্য ভারতবর্ষের সবচাইতে ধনী প্রদেশ বা রাজ্য। ফীয়ারের লেখা এবং মার্কসের নোটস-এ আরও একটা ইঙ্গিত: গ্রামের মানুষের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধারণাটা বা সচেতনতাটা কম। পুকুরে মাছ। সেই জলেই চান। সেই জলেই বাসন ধোয়া। সেই জলেই কাপড় কাচা। সেই জলই খাওয়ার জল। নোটস থেকে এও মনে হয়, সমাজে নারীর অবস্থানও খুব ভালো নয়। বৈঠকখানাটা মনে হচ্ছে পুরুষের জন্যই নির্ধারিত; এক্সক্লুসিভলি। নারীর অবস্থান অন্দরে। নোটস পড়ে মনে হয় অন্দর-বাহিরের বিভাজনটা খুব শার্প, খুব স্ট্রিক্ট। যদিও সরষের মধ্যেই আছে ভূত। আছে অবিনির্মাণী (অর্থাৎ, ডিকন্‌স্ট্রাকটিভ) ফাঁকফোকর। কাপড়ের আপাত নিটোল বুননের মধ্যে আছে ফেঁসে-যাওয়া অংশ। প্রাচ্যবাদী দেওয়ালেও আছে ফাটল। নোটসের একই পৃষ্ঠায় গ্রামবাংলার ঢেঁকির একটা মোটামুটি লম্বা বিবরণ। সেই বিবরণের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে ঢেঁকিতে ধান ভাঙার কাজটা বাড়ির মেয়েরাই করছেন। অর্থাৎ নারী উৎপাদন প্রক্রিয়ার অংশভাক। এক্ষেত্রে ধান। যদিও উৎপাদিত ধান কে বা কারা অ্যাপ্রপ্রিয়েট করছেন তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ফিরে আসি ফীয়ার-মার্কসের অন্তর্লীন প্রাচ্যবাদিতায়। ফীয়ারের লেখার পৃষ্ঠা ২১-২৩ থেকে মার্কস নোটস নিচ্ছেন— নারী কুসংস্কারগ্রস্ত (কেন কুসংস্কারগ্রস্ত? কেন ধর্মপ্রাণ নয়? ইউরোপে যাকে ‘ধর্ম’ বলা হয়ে থাকে, গরিব গ্রামবাংলায়, প্রাচ্যের এক প্রত্যন্ত প্রদেশে তাকেই কি কুসংস্কার বলা হচ্ছে?)। নারী ঘরের মধ্যেকার সব কাজ করে, এমনকী বর্ধিষ্ণু শ্রেণির ঘরেও। রোজ তারা পুকুরে জল আনতে যায়। পুকুরধারে মেয়েদের পরনিন্দা-পরচর্চা। প্রতি গ্রামে জ্যোতিষির উপস্থিতি। স্বাস্থ্যের হালও নিম্নমুখী। এই একই গ্রামে আবার বৈরাগী-বৈরাগিনীর, বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর উপস্থিতি। উপস্থিতি তাঁদের সমাজ-সংস্কৃতির। তাঁদের যৌথতার সংগীতের। উপস্থিতি সহজিয়া জীবনযাপন প্রণালীর। গ্রামে নারীর অবস্থানের ছবিটা তাই কোনও সহজ অঙ্কে আঁকা যাবে না। ধর্মের প্রশ্নটাও বহুধাবিভক্ত। নানান আচার-আচরণ, রীতি-নীতি একইসঙ্গে বিদ্যমান।

মার্কসের নোটসে গ্রামের কুসংস্কারগ্রস্ত রায়তকে চিহ্নিত করা হয়েছে সমাজ পরিবর্তনের প্রধান শত্রু হিসেবে, বা প্রধান অন্তরায় হিসেবে (‘দি গ্রেটেস্ট এনিমি অফ সোশ্যাল রিফর্ম’)। এ সেই রায়ত, যার জীবনে কোনও অ্যাম্বিশন নেই। যে এক প্রাচীন সত্তায় (‘প্রিমিটিভ বিয়িং’-এ) আজও বাঁধা পড়ে আছে।১০ সে অল্পতে সন্তুষ্ট, যে না সংস্কার, না এই দমন-নিপীড়ন-শোষণের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। সে ছেলেকে স্কুলে পাঠায় না। সে ওই পুকুরের নোংরা জলই খেতে থাকে। সে জমিতে আলু বা আখের চাষ করে না, কারণ তাঁর পূর্বপুরুষরা করেনি। সে অভ্যাসের দাস…

মার্কসের নোটস থেকে মনে হচ্ছে: রায়ত যেন এক পিছিয়ে পড়া চেতনার উপস্থাপক। প্রোলেতারিয়েতই কি তবে অগ্রসর চেতনার একমাত্র উপস্থাপক? প্রকৃত চেতনা/বিকৃত চেতনা, শুদ্ধ চেতনা/অপরিণত চেতনার এই বিভাজনটা পুরনো; রায়ত/শ্রমিক-এর এই দ্বিত্বটাও (যেখানে রায়ত=অনগ্রসর এবং শ্রমিক=অগ্রসর) একইসাথে প্রাচ্যবাদী, এবং পুঁজিকেন্দ্রিক (পুঁজিকেন্দ্রিক, কারণ পুঁজির সাথে ওতঃপ্রোতভাবে সম্পর্কিত শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গি বা ভ্যানটেজ পয়েন্ট থেকে রায়তকে দেখা হচ্ছে, রায়ত নামক সত্তাটার মূল্যায়ন করা হচ্ছে)। রায়তকে, রায়তের অভিজ্ঞতাকে, রায়তের বিশ্ববীক্ষাকে তার অসংকুচিত পৃথগতায় বোঝার কোনো চেষ্টা এই অ্যাপ্রোচে নেই। তার ফলে দক্ষিণ গোলার্ধ তথা ঔপনিবেশিক দুনিয়ার একটা বড় অংশ মার্কসের কাজে অধরা রয়ে যাচ্ছে।

২) অন্যটি সংশয়ী— প্রাচ্যবাদের প্রশ্নে সংশয়ী, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রশ্নে সংশয়ী। ইতিহাসবাদিতা প্রশ্নে সংশয়ী। সংশয়ী এমনকী এই অতি-চালু ধারণাটা নিয়ে যে অতীতটা ছিল মূলত সামন্ততান্ত্রিক। এবং বর্তমানটা মূলত পুঁজিবাদী। এই অতি-চালু ধারণাটা দাঁড়িয়ে আছে একটা ফান্ডামেন্টাল মিস্টেক-এর উপর। গণিতের চলতি ভাষায় এই ভুলটাকে উপস্থাপিত করলে বিষয়টা এইরকম দেখায়: পুঁজিবাদ=অর্থনীতি। অর্থাৎ ভুলটার ভ্রূণ লুকিয়ে আছে একটা চরম রিডাকশনিজ়ম বা সরলীকরণ/সংকোচন-এ। অর্থনীতিকে, অর্থনীতির জটিলতাকে, অর্থনৈতিক অভিজ্ঞতার বিবিধতাকে, উৎপাদন-বিনিময়-শ্রমের বিভিন্নতাকে পুঁজিবাদ-নামক একটা বিশেষ ধরনের অর্থনীতিতে রিডিউস বা সরলীকৃত/সংকুচিত করে ফেলার ভুল। পুঁজিবাদ অর্থনীতির একটা অংশমাত্র। অর্থনীতিটা পুঁজিবাদের থেকে অনেক বড়। অনেক বেশি জটিল। আইসবার্গের ১/১১ অংশ জলের উপরে থাকে, আর ১০/১১ অংশ থাকে জলের নীচে। সেই ১০/১১ অংশে ধাক্কা খেয়েই টাইটানিক ডুবেছিল। যা দেখা যাচ্ছে, যা দৃশ্যমান, যা প্রকাশিত হয়ে আছে— অর্থাৎ, জলের উপরের ওই ১/১১ অংশ— তাকে যেন আমরা সমগ্র ভেবে না বসি। (অর্থনৈতিক) সমগ্রটা দৃশ্যমান বা প্রকাশিত অংশ— অর্থাৎ পুঁজিবাদ— থেকে অনেক বড়। পুঁজিবাদের ‘আধিপত্য’-টা হয়তো এখানেই: দৃশ্যমান বা প্রকাশিত ১/১১-কে সমগ্র বলে ভেবে নেওয়ার ভ্রম বা ইল্যুশন/ডিল্যুশন-টা উৎপন্ন করার মধ্যে। মার্কস এইরকমই একটা ইঙ্গিত ‘ভ্যালু, প্রাইস এবং প্রফিট’ নামক লেখাটায় রাখছেন। ইঙ্গিতটার ধরন অনেকটা এরকম: আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা অসংখ্য ‘ডিল্যুশন’-এর উপর দাঁড়িয়ে আছে। ডিল্যুশন ১: সূর্যের উদয় হয় পুবদিকে, আর সূর্য অস্ত যায় পশ্চিমে। আদতে পৃথিবীটাই তার নিজের অক্ষের উপর রোজ একটা করে পাক খাচ্ছে। ডিল্যুশন ২: পণ্য তার প্রকৃত মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ, পণ্যের উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম নিহিত আছে, পণ্য সেই মূল্যেই বিক্রি হচ্ছে। ডিল্যুশন ৩: শ্রমিক ততটাই মজুরি পাচ্ছেন যতটা উৎপাদন তিনি করেছেন; তাঁর প্রাপ্যের চেয়ে কিছু কম পাচ্ছেন না তিনি। মার্কস এই লেখায় দেখাচ্ছেন কীভাবে যাকে আমরা ‘জল’ ভাবি, তা আদতে দু’টি অত্যন্ত আগ্নেয়-উৎপাদক গ্যাসের সংমিশ্রণের পরিণতি। পুঁজিবাদী আধিপত্যও কি তেমনই এক ডিল্যুশন? খণ্ডকে সমগ্র বলে ভেবে নেওয়ার ভ্রম?

ডাইভার্স ইকনমিজ় আইসবার্গ (উৎস: www.communityeconomies.org)

মার্কস তো এই ইল্যুশন/ডিল্যুশনটাকেই বুঝতে চান। ভাঙতে চান দৃশ্যমান ইল্যুশন এবং চিন্তা-চেতনার ডিল্যুশনকে। দৃশ্যমান থেকে না-দৃশ্যমানে, প্রকাশিত থেকে না-প্রকাশিততে যাওয়ার নামই তো ‘মার্কস’ (এবং ‘ফ্রয়েড’)। শপিং মল-এ পণ্যের মায়াজাল ছিঁড়ে উৎপাদনের আপাত-অদৃশ্য অন্ধকূপে পৌঁছনোর নামই তো ‘মার্কস’। কমোডিটি থেকে ‘সিক্রেট অ্যাবোড অফ প্রোডাকশন’-এ পৌঁছনোর নামই তো মার্কস। অ্যাপারেন্ট বা রিভিলড থেকে সিক্রেট-এ পৌঁছনোর নামই তো ‘মার্কস’ (এবং ‘ফ্রয়েড’)। ১/১১-কে সমগ্র বলে ভেবে নেওয়ার ইনোসেন্স ভেঙেই তো সেখানে পৌঁছনো যেতে পারে। রাশিয়ার চিঠি— রাশিয়া, যার অধিকাংশটাই এশিয়া(তে), গ্রামবাংলার গল্প-অভিজ্ঞতা-পাঠ মার্কসকে এথ্‌নোলজি তথা বিবর্তনবাদ তথা ইতিহাসবাদ প্রসঙ্গে সংশয়ী করে তোলে। অর্থনৈতিক আইসবার্গের ১০/১১-র দোরগড়ায় যেন পৌঁছে যান মার্কস… ফীয়ারের ‘এরিয়ান ভিলেজ’-এর নোটস নিতে নিতে…

সেই ১০/১১ অংশে মার্কস মুখোমুখি হচ্ছেন এমন সব বিনিময়ের যা বাজারের মধ্য দিয়ে হচ্ছে না। অর্থের মধ্যস্থতা ছাড়াই যেখানে উৎপাদিত সামগ্রীর বিনিময় চলছে (উপরের ছবিতে যাকে ‘বার্টার’ এবং ‘গিফট’ বলে অভিহিত করা হয়েছে)। মুখোমুখি হচ্ছেন এমন শ্রমের যেখানে মজুরি দেওয়া হচ্ছে না (উপরের ছবিতে যাকে ‘আন-পেইড’ লেবার বলে অভিহিত করা হয়েছে)। মুখোমুখি হচ্ছেন এমন সব উৎপাদন-প্রক্রিয়ার যা শোষক (অর্থাৎ এক্সপ্লয়টেটিভ) নয়। মুখোমুখি হচ্ছেন এমন সব শ্রেণিপ্রক্রিয়ার যা না-পুঁজিবাদী (উপরের ছবিতে যাকে ‘নন-ক্যাপিটালিস্ট’ এবং ‘প্রোডিউসার কোঅপারেটিভ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে)। প্রোডিউসার কোঅপারেটিভ তো কমিউনিস্ট শ্রেণিপ্রক্রিয়ারই অন্য নাম। যেখানে উৎপাদকের সমূহ বা সমষ্টি উৎপাদিত প্রোডিউস ভাগ করে নিচ্ছে নিজেদের মধ্যে। অথবা যেখানে উৎপাদিত প্রোডিউস বাজারে পণ্যের আকারে বিক্রি করে উদ্বৃত্ত মূল্য ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে সকল উৎপাদকের মধ্যে।

আমরা কমিউনিজ়মকে ইতিহাসের এক অধ্যায় হিসেবে দেখছি না; আমরা কমিউনিজ়মকে দেখছি বিষয়িতার এক বিশেষ আকার, অভিব্যক্তি বা আদর্শ হিসেবে, একটা বিশেষ বিষয়ী অবস্থান (‘সাবজেক্ট পজিশন’) হিসেবে; যেখানে উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদকেরাই উদ্বৃত্ত আহরণ এবং বিতরণ করছেন বা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন; যেখানে সাম্যাবস্থা একটা বিশেষ শ্রেণিপ্রক্রিয়া; আমরা তাকে কমিউনিস্ট শ্রেণিপ্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেছি; এবং যে অবস্থা বা ব্যবস্থাটা পুঁজিবাদের পাশাপাশিই বিদ্যমান থাকতে পারে বা আছে। বেশি খুঁজতে হবে না— আমাদের ঘর-গৃহস্থালির মধ্যেই সাম্যাবস্থা বা সাম্য-আদর্শে সক্রিয় বিষয়ী থাকতে পারে; থাকতে পারে এমন বিষয়ীর সমাহার, যাঁরা একসঙ্গে উৎপাদন করেন এবং একসঙ্গে উদ্বৃত্ত শেয়ার করে নেন। বাংলার গ্রামে এমন ঘর-গৃহস্থালির সংখ্যা কম নয়।

এথ্‌নোলজিকাল নোটবুকস-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ফীয়ারের লেখাগুলো— প্রাচ্যের গ্রামসমাজ— প্রাচ্যের ‘কমিউন’ সংক্রান্ত লেখাগুলো মার্কসের আর্কাইভ। বাংলার গ্রামসমাজ, কৃষিকাজ, পরিবার-ব্যবস্থা, চাষির জীবনযাপন প্রণালী, উৎপাদন সম্পর্ক, জমির মালিকানা, বিনিময়-ব্যবস্থা, শ্রমের ধরনধারণ নিয়ে কিছুটা আন্দাজ পাওয়ার জন্য। কী ছিল জমিদারের সঙ্গে চাষির সম্পর্ক? কী ছিল সুদের কারবারি, সরকার এবং আইনব্যবস্থার সঙ্গে চাষির সম্পর্ক? খাজনার পরিমাণ ছিল কতটা? কাকে দিতে হত এবং কীভাবে? ফীয়ার যদিও মার্কসকে কোনো একটা বিশেষ গ্রামের গল্প বলছেন না। উনি ব্রিটিশ বা ইংরেজ পাঠকের জন্য বাংলার একটা— যেকোনও একটা— কৃষিনির্ভর গ্রামের সাধারণ বিবরণ বা বর্ণনা দিচ্ছেন।

সুন্দরবন এলাকার কোনো একটা গ্রাম হয়তো-বা। গ্রামে চাষের উপযোগী সমতল-ভূমি। চাষের উপযোগী মাটি। অনেকটা জায়গা জুড়ে জল-জঙ্গল। খোলা জমি। বর্ষাকালে সেখানে হাঁটু জল থাকে। বৃষ্টি থামার পরে সেই জমিতেই সবুজ ধানগাছ। হলুদ ধান। সোনালি ধান। মার্কস লিখছেন তাঁর নোটসে: ‘বাঙালিরা এই জমিকে খেত বলে’। বর্ষাকালের পরে এখানকার জমিতে তেমন কোনও চাষ হয় না। জমি সাধারণত খালিই পড়ে থাকে। আবার চাষ হয় শীতকালে— ‘রবি’ মরসুমে। একটা জমি অন্য জমি থেকে পৃথক করা হয়ে থাকে ‘আল’ দিয়ে। গ্রামে রাস্তা আছে। কিন্তু অধিকাংশই কাঁচা রাস্তা। নদী-নালা-খাল অবশ্য সর্বত্র। হুগলি, গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা এবং তাদের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা জলপথে চলাচলের রাস্তা তৈরি করেছে। বসতিগুলো একটু উঁচু জমিতে। এক একটা বসতিতে কয়েকটা করে ছোট কুঁড়েঘর। ঘরের উঠোনে ধান শুকোচ্ছে। বুড়ি মায়েরা উঠোনে বসে চরকা কাটে সময়ে সময়ে। মার্কসের নোটস থেকে গ্রামবাংলার একটি ছবি উঠে আসে। ছবিটা আমাদের চেনা। কিছুটা হলেও।

মার্কসের নোটস থেকে এও দেখা যাচ্ছে যে গ্রামটা চাষবাসের উপর নির্ভর। যদিও এমন নয় যে গ্রামটাতে শুধু চাষবাসই হচ্ছে। সেই একই গ্রামে কুমোর, কামার, তাঁতি সকলেই কাজ করছে। কাজ করছে পুরোহিত, গোমস্তা। অর্থাৎ গ্রামে কেউ কেউ নিজের জমিতে কাজ করছে। কেউ কেউ অন্যের জমিতে কাজ করছে। অন্যের জমিতে কাজ করে কেউ কেউ মজুরি পাচ্ছে। আবার কেউ কেউ শ্রমের বিনিময়ে মজুরি পাচ্ছে না, পাচ্ছে ধান। অথবা চাল। আবার কেউ কেউ সেলফ-এমপ্লয়েড (উপরের ছবির জলের নীচের ১০/১১ অংশ দেখুন)— যেমন কুমোর-কামার-তাঁতি। গ্রামের গোয়ালাও বাড়িতে বাড়িতে দুধ, দই, ছানা, ক্ষীর বিক্রি করে থাকে।১১ মার্কসের নোটস থেকে মনে হচ্ছে এই কুমোর-কামার-তাঁতিরা, এই গোয়ালা কাজ করেন নিজেদেরই ওয়ার্ক স্টেশনে। একইসঙ্গে তাঁরা উৎপাদন সামগ্রীর মালিক, উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় শ্রমিক, উৎপাদিত পণ্যের বিক্রেতা, এবং উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরক। যেন-বা এক ধরনের স্ব-উৎপাদন ও স্ব-আহরণ (বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েতের সরল দ্বিত্বে অধরা থেকে যায় স্ব-উৎপাদন ও স্ব-আহরণ প্রক্রিয়া)। এই একই তাঁতি আবার কখনও কখনও অন্যের চাষের জমিতে মজুরিশ্রম করে দিন গুজরান করে থাকেন। অর্থাৎ, একই বিষয়ী কখনও কখনও স্ব-আহরক এবং না-শোষক শ্রেণিপ্রক্রিয়ায়— যখন তিনি তাঁত বুনছেন; আবার কখনও কখনও শোষক উৎপাদন প্রক্রিয়ায়— যখন তিনি মজুরি-শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন এবং তাঁর উৎপাদিত উদ্বৃত্ত— কখনও উদ্বৃত্ত মূল্যের আকারে, কখনো উদ্বৃত্ত শ্রমের আকারে— জমির মালিক, বা উৎপাদিত পণ্য/সামগ্রীর মালিকের কাছে চলে যাচ্ছে। জমির মালিক এবং উৎপাদিত পণ্য/সামগ্রীর মালিক কখনও কখনও একই বিষয়ী। কখনও তাঁরা পৃথক বিষয়ী। ফীয়ারের লেখা থেকে নোটস নিতে নিতে মার্কস যেন কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন: ‘নো পিওরলি অ্যাগ্রিকালচারাল ক্লাস অ্যাজ ইন ইংলন্ড’! মার্কস যেন গ্রামবাংলায়, ইংলন্ডের মতো ‘কৃষকশ্রেণি’— নিদিষ্ট এক শ্রেণি যাকে তিনি কৃষিজীবী বলে অভিহিত করতে পারবেন, তা খুঁজে পাচ্ছেন না। যেন খুঁজে পাচ্ছেন না দুই শ্রেণির চেনা বিভাজন: বুর্জোয়া-প্রোলেতারিয়েত, লর্ড-সার্ফ, মাস্টার-স্লেভ। যা হয়তো-বা ইউরোপেরও বিশেষত্ব নয়। গ্রামবাংলার তো নয়ই।

গ্রামের অধিকাংশ চাষি গ্রামের এবং গ্রামের চারপাশের নিচু জমিতে চাষ করেন। মোটামুটি দুই থেকে দশ একর জমি একটা পরিবারের হাতে থাকে। পরিবারে বাবা, ছেলে, কাকা, জেঠা, খুরতুতো-জ্যাঠতুতো ভাই। পুরো জমিটা অনেক সময়ই একসাথে থাকে না। বিচ্ছিন্ন ছাড়া ছাড়া প্লট হয়তো-বা। সকালে লাঙল, গোরু, বলদ নিয়ে পুরুষ চাষিরা খেতে চলে যায়। দুপুরে কখনও কখনও বাড়ি ফিরে পুকুরে চান, এবং খাওয়া। কখনও বাড়ির মেয়েরা খাবার নিয়ে যায় খেতে। বাবা এবং ছেলে মিলে, লাঙল এবং দুটো বলদের সাহায্যে, বড়জোর তিন একর জমি চাষ করতে পারে। বাদবাকি জমি চাষ করার জন্য একে অপরের সাহায্যের প্রয়োজন, প্রয়োজন সহযোগিতার। চাষিদের ছোট ছোট দল এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম, এক খেত থেকে অন্য খেত ঘুরে চাষে সাহায্য করে থাকে, একে অপরকে। শ্রমের পরিবর্তে কখনও ধান পায়। কখনও চাষি খেতে শ্রম দিয়েই শ্রম শোধ করে। শ্রমের বিনিময়ে শ্রম; বা ধান। কতটা ধান, তারও হিসেব আছে। পাঁচ বান্ডিলের পরিবর্তে এক; বা সাত-এর পরিবর্তে এক। মার্কস নোটসের এই অংশে মুখোমুখি হচ্ছেন নন-মার্কেট এক্সচেঞ্জ-এর। না-মজুরি শ্রমের। উৎপাদিত চাল মূলত চাষির ঘরেই খাওয়া হয়ে থাকে।১২ অর্থাৎ উৎপাদিত ধান বাজারে বেচাকেনা হয় না সেরকম। রবিশস্য অবশ্য পণ্যের আকার নেয়। চাষির হাতে যেটুকু টাকার প্রয়োজন, তা আসে রবিশস্যর বিক্রি থেকে।১৩ এক একটা গ্রামে তিন থেকে চারটে মুদির দোকান। সপ্তাহে দু’বার হাট বসে। গ্রামের মুদির দোকানি শহরের ব্যবসায়ীর ‘এজেন্ট’-এর কাছ থেকে দোকানের সামগ্রী কেনে এই হাটে। হাটের বিক্রেতারা গ্রামের জমিদারকে কিছু টাকা ভাড়া দিয়ে থাকে হাটে দোকান লাগানোর জন্য।১৪

মার্কস নোটসের এক জায়গায় লিখছেন: ‘গ্রামের নানান শ্রেণির জীবনযাপন প্রণালী [যেন] একই ধরনের, [যেন] একইরকম’।১৫ যেন দুই যুযুধান শ্রেণি, এবং সেই দুই শ্রেণির পৃথক জীবনযাপনের তত্ত্বটা একটু শিথিল হয়ে পড়ছে গ্রামবাংলায়। নাকি সেটা সর্বত্র এবং সর্বদাই শিথিল ছিল? আমরা জোরজবরদস্তি করে, টেনে হিঁচড়ে সমাজের অন্তর্নিহিত জটিলতাকে দুই যুযুধান শ্রেণির ছকে আনতে গিয়ে, তাকে দ্বিত্বসম সরল করতে গিয়ে সমাজেরই বিপদ বাধিয়েছি। বিপদ বাধিয়েছি সমাজবাদেরও। সমাজবাদী আন্দোলনেরও। যদিও নোটসের ২৪৮ পৃষ্ঠায় মার্কস লিখছেন, গ্রামের জমিদার বা বড়লোক বাড়িতেই দুর্গাপুজোর চল। গরিব কৃষকের পুজো করার ক্ষমতা নেই।১৬ গ্রামবাংলায় সামাজিক সম্মান শুধুমাত্র সম্পত্তি বা বিত্ত হতে আসে না। আসে কতটা ঘটা করে, কতটা খরচা করে, কতটা জাঁকজমক করে একজন এই ‘আধা-সর্বজনীন পারিবারিক দায়িত্বগুলো’ (‘ইন ফ্যাক্ট স্পেকট্যাকল্‌স্‌’— মার্কস রাউন্ড ব্র্যাকেটে যোগ করছেন) পালন করতে পারছেন। অন্য দিকে গ্রামের মহাজনের হাতে পুঞ্জীভূত পুঁজি (অ্যাকুমুলেটেড ক্যাপিটাল)। কখনও কখনও এই মহাজন জমিদারের থেকেও বেশি ক্ষমতাশালী।১৭ অর্থাৎ কোথাও একটা যেন উঁচু-নিচুর, উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্তের, বড়লোক-গরিবের, ব্রাহ্মণ-শূদ্রের, ক্ষমতাবান-দুর্বলের, পুরুষ-নারীর বিভাজনটাও সক্রিয় (‘নারী এবং শূদ্ররা শাস্ত্রের পাঠ হতে বঞ্চিত’)।১৮

গ্রামের জমিদার বস্তুতই গ্রামের বেশিরভাগ জমির মালিক। গ্রামের ‘রায়ত’-রা জমিদারকে খাজনা দেয়। জমির প্রকৃতি ও উর্বরতার উপর নির্ভর করে সেই খাজনার পরিমাণ। মার্কসের নোটসের পৃষ্ঠা ২৫৪ থেকে একটা ছোট বিবরণ তুলে আনলাম নীচে, জমি এবং খাজনার সম্পর্কের উপর:

মার্কসের নোটস থেকে মনে হচ্ছে খাজনার একটা অংশ সরকারের কাছেও যায় ‘ল্যান্ড রেভেনিউ’ হিসেবে। নোটস থেকে এও দেখা যাচ্ছে যে, খাজনা আদায়ের কাজ শুধুমাত্র জমিদার বা জমিদারের নিজের কর্মচারীরাই করছে না। গ্রামে খাজনা আদায়ের আরও সব ‘মধ্য-স্তরের আহরক’-এর উদ্ভব হয়েছে। যেমন, জমিদারেরই আমলারা। যেমন ‘মণ্ডল’— যিনি গ্রামে রায়তদের মাথা। যেমন ব্রাহ্মণ। গ্রামের জমির কিছু অংশ এদের হাতে। ফলে ক্ষমতা, অর্থবল এবং উদ্বৃত্ত আহরণের একটা জটিল মধ্যস্তর তৈরি হয়ে গেছে গ্রামে। যে মধ্যস্তরে অনেক ধরনের ‘সাব-ইনফিউডেশন’— অর্থাৎ, অনেক ধরনের প্রায়-সামন্ততান্ত্রিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক, সিকি-সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক, এবং যে-সম্পর্ক জমিদার ও রায়তের সরাসরি সম্পর্ক নয়। যে-সম্পর্কের এক দিকে রয়েছে নানান ধরনের রায়ত। যে-সম্পর্কের অন্য দিকে অসংখ্য মধ্যস্তরের খাজনা কালেক্টর; নানান ধরনের কালেক্টর সেখানে; বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ এবং স্বার্থের অন্বেষণে তারা এক জায়গায় এসেছে; এক ধরনের যৌথস্বার্থ যেন-বা; রায়তের উপর, রায়তের জীবনের উপর, রায়তের উদ্বৃত্ত মূল্য বা উদ্বৃত্ত শ্রমের উপর তাদের অধিকারের প্রকৃতি যদিও বিবিধ।

‘খাজনা’ তো আদতে উদ্বৃত্ত মূল্য বা উদ্বৃত্ত শ্রমেরই একটা অংশ। খাজনার কালেকশন তো উদ্বৃত্ত বা উদ্বৃত্ত শ্রমেরই আহরণ। কখনও তা টাকাপয়সার ফর্ম-এ আহরিত হচ্ছে। তখন তা উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরণ। কখনও তা ‘সারপ্লাস প্রডিউস’ বা উদ্বৃত্ত শস্যের আকারে আহরিত হচ্ছে। তখন তা উদ্বৃত্ত শ্রমের আহরণ। কখনও কখনও এঁরা সকলে মিলে যৌথ কাছারিও চালায়। জমি সম্পর্কের এই জটিলতা, উদ্বৃত্ত আহরণের এই বিবিধতা, ক্ষমতার বিন্যাসের এই বহুমাত্রিকতা গ্রামবাংলার সাধারণ বিশেষত্ব। হয়তো-বা সব ধরনের সমাজব্যবস্থারই বিশেষত্ব। মার্কস নোটসে গ্রামের রায়ত বাসিন্দাদের সম্পত্তির নিরিখে চারটে গ্রুপ-এ বিভাজিত করেন:

১. ফার্স্ট ক্লাস (প্রথম শ্রেণির রায়ত): এরা প্রায় ১৫ বিঘা বা তারও বেশি জমি চাষ করে থাকে। এদের পরিবারে এক থেকে দুই জন ভাই এবং চার থেকে পাঁচ জন ‘সমর্থ’ (‘গ্রোন আপ’) ছেলে।

২. সেকেন্ড ক্লাস (দ্বিতীয় শ্রেণির রায়ত): এরা প্রায় ৮ থেকে ১০ বিঘা জমি চাষ করে থাকে। এদের পরিবারে তিন থেকে চার জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ। অনেক সময়ই যথেষ্ট সংখ্যক পুরুষ সদস্য না থাকলে এই পরিবারগুলোকে দিনমজুরদের সাহায্য নিতে হয় চাষ করার জন্য। দেখা যাচ্ছে, এদের হাতে মজুরি দেওয়ার মতো পুঁজি রয়েছে। অন্য দিকে দিনমজুরি করার মতো দরিদ্র শ্রমিকও রয়েছে গ্রামে। সেই খেতমজুর বা কৃষি-শ্রমিকের হাতে কখনও কখনও জমি আছে। আবার কখনও নেই।

৩. থার্ড ক্লাস (তৃতীয় শ্রেণির রায়ত): এদের হাতে ৪ থেকে ৫ বিঘা জমি।

৪. ফোর্থ ক্লাস: এদের সংখ্যাটাই বেশি। এঁদের হাতে খুব বেশি হলে ১ থেকে ২ বিঘা জমি। এদের দিন গুজরান হয় মূলত অন্যের জমিতে কাজ করে। এদেরকে প্রথাগত অর্থে চাষি না বলে কৃষি-শ্রমিক বলাটাই ভাল।

মার্কসের নোটস থেকে একটা ছবি তুলে আনলাম।১৯ এই ছবিটা থেকে বিভিন্ন শ্রেণির কতটা করে সম্পত্তি, কতগুলো আসবাব ও সামগ্রীর অধিকারী তারা, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। প্রথম শ্রেণির রায়ত যেখানে ৪৭৭ টাকার মালিক, সেখানে চতুর্থ শ্রেণির ‘প্রায়-শ্রমিক রায়ত’ মাত্র ২৫ টাকার মালিক। তফাত অনেকটাই।

অর্থাৎ, ফারাক শুধু জমিদার এবং প্রজার মধ্যেই নয়। ফারাক ‘প্রজা’ নামক ক্যাটেগরিটির মধ্যে। প্রজা নামক ক্যাটেগরিটাও অসংখ্য ভাগে বিভক্ত। অর্থাৎ, কৃষিজীবী ও শ্রমিকশ্রেণির মধ্যেও অসংখ্য স্তর, অসংখ্য ইন্টারনাল বা অন্দরের বিভাজন। আগেই দেখেছি, শোষিত শ্রেণির মতোই জমিদার বা শোষক শ্রেণিও একটা সমসত্ত্ব শ্রেণি নয়। না শোষক এক সমসত্ত্ব শ্রেণি, না শোষিত এক সমসত্ত্ব শ্রেণি। উভয় শ্রেণির মধ্যেই অগণন ফাটল। অগণন কন্‌ট্রাডিকশন। অসংখ্য টানাপড়েন। গ্রামবাংলার অভিজ্ঞতা দুই যুযুধান শ্রেণির তত্ত্ব— যে-তত্ত্বটাই চালু তত্ত্ব এবং যে-তত্ত্বটাই কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে জায়গা পেয়েছে— তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

মার্কসের গ্রামবাংলার নোটস থেকে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা বহুধাবিভক্ত। বাস্তবতার চেহারা-চরিত্র উপরের আইসবার্গটার মতোই। তাতে অর্থনীতির নানান ধরন। নানান ধরনের অর্থ ও নীতি তাতে একইসঙ্গে বর্তমান। তাতে আছে শোষণের নীতি। তাতে আছে না-শোষক মুহূর্তও। আছে ভাগ করে নেওয়ার আদর্শ। আছে নানান ধরনের শ্রম। মজুরি শ্রম। না-মজুরি শ্রম। নন-ওয়েজ লেবার। শ্রমের পরিবর্তে ধান বা চাল। শ্রমের পরিবর্তে শ্রম: একজন চাষি অন্য চাষির জমিতে শ্রম দেয়; অন্য চাষি পরে সেই চাষির জমিতেই পালটা শ্রম দেয়; যেন শ্রমের বার্টার। একইসঙ্গে উৎপাদিত সামগ্রীরও বার্টার। নারীর গৃহশ্রম: তাও তো শ্রম; নারীর ঢেঁকিতে ধান ভাঙার শ্রম— তাও শ্রম; গৃ্হস্থালির কাজ, রান্নাবান্নার কাজ— তাও শ্রম। সেখানে উদ্বৃত্ত মূল্য নেই; কিন্তু উদ্বৃত্ত উৎপাদন আছে। ক্যাপিটাল ভল্যুম ওয়ান-এ মার্কস যাকে বলছেন ‘সারপ্লাস প্রোডিউস’,২০ আছে সেই উদ্বৃত্ত শ্রম। উৎপাদিত সামগ্রী তাই কখনও পণ্যের আকার নেয়। কখনও তা উৎপাদিত উৎপাদনের আকারেই থেকে যায়। শ্রেণির প্রশ্নটিও জটিল। গ্রামবাংলায় শোষক, না-শোষক, স্ব-আহরক (আজকাল যাকে আমরা সেলফ-এমপ্লয়েড বলি)— নানান ধরনের শ্রেণি বর্তমান। শোষক শ্রেণির মধ্যেও নানান বিভাজন, নানান টানাপড়েন। শোষক শ্রেণিও এক ধরনের নয়। জমিদার যেভাবে শোষক, মধ্যস্বত্বভোগীরা ঠিক সেভাবে শোষক নয়। শোষক শ্রেণির অন্দরেই রয়েছে শোষিত। শোষক শ্রেণির ঘরেই, জমিদার বাড়ির ভেতরেই নারী শোষিত, নারীর উদ্বৃত্ত শ্রমের আহরক জমিদার বাড়ির পুরুষ। আবার জমিদার বাড়ির নারী কৃষকের উদ্বৃত্ত শ্রম বা উদ্বৃত্ত মূল্যের আহরক। চাষির বাড়িতে, জমিদারের হাতে শোষিত কৃষক, নিজের ঘরের কৃষকের গৃহশ্রমের আহরক। শ্রেণি-অস্তিত্ব বা শ্রেণি-অবস্থান তাই বহুধাবিভক্ত। একই বিষয়ী কখনও শোষিত। আবার কখনও সে স্বয়ং শোষক। শ্রেণি-অস্তিত্ব তাই সমসত্ত্ব নয়। শ্রেণি-বিষয়ীও স্থিরীকৃত নয়।

গ্রামবাংলার অভিজ্ঞতার নিরিখে, পদ্ধতিগতভাবে, মার্কস যেন অনেকগুলো সম্ভাবনার মুখোমুখি:

এক: গ্রামবাংলা প্রায় নিশ্চিতভাবেই শুধুমাত্র ‘প্রাক্‌-পুঁজিবাদী’ বা সামন্ততান্ত্রিক নয়। পরিসরটা জটিল। কোনও একটা রঙে এর ছবি আঁকা সম্ভব নয়।

দুই: গ্রামবাংলাকে বুঝতে হলে শুরু করতে হয় এক ধরনের প্রারম্ভিক বা অরিজিনরি বহুত্ব হতে। শ্রেণির বহুত্ব। শ্রমের বহুত্ব। পণ্যের বহুত্ব। বিনিময়ের বহুত্ব। বাজারের বহুত্ব। শোষকের মধ্যেকার বহুত্ব। শোষিতের মধ্যেকার বহুত্ব। উদ্বৃত্ত আহরকের বহুত্ব। উদ্বৃত্ত উৎপাদকের বহুত্ব। দুই শ্রেণির তত্ত্ব এখানে অকেজো। এই মৌল মালটিপ্লিসিটিকে জমিদার-কৃষকের দ্বিত্ব বা দ্বৈত পরিচয়ে খর্বীকৃত করলে তা হয়ে ওঠে অতি সরল এক বিবরণ। মার্কসীয় পরিসরে এ-যাবৎ আমরা এই দ্বিত্বকে অবলম্বন করে রাজনীতি ভেবেছি। মৌল মালটিপ্লিসিটিকে, বিষয়ী অবস্থানের পিচ্ছিল বহুত্বকে, শ্রেণি-অবস্থানের বহুত্ব, আকাঙ্ক্ষার বিবিধতাকে অবলম্বন করে রাজনীতি ভাবলে রাজনীতিটা কী চেহারা নেয়?

তিন: এই প্রারম্ভিক বহুত্ব অবশ্য আমাদের অধরাই থেকে যায়। অধরা থেকে যায় কারণ আইসবার্গের উপরিভাগ, জলের উপরিভাগের আইসবার্গই আমাদের কল্পনাকে অধিকার করে রাখে। কলোনাইজ করে রাখে। (জলের উপরিভাগের) খণ্ড অংশটা সমগ্রর একটা ভ্রম উৎপাদন করে, একটা মায়াজাল বা একটা ইল্যুশন/ডিল্যুশন-এর জন্ম দেয়। মনে হয়, এটাই তো সব। সবই তো পুঁজিতান্ত্রিক। খণ্ডটা সমগ্র হয়ে যায়। আর সমগ্রটা খণ্ডিত হয়ে যায় ‘প্রাক্‌-পুঁজিতন্ত্রে’; অর্থাৎ, পুঁজিতন্ত্রেরই একটা আদি বা পূর্বস্তরে। যার খণ্ডনটা, যার অবলুপ্তিটা, অ্যানিহিলেশনটা ঐতিহাসিকভাবে অনিবার্য। গ্রাম থেকে শহর, কৃষি থেকে কারখানা, প্রাক্-পুঁজিবাদ থেকে পুঁজিবাদ— এটাই তো ইতিহাসের যাত্রাপথ। এই যাত্রাপথে গ্রামবাংলা একটা ছোট স্টেশন— যাকে ধ্বস্ত করেই পৌঁছনো যেতে পারে অন্তিম গন্তব্যস্থলে বা ফাইনাল ডেস্টিনেশনে। সেই ধ্বস্ত করারই অন্য নাম প্রিমিটিভ অ্যাক্যুমুলেশন (আদি সঞ্চয়)। প্রিমিটিভ অ্যাক্যুমুলেশনের অনিবার্যতাটা, জাস্টিফিকেশনটা লুকিয়ে আছে ইতিহাসের এই (আপাত সরল) লজিকে।

চার: আইসবার্গের নীচের অংশটা, জলের নীচের অংশটা তাই যেন থেকেও নেই। পুঁজিতন্ত্রে বিলীন হয়ে যাওয়া ছাড়া সেই অংশটার অস্তিত্ব-ইতিহাসে নেই অন্য কোনো সম্ভাবনা। নীচের অংশটা যেন-বা এক (না)-উপস্থিত অভিজ্ঞতা। যা উপস্থিত হয়েও অনুপস্থিত। যা উপস্থিত হয়েও উপস্থাপিত নয়। আবার যা অনুপস্থিত হয়েও উপস্থিত; উপস্থিত এক অন্তর্লীন অনুরণনের মতো। যা এক সিক্রেট। যা গুপ্ত। অবলুপ্ত নয়। কিন্তু গুপ্ত; গুপ্ত আমাদের কাছে।

পাঁচ: গুপ্ত আমাদেরই কাছে। কেউ চক্রান্ত করে লুকিয়ে রাখেনি। আমাদেরই অস্তিত্বের আয়নায়, আমাদেরই শ্রেণিসত্তার হরাইজনে, আমাদেরই অর্থনীতির ভূগোলে তা ধরা পড়ছে না। তা দেখা দিচ্ছে না। দেখেও দেখা যাচ্ছে না যেন-বা। বাস্তবতার এই মায়া-চিত্রে আমাদেরই অবচেতন সম্মতি। আনকনশাস ইন্টারপিলেশন। এই অবচেতনই আধিপত্য বা হেজিমনির ভ্রূণ।

মার্কসের এই প্রায় শেষ জীবনের নোটস থেকে দুটো সম্পর্কিত অভিজ্ঞা— ওতঃপ্রোতভাবে সম্পর্কিত অভিজ্ঞা— পরম পারস্পরিকতায় বিধৃত দুটো অভিজ্ঞা আকার পাচ্ছে। যা হয়তো-বা ভবিষ্যতের মার্কসচর্যার (শুধু চর্চা নয়) জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে অর্থনৈতিক বাস্তবতার অন্দরে মৌল শ্রেণি-বহুত্ব। পৃথগতা, পার্থক্যের অনিয়ত ক্রিয়া। অন্য দিকে আধিপত্য। আধিপত্যকে আবার দু’ভাবে ভাবা যায়।

এক: আধিপত্যের মায়াজাল, যাতে এই বহুত্ব ঢেকে যায়। তা এক ধরনের গোপনীয়তায় পর্যবসিত হয়। লুপ্ত হয় না। কিন্তু পর্যবসিত হয়। তা যেন জলের নীচে অ-দৃশ্য হয়ে যায়। মনে হয় জলের ওপরের অংশটাই— পুঁজিতান্ত্রিক অংশটাই সমগ্র। অবশেষ বা বাহির (‘আউটসাইড’) বলে বিশেষ কিছু থাকে না। যদিও-বা থাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, তা পুঁজিতন্ত্রেরই পাস্ট, অতীত। যা পুঁজিতন্ত্রেরই অধঃপতিত রূপ। পুঁজির চরম বিরোধিতার মুহূর্তেও আমরা কোথাও যেন পুঁজিকেন্দ্রিকই রয়ে যাই।

দুই: অথবা সেই বহুত্ব, সেই বিভেদনকেই টেনেটুনে সোজা, সরল করে ফেলা। তাকে কিছু মৌল চিহ্ণায়কে (‘নোডাল সিগনিফায়ার’-এ) ক্রুশবিদ্ধ করে ফেলা, যাতে বহুত্ব আবারও দুই-এর ছকে, দুই শ্রেণির দ্বিত্বে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক জটিলতা সংকীর্ণ হয়ে পড়ে পুঁজিতন্ত্রে। গ্রামবাংলা সমসত্ত্ব হয়ে পড়ে সামন্ততন্ত্রে; প্রাক-পুঁজিতন্ত্রে।

গ্রামবাংলার এই নোটস-এ একইসঙ্গে সক্রিয় বহুত্ব এবং আধিপত্যর প্রেক্ষিত। সক্রিয় কেন্দ্রীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণ। সক্রিয় পার্থক্য-প্রণয়ন এবং সমসত্ত্বকরণ। হয়তো এ দুটোকে, পদ্ধতিগতভাবে, একসাথে ভাবতে পারার, ধারণ করতে পারার নামই ‘মার্কস’।

ঋণস্বীকার

১. J. K. Gibson-Graham, The End of Capitalism (As We knew It) : A Feminist Critique of Political Economy (Blackwell : Oxford, 1996). (গিবসন-গ্রাহাম-এর কাজ ও লেখা থেকে আইসবার্গের ছবিটা নেওয়া হয়েছে। ওই ছবিটার কৃতিত্ব ওঁদের দু’জনের।)

২. Karl Marx, Capital: A Critique of Political Economy, vol 1 (Penguin Books: London, 1990).

৩. Karl Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, Second edition (Van Gorcum & Co. B.V.: Assen, 1974).

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

১. কেন ‘এরিয়ান’? বাংলার গ্রামকে, গ্রামবাংলাকে কেন ‘এরিয়ান’ বলে অভিহিত করলেন ফীয়ার? ফীয়ারের ওরিয়েন্টালিজ়ম বা প্রাচ্যবাদিতার একটা ইঙ্গিত এই নামকরণে। যদিও ফীয়ারের লেখা এবং মার্কসের নোটসে রাস্তার ধারের এক ফকিরের দরগার উল্লেখ রয়েছে: যে দরগায় সকলেই— হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে হাজির হয়। উল্লেখ আছে গ্রামে মুসলিম মহল্লার উপস্থিতির (পৃ. ২৫০)। উল্লেখ আছে মসজিদ এবং মৌলবির। এবং কোরান-এর।

২. Karl Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, Second edition (Van Gorcum & Co. B. V.: Assen, 1974), p. 246.

৩. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 249.

৪. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 286.

৫. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, pp. 257, 259.

৬. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 246.

৭. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 248.

৮. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 249.

৯. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 251.

১০. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 257.

১১. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 251.

১২. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 249.

১৩. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 249.

১৪. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 249.

১৫. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 247.

১৬. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 253.

১৭. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 256.

১৮. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 259.

১৯. Marx, The Ethnological Notebooks of Karl Marx, p. 268.

২০. Karl Marx, Capital: A Critique of Political Economy, vol 1 (Penguin Books : London, 1990), p. 159.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *