মোগলমারির আবিষ্কৃত বৌদ্ধমহাবিহার : প্রত্নকথা
উৎখননের ইতিবৃত্ত ও সংবাদ শিরোনামে মোগলমারি
ইতিহাস ও পর্যটন
বৌদ্ধ প্রভাব

বাংলায় বৌদ্ধধর্ম এবং স্থাপত্য ও শিল্পে তার প্রভাব

বাংলায় বৌদ্ধধর্ম এবং স্থাপত্য ও শিল্পে তার প্রভাব  – আশিস বড়ুয়া

 জাগোহে প্রাচীন প্রাচী।
ঢেকেছে তোমারে নিবিড় তিমি
যুগ যুগ ব্যাপী অমারজনীর,
মিলছে তোমার সুপ্তির তীর
 লুপ্তির কাছাকাছি
 জাগোহে প্রাচীন প্রাচী।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রাচীন প্রাচী ধীরে ধীরে সুপ্তির থেকে জাগছে। তার অতীত গৌরবগাথা যা এতকাল শুধু কাব্যকাহিনিতে বিধৃত ছিল, তার নিদর্শন আজ উঠে আসছে বাংলার আনাচ-কানাচ থেকে। আজকের বাংলা, যা অতীতের কেবল এক বিবর্ণ প্রতিকৃতি, তাকে অবলোকন করে কবির খেদ—

বসিত রাজেন্দ্র যথা স্বর্ণ সিংহাসনে,
ফুকারে শৃগাল তথা বিকট নি:স্বনে।
লুপ্ত গৌড়, সমতট, কর্মান্তের চিহ্ন,
কোথা হরিকেল কোথা কর্ণসুবর্ণ!
পথে পথে রাজধানী—ফুলের বাগান,
এতো নহে বঙ্গ—এ যে বঙ্গের শ্মশান।

—বৃহৎবঙ্গ থেকে উল্লেখিত

সেই শ্মশানে অনুসন্ধানরত সত্যান্বেষী ঐতিহাসিকেরা অক্লান্ত পরিশ্রমে উন্মোচন করে চলেছেন অনেক বিস্মৃত সত্য, উপনীত হয়েছেন এক অমোঘ উপলব্ধিতে। কী সেই উপলব্ধি? প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়:

ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রধানত বৌদ্ধ যুগের ইতিহাস আর কলাবিদ্যা বলতে বৌদ্ধ কলাবিদ্যা। ভারতবর্ষের বৌদ্ধ যুগ হচ্ছে এদেশের সভ্যতার সর্বাপেক্ষা গৌরবমন্ডিত যুগ। তাই বৌদ্ধ সম্রাট অশোক এবং তার অমর কীর্তির দিকে আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে।

সেই সত্যান্বেষীরা এও আবিষ্কার করেছেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা সব বৌদ্ধ ছিলেন এবং বাংলা বৌদ্ধধর্মের একটা অগ্রগণ্য ধর্মক্ষেত্র ছিল।

বাঙালি সভ্যতার বুনিয়াদ যে বৌদ্ধ, হিন্দু স্তরের দু-হাত নীচেই যে বাংলার বৌদ্ধ স্তর পাওয়া যায়, আজকের দিনে তা প্রমাণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাটি দুহাত খুঁড়লেই আমরা অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি ও বৌদ্ধমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সাক্ষাৎ পাই।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার মোগলমারিতে সখিসোনার ঢিবি। মাটি খুঁড়তেই সেখান থেকে বেরিয়ে এল নানান ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। পাওয়া গেল বুদ্ধমূর্তি, পোড়ামাটির ব্রাহ্মী লিপি, বেশ কয়েকটি উৎসর্গ ফলক বা ভোটিভ ট্যাবলেট, ল্যাটেরাইট স্টোনের তৈরি দু-টি পিলার, বহুসংখ্যক মাটির প্রদীপ, অর্ঘ্যপাত্র, মাটির গামলা, ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় পাথরের বুদ্ধমূর্তি ইত্যাদি। পরিস্ফুট হল সমগ্র অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একটি বৌদ্ধবিহারের অস্তিত্ব। প্রাপ্ত নামফলক থেকে জানা গেছে বিহারটির নাম ‘শ্রী বন্দক মহাবিহার’।

মালদহ জেলার জেলাশহর মালদহের দক্ষিণ-পূর্বে ৪০কিমি দূরে হাবিবপুর থানার জগজীবনপুর গ্রামের তুলাভিটা অঞ্চলে একটি পুকুর খনন করতে গিয়ে বেরিয়ে এল এক তাম্রফলক। তাতে সিদ্ধমাতৃকা হরফে, সংস্কৃত ভাষায় বলা আছে: ‘পাল বংশের রাজা দেবপালের পুত্র মহারাজাধিরাজ মহেন্দ্রপাল বৌদ্ধবিহার নির্মাণের জন্য তাঁর রাজত্বের এই অংশের জায়গা নিজ সেনাপতি বজ্রদেবকে সমর্পিত করলেন।’ এই স্থানে উৎখনন করে পাওয়া গেল একটি মিশ্র ধাতুর সিলমোহর। তার মধ্যে দেবনাগরীতে লেখা আছে ‘শ্রী বজ্রদেব কারিত নন্দদীঘি বিহারীয় আর্য ভিক্ষু সংঘ’। অর্থাৎ এই বিহারটির নাম নন্দদীঘির বিহার এবং প্রতিষ্ঠাতা বজ্রদেব।

মুরশিদাবাদ জেলায় ব্যাণ্ডেল-বারহাওড়া লাইনে চিরুটি রেলস্টেশনের নিকটে খননকার্য চালিয়ে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের সন্ধান পাওয়া যায়। ওইখানে প্রাপ্ত একটি ডিম্বাকৃতি সিলমোহর থেকে জানা যায়, এই বিহার রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের আর্য ভিক্ষুদের।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর থানার অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলের ‘ধোসা চন্দনেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন ধোসা গ্রামের লৌকিক দেবতার থান পঞ্চাননতলায় ‘সাহেব বাড়ি’ নামের ঢিবি উৎখননের ফলে একুশ শতকের প্রথম দশকে আবিষ্কৃত হয় আদি ঐতিহাসিক যুগের একটি বৌদ্ধবিহার। ধোসা গ্রামের পূর্বদিকের অদূরবর্তী তিলপি গ্রামের মোল্লা পাড়ায় একযোগে পুরাতাত্ত্বিক খননকাজের ফলে উন্নত নগরসভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সুন্দরবনে ৩০/৩২/৩৩ নম্বর লাটের অন্তর্গত বাইশহাটার মঠবাড়ির প্রত্নস্থলের সঙ্গে উত্তরে বিদ্যাধরী অববাহিকার গাইঘাটার শিমুলিয়া গ্রামে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহার, বালান্দা বৌদ্ধবিহার, বেড়াচাঁপার চন্দ্রকেতু গড়ের বৌদ্ধবিহার, পিয়ালী নদীতীরের বাইশহাটার মঠবাড়ির বৌদ্ধ স্তূপ, সমান্তরালভাবে প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির বৌদ্ধসভ্যতার সাক্ষ্য বহন করছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা পরীক্ষামূলকভাবে বাইশহাটার ঘোষের চকের মঠবাড়ি নামে পরিচিত ঢিবি দু-টি উৎখননের ফলে ইটের তৈরি দু-টি বৌদ্ধ স্তূপের সন্ধান মিলেছে। ‘ধোসা প্রত্নস্থলটি যে বৌদ্ধ স্থাপত্য পরিচয়বাহী সে-সম্বন্ধে বহুলাংশে নিশ্চিত হওয়া গেছে এখানে আবিষ্কৃত এবং সংগৃহীত বিশেষ উল্লেখযোগ্য অনুপম বুদ্ধ-মস্তক নিদর্শন থেকে।’

বাংলার অতীত ইতিহাসের যে প্রতিচ্ছবি আমরা পেয়েছি নানান বিদেশি পরিব্রাজকদের লেখায়, সেই বিস্মৃত অধ্যায় ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন প্রত্ন- উৎখননে। অনাদি অতীত কথা বলছে। প্রকাশ করছে প্রাচীন ইতিহাস। সে-ইতিহাস কিন্তু বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস নয়। আসলে সে-ইতিহাস বৌদ্ধ যুগের ইতিহাস। জাতীয় জীবনের বাহ্য ইতিহাস। বৌদ্ধধর্ম এদেশে তার কী নিদর্শন, কী স্মৃতিচিহ্ন রেখে গিয়েছে এ হল তারই অনুসন্ধান। আমাদের দৃষ্টি বৌদ্ধযুগের স্তূপ, স্তম্ভ, মন্দির ও মূর্তির ওপরই আবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষে বিশাল ক্ষেত্রে মৃত বৌদ্ধধর্মের চিহ্নসকল শুধুমাত্র সংগৃহীত হচ্ছে। সেইসব সম্মিলিতভাবে হয়ে উঠবে বৌদ্ধধর্মের একটি কাঠামো মাত্র। বৌদ্ধধর্মের প্রাণের অনুভূতি তাতে থাকবে না। সেই অনুভব পেতে হলে ধর্মের মূল সুরটিকে ধরতে হবে। বুঝতে হবে তার দ্যোতনা, যা সেই প্রাচীনকালে ঝংকৃত হয়েছিল। যার মূর্ছনায় তৎকালীন জীবনযাত্রা, শিল্প, সাহিত্য, সমাজভাবনা অনুরণিত হয়েছিল।

বুদ্ধের আবির্ভাব খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। এই শতাব্দীতে চীনে কনফুসিয়াস, পারস্যে জরথুস্ট্র, ভারতে মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বৃহত্তর বিশ্বে গৌতম বুদ্ধের প্রবর্তিত ধর্ম দীর্ঘকাল যে ব্যাপক ও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, কনফুসিয়াস অথবা জরথুস্ট্রর ধর্ম তা করেনি। এই প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বাসাম বুদ্ধকে ভারতে এতাবৎকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে অভিহিত করেছেন। কোশাম্বি বুদ্ধকে বিদেশিদের কাছে ভারতের শ্রেষ্ঠ দান বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, চীন, জাপান, কোরিয়া এবং থাইল্যাণ্ডের শিল্প এবং স্থাপত্য, বৌদ্ধ উপাদানের অভাবে দরিদ্র হত। প্রাচীন মঙ্গোলীয় এবং তিব্বতি সাহিত্যের প্রধান অংশ জুড়ে আছে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র। আজও চীন, জাপান, কোরিয়া, সিংহল, থাইল্যাণ্ড, ইন্দোচীন ইত্যাদি অঞ্চলেরলোকেরা বৌদ্ধধর্মকে যেমন বোঝে তেমনভাবে অনুসরণ করে। প্রতিবছর বিদেশ থেকে অসংখ্য তীর্থযাত্রী ভারতে বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি দেখতে আসেন। ভারত ইতিহাসের দেড় হাজার বছর বৌদ্ধধর্ম অধিকার করে আছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে শুরু করে বঙ্গদেশে পালযুগের অবসান পর্যন্ত এর বিস্তার।

পঞ্চদশ শতকে বাংলাদেশে বৌদ্ধধর্ম ও সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। প্রবল জলোচ্ছ্বাস যেমন শহর-নগর প্লাবিত করে জনপদের পর জনপদ ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয় তেমনি এক তীব্র অসূয়া এই ধর্মকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল। বিহার ও স্তূপগুলি হয়েছিল পরিত্যক্ত। ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল গভীর জঙ্গলে, চাপা পড়ে গিয়েছিল মাটির নীচে, নিমজ্জিত হয়েছিল বিস্মৃতির গভীর অন্ধকারে।

বুদ্ধ তাঁর যুগে বসে তার দেশকালে বিদ্যমান সমাজ-সংসার এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতেই সে-যুগের মানুষের কাছে যুগোপযোগী উপদেশ দান করেছিলেন। মানুষকে চিন্তা, ভাবনা, বিশ্বাস প্রভৃতির ক্ষেত্রে বেদসংহিতা এবং উপনিষদ-নির্ভর বেদান্ত দর্শন অনুসারী সাবেক সমাজের ক্ষমতাধারী ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা যে অলঙ্ঘ্য সীমারেখা রচনা করেছিলেন তার চাপে পিষ্ট হয়ে সমাজ তার আধ্যাত্মিক ভাবসত্তা এবং সূক্ষ্ম চিন্তাদর্শ খুইয়ে বাস্তবে এক স্থূল যান্ত্রিক এবং আচারসর্বস্ব ও যাগযজ্ঞ এবং আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকর্মের জাঁকজমকপূর্ণ ‘শবদেহে’ পরিণত হয়েছিল। মানুষকে আকর্ষণ করবার অন্তর্নিহিত দার্শনিক শক্তি তার নি:শেষিত হয়ে গিয়েছিল।

সেই সময় বুদ্ধ বাস্তব পরিপন্থী সেই অমানবিক দর্শনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বেদান্তবাদীদের যাবতীয় আজগুবি কল্পনাকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে জাগতিক মানুষের পার্থিব জীবনের মাহাত্ম্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলেন। নিষ্প্রাণ আচারবাদ এবং ভ্রান্ত অলৌকিক কর্মকান্ডের কারসাজিকে খারিজ করে দিয়ে তিনি পৃথিবীর মানুষের জন্য এক উন্নত নীতি-নৈতিকতাভিত্তিক ভাবাদর্শের রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। আত্মসচেতন ব্যক্তির দায়িত্বপূর্ণ শুদ্ধ নৈতিক চরিত্র এবং বৈষম্যহীন, অসূয়ামুক্ত, নির্মৎসর সামাজিক ব্যবস্থাই এই বাস্তবনির্ভর ভাবাদর্শের মূল ভিত্তি।

বেদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মানবসভ্যতার মহান সন্তান বুদ্ধ একদিন যে ঐতিহাসিক ভাববিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, সেই বিপ্লবের মর্মবস্তুকেই শিষ্য অনুগামীরা যুগ-পরম্পরায় ধারাবাহিকভাবে বহন করে নিয়ে গেছেন সমাজ মানসের বিভিন্ন স্তরে। বৌদ্ধধর্মের দর্শনগত রূপরেখার মধ্যেই তাঁরা রচনা করেছেন সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল এবং কায়েমী স্বার্থের প্রভুদের বিরুদ্ধে নিরন্তর আদর্শগত সংগ্রামের কর্মসূচি।

তারই ফলশ্রুতিতে এবং তাঁর উন্নত ভাবাদর্শে আপ্লুত সমাজ-মানসের অবরুদ্ধ ভাবাবেগ আগলমুক্ত হয়ে আপন ছন্দে পল্লবিত হয়েছিল। বুদ্ধের প্রতি অপরিমেয় শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসায় নিষিক্ত মানুষ সমস্ত সত্তা উজাড় করে গড়ে তুলেছিল স্তূপ, চৈত্য, বিহার। মানসিক বন্ধনমুক্তির আনন্দ বিধৃত হচ্ছিল তাদের শিল্পকলায়, সাহিত্যে। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে রচিত তাদের সে-শিল্পকৃতি আজও আমাদের মুগ্ধ করে।

আজ আড়াই হাজার বছর পরে বিস্মৃতির কুহেলিকা ভেদ করে সেইসব অনুপম শিল্পকৃতি ক্রমে আমাদের গোচরীভূত হচ্ছে। শিষ্যদের কাছে গৌতম বুদ্ধ তাঁর মূর্তি নির্মাণ করতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন। সেই কারণে মূর্তির পরিবর্তে স্তূপ নির্মাণ করে পূজার এক বিকল্প উপায় তাঁর অনুরাগী শিষ্যকুল উদ্ভাবন করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ শিল্প ও ভাস্কর্যের উদ্ভবকে উৎসাহিত করেছিল। আজও যার সাক্ষ্য সগৌরবে বহন করে চলেছে সাঁচী, সারনাথ। পরবর্তী সময়ে কালপ্রবাহের স্বাভাবিক নিয়মে মহাযানীয় চিন্তাধারার প্রভাবে বুদ্ধের মূর্তি সৃষ্টি এর অপ্রতিরোধ্য বাস্তব সত্যরূপে গৃহীত হয়। বুদ্ধের এই মূর্তি কল্পনা গান্ধার রীতি-সংস্কৃতির নৈকট্যে হোক অথবা ভারতের নিজস্ব মথুরা শিল্পরীতির আদর্শেই হোক—মূর্তি সৃষ্টি বা উদ্ভবকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। অনিবার্য বিষয় হয়েই বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রায় চারশত বছর পর প্রকাশ হল বুদ্ধের মূর্তি। মহাযানীয় চিন্তাভাবনা—বুদ্ধের অলৌকিকতা আরোপ, আদিবুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বতত্ত্বের উদ্ভবেই বৌদ্ধ শিল্পচর্চার সূত্রপাত হয় এবং কালক্রমে বৌদ্ধ স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের ক্রমোত্তর বিকাশ ভারতীয় শিল্পকে এক বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। বৌদ্ধ শিল্পচর্চার মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে ভারতীয় শিল্পচর্চার ভিত্তি। থেরবাদীয় আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাবশত ভারতের বৌদ্ধ শিল্পচর্চা ও স্তূপ-ভাস্কর্যে বুদ্ধের বিমূর্ত উপস্থাপনার সূত্রপাত ঘটে। বুদ্ধদেবের অনুপস্থিতি তাই শিল্পে সংরক্ষিত। স্তূপ-ভাস্কর্য শিল্প ক্রমে ক্রমে বিশ্বজনীনতায় স্বীকৃতি লাভ করে তা বহির্ভারতের স্থানে স্থানে বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, জাভা, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে স্তূপ প্রতিষ্ঠার দ্বারা সূচিত। স্তূপগুলিতে মূর্তি সংযোজনও হয় কালধর্মের বাস্তবতা স্বীকার করেই। স্তূপ গড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধমূর্তিসহ বৌদ্ধ শিল্প ও সংস্কৃতির ধারা প্রবর্তিত হয়। শুধু পাথরেই নয়, কালের প্রভাবে মৃত্তিকা ও বিভিন্ন ধাতব পদার্থেও বুদ্ধের মূর্তি নির্মাণ বহুলভাবেই শুরু হয়।

বাংলাদেশে পাথরের অভাব থাকায় এখানে মূলত পোড়ামাটি, তামা, ব্রোঞ্জ দ্বারাই বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্বগণের মূর্তি গড়া হত। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে এ অঞ্চলে কিছু কিছু প্রস্তরমূর্তি আবিষ্কৃত হলেও বিশেষজ্ঞগণের অনুমান এই মূর্তিগুলি সম্ভবত অন্য কোনো স্থান থেকে বহন করে আনা। এই অঞ্চলেও যে প্রস্তর দ্বারা বুদ্ধমূর্তি নির্মিত হত এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা অঞ্চলের সন্নিকটে চন্দ্রকেতু গড়ে। এখানে প্রাপ্ত বুদ্ধ বা বোধিসত্ত্বের মস্তক এবং স্থাপত্য সংস্থান এই অঞ্চলেই প্রস্তরনির্মিত হয়েছিল বলে ভাস্করবিদগণের অনুমান।

বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার ‘বিহারেল’ নামক একটি স্থান থেকে চুনারের বেলেপাথরে প্রস্তুত একটি দন্ডায়মান বুদ্ধমূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তিটিতে গুপ্তযুগের সারনাথ শৈলীর সমস্ত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। ধ্যানমগ্ন, দৃঢ় প্রসারিত নয়নপাত, চক্ষুদ্বয়, নাসিকারন্ধ্র, ওষ্ঠাবয়ব-সংন্যাস, চীবর, উষ্ণীষ, পরিমিত অঙ্গসৌষ্ঠবসমূহ ও সর্বোপরি পেলবতা গুপ্তযুগীয় রীতিকে অতিক্রম করে বাংলার নিজস্ব শিল্পকলার সাবলীলতায় প্রতিষ্ঠিত।

গুপ্তযুগের পরেই পালযুগে বৌদ্ধমূর্তিও ভাস্কর্যের এক পরিণত রূপ লাভ করে। বিশেষ করে ধাতুনির্মিত মূর্তিগুলিই এক উৎকৃষ্ট শিল্পের সৃজন করে বাংলায় বৌদ্ধ শিল্পের এক নবায়ন সূচনা করে। গুপ্তযুগ থেকে পালযুগে উত্তরণে বাংলাদেশের এই নতুন সৃজন শিল্পজগতের আঙিনায় এক বিশেষ অবদানরূপে চিহ্নিত।

পালরাজা ধর্মপালের সময় বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহ যেমন অনূদিত, সম্পাদিত ও রচিত হয় তেমনই নালন্দার ধীমান ও তৎপুত্র বীতপাল নামে শিল্পীদ্বয় গৌড়ীয় শিল্প ও ভাস্কর্যের এক নতুন ধারা প্রচলন করেন।

একাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা ও মগধে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। মহীপাল ও নয়পাল এই পাল নৃপতিদ্বয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সময় মগধের বিক্রমশীল ও বাংলার সোমপুরী বিহার (বর্তমান বাংলাদেশ) শিল্পচর্চার সর্বোচ্চ শিখরে আরূঢ় হয়। গৌড়ীয় শিল্পধারাকে অনুসরণ করেই শিল্পীরা সৃষ্টি করেছেন বৌদ্ধ দেব-দেবীর বহু সুন্দর সুন্দর বিগ্রহ। আরাধ্য দেবতার কঠোর ধ্যানযোগী ভাব পালযুগের বাঙালির কাছে গ্রহণীয় ছিল না। দেবতাদের প্রসন্নতার আভাস, পরিতৃপ্তির চিহ্ন যদি ভক্তদের কাছে না আভাসিত হয় তাহলে সেই শিল্পসৃষ্টি নিরর্থক। ড. কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়:

সেই দেবতাদের মুখ হইবে ধ্যানানন্দে ঢলঢল, এবং সেই মুখে থাকিবে হয় ধ্যানের আবেশ না-হয় ভক্ত-হৃদয়ের উচ্ছল অনুরাগের গভীর তৃপ্তিতে মুদিয়া আসা আঁখি … টোল খাওয়া দুই গালের মাঝে, ঠোঁটের কোণে কোণে ভাসিবে রহস্য-মেদুর মৃদু-মন্দ হাসি মুখের দীপ্তিতে, চোখের ভাষায় ও ঠোঁটের হাসিতে প্রসন্ন দেবতা তাঁহার ভীরু ভক্তকে দিবেন পূজার সার্থকতার আশ্বাস পলে অনুপলে সর্বক্ষণ।

পালযুগের শিল্পীরা মূর্তিতে অরূপ দেবতাকে জীবন্ত রূপ দিলেন মৃত পাথরের গায়ে অথবা ধাতব মূর্তিতে। এ রূপ ছিল বাংলার ভাস্কর্যশিল্পের এক লাবণ্যময় আদর্শ। এই ভাবের প্রয়োগ বিশেষ করে বৌদ্ধ মহাযানীর দেব-দেবী মারীচী, পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী প্রভৃতির মূর্তিতেও প্রকটিত ছিল।

বৌদ্ধধর্মের সাহিত্য ও ভাস্কর্য শিল্পচর্চা ছিল বিহার ও চৈত্যকেন্দ্রিক। যদিও কিছু কিছু নির্মাণ বণিক, নৃপতি ও সাধারণ উপাসকের উৎসাহে গড়ে উঠেছিল। বিহারগুলি ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের আবাসস্থল। এখানে চর্চিত শাস্ত্র ও শিল্পকলা বঙ্গদেশে তথা সমগ্র বিশ্বে প্রসারিত হয়। বিহারের বিভিন্ন পরিবেন বা কোষ্ঠেই তাঁরা বাস করতেন, আবার কোনো কোনো ভিক্ষু বিভিন্ন প্রাসাদ ও গুহায় অবস্থান করতেন। বিহার ও গুহাগুলিই ছিল মূলত বৌদ্ধধর্ম ও শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দু। পরিবেনগুলি ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিদ্যামন্দির। বিহারগুলি যে রাজা, বণিক, উপাসকগণের অকাতর অর্থদানে গড়ে উঠত তা বিভিন্ন শিলালেখ, তাম্র পট্টোলী থেকে জানা যায়। ‘বিহারদান’-কে ‘ধম্মদান’ বলে উপাসকগণ মনে করতেন। বিহারকে সুসজ্জিত করার জন্য বিভিন্ন অলংকরণ সৃজন বৌদ্ধ ভাস্কর্যকে শিল্পক্ষেত্রে এক নতুন প্রতিষ্ঠা প্রদান করেছে। বুদ্ধের ধর্ম সমাজমানসের স্থিতিকে উৎকৃষ্টতার এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছিল যেখানে মানবিক মূল্যবোধের সর্বোচ্চ বিকাশ সাধিত হয়েছিল। সংঘারামকেন্দ্রিক সামাজিক জীবনবোধের সেই স্তরকে সপ্তমে বেঁধে রেখেছিল।

পাল রাজাদের বহুপূর্বেই যে বঙ্গদেশে বহু বিহার বা সংঘারাম ছিল তা চীনা পরিব্রাজক ফাসিয়ান, সুয়ান জাং ও ইৎ-সিং-এর প্রদত্ত বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি। তিব্বতি ঐতিহাসিকগণের বিবরণ থেকেও বাংলার বৌদ্ধধর্ম তথা ভাস্কর্যের অস্তিত্ব বিষয়ে বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। সুয়ান জাং পুণ্ড্রবর্ধনে কুড়িটি, সমতটে ত্রিশটি, তাম্রলিপ্ততে দশটি ও কর্ণসুবর্ণে দশটি বিহার বা সংঘারামের অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।

প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ মঠ, বিহার ও সংঘারামের একটি তালিকা দেওয়া হল:

আশ্রম বিহার (৫০৭ খ্রিস্টাব্দ বৈন্যগুপ্তের গুনাইঘর তাম্রশাসন দ্রষ্টব্য)।

কর্ণসুবর্ণ রঙ্গভিত্তি সংঘারাম

কণকস্তূপ বিহার (সম্ভবত কুমি) পট্টিকেরক পট্টিকায়া?

কাপট্য বিহার (প্রজ্ঞাবর্মা ও তাঁর গুরু বোধিবর্মা)

জগদ্দল বিহার

জিনসেন বিহার

তাম্রলিপ্ত সংঘারাম

ত্রৈকূটক বিহার

দেবীকোট বিহার

পন্ডিতবিহার (চট্টলী)

পুণ্ড্রবর্ধন বিহার (হিউয়েন সাঙ লিখিত পো চি পা)

বজ্রযোগিনী মঠ

বরাহবিহার (তাম্রলিপ্ত সন্নিকটস্থ ইৎ-সিং বিবরণ দ্রষ্টব্য)

বরাড নগরী সন্নগর (বীরভূমের বাড়া / বাবাহ গ্রাম?)

বালান্ডা বিহার (?)

বিক্রমপুরী বিহার

বেজখন্ড (১২২০ খ্রিস্টাব্দ পট্টিকেরক রাজের ময়নামতী তাম্রশাসন দ্রষ্টব্য)

রাজবিহার-জগদ্দল বিহার?

শীলবর্ষ বিহার (বগুড়া)

শ্রীমহাবোধি মন্দির (জগদ্দল বিহার-সংলগ্ন)

সংঘমি বিহার (বাংলাদেশের আসরফপুর তাম্রশাসন দ্রষ্টBব্য)

সমতটের বিহার (নাম অজ্ঞাত)

সোমপুরী বিহার

সুবর্ণ বিহার (নদিয়া, কৃষ্ণনগর)

হলুদ বিহার (পাহাড়পুর দক্ষিণ-পশ্চিমে দীপগঞ্জে স্তূপ?)

তথ্যসূত্র :

 ১. প্রমথ চৌধুরী, মুখপত্র (ভূমিকাংশ), বাংলায় বৌদ্ধধর্ম—সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃ ১১২

 ২. সূর্য নন্দী, মোগলমারিতে আবিষ্কৃত বৌদ্ধবিহার, অত্তদীপ ২০১৩

 ৩. সুজিত বড়ুয়া, পঃ বঙ্গে আবিষ্কৃত বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, বাংলায় বৌদ্ধধর্ম ২০১৪

 ৪. ধূর্জটি লস্কর, পুণ্ড্রদেশে বৌদ্ধ সভ্যতা, বাংলায় বৌদ্ধধর্ম ২০১৪

 ৫. সুপ্রতীপ দেবদাস, সমাজপ্রগতির ধারায় বুদ্ধের দর্শন—একটি আলোচনাত্মক অধ্যয়ন, অত্তদীপ ২০১০, পৃ ৭-৮

 ৬. প্রাগুক্ত, পৃ ১৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *