১৬
বাংলা বিশেষ্যশব্দে সংস্কৃত বিশেষ্যশব্দের অনুস্বার বিসর্গ না থাকাতে কর্তৃকারকে চিহ্নের কোনো উৎপাত নেই। একেবারে নেই বলাও চলে না। কর্তৃপদে মাঝে মাঝে একারের সংকেত দেখা যায়, যেমন : পাগলে কী না বলে।
ভাষাবিজ্ঞানীরা এইরকম প্রয়োগকে তির্যকরূপ বলেন, এ যেন শব্দকে ত্যাড়চা করে দেওয়া। সব গৌড়ীয় ভাষায় এই তির্যকরূপ পাওয়া যায়, যেমন : দেবে জনে ঘোড়ে। বাংলায় বলি : দেবে মানবে লেগেছে, পাঁচজনে যা বলে। “ঘোড়ে’ বাংলায় নেই, আছে “ঘোড়ায়’ : ঘোড়ায় লাথি মেরেছে।
এই তির্যকরূপের ভিতর দিয়েই কারকের বিভক্তিগুলো তৈরি হয়েছে, আর হয়েছে বহুবচনের রূপ, যেমন : মানুষে থেকে, মানুষেরা মানুষেতে মানুষেদের। তোমা আমা যাহা তাহা থেকে: তোমার আমার যাহার তাহার তোমাকে আমাকে ইত্যাদি।
এই তির্যকরূপের কর্তৃকারক এক সময়ে সাধারণ অর্থে ছিল : আপনে শিখায় প্রভু শচীর নন্দনে, সোই আপনে করু সেবা। প্রাচীন রামায়ণে দেখা যায় নামসংজ্ঞায় প্রায় সর্বত্রই এই তির্যকরূপ, যেমন : সুমিত্রায়ে কৌশল্যায়ে মন্থরায়ে লোমপাদে। এখন এর ব্যবহারে একটা বিশেষত্ব ঘটেছে। “বানরে কলা খায়’ বলে থাকি, “গোপালে সন্দেশ খায়’ বলি নে। বাংলার কোনো কোনো অংশে তাও বলে শুনেছি। ময়মনসিংহগীতিকায় আছে : কোনো দোষে দোষী নয় আমার সোয়ামিজনে।
শ্রেণীবাচক কর্তৃপদে তির্যকরূপ দেখা যায়, অন্যত্র যায় না। “বাঘে গোরুটাকে খেয়েছে’ বললে বোঝায় : বাঘজাতীয় জন্তুতে গোরুকে খেয়েছে, ভালুকে খায় নি। যখন বলি “রামে মারলে মরব, রাবণে মারলেও মরব’, তখন বক্তিগত রামরাবণের কথা বলি নে; তখন রামশ্রেণীয় আঘাতকারী ও রাবণশ্রেণীয় আঘাতকারীর কথা বলা হয়।
“জন’ শব্দের তির্যকরূপ “জনা’। একো জনা একো রকমের : এই “জনা’ বিশেষ একজনের সম্বন্ধে নয়, জনগুলি এক-একটি শ্রেণীগত। “একহ’ শব্দ থেকে হয়েছে “একো’।
মনে রাখা দরকার, কর্তৃপদের এই তির্রকরূপ জড় পদার্থে খাটে না। যখন বলি “মেঘে অন্ধকার করেছে’ তখন বুঝতে হবে, “মেঘে’ করণকারক।
গৌড়ীয় ভাষার প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায়, শব্দরূপে সম্বন্ধপদের চিহ্নই প্রাধান্য পেয়েছিল। অবশেষে প্রয়োজনমতো তারই উপরে স্বতন্ত্র কারকের বিভক্তি যোগ করতে হয়েছে। তারই নিদর্শন পাই কর্মকারকে “তোমারে’ “শ্রীরামেরে’ প্রভৃতি শব্দে। আধুনিক বাংলা পদ্যেও এই রে বিভক্তিরই প্রাধান্য। বাংলা রামায়ণ-মহাভারতে কর্মকারকে কে বিভক্তি অল্প। কবিকঙ্কণে দেখা গেছে : খাওয়াব তোমাকে হে নবাৎ আম্ররসে। অন্যত্র : উজানী নগরকে বাসিবে যেন হিম। এরকম প্রয়োগ বেশি নেই।
বাংলা নির্বস্তুক পদার্থ-বাচক শব্দের কর্মকারকে টা টি’র প্রয়োগবাহুল্য, যথা : “মৃত্যুভয় দূর করো’, “চক্ষুলজ্জা ছাড়ো’। কিন্তু ওরই মধ্যে একটু বিশেষত্বের ঝোঁক দিয়ে বলা চলে : মৃত্যুভয়টা দূর করো, চক্ষুলজ্জাটা ছাড়ো। “মৃত্যুভয়টাকে দূর করো’ বলতেও চোষ নেই।
মানুষের বা জন্তু-জানোয়ারের বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন নিয়ে শৈথিল্য করা হয় নি : গোপাল যদি সন্দেশের যোগ্য হয় তা হলে গোপালকেই সন্দেশ দেওয়া যায়। কিন্তু যে বিশেষ্যপদ সাধারণবাচক তার বেলায় কর্মকারকের চিহ্ন কাজে লাগে না, যেমন : রাখাল গোরু চরায়। “গোরুকে’ করায় না। ময়রা সন্দেশ বানায়, “সন্দেশকে’ বানায় না।
বিপদ এই, একটা নিয়মের নাগাল যেই পাওয়া যায় অমনি জুটে যায় অনিয়মের দৃষ্টান্ত, যথা : যে গাড়োয়ান গোরুকে পীড়ন করে সে তো কশাইয়েরই খুড়তুতো ভাই। এখানে গোরু যদিও সাধারণ বিশেষ্য তবু এখানে কর্মকারকে কে বিভক্তি দ্বারা তার সঙ্গে বিশেষ বিশেষ্যের মতো ব্যবহার করা হল। ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো : এখানে “ঝি’ “বৌ’ বিশেষ বিশেষ্য নয়, সাধারণ বিশেষ্য, তবু কে বিভক্তি গ্রহণ করেছে। এটা বেআইনি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু আইন আছে প্রচ্ছন্ন হয়ে। রাখালসাধারণ গোরু চরিয়ে থাকে, সেই তার ব্যাবসা। কিন্তু গাড়োয়ান গোরুকে যে পীড়ন করে সে একটা বিশেষ ঘটনা, না পিটোতেও পারত। বউয়ের উপকারের জন্যে শাশুড়ি যদি ঝিকে মারে সে একটা বিশেষ ব্যাপার, মারাটা সাধারণ ঘটনা নয়। ব’লে থাকি “ময়রা মালপো তৈরি ক’রে, “মালপোকে তৈরি করে’ বলিই নে। কিন্তু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলা অসম্ভব নয় যে : ময়রা মালপোকে করে তোলে জুতোর সুকতলা। মালপো তৈরি করা সাধারণ ময়রা কর্তৃক সাধারণ ব্যাপার; সুকতলার মতো মালপো তৈরি করাটা নিঃসন্দেহ সাধারণ ব্যাপার নয়।
সর্বনামের প্রসঙ্গে করণকারকের নিয়ম পূর্বেই বলা হয়েছে। অন্য বিশেষ্যপদ সম্বন্ধেও প্রায় সেই একই কথা। দ্বারা দিয়ে ক’রে : এই তিনটে শব্দ করণকারকের প্রধান উপকরণ। সর্বনামের সঙ্গে অন্য বিশেষ্যপদের একটা প্রভেদ বিভক্তি নিয়ে; সর্বনামে কে, বিশেষ্যে এ। যথা : হাতে মারা ভালো ভাতে মারার চেয়ে, পৃথিবী পুরাবে তুমি ভরতের ধনে। সর্বনামে এই বিভক্তি বিকল্পে য়, যেমন : তোমায় দিয়ে। নিম্নের দৃষ্টান্তে কর্মকারকের চিহ্ন দেখি নে, যথা : মন দিয়ে শোনো, হাত দিয়ে খাও, লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও। মন দিয়ে কাজ করো, বাজে কাজে হাত দিয়ো না : এখানে মনও নির্বস্তুক, হাতও তাই; এ হাত দৈহিক হাত নয়, এ হাত বলতে বোঝায় চেষ্টা। লোক দিয়ে চিঠি পাঠাও : এ লোক কোনো বিশেষ লোক নয়, সাধারণভাবে যাকে হোক কাউকে দিয়ে চিঠি পাঠাবার কথা হচ্ছে। ঘরামি দিয়ে চাল ছাইতে হবে : এখানে বিকল্পে “ঘরামিকে দিয়ে’ও হয়। কিন্তু ব্যক্তিবাচক বিশেষ্যে কর্মকারকে কে বিভক্তি থাকাই চাই : রামকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ো। মানুষ ছাড়া অন্য জীববাচক বিশেষ্য সম্বন্ধেও এই নিয়ম, যেমন : বাঁদরকে দিয়ে চাষ করানো চলে না, ধোবার গাধাকে দিয়ে ঘোড়দৌড় খেলাবে না কি।
করণকারকে “ক’রে শব্দ অধিকরণরূপের সঙ্গে যুক্ত হয় : গ্লাসে ক’রে জল খাও, তুলিতে ক’রে আঁকো।
করণকারকে “দিয়ে’ আর “ক’রে’ শব্দে পার্থক্য আছে। “পাল্কিতে ক’রে’ যাওয়া চলে, “পাল্কি দিয়ে’ চলে না। খাবার বেলায় বলি “হাতে ক’রে খাও’; নেবার বেলায় বলি “হাত দিয়ে নাও’। একটাতে হাত হচ্ছে উপায়, আর-একটাতে হাত হচ্ছে আধার। পাল্কিতে “ক’রে’ মানুষ যায়, কিন্তু যায় পথ “দিয়ে’। এখানে পাল্কি উপায়, পথ আধার। কিন্তু অর্থহিসাবে বিকল্পে হাত উপায়ও হতে পারে, আধারও হতে পারে। তাই “হাত দিয়ে খাও’ বলাও চলে, “হাতে ক’রে খাও’ বলতেও দোষ নেই।
ব’লে থাকি : বড়ো রাস্তা দিয়ে যখন যাবে গাড়িতে ক’রে যেয়ো। কোনো সাহেব যদি বলে “রাস্তায় ক’রে যাবার সময় গাড়ি দিয়ে যেয়ো’, বুঝব সে বাঙালি নয়। লোক “দিয়ে’ পাঠাব চিঠি, লোকটা উপায়; ব্যাগে “ক’রে’ সে চিঠি নেবে, ব্যাগটা আধার।