১৩
আমাদের শিক্ষার ক্ষেত্র যতই বেড়ে চলেছে ততই দেখতে পাচ্ছি, আমাদের চলতি ভাষার কারখানায় জোড়তোড়ের কৌশলগুলো অত্যন্ত দুর্বল। বিশেষ্যকে বিশেষণ বা ক্রিয়াপদে পরিণত করবার সহজ উপায় আমাদের ভাষায় নেই বললেই হয়। তাই বাংলা ভাষার আপন রীতিতে নতুন শব্দ বানানো প্রায় অসাধ্য। সংস্কৃত ভাষায় কতকগুলো টুকরো শব্দ আছে যেগুলোর স্বতন্ত্র কাজ নেই, তারা বাক্যের লাইন বদলিয়ে দেয়। রেলের রাস্তায় যেমন সিগ্ন্যাল, ভিন্ন দিকে ভিন্ন রঙের আলোয় তাদর ভিন্ন রকমের সংকেত, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপসর্গগুলো শব্দের মাথায় চড়া সেইরকম সিগ্ন্যাল। কোনোটাতে আছে নিষেধ, কোনোটা দেখায় এগোবার পথ, কোনোটা বাইরের পথ, কোনোটা নীচের দিকে, কোনোটা উপরের দিকে, কোনোটা চার দিকে, কোনোটা ডাকে ফিরে আসতে। “গত’ শব্দে আ উপসর্গ জুড়ে দিলে হয় “আগত’, সেটা লক্ষ্য করায় কাছের দিক; নির্ জুড়ে দিলে হয় “নির্গত’, দেখিয়ে দেয় বাইরের দিক; অনু জুড়ে দিলে হয় “অনুগত’, দেখিয়ে দেয় পিছনের দিক; তেমনি “সংগত’ “দুর্গত’ “অপগত’ প্রভৃতি শব্দে নানা দিকে তর্জনী চালানো। উপসর্গ থাকে সামনে, প্রত্যয় থাকে পিছনে। তারা আছে একই শব্দের নানা অর্থ বানাবার কাজে। নতুবা শব্দ তৈরি করবার বেলায় তাদের নইলে চলে না।
শব্দগড়নের কাজে বাংলাতেও কতকগুলো প্রত্যয় পাওয়া যায়। তার একটার দৃষ্টান্ত অন, যার থেকে হয়েছে : চলন বলন গড়ন ভাঙন। এরই সহকারী আ প্রত্যয়, যার থেকে পাওয়া যায় বিশেষ্য পদে : চলা বলা গড়া ভাঙা। এই প্রত্যয়টা বাংলায় সবচেয়ে সাধারণ, প্রায় সব ক্রিয়াতেই এদের জোড়া যায়। এই আ প্রত্যয় বিশেষণেও লাগে, যেমন : ঠেলা গাড়ি, ভাঙা রাস্তা। কিন্তু তি দিয়ে একটা প্রত্যয় আছে যেটা বিশেষভাবে বিশেষণেরই, যেমন : চলতি গাড়ি, কাটতি মাল, ঘাটতি ওজন। মুশকিল এই যে, সব জায়গাতেই কাজে লাগাতে পারি নে, কেন পারি নে তারও স্পষ্ট কৈফিয়ত পাওয়া যায় না। “গড়তি টেবিল’ কিংবা “কথা-কইতি খোকা’ বলতে মুখে বাধে, এর কোনো সংগত কারণ ছিল না। কাজ চালাবার জন্যে অন্য কোনো প্রত্যয় খুঁজতে হয়, সব সময়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে টেবিল গড়া চলছে তাকে সংস্কৃতে বোধ হয় “সংঘটমান’ বলা চলে, কিন্তু বাংলায় কিছু হাৎড়ে পাই নে। যে খোকা কথা কয় ইএ প্রত্যয়ের সাহায্যে তাকে “কথা-কইয়ে’ বলা যেতে পারে। অথচ ঐ প্রত্যয় দিয়ে “হাসিয়ে’ “কাঁদিয়ে’ বলা নিষিদ্ধ। কাঁদার বেলায় আর-এক প্রত্যয় খুঁজে পাওয়া যায় উনে, “কাঁদুনে’। কিন্তু “হাসুনে’ বললে হাসির উদ্রেক হবে। অথচ “নাচুনে’ চলতে পারে। “দৌড়ুনে’ কথার দরকার আছে কিন্তু বলা হয় না, কেউ যদি সাহস ক’রে বলে খুশি হব। “দ্রুতধাবনশীল ঘোড়া’র চেয়ে “জোরে-দৌড়ুনে ঘোড়া’ কানে ভালোই শোনায়। এই শব্দগুলোর প্রত্যয়টাকে ঠিক উনে বলা চলবে না; “নাচুনে’ শব্দের গোড়া হচ্ছে : নাচন + ইয়া = নাচনিয়া। বাংলা ভাষার প্রকৃতি ই এবং আ’কে উ এবং এ কার দিয়েছে, হয়ে উঠেছে “নাচুনে’। এই কথাটা মনে ক’রে কৌতুক লাগে যে, দুটো অসদৃশ স্বরবর্ণকে ঠেলে দিয়ে কোথা থেকে উ এবং এ যায় জুটে।
সংস্কৃতে প্রত্যয় নিয়ম মেনে চলে, বাংলায় প্রায়ই ফাঁকি দেয়। বেসুর-বিশিষ্টকে বলি “বেসুরা’ (চলতি উচ্চারণ “বেসুরো’); সুর-বিশিষ্টকে বলি নে “সুরা’ বা “সুরো’, আর কী বলি তাও তো ভেবে পাই নে। “সুরেলা গলা’ হয়তো বলে থাকি জানি নে, অন্তত বলতে দোষ নেই। বালি-বিশিষ্টকে বলি “বালিয়া’, অপভ্রংশে “বেলে’; কিন্তু চিনি-বিশিষ্টকে বলব না “চিনিয়া’ বা “চিনে’, চিনদেশজ বাদামকে “চিনে বাদাম’ বলতে আপত্তি করি নে।
অনা প্রত্যয়-যোগে হয় “পাও’ থেকে “পাওনা’, “গাও’ থেকে “গাওনা’। কিন্তু “ধাও’ থেকে “ধাওনা’ হয় না। অন্য প্রত্যয় যোগে হতে পারে “ধাওয়াই’। “কুট’ থেকে হয় “কোটনা’; “ফুট’ থেকে “ফুটকি’, হয়, “ফোটনা’ হয় না। “বাঁটা থেকে “বাঁটনা’ হয়; “ছাঁটা’ থেকে “ছাঁটাই’ হবে, “ছাঁটনা’ হবে না।
সংস্কৃতে মৎ প্রত্যয় কোথাও “মান’ কোথাও “বান’ হয়, কিন্তু তার নিয়ম পাকা। সেই নিয়ম মেনে যেখানে দরকার “মান’ বা “বান’ লাগিয়ে দেওয়া যায়। সংস্কৃতে “শক্তিমান’ বলব, “ধনবান’ বলব; বাংলায় একটাকে বলব “জোরালো’ আর-একটাকে “টাকাওয়ালা’। অন্য ভাষাতেও ভাষার খেয়াল ক্ষণে ক্ষণে দেখা দেয়, কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি কম। যেমন ইংরেজিতে আছে : হেল্থি ওয়েল্থি প্লাকি লাকি ওয়েটি স্টিকি মিস্টি ফগি। কিন্তু “কারেজি’ নয়, “কারেজিয়স’। তবু একটা নিয়ম পাওয়া যায়। এক সিলেব্ল্’এর হালকা কথায় প্রায় সর্বত্রই বিশিষ্ট অর্থে y লাগে, বড়ো মাত্রার কথায় এই প্রত্যয় খাটে না।
পূর্বেই বলেছি বাংলা ভাষাতেও প্রত্যয় আছে, কিন্তু তাদের প্রয়োগ সংকীর্ণ, আর তাদের নিয়ম ও ব্যতিক্রমে পাল্লা চলেছে, কে হারে কে জেতে।
সংস্কৃতে আছে ত প্রত্যয়-যুক্ত “বিকশিত পুষ্প’, বাংলায় “ফোঁটা ফুল’। বুক-ফাটা কান্না, চলু-চেরা তর্ক, মন-মাতানো গান, নুয়ে-পড়া ডাল, কুলি-খাটানো ব্যবসা : এই দৃষ্টান্তগুলোতে পাওয়া যায় আ প্রত্যয়, আনো প্রত্যয়। কাজ চলে, কিন্তু এর চেয়ে আর-একটু জটিল হলে মুশকিল বাধে। “অচিন্তিতপূর্ব ঘটনা’ খাস বাংলায় সহজে বলবার জো নেই।
কিন্তু এ কথাও জেনে রাখা ভালো, খাস বাংলায় এমন-সব বলবার ভঙ্গী আছে যা আর কোথাও পাওয়া যায় না। শব্দকে দ্বিগুণ করবার একটা কৌশল কথ্য বাংলায় চলতি, কোনো অর্থবান শব্দে তার ইশারা দেওয়া যায় না। মাঠ ধূধূ করছে, রৌদ্র করছে ঝাঁঝাঁ : মানেওয়ালা কথায় এর ব্যাখ্যা অসম্ভব। তার কারণ, অর্থের চেয়ে ধ্বনি সহজে মনে প্রবেশ করে : উস্খুস্ নিস্পিস্ ফ্যাল্ফ্যাল্ কাচুমাচু শব্দের ধরাবাঁধা অর্থ নেই। তাদের কাছ থেকে যেন উপরিপাওনা আদায় হয়, তাতে ব্যাকরণী টাঁকশালের ছাপ নেই।
বাংলার আর-একরকম শব্দদ্বৈত আছে তাদের মধ্যে অর্থের আভাস পাই, কিন্তু তারা যতটা বলে তার চেয়ে আঙুল দেখিয়ে দেয় বেশি। সংস্কৃতে আছে “পতনোন্মুখ’, বাংলায় বলে “পড়ো-পড়ো’। সংস্কৃতে যা “আসন্ন’ বাংলায় তা “হব-হব’। সেইরকম : গেল-গেল যায়-যায়। সংস্কৃতে যা “বাষ্পাকুল’ বাংলায় তা “কাঁদো-কাঁদো। সংস্কৃতে বলে “অবরুদ্ধস্বরে’, বাংলায় বলে “বাধো-বাধো গলায়’। বাংলায় ঐ কথাগুলোতে কেবল যে একটা ভাব পাওয়া যায় তা নয়, যেন ছবি পাই। একটা শ্লোক বলা যাক–
যাব-যাব করে, চরণ না সরে,
ফিরে-ফিরে চায় পিছে,
পড়ো-পড়ো জলে ভরো-ভরো চোখ
শুধু চেয়ে থাকে নীচে।
ঠিক এরকম একটুকরো রেখালেখ্য এই বাধো-বাধো ভাষাতেই বানানো চলে। বাংলায় বর্ণনার ছবিকে স্পষ্ট করবার জন্যেই এই-যে অস্পষ্ট ভাষার কায়দা, এর কথা বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে ধ্বন্যাত্মক শব্দের আলোচনায় আরও বিস্তারিত করে বলেছি।
বাংলায় কোনো কোনো প্রত্যয় অর্থগত ব্যবহার অতিক্রম ক’রে এইরকম ইঙ্গিতের দিকে পৌঁচেছে, তার উল্লেখ করা যাক : কিপ্টেমো ছিব্লেমো ছেলেমো জ্যাঠামো ঠ্যাঁটামো ফাজ্লেমো বিট্লেমো পেজোমো হ্যাংলামো বোকামো বাঁদ্রামো গোঁড়ামো মাৎলামো গুণ্ডামো।
সংস্কৃতের কোন্ প্রত্যয়ের সঙ্গে এর তুলনা করব? ত্ব প্রত্যয় দিয়ে “কিপ্টেমো’কে কিপ্টেত্ব’ বলা যেতে পারে। কিন্তু ত্ব প্রত্যয় নির্বিকার, ভালো-মন্দ প্রিয়-অপ্রিয় জড়-অজড়ে ভেদ করে না। অথচ উপরের ফর্দটা দেখলেই বোঝা যাবে, শব্দগুলো একেবারেই ভদ্রজাতের নয়। গাল-বর্ষণের জন্যেই যেন পাঁকের পিণ্ড জমা করা হয়েচে। ঐ মো বা আমো প্রত্যয়ের যোগে “বাঁদরামো’ বলি, কিন্তু “সিংহমো’ বলি নে। কিপ্টেমো’ হল, “দাতামো’ হল না। “পেজোমো’ বলা চলে অনায়াসে, কিন্তু “সেধোমো’ (সাধুত্ব) বলতে বাধে। একটা প্রত্যয় দিয়ে বিশেষ ক’রে মনের ঝাল মেটাবার উপায় বোধ করি আর-কোনো ভাষাতেই নেই।
আর-একটা প্রত্যয় দেখো, পনা: বুড়োপনা ন্যাকাপনা ছিব্লেপনা আদুরেপনা গিন্নিপনা। সবগুলোর মধ্যেই কটাক্ষপাত। ব্যাকরণের প্রত্যয়ের যেরকম ভেদনির্বিচার হওয়া উচিত, এ একেবারেই তা নয়। চণ্ডীমণ্ডপে বসে বিরুদ্ধ দলকে খোঁচা দেবার জন্যই এগুলো যেন বিশেষ করে শান-দেওয়া।
আনা প্রত্যয়টা দেখো : বাবুআনা বিবিআনা সাহেবিআনা নবাবিআনা মুরুব্বিআনা গরিবিআনা। বলা বাহুল্য, এর ভাবখানা একেবারেই ভালো নয়। ঐ যে “গরিবিআনা’ শব্দটা বলা হয়েছে, ওর মধ্যেও কপট অহংকারের ভাণ আছে। যদি বলা যায় “সাধুআনা’ তা হলে বুঝতে হবে সেটা সত্যিকার সাধুত্ব নয়।
এই জাতের আর-একটা প্রত্যয় আছে, গিরি। তার সঙ্গে প্রায় “ফলাতে’ কথার যোগ হয় : বাবুগিরি গুরুগিরি সাধুগিরি দাতাগিরি। এতে ভাণ করা, মিথ্যে অহংকার করা বোঝায়।
আরও একটা প্রত্যয় দেখা যাক, অনি বা আনি : বকুনি ধমকানি ছিঁচ্কাঁদুনি শাসানি হাঁপানি নাকানি-চোপানি-চোবানি জ্বলুনি কাঁপুনি মুখ-বাঁকানি খ্যাঁকানি লোক-হাসানি ফোঁপানি গ্যাঙানি ভ্যাঙানি ঘ্যাঙানি খিঁচুনি ছট্ফটানি কুট্কুটুনি ফোস্ফোঁসানি। এর সবগুলিই গাল-দেওয়া শব্দ নয়, কিন্তু অপ্রিয়। হাসটা তো ভালো জিনিস, কিন্তু, আনি প্রত্য দিয়ে হল “লোকহাসানি’, হাসির গুণটা গেল বিগড়িয়ে। ছাঁকুনি নিড়ুনি বিনুনি চাটনি শব্দ বস্তুবাচক, সেইজন্যে তাদের মধ্যে নিন্দার ঝাঁজ প্রবেশ করতে পারে নি।
ইয়া [ বিকারে “এ’ ] প্রত্যয়টা যখন বস্তুসূচক না হয়ে ভাবসূচক হয়, তখন তার ইঙ্গিতে কোথাও সুখের বা শ্রদ্ধার আভাস পাব না। যেমন : নড়্বড়ে নিড়্বিড়ে খিট্খিটে কট্মটে টন্টনে কন্কনে মিন্মিনে প্যান্পেনে ঘ্যান্ঘেনে ভ্যাজ্ভেজে ভ্যাদ্ভেদে ম্যাজ্মেজে ম্যাড়্মেড়ে জব্জবে খস্খসে জ্যাল্জেলে। সামান্য কয়েকটা ব্যতিক্রম আছে, “জ্বল্জ্বলে’ “টুক্টুকে’; সংখ্যা বেশি নয়।
এবার দেখা যাক উআ’র বিকারে “ও’ প্রত্যয় : ঘেয়ো বেতো জ্বোরো নুলো টেকো জেঁকো গুঁফো কুনো বুনো পেঁকো, ফোতো (বাবু), রোথো খেলো ভেতো, খেগো (পোকায়)। এগুলোও সুবিধের নয়; হয় তুচ্ছ নয় পীড়াকর। ভাত যে খায় সে নিন্দনীয় নয়, কিন্তু কাউকে যদি বলি “ভেতো’ তবে তাকে সম্মান করা হয় না। জীবমাত্রই খাদ্যপদার্থ ব্যবহার করে, সেটা দোষের নয়; কিন্তু কোনো-একটা খাদ্যের সম্পর্কে কাউকে যদি বলা হয় “খেগো’ তা হলে বুঝতে হবে সেই খাদ্য সম্বন্ধে অবজ্ঞার কারণ আছে। যথাস্থানে যথাপরিমাণে জল উপাদেয়, কিন্তু যাকে বলি “জোলো’ তার মূল্য বা স্বাদের সম্বন্ধে অপবাদ দেওয়া হয়।
মন্দত্ব বোঝাতে সংস্কৃতে দুঃ ব’লে একটা উপসর্গ আছে, কু’ও যোগ করা যায়। কিন্তু বাংলায় এই প্রত্যয়গুলোতে যে কুৎসাবিশিষ্ট অবমাননা আছে অন্য কোনো ভাষায় বোধ হয় তা পাওয়া যায় না।
এবার স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়ের আলোচনা ক’রে প্রত্যয়ের পালা শেষ করা যাক।
খাপছাড়াভাবে সংস্কৃতের অনুসরণে নী ও ঈ প্রত্যয়ের যোগে স্ত্রীলিঙ্গ বোঝাবার রীতি বাংলায় আছে, কিন্তু তাকে নিয়ম বলা চলে না। সংস্কৃত ব্যাকরণকেও মেনে চলবার অভ্যেস তার নেই। সংস্কৃতে ব্যাঘ্রের স্ত্রী “ব্যাঘ্রী’, বাংলায় সে “বাঘিনী’। সংস্কৃতে “সিংহী’ই স্ত্রীজাতীয় সিংহ, বাংলায় সে “সিংহিনী’। আকারযুক্ত স্ত্রীবাচক শব্দ সংস্কৃত থেকে বাংলা ধার নিয়েছে, যেমন “লতা’; কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে আ প্রত্যয় বাংলায় নেই; সংস্কৃতে আছে জানি, এত বেশি জানি যে, আকারান্ত শব্দ দেখবামাত্র তাকে নারীশ্রেণীয় বলে সন্দেহ করি। বাংলাদেশের মেয়েদের “সবিতা’ নাম দেখে প্রায়ই আশঙ্কা হয় “পিতা’কে পাছে কেউ এই নিয়মে মাতা ব’লে গণ্য করে। মেয়েদের নামে “চন্দ্রমা’ শব্দেরও ব্যবহার দেখেছি, আর মনে পড়ছে কোনো দুর্যোগে ভগবান চন্দ্রমা স্ত্রীছদ্মবেশে বাঙালির ঘরেও দেখা দিয়েছেন, বাঙালির কাব্যেও অবতীর্ণ হয়েছেন। এ দিকে “নীলিমা’ “তনিমা’ প্রভৃতি পুংলিঙ্গ শব্দ আকারের টানে মেয়েদের নামের সঙ্গে এক মালায় গাঁথা পড়ে। “নিভা’ নামক একটা ছিন্নমুণ্ড শব্দ “শরচ্চন্দ্রনিভাননা’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুক্ত হয়েছে বাঙালি মেয়েদের নামমালায় আকারের টিকিট দেখিয়ে।
স্ত্রীলিঙ্গের কোনো একটি বা একাধিক প্রত্যয় যদি নির্বিশেষে বা বাঁধা নিয়মে ভাষায় খাটত তা হলে একটা শৃঙ্খলা থাকত, কিন্তু সে সুযোগ ঘটে নি। বাংলায় “উট’ হয়েতো “উটী’, কিন্তু “মোষ’ হয় না “মোষী’, এমন-কি “মোষীনী’ও না–কী হয় বলতে পারি নে, বোধ করি “মাদী মোষ’। “হাতি’ সম্বন্ধেও ঐ এক কথা, “নাতনী’ বলি কিন্তু “হাতিনী’ বলি নে। উট-হাতির চেয়ে কুকুর-বিড়াল পরিচিত জীব, “কুকুরী’ “বিড়ালী’ বললেই চলত, কিংবা “কুকুরনী’ “বিড়ালনী’। বলা হয় না। মানুষ সম্বন্ধেও কেমন একটা ইতস্তত আছে– “খোট্টানি’ “উড়েনি’ ব’লে থাকি, কিন্তু “পাঞ্জাবিনী’ “শিখিনী’ “মগিনী’ বলি নে; “মাদ্রাজিনী’ও তদ্রূপ; “বাঙালিনী’ বলি নে, “কাঙালিনী’ বলে থাকি।
আত্মীয়তা সম্বন্ধেও নামগুলিতে স্ত্রী প্রত্যয়ের ছাপ আছে : দিদি মাসি পিসি শ্যালী শাশুড়ি ভাইঝি বোনঝি। “ননদ’ শব্দে ইনী যোগ না করলেও তার প্রভাব সম্পূর্ণ থেকে যায়। জা শ্যালাজ প্রভৃতি শব্দে দীর্ঘ ঈকারের সমাগম নেই।
জাতঘটিত ব্যাবসাঘটিত নামে নী ইনী যথেষ্ট চলে : বাম্নী কায়েতনী। অন্য জাত সম্বন্ধে সন্দেহ আছে। “বদ্দিনী’ কখনো শুনি নি। “বাগদিনী’ চলে, “ডোমনী’ “হাড়িনী’ও শুনেছি, “সাঁওতালনী’ বললে খটকা লাগে না। পুরুতনী ধোবানী নাপতিনী কামারনী কুমোরনী তাঁতিনী : সর্বদাই ব্যবহার হয়। অথচ শেলাই ব্যাবসা ধরলেও মেয়েরা “দর্জিনী’ উপাধি পাবে কি না সন্দেহ। যা হোক মোটের উপর বাংলায় স্ত্রীলিঙ্গে নী ইনী প্রত্যয়টারই চল বেশি।
একটা বিষয়ে বাংলাকে বাহাদুরি দিতে হবে। য়ুরোপীয় অনেক ভাষায়, তা ছাড়া হিন্দি হিন্দুস্থানি গুজরাটি মারাঠিতে, কাল্পনিক খেয়ালে বা স্বরবর্ণের বিশেষত্ব নিয়ে লিঙ্গভেদপ্রথা চলেছে। ভাষার এই অসংগত ব্যবহার বিদেশীদের পক্ষে বিষম সংকটের। বাংলা এ সম্বন্ধে বাস্তবকে মানে। বাংলায় কোনোদিন ঘুড়ি উড্ডীয়মানা হবে না, কিংবা বিজ্ঞাপনে নির্মলা চিনির পাকে সুমধুরা রসগোল্লার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করবে না। কিংবা শুশ্রূষার কাজে দারুণা মাথাধরায় বরফশীতলা জলপটির প্রয়োগ-সম্ভাবনা নেই।
এইখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সংস্কৃত ভাষার নিয়মে বাংলার স্ত্রীলিঙ্গ প্রত্যয়ে এবং অন্যত্র দীর্ঘ ঈকার বা ন’এ দীর্ঘ ঈকার মানবার যোগ্য নয়। খাঁটি বাংলাকে বাংলা বলেই স্বীকার করতে যেন লজ্জা না করি, প্রাচীন প্রাকৃত ভাষা যেমন আপন সত্য পরিচয় দিতে লজ্জা করে নি। অভ্যাসের দোষে সম্পূর্ণ পারব না, কিন্তু লিঙ্গভেদসূচক প্রত্যয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণ কতকটা স্বীকার করার দ্বারা তার ব্যাভিচারটাকেই পদে পদে ঘোষণা করা হয়। তার চেয়ে ব্যাকরণের এই-সকল স্বেচ্ছাচার বাংলা ভাষারই প্রকৃতিগত এই কথাটা স্বীকার করে নিয়ে যেখানে পারি সেখানে খাঁটি বাংলা উচ্চারণের একমাত্র হ্রস্ব ইকারকে মানব। “ইংরেজি’ বা “মুসলমানি’ শব্দে যে ই-প্রত্যয় আছে সেটা যে সংস্কৃত নয়, তা জানাবার জন্যই অসংকোচ হ্রস্ব ইকার ব্যবহার করা উচিত। ওটাকে ইন্-ভাগান্ত গণ্য করলে কোন্ দিন কোনো পণ্ডিতাভিমানী লেখক “মুসলমানিনী’ কায়দা বা “ইংরেজিনী’ রাষ্ট্রনীতি বলতে গৌরব বোধ করবেন এমন আশঙ্কা থেকে যায়।