বাংলানিউজ-এর খবর

আটমাস পর দেশে ফিরে নন্দিত কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান নুহাশ পল্লী। দিনের প্রথমভাগে বিশ্রাম নেওয়ার পর বিকেলে দিকে তিনি নুহাশ পল্লীর গাছপালার সান্নিধ্যে সময় কাটান। নিজের হাতে লাগানো বিরল প্রজাতির গাছপালার পরিচর্যার জন্য নুহাশপল্লীর কর্মীদের নির্দেশ দেন এবং নতুন কিছু চারাগাছ লাগানোর পরিকল্পনা করেন।

নিউইয়র্কে আটমাস ক্যান্সার চিকিৎসাধীন থাকার পর শুক্রবার ভোরে হুমায়ূন আহমেদ তার স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন এবং দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে দেশে ফেরেন। কোলন ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন এই লেখক তিন সপ্তাহ দেশে থাকবেন। নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটরিং হাসপাতালের কয়েক দফা কেমোথেরাপি নেওয়ার পর আগামী ১২ জুন বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের অস্ত্রোপচারের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। এই অস্ত্রোপচারটা করা হবে নিউইয়র্কের বেইলি হাসপাতালে। তার আগে দেশের জন্য খানিকটা অস্থীর হয়ে উঠায় চিকিৎসকরা তাকে শর্ত সাপেক্ষে ২০দিনের জন্য দেশ থেকে ঘুরে আসার অনুমতি দেন বলে জানান লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন।

চিকিৎসকরা হুমায়ূন আহমেদকে লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা না-বলার শর্ত দিয়েছিলেন কিন্তু দেশে ফেরার প্রথম দিন তিনি চিকিৎসকদের সেই শর্ত পুরোপুরি পালন করতে পারেন নি। গাজীপুরে নুহাশ পল্লীতে তাকে দেখতে আসা মা-শাশুড়ি, ভাইবোন ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। পাশাপাশি তাকে দেখতে আসা সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গেও সৌজন্য বিনিময় ও মৃদু কথাবার্তা বলেছেন তিনি।

নুহাশ পল্লীতে বাংলানিউজ কথা বলে লেখকের মা আয়েশা ফয়েজের সঙ্গে। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ এখন কেবল আমার একার সন্তান না। সারাদেশের মানুষের সম্পদ সে। তাকে মানুষ কতোটা ভালোবাসে, সেটি আমি বুঝেছি তার অসুস্থতার সময়। কতোদিন পরে ছেলেকে আমি কাছে পেলাম। সামনে তার বড় একটা অপারেশন। সেই অপারেশন শেষে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে হুমায়ূন যেন আমার কাছে, দেশের মানুষের কাছে ফিরে আসতে পারে, সেজন্য আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।

বিকেলের দিকে রোদ পড়ে এলে হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীতে তার গড়ে তোলা বিরল প্রজাতি গাছপালার বাগানে খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ান। এ সময় তিনি উপস্থিত সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, নুহাশ পল্লীর গাছপালাই বোধহয় আমার সবচেয়ে আপনজন। কারণ নিউইয়ার্কে এদেরই আমি সবচেয়ে বেশি মিস করেছি। তাই বলে যে মা আর আত্মীয়-স্বজনকে মিস করিনি, তা কিন্তু নয়। তাদের মিস করা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু গাছপালাকে মিস করাটা স্বাভাবিক নয়। কারণ দেশে ঢাকায় থাকার সময় তো এদের মিস করতাম না।

নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের নিজের হাতে লাগানো আপেল গাছটি এখন বেশ বড় হয়েছে। সেই গাছের নিচে বসে শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দীর্ঘদিন পর আমার প্রিয় গাছপালার সান্নিধ্য পেয়ে আমি আনন্দিত। গাছপালা আমাকে তাদের মাঝে ফিরে পেয়ে আনন্দ পেয়েছে কিনা তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নাই।

তিনি বলেন, আমার নুহাশপল্লীতে কয়েকটি বিরল প্রজাতির গাছ আছে। যা বাংলাদেশের আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এখানে এমন কিছু গাছ আছে যেগুলোর নাম আমি নিজেও জানি না। প্রতি বছরই নতুন কিছু চারাগাছ নুহাশ পল্লীতে লাগানো হয়। আসছে বর্ষা হলো গাছ লাগানোর সিজন। কিন্তু এই সময়টায় আমি দেশে থাকছি না। গাছ লাগানো যাতে থেমে না থাকে সেজন্য কোথায় কোন গাছ লাগানো হবে, এতক্ষণ ঘুরে আমার লোকদের তা দেখিয়ে দিলাম।

নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রসঙ্গে একপ্রশ্নের উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, দেশে আসার পরপর বেশ কয়েকটি চ্যানেলের লোকজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। চ্যানেল আই থেকে এসেছে ইবনে হাসান। বাংলাভিশন থেকে এসেছে শামীম শাহেদ। তাদের ইচ্ছা, দেশে থাকার এই সময়টায় তাদের চ্যানেলে ঈদে প্রচারের জন্য দু’চারটা নাটক তৈরি করি। আমি তাদের কাউকে কোনো কথা দিতে পারি নি। আমার তৈরি ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ ছবিটির সব কাজই শেষ। সেন্সরও হয়ে গেছে। এটি কবে মুক্তি পাবে, সেটা ছবি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস ভালো বলতে পারবে।

নিজের লেখালেখি প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন,  ডাক্তার শুরুতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন লেখালেখি করা যাবে না। একান্তই যদি না পারেন, তাহলে আপনি বলবেন আপনার স্ত্রী লিখবে। ডাক্তারদের সব পরামর্শ তো মেনে চলা যায় না। তাই আমি টুকটাক করে নিজেই লেখালেখিটা চালিয়েছি। এখনও পর্যন্ত আমার কোন সমস্যা হয় নি। এখনও নিজেই লিখতে পারছি। এর মধ্যে একটি নাটক লিখবো। আর কি লিখবো তা এখনও বলতে পারছি না।

হুমায়ূন আহমেদ তার চিকিৎসা প্রসঙ্গে বলেন, ক্যান্সার অসুখটা সত্যিই খুব ভয়াবহ। আমাকে যিনি চিকিৎসা করছেন তার নাম ডাক্তার ভিচ। তিনি এমন এক ঘোষণা দিলেন যে, শুরুতেই ঘাবড়ে গেলাম। আমার চেকআপ করানো সময় একদিন তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, কেমো থেরাপি দিলেও তুমি বেশি দিন বাঁচবে না। তোমার আয়ু বড়জোর দুই বছর। আমি মনে মনে গোছাতে শুরু করলাম দুই বছরে আমার কী কী কাজ করা উচিত? কয়েকবার কেমো নেওয়ার পর অবস্থার পরিবর্তন হলে তিনিই আবার আমাকে আশ্বস্ত করলেন, মনে হচ্ছে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি তার সবকথা স্বাভাবিক আর সহজভাবেই নিয়েছি। আসলে বিশ্বাসটা তো একান্ত নিজের ব্যাপার। তাই কোন কিছুর সামনেই আত্মবিশ্বাস হারানোর কোন কারণ আমি খুঁজে পাই না। যদি আর একদিনও বাঁচি, আমি আনন্দের সঙ্গে বাঁচতে চাই। আমি লিখতে পারছি, এটাই বড় আনন্দের কথা। আমি আনন্দ নিয়ে আছি।

হুমায়ূন আহমেদ আরও বলেন, যে হাসপাতালে আমি প্রথম ভর্তি হই তার ব্যয় বহন করা ছিল আমার জন্য ছিল দুঃসাধ্য। কেমো নেওয়ার পর এবার তাই একটি সরকারি হাসপাতালে আমি ভর্তি হয়েছি। এর নাম বেইলি হাসপাতাল। আমার যে অপারেশনটা তা এই বেইলি হাসপাতালেই হবে। তিনি বলেন, ক্যান্সারের চিকিৎসা খরচ সাংঘাতিক ব্যয়বহুল।  এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আমাকে ঋণ করতে হয়েছে। চ্যানেল আইয়ের কাছ থেকে আমি ৫০ লাখ টাকা ধার নিয়েছি। আমি ঋণগ্রস্ত থাকতে অভ্যস্ত নই। পরেরবার অপারেশন শেষে দেশে ফিরে সেই টাকা পরিশোধ করে দেব।

অনেকটা আবেগ-আপ্লুত কণ্ঠে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, আমার মায়ের বয়স এখন ৮০ বছর। তিনি আমেরিকায় আমার চিকিৎসার জন্য তার আজীবনের সঞ্চয় ৫৫০০ ডলার পাঠিয়েছেন। একেই বলে মা। পৃথিবীতে মা ছাড়া আর কে এরকম করবে!

মা আয়েশা ফয়েজসহ পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ দুই দিন নুহাশপল্লীতে কাটানোর পর ১৩ মে তার ঢাকার ধানমন্ডির বাসভবন ‘দখিন হাওয়া’-তে যান।

এই লেখাটি বাংলানিউজ থেকে নেওয়া।

[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *