নিউইয়র্ক এ চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হুমায়ুন আহমেদ বাংলানিউজের প্রতিনিধি শিহাব উদ্দিন কিসলুর কাছে এই সাক্ষাৎকার দেন।
“মা অপেক্ষা করছেন। ছেলেকে দেখতে। ছেলেও উদগ্রীব। তাই দেশে যাচ্ছি। ডাক্তারকে সেটাই বলেছি। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করেছিল, “দেশে যাওয়া কেন?”
নিউ ইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকার ভাড়া বাসা থেকে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় দেশের উদ্দেশে রওনা করার আগে এভাবেই নন্দিত লেখক হুমায়ুন আহমেদ বাংলানিউজের সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাৎকারটির সূচনা করেন।
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই গুণী মানুষটির সঙ্গে যেন সাক্ষাৎকার নয়, গল্প জমে উঠেছিল। আলাপচারিতায় জানালেন, দেশের খাওয়া-দাওয়া খুব মিস করছেন।
এ প্রসঙ্গটি উঠতেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলেলেন, “ঢাকায় খবর হয়ে গেছে। বুঝেছ, খবর দিয়ে দিয়েছি। প্লেন সকালে নামবে। আমি বড় কই মাছ আলু দিয়ে, পেটে ডিম ভর্তি বড় বড় শিংমাছের ঝোল, আর বড় সাইজের কাতলের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট খাবো। বাংলাদেশি খাবারটা খুব মিস করছি।”
মানুষ হিসেবে অতি সজ্জন হুমায়ূন আহমেদের কথাবার্তায় মোটেও মনে হয়নি তিনি আসলেই চরম বেরসিক এক শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। শুধু বাইরের অবয়বে খানিকটা আঁচ করা যায়।
“দেশে গিয়ে কি কি করবেন, কোথায় কোথায় যাবেন স্যার?“ সোজা প্রশ্ন করলাম।
কোথাও যাবো না,” বললেন হুমায়ূন আহমেদ।
শুধু নূহাশ পল্লীতে যাবো। ওখানেই থাকবো কিছুদিন। ওখানে আমার বাবুর্চি আছে, দারুণ রান্না করে। ওর মত মুড়িঘণ্ট আর কেউ করতে পারে না। সেই মুড়িঘণ্ট খাবো।”
মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, “মা তো মা-ই, সবার উপরে। এই মা আমার চিকিৎসার জন্য জমানো টাকা ডলার করে সাড়ে ৫ হাজার ডলার আমেরিকা পাঠিয়েছেন। জমানো টাকাগুলো কিন্তু আমারই দেওয়া। সেই টাকাই আমাকে পাঠিয়েছেন। এই আমার মা।”
হুমায়ূন আহমেদ চোখের অশ্রু লুকিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কণ্ঠের আবেগ আর চেহারার রক্তিম আভা জানিয়ে দিয়েছে মা তার কত প্রিয়। শরতের মেঘে সূর্যের লুকোচুরির মতই হুমায়ূন আহমেদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে গেছে সাংবাদিকের কলমে।
“স্যার আপনার দেশে ফেরার অনুভূতি…“
বললেন, “দেশে ফেরা তো হচ্ছে না। আগে তো দেশে ফিরেছি স্থায়ীভাবে। কিন্তু এবার আগে থেকেই জানছি আবার ফিরে আসতে হবে। তাই দেশে ফেরার যে সত্যিকারের অনুভূতি, যে ভালো লাগা সেটা ততটা নেই। দেশ যে আমার কাছে অনেক আপন, সেখানে কি ক’দিনের জন্য যাওয়া ভালো লাগে!”
কথোপকথনের মাঝে কিছুক্ষণের জন্য ঘরে ঢুকেছিলেন মামুন ভাই। স্বনামখ্যাত ফটো সাংবাদিক নাসির আলী মামুন। তিনি সুযোগ পেয়ে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুলছিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ূন আহমেদের পারিবারিক বন্ধু গাজী কাশেমকে আমার অ্যানড্রয়েড ফোনের ক্যামেরায় আমাদের কয়েকটি ছবি তুলতে অনুরোধ করলাম। এ সময় হুমায়ূন আহমেদ সেল ফোনটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “মামুন, গুগলের লেটেস্ট এই ফোনটা দেখেছো?”
মামুন ভাই জবাব দিলেন, “জ্বি, খুবই ভালো।”
হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী শাওন ছেলে নিষাদকে সামলানো আর মালপত্র গোছানোতো ব্যস্ত। এরই মাঝে বাইরে গিয়ে ছবি তোলার জন্য গাজী কাশেমের অনুরোধ। ছবি তুললাম। ছবিটা হুমায়ূন আহমেদকে দেখিয়ে বললাম, “স্যার, মামুন ভাইয়ের চেয়ে ভালো হয়েছে না? উনার ব্যবসা তো এবার শেষ!”
বললেন, “হ্যাঁ, ওর ব্যবসা আসলেই শেষ।”
মামুন ভাই খানিকটা সরল হাসিতে সেই `সত্য` যখন স্বীকার করে নিলেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, “শোনো, এতে তোমার কোনো কৃতিত্ব নেই। তোমরা কি জানো বাংলাদেশে ফটোগ্রাফারের সংখ্যা কত?“
আমি আর মামুন ভাই দু’জনই ভাবছিলাম সংখ্যাটা কত হতে পারে।
ওদিকে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, “সংখ্যাটা এক কোটির বেশি। কিভাবে? শোনো। ঢাকায় আমি একদিন পাবলিক টয়লেটে গেছি। অমনি পাশ থেকে কয়েকজন বলে উঠলো, “স্যার একটা ছবি তুলি?”
বলেই সেলফোনে ছবি তোলা শুরু করলো।
বললাম, “বাবারা, আমি তো পাবলিক টয়লেটে দাঁড়িয়ে!”
হাসির জোয়ারে ভেসে গেলাম সবাই। শেষে বললেন, “দেশে সবার হাতেই সেলফোন।
সবাই ক্যামেরাম্যান।”
ওদিকে বিমানবন্দরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কথোপকথন এখানেই শেষ।
[সংগ্রহ : আনোয়ার জাহান ঐরি, চলন্তিকা ডট কম।]