বাংলাদেশ ১

বাংলাদেশ ১

কুড়ি বছরের নির্বাসিত জীবনে দেশের খুব একটা খবর রাখিনি, দুএকজন আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কদাচিৎ কথা হতো। রাজনীতির খবরে মোটেও উৎসাহ ছিল না আমার। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ব্যক্তিগত যোগাযোগও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে একটা দূরের দেশে পরিণত হয়। দেশে যে বাড়ি ঘর ছিল আমার, ফেলে আসা জিনিসপত্তর, ওসবেরও আর কোনও খবরাখবর পরিবারের কেউ আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ওই দেশ, ওই সমাজ, ওই পরিবারের প্রতি বিবমিষা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। আমার এত যে গুণমুগ্ধ পাঠক পাঠিকা, প্রকাশক, সম্পাদক, তাদের চিহ্ন এই কুড়ি বছরে, সত্যি বলতে কী, দেখতে পাইনি। প্রকাশক রয়্যালটি দেয় না, জাল বইয়ে বাজার ছেয়ে থাকে, একের পর এক সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করছে, এসবের প্রতিবাদও কেউ করেনি। সম্পাদকরা ঘুরতো লেখা চাইতে, তাদেরও আর টিকিটি দেখিনি। সরকার আমাকে তাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ যেন মুহূর্তে সরকারের গোলাম বনে গেল। সরকার যাকে পছন্দ করছে না, তাকে পছন্দ করার কোনও অধিকার তখন যেন আর কারোর নেই। এমন ভণ্ড ভীতু সমাজ আমি আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। বছর বছর সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি, দেশে ফিরতে চাই, মার অসুখ, বাবার অসুখ। কিছুতেই বর্বর সরকারগুলোর সায় পাইনি। আমার জন্য দেশের দরজা বন্ধ। যেন দরজাটা ওদের বাপের সম্পত্তি। হঠাৎ হঠাৎ বাংলাদেশের পত্রিকায় বিকৃত করে আমার ভুল ভাল খবর ছাপাহত। পত্র পত্রিকাগুলো গত কুড়ি বছরে আমাকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা তো কম করেনি। কিন্তু বিকৃত করে ছাপানো খবরগুলো যে কোনও কারণেই হোক বন্ধ করেনি, সম্ভবত যারা ভুলছে না। আমাকে, তারা যেন ঘৃণাটা অন্তত করতে পারে, সেকারণে। সেই হঠাৎ হঠাৎ খবর গুলোর তলায় দেখতে পেতাম মানুষের, বিশেষ করে নতুন ছেলেমেয়েদের মন্তব্য। নোংরা কুৎসিত সব মন্তব্য। পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতো। এখনকার তরুণ তরুণী জঘন্য ভাষায় গালাগালি করছে আমাকে, আমাকে না পড়েই, না বিচার করেই, না ভেবেই! এরা কি চেনে আমাকে? জানে আমাকে? আমার লেখা কোনওদিন পড়েছে? না, এরা কারও লেখা পড়ে না। এরা হয়তো কোনও বদমাশদের মুখে আমার নাম শুনেছে, আর বদনাম শুনেছে। এরাই দেশের ভবিষ্যৎ, এরাই নতুন প্রজন্ম। এক গাদা অন্ধত্ব, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, মুখতা, নির্বুদ্ধিতাই শুধু দেখলাম। ঘেন্না লাগলো। হ্যাঁ ঘেন্না। একটিও প্রাণী নেই, যার বোধ বুদ্ধি আছে, বিবেক আছে? সেই লক্ষ লক্ষ লোক কোথায় যারা গোগ্রাসে আমার বই পড়তো, আমার লেখা ভালোবাসতো? সেই সব লেখকই বা কোথায়, যারা আমার লেখার হুবহু নকল করে নারীবাদী লেখা শুরু করেছে বাংলাদেশে? সবাই হাওয়ায় উবে গেছে, শুধু জ্বলজ্বল করছে এক থোকা নতুন প্রজন্ম নামক অন্ধকার।

দেশটার কথা ভাবলে সব কিছু মিলিয়ে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুর উদ্রেক হত না আমার। এমন সময় একদিন দেখি কিছু লোক টুইটারে আমাকে বাংলাদেশের খবর দিচ্ছে। ঢাকার শাহবাগে লোক জমায়েত হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাইছে, খবরটি জানি কি না জানতেও চাইল কেউ কেউ। উত্তর দিইনি। বাংলাদেশে আমার উৎসাহ নেই, ফাঁসিতেও নেই। ওই দেশে কারও ফাঁসি চাওয়া হচ্ছে শুনলে মনে পড়ে তিরানব্বই-চুরান্নবই সালে কী করে লক্ষ লোকের জমায়েত হত শহরে, মিছিল হত, আমার ফাঁসি চাওয়া হত। সেই সব ভয়ংকর দিনগুলোর কথা ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না? কেউ আমার ভেতরে এক ফোঁটা আগ্রহ তৈরি করতে পারেনি শাহবাগের জনসমাগম নিয়ে। মিশরের তাহরির স্কোয়ারেও লক্ষ লোক জমেছিল, ওরা ভোট দিয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের জিতিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে– মানেই মৌলবাদের বিরুদ্ধে নয়। আর মৌলবাদের বিরুদ্ধে– মানেই ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সেক্যুলারিজমের পক্ষে নয়, ধর্মভিত্তিক আইন তুলে দেওয়ার পক্ষে নয়। বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে কিছু লিখছি না বলে কেউ কেউ আমাকে আবার তিরস্কারও করতে শুরু করে। কারো অনুযোগে অভিযোগে তিরস্কারে আমার কিছু যায় আসে না। নতুন প্রজন্ম, যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাইছে, তারা কী করবে ফাঁসি দেওয়া হয়ে গেলে, শুনি? এই প্রশ্নের ভালো কোনও উত্তর পাইনা কারও কাছ থেকে। চল্লিশ বছর আগে কিছু লোক কিছু দোষ করেছিল, কিছু লোককে মেরেছিল, কিছু মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল, তার প্রতিশোধ নেবে নতুন প্রজন্ম। আসলে লেখক শিল্পীদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত লিখেছে, ছবি বানিয়েছে, নাটক করেছে, যে, বাংলাদেশের আজকালকার ছেলেমেয়েরা দুনিয়ার নব্বইভাগ ইতিহাস না জানলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা ভালো জানে।

আমার আগ্রহ সৃষ্টি হল সেদিন, যেদিন শাহবাগের কয়েকজনকে দেখলাম, জামাতি ইসলামি দলটির নিষিদ্ধকরণ চাইছে। আমি সমর্থন করে লিখলাম। যদিও আমি সব রকম নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে, কিন্তু এই নিষিদ্ধকরণ মেনে নেওয়ার কারণ, জামাতি ইসলামি কাগজে কলমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল হলেও এটি মূলত একটি সন্ত্রাসী দল। কাউকে পছন্দ হল না তো মেরে কেটে পঙ্গু বানিয়ে রাখলো, কারও মত তাদের মতের থেকে ভিন্ন হলে জবাই করে ফেলো, ধর্মের নামে বহু বছর যাবৎ যা খুশি করছে ওরা। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠছে আজকাল।

 লিখবো না লিখবো না করেও অনেকগুলো ব্লগ লেখা হয়ে গেল শাহবাগ নিয়ে। এই লেখাগুলোর প্রথম দিকে হতাশা থাকলেও ধীরে ধীরে আশা এসেছে। স্বপ্ন এসে চমৎকার সাজিয়েছে ঘরদোর। কিন্তু দিন দিন যে সব খবর পাচ্ছি, তাতে মনে হয় না বাংলাদেশের ধর্মমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে অদুর ভবিষ্যতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবেন কথা দিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মের কবল থেকে মুক্ত করার তাঁর কোনও ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। জামাতি ইসলামির সন্ত্রাসীরা মুক্তচিন্তক তরুণ তরুণীদের গলা কাটছে, আর ওই কূপমণ্ডুকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে দেশের প্রধানমন্ত্রী মুক্তচিন্তকদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন শাস্তি দেবেন বলে। ইতিমধ্যেই ওদের ব্লগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন না পড়তে পারে ইসলাম বা মুহম্মদের সমালোচনা। অশিক্ষিত ধর্মব্যবসায়ীদের মতো প্রধানমন্ত্রীও ধর্মব্যবসায় মাতেন, দেখতে বড় বিচ্ছিরি লাগে। ঘেন্না লাগে।

আমার বেলাতেও ঠিক এমন করেছিলেন খালেদা জিয়া নামের আরেক প্রধানম স্ত্রী। দেশ জুড়ে ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে আমাকে ফাঁসি দেবে বলে, আর প্র ধানমন্ত্রী ওই কূপমণ্ডুকদের খুশি করতে আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করলেন, আমাকে শাস্তি দিলেন, দেশ থেকে আমাকে বের করে দিলেন, আমার বই নিষিদ্ধ করলেন। আজ কুড়ি বছর পর সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এক রানি গিয়ে আরেক রানি আসে, এক রাজা গিয়ে আরেক রাজা আসে। তবে সব রানিরই, সব রাজারই চরিত্র এক। এঁরা আর যার ভালো চান, দেশের ভালো চান না। দেশের ভালো চাইলে দেশকে ধর্মের বিষ গিলিয়ে এঁরা দেশের সর্বনাশ করতেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *