3 of 3

বাংলাদেশ বদলে গেছে

প্রাচীন চীনের একটি দর্শন ছিলো, ‘এমন কিছু তুমি অন্যের সঙ্গে কোরো না, যা অন্য কেউ তোমার সঙ্গে করলে তোমার মোটেও ভালো লাগবে না। ’ এই দর্শনটিই ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। এই দর্শন মেনে চললে নীতিবান এবং আদর্শবান হওয়ার জন্য আলাদা করে ধর্মের দরকার হয় না। ধর্ম মেনে চললে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন, লোক ঠকানো, মিথ্যে বলা, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, ঘুষ খাওয়া, ঘুষ দেওয়া ইত্যাদি লোকে করে না। বারবার কিন্তু মানুষ প্রমাণ দিয়েছে, ধর্মে বিশ্বাস রেখেও মানুষ সব রকম অনাচারই করে বা করতে পারে। সমাজের মানুষকে কুকর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য সবচেয়ে বড় যে নৈতিক শিক্ষা, তা যে ধর্ম থেকেই আহরণ করে সবাই তা নয়। ধর্ম না মেনেও মানুষ সৎ, উদার এবং সহিষ্ণু হয়। পাশ্চাত্যে যে মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, পঙ্গুর অধিকার, পশুপাখির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কিন্তু কোনও ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া নয়। বৈষম্য এবং বর্ণবাদবিরোধী আইন প্রতিষ্ঠা করার পেছনেও ধর্ম নয়, আছে বিবেকবান মানুষ।

ষাট-সত্তর দশকে যে বাংলাদেশ আমি দেখেছি, সেই বাংলাদেশে ধর্ম ছিল, কিন্তু ধর্ম নিয়ে আদিখ্যেতা, অতিরঞ্জন, চোখ রাঙানো, ছড়ি ঘোরানো, জোরজবরদস্তি ছিলো না। মুসলমানদের মধ্যে দাড়ি রাখা, টুপি পরা আর হিজাব-বোরখা পরা জনপ্রিয় ছিল না। নামাজের চলটা অবসরপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে ছিলো। এতে কিন্তু ধর্ম উবে যায়নি। ধর্ম থাকা সত্ত্বেও জোর করে সংবিধানে, সমাজের সর্বত্র, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অতিরিক্ত ধর্ম আমদানির ফল যে ভালো হবে না, আশির দশকের শেষ দিকেই অনুমান করেছিলাম। এসব নিয়ে বলেছি বলে আমি মন্দ হয়েছি। আমাকে অন্যায়ভাবে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, আজ ২৪ বছর পার হচ্ছে, এখনো আমাকে কোনও সরকারই দেশে প্রবেশ করার অনুমতি দিচ্ছে না। সেই যে বলেছিলাম ধর্মের অতি- চাষ কিন্তু ভালো ফল দেবে না, বাংলাদেশ কিন্তু তার প্রমাণ পাচ্ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসীতে এবং সন্ত্রাসী-সমর্থকে দেশ ছেয়ে গেছে। অতিরিক্ত ধর্ম কোনওকালেই ভালো কিছুর জন্ম দেয়নি। ধর্ম যখন ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আওতা থেকে বেরিয়ে রাজনীতিতে পৌঁছে যায়, তখনই ধর্ম আর ধর্ম থাকে না, তখন সেটি হয়ে যায় রাজনৈতিক ধর্ম। রাজনৈতিক ধর্মের উদ্দেশ্য মানুষকে বোকা বানিয়ে ফায়দা হাসিল করা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ পড়তে জানতেন না, রোজা করতেন না, মদ আর শূকরের মাংস খেতেন, সূরা-আয়াত জানতেন না। তিনি যে ভারত থেকে মুসলমানদের আলাদা করে পাকিস্তান নামের একটি দেশ বানিয়ে ফেললেন, তিনি কিন্তু ইসলাম ধর্মকে ধর্ম হিসেবে নয়, রাজনীতি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের জন্য। সেই থেকে পাকিস্তানে এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে আর কিছু নয়, রাজনীতিই হচ্ছে। নৈতিকভাবে সৎ মানুষ হওয়া এখন আর ধর্ম নয়, ধর্ম চলে এসেছে পোশাকে-লেবাসে, হিজাবে-বোরখায়, টুপি-দাড়িতে, আলখাল্লায় অথবা পাজামা-পাঞ্জাবিতে। ধর্ম এখন আর আর্তের সেবায় নয়, ধর্ম এখন সংযমে নয়, ধর্ম এখন ধনীদের অতিভোজনে, অতিবিলাসিতায়, পাড়ায় সাতটি থাকলেও আরও দশটি মাদ্রাসা গড়ে দেওয়ায়। মানুষ এখন অন্যের জন্য কিছুই গড়ে না, যা গড়ে নিজের জন্য গড়ে। পরকালে বেহেস্ত পাওয়ার আশায় গড়ে। যারা আজ ধর্মপ্রাণ বা ধার্মিক বলে সম্মান পাচ্ছে, তাদের অনেকেই যদি জানে যে পরকাল বলে কিছু নেই, রাতারাতি পালটে যাবে। নামাজ রোজা বাদ দিয়ে দেবে, আল্লাহর ইবাদতে ইতি টানবে, মসজিদ-মাদ্রাসা কিছু গড়বে না, এমন কোনও অন্যায় নেই যে করবে না। এরা যদি ভালো কাজ করে, করে দোযখের ভয়ে, আর বেহেস্তের লোভে। এরা ভালো কাজ করার জন্য ভালো কাজ করে না। মানুষের উপকারের জন্য, সমাজের উন্নতির জন্য ভালো কাজ করার কোনও আগ্রহ এদের নেই। এদেরকে কি কোনও কারণে ভালো মানুষ বলা যায়? আসলে তারাই সত্যিকারের ভালো মানুষ, তারাই সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ, যারা কোনও কিছুর লোভে নয়, যারা ভালো কাজ করে অন্যের ভালোর জন্য। নিঃস্বার্থ মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব বেশি নেই। বেশি নেই বলেই ধর্ম নিয়ে এত অধর্ম হচ্ছে।

জঙ্গিরাও, গবেষণা করে দেখা গেছে, বেহেস্তে যাওয়ার লক্ষ্যেই জঙ্গিবিদ্যায় দীক্ষা নিয়েছে। এখানেও কাজ করছে লোভ। লোভ অতি বেশি হওয়ায় তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। মানুষ হত্যা করতে তাদের হাত কাঁপে না, আত্মঘাতী বোমা গায়ে পরতে ভয় হয় না, মৃত্যুকে পরোয়া করছে না, মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ মারার জন্য। বিশ্বাস করছে যত বেশি কাফের আর বিধর্মী মারবে, তত পোক্ত হবে বেহেস্তে তাদের আসন। এই স্থূল বিশ্বাস ঠিক কজন মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে আমার জানা নেই।

আমার শৈশব-কৈশোরে আমি এমন বাংলাদেশ দেখিনি। এমনকি যৌবনেও দেখিনি। আমার আত্মীয়স্বজনও বদলে গেছে। আমাদের পরিবার ছিলো আদর্শবান পরিবার। নামাজ পড়া, হিজাব পরা, টুপি পরার কোনও চল ছিলো না, কিন্তু সৎ, সভ্য, শিক্ষিত, সংবেদনশীল, সহানুভূতিশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠেছে সবাই। কিন্তু হঠাৎ আমার বড়দা’র ভেতরে অদ্ভুত সব পরিবর্তন লক্ষ করছি। আমার বড়দা’র এখন মুখভরা দাড়ি। গোঁফহীন দাড়ি। আমার চিরকালের ক্লিন-শেভড-স্যুটেড-বুটেড হ্যান্ডসাম বড়দা’র মাথায় এখন টুপি, পরনে লম্বা পাঞ্জাবি। বড়দা এখন পাঁচ বেলা নামাজ পড়ে, সারা দিন তসবিহ জঁপে। ছেলেগুলোকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে ধর্মান্ধও বানিয়েছে। বড়দা কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতো, কবিতা লিখতো, গান শুনতো, সিনেমা দেখতো, ঘুরে বেড়াতো, প্রেম করতো, ছবি তুলতো, ফ্যাশন করতো, ডিজাইন করতো। যেটুকু মানবিকতা, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ছিলো, সব বিসর্জন দিয়ে এখন সে ধর্মান্ধ। আগে আমাকে দেখতে, আমি যেখানেই থাকি, ছুটে ছুটে আসতো। এখন আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করে না। বাবার মৃত্যুর পর আমার ভাগে যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল, তার সবই বড়দা নিজে নিয়ে নিয়েছে। আমার আপত্তিতে তার কিছু যায় আসে না। ধর্মান্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত বোধহয় স্বার্থান্ধ হওয়া। এই অন্যায়টা সম্ভবত বড়দা করতে পেরেছে ধর্মান্ধ হয়েছে বলেই। সম্ভবত ভেবে নিয়েছে অপকর্মের ফল তাকে পরকালে ভোগ করতে হবে না, যেহেতু সে সুন্নত পালন করেছে, দাড়ি রেখেছে, টুপি পরেছে, নামাজ রোজা করেছে। অনেকে তো এও বিশ্বাস করে, গুনাহ করার পর একবার হজে গেলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়, তাই প্রচুর গুনাহ করার পর হজের জন্য উড়োজাহাজে ওঠে।

আমার মামারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবার। এই মামাদের মধ্যে কারো কারো একই হাল। যে মামাদের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কেটেছে, যে মামারা ধর্মের লেবাস নিয়ে মোটেও উৎসাহী ছিলো না, সেই মামারা আজ গোঁফহীন দাড়ি রাখছে, পাঁচবেলা নামাজ পড়ছে। একজন তো জঙ্গি-আস্তানা অভিযানকে বলেই দিয়েছে নাটক। বাংলাদেশে জঙ্গি আছে বলে সে মনে করে না। তার সঙ্গে বড় সখ্য ছিল আমার। মোষের গাড়ি করে রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম আমরা। একাত্তরের ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হলে নতুন পতাকা হাতে আমরা উল্লাস করেছিলাম। সেই মামা। আমার জন্য যত স্নেহ ভালোবাসা ছিলো, সব কর্পূরের মতো উবে গেছে।

কলেজের বন্ধুদের প্রায় সবাই ধর্মান্ধ। বান্ধবীদের প্রায় সবার মাথায় হিজাব। অচেনা দেখায় সবাইকে। মনে হয় গত চব্বিশ বছরে কিছু একটা ঘটে গেছে দেশে। বেহেস্তের লোভের ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের সবখানে, ভাইরাসে আক্রান্ত সবাই। ভুতুড়ে বানিয়ে দিয়ে গেছে কেউ গোটা দেশটাকে। দেশটাকে এখন চিনতে পারি না। মানুষগুলো আর মানুষ নেই, সব জঙ্গি হয়ে গেছে। বাঙালি সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে আরবের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি ভেবে নিচ্ছে, যে আরবেরা বাঙালিদের অবলীলায় শিরশ্ছেদ করছে আরবের মাটিতে। বাঙালিদের মিশকিন বলে ঘৃণা করতে সংকোচ করে না।

যে ধর্ম নিজের আরাম-আয়েশের লোভের জন্য মানুষ করে, সে ধর্ম ধর্ম নয়। ধর্ম হলো মানবতা। জঙ্গিরা যে ধর্ম পালন করছে, সে ধর্ম অন্যের ক্ষতি করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। যে ধর্ম আমার মা পালন করতো, পাড়ার সবার বিপদে-আপদে সাহায্য করতো, সে হলো ধর্ম। যে ধর্ম আমার বাবা পালন করতো, গরিবকে বিনে পয়সায় চিকিৎসা করতো, সে হলো ধর্ম।

সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ মার্চ, ২০১৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *