বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি

বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি 

আশির দশকে গল্পটি আমাকে বলেছিলেন একজন বহুজাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। তখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশেই দু’জন ইসলাম-পছন্দ সমরনায়ক শাসন করছিলেন। দু’দেশেরই অর্থনীতিতে তখন সংকট। শবে বরাতের রাতে দু’জন সমরনায়ক নামাজ পড়তে বসলেন। দু’জন দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে এমনভাবে কাঁদতে থাকেন যে বেহেশতে নাকি হইচই পড়ে যায়। গুজবে প্রকাশ, স্বয়ং জিবরাইল (আঃ) তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে দৌড়ে আসেন। অবশ্যই তিনি প্রথমে পাকিস্তানে গেলেন। তিনি পাকিস্তানের সমরনায়ককে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। পাকিস্তানের সমরনায়ক বললেন, “আল্লাহ পাকিস্তানের প্রতি ঘোরতর অবিচার করছেন। তিনি সব গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশকেই তেলে ভরে দিয়েছেন, অথচ পাকিস্তানকে তেল দেননি। তাই পাকিস্তানে ইসলামী জমহুরিয়াত কায়েম রাখতে তকলিফ হচ্ছে।” জিবরাইল বললেন, “ওহে কমবখত, আল্লাহর কাছে শোকর কর্, তিনি তোকে তেল দেননি, কিন্তু আফগান সঙ্কট দিয়েছেন। একে ভাঙিয়ে যত পারিস কামিয়ে নে।” জিবরাইল এবার বাংলাদেশে এলেন। বাংলাদেশের সমরনায়কের একই দুঃখ। আল্লাহ শুধু আরবদেরই তেল দেননি, তিনি বাঙ্গালীদের পরে মুসলমান হয়েছে এমন সব নালায়েক দেশে (যথা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজিরিয়াকে) তেল দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাঠামোগত সংস্কারের জ্বালায় বাংলাদেশে মুমীন মুসলমানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। বাংলাদেশের সমরনায়কও আল্লার কাছে তেল চান। জিবরাইল বললেন, “বাংলাদেশের জন্য কিছু গ্যাস বা তেল বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে তোর যা উড়নচণ্ডী স্বভাব এখন এ সব বের করলে তুই সব উড়িয়ে দিবি, এখন তেল দেওয়া যাবে না।” সমরনায়ক কাতরভাবে বললেন, তিনি গোনাগার হলেও বাংলাদেশের মুমীন মুসলমানদের কোন দোষ নেই এবং তাদের শাস্তি দেওয়া ঠিক হবে না। অগত্যা জিবরাইল বললেন, “তোকে তেল দেওয়া হবে না। তবে বন্যা দেওয়া হবে। যা পারিস রিলিফের মাল হাতিয়ে নে, আর বন্যার দোহাই দিয়ে মুমীন মুসলমানদের বহুজাতিক দাতাদের জুলুম থেকে রক্ষা কর।” 

উপরের গল্পটি কল্পিত হলেও এতে সত্যের ছায়া (যথা বন্যার অজুহাতে কাঠামোগত সংস্কার পিছিয়ে যাওয়া) রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, বাংলাদেশের বন্যা সম্পর্কে যা শোনা যায় তা সবই সত্য নয়, আবার বাংলাদেশের বন্যা সম্পর্কে অনেক সত্য রয়েছে যা আদৌ শোনা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক হিসাবে বন্যা সকলের জন্য অভিশাপ হলেও, রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রক্রিয়াতে বন্যায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, কেউ কেউ লাভবানও হয়। অস্কার ওয়াইল্ড যথার্থই বলেছেন: “The truth is rarely pure and never simple.” (সত্য খুব কম সময়ই অবিমিশ্র হয় এবং কখনও সরল নয়।) 

অস্কার ওয়াইল্ডের বর্ণিত সত্যের মত বাংলাদেশে বন্যা সম্পর্কেও শেষ কথা বলার এখনও সময় আসেনি। বন্যা বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসের এক চিত্র যেখানে উত্তাল জলরাশি কেড়ে নেয় মানুষের মুখের গ্রাস, ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের আশ্রয় আর পেছনে ফেলে যায় মারি ও মন্বন্তরের তাণ্ডব লীলা। কিন্তু এই ধ্বংসের সবটুকুই অপূরণীয় নয়। বন্যায় এক ফসল নষ্ট হলেও, পরবর্তী ফসল পাওয়া যায়। অনেক সময় পরবর্তী ফসলের ফলন অনেক বেশি হয়। কৃষিবিশেষজ্ঞদের মতে বন্যার সাথে যে পলি আসে তা কর্ষিত জমিতে ফসফরাস ও পটাশের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। বন্যার ফলে জমিতে জলজ শৈবাল ও উদ্ভিদ জন্মে – যা নাইট্রোজেন উৎপাদনে সহায়ক। সবচেয়ে বড় কথা হল বন্যাউপদ্রুত অঞ্চলে জমিতে আর্দ্রতার পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই সাধারণত বন্যা হলে বাংলাদেশে বোরো ফসলের ফলন বেড়ে যায়। উপরন্তু নীচু অঞ্চলের আমন নষ্ট হলেও অপেক্ষাকৃত উঁচু অঞ্চলে আমনের ফলন বৃদ্ধি পায়। 

যদি বন্যার ক্ষতি প্রাকৃতিক দিক থেকে অপূরণীয় হত, তা হলে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব অতি হালকা হওয়া ছিল স্বাভাবিক। বাস্তব পরিস্থিতি হল তার সম্পূর্ণ উল্টো। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলসমূহ বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। বন্যা কোন নতুন ঘটনা নয়। বন্যা সত্ত্বেও হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন বদ্বীপ অঞ্চলে জনসংখ্যার আধিক্য দেখা যাচ্ছে। দু’হাজার বছর আগে চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে যথার্থই লিখেছেন, অতিবৃষ্টির চেয়ে খরা অনেক বেশি ক্ষতিকর।° বন্যা হলে সব ফসল নষ্ট হয় না। খরা হলে সব ফসলই শুকিয়ে যায়। তাই দক্ষিণ এশিয়াতে খরাপ্রবণ অঞ্চলে বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক কম। 

বন্যার প্রত্যক্ষ ক্ষতির চেয়েও অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক হল পরোক্ষ ক্ষতি। বন্যা যত ক্ষতি করে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে বন্যার আশঙ্কা।o বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বন্যা কখন আসবে তার ঠিক নেই। তাই এসব অঞ্চলে সার ও সেচের মত আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করে চাষীরা উফশী (উচ্চ ফলনশীল) শস্য চাষ করার ঝুঁকি গ্রহণ করতে সাহস পায় না। বন্যার সম্ভাবনা তাই কৃষিকে চিরাচরিত চাষ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলিত করে রাখে। 

বন্যা শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক নয়; সামাজিক বৈষম্যকেও বন্যা প্রকট করে তোলে। বন্যার ফলে উঁচু জমিতে ফসল ভাল হয়, অথচ নীচু জমি তলিয়ে যায়। বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে উঁচু ও ভাল জমি দখল করে আছে বড়লোকরা, গরীবরা চাষ করে প্রান্তিক জমি। বন্যা তাই নিঃস্বায়ন প্রক্রিয়াকে নিবিড়তর করে তোলে। বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে দরিদ্ররা ক্রমাগত দরিদ্রতর হতে থাকে এবং ধনীরা ফুলে ফেঁপে ওঠে বন্যা দক্ষিণ এশিয়াতে নতুন কোন সমস্যা নয়। দু’হাজার বছর আগে চাণক্য বন্যাকে একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন এবং বন্যার ক্ষতি হ্রাস করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মতে বন্যা হলে নদীতে পুজো দিতে হবে। বন্যার সময় যারা নদীর তীরে থাকে তাদের বন্যার সময় উঁচু জমিতে নিয়ে যেতে হবে। চাণক্য উপদেশ দিয়েছেন যে, বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে হাতের কাছে কাঠের পাটাতন, বাঁশ ও নৌকা রাখতে হবে। কেউ যদি ভেসে যায় তবে লাউয়ের খোল, চামড়ার থলে, গাছের কাণ্ড, ডিঙি নৌকা এবং মোটা রশি ব্যবহার করে তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করতে হবে। যদি কোন ডিঙির মালিক বন্যার্ত ব্যক্তিকে উদ্ধার না করে তবে তাকে শাস্তি দিতে হবে। চাণক্য অবশ্য বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য কোন কাঠামোগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেননি। এর কারণ বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা নয়। চাণক্যের সময়ে বিভিন্ন ধরনের বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের প্রযুক্তি ভালভাবেই জানা ছিল। মনুস্মৃতি পাঠ করলে মনে হয় যে, প্রাচীন ভারতীয় মুনি ঋষিরা ইচ্ছে করেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঠামোগত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেননি। মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্রাহ্মণ কোন নদী বা স্রোতের গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টা করে তবে সে পুজো করার অধিকার হারাবে। মনুর ভাষ্যকারদের মতে যারা সেতু অথবা বাঁধ নির্মাণ করবে তাদের পাপের জন্য শাস্তি দেওয়া হবে।’ যদিও চাণক্য ও মনু তাঁদের বক্তব্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেননি, তবু মনে হয়, প্রাচীন ভারতীয় মুনি ঋষিরা বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দে হস্তক্ষেপ করলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে ক্ষতিকর। 

প্রাচীন মুনি ঋষিগণ পরিবেশগত কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ভৌত কাঠামো নিরুৎসাহিত করলেও আধুনিক প্রযুক্তি বন্যার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়নি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্যার প্রকোপ হ্রাস করার জন্য নানা ধরনের কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। ইউরোপে ওলন্দাজরা জলনিয়ন্ত্রণে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে। ওলন্দাজরা গর্ব করে বলে থাকে, বিধাতা পৃথিবী তৈরি করেছেন আর ওলন্দাজরা তাদের দেশ হল্যান্ড সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাঠামোগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঠামোগত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে জলাধার নির্মাণ, বাঁধ নির্মাণ, নদীর খাত গভীরকরণ, বন্যার পানি বের করার জন্য নির্গমন পথ নির্মাণ অথবা গতিপথ পরিবর্তন। 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ জলাধার নির্মাণের উপযোগী নয়। এ ধরনের জনবহুল দেশে জলাধার নির্মাণের জন্য যথেষ্ট জায়গা নেই। উপরন্তু জলাধার নির্মাণ হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। যেখানে সমগ্র ভূখণ্ডই বন্যার জলে তলিয়ে যায় সেখানে অতিরিক্ত নির্গমন পথ নির্মাণ অথবা গতিপথ পরিবর্তনও যথেষ্ট কার্যকর হবে না। নদীর খাত গভীরকরণও বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়। প্রতি বছর বাংলাদেশের নদীগুলো দিয়ে ২.৪ বিলিয়ন টন পলি বাহিত হয়; এই পরিমাণ হল পৃথিবীর সব নদী দিয়ে পরিবাহিত পলিমাটির প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীর সকল নদী দিয়ে গড়ে যে পরিমাণ পলিমাটি পরিবাহিত হয় তার একশ গুণের বেশি পলিমাটি বাংলাদেশের নদী দিয়ে সমুদ্রে পড়ে। এ ধরনের নদীর খাত যান্ত্রিকভাবে খনন অর্থনৈতিক দিক হতে গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। কাজেই বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাঠামোগত ব্যবস্থা হিসাবে মাটির বাঁধ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বাংলাদেশে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, সাড়ে চার হাজারের বেশি জলনিয়ন্ত্রক কাঠামো বানানো হয়েছে এবং তিন হাজার মাইলের বেশি জলনিষ্কাশক খাল কাটা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে মোট কর্ষিত জমির এক-তৃতীয়াংশ জমিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অবাঞ্ছিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।’ প্রথমত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীর দুই পারে বাধা সৃষ্টি করে পানি নদীর খাতে আটকে রাখে। এর ফলে যেখানে বাঁধ শেষ হয় সেখানে বন্যার প্রকোপ বেড়ে যায়। যদি নদীর এক পারে বাঁধ দেওয়া হয় তবে অপর পারে পানির চাপ বেড়ে যায়। এক জায়গা হতে অন্য জায়গাতে সমস্যা স্থানান্তর করে এর সমাধান সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, বাঁধ না থাকলে নদীর পানি-বাহিত পলিমাটি সকল প্লাবিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বাঁধ থাকলে পলি নদীর খাতে জমতে থাকে। এতে নদীর তলদেশ উঁচু হতে থাকে। নদীর তলদেশ উঁচু হলে বাঁধও উঁচু করতে হয়। বাঁধ উঁচু করলে নদীর তলদেশ আরও উঁচু হয়। এর ফলে একটি অগ্রহণীয় দুষ্ট চক্রের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তৃতীয়ত, নদীতে বাঁধ দিলে নদীর মূল স্রোত এপার থেকে ওপারে চলে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্রোত আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে নদীর বাঁধ ভাঙতে থাকে। নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণ করে বাঁধকে পেছনে নিয়ে যেতে হয়। এর ফলে পরিচালনা ও সংরক্ষণ ব্যয় অর্থনৈতিক দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়। চতুর্থত, যেখানে বাঁধ দেওয়া হয় সেখানে অনেক ক্ষেত্রে বাঁধের ভেতরে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকরা জল নিষ্কাশনের জন্য বাঁধ কেটে দেয়। এর ফলে বাঁধ নির্মাণের সম্পূর্ণ বিনিয়োগই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চমত, বাঁধের ফলে জমিতে পলি পড়তে পারে না। বাঁধের ভেতরে অনেক ক্ষেত্রে জমি শক্ত হয়ে যায় এবং তাতে আর্দ্রতার অভাব দেখা দেয়। সামগ্রিকভাবে বাঁধ দ্বারা ঘেরাও করা অঞ্চলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায়। ষষ্ঠত, বাঁধ দেওয়ার ফলে মাছের চলাফেরা বিঘ্নিত হয়। মাছের জীবন-চক্র নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। তাই মাছের উৎপাদন কমে যায়। সপ্তমত, অনেক ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতর পানি জমে মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। অষ্টমত, উপকূল অঞ্চলে বাঁধ পরিবেশগত সমস্যার সৃষ্টি করছে। মৃত বদ্বীপে বাঁধের ফলে জলাবদ্ধতার সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। বিল ডাকাতিয়ার দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা এর একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। উপরন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নৌ চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। সব শেষে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ শহরাঞ্চলে নিরাপত্তা সম্পর্কে একটা মিথ্যা মোহ গড়ে তোলে। শহরে বাঁধ দেওয়া অঞ্চলে বাড়িঘর দ্রুত গড়ে ওঠে। কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কখনও সম্পূর্ণ নিরাপদ হতে পারে না। যখন বাঁধ ভেঙ্গে যায় তখনি এ সব অঞ্চলে ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। 

বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহের শুধু অবাঞ্ছিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই দেখা যাচ্ছে না, প্ৰায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহ তাদের মূল অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে কতটুকু সফল হয়েছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে।১০ ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত বন্যা নিয়ন্ত্রণের অর্থনৈতিক মুনাফা সম্পর্কে একটি সমীক্ষা থেকে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। কৃষি খাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের পক্ষে প্রধান যুক্তি হল এই যে, বন্যার অনিশ্চয়তা দূর হলে কৃষকরা চিরাচরিত ধানের বদলে উফশী (উচ্চ ফলনশীল) ধান চাষ করবে এবং এর ফলে আমন ধানের ফলন বেড়ে যাবে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষা এ ধারণা মোটেও সমর্থন করে না। প্রথমত, বন্যা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল ও আমন ধানের ফলন বৃদ্ধির মধ্যে কোন সহগমন (correlation) পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে উফশী বীজের সম্প্রসারণে কোন উল্লেখযোগ্য তফাৎ দেখা যাচ্ছে না। কৃষির সামষ্টিক উপাত্ত হতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের সুফল সম্পর্কে যে সন্দেহ জাগছে তা বিভিন্ন বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কিত ঘটনা সমীক্ষা (case study) হতেও সমর্থিত হচ্ছে। ১৯৮৯-১৯৯৫ সময়কালে বাংলাদেশে বন্যা সম্পর্কিত কর্মসূচীর (Flood Action Plan) এক সমীক্ষাতে ১৭টি সমাপ্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ করা হয়। উক্ত ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৯টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সফল এবং ৮টি বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প অর্থনৈতিক দিক হতে অগ্রহণযোগ্য। এমনকি দুটো বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে প্রকল্প দুটোতে আদৌ কোন লাভ হয়নি বরং লোকসান হয়েছে।১২ অন্যান্য সমীক্ষা হতেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত দু’ধরনের বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। প্রথমত, ক্ষুদ্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহ বৃহৎ বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প হতে অধিকতর কার্যকর হয়। দ্বিতীয়ত, যে সব বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে সেচ সুবিধা থাকে সে সব প্রকল্প অর্থনৈতিক দিক হতে অধিকতর লাভজনক। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আদৌ অভিনব নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা হতেও দেখা যায় যে, বন্যা নিয়ন্ত্ৰণ প্রকল্পসমূহের সুবিধা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয় এবং প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ব্যয় অনেক কমিয়ে দেখানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল সংগঠন (The Corps of Engineers)। সিনেটর প্রক্সমায়ার (Proxmire) প্রকৌশল সংগঠনের প্রকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে দুঃখ করে লিখেছেন: “The Corps of Engineers, under pressure from Congress, has become experts in inventing benefits” (কংগ্রেসের চাপে পড়ে কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স বন্যানিয়ন্ত্রণে সুবিধা আবিষ্কারে বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁড়িয়েছে।) 

প্রতিকূল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও অনিশ্চিত অর্থনৈতিক মুনাফার সম্ভাবনা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কাঠামোগত প্রকল্প বাস্তবায়ন অব্যাহত রয়েছে। এর কারণ মোটেও অর্থনৈতিক নয়। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বন্যানিয়ন্ত্রণ বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত লাভজনক। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নানা ধরনের গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এদের চাপে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গৃহীত হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অর্থনীতির বাধ্যবাধকতাসমূহ সকল দেশে ও সকল সময় এক থাকে না। দেশকালপাত্র ভেদে বাধ্যবাধকতাসমূহ পরিবর্তিত হয়। তাই উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশসমূহে বন্যানিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক অর্থনীতি ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হল মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেসের সদস্যরা। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব অতি কম। তাই এ সব অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় সীমাবদ্ধ। কংগ্রেসের সদস্যরা তিনটি কারণে নিজেদের নির্বাচনী এলাকাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। প্রথমত, তাদের নির্বাচনী এলাকাতে যত নতুন প্রকল্প নেওয়া যায় ততই সাংসদদের জনপ্রিয়তা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নতুন নতুন পূর্তকাজ তাদের যোগ্যতার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। দ্বিতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্ৰণ প্রকল্পসমূহের মুনাফা বিনিয়োগের তুলনায় কম হলেও এসব প্রকল্পে অতি অল্পসংখ্যক জমির মালিক প্রচুর লাভ করে। তাই তারা এ ধরনের প্রকল্প সমর্থন করে। তৃতীয়ত, সাংসদদের নির্বাচনী এলাকাতে ঠিকাদারদের কাজের ও শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাসমূহ পরিবর্তিত হচ্ছে। এক সময়ে বন্যার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হত পল্লী অঞ্চল ও কৃষি খাত। বর্তমানে বন্যার বেশির ভাগ ক্ষতি উদ্ভূত হয় অকৃষি খাতে ও শহরাঞ্চলে। কাজেই শহরাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে চলছে। শহরাঞ্চলে জনসংখ্যার আকস্মিক বিস্ফোরণের ফলে জমির চাহিদা দ্রুত বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রাকৃতিক জল নিষ্কাশনের জন্য যে সব খাল ও নীচু জমি ছিল সবই মানুষের বসতভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি শহরাঞ্চলে নদীর খাতে পর্যন্ত অবৈধ দখলকারীরা বসতি স্থাপন করেছে। এর ফলে শহরাঞ্চলে বন্যার সমস্যা তীব্র হয়ে উঠেছে। কারিগরী দিক থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে সহজ উপায় হল এ সব অবৈধ বসতি তুলে দেওয়া। কিন্তু এ সব অবৈধ বসতির পৃষ্ঠপোষকরা রাজনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী। তাই শহরাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন সহজ উপায় নেই। শহরে বন্যা প্রতিরোধের জন্য চারদিকে বাঁধ দিলে ভেতরে যথাযথ নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে বৃষ্টির পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য বর্ষাকালে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে আপৎকালীন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু জনগণের সহযোগিতার অভাবে শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা স্থায়ী ভিত্তিতে সমাধান সম্ভব হবে না। উপরন্তু নগর রক্ষার জন্য শহরের চারদিকে যে বাঁধ দেওয়া হয় তা বাঁধের ভিতরে নিরাপত্তার একটি মিথ্যা মোহ গড়ে তোলে। জনগণ মনে করে যে, বাঁধের ভিতরে বন্যার জল কোন দিনই আসবে না। এ ধারণার ফলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার মত প্রকল্প এলাকার নীচু জমিতে ঘনবসতি গড়ে উঠছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল কোন মাটির বাঁধই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। যে কোন সময় এ সব বাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। যখন বাঁধ ভেঙ্গে যাবে তখন সংরক্ষিত এলাকায় অচিন্তনীয় ক্ষয়ক্ষতি হবে। তাই শহরাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু বাঁধ বা জল নিষ্কাশন ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য কোথায় বসতি হবে আর কোথায় বসতি হবে না তার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য অঞ্চল বিভাগের বিধি (Zoning law) শহরাঞ্চলে বাস্তবায়ন না করলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে না, শুধু টাকার শ্রাদ্ধ হতে থাকবে। 

বাংলাদেশে পল্লী অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহের রাজনৈতিক চালিকাশক্তি শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাম্রাজ্য বিকাশের প্রবণতা (empire building tendency) অথবা ঠিকাদারদের অর্থ-লিপ্সা নয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলই তাদের বাগ্মিতায় বন্দী হয়ে আছে। যখনই প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেখা দেয় তখনি বন্যা নিয়ন্ত্রণের গালভরা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তাই কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই বন্যা সম্পর্কে ব্যক্তিনিরপেক্ষ যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। পল্লী অঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে হাজার হাজার মাইল জুড়ে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বাঁধ নির্মাণ করাটাই বড় কথা নয়, বাঁধ সংরক্ষণ হল আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। চীনা প্রবাদে তাই বলা হয়েছে, বাঁধ দেখাশোনা করার লোক না থাকলে বাঁধ নির্মাণ সম্পূর্ণ অসার। যে সব দেশে কাঠামোগত ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে সেখানেই রয়েছে সংরক্ষণ ও পরিচালনার জন্য শক্তিশালী স্থানীয় প্রতিষ্ঠান। স্পেনে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গত এগারো শ’ বছর ধরে কাজ করছে। চীনে যেখানেই বন্যার ফলে বাঁধের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় সেখানেই হাজার হাজার লোক ছুটে আসে বাঁধের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। কোথাও কোথাও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষার জন্য বিশ লাখেরও বেশি লোক এগিয়ে আসে। দুভার্গ্যবশত বাংলাদেশে বন্যানিয়ন্ত্ৰণ বাঁধ রক্ষার জন্য জনগণের মধ্যে কোন উৎসাহ দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ গোমতী নদীতে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। গত দেড় শ’ বছর ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ কুমিল্লা শহরকে গোমতীর আকস্মিক বন্যা হতে রক্ষা করে আসছে। কিন্তু এ বাঁধ সরকারের রক্ষা করতে হয়; এ বাঁধ রক্ষার জন্য জনগণের মধ্যে কোন উৎসাহ উদ্দীপনা দেখা যায় না। এ সম্পর্কে প্রথম প্রতিবেদন পাওয়া গেছে ১৮৭৪ সালে – আজ থেকে প্রায় একশ পঁচিশ বছর আগে। তখন কুমিল্লাতে শিক্ষানবীশ সিবিলিয়ন কর্মকর্তা ছিলেন রিচার্ড কারস্টেয়ার্স (Richard Carstairs)। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই “Little World of an Indian District Officer” গ্রন্থে কুমিল্লার গোমতী বাঁধ সম্পর্কে তিনি নিম্নরূপ বর্ণনা রেখে গেছেন[১৪]: 

গোমতী নদী কুমিল্লা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর জলরাশি নদীর দু পারের বাঁধের মধ্যে আটকে রাখা হত। যখন নদী কানায় কানায় পুরে যেত তখন নদীর পানি শহরের জমির আট ফুট উপর দিয়ে বয়ে যেত। বাঁধ নিয়ে আমাদের তাই সব সময়েই দুশ্চিন্তা থাকত। ত্রিপুরার রাজার এর রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার ফলে বাঁধ ইঁদুরের গর্তে ভরে যেত। যখন এ সব গর্তে পানি চুয়ানো শুরু হত তখন পানি চুয়ানো বন্ধ করার জন্য লোক পাওয়া যেত না। স্থানীয় জনগণ দু ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমত, একদল এমন বর্ণের ছিল যাদের জন্য নিজের হাতে কাজ করা নিষিদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় দলের লোকদের নিজেদের জমির বাইরে কাজ করলে সম্মান হানি হত। এ ধরনের লোকদের কুলি হিসাবে কাজ করা ছিল অবমাননাকর। আমার মনে আছে যে একটি বাড়ি এ ধরনের একটি ছিদ্রের নীচে ছিল এবং বাঁধ ভাঙলে বাড়িটি ভেসে যেত। তবু ছিদ্রটি বন্ধ করতে লোকটি তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে একেবারে অস্বীকার করল। এটি আমার কাজ নয়, সে বলল, এটি সরকারের কাজ (উল্লেখ্য যে এটি সরকারের নয় রাজার কাজ ছিল)। সরকারকেই এ কাজ করতে হবে, আমি করব না। 

পরে জেলের কয়েদীদের দিয়ে এ বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু স্থানীয় লোকজন বাঁধ রক্ষাতে কোন সাহায্য করেনি। 

কারস্টেয়ার্সের প্রায় ষাট বছর পরে কুমিল্লাতে শিক্ষানবিস কর্মকর্তা হিসাবে আসেন ডক্টর আখতার হামিদ খান। ১৯৫৬ সালে–কারস্টেয়ার্সের বর্ণনার ৮২ বছর পরে, তিনি গোমতীর বন্যার নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন : 

বাঁধের কোন কোন ছিদ্র আশঙ্কাজনকভাবে বড় হচ্ছিল, যদিও কোথাও কোথাও ছিদ্র বন্ধ করা হয়েছে। নদী কোন মতে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। বাঁধ কোথাও ভাঙেনি। কিন্তু আশেপাশের গ্রামে সব কিছু ছিল স্বাভাবিক। বিপজ্জনক পানির দেওয়াল যা তাদের মাথার উপরে দাঁড়িয়ে ছিল তা গ্রামবাসীদের আদৌ উদ্বিগ্ন করে তোলেনি। ছোটবড় সবাই ছুটির মেজাজে ছিল, খুশিতে তারা মাছ ধরছিল ও গোসল করছিল। যেখানে নদীর ধারে প্রকৌশলীদের জীপ দাঁড়িয়েছিল সেখানে তারা জটলা পাকাচ্ছিল। যদিও বাঁধের ছিদ্রগুলি নিয়ে আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, তারা আদৌ কোন উদ্বেগ ছাড়াই এ সব ছিদ্র দেখছিল। ছিদ্রগুলো কোথা হতে শুরু হয়েছে বের করতে যখন তাদের অনুরোধ করা হয় তখন তারা কোন সহযোগিতা করেনি। তাদের এক দলকে আমি বললুম, “আপনারা কি বুঝছেন না যদি বাঁধ ভেঙে যায় তবে আপনাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবু এ ভাঙন রোধ করতে আপনারা কেন এগিয়ে আসছেন না?” আমি তাদের কাছ থেকে কোন উত্তর পাইনি। তারা কেন উদ্বিগ্ন নয় আমি জানি না, তবু এ কথাও বলতে পারছি না যে তাদের আচরণ নেহাত নির্বোধ। এরা হচ্ছে প্রথম সারির শৌখিনদের মত। তারা যদি বেশি চিন্তা করে তা হলে এদের সুখ থাকবে না। প্রকৃতির সাথে নিরন্তর সংগ্রামে অবিচলিত থাকা একটি গুণ। প্রচণ্ড বাধার মুখে এ মনোভাব এদের বাঁচিয়ে রাখে। 

আখতার হামিদ খানের এ লেখার প্রায় পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখনও স্থানীয় জনগণ গোমতীর বাঁধ রক্ষায় এগিয়ে আসে না। এখনও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ রক্ষার একমাত্র দায়িত্ব হল সরকারের। 

বাংলাদেশে বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহ জনগণের নামে নির্মিত হলেও এসব প্রকল্পে জনগণের আদৌ কোন সম্পৃক্ততা নেই। এর একটি বড় কারণ হল প্রকল্পসমূহ স্থানীয় জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে নির্মিত হয় না। এ সব প্রকল্পের নীলনকশা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়, স্থানীয় জনগণের পছন্দ অনুসারে তা প্রণীত হয় না। তবে বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর চেষ্টা করা হলেও তা কতটুকু সফল হবে সে সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে। তার একটি বড় কারণ হল, বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলে সামাজিক পুঁজির (social capital) অপ্রতুলতা। সামাজিক পুঁজির সরবরাহ নির্ভর করে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষমতার উপর। পূর্বে উল্লেখিত গোমতী নদীর বাঁধসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের অভিজ্ঞতা হতে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে এ ধরনের সামাজিক পুঁজি যথেষ্ট পরিমাণে নেই। 

তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশে কি বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আদৌ কোন ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক হবে না? আমার মনে হয়, এ ধরনের সিদ্ধান্ত সঠিক হবে না। আমাদের অতীতের সাফল্য হতে শিক্ষা নিতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা হতে দেখা যাচ্ছে যে বৃহৎ বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের বদলে ক্ষুদ্র বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহ অধিকতর কার্যকর হয়। দ্বিতীয়ত, যে সব প্রকল্প স্থানীয় জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে নির্মিত হয় তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর। জনগণের চাহিদার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য জনগণ কর্তৃক আংশিক ব্যয়ভার গ্রহণে সম্মতি। যে সব প্রকল্পে স্থানীয় জনগণ ব্যয়ভার বহনে সম্মত হয় সে সব প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণেও জনগণ অংশগ্রহণ করবে। তৃতীয়ত, আমাদের সব সময়েই মনে রাখতে হবে যে, সকল সমস্যারই টেকসই সমাধান নেই। আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশের জনগণ বন্যার মাঝে বাস করে আসছে, ভবিষ্যতেও তা-ই করতে হবে। এ পরিস্থিতিকে কিভাবে আরো সহনীয় করা যায় সে দিকে নজর দিতে হবে। ফসল ছাড়া অন্যান্য খাতে বিশেষ করে অকৃষি খাতে ক্ষতি হ্রাস করার লক্ষ্যে বন্যা-প্রতিরোধক্ষম (flood proofing) ব্যবস্থা আরো ব্যাপক ও শক্তিশালী করা সম্ভব। বিশেষ করে বন্যার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতার ঊর্ধ্বে বাসগৃহ নির্মাণ করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে কুড়িগ্রাম জেলায় কেয়ার নামক বেসরকারী সংস্থার একটি আশাব্যঞ্জক নিরীক্ষার কথা স্মরণ করা যায়। এ প্রকল্পের অধীনে বাসগৃহসমূহ এবং যৌথ আশ্রয়কেন্দ্রসমূহ উঁচু করা হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় এসব বাসগৃহ ও আশ্রয়কেন্দ্র বন্যামুক্ত ছিল। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে মাথাপিছু খরচ হয়েছে ৫৬০ হতে ৬৭০ টাকা মাত্র।১৬ উপরন্তু উপকৃত ব্যক্তিরা এ প্রকল্পের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় বহন করেছে এবং যৌথ আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য জমি দান করেছে। তবে বন্যার সময় ভাঙন রোধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে অনেক বাড়িঘর ও আশ্রয়কেন্দ্র ভেঙ্গে যেতে পারে। বন্যা প্রতিরোধক্ষম ব্যবস্থা সম্প্রসারণের জন্য বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এমন ধরনের ফসলের চাষ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। সামগ্রিকভাবে দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতি অল্প ব্যয়ে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। বন্যার ক্ষতি হ্রাস করার জন্য ব্যয়বহুল কাঠামো অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর অথবা অপ্রয়োজনীয়। 

যতদিন পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন নীতি বাস্তবায়ন করা না হবে ততদিন পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পসমূহের রক্ষণাবেক্ষণের সমস্যা জটিলতর হতে থাকবে। প্রতি বন্যার সময় বাঁধ ভাঙার জুজুর ভয় দেখিয়ে ঠিকাদাররা জরুরীভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ দিতে বাধ্য করবে। কিন্তু বন্যার সময় এ ধরনের কাজের কোন সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান সম্ভব হবে না। এর ফলে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ের সিংহভাগই বিবেকহীন ঠিকাদারদের অনুপার্জিত আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়াবে। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের নামে চড়া দামে পাথর কিনে নদীতে ফেলা হবে। কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে কি না তা বিশ্লেষণ না করেই সরকারকে বরাদ্দ দিতে হবে। সরকারের ব্যয় বাড়তেই থাকবে কিন্তু জনগণের কোন মঙ্গল হবে না। সিরাজগঞ্জ ও চাঁদপুর শহর রক্ষার নামে যে ব্যয় করা হয়েছে তাতে অনেকগুলি নতুন শহর স্থাপন করা সম্ভব ছিল। 

এ সম্পর্কে একটি গল্প মনে পড়ছে। দুই বন্ধু একসাথে প্রকৌশলী হিসাবে ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁদের একজন সড়ক ও জনপথ বিভাগে ও আরেকজন পানি উন্নয়ন বোর্ডে কাজ নেন। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী কয়েক বছর পরে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে একই বিভাগে ঠিকাদার হন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী তাঁর বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখেন বন্ধু অনেক বড়লোক হয়ে গেছেন। প্রকৌশলী তাঁর বন্ধুর কাছে এ রহস্যের কারণ জানতে চান। বন্ধু তাঁকে একটি নদীর কাছে নিয়ে একটি সেতু দেখিয়ে বলেন যে, সেতুটির জন্য বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ দিয়ে তাঁর বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। কয়েক বছর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীও চাকুরি ছেড়ে তাঁর প্রাক্তন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদার হলেন। কিছুদিন পরে তাঁর বন্ধু তাঁর বাড়িতে এসে দেখেন যে তাঁর বন্ধু তার চেয়েও অনেক আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। বন্ধুকে জিজ্ঞেস করা হল কিভাবে এ বাড়ি নির্মাণ সম্ভব হল। বন্ধু তাঁকে নদীর ধারে নিয়ে বললেন যে, নদীর বাঁধের অর্থে তিনি বড়লোক। বন্ধু বললেন, তিনি কোন বাঁধ দেখছেন না (আসলেও কোন বাঁধ ছিল না)। বন্ধুটি বললেন বাঁধের এক শ’ ভাগ বরাদ্দই তার বাড়িতে লেগেছে। তবে খাতাপত্রে বলা হয়েছে বন্যায় বাঁধটি ভেসে গেছে। জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে অর্থ ব্যয় হবে, কিন্তু কোন সুফল মিলবে না, এমনকি সে অর্থের হদিশও পাওয়া যাবে না। 

.

তথ্যসূত্র 

১., Cohen J. M. and M. J., The Penguin Dictionary of Quotations (Aylesbury: ELBS, 1964), p. 416 

২. Rogers, Peter, et al. Eastern Waters Study (Washington: USAID: ISPAN, 1989), pp. 35-37 

৩. Kautilya, The Arthasastra, Rangarajan, L. N., ed., (New Delhi : Penguin Books of India, 1992), p. 129 

৪. Khan, Akbar Ali, “Economic Considerations and Alternatives in Water Policy Formulation in Bangladesh” in Water Resources Policy for Asia Mohammed Ali, et al., ed., (Rotterdam: A. A. Balkema, 1987), pp. 459-485 

৫. Kautilya, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২৯-১৩০ 

৬. Doniger, Wendy and Smith, Brian K., tr., The Laws of Manu (New Delhi: Penguin Books of India, 1991), p. 60 

৭. Thapar, Ramila, A History of India (Hammondsworth: Penguin Books, 1966), p. 253 

৮. Khan, Akbar Ali,, p. 460 

৯. Khan, Akbar Ali, “Floods”, Natural Resources Forum, August 1987, vol. XI No. 3 pp. 259-270 

১০. Planning Commission, The Fifth Five Year Plan, 1997-2002 (Dhaka : Ministry of Planning, 1998), p. 274 

১০. WARPO, National Water Management Plan Project: Legacies and Lessons (mimeo, 1999), p. 18 

১২. WARPO, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫ 

১৩. Proxmire, William, The Fleecing of America (Boston: Hughton Mifflin Company, 1980), p. 93 

১৪. Carstairs, R., The Little World of an Indian District Officer (London : Macmillan and Co, 1912), pp. 88-89 

১৫. Khan, Akhter Hameed, The Works of Akhter Hameed Khan, vol. I (Comilla : BARD, 1983), pp. 341-342 

১৬. WARPO, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *