বাংলাদেশের বোম্বেটেরাজ
চলতি বাংলায় জলদস্যুকে বলা হয় বোম্বেটে। ইংরেজিতে বলে Pirate—শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে। বাংলা ‘বাম্বেটে’ কথাটির উৎপত্তি পর্তুগিজ শব্দ থেকে, তার কারণ একসময়ে পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিষম অত্যাচারে বাংলা দেশের অনেক জায়গাই প্রায় জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল। বোম্বেটে বলতে লোকে বুঝত তখন প্রধানত পর্তুগিজদেরই।
Pirate—শব্দটির উৎপত্তি যখন প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে, তখন বুঝতে হবে যে খ্রিস্টপূর্ব যুগেও গ্রিসদেশের জলপথে ছিল বোম্বেটেদের উৎপাত। কেবল গ্রিস কেন, রোম, মিশর, ভারতবর্ষ ও চিন প্রভৃতি প্রত্যেক প্রাচীন দেশকেই স্মরণাতীত কাল থেকে জলদস্যুদের মারাত্মক উপদ্রবের জন্যে বর্ণনাতীত যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে।
এক শ্রেণির ডানপিটে লোক দুঃসাহসিক কাজ করে আনন্দ পায়। তার উপরে থাকে যদি প্রচুর অর্থলাভের প্রলোভন, তাহ’লে তো আর কথাই নেই। অনেক তথাকথিত সাধুও তখন আর শয়তান হয়ে উঠতে লজ্জা পায় না। আর এ কথাও সকলেই জানে যে, মনুষ্যসমাজে শয়তানের দলই প্রবল।
স্থলপথে সতর্ক পাহারা। সশস্ত্র সৈনিক, জাগ্রত জনতা, পদে পদে আইনের বাধা। চম্পট দেওয়ার আগেই চটপট ধরা পড়বার সম্ভাবনা।
জলপথেও আইনবিরুদ্ধ কাজ করে ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু আগেকার যুগে স্থলপথের মতো জলপথেও উচিতমতো পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। বিশেষত অসীম সাগরে। জলদস্যুরা লুটপাট করে কোথায় ডুব মারত, তাদের গ্রেপ্তার করবার আশা ছিল সুদূরপরাহত। বার বার দেখা গেছে, ভারতসাগরে বোম্বেটেদের অত্যাচার হয়ে উঠেছে মারাত্মকরূপে ভয়াবহ, অথচ ‘সর্ব্বশিক্তমান’ উপাধিধারী দিল্লির বাদশাহও তাদের নাগাল ধরতে পারছেন না। এইসব কারণে বোম্বেটেদের প্রাধান্য ছিল বিশেষ করে সেকালেই।
একালেও বোম্বেটে হতে চায়, এমন সব দুরাত্মার অভাব নেই। কিন্তু স্থলে সৈন্যবাহিনীর মতো জলে রাজার নৌবাহিনীও এতটা প্রবল হয়ে উঠেছে যে, বোম্বেটেগিরি আর নিরাপদ ও লাভজনক নয়। বোম্বেটেরা আর সশস্ত্র ও দ্রুতগামী যুদ্ধ জাহাজের অধিকারী হতে পারে না এবং প্রত্যেক দেশে থাকে ওই শ্রেণির শত শত সরকারি জাহাজ। আজকাল তাই সহজেই দমন করা যায় জলদস্যুতা। একমাত্র চিনসমুদ্র ছাড়া আর কোথাও আজ জলদস্যুতার কথা শোনা যায় না।
কিন্তু যে জলপথে হানা দিতে চায়, রণতরীর অধিকারী হলে সে যে কী সাংঘাতিক হুলস্থূল বাধিয়ে দিতে পারে, গত প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ‘এমডেন’ জাহাজের জার্মান কাপ্তেন তার জ্বলন্ত প্রমাণ রেখে গিয়েছেন। দিনের পর দিন দীর্ঘকাল ধরে এমডেন বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল দিকে দিকে, কিন্তু সমগ্র ভারতসাগরে দিশেহারার মতো ছুটোছুটি করেও তার পাত্তা পায়নি ইংরেজদের দুর্দ্ধর্ষ যুদ্ধজাহাজগুলো।
জলদস্যুতা বেআইনি হলেও তার সঙ্গে আছে রোমান্সের সম্পর্ক। দেশ-বিদেশের সমুদ্রে ও নদনদীতে অর্থ আর রক্ত লোভী সেই বেপরোয়া মানুষদের রোমাঞ্চকর কাহিনি পড়তে ভালোবাসে ছেলে-বুড়ো সকলেই। তাদের কথা নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গল্প ও শত শত উপন্যাস এবং তাদের চাহিদা আছে সমগ্র পৃথিবীতে। তবে কেবল হানাহানি, রক্তারক্তি ও লুঠতরাজের জন্যে নয়, সে সব কাহিনি অধিকতর চিত্তোত্তেজক হয়ে ওঠে ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে যখন নায়ক রূপে দেখা দেয় এক-একজন সাধু ব্যক্তি।
কিন্তু আজ আমি তোমাদের কাছে যে সব দুষ্ট লোকের কথা বলতে বসেছি, তারা কল্পিত গল্প উপন্যাসের কেউ নয়, রক্তমাংসের দেহ নিয়ে বিদ্যমান ছিল তারা সত্যিকার পৃথিবীতেই। জাতে তারা হচ্ছে মগ বা আরাকানী ও ফিরিঙ্গি ও পর্তুগিজ। তাদের পেশা ছিল বাংলাদেশের নদীতে নদীতে জলদস্যুতা করা। সে সব হচ্ছে প্রধানত সপ্তদশ শতাব্দীর ব্যাপার।
আরও কয়েকশত বৎসর পিছিয়ে গেলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব একটি পরম সত্য।
ভারতের মাটিতে মুসলমানরা প্রথম শিকড় গাড়বার সুযোগ পেয়েছিল কেন?
উত্তরে ইতিহাস বলবে, বোম্বেটেদের জন্যেই।
পশ্চিম এশিয়ার কতক অংশ তখন আরবদের করতলগত। মুসলমানদের ধর্মনেতা ও নরপতি বা খলিফার অধীনে হাজাজ ছিলেন ইরাকের শাসনকর্তা।
সিংহলের রাজা ওই খলিফা ও হাজাজের উদ্দেশে পাঠিয়েছিলেন বহুমূল্য দ্রব্যে পরিপূর্ণ নয়খানা জাহাজ।
জাহাজগুলো অগ্রসর হচ্ছিল সিন্ধুদেশের নিকটস্থ সাগরপথ দিয়ে। আচম্বিতে একদল জলদুস্য (খুব সম্ভব তারা ভারতীয়) সেই সব জাহাজ লুণ্ঠন করে সরে পড়ল।
সিন্ধুদেশের রাজা তখন দাহীর। মূল্যবান সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে হাজাজ দূত পাঠিয়ে দাহীরকে বললেন, ‘এর জন্যে ক্ষতিপূরণ করতে ও দস্যুদের শাস্তি দিতে হবে আপনাকেই।’
দাহীর বললেন, ‘সে কী কথা? দস্যুরা তো আমার হাতধরা নয়, আমি তাদের শাস্তি দেব কেমন করে?’
এ যুক্তি হল না হাজাজের মনের মতো। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি দাহীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলেন সৈন্যদল এবং প্রথম যুদ্ধে হেরে ও দ্বিতীয় যুদ্ধে জিতে হাজাজ সিন্ধুদেশ অধিকার করলেন।
সেই হল ভারতে মুসলমান রাজত্বের সূত্রপাত। সেটা হচ্ছে ৭১২ খ্রিস্টাব্দের কথা।
বাংলাদেশে বোম্বেটেরা যখন দস্তুরমতো পসার জমিয়ে তুলেছে, সেই সময়ে ইউরোপে ও আমেরিকাতেও সকলকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছিল জলদস্যুরা। আগে সংক্ষেপে তাদেরও কিছু কিছু পরিচয় দিয়ে রাখি, কারণ ওই ফিরিঙ্গি বোম্বোটেদেরই একদল হয়েছিল ভারতীয় জলপথের পথিক।
আগেই বলেছি, গ্রিক ও রোমানদের সময়েও ইউরোপে জলদস্যুর অভাব ছিল না। বিশ্ববিখ্যাত দিগবিজয়ী জুলিয়াস সিজারকেও একবার জলদস্যুর কবলে পড়ে বিস্তর নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল।
রোম সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পর উত্তর আফ্রিকার মুসলমান জলদস্যুরা ভূমধ্য- সাগরে অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে। পনেরো শতাব্দীর শেষভাগে স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে মুসলমানরা উত্তর-আফ্রিকার মরক্কো প্রভৃতি প্রদেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তারপর তাদের অনেকে জলদস্যুর পেশা নিয়ে ইউরোপীয়দের উপরে অবাধ অত্যাচার চালাতে থাকে। তাদের বিপুল প্রতাপে সারা ইউরোপ হত থরথরি কম্পমান। তারা কেবল সমুত্রযাত্রীদের সর্ব্বস্ব কেড়ে নিত না, মানুষদেরও ধরে নিয়ে গিয়ে গোলাম করে রাখত—এইভাবে হাজার হাজার ইউরোপীয়কে চিরজীবনের জন্য বন্দি হয়ে থাকতে হত। তারা ক্রমে ক্রমে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, সমগ্র ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্য একত্রে চেষ্টা করেও ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত তাদের দমন করতে পারেনি। খৈর এদ-দিন, দ্রাগুত ও আলি বাসা প্রভৃতি বোম্বেটের নাম শুনলেই তখনকার ইউরোপীয় বণিকেদের পেটের পিলে চমকে উঠত। একদিক দিয়ে বাংলাদেশের ফিরিঙ্গি বোম্বেটেরাও ছিল তাদের সুযোগ্য ছাত্র। সে কথা বলব যথাসময়ে।
ভূমধ্যসাগরে মুসলমান বা মুর-জাতীয় বোম্বেটেরা আর সকলের উপরে টেক্কা মেরেছিল বটে, কিন্তু তা বলে মনে কোরোনা যে, নানাদেশীয় ইউরোপীয় জলডাকাতরা হাত গুটিয়ে চুপ করে বসেছিল নিতান্ত ভালোমানুষের মতো। সুবিধা পেলেই তারা প্রাণপণে উৎপাত করত যেখানে-সেখানে। নিম্নশ্রেণির সাধারণ জলডাকাতরা তো ছিলই, তার উপরে আত্মপ্রকাশ করে নূতন একশ্রেণির বোম্বেটে। জাতে তারা ইংরেজ, এবং অনেক সময়ে ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরাও তাদের দলে যোগ দিতে ইতস্তত করত না। ইংরেজ ছাড়া আর সব জাতের জাহাজ তারা নির্বিচারে লুণ্ঠন করত।
ক্রমে ইউরোপীয় বোম্বেটের দল দূর-দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরদিকে আছে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র, তা হচ্ছে আটলান্টিক মহাসাগরেরই একটি শাখা। ওইখানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলটা ছিল ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের জন্যে অত্যন্ত কুখ্যাত। তাদের নির্দয়তা ছিল মর্মভেদী। তারা কেবল জাহাজ লুণ্ঠন করেই ক্ষান্ত হত না, সর্ব্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পর যাত্রীদেরও অকূল সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করত। এইভাবে কত হাজার হাজার অভাগাকেই যে জীবন্ত অবস্থাতেই সলিলসমাধি লাভ করতে হয়েছে, তার হিসাব কেউ রাখতে পারে নি।
নতুন এক ওজুহাত দেখিয়ে সমুদ্রে জাহাজ ভাসালে আর এক শ্রেণির ইংরেজজাতীয় জলদস্যু। তখন ইংল্যান্ডের সঙ্গে স্পেনের দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধ চলেছে। সে সময়ে স্পেনের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল আমেরিকার নানাস্থানে। ইংরেজ বোম্বেটেরা সুবিধা পেলেই স্পেনের কোনও জাহাজই লুণ্ঠন করতে ছাড়ত না। এত বড় তাদের বুকের পাটা ছিল যে, সরকারি যুদ্ধজাহাজের সঙ্গেও তারা লড়াই করতে ভয় পেত না। কেবল সমুদ্রে নয়, প্রায়ই তারা ডাঙ্গায় নেমে বড় বড় অরক্ষিত নগরকেও আক্রমণ করত! সে এক বিষম সর্বনেশে ব্যাপার—লুঠতরাজের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ড! তাদের কবলে পড়ে বহু শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ জনপদ পরিণত হয়েছে প্রাণীশূন্য ভস্মস্তূপে। লাভের লোভে এদের দলে যোগ দিয়েছিল ফরাসি বোম্বেটেরাও। ইংরেজিতে এদের এক নূতন নামকরণ হয়েছে—বাক্যানীয়ার (Bueeaner)। এই দলের কাপ্তেন বার্থোলোমিউ রবার্টস নামে একজন ডাকাত একাই লুণ্ঠন করেছিল চারিশত জাহাজ। এ ছাড়া কীড, টীচ ও লোলোনয়েজ প্রমুখ প্রসিদ্ধ বোম্বেটেরাও হিংস্রতা ও ভীষণতার জন্যে অতিশয় কুখ্যাত হয়ে আছে।
স্বার্থের গন্ধ পেয়ে নীতিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল ইংরেজ গভর্নমেন্ট পর্যন্ত। ‘আমি স্পানিয়ার্ডদের লঙ্গে লড়াই করেছি’ বললেই অত্যন্ত নরাধম যে কোনও জলডাকাতের সাত খুন মাফ হয়ে যেত। হেনরি মর্গ্যান নামে এই দলের এক পাপাত্মাকে বন্দি করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল—শাস্তিলাভ করবার জন্যে। ইংরেজের আইনে বোম্বেটের শাস্তি হচ্ছে প্রাণদণ্ড। কিন্তু তখনকার ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস মর্গ্যানকে বোম্বেটে জেনেও ‘স্যর’ উপাধিতে ভূষিত করেও তৃপ্ত হলেন না, তাকে লেফটেন্যান্ট গভর্নর রূপে পাঠিয়ে দিলেন জামাইকা দ্বীপে। ভক্ষক হল রক্ষক!
ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদেরই এক দলের কার্যক্ষেত্র হল বঙ্গদেশ। ওই দলে ইউরোপের অন্যান্য জাতির লোকও ছিল, হানা দিয়ে বেড়াত তারা ভারতসাগরে। কিন্তু তাদের মধ্যে সব চেয়ে মাথা চাগাড় দিয়ে উঠল পর্তুগিজরাই।
তার কারণও আছে। সমুদ্রপথে তখন পর্তুগালের প্রভুত্বের সীমা নেই। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-ডা-গামা ইউরোপ থেকে ভারতে আসবার জন্যে নতুন সমুদ্রপথ আবিষ্কার করে মস্ত নাম কিনেছেন। আমরা তাঁকে যদি ভদ্রবংশীয় বোম্বেটে বলে ডাকি, তবে কিছুমাত্র অন্যায় হবে না। কারণ ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে কালিকট নগরকে কামানের মুখে সমর্পণ করেন এবং প্রভূত সম্পত্তি লুণ্ঠন ও অগুন্তি নরহত্যা করে স্বদেশে ফিরে যান।
প্রথম ইমানুয়েল ছিলেন পর্তুগালের রাজা। পর্তুগিজরা তখন দক্ষিণ ভারতের একাধিক প্রত্যন্ত প্রদেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। ভাস্কো-ডা-গামার দস্যুতা রাজার কাছে গৃহীত হল বীরত্ব রূপে এবং পুরস্কার স্বরূপ ভাস্কো-ডা-গামা লাভ করলেন পর্তুগালের ভারতীয় উপনিবেশের রাজ-প্রতিনিধি বা শাসনকর্তৃত্ব। তিন মাস পরে দক্ষিণ ভারতেই (কোচিনে) তাঁর মৃত্যু হয়।
ভারতের সঙ্গে পর্তুগালের ওই সম্পর্কের ফলে তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার লোভে দলে দলে পর্তুগিজ এদেশে আসতে আরম্ভ করলে এবং অন্যান্য ইউরোপীয়দের চেয়ে তারাই দলে ভারী হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে তারা বৈধ ও অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশের স্থানে স্থানে আড্ডা গেড়ে কায়েমী হবার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল। প্রথমে তারা কুঠি স্থাপন করলে চট্টগ্রাম ও সপ্তগ্রামে। তারপর আরও নানা জায়গায় তাদের আস্তানার সংখ্যা বেড়ে উঠতে লাগল ক্রমে ক্রমে।
ইংরেজরা যে বৈধ ভাবে বাংলাদেশে প্রধান হয়ে উঠেছিল, ইতিহাস এ কথা বলে না। পর্তুগিজরাও গোড়া থেকেই এখানে প্রাধান্য বিস্তার করতে চেয়েছিল অবৈধ উপায়ে। কিন্তু তারা ছিল ইংরেজদেরও চেয়ে বেশি অসৎ। স্বার্থসিদ্ধির জন্যে তারা কোনওরকম সঙ্কোচ বা ন্যায়-অন্যায়ের ধার ধারত না। দরকার হলেই তারা জলদস্যুতা করত বঙ্গোপসাগরের সেখানে-সেখানে। বাংলার বাসিন্দারা তাদের বন্ধুভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।
তার কারণও ছিল। পর্তুগালের রাজা ভারতেও সুবৃহৎ উপনিবেশ স্থাপন করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজ্যবিস্তার করবার মতো লোকবল তাঁর ছিল না, কারণ পর্তুগাল হচ্ছে ক্ষুদ্র দেশ—ভারতবর্ষের বৃহৎ আসর জমাতে পারে, এমন যোগ্য ও শিষ্ট লোকের সংখ্যা সেখানে বেশি নয়।
যোগ্য লোকের অভাবে পর্তুগালের কর্তৃপক্ষ যে উপায় অবলম্বন করলেন, শেষ পর্যন্ত সেইটেই হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের সর্বনাশের কারণ।
পর্তুগালের কারাগারে ছিল দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীগণ। তাদের বলা হল, ‘তোমরা স্বদেশে বসে জেল খাটতে কিংবা ভারতবর্ষে গিয়ে স্বাধীনতার ভাগ্যপরীক্ষা করতে চাও?’
বলা বাহুল্য, কয়েদিরা ভারতবর্ষে যাওয়াই শ্রেয়স্কর বলে মনে করলে।
তাদের দলে ছিল গুরুতর অপরাধের জন্য দণ্ডিত অপরাধীরাও—কেউ খুনি, কেউ ডাকাত, কেউ গুন্ডা। ভারতে তথা বাংলাদেশে গিয়েও তারা নিজেদের স্বভাব বদলাতে পারলে না, বরং দেশের সমাজ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে তাদের চক্ষুলজ্জা পর্যন্ত ঘুচে গেল। আর কয়লার ময়লাও যায় না।
তখন নানা দেশের ইউরোপীয় ভ্রমণকারীরা ভারত পর্যটন করতে আসতেন। তাঁদের ভ্রমণকাহিনিতে ভারতের পর্তুগিজদের ‘বন্য মানুষ’ এবং ‘পোষ-না-মানা ঘোড়া’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের উপনিবেশে সুশাসনের গুণে পর্তুগিজরা অপেক্ষাকৃত ভদ্রভাবে জীবনযাপন করতে বাধ্য হত। এটা যাদের সহ্য হত না, তারা সেখান থেকে সরে পড়ে বাংলাদেশে গিয়ে পদার্পণ করত, কারণ বাংলার নদীতে নদীতে ছিল জলডাকাতি করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সুযোগ।
চতুর্দিকে হাহাকার! ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের অত্যাচার! সমাজ-সংসার উৎসন্নে যেতে বসল, বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম শ্মশানের মতো হয়ে উঠল।
ফিরিঙ্গিরা নদীতে নদীতে হানা দেয় এবং সুযোগ পেলেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের ইউরোপীয় জলদস্যুদের মতো তীরে নেমেও লুটপাট করে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয় দেয়, মানুষদের বন্দি করে নিয়ে যায়। দেখতে দেখতে তাদের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে বাসিন্দারা পলায়ন করতে লাগল—দেশ হয়ে উঠল অরাজক বা ‘ফিরিঙ্গিরাজক’।
মুকুন্দরাম চক্রবর্ত্তীর ‘কবিকঙ্কন চণ্ডী’ কাব্য নাকি ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত। তার মধ্যেও ওই বোম্বেটে-বিভীষিকার প্রমাণ আছে। ধনপতি সওদাগর নদীতে নৌকো ভাসিয়ে চলেছেন—
‘ফিরিঙ্গীর দেশ’ খান বাহে কর্ণধারে,
রাত্রিতে বহিয়া যায় হরমাদের ডরে।’
‘হরমাদ’ মানে রণপোতবহর। পাছে ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের দ্বারা আক্রান্ত হতে হয়, সেই আশঙ্কায় নৌকো চালানো হয়েছিল রাত্রির অন্ধকারে চুপে চুপে। আর একটি লক্ষ করবার বিষয় হচ্ছে, কবি মুকুন্দরাম ওই অঞ্চলটিকে ‘ফিরিঙ্গির দেশ’ বলে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশ তখন মোগলসাম্রাজ্যের অন্তর্গত এবং তার কয়েকটি প্রান্তে এমন কয়েকটি রাজ্য ছিল, যাদের স্বাধীন বা প্রায়-স্বাধীন বলা চলত। কিন্তু পূর্ব্বোক্ত অঞ্চলে তখন ফিরিঙ্গি পর্তুগিজ জলডাকাতদের প্রাধান্য ছিল এত বেশি যে, তা কেবল ‘ফিরিঙ্গিরি দেশ’ বলেই বর্ণিত হয়েছে।
কিন্তু কেবল কি ফিরিঙ্গি? তাদের সহচর ছিল মগরাও। মগ ও ফিরিঙ্গি—দুষ্টামি ও নষ্টামিতে ‘কে হারে, কে জিতে দুজনে সমান!’ বাংলায় ‘মগের মুল্লুক’ বলে একটা চলতি কথা আছে। মগের মুল্লুক—অর্থাৎ অরাজক দেশ। ফিরিঙ্গি এবং মগদের অত্যাচারে তখন বাংলাদেশের কতকাংশ সত্য সত্যই অরাজক হয়ে উঠেছিল।
আরাকান হচ্ছে ব্রহ্মদেশেরই একটা প্রদেশ। ত্রিপুরার দক্ষিণ দিক থেকে আরাকান রাজ্য আরম্ভ হয়েছে। মগরা হচ্ছে সেখানকারই বাসিন্দা। ধর্মে বৌদ্ধ হলেও তারা অহিংসার মন্ত্র উচ্চারণ করত না। এক সময়ে তারা বাংলাদেশও আক্রমণ করে সমগ্র চট্টগ্রাম জেলা এবং নোয়াখালি আর ত্রিপুরারও কতক অংশ অধিকার করেছিল। এইজন্যে অবশেষে তাদের সঙ্গে মোগলদের সঙ্ঘর্ষ উপস্থিত হয়।
কথায় বলে ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।’ কাজেই ফিরিঙ্গি দস্যুদের সঙ্গে মগ দস্যুদের মিতালি হতে দেরি লাগল না। মগ ও ফিরিঙ্গিরা মনে মনে পরস্পরকে পছন্দ করত না, কিন্তু তারা একজোট হয়েছিল কেবল একই স্বার্থের খাতিরে। মগদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দরকার হলে ফিরিঙ্গিরা মোগলদের সঙ্গে লড়াই করেছিল এবং আরাকানের দুই জায়গায় তাদের দুটো বড় বড় ঘাঁটিও ছিল বটে, কিন্তু তারা কোনওদিনই সম্পূর্ণরূপে আরাকানরাজের বশ্যতা স্বীকার করেনি।
আসলে বাংলায় প্রবাসী ফিরিঙ্গি বা পর্তুগিজরা ছিল জাতিভ্রষ্ট বা সমাজচ্যুত জীব। পর্তুগাল তাদের স্বদেশ হলেও পর্তুগালপতির বা তাঁর রাজপ্রতিনিধিরও কোনও ধারই তারা ধারত না—মায়ে-খেদানো বাপে-তাড়ানো ছেলেদের মতো যা খুশি তাই করতে পারত।
কিন্তু তারা ছিল নিপুণ নাবিক ও জলযুদ্ধে মহা ওস্তাদ। তাদের নৌকো বা জাহাজ ছিল রণপোতেরই নামান্তর, সর্বদাই তার মধ্যে থাকত কামান, বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র। এইজন্যে বাংলার কয়েকজন বিদ্রোহী রাজা তাদের অনেককে বেতন দিয়ে নিজেদের দলে নিযুক্ত করতেন—যেমন শ্রীপুর ও বিক্রমপুরের রাজা চাঁদ রায় ও কেদার রায় এবং যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য।
চট্টগ্রামে ও আরাকানে ছিল পর্তুগিজ বোম্বেটেদের প্রধান আস্তানা। সাধারণত তারা চট্টগ্রাম থেকে বেরিয়ে নদীপথে নৌবাহিনী চালিয়ে যখন-তখন হানা দিত হুগলি, যশোহর, ভূষণা, বাকলা, বিক্রমপুর, সোনারগাঁ ও ঢাকা প্রভৃতি স্থানে। বলা বাহুল্য, তাদের পাপকার্যের সঙ্গী হত মগের দলও এবং তারাও ছিল তাদেরই মতো নিপুণ নাবিক।
শোনা যায়, এখন যেখানে হিংস্রজন্তুপূর্ণ, জনশূন্য সুন্দরবন, আগে সেখানে ছিল সব সমৃদ্ধিশালী জনপদ। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে মগ ও ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের কবলে নির্যাতিত হয়ে নাগরিকরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিল।
পরিত্যক্ত, বিজন নগর আচ্ছন্ন হয়ে যায় ঝোপঝাপ আগাছায়, কালক্রমে বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষের উপরে মাথা তুলে দাঁড়ায় মহা মহা মহীরুহ এবং চর্তুদিকে নরনারীর কলকোলাহলের পরিবর্তে শোনা যেতে থাকে ভয়াল জন্তুদের ভৈরব গর্জন।
নাম হয় তার সুন্দরবন। সুন্দর বটে, কিন্তু ভীষণ সুন্দর!
”আরাকানী জলদস্যুরা (মগ ও ফিরিঙ্গি) নিয়মিত ভাবে বাংলাদেশ লুণ্ঠন করত। হিন্দু বা মুসলমান যাকে হাতের কাছে পেত, তাকেই তারা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেত।
বন্দিদের হাতের তেলোয় ছ্যাঁদা করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত বেতের ফালি (বা রজ্জু), তারপর তাদের নিক্ষেপ করা হত জাহাজের পাটাতনের তলায়। দিনের পর দিন তারা সেইখানে অন্ধকারে গাদাগাদি করে বাস করত। প্রতিদিন সকালে তাদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্যে উপর থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হত কয়েক মুঠো আরাঁধা চাল—যেমন করে লোকে ছড়িয়ে দেয় মুরগিদের জন্যে।
ফিরিঙ্গিরা দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন বন্দরে গিয়ে ওলন্দাজ, ইংরেজ ও ফরাসিদের কাছে বন্দিদের বিক্রয় করে ফেলত। কিন্তু মগরা তা করত না, তারা স্বদেশে নিয়ে গিয়ে বন্দিদের নিযুক্ত করত কৃষিক্ষেত্রে বা গৃহস্থালীর কাজে।’
এই হল ঐতিহাসিকের উক্তি।
তমলুকের কিছুদূর থেকে গঙ্গার একটি শাখা চলে গিয়েছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে। এই জলপথ দিয়েই আনাগোনা করত মগ ও ফিরিঙ্গি দস্যুদল। ইংরেজ বণিকরা ওই জলপথের নাম দিয়েছিল, ‘দুরাত্মাদের নদী’।
আগেই ইউরোপীয় সমুদ্রে মূর জলদস্যুদের কথা বলা হয়েছে। বন্দিদের তারা এখানে-ওখানে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ফেলত।
লুণ্ঠনের সঙ্গে সঙ্গে তারা চালাত দাসব্যবসায়। খুব সম্ভব তাদের দেখাদেখি বাংলাদেশের ফিরিঙ্গি বোম্বেটেরাও ওই পেশা অবলম্বন করেছিল।
ভেবে দেখ, সে কী নিদারুণ ব্যাপার! চারিদিকে অখণ্ড শান্তি, নদীর ধারে ঘুমিয়ে আছে সবুজ বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতি। সোনার ধান দোলানো খেতের আশেপাশে মাঠে মাঠে নির্ভয়ে খেলা করছে গৃহস্থদের শিশুর দল—তাদের কারুর নাম রাম বা শ্যাম কিংবা কাসেম বা কাদের।
আচম্বিতে দিকে দিকে হইচই উঠল—’ওরে, পালা, পালা!’ ”ফিরিঙ্গিরা আসছে, বোম্বেটেরা আসছে!’
নদীর ধারে হুড়মুড় করে এসে পড়ল বোম্বেটেদের জাহাজ এবং তার ভিতর থেকে টপাটপ লাফিয়ে পড়ল মূর্তিমান যমদূতের মতো পর্তুগিজের গোরার দল!
ছেলের দল খেলা ভুলে প্রাণপণে দৌড় মারলে যে যেদিকে পারে। কিন্তু সবাই পালাতে পারলে না, ধরা পড়ল অনেকেই।
তারপর? ফিরিঙ্গি বোম্বেটেরা তাদের নিয়ে গিয়ে বেচে ফেললে, ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকদের কাছে। ক্রীতদাস নিয়ে তারা ফিরে গেল সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে আপন আপন দেশে।
বাংলাদেশের কচি কচি শ্যামলা ছেলে, যেখানে গিয়ে পড়ল সেখানকার মানুষ, ভাষা, তুষারপাত ও জীবনযাত্রা—সবই তাদের কাছে নতুন, আজব, দুর্বোধ! কোথায় আদরভরা মা-বাপের কোল আর কোথায় অজানা বিদেশীদের কাছে যন্ত্রণাপূর্ণ ক্রীতদাসের জীবন। ছিল সবাই আনন্দময় ফুলের বাগানে, গিয়ে পড়ল নির্জল, নির্মম মরুভূমিতে।
ম্যাডাম দ্যু বেরী ছিলেন ফরাসিদেশের এক পরমাসুন্দরী বিলাসিনী, রাজা পঞ্চদশ লুইর প্রিয়-বান্ধবী। এমনি এক বাংলার ছেলে গিয়ে পড়েছিল তাঁর কাছে, তিনি তাকে শখ করে দামি দামি পোশাক পরিয়ে লালনপালন করতেন—মানুষ যেমন করে পাখি পোষে সোনার খাঁচায়। তার বাঙালি বাপ-মা কী নাম ধরে তাকে ডাকতেন কেউ তা জানে না, কিন্তু ফরাসি দেশে সবাই তাকে জামোর বলে ডাকত।
জামোর কি খুশি ছিল? মোটেই নয়, মোটেই নয়! স্বাধীন পাখি কি সোনার খাঁচায় খুশি থাকতে পারে? জামোর জানত, সবাই তাকে বলে ‘বিকটাকার ক্ষুদে জন্তু’! বুকের তলায় প্রাণ তার বিদ্রোহী হয়ে উঠত।
অবশেষে সে প্রতিশোধ নিলে। শুরু হল ফরাসি বিপ্লব, রাজা পঞ্চদশ লুইর প্রিয়পাত্রী ও জামোরের কর্ত্রী দ্যু বেরী হল বন্দিনী।
বিচারালয়ে তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলে জামোর। দ্যু বেরীর উপরে হল প্রাণদণ্ড।
পূর্ববাংলায় মগরাও করত ফিরিঙ্গিদের মতো অমানুষিক অত্যাচার। মুসলমান ঐতিহাসিক তাদের সম্বন্ধে বলেছেন :
‘বাংলার সীমান্তপ্রদেশে মগদের অত্যাচারে আকাশে উড়ত না একটা পাখি, স্থলে বিচরণ করত না একটা জন্তু। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত যাতায়াত করবার পথের দুই পাশে দেখতে পাওয়া যেত না একজনমাত্র গৃহস্থকেও।”
এমন অস্বাভাবিক অবস্থা কল্পনাও করা যায় না। এবং এমন অস্বাভাবিক অবস্থা চিরদিন কখনও স্থায়ী হতেও পারে না। অবশেষে মোগলসম্রাট ও মুসলমান শাসনকর্তাদের টনক নড়ল। প্রথমে তাঁরা ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝে দুই-চারিদল সেপাই পাঠিয়ে বোম্বেটেদের দমন করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বোম্বেটেরা অনায়াসেই তাদের হারিয়ে দিলে। তখন তাঁরা দস্তুরমতো আয়োজন করে কোমর বেঁধে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন।
সর্বপ্রথমে ভারত সম্রাট শাজাহানের দৃষ্টি পড়ল হুগলীর পর্তুগিজ উপনিবেশের উপরে। তাঁর আজ্ঞায় সেনাপতি কাসিম খাঁ সসৈন্যে যাত্রা করলেন হুগলীর দিকে।
বাংলার মধ্যে হুগলিতেই পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল সব চেয়ে সুপরিচালিত, সুরক্ষিত ও সুবৃহৎ। সেখানকার পর্তুগিজদের অধিকাংশই জলদস্যু ছিল না বটে, কিন্তু তারা মোগলদের শত্রু আরাকানরাজকে সৈনিক ও গোলা-বারুদ প্রভৃতি দিয়ে সাহায্য করত। উপরন্তু বাংলার ফিরিঙ্গি বোম্বেটেরা হুগলিতে এসে ফলাও ভাবে দাস-ব্যবসায় চালিয়ে যেত। তাঁর অভাগা প্রজাদের বন্দি করে ফিরিঙ্গিরা যে হাটে নিয়ে গিয়ে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি করে ফেলবে, সম্রাট শাজাহানের পক্ষে এটা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।
মোগলরা যে সৈন্যবলে ছিল অধিকতর বলীয়ান, সে কথা বলাই বাহুল্য। আগে জলস্থলের চারিদিক থেকে হুগলিকে ঘিরে ফেলে তারা আক্রমণ করতে অগ্রসর হল। কিন্তু পর্তুগিজদের যুদ্ধপ্রতিভা ছিল অসামান্য, সংখ্যায় দুর্বল হলেও তারা দীর্ঘ তিন মাস ধরে মোগলদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিলে। অবশেষে তারা গঙ্গায় জাহাজ ভাসিয়ে যুদ্ধ করতে করতে কতক পলায়ন করলে। কতক মারা পড়ল এবং কতক বন্দি হল। মোগলসম্রাট উপহার লাভ করলেন চারিশত বন্দি ফিরিঙ্গি নরনারী। এইভাবে পশ্চিম বাংলায় হুগলি বন্দরে পর্তুগিজদের প্রধান আস্তানা বিলুপ্ত হয়।
কিন্তু এর আগে এবং এর পরে অনেক কাল ধরেই পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলায় ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের প্রভাব বা অত্যাচার ছিল অপ্রতিহত। তারা নিষ্ঠুর ও দস্যু ছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের সময়ে কোনওদিনই তাদের সাহস ও বীরত্বের অভাব হয়নি। মোগলদের সঙ্গেও তারা লড়াই করেছে, মগদের সঙ্গে বিবাদ বাধলেও তারা অস্ত্র ধরেছে এবং জয়ী হয়েছেও বারংবার।
তাদের মধ্যে দুইজন নেতার নাম বাংলার ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। ডোমিঙ্গো কার্ভালহো ও সিবাষ্টিয়ো গঞ্জেলেশ।
কার্ভালহো শ্রীপুরের রাজা কেদার রায়ের অধীনে কাজ করত। সে মগদের কবল থেকে সনদ্বীপ কেড়ে নিয়ে কেদার রায়ের হাতে সমর্পণ করেছিল। এবং কেদার রায়ের রাজধানী মোগলদের দ্বারা আক্রান্ত হলে কার্ভালহোই তাদের হারিয়ে শ্রীপুরকে রক্ষা করে। পরে রাজা প্রতাপাদিত্যের আদেশে সে নিহত হয়।
গঞ্জেলেশ ছিল এক নম্বরের দুরাত্মা। তার নেতা হওয়ার উপযুক্ত বিশিষ্ট গুণ থাকলেও দস্যুতায়, নৃশংসতায় ও বিশ্বাসঘাতকতায় তার তুলনা ছিল না। বাকলার বাঙালি রাজার কাছ থেকে সৈন্যসাহায্য পেয়ে সে মুসলমানদের হারিয়ে সনদ্বীপ অধিকার করে, অথচ পরে ওই রাজাকেই বঞ্চিত করে নিজেই সেখানে প্রভু হয়ে বসে শাসনকার্য চালাতে থাকে। কিন্তু গঞ্জেলেশের ক্রুরতা ও কঠিন স্বভাবের জন্যে তার অধীনস্থ অন্যান্য ফিরিঙ্গি বোম্বেটেরা পর্যন্ত তাকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না। ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা তার কাছ থেকে সনদ্বীপ কেড়ে নেন এবং গঞ্জেলেশের নামও ডুবে যায় বিস্মৃতির অন্ধকারে!
শেষের দিকে মগদের সঙ্গে ফিরিঙ্গিদের আর বিশেষ সদ্ভাব ছিল না।
দুই জাতির মধ্যে প্রায়ই খিটিমিটি বাধতে থাকে। ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের বিখ্যাত শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁ যখন সনদ্বীপ দখল করে চট্টগ্রাম আক্রমণের উদ্যোগ করছিলেন, সেই সময়ে মগেদের সঙ্গে ঝগড়া করে ফিরিঙ্গিরা তাঁর ফৌজে যোগ দেয় সদলবলে। সেই সম্মিলিত মোগল ও ফিরিঙ্গি সৈন্যদের আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে আরাকানীরা সে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেল এবং অবশেষে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হল মগের মুল্লুক। সেখানে বন্দিদশায় জীবনযাপন করছিল হাজার হাজার বাঙালি কৃষক। স্বাধীনতা পেয়ে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে এল।
প্রথমে হুগলি এবং তারপর চট্টগ্রাম—এই দুই প্রধান বন্দর ও আস্তানা থেকে বঞ্চিত হয়ে বোম্বেটেদের মেরুদণ্ড একেবারেই ভেঙে গেল। মগরা আর বাংলার দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারেনি এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষের দিকেও বাংলাদেশ পর্তুগিজরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল বটে, কিন্তু তাদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল বিষদাঁতভাঙা ভুজঙ্গের মতো।
বোম্বেটেদের হাতে ইংরেজদের নাকাল হতে হয়নি। তারা এখানে কায়েমি হয়ে বসবার আগেই বাংলাদেশ থেকে বোম্বেটেরাজ বিলুপ্ত হয়েছে।