অনেকে বলে, ভারতকে যেভাবেই হোক, বিশ্বকাপে যত দীর্ঘদিন সম্ভব, বাঁচিয়ে রাখতে হবে–এই হলো আইসিসির সংকল্প। শুরুতেই ভারত খেলা থেকে চলে গেলে কী করুণ অবস্থা দাঁড়ায়, তা ২০০৭ সালে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল আইসিসি। ভারতের ১০০ কোটিরও ওপর জনসংখ্যা টিভিতে খেলা দেখেনি, সুতরাং বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে গেছে, স্পনসর পাওয়া যায়নি, ক্রিকেট টুরিজমও লাটে উঠেছিল। এভাবে যে চলে না তা বুঝে আইসিসি সেই থেকে যে করেই হোক ভারতের হেরে যাওয়া আর ঘরে ফিরে যাওয়া ঠেকাচ্ছে। নিদেনপক্ষে সেমি-ফাইনালটা যেন ভারতকে দিয়ে খেলাতে পারে। আম্পায়াররাও এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল, তাঁরা জানেন তাঁদের কাছ থেকে আইসিসি কী আশা করছে। দক্ষিণ এশিয়ার গুটিকয় দেশের মতো ক্রিকেটক্রেজি আর কোনও দেশ নয়। ক্রিকেটের মাস্টার হয়ে নিউজিল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়াও পুরো জাতিকে ক্রিকেটক্রেজি বানাতে পারেনি।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ লোকই বলছে, ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে আম্পায়াররা ভারতকে জেতানোর উদ্দেশ্যেই মাঠে নেমেছিলেন। শুরুতে ম্যাচটা জমবে মনে করা হয়েছিল, অবশ্য খানিকটা গড়াতেই ঝুলে পড়লো। আমার বাড়িতে যাঁরা ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন, তাঁরাও, ভারত দুশ’ আশি/পঁচাশি রান করার পরই উঠে চলে গেলেন কারণ তাঁরা বুঝে গেছেন ভারত হাসতে হাসতে জিতবে। যদিও আমি প্রচুর মিষ্টি খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছিলাম, এই ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ নিয়ে ভারতীয়দের তেমন কোনও উত্তেজনা লক্ষ্য করিনি। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ভারতীয়দের উত্তেজনাটা বেশি। পাকিস্তানকে হারাতে যত আনন্দ, তত আনন্দ আর অন্য কোনও টিমকে হারিয়ে ভারতের হয় না। খেলাতে না চাইলেও রাজনীতি এসে যায়।
ভাবছিলাম যদি আম্পায়াররা একশ’ভাগ নিরপেক্ষ হতেন, তবে কি ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জিততে পারতো? আমার কিন্তু মনে হয় না। বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়ের সমালোচনা শুনেছি, ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আন্ডারস্টেন্ডিং-এর অভাবটাও চোখে পড়ার মতো। ফেসবুকে বাংলাদেশ ভক্তদের এখন আস্ফালন দেখছি, সবারই বক্তব্য বাংলাদেশ নির্ঘাত জিততো, কিন্তু আম্পায়াররাই জিততে দেননি। এমনই ক্রুদ্ধ বাংলাদেশের ভক্তকূল এখন যে, পারলে ভারতের বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়। কেউ কেউ আবেগে উত্তেজনায় এমনই কাঁপছে যে হাতের কাছে আইসিসির কেউ, বা আম্পায়ারদের কাউকে পেলে নির্ঘাত জবাই করতে পারে। ক্রিকেটে জেতাটাকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ বলেই ওরা মনে করছে। আম্পায়াররা ইচ্ছে করেই ভারতকে জিতিয়েছেন বা ইচ্ছে করেই বাংলাদেশকে হারিয়েছেন এই বলে বলে যারা ফেসবুক কাঁপাচ্ছে, তাদের এই আবেগটা যদি অভিজিতের হত্যাকারীদের বিচার ত্বরান্বিত করতে, বাংলাদেশে মৌলবাদী উত্থান থামাতে, নারীবিদ্বেষ দূর করতে, লাগাতো- তবে বাংলাদেশের সত্যিকার কিছু উপকার হতো। দেশপ্রেমটা দেখছি শুধু ক্রিকেট জেতার বেলায়। ভিনদেশি লোকেরা বাংলাদেশকে ঠকিয়েছে বুঝলাম। এদিকে যে দেশের লোকরা দেশের লোকদের অবিরাম ঠকাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এই দেশপ্রেমিকরা কি আদৌ কখনও ফুঁসে উঠেছে?
এর মধ্যে আরও ভাবছিলাম, বাংলাদেশ যদি জিততো খেলায়, যদি ভারত না গিয়ে বাংলাদেশ যেতো সেমিফাইনালে, এমনকী যদি বিশ্বকাপও জিতে যেতো, কী হতো বাংলাদেশের? পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের দুর্নাম কি ঘুচে যেতো? চরম নারী-বিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক, আর মানাবাধিকার লংঘনের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আর পরিচিত হতো না? মানুষ কি ভুলে যেতো যে এই দেশটিতে মুক্তচিন্তকদের জবাই করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়, এই দেশটিতে সচেতন লেখকদের জনসমক্ষে কুপিয়ে মারা হয়? জানতো না এই দেশে ধর্মীয় আইন বহাল থাকার কারণে আজ নারীরা তাদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত? জানতো না যে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলেরা বাসে ট্রাকে পেট্রোল বোমা ছুড়ে এ দেশে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে।
বাংলাদেশ শতবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে জিতলেও এ দেশ একটি ব্যর্থ দেশ হিসেবেই প্রমাণিত হবে। সুতরাং সবচেয়ে যেটা জরুরি, ক্রিকেটে জেতার চেয়েও, অন্যায়-অত্যাচার-নির্যাতন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জেতা। আম্পায়াররা ভুল করেন। অহরহই করেছেন অতীতে। শুধু বাংলাদেশই নয়, অনেক দেশই আম্পায়ারদের ভুলের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশি ক্রিকেট ভক্তকূল এটা নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে, কিন্তু প্রতিবাদ তো নয়, দিনভর রাতভর তারা উগরে দিচ্ছে ভারত বিদ্বেষ আর ভারতঘৃণা। আত্মসমালোচনা না করলে কোনো জাতি বা মানুষ উন্নতি করতে পারে না। বাংলাদেশের উন্নতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা বাংলাদেশের মানুষ, অন্য কেউ নয়।