বাঁশের কেল্লা – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
বাঁশের কেল্লার কথা অনেকেই বলে কিন্তু বাঁশের কেল্লা কে তৈরি করেছিলেন এবং এখানে কীভাবে লড়াই চলেছিল, তার কথা হয়তো অনেকের জানা নেই৷
বাঁশের কেল্লা তৈরি করেছিলেন তিতুমির৷ ইংরেজরা বলে, তিতুমির ছিলেন একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত, আবার এদেশের লোকে বলেন, তিনি ছিলেন একজন স্বদেশভক্ত বীর৷ সে যাই হোক, তাঁর জীবনের কাহিনি যা শোনা যায়, সেইটুকুই বলছি৷
২৪ পরগনা জেলায় বাদুড়িয়া থানার ভেতরে হায়দরপুর বলে একটি গ্রাম আছে৷ সে জায়গাটি মুসলমানপ্রধান৷ সেইখানেই এক গরিব মুসলমানের ঘরে ১৭৮২ সালে তিতুমির জন্মগ্রহণ করেন৷ ছেলেবেলা থেকে তিতুমির লাঠিখেলা, ছোরাখেলায় যথেষ্ঠ কৃতিত্ব দেখাতেন এবং তাঁর পালোয়ানির খ্যাতি সে সময় চারধারে খুব ছড়িয়ে পড়ে৷
সেই সময় জমিদারদের জুলুম খাটাবার জন্য লাঠিয়ালের খুব দরকার পড়ত এবং ভালো লাঠিয়ালদের লাঠির জোরে অপরের জমি দখল ও কারুর সঙ্গে রেষারেষি হলে মারপিট করার জন্য লোক রাখতেই হত৷ নদিয়ায় কয়েকজন জমিদার তিতুমিরকে সেই কাজের জন্য বাড়িতে ভালো মাইনে দিয়ে বহাল করেছিলেন৷ যিনি বেশি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করতেন, তাঁর সম্পত্তি রক্ষার জন্যেই তিতুমির চলে যেতেন৷ এই সময়ে একটা হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়ে তিতুমিরকে জেলে যেতে হয়৷
ইংরেজরা তখন ধীরে ধীরে তাঁদের শাসন ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে, লোকে তাদের ভয়ে অস্থির, কিন্তু তিতুমির নিজের শক্তি ইংরেজদের চেয়ে ঢের বেশি ভেবে, ওদের গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতেন না৷ যখন তাঁর উনচল্লিশ বছর বয়স সেই সময় তিনি ভাবলেন যে, আমি যখন একজন খাঁটি মুসলমান, তখন আমার মক্কা যাওয়া প্রয়োজন হজ করতে৷ এ তীর্থস্থান দেখতেই হবে৷ তিনি মক্কায় চলে গেলেন৷
মক্কায় গিয়ে তিনি আরও গোঁড়া মুসলমান হয়ে এলেন৷ মুসলমানদের মধ্যে সেই সময় ইংরেজ ও কাফের বিরোধী একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল-তাদের নাম ‘ওয়াহাবি সম্প্রদায়’৷ এই সম্প্রদায়ের একজন ধর্মগুরু, সৈয়দ আহমেদ সাহেব, তাঁকে দীক্ষা দিলেন৷ ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে এলেন তিতুমিয়া নাম গ্রহণ করে৷ সেই থেকে ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের ধর্মমত ও ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করে দিলেন তিতুমিয়া৷
এই সময়ে তাঁর সঙ্গে মিস্কিন নামে এক ফকিরের আলাপ হল এবং তিনি তিতুমিয়াকে এমন প্রভাবান্বিত করলেন যে, তিতুর গোঁড়ামি আরও বেড়ে গেল৷ হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান যদি তাঁর মতের বিরোধিতা করত, তাহলে তার দফা নিকেশ করে দিতেন তিনি৷ তাঁর ভয়ে সাধারণ লোক কেউ কাছে ঘেঁষতে ভরসা করত না৷ তিতুমিয়া তখন নিজের দল গড়ে ফেললেন৷
পুঁড়ের জমিদার কৃষ্ণদেব রায় আর গোবরডাঙার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একসময়ে তিতুর দলের ঘোরতর একটা সংঘর্ষ বেধে গেল-বহু লোক খুন জখম হল কিন্তু তিতুকে জব্দ করতে এঁরা কেউই পারলেন না৷ সেকালে জোর যার মুলুক তার, এই নীতিটাই চলত, অতএব তিতুর বিরুদ্ধে লাগতে গেলে রীতিমতো যে-শক্তির দরকার হত, সেটা এঁদের ছিল না৷ বাধ্য হয়ে তাঁরা চুপচাপ রইলেন, কিন্তু ইংরেজরা তখন দেশে হাঙ্গামা বাধলে চুপ করে থাকত না, বিশেষ করে জমিদারদের ওপরে কেউ হামলা করলে তারা তাঁদেরই পক্ষ নিত, তবু তিতুমিয়ার বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দেবে না, মামলা ফেঁসে যাবে ভেবে তাঁরাও চুপ করে রইলেন৷ তা ছাড়া তারা জানত তিতুমির একজন দুর্ধর্ষ লোক আর তাঁর দলে লোক অনেক৷
কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তিতুর প্রতাপ ক্রমশ আরও বেড়ে গেল৷ এর ওপর মিস্কিন ফকির তাঁর কানে কানে মন্তর দিলেন, ‘আরে তুম তো বাদশা বন গিয়া, কিসিকো পরোয়া নেহি করো৷’
তিতু ভাবলেন, সত্যিই তো আমার এত অনুচর, এত ভৃত্য, সবাই আমার ভয়ে থরথর করে কাঁপে, আমি তো সত্যিই বাদশা-কাকে পরোয়া তাহলে! আমি নিজেকে এখন বাদশা বলেই ঘোষণা করে দিচ্ছি৷ সত্যি সত্যি তিতু নিজেকে বাদশা বলে প্রচার করে দিলেন৷ তখন থেকে তাঁকে বাদশা তিতুমিয়া বলে সকলে ডাকতে লাগল৷
মিস্কিন হলেন প্রধান মন্ত্রী-সেনাপতি হলেন মাসুম খাঁ নামে তিতুর এক বিশ্বস্ত অনুচর৷ এ ছাড়া সৈন্যসামন্ত সব পদে এক-একজন বসে গেল৷
মিস্কিন ফকির পরামর্শ দিলেন, ‘আরে তুম তো বাদশা হুয়া, তব কিল্লা কাহে নেই বানাতা৷ ইয়ে ইংরেজ লোগোঁকো সাথ লড়াই হোনেসে তুম ক্যা করেগা?-আগাড়ি কিল্লা বানাও!’
সত্যি তো কেল্লা তৈরি না হলে বাদশাহি করা তো যাবে না-তা ছাড়া ইংরেজরা যদি সত্যি সত্যি কোনোদিন কিছু করতে আসে, তাহলে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে তো কেল্লা দরকারই৷ এই ভেবে তিতু নারকেলবেড়িয়া বলে একটি জায়গায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করে ফেললেন৷
কেল্লা তৈরি করার পর, তিতুর প্রজাদের ওপর কর বসল, বাদশার সঙ্গে দেখা করতে হলে নজরানা দিয়ে দেখা করার নিয়ম হল, তাঁর হুকুম না মানলে কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হল৷ ইংরেজরা সে খবর পেল কিন্তু এদেশের লোকের ওপর যা হচ্ছে হোক ভেবে তারা তখনও কিছু বলল না৷ তারপর নীলকুঠির সাহেবদের ওপর যখন বাদশার সৈন্যরা হামলা করে বসল, তখন ইংরেজের টনক নড়ল৷ আর চুপ করে থাকা চলে না৷ সাদা চামড়ার অপমান সহ্য হল না তাদের৷
বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেটকে ইংরেজ সরকার হুকুম দিলেন, তিতুমিরকে গ্রেফতার করো৷ ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্দার সাহেব একদল দেশি সেপাই নিয়ে নারকেলবেড়িয়া হাজির হলেন তিতুকে গ্রেফতার করতে, কিন্তু বাদশা তিতুমির এমন তির আর বর্শা ছুড়তে লাগলেন যে আলেকজান্দার তাঁর দলবল নিয়ে পালাতে পালাতে বাঁচেন৷ তিনি সত্যি কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালালেন৷
এ সংবাদ গেল ভারতের তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিংক-এর কাছে৷ তিনি কলকাতার সামরিক অধ্যক্ষকে হুকুম করলেন, তিতুমিরকে যেকোনো উপায়ে শায়েস্তা করো৷
অধ্যক্ষের হুকুমে, একজন কর্নেলের অধীনে এক-শো গোরা সৈন্য, তিন-শো দেশি সেপাই, দুটো বড়ো বড়ো কামান নিয়ে কলকাতা থেকে নারকেলবেড়িয়ার পথে যাত্রা শুরু করল৷
বেলা দুপুরে তারা বাঁশের কেল্লার বদ্ধ দরজার সামনে পৌঁছে ওখানকার প্রহরীদের জিজ্ঞাসা করলে, ‘তিতুমির কোথায়?’
বাঁশের কেল্লার প্রহরারত সৈন্যরা ভেতর থেকে জবাব দিলে, ‘বাদশার সঙ্গে এখন দেখা হবে না-যাও, ভাগো!’
কর্নেল সাহেব এগিয়ে এসে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘আমি ফোর্ট উইলিয়ম থেকে আসছি, তিতুমিরকে ধরে নিয়ে যাবার গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে৷ তাকে বলে এসো, ভালোভাবে যদি সে আমার সঙ্গে যায় তো ভালোই, নইলে তাকে জোর আমরা ধরে নিয়ে যাব!’
প্রহরী দেখলে চার-শো দেশি-বিদেশি সৈন্য আর দুটো বড়ো কামান নিয়ে এরা হাজির হয়েছে যখন, তখন তাহলে বড়ো রকমের কিছু ঘটবেই-
তাহলে বাদশাকে খবর দিতেই হচ্ছে! তখুনি একজন পাহারাদার ছুটল খবর দিতে৷ একটু পরেই আরও কয়েকজন লোক নিয়ে সেনাপতি মাসুম খাঁ এসে দাঁড়ালেন দরজার ওপারে৷ খুব কড়া ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাই তোমাদের? বাদশা এখন বিশ্রাম করছেন, বেশি গোলমাল করলে ভালো হবে না৷’
কর্নেল গম্ভীরভাবে আবার বললেন, ‘তিতুমিরের নামে সরকার থেকে গ্রেফতারির পরোয়ানা আছে-তাকে ধরে নিয়ে যেতে আমরা এসেছি৷’
বাদশাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে? প্রশ্ন শুনে সবাই এর-ওর মুখের দিকে চাইতে লাগল৷ সবাই ভাবলে, সাহেবের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে বোধ হয়৷ তা না হলে বাংলার বাদশাকে ধরতে আসে!
কর্নেল সাহেব তবু তিনবার পরোয়ানাটা দেখালেন৷ ভেতরের লোকেরা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘জান বাঁচানে চাও, তো হট যাও বেয়াকুফ হিঁয়াসে৷’
কর্নেল আদেশ দিলেন, ‘কামান দাগো’৷
একজন সিপাহি কর্নেলের আদেশ ও ইঙ্গিতে শুধু কেল্লার অধিবাসীদের ভয় খাওয়াবার জন্যে দু-বার ফাঁকা তোপের আওয়াজ করলে৷
কামান দাগার উপক্রম করতেই কিন্তু দরজার ওপারে সবাই হুড়মুড়িয়ে ছুটে পালাল-কিন্তু আওয়াজটা থেমে যেতে উঁকিঝুঁকি মেরে তারা দেখলে যে, কেল্লার কোনো ক্ষতি তো হলই না, এমনকী দরজাটাও ভাঙল না৷
দলের পেছনে পেছনে তিতুমিরও এসেছিলেন৷ কেবল মিস্কিন ফকির লুকিয়ে পড়েছিলেন একটা ঝোপের মধ্যে৷
তিতুমির তখন শত্রুদের বিরুদ্ধে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্যে মিস্কিন ফকিরের খোঁজ করছিলেন কিন্তু তাঁকে খুঁজে পেলেন না৷ ওদিকে কর্নেল সাহেব অনর্থক হাঙ্গামা না করে বিনা রক্তপাতে যদি কার্য উদ্ধার হয়, তার জন্যে কামান চালানো থামিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন৷
ওদিকে ফকির সাহেব সবকিছু চুপচাপ হয়ে যেতে ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসতেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যারা ওঁর খোঁজ করছিল৷ তারা তাঁকে দেখেই সোৎসাহে বলে উঠল, ইংরেজ কর্নেল কামানের গোলা চালিয়েও বাঁশের কেল্লার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি৷ তখন তিনি তাদের কথা শুনে মৃদু হেসে বলে উঠলেন, ‘উ কেয়া করেগা-ম্যায় তো গোলা খা ডালা!’ (আমি তো গোলা খেয়ে ফেলেছি৷)
এ্যাঁ! ফকির সাহেব মন্ত্রের জোরে অত বড়ো বড়ো গোলা খেয়ে হজম করে ফেলেছেন!-কথাটা শুনে তাদেরও চোখ বড়ো বড়ো রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেল৷
কেল্লার মধ্যে ফকিরের এই অদ্ভূত কেরামতির কথা ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে, তিতুমির তখন ছুটে এসে ফকিরকে ঘন ঘন সেলাম জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাহলে এখন আমাদের কী করা কর্তব্য জনাব?’
ফকির বলে উঠলেন, ‘কুছ ডর নেহি-কুত্তাকো মার ডালো!’ (ভয় নেই, কুকুরকে মারো)
সঙ্গেসঙ্গে মহোৎসাহে তিতুমির আর তাঁর সৈন্যদল বাঁশের কেল্লার চারধারে সমবেত হয়ে গোরা সেপাইদের বিরুদ্ধে লাঠি, সড়কি, তির ছুড়তে শুরু করলে৷ দু-চারজন সেপাই সেই আক্রমণে ওইখানেই রক্তাক্ত কলেবরে পড়ে গেল৷ সঙ্গেসঙ্গে কর্নেল হুকুম দিলেন ‘চার্জ! তোপ দাগো৷’
মুহূর্তের মধ্যে কামান আর বন্দুক গর্জে উঠল বাঁশের কেল্লার সামনে৷ সেই গোলা আর গুলির আঘাতে কেল্লার মধ্যে তিতুর বহু সৈন্য প্রাণ দিলে৷ একটি গোলার আঘাতে তিতুমিরের ডান পা-টা উড়ে বেরিয়ে গেল-সঙ্গেসঙ্গে তিতুমির মৃত্যু বরণ করলেন৷
এক ঘণ্টার মধ্যে বাঁশের কেল্লা ধূলিসাৎ হয়ে গেল নারকেলবেড়িয়া গ্রামে৷ বাদশার স্বপ্নপুরী বাতাসে মিলিয়ে গেল চিরকালের মতো৷ সাড়ে তিন-শো লোক বন্দি হল-তার মধ্যে এক-শো চল্লিশ জনের কারাদণ্ড হল, বাকি খালাস পেয়ে গেল৷
এ ঘটনাটি ঘটে ১৮৩১ সালে৷
তিতুমিরের প্রধান সেনাপতি মাসুম খাঁকে সেই বিধ্বস্ত বাঁশের কেল্লার সামনে লটকে দেওয়া হয় তারপরেই৷
কিন্তু ফকিরকে এই ঘটনার পর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ তিনি যে কোথায় সরলেন-তা ইংরেজদের গুপ্তচররাও খুঁজে বার করতে পারেনি কোনোদিন৷