বাঁশির ডাক

বাঁশির ডাক

আমার ছেলেবেলার জীবনে আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা আছে৷ শুনলে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না৷-কিন্তু ব্যাপারটা সত্যি

তখন বিনুর সঙ্গে আমার ভাব হয়নি৷ পুঁটুই তখন আমার একমাত্র বন্ধু৷

আমরা যে পাড়ায় থাকতাম, সে পাড়ার সবচেয়ে বড়ো মানুষ ছিলেন চৌধুরি বাবুরা৷ মস্ত বড়ো বাড়ি, মস্ত গাড়িজুড়ি, মস্ত তাঁদের নামডাক৷ তাঁদের নহবতখানায় রোজ সকাল সন্ধ্যা নহবত বাজত-আমার বেশ মনে পড়ে সেই বাজনার শব্দে সকালে আমার ঘুম ভাঙত, আর ঘুম থেকে উঠে সকালের আলো সকালের বাতাস ভারি মিষ্টি মনে হত৷ এঁদের বাড়িতে এক প্রকাণ্ড পেটা ঘড়ি ছিল, কী গম্ভীর তার আওয়াজ-সে আওয়াজ কাঁপতে কাঁপতে কত দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেত! ঘণ্টায় ঘণ্টায় এই ঘড়ি বাজত-ঠিক সময়টিতে, কোনো দিন একটু ব্যতিক্রম হত না৷ এক একদিন গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে এই ঘড়ির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমার ছোটো মনটি বুক থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে দূরদূরান্তর চলে যেত-বুঝি আকাশের সেই শেষ কিনারায়৷

প্রত্যহ ইস্কুল যাবার সময় এই চৌতালা বাড়ির সামনে দিয়ে আমি যেতাম৷ মনে হত এ যেন কোনো গল্পে শোনা স্বপ্নে দেখা কাদের ইন্দ্রপুরী! প্রকাণ্ড লোহার ফটক-তার সামনে মস্ত পাগড়ি মাথায় এক লম্বা সেপাই৷ অনবরত এধার থেকে ওধার পায়চারি করছে-বিশ্রাম নেই, বিরাম নেই৷ তার হাতের চকচকে ধারালো সঙিনটা রৌদ্রের আলোয় থেকে থেকে ঝকঝক করে উঠত৷ মনে হত, সে ওই বাড়িতে ঢুকতে যাবে ওই সঙিনের খোঁচায় সেপাই তাকে গেঁথে ফেলবে৷ বাড়ির চারপাশ মোটা মোটা উঁচু লোহার গরাদ দিয়ে ঘেরা- যেন কেল্লা বন্দি! সেই গরাদের ফাঁক দিয়ে কোথাও উঠোনের একটুখানি ফালি, কোথাও পাথরে বাঁধানো একটু রোয়াক, কোথাও বাগানের একটু টুকরো দেখা যেত৷ এক জায়গায় দেখতাম সারি সারি রকম-বেরকমের আট-দশটা ঘোড়া বাঁধা-যেমন ঝকঝকে তাদের রং তেমন সুন্দর তাদের চেহারা, তেমনই তোজালো! একবার ছাড়া পেলেই যেন তিরবেগে ছুট দেয়! মনে হত অনেকখানি তেজ যেন আটকা পড়ে ছটফট করছে৷-তাদের সেই ছটফটানি তাদের পায়ের তলাকার পাথরের মেঝেতে খটখট শব্দে বেজে উঠে চারদিকে আগুনের ফিনকি ছড়াত৷ তারই পাশে ছিল মোটা মোটা লোহার শিকলে বাঁধা লিকলিকে সরু পা, ছুঁচলো মুখ এক সার কুকুর৷ ফোঁস ফোঁস শব্দে অনবরত মাটি শুঁকছে-একটু রক্তের গন্ধ পেলেই যেন লাফিয়ে পড়বে৷ এই ঘোড়াশালের ঘোড়া দেখতে দেখতে ভাবতাম হাতিশালটা কোথায়? কিন্তু গরাদের ফাঁক দিয়ে কোথাও খুঁজে পেতাম না; বোধ হয় ওই কোণের দিকে ছিল! লোহার ফটক পেরিয়ে খানিক দূর গেলেই ছোট্ট একটি বাগান-সুন্দর কেয়ারি করা! চারধারে ফুলের গাছ, তার মধ্যিখানে ময়ূরের প্যাখম ছড়ানো পিঠ দেওয়া এক সোনালি সিংহাসন৷ সকালে দেখতাম এই সিংহাসন খালি কিন্তু বিকেলে যখন পুঁটুদের বাড়ি আমি বেড়াতে যেতাম, তখন দেখতাম এই সিংহাসনে বসে একটি সুন্দর ছেলে- ঠিক যেন রাজপুত্তুর! বয়েস তার আমার চেয়ে কম৷ আমার চেয়ে রোগা কিন্তু আমার চেয়ে ফরসা অনেক৷ বড়ো বড়ো দুটি চোখ, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল- থোলো থোলো হয়ে চাঁদপানা মুখের উপর এসে পড়েছে!

এই ছেলেটিকে দেখতে আমার বেশ ভা লো লাগত৷ মনে হত ঠিক যেন গল্পের রাজপুত্তুর! পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে এ কোনো দিন কোনো অচিন দেশে চলে যাবে, সেখানে কত কাণ্ড করবে, তারপর সাতডিঙা ভরে ধন-দৌলত আর রাজকন্যাকে নিয়ে ঘরে ফিরবে৷ ছেলেটি সন্ধ্যার দিকে চেয়ে কী ভাবত৷ বোধ হয় সেই অচিন দেশের কথা!

রেলিঙের ধারে রোজ আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার সঙ্গে বোধ হয় তার ভাব করবার ইচ্ছে হত৷ এক একদিন সে তার সিংহাসন ছেড়ে আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসত! বোধ হয় সে আমাকে তার রাজ্যের পাত্তরের পুত্তুর, কি মিত্তরের পুত্তুর মনে করত-যাকে সঙ্গে নিয়ে সে কোনো দেশদেশান্তর চলে যাবে৷ আমি কিন্তু তাকে আসতে দেখেই ছুট দিতাম৷ তার সঙ্গে আলাপ করতে আমার কেমন ভয় হত-যদি সে আমায় নিয়ে আমার মা-বাপকে কাঁদিয়ে কোনো অজগর বনে চলে যায় মৃগয়া করতে! সে যদি আমাদের পুঁটুর মতো হত তাহলে তখনই আমি তার সঙ্গে আলাপ করে ফেলতাম৷ কিন্তু সে যে ছিল একেবারে অন্যরকম- রাজপুত্তুরের মতন! আমি ছুটে পালাবার সময় দেখতাম, সে লোহার রেলিং ধরে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে যেন অত্যন্ত কাতর ভাবে৷ তার সেই চাহনি দেখে আমার কেমন মায়া করত৷ আমি যদি তার কেউ আপনার-জন হতাম, তাহলে তার ওই চোখের দুঃখ হাত দিয়ে মুছিয়ে দিতাম৷ আহা, ওর কি কেউ বন্ধু নেই?

ছেলেটা নিশ্চয় ছিল মায়াবী৷ নইলে রোজ পুঁটুদের বাড়ি যাবার সময় তাকে দূর থেকে একবার না দেখে থাকতে পারতাম না কেন? রোজ ভেবেছি আর যাব না, কিন্তু যাবার সময় কেমন করে যে গিয়ে পড়তাম, নিজেই বুঝতে পারতাম না৷ কিন্তু রেলিঙের এপাশ থেকে তাকে দেখতেই আমার আনন্দ ছিল, ওপাশে যাবার লোভ আমার কোনো দিনই হয়নি, বরং বিতৃষ্ণাই ছিল৷

কিন্তু হঠাৎ একদিন সব ওলোটপালট হয়ে গেল৷ সেদিন চড়কের মেলা৷ চৌধুরিবাবুদের বাড়ির উত্তর কোণে চৌমাথায় মেলা বসেছে-নানারকম খেলনা বিক্রি হচ্ছে৷ এক জায়গায় একটা লোক ফানুস বিক্রি করছিল৷ আমি সেইখানে অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম৷ কত রঙের ফানুস-লাল, নীল, সবুজ, হলদে-একসঙ্গে তাড়া করা৷ পেটফুলো সেই ফানুসগুলো সরু সরু সুতোয় বাঁধা৷ সেই বাঁধনটুকু ছিঁড়ে নীল আকাশে উড়ে পালাবার জন্যে তারা ছটফট করছিল৷ কেবলই মাথা দোলাচ্ছি৷ আমি ভাবছিলাম এদের একটা যদি কোনো রকমে ছাড়া পায়, তাহলে দেখি কতদূর সে উড়ে যায়-কতদূর-কতদূর! আমার হাতে যদি তখন কেউ একটা ফানুস দিত, আমি ঘরে না নিয়ে গিয়ে সেটাকে আকাশে ছেড়ে দিতাম৷ সে কেমন দুলতে দুলতে বাতাসে ভাসতে ভাসতে কোথায় কোন স্বপ্নলোকে চলে যেত৷

হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে পিছন থেকে কে আমায় কোলে তুলে নিল৷ হাত দুটো তার খুব কড়া ঠেকল বটে, কিন্তু তুলে নেবার ধরনে জোর নেই; যেন আদর আছে৷ সে আমাকে একেবারে সেই চৌধুরিবাবুদের কেয়ারি করা বাগানের মধ্যে এনে হাজির করল৷ আমার মন থেকে তখনও সেই রঙিন ফানুসের নেশা কাটেনি৷ আমার কেমন বোধ হতে লাগল ওই ফানুসগুলোই যেন আমাকে এখানে উড়িয়ে এনেছে!

একটা ফুল গাছের ঝোপ থেকে গুঁড়ি মেরে সেই ছেলেটি বেরিয়ে এল৷বুঝি এতক্ষণ সে লুকিয়েছিল! তাড়াতাড়ি ছুটে এসে আমার হাত ধরে সে বলল-“তোমার নাম কী ভাই?” কী মিষ্টি গলার সুর৷ আমার সর্বাঙ্গের অসোয়াস্তি এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল৷ কিন্তু আমি কোনো কথাই কইতে পারলাম না৷ সে আস্তে আস্তে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার সেই সোনালি সিংহাসনে আমায় বসাল৷ তারপর সে আমার পায়ের কাছটিতে মাটিতে গা এলিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল৷ আমি তন্ময় হয়ে তার সেই সুন্দর মুখখানি, টানা টানা চোখদুটি একদৃষ্টে দেখছিলাম, হঠাৎ সে বলে উঠল-“অমন করে কী দেখছ? আমার সঙ্গে ভাব করবে না?”

ভারি ইচ্ছা হতে লাগল-ছুটে গিয়ে এই মিষ্টি আদরের জবাব দিই, কিন্তু গলা কেমন আটকে গেল, চোখমুখ লাল হয়ে উঠল, চোখের কোণে জল আসতে লাগল!

সে তার পাতলা টুকটুকে ঠোঁট দুখানি একটু কাঁপিয়ে বলল-“রাগ করেছ ভাই, ধরে এনেছি বলে? নইলে তুমি যে আসতে চাও না! কী করব? তোমার সঙ্গে যে বড্ড ভাব করতে ইচ্ছে হল-তাই তো ধরে আনলাম৷ রাগ করো তো আবার ছেড়ে দিই৷” বলে আস্তে আস্তে তার সেই সুন্দর মুখখানি আমার মুখের কাছে এগিয়ে আনল৷ ইচ্ছে হতে লাগল সেই মুখখানি দু-হাতে ধরে বলি-না, না, রাগ করিনি, রাগ করিনি! কিন্তু পারলাম না৷

সে হতাশ দৃষ্টিতে আমার নির্বাক মূর্তির দিকে খানিক চেয়ে রইল৷ দেখতে দেখতে তার মুখখানি শুকিয়ে এল, চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠল৷ একটি ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে সে বলল-“আমার সঙ্গে ভাব করবে না? আমার বন্ধু হবে না? আচ্ছা বেশ, তোমায় ছেড়ে দিলাম৷” বলে আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল৷ আমি আর থাকতে পারলাম না, ছুটে গিয়ে তার মুখখানি দু- হাতে ধরে আমার দিকে ফিরিয়ে নিলাম৷ সে হেসে বলল-“তবে তুমি আমার বন্ধু হলে?” আমি ঘাড় নাড়লাম-“হ্যাঁ৷”

সে মহা আনন্দে আমার হাত ধরে টানতে টানতে সমস্ত বাগানটা ঘুরিয়ে এক জায়গায় এনে দাঁড় করাল৷ সেখানে একটা গাছের ডালে বাঁধা লাল, নীল, হলদে রঙের একতাড়া ফানুস-ঠিক তেমনিধারা, যেমন মেলার হাটে বিক্রি হচ্ছে দেখেছিলাম৷ সে সেই ফানুসগুলো নিয়ে এক একটি করে বাঁধন খুলে উড়িয়ে দিতে লাগল-একটুও মায়া করল না৷ মনের আনন্দে কী যে করবে, সে যেন খুঁজে পাচ্ছিল না৷ ছাড়া পাওয়া ফানুসগুলো উড়ে উড়ে সন্ধ্যার ঝাপসা আকাশটাকে রঙে রঙে একেবারে রঙিন করে তুলল৷ সব ফানুসগুলো যখন ছাড়া শেষ হয়ে গেল, তখন সে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল- “আমার নাম সুরজিৎ! আমাকে সুরো বলে ডেকো-বুঝলে?”

আমাদের দু-জনকার খুব ভাব হয়ে গেল৷ এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই এই বাগানের মধ্যে আমাদের দুই বন্ধুর খেলার আসর, গল্পের আসর জমতে লাগল৷ সুরোর খেলনার অন্ত ছিল না৷ ঘুড়ি লাটাই, ফুটবল ব্যাটবল, লাট্টু, মারবেল-এসব তার অগুন্তি ছিল৷ মাঝে মাঝে সে নতুন নতুন রঙিন বাক্সোয় বন্ধ নানারকম ছবিওয়ালা বিলিতি খেলা নিয়ে আসত৷ সেই সব খেলা সে আমায় শেখাত৷ আমরা দু-জনে খেলতাম৷ এ ছাড়া সুরোর একটি সরু কাঠের বাঁশি ছিল৷ সে চমৎকার বাজাত এই কাঠের বাঁশিটি! আমার ভারি ভালো লাগত! আমি আশ্চর্য হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করতাম-“কোথা থেকে শিখলে ভাই বাজাতে?” সে বলত-“রানি মায়ের কাছে৷”

রানি মা ছিলেন সুরোরই মা৷ সুরো শুধু মা না বলে কেন তাকে রানি মা বলত জানি না৷ কিন্তু তার মুখে ওই রানি মা ভারি মিষ্টি শোনাত৷ মায়ের কত কথা সুরো আমার কাছে বলত৷ শুনতে আমার ভারি ভালো লাগত-ঠিক গল্পের মতন৷ এই গল্প শুনে শুনে মনে মনে রানি মায়ের একটা ছবি আমি তৈরি করে নিয়েছিলাম৷ সেই ছবিটিকে ভালোবাসতে আমার ভারি ইচ্ছা করত৷ তাঁকে চোখে দেখিনি কিন্তু সুরোর বাঁশির সুরে মনে হত যেন তাঁরই মিষ্টি গলা শুনছি৷

সুরোর সঙ্গে এত ভাব হয়ে গেলেও আমার মনে হত, সে যেন সামান্য ছেলে নয়-সে সত্যিকার রাজপুত্তুর৷ বিশেষ, সে যখন বাঁশি বাজাত আর রানি মায়ের গল্প বলত তখন কোনো দেশের কোনো রাজপুত্র সুরজিৎ আমার চোখের সামনে জ্যান্ত হয়ে উঠত! আর ওই চৌতলা প্রকাণ্ড বাড়িটাকে মনে হত যেন কোনো দূরদূরান্তরের রাজপুরী! আমি দূর আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবতাম সন্ধ্যা বেলা বাজানো রাজপুত্র সুরজিতের এই বাঁশির সুর বাতাসে ভাসতে ভাসতে কোনো রাজকুমারীর বুকে গিয়ে বাজছে কে জানে!

সুরো হঠাৎ বাঁশি থামিয়ে হেসে আমায় জিজ্ঞাসা করত-

“অমন একমনে আকাশের দিকে চেয়ে কী ভাবছ?”

আমি থতমত খেয়ে যেতাম৷ সুরো বাঁশি ফেলে আমার হাতখানা তুলে নিয়ে তার গালে মুখে বুলিয়ে দিত৷

হঠাৎ একদিন হাসি খেলা গান গল্প সব বন্ধ হয়ে গেল-সুরোর অসুখ হয়ে৷ আমি যেদিন সেই বাগানে গিয়ে সুরোকে প্রথম দেখতে পেলাম না, যখন দেখলাম সমস্ত বাগান শূন্য, তখন আমার মনে হল রাজপুত্র আমায় যেন একা ফেলে কোনো দুর্গম দেশে চলে গিয়েছে৷ বাগানের বাতাস আর গাছের পাতা হা-হা করে কাঁদছে! একদিন গেল, দু-দিন গেল, সপ্তাহ গেল, তবু সুরোর দেখা নেই৷ আমাদের খেলার আসর যেমন শূন্য, তেমনই শূন্য রয়ে গেল৷ ইচ্ছে হত-ভারি ইচ্ছে হত-ওই চৌতলা বাড়িটার মধ্যে গিয়ে সুরোকে একবার দেখে আসি-একটিবার মাত্র, কিন্তু কী করে যাব ঠিক করতে পারলাম না৷ সুরোর সঙ্গে দেখা হত না, কিন্তু মাঝে মাঝে রাত্রে ঘুমের মাঝে এসে সে যেন আমায় বাঁশি শুনিয়ে যেত৷ আমি বাঁশির শব্দে জেগে উঠতাম, কিন্তু জেগে সে বাঁশি আর শুনতে পেতাম না৷ আশায় আশায় কতক্ষণ জেগে থাকতাম, কিন্তু হায় সে বাঁশি আর বাজত না!

শুনলাম তার জ্বর বিকার হয়েছে৷ শুনেই বুকটা ধড়াস করে উঠল৷ কাকার ছোটো ছেলে খুদুর জ্বর বিকার হয়েছিল৷ তার সেই অসুখে ছটফটানি, ধমকানি, আবোলতাবোল গোঙানি-সব আমার দেখা ছিল৷ সুরোর সেই একই অসুখ হয়েছে শুনে আমার সমস্ত বুকটা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল৷ খুদু পনেরো দিনের দিন মারা যায়৷ সুরোর যদি তাই হয়? না, না! এ কথা মনে আনতেই কান্না আসে! কিন্তু মন থেকে ওই পনেরো দিনের আতঙ্কটা কিছুতেই দূর করতে পারতাম না৷ মনে মনে ঠাকুরকে বলতাম-হে ঠাকুর, ওই পনেরো দিনটা যেন না আসে!

চৌধুরিবাড়ির সকাল সন্ধ্যায় নহবত বন্ধ হয়ে গেল, ঘণ্টায় ঘণ্টায় সে ঘড়ি বাজত তাও আর শোনা যেত না, সেপাইদের ঘরে রাত্রে মাদলেও আর কাঠি পড়ত না৷ পাড়ার লোকেরাসুদ্ধ যেন পা টিপে টিপে চলত-পাছে শব্দ হয়, পাছে খোকাবাবু চমকে ওঠে-পাছে তার অসুখ বাড়ে!

আমি স্কুলে যাবার সময় সুরোদের বাড়ির দিকে চেয়ে ভাবতাম-সে কোনখানে কোন ঘরটিতে শুয়ে আছে তার রানি মায়ের কোলে মাথা দিয়ে৷ ভাবতে ভাবতে মনে হত যেন কেমনতর একটা ঝাপসা কালো ছায়া সেই বাড়ির গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে! দেখে আমার ভয় করত৷ তারপর বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার সময় আমি আমাদের সেই খেলার বাগানের সামনে চুপিচুপি এসে দাঁড়াতাম৷ দেখতাম ছেঁড়া ন্যাকড়া পরা ভিখারির দল চোখ মুছতে মুছতে ফিরে যাচ্ছে৷ দেখে আমার কান্না পেত৷ এই সব ভিখারিদের রোজ সন্ধ্যা বেলা সুরো ভিক্ষা দিত৷ সে বলত, তার রানি মা এই ভিক্ষা দেওয়ার খেলা শিখিয়েছেন৷ এই খেলাতে দেখতাম সুরোর সবচেয়ে যেন বেশি অনন্দ৷ এই ভিখারির দল এলে সে সব খেলা ফেলে, সব কিছু ভুলে এদের কাছে ছুটে যেত৷ তার সেই সুন্দর হাতখানি নেড়ে নেড়ে সে কাউকে চাল, কাউকে পয়সা, কাউকে ফল বিতরণ করত৷ আবার কখনো কখনো কোনো গরিব মেয়েকে বাগান থেকে একটি ফুল তুলে দিত৷ যে যা পেত, খুশি হয়ে হাসিমুখে চলে যেত৷ এখন আর সুরোর সেই ভিক্ষা দেওয়া খেলা নেই; এদের মুখে সে হাসিও নেই৷ তাদের সেই শুকনো মুখ দেখে আমারও বুকটা শুকিয়ে আসত৷

দেখতে দেখতে সেই সর্বনেশে পনেরো দিনটা এগিয়ে এল৷ সেদিন সকালে উঠেই শুনলাম-সুরোর আজ খুব বাড়াবাড়ি, আজকের দিনটা কাটে কি না! পনেরো দিনের দিন খুদু যখন মারা যায়, তখনও ঠিক এই কথাই শুনেছিলাম৷ সেই কথা মনে পড়ে বুকটা ছাঁৎ করে উঠল৷ কেবলই মনে হতে লাগল সুরোকে যদি আজ একটিবার দেখতে পাই, তাহলে তার গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিই৷

সারাদিন সুরোর জন্যে মনটা ছটফট করতে লাগল৷ তাদের বাড়ির আশেপাশে দিনের মধ্যে কতবার ঘুরে এলাম৷ কেবলই মনে হচ্ছিল কে যেন বলবে সুরো ভালো আছে, কোনো ভয় নেই৷ ওদের বাড়িতে কত লোক এল, কত লোক গেল, কিন্তু কেউ সে কথা বলল না৷ সবাই যেন মুখ ফিরিয়ে চলে গেল৷

খুদু যেদিন মারা যায় ঠিক এমনিধারাই হয়েছিল৷

রাত্রে যখন বুড়ি ঝি বিছানা পেতে দিতে এল, আমার তখন কেমন কান্না পাচ্ছিল৷ আমি বুড়িকে জিজ্ঞাসা করলাম-“বুড়ি, সুরো কি সত্যি বাঁচবে না?”

বুড়ি বলল-“সবাই তো তাই বলছে ভাই!”

আমি বললাম-“ওরা তো রাজা, ওরাও কি ইচ্ছে করলে নিজের ছেলেকে বাঁচাতে পারে না?”

বুড়ি বলল-“ভাই, যম কি আর রাজা প্রজা মানে?”

সুরো তা হলে বাঁচবে না? আমি বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম৷ বুড়ি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল৷ আমি তো কই কাঁদিনি, তবু বুড়ি বলল-“কেঁদো না ভাই, ঘুমোও৷” মনে হল বুড়ি যেন তার ডান হাত দিয়ে তার চোখ দুটো একবার মুছে নিল! রোজ রাত্রে শোবার সময় এই বুড়ির সঙ্গে আমি সুরোর কত গল্পই করতাম৷ আজ আর কোনো গল্প করতে ইচ্ছে হল না৷

বুড়ি আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল-“ঘুমুলি ভাই?”

আমি বললাম-“না৷ আমার আজ আর ঘুম আসছে না; তুই যা৷”

বুড়ি বলল-“দেখ, চৌধুরিবাবুদের খোকাকে বাঁচাবার এক উপায় আছে-কিন্তু সে কি ওরা পারবে?”

আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম-“কী উপায়, বুড়ি?”

সে বলল-“তাহলে আমাদের দেশের একটা গল্প বলি শোন৷”

আমি চুপ করে রইলাম৷ বুড়ি গল্প বলতে লাগল৷

“সে অনেক দিনের কথা৷ আমি তখন খুব ছোটো-তোর চেয়েও বোধ হয় বয়স কম৷ আমি তখন দেশে আমার বাপের বাড়িতে থাকতাম৷ আমাদের দেশের রাজার সবেধন একমাত্র ছেলে! অনেক মানত, অনেক পুজো-স্ব্যস্তয়ন করে এই ছেলে হয়৷ এই ছেলের ভাতে রাজবাড়িতে মহা ধুম লেগে গেল৷ তেমন ধুম আমাদের দেশে কেউ কখনো দেখেনি! যাত্রা পাঁচালি তরজা, কত রকমের আমোদ যে হয়েছিল, তার ঠিক নেই৷ সাতদিন, সাতরাত্রি গাঁয়ের কেউ ঘুমোয়নি৷ দিনরাত হইহই রইরই ব্যাপার! চারদিক থেকে এত লোক এসেছিল যে গাঁয়ে আর লোক ধরে না-বোধ হত যেন মস্ত মেলা বসে গেছে৷ তার উপর রাজা দেশ-বিদেশ থেকে যত বড়ো বড়ো সাধু সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণ ফকির নিমন্ত্রণ করে আনিয়েছিলেন, তাঁর ছেলেকে আশীর্বাদ করে যাবার জন্যে৷ তাঁদের দেখবার জন্যেই বা ভিড় কত! এই সাধু সন্ন্যাসীরা কেউ বটতলায়, কেউ পঞ্চানন তলায়, কেউ চণ্ডীতলায় আসন পেতে বসলেন৷ সালুমোড়া রাজবাড়ির পালকি, সামনে সেপাই-বরকন্দাজ এবং ভিতরে রাজপুত্তুরকে নিয়ে বটতলা থেকে পঞ্চানন তলা, পঞ্চানন তলা থেকে চণ্ডীতলায় সকাল সন্ধ্যা সাধু সন্ন্যাসীদের আশীর্বাদ কুড়িয়ে ফিরতে লাগল৷ সন্ন্যাসীরা কেউ পায়ের ধুলো দিয়ে, কেউ যজ্ঞের ভস্ম দিয়ে, কেউবা একটি রাঙা রুদ্রাক্ষ দিয়ে ছেলেকে আশীর্বাদ করলেন৷ কত দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ, কত বাউল-ফকির যে কত রক্ষাকবচ এবং হরেক রকমের মাদুলি দিলেন তার ঠিক নেই! মাদুলির ভারে সেই আট মাসের ছেলের গলা ও ঘাড় ঝুঁকে পড়ল, হাত আড়ষ্ট হয়ে গেল! বেচারা হাত তুলে, ঘাড় নেড়ে যে একটু খেলা করবে তার উপায় রইল না৷ সবাই বলল, হ্যাঁ, এ ছেলে নিরোগ তো হবেই, চাই কী অমরও হতে পারে!

“কিন্তু অদৃষ্ট যাবে কোথায়? আট দিন যেতে না যেতেই ছেলে অসুখে পড়ল৷ সাধু সন্ন্যাসীরা অনেক চরণামৃত দিলেন, কিন্তু কোনো ফল হল না-অসুখ বেড়েই চলল৷ এত আমোদআহ্লাদ দু-দিনের মধ্যেই কর্পূরের মতো উবে গেল৷ অমন জমজমাট গাঁ হানাবাড়ির মতো হাঁ-হাঁ করতে লাগল৷ রাজাবাবু কেবল সন্ন্যাসীদের ছাড়লেন না৷ তিনি হুকুম দিলেন ছেলেকে না সারিয়ে কোনো সাধু সন্ন্যাসী গাঁ ছেড়ে যেতে পাবেন না৷ গেলে টের পাবেন! সন্ন্যাসীরা কেউ বটতলায়, কেউ পঞ্চানন তলায় নানারকম ক্রিয়াকাণ্ড শুরু করে দিলেন৷ রোজ রোজ নতুন নতুন মাদুলি কবচ তৈরি হতে লাগল৷ শেষে রাজাবাবু বলে পাঠালেন যে ছেলের গায়ে মাদুলি বাঁধবার আর জায়গা নেই৷ উপায় কী?

“এত করেও কিছুতে কিছু হল না৷ ছেলে এখন যায়, তখন যায় হয়ে উঠল৷ রাজবাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল৷ বাড়ির চাকর দাসি সবাই চুপিচুপি বলাবলি করতে লাগল, ছেলে বাঁচবে না! তখন ছেলের এক মামা কোনো শহর থেকে এক বড়ো ডাক্তার এনে হাজির করল৷ ডাক্তার এসেই আগে, তাড়াতাড়ি ছেলের বুক থেকে নিজের হাতে মাদুলি কবচ সব খুলে ফেলে দিল৷ কারও কথা শুনল না৷ বলল-মাদুলির ভারে যে ছেলে নিশ্বাস নিতে পারছে না, দম আটকে আসছে! ডাক্তার আসতেই গাঁয়ে আবার হইচই পড়ে গেল৷ লোকজন এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করতে লাগল-এটা আন, ওটা আন, সেটা আন! গাঁ থেকে শহর পর্যন্ত ঘোড়ার ডাক বসে গেল৷ সেপাই-বরকন্দাজ কেউ ডাক্তারের লেখা কাগজ হাতে ওষুধ আনতে ছুটল, কেউ বরফ আনতে ছুটল, কেউ আরও কত কী আনতে ছুটল৷ এই গোলমালের মধ্যে সাধু সন্ন্যাসীদের দিকে আর কারও নজর রইল না; তাঁরা সেই ফাঁকে যার যেখানে সরে পড়লেন৷ বটতলা পঞ্চাননতলা ফাঁকা হয়ে গেল৷ কেবল চণ্ডীতলা থেকে জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী নড়লেন না; তিনি অটল হয়ে বসে রইলেন৷

“আমার মা ছিলেন এই রাজপুত্রের দাসী৷ এই ছেলের ভাতে তিনি পরনে পেয়েছিলেন গরদের শাড়ি, হাতে পেয়েছিলেন সোনার অনন্ত৷ আর আমি পেয়েছিলাম একখানি লাল চেলি, আর আমার ছোটো ভাইটি পেয়েছিল একটি রুপোর ঝুমঝুমি৷

“আমার ছোটো ভাই তখন বোধ হয় বছরখানেক হবে৷ মা রাজবাড়ি থেকে একবার সকালে, একবার দুপুরে, একবার সন্ধ্যা বেলা এসে তাকে দুধ খাইয়ে যেত! সারাদিন সে আমার কাছে থাকত৷ সে কাঁদলে আমি তাকে কোলে বসিয়ে দোল দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম! রাত্রে সে আমার বুকটিতে হাত রেখে আমার পাশে চুপ করে ঘুমিয়ে থাকত৷ আমার ভাইটি ছিল ভারি লক্ষ্মী, আমাকে একটুও জ্বালাতন করত না! তার সেই কচি কচি নরম হাত দিয়ে আমায় সে জড়িয়ে ধরত আমার এখনও তা মনে লেগে আছে৷

“ডাক্তার আসতে দিন দুয়েক রাজপুত্রের অসুখ একটু কম পড়ল৷ মা আমার ভাইটিকে দুধ খাওয়াতে এলে তাঁর মুখেই শুনতাম৷ কিন্তু দু-দিন না যেতেই অসুখ আবার বেড়ে উঠল৷ একদিন সন্ধ্যা বেলা মা এসে আমাকে চুপিচুপি বললেন-‘আজ রাতটা বোধ হয় কাটবে না!’ বলে মা আমার তাড়াতাড়ি চলে গেলেন৷ আমার ভাইটিকে একটু আদরও করলেন না, একটু দুধও খাওয়ালেন না৷ দেখে, মায়ের ওপর আমার ভারি রাগ হল৷ আমি ঝিনুকে করে একটু গাই-দুধ আমার ভাইটিকে খাইয়ে দিতে গেলাম, কিন্তু সে খেতে চাইল না; আমার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল৷ আমি তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম৷ সে আজ আর আমার বুকে হাতটি রেখে ঘুমোল না৷ আমার মনে কেমন অস্বোয়াস্তি হতে লাগল৷ আমার ভালো ঘুম হল না৷ আমি রাত্রে উঠে উঠে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখতে লাগলাম৷ সে অঘোরে ঘুমতে লাগল৷

“পরদিন মা রাজবাড়ি থেকে একবারও এলেন না-ছেলেকে দুধ খাওয়াতে৷ আমার ভাইটিও এমন লক্ষ্মী যে সারাদিন কাঁদল না, চুপটি করে পড়ে রইল৷ আমি তাকে দুধ খাওয়াতে গেলাম, সে দুধ গিলতে পারল না! আহা বেচারার দোষ কী? আমি ছেলেমানুষ কি দুধ খাওয়াতে জানি? বেচারা সারাদিন না খেয়ে পড়ে রইল, কিন্তু এমনই লক্ষ্মী যে তবু একটু কাঁদল না৷ আহা, ভাইটি আমার! মায়ের উপর ভারি রাগ হতে লাগল৷ এমন লক্ষ্মী ছেলেকে হেনস্থা করে!

“সারা রাত্রির মধ্যেও মা এল না৷ আমি একলাটি ভাইকে নিয়ে পড়ে রইলাম৷ পরের দিন সকালে এসে মা বললেন-“বোধ হয় মা-চণ্ডী মুখ তুলে চাইলেন৷ রাজকুমার আজ সাত দিন পরে চোখ মেলে চেয়েছে৷ কাল দিন রাত কোথা দিয়ে কেমন করে কেটেছে, ভগবানই জানেন৷’ বলে মা আমার ঘরের দিকে ছুটে গেলেন৷

“আমার ভাইটি তখনও ঘুমোচ্ছিল৷ আমার মা গিয়ে তাকে আদর করে ডাকলেন-‘খোকন! খোকন! খোকন আমার৷’ খোকন কোনো সাড়া দিল না৷ আর সেই রুপোর ঝুমঝুমিটা ধরে মা তার কানের কাছে কত বাজালেন, কিন্তু ভাই আমার আর জাগল না,” বলে বুড়ি চুপ করল৷

আমি ধড়মড় করে উঠে বললাম-“কী হল বুড়ি? তোমার ভাইয়ের কী হল?”

সে বলল-“কী হল ভাই, তা তো বুঝতে পারলাম না৷ সে আর ঘুম থেকে জাগল না৷ অনেকে অনেক কথা বলল৷ কেউ কেউ বলল, ওই যে চণ্ডীতলায় সন্ন্যাসী অচল অটল হয়ে বসেছিল, সেই নিশির ডাক দিয়ে আমার ভাইয়ের প্রাণটিকে ভুলিয়ে নিয়ে গেছে৷”

আমার পাশ থেকে আমার ছোটো ভাই নুটু বলে উঠল-“নিশির ডাক কী বুড়ি?” সে বোধ হয় এতক্ষণ ঘুমোয়নি, শুয়ে শুয়ে বুড়ির গল্প শুনছিল৷

বুড়ি বলল-“নিশির ডাক? সে ভাই বড়ো সর্বনেশে কাণ্ড৷ তার কথা ভাবতেও বুকে কাঁটা দিয়ে ওঠে৷”

নুটু বলল-“নিশির ডাকে কী হয় বুড়ি?”

বুড়ি বলল-“জ্যান্ত মানুষের প্রাণপুরুষ মরা মানুষের দেহে চলে যায় আর অমনি দেখতে দেখতে মরা মানুষ বেঁচে ওঠে, আর জ্যান্ত মানুষ ধড়ফড়িয়ে মারা যায়৷”

নুটু বলল-“তাই বুঝি তোমার ছোটো ভাই মারা গেল, আর তোমাদের রাজকুমার বেঁচে উঠল?”

বুড়ি বলল-“আমাদের গাঁয়ের লোকেরা তো তাই বলে ভাই! তাদের কেউ কেউ নাকি দেখেছিল জটাধারী ত্রিশূল হাতে এক খ্যাপা ভৈরব সেই রাত্রের অন্ধকারে একটা ডাব হাতে করে আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷”

নুটু বলল-“ডাব হাতে করে কেন?”

বুড়ি বলল-“ওই ডাবের মধ্যে করেই তো প্রাণপুরুষ নিয়ে যায়৷ ওই ডাবই হচ্ছে মন্ত্রপড়া ডাব৷ কালভৈরবের পুজো দিয়ে, সাত দিন, সাত রাত্রি, অনাহারে, অনিদ্রায় অনবরত এক মনে মারণ মন্ত্র জপ করে সিদ্ধ ভৈরবরা ওই ডাবকে গুণ করে৷ ওই ডাব তখন আর ডাব থাকে না-ওর মধ্যে তখন কালপুরুষের আবির্ভাব হয়৷ সেই কালপুরুষ এসে তাঁর হাতের মৃত্যুদণ্ডটি মানুষের বুকে ছুঁইয়ে বুকের ভেতর থেকে প্রাণটিকে খসিয়ে নিয়ে চলে যান৷”

নুটু বলল-“যার প্রাণটাকে নিয়ে যায়, সে কিচ্ছু করতে পারে না?”

বুড়ি বলল-“তার সাধ্য কী কিছু করে! তার প্রাণ সুড়সুড় করে কালভৈরবের সঙ্গে চলে যায়৷”

নুটু বলল-“ওর কোনো উলটো মন্ত্র নেই? যে মন্ত্র জপ করলে কালভৈরব আর কাছে ঘেঁসতে পারে না?”

বুড়ি বলল-“না, কোনো উলটো মন্ত্র নেই বটে; কিন্তু নিশির ডাকে যদি সাড়া না দাও, তাহলে কালভৈরবের ঠাকুরদাদাও তোমার কিছু করতে পারবে না৷”

নুটু বলল-“নিশির ডাকে সাড়া দেওয়া কাকে বলে?”

বুড়ি বলল-“তা বুঝি জান না? ওই মন্ত্রপড়া ডাব নিয়ে ভৈরবরা নিশুত রাতে, যখন চারদিক অন্ধকার ঘুটঘুট করছে, সবাই যখন ঘুমিয়েছে, কেউ কোথাও জেগে নেই, সেই সময় কালো ত্রিশূল হাতে, কালো কাপড় পরে, বাড়ির দরজায় দরজায়, বাড়ির জানলার কাছে কাছে-যেখানে ছোটো ছোটো ছেলেরা ঘুমোয়, সেইখানে ঘুরে বেড়ায়, আর আস্তে আস্তে মিষ্টি গলায় ছেলেদের নাম ধরে ডাকে৷ যে ছেলে সাড়া দেয়, কালপুরুষ এসে তার প্রাণটিকে বুক থেকে খসিয়ে নেয়-“

নুটু বলল-“যে সাড়া দেয় না?”

বুড়ি বলল-“তার কিছুই হয় না৷ সে যেমন ছিল, তেমনই থাকে৷”

“আর যে সাড়া দেয়?”

“তার প্রাণপুরুষটি তার ওই সাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে বেরিয়ে আসে৷ তার পর চুম্বক যেমন লোহাকে টানে তেমনই ওই মন্ত্রপড়া ডাব প্রাণপুরুষকে নিজের দিকে টানতে থাকে৷ প্রাণপুরুষ ডাবের কাছাকাছি এলেই ভৈরব ঠাকুর ওই ডাবের মুখটি একবার খুলে ধরেই চট করে বন্ধ করে দেন, আর প্রাণপুরুষ ওই ডাবের মধ্যে আটকা পড়ে যায়৷”

“তারপর?”

“তারপর ওই ডাবের মুখটি ফাঁক করে প্রাণসুদ্ধ ডাবের জল মরা মানুষকে খাইয়ে দেয়-মরা মানুষ সেই নতুন প্রাণ পেয়ে বেঁচে ওঠে৷”

নুটু বলল-“প্রাণপুরুষ সেখান থেকে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে এসে নিজের দেহে ঢুকে পড়ে না কেন?”

“তা কি আর পারে ভাই? সে তখন বত্রিশ নাড়ির বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছে-তার কি আর পালাবার জো আছে! তখন পালাতেও পারে না- থাকতেও তার ভালো লাগে না৷”

“থাকতে ভালো লাগে না কেন?”

“নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়িতে থাকতে কি মানুষের ভালো লাগে? সে তবু বাড়ি; এ যে নিজের দেহ ছেড়ে পরের দেহে বাস করতে হয়! এ কি কম কষ্ট? নিজের মা-বাপ থাকতে পরের মাকে মা বলতে হয়, পরের বাপকে বাপ বলতে হয়৷ নিজের ভাই-বোন কেউই তখন আর আপনার থাকে না৷”

“সব পর হয়ে যায়?”

“সব পর হয়ে যায়!”

“তোমার সেই ছোটো ভাইটি পর হয়ে গেলে, সে তোমায় চিনতে পারত?”

“পারত বই কী! সেই রাজকুমারের বড়ো বড়ো চোখের ভেতর থেকে আমায় উঁকি মেরে দেখে, সে আমায় খুব চিনতে পারত-এ আমি বেশ টের পেতাম৷ আমার মনে হত সে যেন মাঝে মাঝে ইচ্ছ করে বলত-দিদি, তোমার দু-টি পায়ে পড়ি, আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাও৷”

নুটু বলে উঠল-“তুমি তাকে কোলে নিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে না কেন?”

“কী করে যাব ভাই? সে কি তখন আমার ছোটো ভাইটি আছে-সে যে তখন রাজপুত্তুর-পরের ছেলে!”

“তোমার ভাই তাতে কাঁদত?”

“কাঁদত বই কী! আমার দিকে চেয়ে চেয়ে তার চোখ দিয়ে টসটস করে জল গড়িয়ে পড়ত!”

“তুমি তাকে খুব আদর করতে না কেন?”

“আদর করতাম তো৷ কিন্তু সে আদর তো আমার ভাই পেত না-সে পেত আমাদের গাঁয়ের রাজাবাবুর ছেলে৷ যে গায়ে আমি হাত বুলোতাম সে গা তো আমার ভাইয়ের গা নয়, সে রাজকুমারের গা৷ তাতে আমার ভাইয়ের প্রাণ খুশি হবে কেন? সে তাতে আরও কাঁদত৷ রাজার বাড়ির এত আদর যত্নেও আমার ভাইয়ের প্রাণে কোনো সুখ ছিল না-এ আমি তার সেই মুখখানি দেখেই বুঝতে পারতাম৷ আহা, তার চেয়ে আর ভাইটি আমাদের গরিবের ঘরে নুন-ভাত খেয়ে অনেক সুখে থাকত৷”

নুটু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠল-“এ তোমার গল্প, না? এসব কথা সত্যি না; না বুড়ি?”

বুড়ি বলল-“না ভাই, এ সব সত্যি৷ একটুও মিথ্যে নয়৷” নুটু বলল- “এ গল্প ভালো নয়, একটা ভালো গল্প বলো বুড়ি৷”

বুড়ি বলল-“না, আজ আর গল্প নয়, তোরা ঘুমো, রাত হল৷” বলে বুড়ি বাসন মাজতে চলে গেল৷ আমি বুড়ির গল্পের কথা ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম৷

নুটু দেখি আমার কাছে অনেকখানি সরে এসে আমার গায়ে হাত দিচ্ছে৷ আমি বললাম-“কী রে নুটু?”

নুটু বলল-“দাদা, বড়ো ভয় করছে!”

আমি বললাম-“কীসের ভয়?”

“যদি নিশিতে ডাকে?”

আমি বললাম-“সাড়া দেব না৷”

“যদি দিয়ে ফেলি?”

“তা হলে ভারি মুশকিল হবে কিন্তু!”

নুটু ভয় পেয়ে বলে উঠল-“তবে কী করব দাদা? কী হবে!” বলে সে কেঁদে ফেলে৷

আমি তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম-“তোর কোনো ভয় নেই, আমি তোকে পাহারা দেব৷”

নুটু চোখ মুছতে মুছতে বলল-“কিন্তু দাদা, তুমি যেন অন্যমনস্কে সাড়া দিয়ে ফেলো না৷”

আমি বললাম-“না রে না, কোনো ভয় নেই! এখানে-এই শহরে নিশির ডাক কোথা থেকে আসবে?”

নুটু বলল-“যদি আসে! তুমি দাদা, জানলাগুলো বন্ধ করে দাও৷”

আমি উঠে জানলাগুলো বন্ধ করে দিলাম৷ নুটু আমার বুকের কাছটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল৷ আমার ঘুম আসছিল না, আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম-সুরোর কথা৷

রাত কত জানি না, বুড়ি হঠাৎ আবার ঘরের মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল-“কী রে তোরা ঘুমুলি?”

আমি বললাম-“কেন বুড়ি?”

সে খুব চাপা গলায় বলল-“ভাই, তোরা আজ খুব সাবধানে থাকিস!”

আমি বললাম-“কেন, কী হয়েছে?”

সে বলল-“বড়ো সর্বনেশে কথা শুনে এলাম৷ চৌধুরিবাবুদের খোকাকে ডাক্তার-বদ্যি এলে দিয়েছে-বিষ বড়ি খাইয়েও কিছু হল না৷”

আমি বলে উঠলাম-“বুড়ি, কী হবে? আমি সুরোকে দেখতে পাব না?কত দিন তাকে দেখিনি!”

বুড়ি আঁতকে উঠে বলে উঠল-“না, না! এখন আর তাকে দেখতে ইচ্ছে করিসনি-সর্বনাশ হবে!”

আমি বললাম-“কেন বুড়ি?

বুড়ি বলল-“সে তুই ছেলেমানুষ বুঝতে পারবি না! তুই ভাই, আজ চুপ করে থাক৷ সুরোর কথা আজ আর মনে তোলাপাড়া করিসনি৷”

আমি বললাম-“তুই অমন করছিস কেন বুড়ি, কী হয়েছে?”

বুড়ি বলল-“ভাই, কী হয়েছে বুঝতে পারছি না৷ আমার ছোটো ভাইটি যে-রাতে মারা যায় সে রাতেও আমার বুক এমনি ধড়ফড় করেছিল৷ তখন কিছু বুঝতাম না, তাই ওই সর্বনাশটা হয়ে গেল! আজ তোরা কারও ডাকে সাড়া দিসনি-বুঝলি-কারও ডাকে নয়৷”

আমার বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল! আমি ভয়ে ভয়ে বললাম-“তবে কি আজ নিশির ডাক হবে?”

বুড়ি বলল-“সেই রকমই তো মনে হচ্ছে৷ দেখ না আজকের রাতটা কীরকম ভয়ানক অন্ধকার হয়ে উঠেছে-কেবলই গা ছমছম করছে৷ গাছপালাগুলো অবধি ভয়ে কাঠ হয়ে আছে! বাড়িগুলো যেন থরথর করে কাঁপছে! আকাশের বুকের ভেরতটা যেন দুরদুর করছে৷ আর বাতাসের গায়ে যেন প্রকাণ্ড একটা কালপ্যাঁচা কেবলই ডানা দিয়ে ঝাপটা মারছে-ঝপ-ঝপ-ঝপ!”

আমি বললাম-“কিন্তু ভৈরব ঠাকুর কী এসেছে?”

বুড়ি বলল-“এসেছে বই কী! শুনলাম, চৌধুরিবাবুরা কোথা থেকে এক ভীম-ভৈরবকে আনিয়েছে৷ আমি ছাদে উঠে দেখলাম, ওদের ওই ঠাকুরবাড়ির দিক থেকে কালো কুণ্ডলী ধোঁয়া উঠছে-বোধ হয় কালভৈরবের পুজো হচ্ছে৷”

আমি বললাম-“কিন্তু বুড়ি, নুটু যে ঘুমিয়ে রইল৷ ও তো কিছু জানল না৷”

বুড়ি বলল-“ওকে জাগিয়ে দে ভাই, জাগিয়ে দে৷”

আমি নুটুকে ধরে ঠেলে দিতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসে ঢুলতে লাগল৷ আমি তাকে ঠেলা দিতে দিতে বললাম-“নুটু আজ নিশির ডাক হবে-চুপ করে বসে থাক৷”

নুটু ঘুমের ঘোরে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ফ্যালফ্যাল চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল-কোনো কথা বলল না৷ আমি বললাম-“বুড়ি, তুই আজ আর এখান থেকে নড়িসনি৷” বুড়ি বলল-“তা আর বলতে৷ আমি এই সারারাত জেগে রইলাম৷” বলে সে আঁচল পেতে মাটিতে শুয়ে পড়ল৷ তারপর বলল-“দেখ, আজ আর দু-চোখের পাতা এক করিসনি, তাহলেই ওরা নিদুলি-মন্ত্র দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে৷” আমি নুটুকে ধরে বসে রইলাম৷ পাছে ওরা নিদুলি-মন্ত্র দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয় এই ভয়ে কিছুতেই চোখ বুজলাম না! নুটু কিন্তু আমার গায়ের উপরই ঘুমিয়ে পড়ল৷ একটু পরে দেখি বুড়িও নাক ডাকছে৷ আমি ডাকলাম-“বুড়ি! বুড়ি! সে সাড়া দিল না৷ নুটুকে ডাকলাম- “নুটু! নুটু!” সেও সাড়া দিল না৷ নিশ্চয় ওরা নিদুলি মন্ত্রে এদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে!-এই কথা ভাবছি, এমন সময় কে যেন একটা ঝাপটা দিয়ে ঘরে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে গেল৷ সব অন্ধকার! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম-“বুড়ি! বুড়ি! নুটু! নুটু!” জবাব পেলাম না! সব একেবারে চুপ৷ আমি সেই থমথমে অন্ধকারে অসাড় হয়ে বসে রইলাম৷ জানলার ফাঁক দিয়ে বাইরে অন্ধকারগুলো ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে আমার আশেপাশে, চারদিকে কালো কালো বিকট চিহারার নানারকম মূর্তি তৈরি করে দেখাতে লাগল৷ আমি কাঠ হয়ে একদৃষ্টে সেই সব দেখতে লাগলাম৷ চোখ বুজতে পারলাম না, পাছে ঘুমিয়ে পড়ি৷ কিন্তু নিদুলি মন্ত্রে আমার চোখের পাতা ক্রমেই ভারী হয়ে আসতে লাগল৷ শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল৷ মাথার ভেতরটায় কে যেন আস্তে আস্তে সুড়সুড়ি দিতে লাগল৷ হাত, পা, কোমরের খিলগুলো হঠাৎ যেন ফুস করে খুলে গিয়ে আমার সর্বশরীর এলিয়ে গেল৷ তারপর কী হল জানি না৷

“নিপু! নিপু!”

আমি ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে বললাম-“কী ভাই, কী ভাই সুরো?”

“নিপু! নিপু!”

“এই যে ভাই সুরো!-এই যে ভাই আমি!”

“নিপু! নিপু!”

“যাচ্ছি ভাই, যাচ্ছি!”

বলতে না বলতেই কে যেন আমাকে কোথা দিয়ে কেমন করে একেবারে চৌধুরিবাবুদের বাড়িতে সুরোর ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলল৷ আমার যেন হঠাৎ টনক নড়ল-তাই তো এ কী করেছি! ঘুমের ঘোরে নিশির ডাকে সাড়া দিয়েছি৷ সর্বনাশ! আমি থরথর করে কাঁপতে লাগলাম৷ কে এসে আমার হাত ধরল৷ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম-“না গো না, আমি এখানে থাকব না, কিছুতেই থাকব না৷ আমায় বাড়ি রেখে এসো!” কিন্তু সে আমার কথা কানে তুলল না৷ আমি আরও কাঁদতে লাগলাম৷ কে একজন নরম গলায় বলল-“ভয় কী তোমার, কিচ্ছু ভয় নেই৷” বলে সে আমার গায়ে হাত বুলোতে লাগল৷

আমি কেঁদে বললাম-“ওগো, তোমার দু-টি পায়ে পড়ি, আমায় তোমরা বাড়িতে রেখে এসো৷ নইলে আমার মা বড়ো কাঁদবে৷” সে কী বলতে যাচ্ছিল, একজন খুব মোটা গলায় বলে উঠল-“বোধ হয় ছেলেটা টের পেয়েছে৷ তাই গোল বাধিয়েছে৷ নইলে এমন তো হবার কথা নয়! দাঁড়াও ওকে ঠান্ডা করছি৷”-বলেই সে লোকটা এসে তার লোহার মতন শক্ত হাত দিয়ে আমার চোখ দুটো সজোরে চেপে ধরল৷ অমনি আমার সমস্ত শরীর যেন হিম হয়ে এল; সর্বাঙ্গ শিরশির করতে লাগল৷ বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে করতে হঠাৎ ধপ করে একেবারে থেমে গেল৷ তারপর কী হল জানি না৷

“নিপু এসেছিস ভাই? নিপু!”

হঠাৎ দেখি সুরো ও আমি একটা যেন হাত-পাওয়ালা খুব ছোট্ট খুপরির মধ্যে অত্যন্ত ঘেঁসাঘেঁসি ঠেসাঠেসি করে রয়েছি৷ এই জায়গাটুকুর মধ্যে যেন কেবল সুরোকেই ধরে, আমি যেন বেশি৷ তাই আমার কেমন কষ্ট হচ্ছিল-খুব একটা আঁট জামা গায়ে জোর করে পরিয়ে দিলে যেমন অসোয়াস্তি হয়ে, আমার তেমনই বোধ হচ্ছিল! মনে হচ্ছিল যে জামাটা যদি ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে যায়, যেন একটু আরাম পাই৷ একটু পরেই বুঝতে পারলাম, ওই হাত-পাওয়ালা ছোট্ট খুপরিটা সুরোর দেহ; আমি তারই মধ্যে এসে প্রবেশ করেছি৷

আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম-“এরা জোর করে-ভুলিয়ে আমায় ধরে এনেছে, তুমি আমায় এখনই বাড়ি পাঠিয়ে দাও৷” সুরো বলল-“রাগ করছিস কেন ভাই? এরা এনেছে বলেই তো তোর সঙ্গে দেখা হল-নইলে তো আর দেখা হত না৷

“আমি যে চলে যাচ্ছি৷”

“অ্যাঁ, চলে যাচ্ছিস? কোথা যাচ্ছিস, ভাই?”

“রাজকুমারীর কাছে৷”

“কোন রাজকুমারী?”

“সেই যে রাজকুমারী, যে আমার জন্যে বসে বসে মালা গাঁথে৷”

আমি বললাম-“সে তো গল্পের রাজকুমারী৷”

সুরো বলল-“আমিও যে গল্পের রাজপুত্র৷ সেই গল্পের রাজকুমারীর সঙ্গে এই গল্পের রাজপুত্রের মিলন হবে৷ তবে তো গল্প শেষ হবে৷”

আমি বললাম-“তুই গেলে কিন্তু রানি মা বড়ো কাঁদবেন৷”

সে বলল-“তোরা তাঁকে ভুলিয়ে রাখিস৷ বলিস-সুরো মৃগয়া করতে গেছে-এই এল বলে, তুমি কেঁদো না৷”

আমি বললাম-“সুরো, তুই এমন নিষ্ঠুর হলি কী করে? আমাদের ছেড়ে যেতে তোর কষ্ট হচ্ছে না?”

সুরো বলল-“দেখ দিকিন আমার বুকে হাত দিয়ে৷”

সুরোর বুকে হাত দিয়ে দেখলাম তার প্রাণটা যেন তার বুকখানিকে সজোরে আঁকড়ে ধরে আছে৷ আমি বললাম-“ভাই সুরো, তবু কেন যাচ্ছিস!” সুরো বলল-“তুই যে রাজকুমারীর বাঁশি শুনিসনি, তাই বুঝতে পারছিস না! সে ডাক শুনলে কি আর থাকা যায়! নইলে দেখিস না, এই মানুষ ঘরে আছে, হঠাৎ কাঁদিয়ে কেঁদে সে কোথায় বিবাগি হয়ে যায়৷”

আমি বললাম-“সুরো, তোর জন্যে আমার বড়ো মন কেমন করবে, আমার কান্না পাবে৷”

সুরো বলল-“আমার খেলনাগুলো তোকে দিয়ে গেলাম৷ তুই সেগুলো নিয়ে খেলিস, মনে হবে যেন আমার সঙ্গেই খেলছিস৷ এই দেখ না, আমি অসুখে শুয়ে শুয়ে তোর দেওয়া সেই ছবির বইখানা দেখতাম আর আমার মনে হত, তুই যেন গল্প বলছিস৷” আমি বললাম-“কিন্ত তোকে দেখতে না পেলে রানি মা বড়ো কাঁদবেন!”

সুরো বলল-“তুই তাঁকে ভুলিয়ে রাখিস ভাই!”

আমি বললাম-“আমি কী করে ভুলিয়ে রাখব?”

সে বলল-“তুই আমার মায়ের কাছটিতে থাকিস৷ বলিস-এই যে মা আমি তোমার সুরো৷ সন্ধ্যা বেলা ফলের বাগান থেকে খেলা শেষ করে এসে বলিস-এই যে মা, আমি তোমার সুরো-খেলা করে ফিরে এলাম৷ আমার বাঁশি শুনিয়ে তাঁকে বলিস-এই দেখো মা, তোমার সুরো কেমন বাঁশি বাজায়৷ আমার মুক্তোর মালাটা গলায় দিয়ে বলিস-এই দেখো মা, মুক্তোর মালা তোমার সুরোর গলায় কেমন মানিয়েছে! মা মনে করবে, এই তো আমার সুরো! সুরো তো কোথাও যায়নি!” আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম-“না, না, আমি রানি মায়ের ছেলে হতে পারব না৷ আমার মায়ের জন্যে বড়ো মন কেমন করবে-আমার মা কাঁদবে, নুটু কাঁদবে!”

সুরো বলল-“কিন্তু এরা যে আমার বদলে তোকে রানি মায়ের ছেলে হবার জন্যেই নিশির ডাকে ভুলিয়ে এখানে এনেছে৷” আমি কেঁদে উঠে বললাম-“না, না, আমি কিছুতেই তুই হব না, আমি নিপুই থাকব! তোর দু-টি পায়ে পড়ি, তুই আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দে!”

সুরো বলল-“আচ্ছা, তোর ভয় নেই৷”

আমি বললাম-“না, তুই ঠিক করে বল-আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দিবি?”

সুরো বলল-“দেব, দেব-আমি কথা দিচ্ছি তোকে ঠিক তোর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেব৷”

আমি বললাম-“তবে এখুনি পাঠিয়ে দে৷”

সে বলল-“দিচ্ছি৷ কিন্তু আমার কী মনে হচ্ছে জানিস?”

আমি বললাম-“কী?”

সে বলল-“সেখানে গিয়ে তোদের জন্যে যদি বড্ড মন কেমন করে?”

 আমি বললাম-“তা কি করবে? ওই মায়াবী মালা গলায় পরলে আমাদের কথা হয়তো আর মনেই থাকবে না৷”

সুরো বলল-“হয়তো সন্ধ্যা বেলা তোর কথা মনে পড়বে, হয়তো রাত্রে শোবার সময় রানি মাকে মনটা খুঁজতে থাকবে, হয়তো সকালে উঠে ভাবতে থাকব-কই আমার চন্দনা পাখি তো ডাকছে না-খোকাবাবু ওঠো, খোকাবাবু ওঠো!”

আমি বললাম-“তখন কী করবি?”

সে বলল-“কী আর করব? হয়তো সমুদ্রের ধারে একা গালে হাত দিয়ে বসে ভাবব-এই সমুদ্র পেরিয়ে যাই কেমন করে? হয়তো রাজকুমারী আমার চোখের জল মুছিয়ে বলবে, কেঁদো না! কিন্তু তবু মন কাঁদতে থাকবে! তোরা হয়তো তখন ভুলে যাবি, কিন্তু আমি তোদের কথাই কেবল ভাবব আর কাঁদব৷”

অমি বললাম-“সুরো, তবে তুই যাসনি৷”

সুরো বলল-“সবাই তো যেতে মানা করছে, সবাই তো ছেড়ে দিতে কাঁদছে, কিন্তু তবু তো থাকতে পারছি না ভাই! রাজকুমারীর ওই বাঁশির সুর যে প্রাণ টেনে নিয়ে চলেছে৷ ওই সেই বাঁশির ডাক! নিপু, বিদায় দে ভাই৷ মনে রাখিস আমায়!” আমি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলাম-“না সুরো, না, যাসনি,

আমার কান্নার দু-ফোঁটা জল হাতে নিয়ে সে বলল-“এই আমার রইল-তোর স্মরণচিহ্ন!”

আমি আরও চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম-“না, না, তোকে আমি কিছুতেই ছাড়ব না৷” বলে তার হাত চেপে ধরলাম৷ সুরো আমার হাতটি বুকে খানিক চেপে চুপ করে রইল৷ তারপর আস্তে আস্তে মুখ তুলে বলল-“ওই আমার রথ এসেছে৷” বলে সে আমার হাত ছেড়ে দিল৷ বলল-“আর তোকে ধরে রাখব না, তুই তোর মায়ের কাছে ফিরে যা৷ আমায় বিদায় দে৷” বলতে বলতে সুরো কোথায় মিলিয়ে গেল, আমিও যেন সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে যেতে লাগলাম৷ কী হল কিছু বুঝতে পারলাম না৷ কেবল শুনলাম মা যেন অনেক দূর থেকে ডাকছে-“নিপু! নিপু!”

“নিপু! নিপু!”

আমি ধড়মড় করে উঠে চোখ মুছতে মুছতে দেখলাম চোখের পাতা ভিজে৷

“নিপু! নিপু!”

আমি চোখ মুছে দেখি, মা আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে৷

“নিপু! নিপু!”

মা বলল-“দেখবি আয়৷”

আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি সকালের সোনালি রোদে আকাশ ভরে গিয়েছে; আর একখানি সোনালি চতুর্দোলায় ফুলে ফুলে সাজানো, ফুলের মালা গলায়, জরির জামা গায়ে, বরের বেশে চলেছে রাজপুত্র সুরজিৎ-যেন কোথাকার কোন রাজপুরী থেকে তার বধূ আনতে৷

তারপর কত দিন ওই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি-কত বর কত বধূ নিয়ে ফিরে এল দেখলাম, কিন্তু সুরো তো কই তার সেই রাজকুমারী বধূকে নিয়ে আর ফিরে এল না৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *