বাঁচা-মরার অর্থনীতি

বাঁচা-মরার অর্থনীতি 

এমন এক দিন ছিল যখন লোকে বিশ্বাস করত যে অসুখ সারান বিধাতা আর তার জন্য ফি গোনেন ডাক্তার। আঠারো শতকে ভল্টেয়ার লিখেছেন, “The art of medicine consists of amusing the patient, while nature cures the disease.” (চিকিৎসা শাস্ত্রের কাজ হলো রোগীর মনোরঞ্জন, পক্ষান্তরে রোগ নিরাময় করে প্রকৃতি।)। গত দু’শ বছরে চিকিৎসা শাস্ত্রের অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। আজকের ডাক্তার শুধু রোগীর মনোরঞ্জনই করেন না, তিনি বিগত দিনের প্রতিকারহীন রোগও ভাল করেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের অভাবনীয় অগ্রগতির সাথে সাথে ডাক্তারদের ফি-এর সৃষ্টিছাড়া বৃদ্ধি ঘটেছে। ডাক্তারদের ফি যত স্ফীত হচ্ছে, ডাক্তারদের নিয়ে জনগণের ক্রোধও ততই বাড়ছে। আমেরিকানরা বলেন যে, আজকের ডাক্তাররা সবাই বিশেষজ্ঞ হতে চান, তবে তাঁদের অনেকেরই আগ্রহ চিকিৎসা সম্পর্কে ততটা নয় যতটা ব্যাংক আর শেয়ার বাজার নিয়ে। রোগীরা ঠাট্টা করে বলেন, “অপারেশনের সময় বুঝতে পারিনি কেন সার্জেন অস্ত্র ধরার আগে মুখোশ পরেন, তবে বিলটি পাওয়ার পর বুঝলাম যে মুখোশ পরাটাই ছিল তাঁর জন্য স্বাভাবিক।” আবার কেউ কেউ বলেন, “অপারেশন থিয়েটারের পাশে রোগীর আরোগ্যের জন্য কক্ষ রাখাই যথেষ্ট নয়, হাসপাতালের ক্যাশিয়ারের অফিসের পাশেও অনুরূপ কক্ষ থাকা উচিত।” অভিযোগ করা হয় যে, মেডিক্যাল বিল শোধ করতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে খারাপ রোগ। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৫ সালে শুধু স্বাস্থ্য খাতে খরচ হয় প্রায় ৯৮২ বিলিয়ন ডলার। এই অংক ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের স্থূল জাতীয় উৎপাদের প্রায় ৩১.৭ গুণ বেশি। তবে স্বাস্থ্য খাতে দুটি দেশের মাথাপিছু ব্যয়ের বৈষম্য আরো নাটকীয়। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৩৫৮৮ ডলার, একই সময়ে বাংলাদেশে এই ব্যয় ছিল ৭ ডলার। স্বাস্থ্য খাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাথাপিছু ব্যয় বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় ৫০০ গুণ বেশি। গত ত্রিশ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা ব্যয় হুহু করে বাড়ছে। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থূল জাতীয় উৎপাদের ৫.৩ শতাংশ ব্যয়িত হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে। একত্রিশ বছর পরে ১৯৯১ সালে এই অনুপাত ১৩.৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট জাতীয় উৎপাদের ২ শতাংশ কৃষি খাত থেকে আসে। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষকরা যা উৎপাদন করে তার প্রায় ৬.৫ গুণ বেশি মূল্য সংযাজন হয় স্বাস্থ্য খাতে। এ প্রবণতা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রাক্কলন অনুসারে শিল্পায়িত দেশসমূহে ১৯৬০ সালে স্বাস্থ্য খাতে স্কুল জাতীয় উৎপাদের ৪.৫ শতাংশ ব্যয়িত হয়; ১৯৯১ সালে এই হিস্‌সা ৯.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৬০ সালে স্বল্পোন্নত দেশসমূহে এই হিস্‌সা ছিল ০.৬ শতাংশ, ১৯৯৫ সালে এই অনুপাত ১.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান (Paul Krugman) লিখেছেন, “স্বাস্থ্য পরিচর্যা মার্কিন অর্থনীতিকে জ্যান্ত গিলে ফেলছে।”[১] বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধির এ প্রবণতা অদূর ভবিষ্যতে মোটেও পরিবর্তিত হবে না বরং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বেড়েই চলবে। এর একটি কারণ হল গড় আয়ুর প্রত্যাশা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ১৯৫০ সালে বিশ্বে গড় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ছিল ৪০। ১৯৯০ সালে এ সংখ্যা ৫৯-এ উন্নীত হয়েছে। গত চল্লিশ বৎসরে গড় আয়ুর প্রত্যাশা বেড়েছে ১৯ বছর। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে, দু’হাজার বছর আগে কৃষিপ্রধান সমাজে গড় আয়ুর প্রত্যাশা ছিল ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। গত দু’হাজার বছরে গড় আয়ুর প্রত্যাশা খুব বেশি হলে ২০ বছর এবং কমপক্ষে পাঁচ বৎসর বেড়েছে। অর্থাৎ গত ৪০ বছরে গড় আয়ুর প্রত্যাশা যতটুকু বেড়েছে ততটুকু বাড়তে এর আগে প্রায় দু’হাজার বছর লেগেছে। প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির সাথে সাথে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে জনসংখ্যার ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশসমূহে বাড়ছে শিশু ও তরুণদের সংখ্যা, আর উন্নত দেশসমূহে বুড়োদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যার মাত্র ৪ শতাংশের বয়স ছিল পঁয়ষট্টির বেশি। অথচ আজকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের বুড়োদের সংখ্যা ১৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে। তাদের অসুখ-বিসুখ বেশি হয়। তাই তাদের স্বাস্থ্য সেবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বুড়োদের চিকিৎসা খরচের যোগান দিতে হচ্ছে কর্মক্ষম ব্যক্তিদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করে। অথচ জনসংখ্যা না বাড়াতে কর্মক্ষম করদাতাদের সংখ্যা কমে আসছে। কাজেই স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন আগামী দিনের রাজনীতির সবচেয়ে জটিল সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। 

চিকিৎসা খাতে ব্যয়ের অভূতপূর্ব বৃদ্ধি অবশ্যই সবার জন্য স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করেনি। বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের সাথে প্রত্যাশিত গড় আয়ুর কোন সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক নেই। ১৯৯০ সালের একটি সমীক্ষাতে দেখা যাচ্ছে যে, সৌদি আরবে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় হল ৩২২ মার্কিন ডলার, অথচ জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু ৬৪ বছর। চীনে স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় ছিল ৩.৫ মার্কিন ডলার (সৌদি আরবে মাথাপিছু অনুরূপ ব্যয়ের মাত্র ৯২ ভাগের এক ভাগ), অথচ প্রত্যাশিত গড় আয়ু সৌদি আরবের চেয়ে পাঁচ বছর (৬৯ বছর) বেশি। শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ কোরিয়ার গড় প্রত্যাশিত আয়ু সমান (৭২ বছর), স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় শ্রীলঙ্কায় ১৮ ডলার আর দক্ষিণ কোরিয়াতে ৩৭৭ ডলার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর যুক্তরাজ্যে প্রত্যাশিত গড় আয়ু হলো ৭৬ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয় যুক্তরাজ্যের অনুরূপ ব্যয়ের আড়াই গুণেরও বেশি। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মোট ২৬.৭ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ৩.৭ কোটি লোকের স্বাস্থ্য বীমা নেই। 

একবিংশ শতাব্দীতে স্বাস্থ্য খাতে চ্যালেঞ্জ হলো দুটো। প্রথমত, চিকিৎসা শাস্ত্রের অভাবনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের জনসংখ্যার সিংহভাগ ন্যূনতম স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত। আজকের বিশ্বের হতদরিদ্রদের অবস্থা কবি কোলরিজের অভিশপ্ত নাবিকের মত। কোলরিজের কবিতার নাবিক চারধারে সমুদ্রের জল থাকা সত্ত্বেও এক ফোঁটা পানীয় জল পায়নি। চিকিৎসার প্রাচুর্য সত্ত্বেও আজকের হতদরিদ্ররা চিকিৎসার সুযোগই পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, যেখানে জনগোষ্ঠী চিকিৎসার যথাযথ সুযোগ পাচ্ছে সেখানে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের প্রচুর অপচয় হচ্ছে। এ ধরনের অপচয়ের জন্য অর্থ সংস্থান সব চেয়ে সচ্ছল রাষ্ট্রের পক্ষেও সম্ভব নয়। তবে রোগের চিকিৎসার চেয়েও অপচয়ের দাওয়াই অনেক বেশি কঠিন। চিকিৎসা খাতে সংস্কার তাই রাতারাতি সম্ভব হবে না। এ খাতে কোন বড় পরিবর্তন করতে হলে তিনটি পক্ষকে একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে হবে। এ তিনটি পক্ষ হলো : রোগী, রাষ্ট্র ও ডাক্তার। কিন্তু এদের স্বার্থ ও বাধ্যবাধকতা ভিন্ন। এদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলা তাই সহজ নয়। 

রোগ নিয়ে আসে যন্ত্রণা, অসুবিধা এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃত্যুর কালো ছায়া। সবাই রোগের উপশম চায়। কিন্তু সাধ থাকলেও সবার সাধ্য নেই। আর্থিক দিক থেকে দু’ ধরনের রোগী রয়েছে। এক ধরনের রোগীরা চিকিৎসা ব্যয় নিজেরা বহন করে, আরেক ধরনের রোগীদের সকল চিকিৎসার ভার গ্রহণ করে সরকারী ও বেসরকারী স্বাস্থ্য বীমা যাঁরা নিজেদের ব্যয়ে চিকিৎসা করেন তাঁরা চিকিৎসার আগে ব্যয় ও লাভের অনুপাত নির্ণয় করেন। জীবননাশক ও যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধি না হলে এ ধরনের রোগীরা চিকিৎসার ব্যয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পক্ষান্তরে যাঁদের পূর্ণ স্বাস্থ্য-বীমা রয়েছে তাঁরা চিকিৎসার জন্য খরচের তোয়াক্কা করেন না। তার ফলে অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য অর্থের অপচয় হয়। অর্থনীতির বুলিতে স্বাস্থ্য-বীমা নৈতিক ঝুঁকির (moral hazard) সৃষ্টি করে।[২] বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ পাওয়াতে বীমাকৃত ব্যক্তিরা স্বাস্থ্যের যথেষ্ট যত্ন নেন না। উপরন্তু প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে বীমার অর্থ ব্যয় করেন। এর ফলে বীমার ব্যয় বেড়ে যায়। তাই ব্যয়বহুল স্বাস্থ্যবীমার সুযোগ শুধু মাত্র বিত্তবানদের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে এবং বীমার সুযোগ অসচ্ছল ব্যক্তিদের নাগালের বাইরে চলে যায়। ধনীদের অপচয়ের ফলে গরীবদের চিকিৎসার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে অপচয় হ্রাসের জন্য দুটো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বীমা বহন করলে সুবিধাভোগীদের মধ্যে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হবে না। যদি চিকিৎসার আংশিক ব্যয় রোগীদের বহন করতে হয় তবে বীমার সুযোগ ব্যবহারের আগে রোগীরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবেন। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এ ধরনের সংস্কারের ফলে বীমার ব্যয় কমে যায়। দ্বিতীয়ত, অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করে ও উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সরকার বীমার ব্যয় হ্রাস করতে পারে। 

নির্দেশ অর্থনীতির (command economy) দ্রবীভবনের প্রেক্ষিতে প্রায় সকল দেশেই অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সরকারের আয়তন ক্রমশ হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ভূমিকার কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। শিল্পোন্নত দেশসমূহে স্বাস্থ্য খাতে মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ আসে সরকারী খাত থেকে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারী ব্যয়ের হিস্‌সা হলো প্রায় ৫০ শতাংশ। তিনটি কারণে সরকারের পক্ষে স্বাস্থ্য খাতকে পুরোপুরি বাজারের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রথমত, বেসরকারী খাতের পক্ষে যুক্তিসঙ্গত মূল্যে কতিপয় স্বাস্থ্য সেবা সরবরাহ সম্ভব হবে না। ছোঁয়াচে রোগ বন্ধ করতে হলে যারা পয়সা দিয়ে টীকা দিতে পারবে টীকার সুযোগ শুধু তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, যাদের খরচ করার সামর্থ্য নেই তাদের জন্যও টীকার ব্যবস্থা করতে হবে। তেমনি স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষা বা নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্যাদিও সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এ সকল সেবা জনস্বাস্থ্য সেবা নামে পরিচিত। এসব সেবা ব্যক্তিগত পণ্য নয়, গণপণ্য (public goods)। এসব সেবার প্রভাব শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, এদের প্রভাব পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। তাই জনস্বাস্থ্য খাত সরকারের কাছ থেকে বেসরকারী খাতে হস্তান্তরের সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, দরিদ্র জনগণের জন্য ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করে দেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। শুধু নৈতিক কারণেই নয় অর্থনৈতিক দিক থেকেও এ ধরনের ব্যবস্থার যুক্তি রয়েছে। অসুস্থ গরীবরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না, অথচ অসুখ না সারলে তাদের পক্ষে কাজ করাও সম্ভব নয়। এ ধরনের রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করলে এদের উৎপাদনশীলতা বাড়বে; ফলে এরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে এবং সরকারের উপর এদের নির্ভরশীলতা কমে যাবে। তৃতীয়ত, স্বাস্থ্য সেবার কোন কোন খাতে বাজার কাজ করে না। বাজারকে সঠিকভাবে কাজ করতে হলে বাজারের কুশীলবদের রোগীদের সম্পর্কে সকল তথ্য জানতে হবে। নিজেদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে রোগীরা যত জানে, বাজার তত জানে না। তাই বাজারের পক্ষে স্বাস্থ্য সেবার প্রতিযোগিতামূলক দাম নির্ণয় করা সম্ভব নয়। উপরন্তু প্রতিটি শহরে বা গ্রামে অনেকগুলি হাসপাতাল ও অনেক বিশেষজ্ঞ রাখা সম্ভব নয়। কাজেই এদের ব্যবসা হয় একচেটিয়া ধরনের। এরা যাতে ভোক্তাদের প্রতারণা না করতে পারে তার জন্য স্বাস্থ্যসেবার খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন রয়েছে। 

বিংশ শতাব্দীর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সীমিত সম্পদ নিয়ে সরকারের পক্ষে সকল স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করা সম্ভব নয়। ব্যয়ের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সম্পদ বরাদ্দ করতে হবে। যেখানে ব্যয়ের কার্যকারিতা কম সেখানে ব্যয় হ্রাস করতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যন্ত জটিল। স্বাস্থ্য খাতে শুধু অর্থ নয়, মানুষের বাঁচা—মরার প্রশ্নও জড়িয়ে আছে। এখানে শুধু যুক্তি নয় আবেগও কাজ করে। মানুষের জীবনের মূল্য অর্থনীতিবিদের লাভ-লোকসানের পাটীগণিত দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে অর্থ সাশ্রয় করতে গিয়ে কোন রোগীর মৃত্যু ঘটলে তার সামাজিক প্ৰতিক্ৰিয়া তীব্র হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হ্রাস সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকদের সহযোগিতা। এ ধরনের সহযোগিতা পাওয়া অত্যন্ত শক্ত। প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান মনে করেন যে, চিকিৎসা খাতের সবচেয়ে বড় রোগ হলো ডাক্তারদের একচেটিয়া ব্যবসা।[৩] সকল দেশেই ডাক্তারদের নিজস্ব সমিতি ডাক্তারি করার অনুমতি দিয়ে থাকে। এ ধরনের সমিতিরা চায় না যে, ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ুক এবং ডাক্তাররা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হোক। তাই তারা ডাক্তারদের নিবন্ধন সীমিত করে রাখে। ডাক্তারগণ অবশ্য বলেন যে, ডাক্তারদের সেবার মান নিশ্চিত করা তাঁদের দায়িত্ব। প্রতিযোগিতা বাড়ানোর জন্য ডাক্তারের সংখ্যা বাড়াতে হলে পেশাগত মান নেমে যাবে। এর ফলে সমাজের অনিষ্ট হবে। মিল্টন ফ্রিডম্যান অবশ্য এ যুক্তি মানেন না। তিনি মনে করেন যে, ডাক্তাররা সামাজিক ক্ষতির অহেতুক ভয় দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ক্রুগম্যানের বক্তব্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তিনি যথার্থই লিখেছেন, “The essential health care problem seems to be one not so much of market structure as of morality” (স্বাস্থ্যসেবার মূল সমস্যা বাজারের কাঠামো বলে মনে হয় না, মূল সমস্যা হল নৈতিক)”[৪]। 

ডাক্তারদের নৈতিক সমস্যার উৎস দুটি। প্রথমত, ডাক্তারদের সিদ্ধান্তের সাথে রোগীদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত আর কেউ অন্যদের সম্পর্কে এত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। তাঁদের অনেক ভুল কোন দিনই সংশোধন করা সম্ভব নয়। কাজেই অর্থাভাবে রোগীদের কোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে ডাক্তারগণ নৈতিক দিক থেকে সাহস পান না। দ্বিতীয়ত, ডাক্তারি পেশার একটি অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়েছে। সকল স্বাধীন পেশাতেই স্বার্থের সংঘাতকে (conflict of interest) গর্হিত গণ্য করা হয়। যে বিষয়ে পেশাদারদের ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে সে বিষয়ে তাঁরা কোন পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। ডাক্তারদের পক্ষে তা করা সম্ভব হয় না। ডাক্তাররা রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা বা অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ধরনের পরীক্ষা বা অস্ত্রোপচার করে সেই ডাক্তার নিজেই অর্থ কামাই করেন। রোগীর ব্যয় বাড়লে ডাক্তারের আয় বাড়ে। কাজেই রোগীর স্বার্থে, না নিজের স্বার্থে ডাক্তাররা ব্যয়বহুল চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকে যায়। ডাক্তারদের নৈতিক ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। এ বিতর্ক চলছে কয়েক হাজার বছর ধরে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ডাক্তারদের নৈতিক ভূমিকা নিয়ে তিনটি মতবাদ দেখা যায়। 

একটি মতবাদ বিশ্বাস করে যে ডাক্তারের দায়িত্ব হলো চুক্তিভিত্তিক। প্রতিটি ডাক্তার তাঁর রোগীকে সম্ভবশ্রেষ্ঠ সেবা প্রদানের জন্য দায়বদ্ধ। যদি তিনি সম্ভবশ্রেষ্ঠ সেবা প্রদান করতে ব্যর্থ হন তবে রোগীর কাছে তিনি দায়ী থাকবেন। এই মতবাদের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে প্রায় চার হাজার বছর আগে রচিত হামুরাবির (২১২৩-২০৮১ খৃষ্টপূর্ব) সংহিতায়।[৫] হামুরাবি ছিলেন ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের অধিনায়ক। হামুরাবির বিধান হল, কোন ডাক্তার যদি রোগীর চিকিৎসা ঠিকমত না করেন তবে ঐ ডাক্তারকে রোগীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তার যদি রোগীর ক্ষতিপূরণ না করেন তবে তাঁর আঙ্গুল কেটে ফেলতে হবে। আজকের দুনিয়াতে অমনোযোগী ডাক্তারদের আঙ্গুল কাটা হয় না। তবে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়। 

আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকাংশে হামুরাবির ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। ডাক্তারদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ব্যবহারজীবীর পেশা ও নেশা। যুক্তরাষ্ট্রে ঠাট্টা করে বলা হয়ে থাকে যে, প্রতিটি মহৎ ব্যক্তির পেছনেই থাকে তার স্ত্রীর অনুপ্রেরণা আর প্রত্যেক ভাল ডাক্তারের পেছনেই রয়েছে উকিলদের তাড়া। উকিলদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ডাক্তাররা কর্তব্যে অবহেলা বীমার (malpractice insurance) দ্বারস্থ হন। কিন্তু যে ডাক্তারের বিরুদ্ধে যত বেশি বীমার দাবি আসে তাঁকে তত বেশি বীমার কিস্তি দিতে হয়। এর ফলে ডাক্তারদের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় আইনের ঝামেলা সামলাতে। ডাক্তাররা তাই উকিলদের ঘৃণা করেন। উকিলরা বলেন কর্তব্যে অবহেলাকারী ডাক্তাররা নিষ্ঠুর আর ডাক্তাররা বলেন উকিলরা হল হৃদয়হীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উকিলদের সম্পর্কে ডাক্তারদের একটি প্রিয় ঠাট্টার নমুনা দিচ্ছি। একজন হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর হৃৎপিণ্ড সংযোজনের প্রয়োজন দেখা দেয়। রোগীকে জানানো হয় যে, হৃৎপিণ্ড সংযোজনের দু’জন সম্ভাব্য দাতা রয়েছে। একজন সম্ভাব্য দাতা হলেন পঁচিশ বছরের খেলোয়াড়। আরেক জন হলেন প্রবীণ উকিল। রোগীকে বলা হল, এ দুজনের মধ্যে যে কোন একজনের হৃৎপিণ্ড তিনি গ্রহণ করতে পারেন। ডাক্তাররা আশা করছিলেন যে, রোগী পঁচিশ বছরের খেলোয়াড়ের হৃৎপিণ্ড পছন্দ করবে। কিন্তু রোগী ষাট বছরের উকিলের হৃৎপিণ্ড সংযোজন করতে চায়। কারণ জিজ্ঞাসা করলে রোগী বলে, উকিলদের হৃদয় কখনও ব্যবহৃত হয় না, আর তাই ষাট বছরের উকিলের হৃদয় সম্পূর্ণ অব্যবহৃত ও আনকোরা হবে। বুড়ো উকিলের হৃদয়ই তার পছন্দ। 

ডাক্তাররা উকিলদের সম্পর্কে যাই বলুন না কেন, উকিলরা ডাক্তারদের সামান্য ত্রুটি খুঁজে পেলেও তাঁদের ছাড়েন না। উকিলরা যত মামলা জিতছে তত কর্তব্যে অবহেলা বীমার (malpractice insurance) খরচ বাড়ছে। ডাক্তারগণ অবশ্য নিজেরা এ খরচ বহন করেন না। তাঁরা এ খরচ রোগীদের কাছ থেকে আদায় করেন। এর ফলে স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় বেড়েই চলছে। ডাক্তাররাও মানুষ, তাদের কর্তব্যে অবহেলা সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু যেখানে সরল বিশ্বাসে কর্তব্যে অবহেলা হয় সেখানে ডাক্তারদের আইনগতভাবে রক্ষা পাওয়ার অধিকার থাকা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। এ অধিকার অস্বীকার করলে স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত হবে না, শুধু স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় বাড়বে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই বিশ্বাস করা হয় যে, ডাক্তারদের সেবার মান মামলা মোকদ্দমা করে বাড়ানো যাবে না। আদালতের পক্ষে ডাক্তারদের তত্ত্বাবধান করা সম্ভব নয়। ডাক্তারদের কার্যকর তত্ত্বাবধান করতে হবে সমগোত্রীয়দের (peer group)। এই মতবাদের উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে হিপোক্রেটিসের (Hippocrates) শপথে। 

হিপোক্রেটিস (৪৬০-৩৫৯/৩২৭ খৃষ্টপূর্ব) ছিলেন প্রাচীন গ্রীসের একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক। তাঁকে চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক গণ্য করা হয়ে থাকে। এশিয়ার উপকূলের অদূরে অবস্থিত কোস দ্বীপে তাঁর জন্ম। বিভিন্ন দেশ সফর করে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। পরে তিনি জন্মস্থানে ফিরে এসে দক্ষিণার বিনিময়ে শিষ্যদের চিকিৎসা শাস্ত্র শেখান। গ্রীক জগতের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্র, রোগী ও চিকিৎসকরা তাঁর কাছে ভিড় জমায়। কারো কারো মতে তিনি ১৩৩ বছর বাঁচেন, আবার কেউ কেউ বলেন তাঁর আয়ুষ্কাল ছিল নিরানব্বই। তাঁর দীর্ঘ জীবন কালে তিনি অসংখ্য শিষ্যকে চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর মৃত্যুর পর দেখা যায় যে, ডাক্তারের সংখ্যা খুব বেশি বেড়ে গেছে এবং তাঁদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই অবস্থাতে হিপোক্রেটিসের শিষ্যরা একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করেন। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ তাঁরা এই আচরণবিধির নামকরণ করেন হিপোক্রেটিসের শপথ। যাঁরা ডাক্তারি পেশা গ্রহণ করেন তাঁদের এ ধরনের শপথ নিতে হয়। চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রি লাভের পর ছাত্ররা আজও এ ধরনের শপথ নিয়ে থাকে। শপথটি নিম্নরূপ[৬]: 

চিকিৎসার দেবতা এ্যাপোলোর নামে, দেবতা এসক্লপিয়াস (Asclepius), দেবতা হেজিই (Hygiaea), দেবতা পেনাসিয়া (Panacea) এবং সকল দেব ও দেবীর নামে এবং তাঁদের সাক্ষী করে আমি শপথ নিচ্ছি যে আমি এই শপথ ও এই অঙ্গীকার আমার সকল সামর্থ্য ও আমার বিচার বুদ্ধি দিয়ে বাস্তবায়ন করব। আমি আমার গুরুকে মাতা পিতার মত সম্মান করব, তাঁকে আমার জীবিকার অংশীদার হিসাবে গণ্য করব, যখন তাঁর প্রয়োজন দেখা দেবে তখন তাঁকে আমার আয়ের অংশ প্রদান করব, তাঁর পরিবারের সদস্যদের আমার নিজের ভাই গণ্য করব, যদি তাঁর পরিবারের সদস্যরা চান তবে তাঁদের দক্ষিণা অথবা কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়াই আমি চিকিৎসা শাস্ত্র শিখাব। আমার ছেলেদের, আমার শিক্ষকের ছেলেদের এবং চিকিৎসকের শপথ ও দায়িত্ব যে সব চিকিৎসক গ্রহণ করেছেন তাঁদের চিকিৎসার নীতিমালা সম্পর্কে মৌখিক শিক্ষা ও অন্যান্য শিক্ষা প্রদান করব এবং অন্য কাউকে চিকিৎসা শাস্ত্র পড়াব না। আমার সাধ্য ও বিচার বুদ্ধি অনুসারে চিকিৎসা করে আমি রোগীদের সাহায্য করব, কিন্তু কখনও কাউকে জখম করব না অথবা কারো প্রতি অন্যায় আচরণ করব না। কেউ চাইলেই তাঁকে বিষ খাওয়াব না অথবা এই ধরনের চিকিৎসার পরামর্শ দেব না। অনুরূপভাবে গর্ভপাত করার জন্য কোন নারীকে যন্ত্র (pessary) দিয়ে সহায়তা করব না। আমি আমার জীবন এবং আমার পেশাকে নিষ্কলঙ্ক ও পবিত্র রাখব। আমি নিজে ছুরি ব্যবহার করব না, এমনকি পাথুরে রোগীদের ক্ষেত্রেও নয়; এ ধরনের চিকিৎসা আমি এ বিষয়ে যোগ্য কারিগরদের কাছে ছেড়ে দেব। যে গৃহেই আমি প্রবেশ করি না কেন আমি শুধু অসুস্থদের সহায়তা করতে প্রবেশ করব এবং আমি ইচ্ছাকৃত অন্যায় বা অপকার করা থেকে বিশেষ করে স্বাধীন ও দাস শ্রেণীর পুরুষ ও মহিলাদের দেহের অমর্যাদা থেকে বিরত থাকব। আমার পেশাগত কাজে যা দেখি না বা শুনি না কেন এবং পেশার বাইরেও লোকজনের সাথে আলোচনা থেকে জানি না কেন তা বাইরে প্রকাশিত হতে দেব না, এ ধরনের তথ্য আমি কখনও ফাঁস করব না এবং সব সময় এদের পবিত্র গোপনীয় তথ্য হিসাবে গণ্য করব। আমি যদি এই শপথ পালন করি ও ভঙ্গ না করি তবে যেন আমি আমার জীবন ও আমার পেশার জন্য সুনাম বয়ে আনি। যদি এ শপথ ভঙ্গ করি অথবা অস্বীকার করি তবে এর উল্টোটা যেন আমার জীবনে ঘটে। 

অর্থনীতিবিদ্ মিল্টন ফ্রিডম্যানের মতে এ দীর্ঘ শপথে যেমন ধনাত্মক দিক রয়েছে তেমনি রয়েছে ঋণাত্মক উপাদান।[৭] হিপোক্রেটিসের শপথে ডাক্তারদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু এই শপথেই রয়েছে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে চিকিৎসকের পেশা সীমিত রাখার অঙ্গীকার। চিকিৎসকদের ট্রেড ইউনিয়নের বীজ এই শপথেই নিহিত রয়েছে। চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ সম্পর্কে কোন ইঙ্গিত হিপোক্রেটিসের শপথে নেই। তবে হিপোক্রোটিস এ সম্পর্কে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, যে সব রোগীর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে তাদের কাছ থেকে বেশি ফি আদায় করতে হবে। তবে কারো যদি সামর্থ্য না থাকে তবে তাকে মাগনা চিকিৎসা করা সঙ্গত হবে। হিপোক্রেটিস বলতেন, “For where there is love of man, there is also love of the art.[৮] (যেখানে মানুষের জন্য ভালবাসা রয়েছে সেখানে চিকিৎসাবিদ্যার প্রতি ভালবাসাও প্রতিফলিত হয়।) 

হিপোক্রেটিসের শপথের ভিত্তিতে সমগোত্রীয় চিকিৎসকদের একে অপরের খবরদারি করা সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সমগোত্রীয় ডাক্তারগণ তাঁদের সহকর্মীদের ভুল ত্রুটি ঢেকে রাখার চেষ্টা করেন। কাজেই আইনগত ব্যবস্থা ছাড়া কার্যকরভাবে হিপোক্রেটিসের শপথ বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। অন্যদিকে আইনগত ব্যবস্থা ব্যাপক হারে গৃহীত হলে চিকিৎসার ব্যয় বেড়ে যায়। 

আইনগত ব্যবস্থা বা সমগোত্রীয়দের তদারকি ডাক্তারদের নৈতিক দায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। প্রতিটি ডাক্তারকে নৈতিক দায়িত্ব নিজের দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, বাইরে থেকে তার উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি ডাক্তারেরই মনে রাখতে হবে যে, তিনি নিজের জন্য যা করবেন না রোগীদের দিয়ে তা করানো ঠিক হবে না। এই মতবাদ হলো ডাক্তারের নৈতিকতা সম্পর্কে তৃতীয় পন্থা। কিন্তু এ দায়িত্ব পালন সহজ নয়। নিজের জীবন থেকেই একটি উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে সলিমুল্লাহ হল থেকে কলেরা প্রতিষেধক ইনজেকশন দেওয়ার জন্য ত্রিশ সদস্যের একটি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আমিও সে দলের সদস্য ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইনজেকশন সম্পর্কে আমাদের জরুরী ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মেডিক্যাল অফিসার ও পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে বীর শহীদ ডাক্তার মর্তুজা। তিনি আমাদের প্রশিক্ষণ দু’ভাগে ভাগ করলেন। প্রথম দিন তাত্ত্বিক শিক্ষা আর দ্বিতীয় দিনে ব্যবহারিক শিক্ষা। প্রথম দিনের তাত্ত্বিক ক্লাসে ডক্টর মর্তুজা জানালেন যে, হাতে ইনজেকশন দিতে হলে মানুষের হাতের গঠন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তিনি হাতের মাংশপেশি, শিরা উপশিরা ও স্নায়ুতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করেন। তার পর ঠিকভাবে ইনজেকশন না দিতে পারলে কি কি সমস্যা হয় তা আলোচনা করেন। তিনি জানালেন অসাবধানতাবশত স্নায়ুতন্ত্র ও শিরা উপশিরাকে জখম করলে হাত অকেজো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কি কি ভুল করলে ইনজেকশন থেকে রোগ সৃষ্টি হতে পারে তাও তিনি বর্ণনা করেন এবং সঠিকভাবে ইনজেকশন দেওয়ার পদ্ধতি বাতলে দেন। প্রথম দিনের ক্লাসের শেষে তিনি জানান যে, পরদিন ক্লাসে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী আরেকজন প্রশিক্ষণার্থীকে ইনজেকশন দেবে। আমরা সবাই গ্রামের নিরক্ষর লোকদের ইনজেকশন দেওয়ার জন্য উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আনাড়িদের হাতে ইনজেকশনের কি বিপদ তা জানতাম না। যখন জানলাম তখন আনাড়ি সতীর্থদের কাছে ইনজেকশন নেওয়ার ঝুঁকির ভয়ে শিউরে উঠি। দ্বিতীয় দিনের ক্লাসে ভয়ে আমি যাইনি। আমি মনে করেছিলাম যে, আমার সতীর্থরা আমার চেয়ে সাহসী এবং তাদের অনেকেই হয়ত একে অন্যের হাতে ইনজেকশন দিয়েছে। দু’দিন পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, ত্রিশজন স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণার্থীর একজনও দ্বিতীয় দিনের ক্লাসে হাজির হয়নি। অন্যের চিকিৎসার ব্যাপারে আমরা অনেকেই সাহসী। কিন্তু একই মানদণ্ড কি আমরা নিজেদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারব? আমি পারিনি। আমার মনে হয় অনেক ডাক্তারই আমার মত পালিয়ে যাবেন। 

ডাক্তারদের নৈতিক উভয়-সংকটের কোন সহজ সমাধান নেই। দ্রুত কারিগরী পরিবর্তনের ফলে এ সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে জ্ঞানের প্রত্যন্ত সীমায় দ্রুত গতিতে ব্যয়বহুল চিকিৎসা-পদ্ধতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। যারা বিত্তবান তারা নতুন নতুন চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে, অথচ যারা বিত্তহীন তাদের অনেকেই প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুঃখ করে বলা হয়ে থাকে যে, নিউইয়র্ক শহরের কৃষ্ণাঙ্গ-অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা বাংলাদেশের চেয়ে নিকৃষ্ট। চিকিৎসা খাতে ক্রমেই বৈষম্য বাড়ছে—বৈষম্য বাড়ছে ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে, বাড়ছে শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের মধ্যে। এ বৈষম্য দূর করে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করাই হবে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ; শুধু ডাক্তারদের জন্য নয় – অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিদদের জন্যও বটে। 

.

তথ্যসূত্র 

১. Krugman, Paul, The Age of Diminished Expectations (Cambridge: MIT Press, 1994), p. 74 

২. World Bank, World Development Report, 1993 (New Work: Oxford University, 1993), p. 56 

৩. . Friedman, Milton and Rose, Friedman, Free to Chose (New York: HBJ, 1990), p. 56 

৪. Krugman, Paul, প্রাগুক্ত p. 83 

৫. Durant, Will, Our Oriental Heritage (New York: Simon and Schuster, 1963), p. 231 

৬. Durant, Will, The Life of Greece (New York: Simon and Schuster, 1963), p. 347 

৭. Friedman, Milton and Rose, Friedman, প্রাগুক্ত, p. 230 

৮. Durant, Will, The Life of Greece, (New York: Simon and Schuter, 1963), p. 348 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *