বহুরূপী

বহুরূপী

এটা বরদার গল্প হইলে কখনই বিশ্বাস করিতাম না। কিন্তু দুঃখের সহিত বলিতে হইতেছে যে, ব্যাপারটা আমার চোখের সম্মুখেই ঘটিয়াছিল, সুতরাং হাসিয়া উড়াইয়া দিবার আর পথ নাই। যদিও বরদা মূলত এই ঘটনার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল, তবু এত বড় ভোজবাজি তাহার মতো মিথ্যেবাদীর পক্ষেও অসম্ভব বলিয়া মনে করি।

গত শীতকালে বরদার মস্তকে হঠাৎ বিষয়বুদ্ধি চাগাড় দিয়া উঠিয়াছিল। শহর হইতে মাইল পনের দূরে—বেহারের গ্রাম্য ভাষায় যাহাকে দেহাত বলে—সেই অজ পাড়াগাঁয়ে বরদার কিছু ধান জমি ও কয়েক ঘর কায়েমী প্রজা ছিল। এতকাল ফৌজদার সিং নামক জনৈক শিশোদীয়বংশীয় রাজপুত এই সকল বিষয়সম্পত্তির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত ছিলেন; কিন্তু হঠাৎ বরদা শিশোদীয় রাজপুতের সততা সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া স্বয়ং দুর্জয় শীতে ধান কাটাইবার জন্য প্রস্থান করিল। দশদিনের মধ্যে তাহার আর কোনও খবরই পাওয়া গেল না।

প্রত্যহ সন্ধ্যার পর ক্লাবে বসিয়া অনর্গল মিথ্যা কথা না বলিলে যাহার স্বাস্থ্য খারাপ হইয়া যায়, সঙ্গীহীন পাড়াগাঁয়ে তাহার এই দীর্ঘ প্রবাস কি করিয়া কাটিতেছে, এই প্রশ্ন আমাদের উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিল। সেখানে বরদা কাহাকে আষাঢ়ে গল্প শুনাইতেছে? আমরা ভাবিয়াছিলাম, দু’দিন যাইতে না যাইতেই সে পলাইয়া আসিবে—কিন্তু এ কি! দশ দিন কাটিয়া গেল এখনও তাহার দেখা নাই। তাহার বাড়িতে অনুসন্ধান করিয়া জানা গেল, বরদা নিজের কাছারি বাড়িতে পরম সুখে কালাতিপাত করিতেছে, শীঘ্র গৃহে ফিরিবার ইচ্ছা নাই; ধান কাটানো যে কিরূপ আনন্দদায়ক কার্য তাহাই উচ্ছ্বসিত ভাষায় বর্ণনা করিয়া লম্বা চিঠি লিখিয়াছে। শুনিয়া আমরা স্তম্ভিত হইয়া গেলাম।

অমূল্য বলিল, ‘ধান-টান সব মিছে কথা, যা হয়েছে আমি বুঝেছি। বরদার বৌ ওকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বঙ্গ-মহিলা হলেও ধৈর্যের একটা সীমা আছে তো।’

তা সে কারণ যাহাই হোক, বরদার অভাবে ক্লাবের সান্ধ্য অধিবেশনগুলি নিঝুম ও ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িতে লাগিল। বরদা যতই মিছে কথা বলুক, সে একজন সত্যকার মজলিশি লোক তা ক্রমশ সকলেই হৃদয়ঙ্গম করিতে লাগিলাম; এমন কি অমূল্যকে দেখিয়াও মনে হইতে লাগিল, তর্ক করিবার একজন প্রতিপক্ষের অভাবে সে ভিতরে ভিতরে বিশেষ মুড়িয়া পড়িয়াছে।

অবশেষে চৌদ্দ দিনের দিন বরদার চিঠি আসিল; তাহার বাড়ির চাকর রঘুয়া চিঠিখানা ক্লাবে দিয়া গেল। ক্লাবের সভ্যগণকে সম্বোধন করিয়া বরদা চিঠি দিয়াছে; পাঠ করিয়া তাহার দীর্ঘ অজ্ঞাতবাসের যথার্থ কারণ অজ্ঞাত রহিল না। বরদা লিখিয়াছে—

বন্ধুগণ, তোমরা প্রেতযোনিতে বিশ্বাস কর না; আমি কাল্পনিক ভূতের গল্প বানাইয়া বলি এরূপ ইঙ্গিতও মাঝে মাঝে করিয়া থাক। তোমাদের মতো অন্ধ নাস্তিকের বিশ্বাস জন্মাইতে হইলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ চাই; তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি, নিজের চোখে ভূত দেখিতে চাও? স্বকর্ণে ভূতের কথা শুনিতে চাও? ভূতের সহিত করকম্পন করিতে চাও?

আমি এখানে আসিবার পর আমার কাছারি বাড়িতে একটি অশরীরী আত্মার সহিত পরিচয় হইয়াছে। অত্যন্ত মিশুক লোক, প্রত্যহ অনেক রাত্রি পর্যন্ত আমাদের গল্প-গুজব আলাপ-আলোচনা হয়। তিনি তোমাদের সহিত আলাপ করিতে রাজী হইয়াছেন। যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে, সকলে মিলিয়া এখানে চলিয়া এস। এক রাত্রি থাকিলেই চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হইবে।

কবে আসিতেছ জানাইও। এখানে আসিতে হইলে তারাপুর পর্যন্ত বাসে আসিতে হয়, সেখান হইতে আমার আস্তানা পদব্রজে আড়াই মাইল। রাস্তাঘাট নাই বটে, কিন্তু এসময়ে কোনও কষ্ট হইবে না। তারাপুর থানায় খোঁজ লইলে সেখানকার চৌকিদার পথ দেখাইয়া দিবে। ইতি

তোমাদের বরদা

চিঠি পড়িয়া অমুল্য বলিল, ‘হুঁ, এই চৌদ্দ দিন জিরিয়ে নিয়েছে কিনা, একটা বড় রকম বুজরুকি দেখাবে।’

আমি বলিলাম, ‘কিন্তু ভূতের সঙ্গে করকম্পনটা হবে কি করে?’

পৃথ্বী বলিল, ‘সেটা যথাস্থানে পৌঁছে পরীক্ষা করে দেখা যাবে। তা হলে কবে যাওয়া স্থির করছ?’

গবেষণার পর স্থির হইল আগামী মঙ্গলবার আমি, অমূল্য, পৃঙ্খী ও চুনী এই চারজন, পূর্বাহ্নে কোনও খবর না দিয়াই বরদার আড্ডায় গিয়া হানা দিব। বড়দিনের ছুটি আসিয়া পড়িয়াছে, প্রেতাত্মার সহিত করকম্পনের মহাসৌভাগ্য যদি নাও ঘটে তবু একটা আউটিং তো হইবে। ওদিকটাতে শিকারও ভাল পাওয়া যায়।

নির্দিষ্ট দিনে আমরা চারিজন বৈকালে আন্দাজ সাড়ে তিনটার সময় বাস হইতে অবতরণ করিয়া হাঁটা পথ ধরিলাম। ধানক্ষেতের আলের উপর দিয়া যাহাদের চলা অভ্যাস নাই তাহাদের পক্ষে এই পথে পদক্ষেপ সর্বদা নিরুদ্বেগ নয়,—মাঝে মাঝে অতর্কিতভাবে পথিপার্শ্বস্থ পঙ্কশয্যায় বিশ্রাম করিবার সুযোগ ঘটিয়া যায়। কিন্তু সে যাহাই হোক, আড়াই মাইল পথ যে এত দীর্ঘ হইতে পারে, তাহা পূর্বে কখনও ভাবিতে পারি নাই! অমূল্য শ্লেষ করিয়া বলিল, মাইলগুলা সম্ভবত ভৌতিক মাইল, তাই তাহাদের আদি অন্ত খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।

এই অতি-প্রাকৃত আড়াই মাইলের শেষে যখন বরদার আস্তানায় আসিয়া পৌঁছিলাম তখন পৃথিবীপৃষ্ঠে দিনের আলো আর নাই, কেবল পশ্চিম আকাশে শীর্ণ সন্ধ্যালোক মুমূর্ষূর প্রাণশক্তির মতো নির্বাণোন্মুখ হইয়া আসিতেছে।

চারিদিকে কোথাও মানুষের বসতি নাই, আবছায়া ধানক্ষেতের মাঝখানে বিঘাখানেক পতিত জমি, তাহারই একপ্রান্তে একটি জীর্ণ ইটের ঘর—চারিপাশে অপরিসর একটু বারান্দা, মাথার উপর খড়ের ছাউনি। পতিত জমির উপর স্থানে স্থানে খড়ের স্তূপ রাখা আছে। প্রথমটা লোকজন কাহাকেও দেখিতে পাইলাম না, ঠিক স্থানে পৌঁছিয়াছি কি না সন্দেহ হইতে লাগিল। অনতিদূরে একটা শিকলে বাঁধা কুকুর কুণ্ডলী পাকাইয়া শুইয়া ছিল, কাছে গিয়া দেখিলাম বরদার কুকুর—খোক্কস। খোক্কসের সহিত আমাদের প্রণয় ছিল, কিন্তু সে বিশেষ উৎসাহ প্রদর্শন করিল না, নিদ্রালুভাবে একবার তাকাইয়া আবার থাবার মধ্যে মুখ খুঁজিয়া ঘুমাইতে লাগিল।

কিন্তু বরদা কোথায়? ঘরের মধ্যে আলো জ্বলিতেছে না; এদিক ওদিক চাহিতে দেখি খড়ের একটি গাদার তলা হইতে হামাগুড়ি দিয়া একটি প্রাণী বাহির হইয়া আসিতেছে। মূর্তিটি ক্রমে খাড়া হইয়া আমাদের সম্মুখে আসিয়া ফৌজী সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। প্রথমটা ভাবিয়াছিলাম বুঝি বরদার শিশোদীয়বংশীয় রাজপুত; কিন্তু দেখিলাম—তাহা নয়, নেপাল হইতে অবতীর্ণ চন্দ্রবংশীয় একজন ক্ষত্রিয়। সম্ভবত বরদার দেউড়ি পাহারা দিবার জন্য নিযুক্ত হইয়াছেন। পরিধানে খাকি পোষাক, পায়ে বুট জুতা, কোমরে কুক্‌রি—রীতিমত যোদ্ধৃবেশ। তাঁহাকে বরদার কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় তিনি চন্দ্রবংশীয় ভাষায় যাহা বলিলেন তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে পারিলাম না।

শীতে এতখানি পথ হাঁটিয়া শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিল; আমরা আর বাক্যব্যয় না করিয়া ঘরের দিকে অগ্রসর হইলাম। চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় নির্বিকার মুখে আবার খড়ের গাদার মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

আমরা যেখানে ছিলাম সেখান হইতে ঘরটি বোধ করি ত্রিশ কদম দূরে। বারান্দাসুদ্ধ ঘরের ভিত মাটি হইতে হাত দুই উঁচুতে অবস্থিত। বারান্দায় উঠিয়া সম্মুখেই ঘরের দ্বার; আমি সর্বপ্রথম উপরে উঠিয়া দ্বারের দিকে পা বাড়াইয়াই চমকাইয়া উঠিলাম!—অন্ধকার দরজার মুখে কে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

পরক্ষণেই বরদা সশব্দে হাসিয়া উঠিল, বলিল, ‘এস। খবর না দিয়ে এলে যে; আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না?’

আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম। বরদা একটা তেলের ল্যাম্প জ্বালিয়া টেবিলের উপর রাখিল।

অমূল্য ঈষৎ বিরক্তির স্বরে বলিল, ‘ঘরেই ছিলে তো—সাড়া দিচ্ছিলে না কেন?—দেয়ালা হচ্ছিল বুঝি?’

উত্তরে বরদা কেবল হাসিল। বলিল, ‘বসো সবাই। শীতে নিশ্চয় কালিয়ে গিয়েছ। চা তৈরি আছে—দিচ্ছি।’ বলিয়া প্রকাণ্ড একটা থার্মোফ্লাস্ক, হইতে ধূমায়িত চা ঢালিয়া সকলকে দিতে লাগিল।

চা খাইতে খাইতে বরদার ঘরের চর্তুদিকে চক্ষু ফিরাইয়া দেখিতে লাগিলাম। ঘরের কোথাও এতটুকু প্লাস্টার নাই, নোনাধরা লাল ইটগুলি সারি সারি দাঁত বাহির করিয়া আছে; মেঝে মাটির, গোময় দিয়া লিপ্ত। এক কোণে একটি ক্ষুদ্র চারপাইয়ের উপর বরদার লেপ-বিছানা স্থূপীকৃত রহিয়াছে। আর এককোণে একটি বড় কাঠের সিন্দুক, তাহার উপর চায়ের সরঞ্জাম স্টোভ ইত্যাদি রাখা আছে; ঘরের মধ্যস্থলে একটি কেরোসিনকাঠের টেবিল, এবং তাহাই ঘিরিয়া কয়েকটি কঞ্চির মোড়ার উপর বসিয়া অনুজ্জ্বল ল্যাম্পের আলোয় আমরা কয়জন চা পান করিতেছি।

খোলা দরজা দিয়া ঠাণ্ডা বাতাস আসিতেছিল, বরদা সেটা বন্ধ করিয়া দিয়া আমাদের মধ্যে আসিয়া বসিল; তৃপ্তভাবে দুই হাত ঘষিতে ঘষিতে বলিল, ‘আমার ঘরটি কেমন দেখছ? ঘর ছিল না, কেবল চারিটি পুরানো দেওয়াল দাঁড়িয়ে ছিল; আমি এসে খড়ের চাল তুলে বাসের উপযোগী করে নিয়েছি।—বেশ হয়নি?’

‘খাসা হয়েছে!’

‘পেয়াদা সেপাই চিরকাল বাইরে খড়ের ছাপ্পর তৈরি করে তার মধ্যে থাকে; এবারও তাই আছে। কিন্তু আমি ভাই পারলুম না। তেরপলের তলায় এক রাত্তির শুয়েছিলুম—বাপ কি শীত! ঘরের মধ্যে এক রকম ভালই আছি। আচ্ছা, ঘরটা তোমাদের বেশ ইয়ে বোধ হচ্ছে না?’

আমরা সকলেই ঘাড় নাড়িয়া সায় দিলাম। ‘ইয়ে’ বলিয়া বরদা ঠিক কি বুঝাইতে চাহিল জানি না, কিন্তু এই ঘরে পদার্পণ করিবার পর হইতেই আমার মনের উপর কেমন একটা ছায়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, মনের সে পরিহাস-তরল ভাব আর ছিল না। কোথায় এ ঘরের কি গলদ আছে—বুঝিতে পারিতেছিলাম না, অথচ অপরিচিত অন্ধকার পথে চলিবার সময় যেমন চক্ষু-কর্ণের তীক্ষ্ণতা অজ্ঞাতসারেই বাড়িয়া যায়, তেমনি একটা দুর্লক্ষ্য অবাস্তবতার সংশয় আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে অতিশয় সতর্ক ও সচেতন করিয়া তুলিয়াছিল।

চায়ের পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়া অমূল্য বলিল, ‘তারপর, তোমার ভূত কই?’

বরদার হাসিমুখ আস্তে আস্তে গম্ভীর হইয়া গেল। সে যেন কয়েক মুহূর্ত উৎকর্ণ হইয়া কি শুনিল, তারপর অমূল্যর দিকে ফিরিয়া ঈষৎ ক্ষুব্ধ স্বরে বলিল, ‘ভয় নেই, তাঁর পরিচয় পাবে; মিছে তোমাদের এত দূর ডেকে আনিনি।’

চুনী জিজ্ঞাসা করিল, ‘কতক্ষণে তাঁর দর্শন পাওয়া যাবে? তাঁর আসার সময়ের কিছু স্থিরতা আছে কি?’

বরদা বলিল, ‘কিছু না। শুধু তাই নয়, কোন্ রূপে তিনি আসবেন, তারও স্থিরতা নেই।’

আমরা মোড়া টানিয়া আরও ঘনিষ্ঠ হইয়া বসিলাম। পৃথ্বী হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, ‘সেটা কি রকম!’

বরদা বলিল, ‘তিনি মানুষের রূপ ধারণ করে আসেন বটে, কিন্তু চেহারা সব সময়ে এক রকম হয় না।’

‘তার মানে কি?’

‘তার মানে—’ বরদা যেন একটু ইতস্তত করিল—‘অশরীরী আত্মাকে স্থূল দেহ ধারণ করতে হলে কিছু জান্তব মাল-মশলার দরকার হয়, তার নাম বিজ্ঞানের ভাষায় এক্‌টোপ্লাজম্। এই এক্‌টোপ্লাজম্‌ প্রয়োজন মতো না পেলে চেহারা একটু অন্যরকম হয়ে যায়।’

অমূল্য বলিল, ‘ও, তোমার সেই পুরাতন থিওরি! কিন্তু তোমার ইনি এক্‌টোপ্লাজম্‌ পান কোথা থেকে!’

বরদা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া শেষে ধীরে ধীরে বলিল, ‘বোধ হয় খোক্কসের গা থেকে। তিনি যতক্ষণ থাকেন, কুকুরটা নির্জীব হয়ে পড়ে থাকে,—নড়েচড়ে না, ডাকেও না—তবে শুধু যে এক্‌টোপ্লাজমের তারতম্যে চেহারার তারতম্য হয় তা নয়, অন্য কারণও আছে।’

‘অন্য কারণটি কি?’

‘ইচ্ছা। প্রেতযোনি ইচ্ছা করলেই চেহারা বদল করতে পারে; কারণ, তাদের দেহের উপাদান মানুষের দেহের উপাদানের মতো কঠিন বস্তু নয়।’

এই সময়ে বরদাকে একটু বিশেষভাবে লক্ষ্য করিলাম। এ কয়দিনে তাহার কি একটা পরিবর্তন ঘটিয়াছে। পরোক্ষ বিশ্বাসের গণ্ডী ছাড়াইয়া যেন সে সাক্ষাৎ উপলব্ধির দৃঢ়তর ভিত্তির উপর পা দিয়া দাঁড়াইয়াছে। তার্কিকের যুযুৎসা একেবারেই নাই, মুখে একটা নিঃসংশয় প্রসন্নতার ভাব, ঠোঁটের কোণে একটু সকৌতুক কোমলতা ক্রীড়া করিতেছে। বরদার এই অবস্থান্তর আমার মনের ছায়াকে আরও গাঢ় করিয়া তুলিল।

পৃথ্বী বলিল, ‘থিওরি যাক। এখন ঘটনাগুলো বল শুনি—তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কতদূর দাঁড়িয়েছে, কোথায় প্রথম সাক্ষাৎ হল ইত্যাদি। অর্থাৎ তোমাকে আগাগোড়া গল্পটা বলবার সুযোগ দিচ্ছি। আরম্ভ কর।’

বরদা একটু হাসিয়া বলিল, ‘বেশ।’ তারপর আবার যেন কান পাতিয়া কি শুনিল—‘দ্যাখো, একটা কথা তোমাদের বলে রাখি। যদি কোনও সময় বুঝতে পারো যে তিনি এসেছেন—ভয় পেয়ো না। ভয় পেলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।’

চারিদিকে সচকিতভাবে একবার চাহিয়া আমরা আশ্বাস দিলাম, ভয় পাইব না। বরদা তখন বলিতে আরম্ভ করিল—

‘প্রথম যে-রাত্রে এ ঘরে শুই, সে-রাত্রে কিছু বুঝতে পারিনি। দ্বিতীয় রাত্রে হঠাৎ এক সময় ঘুম ভেঙে গেল; শুনতে পেলুম, ঘরের মধ্যে কে খসখস করে চলে বেড়াচ্ছে। দরজা বন্ধ করে শুয়েছিলুম, ভাবলুম, সিঁদ কেটে চোর ঢুকেছে। বালিশের তলায় টর্চ ছিল, হঠাৎ জ্বেলে ঘরের চারিদিকে ফেললুম। কেউ কোথাও নেই।

‘আবার আলো নিভিয়ে যেই শুয়েছি অমনি খসখস শব্দ আরম্ভ হল। আবার আলো জ্বাললুম। এই রকম তিন-চার বার হল। তারপর হঠাৎ বুঝতে পারলুম। চিরজীবন এই বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, তবু বুকের ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। আলো নিভিয়ে গলার স্বর যথাসাধ্য সংযত করে বললুম, ‘আপনি কে আমি জানি না; কিন্তু আপনার যদি কিছু বলবার থাকে আমাকে বলতে পারেন।’

‘মনে হল, কে যেন আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলুম, ‘আপনি ভয় পাবেন না?’

‘লেপের মধ্যে থেকেও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, বললুম, ‘না।’

‘তিনি মৃদু কণ্ঠে একটু হাসলেন! যেন আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছেন। হাসি শুনে আমার মনে সাহস হল; ভারি সহানুভূতিপূর্ণ নরম হাসি—একটু করুণ। আমি বললুম, ‘দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।’

‘চোখে কিছুই দেখতে পেলুম না, অনুভবে বুঝলুম, তিনি আমার বিছানার পাশে বসলেন। তারপর নিঃশ্বাসের মতো মৃদুস্বরে বললেন, ‘আমি এই ঘরটাতে থাকি। আপনি এসে পর্যন্ত আলাপ করবার জন্য ছটফট করছি, কিন্তু পাছে আপনি ভয় পান—তাই সাহস হচ্ছিল না।’

‘আমি কি বলব ভেবে পেলুম না। তিনি বলতে লাগলেন, ‘এইখানে প্রায় পঁচিশ বছর আছি। ঘরটা আমিই তৈরি করিয়েছিলুম, তারপর মৃত্যুও হল এইখানেই। প্লেগ হয়েছিল…সৎকার করবার লোক ছিল না, মৃতদেহটাকে শেয়াল কুকুরে ছেঁড়াছেঁড়ি করলে…সেই থেকে এ জায়গা ছেড়ে যাবার আমার উপায় নেই…একলাই থাকি। আপনি এসেছেন দেখে ভারি আনন্দ হল; কারুর সঙ্গে তো মিশতে পারি না;—দুটো কথা কইবারও সুযোগ হয় না। সবাই ভয় পায়; অথচ আমি—আমরা কারো অনিষ্ট করতে চাই না—ক্ষমতাও নেই।—কেন বলুন দেখি সবাই ভয় পায়?’

‘এ প্রশ্নের উত্তর জানি না, তাই জবাব দেওয়া হল না। তিনি বললেন, ‘আমি যদি মাঝে মাঝে এসে আপনার সঙ্গে গল্পসল্প করি, আপনার কষ্ট হবে না তো?’

‘আমি বললুম, ‘না, বরং খুশি হব।’

‘তিনি গাঢ় স্বরে বললেন, ‘ধন্যবাদ। আচ্ছা, আমাকে চোখে দেখলে কি আপনি খুব ভয় পাবেন? সত্যি বলছি আমার চেহারা বীভৎস নয়—সাধারণ মানুষের মতো।’

‘বুকের ভেতর দুরু দুরু করে উঠল, কিন্তু বললুম, ‘না, ভয় পাব না।’

‘তিনি বললেন, ‘তবে আলোটা জ্বালুন।’

‘মনকে দৃঢ় করে টর্চ জ্বাললুম। মুহুর্তের জন্য তাকে দেখতে পাওয়া গেল। আমাদেরই সমবয়স্ক একটি যুবক, ময়লা রং, বড় বড় চুল—আগ্রহভরা চোখে আমার পানে চেয়ে রয়েছেন। নিতান্তই সহজ মানুষের চেহারা, ভয় পাবার কিছু নেই, কিন্তু তবু বুদ্ধি-বিবেচনা কোনও কাজেই লাগল না, সমস্ত অন্তরাত্মা যেন ভয়ে আঁতকে উঠল। মূর্তিও সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল। শুনতে পেলুম, বাইরে খোক্কস কুকুরটা কান্নার মতো একটা আওয়াজ করে ডেকে উঠল।’

বরদা চুপ করিল।

ফুসফুস হইতে অবরুদ্ধ বাষ্প মুক্ত করিয়া বলিলাম, ‘তারপর?’

বরদা বলিল, ‘তারপর—’ সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল, পূর্বের ন্যায় উৎকর্ণ হইয়া শুনিল। তারপর আমাদের দিকে ফিরিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, ‘সময় সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে—হ্যাঁ, তারপর ক্রমে ভয় কেটে গেল। এখন রোজই তিনি আসেন, অনেক কথাবার্তা হয়। তোমাদের সঙ্গেও দেখা করবার জন্যে তিনি খুব উৎসুক ছিলেন—কিন্তু—। আর সময় নেই—এস।’ বরদা আমার দিকে প্রসারিত করতল বাড়াইয়া দিল। কিছু না বুঝিয়া তাহার সহিত শেকহ্যান্ড করিলাম। বরদার হঠাৎ হইল কি? আমাদের বিদায় করিতে চায় নাকি?’

অমূল্য বলিল, ‘কিন্তু কই, তিনি এখনও দেখা দিলেন না?’

বরদা আবার বসিয়া পড়িল, মুখের উপর দিয়া একবার হাত চালাইয়া বলিল, ‘হয়তো দেখা দিয়েছেন—তোমরা জানতে পারনি—’

এই সময় বাহিরে দ্রুত পদধ্বনি শুনা গেল। আমরা চমকিয়া সোজা হইয়া বসিলাম। পদশব্দ বারান্দার উপরে উঠিল, তারপর বদ্ধ দরজায় সজোরে ধাক্কা পড়িল। হৃদ্‌যন্ত্রটাও ওই ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে চমকিয়া উঠিল; আমরা প্রশ্ন-বিস্ফারিত চক্ষে পরস্পরের পানে চাহিলাম—এ সময় হঠাৎ কে আসিল? তবে কি—

বরদার মুখে একটা ম্লান হাসি ক্রীড়া করিতেছিল; সে পূর্ণ চক্ষে আমার পানে চাহিয়া বলিল, ‘বুঝতে পারছ না?’

আমি নীরবে মাথা নাড়িলাম।

বরদা ব্যথিত অবসন্ন কণ্ঠে বলিল, ‘এখনি বুঝতে পারবে; দোর খুলে দাও—’

দ্বার খুলিয়া দিব? কিন্তু দ্বারের ওপারে কী আছে?

আবার সজোরে ধাক্কা পড়িল; বরদা আবার চোখের নীরব ইঙ্গিতে আমাকে দ্বার খুলিয়া দিতে বলিল। আমি মোহাচ্ছন্নের মতো উঠিয়া গিয়া দ্বারের হুড়কা খুলিয়া দিলাম।

অধীর হস্তে কবাট ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিল—বরদা!

বরদা বলিয়া উঠিল, ‘আরে, তোমরা এসেছ? আমি একটা কাজে বেরিয়েছিলুম—’ আমাদের মুখ দেখিয়া বরদা অর্ধপথে থামিয়া গেল।

আমরা সকলে, যে মোড়ায় বরদা বসিয়াছিল সেই দিকে ফিরিলাম। দেখিলাম, মোড়ায় যে বসিয়াছিল সে নাই—মোড়া খালি।

এই সময় বাহিরে বরদার কুকুরটা কান্নার মতো একটা দীর্ঘ একটানা সুরে ডাকিয়া উঠিল।

বরদা সেই ডাক শুনিয়া তীক্ষ্ণ চক্ষে আমাদের পানে চাহিল, তারপর ব্যগ্র কণ্ঠে বলিল, ‘অ্যাঁ! তবে কি—?’

আমি অতি কষ্টে গলা হইতে আওয়াজ বাহির করিলাম, ‘হ্যাঁ। অতিথি-সৎকারের কোনও ত্রুটি হয়নি। কিন্তু ভাই, আজ রাত্রেই আমরা বাড়ি ফিরব।’

১২ ভাদ্র ১৩৪৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *