বহুরূপী – প্রণব রায়

বহুরূপী – প্রণব রায়

মানেকরাম অ্যান্ড লছমীপ্রসাদের প্রকাণ্ড সোনালি সাইনবোর্ডখানা পার্ক স্ট্রিটের মোড়টা যেন আলো করে রেখেছে। পথের এদিকে—ওদিকে অনেকদূর থেকেই নজরে পড়ে বড় বড় ঝকঝকে সোনালি হরফগুলো, আর বিশেষ করে লাল ‘নিয়নে’ লেখা ‘জুয়েলার্স’ কথাটি। বাস্তবিক এত বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান শহরে আর নেই। শোনা যায়, ভারতবর্ষের দেশি রাজা—রাজড়ারা মানেকরাম লছমীপ্রসাদের বাঁধা খরিদ্দার। খাঁটি কমল ক্ষিরের একমাত্র ব্যবসাদার নাকি ওরাই।

নামও যেমন, দোকানও তেমনি। সামনে দিয়ে গেলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে যেতে হয় দু’পাশের বড় বড় দু’টো শো—কেসের দিকে। সন্ধ্যার পর একশো পাওয়ারের আলোয় সাজানো সোনার মাঝে মাঝে চুণি—পান্না—নীলা—হিরার টুকরোগুলো থেকে যেন লাল—নীল—সবুজ—সাদা রঙের বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। বিচিত্র ইন্দ্রধনুকে কে যেন ছড়িয়ে—ছিটিয়ে দিয়েছে দু’টো শো—কেসের মধ্যে। দেখলে ধনীর চোখ ওঠে ঝলসে, আর গরিবের চোখে ধাঁধা লেগে যায়।

আর, চোখে পড়ে দোকানের ফটকের দু’পাশে দীর্ঘদেহ পাঠান—প্রহরীর হাতে ঝকঝকে কিরীচ লাগানো দু’টো সজাগ রাইফেল।

আমাদের গল্পের শুরু এই মানেকরাম লছমীপ্রসাদের দোকান থেকেই।

গত তেরোশ’ ছাপ্পান্ন সালের ফাল্গুনী—সন্ধ্যায় ঝকঝকে একখানা ছাই রঙের প্রকাণ্ড মোটরকার এসে থামল দোকানের সামনে ফুটপাথের ধারে। ড্রাইভারের আসন থেকে নামল লম্বা—চওড়া সুপুরুষ একটি যুবক। রংটা মাজা—মাজা শ্যামল, নাকটা খড়্গের মতো উঁচু, ঘন ভুরুর নীচে চোখদু’টো খুব বড় না হলেও বুদ্ধিতে উজ্জল। দাড়ি—গোঁফ কামানো নিটোল মুখ। পরনে ধপধপে ঢিলে পা—জামা আর গিলে—আস্তিন পাঞ্জাবি। হাল্কা কমলা রঙের দামি একখানা শাল বাঁ—দিকে কাঁধের ওপর থেকে লুটিয়ে প্রায় মাটি ছোঁয়—ছোঁয়। সবটা মিলিয়ে একটা সম্ভ্রান্ত ঘরের ছাপ।

শালটা ভালো করে কাঁধে তুলে দিয়ে যুবকটি দোকানে ঢুকতেই এক মুহূর্তের জন্যে চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল। তার পরেই চাপা একটা গুঞ্জন : লালজি! লালজি!

লালজি বলে ছোকরাটি শহরে পরিচিত বটে, কিন্তু কি যে তার আসল নাম, কেউই বলতে পারে না, হয় সে নিজেও ভুলে গেছে। লোকে জানে, লালজি মস্ত ধনী বংশের সন্তান, বাপের অগাধ সম্পত্তি এখন তারই হাতের মুঠোয়। আর জানে, লালজির দরাজ হাতের মুঠো কখনও বন্ধ হয় না। হিসেবি লোকেরা আড়ালে বলে। কাঁচা পয়সার কাপ্তেন। গরিব লোকেরা তারিফ করে’ বলে, বনেদী বংশের বাচ্ছা তো! তাই টাকার ওপর দরদ নিয়ে জন্মায়নি।

এ—হেন লালজি এসেছে শহরের সেরা জুয়েলার্স মানেকরাম লছমীপ্রসাদের ঘরে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে মাথায় ভাটিয়া—টুপি পরা বেঁটেখাটো একটি বিরাট চর্বির পিণ্ড দু’হাত বাড়িয়ে সাদর আপ্যায়নের হাসি হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো : আইয়ে, আইয়ে লালজি—সাহাব! আজ আমার খুশকি সমতি, আপনার পায়ের ধুলো আজ আমার দোকানে পড়লো। ভবানীপুরে হিরালাল ভাইয়ার দোকানের সামনে যখনই আপনার গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, তখনই ভাবি, হায় রাম—এমন কি কসুর করেছি যে, লালজির পায়ের ধুলো আমাদের দোকানে একদিনও পড়ল না?

লোকটি মৃত মানেকরামের ছেলে রাজারাম। ঝানু ব্যবসাদার। দুই কানে দুটো বড় বড় হিরের টপ ছাড়া তার বেশভূষায় এবং অতি অমায়িক ব্যবহারে ধরবার যো নেই যে, এই ব্যক্তি এই কারবারের বারো আনা অংশীদার। সন্ধ্যার পর রোজ দোকানে এসে কারবার দেখাশোনা করা তার বরাবরের অভ্যাস।

কাউন্টারের সামনে সম্ভ্রান্ত খরিদ্দারের জন্যে হালফ্যাশানের সোফাসেট পাতা। রাজারাম দু’হাত কচলে হাসিমুখে বললে, মেহেরবানি করে আগে বসুন, তারপর কথা হবে। কৌচে বসতে না বসতেই একজন কর্মচারী এসে গোলাপ—ভাশ থেকে লালজির গায়ে খানিকটা গোলাপ—জল ছিটিয়ে দিল। এটা ওদের অভ্যর্থনার রীতি।

সাদা সিল্কের রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে লালজি বলল, চামেলিটাই আমি পছন্দ করি, গোলাপ—জলে আমার কেমন মাথা ধরে’ যায়।

এত বড় ধনী খরিদ্দারের আপ্যায়নে প্রকাণ্ড ভুঁড়িসমেত রাজারাম ব্যস্ত হয়ে পড়েছে : আপনি তো শুধু গাহক নন লালজি, আপনি আমার মেহমান!…এই, পান মাঙাও—সিগ্রেট মাঙাও—

লালজির পাতলা চাপা ঠোঁট দুটি অল্প হাসিতে খুলে গেল। হেসে বললে, ব্যস্ত হবেন না রাজারামবাবু, পান আমি কেয়া খয়ের ছাড়া খেতে পারি না। আমার ডিবেটা গাড়ি থেকে কাউকে আনতে বলে দিন।…হ্যাঁ, এবার কাজের কথা বলি।

বলুন।

ভক্ত হনুমানের মতো রাজারাম হাতদুটি জোড় করে দাঁড়িয়ে রইল।

দেখুন,—লালজি বলতে লাগল, জড়োয়ার সওদা আমি বরাবর হিরালালের দোকানেই করে থাকি। আমার বাপের আমল থেকে চলছে কিনা, কিন্তু হিরালালের শো—রুম ছেড়ে আজ আপনাদের দোকানে কেন এলাম জানেন কি?

গদগদ কণ্ঠে রাজারাম বললে, আপনার অনুগ্রহ।

সে—কথায় কোনো কান না দিয়ে লালজি বললে, হিরালালের জিনিস খুবই ভালো। কিন্তু ফ্যাশন, স্টাইল সব সাবেকি। হাল আমলে আর তা চলে না। শুনেছি, আপনাদের ফ্যাশান খুব আপটুডেট, আর গয়নার ডিজাইনও বেশ পছন্দসই—

লালজির মুখের কথা রাজরাম যেন লুফে নিল : তা বৈকি! ফেশন ডিজাইনে মানেকরাম লছমীপ্রসাদের তামাম শহরে একলম্বর। নইলে কি পাকইস্ট্রিটের মতো রাস্তায় দোকান চলে হুজুর?

লালজি কৌচে ভালো হয়ে বসল। বলল, ব্যাপার কি হয়েছে জানেন রাজারামবাবু, আমার এক দূর—সম্পর্কের ভাগ্নীর কাল বিয়ে। পাত্র হচ্ছে বিলতে—ফেরত, তায় জজের ছেলে—মানে একটু বিলিতি—ঘেঁষা মানুষ ওরা। তাই কিছু হালফ্যাশনের গহনা দরকার। অবিশ্যি বেশি কিছু নয়, এই ধরুন হাতের কয়েকগাছা, এক—আধটা গলার আর কানের—হ্যাঁ, বিয়ের ব্যাপার যখন, তখন যা—যা দরকার বুঝতেই তো পারছেন! মোটমাট হাজার পঁচিশ টাকার মধ্যে হলেই ভালো, দূর—সম্পর্কের ভাগ্নীকে আর কত দেওয়া যায় বলুন?

রাজারাম তখন বোধ করি মনে মনে আঁচ করছিল, দূর—সম্পর্কের ভাগ্নীর জন্যে পঁচিশ হাজার হলে লালজির নিজের ভাগ্নীর জন্যে কত হতে পারে? লাখখানেক নিশ্চয়ই! জয় হনুমানজি!

গাড়ি থেকে পানের ডিবে এসে গিয়েছিল। মিনে—করা রুপোর ডিবেটা খুলে লালজি দু’টো খিলি মুখে পুরলো। তারপর ডিবেটা রাজারামের সামনে এগিয়ে ধরে বললে, নিন।

রাজারাম হাত কচলে গদগদ স্বরে বললে, পান—হেঁ—হেঁ—হেঁ—থাক, থাক—

পকেট থেকে সোনার জর্দ্দার কৌটোটা বের করে ঈষৎ হেসে লালজি বললে, খাস লক্ষ্নৌয়ের চিজ।

আর কিছু বলতে হলো না। রাজারাম একসঙ্গে চার খিলি পান তার মুখবিবরে চালিয়ে দিলে। তারপর তিন আঙুলে বিরাট একটিপ জর্দা নিয়ে নাকের কাছে ধরে অত্যন্ত আরামের সঙ্গে ঘ্রাণ নিলে।

লালজি বললে, কিন্তু একটা কাজ আপনাকে করতে হবে রাজারামবাবু।

একমুখ পান—জর্দা নিয়ে রাজারাম ঘোঁত ঘোঁত করে যা বললে, তার অর্থ বোধ করি এই দাঁড়ায় : হুকুম করুন, বান্দা হাজির।

লালজি বলতে লাগল, আসছে বৈশাখেই আবার আমার ভাইঝির বিয়ে। (জয় হনুমানজি! ভাইঝি নিশ্চয়ই দূর—সম্পর্কের নয়, নিজেরই হবে! রাজারামের ক্ষুদে ক্ষুদে চোখ দুটো চক চক করে উঠল।) তবে বরপক্ষ পেড়াপীড়ি করলে এই ফাল্গুনের শেষ তারিখেই দিতে হবে। তাই বলছিলাম কি, আপনি আমাকে এমন সব গয়না দেখান, যার জোড়া আপনাদের তৈরি অছে। তাতে সুবিধে হবে কি জানেন, একটা সেট আজকে নিয়ে যাই—আর ফাল্গুনেই যদি ভাইঝির বিয়ে দিতে হয়, তাহলে দিনকতক পরেই আর একটা সেট নিয়ে যাব। তখন আর বাছাবাছি পছন্দর ঝামেলা থাকবে না। অবিশ্যি আপনি যদি অন্য খদ্দের পেয়ে যান, সে—কথা আলাদা—স্বচ্ছন্দে বেচে দিতে পারেন। আমার দরকার হলে না হয় নতুন করে গড়িয়ে নেওয়া যাবে, কি বলেন?

কোঁত করে পানের রস গিলে রাজারাম বললে, কুছু ভাববেন না লালজি। দু’সেট গয়নাই যখন আপনি লিবেন, তখন দোসরা খরিদ্দার এলে হামি ঘুরিয়ে দোব। আপনার মতো ক’টা খরিদ্দার মেলে?

না, না, সে কি কথা! অন্য খদ্দের এলে ফিরিয়ে দেবেন কেন? তাতে দোকানের পসার নষ্ট হতে পারে। ভালো খদ্দের পেলে গয়নার অন্য সেটটা আপনি স্বচ্ছন্দে বেচে দেবেন। আমি না হয় নতুন করে অর্ডার দোব।

আচ্ছি বাত—রাজারাম বিনয়ে নুয়ে পড়ে বলল, হুকুম করুন, জিনিস দেখাই।

সোনার হাতঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে লালজি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার আবার একটু তাড়া আছে কিনা—

শুরু হল অলঙ্কার দেখানো। আলমারি থেকে ভারে ভারে আসতে লাগল ভেলভেটে—মোড়া বাক্সর পর বাক্স। তিলমাত্র জায়গা রইলো না শ্বেতপাথরের টেবিলটার ওপর। এলো চুনি বসানো ব্রেসলেট, পান্নার কর্ণভুষা, এলো মুক্তোর কণ্ঠি, আর সাপের চোখের মতো আলো ঠিকরে—পড়া কমল হিরের নেকলেস।

রাজারামের মুখে খই ফুটতে লাগল : এই যে দেখছেন চুনি—ফোঁটা ফোঁটা তাজা খুনের মতো, এ হচ্ছে একদম আসলি পাথর। রত্নগড়ের দেওয়ান বাহাদুরের ঘরে খালি এক জোড়ি মিলবে। আর এই মুক্তোর কষ্টি—হিরালালের তামাম গদি ঢুঁড়ে কেউ বার করুক তো দেখি এমন চিজ—দেখি হিম্মত! এ মুক্তো নয় হজুর, মুক্তো নয়, সুন্দরী ঔরতের জমাট—বাঁধা চোখের জল!…আর এই দেখুন—জিনিসের সেরা জিনিস—

ঝলমলে হিরের নেকলেসটা রাজারাম আলোয় তুলে ধরলে। পাথর—গুলো থেকে নীলাভ বিদ্যুৎ ঠিকরে পড়তে লাগল।

রাজারাম বলতে লাগল, খাঁটি কমল হিরে জনাব, খাঁটি কমল হিরে। এর কদর আপনি ছাড়া আর কে বুঝবে লালজি? ঠিক এই জাতের পাথর পাওয়া যাবে শুধু বরোদার গাইকোয়াড়ের সিন্দুকে। মানেকরাম লছমীপ্রসাদ খাঁটি মাল ছাড়া কারবার করে না হজুর—আর ডিজাইনও দেখুন একদম—

রাজারামের উচ্ছ্বাস থামিয়ে দিয়ে লালজি শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, সবগুলোরই জোড়া তৈরি আছে তো?

আছে বৈকি!

বেশ, তাহলে এক সেটের দাম ফেলুন। একটু চটপট—তাড়া আছে কিনা আমার!

রাজারামের র্ধূত্ত চোখ দু’টো লোভে চকচক করে উঠল। কাউন্টার থেকে পেন্সিল আর প্যাড নিয়ে সে বললে, এক মিনিট লালজি—স্রিফ এক মিনিট—হিসেব আমার হয়ে গেল বলে!

লালজি একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাল। আটটা বাজতে সতেরো। তারপর পানের ডিবে খুলে আরও দু’টো খিলি আর একটু জর্দা মুখে পুরে দিলে।

এক মিনিট নয়, দু’মিনিট নয়, দামের হিসেব করতে রাজারামের লেগে গেল দশ মিনিটের ওপর। শ্লিপটা হাতে করে এসে বললে, সবসুদ্ধ হল চব্বিশ হাজার সাতশো’ তিপ্পান্ন টাকা। আপনার পক্ষে সামান্য।

রাজারাম পাশের কর্মচারীর দিকে ইঙ্গিত করলে। তারপর অতি অমায়িক হেসে প্রায় কানে কানে বলার মতো বললে, বিলটা করে ফেলব কি?

বিল!—লালজি সোজা হয়ে বসল। ইচ্ছে হলে বিল অবশ্য করতে পারেন রাজারামবাবু, কিন্তু আমি বলছিলাম কি, বিল করা মানেই তো সেলট্যাক্স বাবদ কতকগুলো টাকা গভর্নমেন্টের হাতে তুলে দেওয়া। আমি কিন্তু এটাকে বোকামি বলব রাজারামবাবু। জিনিস পেলাম আমি, তার বদলে টাকা পেলেন আপনি—ব্যস, মিটে গেল। এর জন্যে তৃতীয় পক্ষকে দালালি দেওয়াটা বোকামি নয় কি?

গম্ভীর মুখে রাজারাম শুধু বার দু’য়েক ঘাড় নাড়ল। তাতে ‘হ্যাঁ’ও বোঝাতে পারে, ‘না’ও বোঝাতে পারে।

লালজি বলতে লাগল, আর চব্বিশ হাজার টাকার ওপর সেলট্যাক্স ধরলে নেহাৎ অল্প টাকা হবে না। তার চেয়ে আমি বলি কি, বিলটা আর না—ই তৈরি করলেন। যা দাম হয়েছে, তার ওপর আরও কিছু ধরে পুরো পঁচিশ হাজারই আপনি নিয়ে নিন। সেলট্যাক্সের কিছুটা আমারও বাঁচল, আর আপনারও কিছু এসে গেল। কি বলুন?

হাতঘড়িটার দিকে লালজি আর একবার তাকাল। আটটা বাজতে পাঁচ।

বিনয়ে নুয়ে পড়ে রাজারাম বললে, আপনার মতো খরিদ্দারের কথা না রাখলে আমাদের কি চলে লালজি?

বেশ, বেশ। এই তো সাচ্চা কারবারির মতো কথা। পান নিন—

ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসতে হাসতে রাজারাম এক সঙ্গে আরও চার খিলি পান ধ্বংস করলে।

লালজির দৃষ্টি হাতঘড়ির দিকে। আটটা বাজতে তিন।

তাপপর বললে, সঙ্গে নগদ বেশি নেই। চেক দিই?

মাথা কাত করে রাজারাম বললে, দিন। কে না জানে, লালজির চেকে আর গভর্নমেন্টের নোটে কোনো তফাত নেই!

হাসিমুখে লালজি পাঞ্জাবির ডান পকেটে হাত চালিয়ে দিলে। তারপর বাঁ পকেটে। তারপর হঠাৎ অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বললে, কিন্তু একটা মুশকিল হয়েছে রাজারামবাবু। আমার চেকবইটা ফেলে এসেছি হোটেলে—তাই তো কি করা যায়?

তাতে কি হয়েছে?—রাজারাম আশ্বাসের সুরে বলল, সঙ্গে না হয় লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি এখন হোটেলে ফিরবেন কি?

ফিরতেই হবে, উপায় কি?—লালজি বললে।

হাতঘড়িটায় তখন কাঁটায় কাঁটায় আটটা।

কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো একটি কর্মচারীকে ডেকে রাজারাম বললে, লালজি সাহেবের সঙ্গে গিয়ে চেকটা এখুনি নিয়ে এসো। খুব হুঁশিয়ার কিন্তু—দিনকাল বড় খারাপ—

হালকা কমলা রঙের শালখানা কাঁধে তুলে দিয়ে পানের ডিবেটা নিয়ে লালজি যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একখানা দামি চকোলেট রঙের মোটর এসে থামল দোকানের সামনে। ড্রাইভার দরজা খুলে দিতেই নামল অল্পবয়সি একটি মেয়ে। ঘন সবুজ জর্জেট শাড়ির আবরণে তার সুঠাম দেহের চম্পকবর্ণচ্ছটা যেন মেঘপুঞ্জের মধ্যে সৌদামিনীর মতো বন্দিনী হয়ে আছে। দেহবর্ণ আর সর্ব অবয়বের গঠন মিলিয়ে মেয়েটিকে অসামান্যা সুরূপা বলা যায়।

সবুজ মখমলের ওপর জরির কাজ করা ভ্যানিটি ব্যাগ দুলিয়ে চঞ্চল ছন্দে মেয়েটি দোকানে ঢুকে এলো। সেদিকে তাকিয়ে লালজির মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠল। সহর্ষ বিস্ময়ে বলে উঠল, রুক্মিণী!…এসো, এসো, তুমি একেবারে ঈশ্বরপ্রেরিত! বড় সময়মতো এসে পড়েছে।—আপনার কর্মচারীকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না রাজারামবাবু, রুক্মিণী যখন এসে পড়েছো, তখন ব্যবস্থা আমি এইখানেই করে’ দিচ্ছি।….রুক্মিণীকে চেনেন তো রাজারামবাবু? চেনেন না? কী আশ্চর্য! স্যার জগদীশপ্রসাদের একমাত্র কন্যা, অল ইন্ডিয়া টেনিস চ্যাম্পিয়ন—শহরের লাইট—পোস্টগুলো পর্যন্ত ওকে চেনে, আর আপনি—

নিজের অজ্ঞতা ঢাকবার জন্যে রাজারাম তাড়াতাড়ি বলে উঠল, বটে, বটে! আমারও তাই চেনা—চেনা লাগছে। খবরের কাগজে ছবি দেখেছি কিনা! ….নমস্তে দেবীজি!

রুক্মিণীর পাতলা ঠোঁটের ফাঁকে কুন্দদন্ত দেখা গেল। লালজির দিকে তাকিয়ে বললে, আপনি এখানে? সওদা করতে বুঝি? কই, কি সওদা করলেন, দেখি!

রুক্মিণী জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল।

লালজি বললে, বিপদ দেখ! সওদা করে পকেটে হাত দিয়ে দেখি, হরি! হরি! চেকবই আনতে ভুলে গেছি। তা তুমি চেকবই সঙ্গে এনেছ নিশ্চয়ই? চট করে একখানা চেক লিখে দিয়ে আমায় কৃপা করো তো দেবী!

বঙ্কিম কটাক্ষে তাকিয়ে রুক্মিণী জবাব দিলে, কৃপা নয়, সেবা। লালজির এতটুকু সেবা করতে পেলে আমি ধন্য হই।

তারপর ভ্যানিট ব্যাগ খুলে চেকবই আর পেন বের করে’ জিজ্ঞসা করলে, কত?

লালজি বললে, পঁচিশ হাজার।

রুক্মিণী চেক লিখতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে লালজি হঠাৎ বললে, দাঁড়াও, আগে রাজারামবাবুকে জিজ্ঞাসা করে দেখি, এ চেক চলবে কিনা!

রাজারাম যেন মরমে মরে গেল। কানে হাত দিয়ে বলে উঠল, সীয়ারাম, সীয়ারাম। স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ের চেক যদি না চলে তো সরকারি নোটও চলবে না।

লালজি সহাস্যে বলল, পাকা কারবারি লোক বটে এই রাজারামবাবু। চেকটা তাহলে আপনাদের ফার্মের নামেই লেখা হোক?

খুশিতে রাজারামের ক্ষুদে ক্ষুদে চোখদুটো চর্বির স্তূপের তলায় প্রায় ঢাকা পড়ে গেল।

রুক্মিণী ততক্ষণে চেক লেখা শেষ করেছে। সেখানা রাজারামের হাতে দিয়ে লালজি বললে, ঠিক আছে?

রাজারাম শুধু গদগদ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল।

আচ্ছা চলি।—আজ রাতে বোধহয় সময় পাব না, আমার চেকখানা কাল সকালেই তোমার ওখানে যাবে রুক্মিণী। অনেক ধন্যবাদ তোমায়।

যাওয়ার জন্যে লালজি পা বাড়াতেই রুক্মিণী বলে উঠল, বারে! সওদা দেখালেন না?

লালজি বললে, সওদা সামান্যই। খুলে দেখতে পার।

লালজির ইঙ্গিতে কর্মচারীটি প্যাকেট খুলে একে একে সব দেখালো। ঝলমলে অলঙ্কারগুলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রুক্মিণী বললে, ভারি সুন্দর তো! আপনার পছন্দ আছে লালজি।

সূক্ষ্ম একটু অর্থপূর্ণ হাসি লালজির চাপা ঠোঁটে দেখা দিল।

সত্যিই আমার পছন্দ আছে। কিন্তু আর নয়, বিয়েবাড়ি যাবার তাড়া আছে আমার।—বলে লালজি এগোল। সঙ্গে সঙ্গে কর্মচারীটি গেল প্যাকেটটা আর পানের ডিবে গাড়িতে তুলে দিতে।

ছাই রঙের গাড়িখানা সাঁ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রুক্মিণী রাজারামকে বলল, দেখুন, লালজি যে সমস্ত অলঙ্কার নিয়েছেন, আমারও কিন্তু ঠিক ওই জিনিস একসেট চাই। ডিজাইনগুলো ভারী পছন্দ হয়েছে আমার।

দু’হাত কচলে রাজারাম সবিনয়ে নিবেদন করল, ওই সব অলঙ্কার আর মাত্র একসেটই আছে। কিন্তু লালজি তাঁর ভাইঝির বিয়ের জন্যে সেগুলো রাখতে বলে গেছেন।

রুক্মিণী কেমন যেন উদাসীন কণ্ঠে বললে, লালজিকে যদি আপনি কথা দিয়ে থাকেন, তাহলে আর উপায় কি বলুন? তবে অলঙ্কারগুলো আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আচ্ছা—

কৌচ থেকে রুক্মিণী উঠে দাঁড়াল। এত বড় খরিদ্দার হাতছাড়া হয় দেখে রাজারাম শশব্যস্তে বলে উঠল, না, না, কথা—টথা কিছু দিইনি। আর দিলেই বা কি, স্যার জগদীশ প্রসাদের মেয়ের যখন পছন্দ হয়েছে, তখন আমাকে দিতেই হবে—আলবৎ দিতে হবে—

সেটা আপনার ইচ্ছে।—রুক্মিণীর মুখে তেমনি উদাসীনতা।

রাজারাম বললে, জিনিসগুলো তাহলে দেখে দিন।

আলমারি থেকে এল তেমনি চুনির ব্রেসলেট, পান্নার কর্ণভূষা, মুক্তোর কণ্ঠি, কমল হিরের নেকলেস। রুক্মিণী একবার দেখে নিয়ে বললে, জিনিসগুলো গাড়িতে তুলে দিতে বলুন, আর বিল করুন।

প্রকাণ্ড কচ্ছপের মতো বিপুল দেহ দুলিয়ে রাজারাম প্রায় ছুটেই কাউন্টারে গেল বিল করতে। রুক্মিণী তখন ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে ছোট্ট একটি আর্শি মুখের সামনে ধরে পাউডার—পাফটা মুখে একবার বুলিয়ে নিল। তারপর আর্শি আর পাফটা ভ্যানিটির ভেতর রাখল। সঙ্গে সঙ্গে চেকবই আর পেন।

রাজারামের তখন বিল করা হয়ে গেছে। পুরো সেলট্যাক্স নিয়ে মোট দামটা পঁচিশ হাজারের খানিকটা বেশি হল। বিলখানার ওপর চোখ বুলিয়ে রুক্মিণী বললে, বাঃ! আমার বেলায় বিলটা বেশি হয়ে গেল? অথচ লালজি যা নিয়েছেন, আমিও ঠিক তাই নিয়েছি। চমৎকার বিচার আপনার রাজারামবাবু!

অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে রাজারাম মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, মানে—ইয়ে হয়েছে—লালজির বেলায় সেলট্যাক্সটা—

রুক্ষ্মিণী ঈষৎ কঠিন কণ্ঠে বললে, আমি পঁচিশ হাজারের এক পয়সাও বেশি দোব না। যান, বিলটা ঠিক করে আনুন।

আমতা আমতা করে রাজারাম কি যেন বলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু কিছুই বলা হল না। সামান্য কয়েকশো টাকার লোভ করতে গিয়ে পঁচিশ হাজার টাকার দাঁও ফসকাবে, এমন গর্দভ রাজারাম শেঠ নয়। অতএব সুবোধ বালকের মতোই বিলটাকে সে কেটে—ছেঁটে আনে।

বিলটা হাতে নিয়ে একনজর দেখে রুক্মিণী বললে, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে।

তারপর সবুজ মখমলে মোড়া ভ্যানিটি ব্যাগটি খুলে, বিলটিকে সযত্নে রেখে ঋজু ভঙ্গীতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। পেছন পেছন গিয়ে রাজারাম অমায়িক বিনয়ে বললে, চেকটা—

একটা ঘূর্ণিপাক দিয়ে রুক্মিণী ঘুরে দাঁড়াল। রুদ্ধ নিঃশ্বাসে রাজারাম প্রত্যাশা করল, রুক্মিণী এইবার সলজ্জমুখে মার্জনা ভিক্ষা করবে—হয়তো বা একটু মিঠা হাসির সঙ্গে বলবে, ইস! কি ভুলো মন আমার! আর সে—কথার উত্তরে রাজারাম ভদ্রতায় বিগলিত হয়ে বলবে, তাতে কি হয়েছে!

কিন্তু না, রুক্মিণীর মুখে—চোখে কোথাও লজ্জার রক্তিমা বা কুণ্ঠার জড়িমা নেই। একটা দৃপ্ত—কঠিন ভঙ্গিতে মুখ তুলে স্পষ্টগলায় সে প্রশ্ন করল, কিসের চেক?

রাজারাম যেন একটা ধাক্কা খেলো। ঢোক গিলে বললে, মানে— গয়নাগুলোর দরুন—

সোজা জবাব এল, সে—চেক তো আগেই দিয়েছি। পুরো পঁচিশ হাজার।

হতভম্বের মতো রাজারাম এক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। তারপর পানের রস—মাখানো পুরু নীচের ঠোঁটটা ঝুলে পড়ল বোকার মতো। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে শুধু বলল, সে তো লালজির দরুন—

লালজিকে আমি চিনি না।

কথাগুলো বোমার কয়েক টুকরো ‘স্পিলনটারের’ মতো প্রচণ্ডবেগে বিঁধলো রাজারামের হৃদপিণ্ডে। একপলকে মাথার ভেতরটা তার গোলমাল হয়ে গেল। ছুঁড়িটা কি দিল্লাগি করছে? না অন্য কোনো মতলব? কিন্তু স্যার জগদীশপ্রসাদের মতো সরিফ আদমীর মেয়ে—! গলায় যথাসম্ভব জোর এনে রাজারাম বললে, বড়ি তাজ্জবকি বাৎ! এই একটু আগে লালজির সঙ্গে আপনি কথা কইলেন, তাঁর হয়ে চেক দিলেন, আর এখন বলছেন লালজিকে চিনি না? চিনুন বা না—ই চিনুন, মাল নিয়েছেন, দাম দিয়ে যান। নইলে গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে নিতে বাধ্য হবো।

তীক্ষ্ন বিদ্রুপের হাসিতে রুক্মিণীর আরক্ত ঠোঁট দুটি দ্বিধাবিভক্ত হল : বেশ, পারেন তো নামিয়ে নিন।

রাজারাম হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো চকোলেট রঙের সেই গাড়িখানার দিকে। কিন্তু হরি—হরি, গাড়ির মধ্যে অলঙ্কারের প্যাকেটও নেই, ড্রাইভারও নেই।

পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে রাজারাম ফিরে এলো।

এ জুয়াচুরি—আমি পুলিশে ফোন করব—লালবাজার থেকে কমিশনার ডাকব—বলব, আমায় ঠকিয়েছে—পঁচিশ হাজার টাকার গহনা ঠকিয়ে নিয়েছে—হায় হনুমানজি—হায় রাম!

টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে রাজারাম পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগল : হ্যালো…পার্ক স্ট্রিট থানা—

গোলমালে দোকানের কর্মচারীরা ভীত সন্ত্রস্তভাবে চারপাশে ভীড় করে দাঁড়াল। কে একজন বললে, দরোয়ান, ফটক বন্দ করো—

খটাস করে একটা ধাতব আওয়াজ হল। রুক্মিণী দেখতে পেলে, ফটকের দু’পাশে দণ্ডায়মান পাঠান—প্রহরীদের হাতে ঝকঝকে সঙ্গীন দুটো আড়াআড়িভাবে দরজার পথ আগলে রয়েছে!

রুক্মিণী একেবারে রাজারামের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর সতেজ কঠিন কণ্ঠে বললে, থামুন!

সে—কথায় কান না দিয়ে রাজারাম উন্মত্তের মতো বললে, পুলিশ এলে আমি সব কথা জানাবো—স্যার জগদীশপ্রসাদের বেটিকে জেল খাটিয়ে ছাড়বো, তবে আমার নাম রাজারাম।

আরক্ত ঠোঁট দুটির ওপর সূক্ষ্ম বিদ্রুপের হাসি আবার দেখা দিল। রাজারামের মোটা ভাঙা গলার আওয়াজ ছাপিয়ে রুক্মিণীর মিহি গলা উঁচু পর্দায় শোনা গেল : তার আগে জেনে রাখুন, একজন ভদ্রমহিলাকে অনর্থক হয়রান করার জন্যে শাস্তি আপনাদেরই পেতে হবে। পুলিশ এলে আমি এই কথাই বলব যে, পঁচিশ হাজার টাকা অলঙ্কারের জন্যে আপনাদের ফার্মের নামে পুরো পঁচিশ হাজার টাকার চেক আমি সই করে দিয়েছি। সে—চেক রয়েছে আপনার কোটের পকেটে, আর তার বিলও রয়েছে আমার এই ব্যাগের মধ্যে। তবু আমাকে আপনারা যথেষ্ট হয়রান করেছেন। পুলিশ এলে আপনাদের এই বেয়াদবি আমি কিন্তু মাপ করবো না—ড্যামেজের মামলা করব আপনাদের নামে।

দোকানের গোলমাল এক মুহূর্তে ডুবে গেল স্তব্ধতায়।

রাজারামের হাত থেকে রিসিভারটা খসে পড়ে গেল। ডান হাতের মুঠোয় সেটা ধরে রুক্মিণী অতি মধুর গলায় বলল, পুলিশে ফোন কি এবার আমিই করব রাজারামবাবু? না সেপাইদের দরজাটা ছেড়ে দিতে বলবেন?

বাক্যহত স্তম্ভিত রাজারামের কপালে এই ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে! শুকনো ঠোঁট দুটোকে জিভ দিয়ে চেটে সে শুধু কোনোমতে উচ্চারণ করলো : দরওয়াজা ছোড় দো!

আবার খটাস করে আওয়াজ হল। ঝকঝকে সঙ্গীন দুটো দরজার দু’পাশে গেল সরে’।

আবার সেই তীক্ষ্ন বিদ্রুপের হাসিতে রুক্মিণীর আরক্ত ঠোঁট দুটো দ্বিধাবিভক্ত হল।

বিপর্যস্ত ঘর্মাক্ত রাজারামের দিকে নিতান্ত অবজ্ঞাভরে একবার তাকিয়ে রুক্মিণী শুধু বললে, নমস্তে। তারপর দর্পিত পদক্ষেপে দোকান থেকে বেরিয়ে নিজেই গাড়িতে স্টার্ট দিল।

রাজারাম তখনও মূঢ়ের মতো সেদিকে তাকিয়ে। চকোলেট রঙের গাড়িখানা চোখের আড়াল হতেই রাজারাম তার বিপুল চর্বির পিণ্ড সমেত ধপ করে কৌচে বসে পড়ে বললে, ঠান্ডা পানি!

চকোলেট রঙের প্রকাণ্ড মোটরখানা এসে দাঁড়াল ওয়েলেসলির এক কফি হাউসের সামনে। দরজার পাশে দাঁড় করানো একটা বোর্ডে বড় বড় রঙিন ইংরেজি আর উর্দু হরফে লেখা :

বিশেষ নাচের আসর

জোহরা বাঈ

আজ রাত্রি দশটায়

পাড়াটা বিশেষ অভিজাত নয়, মুসলমান আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাই বেশি এখানে। কিন্তু পাড়াটা অভিজাত না হলেও কফি হাউসটির চটক খুব। শুধু কফিই এখানকার আকর্ষণ নয়, এর প্রধান আকর্ষণ হল হলের মাঝখানে উঁচু নাচের স্টেজ আর দু’পাশে সারি সারি কেবিনগুলো। রাত্রি আটটার পর এই স্টেজের ওপর যখন বিলাসিনী সুন্দরী নর্তকীদের নৃত্যের নমে অঙ্গ—প্রদর্শনী শুরু হয়, তখন দু’পাশের কেবিনগুলো থেকে সোডার বোতল খোলার আওয়াজ পাওয়া যায়। এর জন্যে দোকানের মালিকের কোনো লাইসেন্স রাখার প্রয়োজন হয় না কেন, এ প্রশ্ন আপনারা বরং শহরের পুলিশ—কমিশনারকে করে দেখবেন।

বলা বাহুল্য ওয়েলেসলির এই কফি হাউসটি শহরের মতো নিশাচরের একটি বিশেষ আড্ডা।

চকোলেট রঙের গাড়িটা থেকে ঘন সবুজ জর্জেট শাড়িপরা একটি মেয়েকে আমরা নামতে দেখলাম। মুখে কালো রঙের পাতলা নেটের সূক্ষ্ম আবরণ।

স্টেজের ওপর তখন অর্কেস্ট্রা সহযোগে একপাল ‘ব্যালে’র নৃত্য সবে শুরু হয়েছে। ওয়েলেসলির কফি হাউস তখনও ভালোভাবে জমেনি। হল ভর্তি হয়ে যায় সাধারণত রাত্রি দশটার পর।

কালো রঙের ঘোমটা ঢাকা মেয়েটি হলের ভেতরে প্রবেশ করতেই ওধার থেকে অল্প দাড়িওলা একজন বয় কফির খালি পেয়ালা হাতে তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে নীচু গলায় বলে গেল, সাত নম্বর কেবিন।

মেয়েটি একবার হলের চারপাশ লক্ষ করল। তারপর সোজা গিয়ে সাত নম্বর কেবিনের পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে এক পেগ ‘জিন’ নিয়ে যে ব্যক্তিটি বসেছিল, দেখতে সে হুবহু আমাদের পূর্ব—পরিচিত লালজির মতো। তফাতের মধ্যে শুধু মুখের সূচলো একজোড়া ভ্রমর—কালো গোঁফ, চোখে একজোড়া নীল গগলস আর মাথায় জরির কাজ করা লক্ষ্নৌয়ি টুপি। একটা সিগারেট ধরাবার জন্যে লোকটি দেশলাই জ্বেলেছিল। মেয়েটি ঢুকতেই জ্বলন্ত কাঠিটা ফেলে দিয়ে বলল, এসো জোহরা, একটু দেরি হয়ে গেছে তোমার!

মেয়েটি একটা চেয়ারে বসে পড়ে আস্তে আস্তে মুখের কালো আবরণটা উন্মোচন করল। আমরা যা ভেবেছিলাম, তাই। মেয়েটি রক্মিণী। কিন্তু কফি হাউসে তার পরিচয় জোহরা বাঈ।

লোকটির মুখ থেকে সিগারেটটা নিয়ে জোহরা নিজের মুখে দিয়ে জ্বালালো। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললে, দেরি হওয়ারই কথা। কাজটা সহজ ছিল না লালজি।

বটে?

মাহাঙ্গু ড্রাইভার এসেছিল?

হ্যাঁ, জিনিসগুলো দিয়ে গেছে।

কোথায় সেগুলো?

লালজি আর একটা সিগারেট ধরাচ্ছিল। ইশারায় টেবিলের ওপর একটা ছোট অ্যাটাচি—কেস দেখিয়ে দিল।

লালজির হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোহরা বললে, এবার আমি গ্রিনরুমে যাই। দশটায় আমার নাচের প্রোগ্রাম আছে।

লালজি বললে, আমিও উঠবো।

কোথায় যাবে?

জিনিসগুলো আজ রাত্রেই বেচে ফেলতে হবে। টাকার বড় দরকার জোহরা। জিনের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে অ্যাটাচি—কেস হাতে লালজি উঠে দাঁড়ালো।

জোহরা হঠাৎ পিছু ডাকলে, লাল—

লালজি ফিরে তাকাতেই তার বুকের একান্ত সন্নিকটে এসে জোহরা চাপা গলায় বললে, খুব সাবধানে চলাফেরা করবে লাল—

হঠাৎ একথা?

পঁচিশ হাজার টাকার শোক রাজারাম চট করে ভুলতে পারবে না। পুলিশে খবর দেবে নিশ্চয়ই।

লালজি একটা ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বললে, হিসেবে একটু ভুল হচ্ছে জোহরা। পঁচিশ হাজার নয়, পঁচিশ আর পঁচিশ—পঞ্চাশ হাজার।

জোহরা সবিস্ময়ে চাইল : একথার মানে?

মানে, আমার যে চেকবইটা তুমি মানেকরাম লছমীপ্রসাদের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলে, সেটা তিন বছর আগে বাতিল হয়ে গেছে। সুতরাং রাজারামের হাতের চেক রাজারামের কাছেই ফিরে আসবে।

কিন্তু ওরা যদি কেস করে?

কেস করলে, স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ে রুক্মিণীর নামেই করবে। তুমি জোহরা বাঈ—তোমার ভয় কিসের?—লালজি পর পর তিনটে ধোঁয়ার রিং ছাড়লে। তারপর আবার বললে, হ্যাঁ, চেকবইটা সাবধানে রেখো—দরকার হলে না হয় পুড়িয়ে ফেলো।

ফেলবো। কিন্তু তুমিও সাবধানে থেকো লাল। আজ কদিন থেকে দেখছি দু’একটা নতুন মুখ কফি হাউসে আনাগোনা শুরু করেছে—খুব সম্ভব পুলিশের লোক।

সেই পরিচিত সূক্ষ্ম বুদ্ধিদীপ্ত হাসি লালজির ঠোঁটে দেখা গেল। বাঁ—দিকের ভুরু তুলে জোহরার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করল। তারপর সিগারেটের টুকরোটা ফেলে, জুতোর আগা দিয়ে মাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। ভারী পর্দাটা উঠলো দুলে।

সেইদিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জোহরা ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো। আজও তাকে লাল ঠিকমতো বুঝতে পারল না, না পারল সে নিজেকে ঠিকমতো বোঝাতে।

কালো রঙের পাতলা আবরণটা মুখের ওপর ফেলে জোহরা বেরোল কেবিন থেকে। গ্রিন—রুমে গিয়ে এখুনি তৈরি হতে হবে। আজ রাত দশটায় তার নাচের প্রোগ্রাম।

পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসারের সামনে রাজারাম তখন নাকের জলে চোখের জলে একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

দু’জনের প্রত্যেকেই পঁচিশ হাজার টাকার মাল নিয়ে গেছে, বলছেন?

জি হাঁ। একই ডিজাইনের অলঙ্কার।

দু’জনে একসঙ্গে এসেছিল?

জি না। আগে লালজি, তারপর রুক্মিণী।

চেকটা কে দিয়েছে?

লালজি।

চেকটা হাতে নিয়ে দারোগা ভুরু কুঁচকে বললেন, কিন্তু সই তো দেখছি রুক্মিণী দেবীর?

থতমত খেয়ে রাজারাম বললে, চেকটা রুক্মিণী দেয় লালজিকে, লালজি দেয় আমাকে।

তাহলে কার দেওয়া হল?

রুক্মিণীর—না, না, লালজির—

দারোগা ধমকে উঠলেন, ঠিক করে বলুন—

আরো থতমত খেয়ে রাজারাম একেবারে গোবরগণেশ হয়ে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলে বললে, মাথার কি আর ঠিক আছে দারোগা সাহেব? ছুঁড়িটা একেবারে পথে বসিয়ে গেছে আমাকে।

আপনি ঠিক জানেন যে, সেই মেয়েটিই স্যার জগদীশপ্রসাদের মেয়ে?

জি না। তা ঠিক জানি না। তবে চেহারাটা, খবরের কাগজে জগদীশপ্রসাদের মেয়ের যে ছবি দেখেছি, অবিকল তাই—মায় চিবুকের ওপর কালো তিলটা পর্যন্ত।

বটে! আগে কখনও দেখেছেন?

জি না।

আচ্ছা, লালজিকে কতদিন জানেন আপনি?

তিন—চার সাল হবে।

তাকে কিরকম লোক মনে হয় আপনার?

লোক তো ভালোই মনে হোত, তবে আজকের ব্যাপারটার পর আমার সন্দেহ হচ্ছে—আমি বলছি দারোগাসাহেব রুক্মিণীর সঙ্গে লালজিরও নিশ্চয় যোগসাজশ আছে। বেমালুম চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ল!..হায় রাম, এই দুনিয়া কেবল জুয়াচোরে ভর্তি।

মোটর দু’খানার নম্বর নিয়েছেন?

জি না। তবে লালজির গাড়িখানা ছাই রঙের মাস্টার বুইক, আর রুক্মিণীর গাড়ি চকোলেট রঙের—বোধ হয় হাডসন।

আচ্ছা, আপনি এখন যেতে পারেন শেঠজি।

দারোগা তাঁর কাগজপত্রের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। ক্লান্ত—ক্লিষ্ট রাজারাম ফোস করে জলহস্তীর মতো একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল। দরজার ওপাশ থেকে শুধু তার খোদোক্তি শোনা গেল : হায় রাম!

রিপোর্ট লেখা শেষ করেই দারোগা টেলিফোনের রিসিভার হাতে নিলেন।

হ্যালো…বিশ্ববার্তা অফিস…হ্যাঁ, রমলা সেনকে চাই, রিপোর্টার রমলা সেন…পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে বলছি।…হ্যাঁ, আমি গুপ্ত…একটা ভারী ইন্টারেস্টিং কেস এসেছে রমলা, সময় করে একবার এসো…কেসটা?…৪২০!

আর সেই রাত্রে ঠিক সেই মুহূর্তে ছাই রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানা এসে থামল বড়বাজারে কটন স্ট্রিটের মুখে।

গাড়ি থেকে নামল চোখে নীল গগলস—আঁটা হাতে ছোট অ্যাটাচি—কেস সমেত কফি হাউসে দেখা লালজির সেই পরিচিত মূর্তি। রাত সাড়ে দশটার পর কটন স্ট্রিটের অঞ্চল জনবিরল হয়ে এসেছে। এদিক—ওদিক তাকিয়ে লালজি গাড়ির কাচ তুলে দরজা লক করে দিল। তারপর কিছুদুর এগিয়ে বাঁ—দিকে ইট—বাঁধানো একটা সরু গলিপথ ধরলে। কাশীতে বাঙালিটোলার গলি যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কটন স্ট্রিটের এই বাইলেনটির চেহারা খানিকটা বুঝতে পারবেন। দু’পাশে তেমনি উঁচু উঁচু বাড়ি। সেই অন্ধকার গলিপথে গ্যাসবাতির কোনো চিহ্নই নেই, কিন্তু আশ্চর্য, লালজি অত্যন্ত সহজভাবে হেঁটে যেতে লাগল।

বাই—লেনটটা যেখানে একটা অত্যন্ত পুরানো তিনতলা বাড়ির দরজায় এসে শেষ হয়েছে, সেইখানে পৌঁছে লালজি ওপর দিকে তাকিয়ে দু’বার শিস দিলে। মিনিটখানেক পরে তেতলার একটা খড়খড়ি জানলা খুলে গেল। অন্ধকারে আবছা একটা মুখ উঁকি দিয়ে খনখনে গলায় উর্দু ভাষায় জিজ্ঞাসা করল, এত রাত্রে কে ডাকে?

নীচে থেকেও চোস্ত উর্দুতে জবাব হলা মারিজ! অর্থাৎ রোগী। ডাক্তারকে চাই।

কেসটা কি?

ডেলিভারি।

খড়খড়ি—দেওয়া জানলাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

একটু পরেই লোহার পাত—মারা সদর দরজার ভারী কাঠের পাল্লা দুটো বিশ্রী আওয়াজ করে একটু ফাঁক হল। আর সেই দ্বারপথে দেখা দিল চর্বির—বাতির একটুকরো হলদে আলো, আর অদ্ভুত একটা মুখ। বিলিতি থিয়েটারে ‘শাইলক ইহুদি’র ভূমিকায় অভিনেতাদের যে রূপসজ্জায় দেখা যায়, অবিকল তেমনি। সরু ছুঁচলো মুখে পাতলা কটা রঙের দাড়ি—গোঁফ, মাথায় কালো ভেলভেটের গোল টুপি, নাকটা কাকাতুয়ার ঠোঁটের মতো বাঁকা, আর দুই চোখে ধূর্ত শেয়ালের মতো লোভ, সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বাসা।

চর্বি—বাতির আলোয় আরও একটা জিনিস দেখা গেল। দরজার ডান দিকের আঁটা একটা কাঠের ফলকে হিন্দিতে লেখা :

পার্শি ডাক্তার

ফিরদৌস ইরানি

স্ত্রী ও শিশুরোগে বিশেষ পারদর্শী

বাতিটা লালজির মুখের সামনে তুলে ধরে গোল টুপিওলা লোকটি খনখনে গলায় বললে, এত রাত্রে যে!

বাঁ—দিকের ভুরু তুলে লালজি জবাব দিলে, তোমার মতো ডাক্তারের কাছে রোগীদের এই তো আসার সময়।

কেসটা কি খুব জরুরি?

নিশ্চয়ই! খুবই জরুরি ইরানি সাহেব।

ইরানি সাহেব হাসলে। লোকটার সামনের দুটো দাঁত নেই। দন্তহীন মুখে হেসে ডাঃ ফিরদৌস ইরানি বললে, তাহলে এসো—ভেতরেই এসো লালজি।

লালজি ইরানিসাহেবকে অনুসরণ করলে।

তেতলায় নিজের ঘুরে ঢুকে ইরানি সাহেব আগে দরজার খিল বন্ধ করলে। তারপর বাতিটা টেবিলের ওপর রেখে লালজিকে বললে, বসো!

ঘরখানা ডাক্তারের ঘরই বটে। গোটা তিন—চার আলমারি মোটা মোটা ডাক্তারি বইয়ে ঠাসা। একপাশে একটা বড় কাঠের র‌্যাকের ওপর নানারঙের ওষুধের শিশি—বোতল, খল, মেজার—গ্লাস, মাঝখানে বনাতমোড়া একটা টেবিল আর গোটা দুই—তিন চেয়ার। ঘরের বাকি অর্ধেকটা লম্বা পর্দা খাটিয়ে শয়নকক্ষ করা হয়েছে। সেদিকটায় আছে কম্বলপাতা একটা নেয়ারের খাট আর তার শিয়রে একটা রঙচটা লোহার সিন্দুক। সিন্দুকের ঠিক ওপরেই দেয়ালে ঝুলছে একটি আস্ত নরকঙ্কাল। সিন্দুকের ওপর একটা পিতলের ধূপদানি থেকে অল্প অল্প সুগন্ধ ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।

পর্দাটা সরিয়ে ইরানি সাহেব বললে, এইখানে বসো।

লালজি এসে খাটের ওপর বসলো। জপের মালা হাতে কালো আলখাল্লাপরা ইরানি সাহেব কাছে এসে দাঁড়াল সিন্দুকটায় হেলান দিয়ে। একটা সিগারেট ধরিয়ে লালজি বললে, তোমার এখানে আগেও কয়েকবার এসেছি ইরানি সাহেব, কিন্তু একটা কথা জানা হয়নি। ওই কঙ্কালটিকে মাথার শিয়রে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন?

ইরানি সাহেব একবার ফিরে তাকাল। তারপর জপের মালার সাদা—কালো কাচের গুটিগুলো নাড়তে নাড়তে বললে, লোহার সিন্দুকটা সারারাত পাহারা দেয় যে! ধূপ—ধুনো জ্বালিয়ে সারারাত ওকে জাগিয়ে রাখতে হয়।

লালজির মুখে কৌতুকের একটু হাসি দেখা দিল। বললে, ওঃ! ওইটি তাহলে তোমার পাহারাদার? আমি ভেবেছিলাম, তোমার পূর্বপুরুষদের কেউ।

অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে ইরানি সাহেব ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, আমার পূর্বপুরুষরা সাধু ব্যক্তি ছিলেন।

বটে! সে তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। আচ্ছা ইরানি সাহেব, তোমার তো তিনকূলে কেউ নেই বলেই শুনেছি। এই লোহার সিন্দুকটিকে যখের মতো আগলে থাকো কেন বলত? কার জন্যে?

ইরানি সাহেব অন্য দিকে তাকিয়ে রইল, জবাব দিল না। হাতের মালা দ্রুত ঘুরতে লাগল।

কই, জবাব দিলে না? তুমি মরলে, কে ভোগ করবে তোমার এত টাকা?

এবার ইরানি সাহেব মুখ ফিরিয়ে বললে, সে—কথা আর একদিন তোমায় বলব লালজি। আজ থাক। কাজের কথা বলো।

কিছু মাল এনেছি বেচতে। নগদ টাকা চাই—আজই—এখুনি—

দন্তহীন মুখে ইরানি সাহেব হাসলে। বললে, বেশ, আগে মাল দেখাও, দরদস্তুর হোক—

লালজি অ্যাটাচি—কেসটা খুলে ফেললে। চুণি—পান্না—হিরে—মুক্তোগুলো চর্বিবাতির আলোয় রঙিন ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করল। ইরানি সাহেবের ধূর্ত চোখ দুটো চকচক করে উঠল। ছিলাছেঁড়া ধনুকের মতো সিধে হয়ে গেল আলখাল্লাপরা শীর্ণ ন্যুব্জদেহ। হাতের মালা গেল থেমে।

এগিয়ে এসে অলঙ্কারগুলো বাতির আলোয় নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে ইরানি সাহেব বললে, হুঁ, জিনিসগুলো মন্দ নয়, নিতে পারি। কি দামে ছাড়বে?

তুমিই বল।

নিতান্ত নির্লিপ্তের মতো মুখ ঘুরিয়ে ইরানি সাহেব জবাব দিলে, সব মিলিয়ে হাজার দশেক।

বিশ হাজারের এক পয়সা কম নয়,—লালজি বললে।

দন্তহীন মুখে ইরানি সাহেব আবার হাসলে : বিশ হাজার? বিশ হাজার কত টাকা জান?

একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে লালজি বললে, জানি। বড়লোকের এক সপ্তাহের খরচ, আর গরিবের সারা জীবনের স্বপ্ন। যাক সে—কথা, তুমি দেবে কিনা বলো।

ইরানি সাহেব ঘুরে গিয়ে আবার সিন্দুকে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। ঘুরতে লাগল হাতের মালা। উদাসীন কণ্ঠে শুধু বললে, দশ হাজারের এক পাই বেশি না।

ও, আচ্ছা।

অ্যাটাচি—কেসটা বন্ধ করে লালজি উঠে দাঁড়াল। বললে, তোমার মতো ডাক্তার শহরে আরও দু’দশজন আছে। তাদের কাছেই যাই তাহলে।

এগিয়ে গিয়ে দরজার খিলটা খোলবার জন্যে হাত বাড়াতেই পেছন থেকে খনখনে গলায় ডাক এলো : শোনো, শোনো!

ফিরে না তাকিয়ে লালজি বললে, আমার সময় বড় কম।

শুনেই যাও না।

লালজি ঘুরে দাঁড়াল : বল।

দেখ, নেকলেসের হিরেগুলো ঠিক খাঁটি নয়, আর মুক্তোগুলো ঝুটো—

লালজি বললে, চোখে তোমার ছানি পড়েছে ইরানি সাহেব।

যাকগে, দশের ওপর নাহয় আরও পাঁচ দিচ্ছি—জিনিসগুলো রেখে যাও। হাতের টাকা ছাড়তে নেই লালজি।

সিগারেটের টুকরোটা পা দিয়ে ঘষে লালজি জবাব দিলে, হাতে টাকা এলে লালজি ছেড়েই দিয়ে থাকে, তোমার মতো সিন্দুকে ধরে রেখে ভূতের পাহারা বসায় না।…সময় আমার বড় কম ইরানি সাহেব। পঞ্চাশ হাজার টাকার মাল মাত্র বিশ হাজারে দিতে চাইছি, আজ টাকার নিতান্ত দরকার বলে। নইলে পঁচিশ—তিরিশ হাজারে অনায়াসেই বেচতে পারতাম। কিন্তু আর দেরি করতে পারব না, লেন—দেন মিটিয়ে ফেলতে হয় তো এখুনি মিটিয়ে ফেলো।

আলখাল্লার পকেট থেকেই ইরানি সাহেব চাবি বের করে সিন্দুক খুললে। তারপর অ্যাটাচি—কেস থেকে অলঙ্কারগুলো ভেতরে রেখে কতকগুলো নোটের তাড়া খাটের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বিড় বিড় করে বকতে লাগল : বিশ হাজারে কিনলে আমার কি থাকবে বল? ডাহা লোকসান হয়ে যাবে দেখছি!….

ক্ষিপ্রহাতে নোটের তাড়াগুলো খালি অ্যাটাচি—কেসে পুরতে পুরতে লালজি শুধু বললে, ঠিক আছে তো? গুনে নিলাম না কিন্তু! তুমি আবার সাধু পূর্বপুরুষদের বংশধর কিনা!

সিন্দুকটা আবার চাবিবন্ধ করতে করতে ইরানি সাহেব বললে, চোরে—চোরে কখনও বেইমানি করে না।

লালজি একবার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। তারপর দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললে, আবার দেখা হবে।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ ক্রমশ মিলিয়ে গেল।

আবার সেই রাত্রে—

রাত প্রায় বারোটা বাজে।

মানিকতলা হালসিবাগানের রাস্তা তখন একেবারে নির্জন হয়ে এসেছে। ১৭/১বি, বাড়িটার নীচেকার একটি জানলা তখনও খোলা। ভেতরে হ্যারিকেন লণ্ঠনের আলো তখনও জ্বলছে দেখা গেল। গল্পের পরবর্তী ঘটনার জন্যে আমাদের এই ঘরেই যেতে হবে।

দৈর্ঘ্যে—প্রস্থে ঘরটাকে ছোটই বলতে হবে। নিতান্ত মধ্যবিত্ত গৃহস্থ—ঘরের চেহারা যা হয় তাই। সাজানো আছে, তবে সজ্জা তেমন বিশেষ কিছু নেই। অতি পুরাতন একটা ক্যাম্বিসের চেয়ারে বসেছিলেন হরলাল চাটুয্যে। বয়স পঞ্চাশের ওপর গেছে। বহু ঝড়—ঝাপটা খেয়ে যে—জাহাজ ভাঙা হাল আর ছেঁড়া পাল নিয়ে কোনোরকমে বন্দরে এসে ভিড়েছে, ভদ্রলোকের চেহারাটা তারই অনুরূপ। অদূরে তক্তাপোশের ওপর বসে তাঁর স্ত্রী। শীর্ণ মুখে জ্বলজ্বলে একটি সিঁদুর—টিপ ছাড়া আর কোনো আভরণ তাঁর নেই।

হরলালবাবু গড়গড়ার রবারের নলটা মুখে দিয়ে তামাক টানার নামে মাঝে মাঝে শুধু আওয়াজ করছিলেন। কলকের তামাক বহুক্ষণ আগেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রাচীন একটা জাপানি ওয়ালক্লক টক টক আওয়াজে সময়ের বুকে দুর্বলভাবে হাতুড়ি পিটে চলেছে। শুধু সময়ের বুকে নয়, হরলালবাবু আর তাঁর স্ত্রী বিরজা দেবীর বুকেও।

বিরজা দেবী বললেন, হ্যাঁগা, এখনও তো এল না?

আসবে, আসবে। হরলালবাবু অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন।

ঠিক আসবে তো?

তাই তো বলেছিল।

মুখ থেকে রবারের নলটা ফেলে, ঘরের অপরিসর জায়গাটুকুতে হরলালবাবু পায়চারি শুরু করলেন। দুই হাত পিছন দিকে পরস্পর—বদ্ধ। সেইদিকে তাকিয়ে বিরজা দেবী একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।

জাপানি ওয়ালক্লক সময়ের বুকে হাতুড়ি পিটে চলেছে।

বিরজা দেবী আবার প্রশ্ন করলেন, কখন আসবে বলেছিল?

আজ রাত বারোটার মধ্যে।

হ্যাঁগা, কথা সে রাখবে তো?

কি জানি, আশা তো করি!

ঘড়ির নীচে দক্ষিণা—কালিকার একটি পট ঝোলানো। সেইদিকে তাকিয়ে বিরজা দেবী একবার হাত দুটি জোড় করলেন। তারপর ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বললেন, আশা, ঘুমোলি মা?

ঘরের ভেতরের দরজা দিয়ে দেখা গেল, পাশের ঘরের বিছানায় তিন—চারটি ঘুমন্ত বালক—বালিকাদের পাশে অল্পবয়সি একটি মেয়ে একবার পাশ ফিরল শুধু। বোঝা গেল, আশার চোখে ঘুম নেই। সেইদিকে তাকিয়ে বিরজা দেবী আরও কি বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন।

সময়ের বুকে অবিশ্রান্ত হাতুড়ি পেটা চলেছে। চলে যাচ্ছে সেকেন্ডের পর সেকেন্ড, মিনিটের পর মিনিট।

কাঁপা গলায় বিরজা দেবী ডাকলেন, শুনছো, বারোটা যে বাজে, কখন আসবে সে?

হরলালবাবু জবাব দিলেন না। পায়চারি দ্রুততর হয়ে উঠল।

হঠাৎ ব্যাকুল স্বরে বিরজা দেবী বলে উঠলেন, হ্যাঁগা, যদি না আসে—যদি মিথ্যে আশা দিয়ে থাকে? তবে কি আমার আশার কোনো গতি হবে না?

হরলালবাবুর বুকের পাঁজরা ভেদ করে একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল : তারা! তারা!

বিরজা দেবীর গালের ওপর দিয়ে ঝর ঝর করে চোখের জল নেমে এল। হরলালবাবুর কাছে উঠে এসে তিনি বলতে লাগলেন, কাল রাত পোহালেই মেয়ের বিয়ে, অথচ এখনও একটি পয়সা জোগাড় হল না! কি করে কি হবে—আমি যে আর ভাবতে পারছি না!…

গভীর স্বরে হরলালবাবু বললেন, ভাবতে আমিও আর পারছি না বিরজা। দু’—দু’বার বাঁধা দেওয়া এই বাড়িখানা—এরই বা কি দাম আছে বলো! গরীবের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাটাই ভুল বিরজা।

সজলকণ্ঠে কতকটা আত্মগতভাবেই বিরজা দেবী বললেন, গরীবের কি কেউ নেই?

ভেবেছিলাম একজন অন্তত আছে। তাই তো ট্রাম থেকে পড়ে গিয়ে যেদিন মোহিতমোহনের গাড়িতে হাসপাতালে গিয়েছিলাম, সেদিন ভেবেছিলাম, এ শুধু ঠাকুরের দয়া! আমার মুখে সব কথা শুনে সে বললে, আপনি কিছু ভাববেন না, নিশ্চিন্তে বিয়ের দিন স্থির করুন। টাকা আগের দিন রাত বারোটার মধ্যে আপনার কাছে পৌছে যাবে। মোহিতমোহনের কথায় বিশ্বাস করেই তো এতটা এগিয়েছি। নইলে একশো—দশ টাকার কেরানি আমি, আমার সাধ্য কি, অমন পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ভরসা করি?

কিন্তু মোহিতমোহন তো এখনও এল না? কি উপায় হবে কাল সকালে?

গরিবের ভাগ্যে যা হয়, তাই হবে। কুল—মান—সম্ভ্রম সবই যাবে। আর আশার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কেঁদে কেঁদে তোমার দিন কাটবে!….হরলালবাবুর শুকনো ধরা গলা উত্তেজনায় প্রখর হয়ে উঠল : গরিবের কেউ নেই বিরজা, কেউ নেই। গরীবের ঠাকুরও নেই, নইলে মোহিতমোহন আসত!…রাত বারোটার মধ্যে নিশ্চয়ই….

হরলালবাবুর মুখের কথা শেষ হল না। পঙ্গু স্থবিরের মতো ক্যাম্বিশের চেয়ারটায় তিনি বসে পড়লেন।

জাপানি ওয়ালক্লকটায় তখন টং টং করে বারোটা বাজছে!

এলো না! মোহিতমোহন এলো না!

বিরজা দেবীর দুই চোখ তখন অশ্রুতে অন্ধ হয়ে গেছে। দক্ষিণা—কালিকার পটের তলায় পাগলের মতো তিনি মাথা খুঁড়ছেন : মাগো, একি করিল মা—একি করলি?…

ঠিক সেই মুহূর্তে!

বাইরের দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল না? আবার শব্দ হল—আবার—

সহসা উদভ্রান্তের মতো হরলালবাবু ‘কে?’ বলে ছুটে গেলেন।

দরজা খুলতেই আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা একটি মূর্তি লম্বা—চওড়া বড় একখানা মোটা খাম হরলালবাবুর হাতে দিল। বিমূঢ় হরলালবাবু তাকে কিছু প্রশ্ন করার আগেই পথের অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো সে মিলিয়ে গেল। কম্পিত হাতে হরলালবাবু তাড়াতাড়ি খামটা ছিঁড়তেই বেরোল একশো টাকার একতাড়া নোট আর একখানা চিঠি।

পাগলের মতো হরলালবাবু চিৎকার করে উঠলেন, বিরজা, আমার চশমা—আমার চশমা দাও শিগগির—

চশমা লাগিয়ে লণ্ঠনের কাছে এসে হরলালবাবু চিঠিখানা পড়লেন : আমার প্রতিশ্রুত টাকা পাঠাইলাম। আপনার মেয়ের বিবাহের জন্য পাঁচ হাজার, আর বন্ধকি বাড়িটা ছাড়াইবার জন্য সাত হাজার। বিবাহের শুভকাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হৌক, এই কামনা করি।

—মোহিতমোহন

চিঠিপড়া যখন শেষ করলেন, তখন চোখের জলে হরলালবাবুর চশমা ঝাপসা হয়ে গেছে। আর বিরজা দেবী ছুটে গিয়ে আশার মাথায় হাত দিয়ে হেসে—কেঁদে বলতে লাগলেন, আর কত ঘুমোবি পোড়ারমুখী, তোর দুঃখের রাত যে এবার কাটলো!…

কুইন মেরি হোটেল।

প্রিন্সেপ স্ট্রিটের ওপর গঙ্গামুখী প্রকাণ্ড সৌধ। শহরের সেরা অভিজাত পান্থশালা। এই হোটেলের তেরো নম্বর কামরায় চলুন। আজ দিনের আলোয় গল্পের দ্বিতীয় অঙ্কের যবনিকা উঠবে সেখানে।

পুব দিকের এই ঘরে প্রায় ঘণ্টাখানেক হল লালজির ঘুম ভেঙেছে। সকালের অজস্র রোদে জানলা—দরজার ফিকে সবুজ নেটের পর্দগুলো ঝলমলিয়ে উঠেছে। ধবধবে নরম বিছানায় আড় হয়ে বসে লালজি দিনের সংবাদপত্রে চোখ বুলোচ্ছিল। পাশে তে—পায়া একটা টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম, মিনেকরা রূপোর পানের ডিবে, সিগারেট—কেস আর হাতঘড়ি।

বেয়ারা এসে ফুলদানিতে তাজা ডালিয়ার গোছা সাজিয়ে দিয়ে গেল। সংবাদপত্র রেখে আলস্যভরে লালজি একটা হাই তুললে। তারপর ডিবে থেকে গোটা দুই পান তুলে নিলে। সিগারেট সে কমই খায়।

ঘরে এসে দাঁড়াল খাকি উর্দিপরা মাঝারি সাইজের অত্যন্ত বলিষ্ঠ চোহারার একটি লোক। লোকটার বাঁ—চোখটা কানা, কিন্তু ডান চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ন!

এই লোকটিকেই আমরা দেখেছিলাম রাজারামের দোকানের ফটকে চকোলেট রঙের গাড়ির ড্রাইভারের আসনে। লোকটির নাম মাহাঙ্গু।

মাহাঙ্গু দীর্ঘ সেলাম জানিয়ে দাঁড়াল।

লালজি প্রশ্ন করলে, গাড়ি দুটোর রঙ বদলাতে দিয়েছো মাহাঙ্গু?

লোকটি নিঃশব্দে ঘাড় নাড়লে।

আর নাম্বার প্লেট দুটো?

মাহাঙ্গু জানালে, সে আগেই বদলে দিয়েছে।

ঠিক আছে। রাত্রে কফি হাউসে হাজির থেকো।

আবার সেলাম জানিয়ে মাহাঙ্গু বিদায় নিল।

এইবার জরিদার চটিজোড়া পায়ে গলিয়ে, ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে লালজি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বাইরের লবিতে। প্রভাতী চায়ের বৈঠক সেখানে তখন শেষ হয়ে গেছে। শুধু একধারে একটি প্রাণী তখনও বসে’ বসে’ কোঁচার খুঁট দিয়ে চায়ের পেয়ালাটি সযত্নে ধরে তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছিল।

লালজিকে দেখে পরম আপ্যায়নের সঙ্গে লোকটি বলে উঠল, আসতে আজ্ঞা হোক বাবু সাহেব।

লোকটির দিকে লালজি সকৌতুকে ফিরে তাকাল। সেই বিচিত্র মূর্তি! গায়ে গেরুয়া রঙের হাতকাটা বেনিয়ান, গলায় তুলসীর কণ্ঠি, কপালে, নাকে আর কানের দুই ডগায় গেরিমাটির তিলক। দিন দুই হল লোকটা হোটেলে এসে উঠেছে। একরকম গায়ে পড়েই লালজির সঙ্গে আলাপ করবার চেষ্টা করছিল। নাম গোপীকান্ত আচার্য। আসামের এক জমিদারের সেরেস্তায় কাজ করে। সদাহাস্য মুখ বৈষ্ণব—বিনয়ে সদাই বিগলিত।

পেয়ালায় সশব্দে একটা চুমুক দিয়ে গোপীকান্ত বললে, চা বড় মজার জিনিস, বুঝলেন বাবু সাহেব? খেতে না খেতেই দেহ একেবারে চাঙ্গা। গৌর! গৌর! ইচ্ছে করেন নাকি এক বাটি?

লালজি ঘাড় নেড়ে জানাল, না।

অতি সন্তর্পণে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে গোপীকান্ত পুনরায় বললে, একটা কথা শুধোই বাবু সাহেব। চায়ের এই বাটি—টাটিগুলো এরা গঙ্গাজলে ধোয় তো?

হাসি চেপে লালজি বললে, তা আর বলতে!

গোপীকান্ত অত্যন্ত খুশি হয়ে বলে উঠল, গৌর! গৌর! তারপর একটা বিড়ি বের করে ধরিয়ে প্রশ্ন করলে, আচ্ছা বাবু সাহেব, ক্লাইভ রো ইস্টিশানটা কোনো দিকে পড়বে বলতে পারেন?

ইস্টিশান!

আজ্ঞে, যেমন হাবড়া, শেয়ালদা ইস্টিশান।

এবার লালজি ব্যাপারটা বুঝতে পারল। অতি কষ্টে হাসি সম্বরণ করে বললে, ক্লাইভ রো ইস্টিশান নয় আচায্যি মশায়, ওটা একটা রাস্তার নাম! তা, কোথায় যাবেন?

যাবো আপনার গিয়ে ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্স কোম্পানির আপিসে।

কি কাজে? লাইফ ইন্সিওর করেছেন নাকি?

আজ্ঞে না, আমি ছাপোষা মানুষ। জমিদারির কাজ করি আর গৌর নাম গাই।

তবে কি কাজে যাবেন সেখানে? সেখানে তো গৌর নাম হয় না!

বলি তাহলে শুনুন।—সোফার ওপর দুই পা তুলে গোপীকান্ত আরাম করে বসল। তারপর শুরু করলে, আমাদের জমিদার বাহাদুর জানকীনাথ চৌধুরী মশায়ের শিকারের বাতিক ছিল। দিন নেই, রাত নেই, খালি হাতির পিঠে বন্দুক হাতে জঙ্গলে জঙ্গলে দুমদাম করে বেড়াতেন। কিন্তু কৃষ্ণের জীব—হত্যা ধর্মে সইবে কেন? মাসখানেক আগে একদিন হাতির পিঠ থেকে পড়ে—ব্যস খতম। মরবার বছর দুই—তিন আগে জমিদার বাহাদুর মেয়ে অপর্ণার নামে পনেরো হাজার টাকার ইন্সিওর করে যান। ওই একটিমাত্র মেয়ে কিনা—তায় বিধবা! তাই হাজারিকা মশাই—মানে আমাদের ম্যানেজার ভূজঙ্গধর বাবু আমায় ডেকে বললেন, গোপীকান্ত, তুমি একবার কলকাতায় যাও। জমিদারির দু’টো—একটা কাজ সেরে এসো, আর সেই সঙ্গে অপর্ণা—মায়ের নামের পলিসিখানাও নিয়ে যাও। ইন্সিওর কোম্পানি থেকে টাকাটা তোলার ব্যবস্থা করে এসো।

লালজির দৃষ্টি তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করল, কোন কোম্পানি বললেন?

ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানি। ৩২/১ ক্লাইভ রো।

স্মিত হাসিতে লালজির মুখ ভরে গেল। বলে উঠল, আরে, এ তো আমাদেরই কোম্পানি। আমি যে ওখানকার এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।

গৌর! গৌর!—গোপীকান্তের মুখ থেকে বিড়িটা খসে পড়ে গেল। লালজির একখানা হাত চেপে ধরে বললে, তাহলে আমার এই কাজটুকু আপনাকে করে দিতে হবে বাবু সাহেব। বিদেশি লোক আমি, জানা—চেনা নেই—

পরম আশ্বাসের সুরে লালজি বললে, এ আর অধিক কথা কি! যা করবার আমিই সব করে দেব’।

তাহলে আপনার সঙ্গেই কোম্পানির অফিসে যাই, কি বলেন?

লালজি বললে, আপনি আর কেন কষ্ট করবেন আচায্যি মশাই? পলিসিখানা আমাকে এনে দিন, সব ব্যবস্থা আমিই করব’খন। আপনি বরং নির্জনে বসে গৌর নাম করুন।….হ্যাঁ, জমিদার সাহেবের ডেথ সার্টিফিকেটটাও এনেছেন তো?

গোপীকান্ত বললে, তা তো বলতে পারি নে। কাগজপত্রগুলো এনে দিই, আপনি দেখুন।

গোপীকান্ত একরকম ছুটেই চলে গেল। লালজি এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখল, দু’একটা বেয়ারা ছাড়া আর কেউ আনাগোনা করছে না। লবির কোণে রাখা ফোনের রিসিভারটা লালজি তুলে নিল : হ্যালো…সিটি ১০০১…ওয়েলেসলি কফি হাউস?…একবার দোতলায় কানেকশনটা দিন তো!….জোহরা?…হ্যাঁ, আমি….এখুনি একবার আসতে হবে।…হ্যাঁ, এখখুনি। এই ধরো সাড়ে দশটার মধ্যে। আর শোনো, কি পোশাকে আসবে বলে দিই…সরু জরিপাড় সাদা মখমলের শাড়ি, সাদা ব্লাউজ, গলায় সরু একগাছি হার ছাড়া আর কোনো অলঙ্কার থাকবে না। চোখের কাজল তুলে ফেলবে, বুঝলে?…ব্যাপার সবই জানতে পারবে এখানে এলে…রাস্তায় একখানা ট্যাক্সি ধরে…

লালজি হঠাৎ রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল। গোপীকান্ত এলো লম্বা পুরু একটা খাম হাতে নিয়ে। লালজি খুলে দেখে বললে, ঠিক আছে।…আপনি নিশ্চিন্তে গৌর নাম করুন গে আচায্যি মশাই! টাকাটা সময় মতো আপনাদের কাছে পৌছে যাবে’খন।

যে আজ্ঞে—গৌর! গৌর!—গোপীকান্ত বিদায় নিল।

লালজিও নিজের ঘরের দিকে ফিরল।

কিন্তু আশ্চর্য! দরজার হাতলে হাত দেওয়ার আগেই ভেতর থেকে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল নিতান্ত অপরিচিতা একটি মেয়ে। বাঙালির মেয়ে হলেও দীর্ঘচ্ছন্দ দেহ, মোটামুটি সুন্দরী। বয়স পঁচিশের ওপর মনে হয়। পরনে ঘন কালো জর্জেটের শাড়ি, গায়ে হাতের কব্জি পর্যন্ত পুরো হাতা ব্লাউজ। চুলগুলি কপালের ওপর আঁট করে তুলে বাঁধা। চোখে সরু সোনার ফ্রেমের চশমা। মেয়েটিকে দেখলে স্কুল মিসট্রেস বলেই মনে হয়।

লালজি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, আপনি?

মেয়েটি একবার লালজির মুখের দিকে তাকালো। তারপর বললে, আমি লেডি মুখার্জির কাছে এসেছি, তাঁর একজন গর্ভনেস চাই, তাই—

কিন্তু এ ঘরে তো লেডি মুখার্জি থাকেন না!

তবে কে থাকেন?

লালজি সমুখের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে স্মিতমুখে বললে, অধম। লেডি মুখার্জির কামরা ছ’ নম্বর!

অপরিচিতা একটু সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ও, তাই নাকি?…কিন্তু এটাই তো ছ’ নম্বর কামরা?

আজ্ঞে না, এটা ন’ নম্বর।

সে কি! আপনি বোধহয় ভুল করছেন।

ভুলটা বোধকরি আপনারই হচ্ছে।

কক্ষনো না! এ ঘরের নম্বরটা তাকিয়ে দেখুন তো!

দু’জনে এক সঙ্গেই দরজার মাথায় তাকিয়ে দেখল। লালজির মুখে মৃদু হাসি ফুটলো। বললে, ভুলটা দেখছি আমাদের কারোর নয়, দৈবের। আমার ঘরের নাম্বার প্লেটটা কেমন করে জানি না উল্টে যাওয়াতে ইংরেজি ‘9’টা হঠাৎ ‘6’ হয়ে গেছে!

মেয়েটি লজ্জিত অপ্রতিভ মুখে বললে, ওঃ, তাই তো!…কিছু মনে করবেন না যেন!

কিছুমাত্র না!—লালজি হাসিমুখে বললে।

ছোট্ট একটা নমস্কার করে অপরিচিতা যাবার জন্যে পা বাড়াতেই দেখা গেল, দূরের লবি থেকে জোহরা সাদা শাড়ি পরা মূর্তিটি এগিয়ে আসছে। মুখে সেই সূক্ষ্ম কালো আবরণ।

লালজি ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

জোহরা প্রবেশ করে মুখের আবরণ তুলে দিল। তারপর প্রশ্ন করলে, ও মেয়েটি কে লাল?

তরল কণ্ঠে লালজি বলে উঠল, ‘পথভোলা এক পথিক’।

মানে?

মানে, চিনি না। নারীকে দেবতারাই চিনতে পারেন না, আমি কি করে চিনবো বল?

এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে জোহরা বললে, থাক, বলতে হবে না। প্রশ্ন করাটাই আমার ভুল হয়েছিল। লালজি সকৌতুকে একবার তার দিকে চাইলো। বললে, দেখ জোহরা, তুমি বরং রাগ কোরো, কিন্তু অভিমান কোরো না। মেয়েরা অভিমান করলে আমার কেমন হাসি পায়।

আহতকণ্ঠে জোহরা বললে, দুনিয়ায় এক জাতের মানুষ আছে, চোখের জল দেখলেও তাদের হাসি পায়।

বাঁ—দিকের ভুরু তুলে লালজি বললে, আচ্ছা, মাঝে মাঝে তোমার মেজাজ অমন বিগড়ে যায় কেন বলো তো? কি হয় তোমার?

জোহরা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে বললে, কিছু না।…ওকথা থাক, কেন ডেকেছ বল।

পথে যেতে যেতে বলব।…আমি আধঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।

* * * আধঘণ্টা বাদে কুইন মেরি হোটেলের ন’ নম্বর ঘর থেকে গলাবন্ধ কোটের ওপর মাফলার জড়ানো, ট্রাউজার পরা, মোটা ফ্রেমের চশমাচোখে, মুখে কাঁচা—পাকা ছাঁটা গোঁফ, রুপো—বাঁধানো লাঠি হাতে একটি মধ্যবয়সি প্রৌঢ়কে অবগুণ্ঠনবতী একটি মহিলার সঙ্গে আমরা বেরিয়ে যেতে দেখলাম।

দূরে ক্লক—টাওয়ারে বাজল সাড়ে দশটা।

সকাল সাড়ে দশটা বাজল আরেক জায়গায়। পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসার পঙ্কজ গুপ্তের খাস—কামরায়।

জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন অফিসার। বলছিলেন, ব্যাপারটা গুলি—গোলা—খুন— জখমের চেয়েও রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে। প্রায় ষোলো বছর পুলিশ—লাইনে আছি, ‘চারশো বিশ কেস’ অনেকরকম দেখেছি, কিনারাও করেছি অনেক, কিন্তু এমন নিখুঁত জুয়াচুরি কখনও দেখিনি হে! ব্যাপারটা কিনারা সহজে হবে বলে মনে হয় না। তোমার কি মনে হয় বিশু?

বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ওরফে বিশুকে চিনতে আপনাদের দেরি হবে না নিশ্চয়ই। ‘রোমাঞ্চ’ যাঁরা নিয়মিত পড়েন, তাঁরা বিশুকে ‘রোমাঞ্চ’র জন্ম থেকেই গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ীর সঙ্গেই দেখে আসছেন। বিশু অফিসার পঙ্কজ গুপ্তের বিশেষ বন্ধু।

একটা চেয়ারে বসে বিশু টেবিলের ওপর কতকগুলো দেশলাইয়ের কাঠি সাজিয়ে কি একটা অদ্ভুত খেলায় মেতেছিল। সেইদিকে দৃষ্টি রেখেই সে জবাব দিলে, মনে কিছুই হয় না, কেননা, মনে হবার মতো কোনো সূত্রই এখনও পাওয়া যায়নি।

অফিসার গুপ্ত একটু হেসে বললেন, তবে কি এতদিন বৃথাই প্রতুল লাহিড়ীর সাকরেদি করেছ?

বিশু এবার মুখ তুলে শান্ত গলায় বললে, ধীরে বন্ধু ধীরে! আমি তো পি. সি. সরকার নই যে, ম্যাজিকে রহস্যের কিনারা করে ফেলবো?

অফিসার গুপ্ত কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় টেলিফোন উঠল বেজে। গুপ্ত রিসিভারটা তুলে নিলেন: হ্যালো….পার্ক স্ট্রিট থানা…হ্যাঁ, আমি গুপ্ত। কে?….রাজারামবাবু…না, এখনও কোনো কিনারা হয়নি। কেসটা খুব সহজ নয়—কিনারা করতে সময় নেবে….চকোলেট রঙের গাড়িটার নম্বর পাওয়া গেছে? মানে, রুক্মিণীর গাড়ির? …হ্যাঁ, বলুন…GK 3399?…নম্বর নিয়েছিল কে? আপনার পাঠান দরোয়ান?….আচ্ছা দেখি, নম্বরটা কোনো কাজে লাগে কিনা….হ্যাঁ, মাঝে মাঝে খবর নেবেন….দরকার হলে আমিও ফোন করব।….আচ্ছা…

রিসিভারটা রেখে দিয়ে অফিসার গুপ্ত তাড়াতাড়ি তাঁর নোট—বইয়ের পাতা উল্টোতে লাগলেন। স্যার জগদীশপ্রসাদের কন্যা রুক্মিণীর গাড়ির বর্ণনা ও নম্বর এতে লেখা আছে। কিন্তু দেখা গেল রাজারামের দেওয়া নম্বরের সঙ্গে তার আকাশ—পাতাল প্রভেদ। রুক্মিণীর গাড়ি হল টকটকে লাল রঙের ‘মার্সিডিজ’, নম্বর WBC 1001!

নোটবই ফেলে অফিসার গুপ্ত হতাশ হয়ে বলে উঠলেন, নাঃ!

বিশু জিজ্ঞাসা করল, কাল তুমি আসল রক্মিণীর খবরের জন্যে ‘বেঙ্গল ক্লাবে’ গিয়েছিলে না?

অফিসার বললেন, হ্যাঁ। সেখান থেকে জানতে পারলাম, রাজারামের দোকানে যখন ঘটনা ঘটে, সে—সময় রুক্মিণী একজন চেক—মহিলার সঙ্গে টেনিশ খেলছিল। তারপর ক্লাব থেকে তারা সদলে নিউ এম্পায়ারে যায়। তাছাড়া ক্লাবে যে ‘বার’ আছে, সেখানে রুক্মিণীর সই করা অনেক পুরোনো বিল রয়েছে। তার সেই সইয়ের সঙ্গে রাজারামের চেকের সই মিলিয়ে দেখলাম, কোথাও এতটুকু মিল নেই—যদিও ওই ব্যাঙ্কেই রুক্মিণীর অ্যাকাউন্ট বরাবর খোলা আছে।

পকেট থেকে চেকটা বার করতে করতে অফিসার গুপ্ত বললেন, তুমি তো হ্যান্ডরাইটিং—এক্সপার্ট বিশু, এটা একবার দেখ দিকি!

চেকটা হাতে নিয়ে বিশু খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বললে, লেখাটা নিতান্ত কাঁচা হাতের, রুক্মিণীর মতো বিলাত—ফেরত মেয়ের এমন লেখা হতে পারে না! যে কলমে এই চেক লেখা হয়েছে, লেখক সে—কলম আগে বড় একটা ব্যবহার করেনি। তাই সই করতে গিয়ে এক জায়গায় অল্প খোঁচা লেগে গেছে। কলমটা যে নিয়মিত ব্যবহার করে, বাঁ দিকে চেপে লেখাই তার অভ্যাস; আর সেই অভ্যাসের ফলে নিবের বাঁ—দিকটা ঈষৎ ক্ষয়ে গেছে। এ ছাড়া আর কিছু বলতে পারব না, গুপ্ত।

চেকটা আবার পকেটে রাখতে রাখতে অফিসার গুপ্ত বললেন, কিন্তু এইটুকু সূত্র থেকে ছদ্ম রুক্মিণীকে খুঁজে বের করা কি সম্ভব হবে বিশু?

বিশু বললে, কিসের থেকে কি যে সম্ভব হয়, তা কে বলতে পারে গুপ্ত? তবে আমার মনে হয়, রুক্মিণী—রহস্য ভেদ করার আগে লালজি—রহস্য ভেদ করতে পারলেই সব কিছুর কিনারা হয়ে যাবে।

অফিসার গুপ্ত বললেন, ঠিক কথা। কিন্তু লালজি নিজেকে এমন—ভাবে ধরা—ছোঁয়ার বাইরে রেখেছে যে, তার বিরুদ্ধে কোনো চার্জই দাঁড় করানো যাচ্ছে না। ধরো, লালজি যদি স্বীকারই করে যে, সে রাজারামের দোকানে গিয়েছিল, তাহলেও এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, পঁচিশ হাজার টাকার অলঙ্কার সে কেনেনি, ঠকিয়ে নিয়েছে। পঁচিশ হাজার টাকার বিল দেখিয়ে বলতে পারে যে, নগদ টাকায় সে অলঙ্কার কিনেছে। কেননা বিলটা ছদ্ম রুক্মিণীর হাত থেকে দরকার মতো তার হাতে নিশ্চয়ই আসবে। সুতরাং আইনকে সে অনায়াসেই বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে। অথচ পঞ্চাশ হাজার টাকার শোকে রাজারাম পাগল হয়ে উঠেছে, তাকেই বা ঠেকাই কি করে?….আমার একটা অনুরোধ রাখবে বিশু?

বিশু আবার দেশলাইয়ের কাঠির খেলায় মন দিয়েছিল। মুখ না তুলেই বলল, বল।

এই কেসটায় তুমি আমাকে সাহায্য করো। যেমন করে পারো, খোঁজ নাও, এই লালজি লোকটি কে? কি তার আসল পরিচয়?

আগে জানা দরকার থাকে কোথায়? বিশু বললে।

দরজার কাছ থেকে মেয়েলি গলায় জবাব এলো : কুইন মেরি হোটেল, ন’ নম্বর কামরা।

বিশু এবং গুপ্ত দু’জনে এক সঙ্গে তাকিয়ে দেখলে, একটি মেয়ে ঘরে প্রবেশ করছে। পরনে কালো জর্জেট, চোখে চশমা, চুলগুলি কপালের ওপর আট করে তুলে বাঁধা।

বিশু সবিস্ময়ে বলে উঠলো, রমলা! তুমি লালজির খবর কেমন করে জানলে?

মৃদু হেসে রমলা জবাব দিলে, আমি সংবাদপত্রের রিপোর্টার। অনেক কিছুই আমাদের জানতে হয় বিশু—দা।

গুপ্ত বললেন, ব্যাপারটা খুলে বলি, শোন বিশু। কাল কলকাতার সমস্ত হোটেলে ফোন করে আমি জানতে পারি যে, আগে লালজি ছিল সাডার স্ট্রিটে ‘ফেয়ার—লন’ হোটেলের স্থায়ী বোর্ডার। আজ সপ্তাহ দুই হল সেখান থেকে হঠাৎ উঠে গেছে। কোথায় গেছে, হোটেলের কর্তৃপক্ষ বলতে পারেনি। বাবুর্চি এবং খানসামাদের কাছে খোঁজ করায় আবদুল বলে একটি খানসামা আমাকে জানায় যে, লালজি বর্তমানে প্রিন্সেপ স্ট্রিটে কুইন মেরি হোটেলে গিয়ে উঠেছে। ভালো করে জেনে আসবার জন্যে রমলাকে আজ সকালে আমিই সেখানে পাঠিয়েছিলাম।

বিশু সহর্ষে বলে উঠলো, বটে! বটে! কিছু খবর পাওয়া গেল নাকি?

রমলা জবাব দিলে, নিশ্চয়ই! খবর সংগ্রহ করাই যে আমাদের পেশা। লালজির সঙ্গে আলাপ করে, তাঁর চেহারায় এবং তাঁর ঘরে সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলাম না। বরং এই ধারণা নিয়েই ফিরে এসেছি যে, লালজি একজন রুচিবান, ভদ্র, সৌখিন পুরুষ। ইংরিজিতে যাকে বলে ‘ফাইন জেন্টলম্যান’। লোকটির মধ্যে আর কিছু থাক আর না থাক, ব্যক্তিত্ব আছে যথেষ্ট—

আর আধুনিক মেয়েদের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, তাই নয় কি রমলা? যাক, লোকটাকে তোমার কিরকম মনে হল?

রমলা ফোঁস করে একটা কৃত্রিম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললে, মনে হল, এই সে—ই, যার জন্যে একদা রাধা হয়ে আমি লাজ—লজ্জা, কুল—মান খুইয়ে বসেছিলাম। সে যে কি, তা কেমন করে বলব? আমার ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে বিশুদা!

অফিসার গুপ্ত সশব্দে হেসে উঠলেন।

বিশু বললে, তামাশা রাখো রমলা। কুইন মেরি হোটেলে গিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছুই দেখোনি?

এবার সংযত কণ্ঠে রমলা বললে, দেখেছি। হোটেল থেকে চলে আসার আগে সাদা শাড়িপরা অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত টাইপের একটি মেয়েকে লালজির ঘরে ঢুকতে দেখলাম।

দেখতে কেমন?

দেখতে পাইনি। কালো ‘ভেল’ দিয়ে মুখ ঢাকা ছিল।

আর কিছু দেখতে পেয়েছো?

লালজির মাথার বালিশের তলায় এই চিরকুটটা পাওয়া গেছে।— ব্লাউজের বুকের ভেতর থেকে রমলা বালির কাগজের একটা ভাঁজকরা টুকরো বের করে বিশুর হাতে দিল। তাতে পেন্সিলে লেখা :

কিং জর্জেস ডক (ইস্ট)

এস. এস স্যাভেজ গার্ল

 ৫/৩/৫০

কাগজটা পকেটে পুরে বিশু জিজ্ঞাসা করলে, আর কিছু?

রমলা জানালে, উল্লেখযোগ্য আর কিছুই তো চোখে পড়েনি। তার পর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠল, এবার আমাকে উঠতে হবে—অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে।

গুপ্ত দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বেশ, এসো। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলে রাখি রমলা, লেডি মুখার্জির গভর্নেসের চাকরিটা দু’একদিনের মধ্যে যেমন করেই হোক তোমাকে নিতে হবে। চাকরিটা যাতে নিশ্চিত পাওয়া যায়, সেইজন্যে ব্যারিস্টার এস. এন. গুহ’র সার্টিফিকেট আমি এনে দোব।…আচ্ছা, এসো।

চশমাটা হাতব্যাগে ভরে রমলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অফিসার গুপ্ত এবার বিশুর পানে তাকিয়ে বললেন, এরপর থেকে কিন্তু তোমার ওপর ভার রইল।

বিশু আবার দেশলাইয়ের কাঠিতে মন দিয়েছিল। বললে, দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। আপাতত রমলার দেওয়া এই কাগজের চিরকূট থেকে কিছু হদিশ পাওয়া যেতে পারে।

পার্ক স্ট্রিট থেকে চলুন ক্লাইভ রো। ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্সের প্রকাণ্ড সৌধ। তারই তিনতলায় জেনারেল ম্যানেজারের অফিস—ঘর। কথা হচ্ছিল সেইখানেই।

ম্যানেজার মিঃ আয়ার বলছিলেন, হ্যাঁ, খবরের কাগজে দেখেছি জানকীনাথের মৃত্যুসংবাদ। বড় দুঃখিত হলাম খবরটা পড়ে। এখন বলুন, আপনাদের জন্যে কি করতে পারি?

প্রৌঢ় লোকটি গলায় কম্ফর্টার জড়িয়ে রুপো বাঁধানো লাঠির ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে বসেছিলেন। বার দুই কেশে তিনি বললেন, আগে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি জমিদার সাহেবের একমাত্র কন্যা অপর্ণা দেবী।

আর আপনি?

কাশি সামলে প্রৌঢ় লোকটি বললেন, আমি ভুজঙ্গধর হাজারিকা। জানকীনাথ চৌধুরীর এস্টেটে তেইশ বচ্ছর ম্যানেজারি করছি। ….হ্যাঁ, বলছিলাম কি, এই অপর্ণা মায়ের নামেই বছর তিনেক আগে জমিদার সাহেব আপনাদের কোম্পানিতে পনেরো হাজার টাকার ইন্সিওর করে যান। অপর্ণা—মা সেই টাকাটার জন্যেই আপনার দ্বারস্থ হয়েছেন।….

মিঃ আয়ার বললেন, ও! আশা করি, মৃত জানকীনাথের ডেথ—সার্টিফিকেটখানা এনেছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ, এনেছি বৈকি!

কোটের বুক পকেট হাতড়ে ভুজঙ্গধর একটা লম্বা পুরু খাম বার করে মিঃ আয়ারের হাতে দিলেন। মিঃ আয়ার জিজ্ঞাসা করলেন, আর পলিসি?

ভূজঙ্গধর বললেন, এতেই আছে দেখুন।

মিঃ আয়ার খামের ভেতরকার কাগজপত্রে মন দিলেন।

ভুজঙ্গধর সামনের দিকে ঝুঁকে বলতে লাগলেন, গোড়ার কথাটা খুলে বলি আপনাকে মিঃ আয়ার। অল্প বয়সে বিধবা হওয়ায় অপর্ণা—মায়ের জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে। জমিদার সাহেবের জামাই ছিলেন দেখতে যেমন রাজপুত্রের মতন, তেমনি কৃতী ছেলে। যাক সে—কথা, বলতে গেলে মায়ের আমার চোখের জল বাধা মানবে না।

পাশের চেয়ারে অপর্ণা তার অশ্রুভারাক্রান্ত বিষণ্ণ চোখ দুটি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল।

হ্যাঁ, কি বলছিলাম,—একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভুজঙ্গধর আবার শুরু করলেন, জমিদার সাহেব ছিলেন অত্যন্ত খেয়ালি প্রকৃতির লোক। সারা জীবন শিকার আর আমোদ—প্রমোদের পেছনে বহু টাকা ব্যয় করে শেষ জীবনে ফতুর হয়ে পড়েছিলেন। মেয়ের ভবিষ্যতের ভাবনা আগে কখনও ভাবেননি; তাই শেষ জীবনে মেয়ের নামে এই টাকাটা তিনি ইন্সিওর করে যান। এখন এই টাকাটাই অপর্ণা—মায়ের একমাত্র সম্বল।

তারপর গলা নামিয়ে ভুজঙ্গধর বললেন, বাকি সমস্ত সম্পত্তি দেনার দায়ে নিলাম হতে বসেছে কিনা। এখন ইন্সিওরেন্সের এই টাকাটা শিগগির না পেলে মাকে আমার পথে দাঁড়াতে হয়—অত বড় ঘরের মেয়ে—

ভুজঙ্গধরের গলা ধরে এলো। বার দুই কেশে গলা সাফ করে তিনি আবার বললেন, তাই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি মিঃ আয়ার। এখন আপনি ছাড়া আর গতি কি! ….কি বল মা?

সমর্থনের জন্যে ভুজঙ্গধর একবার অপর্ণার দিকে তাকালেন।

ম্লান বিষণ্ণ চোখ দুটি আয়ারের মুখের দিকে তুলে অপর্ণা ধীরে ধীরে বললে, আমার এ বিপদে আপনার সাহায্য আশা করতে পারি কি মিঃ আয়ার?

সুন্দরী নারীর কালো চোখের দৃষ্টিবাণ ব্যর্থ হবার নয়। মাদ্রাজি যুবকের মর্মস্থলে বিদ্ধ হতে দেরি হল না। মিঃ আয়ার নরম গলায় বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই পারেন। টাকাটা যাতে ঠিকমতো পান, সে—বিষয়ে আমি চেষ্টার ত্রুটি করব না।

কবে নাগাদ আশা করতে পারা যায়?—ভুজঙ্গধর প্রশ্ন করলেন।

নিয়ম অনুসারে অন্তত মাসখানেক লাগবার কথা।

কালো চোখের সকরুণ মিনতি মিঃ আয়ারের মুখের পানের আবার তুলে ধরে অপর্ণা বললে, এক মাস! …অতদিন দেরি হলে আমাকে সত্যিই পথে দাঁড়াতে হবে মিঃ আয়ার। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই স্বামী হারিয়েছি বলে শ্বশুরবাড়িতে আমার ঢোকবার অধিকার নেই। বাপের আশ্রয়ও ভেঙে গেল। এই টাকাটা শিগগির না পেলে এখন আমি কি করব—কোথায় গিয়ে দাঁড়াব বলতে পারেন?

কালো চোখের শুক্তির ভেতর থেকে টল টল করে কয়েকটা তরল মুক্তো গড়িয়ে পড়ল।

মিঃ আয়ারের গলা আরও নরম হয়ে গেল। বললেন, কি করবো বলুন, আমি কোম্পানির চাকর। কোম্পানির আইন ভাঙতে তো পারি না!

ঘাড় নাড়তে নাড়তে ভুজঙ্গধর বললেন, তা তো বটেই! তা তো বটেই! তবু বিধবা মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি যদি টাকাটা আরও শিগগির পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন—মানে, আইন তো আপনাদের হাতেই—

কম্পিত ঠোঁট নেড়ে অপর্ণা শুধু বললে, আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো মিঃ আয়ার।

আশ্বাস দিয়ে মিঃ আয়ার বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, স্পেশাল কেস হিসেবে আপনার টাকাটা যত শিগগির পারি তোলবার ব্যবস্থা করে দোব। সপ্তাহ দুই পরে আপনি আমার একখানা চিঠি পাবেন মিঃ হাজারীকা।

আবেগে ভুজঙ্গধর লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন : আপনি মহৎ মিঃ আয়ার, সদাশয় ব্যক্তি! হ্যাঁ, চিঠি আসামে পাঠাবার দরকার নেই কলকাতার ঠিকানাতেই পাঠাবেন। আচ্ছা, আজ আসি তাহলে—এসো মা—

অপর্ণাকে সঙ্গে নিয়ে কম্ফর্টার—জড়ানো ভুজঙ্গধর লাঠিতে ভর দিয়ে কাশতে কাশতে বিদায় নিলেন।

সবে সন্ধে হয়েছে।

ওয়েলেসলির কফি হাউসের দোতলার ফ্ল্যাটে বসে জোহরা অলসভাবে কেশ—প্রসাধন করছে। পায়ের কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে পোষা কাবুলি বিড়ালটা পরম আদরে তার পায়ে মুখ ঘষছে। ঘরে আলো জ্বালা হয়নি। সুকোমল স্বপ্নের মতো পাতলা অন্ধকার ঘরটি ছেয়ে আছে। জানলার বাইরে আকাশে শুধু একটি তারা দেখা যাচ্ছে—সন্ধ্যাতারা।

আজকাল প্রতি সন্ধ্যায় এই নিরালা অবসরে জোহরার কি যেন হয়! তার বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, দুনিয়াটা শূন্য মনে হয়। কি যেন চেয়েছিল সে জীবনে, কি যেন পায়নি! সেই ব্যর্থতায় মনটা যেন মাঝে মাঝে ভেঙে পড়তে চায়।

অথচ কিসের অভাব তার? কি দেয়নি তাকে লালজি? দিল্লির পাঁকের তলা থেকে কুড়িয়ে এনে তাকে বাদশাজাদীর তখতে বসিয়েছে লাল। আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, অলঙ্কার সজ্জা, বিলাসের উপকরণ, কোনোও কিছুরই অভাব নেই তার।

তবু—তবু কেন বিলাসিনী নর্তকী জোহরার মনের ভিতরে এক কাঙালিনী ভিক্ষার অঞ্জলি পেতে বসে বসে কাঁদে? কি চায় সে? কিসের ক্ষুধা তার? কিসের তৃষ্ণা? সন্ধ্যার ওই একক তারার মতো নিজেকে তার মাঝে মাঝে কেন এত একা মনে হয়? কেন, সে তা জানে। নিজের মনের অগোচর কিছুই নেই। জোহরা জানে যে, সে ভালোবেসেছে। আর এই ভালোবাসাই তাকে করেছে রিক্ত।

কিন্তু কাকে ভালোবাসল জোহরা?

বলবে না—দুনিয়ার কাউকে জোহরা বলবে না তার নাম। শুধু বলতে পারে একজনকে, যদি সন্ধ্যার এই নিভৃত অবসরে সুকোমল স্বপ্নের মতো পাতলা অন্ধকারে ছাওয়া এই ঘরে এসে সে দাঁড়ায়।

কে?

দরজায় একটা ছায়া পড়তেই জোহরা চমকে উঠল।

বন্দেগি বাঈজি!

হাসিমুখে লালজি প্রবেশ করলে।

এক মুহূর্তের জন্যে জোহরার সারা দেহ—মন যেন অবশ হয়ে গেল। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে বললে, এসো। এমন অসময়ে যে?

একটু দরকার আছে বাঈজি।

জোহরার মুখে ছায়া পড়লো : দরকার না হলে তুমি আসো না, তা জানি। দরকারের জন্যেই দিল্লির পথ থেকে আমাকে কুড়িয়ে এনেছিলে। দরকার যেদিন মিটে যাবে, সেদিন আবার আমায় পথে ফেলে যেতে তোমার দেরি হবে না, তাও জানি। একবার পেছন ফিরে তাকাবারও সময় হবে না হয়তো।

একটা কৌচে ধপ করে বসে পড়ে লালজি অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার? থিয়েটারের পার্ট মুখস্থ করছ নাকি? স্টেজে চাকরি নেবে বুঝি?

জোহরার চোখ দুটো দপ করে একবার জ্বলে উঠেই স্তিমিত হয়ে গেল।

আমি তাচ্ছিল্য সইতে পারি, কিন্তু ঠাট্টা সইতে পারি না লাল।…

লালজি বললে, ঠাট্টা আমি করিনি জোহরা। আজ ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্সের ম্যানেজারের ঘরে যে নিখুঁত অভিনয় তুমি করে এসেছ, তাতে তোমার নাট্যসম্রাজ্ঞী উপাধি পাওয়াই উচিত।

বাঁকা চোখে চেয়ে জোহরা বললে, অভিনয়ে তুমিও কম যাও না লাল। তোমার আগাগোড়াই অভিনয়!

হয়তো তাই। কিন্তু মাদ্রাজি ম্যানেজার আজ সারারাত সুন্দরী অপর্ণার স্বপ্ন দেখবে নিশ্চয়ই! সুতরাং আশা হয়, টাকাটা পাওয়া যাবে নির্ঘাত।

জোহরা ধীরে ধীরে লালজির কাছে এসে বসলো। বললে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো লাল?

এত ভনিতা কেন?

কথাটা তোমায় কোনোদিন জিজ্ঞাসা করিনি কিনা!

তাহলে আজও জিজ্ঞাসা না করলে পারতে। যাকগে, কি জানতে চাও, বল।

এত টাকা নিয়ে তুমি কি কর?

লালজি এক মুহূর্ত জোহরার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, খেলা করি। টাকা আমার খেলনা।

সশব্দে হেসে উঠল লালজি।

জোহরা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। লালজিকে আজও সে বুঝতে পারে না,—না পারে নিজেকে বোঝাতে।

লালজি উঠে আলমারি থেকে একটি ‘জিনে’র বোতল আর একটা গেলাস বার করে আনল। তারপর জোহরাকে বলল, নীচে থেকে বয় ইয়াসিনকে একবার ডাক দাও তো জোহরা।

একটু পরেই ইয়াসিন এসে দাঁড়াল। এই লোকটিকে আমরা দেখেছিলাম, কফি হাউসে জোহরার কানে কানে ‘সাত নম্বর কেবিন’ বলতে।

লালজি বললে, তোমার একটা পুরোনো লুঙ্গি, একটা ময়লা গেঞ্জি আর একটা তোয়ালে এখুনি চাই ইয়াসিন।…হ্যাঁ, এক প্যাকেট কাঁচি সিগারেট এনো।

জি আচ্ছা।

ইয়াসিন বেরিয়ে গেল।

জোহরা প্রশ্ন করল, ওসব জিনিস দিয়ে কি হবে?

লালজি জবাব দিলে, দুনিয়াদারির নাটকে নতুন ভূমিকায় নামতে হবে। আমি যে বহুরূপী!

আজ রাত দশটায় আমার সঙ্গে চলুন খিদিরপুরের কিং জর্জেস ডকের ফটকে। লক্ষ করুন সবুজ—চেক লুঙ্গিপরা আধময়লা গেঞ্জি গায়ে তৈলাক্ত চুলে পরিপাটি করে টেরি—কাটা যে মুসলমান জাহাজী মাল্লাটি এইমাত্র এলো। ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমার ফাঁকে একটা সিগারেট চেপে ধরে ঘন ঘন টানছে আর শিস দিয়ে একটা গজলের সুর ভাঁজছে। ভেতরে যেতেই ফটকে মোতায়েন কনস্টেবল হেঁকে উঠল, কৌন হ্যায়?

জড়িত কণ্ঠে জবাব এলো, মহম্মদ রশিদ।

কাঁহা যাতা?

ইস্টিমারমে—এস. এস. স্যাভেজ গার্ল।

কাঁহা গিয়া থা?

লোকটা তার পাতলা নূর চুমরে একটু হাসল। তারপর বললে, থোড়া পিনে কো লিয়ে সিপাহিজি—ইয়ে চাঁদনি, ইয়ে আশকভ্যরী বাহার….মওজ উড়াও সিপাহিজি—জওয়ানি বীত যায়েগি!

হা হা করে মহম্মদ রশিদ হেসে উঠল।

কনস্টেবল আবার হেঁকে উঠল, এই হল্লা করো মৎ! চুপচাপসে চলা যাও।

স—স—স!—মহম্মদ রশিদ নিজের ঠোঁটে আঙুল চেপে আওয়াজ করলে। তারপর টলতে টলতে ভেতরে ঢুকে গেল।

ওকেই আমাদের অনুসরণ করতে হবে।

ফাল্গুনের এই জ্যোৎস্না—রাত্রে কিছু তরল পদার্থের গুণে মহম্মদ রশিদের প্রাণে তখন বোধ করি জোয়ার এসেছে। হঠাৎ সে গলা ছেড়ে গান ধরলে :

তু মেরা চাঁদ, ম্যয় তেরি চাঁদনি হো….

গাইতে গাইতে লোকটা স্থলিত পায়ে এগোতে লাগল, যেখানে একটা স্প্যানিস কার্গো—বোট এসে লেগেছে। জাহাজটা আসছে সিঙ্গাপুর থেকে। তারই সামনে দাঁড়িয়ে মহম্মদ রশিদ গানের নামে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল :

নেহি দিলকা লাগানা কোই দিল্লাগী—কোই দিল্লাগী—

একটু পরেই জাহাজের ওপর থেকে একটা চাপা শিসের আওয়াজ শোনা গেল। যেদিকটায় কুলিরা মাল খালাস করছিল, সেদিকে না গিয়ে মহম্মদ রশিদ অন্যদিকে একটা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে উঠে গেল। জাহাজের এদিকটায় আবছা অন্ধকারে গোল টুপি পরা একটি মুর্তি রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়েছিল। মহম্মদ রশিদ চাপা গলায় ডাকলে, পিটার!

মূর্তিটি এগিয়ে এলো। একজন স্প্যানিস খালাসি।

মহম্মদ রশিদ পরিষ্কার ইংরিজিতে জিজ্ঞাসা করলে, খবর কি? বেবি কোথায়?

পিটার জবাব দিলে, বেবি তোমার জন্যে তৈরি হয়ে আছে। আগে টিকিট দাও।

মহম্মদ রশিদ ট্যাঁক থেকে একটা আংটি বের করে দিলে হিরের টুকরোটা ঝলসে উঠল। আংটিটা হাতে নিয়ে পিটার লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, আ!

তারপর নিজের কোমর থেকে একটা চওড়া বেল্ট খুলে মহম্মদ রশিদের হাতে দিলে।

রশিদ জিজ্ঞাসা করল, কতটা আছে?

পাউন্ডখানেক হবে।

বেল্টটা লুঙ্গির ওপরে নিজের কোমরে আঁটতে আঁটতে রশিদ বললে, আরও বেশি আশা করেছিলাম।

পিটার তার কাঁধ চাপড়ে বললে, বেটার লাক নেকস্ট টাইম।

পুরোনো খদ্দেরকে ভুলে যেও না পিটার। পরের বার কিছু স্প্যানিস মদ আমার চাই। তাই হিরের আংটিটা আগাম দিয়ে রাখলাম।

ও. কে ডিয়ার।

মহম্মদ রশিদ আবার দড়ির সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। তারপর গলা ছেড়ে গান ধরে টলতে টলতে ফটকের রাস্তা ধরলো।

কনস্টেবল আবার রুখলে, ফির কাঁহা যাতা হায়?

চোখের একটা ইসারা করে রশিদ বললে, সচ বাতাউ? তারপর কনস্টেবলের কানের কাছে মুখ এগিয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বলল।

ক্রুদ্ধ কনস্টেবল তাড়া দিয়ে উঠল, হট।…দিল্লাগী মিলা হায়?

তেরি কসম ইয়ার’—নেশার ঝোঁকে মহম্মদ রশিদ হেসে গড়িয়ে পড়ল।

কনস্টেবল আবার ধমকে উঠল, কেয়া হায় তেরে পাশ?

কুছ নেহি ইয়ার। স্রিফ ইয়ে দিল—

তারপর পুনরায় জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে গান ধরল :

 এক দিলকা টুকড়ে হাজার হুয়ে

 কোই ইঁহা গিরা, কোই উঁহা গিরা—

নেশায় টলমল রশিদকে দেখে কনস্টেবলের বোধকরি ধারণা হল, লোকটা বেহেড মাতাল ছাড়া সন্দেহজনক কিছু নয়। বিরক্ত হয়ে সে বললে, যা ভাগ।

‘আদাব মেরি রাজা’ বলে এক দীর্ঘ কুর্নিশ জানিয়ে রশিদ স্খলিত পায়ে ফটক থেকে বেরিয়ে গেল। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, লোকটা হোঁচট খেয়ে এখুনি পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য ডক এলাকা পার হয়ে বড় রাস্তায় পা দিতেই রশিদের চলন গেল বদলে। দ্রুতপায়ে এগিয়ে সে একটা বড় গাছের নীচে কালো রঙের একটা অপেক্ষমান মোটরে টপ করে উঠে পড়ল। তারপর বললে, চালাও মাহাঙ্গু—খবরদার, হেডলাইট জ্বেলো না যেন।

গাড়িটা অন্ধকারে সাঁ করে বেরিয়ে গেল।

রাস্তার উলটো দিকে একখানা জিপ দাঁড়িয়েছিল। ভেতরে দুটি ছায়ামূর্তি। একজন অপরকে বললে, গাড়িখানার পেছু নাও গুপ্ত। এ লালজি ছাড়া কেউ নয়।

খিদিরপুর ব্রিজ পার হয়ে কালো রঙের গাড়িটা রেসকোর্সের পাশের রাস্তা ধরলো।

কানা মাহাঙ্গুর একটা চোখ রাত্রে বেড়ালের মতো জ্বলে। বার দু’য়েক মুখ বাড়িয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে সে বললে, একটা জিপ পিছু নিয়েছে হুজুর। একটা গাড়ি খিদিরপুরে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের থেকে তফাতে দাঁড়িয়েছিল। এ সেই গাড়িটাই মালুম হচ্ছে।

পিছনের সিটে মহম্মদ রশিদ তখন লুঙ্গি আর গেঞ্জির বদলে ট্রাউজার আর হাফ শার্ট পরেছে। মুখে দাড়ির চিহ্নও নেই। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, বেকুফ! একথা আগে বলনি কেন?

মাহাঙ্গু জিজ্ঞাসা করলে, স্পিড দেব?

তাতে কোনো লাভ হবে না। জিপটাকে এগিয়ে যেতে দাও।

গাড়ি ততক্ষণে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে এসে পড়েছে। অকস্মাৎ মাহাঙ্গু প্রাণপণে ব্রেক কষলো। প্রচণ্ড একটা আর্তনাদ করে কালো রঙের গাড়িখানা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পাশ দিয়ে জিপখানা বেরিয়ে গেল তিরের মতো।

চোখের পলকে মাহাঙ্গু স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে এক্সেলেটর চেপে ধরলো। মেমোরিয়ালের পাশের রাস্তায় গাড়িখানা সবেগে উধাও হয়ে গেল।

জিপের ড্রাইভার এজন্যে একেবারেই তৈরি ছিলেন না। অনেকটা দূর এগিয়ে গিয়ে তিনি যখন গাড়ি ঘোরালেন, তখন কালো রঙের গাড়িখানার চিহ্নমাত্রও দেখা যায় না।

গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে গুপ্ত বললেন, বেমালুম চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ল হে বিশু! এখন আর কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে বল?

অফিসার গুপ্ত খুঁজে না পেলেও কালো রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানাকে আরো আধ ঘণ্টা পরে আমরা কিন্তু খুঁজে পেলাম। বেলেঘাটা ছাড়িয়ে ট্যাংরায় এসে গাড়িখানা থামল একটা কাঠের ফটকের সামনে। ফটকের ভেতরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে সারি সারি কাঠের বাড়ি। কাঁচা মেটে রাস্তার দু’পাশে দূরে দূরে একটা করে চিনে—লণ্ঠন ঝোলানো। তাতে অন্ধকার আরও বেশি ঘন হয়েছে। কাঁচা চামড়ার অস্বস্তিকর গন্ধে পাড়াটার হাওয়া ভারী হয়ে আছে। লোকে এই পাড়াটাকে বলে, ‘চায়না টাউন’। চামড়ার কারবারি চিনাদলের আস্তানা এখানে।

সমস্ত পাড়াটা যেন তন্দ্রায় ঝিমিয়ে আছে। শুধু ঝোলানো লণ্ঠনগুলির নীচে ছোট ছোট কাঠের টুলের ওপর বসে জেগে আছে কয়েকটি চিনা। থ্যাবড়া, গোল মুখগুলি ভাবলেশহীন। ছোট ছোট কুতকুতে চোখ নেশায় যেন ঢুলছে।

কাঠের ফটক ঠেলে লালজি ভেতরে ঢুকল। দেখা গেল, প্রথম চিনাটির ঝিমানো চোখ দুটো হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠেছে। লালজি তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় বললে, বাজপাখী।

প্রথম চিনাটি একবার ঘাড় নেড়ে শিস দিয়ে উঠল। তার আওয়াজ মিলিয়ে যেতে না যেতেই অদূরে দ্বিতীয় চিনাটির মুখ দিয়ে অনুরূপ শিসের আওয়াজ বেরোল। তারপর তৃতীয়—চতুর্থ—

অন্ধকার রাত্রিকে শিউরে দিয়ে শিসের আওয়াজ ক্রমশ দূরে চলে গেল।

সেই গা—ছমছমে পথে লালজি এগিয়ে যেতে লাগল। থামল গিয়ে কাঁচা মাটির রাস্তাটা যেখানে একটা প্রকাণ্ড বিলের ধারে শেষ হয়েছে। বাঁ—দিকে একটা কাঠের বাড়ির দরজায় বসে একজন চিনা বুড়ি। শনের মতো পাকা চুল। মুখের কোঁচকানো চামড়া যেন অতীতের শিলালিপি। পায়ের আওয়াজ পেয়েই খনখনে বুড়ি বলে উঠল, কে যায়?

লণ্ঠনের সামনে এগিয়ে গিয়ে লালজি বললে, তোমার বাজপাখী বুড়ি—মা।

দন্তহীন মুখে বুড়ি একগাল হাসলে। বললে, বেশ, বেশ, ভালো তো? যাও, ভেতরে ওয়াং আছে। যাবার সময় আমার দস্তুরিটা দিয়ে যেও।

দেব বৈকি বুড়ি—মা।—বলে লালজি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ভেতরে ছোট ছোট কাঠের খুপরির পাশ দিয়ে চোরা গলিপথ। সেই পথ দিয়ে গেলে হলের মতো একটা বড় ফাঁকা জায়গা, অনেকটা ঢাকা বারান্দার মতো। মাঝখানে একটা লম্বা কাঠের টেবিল, দু’পাশে সরু বেঞ্চি। ঘরের চাল থেকে বড় বড় দুটো চিনে—লণ্ঠন ঝুলছে। টেবিলের দু’পাশে নানা জাতের সমাবেশ,—চিনে, বাঙালি, ভাটিয়া, পাঞ্জাবি, মুসলমান। তবে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সংখ্যাই বেশি। বেঞ্চিতে যারা জায়গা পায়নি, তারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।

জুয়া চলছিল। তার সঙ্গে চোলাই মদ আর চন্ডু। টেবিলের এক—প্রান্তে একটা উচু কাঠের টুলের ওপর বসে ঘোর তামাটে বর্ণের একজন চিনা বসে। হাতকাটা গেঞ্জির ফাঁকে তার দেহের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, মনে হয় পাথরে কোঁদা। ছোট করে চুল ছাঁটা, মুখে একটা বর্মা চুরুট। লোকটার বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তার সামনে টেবিলের ওপর স্তূপাকার নোট, টাকা আর খুচরো পয়সা। মাথা—বেঁকানো একটা লাঠির সাহায্যে মাঝে মাঝে সে লম্বা টেবিলের মাঝখান থেকে টাকা—পয়সা এনে সামনে জড়ো করছিল। তার মুখের চেহারা আর অত্যন্ত সজাগ লালচে চোখ দু’টো দেখলে স্বতঃই মনে হয়, লোকটা শেয়ালের মতো ধূর্ত, সাপের মতো ক্রুর, আর শয়তানের মতোই নিষ্ঠুর।

এই হল ওয়াং। জুয়ার আড্ডার মালিক বা ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডেন কিপার’।

তারই কোলের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে বছর ন দশের একটি চিনা মেয়ে একমনে তাসের খেলা দেখছিল। শিশির—স্নিগ্ধ ফুলের মতো তাজা টুলটুলে মুখখানি। মাথায় একরাশ কালো চুলের স্তবক। চোখ দুটি কেমন যেন শান্ত বিষণ্ণ। তার পাশে টেবিলে ঠেস দিয়ে রাখা একটা ‘ক্রাচ’। ওরাংয়ের বুকের কাছে এই মেয়েটিকে দেখলে মনে হয়, একটা রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে যেন ছোট্ট একটি বনফুল! দুজনকে দেখতে নিতান্তই বেমানান,—তবু ওয়াংয়ের আড্ডার লোকেরা জানে যে, এই মেয়েটিকে ছাড়া ওয়াং কখনও জুয়ার টেবিলে বসে না।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে লালজি ঘরের আবহাওয়াটা লক্ষ করছিল। তাকে দেখতে পেয়ে মেয়েটা ওয়াংয়ের কোল ছেড়ে ক্রাচে ভর দিয়ে খট খট করে কাছে এসে দাঁড়াল। দেখা গেল, মেয়েটার ডান পায়ের হাঁটু থেকে নীচের অংশটা দড়ির মতো সরু লিকলিকে। একমুখ হেসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, হেল—লো লাল, এতদিন আসোনি কেন? কোথায় ছিলে?

সস্নেহে মেয়েটির গাল দুটি স্পর্শ করে লালজি বললে, আকাশে। তোমার জন্যে কি এনেছি বলো তো মিমি?

সরল চোখদুটি মেলে মিমি শুধু তাকিয়ে রইল।

লালজি বললে, আগে চোখ বন্ধ কর।

চোখ বুজতেই লালজি পকেট থেকে টফি বার করে মেয়েটির হাত ভরে দিল।

তুমি কত ভালো। আনন্দে আর কৃতজ্ঞতায় লালজির হাতখানা ধরে মেয়েটি নিজের গালের ওপর একবার চেপে ধরলো। ঠিক সেই সময় মোটা কর্কশ গলার ডাক এলো, মিমি!

লালজি দেখলে, টেবিল ছেড়ে ওয়াং উঠে আসছে।

তোমার শোবার সময় হয়েছে মিমি।

মাথা ঝাঁকি দিয়ে মিমি বললে, না। আমি এখন লালজির সঙ্গে গল্প করবো।

রাত জাগলে অসুখ করবে পাজি মেয়ে।

না, অসুখ করবে না।

ভারী একগুঁয়ে মেয়ে। তারপর লালজির দিকে চেয়ে ওয়াং বললে, খবর কি?

লালজির কাছ থেকে জবাব এলো : বাজপাখি শিকার ধরে এনেছে।

কি শিকার?

কোকেন। প্রায় এক পাউণ্ড।

কোমর থেকে বেল্টটা খুলে লালজি ওয়াংয়ের হাতে দিল। ওয়াংয়ের মুখে একটিও রেখা পড়ল না। কোমর থেকে একখানা ছুরি বের করে নিঃশব্দে সে বেল্টের খানিকটা চিরে ফেলল। দেখা গেল, ভিতরটা সাদা পাউডারে ভর্তি।

একটু জিভে ঠেকিয়ে দেখলে সে। তারপর লালজিকে জিজ্ঞাসা করল, টাকাটা আজই চাই?

এখুনি।

বেশ। ওয়াং কখনও ধারে কারবার করে না।

টেবিলে ফিরে গিয়ে ওয়াং কতকগুলো নোট গুনে গুনে লালজির হাতে দিল। তারপর বললে, অল রাইট?

লালজি হেসে বললে, অল রাইট ওয়াং। গুড নাইট।

টেবিলে বসবে না?—ওয়াং প্রশ্ন করল। আজ বোর্ড খুব ভারী।

লালজি এক মুহূর্ত ভাবলে। তারপর টেবিলের একপাশে বসে পড়ে বললে, আচ্ছা, তাস দাও। টাকাটা খানিকটা বাড়িয়ে নিয়েই যাই।

লালজি জুয়ার টেবিলে বসাতে চারপাশে উৎসাহের লক্ষণ দেখা দিল। জনকয়েক অ্যাংলো ছোকরা বলে উঠল, উইশ, ইউ লাক, লাল।

কেউ কেউ বিদ্রুপের হাসি হেসে বললে, দেখাই যাক!

খেলা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ভাগ্য কারো একচেটে নয়। গোড়া থেকেই লালজি হারতে শুরু করল।

চারপাশে গুঞ্জন উঠলো : এ তো জানা কথা! ওয়াংয়ের টেবিল থেকে কেউ কখনও জিতে ফিরে যেতে পারে না—তা সে যে—ই হোক।

পরের বাজির তাস দেওয়া হল। লালজি দান তুলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার কানের গোড়ায় ফিস ফিস করে কে যেন বললে বাবার তাসগুলো দাগী!

মিমি যে কখন এসে লালজির কোলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে, কেউই তা লক্ষ করেনি।

মোটা কর্কশ গলায় ওয়াং বললে, বাজি ধরো লাল—

সোজা ওয়াংয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লালজি ধীরে ধীরে বললে, ধরবো। কিন্তু তার আগে এই পুরোনো তাসের বদলে নতুন তাস আনো।

ওয়াং যেন একটু চমকে উঠল : তোমার একথার মানে?

তেমনি শান্ত গলায় লালজি বললে, তোমার কার্ডগুলো চিহ্ন দেওয়া। হয় নতুন কার্ড আনো, না হয় তো আমার টাকা ফিরিয়ে দাও।

টেবিলের চারপাশে প্রবল চাঞ্চল্য দেখা দিল। একদল লালজির পক্ষ নিয়ে, আর একদল ওয়াংয়ের পক্ষ নিয়ে শোরগোল শুরু করলে। উত্তেজিত অ্যাংলো ছোকরার দল চিৎকার করে উঠল : এমন জুয়াচুরির কারবার ক’দ্দিন চালাচ্ছ ওয়াং? আমাদের অনেক টাকা খেয়ে তোমার পেট মোটা হয়েছে! এবার নতুন করে তাস আনাও, নয়ত এখুনি টাকা ফেরত দাও—

ওয়াংয়ের লালচে চোখ দুটো একবার দপ করে জ্বলে উঠল, তারপর সোনা—বাঁধানো দাঁতগুলো বের করে নেকড়ের মতো নিঃশব্দে হাসল।

সমস্ত ঘরখানা এক নিমেষে চুপ! ওয়াংয়ের এ—হাসির অর্থ সকলেই জানে। জানে যে, এই হাসির পর অন্তত বিশখানা চিনে ছুরি বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।

চারপাশে একবার তাকিয়ে ওয়াং থেমে থেমে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, এই ইঁদুরগুলোর কথা আমি ধরি না। কিন্তু তুমিও যদি এদের দলে যোগ দাও লাল, তাহলে তোমাকেও—

ওয়াংয়ের মুখের কথা শেষ হল না। ট্রাউজারের পকেট থেকে ছোট একটা অটোমেটিক পিস্তল বের করে, খেলনার মতো লুফতে লুফতে লালজি বললে, এটা সম্প্রতি কিনেছি, ভারী সুন্দর, না ওয়াং?

ওয়াংয়ের দুই চোখ যেন জ্বলন্ত দু’টুকরো কয়লা।

ঘরে সুঁচ পড়লে শব্দ শোনা যায়।

পিস্তলটা আবার পকেটে পুরে সহজ গলায় লালজি বললে, কি করবে বলো ওয়াং? টাকা ফেরত দেবে, না নতুন তাস আনবে? আর বেশিক্ষণ বসতে পারব না।

ওয়াংয়ের ইশারায় একজন চিনা এক প্যাকেট নতুন তাস নিয়ে এল।

আবার শুরু হল খেলা। দেওয়া হল চারখানা করে কার্ড। রাগে উত্তেজনায় ওয়াং মোটা বাজি ধরলে। তারপর জিজ্ঞাসা করলে, লাল না কালো?

টেবিলের ওপর আঙুলের টোকা মারতে মারতে লালজি বললে, লাল।

ওয়াং বললো, শো।

তাস তোলবার আগেই লালজির ডান হাতখানা ধরে নিজের গালের ওপর মিমি একবার চেপে ধরলো।

ককর্শগলায় ওয়াং আবার হেঁকে উঠল, শো।

লালজি চারখানা তাস একে একে চিত করে দিল। চারখানা তাসই লাল রঙের।

উচ্ছ্বাসে অ্যাংলো ছোকরার দল চিৎকার করে উঠল—যেন জিৎ তাদেরই।

জ্বলন্ত চোখে মিমির দিকে চেয়ে ওয়াং ডাকলে, এদিকে এসো মিমি!

লালজির পাশ থেকে মিমি কিন্তু নড়ল না।

ওয়াং আবার গর্জন করে উঠল, এদিকে আয় বলছি, শয়তানের বাচ্চা!

ক্রাচে ভর দিয়ে মিমি সোজা হয়ে দাঁড়াল। দুই চোখে উপচে—পড়া ঘৃণা নিয়ে তাকাল বাপের দিকে। তারপর ‘আমার ঘুম পেয়েছে, আমি শুতে যাই’ বলে খট খট করে চলে গেল।

ওয়াংয়ের সামনে হাত মেলে লালজি হেসে বললে, শুনেছি, ওয়াং কখনও ধার রাখে না। সুতরাং—

চাপা রাগে ওয়াং পিচ করে মেঝের ওপর খানিকটা থুতু ফেললে। তারপর অনেকগুলো নোট লালজির হাতের ওপর ছুড়ে দিলে।

নোটগুলো পকেটে পুরে লালজি দাঁড়িয়ে উঠে বললে, গুড নাইট ওয়াং। আবার দেখা হবে।

ওয়াং পিচ করে আবার থুতু ফেলল। তারপরে চারপাশে একবার তাকিয়ে বলে উঠল, দেখ, দেখ, পেনটুলেন—পরা মেয়েটা টাকা জিতে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।

ওয়াংয়ের দল হো হো করে হেসে উঠল। চুপ করে বসে রইল শুধু অ্যাংলো ছোকরার দল। লালজি একবার হাতঘাড়ির দিকে তাকাল। বারোটা বাজতে সতেরো মিনিট।

আরক্ত মুখে লালজি আবার টেবিলে বসে বললে, বেশ, আর একটা চান্স তোমায় দিচ্ছি ওয়াং। নাও, তাস দাও।

চারখানা করে তাস দেওয়া হল। এবার লালজি—বললে, লাল—কালোর জোড়া।

গুনে গুনে হাজার টাকার নোট টেবিলের ওপর রেখে ওয়াং চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, আর একবার ভেবে বলো লাল। হারলে তোমার দু’হাজার বেরিয়ে যাবে। তখন কান্নাকাটি করো না যেন! আবার ভেবে বলো।

শান্তগলায় জবাব এলো : লালজি কখনও দু’বার ভাবে না ওয়াং। তুমিই বরং আবার শুনে রাখ—লাল—কালোর জোড়া।

শো।

তাস চারখানা লালজি উলটে দিল। সত্যিই লাল—কালোর জোড়া।

তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে গেল। আনন্দে অ্যাংলো ছোকরার দল মদের গেলাস ছুড়তে লাগল। হাজার টাকার তাড়াটা পকেটে ভরে লালজি ওয়াংয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, আশা করি, এর পর তোমার আর কিছু বলবার নেই ওয়াং?

সোনা—বাঁধানো দাঁত বের করে আর একবার নেকড়ের মতো শুধু হাসলে ওয়াং।

গুড নাইট।

লালজি দরজার দিকে এগোল। সঙ্গে সঙ্গে পাশের দু’জন চিনার সঙ্গে ওয়াংয়ের কি ইসারা হয়ে গেল কে জানে। টেবিলের পাশ থেকে লোক দু’টো নিঃশব্দে সরে গেল।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার গোড়ায় ঘুরে দাঁড়াল লালজি। সেখান থেকেই বললে, একটা কথা জানিয়ে যাই ওয়াং। লালজির মাথার পেছন দিকেও দুটো চোখ আছে। অন্ধকারে সে—দুটো বাঘের চোখের মতোই জ্বলে।

দরজার বাইরে চোরা গলিপথে লালজির মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল।

হঠাৎ সেই অন্ধকার চোরা গলিপথে কে যেন অত্যন্ত কোমল গলায় বলে উঠল, তুমি চলে যাচ্ছো?

লালজি ভালো করে তাকিয়ে দেখল, ক্রাচে ভর দিয়ে মিমি দাঁড়িয়ে। মেয়েটা বিছানা ছেড়ে চুপি চুপি কখন উঠে এসেছে, কে জানে! সরল বিষণ্ণ দুটি চোখ মেলে বললে, আমার কথা তুমি ভুলে যাবে না লাল?

নীচু হয়ে মিমির কপালে একটা চুম্বন দিয়ে লালজি বললে, তোমায় কখনও ভুলব না মিমি। এইবার শুতে যাও, লক্ষ্মী মেয়ে! তোমার বাবা জানতে পারলে রাগ করবে।

মিমি চলে গেল। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে লালজি সদর দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিল।

দরজার বাইরে সেই শাঁকচুন্নি বুড়ি বসে। একখানা নোট তার হাতে গুঁজে দিয়ে লালজি বললে, তোমার দস্তুরি বুড়ি—মা।

দন্তহীন মুখে বুড়ি হাসলে : বেশ, বেশ আবার এসো।

চলতে চলতে লালজি হাতঘড়িটায় দেখলে, বারোটা বাজতে সাত।

ট্যাংরা থেকে দৃশ্যপট বদলে গেল ইন্টালির ডিহি শ্রীরামপুর রোডের একটা ছোট ঘরের মধ্যে।

চলুন ওই ঘরে।

নিতান্ত নিরাভরণ দরিদ্র ঘর। একখানা চার—পায়ার ওপরে বুক অবধি খদ্দরের চাদরে ঢেকে বাইশ—তেইশের একটি যুবক শুয়ে শুয়ে হাঁপাচ্ছিল। শীর্ণ গালভাঙা মুখে চোয়ালের হাড় দুটো ঠেলে উঠেছে। রংটা হয়তো এককালে টকটকে সোনার মতো ছিল, এখন কাগজের মতো সাদা। ফুল শুকিয়ে যাবার পরেও পাপড়িগুলি বোঁটায় লেগে থাকলে যেমন দেখতে হয়, রুগ্ন ছেলেটির চেহারা ঠিক তাই। শুধু কোটরে—বসা চোখের তারায় অনির্বাণ প্রাণশক্তি এখনও জ্বলজ্বল করছে।

রুগ্ন ছেলেটির পাশে একটা মোড়ায় বসে আছে সাদা খদ্দরের থান—পরা একটি যুবতী। শীর্ণ একহারা দেহ। কাঁচা হলুদের মতো রং। হোমের আগুন যেন নিভে এসেছে, মুখে তেমনি সকরুন তপঃশুদ্ধ ভাব।

ছেলেটির বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মেয়েটি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করল, বড্ড কষ্ট হচ্ছে শামু?

শামু তখনও হাঁপাচ্ছিল। তবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললে, কই, না তো। আমার কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না। আজ তো কাশির সঙ্গে আর রক্ত পড়েনি! তুই এত ভাবনা করছিস কেন দিদি?

একটু ঘুমোবার চেষ্টা কর শামু।

শামু বললে, ঘুম আসছে না। তার চেয়ে দু’জনে গল্প করি আয়। আচ্ছা, বিয়াল্লিশের সেই আগস্ট—আন্দোলনের কথা তোর মনে আছে দিদি? মিদনাপুর যাবার আগে তুই আমার কপালে সেই রক্ত—চন্দনের ফোঁটা—

এখন আর কথা বলিসনে শামু। আবার কাশি আসবে।

শামু বলে যেতে লাগল, যাবার আগে তুই বলেছিলি, ‘তুই যদি আর ফিরে না আসিস শামু, তবু আমি দুঃখ করব না। ভাবব, ভাইয়া অমার তীর্থে গেছে।’ তোর সে—কথা আমি আজও ভুলিনি দিদি।…তারপর সেই ছাত্র—আন্দোলনের সময় নিজের শাড়ি ছিঁড়ে আমার মাথায় পটি বেঁধে দিয়ে সারাটা রাত খোলা রাস্তার ওপর আমাদের সঙ্গে জেগে বসেছিলি। তোর মনে আছে দিদি?

একটু চুপ কর শামু। ঘুমোবার চেষ্টা কর।

শান্ত শিশুর মতো শামু বললে, আচ্ছা।

একটা এলুমিনিয়ামের বাটিতে একটু দুধ ঢাকা ছিল। শামুর দিদি কাগজ জ্বেলে সেটুকু গরম করে এনে বললে, এটুকু আগে খেয়ে নাও।

শামু বললে, এখন তো আমার ওষুধ খাবার সময়। ওষুধটা আগে দাও।

পলকে দিদির মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। পয়সার অভাবে আজ ওষুধ কেনা হয়নি। তাড়াতাড়ি ঘরের কোণে টেবিলের কাছে গিয়ে বলে উঠল, ইস। শিশিটা কাত হয়ে সব ওষুধটুকু পড়ে গেছে দেখছি। আমারই রাখার দোষ।

অল্প একটু হেসে শামু বললে, ভালোই হয়েছে। তুই আর মিথ্যে ওষুধ কিনিস নে দিদি। আমি অমনিই সেরে উঠব।

দিদি বললে, দুধটুকু জুড়িয়ে যাচ্ছে শামু।

আমি তো দুধ খাব, কিন্তু তুই—তুই খাবি কি?

আমার আজ খেতে নেই, ব্রত আছে।

দিদির মুখের দিকে শামু কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল। তারপর বললে, রোজই তোর ব্রত? তুই কি ভাবিস আমি কিছু বুঝিনে? আমাকে বাঁচাতে গিয়ে তুই কি নিজে মরবি দিদি?

নীরবে দিদি দুধটুকু ফিডিং কাপে ঢালতে লাগল।

জানালার ধারে রাখা ল্যাম্পের শিখাটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিল। তেল বোধ হয় ফুরিয়ে এসেছে।

সেইদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শানু কতকটা আপন মনেই বললে, একদিন শুধু বাঁচবার জন্যেই আমরা দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য, দেশ যখন স্বাধীন হল, তখন আমরা মরতে বসেছি!…. ওকি! আবার কাঁদছিস দিদি?

ধরা গলায় দিদি বললে, আর কাঁদব না শামু। দুধটুকু খেয়ে ফেলো।

দুধ খেয়ে শামু আস্তে আস্তে চোখ বুজলো। আর তার রুক্ষ চুলে আঙুল চালাতে চালাতে দিদি কস্তুরী প্রাণপণে কান্না রোধ করতে লাগল। বড় সত্যি কথা বলেছে শামু। সারা জীবন বাঁচবার সাধনা করে মিলেছে শুধু মৃত্যুর অভিশাপ। পনেরো বছর আগে কস্তুরীর বাবা প্রাণ দিয়ে গেছেন কংগ্রেসের সেবায়। শামু তখন শিশু। স্বামী মারা গেছেন ‘কাকোরী ষড়যন্ত্র—মামলার’ আসামি হয়ে জেলের মধ্যে। আর আজ দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, তখন মরতে বসেছে তার ছোট ভাই—শামু। কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী শ্যামলাল ক্ষেত্রী।

টস টস করে জল গড়িয়ে এলো কস্তুরীর গাল বেয়ে। পারে না—আর সে পারে না। সারাটা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে, অভাবের সঙ্গে যুঝে কস্তুরীর সে মনের জোর আর নেই।

ল্যাম্পের শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। কখন নিভে যায়, কে জানে।

শামু হঠাৎ চোখ মেলে বলে উঠল, একদিন কিন্তু পৃথিবীতে এ—দুঃখ থাকবে না—থাকবে না এত অভাব, এত কষ্ট, একমুঠো খাবার, এক ফোঁটা নিঃশ্বাসের জন্যে এত আকুলি—বিকুলি! দেশ, স্বাধীনতা, সব কিছুর চাইতে বেঁচে থাকার দাম যে বড়, একথা মানুষ বুঝতে পারবে।—জোরে জোরে নিঃশ্বাস টেনে শামু বলে যেতে লাগল, সেদিন আকাশ আরও নীল হবে, মাটিতে ফলবে আরও সোনার ফসল….সেদিন হয়তো আমি থাকব না, তবু বলে যাচ্ছি…

খক খক করে আবার কাশি শুরু হল। ভাইটির বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সজল ব্যাকুল কণ্ঠে কস্তুরী বললে, সেদিনও তুই থাকবি শামু, সেদিনও তুই থাকবি। তোকে আমি সারিয়ে তুলব—স্যানাটোরিয়ামে পাঠাব—

একঝলক রক্ত তুলে শামু তখন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ক্ষীণ স্বরে বললে, তুই জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস দিদি? টাকা পাবি কোথায়? কে দেবে?

ধীর স্বরে কস্তুরী বললে, গরিবের বন্ধু!

একটু তিক্ত হাসি শামুর পাণ্ডুর ঠোঁটে দেখা দিল। বললে, গরীবের বন্ধু দুনিয়ায় কেউ আছে নাকি? একথা তুই আজও বিশ্বাস করিস?

বিশ্বাস করি বৈকি ভাইয়া। ডক্টর সাহেবের চেম্বারে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। শুনলাম মস্ত বড়লোক। ডক্টর সাহেবের সঙ্গে তাঁর দোস্তি আছে। প্রায়ই আসেন রোগীদের খোঁজ— খবর নিতে। আমার মুখে তোর অবস্থার কথা শুনে বললেন, কোনো চিন্তা নেই, টাকার জন্যে আপনার ভাইয়ার চিকিৎসা আটকাবে না। টাকা আপনি পৌঁছে যাবে। সেই থেকে আমি রোজ দিন গুনছি শামু।

তোর দিন গোনা ফুরোবার আগে আমিই ফুরিয়ে যাব দিদি।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কস্তুরী কান্না সামলে নিল। বললে, ছিঃ! অমন কথা মুখে আনিসনি ভাইয়া। একটু ঘুমো, রাত অনেক হল।

পাশের ভাড়াটেদের ঘড়িতে তখন বারোটা বাজার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

কস্তুরীর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। কই, আজও তো সে এলো না! তবে কি তার দিন গোনা সত্যিই ফুরোবে না? তার আগেই ফুরিয়ে যাবে এই নির্মল, নিষ্পাপ, তরুণ শামুর শেষ নিঃশ্বাস?

নিভন্ত ল্যাম্পের শিখাটা কেঁপে উঠল।

টপ করে একখানা লম্বা—চওড়া খাম এসে পড়লো শামুর বিছানার ওপর….

চমকে উঠে কস্তুরী তাকিয়ে দেখল, কালো একখানা হাত জানলার বাইরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খামটা খুলতেই দেখা গেল একরাশ নোট আর একখানা চিঠি। কস্তুরীর হাত তখন ঠক ঠক করে কাঁপছে। চিঠিখানা কুড়িয়ে নিয়ে সে পড়লো :

আপনার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য দুই হাজার টাকা পাঠাইলাম। কোনো পাহাড়ি জায়গায় ভালো স্যানাটোরিয়ামে তাহাকে পাঠাইয়া দিন। প্রয়োজন মতো আরও টাকা ঠিক সময়ে পৌঁছিবে। আশা করি, আপনার ভাইটি সত্বর নিরাময় হইয়া উঠুক।

 মোহিতমোহন

শামু অভিভুতের মতো প্রশ্ন করলে, এত টাকা কোত্থেকে এলো দিদি? কে দিল?

হাত দুটি জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে কস্তুরী শুধু বললে, গরিবের বন্ধু!

কুইন মেরি হোটেলের ছ’নম্বর কামরায় আজ সপ্তাহখানেক হল বছর পঁচিশ—ছাব্বিশের একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। নাম শীলা রক্ষিত। ফুল—হাতা ব্লাউজ গায়ে, চুলগুলি কপালের ওপর আঁট করে তুলে বাঁধা, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। নিতান্ত সাধাসিধে চেহারা। তবু ভিড়ের মধ্যে মিশিয়ে যাবার মতো নয়।

শীলা প্রৌঢ়া লেডি মুখার্জীর নতুন গভর্নেস। মেয়েটি এসেছিল তাঁর যৌবনকালের বন্ধু ব্যারিস্টার এস. এন. গুহ’র চিঠি নিয়ে। সুতরাং তাকে ফিরিয়ে দেওয়া গেল না। কাজে—কর্মে মেয়েটি মন্দ নয়। শুধু একটু একগুঁয়ে। তা হোক, শীলাকে লেডি মুখার্জীর মোটামুটি পছন্দই হয়েছে।

বিধবা হবার পর থেকে লেডি মুখার্জী ময়ূরভঞ্জে তাঁর জমিদারিতেই বাস করছিলেন। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসা করাতে। রোগটা তাঁর কি—ডাক্তারেরা আজও ধরতে পারেননি। তিনি নিজেও ঠিক জানেন না। কিন্তু আমরা জানি। নিঃসন্তান ধনী মহিলাদের সময় কাটাবার মতো যখন কিছুই থাকে না—বন্ধু—বান্ধবের সঙ্গে পার্টি—পিকনিকে হুল্লোড় করে বেড়াবার মতো বয়স আর যৌবনের গরিমা যখন পার হয়ে যায়, তখন তাঁদের এই রোগটাই দেখা দেয়। মাঝে মাঝে চোখ কপালে তুলে মূর্ছার ভাব হয়—আর কিছুই নয়।

সুতরাং সদাসর্বদা দেখাশুনো করার জন্যে একজন ভদ্র পরিচারিকা দরকার। শীলা তাই চাকরি পেয়ে গেল।

দু’খানা কামরা বাদ দিয়েই লালজির ন’নম্বর কামরা। আসতে—যেতে প্রায়ই শীলার সঙ্গে দেখা হয়। দ্বিতীয় দিন দেখা হতে বলেছিল, আমার ঘরের নাম্বার—প্লেটটা সোজা করে লাগিয়ে দিয়েছি। আশা করি, আর ভুল হবে না।

অল্প ভুরু কুঁচকে শীলা বলেছিল, অর্থাৎ আপনার ঘরে যেতে মানা করছেন?

স্মিত মুখে লালজি জবাব দিয়েছিল, সে—কথা নয়। বলছি যে, যেতে যদি হয়, ঘরটা এবার চিনেই যেতে পারবেন।

ঘর চেনার আগে ঘরের মানুষকে চেনা দরকার, তাই নয় কি?—চলে যাওয়ার আগে মুখ ফিরিয়ে শীলা বলে গিয়েছিল।

চমৎকার কথা বলতে পারে মেয়েটি! লালজি ভাবলে, না, দশের মধ্যে মিশিয়ে যাবার মতো মেয়ে এ নয়।

এরপর দিনসাতেক দু’জনে আর কোনো কথা হয়নি। দেখা হলে লালজি শুধু ঘাড় নাড়ে আর শীলা ঠোঁট দুটি অল্প খুলে হাসির ভঙ্গি করে।

আট দিনের দিন—

রাত তখন ভারী। দুটো কি আড়াইটে হবে।

লালজি তখন শুয়েছে। ঘন হয়ে এসেছে তন্দ্রা। দরজায় ঘন ঘন আওয়াজ, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েলি গলার ডাক : শুনছেন, শুনুন—ও মিস্টার—

ধড়মড় করে লালজি উঠে বসল। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে চাপিয়ে দরজা খুলতেই দেখল, শীলা। তখনও হাঁপাচ্ছে, চোখে—মুখে ব্যাকুল ভয়।

লালজি অবাক হয়ে গেল : আপনি!…ব্যাপার কি?

শীলা বললে, লেডি মুখার্জী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। হাত—পা সব ঠান্ডা হয়ে এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান ফিরে আসেনি।….কি যে করব, ভেবে পাচ্ছি না।….

ডাক্তারকে খবর দিয়েছেন?

ফোন করেছি। বললেন, আসতে ঘণ্টখানেক দেরি হবে। এতক্ষণ একা আমি সামলাই কি করে? … আসবেন একবার দয়া করে?

লালজি বললে, দয়া না করেই যাচ্ছি, চলুন।

দু’জনে যখন ছ’নম্বর কামরায় প্রবেশ করলে, তখন বিছানার ওপর লেডি মুখার্জীর মূর্ছিত দেহ পড়ে আছে। ছোটোখাটো একটা মৈনাক পাহাড়! থেকে থেকে অস্পষ্ট ‘উ’—আ’ আওয়াজ ছাড়া আর বিশেষ কিছু সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

শীলা বললে, আপনি ‘পালস’ দেখতে জানেন? আগে ‘পালস’টা দেখুন।

লেডি মুখার্জীর হাতখানা ধরে লালজি বললে, ভয়ের তো কিছু দেখছি না। ঘরে ‘স্মেলিং সল্ট’ আছে?

‘স্মেলিং সল্টে’র শিশিটা এগিয়ে দিয়ে শীলা বললে, এতে কোনো ফল হয়নি। তবু আপনি একবার চেষ্টা করে দেখুন। আমি যাই, দেখি বাবুর্চি—ঘরে যদি খানিকটা বরফ পাওয়া যায়!

তারপর দরজা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়ে বললে, আমি না আসা অবধি রোগী ছেড়ে যাবেন না যেন!

স্মেলং সল্টের শিশিটা খুলে লালজি লেডি মুখার্জীর নাকের কাছে বারকয়েক ধরলে। একটি বিরাট হাঁচি ছাড়া তাতে আর কোনো ফল হল না। হাতের তেলো দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বারকয়েক ঘষলে। তাতেও জ্ঞান ফিরে এল না। লালজি ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠছিল। রাত দুপুরে আচ্ছা ঝামেলা!

হঠাৎ কেমন একটা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেডি মুখার্জী কাতর স্বরে প্রশ্ন করলেন, আমি কোথায়?

লালজি মনে মনে বললে, ‘যমের বাড়ি’! মুখে বললে, আপনার ঘরে।

ক্ষীণ স্বরে লেডি মুখার্জী ডাকলেন, শীলা!

লালজি জানালে, শীলা বরফ আনতে গেছে, এখুনি আসবে।

কিন্তু সে—কথা লেডি মুখার্জীর কানে গেল কিনা সন্দেহ। আদুরে খুকির মতো নিতান্ত অধীর হয়ে তিনি ডাকতে লাগলেন, শীলা! শীলা!

ঠিক এই সময় দরজা ঠেলে ঢুকে শীলা বললে, বরফ পাওয়া গেল না, ফুরিয়ে গেছে!

লালজি এগিয়ে এসে বললে, এবার আপনার রুগি সামলান। আমি সরে পড়ি।

* * *

নিজের ঘরে লালজি যখন এসে দাঁড়াল, অস্পষ্ট সুখস্মৃতির মতোই মিষ্টি অথচ হাল্কা একটা সুগন্ধে তার সমস্ত চেতনা তখনো রিমঝিম করছে।

গন্ধটা ফরাসি ল্যাভেন্ডারের।

শীলার সঙ্গে দেখা হলেই এই গন্ধটা সে পায়।

পরদিন সকাল। কুইন মেরি হোটেলের লবি।

গোপীকান্ত আচার্য বলছিল, টাকাটা তাহলে কবে আদায় হবে বাবু—সাহেব?

সোনার জর্দা—কৌটো খুলে একটু মুখে ফেলে লালজি বললে, তা প্রায় মাস দুয়েক লাগবে।

গোপীকান্তর চোখ কপালে উঠল : গৌর! গৌর! বলেন কি! দু’মাস এই হোটেলের ভাত খেতে হবে? অতদিন তো আমি কলকাতায় থাকতে পারব না বাবুসাহেব!

লালজি জিজ্ঞাসা করলে, কেন বলুন দিকি?

আমার মন—কেমন করবে।

সকৌতুকে লালজি বললে, মন—কেমন করবে! বলি আচাযি মশাই, দেশে একটি সেবাদাসী রেখে এসেছেন নাকি?

গৌর! গৌর!—গোপীকান্ত লজ্জায় অধোবদন হয়ে গেল। তারপর মুখ তুলে আমতা আমতা করে বললে, ইয়ে—ওর নাম কি—দেশে একটি ময়নাপাখি পুষেছি কিনা—

তরল কণ্ঠে লালজি বললে, বুঝেছি! আপনি স্বচ্ছন্দে দেশে ফিরে যান আচায্যি মশাই। কোম্পানির চিঠি এনে দিয়েছি, ইন্সিওরের টাকা অপর্ণা দেবীর নামে ঠিক সময়েই পৌঁছে যাবে ‘খন।

তারপর গলা নামিয়ে বললে, কালকের মেলেই আপনি চলে যান আচায্যি মশাই। আর দু’চারদিন দেরি হলে গিয়ে হয়তো দেখবেন, ময়না—পাখি শিকলি কেটেছে।

গৌর! গৌর! তা কি সম্ভব!

লালজি বললে, সম্ভব বৈকি! শাস্ত্র পড়েননি? শাস্ত্রে বলেছে, রমণী হচ্ছে মনিব্যাগের মতো, কখন যে পকেট মারা যাবে, কিচ্ছু বলা যায় না!

গোপীকান্তর হাসি—হাসি মুখখানি শুকিয়ে এল। বললে, তাহলে চলেই যাই বাবুসাহেব, কি বলেন? ম্যানেজারবাবুও পত্র লিখে জানিয়েছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে…ইন্সিওরের টাকাটা ঠিক পাওয়া যাবে তো? মানে বলছিলাম কি, রাজধানী শহর, শুনেছি এখানে ঠগ বাটপাড়—

গলায় জোর দিয়ে লালজি বললে, আমি কোম্পানির অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার, আমি যখন আপনাকে অভয় দিচ্ছি, তখন আপনার ভয়টা কিসের? আপনি নিশ্চিন্তে চলে যান।

কৃতার্থ হয়ে গোপীকান্ত বলে উঠল, য্যাজ্ঞে। তাহলে বিলম্ব না করে আজকের মেলেই….গৌর! গৌর!

গোপীকান্ত ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। লালজি কৌচে বসে বসে আলস্য ভাঙলে। তারপর উঠে করিডরের মুখে আসতেই দেখা হল শীলার সঙ্গে।

নমস্কার! বেরোচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ। লেডি মুখার্জীর জন্যে কয়েকটা জিনিস কিনতে।

লালজি বললে, জানেন, কাল রাত্রে চোর এসেছিল?

চোর!

হ্যাঁ। আমার কামরায়।

শীলা শুধু বললে, ও! তাই নাকি?

একটু সূক্ষ্ম হাসির ছটায় লালজির ঠোঁটের প্রান্ত আর চোখের তারা ঝিকমিক করে উঠল। বললে, ভারি শৌখিন চোর কিন্তু—ফরাসি ল্যাভেন্ডার মাখে!

শীলা কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। ‘দেরি হয়ে যাচ্ছে’ বলে হঠাৎ দ্রুতপায়ে লালজির পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। আর ফরাসি ল্যাভেন্ডারের হালকা—মিষ্টি সুগন্ধে বিবশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লালজি।

চলুন একবার পার্ক স্ট্রিট থানায় যাই। অফিসার গুপ্তর খাস—কামরায়।

অনেক খুঁজেও কাল রাত্রে লালজির ঘরে বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না। শুধু এই শিশিটা।

হাতব্যাগ থেকে ছোট একটা শিশি বের করে রমলা টেবিলের ওপর রাখল।

শিশিটা তুলে নিয়ে বিশু বললে, এটা তো দেখছি স্পিরিট—গাম!

অফিসার গুপ্ত বললেন, মাই গড! স্পিরিট—গাম নিয়ে লালজি করে কি? থিয়েটারের বাতিক আছে নাকি?

অল্প হেসে বিশু জবাব দিলে, আছে বৈকি! শেক্সপীয়র বলে গেছেন এই দুনিয়াটাই একটা স্টেজ। আশা করি, খিদিরপুর ডকে মহম্মদ রশিদকে এত শিগগির ভুলে যাওনি গুপ্ত?

না, তা যাইনি। তবে সেই লোকটাই যে লালজি, তারও তো কোনো প্রমাণ পাইনি।

বিশু বললে, কিন্তু লালজি এ্যামেচার অভিনেতা নয়, রীতিমতো পেশাদার, তা এই শিশিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কেননা, স্পিরিট—গামের অনেকখানি খরচ হয়ে গেছে।

অফিসার গুপ্ত বললেন, অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, লালজি প্রায়ই ছদ্মবেশে বেরোয়?

উত্তরে বিশু বললে, বিলক্ষণ। তবে কবে কোনো রঙ্গমঞ্চে, কোনো ভূমিকায়, সেটাই এবার সঠিক জানতে হবে। লোকটা যে বহুরূপী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

রমলা এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিল। এইবার বললে, এখন তাহলে আমার কর্তব্য কি বিশুদা?

সে—কথার জবাব না দিয়ে বিশু অন্যমনস্কের মতো জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা রমলা, এই ক’দিনের মধ্যে লালজির ঘরে কাউকে আসতে বা যেতে দেখেছ? কোনো পুরুষ বা মেয়ে?

শুধু একটি মেয়েকেই মাঝে মাঝে দেখতে পাই। সেই মেয়েটি, কালো ভেল দিয়ে যা’র মুখ ঢাকা।

অফিসার গুপ্ত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে একবার বিশুর দিকে তাকালেন। তার অর্থ, কে এই রহস্যময়ী?

বিশু আবার জিজ্ঞাসা করলে, সে কে জানতে পেরেছ?

না।

তোমাকে একটা কাজ করতে হবে রমলা। সেই রহস্যময়ী মেয়েটি এবার যেদিন কুইন মেরি হোটেলে আসবে, তোমার চোখ—কান আরও ভালো করে খুলে রেখো।

অর্থাৎ?

ধরো, মেয়েটি যখন হোটেল থেকে বেরোবে সেই সময় লেডি মুখার্জীর খবর নিয়ে তোমাকে ডাক্তারের চেম্বারে ছুটতে হতে পারে। তারপর—

হেসে রমলা বললে, বুঝেছি।

পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে বেরিয়ে চলুন কাছাকাছি যাই।

জি. মেকেঞ্জির শো—রুম।

কথা বলছিল দু’জন লোক। সারস পাখির মতো অত্যন্ত ঢ্যাঙ্গা এবং অত্যন্ত রোগা লোকটি মেকেঞ্জির সেলসম্যান দত্ত। অপর ব্যক্তি মাথা থেকে পা অবধি নিখুঁত বিলিতি সজ্জায় টিপটাপ সাহেব। গালের দু’পাশে জুলপি দুটো অনেকখানি নেমে এসেছে। গোঁফের দুটি প্রান্ত ‘কসমেটিক’ দিয়ে সুঁচের মতো সরু করে পাকানো। ডান চোখে ‘মনোকল’, সরু কালো ফিতা দিয়ে গলার সঙ্গে আটকানো। রীতিমতো সৌখিন এবং সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি।

লোকটি বলছিলেন, একখানা ভালো গাড়ি কিনতে চাই। অবশ্য যদি আমার পছন্দমতো হয়।

নিশ্চয়ই! পছন্দ না হলে আপনি কিনবেন কেন?—প্রবল উৎসাহে হাত নেড়ে দত্ত শুরু করলে, তবে যে সমস্ত গাড়ি আপনাকে দেখাব, তা’ পছন্দ না করে’ আপনার উপায় নেই। আর খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করাই আমাদের একমাত্র কাজ।….সিগারেট?

ফস করে পকেট থেকে ক্যাপস্টেনের প্যাকেট বের করে দত্ত তাঁর সামনে ধরলে।

ঈষৎ হেসে সাহেবী ভদ্রলোকটি বললেন, নো, থ্যাঙ্কস। আমার ব্র্যান্ড অন্য।

তারপর নিজের সোনার সিগারেট—কেসটা খুলে নিজে একটা নিয়ে দত্তর সামনে ধরলেন।

সিগারেট নিয়ে দত্ত পুনরায় শুরু করলে, গাড়ির কথা যদি বলেন মিস্টার—

লাইটার জেলে দত্তর মুখের সামনে ধরে ভদ্রলোক বললেন, সেইন।

দত্ত বললে, গাড়ির কথা যদি বলেন মিঃ সেইন, তাহলে প্রথমেই নাম করব ‘ওলডস মোবাইল’। দেখতে যেমন লাভলি, চড়তেও তেমনি আরাম। কি বলব, যেন ঘুম আসে! আর ইঞ্জিনের কথা যদি বলেন, তাহলে বলব ‘স্টুডিবেকার কম্যান্ডার’। চোখ বুজে চড়লে গাড়ি চলছে কিনা টেরই পাওয়া যায় না। আপনি নিজের হার্ট—বীট বরং শুনতে পাবেন, মিঃ সেইন, কিন্তু স্টুডি—কম্যান্ডারের ইঞ্জিনের শব্দ—

মিঃ সেইন বললেন আমার কিন্তু মাস্টার বুইকের ওপরই ঝোঁক।

বাঁ—হাতে ডান হাতের তেলোয় ঘুসি মেরে দত্ত বলে উঠল, মাস্টার বুইক! একখানা গাড়ির মতো গাড়ি বটে! যেমন দেখতে, তেমনি চড়তে, তেমনি চালাতে। গাড়ি তো নয়, যেন একটা রাজহাঁস। লাভলি!

আছে আপনাদের?—খসে—পড়া মনোকলটা চোখে লাগিয়ে মিঃ সেইন প্রশ্ন করলেন।

দত্ত সোৎসাহে বললে, একখানা কেন, দশখানা আছে মিঃ সেইন।

উনিশশো পঞ্চাশ মডেল?

সিওর!—আসুন আপনাকে দেখাই।

মিঃ সেইনকে নিয়ে দত্ত একখানা ঘন নীল রঙের মোটর গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে বললে, দেখুন! হাউ ফাইন!

মিঃ সেইন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন, একটু চালিয়ে দেখতে পারি? মানে ইঞ্জিনটা একবার পরখ করে—

নিশ্চয়! নিশ্চয়! দেখুন না চালিয়ে।

দত্তর আদেশে গাড়িতে কিছু পেট্রল ঢালা হল। তারপর তাকে পাশে বসিয়ে মিঃ সেইন নিজেই ড্রাইভ করে বেরোলেন।

পার্ক স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গি। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে মিঃ সেইন অপর হাতে সোনার সিগারেট—কেসটা দত্তর সামনে খুলে ধরতে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কেসটি খালি। লজ্জিত মুখে বললেন, সো সরি। চলুন, একটা দোকান থেকে কিছু সিগারেট নেওয়া যাক।

গাড়ি তখন এম্পায়ার স্টোর্সের কাছে এসে পড়েছে। মিঃ সেইন দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে বললেন, কিছু যদি মনে না করেন মিঃ দত্ত—

দত্ত বিগলিত সৌজন্যের সঙ্গে বললে, কিছু না—কিছু না! আমিই এনে দিচ্ছি। কি ব্র্যান্ড?

থ্রি ক্যাসেলস!

মিঃ সেইন একখানা দশ টাকার নোট তার হাতে দিতেই দত্ত নেমে দোকানে ঢুকল। আর সেই মুহূর্তে চোখের পলক না ফেলতে ফেলতে ঘন নীল রঙের গাড়িখানা যেন হাওয়ায় উড়ে চলে গেল।

ঘণ্টাখানেক পরে।

হাওড়ার একটা গ্যারাজে নীল রঙের গাড়িটা এসে ঢুকল। মিঃ সেইন গাড়ি থেকে নেমে রুমালে কপালের ঘাম মুছলেন।

তেল—কালিমাখা একজন মিস্ত্রি কাজ করছিল। মিঃ সেইন বললেন, নাম্বার—প্লেটটা বদলে দাও হে পটল—চটপট—আর ইঞ্জিনের নম্বরটাও।

সেলাম লালজি!—হেসে পটল মিস্ত্রী বললে।

তারপর গাড়িখানার কাছে এসে বললে, নতুন গস্ত বুঝি? এও যে দেখছি স্যার আপনারই গাড়ির মতো মাস্টার বুইক—ফিফটি মডেল!

লালজি বললে, তফাত শুধু নম্বরের। সেটাও বদলে BLA 7777 করে দিলে গাড়িটা পুরোপুরি আমারই হয়ে যাবে, আর—

একগাল হেসে পটল মিস্ত্রি বললে, আর তখন সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বলে স্বচ্ছন্দে—

তোমার মগজ খুব সাফ পটল!…নাও, ধর। হ্যাঁ, মাইল—মিটারের তারটাও কেটে দিতে হবে।

খানকয়েক নোট লালজির হাত থেকে পটলের হাতে চালান হয়ে গেল নিঃশব্দে।

শহরের অফিস—পাড়ায় একবার ঘুরে আসা যাক—

নর্টন হ্যারিসের অফিস। স্ট্রান্ড রোডের ওপরেই।

ছোটসাহেব মিঃ কার্টার পাইপ মুখে তখন কাগজপত্রে দস্তখত করছিলেন। মুখ না তুলেই বললেন, ইয়েস লালজি!

সামনের চেয়ারে বসে লালজি বললে, সেই গাড়িখানা এনেছি মিঃ কার্টার। আপনার শোফার ট্রায়াল দিয়ে দেখে নিচ্ছে। সেকেন্ডহ্যান্ড হলেও গাড়িখানার কন্ডিশন নতুনেরই মতন,—মাত্র বছরখানেক হল কিনেছি।

মিঃ কার্টার মুখ তুললেন, কত মাইল রান করেছে?

সেটা ঠিক বলতে পারব না। গাড়ি কেনার পর থেকেই মাইল—মিটার বিগড়ে আছে—সারানো হয়ে ওঠেনি। তবে আন্দাজ পাঁচ হাজার মাইলের বেশি গাড়িটা চলেনি।

উর্দিপরা একজন পাঞ্জাবি সেলাম করে দাঁড়াল। মিঃ কার্টারের ড্রাইভার। বললে, ইঞ্জিন বহুৎ আচ্ছা হায় সাব! গাড়ি বিলকুল নয়ি হ্যায়। আপ লে সেঁকতে হেঁ।

মিঃ কার্টারের বুলডগ—মুখে খুশির আভাস দেখা গেল। লালজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইন্সিওরের কাগজপত্র, টোকেন, ওনার—বুক—সব এনেছ তো?

সব এনেছি।

এখন বল, কত দামে ছাড়বে?

নেট সাত হাজার।

টু মাচ!—মিঃ কার্টার গর্জন করে উঠলেন : নো, নো, মেক ইট সিক্স।

লালজি চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, আমি পেশাদার সেলসম্যান নই মিঃ কার্টার। তাই একদর বলেছি। আপনার না পোষায় ছেড়ে দিতে পারেন।

পাইপটা দাঁতে কামড়ে কার্টার সাহেব একটু ভাবলেন।

অলরাইট! একখানা রসিদ লিখে দাও।;

টেবিলের ড্রয়ার থেকে মিঃ কার্টার চেকবই বের করলেন।

বৈশাখী রাত্রি। গুমোট ভেঙে ঝিরঝিরে দক্ষিণ হাওয়া দিচ্ছে।

ওয়েলেসলি কফি—হাউসে এইমাত্র জোহরা বাঈয়ের জিপসি নাচ শেষ হল।

গ্রিনরুমে বসে জোহরা তখন মেক—আপ তুলছে। মুখে খানিকটা ক্রিম ঘষে, জরির কাজ—করা কালো সার্টিনের জামাটা সে খুলে ফেললে। সমুখে বড় আর্শি। সেদিকে হঠাৎ চোখ পড়তেই, জোহরার দৃষ্টি যেন আটকে গেল।

কেন এত রূপ? কেন এত যৌবন—লাবণ্য? যদি বুকভরা তৃষ্ণা অতৃপ্তই রয়ে গেল জীবনে? ….হ্যাঁ, তার দেহ—শতদলে একদা কামনার পাঁক লেগেছিল বটে, কিন্তু সে চিহ্ন কি বহু নিশীথের তপ্ত অশ্রুধারায় আজও ধুয়ে যায়নি? ফুলে যদি কাদা লাগে, গঙ্গাজলে ধুয়ে ফেললে আবার নির্মল হয়ে যায়; আর নারীর দেহ?

আচ্ছা, লালজির কি চোখ নেই? না বুকের ভিতরটা পাথর দিয়ে তৈরি? কামনা নেই, বাসনা নেই, অনুভূতিও বোধ করি নেই! এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল, জোহরা যদি কুৎসিত কুরূপ হতো। ব্যর্থ রূপ—যৌবনের বোঝা বয়ে আর বেড়াতে হতো না—পলে পলে পুড়তে হতো না উপেক্ষার আগুনে।

কিন্তু না, অনেক সয়েছে সে আর নয়। তার পূর্বপুরুষ ছিল বন্য তাতার। কামনার বস্তু তারা ভিক্ষা করত না, লুঠ করে নিত। আজও তার রক্তে সেই বিষ রয়েছে! হার যদি মানতেই হয় তবে দলিত সাপিনির মতো লালজিকে তার বিষচুম্বন একদিন সে দিয়ে যাবেই!…

টক—টক—টক।

গ্রিনরুমের দরজায় টোকা পড়ল।

কে? বাইরে থেকে ইয়াসিনের চাপা গলা শোনা গেল : সাত নম্বর কেবিন।

জোহরা দ্রুত বেশ—পরিবর্তন করতে লাগল। তারপর মুখের ওপর কালো ভেলটা চাপা দিয়ে যখন সাত নম্বর কেবিনের পর্দা ঠেলে ঢুকল, লালজি তখন সামনে জিনের’ গ্লাস নিয়ে সিগারেট টানছে।

এসো বাঈজি।

কালো ভেলটা মুখ থেকে সরিয়ে জোহরা সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।

লালজি বললে, বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়। অসুখ করেনি তো?

এ প্রশ্ন কেন?

বাঃ! তুমি আমার পার্টনার। কেমন আছো, জানতে চাইব না?

জেনে কি হবে?

অসুখ সারাবার ব্যবস্থা করব!

জোহরা হাসলে। শেষ রাত্রির চাঁদের মতো ফিকে একটু হাসি। বললে, ইলাজ করবে কে? তুমি? শুক্রিয়া! দরকার হবে না।

বাঁ দিকের ভুরু তুলে লালজি সোজা তার মুখের দিকে তাকাল : কি হয়েছে তোমার খুলে বলো তো?

অবরুদ্ধ আবেগে জোহরা বললে, বলেছি—হাজার বার বলেছি। আর বলতে পারি না। পাথরের কানে কানে বুকের দরদ জানিয়ে কোনো লাভ নেই।

এক চুমুকে গেলাসের অর্ধেকটা শেষ করে লালজি বললে ও! সেই পুরোনো কথা! আজো ফুরোয়নি?

তীব্র কণ্ঠে জোহরা বললে, না, আজো ফুরোয়নি। এ জীবনে ফুরোবে না। ….যাক, ডেকেছ কেন বলো।

অলস ভঙ্গিতে লালজি ধোঁয়ার একটা রিং ছাড়লে। তারপর বললে, কুঞ্জ বিশ্বাসকে তোমার বোধ করি মনে আছে জোহরা? সেই যে পুজোর সময় কাশী থেকে ফেরবার পথে ট্রেনে আলাপ হয়েছিল? মোটাসোটা থলথলে চেহারা, পাকিস্তানের লোক বলে’ কথায় বাঙালে টান, তিসির আড়তদার। মনে নেই তোমার?

আছে। কিন্তু হঠাৎ কুঞ্জ বিশ্বাসের কথা কেন?

এই ক’মাসের মধ্যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার আলাপ ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুলোককে একদিন আদর করে ডেকে নেমন্তন্ন খাওয়ানো উচিত, কি বল?

জোহরা বললে, বেশ তো!

কাল আমার বিয়ের তারিখ। তাই ভাবছি, কুঞ্জবাবুকে কালই সন্ধ্যাবেলা খেতে বলব।

বিয়ের তারিখ! তোমার?

জোহরার চোখ দুটি আরো দীর্ঘায়ত হয়ে উঠল।

লালজি গেলাসে আর একটা চুমুক দিলে : তুমি অবাক হলে কি হবে, কাশী থেকে ফেরবার ট্রেনে কুঞ্জবাবু আমার সুন্দরী বৌ রঞ্জনা দেবীকে দেখেছেন এবং দেখে অতিশয় মুগ্ধ হয়েছেন। মনে নেই?

জোহরার মুখ হঠাৎ রাঙা হয়ে উঠল।

কি তোমার মতলব বল তো লাল?

গেলাসটা শেষ করে লালজি বললে, শিকার জালে পড়েছে, শুধু টেনে তোলাটাই বাকি! ….যাক, কাল পাঁচটায় হোটেলে এস।….হ্যাঁ, কাল বিকেল পাঁচটার পর থেকে তুমি হচ্ছো কানপুর গালা ফ্যাক্টরির সিনিয়র পার্টনার লালমোহন মুখুয্যের স্ত্রী রঞ্জনা দেবী। ভুলো না।

হাত—ঘড়িটার পানে একবার তাকিয়ে লালজি উঠে পড়ল। তারপর কেবিনের ভারী পর্দা দুলিয়ে বেরিয়ে গেল। আর সেই দুলন্ত পর্দার দিকে তাকিয়ে একাকিনী জোহরা দাঁড়িয়ে রইল স্তব্ধ হয়ে।

টিটাগড় চটকুলিদের বস্তি। আজ রাতে চলুন সেখানে।

মধ্যরাত্রির অন্ধকার পাখা মেলে নেমেছে বস্তির ওপরে। কি যেন একটা দুঃস্বপ্নের আতঙ্কে ঘুম নেই সমস্ত মহল্লাটার চোখে। এখানে—ওখানে ছোটখাটো জটলা, ফিসফিস কথা, অন্ধকার ছায়ামূর্তির আনাগোনা।

বস্তির ভেতর দিয়ে চলুন শেষপ্রান্তে—খাপরা ছাওয়া শেষ ঘরখানায়, যেখানে ঝমরু সর্দারের বাস।

ছোট্ট জানলার পাশে কেরোসিনের ডিবে জ্বলছে। রুদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে বসে ঝমরু সর্দার, লোকটার মাথায় কাঁচা—পাকা চুলের মধ্যে থেকে রক্তের ধারা নেমে এসে গায়ের ফতুয়া পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়েছে। ছেঁড়া ন্যাকড়া পুড়িয়ে তার মাথায় পটি বেঁধে দিচ্ছিল বৌ মোতিয়া।

ধর্মঘট আর কতদিন চলবে?

যতদিন না মিলের মালিকরা আমাদের কথায় রাজি হয়।

এক মাস কেটে গেল, আরো কতদিন এইভাবে কাটবে?

একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওপর দিকে হাত তুলে ঝমরু বললে, মালিক জানে।

মোতিয়া বললে, কিন্তু এ ধর্মঘট চালিয়ে লাভ কি হবে বলতে পারিস? এতে দুঃখী—মজুরদের কষ্ট তো খালি বেড়েই যাচ্ছে। আমার কথা শোন সর্দার, ধর্মঘট বন্ধ করে দে।

তা’ হয় না।

এই ধর্মঘটের জন্যে তোর জান যেতে বসেছে তবু জিদ ছাড়বি না? মজদুর ভাইরা ভাবছে, তাদের কলে যাওয়ার রাস্তা তুই আটকে রেখেছিস। তাই তো আঁধারে তোর মাথায় লাঠি পড়ল খুন বইলো তোর কপাল বেয়ে—

ঝর ঝর করে মোতিয়া কেঁদে ফেললো।

ঝমরু বললে, ইউনিয়নের কথা ঠেলি কি করে?

তিক্ত কণ্ঠে মোতিয়া বলে উঠল, তবে ইউনিয়ন চুপ করে আছে কেন? খেতে দিক আমাদের?

ফান্ডের টাকা ফুরিয়ে এসেছে, তাই। নইলে খেতে দিত বৈকি! এতদিন তো চালিয়ে এসেছে!

কিন্তু আজ—আজ চলবে কি করে? তিনদিন পেটে দানা—পানি নেই, বুকে নেই একফোঁটা দুধ।—দুটো ঘুমন্ত শিশুর দিকে হাত দেখিয়ে মোতিয়া বলতে লাগল, ওই দুটো বাচ্চার মুখে কি দেব? মায়ের চোখের সামনে ছেলে শুকিয়ে মারা যাবে এই কি তুই চাস?

ক্লান্ত কণ্ঠে ঝমরু ধমকে উঠল, চুপ কর মোতিয়া!

তারপর গভীর আশ্বাসের সঙ্গে বললে, এ কষ্ট আমাদের থাকবে না রে—টাকা আসবেই—আজই আসবে!

ঝুট বলিসনে সর্দার!

ঝুট নয়, সত্যিই টাকা আসবে দেখিস।

ওকথা বলে আমাকে আর ভুলিয়ে রাখিসনে সর্দার—তোর পায়ে ধরি, ধরমঘট—

মোতিয়ার কথা বাইরের হল্লার আওয়াজে ডুবে গেল। বাইরে কারা যেন জড়ো হয়েছে। কারা যেন ডাকছে, বেরিয়ে এসো ঝমরু সর্দার! নিকল আও!

ঝমরু উঠে দরজা খুলতে যেতেই মোতিয়া পাগলিনীর মতোই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

যাসনে সর্দার, উপোস করে ওরা ক্ষেপে আছে—ওরা তোকে মেরে ফেলবে—কেটে ফেলবে—

এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে ঝমরু দরজাটা খুলে ফেললো।

ঘরের সামনে খানিকটা খোলা জমি, সেখানে প্রায় শ’খানেক স্ত্রী—পুরুষ জড়ো হয়েছে। কয়েকজনের হাতে জ্বলন্ত মশাল, তারই রক্তাভ আলোয় জনতার মুখের ভাব দেখে ঝমরু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, কি চাস তোরা?

জনতা চিৎকার করে উঠল : ধরমঘট বন্দ কর দো!

ঝমরু বলতে গেল, তোদেরই ভালোর জন্যে—

কথা শেষ করতে দিল না ক্ষিপ্ত মজুরের দল।

ভালো আমরা চাই না, আমরা খাবার চাই—ভুখা পেটে দানা—পানি চাই। হুকুম দে, কাল থেকে আমরা কলে যাবো।

ঝমরু বললে, এতদিন সবুর করেছিস, আর ক’টা দিন—

জনতা আবার চীৎকার করে উঠল : ধরমঘট বন্দ কর দো! নৈলে জ্বালিয়ে দেবো তোর ঘর!

ভাই সব!—ঝমরু হাত তুলে তাদের থামতে বললে।

ভাইয়োঁ, ইউনিয়নের কথা তোরা ভুলিস নে। ইউনিয়নের কথা অমান্য করলে আখেরে পস্তাতে হবে—

জাহান্নমে যাক ইউনিয়ন!—ঝমরুর কথা আবার ডুবে গেল জনকলরবে।

ইউনিয়নের কথা আর মানব না! হয় কাল থেকে কলে যাবার হুকুম দে সর্দার—নয় চাল দে—আটা দে—

ককিয়ে—ওঠা একটা রুগ্ন শিশুকে দুই হাতে তুলে ধরে ঝমরুর সামনে এগিয়ে এল রুক্ষ্ম মলিন চেহারার এক কুলি—মেয়ে। গলা চিরে চীৎকার করে উঠল, আমার বাচ্চার মুখে দুধ দে—

তারপর নিজের শীর্ণ শুষ্ক স্তন দেখিয়ে বললে, এই দ্যাখ কিচ্ছু নেই—এক ফোঁটা খুনও আর বেরোয় না—

মধ্যরাত্রির স্তব্ধতাকে যেন নখ দিয়ে দীর্ণ করে জনতা হল্লা করে উঠল, বন্দ কর দো ধরমঘট! নয়তো টাকা দে!

হল্লা ছাপিয়ে সহসা ঝমরু গলা চড়িয়ে বলে উঠল, তাই দেব ভাই সব, টাকাই দেব। টাকা আমাদের আসবে—আজ রাতেই আসবে—ঘাবরাও মৎ ভাইয়োঁ!

নিমেষে ঝড় শান্ত হয়ে গেল।

তারপর পাঁচ—সাতজন একসঙ্গে প্রশ্ন করলে, টাকা আসবে! ইউনিয়নের টাকা তো ফুরিয়ে গেছে।…তবে টাকা আসবে কোত্থেকে? আসমান ফুঁড়ে? কে দেবে, নাম বল?

ঝমরু বললে, যে দেবে, তার নাম আমি জানি নে, তবে টাকা সে দেবে বলেছে—কসম খেয়েছে—

ঝড় আবার উত্তাল হয়ে উঠল : ঝুট বাত! ঝুট বাত!

প্রাণপণে ঝমরু চিৎকার করে বললে, বিশ্বাস কর তোরা, ঝুট বাত নয়। ইউনিয়নের অফিসে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কাল। রাজার মতো চেহারা, বাদশার মতো দরাজ দিল। আমাকে সে বললে, ‘ধরমঘট কিছুতেই বন্ধ হতে দিও না সর্দার, তোমাদের দিন গুজরানের টাকা আমি দেব—ভরসা রেখো তোমরা।’ ভাই সব, আজ তার টাকা আসবে—বিশ্বাস কর তোরা, আজই রাত বারোটার সময়—

সহসা ঝমরু বোবা হয়ে গেল।

চট কলের পেটা—ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজছে!

হো হো করে ক্ষিপ্ত জনতা অট্টহাস্য করে উঠল : আজই রাত বারোটার মধ্যে টাকা আসবে, না সর্দার?…ঝুটে কাঁহিকে! ভেবেছিস, তোর ধোকাবাজি আমরা ধরতে পারব না? কই তোর রাজাবাবু?

ঝমরুর মাথার ভেতরে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কপালটা দপ দপ করছে। কি করবে সে এখন? বারোটা বেজে গেল, তবু এল না তো সে! সেই রাজার মতো চেহারা, সুন্দর মুখ! সেও বেইমানি করলে গরিবদের সঙ্গে?

কোনোরকমে সে বললে, এই রাতটা আমায় ভাবতে দে তোরা।

তারপর কপালটা টিপে ধরে টলতে টলতে ঘরের মধ্যে এসে বসে পড়ল। মোতিয়া ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কি হ’ল? কি হল তোর সর্দার?

গভীর ক্লান্তিতে চোখ বুজে ঝমরু শুধু বললে হায় গরিবের ভগবান!…

ঝুপ করে একটা শব্দ।

চমকে উঠে ঝমরু দেখলে, খোলা জানলা—পথে একখানা কালো হাত ছায়ার মতো নিঃশব্দে সরে গেল, আর তার সমুখে পড়ে আছে লম্বা—চওড়া একখানা পুরু খাম। খুলতেই বেরুলো একরাশ নোট, আর পরিষ্কার হিন্দিতে লেখা একটুকরো চিঠি :

ধর্মঘট বন্ধ কোরো না কিছুতেই। পাঁচ হাজার টাকা পাঠালাম তিনশো মজদুরের জন্যে। সবাইকে ভাগ করে দিও। দরকার হলে আরো টাকা পাবে। গরিবদের টাকা নিয়ে যারা বেইমানি করে, তাদের সঙ্গে আপোস কোরো না—পুরো পাওনা আদায় করে নাও।

মোহিতমোহন

ভয়ে বিস্ময়ে উত্তেজনায় মোতিয়ার মুখে তখন কথা হারিয়ে গেছে। আর চিঠিখানা বুকে চেপে ঝমরু পাগলের মতো বলছে, গরীবের মা—বাপ! ভগবান তোকে রাজা করুক!…

মটকার পাঞ্জাবি পরা মোটাসোটা থলথলে চেহারার শ্যামবর্ণ এক ব্যক্তি কুইন মেরি হোটেলে ন’নম্বর কামরার সামনে দাঁড়িয়ে সোনার চেন দেওয়া পকেট—ঘড়ি বার করে দেখলেন, হ্যাঁ, ঠিক সাতটাই বেজেছে।

ভদ্রলোকের মাথার মাঝখানে মাঝারি সাইজের একটি টাক। ডান পাশের চুলগুলি আঁচড়ে বাঁ দিকে ফেলে সেটি সযত্নে ক্যামোফ্লেজ করা। আলগোছে তার ওপর একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক দরজায় ঘা দিলেন।

একটু পরে দরজা খুলে গেল। মুখ বাড়াল লালমোহন মুখুয্যের স্ত্রী রঞ্জনা দেবী! গোলপের পাপড়ির মতো গোলাপী ঠোঁট দুটি অল্প হাসিতে খুলে গেল।

ও, কুঞ্জবাবু! আসুন, ভেতরে আসুন।

জরির ধাক্কা—দেওয়া লুটিয়ে পড়া কোঁচাটি সযত্নে বাঁ—হাতে তুলে কুঞ্জ বিশ্বাস প্রবেশ করলেন। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে রঞ্জনা হাত দুটি জোড় করে বললে, নমস্কার, বসুন।

হেঁ—হেঁ—নমস্কার, নমস্কার।—কুঞ্জবাবু একটা কৌচে বসলেন : ভালো আছেন তো রঞ্জনা দেবী? কর্তাকে দেখছি না যে—মানে লালমোহনবাবু?

কুন্দদন্তে নীচের ঠোঁটটা একবার চেপে রঞ্জনা বলে উঠল ওহো, আপনাকে বলতেই ভুলে গেছি আজ দুপুরে একখানা জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে ওঁকে এই সন্ধের গাড়িতে কানপুর যেতে হল। ফ্যাক্টরিতে কি যেন একটা গন্ডগোল বেধেছে।

কুঞ্জবাবু আকাশ থেকে পড়লেন।

বলেন কি! কোলকাতা থেকে একেবারে কানপুর? আজকের এই মধুযামিনী ছেড়ে—হেঁ—হেঁ—

রঞ্জনা বললে, হঠাৎ চলে যেতে হল বলে উনি খুবই দুঃখিত। বার বার করে আমাকে বলে গেলেন ‘রঞ্জনা, তুমি কুঞ্জবাবুকে বোলো যেন মনে কিছু না করেন। ভালো করে না খাইয়ে ছেড়ো না কিন্তু।’

ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে কুঞ্জবাবু বললেন, আর খাওয়া! এ যে শিবহীন যজ্ঞ হল দেখছি!

মধুর হেসে রঞ্জনা বললে, আমি তো আছি, আপনার যত্নের কোনো ত্রুটি হবেনা।

সে কি কথা! আমি তা বলিনি—মানে—

লজ্জিত অপ্রতিভ কুঞ্জবাবু বাকিটুকু হেঁ—হেঁ দিয়ে শেষ করলেন।

রঞ্জনা বললে, খাবার আনতে বলব?

এই তো মোটে সাতটা।

তবে চা? কিম্বা কোল্ড ড্রিঙ্ক?

না, না, ওসব কিছু দরকার নেই। লালমোহনবাবু কবে ফিরবেন?

ফুলদানীতে একগোছা মরশুমি ফুল সাজাতে সাজাতে রঞ্জনা বললে, বলে গেছেন দিন কয়েকের মধ্যেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

ফুলের স্তবকের পাশে রঞ্জনাকে একটা বড় ফুলের মতোই দেখাচ্ছিল। কাঠ—গোলাপ রঙের বেনারসি শাড়িখানা রঞ্জনার সুঠাম দেহ জুড়ে আগুনের মতোই জ্বলছে। সেইদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কুঞ্জ বিশ্বাস সিগারেট টানছিল। হঠাৎ বলে উঠল, আপনাদের দুটিকে বেশ মানায়।

রঞ্জনা একবার বাঁকা চোখে তাকাল। তারপর হেসে বললে, আপনাদেরই বা কম কি? আপনার স্ত্রী তো শুনেছি, খুব সুন্দরী।

কেমন যেন একটু তাচ্ছিল্যের সুরে কুঞ্জবাবু বললেন, নাঃ, আপনার মতো নয়।

কালো চোখ দুটি কৌতুকে ঝিলমিলিয়ে উঠল।

আমি আবার সুন্দরী নাকি?

গলায় অস্বাভাবিক জোর দিয়ে কুঞ্জবাবু বলে ফেললেন, আলবাত!

সত্যি?

রঞ্জনা কৌচের কাছে এসে দাঁড়াল। মুখে মৃদু হাসি। এ সেই হাসি, যে হাসির শিখায় ট্রয় নগর ধ্বংস হয়েছিল, ছারখার হয়েছিল স্বর্ণলঙ্কা।

রঞ্জনা আবার বললে, বলুন না, সত্যি—?

কুঞ্জ বিশ্বাস বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে শুধু বললে, হেঁ—হেঁ—

রঞ্জনা গিয়ে রাস্তার দিকের জানলার পর্দাটা সরিয়ে দিলে। বললে, আজ ভারী গরম পড়েছে নয়?

ভয়ানক।

সিল্কের রুমাল বার করে কপাল আর ঘাড় মুছতে লাগলেন কুঞ্জবাবু। পাখার রেগুলেটর একটু ঘুরিয়ে দিয়ে রঞ্জনা বললে, ওকি, অমন আড়ষ্ট হয়ে বসেছেন কেন! ভালো করে বসুন না!

হেঁ—হেঁ—মানে আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।

মাথার ঘোমটা সরিয়ে রঞ্জনা এসে ক্লান্ত অলসভঙ্গিতে কুঞ্জবাবুর পাশে বসে পড়ল। তারপর কৌচের পিঠে হেলান দিয়ে চোখ দুটি বুজে অস্ফুটে বলে উঠল, ইস, মাথাধরাটা এখনও ছাড়ল না!

ব্যস্ত হয়ে কুঞ্জবাবু বলে উঠলেন, মাথা ধরেছে নাকি?

কোনো জবাব এলো না। মন্থর আলস্যে মুদিতনয়না রঞ্জনা কৌচে এলিয়ে শুয়ে আছে।

কি একটা বলতে গিয়ে কুঞ্জবাবু ঢোঁক গিললেন।

কাঠ—গোলাপ রঙের শাড়ি রঞ্জনার দেহবঙ্কিমা ঘিরে অগ্নিশিখার মতোই মুগ্ধ পতঙ্গের মরণ—শয্যা পেতেছে। রঞ্জনার কেশে সুরভি, বেশে সুরভি, নিঃশ্বাসে সুরভি।

সিল্কের রুমালে কুঞ্জবাবু আর একবার কপাল আর ঘাড় মুছে নিলেন। তারপর একটু কেশে জিজ্ঞাসা করলেন, মাথাধরাটা ছাড়ল কি?

সরু আঙ্গুলগুলো নিজের কপালে বোলাতে বোলাতে রঞ্জনা শুধু বললে, উঁহু।

বারদু’য়েক কেশে কুঞ্জ বিশ্বাস গলাটা সাফ করে নিলেন। তারপর বললেন, কিছু যদি মনে না করেন, কপালটা নাহয় আমিই—

রঞ্জনা ক্ষীণ আপত্তি জানালে : না, না, আপনি কেন কষ্ট করবেন….উঃ!—

একটা অস্ফুট কাতরোক্তি করে উঠল রঞ্জনা।

ততোধিক কাতর হয়ে সরলপ্রকৃতি কুঞ্জবাবু বললেন, বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, না? এখুনি কমে যাবে।

তারপর—

কখন যে তন্দ্রার ঘোরে রঞ্জনার মাথাটা কুঞ্জবাবুর বুকের কাছে ঢলে পড়েছে, আর কখন যে শুভ্রনিটোল একখানা হাত ঘুমন্ত শ্বেত—গোখরোর মতো তাঁর কোলের ওপর এলিয়ে পড়েছে, কুঞ্জবাবু তা লক্ষ করেননি।

হঠাৎ একঝলক বিদ্যুতের আলো। আর ক্লিক করে একটা শব্দ!

কুঞ্জবাবু চমকে উঠলেন। শ্বেত—গোখরো বুঝি সত্যিই দংশন করেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে ছিলা—ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে সরে গেল রঞ্জনা।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্বয়ং লালমোহন। হাতে ফ্ল্যাশলাইট লাগানো একটা ক্যামেরা।

বাঃ, দৃশ্যটা সত্যিই অপূর্ব কুঞ্জবাবু, তাই ক্যামেরায় তুলে রাখলাম।

কুঞ্জ বিশ্বাস যেন পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

বিদ্রুপের হাসিতে ঠোঁটের প্রান্ত বেঁকিয়ে লালমোহন আবার বললে, আপনার স্বর্গসুখে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত কুঞ্জবাবু। ট্রেনটা নেহাত ফেল করলাম বলেই আমাকে ফিরে আসতে হল, নৈলে….কিন্তু ভাবছি, আজকের বিয়ের তারিখটা আমার না আপনার?

হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে কেঁদে ফেলে রঞ্জনা লালমোহনের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে উঠল, মাথার যন্ত্রণায় আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আর সেই সুযোগে এই লোকটা আমায়—এতখানি ইতর—এতখানি নীচ—

রঞ্জনা কান্নায় ভেঙে পড়লো।

কুঞ্জবাবু একবার কথা বলবার চেষ্টা করলেন, কোনো আওয়াজ বেরোল না। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তবু জিভটাকে শুকনো ঠোঁটে বুলিয়ে নিয়ে কোনোরকমে বললেন, বিশ্বাস করুন, কোনো কুমতলবে আমি—ওর বড্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল—

তীক্ষ্ন বিদ্রূপের হাসিতে ঘর ভরে গেল : তাই পরকীয়া সেবা করছিলেন? বেশ তো, আদালতে এই কথাই বলবেন।

কুঞ্জবাবুর বুকে একটা মুগুরের ঘা পড়ল।

আদালত! আপনি আমার নামে মামলা করবেন?

দাঁতে দাঁত ঘষে লালমোহন বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, তা করবো বৈকি। আপনি কি আশা করেন যে, আমার স্ত্রী সঙ্গে আপনি প্রেম করবেন, আর আমি আপনাকে ফুলের তোড়া কিনে এনে দেব?

কিন্তু ভগবান সাক্ষী—

নির্বোধ অভিমানী শিশুর মতো কুঞ্জবাবুর ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল শুধু।

সেইদিকে একবার তাকিয়ে লালমোহন গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, আপনাকে আমি বন্ধু বলেই জেনেছিলাম কুঞ্জবাবু। সেই হিসেবে অবশ্য আদালতের কেলেঙ্কারি থেকে আপনাকে বাঁচানোই আমার উচিত।

তীক্ষ্ন কণ্ঠে রঞ্জনা বলে উঠল, কিছুতেই না, ওই ইতর পাজি শয়তানটাকে কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

কুঞ্জ বিশ্বাস পকেট থেকে আবার সিল্কের রুমাল বের করলেন। কপালে আর ঘাড়ে বিন বিন করে ঘাম দেখা দিয়েছে। জালে—পড়া শিকারের প্রতি শিকারি যেমন পরম পরিতৃপ্তির চোখে তাকায়, লালমোহন তেমনি করে কুঞ্জ বিশ্বাসের অবস্থাটা একবার লক্ষ করলে। তারপর বললে, যা হবার তা হয়ে গেছে। কেলেঙ্কারি এখন চেপে যাওয়াই ভালো নয় কি কুঞ্জবাবু? আমি বলি কি, আপনি এক কাজ করুন। আপনার বিরুদ্ধে একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে এই ক্যামেরায় তোলা ছবিটা। এটা আপনি কিনে ফেলুন। দামও বেশি নয়—দশ হাজার মাত্র।

কুঞ্জবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন : দশ হাজার টাকা।!

ঈষৎ হেসে লালমোহন বললে, ইজ্জতের দাম আরো বেশি। নেহাৎ আপনি বন্ধুলোক বলেই—অবশ্য দশ হাজার টাকা আপনি আমাকে না দিয়ে কেস লড়তে পারেন। যা আপনার অভিরুচি।

কিন্তু টাকা তো আমার কাছে নেই! —নিতান্ত অসহায়ের মতো কুঞ্জবাবু বললেন।

কাছে নাই—বা থাকল, চিঠি লিখে দিন, আপনার গদি থেকে আনিয়ে নিচ্ছি। চিৎপুরে আপনার গদি না? ঠিকানাটা আমার জানা আছে। আমার প্যাড আর পেনটা দাও তো রঞ্জনা…নিন, লিখুন—

কলের পুতুলের মতো কুঞ্জবাবু লিখে গেলেন :

আমার চিঠি পাওয়ামাত্র এই পত্রবাহকের হাতে নগদ দশ হাজার টাকা পাঠাইবে। আমার বিশেষ প্রয়োজন। পত্র—বাহক বিশ্বস্ত, কোনোরূপ সন্দেহের কারণ নাই। ইতি—

কুঞ্জবিহারী বিশ্বাস

চিঠিখানা লিখে দিয়ে কুঞ্জবাবু করুণভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, এবার যেতে পারি?

অত্যন্ত অমায়িকভাবে হেসে লালমোহন বললে, তাও কি হয়? আপনি অতিথি, না খাইয়ে কি ছাড়তে পারি? আপনি খেতে বসুন, টাকাটা ততক্ষণে গদি থেকে এসে যাক। মাহাঙ্গু!

দরজা ঠেলে কানা মাহাঙ্গু সেলাম করে দাঁড়াল।

লালমোহন বললে, এই চিঠিখানা নিয়ে চিৎপুরে কুঞ্জবাবুর গদিতে যাও। দশ হাজার টাকা নিয়ে এসো। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বোলো, বাবু একখানা দামি ছবি কিনেছেন।

ঘণ্টাখানেক পরে কুঞ্জ বিশ্বাসকে ন’নম্বর কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গেল। ছবিটা লালমোহন দেয়নি। বলেছে, এনলার্জ করে বাঁধিয়ে তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে।

ন’নম্বর ঘরের মধ্যে লালমোহন তখন হাসিমুখে বলছে, সাবাস বাঈজি! আজ তোমার অভিনয় দেখে পুরো দশ হাজার টাকাই ইনাম দিতে ইচ্ছে করছে!

জোহরা আর্শির সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করে নিচ্ছিল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, অভাব আমার টাকার নয়, লাল।

তবে?

তুমি পুরুষ—তুমি বুঝবে না।

জোহরা ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেললে : কিন্তু বুঝতে একদিন হবেই তোমাকে।…চলি। রাত দশটায় আমার নাচ আছে।

কালো ভেলটা মুখের ওপর ফেলে দিয়ে জোহরা বেরিয়ে গেল।

হোটেল থেকে বেরিয়ে জোহরা অপেক্ষমাণ একখানা কালো রঙের মোটরে উঠে বললে, চলো মাহাঙ্গু—

জোহরা যদি একবার উপরপানে তাকাতো, তাহলে দেখতে পেতো, দোতলায় লবির জানলার ফাঁকে আরেকটি কৌতূহলী মুখ উঁকি দিচ্ছে।

সে মুখখানা শীলার।

কালো গাড়িটা স্টার্ট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীলা নীচে নেমে গেল। ওদিকের ফুটপাথে ট্যাক্সি—স্ট্যান্ড। একখানা হলদে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে বললে, চালাও জলদি—

* * * কালো রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানা এসে থামলো ওয়েলেসলি কফি হাউসের সম্মুখে। জোহরা নেমে ভেতরে ঢুকে গেল।

কিছুদূরে ট্যাক্সির ভেতরে বসে শীলা বললে, এবার পার্ক স্ট্রিট থানা।

জেনারেল পোস্টাপিসের ঘড়িতে এগারোটা বাজল।

আমাদের আর একবার ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্সের অফিসে যেতে হবে। জেনারেল ম্যানেজার মিঃ আয়ারের ঘরে।

মিঃ আয়ার বললেন, টাকাটা আপনি আজই পেয়ে যাবেন অপর্ণা দেবী। মাসখানেক দেরি হল বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু এর চেয়ে কম সময়ে পেমেন্ট করা সম্ভব হয় না।

উত্তরে অপর্ণা স্নিগ্ধ সকরুণ চোখ দুটো তুলে নীরবে কৃতজ্ঞতা জানাল। বার দুই কেশে কম্ফর্টার—জড়ানো ভুজঙ্গধর জিজ্ঞাসা করলেন, চেকটা রেডি হয়েছে?

হ্যাঁ, রেডি করেই রেখেছি।

টেবিলের ড্রয়ার থেকে মিঃ আয়ার রসিদের কাগজপত্র সমেত চেক—খানা বের করলেন। তারপর বললেন, অপর্ণা দেবীকে একটা সই দিতে হবে।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!—ব্যস্ত হয়ে ভুজঙ্গধর কেশে ফেললেন।

আর সাক্ষী হিসেবে আপনারও একটা সই চাই মিঃ হাজারিকা।

যথারীতি সই হবার পর মিঃ আয়ার চেকখানা অপর্ণার দিকে এগিয়ে বললেন, ইন্ডিয়া অ্যাস্যুরেন্সের তরফ থেকে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে আমি আপনাকে পনেরো হাজার টাকা দিচ্ছি।

কালো দিঘি জলের মতো অপর্ণার চোখদুটি টলটলিয়ে উঠল। চেকখানা নিয়ে সে নীরবে ভুজঙ্গধরের হাতে দিল। সেখানা মুড়ে পকেটে রাখতে রাখতে প্রৌঢ় ভুজঙ্গধর আবেগরুদ্ধ কণ্ঠ বার দুই কেশে সাফ করে নিলেন। তারপর বললেন কি উপকার যে করলেন মিঃ আয়ার…

সম্মিত মুখে মিঃ আয়ার বললেন, উপকার নয় কর্তব্য।

ভুজঙ্গধর বলতে লাগলেন কত বড় ঘরের মেয়ে হয়ে অপর্ণা মাকে পথে দাঁড়াতে হয়েছিল…এই টাকা দিয়ে মেয়েটা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবে। ধন্যবাদ অনেক ধন্যবাদ আপনাদের কোম্পানিকে। আচ্ছা, আজ তাহলে আসি মিঃ আয়ার। আজ রাত্রের মেলেই আসাম যাব ভাবছি।…চলো মা—

ধীর ভঙ্গিতে অপর্ণা উঠে দাঁড়াল। তারপর শুভ্র সুডৌল ডান হাতখানি আয়ারের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে কাঁপা গলায় বললে, কি বলে আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব—

সেই শঙ্খের মতো শুভ্র, মোমের মতো নরম করতল সসম্ভ্রমে নিজের দুই মুঠির মধ্যে ধরে তরুণ মাদ্রাজি ম্যানেজার মুহূর্তের জন্যে যেন সম্বিৎ হারিয়ে ফেললো।

দরজার দিকে এগিয়ে ভুজঙ্গধর বললেন, নমস্কার মিঃ আয়ার!

অপর্ণার হাতখানা মিঃ আয়ার ছেড়ে দিলেন।

সুইং—ডোরের বাইরে ভুজঙ্গধরের কাশি আর দুজনের পায়ের শব্দ ক্রমশ দূরে চলে গেল।

চেয়ারে বসে পড়ে মিঃ আয়ার একটা সিগারেট ধরালেন। শঙ্খের মতো শুভ্র, মোমের মতো নরম সেই করতলের স্পর্শ নিজের কালো মুঠির মধ্যে এখনও তিনি অনুভব করতে পারছেন।

বেয়ারা ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর একটা শ্লিপ রাখল। সেদিকে দৃষ্টি না দিয়েই অন্যমনস্কের মতো মিঃ আয়ার বললেন, সেলাম দো।

বেয়ারা চলে গেল।

একটু পরেই ঘরে ঢুকলো দুটি প্রাণী। লংক্লথের পাঞ্জাবির ওপর এণ্ডির চাদর গায়ে দাড়ি গোঁফ কামানো শীর্ণ একটি ভদ্রলোক, আর গরদের থানপরা রীতিমতো কালো মধ্যবয়সি একটি মহিলা।

মিঃ আয়ার বললেন, ইয়েস?

কথায় পুরোদস্তুর আসামী টান দিয়ে ভদ্রলোকটি বললেন নমস্কার। আমি হচ্ছি আসামের জমিদার মৃত জানকীনাথ চৌধুরীর এস্টেটের ম্যানেজার ভুজঙ্গধর হাজারিকা, আর ইনি জমিদার সাহেবের একমাত্র কন্যা শ্রীমতী অপর্ণা দেবী।

নিমেষে মিঃ আয়ার তিরের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন : হোয়াট!

ভদ্রলোক বললেন, আমরা এসেছি, জমিদার সাহেব তাঁর মেয়ের নামে পনেরো হাজার টাকার যে ইন্সিওরটা করে গেছেন, তারই জন্যে।

বিমূঢ় বিস্ময়ে মিঃ আয়ার বললেন, দুনিয়ার আর ক’টা ভুজঙ্গধর এবং অপর্ণা দেবী আছেন, বলতে পারেন?

অবাক হয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, কেন বলুন তো?

এইমাত্র একজন ভূজঙ্গধর এবং একজন অপর্ণা দেবী মৃত জানকীনাথের ইন্সিওর করা পনেরো হাজার টাকা নিয়ে চলে গেছেন।

বলেন কি!

দ্বিতীয় ভুজঙ্গধর ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন এবং দ্বিতীয় অপর্ণা দেবী তারস্বরে ক্রন্দন জুড়ে দিলেন : ওগো, আমার কি হবে গো…

কুইন মেরি হোটেলের ছ’নম্বর কামরা থেকে বেরিয়ে শীলা ব্যস্ত হয়ে ডাক দিল, বয়! বয়!

বয় ছুটে এলো।

জলদি বরফ লাও মেমসাহেব বেহোঁশ হো গ্যয়ী!

বয় বরফ আনতে ছুটলো, আর রাগে বিরক্তিতে মুখ অন্ধকার করে শীলা দাঁড়িয়ে রইলো করিডরে। নাঃ আর পারা যায় না! ওই ঘন ঘন মূর্ছা যাওয়া বাতিকগ্রস্ত মুটকি মহিলাকে নিয়ে সত্যিই আর পারা যায় না! শীলা এবার নিশ্চয় চাকরি ছেড়ে দেবে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

কিন্তু উপস্থিত তো একটা উপায় করতে হবে লেডি মুখার্জীর মূর্ছা ভাঙানোর জন্যে! কি জানি, যদি মরেই যায়? শেষ অবধি খুনের দায় চাপবে নাকি ঘাড়ে?

স্মেলিং সল্টের শিশিটা যে কোথায় গেল…একবার দেখবে নাকি ন’নম্বর কামরায় স্মেলিং সল্ট আছে কিনা?

শুনছেন, ও মিস্টার—আপনার ঘরে স্মেলিং সল্ট—

হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে ঢুকতেই শীলার মুখের কথা হারিয়ে গেল। ঘরে লালজি নেই। তার বদলে বসে বসে পানের সাথে জর্দা মুখে দিচ্ছেন সৌম্যদর্শন মধ্যবয়সী একজন প্রৌঢ়, মাথায় কাঁচা—পাকা চুল, চোখে চশমা, গলায় এই গরমের দিনেও কম্ফর্টার জড়ানো। হয়তো ঠান্ডা লাগার বাতিক আছে।

অপ্রস্তুত হয়ে শীলা বললে, মিঃ লালজি—

কথা বলতে গিয়ে ভদ্রলোক কেশে ফেললেন! কাশতে কাশতে জবাব দিলেন, লালজি তো নেই, বেরিয়ে গেছে। আমি তার জ্যাঠামশাই।

ওঃ!—শীলা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। ছুটলো লবির দিকে ডাঃ ঘোষকে টেলিফোন করতে। কিন্তু রিসিভার তুলে যখন সে কথা কইছে, তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ল সিঁড়ির দিকে। পা জামা আর পাঞ্জাবি পরা লম্বাটে চেহারার একটি লোক সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে…লালজি না?

তবে যে প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বললেন, লালজি বেরিয়ে গেছে?

ডাক্তারের সঙ্গে কথা অসমাপ্ত রেখেই শীলা ফের ছুটে গেল ন’নম্বর কামরার দিকে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই, আর্শ্চয জ্যাঠামশাইয়ের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। শুধু রুপো—বাঁধানো লাঠিটা পড়ে আছে।

রাত দশটায় জিপসি—নাচ শুরু হল ওয়েলেশলি কফি—হাউসে।

জোহরা বাঈয়ের এই নতুন জিপসী—নাচ আজকাল কফি—হাউসে লোক টানছে খুব বেশি। রাত দশটা থেকে টেবিল খালি পাওয়া কঠিন। কফির কাটতি খুব বেশি নয়। আঠারোটি বয়ের হাত ব্যথা হয়ে যায় ক্রমাগত সোডার বোতল খুলে খুলে।

নাচের আগে জোহরা এসে স্টেজে দাঁড়ালেই বিপুল হর্ষধ্বনিতে হল যেন ফেটে পড়ে। বিশেষ করে স্টেজের একেবারে সামনের টেবিলগুলো থেকে উচ্ছ্বাস একটু বেশি পরিমাণেই প্রকাশ পায়। সেখানে যারা বসে, তারা নাচের সময় কখন ক’বার করতালি দেবে, কী ভঙ্গিতে তারিফ করবে, জোহরার মুখস্থ হয়ে গেছে। এমন কি প্রতিদিন দেখে দেখে তাদের মুখগুলি পর্যন্ত জোহরার বিশেষ চেনা। কিন্তু আজ তাদেরই মধ্যে একটি নতুন মুখ দেখা গেল। লোকটির বয়স হয়েছে, কিন্তু চেহারা দেখে চট করে ধরবার উপায় নেই। শুধু দু’পাশে রগের কাছে সাদা ছোপ তার বয়সটাকে ধরিয়ে দেয় নৈলে তাকে অনায়াসেই যুবক বলা যেত। এককালে লোকটি সুপুরুষ ছিল সেটা তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু অপরিমিত অত্যাচারের ইতিহাস তার সেই সৌন্দর্য্যের স্মৃতিকে কলঙ্কিত করে ফেলেছে। মাথার সামনের দিকে কটা রঙের চুলগুলি পাতলা হয়ে গেছে, চোখের কোলে রাত্রি—জাগরণের কালি প্রসাধনের প্রলেপেও বিশেষ ঢাকা পড়েনি।

লোকটির পরনে কড়া ইস্ত্রিকরা ডিনার স্যুট। কালো কোটের বাটন—হোলে টকটকে লাল একটা ফুল আটকানো। মুখে সরু গোঁফ আর ফরাসি ধরনের ছাঁটা দাড়ি। সব মিলিয়ে একটা বিদেশি ছাপ।

জোহরা লক্ষ করেছে, নতুন লোকটির মদ খেতে যত উৎসাহ, খাওয়াতে উৎসাহ তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং তার টেবিলেই মধু—মক্ষিকাদের ভিড়।

অনেকগুলি গেলাস জল—তরঙ্গের বাটির মতো সাজিয়ে, দু’হাতে দু’টো চামচ নিয়ে সে নাচের সঙ্গে সঙ্গে তাল দিচ্ছিল। জোহরা যতবার তাকে লক্ষ করেছে, একবারও তাকে বেতালা হতে দেখেনি। লোকটা শুধু শৌখীন স্ফূর্তিবাজ নয়, মিউজিকও জানে ভালো।

নাচ শেষ হতেই নতুন বিদেশি লোকটি সবার আগে দাঁড়িয়ে উঠে করতালি দিতে শুরু করলে। লীলায়িত ভঙ্গিতে হাত দুটি দু’পাশে প্রসারিত করে জোহরা দর্শকদের প্রতি একবার মাথা নোয়ালে, তারপর স্টেজ থেকে নেমে চলে গেল।

গ্রিনরুমে জোহবার মেক—আপ তোলা সবে শেষ হয়েছে।

দরজায় টকটক আওয়াজ।

কে?

ঘরে ঢুকল ইয়াসিন। হাতে একটুকরো কাগজ, তাতে লেখা : আন্দ্রে পল।

ইয়াসিন বললে, সাহেব বাইরে দাঁড়িয়ে।

ভুরু দুটো কুঁচকে জোহরা নামটার দিকে একবার তাকাল।

আসতে বল।

দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল আন্দ্রে পল। হাতে মস্ত একটা ফুলের স্তবক। জোহরা সবিস্ময়ে দেখল, এ সেই লোক—স্টেজের সামনে টেবিলের সেই নতুন বিদেশি আগন্তুক।

অভিবাদনের ভঙ্গিতে আন্দ্রে মাথাটা ঈষৎ নুইয়ে ফুলের তোড়াটি এগিয়ে ধরলো। তারপর ভাঙা হিন্দিতে বললে, মাদাম, তোমার নাচ দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।

ফুলের তোড়াটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে জোহরা শুধু বললে, ধন্যবাদ!

ঈষৎ হেসে আন্দ্রে বললে, ধন্যবাদটা তোমারই পাওয়া উচিত মাদাম—আমার এই সামান্য উপহার তুমি গ্রহণ করেছো বলে।

জোহরা বসতে বলার আগেই আন্দ্রে একটা চেয়ার দখল করে বসল। বললে, নাচ আমি বড় ভালোবাসি। তাই তোমার সঙ্গে আলাপ না করে থাকতে পারলাম না, মাদাম। প্যারিসে জন্মালে তোমার আরও কদর হোত।

আপনি তো দেখছি বিদেশি। দেশ কোথায়?

আমার বাবা ছিলেন ফরাসি, সেই হিসেবে আমার দেশ প্যারিস। কিন্তু আমার মা ছিলেন এ্যাংলো ইন্ডিয়ান। তাই আমি মানুষ হয়েছি এই দেশেই। আমার একটা মিউজিক স্কুল আছে। সেখানে আমি পিয়ানো বাজাই। শিখবে তুমি?

কোনোদিন ইচ্ছা হলে বলব আপনাকে।

এখানে রোজই তোমার নাচ থাকে?

না, কেবল শনি আর রবিবার।

আন্দ্রে জিজ্ঞাসা করল, তুমি বিলিতি নাচ জানো?

কিছু কিছু।

আমিও কিছু জানি। দিনকতক নাচের একটা ট্যুরিংপার্টিও করেছিলাম। ভালো চলল না বলেই তুলে দিয়েছি। তোমার সঙ্গে একদিন নাচবার ইচ্ছে আছে।

আমার সময় বড় কম।

সে কি! জীবনে আনন্দ করার সময় তোমার নেই!…..তোমাকে যদি একদিন গ্র্যান্ড হোটেলে নাচের জন্যে আমন্ত্রণ করি, এই বিদেশি বন্ধুর অনুরোধ তুমি রাখবে কী মাদাম?

একটু ইতস্তত করে জোহরা বললে, এখন ঠিক বলতে পারছি না।

কেন, তুমি কি বিবাহিতা?

না।

নাচ ছাড়া তুমি কি অন্য কাজ করো?

না—ঠিক তা নয়—তবে—

আন্দ্রে হঠাৎ আবেগভরে বলে উঠল, তুমি আর্টিস্ট, জীবনটাকে ভোগ করে নাও মাদাম। যৌবন হচ্ছে একরাত্রির উৎসব। এই আছে, এই নেই। সময় থাকতে আশা মিটিয়ে নাও। আমার ধর্ম হচ্ছে Eat Drink and be merry। কে জানে, কবে বসন্ত ফুরিয়ে যাবে, তার আগে জীবনের মধু নিংড়ে নাও—শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত। আফশোষের কিছুই থাকবে না। তোমাদের কবি ওমর খৈয়ামই তো বলে গেছেন :

 নগদ যা পাও, হাত পেতে নাও,

 বাকির খাতায় শূন্য থাক!

আ!….একটা কবির মতো কবি! মাদাম, তুমি বিরক্ত বোধ করছো। বোধ হয়? নাচের পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছ নিশ্চয়?….আচ্ছা, আজ গুড নাইট। তোমার নাচের দিন আসবো।

আর একবার মাথা নুইয়ে আন্দ্রে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।

জোহরার কানে বাজতে লাগল : জীবনটাকে ভোগ করে নাও মাদাম। যৌবন হচ্ছে একরাত্রির উৎসব!….সময় থাকতে আশা মিটিয়ে নাও! কে জানে কবে বসন্ত ফুরিয়ে যাবে…

জোহরা জানে, বসন্ত ফুরিয়ে গেলে শুকনো ফুল হাওয়ায় উড়ে যায়! আন্দ্রে ঠিকই বলেছে, সময় থাকতে আশা মিটিয়ে নিতে হবে। মরণান্ত কাল পর্যন্ত জোহরা আশা ছাড়বে না—একথা তুমি জেনে রেখো লালজি!

সেই রাত্রে কালো রঙের মাস্টার বুইক গাড়িখানাকে বড়বাজারের কটন স্ট্রিটের মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। ভেতরে আরোহী নেই। আমরা জানি, কোথায় তাকে এখন পাওয়া যাবে।

বাঁ—দিকে ইট—বাঁধানো সরু গলির মধ্যে সেই যে পার্শি ডাক্তার ফিরদৌস ইরানি, তারই বাড়ির সামনে লালজিকে খুঁজে পাওয়া গেল। দরজায় আঘাত করতে গিয়ে লালজি আশ্চর্য্য হয়ে গেল। কপাট দুটো খোলা। এ বাড়িতে আনাগোনা তার বহুদিনের, কিন্তু একটা দিনও সে দরজা খোলা থাকতে দেখেনি। পুলিশের ভয়ে ইরানি সাহেব অষ্টপ্রহর দরজা বন্ধ করে রাখত। আজ তার ব্যতিক্রম কেন? হল কি?

চাপা গলায় লালজি ডাক দিল, ডক্টর সাহেব।

একটু পরে তিনতলার জানলা থেকে চেনা গলার জবাব এল, ওপরে এসো।

যাক ইরানি সাহেব তাহলে আছে! ধরা পড়েনি।

দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে লালজি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু আশ্চর্য হতে আরও একটু বাকি ছিল তা’র। ইরানিসাহেবের ঘরে আলমারি ভর্তি সেই সব ডাক্তারি বই, ওষুধের শিশিপত্তর, এমন কি টেবিল—চেয়ারগুলো পর্যন্ত নেই। রয়েছে শুধু সেই লোহার সিন্দুকটা, আর তার ওপর দেয়ালে ঝোলানো সেই আস্ত নরকঙ্কাল। মেঝের ওপর কম্বল বিছিয়ে ইরানিসাহেব বসে বসে মালা ঘোরাচ্ছিল।

লালজি ঘরে ঢুকতে বললে এসো। কি মনে করে?

কম্বলের একপাশে বসে পড়ে লালজি বললে যা মনে করে বরাবর এসেছি, আজও তাই। একখানা চেক ক্যাশ করে দিতে হবে। ভালো জায়গার চেক—ইণ্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানির।

পকেট থেকে লালজি চেকখানা বের করলে।

সামনের দুটো ভাঙা দাঁত বের করে ইরানি সাহেব হাসলে একটুখানি। বললে, টাকা নেই।

বাঁ—দিকের ভুরু তুলে লালজি একবার তাকালে ইরানি সাহেবের দিকে। বললে, টাকা নেই! তোমার? ওসব বাজে কথা রাখো সাহেব। পনেরো হাজারের চেক ক্যাশ করতে কত কমিশন নেবে, সোজা করে বল দেখি?

মালা ঘোরানো বন্ধ রেখে ইরানি সাহেব উঠল। লোহার সিন্দুকের ডালাটা টেনে খুলে দিলে। ভেতরটা একেবারে ফাঁকা—শূন্যগর্ভ! তারপর বললে, কারবার তুলে দিয়েছি।

লালজির মুখের ভাব বদলে গেল।

পুলিশের নজর পড়েছে নাকি?

ইরানি সাহেব ঘাড় নাড়লে : না। এমনিই তুলে দিলাম। আর ভালো লাগল না।

সাবাস—সকৌতুক বিদ্রুপে লালজির চোখ দুটো নেচে উঠল : কথাটা সাধু পূর্বপুরুষদের বংশধরের মতোই বললে বটে, কিন্তু আসলে তুমি যে আমারই মাসতুতো ভাই।…সত্যি কথাটা খুলে বল দেখি সাহেব। সিন্দুকের মধ্যে তোমার সেই যখের ধন গেল কোথায়? অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলেছ বুঝি?

অন্ধ হাসপাতালে দিয়ে দিয়েছি। ডাক্তারি বইগুলো পর্যন্ত।

লালজির মুখ গম্ভীর হয়ে এল। লোকটা বলে কি? শাইলক ইহুদির মতো লোভী, অর্থপিশাচ চোরা—কারবারি ফিরদৌস ইরানি তার যথাসর্ব্বস্ব অন্ধদের হাসপাতালে দান করেছে! এও কি সম্ভব?

সত্যি বলছো ইরানি সাহেব?

মিথ্যে বলে লাভ কি লালজি? তুমি হাসপাতালে খবর নিও।

মুহূর্তখানেক লালজি স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বললে, কিন্তু কেন ইরানি সাহেব? হঠাৎ তোমার হল কি?

ইরানি সাহেব নীরবে আবার এসে কম্বলের ওপর বসল। ঘুরতে লাগল হাতের মালা। চর্বি—বাতির আলো পড়েছে তার মুখে। লালজি ভালো করে তাকিয়ে দেখল। শান্ত সমাহিত মুখভাব। চোখের দৃষ্টি উদাস কোমল। এই ইরানি সাহেবকে লালজি আগে কখনও দেখেনি!

কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে ইরানি সাহেব বললে, তোমাকে একটা গল্প বলি শোন। একদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে, এত টাকা আমি যখের মতো কার জন্যে আগলে বেড়াই? সেই কথা আজ বলি শোন লাল।—পঁয়ত্রিশ বছর আগে, আমি তখন পঁচিশ বছরের যুবক। সবে ডাক্তারি পাশ করেছি। প্রাণে তখন নতুন আশা, চোখে নতুন স্বপ্ন। প্র্যাকটিস শুরু করলাম। সেই সময় একটি রুগি দেখতে গিয়ে একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয় নাম তার রুমা। ফুলের মতো নরম, শিশিরের মতো পবিত্র মেয়ে। বড় ভালো লাগতো তাকে। মুগ্ধ হলাম বিশেষ করে তার চোখদুটো দেখে। ভোরবেলা সূর্য—ওঠার ঠিক আগেকার আকাশ দেখেছ? ঠিক তেমনি নীলাভসুন্দর ছিল রুমার চোখ দুটি। একদিনের আলাপ ক্রমশ প্রতিদিনের আকর্ষণে দাঁড়াল। বিয়ে করলাম তাকে। ঘরও বাঁধলাম। কিন্তু আশা আমার মিটলো না; আগেই বলেছি, প্রাণে তখন আমার অনেক আশা, অনেক সাধ। সে সাধ মেটাতে হলে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু আমার মতো ছোকরা ডাক্তারের তেমন পসার কই? রোজগার কি করে হবে? এই সময় পড়ে গেলাম বদসঙ্গে। রোজগারের রাস্তা খুলে গেল। কেমন করে জানো? শহরে অনেক পাপ, অনেক জঞ্জাল, আর ভ্রূণহত্যা—লেগে গেলাম সেই গোপন পাপের ব্যবসাতে। দিনের পর দিন ডাক আসতো কলঙ্কিনী কুমারী আর ভ্রষ্টা বিধবাদের কাছ থেকে। মোটা মোটা টাকার অঙ্কের বিনিময়ে কত নিষ্পাপ শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিইনি—কত অনাগত জীবনকে গোপনে গোপনে শেষ করে দিয়েছি। সাত বছরের মধ্যেই আলাদীনের মতো আমার ভাগ্য ফিরে গেল। কিন্তু সুখী করতে পারলাম না রুমাকে। সাত বছরে দুটি সন্তান হয়েছিল, তারাও রইল না। যে সমস্ত সুকুমার জীবন নষ্ট করেছি, তারা যেন আমার শিশুদের ওপর শোধ নিলে।

একটু থেমে ইরানি সাহেব আবার শুরু করলে, আমার গোপন ব্যবসার কথা রুমা প্রথমে জানতে পারেনি। কিন্তু জানতে পারল যেদিন, সেদিন আর তাকে ধরে রাখা গেল না। আমার প্রতি অপরিসীম ঘৃণায় একদিন রাত্রে আমাকে ছেড়ে চলে গেল নিঃশব্দে। টাকার মোহ, বিলাসিতার আকর্ষণ, আমার প্রতি ভালোবাসা—কিছুই তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে না। মনে একটা ধাক্কা লাগল। ভাবলাম, তাকে ফিরিয়ে এনে জীবনটাকে বদলে ফেলি। কিন্তু প্রচণ্ড অভিমান এসে বাধা দিল। সাত বছরের ভালোবাসার বাঁধন ছিঁড়ে সে যদি এমনি করে চলে যেতে পারে, তবে যাক সে। রুমাকে আমি আর ডাকব না। তারপর দিন গেল, বছর গেল, যৌবন গিয়ে বার্ধক্য এলো। কিন্তু পাপের পিছল পথ থেকে আমি আর ফিরতে পারলাম না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার গোপন ব্যবসা ছেড়ে চোরাই কারবার ধরলাম। তাতে আরও টাকা। টাকার নেশা যেন আমাকে পেয়ে বসেছিল। রুমাকে আর ফিরে ডাকিনি। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে ক্রমে ক্রমে তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তবু একেবারে ভুলতে পারিনি, মাঝে মাঝে মনে পড়তো। মনের মধ্যে কোথায় যেন আশা জেগেছিল—একদিন সে ফিরে আসবে। ভেবেছিলাম, যৌবন গেছে বটে, টাকা তো আছে—অনেক টাকা, প্রচুর টাকা দিয়ে আবার সুখের ঘর গড়বো। পঁয়ত্রিশ বছর এমনি করেই গেল কেটে।

লালজি প্রশ্ন করলে, তারপর?

দিনসাতেক আগে নিউ মার্কেটে গিয়েছিলাম কিছু ফল কিনতে। দোকানে দাঁড়িয়ে ফল কিনছি, এমন সময় পেছন থেকে কে একজন কাতর গলায় বলে উঠল, কিছু ভিক্ষে দাও, ভগবান তোমার ভালো করবেন। পকেট থেকে একটা আনি বার করে ফিরে তাকে দিতে যাব, হাতখানা আমার অবশ হয়ে গেল। পঁয়ত্রিশ বছর পরেও চিনতে আমার ভুল হয়নি। ভিক্ষা যে চাইছে, সে আর কেউ নয়, রুমা! ফুলের মতো নরম, শিশিরের মতো পবিত্র সেই রুমা অনাহারে শুকনো পাতার মতোই কালো কুৎসিত শ্রীহীন হয়ে গেছে। আমার দিকে তাকিয়েই সে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু তার মুখের ভাবে বুঝতে পারলাম, আমাকে সে চিনতে পারেনি। অথবা চিনতে পেরেও চেনা দিচ্ছে না। আনিটা দিয়ে বললাম, নাও। কিন্তু হাত সে বাড়ালো অন্য দিকে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, তার সেই চোখ দুটি—ভোরবেলার সূর্য ওঠার ঠিক আগেকার আকাশের মতো নীলাভ—সুন্দর দুটি চোখের তারা সাদা!

লালজির গলা দিয়ে অস্ফুট আওয়াজ বেরোলো : রুমা অন্ধ?

চোখ বুজে ইরানি সাহেব বসে রইল, কোনো জবাব দিল না। ঘুরতে লাগল হাতের মালা। তারপর একসময় মৃদু গভীর স্বরে ধীরে ধীরে আবার বলতে লাগল : এ আমারই পাপ, লাল। আমারই পাপে রুমা অন্ধ হয়ে গেল। Crime does not pay, my boy! পাপের দেনা শোধ করতেই হয়।….রুমাকে পরিচয় দিইনি। তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই দিনই অন্ধ হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম, আর পরের দিনই আমার সঞ্চিত সমস্ত টাকাকড়ি হাসপাতালে দিয়ে এলাম—যদি ভালো করে চিকিৎসার ফলে রুমার চোখের দৃষ্টি কোনোদিন ফিরে আসে।

চুপ করে বসে লালজি শুনছিল। বললে, নিজের জন্যে কিছুই রাখলে না ইরানি সাহেব? তোমার দিন চলবে কি করে?

প্রশান্ত মুখে ইরানি সাহেব জবাব দিলে, চালাবার যিনি মালিক, তিনিই জানেন। তারপর দেয়ালে—ঝোলানো নরকঙ্কালটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললে, ওই তো পরিণাম! তবে আর ভাবনা কিসের?

লালজি নিঃশব্দে বিদায় নিলে।

থানা—পুলিশ বাদ দিয়ে কোনো গোয়েন্দা—গল্প তৈরি হয় না। সুতরাং আমার সঙ্গে আপনাদেরও আর একবার পার্ক স্ট্রিট থানায় যেতে হবে। অফিসার গুপ্ত পড়ছিলেন :

গত সোমবার ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্স কোম্পানিতে এক বিচিত্র প্রতারণার কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে। প্রায় মাসখানেক পূর্বে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক একটি অল্পবয়স্কা বিধবা মহিলাকে সঙ্গে করিয়া উক্ত কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার মিঃ আয়ারের সহিত দেখা করে। ভদ্রলোকটি নিজেকে আসামের মৃত জমিদার জানকীনাথ চৌধুরীর এস্টেটের ম্যানেজার ভুজঙ্গধর হাজারিকা বলিয়া পরিচয় দেয় এবং বলে যে, বিধবা তরুণীটি জমিদারের একমাত্র কন্যা অপর্ণা দেবী। মৃত জনকীনাথ চৌধুরীর মৃত্যুর তিন বৎসর পূর্বে কন্যা অপর্ণার নামে উক্ত বীমা কোম্পানিতে পনেরো হাজার টাকা জীবনবীমা করিয়া যান। ভুজঙ্গধর ও অপর্ণা নামে পরিচিত সেই প্রৌঢ় লোকটি এবং বিধবা মহিলাটি যথারীতি বীমার পলিসি ও মৃত জানকীনাথের ডেথ—সার্টিফিকেট ম্যানেজারের নিকট দাখিল করিয়া বীমার দরুণ পনেরো হাজার টাকা দাবী করে। তাহারা গত সোমবার দিন কোম্পানির নিকট হইতে পনেরো হাজার টাকার চেক লইয়া সরিয়া পড়ে। ইহার অব্যবহিত পরে আর এক ব্যক্তি একটি বিধবা বয়স্কা মহিলাকে সঙ্গে লইয়া ম্যানেজারের ঘরে প্রবেশ করে। তাহারাও আপনাদিগকে ভূজঙ্গধর ও অপর্ণা দেবী বলিয়া পরিচয় দিয়া উক্ত টাকার দাবী জানায়।

পড়া থামিয়ে অফিসার গুপ্ত বললেন, শুনছো বিশু?

টেবিলের ওপর দেশলাইয়ের কাঠি সাজিয়ে বিশু নাড়াচাড়া করছিল। মুখ না তুলেই বললে, শুনছি বৈকি, তারপর?

অফিসার গুপ্ত আবার শুরু করলেন :

তাহারা আরও বলে যে, মৃত জমিদারের ডেথ—সার্টিফিকেট ও বীমার পলিশি জমিদারীর একজন পুরাতন কর্মচারি গোপীকান্ত আচার্যের মারফত ইতোপূর্বে পাঠাইয়া দিয়াছে এবং সেই মর্মে কোম্পানির নিকট হইতে প্রাপ্ত একখানা চিঠিও দেখায়। এই ব্যাপারে জেনারেল ম্যানেজার মিঃ আয়ার বিভ্রান্ত হইয়া পড়েন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কে ও পুলিশে ফোন করিয়া সমস্ত ঘটনা জানান।

দেশলাইয়ের কাঠির দিকে চোখ রেখেই বিশু বললে, যাক, টাকাটা তাহলে মারা যায়নি।

অফিসার গুপ্ত পড়ে যেতে লাগলেন :

অনুসন্ধানে জানা যায় যে, তাঁহারই প্রকৃত ভুজঙ্গধর ও অপর্ণা দেবী। কিন্তু প্রথম ব্যক্তিদ্বয় কে বা কি, তাহার সঠিক বিবরণ এখনো পাওয়া যায় নাই। ম্যানেজারের বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে যে, প্রথমোক্ত প্রৌঢ় ব্যক্তির চোখে চশমা, মুখে ছাঁটা গোঁফ, গলায় কম্ফটার এবং হাতে রূপা—বাঁধানো একগাছা লাঠি ছিল। বয়স অনুমান পঞ্চাশের উপরে। তরুণী মহিলাটি অসামান্যা রূপসী এবং সম্ভ্রান্ত—দর্শনা। জোর তদন্ত—

রমলা হঠাৎ স্বগত বলে উঠল, চোখে চশমা, মুখে ছাঁটা গোঁফ, গলায় কম্ফর্টার আর হাতে রূপা—বাঁধানো লাটি!…লোকটিকে আমার দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে বিশুদা।

বিশু এবার মুখ তুলে সোজা হয়ে বসল : কোথায়?

পরশুদিন আমাদের হোটেলের ন’নম্বর কামরায়—মানে, লালজির ঘরে। ভদ্রলোক বললেন, তিনি লালজির জ্যাঠামশাই।

বিশু বললে, জ্যাঠামশাই?

হ্যাঁ। কিন্তু আশ্চর্য, মিনিট দশ পনেরো বাদে আবার ঘরে গিয়ে দেখা গেল, জ্যাঠামশাই কর্পূরের মতো উবে গেছেন আর তার বদলে বেরিয়ে যাচ্ছে স্বয়ং লালজি!

বিশু হেসে উঠল : লালজি তাহলে জ্যাঠা—ভাইপো দুই পুরুষের ভূমিকায় একসঙ্গে নেমেছে। বাহাদুর বলতে হবে। সত্যিই বহুরূপী বটে! কিন্তু জাল অপর্ণা দেবীটি কে? লালজির পার্টনার সেই রহস্যময়ী…আচ্ছা গুপ্ত, শুনেছি তোমাদের অপরাধ—তত্ত্বে বলে, অপরাধী পুরুষের প্রতি অপরাধ—প্রবণ মেয়েদের আকর্ষণ একটু বেশিই হয়ে থাকে। বহু ক্ষেত্রে গভীর ভালোবাসাও জন্মায়। তা যদি হয়, তাহলে লালজির প্রতি সেই সুন্দরী রহস্যময়ীর গভীর আসক্তি থাকা স্বাভাবিক। নয় কি?

বিরক্ত হয়ে অফিসার গুপ্ত বললেন, গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে তুমি কি এবার প্রেমের গল্প লিখবে—

অফিসারের কথা শেষ হল না। তার আগেই মোটাসোটা গলদঘর্ম এক ব্যক্তির ঝড়ের মতো প্রবেশ।

নমস্কার দারোগাবাবু! দয়া করে একটা কেস লিখে নিন তো।

ভুরু কুঁচকে অফিসার গুপ্ত বললেন, কে আপনি?

পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বার করে কপাল আর ঘাড় মুছতে মুছতে লোকটি বললে, আমার নাম শ্রীকুঞ্জবিহারী বিশ্বাস। কারবারী লোক, চিৎপুরে আমার তিসির আড়ত আছে। আমাকে ঠকিয়েছে মশাই! গালে চড় মেরে দশটি হাজার টাকা ঠকিয়ে নিয়েছে। যাকে বলে, ব্ল্যাক—মেল!

ব্যাপারটা কি? কে ঠকিয়েছে?

লালমোহন মুখুজ্জে মশাই, কানপুরের গালার কারবারি। হারামজাদা এত বড় শয়তান, নিজের সুন্দরী বৌটাকে লেলিয়ে দিয়ে—সে কি কেলেঙ্কারি মশাই! কি কুক্ষণেই যে গিয়েছিলাম তাদের বিয়ের তারিখে নেমন্তন্ন খেতে। এমন জানলে কোন সম্বন্ধি—

অফিসার গুপ্ত ধমকিয়ে উঠলেন, থামুন। সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলুন আগে।

দশ হাজার টাকার মর্মান্তিক যন্ত্রণায় কুঞ্জ বিশ্বাস তার আক্কেল—সেলামির সমস্ত বিবরণটি বলে গেল।

অফিসার গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, লালমোহন মুখুজ্জের সঙ্গে আপনার কতদিনের আলাপ?

তা প্রায় মাস আষ্টেক হবে।

আপনার সঙ্গে কখনো কোনো বিবাদ হয়েছিল তার?

কক্ষনো না। উল্টে দহরম—মহরম! মাঝে মাঝে একসঙ্গে একটু—আধটু ইয়েও চলতো।

লালমোহন মুখুজ্জের স্ত্রীর সঙ্গে কতদিনের আলাপ?

এক—আধ দিন মাত্তর! আমি মশাই মেয়েছেলের কারবারে নেই। তবে হ্যাঁ, মুখুজ্জের স্ত্রী রঞ্জনা দেখতে যেন ডানাকাটা পরি! কিন্তু কে জানত মশাই, ভেতরে ভেতরে মিছরির ছুরি!

রমলা অন্যদিকে মুখ ফেরালো।

অফিসার গুপ্ত জিজ্ঞাসা করলেন, লালমোহন মুখুজ্জে থাকে কোথায়?

হোটেলে মশাই, হোটেলে। কি যে নাম—কুইন ভিক্টোরিয়া—

বিশু প্রশ্ন করলে, কুইন ভিক্টোরিয়া, না কুইন মেরি হোটেল?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই হোটেল। তারই ন’নম্বর কামরায় থাকে।

কুঞ্জ বিশ্বাস বাদে বাকি তিনজন নিঃশব্দে পরস্পরে দৃষ্টি—বিনিময় করল।

অফিসার গুপ্ত বললেন, কিন্তু আপনি এখানে কেস লেখাতে এসেছেন কেন? কেসটা তো এ—থানার এলাকায় নয়।

কুঞ্জ বিশ্বাস উত্তেজিত হয়ে উঠল : এ—থানা ও—থানা জানি না মশাই, আমার দুঃখের কথা কোলকাতার সব থানাতেই জানিয়েছি। এর একটা বিহিত আপনাদের করতেই হবে। ওই ছুঁচো লালমোহন মুখুজ্জেটাকে ধরে তাকে দিয়ে ঘানি টানাবো, তবে আমার শান্তি। দশ হাজার গেছে, নাহয় আরও দশ হাজার যাবে। কুচ পরওয়া নেই…আচ্ছা নমস্কার। এবার মুচিপাড়া থানায় যাই—ওইটাই এখনো বাকি।

সিল্কের রুমাল দিয়ে কপাল আর ঘাড় মুছতে মুছতে মোটাসোটা গলদ—ঘর্ম কুঞ্জ বিশ্বাসের প্রস্থান।

তিনজনেই নীরব। শুধু ওয়াল—ক্লকটার বুকে সময়ের হৃৎস্পন্দন শোনা যাচ্ছে।

তারপর নীরবতা ভেঙে বিশু বললে, বহুরূপী লালজির এও আর একটি রূপ।

‘বিশ্ববার্তা’ কাগজখানা হাতের মুঠোয় পাকাতে পাকাতে অফিসার গুপ্ত অবরুদ্ধ রাগে বলে উঠলেন, লালজি! লালজি! লালজি! সারা শহরে লোকটা যেন ভেলকি দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। লালজি—রহস্যের একটা কিনারা করতেই হবে বিশু—যত শিগগির হয়।

দেশলাইয়ের কাঠির খেলায় বিশু আবার মন দিয়েছিল। মুখ না তুলেই বললে, ধীরে বন্ধু, ধীরে। উতলা হওয়া পুলিশ—অফিসারের কাজ নয়।

কিন্তু এদিকে যে চাকরি রাখা দায় হয়ে পড়েছে! একে রাজারামের কেসটার কোনো কিনারা এখনও হয়নি, তার ওপর আজ ‘বিশ্ববার্তা’ কাগজে এই রিপোর্টটা বেরোবার পর উপরওয়ালা কড়া নোট পাঠিয়েছেন, তা জানো? ইচ্ছে হচ্ছে এখুনি গিয়ে লালজিকে—

গ্রেপ্তার করবে? কিন্তু তার আগে আট—ঘাট বেঁধে কাজ করাই ভালো নয় কি?

রমলা এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এবার বললে, এখন তাহলে আমার প্রতি কি নির্দেশ আপনাদের?

সে—কথার কোনো জবাব না দিয়ে বিশু বললে, আচ্ছা রমলা, কাজ আর কাজ করে তুমি কি পাগল হবে? মেট্রোতে একটা নতুন ছবি এসেছে—’গ্রেট ওয়ালজ’। চমৎকার ছবি, দেখে এসো না একদিন।

রমলা যেন নেচে উঠল : চলুন না দেখে আসি।

বেশ তো! দু’খানা টিকিট কেটে রেখো একদিন। ধরো, আসছে রবিবার—ছ’টার শোতে। পরের টিকিটে সিনেমা দেখতে আমি ভয়ানক ভালোবাসি। তবে একটা কথা বলে রাখি ভাই, হঠাৎ কোথাও আটকা পড়ে যদি সেদিন যেতে না পারি, তবে রাগ করো না যেন।

বা রে! একখানা টিকিট নষ্ট হবে যে।

নষ্ট হবে কেন, আমার বদলে নাহয় আর কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেও।

কোথায় আবার সঙ্গী খুঁজে পাবো?

চোখে একটি ইশারা নিয়ে বিশু বললে, পাবে, পাবে। হোটেলে আশে—পাশে খুঁজলেই নতুন সঙ্গী পেয়ে যাবেখন….বুঝতে পারছো না?

পেরেছি।

হাসিমুখে রমলা যাবার জন্যে উঠে পড়ল।

হাতের মুঠোয় এসে ইন্ডিয়া অ্যাসিওরেন্সের পনেরো হাজার টাকা পিছলে বেরিয়ে গেল। আফসোসটা সেইজন্য নয়। টাকাটা যে পথে এসেছিল, সেই পথটাই পিছল। সে পথে টাকা আসেও যেমন সহজে, তেমনি বেরিয়েও যায় মহূর্তে। এই হল নিয়ম। কাজেই লালজি সেজন্য চঞ্চল হয়নি, চঞ্চল তাকে করেছে পনেরো হাজার টাকার চেক ভাঙাতে গিয়ে ফিরদৌস ইরানির যে অদ্ভুত পরিবর্তন দেখেছে, তারই চিন্তাটা।

লালজির মনে পড়ল ইরানি সাহেবের কথা : Crime does not pay, my boy! পাপের দেনা কখনো বাকি থাকে না!

নীতির কথা, ধর্মের কথা!….ফুঃ!

কিন্তু এ সব নিয়ে লালজি মাথা ঘামাচ্ছেই বা কেন? নীতি বল আর ধর্মই বল, সে সব তো বহুদিন আগে গঙ্গার জলে সে ভাসিয়ে দিয়েছে! তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে দুনিয়াদারির হাটে এ সবের দাম কানাকড়িও নয়।

সুতরাং ওসব বাজে কথা মুছে ফেলে দাও মন থেকে।

পিটার খবর পাঠিয়েছে, কিছু স্প্যানিস মদ খিদিরপুরে এসে পৌঁছবে আগামী হপ্তায়। এবারে অবশ্য মহম্মদ রশিদ যাবে না, যাবে অন্য কেউ। কিন্তু তার আগে একবার ওয়াংয়ের আড্ডায় যাওয়া দরকার। কত দর দিতে পারে জানতে হবে। না পোষালে শহরে অন্য খদ্দেরের অভাব হবে না।

ট্যাংরায় সেই কাঠের ফটকের সামনে লালজির গাড়ি এসে যখন থামল, রাত তখন বেশি হয়নি। ঝোলানো চিনে লণ্ঠনগুলির তলায় দু’একটা ঝিমন্ত থ্যাবড়া গোল মুখ যথারীতি বসে। চাপা গলার লালজি বললে, বাজপাখি।

প্রথম লোকটা ছোট ছোট চোখ মেলে একবার তাকালো শুধু। তারপর আবার ঝিমতে শুরু করলে। আশ্চর্য, লোকটা শিস দিতে ভুলে গেল নাকি? না, চণ্ডুর মাত্রাটা আজ অত্যধিক হয়েছে?

লালজি দ্বিতীয় লোকটার কাছে এগিয়ে গেল। একখানা চীনে কাগজের পৃষ্ঠা থেকে একবার মুখ তুলে লোকটা আবার মুখ নামিয়ে নিল।

কোনো সঙ্কেতের আওয়াজ এবারও হল না। লালজি রীতিমতো অবাক। চায়না টাউনে এ ব্যাপার নতুন বৈকি—তবে কি কোনো নতুন সঙ্কেত চালু হয়েছে এখানে?

লালজি একবার ট্রাউজারের পকেটে হাত দিলে। অটোমেটিকটা ঠিকই আছে। তারপর এগিয়ে চলল। বিলের ধারে সেই বাঁহাতি কাঠের বাড়ি। কিন্তু কই—কোথায় সেই শাঁকচুন্নি বুড়ি, আড্ডায় ঢোকবার আগে যে দস্তুরির কথাটা স্মরণ করিয়ে দেয়? যমরাজার কাছে দস্তুরি আদায়ের জন্যে বুড়ি মাটি নিয়েছে নাকি? না, পুলিশের দৃষ্টি পড়েছে ওয়াংয়ের আড্ডার ওপর, তাই গা ঢাকা দিয়েছে?

চায়না টাউনের চেহারাটা আজ গোলমেলে ঠেকছে!

দরজা ঠেলে লালজি ঢুকলো। কাঠের খুপরিগুলোর পাশ দিয়ে সেই চোরা গলিপথ লালজির মুখস্থই আছে। তবু গলিপথের শেষে এসে তার ধাঁধা লেগে গেল।

এ কোথায় এলো সে? কোথায় সেই জুয়ার টেবিল, সেই অ্যাংলো ছোকরার দল, বন্য বাইসনের মতো বলিষ্ঠ নিষ্ঠুর সেই ওয়াং, আর রুক্ষ পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট বনফুলের মতোই ক্রাচে ভর দিয়ে সেই ছোট্ট মিমি?

হল ভর্তি সারি সারি মশারি—ফেলা বিছানা। লালজি লক্ষ করলে, কয়েকটা বিছানার মধ্যে ছোট ছোট শিশুর দল পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। জুয়ার লম্বা টেবিলটা হলের একপাশে সরানো। তার দু’পাশে বেঞ্চির ওপর জন পনেরো কুড়ি ছেলেমেয়ের দল খেতে বসেছে। বয়স পাঁচ থেকে বারোর মধ্যে। চিনে ছাড়া আরো নানা জাত আছে।

একবার চোখ বুজে লালজি আবার তাকিয়ে দেখলো। ভুল করে বাচ্চাদের কোনো বোর্ডিং—এ এসে পড়ল নাকি? কিন্তু না, ভেতরে প্রবেশ করার আগে দরজার বাইরে ড্রাগন—আঁকা ঝোলানো লণ্ঠনটা সে তো বিশেষ লক্ষ করেই দেখেছিল! না, ভুল তার হয়নি।

কিন্তু ওয়াং কোথায়? ডাকবে নাকি একবার ওয়াংয়ের নাম ধরে?

ডাকতে হল না। পাশের একটা খুপরি থেকে ওয়াং বেরিয়ে এলো। হাতে তার প্রকাণ্ড একটা পাত্র। ছেলেমেয়েদের প্রত্যেকের গেলাসে খানিকটা করে দুধ ঢেলে দিয়ে বললে, নাও, খেয়েদেয়ে যে যার বিছানায় শুয়ে পড়। আর শুতে যাওয়ার আগে—মনে আছে তো?

আড়াল থেকে শুনলে বিশ্বাসই হোত না, ওয়াংয়ের গলা এত কোমল হ’তে পারে!

খাওয়া শেষ করে একে একে ছেলেমেয়েরা উঠে পড়ল। তারপর শুতে যাওয়ার আগে ওয়াংকে তারা একটি করে চুম্বন করে দিয়ে গেল।

সোনা বাঁধানো দাঁত বের করে ওয়াং নীরবে হাসছিল। নেকড়ের মতো শরীর—হিম—করা সেই ভয়ঙ্কর হাসি নয়। স্নেহের উত্তাপে আশ্চর্য মধুর হাসি।

অভিভূতের মতো লালজি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, এবার ডাকল, ওয়াং।

ওয়াং ফিরে তাকিয়ে সহজ গলায় বললে, এসো লালজি, বসো।

লালজি আস্তে আস্তে বেঞ্চির ওপর গিয়ে বসল। তার পাশে বসে ওয়াং হাসি মুখে বললে, অবাক হয়ে গেছো নয়?

অবাক হওয়ার কথা নয় কি?

তা বটে!

ওয়াং নীরব হয়ে রইল।

লালজি জিজ্ঞাসা করলে, জুয়ার আড্ডা একেবারে তুলে দিয়েছ নাকি?

হ্যাঁ।

এরা কারা?

আমার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেমেয়েরা।

কিন্তু এদের মধ্যে মিমিকে দেখছি না যে? সে কোথায়? ঘুমিয়েছে?

লালজি পকেট থেকে টফি বার করল।

ওয়াংয়ের মুখের হাসি নিভে এল। অত্যন্ত মৃদু গলায় বললে, মিমি নেই।

নেই! কোথায় গেছে?

স্বর্গে।

টফিগুলো হাতের মুঠোয় ধরে লালজি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছিল!

ওয়াং বললে, একদিন তাকে খুব বকেছিলাম। বড় অভিমানী মেয়ে ছিল সে, সেদিন আমার সেই কটু কথা সহ্য করতে পারেনি বোধহয়। আমাকে না বলে চুপি চুপি কখন ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল টের পাইনি। মেয়েকে খুঁজতে বড় রাস্তায় গিয়ে দেখি, তাকে তখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে। শুনলাম, রাস্তা পার হতে গিয়ে খোঁড়া মেয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারেনি। একখানা মোটর তার ওপর এসে পড়ে। হাসপাতালে পৌঁছবার আগেই সব শেষ। মেয়েকে খুঁজে পেলাম বটে, কিন্তু ঘরে আনা আর হল না!

একটু নীরব থেকে ওয়াং আবার বলতে লাগল, মিমিকে মাটি চাপা দিয়ে এসে যখন এই ঘরে ফিরলাম, তখন হঠাৎ মনে হল আমি পাগল হয়ে যাব। এত বড় শূন্য ঘরে আমার দম আটকে আসতে লাগল। মা—মরা মেয়েটা আমার জীবন কতখানি জুড়ে ছিল, আগে তা বুঝিনি। জুয়ার আড্ডা তুলে দিলাম। পথে অনাথ ছেলেমেয়ে দেখলেই কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসি। এই করে আজ একত্রিশটি ছেলেমেয়ে আমার ঘর ভরে তুলেছে। কিন্তু আরও জায়গা আছে—আরও অনেক ছেলেমেয়ের জায়গা আছে আমার এই ঘরে।

একটা মশারির ভেতর থেকে একটা কচি বাচ্চা কেঁদে উঠল।

ওয়াং বলল, বসো, আসছি।

তাড়াতাড়ি গিয়ে সে মশারির মধ্যে ঢুকল। লালজি অবাক হয়ে শুনলো গুনগুন করে ওয়াং ঘুমপাড়ানি ছড়া গাইছে।

সেই ওয়াং!

বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়ে সে আবার ফিরে এল। বললে, মিমি যায়নি, এদের মধ্যেই আছে। এদের আমি নিজের হাতে খাওয়াই, পরাই, ঘুম পাড়াই। সঙ্গে করে রোজ স্কুলে নিয়ে যাই। আর বাকি সময়টুকু চামড়ার কাজ করি। কোনো দুঃখ নেই আমার। কেন জানো? শাস্তি তো আমার হয়েই গেছে।

শাস্তি! কিসের?

পাপের। পাপের দেনা বাকি থাকে না—একদিন না একদিন মানুষকে শোধ করতেই হয়। মিমিকে হারিয়ে একথা জেনেছি।

ইরানি সাহেবও ওই কথা বলেছিল। লালজি হঠাৎ কেমন যেন অস্থির বোধ করতে লাগল। এসব কথা সে শুনতে চায় না—মানতেও চায় না। পাপ—পুণ্যের বিচার বহুদিন আগেই সে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।

হাতের টফিগুলো টেবিলের ওপর রেখে লালজি বললে, চলি ওয়াং।

মাঝে মাঝে এসো। আর কোনো অনাথ ছেলেমেয়ের সন্ধান পেলে তাকে দিয়ে যেও এখানে।

চোরা গলিপথ দিয়ে চলতে চলতে অন্ধকারে লালজি শুনতে পেল, কচি কোমল গলায় কে যেন বলছে : ‘আমায় তুমি ভুলে যাবে না লাল?’

লালজি মনে মনে বললে, তোমায় ভুলবো না মিমি।

মস্ত একটা ব্ল্যাক প্রিন্সের তোড়া হাতে নিয়ে আন্দ্রে গ্রিন রুমে প্রবেশ করল।

মেক—আপ শেষ করে জোহরা চোখের কোলে পেন্সিলের রেখা টানছিল। আরশিতে আন্দ্রেয় ছায়া দেখে হেসে বললে, রোজ ফুল কেন?

ফুলের তোড়াটা টেবিলের ওপর রেখে আন্দ্রে জবাব দিলে, পারস্য দেশের এক কবি বলেছেন, দুটি মাত্র পয়সা যদি জোটে, তাহলে একটি পয়সার খাদ্য কিনো, আর বাকি পয়সাটি দিয়ে কিনো ফুল।….আ, গ্রেট। কবির মতো কবি বটে।

তরল কণ্ঠে জোহরা বললে, তোমার কাঁধে কাব্যের ভূত চেপেছে আন্দ্রে সাহেব।

মাথা নাড়তে নাড়তে আন্দ্রে বললে, সে—কথা ঠিক। কিন্তু আজ থেকে নয়, অনেকদিন থেকেই। মাদাম, পথে আসতে আসতে দেখলাম, আকাশে চাঁদ হাসছে, আর তারাদের চোখে যাদু। চল না, খানিকটা বেড়িয়ে আসি।

আজ? নাচ রয়েছে যে।

বেশ, তবে কাল?

কাল রবিবার, কালও তো নাচ আছে।

সে তো রাত দশটায়। আমি শুধু তোমার সন্ধ্যেবেলাটা চাইছি। কাল আমরা বেরিয়ে ধরো, একটা ভালো ছবি দেখতে পারি। তারপর গঙ্গার ধারে খানিকটা বেড়িয়ে, দশটার আগেই আবার এখানে ফিরে আসা যাবে, কেমন?

গ্রিন—রুমের বাতিগুলো এই সময় বারকয়েক দপ দপ করে উঠল।

জোহরা ব্যস্ত হয়ে বললে, নাচের সময় হয়েছে। যেতে হবে।

গ্রিন—রুম থেকে বেরোবার আগে আন্দ্রে বললে, তাহলে কালকের সন্ধের প্রোগ্রাম ঠিক রইলো মাদাম?

যেতে যেতে জোহরা বলে গেল, আচ্ছা।

আন্দ্রে আস্তে আস্তে হলের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। জোহরার জিপসি নাচ তখন শুরু হয়ে গেছে।

নিজের রিজার্ভ করা টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আন্দ্রে দেখলে, তিন গেলাস ‘বিয়ার’ নিয়ে তিন ব্যক্তি পরমানন্দে টেবিলটা দখল করে বসে আছে। একজন পাঞ্জাবি ছোকরা, আর একজন স্থূলাকার বেঁটে বার্মিজ এবং তৃতীয়জন তুর্কি—ফেজ মাথায় দিয়ে বসে বসে সিল্কের রুমালে কপাল আর ঘাড় মুছছে।

আন্দ্রে সবিনয়ে বলল, মাপ করবেন, আপনাদের বোধ হয় টেবিল চিনতে ভুল হয়েছে।

আশ্চর্য! পাঞ্জাবী ছোকরাটি ইংরাজিতে মাদ্রাজি টান দিয়ে বলল, না, চিনতে ভুল আমাদের হয়নি।

সঙ্গে সঙ্গে মোটা বেঁটে বার্মিজ পরিষ্কার হিন্দিতে বলে উঠল, রামজি কসম—কোনো ভুল হয়নি।

আর ফেজ মাথায় তুর্কি মুসলমানটি সাদা বাংলায় বললে, ভুল আমাদের হতেই পারে না স্যার।

চাপা গলায় আন্দ্রে বললে, ভালো করে দেখেছেন তো মিঃ আয়ার? রাজারামবাবু, আপনিও দেখেছেন তো? কি কুঞ্জবাবু?

তিনজনেই একত্রে স্টেজের দিকে তাকাল, তারপর একই সঙ্গে তিনটি জবাব এল :

এই সেই অপর্ণা দেবী!

এই হচ্ছে রুক্মিণী!

এই তো রঞ্জনা!

এবার আন্দ্রে বললে, এখন তাহলে আপনারা যেতে পারেন।

তারা চলে যেতেই আন্দ্রে তাদের তিনটে গেলাস জলতরঙ্গের বাটির মতো পাশাপাশি সাজিয়ে নাচের সঙ্গে তাল দিতে শুরু করলে।

স্টেজের ওপর একহাতে চকচকে একখানা ছোরা, আরেক হাতে ট্যাম্বুরিন নিয়ে জিপসী জোহরা তখন মিউজিকের তালে তালে বুনো সাপিনির মতো হেলছে, দুলছে….

দু’দিন ধরে কি যেন হয়েছে লালজির।

মনের কোথায় যেন একটু বিকল হয়েছে। হঠাৎ যেন অবসাদ এসেছে দেহে—মনে। ছুটি চাই।

এই দু’দিন সে হোটেল ছেড়ে বিশেষ কোথাও বেরোয়নি। কৌচে গা এলিয়ে আলস্যভরে শুধু সিগারেটের পর সিগারেট টেনেছে। যায়নি নতুন শিকারের সন্ধানে। দেখাও করেনি জোহরার সঙ্গে। ফোনে বলে দিয়েছে, ভয়ানক ব্যস্ত।

কিন্তু কেন?

কেন, তা সে নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অথচ ভালোও লাগছে না এই নিষ্ক্রিয় জড়তা! নিজের সম্বন্ধে লালজি আজ চিন্তিত। বিরক্তও বটে।

চড়া পর্দায় সেতার বেজে চলেছিল দ্রুত লয়ে। কোথায় গিয়ে কোন সমে শেষ হবে সে জানত না। জানবার প্রয়োজনও ছিল না বিশেষ, হোক না শেষ যেখানে খুশি! কিন্তু তার আগেই আজ দু’দিন ধরে একটি তার গেছে আলগা হয়ে। বেসুর আওয়াজ দিচ্ছে।

উঠে গিয়ে লালজি জানলার পর্দা সরিয়ে দিল।

পশ্চিমে সূর্যাস্ত হচ্ছে।

দাঁড়িয়ে রইলো লালজি। সূর্যাস্ত দেখার এমন অবকাশ বহুদিন তার মেলেনি। সে শুধু দেখেছে, রাত্রি আকাশের তলায় নিশাচর জীবনের সর্পিল গতি—কফি হাউসে, ফিরদৌস ইরানির ঘরে, ওয়াংয়ের আড্ডায়।

সেই ইরানি সাহেব বদলে গেছে। বদলে গেছে ওয়াং। জীবনের অন্ধকার চোরা—পথে তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী দু’জন!…

কিন্তু গেলই বা বদলে, তাতে লালজির কি আসে—যায়? নাঃ, কিছুই আসে—যায় না। আরেক ইরানি সাহেব জুটবে, জুটে যাবে আরেক ওয়াং। লালজি তার অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সোজা পথে সঙ্গী খুঁজতে হয়, অভাব হয় না চোরা পথে।

তবু—

তবু এটা সত্যি যে, তারা বদলে গেল। কেন বদলে গেল? কে দিল তাদের বদলে? অন্ধ রুমার দুঃখ? মিমির মৃত্যুর বেদনা? না, বিবেকের নির্দয় চাবুক?

Crime does not pay! পাপের দেনা শোধ করতেই হয়!….

রাবিশ!

পোড়া সিগারেটের টুকরোটা লালজি চটির তলায় পিষে ফেলল।

না, ও সব লালজি বিশ্বাস করে না। তার কোনো দুঃখ নেই—বেদনা নেই—নেই দুর্বলচিত্ত ফিরদৌস ইরানি আর ওয়াংয়ের মতো পাপের চিন্তা, পরিণামের ভয়! আর, বিবেক? গ্রাহ্য করে না সে। ওটা চিত্তের দুর্বলতা—বয়সের লক্ষণ!

দূর করো ও—সব ভাবনা।

এখন খানিকটা জিন পেলে হতো। কপালের রগ দু’টো দপ দপ করছে।

দরজায় আওয়াজ হ’ল—টক টক টক।

শুনছেন—ও মিস্টার—ঘরে আছেন?

লালজি চকিতে ঘুরে দাঁড়াল। শীলার গলা! বললে, আসতে পারেন।

দরজা ঠেলে দ্রুতপায়ে ঢুকল শীলা। সঙ্গে সঙ্গে গত রজনীর সুখস্মৃতির মতো ফরাসি ল্যাভেন্ডারের হালকা। মিষ্টি সুগন্ধে লালজির মাথাধরা কমে গেল।

দেখুন দেখি কী মুসকিলে পড়েছি—

লালজি তৎক্ষণাৎ স্মেলিং সল্টের শিশিটা এগিয়ে দিলে।

হেসে ফেললে শীলা। বললে, না, লেডি মুখার্জ্জী আজ ভালোই আছেন।

তবে মুসকিলটা কি?

দেখুন না কাণ্ড! সকালে লেডি মুখার্জি বললেন, যাও, মেট্রো থেকে সন্ধের জন্যে দু’খানা টিকিট কিনে আনো। রোদে পুড়ে টিকিট করে আনলুম, আর এখন বলছেন কিনা ব্যারিস্টার গুহ সাহেবের আসার কথা আছে, ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি একাই যাও।….আচ্ছা, বলুন তো একা একা কখনো সিনেমা দেখা যায়?

লালজি বললে, নিশ্চয়ই না!

নিতান্ত অসহায়ের মতো শীলা বললে, এখন কী করি আমি? সকাল থেকে আশা করে বসে আছি সিনেমায় যাব, অথচ….এখন কোনো কাজ আছে নাকি আপনার?

কেন বলুন তো?

বলছিলাম বিশেষ কাজ যদি না থাকে, চলুন না ছবি দেখে আসি। টিকিট তো করাই রয়েছে। যাবেন?

হেসে লালজি বললে, দ্বিতীয়বার অনুরোধের প্রয়োজন হবে না। আমিও এইমাত্র ভাবছিলাম, যেখানে হোক কোথাও গেলে হয়।

শীলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললে, তাহলে চটপট—ছ’টা বাজতে পনেরো মিনিটও বাকি নেই—

বালিশের তলা থেকে পার্সটা পাঞ্জাবির পকেটে ফেলে লালজি বললে, চলুন—

চৌরঙ্গি। মহানগরির সেরা রাজপথ।

দিনের আলোয় শহরের হৃৎপিণ্ড এখানে স্পন্দিত হতে থাকে। সন্ধের পর বদলে যায় এর রূপ। কুহকিনী যাদুকরীর মতো বিভ্রান্ত করে দেয় পথিককে।

মেট্রো সিনেমার সামনেটা আলোয় আলোয় দিন হয়ে গেছে।

একখানা ট্যাক্সি এসে ফুটপাথের সামনে হঠাৎ থেমে গেল। ভেতরে আন্দ্রে আর জোহরা।

‘গ্রেট ওয়ালজ’!…আ, অপরূপ ছবি! কী মিউজিক! চলো মাদাম, এই ছবিটাই দেখা যাক।

সাহেব আর সুন্দরী স্ত্রীলোক দেখে দারোয়ান শশব্যস্তে গাড়ির দরজা খুলে দিল।

আন্দ্রে বললে, সিট আমার রিজার্ভ করাই আছে, ভাবনা নেই।

দু’জনে যখন হলের মধ্যে ঢুকল, তখন একখানা কার্টুন ছবি শুরু হয়ে গেছে। হল অন্ধকার।

কার্টুন ছবির পর নিউজ মুভিটোন।

মিনিট পনেরো পরে ইন্টারভ্যালের আলো জ্বলে উঠল। আন্দ্রে বললে, ‘গ্রেট ওয়ালজ’ ছবিটা আমার দেখা। কিন্তু একবার কেন, দশবার দেখলেও আমার কাছে পুরোনো হবে না মাদাম। আমেরিকায় এই ছবি চলেছিল—আরে! লালজি না?

জোহরা চকিত হয়ে উঠল।

সত্যিই লালজি! পেছন থেকে চিনতে আর যে—ই ভুল করুক, জোহরার ভুল হবে না। লালজির ছায়া দেখলে সে চিনতে পারে। তাদেরই সামনে দুটো সারি আগে বসে আছে। কিন্তু পাশে তার কে? বাসন্তী রঙের শাড়িপরা মাজা—মাজা রঙ, দীর্ঘচ্ছন্দ চেহারার কে ওই মেয়েটি তার পাশে বসে গল্প করছে?

ঠাহর করে দেখে আন্দ্রে বললে, তাই তো, লালজিই বটে! কিন্তু পাশে গার্ল ফ্রেন্ডটি কে? …ওহো, দ্যাট শীলা!

কৌতুকের একটু সূক্ষ্ম হাসি আন্দ্রের মুখে দেখা দিল : সিনেমায় হোক, হোটেলে হোক, ‘বার’—এ হোক, লালজিকে দেখতে পেলে কোনো গার্লফ্রেন্ড তার সঙ্গে থাকবেই। কিন্তু এই শীলাকে নিয়ে আজকাল একটু বাড়াবাড়ি করছে।….লালজিকে চেনো তো মাদাম?

জোহরার কাছ থেকে ছোট্ট জবাব এলো : না।

ঘাড় বাঁকিয়ে আন্দ্রে একবার তাকাল তার দিকে। কেমন যেন ভাবলেশহীন জোহরার মুখ। মর্মর পাথরের মতো মসৃণ অথচ কঠিন।

আন্দ্রে আবার বলতে লাগল, লালজিকে চেনো না? আশ্চর্য! অর্ধেক শহর ওকে চেনে। হোটেলে, ক্লাবে, ‘বার’—এ, সিনেমায়, খেলার মাঠে কে না চেনে লালজিকে? বিশেষ করে মেয়ে—মহলে সে ডার্লিং। কেনই বা হবে না বলো? চমৎকার স্বাস্থ্যবান ছেলে, অগাধ টাকা, মেজাজও ভারী শৌখিন। আর কী চাই? সুতরাং ওকে নিয়ে মেয়ে মহলে রেষারেষি তো লাগবেই! প্রকৃতির নিয়ম।

আন্দ্রে সকৌতুকে হেসে উঠল।

কিন্তু সম্প্রতি লালজির পক্ষপাতিত্ব শীলার ওপরই একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। সেদিন সিক্সটি সিক্স ক্লাবে লালজি বলছিল, শীলাকে নাকি ও ভালোবেসেছে।

জোহরার মুখের দিকে আন্দ্রে চোখ ফেরালো। পলকের জন্যে সে—মুখ আগুনের মতো রাঙা হয়ে উঠেই কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।

আন্দ্রে বলতে লাগল, লালজির মুখে কথাটা অবশ্য খুবই আশ্চর্য! কেননা, যতদূর জানি মেয়েদের নিয়ে ও বরাবর খেলাই করে এসেছে, মন দেওয়া—নেওয়ার ব্যাপারে নিজেকে কখনও জড়ায়নি। কিন্তু সেদিন ক্লাবে বললে এতদিনে সে নাকি তার রাইট গার্ল—মনের মতো সঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছে। শীলাকে লালজি নাকি শিগগিরই বিয়ে করবে।

আন্দ্রে ফিরে তাকাল। জোহরার মুখ অন্য দিকে।

লালজি—শীলার প্রেমের কথা আজকাল শহরের মুখে মুখে। শুনলাম, বিয়ের পর ওরা দুজনে কাশ্মীরে গিয়ে—

আঃ চুপ করুন! ছবি আরম্ভ হয়ে গেছে।

জোহরার কণ্ঠ যেমন নীরস তেমনি কঠিন শোনালো।

শো ভাঙবার পর বাইরের লবিতে বেরিয়ে এল আন্দ্রে আর জোহরা। জন—জটলার মাঝে জোহরার চোখ দু’টি কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ কিসে আটকে গেল তার দৃষ্টি।

কিছুটা তফাতে জনস্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চলেছে লালজি, আর তার বাহু আশ্রয় করে বাসন্তী রঙের শাড়িপরা সেই মেয়েটি—লালজির নতুন আবিষ্কার, শীলা যার নাম।

আন্দ্রে বললে, এসো মাদাম, লালজির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। নাইস চ্যাপ! খুশি হবে। এস—

জবাল এল, না।

পশ্চিম দিগন্তে ঝড়ের ভ্রূকুটি। এলিয়ে পড়েছে কালবৈশাখীর জটা। আন্দ্রে তাকিয়ে দেখলে, তারই আভাস জোহরার মুখে।

ফুটপাথের ধারে এসে দাঁড়াল খালি ট্যাক্সি। শীলার হাত ধরে উঠল লালজি। আর সঙ্গে সঙ্গে মিটার ডাউন করে বেরিয়ে গেল গাড়ি আলো ঝলমল চৌরঙ্গির বুকের ওপর দিয়ে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোহরা দেখলে। চোখ দু’টো তার জ্বালা করছে জ্বোরো রুগির মতো। কপালের রগ দুটো অসহ্য উত্তাপে যেন ফেটে পড়বে।

হোয়াইট ‘ওয়ের ঘড়িটা দেখে নিয়ে আন্দ্রে বললে, তোমার নাচের এখনো বহুৎ দেরি মাদাম। চল না একবার গ্র্যান্ডে ঘুরে যাই।

শুকনো গলায় জোহরা বললে, তুমি একাই যাও আন্দ্রে, শরীরটা আমার খারাপ লাগছে।

আন্দ্রে ব্যস্ত হয়ে উঠল, শরীর খারাপ লাগছে! তাহলে কাজ নেই আর কোথাও গিয়ে। তোমায় কফি—হাউসেই পৌঁছে দিই চল।

কফি—হাউসে পৌঁছতে আমার দেরি হবে আন্দ্রে। পথে একটু কাজ আছে।

একখানা খালি ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল জোহরা।

মুখে বিচিত্র হাসি নিয়ে পথের ধারে দাঁড়িয়ে রইল আন্দ্রে পল।

চৌরঙ্গি থেকে ট্যাক্সিখানা ময়দানের রাস্তা ধরতেই শীলা জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকাল। অর্থাৎ এদিকে কোথায়?

কুশনে হেলান দিয়ে বসে লালজি একটা সিগারেট ধরিয়েছিল আরাম করে। গম্ভীর মুখে বললে, আপনাকে নিয়ে ইলোপ করার ইচ্ছে হয়েছে।

ততোধিক গম্ভীর মুখে শীলা বললে, ও! তাই নাকি! কিন্তু শুধু একা আপনার ইচ্ছা হলেই তো হবে না, আমারও ইচ্ছে হওয়া চাই যে!

লালজি এবার হাসলে।

ভুল হল আপনার। দু’জনের ইচ্ছে হলে সেটা তো হরণ হবে না, সেটা বরণ হয়ে দাঁড়াবে। তাতে কোনো থ্রিল নেই—সুতরাং আমার আগ্রহও নেই।

আচ্ছা, ইলোপ না হয় করলেন, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবেন কোথায় শুনি?

ধরুন, মঙ্গলগ্রহে। সেখানে লাল অরণ্য—ছায়ায়—

শীলা আঁতকে উঠল।

ওরে বাবা! সঙ্গে মশারি নেই, ফ্লিট নেই, সেই জঙ্গলে থাকব কি করে? এত জায়গা থাকতে শেষে কিনা মঙ্গলগ্রহের জঙ্গলে? না মিস্টার, আপনার সঙ্গে ইলোপ করা আমার পোষাবে না।

তবে কোথায় যেতে চান বলুন? ভেনিস? মন্টিকার্লো? ক্যালিফোর্নিয়া, কাশ্মীর—

বড় জোর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

সশব্দে হেসে উঠল লালজি।

আচ্ছা, তাই সই।

লালজির কথামতো ট্যাক্সি ড্রাইভার মেমোরিয়ালের পাশে গাড়ি বাঁধল। দু’জনে নেমে এগিয়ে গেল ঝিলের ধার অবধি।

পশ্চিমে বৈশাখী মেঘের সমারোহ। এলোমেলো হাওয়ার ফুৎকারে নিভে গেছে অনেকগুলি তারার বাতি। আসন্ন ঝড়ের সম্ভাবনা। মেমোরিয়ালের আশেপাশে লোকের জটলা অনেকটা পাতলা।

বাঁ কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে লালজি ঘাসের ওপর আড় হয়ে পড়ল। তারপর শীলাকে বলল, বসুন।

উড়ন্ত আঁচল সামলে নিয়ে শীলা বসে পড়ল। বললে, এরপর সিনেমার হিরোইনদের মতো গান গাইতে বলবেন না তো?

বললেই বা আপত্তি কিসের?

নাটক আমি পছন্দ করি শুধু স্টেজে, প্রতিদিনকার জীবনে নয়।

লালজি একটা নতুন সিগারেট ধরালো। বলল, আপনার বয়স অল্প, তাই এ—কথা বলছেন। বয়স বাড়লে, অভিজ্ঞতা বাড়লে বুঝতে পারবেন, জীবনের চেয়ে বড় নাটক আর নেই। জীবনে এক একটি মুহূর্ত আসে, যা সমস্ত হিসেব—নিকেশের বাইরে। তাই নিয়েই তো স্টেজের জন্যে নাটক লেখা হয়।

সেটা স্টেজেই ভালো লাগে। তার বাইরে সেটা ন্যাকামি বলেই মনে হয়।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে লালজি বললে, আমারও তাই মনে হোত। কিন্তু নাটক আমরা মানি আর না মানি, নিয়তি বলে এক অদৃশ্য নাট্যকার আছেন, তাকে মানতেই হবে। ধরুন, আপনার—আমার আলাপটা—এও খানিকটা নাটকীয় নয় কী? আর এই নাটকের পরিণতি কোথায় সেই অদৃশ্য নাট্যকার ছাড়া আর কে বলতে পারে?

এবার শীলার কাছ থেকে কোনো জবাব এল না।

লালজির কণ্ঠ কেমন যেন উদাস। ঠিক এভাবে লালজিকে কথা কইতে আগে সে শোনেনি। কিন্তু লালজি—শীলার আলাপটা নাটকীয় নয়, নাটকীয় হয়ে দাঁড়াবে হয়তো এর পরিণতি। সে—পরিণতি কি অদৃশ্য নাট্যকার ছাড়া আর কেউ সত্যিই জানে না?

জানে বৈকি, শীলা জানে। কি আসে যায় তার, যদি সেই পরিণতি ভয়ঙ্কর বিয়োগান্ত হয়? শীলা কি জানে না, লালজি কে? সে কি জানে না লালজি একজন ভদ্রবেশী প্রতারক—সমাজের শত্রু—চারশো বিশ ধারার আসামি!

সুতরাং কি আসে যায় শীলার?

কিন্তু কিছুই কি আসে যায় না? কে যেন তার কানে কানে বলল, মিথা বলো না শীলা। আগুন নিয়ে খেলতে খেলতে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তোমার নিজের আঁচলেও আগুন ধরেছে, একথা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? অস্বীকার করতে পারো কি, লালজির জীবন—নাটকের পরিণতির সঙ্গে তোমারও হাসি—কান্না, আনন্দ—বেদনা অনেকখানি জড়িয়ে গেছে?

শীলার ভাবনা সভয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে মনে বারবার সে জপ করতে লাগল, সেন্টিমেন্টের চেয়ে কর্তব্য বড়, হৃদয়াবেগের চেয়ে বড় কর্তব্যনিষ্ঠা।

মিনিট পনেরো চুপচাপ কাটলো।

অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। তবু বৈশাখী—সন্ধ্যার ঝোড়ো আকাশের তলায় দু’জনে দু’জনের উপস্থিতি সমস্ত চেতনা দিয়ে অনুভব করছে।

একসময় লালজি কথা বললে, আচ্ছা, কী নামে আপনাকে ডাকা যায় বলুন তো?

কেন, বাপ—মা কি আমার কোনো নাম রাখেননি?

সে তো আমারও বাপ—মা রেখেছেন, কিন্তু আপনি ডাকেন কেন মিস্টার বলে?

যে—কোনো ভদ্রলোককে মিস্টার বলেই ডাকা হয়, তাই।

সে তো সকলের জন্যে। শুধু একজনের জন্যে যে নাম, আমি তার কথাই বলছি।

বেশ তো, সে—নাম তাহলে একজনই ঠিক করুন।

লালজি সোজা হয়ে উঠে বসল। শীলার দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বললে, আমি তোমাকে ডাকব মৌসুমী বলে।

শীলা আস্তে আস্তে বললে, মানে যাই হোক, নামটা অদ্ভুত বটে।

লালজি বলতে লাগল, মৌসুমী বাতাস আনে রুক্ষ মাটির বুকে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত—নবীন ফসলের আশা।

তারপর কানে কানে বলার মতো আবছা গলায় লালজি উচ্চারণ করলে, আমার জীবনে তাই তুমি মৌসুমী।

আকাশে নতুন মেঘ উঠলে তৃণে তৃণে যেমন শিহরন লাগে, তেমনি করে শীলার দেহের প্রত্যেকটি স্নায়ু শিহরিত হতে লাগল। একটু আগে কে জানতো, মেঘছায়াঘন সন্ধার আকাশের তলায় বসে পুরুষের মুখ থেকে মধুর কপোত—কূজনের মত প্রিয় নামের ডাকটি শোনার লগ্ন তার জীবনে আজই আসবে! জীবনটা সত্যিই নাটক নয় কি?

সমস্ত মনের জোর দিয়ে শীলা বার বার নিজেকে বলতে লাগল, সেন্টিমেন্টের চেয়ে কর্তব্য বড়, হৃদয়াবেগের চেয়ে বড় কর্তব্যনিষ্ঠা।

লালজি বললে, আচ্ছা মৌসুমী, পাপ—পুণ্য, স্বর্গ—নরক—এ সবে তুমি বিশ্বাস করো?

করি বৈকি। শতকরা নিরানব্বইজন বিশ্বাস করে।

পাপ কাকে বলো তোমরা?

পরের ক্ষতি করাটাই পাপ।

কিন্তু সে ক্ষতি দিয়ে যদি আরেকজনের উপকার হয়?

তবুও সেটা পাপ। তার জন্যে শাস্তি পাওয়াই উচিত।

লালজি চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, তোমার মতের সঙ্গে আমার মতো মিলল না মৌসুমী। তবু তোমার কথাই হয়তো সত্যি।

শীলা বললে, চলুন, এবার উঠি।

আরও কিছুক্ষণ বসো মৌসুমী। আজকের পর আরও অনেক সন্ধ্যা আমাদের জীবনে আসবে—কিন্তু এই সন্ধ্যাটি আর আসবে না। তুমি নিয়তি মানো মৌসুমী?

শীলা জবাব দিলে, মানি।

লালজি বললে, আজকের সব কিছুই নিয়তির চক্রান্ত—সেই অদৃশ্য নাট্যকারের খেলা! এতে তোমার—আমার কোনো হাত নেই মৌসুমী।

শীলা আবার বললে, রাত হল। এবার যাই।

আর একটু বসো।

পশ্চিমী মেঘের জটলা আরও ঘন হয়ে উঠেছে। নির্জন হয়ে এসেছে মেমোরিয়ালের চারপাশ। অন্ধকার ছায়ামূর্তির মতো দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে স্তব্ধ হয়ে। অন্ধকারে চেনা যায় না, কিন্তু জানা যায়। জানা যায় যে দুটি হৃদয় পরস্পরকে স্পর্শ করেছে।

লালজি যেন হঠাৎ স্বপ্নে কথা কয়ে উঠল : মানুষকে কতখানি ঘৃণা করো মৌসুমী?

অনেক।

আর, কতখানি ভালোবাসো?

অনেক।

যাকে ঘৃণা করা উচিত, তাকে ভালোবাসতে পারো না?

কি একটা আবেগের বাষ্প শীলার বুকের ভেতর ঠেলে উঠছিল। অন্ধকারে বোঝা গেল না তার চোখে জল কিনা। ধরা গলায় জবাব দিলে, কি হবে সে—কথা জেনে?

তারপর চঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, কিন্তু আর নয়। এবার ঝড় উঠবে।

ঝড় সত্যিই উঠলো। লালজি উঠে দাঁড়াবার আগেই বেজে উঠলো নটরাজের গুরু গুরু ডমরুধ্বনি। অন্তরীক্ষে যেন কোন উন্মাদিনী ললাটে সোনার কঙ্কন হেনে হাহাকার করে উঠলো। আর তারই কঙ্কনাতে স্বর্ণবর্ণ বিজলি শিখায় ঝলসে গেল দিকদিগন্ত।

তারপর নেমে এলো বড় বড় অশ্রুর ফোঁটার মতো বৃষ্টির ধারা।

ঝড়ে বিপর্যস্ত শীলাকে একহাতে জড়িয়ে, বৃষ্টিতে অন্ধ হয়ে হোঁচট খেতে খেতে সিক্তবাসে লালজি যখন গাড়িতে এসে উঠল, ঝড়ের তাণ্ডব তখন একটু কমে এসেছে।

গাড়ি ছেড়ে দিল।

নতুন বৃষ্টি আর ফরাসি ল্যাভেন্ডারের হালকা অথচ মিষ্টি সুগন্ধে গাড়ির ভেতরকার বাতাস মূর্ছিত হয়ে আছে যেন।

লালজি আস্তে আস্তে ডাকলে, কথা কইছো না যে মৌসুমী?

পিছনের সিটে হেলান দিয়ে শীলা ঝড়ে ছিন্নমূল পুষ্পলতার মতো শ্রান্ত অবসাদে চোখ মুদে বসেছিল। অস্পষ্ট স্বরে বললে, একটু চুপ করে থাকতে দাও আমাকে।

একখানি হাত বড় স্নেহে, বড় আদরে আর একটি হাতকে ধীরে ধীরে স্পর্শ করলে।

ঠিক সেই সময় আন্দ্রেকে পার্ক স্ট্রিট থানায় অফিসার গুপ্তের কামরায় ঢুকতে দেখা গেল।

অফিসার গুপ্ত তখন রিপোর্ট লিখছেন। বিদেশি আগন্তুক দেখে মুখ তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়েস—হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, জেন্টলম্যান?

আন্দ্রে একটু হেসে সাদা বাংলায় বললে, এক কাপ কড়া চা ফরমাস করো গুপ্ত।

মাই গড! বিশু!

রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিশু বললে, তাহলে পুলিশের চোখেও ধুলো দিতে পেরেছি, কি বলো?

বিলক্ষণ। কিন্তু এই ঝড়—বৃষ্টি মাথায় করে হঠাৎ থানায় যে?

কোটটা খুলে চেয়ারের পিঠে রেখে বিশু বললে, এসে যখন পড়েছি, তখন রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যাক।

গুপ্ত বললেন, বেশ, কিন্তু আর কিছুক্ষণ পরে ঝড় থেমে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

একখানা চেয়ারে বসে আরেকটায় আরাম করে পা তুলে দিল বিশু। বললে, ঝড় থামলেও আমাকে এখানেই থাকতে হবে আজ।

দুই চোখে কৌতূহল নিয়ে গুপ্ত প্রশ্ন করলেন, কেন বল দেখি?

আজ রাতে রমলার কাছ থেকে একটা জরুরি টেলিফোন আশা করছি। অবশ্য তার আগে তাকেই একবার ফোন করার দরকার।

বিশু রিসিভারটা তুলে নিলে।

হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে দু’হাত দিয়ে শীলা এলোমেলো ভিজে চুলগুলি যথাসম্ভব বিন্যস্ত করে নিল।

লালজি নিচু গলায় বললে, লেডি মুখার্জী যদি জিজ্ঞাসা করেন এমন চেহারা হল কেন, কি বলবে শুনি?

বাঁকা চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে শীলা নীচু গলায় বললে, বলবো, ডাকাতে ধরেছিল। তারপর লালজিকে পিছনে ফেলে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল ছ’নম্বর কামরার দিকে।

ন’নম্বর ঘরে যেতে হলে ছ’নম্বর কামরা পার হতে হয়। মৃদু শিস দিতে দিতে লালজি এগোল। যদি সে গাইতে পারত! অন্তত একটা দিনের জন্যে তার কণ্ঠে যদি সুরের বন্যা বয়ে যেতো, লালজি তাহলে প্রাণের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারতো আজ। অন্ধকার রাত্রে জীবনকে সে বহুরূপে দেখেছে, কিন্তু আজকের এই মেঘগহন রাত্রির আকাশের তলায় শীলার সঙ্গে একত্রে জীবনের যে রূপ সে প্রত্যক্ষ করেছে, তা বিচিত্র, আশ্চর্য অপরূপ!….প্রণাম তোমায় হে অদৃশ্য নাট্যকার, লালজিকে তুমি জীবনের পরমসুন্দর রূপের সন্ধান দিয়েছ বলে।

এলোমেলো ভিজে চুল, অসংযত পদক্ষেপ আর মুখে বিচিত্র হাসি নিয়ে লালজি ন’নম্বর কামরায় ঢুকল।

কিন্তু ও কে? অন্ধকার ঘরে বৃষ্টির ঝাপটা আর হু হু হাওয়া অগ্রাহ্য করে খোলা জানলার পাশে পিছন ফিরে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে?

কে?

লালজি সুইচ টিপে দিল। ভেসে গেল ঘর স্পষ্ট প্রখর আলোর বন্যায়।

আমি। জানলার পাশে মূতিটি ঘুরে দাঁড়াল।

লালজির বিস্ময়ের সীমা রইল না।

জোহরা, তুমি! হঠাৎ যে?

তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতে এসেছি!

মর্মর পাথরের মতো মসৃণ মুখ পাথরের মতোই কঠিন। দুই চোখে আগুন জ্বলছে!

বোঝাপড়া! কিসের?

কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কার সঙ্গে ছিলে?

লালজির মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল।

কৈফিয়ত চাও নাকি জোহরা?

যদি চাই, সেটা আমার দাবি লাল।

আজ তোমার কি হয়েছে বলো তো?

সে—কথা পরে। আগে বলো, কোথায় ছিলে তুমি—কে ছিল সঙ্গে?

অধিকারের বাইরে যেও না জোহরা। আমি জবাব দেবো না।

জানলার পাশ থেকে সোজা এগিয়ে এল জোহরা। দাঁড়াল লালজির মুখোমুখি। বললে, তুমি জবাব না দিলেও ক্ষতি নেই। আমি জানি, সন্ধেবেলা থেকে তুমি কার সঙ্গে বিহার করছিলে। সে তোমার নতুন প্রিয়তমা, দিল কী রানি, যাদুকরী শীলা।

জোহরা নিঃশব্দে হাসলে। ধারালো ছুরির ফলার মতো ধারালো ব্যঙ্গের হাসি।

এক মুহূর্ত লালজি স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর বললে, জানো যদি, তবে প্রশ্ন করছিলে কেন?

দেখছিলুম, কতটা লুকোচুরি তুমি খেলতে পারো।

লুকোচুরি কিসের?

তোমার প্রেমের লালজি—তোমার প্রেমের!

জোহরার চোখদুটি ধারালো ছুরির ফলার মতো আবার ঝিকমিকিয়ে উঠল।

আমি জানি, শীলার সঙ্গে তোমার প্রেমের লুকোচুরি চলছে অনেক—দিন থেকেই। সেই যেদিন হোটেলের এই কামরা থেকে শীলাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম, সেইদিন থেকেই। অথচ সেদিন তোমায় জিজ্ঞাসা করেও পরিষ্কার জবাব পাইনি। কিন্তু আজ সব পরিষ্কার হয়ে গেছে—দিনের আলোর মতো।

দুই হাত পিছন দিকে একত্র করে লালজি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জোহরা লক্ষ করলে দেখতে পেতো, তার চোয়ালের হাড় দৃঢ় রেখায় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। দুই চোখ বজ্রগর্ভ।

জোহরার দৃষ্টি সেদিকে ছিল না। বিষাক্ত হাসি ছড়িয়ে সে তখন বলে চলেছে, তারপর প্রেমিক সাজাহান, কবে শাদি করছো তোমার মমতাজকে? কবে যাচ্ছ কাশ্মীর? চাঁদনি রাতে তোমার বেগমকে বুকে নিয়ে নীল দরিয়ার জলে ভাসতে ভাসতে প্রেমের খোয়াব দেখতে কবে যাচ্ছ শুনি?

শান্ত গম্ভীর গলার অত্যন্ত ধীরে ধীরে লালজি বললে, তুমি যদি পুরুষ হ’তে জোহরা, আর একটি কথা বলবার আগেই তোমাকে আমি চাবুক মারতাম।

আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়লো জোহরা, দুই হাতে শাড়ির আঁচল বুকের ওপর থেকে সরিয়ে উন্মত্তের মতো সে বলে উঠল, বেশ, মারো—মারো চাবুক আমার বুকে, মিটে যাক আমার বুকের দরদ। একেবারে শেষ করে দাও আমাকে!…..কিন্তু তোমাকেও আমি শান্তিতে বাঁচতে দেবো না লাল। ভুলে যেও না, আমার শরীরে বিষাক্ত তাতারি খুন আছে। প্রাণ থাকতে আমি অন্য কোনো আওরাতের হাতে তোমাকে তুলে দিতে পারব না।

চকিতে টেবিলের ওপর থেকে জোহরা চায়না গ্লাসের প্রকাণ্ড ফুলদানিটা তুলে নিলে।

আমি মরবার আগে, জেনে রাখো লাল, তোমাদের দু’জনের মহব্বৎ এমনি টুকরো টুকরো করে’ দিয়ে যাবো—

ঝন ঝন শব্দে চায়না গ্লাসের ফুলদানিটা মেঝের ওপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল।

আর জানলার শার্সিতে আছড়ে পড়ল ঝড়ের হাহাকার।

জোহরার দুই কাঁধ দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে লালজি বলে উঠল, কী করছো তুমি জোহরা? থামো—চুপ করো—

চুপ আমি করবো না।

বলছি চুপ করো!

উন্মাদিনীর মতো জোহরা চিৎকার করে উঠল, না—না—না! আমাকে আর চুপ করাতে পারবে না লাল।

দাঁতে দাঁত চেপে লালজি বললে, তোমার স্পর্ধার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে জোহরা।

তোমারও নিষ্ঠুরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে লাল।

একটা ঝাঁকানি দিয়ে জোহরা লালজির হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। বলতে লাগল, কোনোদিন আমাকে তুমি ভালোবাসতে পারোনি, তা জানি। কিন্তু তাই বলে অন্য মেয়ের সঙ্গে তুমি ভালোবাসার খেলা খেলবে, আর দিনের পর দিন আমি চোখ মেলে তাই দেখবো—এ তুমি স্বপ্নেও ভেবো না লাল। আমি যা পাইনি, খোদা কসম, অপরকেও তা পেতে দেবো না—কিছুতেই না। তোমার শীলা, তোমার পেয়ারের রানির কাছে তোমার মুখোস আমি খুলে দেবো…জানিয়ে দেবো, তুমি কত বড় ঠগ, ধাপ্পাবাজ, জুয়াচোর—

তুমি কি বলছো, তুমি জানো না জোহরা!

জোহরা তবু বলে চললো, তোমার কীর্তির কথা একে একে সব বলব তাকে! বলবো, তুমি রাজারামের দোকান থেকে গহনা ঠকিয়ে নিয়েছো—

সচকিত হয়ে লালজি বলে উঠল, চুপ!

জোহরার গলা আর এক পর্দা চড়লো : আমাকে জাল অপর্ণা সাজিয়ে তুমি ফাঁকি দিয়ে ইন্সিওর কোম্পানির পনেরো হাজার টাকা মেরেছো—

জোহরা!

আমাকে দিয়ে ফন্দি করে এই সেদিন কুঞ্জ বিশ্বাসের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা আদায় করে নিয়েছো—

লালজির ডান হাতখানা সাপের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে যাছিল জোহরার নরম গলার দিকে, কিন্তু তার আগেই নিমেষে সজাগ হয়ে উঠল তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়।

দরজার বাইরে কার লঘু পদশব্দ মিলিয়ে গেল না?

লালজি হতচেতনের মতো দাঁড়িয়ে রইল এক সেকেন্ড। হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চাপা উদ্বেগের স্বরে বললে, এখানে আর এক মুহূর্তও থেকো না জোহরা। বাথরুমের পাশে মেথর যাবার ঘোরানো সিঁড়ি—এখুনি পালিয়ে যাও।

লালজির মুখের দিকে তাকিয়ে জোহরার সর্বাঙ্গ হিম হয়ে এলো।

লালজির একখানা হাত আঁকড়ে ধরে রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, তোমায় ছেড়ে আমি পালাবো না লাল।

কথা শোন জোহরা—বিপদ বাড়িয়ো না।

চাপা কান্নায় জোহরার ঠোঁট দুটি থর থর করে কেঁপে উঠল। ব্যাকুল হয়ে বললে, আসুক বিপদ, তোমায় একা ফেলে যাবো না—

আঃ জোহরা,—যাও বলছি।

জোহরাকে বাথরুমের দিকে ঠেলে দিয়ে লালজি শুধু বললে, দশটায় তোমার নাচের প্রোগ্রাম। আবার দেখা হবে।

খোলা জানালা পথে হু হু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে গেল ঝড়ের হাওয়া।

ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে জোহরা নেমে যেতেই খাটের গদির তলা থেকে কি—একটা বস্তু নিয়ে লালজি পকেটে পুরলো। তারপর দ্রুতপদে গিয়ে ঘরের দরজাটা খুলে ফেললে একটানে।

রাত দশটার পর হোটেলের করিডরে সবগুলি বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। শুধু লবির মুখে একটিমাত্র বাতি জ্বলে।

সেই আবছা অন্ধকারে এদিক—ওদিক তাকিয়ে লালজি ভাবলে, তবে কি সে ভুল করেছে? সে যা শুনেছে, তা কি পায়ের আওয়াজ নয়? ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ?

সহসা তার সমস্ত চেতনা রিমঝিম করে উঠলো, হালকা অথচ মিষ্টি একটা সুগন্ধে।

গন্ধটা ফরাসি ল্যাভেন্ডারের আর সঙ্গে সঙ্গে শিকারি কুকুর যেমন শত্রুর গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলে, করিডরের আবছা অন্ধকারে লালজিও তেমনি করে নিঃশব্দে এগোতে লাগল।

আলো—আঁধারিতে ঠিক চেনা যাচ্ছিল না মেয়েটি কে। লবির একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে মেয়েটি চাপা গলায় কথা বলছিল।

হ্যালো….পার্ক স্ট্রিট থানা?….কে, বিশুদা? হ্যাঁ, শুনুন, এখুনি আপনারা হোটেলে চলে আসুন….যত শিগগির পারেন….আমি রমলা কথা বলছি। লালজির ঘরে দু’জনেই আছে….আপনার কথামতো দরজার বাইরে থেকে সবই শুনতে পেয়েছি….কী হল? হ্যালো…হ্যালো…শুনুন…শুনছেন….

হঠাৎ পেছন থেকে কে বলে উঠল, কেউ শুনতে পাবে না।

চকিতে শীলা ঘুরে দাঁড়াল। অস্পষ্ট অন্ধকারে লালজির চোখ দু’টো হায়েনার মতো জ্বলছে।

শব্দ করে হেসে লালজি বললে, কেন বৃথা পরিশ্রম করছো শীলা দেবী—ওরফে রমলা? টেলিফোনের তার আমি কেটে দিয়েছি।

কলের পুতুলের মতোই রমলা রিসিভারটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। পিছনে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে লালজি! সিঁড়ির মুখের আলোটা তেরছাভাবে এসে পড়েছে ওর দুই চোখের ওপর। রমলা তাকিয়ে দেখলে, অন্ধকারে যেন দু’টুকরো ফসফরাস জ্বলছে!

দু’জনে দু’জনের দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। বাইরে ঝড়ের বেগ বাড়ছে।

গলায় বিষ—মাখানো ব্যঙ্গ নিয়ে লালজি বললে, বাঃ! চমৎকার তোমার অভিনয়। বাস্তবিক, আমার হাততালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। বাংলার মাতাহারি, তোমার জয় হোক!….উঁহু, এক পা নড়ো না।

চকচকে উজ্জ্বল একটা বস্তু লালজির পকেট থেকে ডান হাতে এলো।

আমার এই অটোমেটিক পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো আছে। তোমাকে যদি এখন গুলি করি, কেউ জানবে না—কেউ শুনবে না। নিঃশব্দে কাজ হয়ে যাবে।

রমলা যেন পাথর।

পিস্তলটা লালজি পকেটে পুরলে। তারপর বললে, না, গুলি এখন তোমায় করব না। তোমার আমার শেষ বোঝাপড়া এখনও বাকি। তার আগে তোমাকে মারা ঠিক হবে না।

এক পা এগিয়ে লালজি রমলার দুই কাঁধ মুঠো করে ধরলে। তারপর সাপের হিস হিস আওয়াজের মতো চাপা অথচ তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, কেন—কেন একাজ করলে? বল, কেন? কিসের লোভে?

লালজির বলিষ্ঠ হাতের শক্ত থাবার চাপে রমলার মুখ যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠল। প্রাণপণ চেষ্টায় সে জবাব দিলে, একটা জোচ্চেচার—একটা জালিয়াতকে ধরিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য।

ও! একটা জোচ্চেচার, একটা জালিয়াত!

লালজির হাতের মুঠি খসে এল রমলার কাঁধ থেকে।

কিন্তু আজকের দুনিয়ায় কে জোচ্চেচার নয়, বলতে পারো? ভাই ঠকাচ্ছে ভাইকে, ধনী ঠকাচ্ছে গরিবকে, মনিব ঠকাচ্ছে চাকরকে, ধর্মযাজক ঠকাচ্ছে ধর্মভীরুকে, দেশের মন্ত্রী ঠকাচ্ছে প্রজাসাধারণকে। তোমার কর্তব্য কি শুধু একা আমার জন্যে রমলা?

শুকনো গলায় রমলা বললে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার। সমাজের কাছে, আইনের কাছে তোমার মতো ক্রিমিনালের শাস্তি পাওয়া উচিত।

তিক্ত কণ্ঠে লালজি বলে উঠল, সমাজ! কোনো সমাজ? যে সমাজ গরিবকে অন্ন দেয় না, মানুষকে সৎপথে চলতে দেয় না, ভদ্রভাবে বেঁচে থাকবার অধিকার দেয় না, সেই সমাজের মুখ চেয়ে তুমি বলছো, এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না? চমৎকার যুক্তি!…শোন রমলা, আমার মতো ক্রিমিনাল যারা, তোমাদের সমাজকে, তোমাদের আইনকে তারা থোড়াই কেয়ার করে! কিন্তু সত্যি করে বলো তো রমলা, তোমাদের সমাজে—তোমাদের আইনে কোনো উপায়ই কি ছিল না, অসৎ পথ থেকে আমাকে সরিয়ে আনার—আমার জীবনকে ভদ্র সুন্দর করে তোলার?

রমলা স্তব্ধ।

লালজি বলে চললো, যে সমাজে শুধু শাসন আছে, স্নেহ নেই—ঘৃণা আছে, ভালোবাসা নেই—সে সমাজের কথা মুখে আনার আগে লজ্জায় তোমার মাথা হেঁট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল রমলা। আগুন ধরিয়ে দাও সে সমাজে—ছাই হয়ে যাক পুড়ে।

স্থির কণ্ঠে রমলা বললে, সমাজকে চিরদিন কঠোর হতে হয়। নইলে শৃঙ্খলা থাকে না—শান্তি থাকে না।

বন্ধ কর—বন্ধ কর তোমার ওই শান্তি আর শৃঙ্খলার ধাপ্পাবাজি! আমার চেয়েও ধাপ্পাবাজ তোমাদের সমাজ! যেখানে সততার দাম নেই, মনুষ্যত্বের দাম নেই, লাখো গরিবের জীবন নিয়ে যেখানে জুয়া খেলা হচ্ছে, সেখানে শান্তিই বা কি, আর শৃঙ্খলাই বা কিসের?

লালজির চাপা বিদ্রুপের হাসিতে ঝড়ের বাতাস যেন কেঁপে উঠল। তারপর হাসি থামিয়ে অত্যন্ত শান্ত সহজ গলায় বললে, থাক এসব কথা। আজ তোমারও সময় নেই, আমারও নেই! এখুনি পুলিশ এসে পড়বে। জীবনে ঠিক এমনি করে দু’জনে মুখোমুখি দেখা হয়তো আর হবে না। তাই আজ শুধু একটা কথাই তোমায় জিজ্ঞাসা করি, তুমি জবাব দাও, মৌসুমী।

ঝড়ে বাঁশপাতার মতোই থরথর করে কেঁপে উঠলো রমলা। যন্ত্রণাবিদ্ধ অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, ও নামে আর ডেকো না লাল—মিনতি করছি। মরে যাক—মৌসুমী মরে যাক—

ম্লান—মধুর একটু হাসির রেখা দেখা দিল লালজির ঠোঁটের প্রান্তে। মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, না। রমলারা মরে যায়—শীলারা মরে যায়, আমার মৌসুমী মরে না—কোনোদিন মরতে পারে না। কিন্তু জবাব দাও আমার প্রশ্নের। জানি, সমাজের আজ সবটাই মেকি। আমিও মেকি—তুমিও মেকি। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় ঝড়ের আকাশের তলায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পাশে সেই একটি ঘণ্টা?

বৃষ্টিসিক্ত একটা মস্ত বড় ফুলের মতোই রমলার অশ্রুধোয়া মুখখানা দুই হাতে তুলে ধরে অবরুদ্ধ আবেগে লালজি বললে, সেও কি মিথ্যে, মৌসুমী? সেও কি শুধু খেলা? এতটুকু সত্য কি ছিল না তার মধ্যে? বল মৌসুমী—জবাব তোমায় দিতেই হবে, বল—

রমলার ঠোঁট দুটি স্ফুরিত হয়ে উঠল : একথা জানতে চেয়ো না, আজও সময় হয়নি!

রমলার মুখখানা ছেড়ে দিয়ে লালজি বললে, বেশ, জানতে চাইব না। আমার প্রশ্ন চিরদিন প্রশ্নই থেকে যাক। কিন্তু আমার কথাটা জেনে রাখো মৌসুমী, ভালোবাসা কি, আমি জানতাম না। জীবনে প্রথম তুমিই আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছো, একথা বলতে কোনো লজ্জা, কোনো কুণ্ঠা আমার নেই। আমার অন্ধকার ক্রিমিনাল—জীবনে আজই সন্ধ্যায় মাত্র একটি ঘণ্টার জন্যে তুমি প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছিলে। সে প্রদীপ ঝড়ে নিভে গেল। তবু তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ মৌসুমী।….ওকি!

বাইরের রাস্তায় মোটর থামার আওয়াজ : লবির জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেই লালজির বুঝতে দেরি হল না, জিপ গাড়িতে কারা। নিমেষে অটোমেটিক পিস্তল তার পকেট থেকে আবার বেরিয়ে এল হাতের ওপর। পলকে বদলে গেল লালজির কণ্ঠস্বর। চাপা কঠিন স্বরে বললে, পেছন ফিরে দাঁড়াও রমলা—এক পাও নড়বার চেষ্টা করো না। পিস্তলে আমার হাত সহজে ফসকায় না, জেনো।

সিঁড়ির নীচ থেকে ভারী বুটের শব্দ আসছে।

কলের পুতুলের মতো পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইল রমলা। লালজি বললে, পুলিশ এলে বলো, তাদের চা খাওয়াতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত। সে ভারটা তোমায় দিয়ে গেলুম।

করিডরের আবছা অন্ধকারে লালজির মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেল।

আর সেই মুহূর্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো অফিসার গুপ্ত আর বিশু। আর জনচারেক সাদা—পোশাকে কনস্টেবল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে দাঁড়িয়ে রমলা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে বললে, লালজি পালিয়েছে।

থমকে দাঁড়িয়ে অফিসার গুপ্ত বললেন, পালিয়েছে? কেমন করে? কোন দিক দিয়ে?

তা দেখিনি। শুধু জানি, করিডরের দিকে গেছে।

কিন্তু করিডর দিয়ে তো পালাবার কোনো রাস্তা নেই?

বিশু বললে, আগে ন’নম্বর কামরাটা দেখা দরকার।

ন’নম্বর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। ঢুকতেই দেখা গেল, বাথরুমের দরজাটাও খোলা। পাশে মেথর যাতায়াতের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।

সেই দিকে তাকিয়ে অফিসার গুপ্ত বলে উঠলেন, ইস! হাতের মুঠোয় এসে দু’জনেই নাগালের বাইরে চলে গেল।

বিশুর কপালে রেখা দেখা দিল। বললে, নাগালের বাইরে হয়ত এখনও যায়নি। কিন্তু আর এক মুহূর্তও দেরি নয়—এসো গুপ্ত, এসো রমলা—

কফি—হাউসে জিপসি—নাচ শুরু হয়েছে।

জোহরার এক হাতে ট্যাম্বুরিন, আর এক হাতে চকচকে ছোরা। অর্কেষ্ট্রার তালে তালে তার সুঠাম দেহ সাপুড়িয়া বাঁশির সুরে বশ—করা বুনো সাপিনির মতো কখনও বা হেলছে, দুলছে, কখনও বা দ্রুত লয়ে ঘূর্ণির মতো ঘুরছে। আর হলের উজ্জ্বল আলোয় বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠছে তার চোখের তারা, তার হাতের ছোরা, তার ঘাগরার জরি।

কফি—হাউসে ভীড় আজ অসম্ভব রকম। উচ্ছ্বসিত তারিফের আর অন্ত নেই। মাতাল হয়ে উঠেছে সকলে নাচের নেশায়।

হঠাৎ জোহরার দৃষ্টি পড়ল দূরে। হলে এসে দাঁড়িয়েছে আন্দ্রে। আন্দ্রে আজ দেরি করে ফেলেছে। কিন্তু তার পেছনে পেছনে এসে ঢুকলো ওরা কারা? একজন পুলিশ—অফিসার, আর বাসন্তী রঙের শাড়ি—পরা দীর্ঘচ্ছন্দ চেহারার ওই মেয়েটিকেই আজ সে সিনেমায় লালজির পাশে দেখেছে না? হ্যাঁ, সে—ই—জোহরার জীবনের রাহু শীলা!

জোহরার হৃতস্পন্দন যেন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। ওরা কেন এখানে? কেন এসেছে আন্দ্রের সঙ্গে? ওরা কে?

তাল কেটে গেল জোহরার। দেখলে, আন্দ্রে তাদের সঙ্গে কি যেন কথা কইল, তারপর টেবিলের ধার দিয়ে, হলের থামের পাশ দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল তিনজনে।

ভিড়ের মধ্যে আর একজন নিঃশব্দে লক্ষ করল তাদের। সে বয় ইয়াসিন।

সাপের চোখের মতো ঝলসে উঠল জোহরার দুই চোখ। তার জ্বলন্ত দৃষ্টি তিরের মতো গিয়ে পড়ল শুধু শীলার ওপর।

শীলা এগিয়ে আসছে আন্দ্রের পাশে।

মিউজিকের লয় দ্রুত থেকে দ্রুততর হল। জিপসি জোহরা হেলছে, দুলছে—

আরও এগিয়ে এলো শীলা।

আরও দ্রুত হল মিউজিক। জিপসী জোহরা ছোরা লুফছে—

শীলা আসছে এগিয়ে।

জিপসী মেয়ের ছোরায় খেলছে বিদ্যুৎ—

হঠাৎ আন্দ্রে থেমে গিয়ে ধাক্কা দিল শীলাকে। আর সেই মুহূর্তে শীলার পাশ দিয়ে মৃত্যুর লকলকে জিহ্বার মতো চকচকে ছোরাখানা গিয়ে একটা কাঠের থামের গায়ে গিয়ে বিঁধলো।

নাচের নতুন ঢং ভেবে চিৎকার করে তারিফ জানালো জনতা।

আন্দ্রে আবার এগিয়ে যেতেই সজোরে ধাক্কা লাগল কফির ট্রে সমেত বয় ইয়াসিনের সঙ্গে। আন্দ্রে টাল সামলে নেবার আগেই থামের ওপর দিয়ে অফিসার গুপ্ত দ্রুতপায়ে এগোলেন স্টেজের দিকে।

চোখের নিমেষে পকেট থেকে একটা কাচের বাল্ব বের করে ইয়াসিন ফেলে দিল মেঝের ওপর। বিস্ফোরণের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় কুয়াশার মতো ঘন সাদা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল স্টেজের সামনেটা।

সেই ধোঁয়ার পর্দার দিকে অফিসার গুপ্ত রিভলবার তুলে ধরতেই আন্দ্রে তাঁর হাত চেপে ধরে বললে, আন্দাজে ফায়ার করে নিরীহ লোক মেরো না—এসো আমার সঙ্গে।

রুমালে নাক চেপে তিনজনে ধোঁয়ার পর্দার আড়ালে হারিয়ে গেল।

এই আকস্মিক বিপর্যয়ে হলের মধ্যে তখন প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। ভীত—সন্ত্রস্ত জনতা পালাবার অন্ধ চেষ্টায় পরস্পরকে শুধু দলিত পিষ্ট করে ফেলছে। বেরোবার পথ খোলা নেই। সারা বাড়িটা ঘেরাও করেছে পুলিশ।

কিন্তু লালজি কোথায়—এই প্রলয়—নাট্যের নায়ক যে?

ধোঁয়ার পর্দার ওধারে চলুন। রহস্য—যবনিকার অন্তরালে।

রমলার হাত ধরে টানতে টানতে, অফিসার গুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে আন্দ্রে যেখানে এসে পড়ল, সেখানে গ্রিনরুমে যাওয়ার দরজা। তার পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি।

আন্দ্রে বলল, ওপরে চল।

কিন্তু দুটো ধাপের বেশি ওঠা গেল না। তার আগেই সিঁড়ির ওপরের বাতিটা গেল নিভে আর অন্ধকারে নিঃশব্দে একটা গুলি এসে লাগল কাঠের রেলিং—এ, আর একটা এসে বিঁধল আন্দ্রের বাঁ—কাঁধে।

ফায়ার! চিৎকার করে উঠল আন্দ্রে। সঙ্গে সঙ্গে অফিসার গুপ্তের হাতের রিভলবার গর্জন করে উঠল ওপরের দিক লক্ষ করে। সিঁড়ির মাথায় উঠলে তখন দেখা যেত, জোহরার ঘরের সামনে কাঠের রেলিং—এর ধারে অন্ধকারে বন্য শ্বাপদের মতোই আত্মগোপন করে বসে আছে লালজি। হাতে অটোমেটিক পিস্তল নীচের দিকে লক্ষ্য করা। পেছনে দাঁড়িয়ে জোহরা—পাথরের মূর্তির মতো স্থির।

নীচের থেকে শোনা গেল আন্দ্রের কণ্ঠস্বর : সারেন্ডার, লালজি! আর কোনো উপায় নেই তোমার!

উত্তরে লালজির পিস্তলের মুখ থেকে আরেকবার আগুন বেরোল।

সঙ্গে সঙ্গে নীচের থেকে প্রত্যুত্তর দিলে অফিসার গুপ্তের রিভলবার। ঝনঝন শব্দে চুরমার হয়ে গেল জোহরার জানলার শার্সি!

আবার আন্দ্রের গলা শোনা গেল : এখনও সময় দিচ্ছি—সারেন্ডার!

ড্যাম ইট!—অটোমেটিকের মুখ দিয়ে আবার আগুন বেরোল। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল গুপ্তর রিভলবার।

চাপা গলায় লালজি বললে—পিস্তলে আর দুটো গুলি আছে মাত্র—এই বেলা তুমি ছাদ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করো জোহরা।

জোহরা শুধু বললে, তোমায় ছেড়ে পালাবো না।

কথা শোন জোহরা, এখনও সময় আছে।

না।

সিঁড়ির তলা থেকে একটা গুলি এসে বিঁধল কাঠের রেলিং—এ। সঙ্গে সঙ্গে অটোমেটিকের মুখেও আগুন দেখা দিল।

নীচ থেকে আন্দ্রে বললে, আর দু’মিনিট সময় দিচ্ছি লালজি—সারেন্ডার!

দাঁতে দাঁত চেপে লালজি কুৎসিত একটা গালাগালি দিল।

অফিসার গুপ্তর রিভলবার আবার গর্জন করে উঠল।

আন্দ্রে বললে, সার্জেন্ট জোনসের কাছে টর্চ আছে রমলা—শিগগির—

লালজির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছে। ক্লান্ত পশুর মতো হাঁফাতে হাঁফাতে সে বললে, আরও গুলি আনা উচিত ছিল—কুকুরগুলো যে এখানেও পিছু নেবে ভাবতে পারিনি।

নীচ থেকে আন্দ্রে আবার চিৎকার করে উঠল, শেষবার বলছি, লালজি, সারেন্ডার! ওয়ান—টু—

তিনের আগেই লালজির অটোমেটিক শেষবার আগুন উদগার করলে। তারপর বিদ্যুৎবেগে দাঁড়িয়ে উঠে, জোহরার হাত ধরে টেনে বললে, চলো—

দোতালায় সিঁড়ির মুখ পার হয়ে ছাদে যাবার রাস্তা। অন্ধকারে দু’জনে নিঃশব্দে সেদিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ টর্চের এক ঝলক আলো এসে পড়ল তাদের ওপর।

চিৎকার করে উঠল আন্দ্রে, ফায়ার!

পলাতক আসামিকে লক্ষ্য করে গুপ্তর রিভলবার গর্জে উঠল। কিন্তু তার আগেই চোখের নিমেষে লালজিকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে জোহরা।

মর্মান্তিক যন্ত্রণায় সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরে পড়ে গেল সে। টকটকে লাল তাতারি রক্তে ভিজে গেল জিপসি মেয়ের বুকের কাঁচুলি। সেইদিকে একবার তাকিয়ে, হাতের পিস্তল ফেলে লালজি বলে উঠল, স্টপ অফিসার! আমি ধরা দিচ্ছি।

তারপর হাঁটু গেড়ে বসে জোহরার মাথা নিজের বাহুর ওপর তুলে নিয়ে বললে, এ কী করলে জোহরা? কেন এমনি করে নিজেকে জখম করলে?

ধীরে ধীরে চোখ মেললো জোহরা। আস্তে আস্তে বললে, দিল তো আমার জখম হয়েই ছিল। জখমি দিল কি নতুন করে জখম হয়? কিন্তু তুমি কেন পালালে না লাল?

ধরা গলায় লালজি বললে, এতকাল তুমি বলে এসেছো, এবার আমি বলছি, তোমায় ছেড়ে পালাবো না।

পৃথিবীর বাতাস ফুরিয়ে আসছে জোহরার কাছে। প্রাণপণে নিঃশ্বাস টেনে জোহরা ডাকলে, লাল—

আরও কাছে লালজি তার মুখটা নামিয়ে আনলে। জোহরার মুখ নীল হয়ে উঠেছে যন্ত্রণায়। অতি কষ্টে দম নিয়ে, থেমে থেমে সে বললে :

কোই হামে ব্যতা দে কেয়া কসুর থা দিলকা?

লব তক তো যাম আয়া, আতেহি ম্যগর ছলকা!

(বলে দাও, আজ আমাকে বলে দাও, কি দোষ করেছিল এ হৃদয়? ওষ্ঠের প্রান্ত অবধি এসে এসে কেন ছলকে পড়ে গেল পাত্রভরা সুধা?)

লালজির মুখ আরও নেমে এল মৃত্যুপথযাত্রিনী জোহরার ওপর! তার পাণ্ডুর অধরে পরম স্নেহে দিলে চুম্বন—প্রথম ও শেষ চুম্বন!

রাত্রিশেষের ফুল ঝরে যাওয়ার আগে যে হাসি হাসে, সেই হাসিতে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল জোহরার মুখ। অস্ফুট স্বরে বললে, আলবিদা! (বিদায়)

তারপরই হঠাৎ বুজে এলো চোখ দুটি। মাথাটা হেলে পড়ল কাত হয়ে।

বাইরে হু—হু শব্দে বিলাপ করে উঠল বৈশাখী ঝড়।

অতি সন্তর্পণে লালজি জোহরাকে শুইয়ে দিল মেঝের ওপর। যেন ঘুম না ভাঙে! অতি আদরে গুছিয়ে দিল তার চুলগুলো। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে, চলুন অফিসার, আমি তৈরি।

পুলিশ—প্রহরী বেষ্টিত হয়ে চলে গেল লালজি। আর, লালজির শেষ স্মৃতি নিয়ে অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে রইল একা জোহরা।

বাইরে তখনও হাহাকার করছে উন্মাদ ঝড়। আর, বড় বড় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির অশ্রুধারা।

* * *

আসামি, তোমার কিছু বলবার আছে?

কাঠগড়ার রেলিং ধরে সোজা হয়ে দাঁড়াল লালজি। কোর্টরুমে লোকারণ্য। চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে সে বললে, আছে। কিন্তু আমার যা বক্তব্য, তা বলার আগে একটা কাহিনি বলি শুনুন। বিচারসভার কাছে এইটুকু অনুমতি আমি চাই।

মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন বিচারপতি।

লালজি শুরু করলে, আজ থেকে সাত বছর আগে তেইশ বছরের একটি যুবক তার রুগ্না মায়ের শিয়রে বসে বসে ভাবছিল, কেমন করে তার মাকে বাঁচাবে। ছেলেটির স্বাস্থ্য ছিল শক্তি ছিল, বুদ্ধি ছিল—বি—এ ডিগ্রিও ছিল, তবু কাজ জোটেনি কোথাও—জোটেনি একটাও চাকরি। বিধবা মায়ের শেষ অলঙ্কারটুকুও বিক্রি হয়ে গিয়েছিল ছেলের পড়ার খরচ চালাতে। আর যা কিছু ঘরের দামি আসবাব, তাও একে একে গেছে মায়ের অসুখে। তারপর কোঠা বাড়ি থেকে খোলার ঘর, ভদ্র—পাড়া থেকে নোংরা বস্তি। ক্রমে দিন আর চলে না। কিন্তু দিন না চলুক, মায়ের চিকিৎসা তো চালাতে হবে! যেমন করে হোক চালাতেই হবে। বিকারের ঘোরে ভুল বকছিল মা, সেই দেখে কেঁদে উঠল সাত বছরের ছোট বোনটি। দাদাকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করল ‘মা কি আর বাঁচবে না দাদা?’ বাঁচবে না? দুনিয়ার এত লোকের মা বেঁচে আছে, তাদের মা বাঁচবে না? গরিবের মায়ের বাঁচার কি অধিকার নেই? পাগলের মতো ছুটলো ছেলেটি ডাক্তারের বাড়ি। কিন্তু এলো না ডাক্তার, দিলে না ওষুধ। ভিজিটের টাকা বাকি, ওষুধের দাম বাকি, আগের সে—টাকা চুকিয়ে না দিলে, গরিবের বাড়ি রুগি দেখতে যাওয়ার সময় ডাক্তারবাবুর হবে না। সেখান থেকে গেল ছেলেটি আত্মীয়—স্বজনের বাড়ি, বন্ধু—বান্ধবের কাছে—দোরে দোরে ঘুরে ভিখিরির মতো হাত পেতে চাইল কয়েকটা টাকা। তবু কেউ দিল না। পথের কুকুরের মতো তাড়া খেয়ে খেয়ে সে এসে দাঁড়াল শিয়ালদা স্টেশনের সামনে। সারাদিন মোট বয়ে সন্ধ্যার সময় পেলো তিন টাকা সাড়ে এগারো আনা। সেই টাকায় ওষুধ কিনে সে যখন ঘরে ফিরলো, তখন ওষুধের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে মায়ের! কিন্তু দুর্ভাগ্যের শেষ এখানেই নয়। ভোর—রাত্রে মাকে দাহ করে ফিরে এসে দেখা গেল, ছোট বোনটির ভেদবমি হচ্ছে। খিদের জ্বালায় গত দু’দিনের বাসি ভাত—তরকারি খেয়েছিল সে। বড় আদরের ছিল তার বোনটি, সাত—আট ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল তার চোখের সামনেই। যাক, ভালোই হল, আর কোনো বাঁধন রইল না। বোনটিকে দাহ করে সে আর ঘরে ঢুকলো না, ঘুরে বেড়াতে লাগল রাস্তায় রাস্তায়। তখন সন্ধ্যা নেমেছে শহরের ওপরে। চৌরঙ্গি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে দেখছিল, কত আলো, কত হাসি, কত ঐশ্বর্য! সিনেমায়, হোটেলে, বড় বড় দোকানে, ধনীদের দামি মোটরে কত বিলাস, কত প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি। সেইদিন রাত্রে মহানগরির আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে মনে মনে ছেলেটি প্রতিজ্ঞা করলো, যেমন করেই হোক, বড়লোক সে হবেই। ছেলেটির নাম ছিল সুশান্ত। সুশান্ত সেদিন বুঝলো, দুনিয়ার হাটে শিক্ষার দাম নেই, সভ্যতার দাম নেই, সততারও দাম নেই। মাটির পুতুল—তাও চার আনা দামে বিকোয় গরিবের প্রাণের দাম চার পয়সাও নয়। এ দুনিয়ার নীতি মিথ্যে, ধর্ম মিথ্যে, পাপ—পুণ্যের বিচার মিথ্যে—সত্য শুধু বড়লোক হয়ে বেঁচে থাকা। একটা রাতের মধ্যেই বদলে গেল সুশান্তর জীবন—দর্শন। আর, পরের দিন থেকেই সুশান্ত মরে গিয়ে জন্মালো লালজি।

সমস্ত কোর্ট—রুম স্তব্ধ।

লালজি বলে চললো : আজকের সমাজ সততার সঙ্কীর্ণ পথের মুখে লিখে দিয়েছে—No thoroughfare! সে—পথে চলা যায় না। কিন্তু অসৎপথ চৌরঙ্গির মতোই বড়, সে—পথ সকলের জন্যেই খোলা। সেই পথেই আমার যাত্রা শুরু হল। আর, বছর খানেকের মধ্যেই ভদ্র সন্তান থেকে পুরোদস্তুর চারশো’ বিশ ধারার আসামি হয়ে গেলাম আমি। জুয়াচুরির পথে, জালিয়াতির পথে, চোরা—কারবারের পথে রাশি রাশি টাকা আসতে লাগল আমার হাতে। জুয়াচুরির ব্যবসাতে আরো সুবিধে হবে বলে দিল্লির বাঈজি—মহল্লা সবজিমণ্ডি থেকে একদিন নিয়ে এলাম জোহরা বাঈকে। কিছু কিছু লেখাপড়া শিখিয়ে তাকে চলনে—বলনে রীতিমতো কেতাদুরস্ত করে তুললাম। জোহরার সাহায্যে আমার চারশো’ বিশের কারবার ফলাও হয়ে উঠল। পুলিশ আমার নাগাল পাবে কি করে? শিক্ষিত ভদ্রসন্তান যখন জোচ্চার হয়, তখন সে সাধারণ অপরাধীর বাইরে চলে যায়। সুতরাং টাকা নামক রুপোর খেলনা নিয়ে খেলা করতে করতে পরম নিশ্চিন্তে আমার দিন কাটতে লাগল। একটা—দুটো দিন নয়, সাত—সাতটা বছর। শহরের মুখে মুখে গল্পকথার মতো রটে গেল লালজির অগাধ টাকার কথা। কিন্তু—

লালজি একবার তাকাল সেইদিকে, যেখানে জনতা ভিড় করে দাঁড়িয়ে শুনছিল।

কিন্তু বড়লোক হয়েও আমি ভুলিনি গরিবদের কথা। একটা দিনের জন্যেও মন থেকে মিলিয়ে যায়নি আমার অতীত জীবনে দারিদ্র্যের সেই চাবুকের দাগ। তাই সারাদিন জুয়াচুরি ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে আমি সন্ধান নিতাম, টাকার অভাবে কোথায় কোন গরীবের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, কোথায় কোন নিঃসম্বল রুগি বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছে, কোথায় কোন বেকার মজুরের ভুখা পেটে দানাপানি পড়েনি। রাতের অন্ধকারে ‘মোহিতমোহন’ ছদ্মনামে গোপনে টাকা পৌঁছে দিয়ে আসতাম তাদেরই ঘরে। কোনোদিন পরিচয় দিইনি, পাছে আমার অসৎ পথের টাকা আমার গরিব ভাইবোনেরা গ্রহণ না করে। অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আজ আমি ক্ষমা চাই তাদের কাছে।

জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে হরলালবাবু বিরজা দেবী, কস্তুরী, ঝমরু সর্দার, মোতিয়া এবং তাদেরই মতো আরও অনেকের চোখ গভীর কৃতজ্ঞতায় তখন সজল হয়ে উঠেছে।

লালজি বলতে লাগল, কিন্তু কে জানতো আমার এই কাহিনি শেষ পরিচ্ছেদে এসে হঠাৎ উল্টে যাবে! আমার অপরাধের স্বপক্ষে যত যুক্তি থাক না কেন, যা পাপ, তা পাপ। আজ নিয়তি আমায় শিখিয়েছে, পাপের পথ দিয়ে কখনও ভালো করা যায় না… নিজেরও না, পরেরও না। আমার দুই অসৎপথের বন্ধু বলেছিল, Crime does not pay! পাপের দেনা একদিন না একদিন মানুষকে শোধ করতেই হয়। পাপের সেই ঋণ অদ্ভুতভাবে তাদের শোধ করতে হয়েছে। ভগবান বলে যদি কেউ থাকে, এ হয়ত তারই বিচার। আমার পাপের ঋণ শোধ করতে আজ আমিও প্রস্তুত। বিচারসভার কাছে আমার শুধু এই প্রশ্ন—কয়েকজন মাত্র ধনীকে ঠকাবার অপরাধে যদি আমার বিচার হয়, তবে দেশের যে সুধনী—সম্প্রদায় দিনের পর দিন লক্ষ লক্ষ গরিবকে ঠকাচ্ছে, তাদের বিচার নেবে কবে? কে করবে তাদের বিচার?

লালজির কথা শেষ হল। তার শেষ প্রশ্নের কথাগুলি স্তব্ধ কোর্ট—রুমের দেওয়ালে দেওয়ালে আঘাত করে ফিরতে লাগল।

ধীর—গম্ভীর স্বরে জজ রায় উচ্চারণ করলেন।

পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড!

হাসিমুখে দণ্ড গ্রহণ করল লালজি। তারপর কাঠগড়া থেকে নেমে পুলিশ—পাহারায় সঙ্গে কোর্ট রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে অপেক্ষা করছিল কয়েদিগাড়ি। আর অপেক্ষা করছিল রমলা। গাড়িতে ওঠবার আগে লালজির কাছে এগিয়ে গেল সে। অশ্রুপ্লাবিত দুই চোখ তুলে বলবে, আমি অপেক্ষা করে থাকব।

স্মিতমুখে লালজি হাসলে। বুক—ভরা নিঃশ্বাস নিয়ে শুধু বললে, চমৎকার তোমার এই ফরাসি ল্যাভেন্ডারের গন্ধটা!

তারপর গাড়িতে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *