বহুযুগের ওপার হতে
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দস্তগীর কমিটির প্রথম প্রতিবেদন কোনো দিন আলোর মুখ দেখবে না। শোনা যায়, ৭০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি এত অসংলগ্ন ছিল, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ঘরভর্তি লোকজনের সামনে সেটি টেবিল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। নতুন করে প্রস্তুত করা দ্বিতীয় প্রতিবেদন ১৩ দিন পর ঢাকায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেই প্রতিবেদন। ৩৬ পৃষ্ঠায় নামিয়ে আনা হয়েছিল। তাতে তদন্ত কমিটির নেওয়া কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ও ভাষ্য হেঁটে ফেলে দেওয়া হয়। প্রথম প্রতিবেদনে ছিল, অথচ দ্বিতীয় প্রতিবেদনে স্থান পায়নি, এমন কয়েকজনের ভাষ্যের কিছু অংশ ও দুটি সাক্ষাৎকার এখানে তুলে ধরা হলো।
ভাষ্য ১
ফজলে ইকরাম চৌধুরী, সভাপতি
বাংলাদেশ মাস্টার স্টিভিভোরস অ্যাসোসিয়েশন
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আমি বন্দরের ৩ নম্বর কন্টেইনার জেটিতে গ্যান্ট্রি ক্রেন অপারেটর শামস মেহেদির সঙ্গে অলস গল্প করছিলাম। শামস মেহেদি আমাদের সাতক্ষীরা এলাকার ছেলে। আমার দেশি ভাই। বিএল কলেজের ছাত্র ছিল। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের ব্যাপারে আমি ঘটকালি করছিলাম। শামস মেহেদি ক্রেনের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। এ সময় মাঝেমধ্যে তার পকেটে রাখা ওয়াকিটকি বেজে উঠছিল। তাতে আমাদের গল্পে বিঘ্ন ঘটছিল না। কেননা কেউ আমরা সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছিলাম না।
গল্পের একপর্যায়ে শামস মেহেদির ওয়াকিটকিতে ভিটিএমআইএস রুমের মহসীন মোস্তফার কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে। মহসীন বন্দরের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন। ঘূর্ণিঝড়সংক্রান্ত সতর্কবার্তা! বন্দরের জন্য অ্যালার্ট নম্বর ৪। বন্দরের বিপদসংকেতের মাপকাঠি আলাদা। এখানে চার নম্বর অ্যালার্ট মানেই মহাবিপদ সংকেত। এর চেয়ে খারাপ কিছু ঘটতে পারে না। ঘোষণা শুনে আমাদের ভ্রু কুঁচকে গিয়েছিল। আমি আর শামস মেহেদি অবাক হয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
এ রকম আঁতকা আকাশ থেকে ঘূর্ণিঝড় পড়ে নাকি? দুপুরের দিকে আবহাওয়া দপ্তর থেকে একটা ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্কসংকেত ঝুলিয়ে রাখা ছিল বটে, বন্দরের জন্য কোনো আলাদা সতর্কতাই ছিল না। কারণ সেপ্টেম্বরে সমুদ্রে এ রকম লঘুচাপ সপ্তাহে দু-তিনটা থাকেই। সেগুলো বিশেষ ধর্তব্যের নয়।
বলা নেই কওয়া নেই, এক লাফে অ্যালার্ট ফোর? মহসীনের কি মাথাটাথা খারাপ হলো নাকি!
ভাষ্য ২
মহসীন মোস্তফা, রেডিও কন্ট্রোল অপারেটর
চট্টগ্রাম বন্দর
২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আমার ডিউটি তখন শেষের দিকে। উঠব উঠব করছি। লুবনা ম্যাডামের গাড়িতে আজ লিফট পাওয়া যাবে। কিন্তু শর্ত, সময়মতো বের হতে হবে। আমি টিফিন ক্যারিয়ার গোছাচ্ছি, এমন সময় আবহাওয়া অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিস থেকে কামরুল মোল্লা ল্যান্ডফোনে আমাকে ফোন করেন। আমার হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ার পড়ে যাওয়ার অবস্থা। ঠিক শুনছি তো? কামরুল আমাকে বলছেন, ৬ নম্বর বিপদসংকেত নদীবন্দরে। এখন, নদীবন্দর আর মাছ ধরার জাহাজের জন্য যেটা ৬ নম্বর বিপদ সংকেত, সমুদ্র বন্দরের জন্য সেটা অ্যালার্ট ৩। এর ওপর এক ধাপ উঠলেই অ্যালার্ট ৪।
আমি আমাদের ফ্লোর ইনচার্জ হার্বার মাস্টার আমিনুল ইসলামের টেবিলে ছুটে যাই। আমিনুল ইসলাম আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঢাকায় আবহাওয়া দপ্তরের কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। ক্রস চেক। তারপর আমাকে বললেন, মহসীন, ঘোষণা দাও। অ্যালার্ট ৩।
লুবনা ম্যাডামের গাড়ির ড্রাইভার আমার মোবাইলে বারবার ফোন দিচ্ছিল। তাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আমার টেবিলে মাইক্রোফোনের বাটন অন করি। ঘোষণা দিতে যাব, এই সময় আমার টেবিলের ল্যান্ডফোন বেজে ওঠে। আবহাওয়া অফিসের কামরুল আবার ফোন দিয়েছে। বলল, মহসীন ভাই, স্টপ। ভুল হইছে। ৬ নম্বর নয়, ৭ নম্বর মহাবিপদসংকেত।
তার মানে বন্দরের জন্য অ্যালার্ট ৪ ঘোষণা করা ছাড়া আর উপায় নেই।
আমি ইংরেজিতে বললাম, হোলি শিট!
ঘোষণা দেওয়ার সময় বুঝতে পারছিলাম, আমার গলা কাঁপছে।
ভাষ্য ৩
মনজুর আকন্দ, থার্ড অফিসার, গ্লাডিয়েটর
সাগরে ২৩ দিনের মাছ ধরার সর্টি শেষে আমরা বন্দরে ফিরছি। আমাদের গ্লাডিয়েটর একটা মিড ওয়াটার ফিশিং ট্রলার। এবার ২৩ দিন অনেক রিবন ফিশ আর পমফ্রেট ধরা পড়েছে। প্রচুর দাতিনা মাছও পেয়েছি। অল্প কিছু লবস্টার। ফ্রিজিং করে সেগুলো খোলে ভরে রাখা হয়েছে। ২৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বহির্নোঙরের আলফা অ্যাংকরেজ এলাকা পেরিয়ে আমরা কর্ণফুলীর এসচয়ারিতে ঢুকছি। আমাদের ডানে ‘সেইন্ট ভ্যালিয়েন্ট’ নামে সিঙ্গাপুরের একটি মাদার ভেসেল। যাওয়ার সময় এটাকে দেখে গিয়েছিলাম। ২৩ দিন ধরে পণ্য নিয়ে এটা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বন্দরের কাজের গতির নমুনা।
ব্রিজ রুমে রেডিও বার্তা আসছে। অপারেটরের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। অ্যালার্ট ফোর। রেডিওর শর্ট ওয়েভ স্টেশন থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর থেকে সাড়ে চার শ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে, যেটার পরিধির বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ কিলোমিটারের বেশি। একটা বিশাল চাকা যেন বন বন করে ঘুরছে। আমি ব্রিজরুমে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাগরের পানি পুকুরের মতো শান্ত। ঝড়ের কোনো চিহ্ন কোথাও নেই। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে গেছে। পুরো সাগর লাল হয়ে আছে।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, সমুদ্র আজ একটু যেন বেশিই লাল। এত লাল আগে দেখিনি।
ভাষ্য ৪
নাথানেল সেভেন্তো, ক্যাপ্টেন, এল এসপেকতাদোর
ব্রাজিল থেকে তিন হাজার টন গম নিয়ে এসেছিল আমাদের জাহাজ এল এসপেকতাদোর। ১৫ দিন আউটার অ্যাংকরেজ চার্লিতে অপেক্ষা করার পর আমরা বন্দরে প্রবেশ করার অনুমতি পাই। আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করেছিলাম। কেননা চট্টগ্রাম বন্দরের কাজের গতি আমাদের অজানা নয়। নতুন জেটিতে আমাদের পণ্য খালাস শুরু হয়েছিল সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ মধ্যরাতে। কিন্তু ২৯ তারিখ সন্ধ্যার আগে আগে ৩০ শতাংশ পণ্য খালাস বাকি থাকতেই আমাদের দ্রুত বন্দর ত্যাগ করতে বলা হয়। আমরা অবাক হইনি। কেননা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ম্যাটেরিওলজি ডিপার্টমেন্ট থেকেও আমাদের ঝড়ের সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল। বে অব বেঙ্গলের সমুদ্র কতটা আনপ্রেডিকটেবল, আমাদের ধারণা আছে। কিন্তু এ রকম আকস্মিক ঝড়ের কথা আমি কোনো দিন শুনিনি। আমাদের ক্রুদের অনেকেই চট্টগ্রাম শহরে গিয়েছিল বাজারসদাই করতে। তাদের জরুরি তলব করে দ্রুত নোঙর তুলে আমরা আউটার অ্যাংকরেজ চার্লিতে ফিরে আসি। ভোলা সাগরের বুকে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করতে থাকি ঝড়ের। এইটাই নিয়ম। ঝড়ের সময় জাহাজ বন্দরে রাখা হয় না। গভীর সমুদ্রে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, যাতে বন্দরের জেটির সঙ্গে ধাক্কা না লাগে।
ভোর চারটার দিকে ঝড় আঘাত হানে বন্দরে। ২২ বছরের নাবিক জীবনে আমি সমুদ্রে বহু ঝড় দেখেছি। কিন্তু এবার যা দেখলাম, আমার পক্ষে বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়।
আমাদের জাহাজের ক্যাডেট ইঞ্জিনিয়ার এডওয়ার্ড গ্রিনভিল শিক্ষানবিশ। ল্যাঙ্কাশায়ারে বাড়ি। ব্রিস্টলে কোনো একটা নৌবিদ্যার কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়েছে। ঝড়ের তাণ্ডব দেখে কেবিনে বসে ছেলেটা সারা রাত ধরে কান্নাকাটি করল। যিশুর নাম ধরে ডাকাডাকি।
হার্বার মাস্টার আমিনুল ইসলামের সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন: ঝড় কখন আঘাত হেনেছিল?
আমিনুল: ভোর চারটার পর। আজানের আগে আগে।
প্রশ্ন: আপনারা পোর্ট পুরোপুরি ক্লিয়ার করেছিলেন?
আমিনুল: মোটামুটি। সাতটা কনটেইনার জাহাজ ছিল। তাদের সবাইকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে বন্দর ছেড়ে যেতে বলি আমরা। যেসব জাহাজের ড্রাফট বা তলার গভীরতা সাড়ে ৯ মিটারের বেশি, সেগুলো বন্দরে এমনিতেই ঢুকতে পারে না। কার্গো ভেসেলগুলো এর কম ড্রাফটের হয়। বাল্ক কার্গোগুলো বেশি ড্রাফটের। সেগুলো আউটার অ্যাংকরেজে থাকে। মানে। বন্দরের নিকটবর্তী খোলা সমুদ্রে। ঝড়ের সময় সবাইকে খোলা সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন : এটুকু আমরা জানি।
আমিনুল : বলে রাখছি, যাতে আমাদের ভুল না বোঝেন।
প্রশ্ন : এই ঝড়ের ব্যাপারে অস্বাভাবিক কিছু কি আপনাদের চোখে পড়েছে?
আমিনুল : না তো।
প্রশ্ন: আপনারা অ্যালার্ট ওয়ানে না গিয়ে সন্ধ্যায় কেন সরাসরি অ্যালার্ট ফোরে চলে গেলেন?
আমিনুল : কারণ ঝড়টা খুব কাছে চলে এসেছিল।
প্রশ্ন : হঠাৎ?
আমিনুল : হঠাৎ।
প্রশ্ন : কোথায় শুরু হয়েছিল ঝড়টা?
আমিনুল : সেটা আবহাওয়া দপ্তর বলতে পারবে। আমরা কী করে বলব?
প্রশ্ন : ঝড়ের পর কী হয়েছিল?
আমিনুল: ঝড়ের পর সব শান্ত। কোনো ডিসট্রেস কল আসেনি। কোনো এসওএস বার্তা নেই। ভোরবেলা বন্দরের একটা টহল দল টাগ বোট নিয়ে আউটার অ্যাংকরেজগুলো ইন্সপেকশন করে এসেছে।
প্রশ্ন : সেখানে তারা অস্বাভাবিক কিছু পায়নি?
আমিনুল : সব জাহাজ অক্ষত ছিল। কোনো জাহাজ বিপাকে পড়েনি।
প্রশ্ন : আমরা আবার প্রশ্ন করছি। টহল দল কি অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পেয়েছে?
আমিনুল : পেয়েছে।
প্রশ্ন : কী সেটা?
আমিনুল: তারা ওয়াকিটকিতে যা জানাচ্ছিল, আমরা সেটার কোনো মানে বুঝতে পারছিলাম না।
প্রশ্ন: কোথায়?
আমিনুল: ব্রাভো আর চার্লির মাঝামাঝি আউটার। অ্যাংকরেজে উন্মুক্ত সমুদ্রের একটা অঞ্চলকে আমরা বলি আলফা, একটাকে বলি ব্রাভো। আরেকটাকে বলা হয় চার্লি।
প্রশ্ন: জানি। সেখানে কী দেখতে পেয়েছে তারা?
আমিনুল: আপনারা তো সেটা জানেন। আমাকে প্রশ্ন করছেন। কেন?
প্রশ্ন : বটে, বটে। তা, শুনে আপনারা কী করলেন?
আমিনুল: আমরা তাদের ফিরে আসতে বলি। দ্বিতীয় আরেকটা দল পাঠাই আমরা সকাল ১০টার দিকে। এটায় ইন্সপেকশন বিভাগের প্রধান রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি ছিলেন।
প্রশ্ন: তিনি কী দেখলেন?
আমিনুল: তিনিও একই জিনিস দেখেছেন।
প্রশ্ন: ওটা তখনো ওখানেই ছিল?
আমিনুল: ছিল। একই জায়গায়। একইভাবে।
প্রশ্ন: এবার শুধু রেকর্ড রাখার খাতিরে আপনি কিছু জিনিস বলুন। আমরা জানি কি জানি না, সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমরা প্রশ্ন করব, আপনি সরাসরি জবাব দেবেন।
আমিনুল: ঠিক আছে।
প্রশ্ন : রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি কী দেখতে পেয়েছিলেন?
আমিনুল : তিনি সমুদ্রের পানিতে একটা বিশাল জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। বিশাল। আর অচেনা।
ভাষ্য ৫
রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি, সিনিয়র নেভাল ইন্সপেক্টর
চট্টগ্রাম বন্দর
প্রথম অবস্থায় বুঝতে পারছিলাম না, জিনিসটা কী।
ঝড়ের পর সমুদ্র ঝকঝকে পরিষ্কার আর অস্বাভাবিক শান্ত। কিন্তু আলফা আর চার্লির মাঝখানে এই জায়গাটা কেমন ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়া। অস্বাভাবিক সেই কুয়াশার ভেতরে আমাদের ছোট্ট টাগ বোটটা যখন ঢুকল, মনে হলো একটা প্রাচীন গুহায় ঢুকছি। হুট করে বাতাসটা ঠান্ডা হয়ে গেল। তাপমাত্রা যেন ধপ করে নেমে গেল কয়েক ডিগ্রি।
আমরা সামনে তাকিয়ে আছি। খুব বেশি দূর দৃষ্টি চলে। এ কারণে বুঝতেই পারিনি একটা জাহাজের খোলের কয়েক হাতের মধ্যে চলে গিয়েছি। আরেকটু হলে আমাদের টাগ বোট ধাক্কা খেত খোলের গায়ে। জাহাজটা এতো বড়, হঠাৎ মনে হলো, কুয়াশার মধ্যে একটা কালো ছায়া যেন আমাদের গ্রাস করতে আসছে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাডার সেকশনের মঈনুদ্দীন মাহমুদ। তিনি আমার জামার আস্তিন খামচে ধরলেন। আর তখন সব কুয়াশা কেটে গিয়ে সামনে ভেসে উঠল পুরো জাহাজটা।
এ রকম জাহাজ আমি জীবনে কখনো দেখিনি। না, ঠিক বলছি না। দেখেছি। বইপত্রে, সিনেমায়। কাঠের একটা সুবিশাল গ্যালিয়ন বা পাল তোলা জাহাজ। চার কি পাঁচ শ বছর আগে এ রকম জাহাজে চেপে বণিক আর অভিযাত্রীরা বেরিয়ে পড়তেন। নতুন মহাদেশ আর সমুদ্রপথ আবিষ্কারে।
এ জাহাজ কবে জাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে। এটা এখানে এল কী করে?
ভাষ্য ৬
মঈনুদ্দীন মাহমুদ, অপারেটর, রাডার সেকশন
জাহাজটাকে ঘিরে বেশ কয়েকবার চক্কর দিল আমাদের টাগ। বোট। আমরা বেশ কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করলাম : ‘কেউ কি আছেন? সাড়া দিন।
জাহাজের গায়ে ধাক্কা লেগে প্রতিধ্বনি উঠতে লাগল। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
মৃদু ঢেউয়ে জাহাজটা ধীর গতিতে দুলছে। আর অদ্ভুত একটা কটকট আওয়াজ উঠছে, গা ছমছম করা।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, জাহাজের ডেকে উঠতে হবে। কিন্তু ডেক এত উঁচুতে, ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না।
অনেক কষ্টে পেছনে দড়ির মই ছুঁড়ে অবশেষে দুপুরের দিকে ডেকে উঠতে পারলাম আমরা দুজন। আমি আর রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি।
পুরো জাহাজে একটা লোকও নেই। পরিত্যক্ত।
ভাষ্য ৭
রশীদুদ্দীন পাটোয়ারি, সিনিয়র নেভাল ইন্সপেক্টর
চট্টগ্রাম বন্দর
আমরা যেন বর্তমান ছেড়ে পুরোনো একটা যুগে প্রবেশ করেছি। চার মাস্তুলবিশিষ্ট বিশাল এক গ্যালিয়ন। এখন পাল গুটিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা গোটানো পাল আর দড়িদড়ার ওপর দিয়ে হাঁটলাম। ডেক, কোয়ার্টার ডেক, ব্রিজ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আমাদের মনে হচ্ছিল, জাহাজটাকে কিছুতেই পরিত্যক্ত বলার জো নেই। একটু আগেও যেন এখানে লোকজন ছিল। পুরো জাহাজ ক্রু আর খালাসিতে গিজগিজ করেছে। তাদের সবার কর্মব্যস্ততার ছাপ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কাপ্তানের কক্ষে কাঠের টেবিলে পুরোনো মানচিত্র আর কম্পাস এমনভাবে ছড়িয়ে রাখা, যেন একটু আগেও কাপ্তান এখানে কাজ করছিলেন। খালাসিদের বিছানাগুলো এখনো উষ্ণ। যেন এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে গেছে। এমনকি কিচেনে ঢুকে দেখি, তরকারি আর মাংস কুটে রাখা হয়েছে। সেলারে ওয়াইনের পিপায় ওয়াইন ভরা। কোনো এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে সবাই যেন তড়িঘড়ি জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে। অথবা আমাদের ডেকে উঠতে দেখে অদৃশ্য হয়ে গেছে সবাই। লুকিয়ে আছে জাহাজেরই কোথাও। পুরো ব্যাপারটা এমন বেখাপ্পা, আমরা মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিলাম না। যেন বহুকাল আগে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া এক জাহাজ ঝড়ের ঘুর্ণিতে পড়ে এত বছর পর উঠে এসেছে। কিন্তু সবকিছু এত পরিপাটি আর উষ্ণ থাকে কী করে?
জাহাজের খোলে কাঠের ওপর খোদাই করা নাম অনেক কষ্টে উদ্ধার করতে পারলাম ‘সান্তা কাতারিনা দো মন্তে সিনাই’।
বড় অদ্ভুত নাম। কাপ্তানের কক্ষেও কাগজপত্রে এই নাম পেয়েছি। পরে খোঁজখবর করে জেনেছি, পর্তুগিজ আর্মাদাদের বহরে এ রকম নামধাম একসময় দেখা যেত। বিশেষ করে মসলা আর মসলিনের বাণিজ্যের জন্য এ অঞ্চলে যেসব সওদাগরি জাহাজ আসত, সেগুলোর কোনো কোনোটায় এই তরিকার নামের দেখা মিলত। আমাকে এইসব পরে জানিয়েছেন শৈলেনদা, মানে শৈলেন ব্যানার্জি, আমাদের নেভাল একাডেমির সাবেক অধ্যাপক।
আবহাওয়াবিদ শাকিল আব্বাসের সাক্ষাৎকার
প্রশ্ন আমরা শুধু দুটি প্রশ্ন করব আপনাকে। আপনি ঠিক ঠিক জবাব দেবেন।
আবহাওয়াবিদ করুন।
প্রশ্ন কোনো লঘুচাপ সৃষ্টি না হয়ে, কোনো রকম মধ্যবর্তী দশা না পেরিয়ে শূন্য থেকে সমুদ্রে একটা পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে পারে?
আবহাওয়াবিদ পারে।
প্রশ্ন : কীভাবে?
আবহাওয়াবিদ: পৃথিবীর মাথা খারাপ হয়ে গেলে।
প্রশ্ন: এই ঘূর্ণিঝড়ের একটা অস্বাভাবিক দিক নিয়ে আপনি এর আগে পত্রপত্রিকায় একটি মন্তব্য করেছেন, আমাদের কানে এসেছে।
আবহাওয়াবিদ: কী সেটা?
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, এই ঘূর্ণিঝড়টির বাতাস উল্টো দিকে ঘুরছিল।
আবহাওয়াবিদ : বলেছি।
প্রশ্ন : আপনি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?
আবহাওয়াবিদ : পৃথিবীর আবর্তনের কারণে উত্তর গোলার্ধে যত সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়, সেগুলোর বাতাস ঘোরে ক্লকওয়াইজ, মানে ঘড়ির কাটার দিকে। আর দক্ষিণ গোলার্ধের ঘূর্ণিঝড়গুলো ঘোরে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ, মানে ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে। কিন্তু উত্তর গোলার্ধে হওয়া সত্ত্বেও এই ঝড়টির। বাতাস ঘুরছিল অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ।
প্রশ্ন : এটা কি সম্ভব?
আবহাওয়াবিদ : সম্ভব।
প্রশ্ন: কীভাবে?
আবহাওয়াবিদ: পৃথিবীর মাথা খারাপ হয়ে গেলে।