বহুবচন
একের পরে দুই। কিন্তু বচনে একের পরেই বহু। একলা থাকতে পারি আমি। তাহলে শুধু আমি; –একা, একলা, একজন। আমি একবচন। আমার সাথে থাকতে পারে অন্য কেউ; সে অথবা তুমি। বা সে আর তুমি। তখন সে তুমি আর আমি মিলে হয়ে উঠি আমরা। তুমি আর আমি মিলেও আমরা। সে আর আমি মিলেও আমরা। বহুবচন। একটি পাখি আকাশে। পাখিটি একবচন। দুটি বা অনেক পাখি আকাশে। তখন বলি, ‘পাখি দুটি’, বা ‘পাখিরা’। বহুবচন। একটি, একজন হ’লে একবচন। একের বেশি হ’লেই বহুবচন।
পৃথিবীর সব ভাষায়ই বিশেষ্য ও সর্বনাম শব্দের একবচন ও বহুবচনের রূপে পার্থক্য আছে। একবচনে শব্দটি এক রকম; বহুবচনে অন্য রকম। সাধারণত একবচনের রূপের সাথে নানা কিছু যোগ ক’রে তৈরি করা হয় শব্দের বহুবচনের রূপ। বাঙলায় ‘রা’, ‘এরা’ যোগ করলে শব্দ বহুবচন হয়। ‘ছেলে’ একবচন। ‘ছেলেরা’ বহুবচন। ‘লেখক’ একবচন। ‘লেখকেরা’ বহুবচন। অনেক সময় যোগ করি ‘গুলো’। ‘পাখি’ একবচন। ‘পাখিগুলো’ বহুবচন। আছে আরো কয়েকটি বহুবচনের চিহ্ন : ‘দল’, ‘গণ’, ‘বৃন্দ’, ‘সমূ হ’ প্রভৃতি। বলতে পারি ‘ছাত্রদল’, ‘শিক্ষকগণ’, ‘অতিথিবৃন্দ’, ‘পুস্তকসমূ হ’। এগুলো বহুবচন। আরো আছে সংখ্যা আর সমষ্টিবাচক শব্দ : ‘দুই’, ‘তিন’; এবং ‘অনেক’,’বহু’, ‘সব’ প্রভৃতি শব্দ। ‘দুটি ছেলে’, ‘অনেক মেয়ে’, ‘বহু মানুষ’, ‘সব পাখি’ বহুবচন।
এগারো শো বছর ধ’রে তো একই রকমে বহুবচন প্রকাশ করতে পারে না একটি ভাষা। বাঙলা ভাষার যখন জন্ম হয়েছিলো তখনি এর সব রকম বিকাশ ঘটে যায় নি। যেমন ঘটে নি বহুবচনের রূপে। এখন এক রকম বহুবচন শব্দ গঠিত হয় শব্দের রূপ বদল ক’রে। “চর্যাপদ”-এর কালে রূপ বদলের ব্যাপারটি শুরু হয় নি। তখন শব্দটি ঠিকই থাকতো, আর তার আগে বা পরে অন্য শব্দ বসিয়ে বহুত্ব বোঝানো হতো। ‘লোঅ’ (লোক ) শব্দটি শব্দের পরে বসিয়ে বহুবচন বানানো হতো কখনো। যেমন : ‘পারগামিলোঅ’ (পারগামীরা), ‘বিদুজণলোঅ’(বিদ্বজ্জনেরা), ‘তুমহে লোঅ’ (তোমরা)। কখনো সমষ্টিবাচক শব্দ দিয়ে বোঝানো হতো বহুত্ব। “চর্যাপদ”-এ পাই ‘সকল সমাহিঅ’ (সকল সমাধা করা হলো),’সঅল সহাবে’ (সকল স্বভাবে), ‘ণাণা তরুবর’ (নানা গাছ)। সংখ্যা শব্দ দিয়েও বোঝানো হতো বহুত্ব। যেমন : ‘বতিস জোইণী’ (বত্রিশ যোগিনী), ‘চউষষ্ঠী পাখুড়ী’ (চৌষট্টি পাপড়ি)। শব্দ দুবার ব্যবহার ক’রেও বহুত্ব বোঝানো হতো। যেমন : ‘উঞ্চা উঞ্চা পাবত’ (উঁচু উঁচু পর্বত), —জে জে আইলা’ (যে যে এলো)। এ-নিয়মগুলো বাঙলায় এখনো আছে।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এও এভাবেই প্রকাশ করা হয় বহুবচন। আর এ- কাব্যেই জন্ম নেয় বাঙলা ভাষার বিখ্যাত বহুবচন চিহ্ন ‘রা’। সমষ্টিবাচক ‘সব’ দিয়ে বারবার বহুবচন প্রকাশ করা হয়েছে এ-কাব্যে। পাওয়া যায় ‘তোহ্মে সব’ (তোমরা), ‘সব দেব’, ‘সব পসার’, ‘সব গুআ পানে’। ‘যত’, ‘নানা’ প্রভৃতি দিয়েও প্রকাশ করা হয়েছে বহুত্ব। এ-কাব্যে পাই ‘যত নানা ফুল পান করপুর সব পেলাইল পাএ’, ‘নানা ফুল খাএ নারায়ণে’, ‘বুইলোঁ সব সখিজনে’।
‘গণ’ চিহ্নটি এখন শুধু সম্ভ্রমাত্মক শব্দের সাথেই বহুবচন বোঝানোর জন্যে বসে। আমরা বলি : ‘পণ্ডিতগণ’, ‘ছাত্রগণ’, ‘শিক্ষকগণ’। বলি না ‘বইগণ’, ‘পুতুলগণ’। কিন্তু “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ বস্তুবাচক শব্দের সাথে নির্বিচারে বসেছে ‘গণ’। পাওয়া যায় ‘বাদ্যগণ’, ‘তরুগণ’, ‘দুখগণ’, ‘প্রণামগণ’। মধ্যযুগের দ্বিতীয় ভাগে বিভিন্ন কাব্যে পাওয়া যায় ‘হারগণ’, ‘হাণডীগণ’, ‘মেঘ তারাগণ’, ‘গিরিগণ’, ‘মঙ্গলগণ’ প্রভৃতি প্রয়োগ। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর বিখ্যাত ঘটনা হচ্ছে বহুবচন বোঝানোর জন্য ‘রা’-র ব্যবহার। প্রথম ও দ্বিতীয় পুরুষের সর্বনামের বহুবচন বোঝাতে মাত্র তিনবার বড়ু চণ্ডীদাস ‘রা’ প্রয়োগ করেছেন এ-কাব্যে। তাঁর সে-অবিস্মরণীয় প্রয়োগ তিনটি হচ্ছে : ‘আজি হৈতেঁ আহ্মারা হৈলাহোঁ একমতী’, ‘আহ্মারা মরিব শুণিলেঁ কাঁশে’, ও ‘পুছিল তোহ্মারা কেহ্নে তরাসিল মণে’। এখানেই পাই ‘আমরা’, ‘তোমরা’র পূর্বপুরুষ ‘আহ্মারা’, ‘তোহ্মারা’।
‘রা’ জন্ম নেয়। কিন্তু সহজে জয় করতে পারে নি বাঙলা বিশেষ্যকে। পনেরো-ষোলো শতক পর্যন্ত ‘রা’ কাজ ক’রে চলে সর্বনামের বহুবচন চিহ্নরূপেই। তারপর শুরু হয় এর জয়ের যুগ। বসতে শুরু করে বিশেষ্যের সাথে। কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন, ‘বন্দ্যবংশে জন্ম স্বামী বাপেরা ঘোষাল।’ কবি বিপ্রদাস লিখেছেন, ‘কুমারেরা রড়ারড়ি যাএ’; কবি রূপরাম লিখেছেন, ‘যুবতীরা কয়’। এভাবে বেড়ে চলে ‘রা’র রাজ্য।
বহু বোঝাতে ‘গুলো’ এখন আমরা ব্যবহার করি খুব। এটা কয়েক বছর আগেও ছিলো, এমনকি এখনো কারো কারো মুখে, ‘গুলি’। এটি মধ্যযুগ থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে বাঙলায়। তখন এর রূপ ছিলো ‘গুলা’। ষোলো শতকে এর জন্ম। কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন, ‘ঘরগুলা করে দলমল।’ কবি রূপরাম লিখেছেন,’সন্ধ্যাবেলা সিদ্ধিগুলি কে দিবেক বেটে।’ ‘গুলা’, ‘গুলি’ এখন চলতি বাঙলায় ‘গুলো’।
চলতি বাঙলায় একটি জটিল বহুবচন চিহ্ন হচ্ছে ‘দের’। কর্তা নয় এমন বিশেষ্যপদে এটি বসে। আমরা বলতে পারি ‘মেয়েরা এলো’। বলতে পারি না ‘মেয়েদের এলো’—এটা ভুল। কিন্তু বলতে পারি ‘আমি মেয়েদের দেখেছি’। বলতে পারি না ‘আমি মেয়েরাকে দেখেছি’; এটা ভুল। ‘রা’ (আর ‘এরা’) বসে কর্তাপদে। ‘দের’ বসে কর্তা নয় এমন পদে। তবে আরো একটি ‘দের’ আছে বাঙলায়। এবং জটিলতা সেখানেই। ‘আমাদের বাগান’, আর ‘তোমাদের ফুল’-এ ‘দের’ সম্বন্ধ বোঝাচ্ছে। বহুবচনের ‘দের’, আর সম্বন্ধের ‘দের’ কি একই ‘দের’?
বহুবচনের ‘দের’-এর কথায় আসি। সাধুভাষায় এটি ছিলো কখনো ‘দিগ’কখনো ‘দিগের’। সাধুভাষায় পাওয়া যায় “তোমাদিগকে’, ‘তোমাদিগের’। এই ‘দিগ’ নাকি এসেছে সংস্কৃত ‘আদি’ থেকে। দ্বিজ মাধব লিখেছেন, ‘বরুণ পবন শত্রু দুর্বাসাদি।’ কৃত্তিবাস লিখেছেন, “তাহাদিগে ধরিআঁ আনহ মোর ঠাঁই।’ মাণিকরাম লিখেছেন, ‘আমাদিকে সঙ্গে করা।’ ফারসিতে একটি শব্দ আছে ‘দিগর’, যার অর্থ ‘অন্য, আরো’। কেউকেউ মনে করেন ‘দিগ’-এর জন্মে ফারসি ‘দিগর’-এর ভূমিকা আছে। কবি কেতকাদাস, সতেরো শতকে, তাঁর “মনসামঙ্গল”-এ লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণের গরু রাখে বসুয়া দিগর।’