বহিরাগত বিতাড়ন আইন
বিনা পাসপোরট ও ভিসায় সার্বভৌম বিহার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রবেশ করার অপরাধে শ্রী রাজনারায়ণ নামক জনৈক ভারতীয় সংসদ সদস্যকে বহিরাগত বিতাড়ন আইন মোতাবেক বিহার থেকে সম্প্রতি বহিষ্কার করা হয়েছে। ভারতে প্রগতিশীল গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার যে অলিখিত বহিরাগত বিতাড়ন আইন প্রবর্তন করেছেন, বিহারের গফুর সরকারই সর্বপ্রথম তার প্রয়োগ করে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
বহিরাগত বিতাড়ন আইনের ১২(ক) ধারায় স্পষ্টতই এই উল্লেখ আছে যে, সার্বভৌম প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক কোনও রাষ্ট্রে প্রবেশকারী কোনও বহিরাগতের কাছে যদি পাসপোরট এবং ভিসা না থাকে তবে তাঁকে উক্ত রাজ্যে অনধিকার প্রবেশের অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য করা হবে।’ প্রগতিশীল গণতন্ত্র বাঁচাও কমিটির জনৈক মুখপাত্র জানালেন। ‘বিহারের গফুর সরকার যে-রকম তৎপরতার সঙ্গে এই অলিখিত বহিরাগত বিতাড়ন আইন শ্রী রাজনারায়ণ নামক জনৈক বহিরাগত সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছেন, তাতে প্রগতিশীল গণতন্ত্র বাঁচাও কমিটির পক্ষ থেকে গফুর মন্ত্রিসভাকে প্রগতিশীল গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁদের তৎপরতার জন্য বিশেষভাবে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে।’
জনৈক প্রগতিশীল সংবিধান বিশারদের মতে শ্রী রাজনারায়ণকে মাত্র বিহার সীমান্ত পার করে মোগলসরাইতে ছেড়ে দিয়ে আসাটা ঠিক হয়নি। বহিরাগত শ্রী রাজনারায়ণ বিনা পাসপোরট ও ভিসায় বিহারে প্রবেশ করে প্রগতিশীল গণতন্ত্রের পক্ষে যেমন বিপদস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাতে তাঁর আরও কঠোর সাজা হওয়া উচিত ছিল।
উক্ত প্রগতিশীল সংবিধান বিশারদ বলেন, ‘প্রগতিশীল গণতন্ত্রবাদী সোভিয়েত রুশিয়া হলে শ্রী রাজনারায়ণকে তাঁর এই গর্হিত অপরাধ স্খালনের জন্য কমপক্ষে কুড়ি বছর দাস-শ্রম শিবিরে বাস করিতে হত। তবে তাঁর পক্ষে একাগ্রচিত্তে প্রগতিশীল গণতন্ত্রের মহিমা উপলব্ধি করা সম্ভব হত। শ্রী রাজনারায়ণকে মোগলসরাইতে বহিষ্কার করার মতো এমন একটা লঘু দণ্ড দিয়ে প্রথমত অলিখিত বহিরাগত বিতাড়ন আইনের গুরুত্বকে লঘু করে দেওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয়ত শ্রী রাজনারায়ণকে শোধরাবার সুযোগ না দিয়ে প্রগতিশীল গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে জন বিরোধী মনোবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়াই হয়েছে।’
বহিরাগত সংসদ সদস্য শ্রী রাজনারায়ণকে বিনা পাসপোরট ও ভিসায় গ্রেফতার করা সত্ত্বেও তাঁকে দাস শ্রমশিবিরে না পাঠিয়ে মোগলসরাইতে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসা হল কেন? এতে কি অলিখিত বহিরাগত বিতাড়ন আইনের ১৭(গ) ধারা লঙ্ঘন করা হল না?
এই প্রশ্নের উত্তরে সার্বভৌম বিহার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র কমিশনার জানান যে, অলিখিত বহিরাগত বিতাড়ন আইন যাঁরা মনোযোগ দিয়ে অনুধাবন করবেন তাঁরা দেখতে পাবেন ৫(৩) ধারায় পরিষ্কার করে একথা বলা আছে যে ১৭(গ) ধারা প্রয়োগ সম্পর্কে বাস্তব অসুবিধা দেখা দিলে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রশাসক মণ্ডলী প্রথম অপরাধীর ক্ষেত্রে গণবিবেক অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে তাই করা হয়েছে, কারণ ১৭(গ) ধারা প্রয়োগে কয়েকটি বাস্তব অসুবিধা দেখা দিয়েছিল।
শ্রী রাজনারায়ণের ক্ষেত্রে বহিরাগত বিতাড়ন আইনের ১৭(গ) ধারা প্রয়োগে বাস্তব অসুবিধা কী দেখা গিয়েছিল?’
সার্বভৌম বিহার প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র কমিশনার বলেন, ‘প্রগতিশীল গণতন্ত্র রক্ষাকল্পে জনবিরোধী শক্তির মোকাবিলা করার জন্য আমরা একশ পাঁচটি শুদ্ধি শিবির এবং বারটি চির বিশ্রাম নিকেতন প্রতিষ্ঠার যে প্রকল্প গ্রহণ করেছি, বর্তমানে তার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে মাত্র। এই বিষয়ে আমরা বিভিন্ন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দেশ থেকে আনীত নকশা পরীক্ষা করে দেখেছি। মুশকিল হয়েছে এই যে, চির বিশ্রাম নিকেতন এবং শুদ্ধি শিবিরের যে-কটা ডিজাইন আমাদের বিশেষজ্ঞদের পছন্দ হয়েছে তার সব কটাই শীতপ্রধান দেশের উপযোগী। আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াবার জন্য ওই সব ডিজাইনের পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন এবং এর জন্য সময় দরকার। তারপর চির বিশ্রাম শিবিরের জন্য প্রয়োজনীয় স্থান নির্বাচনও একটা প্রধান সমস্যা। তবে আপনাদের এই আশ্বাস দিতে পারি যে, আমরা যেভাবে এগিয়ে চলেছি তাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনের উপযুক্ত চির বিশ্রাম নিকেতন এবং শুদ্ধি শিবিরে প্রগতিশীল গণতন্ত্রের পক্ষে অবাঞ্ছিত এবং বহিরাগত ব্যক্তিদের পুরে ফেলে অলিখিত বহিরাগত বিতাড়ন আইনের ১৭(গ) ধারার মর্যাদা পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারব।
‘যাক, আশ্বস্ত হওয়া গেল। ভারতে গণতন্ত্রের যা নমুনা আমরা দেখেছি তাতে আমাদের আশঙ্কা হয়েছিল চির বিশ্রাম নিকেতন তৈরি হতে হতে বুঝি জন্ম ‘কাবার হয়ে যাবে।’
‘আপনারা ভুল করছেন।’ প্রগতিশীল গণতন্ত্র বাঁচাও কমিটির মুখপাত্র বললেন, ‘ভারতে যে গণতন্ত্র এতদিন আপনারা দেখেছেন, তা হচ্ছে বুর্জোয়া গণতন্ত্র। একেবারে ওয়ার্থলেস। আর আমরা যে গণতন্ত্র আনছি তা হচ্ছে প্রগতিশীল গণতন্ত্র। দুটো একেবারে আলাদা জিনিস।’
‘আরে মশাই, বুরজোয়া গণতন্ত্রেও গণতন্ত্র আছে। প্রগতিশীল গণতন্ত্রেও গণতন্ত্র আছে। উনিশ আর বিশ।’
প্রগতিশীল গণতন্ত্র বাঁচাও কমিটির মুখপাত্র বললেন, ‘আপনার বিচারে তো তাহলে চিনি আর দারচিনিতেও মাত্র উনিশ বিশ তফাৎ। কেননা দারচিনিতেও তো চিনি আছে। আমাদের প্রগতিশীল গণতন্ত্র ওই আপনাদের দারচিনির মত। নাম শুনে চিনি চিনি মনে হবে বটে তবে দুটো জিনিষে একেবারে আকাশ পাতাল তফাৎ। আমাদের প্রগতিশীল গণতন্ত্রে সরকার বিরোধী মাত্রেই বহিরাগত। বাছাধনরা যাবে কোথায়? আজ আমরা তেমন তৈরি নেই তাই শুধু বিহার থেকে বার করে মোগলসরাইতে ছেড়েছি। কিন্তু গোটা দেশে যখন প্রগতিশীল গণতন্ত্র কায়েম হবে, তখন?’
‘ও বুঝেছি, তখন বহিরাগত বিতাড়ন আইন অনুসারে আবার মোগলসরাইতেই তাঁকে ধরবেন। কেমন?’
‘এতক্ষণে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন দেখছি।’
‘আর ততদিনেও যদি চির বিশ্রাম নিকেতন কি শুদ্ধি শিবির তৈরি না হয়ে ওঠে, তবে—’
‘তবে তাঁকে বহিরাগত বিতাড়ন আইনে মোগলসরাইতে ধরব আর বিকানীরে গিয়ে ছাড়ব। তারপর—’
‘তারপর তাঁকে আবার বহিরাগত বিতাড়ন আইনে বিকানীরে ধরবেন—’
‘আর কামরূপ কামাখ্যায় গিয়ে ছাড়ব—’
বহিরাগত বিতাড়ন আইন এ ৫৩
‘বাঃ! বাঃ! তারপর তাঁকে আবার বহিরাগত বিতাড়ন আইনে—’
‘ধরব আর একেবারে চির বিশ্রাম নিকেতনে পুরে দেব।’
‘সত্যি, একেবারে ফুল প্রুফ। প্রগতিশীল গণতন্ত্র অমর রহে। অলিখিত বহিরাগত আইন জিন্দাবাদ।’
১০ এপ্রিল ১৯৭৪