বহরমপুরের বাঁশিওয়ালা

বহরমপুরের বাঁশিওয়ালা 

পরদিন ভোরবেলা বহরমপুর থানার চারপাশে বস্তিবাসী জমা হতে থাকল। গত রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া এক কিশোরের লাশ নিয়ে বস্তিবাসীরা থানার সামনে এগোতে শুরু করল। কয়েকজন মহিলা লাশটাকে জড়িয়ে ধরে আহাজারি করছে। তাদের দাবি এই কিশোর একটা সামান্য চায়ের দোকান চালায়। সে নিরপরাধ। এই নিরপরাধ একটা ছেলেকে পুলিশ কেন গুলি করবে? উপস্থিত সবার মুখে বিচার চাই বিচার কর বললেও সবার চাহনি ছিল আক্রোশের। তারা বিচার না, প্রতিশোধ নিতে এসেছে। সবার হাতেই দা, কিরিচ, কাস্তে, বাঁশ, ইট। 

ভোরবেলা থানায় ওসি সাহেবের থাকার কথা না। সেকেন্ড অফিসার সাজ্জাদ ছিলেন। তিনি তাড়াতাড়ি থানার সদর দরজা বন্ধ করে দিতে বললেন। ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। দুজন পুলিশকে কাস্তে দিয়ে কুপিয়ে জখম করে ফেলেছে দুইজন বস্তিবাসী। সাজ্জাদ তাড়াতাড়ি ওসি সাহেবকে ফোন দিলেন। ফোন রাখতে রাখতেই উত্তেজিত জনতা থানায় আগুন ধরিয়ে দিল। দাউ দাউ করে থানার ভেতরে জ্বলতে লাগল আগুন। 

ওসি থানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতেই তিনজন পুলিশ পুড়ে মারা গেল। বন্দুক লুট হয়ে গেল তিনটা। সেই বন্দুক দিয়ে কয়েকজন এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। থানার সামনে বেশ কিছু গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। তার ভেতরে একটা কালো টয়োটাও ছিল। উপস্থিত বস্তিবাসী ক্ষুধার্ত রাক্ষসের মত গাড়িগুলো ভাঙতে শুরু করল। আগুন ধরিয়ে দিল কয়েকটাতে। কালো টয়োটাটা মুহূর্তের ভেতরে হলুদ আগুনের লেলিহান শিখায় ঢেকে গেল। গাড়িটার ভেতর থেকে কাউকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল না। 

মতিনগরসহ আশেপাশের থানা থেকে পুলিশ আসতে আসতেই থানার অর্ধেকটা আগুনের গ্রাসে চলে গেল। ক্ষিপ্ত জনতার সামনে ফায়ার ব্রিগেড আসতে সাহস করল না। পরে পুলিশের পেটোয়া বাহিনী এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করল। বেধড়ক পিটিয়ে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পরেও পরিস্থিতি আরও বিগড়ে গেল। বাধ্য হয়ে জলকামান নিয়ে আসা হল। 

দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল বহরমপুর জুড়ে। বস্তি থেকে দলে দলে মানুষ বের হয়ে আসতে লাগল। বেশির ভাগই জানে না কেন তারা দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ছে, শুধু মাত্র সামনের মানুষটাকে দেখে পেছনের মানুষটাও নেমে পড়ছে রাস্তায়। 

দুপুরের ভেতরে বহরমপুর হয়ে গেল নরক গুলজার। 

***

মেরিলিনা বসে বসে টিভিতে দাঙ্গা দেখছিল। উন্মত্ত জনতা ভাঙা গাড়ির ওপরে চড়ে চিৎকার করছে। কমবয়সী কিছু ছেলে গাড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে প্রসাব করছে। অনেকে পুলিশের লাশ মোড়ে মোড়ে টাঙ্গিয়ে রাখছে। পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া ব্যাটন আর হেলমেট পরে ঘুরছে অনেকে। এরই মধ্যে শহরের প্রধান প্রধান মোড়ে লাগানো মাইকে খড় খড় করে একটা কণ্ঠ শোনা গেল, “প্রিয় শহরবাসী, আসো। শহরটাকে পাপ মুক্ত করি। এই সরকার তোমাদের কাছ থেকে যে টাকা নেয়, যে টাকা দিয়ে পুলিশ বাহিনী পোষা হয়, সেই পুলিশ বাহিনীই আজ ফ্রাঙ্কেন্সটাইনের মত তোমাদের ওপরেই গুলি চালাচ্ছে। সরকার শাসন করার জন্য কর আদায় করে না, সরকার কর আদায় করে তোমাদেরকে শোষণ করার জন্য। আজ রাতে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র দেখানো হবে। তার করা পাপগুলো সবাই দেখতে পাবে। আবার বলছি, পাপের কারণ বিনাশ করাই সব থেকে বড় প্রায়শ্চিত্ত।” বস্তি থেকে দলে দলে লোকজন এসে সুপারশপে হামলা করতে শুরু করল। এক ঘণ্টার ভেতরে পুলিশ পিছু হাঁটতে শুরু করল। জলকামানের গাড়িগুলোতে জ্বলতে লাগল লাল রঙের আগুন। রক্ষা পেল না সংবাদকর্মীদের গাড়িগুলোও। 

ফিরোজ টিভি বন্ধ করে দিলেন। এটা বশিরের কণ্ঠ। শহরটাকে বাঁচাতে হলে খুব দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। তার আগে মেরিলিনার সাথে কিছু কথা বলতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। ফিরোজ মেরিলিনার দিকে এগিয়ে গেলেন। মেরিলিনার সামনে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল তার। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই মেয়েটা তার বাবার লাশ দেখতে পাবে। যেই মানুষটাকে সে খুঁজতে এসেছিল, সেই মানুষটার লাশ দেখতে তার কেমন লাগবে? বশিরের মৃত্যুটা এমনভাবে করতে হবে যাতে মনে হয় তাকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এতে যদি মেয়েটা কিছুটা সান্ত্বনা পায়। 

“মেরিলিনা” ফিরোজ বললেন। 

“বলেন।” 

“আজ সন্ধ্যায় আমার সাথে একটু বেরোতে হবে।” 

“কোথায়?” 

“একটা জায়গায়। একজনের সাথে দেখা করতে হবে। তিনি জানেন তোমার বাবা কোথায় আছেন। 

ইচ্ছে করেই মিথ্যা বলতে হল ফিরোজ সাহেবকে। কারণ, অবস্থা কখন যে কি হয়, বলা মুশকিল। আগে থেকে মেয়েটাকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে চান না তিনি। তিনি বললেন, “তুমি প্রস্তুত হয়ে থেকো। কেমন?” 

মেরিলিনা মাথা নাড়ল। ফিরোজের একবার ইচ্ছা করল বলেন, এই যে মাইকে কণ্ঠটা শুনলে এটা তোমার বাবার কণ্ঠ। তোমার বাবা এই শহরটাকে, এই দেশটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে চান। তোমার বাবাকে আমরা বাধ্য হয়ে খুন করতে যাচ্ছি। 

ফিরোজের ফোন বাজতে শুরু করল। প্রধানমন্ত্রীর কল। ফিরোজ কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ঝাঁঝালো কণ্ঠ, “ফিরোজ, লোকটা কি বলছে দেখেছ?” 

“দেখেছি। শুনেওছি। তীলক আপনাকে অপারেশানের ডিটেইলস দিয়েছে না?” 

“হ্যা। জন্তুটাকে লাখাতে লাখাতে আমার পায়ের কাছে এনে ফেলবা।”

“আমরা সন্ধ্যার দিকে অপারেশন শুরু করব। চিন্তা করবেন না।” লাইনটা কেটে গেল। তীলক একটু আগে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, সন্ধ্যার ভেতরে অবস্থার পরিবর্তন না হলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। আর ঠিক সন্ধ্যা ছয়টার সময় শুরু হবে অপারেশন ফুলস্টপ। 

মেরিলিনাকে প্রস্তুত হতে বলে ফিরোজ নিজের রুমে গেলেন। দেয়ালের সাথের ওয়ারড্রোবটা সরিয়ে দেয়ালের ভেতর থেকে একটা ড্রয়ার খুললেন। আজ থেকে বিশ বছর আগে ব্যবহার করা এম-৪ কার্বাইনটা ঠিকঠাক করতে শুরু করলেন। বশির জামান একা নন। তার সাথে তার তিনটা পোষা কুকুর আছে। এত সহজ হবে না আজকের অপারেশনটা। ফিরোজ ভাবলেন, যদি ফিরে আসতে পারেন, তাহলে মেরিলিনাকে ঈশ্বর বাগচীর কাছে দিয়ে দেবেন। সেখানেই মেরিলিনা ভালো থাকবে। তা না হলে তফিসুল বারী মেরিলিনাকে ছেড়ে দেবেন না। মেরিলিনা বাঁচবে না। 

কার্বাইন আর রিভলভারটা খাটের ওপরে রেখে ফিরোজ অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলেন। সকাল এগারোটা বাজে। একটু পরে তীলকের ওখানে গিয়ে প্লাটুনের সবাইকে পরিকল্পনাটা বুঝিয়ে দিতে হবে। তারপর ঈশ্বর বাগচীর ওখানে একটু যেতে হবে। মেরিলিনার কথাটা বাগচীকে আগে থেকেই বলে যেতে চান ফিরোজ। কে জানে, যদি আর ফিরে আসা না হয়? 

ঘড়ির কাঁটা অবুঝের মত ডান দিকেই ঘুরতে লাগল। রাজধানী থেকে বহরমপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। সূর্যটাও ঢলে পড়তে লাগল পশ্চিমে। আজকের দিনটা যেন অনেক বেশি ছোট। যেন সন্ধ্যার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে ঘড়িটা। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *